৩য় অধ্যায় – রাখালিয়া বাঁশি : জিউশ বা ইহুদীয় ধর্মীয় সংগীত
ভূমিকা
জিউশ বা ইহুদীয় ধর্মীয় সংগীত প্রভূত বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং বহু বছরের পুরোনো সংস্কৃতির ধারক বাহক। মাঝে মাঝে এর অবতারণা ধর্মীয় সংগীতরূপে, মাঝে মাঝে সম্পূর্ণ তা থেকে আলাদা। এর সুর, সংগীতমূর্ছনা এবং রচনা (composition) যুগে যুগে বৈচিত্র্যের ছাপ রেখেছে ইতিহাসে। জিউশ ধর্মীয় সংগীতের ইতিহাস একই সঙ্গে উপাসনা বা প্রার্থনাসংগীত, লোকসংগীত ও আধুনিক চার্চসংগীতের রদবদলকে মূল্যায়িত করে।১ পুরাতনী উপাসনাসংগীত বস্তুত জেরুজালেমের ‘প্রার্থনা-কক্ষের সংগীত’ থেকে অভিন্ন। ‘মিসনা’ (Mishna) অনুসারে, চিরাচরিত ‘প্রার্থনা-কক্ষের সংগীত’-এর (Temple orchestra) অর্কেস্ট্রায় ১২টি বাদ্যযন্ত্রের বহুল ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায় যা ১২জন গায়কের একটি দল পরিদর্শন করত।২
বেশ কিছু অতিরিক্ত বাদ্যযন্ত্র যা প্রাচীন হিব্রু সংগীতের আধার অথচ সেগুলি কিন্তু এই temple orchestra-য় ব্যবহৃত হতো না। এর মধ্যে ‘উগাব’৩, যা প্রাচীন চার্চে ব্যবহৃত অর্গ্যান জাতীয় বাদ্যযন্ত্র, এই বিশেষ প্রার্থনা সংগীতে অভাবিতভাবে ব্রাত্য থেকেছে।
পরবর্তীকালে এই পবিত্র জিউশ ‘প্রার্থনা বাক্য’-গুলি এবং—অর্ধেক ইহুদি রাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ধবংস হলে—ধর্মীয় সংগীতাচরণ ইহুদি সংস্কৃতি থেকে এক প্রকার বন্ধ করে দেওয়া হয়। আরও পরে অবশ্য এটি, ‘পিউতিম’ (Piyyutim-ইহুদি কাব্যরূপ)-এর হাত ধরে আবার মূলস্রোতে ফিরে আসে। এই ‘পিউতিম’-ই ইহুদি সংগীতকে ভবিষ্যতে আরও নতুন মোকাম৪ জোগায়। টেম্পল অর্কেস্ট্রাতেও এই প্রাচীন হিব্রুকাব্যরূপের প্রভাব দেখা যায় যা ‘পিউতিম’-র রচয়িতা নিজেই বেছে থাকেন। একই সঙ্গে লোকসংগীত ও চারণসংগীত একে আরও উৎকর্ষ দান করেছে। এভাবেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জিউশ বা ইহুদি ধর্মীয়সংগীত বিবর্তিত হয়েছে উন্নতির চরম শিখরে।
সমসাময়িক ইতিহাস
বিংশ শতাব্দীতে জিউশ ধর্মীয়সংগীতের ব্যাপ্তি ও বৈচিত্র্য চোখে পড়বার মতো। বিংশ শতাব্দীতে এই ধর্মীয়সংগীতের মহার্ঘতা Sholmo Carlebach-এর ‘Nigunim’ থেকে Devbie Friedman-এর Jewish feminst folk পর্যন্ত বিস্তৃত। বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ Velvel Pasternak এই শতাব্দীতে জিউশ ধর্মীয় সংগীতের সংরক্ষণ ও তার কালবিবর্তনের এক বিশাল স্বাক্ষর রেখেছেন।৫ এছাড়াও এই শতাব্দীতেই ‘Mordeehai Ben david’, ‘Abraham Fried’ এবং জিউশ ধর্মীয় ব্যান্ড মিউজিক যেমন—‘Yigal Salik’-এর ‘London Pirchei’ যথেষ্ট জনপ্রিয়তা লাভ করে।
এক্কেবারে সাম্প্রতিককালে ‘রেগে’ আর্টিস্ট ‘Mati Syahu’ জিউশ’ Shepherdic song’ বা ‘মেষ পালকের গীতি’-র নতুন ‘Neo-rege’৬ ভার্শান বার করেন। এছাড়াও এক সম্ভ্রান্ত গোঁড়া চার্চসংগীতের দল ধর্মীয় ভাবধারা, ইহুদি সংস্কৃতি নিয়ে সুর রচনা শুরু করেছে যেটি মূলত ইংরেজি ও হিব্রুতে লেখা। খ্রিস্টীয় ধর্মীয়- সংগীতের পূর্বব্যবহার (ethnic treatment) এই ধর্মে বহুলাংশে দেখা যায়। জেরুজালেমের পবিত্র মন্দিরগুলিই বস্তুত এই ধর্মীয় সংগীতের পীঠস্থান। উপাসনাগৃহে বা ধর্মীয় নির্দেশিত স্থানগুলিতে ইহুদিদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ তালমুদ-এর শ্লোক (chants) বা ইহুদিদের ধর্মীয় সংগীত পরিবেশিত হয়ে থাকে।৭
পবিত্র তালমুদ অনুসারে বিখ্যাত ইহুদি সাধক জাসুয়া বিন হানানিয়া বা হানিয়া, যিনি কিনা পবিত্র ‘লেভি’র বংশধর ও ইহুদি যাজকশ্রেণির চারণকবিদের অন্যতম, ইহুদিদের সুর্নিদিষ্টভাবে পথ নির্দেশ করেছেন কীভাবে সমবেত ইহুদি সংগীতকারেরা ইহুদিদের মঙ্গলার্থে পবিত্রস্থানে জড়ো হয়ে সংগীতসাধনা করেছেন (তালমুদ, সুক 53 এ)। রাখালিয়া সংগীত বা Shepherdic song এই ধর্মের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। স্প্যানিশ জিউশদের এই সংগীত মধ্যযুগীয় স্পেনে যথেষ্ট সমৃদ্ধ হয় ও পরবর্তীকালে রাজসভাতেও তা পরিবেশিত হয়।
ইহুদি কিংবদন্তী অনুযায়ী বীরবালক ডেভিড ও নিষ্ঠুর সেনাধ্যক্ষ গালিয়াথের যুদ্ধ এবং সেই কিংবদন্তীজাত রচনাই এই সংগীতের মূল সম্পদ। ডেভিড নিজেও মেষপালক ছিলেন ও ভালো গান গাইতে পারতেন।৮ পরবর্তীকালে এই সংগীত স্পেন, মরক্কো, আর্জেন্টিনা, তুরস্ক ও গ্রিসে জনপ্রিয়তা লাভ করে।
মূলত আনন্দ, বীরগাথা, প্রেমরস সংগীত (love Song) ও আধ্যাত্মিকতা—এই বিশেষ সংগীতের ধারণ। বহু ভাষায় এই ধর্মীয় সংগীতের চর্চা হলেও মূলত হিব্রু ও লাতিনই এর ভাষারূপে সর্বজনবিদিত।
প্রকারভেদ
ইহুদিদের ধর্মীয় সংগীত যুগ যুগ ধরে নানান রূপে, নানান ছন্দে-বর্ণে-শব্দে বিস্তার লাভ করেছে। এর বিশেষ বিভাগগুলি নিয়ে নীচে আলোচনা করা হল :
১. পিয়ুট (Piyyut)
‘পিয়ুত’ বা ‘পাইয়ুট’ একটি বিশেষ ধরনের জিউশ সংগীতের সাংগীতিক কাব্যরূপ, যা তৈরি হয়ে থাকে মূলত গাইবার জন্যই। এই জাতীয় গানকে ‘পিয়ুতিম’ (Piyyutm) বলা হয় যা মিসন্যায়িক (Mishnaic Period) যুগ থেকে চলে আসছে। এগুলি বেশির ভাগ হিব্রু বা অ্যারামাইক৯ (Aramaic) ভাষায় লিখিত। পরবর্তীকালে এই পিয়ুটগুলো সর্বসাধারণের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করে। যেমন—আদেথ ওলাম (Adon Olam বা Master of the world) ইহুদি ধর্মীয় সংগীতে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে রেখেছে।
২. জেমিরত (Zemirot)
‘জেমিরত’ মূলত ইহুদি মন্ত্র যা হিব্রু ভাষায় গাওয়া হয়ে থাকে। মাঝে মাঝে Yiddish বা Ladino ভাষাতেও এই বিশেষ ধর্মীয় সংগীতের ব্যাপ্তি লক্ষণীয় যা বিশেষত ‘সাবাথ’ বা অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হয়। তালমুদ-এর পবিত্র অংশ থেকে জেমিরত গাওয়া হয়ে থাকে।১০
৩. নিগুন (Nigun)
এটি একটি বিশেষ ধরনের সমবেত বা গোষ্ঠীগত ধর্মীয় সংগীতচর্চার রূপবিশেষ। এই পর্যায়ের সংগীতে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার উল্লেখ্য। মাঝে মাঝে বাইবেল কিংবা সনাতনি ইহুদীয় রচনাগুলি থেকে নিগুনের ব্যাপ্তিসাধন ঘটে।
পরবর্তীকালে নিগুণের দ্রুত পরিবর্তন ও উন্নতিসাধন একে আরও ব্যতিক্রমী করে তোলে। এই ব্যতিক্রমী অংশটি ‘হাসিদিয়’ (Hasidism) ভাবধর্মাচরণেও বিদ্যমান। ‘হাসিদিজম’-এ (Hasidism)১১ এই গানগুলি ইহুদিদের ‘রাবিব’ বা ‘প্রধানরাজা’-রা রচনা করেন। এতে ‘দেভেস’ (Deveks) বা ঈশ্বরের সঙ্গে কথোপকথন নামে বিশেষ সাংগীতিক রূপ পাওয়া যায় যা ব্যক্তিবিশেষের ধ্যানগর্ভের বা ভাবসমাধির পক্ষে আদর্শ। হাসিদিজমের প্রবক্তা মহান ‘বাল সেম থব’ (Baal Shem Tov) এই ‘নিগুণ’-গুলিকে১২ ঐশ্বরিক শক্তির আধার ও পরম- করুণাময়ের আশ্রয়রূপে ব্যাখ্যা করেন।
পিয়ুট, জেমিরত, নিগুণ ছাড়াও এই ধর্মীয়সংগীতের আরও কয়েকটি প্রকারভেদ যেমন—পিজমোনিন (Pizmonin) ও ‘বকাসত’ (Baqashot) উল্লেখযোগ্য। এই দুটি ধর্মীয় সাংগীতিক রূপই প্রাচীন ইহুদি লোকসংগীতের আধার।
এই সব ক-টি ইহুদি ধর্মীয় সংগীতের মূলখণ্ডচিত্র ও বাইবেল অনুপ্রাণিত। এই সংগীতের অধিকাংশ রচনাই বাইবেল, তালমুদ ও তানাঘ অন্তর্ভুক্ত অথবা প্রাচীন ইহুদি কবিদের (যেমন ইহুদা হালেভি ও ইস্রায়েল নাজারা) রচনা থেকে সংগৃহীত।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে আজও এগুলির চর্চা পুরোদমে চলেছে ও ধর্মীয় ইহুদি সংগীতের এই অসাধারণ বিবর্তন কালক্রমে প্রাচ্যের গণ্ডী টপকিয়ে পাশ্চাত্যেও সমানভাবে প্রভাব ফেলেছে।
জেরুজালেমের এই প্রাচীন ধর্মীয় সাংগীতিক রূপ রাখালিয়া সুরের হাত ধরে আজ সমগ্র বিশ্বে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছে এবং প্রার্থনাসংগীতের জগতে গড়ে তুলেছে এক তুমুল আন্দোলন যা মরক্কো, তিউনিশিয়া, আলজিরিয়া, ইজরায়েল, গ্রিস, যুগোশ্লাভিয়া, মিশর ও অন্যান্য দেশেও সমান প্রভাব বিস্তার করেছে।১৩ আজও সেই ‘রাখালিয়া বাঁশি’ সর্বত্র ভেসে বেড়ায়—জেরুজালেম থেকে মহাপৃথিবীর পথে।
অন্যান্য সাংগীতিক প্রভাব
বাইবেলের সময় থেকেই নৃত্য, গীত ও বাদ্য জিউশ বা ইহুদিধর্মে এক গভীর প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়েছিল। স্বতন্ত্র কিছু আঞ্চলিক ও লোকসংগীতের বর্ণময় ভূমিকা ইহুদি ধর্মীয় সংগীতকে রঙিন করে তোলে।
এর মধ্যে বিশেষ উল্লেখনীয় কিছু সংগীত নিয়ে আলোচনা করলে দেখা যাবে ইহুদিধর্মে সংগীতের বিবর্তন কীভাবে কালানুসারে সমৃদ্ধ হয়েছে। এই বিশেষ সাংগীতিক রূপগুলিকে বাদ দিলে ইহুদি ধর্মীয়সংগীতের আখ্যান অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে বলে মনে হয় :
১. ইজরায়েলি সংগীত
শাস্ত্রীয় ও আধুনিক ইজরায়েলি সংগীত সেইসব কতিপয় সাংগীতিক রূপ যা ইহুদিধর্মে বিশেষ প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়েছিল। এর ধর্ম ও ধর্মীয় সাংগীতিক ভূমিকা (Religious music culture) এতটাই অসীম যে একে ইহুদি ধর্মীয়- সংগীতের Central Sun বললেও অত্যুক্তি হয় না। বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পূর্ণ এই ইজরায়েলি সংগীত প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সংগীতের এক বিস্ময়কর যোগসূত্র। এই সংগীতের সাংগীতিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে হাসাদীয় সংগীত১৪ (Hasadic song), এশিয়ান ও অ্যারাবিক পপ, রক, ফোক-এর আশেপাশে ইয়েমেনাইট সংগীত (Yemenite Music), হিপ হপ ও হেভি মেটালেরও নিদর্শন পাওয়া যায়।
অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে জিওনিস্ট আন্দোলনের (Zionist movement) পৃষ্ঠপোষকরূপে লেখা হয়েছিল জনপ্রিয় লোকসংগীত। প্রথম দিকে এইসব সংগীতের সুর ও যন্ত্রানুষঙ্গ জার্মান, রুশ ও সনাতনি ইহুদি লোকসংগীতের অনুসরণে হিব্রুভাষায় লেখা হত।১৫ বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ইজরায়েলি সংগীতকারেরা হিব্রুভাষা, সংস্কৃতি ও সাংগীতিক প্রয়োগের এক বিশাল পরিবর্তন আনেন। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত ইজরায়েলি সংগীতজ্ঞ ও সমালোচক মিনাশি রাভিনা (Menashe Ravina) ইজরায়েলি ও হিব্রু সংগীতের এই তুমুল বিবর্তনকে ‘ইহুদি ধর্মীয়সংগীতের রেনেসাঁ’ বলে ব্যাখ্যা করেন।
এরপর নানান রাজনৈতিক যুব আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন ও কিবুজ১৬ আন্দোলন (Kibbutz Movement) এই আঞ্চলিক সংগীতের আরও উন্নতি- সাধন করে। জিওনিস্ট মুভমেন্টের বিশেষ কিছু নজিরবিহীন বৈশিষ্ট্য এই সময় উঠে আসে ইজরায়েলি সংগীতে। এখনও ইহুদি ধর্মীয় সংগীতে এই ইজরায়েলীয় প্রভাব (impact of israel) বিদ্যমান। চিরস্মরণীয় হয়ে আছে প্রাচীন হিব্রু ভাষা, ধর্মীয় সংস্কৃতি ও সংগীতের সেই অভাবনীয় উন্নয়ন যা ইজরায়েলি সংগীতকে অমরত্ব দান করেছে।
২. ক্লেজমার (Klezmer)
আনুমানিক ষোড়শ শতাব্দীতে ইহুদি ধর্মীয় সংগীতের আসরে স্বতন্ত্র সংগীতের প্রভাব বিশেষরূপে পরিলক্ষিত হয় ক্লেজমেরিম (Klezmerim) সংগীতকারদের সংগীতে, যা মূলত পূর্ব ইউরাপের ‘আসকেনাজি জিউশ’১৭ (Askhenazi jews) সম্প্রদায়ভুক্ত। তারা ধর্মীয় ভাবধারাকে পুনরায় তাদের সংগীতের মাধ্যমে—যা কিনা হিব্রু ফোক, রক ও মেটাল মিউজিকের ধারার অর্ন্তগত—উন্নতির শিখরে নিয়ে আসে। মূলত প্রাচীন হিব্রু বীরগাথা, লোকসংগীত ও জাতীয়তাবাদের মন্ত্রে দীক্ষিত এই সংগীতকে ‘ক্লেজমীয় সংস্কৃতি’-র (Klezmian cultave) পীঠস্থানরূপে ব্যাখ্যা করা হয়।১৮ এছাড়াও নানান উৎসব ও দৈবসাধন সংগীতকে এখানে নতুনরূপে ধর্মীয় সাংগীতিক জীবনের অন্তর্ভুক্ত করার সফল চেষ্টা হয়েছে। এই সংগীতকারেরা প্রকৃত অর্থে ঈডিশ সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন ও ইহুদি ধর্মীয় সংগীতকে এনেছিলেন ভক্তিমার্গে।
৩. মীজরাহী (Mizrahi)
মিজরাহী সংগীতকে বস্তুত ইহুদি ধর্মীয় সংগীতের নতুন ধারারূপে চিহ্নিত করা হয়। এই বিশেষ ইজরায়েলি সংগীতটির ধারা ইজরায়েলি লোকসংগীত ও আরবিয় বিশেষত মেডিটেরেনিয়ান সংগীতের এক অপূর্ব সংমিশ্রণ। চিরায়ত মিজরাহী সংগীতের রূপ উঠে আসে ইহুদি চারণকবিদের১৯ ধর্মীয় ভাবধারায়। এই বিশেষ সংগীতে মূলত বেহালা বা তারের যন্ত্রের একচ্ছত্র আধিপত্য বর্তমান। এছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যীয় যন্ত্রসংগীতের প্রভাবও বিশেষ লক্ষণীয়। এটি উচ্চস্বরে গাওয়া ও বাজানো হয়ে থাকে যা আধুনিক ইহুদি ও ইজরায়েলি সংগীতে বিশেষ জনপ্রিয়।
৪. রাখালিয়া সংগীত বা ল্যাডিনো (Ladino)
রাখালিয়া সংগীত বা ল্যাডিনো গীতি শেফার্ডিক জিউশদের আত্মার স্বর। এটি মধ্যযুগীয় স্পেনে২০ জাত ও পরবর্তীকালে নানান ইহুদি অঞ্চলে স্বীকৃতি পায়। পূর্বে উল্লেখিত ইহুদি ধর্মীয় সংগীতের সমসাময়িক ইতিহাস পর্বে এর বিস্তারিত আলোচনা দ্রষ্টব্য।
এত স্বল্প আলোচনায় জিউশ বা ইহুদি ধর্মীয় সংগীতের মাহাত্ম্য বোঝানো অসম্ভব। বাইবেলের সময় থেকে শুরু করে আধুনিক যুগ পর্যন্ত বিস্তৃত এই ধর্মীয় সংগীতের ইতিহাসে বার বার ঘটেছে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সংগীতের মেলবন্ধন। বিখ্যাত আইরিশ সংগীতকার মরিস র্যাভেল বেহালা ও পিয়ানোতে রচনা করেন ‘Kaddisch’২১ যা সনাতনি ইহুদি উপাসনাসংগীতের আধুনিকীকরণ। বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বিখ্যাত রুশ কম্পোজার সের্জেই প্রকোফিৎ লিখেছিলেন Hebrew Melodies যা ইহুদি লোকসংগীতের পিয়ানো ও ক্ল্যারিয়োনেটের আখ্যান। এরকম উদাহরণ আরও অনেক, অপরিমিত, অগণিত।
যুগযুগ ধরে হিব্রু ভাষাভাষীদের এই প্রাচীন ধর্মীয় সংগীত মানবসভ্যতার ইতিহাসের এমন এক অনন্যসাধারণ অধ্যায়, যা শুধুমাত্র দেশ-কাল বা ধর্মীয়করণের নিরিখে ভাগ করা অকল্পনীয়। বিশ্বধর্মীয় সংগীতের আসরে এক স্বতন্ত্র স্থান চিরকালের জন্য বাঁধা রয়ে গেছে সবার অলক্ষে জেরুজালেমের রুক্ষ মেঠো পথে, প্রাচীন মন্দির বা উপাসনাকক্ষের সংগীত, সমুদ্রের গল্প কিংবা রাখালিয়া বাঁশি-র মেঠো সুরে—আমাদেরই স্বপ্নে ও জাগরণে।
***
৩য় অধ্যায়
রাখালিয়া বাঁশি : জিউশ বা ইহুদীয় ধর্মীয় সংগীত
১. Michael Brenner and Jeremiah Riemer (2010), A short history of the Jews, Princeton University press, 978-0765759665, p. 47
২. Ronald H. Isaacs (1997), Jewish Music : Its History, people and song, Jeson Anonson ; 978-0765759665, p. 47
৩. Ibid, p. 53
৪. Ibid, p. 118
৫. Velvel Pastenak (2003) ; the Jewish music companion, Tara publication ; 978-1928918240 ; p.9
৬. Ibid, p. 64
৭. Norman Solomon (2009), The Talmud : A selection, Penguin classics, 978-0141441788, p. 132
৮. Ibid, p. 261
৯. Semanuel Rubin (2006) ; Music in Jewish history and culture ; Hermione Park press, 978-089901336, p. 42
১০. Ibid, p. 74
১১. Abraham Z, Idelsohn (1992), Jewish Music : Its historical development, Dover press, 978-0486271477, p. 69
১২. Ibid, p. 77
১৩. Brad statson (2008) ; Jewish sacred music and Jewish identity, Paragon house, 978–1557788726, p. 212
১৪. Peter Gradenwitz (1996), The Music of Israel : From the biblical era to modern times, Amadeus press, 978-1574670127, p. 39
১৫. Ibid, p. 234
১৬. Paul Bohlman (1988) ; The study of folk music in Modern world, Indiana university press, p. 118
১৭. Seth Rogovoy (2000) ; The Essential Klezmer ; Algonquin books, 978–1565122444, p. 25
১৮. Ibid, p. 71
১৯. Ilan Stavans (2005), The Schocken book of modern Sephardic literature, Schocken ; 978-0805242287, p. 220
২০. Ibid, p. 165
২১. Philip V. Bohlman (2009) ; Jewish musical modernism : old and real, university of Chicago press, 978-02260063863, p. 185