১০ম অধ্যায় – তমসো মা জ্যোতির্গময়ঃ : সনাতনি হিন্দু ধর্মীয় সংগীত

১০ম অধ্যায় – তমসো মা জ্যোতির্গময়ঃ : সনাতনি হিন্দু ধর্মীয় সংগীত

প্রাককথন

বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন ও মহান ধর্মীয় দার্শনিক ভাবধারা হল হিন্দুধর্ম। সিন্ধুসভ্যতার অববাহিকায় লালিতপালিত বলে ‘সিন্ধু’-র অপভ্রংশরূপে এটি ‘হিন্দু’-রূপে পরিচিত। প্রাচীন পণ্ডিতদের মতানুসারে আর্যদের ভারতে আগমনের আগেই সিন্ধু উপত্যকায় এক সুসভ্য জাতি বসবাস করত যারা আর্যদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজ অপেক্ষাও উন্নত ছিল। বর্বর, যুদ্ধবাজ জার্মানরা যেমন ৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোম সাম্রাজ্যকে পরাভূত করেছিল, স্যার জন মার্শালের মতে আর্যগণও সেইভাবে ১৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিন্ধু উপত্যকায় প্রভুত্ব বিস্তার করে। একই সঙ্গে বিস্তার ঘটে তাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি, সামাজিক রীতিনীতি ও ধর্মীয় ভাবাদর্শের। আনুমানিক এই সময়েই হিন্দুধর্মের সূচনা। অনেকে মনে করেন প্রাচীন সভ্যজাতির মতো সিন্ধুবাসীরাও সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নাগরিকজীবন নির্বাহ করত। তারা কৃষি-শিল্প-বাণিজ্যে অভ্যস্ত ছিল। তামা-পিতলের যুগে থেকেও তারা যথেষ্ট উন্নতি করে। তাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে জড়িত একটি ‘বিশেষ’ ধর্ম ও চিত্রলিপির আভাস পাওয়া যায়। তাদের চিত্রলিপিতে যে অন্যান্য লিখিত উপকরণ পাওয়া গেছে সেগুলি আজও পাঠ করা যায়নি। কিন্তু অন্যান্য পরীক্ষা থেকে জানা গেছে, এই সিন্ধু সভ্যতা আসুর এবং ক্যালডিয়ান (Chaldean) সভ্যতার সমসাময়িক এবং এদের মধ্যে বিশেষ ধর্মীয় ভাবধারা বিদ্যমান ছিল—যেখানে লিঙ্গ ও অন্যান্য রকমের দেবচিত্র ও দেবমূর্তি পূজিত হত। এখানেই হিন্দুধর্মের সারাৎসার সন্নিহিত রয়েছে।

জৈমিনির মতে (৩০০ খ্রিস্টাব্দ) আর্যদের প্রাচীন সাহিত্য বেদ দু-ভাগে বিভক্ত—মন্ত্র ও ব্রাহ্মণ। মন্ত্রের সংকলন সংহিতা নামে পরিচিত। বেদ-এর চারটি অংশ ঋক, সাম, যজুঃ ও অথর্ব। অর্থবের নিজস্ব মন্ত্র বা সংহিতা আছে যা আজও একাধিক পাওয়া যায়। বহুযুগ ধরে ব্রাহ্মণগণ এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও ধর্মকে লিপিবদ্ধ না-করে কণ্ঠস্থ করে রাখতেন। বহু প্রাচীন সভ্যতা ও ধর্মেও এই রীতি দেখা যায়। সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে তাঁরা প্রচণ্ড পরিশ্রমের দ্বারা বেদের ছন্দ, ব্যাকরণ, উচ্চারণ ও সুরকে সুললিত সংগীতের মাধ্যমে কণ্ঠস্থ করেই সুরক্ষিত রেখেছিলেন এবং তা এককথায় অসাধারণ।

সিন্ধুসভ্যতার প্রচুর পুথি, ভাস্কর্য ও চিত্রশিল্পে প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত ও বাদ্যযন্ত্রের উদাহরণ মেলে। উদাহরণ পাওয়া যায় ঋগবেদ, সামবেদ ও উপনিষদ-এর প্রাচীন মন্ত্রোচ্চারণে। প্রাচীন ভারতে সংগীত ও বাদ্যযন্ত্রের এই অসাধারণ বিদ্যাভাস বহুযুগ ধরেই চলে আসছে। হিন্দুধর্মের প্রাচীন সংগীতকোষ সংগীত রত্নাকর-এর হিন্দুধর্মের নানান বিখ্যাত সংগীতাচার্যদের নাম পাওয়া যায়। বিশাখিল, দত্তিল, কম্বল, বায়ু, বিশ্ববসু, রম্ভা, অর্জুন, নারদ, হনুমান প্রমুখ সংগীতগুরু এবং লোল্লট, উদ্ভট, অভিনব গুপ্ত কীর্তিধর প্রমুখ সেই সময়কার সাংগীতিক ব্যাখ্যাকারদের নাম উল্লেখনীয়।

মূলত কোনো বিশেষ যুগ, সময় বা কাল দ্বারা হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় এবং ধর্মীয় সংগীতকে চিহ্নিত করা দুঃসাধ্য। সামবেদ-কেই হিন্দুধর্মের প্রাথমিক সাংগীতিক উৎসস্থলরূপে ধরা যেতে পারে। পুরাণ অনুসারে প্রজাপতি ব্রহ্মা থেকেই বেদ-এর উৎপত্তি। মতান্তরে মহাদেব তাঁর পঞ্চমুখ থেকে পাঁচটি এবং পাবর্তীর মুখ থেকে একটি রাগের সৃষ্টি করেন। ব্রহ্মা এই বিশেষ রাগগুলিকে ছয় ঋতু অনুসারে ভাগ করেন। যেমন—গ্রীষ্মে দীপক, বর্ষায় মেঘ, শরতে ভৈরব, হেমন্তে শ্রী, শীতে মালকোষ ও বসন্তে হিন্দোল। পুরাণ অনুসারে এই সকল রাগেরই একটি করে স্ত্রী বর্তমান এবং এখান থেকেই ছত্রিশ রাগিণীর উৎপত্তি। দেবর্ষি নারদ বিরচিত সংগীত শাস্ত্রকল্প -এও এর প্রসঙ্গ উল্লেখিত আছে।

হিন্দু সংগীতের বা হিন্দুধর্মীয় সংগীতের প্রধান রূপকল্প হিসেবে ধরা যেতে পারে কবি জয়দেব বিরচিত গীতগোবিন্দ-কে। হিন্দুস্থানী মার্গ বা ধর্মীয় সংগীতে এই গ্রন্থের ভূমিকা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। রাধাকৃষ্ণলীলারসে সমৃদ্ধ এই কাব্যগ্রন্থটির বহু কবিতা গানের আকারে পরিবেশিত হয় এবং এর অধিকাংশগুলিই বহু প্রাচীন রাগ, রস ও তানাশ্রিত। ৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে বোগদাদের বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ ও দার্শনিক হারুন-অল রশীদ এই সংগীতকে এক ভিন্নমাত্রা প্রদান করেন। চতুর্দশ শতাব্দীর প্রারম্ভে খ্রিস্টাব্দে সুলতান আলাউদ্দীন খলজীর সময় রাজদরবারের সীমা অতিক্রম করে হিন্দুস্থানী মার্গসংগীতের প্রভূত প্রসার ও ব্যাপ্তি ঘটে। এই সময়ে বিখ্যাত গায়ক বৈজু বাওরা (জন্মসাল নিয়ে মতান্তর) সংস্কৃত ও পালিভাষার ধ্রুব, প্রবন্ধ ও ছন্দের অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটিয়ে ধ্রুপদ সৃষ্টি করেন। আনুমানিক একই সময়ে দাক্ষিণাত্যের বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ নায়ক গোপাল উত্তর ভারতে এসে এই বিশেষ ধর্মীয় সংগীতের প্রকৃত রূপদান করেন যার মধ্যে সংগীতাচার্য হরিদাস স্বামী ও বিখ্যাত গায়ক তানসেন-এর অবদানও চিরউল্লেখনীয়।

দিল্লির পাঠান সম্রাট আলাউদ্দীন খলজীর সময় দরবারি সংগীতের প্রচলন ও বিস্তার। তাঁর সবান্ধব নিমন্ত্রণেই বিখ্যাত সংগীতসাধক আমির খসরু পারস্য থেকে ভারতে আসেন। ইনি মূলত সুফি সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন। এঁর রচিত বহু গান ও কবিতায় গুজরাতি, ফারসি, সংস্কৃত, মৈথিলী ও পারসিক ভাষা ও সুরের সমন্বয় লক্ষ করা যায়। এঁর বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ফারসি সুর যেমন—সাজগিরী, ইয়ামন, ওসাক, মাফেক, জিলাফা ইত্যাদি বিখ্যাত। এঁর গায়কি অঙ্গ ছিল পারস্য সুফিদের পদ্ধতিতে। বীণা, তবলা জাতীয় বহুবিধ বাদ্যযন্ত্রও তিনি আবিষ্কার করেন যা পরবর্তীকালে হিন্দুস্থানী সংগীতকে আরও সমৃদ্ধ করে তোলে। এছাড়া তানসেন পরবর্তীযুগে ষোড়শ শতাব্দীতে গোয়ালিয়রের মহারাজা মান হিন্দুস্থানী সংগীতের পুনর্জন্ম ঘটান। কর্নেল ডেভিড ক্যানিংহ্যামের Archaeological report of Gwalior-এ হিন্দু সংগীতের এই মহান পৃষ্ঠপোষক রাজা-সৃষ্ট নানান বিচিত্র রাগরাগিণীর উল্লেখ পাওয়া যায়।

একই সঙ্গে সনাতনি হিন্দু ধর্মীয়সংগীতের নানান লোকাচারেও সংগীত যুগ যুগ ধরে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে। এতে ঘন্টাধবনি, শঙ্খধবনি, নাকাড়া, উলুধবনি, হাততালি, গালবাদ্য, গুবগুবা, খঞ্জনি ও ডম্বরুনিনাদ উল্লেখনীয়। হিন্দু ধর্মীয় সংগীত১০ মূলত অন্যান্য ধর্মের মতোই স্বধর্ম অর্থাৎ হিন্দুধর্ম অনুসরণকারী। এই বিশেষ ধর্মীয় সংগীতে হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সংগীত, কর্নাটকী, উত্তর ভারতীয় শাস্ত্রীয়গীতি, কীর্তন, ভজন, অঙ্গীরা, ভাওয়াই, টুসু, দরবেশী, বাউল ইত্যাদির উল্লেখ পাওয়া যায়। সপ্তদশ শতাব্দীতে ভক্তি আন্দোলনের পথ ধরে এই ধর্মীয় সংগীতের বিশাল অভ্যুত্থান ঘটে, যা নিয়ে পরবর্তী অংশে আলোচনা করা হল।

ভক্তি আন্দোলন

দ্বাদশ শতকের প্রথম ভাগে ভারতবর্ষে মুসলিম আধিপত্য সনাতনি ভারতীয় সংস্কৃতির উপর প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। হিন্দুধর্ম এ সময়ে প্রচণ্ড ধাক্কা খায়, ব্রাহ্মণ ও পুরোহিতদের প্রভাব প্রতিপত্তি ক্ষুণ্ণ হয় এবং বহু হিন্দু ও বৌদ্ধ মঠ-মন্দির ধবংসপ্রাপ্ত হয়। হিন্দু রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতা থেকে ভারতীয় সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সংগীত বঞ্চিত হয় এবং সেই সঙ্গে শিল্পকলার অগ্রগতি কিছু সময়ের জন্য রুদ্ধ হয়ে পড়ে। ভারতে ইসলামের প্রতিষ্ঠার বহু পূর্বেই পারসিক, শক, কুষান, হুন বিভিন্ন জাতি বিভিন্ন সময়ে ভারতে বসবাস ও রাজ্যস্থাপন করেছিল। কালক্রমে তারা ভারতীয় ধর্ম, ভাষা ও সামাজিক আচরণে বিলীন হয়ে যায়। তুর্কি আক্রমণকারীদের১১ ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম দেখা যায়। তুর্কিরা তাদের সঙ্গে এক সুনির্দিষ্ট ধর্ম, সামাজিক আচার অনুষ্ঠান, ধর্মীয় সংগীত, সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়েই এদেশে আসে। প্রথম দিকে রাজনৈতিক মতবিরোধের সাথে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সামাজিক ও ধর্মীয় সংঘর্ষও ঘটেছিল। ধর্মীয় সংঘাতের মূল কারণ ছিল হিন্দু ও ইসলামধর্মের মৌলিক পার্থক্য। এই পার্থক্য উভয় ধর্মের মিলনের পথে বাধা সৃষ্টি করে। হিন্দুধর্মের বর্ণাশ্রম ও ইসলামের গণতান্ত্রিক আদর্শের মধ্যে মতবিরোধ ছিল। ইসলামধর্মের ধর্মীয় সংস্কৃতির প্রভাবে প্রথমদিকে হিন্দুসমাজে রক্ষণশীলতা বৃদ্ধি পায়। সামাজিক বৈষম্য ও অত্যাচারের ফলে বহু হিন্দু, মুসলমানি ধর্মের গণতান্ত্রিক আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং অচিরেই ইসলামধর্মে দীক্ষিত হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই ধর্মান্তরিকরণ ছিল স্বেচ্ছাপ্রণোদিত, তরবারির সাহায্যে নয়। অবশ্য সে-সময় যে জোর করে ধর্মান্তরিকরণ হয়নি তা বলা হাস্যকর। সেই সময় ইসলামি আগ্রাসন থেকে হিন্দুধর্ম ও সমাজকে রক্ষার্থে হিন্দুসমাজের আচার-আচরণ ও রীতিনীতি কঠোর করা হয়।

যাই হোক, এভাবে দীর্ঘকাল ধরে পাশাপাশি বসবাস করার ফলে ভারতীয় ও ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতির মধ্যে এক নিবিড় যোগসূত্র স্থাপিত হলেও উভয়ের মৌলিক সত্তা অক্ষুণ্ণ থাকে। ভারতীয়দের গভীর ধর্মীয় বিশ্বাস ও সাহিত্য, শিল্প, স্থাপত্যের সঙ্গে মুসলমানদের ধ্যানধারণার সংমিশ্রণে এক সমৃদ্ধ সংস্কৃতি শেষপর্যন্ত গড়ে ওঠে, যা সামগ্রিকভাবে ভারতীয় সংস্কৃতি১২ বলে পরিচিতি লাভ করে। ধর্মীয়, বিজ্ঞান, সামাজিক ও রাজনৈতিক আচার-আচরণ, শিল্প, স্থাপত্য, সাহিত্য এবং বিশেষ করে সংগীতের ক্ষেত্রে এই সমন্বয় ঘটে। হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে মৌলিক ধর্মীয় ও সামাজিক পার্থক্য থাকলেও দুই ধর্মের বেশ কিছু সংস্কারক উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে যোগসূত্র ও সমন্বয়ের প্রয়োজন অনুভব করেন। চতুর্দশ শতকে মহারাষ্ট্র, গুজরাত, পঞ্জাব ও বাংলার বিভিন্ন ধর্মাচার্যরা দুই প্রধান ধর্মেরই কিছু কিছু রীতিনীতি বিসর্জন দিয়ে ধর্মকে আরও বেশি মানবতাবাদী করে তুলতে প্রয়াসী হন। ইসলামের সংস্পর্শে একদিকে যেমন হিন্দুসমাজের রক্ষণশীলতা বেড়ে যায়, তেমনি অন্যদিকে ইসলামের গণতান্ত্রিক আদর্শের প্রভাবে হিন্দুধর্মে ‘ভক্তিবাদ’১৩ বা উদারনৈতিক আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। মুসলমানদের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ‘সুফিবাদ’ যার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। ভক্তিবাদের আদর্শ অতিপ্রাচীন। হিন্দুধর্মে আত্মার মুক্তির জন্য তিনটি বিশেষ গুণের কথা বলা হয়েছে, যেমন—’জ্ঞান’, ‘কর্ম’ ও ‘ভক্তি’।১৪ ভক্তিবাদের মূলকথা হল আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার অতীন্দ্রিয় মিলন। ভক্তিবাদে মূলত বর্ণাশ্রম ছিল না। ভক্তিবাদের নানান প্রচারকরা খ্রিস্টীয় সপ্তম থেকে দ্বাদশ ও চতুর্দশ শতকের প্রেক্ষাপটে এই মতবাদের প্রচার চালান। ধর্মীয় আচার-আচরণের বিরোধী ছিলেন এই ‘ভক্তি’ ও ‘সুফিবাদীরা। ঈশ্বরের প্রতি অচলাভক্তিকে এঁরা পরমধর্ম বলে মনে করেন। এই বিশেষ ক্ষেত্রেই ধর্মীয় সংগীতের উত্থান ঘটে হিন্দুধর্মে।

এই বিশেষ রূপান্তরের সময়ে গোটা ভারতবর্ষজুড়ে ধর্মীয় মত-ভাবনার স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ধর্মীয় সংগীতের প্রবল জোয়ার ওঠে। এই দিক থেকে বিচার করলে ভক্তি বা সুফিবাদকে এক ধর্মীয় সাংগীতিক আন্দোলন বলা হলে তা ভুল হয় না। ভক্তিবাদের প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে সেই সময় রচিত নানান ধর্মীয় সংগীত, দোঁহা, পদ, কীর্তন ইত্যাদি সমকালীন ভারতীয় সমাজের উপর প্রচণ্ড প্রভাব ফেলেছিল। ভক্তি শব্দের অর্থ ভজনা১৫ (Devotion) অর্থাৎ ঈশ্বরের নামগান। এর মূল কথা হল অন্তরের পবিত্রতা, ঈশ্বরের প্রতি ঐকান্তিক ভক্তি, সৎকর্ম, সদাচারণ, জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলন ও এক ঈশ্বরে বিশ্বাস।

ভক্তি আন্দোলনের উৎপত্তি দক্ষিণ ভারতে হলেও পরে তা উত্তর ভারতে প্রসারিত হয়। ভক্তি আন্দোলনের মূল প্রবক্তারা হলেন কবির, রামানন্দ, নামদেব, শ্রীচৈতন্য, মীরাবাই প্রমুখ। এঁরা সকলেই ধর্মীয় বিভেদ ভুলে মানবতাবাদের সমন্বয়ের কথা প্রচার করেন। এঁদের প্রত্যেকের সময়েই ধর্মীয় সংগীতের মহাজাগরণ ঘটে এবং সেখানে ভক্তিকেই ধর্মীয় উপাসনার পন্থারূপে গ্রহণ করা হয়। নানান সময়ে রচিত নানান ভজন, কীর্তন, পদ, দোঁহা ভারতের ধর্মীয় সাংগীতিক কাঠামোকে সমৃদ্ধ করে।

১. রামানন্দ

সুলতানি আমলে ভক্তিবাদকে কেন্দ্র করে ভারতে যে ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের জোয়ার দেখা যায় তার অন্যতম প্রধান প্রচারক ছিলেন ভক্তিবাদের প্রথম প্রবক্তা রামানুজের শিষ্য রামানন্দ।১৬ ইনিই প্রথম উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের মধ্যে ভক্তিবাদের সেতু রচনা করেন। ‘শ্রীরামচন্দ্রই ঈশ্বর’ এবং ‘তাঁর প্রতি অবিচল ভক্তিই মানুষকে মুক্তির পথ দেখাবে’—এই ছিল রামানন্দের বাণী। রামানন্দ জাতিভেদ, ধর্মীয় আড়ম্বর ও বর্ণবৈষম্য মানতেন না। রামানন্দ নিজে নানান ভক্তিমূলক পদ, আখ্যান ও সংগীত রচনা করে গেছেন যা আজও দক্ষিণ ভারতে বিশেষভাবে সমাদৃত।

২. কবির

মধ্যযুগের ভারতে ভক্তি আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সাধক হলেন কবির। ইনি রামানন্দের শিষ্য এবং প্রথম এঁর চিন্তাধারায় হিন্দু ভক্তিবাদ ও মুসলিম সুফিবাদের মেলবন্ধনের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। মধ্যযুগীয় ভারতীয় ধর্মপ্রচারকদের মধ্যে ইনিই সর্বপ্রথম হিন্দু ও মুসলমানদের মিলনের আহ্বান জানান। কবির এই দুই ধর্মের কোনোটারই বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠান মানতেন না। জাতিভেদ, মূর্তিপূজা ও নমাজ পড়ার তীব্র বিরোধী ছিলেন কবির। রামানুজের প্রধান এই ভাবশিষ্য মনে করতেন ঈশ্বর এক ও অভিন্ন যাঁকে শুধুমাত্র অন্তরের ভক্তি ও অনুরাগের১৭ মাধ্যমে লাভ করা যায়। গুরুর মতোই ইনিও তাঁর বাণী বা উপদেশগুলি দেহাতি হিন্দিতে ছোটো ছোটো কবিতা বা ‘দোঁহা’-র মাধ্যমে প্রচার করেন যার মধ্য দিয়ে তিনি সহজ-সরল সাংগীতিক উপস্থাপনার (ভজন) মাধ্যমে মানবজীবনদর্শন ও ঈশ্বরীয় সাধনার নানান জটিল তত্ত্বকে অত্যন্ত সহজ ও সুন্দরভাবে প্রকাশ করেছেন।

৩. নানক

ভক্তি আন্দোলনের অন্যতম প্রধান প্রবক্তা হলেন শিখধর্মের প্রবর্তক গুরু নানক। কবিরের মতো ইনিও একেশ্বরে বিশ্বাসী ছিলেন। ধর্মের জটিল আচার থেকে মুক্ত হয়ে প্রেম ও ভক্তির মাধ্যমে ভগবানের কাছে আত্মসমর্পণই ছিল তাঁর মূলবাণী। মূলত কোনো নতুন ধর্মস্থাপনের বাসনা নানকের ছিল না। হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে সামাজিক সম্প্রীতি স্থাপনই ছিল তাঁর জীবনের ব্রত। এঁর শিষ্যরা ‘শিখ’১৮ নামে পরিচিত যার অর্থ ‘শিষ্য’ বা ‘অনুগামী’। তাঁর নানান উপদেশ গুরুগ্রন্থ সাহেব গ্রন্থে সংকলিত ও তাঁর রচিত নানান ভজন, কীর্তন বিখ্যাত যা গুরুমুখী বা প্রাচীন পঞ্জাবিভাষায় গোটা ভারতে সমাদৃত।

৪. নামদেব

খ্রিস্টীয় চর্তুদশ শতকের প্রথমদিকে মারাঠি-ভক্তিবাদী সন্ত নামদেব মহারাষ্ট্রের ও পশ্চিম ভারতের নানান স্থানে ভক্তি আন্দোলনের প্রচার করেন। ইনিও অন্য সবার মতো একেশ্বরবাদী এবং মূর্তিপূজা ও ধর্মের বাহ্যিক অনুষ্ঠানের ঘোর বিরোধী ছিলেন। এঁর ধর্মমতের মূল কথা ছিল অন্তরের শুচিতা, ঈশ্বরে ঐকান্তিক ভক্তি ও ‘হরি’-র গুণকীর্তন। হিন্দু-মুসলমানের মৈত্রীস্থাপনে বিশ্বাসী সন্ত নামদেব মারাঠি ভাষায় বহু কবিতা, পদ ও ভজন রচনা করে গেছেন।

৫. বল্লভাচার্য

ভক্তিবাদের আরেক পুরোধা হলেন স্বামী বল্লভাচার্য।১৯ ইনি কৃষ্ণের উপাসক এবং অন্যান্য ধর্মগুরুদের মতো ইনিও জাতপাত, ধর্মবৈষম্য, জাতিভেদের তীব্র বিরোধী ছিলেন এবং তাঁর সময়ে তিনিও নানান কীর্তন ও পদের রচনা করেন যা আজও উত্তর ভারতে সাধারণ লোকের মধ্যে বিখ্যাত।

৬. শ্রীচৈতন্যদেব

কবির, নানক ও নামদেবের আন্দোলন ছাড়াও উত্তর-পূর্ব ভারতে বিশেষত অবিভক্ত বঙ্গদেশে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলাকে কেন্দ্র করে ভক্তিবাদের তথা বৈষ্ণব ধর্মের বিকাশ হয়, যার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রচারক ছিলেন শ্রীচৈতন্যদেব।২০ শ্রীচৈতন্য বিশ্বাস করতেন যে নামগানের মধ্য দিয়ে অর্থাৎ পবিত্র সাংগীতিক সাধনার মধ্য দিয়ে ঈশ্বরলাভ সম্ভব। নগর সংকীর্তনের মাধ্যমে শ্রীচৈতন্য ও তাঁর ভক্তরা বৈষ্ণবধর্মের প্রচার করেন। তাঁর নেতৃত্বেই সে-সময় ধর্মীয়-সংগীত ও তার প্রকৃত মূল্যায়নের নবজাগরণ ঘটে। শ্রীচৈতন্যর মূলকথা ছিল—বৈরাগ্য, জীবে দয়া ও ঈশ্বরের প্রতি ঐকান্তিক প্রেম। তিনি অহিংসাকে পরমধর্মরূপে গ্রহণ করেন এবং ধর্মীয় সাংগীতিক বাতাবরণের মাধ্যমে জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের সমানাধিকারের বাণী প্রচার করেন।

৭. শংকরাচার্য

এই একই সময়ে অসমে ভক্তিবাদের সঙ্গে সঙ্গে তন্ত্রবাদের যথেষ্ট প্রচার ঘটে। অসমের ভক্তিবাদ প্রচারকদের মধ্যে শংকরদেব বা শংকরাচার্য প্রধান।২১ তিনি একেশ্বরবাদ এবং হিন্দু সংগীত ও সংস্কৃতির ঐক্যে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর রচিত বহু ভজন-কীর্তন আজও ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে শ্রদ্ধার সঙ্গে গাওয়া হয়ে থাকে।

৮. মীরাবাই

মধ্যযুগের ভক্তি আন্দোলনে এক অবিস্মরণীয় নাম হল মীরাবাই। তিনি একাধারে গায়িকা ও সাধিকা। কৃষ্ণ প্রেমরসে সম্পৃক্ত মীরাবাই২২ সংগীত ও ভজন-কীর্তনের মধ্য দিয়ে অভিষ্ঠকে লাভ করায় বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁকে নিয়ে প্রচুর কিংবদন্তি গড়ে উঠেছে। তাঁর রচিত ভজন বহু রাগাশ্রিত এবং হিন্দুস্থানী ধর্মীয় সংগীতের এক উজ্জ্বল দলিল। আজও তার রচিত পদ ও ভজন গোটা ভারতবর্ষে সমৃদ্ধ।

৯. সুরদাস ও দাদূ

মধ্যযুগের ভক্তি আন্দোলনের দুই খ্যাতনামা সাধক হলেন সুরদাস ও দাদূ। সুরদাস অন্ধ এবং কৃষ্ণভক্ত ছিলেন। তাঁর রচিত ভজন ও পদগুলি কৃষ্ণরস-এ পরিপূর্ণ ও হিন্দি সাহিত্য ও সংগীতের অমূল্য সম্পদ। একই ভাবে অন্য আরেক খ্যাতনামা সাধক দাদু জাতিধর্মবর্ণ ও সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিই যে সাধনার বাধা ও ধর্মের অন্তরায় তা বোঝাবার চেষ্টা করেন।২৩

সুফি আন্দোলন

ভারতে তুর্কিবিজয় ও দিল্লির সুলতানি শাসনের আমলে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় সমাজে আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি এমনকী ধর্মীয় পরিকাঠামোতেও নতুন চেতনার উদ্ভব হয়। বস্তুত মুসলমানসমাজের ধর্মীয় রক্ষণশীলতা, কুসংস্কার ও নৈতিক অধঃপতনের বিরুদ্ধে প্রেম ও ভক্তির এক অভাবনীয় সংমিশ্রণে যে সংস্কারধর্মী নতুন ধর্মীয় মতবাদের বিকাশ ঘটে তাই হল সুফিবাদ।২৪ বিখ্যাত ঐতিহাসিক আববাবির মতানুসারে সুফিবাদ মূলত ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের ব্যক্তিগত অনুভূতির মাধ্যমে আল্লার জীবন সান্নিধ্যকে উপলব্ধি করার মাধ্যম বিশেষ।

অনেকেরই ধারণা সুফি মতবাদ ইসলামের কুক্ষিগত বিষয় নয়। গ্রিক, হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মের দার্শনিক তত্ত্বে ভিত্তি করেই সুফিবাদের সৃষ্টি। এর মতান্তরে বিখ্যাত ইসলামি বিশেষজ্ঞ ড. ইউসুফ হুসেন প্রমুখ মনে করেন—’সুফিবাদ ইসলামের সন্তান, ইসলামের অন্তর থেকেই এর উদ্ভব’। ইসলামের প্রথমপর্বেই এক রহস্যবাদী সম্প্রদায়ের উত্থান হয়। এরপর দশম শতকে ‘মুতাজিলা’ বা ইসলামীয় যুক্তিবাদী দর্শনের বিকল্প হিসেবে মরমিয়াবাদের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ইসলামধর্মের গোঁড়ামির বিরুদ্ধে এই বিভিন্ন মরমিয়া সাধকগণ ঈশ্বরের প্রতি প্রেমের ওপরেই বেশি জোর দেন। গভীর ভক্তিমার্গে এঁদের অবস্থান এবং এঁরা মনে করতেন নিরঙ্কুশ সংগীত-সাহিত্য ধর্ম ও প্রেমই মানুষ ও ঈশ্বরের মিলন সেতু।

সুফি শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে আরবি শব্দ ‘সাফা’ অর্থাৎ ‘পবিত্রতা’ থেকে। ঐতিহাসিকদের মতে এক শ্রেণির বিশেষ ইসলামি সাধকেরা অধিকাংশ সময় পশমের পোশাক (মূলত টুপি) পরতেন বলে এদের সুফি নামে অভিহিত করা হত। এদের জীবনচর্চা ছিল অনাড়ম্বর। সর্ব ধরনের বিষয়াসক্তি থেকে মুক্ত এই সুফিরা সর্বতোভাবে ঈশ্বর সাধনায় নিমগ্ন থাকতেন। বৈরাগ্য, চিত্তশুদ্ধি ও নৈতিকতার উপর এঁরা গুরুত্ব আরোপ করতেন। এঁরা মনে করতেন সংগীতই হল অভিষ্ঠ লাভ করার একমাত্র মাধ্যম। ভক্তি আন্দোলনে জড়িত বাউল ও কীর্তনগোষ্ঠীদের সঙ্গে এঁদের বহুল মিল পরিলক্ষিত হয়।

সুলতানি যুগে ভারতবর্ষে মোট ১২টি সুফি সম্প্রদায় গড়ে উঠেছিল। এই সম্প্রদায়গুলি ‘সিলসিলা’২৫ নামে পরিচিত। সুফী সম্প্রদায়ভুক্ত সাধকগণ ‘পীর’, ‘দরবেশ’ বা ‘ফকির’ নামে পরিচিত ছিলেন। তবে এই বিভিন্ন সুফী সম্প্রদায়ের মধ্যে ভারতবর্ষে যে দুটি সম্প্রদায় সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় ছিল তা হল—’চিশতি’ ও ‘সুরাবর্দী’ সম্প্রদায়।

১. চিশতি সম্প্রদায়

ভারতে ‘চিশতি’ সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বিখ্যাত সুফি সাধক খাজা মইনুদ্দিন চিশতি।২৬ ১১৯২ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ইনি মধ্য এশিয়া (মতান্তরে বাগদাদ) থেকে ভারতে আসেন ও আজমীরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। এঁর শিষ্যদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন—কুতুবউদ্দিন কাফি, নিজামউদ্দিন আউলিয়া ও নাসিরুদ্দিন চিরাগ প্রমুখ। এই শিষ্যদের মধ্যে নিজামুদ্দিন আউলিয়া (১২৩৮ – ১৩২৫ খ্রিস্টাব্দ) সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় ও খ্যাতিমান ছিলেন। খাজা মইনুদ্দিন ও তাঁর শিষ্যরা প্রত্যেকেই ধর্মীয় সাধক ছাড়াও সংগীত সাধকরূপেও বিশেষ পরিচিত ছিলেন। এঁরা সকলেই ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে বহু ধর্মীয় সংগীত, কাওয়ালি, মরসিয়া, দোহা ও নানান বন্দিশ রচনা করে গেছেন যা আজও অমর।২৭ এঁদের ধর্মীয় উদারতা, সাংগীতিক প্রভাব ও সর্বোপরি মানবিকতার জন্য বহু হিন্দু ও মুসলমান এঁদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। আজও পৃথিবীর তথা ভারতের নানান মসজিদ, দরগায় এঁদের রচিত পদ গাওয়া হয়ে থাকে যা ধর্মীয়সংগীতের অন্যতম উজ্জ্বল দলিল।

২. সুরাবর্দী সম্প্রদায়

সুফিদের দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য সম্প্রদায়টি হল ‘সুরাবর্দী’ যা সেই সময় পাঞ্জাব, মূলতান, পেশওয়ার ও বাংলায় যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। এই সম্প্রদায়ের প্রবাদপ্রতিম সাধক ছিলেন ‘সাহাবুদ্দিন সুরাবর্দী’ ও ‘হামিদউদ্দীন নাগরী’। নানান কারণে সুরাবর্দী সম্প্রদায়২৮ ভারতে ততটা প্রসার লাভ করেনি। যদিও ‘চিশতি’ সম্প্রদায়ের মতো এঁদেরও রচিত বহু গান, কাওয়ালি ও দরবেশী সংগীত জনপ্রিয়তা প্রায় তবুও এঁরা ‘চিশতি’দের মতো কঠোর সংযম, আত্মত্যাগ ও অনাড়ম্বর জীবনে বিশ্বাসী ছিলেন না। এঁরা অভিজাতদের সঙ্গে মেলামেশা ও নানান দরবারি কাজকর্মেও অংশ নিতেন।

অন্যান্য সম্প্রদায়

পরবর্তীকালে ভারতে আরও তিনটি সুফি সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। যেমন—’কাদরি’, ‘শাওরী’ ও ‘নকশাবাদী’। এই সকল সম্প্রদায়গুলিই শরিয়ৎ-এর নিয়মবিধি অনুসরণ করত। এমনকী তৎকালীন সংগীতেও এদের প্রভাব লক্ষ করা যায়। প্রতিটি সম্প্রদায়েরই তা সে ‘চিশতি’ অথবা ‘সুরাবর্দী’ হোক অথবা ‘কাদরী’ বা ‘নকশাবাদী’ হিন্দুস্থানী ধর্মীয় সংগীতে অবদান উল্লেখযোগ্য। আধুনিক যুগে বুল্লেহ শাহ, ইদ্রীশ শাহ, মহম্মদ পীর বকশ ও জিয়াউদ্দীন বারানীর মতো প্রমুখ সাধকদের সাংগীতিক অবদান-এ এই সুফিবাদ২৯ আরও গৌরবোজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এঁদের প্রত্যেকের নানান রচনা, কাওয়ালি, গজল আজও ভূ-ভারতে সর্বজনবিদিত।

সুফি ও ভক্তি আন্দোলনের প্রভাব

যদিও সমকালীন যুগে ভারতবর্ষে ধর্মের গোঁড়ামি, ক্ষমতাশীল শাসকগোষ্ঠীর আধিপত্য ও ধর্মীয় সংকীর্ণতা প্রবল আকার ধারণ করেছিল তবুও সুফি বা ভক্তি আন্দোলনের প্রভাব ভারতীয় সংস্কৃতি-সমাজ-সাহিত্য ও সংগীতে বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। এই দুই বিশিষ্ট আন্দোলন ধর্মের গোঁড়ামি, অস্পৃশ্যতা, ব্যাভিচার ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে, অন্যদিকে দুই প্রধান ধর্মের সংস্কৃতি৩০ ও সামাজিক ঐক্য বজায় রাখে। এই দুই আন্দোলনের উদারতা ও মানবিক দৃষ্টিকোণ সর্বস্তরের মানুষকে আকৃষ্ট করে সহজ-সরল জীবনযাত্রায়। এছাড়া এই আন্দোলনগুলি সমাজজীবনে নৈতিকতা, মানবতাবাদ ও একতা গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়।

সাংগীতিক প্রভাব

সমকালীন যুগে এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় আন্দোলন ধর্মীয় সংগীতের উন্নতিকরণের এক নতুন দিশা দেখায়। রামানন্দ, কবির, মীরাবাই-এর রচিত পদ, ভজন হিন্দুস্থানী ধর্মীয় সংগীতের এক গুরুত্বপূর্ণ অবদান। একই সঙ্গে নানক, দাদু, শ্রীচৈতন্য বিরচিত কীর্তন তৎকালীন সমাজে ভক্তিমার্গের জনজোয়ার সৃষ্টি করে।৩১ নামদেব-এর রচনা হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সংগীতকে ধর্মীয় চেতনার এক নতুন রূপ দেয়। একইভাবে সুফি আন্দোলনে খাজা মইনুদ্দিন চিশতি, আমির খসরু, জিয়াউদ্দীন বারানী ও সাহাবুদ্দিনের রচনা, কাওয়ালি, দোঁহা, গজল ও আধ্যাত্মিক গীতি হিন্দুস্থানী ধর্মীয় সংগীতের এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। এই দুই আন্দোলনই তৎকালীন ভারতের ধর্মীয় সংগীতে শাস্ত্রীয় সংগীত, লোকায়ত ও বিদেশি সুরের এক অদ্ভুত এন্দ্রজালিক পৃথিবী রচনা করে যা বিগত পাঁচশো বছরেও অক্ষুণ্ণ। হিন্দুস্থানী ধর্মীয় সংগীতের এক অনন্যসাধারণ এই অধ্যায় চিরকাল ধর্মীয় সংগীতকে ভারতবর্ষের বুকে অমর ও অবিনশ্বর ঘোষণা করে।

ধর্মীয় সংগীত মাধ্যম

হিন্দুস্থানী ধর্মীয় সংগীত মুলত হিন্দুধর্ম অনুপ্রাণিত। অবশ্য হিন্দুস্থানী ধর্মীয় সংগীতকে শুধুমাত্র হিন্দুধর্ম দিয়ে বিশ্লেষণ করা অনুচিত। যুগ যুগ ধরে যে স্থানে ‘শক-হুন-গল, পাঠান, মোগল এক দেহে হলে লীন’ তাকে শুধুমাত্র হিন্দুধর্ম দিয়ে ব্যাখ্যা করলে ভুল করা হবে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জাতি, বিভিন্ন সম্প্রদায় ও বিভিন্ন মাধ্যম এই সাংগীতিক ধারাটিকে অনুপ্রাণিত, অনুশীলিত ও সমৃদ্ধ করেছে। সুফী ও ভক্তিবাদ এই সমৃদ্ধিকে দিয়েছে নতুন মাত্রা। তবু আলোচনার সুবিধার্থে হিন্দুস্থানী ধর্মীয় সংগীতকে হিন্দুস্থানীয় শাস্ত্রীয় সংগীত, কীর্তন, ভজন ও অন্যান্য সাংগীতিক ধর্মে বিভক্ত করা যেতে পারে। ধর্মীয় সংগীতের এই বিশেষ পর্যায়ে আমরা হিন্দুস্থানী ধর্মীয় সংগীতের দুই মুখ্য মাধ্যম ভজন ও কীর্তন নিয়ে আলোচনা করব। জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে গোটা ভারতবর্ষের মানবসম্প্রদায়ের কাছে এই দুটি বিশেষ মাধ্যমের গ্রহণযোগ্যতা অসামান্য ও অপরিহার্য। বিগত পাঁচ শতাব্দীর চেয়েও বেশি সময় ধরে ভারতের লোকসমাজে এর স্থান অকল্পনীয় ও মানবঐক্যতা নিরুপণে আজও কীর্তন ও ভজন-এর বিকল্প কিছু নেই, না-কিছু ছিল বা থাকবে।৩২

১. ভজন

‘ভজন’ মূলত বহু প্রাচীন আধ্যাত্মিক হিন্দু ধর্মীয় সংগীত যা অত্যন্ত সহজ-সরলভাবে ও লোকায়ত সুরমূর্ছনার এক অপূর্ব মেলবন্ধনে পরিবেশিত হয়। বিশেষত এই সংগীতে প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। সনাতনি ভারতীয় সংস্কৃতিতে নানা প্রকার ভজন, যেমন—নির্গুণী, গোরক্ষনাথী, বল্লভপন্থী, অষ্টদান, মধুর-ভক্তি ও দক্ষিণ ভারতীয় সম্প্রাদ্য ভজন৩৩ লক্ষণীয়। এই সকল ভজনই তাদের নিজস্ব চারিত্রিক গুণগত মানে সর্বভারতে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ। ভজন মূলত পরমকরুণাময় ঈশ্বরের লীলাপ্রদর্শনকারী অথবা পরমেশ্বরের প্রতি ভক্তি প্রেমবর্ণনার আধাররূপে পরিচিত। হিন্দুধর্মে ভজন একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। বহুপ্রকারের ভজন হিন্দুধর্মের আরাধ্য নানান দেবদেবীর নামসংকীর্তনে সংযোজনায় সংযোজিত। এই সেই পবিত্র মাধ্যম যেখানে উচ্চারিত হয়—’রসানাম লক্ষণাম ভজনাম’—মাধ্যম যা অন্তরাত্মার সঙ্গে নিকটস্বরূপ। হিন্দুস্থানী ভজনে মূলত ধ্রুপদাঙ্গ, সুফি কাওয়ালি ও হরিদাসী কীর্তন-এর প্রভাব বর্তমান। হিন্দুস্থানী ভজনের কিংবদন্তী রূপকারদের মধ্যে নানক, কবির , মীরাবাই, নরোত্তম দাস, সুরদাস ও তুলসীদাস বিখ্যাত। এঁদের প্রত্যেকের বিরচিত ভজনই দেশ-কাল-সময়ের সীমানা ছাড়িয়ে সর্বজনবিদিত হয়। এঁদের রচনাগুলি আজও হিন্দি সাহিত্যের এক একটি অমূল্য রত্ন প্রায়। এমনকী অ-হিন্দী ভাষাভাষীদের কাছেও এই ভজনগুলি৩৪ সমান জনপ্রিয়। হিন্দি ছাড়াও এই ভজনগুলিতে মৈথিলী, দেবনাগরী ও অন্যান্য উপভাষার প্রভাব লক্ষণীয়। হিন্দুস্থানী ভজনের ইতিহাসে কবিরের ‘চাদারিয়া ঝিনি রে ঝিনি’, মীরাবাই-এর ‘মানে চাকর রাখোজী’, তুলসী দাসের ‘রামচন্দ্র কৃপালু ভজো মন’ ও সুরদাসের ‘দর্শন দো ভগবান’ যুগ যুগ ধরে হিন্দুস্থানী ধর্মীয় সংগীতের আকাশে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের স্বাক্ষর রেখে এসেছে। হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সংগীতের আধারে বিরচিত এই সকল পদগুলি ঈশ্বর ভজনা ও অদ্বৈত প্রেমের শ্বাশ্বত বাণী বহন করে চলেছে। আধুনিক যুগে ডি. ভি পালুস্কর ও পণ্ডিত ভি. এন. ভাতখণ্ডের সাহচর্যে এর প্রভূত বিস্তৃতি ঘটে। আধ্যাত্মিক সাধনার অন্যতম শ্রেষ্ঠ মাধ্যমরূপে আজও ‘ভজন’ ঈশ্বরীয় কৃপালাভের ও মোক্ষ সাধনের অনন্য অসাধারণ রূপকল্প।

২. কীর্তন

সংস্কৃতে ‘কীর্তন’ শব্দের অর্থ ‘পুনরুচ্চারণ’। কীর্তন মূলত অনন্তকে আহ্বান ও তার সাড়া জাগানোর ধর্মীয় সাংগীতিক পদ্ধতিবিশেষ। যখন এই মাধ্যম স্তোত্রাকারে ব্যক্তিবিশেষে ধ্যানের মাধ্যমে উচ্চারিত হয় তখন তাকে ‘জপ’ এবং যখন দলগতভাবে বাদ্যযন্ত্রানুষঙ্গের মাধ্যমে ধবনিত হয় তখন তাকে ‘কীর্তন’ বা ‘সংকীর্তন’ (‘সম’ অর্থাৎ ‘সম্পূর্ণ’) বলা হয়ে থাকে। ভগবদগীতা (৯।১৩)- তে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছেন, পবিত্র ও মহান মানবেরা সর্বদা তাঁর নাম ‘সংকীর্তনে’র মাধ্যমে মোক্ষলাভের পথ খুঁজে ফেরেন। হিন্দু ধর্মীয় সংগীতের ইতিহাসে পঞ্চদশ শতাব্দীতে ভক্তি আন্দোলনে বাংলায় শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ও অন্যান্য বিখ্যাত সাধকেরা ‘কীর্তন’-এর৩৫ জনপ্রিয়তা ঘটান। এই বিশেষ সময়ে তামাম উত্তর-পূর্ব ভারত ভজনের পাশাপশি হরিনাম সংকীর্তন বা ‘কীর্তন’-এর প্রভাবে ভাবাবেগে উদবেল ও আলোড়িত হয়। ‘কীর্তন’ মূলত প্রাচীন সংস্কৃত ও ব্রজবুলি রচনা থেকে সংগৃহীত এবং পুনঃরচিত হয়ে থাকে এবং হারমোনিয়াম, শ্রীখোল, মৃদঙ্গ ও পাখোয়াজ, খঞ্জনী ও করতালির মাধ্যমে পরিবেশিত হয়। পরবর্তীকালে কীর্তন বৈষ্ণবধর্ম ছাড়াও, শিখ ধর্ম, বাউল সহজিয়া ও বৌদ্ধ ধর্মের কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে সম্প্রসারিত হয়ে পড়ে যা গোটা ভারত জুড়ে ধর্মীয় সাংগীতিক আন্দোলনের অন্যতম মূল পৃষ্ঠপোষকরূপে পরিগণিত হয়। নিম্ললিখিত এই ক্ষেত্রবিশেষগুলি নিয়ে সবিস্তারে আলোচনা করা হল :

চৈতন্য-বৈষ্ণব ধারা

পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে বঙ্গদেশে ভক্তি আন্দোলনের ঢেউ এসে পড়ে। ভারতের অন্যান্য বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের মতোই সেই সময় এই বঙ্গদেশে ভক্তি আন্দোলনের পথ ধরে এক মহৎ সংগীত সাধনার ব্যাপ্তি ঘটে থাকে যার পুরোভাগে ছিলেন গৌড়ীয় বৈষ্ণব সাধক শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু। সেই যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সমাজ-সংস্কারক ও ধর্মীয় সাধক শ্রীচৈতন্য সর্বপ্রথম গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধারার শ্রীকৃষ্ণের পবিত্র অষ্টোত্তর শতনামকে হরিনাম সংকীর্তনের মাধ্যমে বিপুল জনপ্রিয়তা দান করেন। তিনি জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে মানুষের মধ্যে ভাগবত প্রেম, মৈত্রী ও ত্যাগের মন্ত্র বপন করে যান যার একমাত্র আধার ছিল—’কীর্তন’।৩৬ কথিত আছে মহাপ্রভু নিজে অসাধারণ কীর্তনীয়া ছিলেন এবং তাঁর সংগীতের আহ্বানে দলে দলে মানুষ বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হন ও তৎকালীন বঙ্গদেশে ভক্তি ও ভাগবত প্রেমসাধনার জোয়ার ওঠে। শ্রীচৈতন্য তাঁর সমগ্র জীবন কীর্তনের মাধ্যমে ভাগবত আরাধনায় উৎসর্গ করেন এবং ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম ভাগে পদব্রজে গোটা ভারতবর্ষ পরিভ্রমণ করে এর ব্যাপ্তি ঘটান। হাজার হাজার মানুষ তাঁর কীর্তনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঈশ্বরপ্রেমে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে এবং সংগীতের মাধ্যমে ঈশ্বরসাধনা ও মোক্ষলাভের পথ খুঁজে পায়। তার উল্লেখযোগ্য শিষ্যদের মধ্যে পরবর্তীকালে যবন হরিদাস, নিত্যানন্দ স্বামী ও অদ্বৈত ঠাকুর তথা বাসুদেব সার্বভৌম্য ও কেশব কাশ্মিরীর মতো পণ্ডিতেরা উল্লেখযোগ্য। শ্রীচৈতন্য বিরচিত ‘শিক্ষাষ্টকম’৩৭-এ তিনি কীর্তনের বা সংকীর্তনের মাহাত্ম্য উল্লেখ করে বলেছেন যে এটিই একমাত্র পাথেয় যা সাধারণ মানুষকে পরমকরুণাময় ঈশ্বরের পরমাত্মীয় করে তুলতে সক্ষম। কীর্তনের প্রসারে, রচনায় ও ব্যাপ্তিতে তাই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর স্থান চিরস্মরণীয়।

শিখ কীর্তন

খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথমভাগে বিখ্যাত শিখ ধর্মগুরু ও ভক্তি আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা গুরুনানকের পৃষ্ঠপোষকতায় শিখ সম্প্রদায়ের মধ্যে ‘কীর্তন’ বা ‘গুরুমত’ সংগীতের প্রচলন ঘটে যা পরবর্তীকালে নানকের যোগ্য উত্তরসূরি গুরু অর্জন-এর সাহচর্যে বিস্তার লাভ করে। শিখধর্মে বিশেষত শিখ জাতির পবিত্র ধর্মগ্রন্থ শ্রীশ্রী আদি গুরুগ্রন্থ সাহেব থেকে উল্লিখিত পবিত্র স্তোত্র বা শ্লোকগুলিকে কীর্তনের আকারে গাওয়া হয়ে থাকে। এই বিশেষ ধর্মীয় সংগীতটি অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির ছাড়াও অন্যান্য ঐতিহাসিক গুরুদ্বারেও গাওয়া হয়ে থাকে। এই সংগীত পরিবেশনকালে প্রধানত হারমোনিয়াম, তবলা, খঞ্জনী, সেতার ও মন্দিরার বহুল ব্যবহার লক্ষণীয়। শিখ কীর্তনের অধিকাংশ গানগুলিই হিন্দুস্থানী রাগ, তাল ও ধবনিকেন্দ্রিক।৩৮ পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে ভক্তি আন্দোলনের সময় থেকে শুরু করে আধুনিক সময় পর্যন্ত শিখ সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক ধারার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে কীর্তন জুড়ে যায়। গুরুগ্রন্থসাহেব-এর নানান স্তোত্র ও গান আজও শিখ সম্প্রদায়ের মৈত্রী, ঐক্য ও সংহতি স্থাপনে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করে।

শিখকীর্তন বা ধর্মীয় সংগীতে ব্যবহৃত স্তোত্র বা মন্ত্রগুলিকে ‘সাবাদ’৩৯ বলা হয়ে থাকে। মূলত এই ‘সাবাদ’টিকে ‘মূলমন্ত্র’ বা ‘গুরুমন্ত্র’ নামে অভিহিত করা হয়। যে লিপি অনুসারে ‘সাবাদ’ বা অন্যান্য গুরুমন্ত্র রচিত হয়ে থাকে তা ‘গুরুমুখি’ নামে পরিচিত। এটি পাঞ্জাবের একটি সুপ্রাচীন ও বিশেষত লোকায়ত ভাষা, যাতে আজও অধিকাংশ শিখ সম্প্রদায়ের লোকেরা কথা বলে থাকেন। প্রতিটি শিখ কীর্তন বা ভজন মূলত শিখদের পূর্বউল্লেখিত পবিত্র ধর্মগ্রন্থের অংশ এবং এর প্রতিটি রচনাই সুপ্রাচীন হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সংগীত-এর আধারে রচিত এবং নানান গুরুদ্বারে একক বা অলিখিতভাবে পরিবেশিত হয়ে থাকে। গুরু নানক, গুরু অর্জন ও পরবর্তী রঞ্জিত সিংহ প্রমুখেরা প্রচুর ভজন বা কীর্তন রচনা করে গেছেন যা আজও আপামর জনচেতনাকে জাগরিত করতে সক্ষম। শিখধর্মে এছাড়াও আরো একটি উল্লেখযোগ্য ধর্মীয় সাংগীতিক মার্গ হচ্ছে ‘দাধি ভরন’ এখানে ‘দাধ’৪০ বা ‘ধার সারেঙ্গীর’ ব্যবহার হয়ে থাকে ঈশ্বরীয় নামকীর্তনের মাধ্যমে শিখ জাতির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস বর্ণনে। শিখ ভজন বা কীর্তনের ন্যায় ‘দাধি ভরন’-কেও একটি অত্যন্ত পবিত্র সাংগীতিক মাধ্যম- রূপে পরিগণিত করা হয়ে থাকে যা আজও শিখ জাতির নানান উৎসবে ও জমায়েতে বিশেষ মর্যাদা ও ভক্তির সঙ্গে পরিবেশিত হয়ে থাকে।

পাশ্চাত্য কীর্তন

আধুনিক যুগে ভক্তি আন্দোলন এবং তার মাধ্যমগুলি পাশ্চাত্যের দেশগুলিতেও বিশেষভাবে সমাদৃত হয়। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের মেয়র রুডলফ গিউলিয়ানির উদ্যোগে টমস্কিন স্কোয়ার পার্কে প্রথম প্রকাশ্য কীর্তন সংগঠিত হয় ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদের উৎসাহে। ইন্ট্যারনাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণা কনশাসনেস (ISKON)৪১-এর উদ্যোগে প্রাচ্যের কীর্তন আজ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে সমাদৃত। পাশ্চাত্য কীর্তনে প্রভুপাদ ছাড়াও কৃষ্ণা দাস, করুণামৃতা দাসি, জয় উত্তল, বামদেব, রাগিনী ও ইন্দ্রদাস প্রমুখ সিদ্ধ কীর্তনীয়ারা দেশজ কীর্তনের নামমাহাত্ম্য ও বাণী প্রচার করে চলেছেন। এই বিশিষ্টদের সাহচর্যেই আজ কীর্তন সমগ্র পৃথিবীর মৈত্রী-ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্যবোধের প্রেমকাব্যের মূর্ত প্রতীক।

বাউল-ফকির ধারা

হিন্দুস্থানী ধর্মীয় সংগীতের অন্যতম প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হল বাউল ও ফকির ধারা। পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন ও অতীন্দ্রিয় সাংগীতিক সংস্কৃতি এটি। ধর্মীয় ভাবদর্শন ও সাংগীতিক ঐতিহ্যের এক অনন্যসাধারণ মেলবন্ধন এই বাউল-ফকির সংগীত। পঞ্চদশ শতাব্দীতে বঙ্গদেশে এর উত্থান। এই বিশেষ ধর্মীয় সাংগীতিক গোষ্ঠীটি পৌত্তলিকতায় বিশ্বাসী নয়। এরা জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে একেশ্বরবাদের সাধনায় সংগীতের মাধ্যমে নিমজ্জমান। এই বিশেষ সম্প্রদায়টিকে কোনো নির্দিষ্ট জাতি বা গোষ্ঠী দিয়ে বিচার করা যায় না যদিও এদের মধ্যে হিন্দু, বৈষ্ণব ও মুসলিম সুফি সম্প্রদায়ের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। এই বিশেষ সম্প্রদায়টিকে তাদের বিশেষ পোশাক-পরিচ্ছদ, সাধারণ জীবনযাপন, নিবিড় সরলসংগীত সাধনার মাধ্যমে ব্রহ্মকে জানার ব্যাকুলতা ও একতারা, দো-তারা, খমক, গুপিবস্ত্র ইত্যাদি বিশেষ বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারকারীরূপে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। বঙ্গজীবনের এক অবিচ্ছেদ্য ধর্মীয় সাংস্কৃতিক অঙ্গরূপে পরিচিত এই বিশেষ সম্প্রদায়টিকে ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে ইউনেস্কো (UNESCO) ‘Masterpieces of the oral and intangible Heritage of humanity’ রূপে স্বীকৃতি প্রদান করেছে।

মূলত ‘বাউল’ শব্দটিকে নিয়ে প্রচুর মতবাদ রয়েছে। বিখ্যাত পণ্ডিত শশিভূষণ দাশগুপ্ত মহাশয়ের মতে এটি সংস্কৃত ‘বাতুল’ থেকে জাত আবার অনেকের মতে এটি সংস্কৃত ‘ব্যাকুল’ থেকে আগত। যদিও প্রথম বাউলের আবির্ভাব নিয়ে মতভেদ রয়েছে তবুও পঞ্চদশ শতাব্দীতে রচিত বহু গ্রন্থ ও পুথি রচনায় এর প্রমাণ পাওয়া যায়। এর মধ্যে বৃন্দাবনদাস বিরচিত চৈতন্যভাগবত ও কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত৪২ উল্লেখযোগ্য। বঙ্গদেশে পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে বৈষ্ণব সাধক নিত্যানন্দের পুত্র বীরভদ্র প্রথম বাউল সম্প্রদায়ের প্রবর্তন করেন। বাউল ফকির ধারা গ্রাম বাংলার অন্যতম সাংস্কৃতিক পর্যায়। এর উৎপত্তি বা জীবনদর্শন নিয়ে যতই মতভেদ থাকুক না-কেন বাউল ফকির সম্প্রদায় মূলত তন্ত্র, সুফিবাদ, বৈষ্ণব ও বৌদ্ধ মতাদর্শের এক মিলিত ফসল। এই বিশেষ সম্প্রদায়ে দু-প্রকারের অঙ্গ যথা হিন্দুতন্ত্র ও বৌদ্ধতান্ত্রিক ‘সহজিয়া’-র৪৩ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। নানা পণ্ডিতদের মতানুসারে বাউল-ফকিরিধর্ম মূলত প্রাচীন চর্যাপদের যোগসাধনার অবিচ্ছেদ্য রূপ, যার মধ্যে বৌদ্ধ সহজিয়াতন্ত্রের রূপ দেখা যায়। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বঙ্গদেশের সীমানা ছাড়িয়ে বাউল ফকির সংস্কৃতি গোটা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। আজও এর ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি চিরঅম্লান।

সংগীত সাধনা

বাউলাঙ্গ সংগীত মূলত অতীন্দ্রিয় প্রেম, ঈশ্বরিক ভালোবাসা ও আত্মনিবেদনের এক অনুপম মাধ্যম। বাউল ফকির সংগীতে একেশ্বরবাদী চিন্তাধারা, অখণ্ড ব্রহ্মর আহ্বান ও ঈশ্বরের প্রতি অনিঃশেষ প্রেম নিবেদন ছাড়াও সেই সময়কার গ্রাম বাংলার আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা, প্রশাসনিক লেনদেন ও গ্রামবাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ছোঁয়া বিদ্যমান। বাউল ‘সহজিয়া’ ধারা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকেও প্রভাবিত করেছিল। রবি ঠাকুরের নানান গানে বাউল সংগীতের চলন ও প্রভাব দেখা যায়। আজও বাউল ফকির সম্প্রদায়ের সংগীত সাধনা ও সংগীতের মাধ্যমে ঈশ্বরলাভের দর্শন সর্বজনবিদিত ও প্রভূত জনপ্রিয়।

মূলত বাউল-ফকিরি ধর্ম দেহতত্তের যে দুটি প্রধান আঙ্গিকের উপর নির্মিত তা দেহ-সাধনা, ও মন-সাধনা নামে পরিচিত। এর পাশাপাশি ‘চার-চাঁদ’, ‘নবদ্বার’, ‘প্রকৃতি’ ও ‘দম সাধনা’ ইত্যাদি মার্গেও এদের আচার-বিধি পরিলক্ষিত হয়। বাংলায় বাউলদের সঙ্গে ফকিরদের সুফি ঐতিহ্যও বিখ্যাত। ইসলামি সুফি ঐতিহ্য ও মর্মমুখী চিন্তার ক্রমবিকাশে এই মতবাদের উদ্ভব। মহম্মদের একদল অনুচর সাধক সুফি নামে পরিচিত ছিলেন। সুফি মানে পশম বা পবিত্রতা। ইসলামের সূত্রপাতের সঙ্গে সঙ্গে ধর্মীয় মতাদর্শের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। হজরতের মৃত্যুর পর থেকেই ইসলামে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব শুরু হয়। সুফি সাধকেরা তাঁদের রচনায় ও আচার- অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এর প্রতিবাদ জানান। যার ফলে সুফিদের উপর রাষ্ট্রের দমন নীতি শুরু হয়। মনসুর হাল্লাজু ও সুরাবর্দীর মতো মহান সাধকেরা এই দমন নীতির শিকার হন। বাউলদের মতোই সুফিদের জীবনযাপন, উপাসনা, নাচ-গান ও কোরান হাদিশ-এর ব্যাখ্যা ইসলামের বিরোধী ছিল। এঁরা নামাজ, রোজা, কালেমা, হজ ও জাকাত মানতেন না। ক্রমে এই ধর্মীয় আন্দোলন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। পারস্যে একে বিপুল সমাদরে গ্রহণ করা হয়। প্রখ্যাত সুফি সাধকদের নামে গড়ে ওঠে নানান সম্প্রদায়। এই সকল সাধকেরা জ্ঞানকে অনন্ত মেনে ও সত্যকে অক্ষয় মনে করে সংগীতের মাধ্যমে অভিষ্ঠলাভের ইচ্ছায় মানবধর্মের উন্নতিসাধনে নিজেদের ব্রতী করেন। চিস্তিয়া, কাদেরিয়া প্রমুখ উদারপন্থী সুফিসাধকেরা এ প্রসঙ্গে উল্লেখনীয়। এঁরা জাতিধর্মবর্ণ বিভেদ মানতেন না। এঁদের অনেকেই ভারতীয় সাধুদের পোশাক, খাদ্য, সাধনপদ্ধতির আংশিক ব্যবহারও করেছেন।

বাংলায় ‘সুফি’-র চাইতে পীর, ফকির বা দরবেশ নামটি বহুপ্রচলিত ও সর্বজনবিদিত। আরবি ভাষায় এর অর্থ নিঃস্ব মানুষ বা ইসলামি উপাসক। দরবেশ শব্দটি ফারসি ‘দরআবেজ’ থেকে জাত। যার অর্থ দরজায় ঝুলছে এমন কিছু। বিশেষত ইসলামি মাধুকরী অর্থেই এটি ব্যবহৃত হয়। যারা সেই মাধুকরী বা ভিক্ষা গ্রহণ করেন তাদের দরবেশ বলা হয়। এদের পোশাক লাল-হলুদ-সাদা ইত্যাদি বহু বর্ণের টুকরো দ্বারা নির্মিত বলে একে দরবেশি পোশাক বলা হয়। এই ফকিররা কিন্তু সমাজবিমুখ ছিলেন না। যাযাবর গোষ্ঠীর পাশাপাশি এরা গার্হস্থ্য জীবনযাপন, কৃষি ও ব্যবসায় নিবেদিত ছিলেন। বাংলার ফকিরদের মধ্যে মাদারিগোষ্ঠী প্রধান। এরা মূলত পারস্যমৃত্তিকাজাত। সৈয়দ বদিউদ্দিন এর প্রতিষ্ঠাতা যিনি ‘কুতুব-উল-মাদার’—যা কিনা সুফিসাধকদের শ্রেষ্ঠ সম্মান—উপাধিতে ভূষিত ছিলেন। অসাধারণ পণ্ডিত এই মানুষটি পারস্যদেশ থেকে দৈবআদেশে ভারতবর্ষে আসেন এবং তাঁর অনুগামীরা মাদারি পীর নামে পরিচিত হন। পরবর্তীকালে এই গোষ্ঠীরই আরেকজন বিখ্যাত ফকির মজনুশাহ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন।

বাউলদের মতো সুফি মতবাদও কোরান-এর অন্তর্নিহিত ঐতিহ্যের উপর নির্ভরশীল। দেহের মধ্যে যে ঈশ্বরের অধিষ্ঠান তাকে জানার সাধনায়, খুঁজে পাবার আবেগে গড়ে ওঠে দেহসাধনার লোকায়ত সংস্কৃতি। নরনারী যুগলপ্রেম, আশিক মাশুকের প্রসঙ্গে সুফি ও বাউলসাহিত্য সম্পৃক্ত। মখদুম সৈয়দ, চিশ্চিয়া, রজ্জব, সারমাদ, সুরাবর্দী প্রভৃতি সুফিসাধকেরা এই দেহসাধনায় নিমজ্জিত হয়েছিলেন। দেহসাধনার সাধকরূপে এঁদের জীবনচর্চা ও দেহবাদ কেন্দ্রীভূত। ভারতের ধর্মীয় লোকগানের জগতে এরই পাশাপাশি ঝুমুর, গম্ভীরা, মুসলিম বিবাহগীতি, মর্সিয়াজারি, রামায়ণগান, সাঁওতালী বিবাহসংগীত, শ্যামাসংগীত, ব্রাহ্মসংগীত, কবিগান, রায়বেশে, মনসা ও শীতলার ভাসান ইত্যাদির সঙ্গে দেহতত্ত্বগীতি এক অন্য দর্শন ও জীবনবোধের কথা বলে। হিন্দু ধর্মীয় সংগীত এরই ধারক ও বাহক।

***

১০ম অধ্যায়
 তমসো মা জ্যোতিঃর্গময় : সনাতনি হিন্দু ধর্মীয় সংগীত

১. A. L. Basham (2005) ; The wonder that was India, Picador : India, 9780330439091, pp. 27-30

২. Ibid, p. 69

৩. S.N. Dasgupta (2000) ; A History of Indian Philosophy, Motilal Banarsidass: Kolkata, 9788120804081, p. 12

৪. A.L. Basham, p. 72

৫. বীরেন্দ্র কিশোর রায়চৌধুরী (২০০৬); হিন্দুস্থানী সংগীতে তানসেনের স্থান, থীমা : কলকাতা, 8186017658, পৃ. ১৩

৬. তদেব, পৃ. ১৪

৭. তদেব, পৃ. ১৫

৮. তদেব

৯. তদেব

১০. John S. Hawley (2008) ; Songs of the Saints of India OUP : USA, 97801956942208, p. 64

১১. Shahabuddin Iraqi (209) ; Bhakti movement in medieval India Social and political perspective, Manohar : New Delhi, 8173048002, p. 49

১২. Ibid, p. 77

১৩. Deepak Sharma (2010) ; The Classical Indian Philosophy : A Reader, Cloumbia University Press : USA, 9780231133999, p. 21

১৪. Ibid, p. 32

১৫. Karen P. Prentiss (2000), The embodiment of Bhakti, OUP : USA, 9780195129130, p.8

১৬. John S. Hawley, p. 40

১৭. Ibid, p. 76

১৮. Ibid, p. 141

১৯. John S. Hawley (2005) ; Three Bhakti Voices : Mirabai, Surdas and Kabir in their time and ours, OUP : USA, 9780195670851, p. 117

২০. Ibid, p.213

২১. Karen P. Prentiss, p.82

২২. Ibid, p.96

২৩. Ibid, p. 99

২৪. Raziuddin Aquil (2010) ; Sufism and Society in Medieval India : Devates in Indian History, OUP : New York, 9780198064442, p. 39

২৫. ….(2009) ; Sufism, culture and politics : Afghans and Islam in Medieval North India, OUP : New Delhi , 9780195685121, pp. 57-59

২৬. Ibid, p. 136

২৭. Ibid, p. 178

২৮. Ibid, p. 196

২৯. Ibid, p. 229

৩০. David N. Lovenzen (2005) ; Religious movements in South Asia 600-1800, OUP : New York, 9780195664485, p. 16

৩১. Ibid, p.48

৩২. Ibid, p.56

৩৩. Reginald Massey ; The Music of India, Kalm & Averill Pub. ; 9781871082500, pp. 44-47

৩৪. Ibid, p. 63

৩৫. Ibid, p. 81

৩৬. D. Dennis Hudson (2000) ; Krishna’s Mandala : Bhagavad Religion and Beyond, OUP : USA, 97801980062769, p. 127

৩৭. Ibid, p. 94

৩৮. Michael Nijhawan (2006) ; Dhadi Durbar : Religion, Violence and performance of Sikh History, OUP : New Delhi, 9780195679670,p. 58

৩৯. Ibid, p. 79

৪০. Ibid, p. 121

৪১.. David N. Lovenzen ; p. 146

৪২. Jeanne Openshaw (2002) ; The seeking Bauls of Bengal, Cambridge UP : London, 9780521811255, p.88

৪৩. Ibid, p. 97.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *