৭ম অধ্যায় – নোয়ার প্রার্থনা : আর্মেনিয়ান ধর্মীয় সংগীত
ভূমিকা
ককেশাস পর্বতমালার পাদদেশে অবস্থিত পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা প্রাচীন খ্রিস্টান রাষ্ট্রটি হল আর্মেনিয়া১। মূলত ক্যাথলিক ভাবধারায় সম্পৃক্ত এই খ্রিস্টীয় ঐতিহ্যসমৃদ্ধ দেশটির ধর্মীয়সংগীতও বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ। খ্রিস্টীয় ধর্মীয় সংগীতের মতো ক্যাথলিক চার্চসংগীতের প্রভাব এই আর্মেনীয় ধর্মীয় সংগীতে দেখা গেলেও এই ধর্মীয়- সংগীতের নানান উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য একে খ্রিস্টীয় ধর্মীয় সংগীত থেকে অনেকটাই স্বতন্ত্র করে তুলেছে।
ককেশাস পর্বতমালা ও তার সমতলের নিকটবর্তী হওয়ায় এই আর্মেনীয় ধর্মীয় সংগীতে প্রাচীন লোকায়ত সংগীতের বহুল প্রয়োগ ও ব্যবহার লক্ষণীয়। আর্মেনীয় ধর্মীয়সংগীতের প্রবাদপ্রতিম শিল্পী জিভান গাসপেরিয়ান (Djivan Gasparyan)-এর ‘ডুডুক’ সংগীত যা কিনা খ্রিস্টান পপ সংগীতের একটি সরলীকরণ-এর হাত ধরে আর্মেনিয়ান ধর্মীয় সংগীতে বিস্তার লাভ করে। এছাড়াও আর্মেনীয় সংগীতে দক্ষিণ ইউরোপ মূলত গ্রিস, স্পেন ও ইতালিয়ান সংগীতের বিরাট প্রভাব দেখা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় আর্মেনীয় জাতিগোষ্ঠীরা তাদের সনাতনি লোকসংগীতের ধর্মীয়করণে এক বিশাল রূপান্তর আনে যা আর্মেনীয় ধর্মকে এক চমৎকার মাত্রায় নিয়ে যায়।
আর্মেনীয় ধর্মীয় সংগীতের মধ্যে প্রাচীনতম রূপ হল ‘আর্মেনিয়ান চ্যান্টস’২ বা স্তুতিগীতি যা আর্মেনীয় ধর্মীয় সংগীতে সর্বাধিক প্রচলিত ও জনপ্রিয়। এই স্তুতি বা ‘চ্যান্টস’ প্রাচীন ‘খায’ লিপিতে লেখা যা কিনা লোকায়ত আর্মেনিয়ার ধর্মীয় সংগীতের স্বরলিপিকরণ। এর অধিকাংশ স্তুতিগুলি বহু প্রাচীন, এমনকী কিছু কিছু স্তুতি খ্রিস্টীয় ধর্ম প্রবর্তনের আগেও প্রবর্তিত। এর মধ্যে বেশ কিছু চ্যান্টস রচনা করেন বিখ্যাত সেন্ট মেসরপ মাসতোত (St. Mesrop Mashtot)৩ যিনি সর্বপ্রথম আর্মেনিয়ান বর্ণমালার সৃষ্টি করেছিলেন। এই সমস্ত প্রাচীন স্তুতিগুলি ‘সারাকানস’৪ নামে পরিচিত। বহু সময়কাল ধরে নানা আর্মেনিয়ান সংগীতকার এই ‘সারাকানস’-গুলিকে পুনঃমূল্যায়ন করেন এবং একে উৎকর্ষে-এর এক নতুন রূপ দেন। এদের মধ্যে বিখ্যাত হলেন ‘লুসিনে থাকারিয়ান’ যিনি প্রাচীন ও পবিত্র ইচমিয়াদযিন ক্যাথিড্রাল চার্চে ‘সারাকান-গুলির পরিবেশনার মাধ্যমে বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করেন। সেন্ট মেসরপ-র মতো লুসিনেও এই প্রাচীন ‘সারাকান’-গুলিতে সুরযোজনা করেন যা পরবর্তীকালে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে বিখ্যাত আরেক সংগীতজ্ঞ ‘কোমিতাম র্ভাদা’ আরও ভালোভাবে সেটি নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করেন। প্রাচীন আর্মেনিয়ান ধর্মীয় সংগীত ছাড়াও সনাতনি আর্মেনিয়ান শাস্ত্রীয় সংগীতের জনকরূপে ‘র্ভাদা’৫ পরিচিত। তিনি ১৮৯৯ থেকে ১৯১০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আর্মেনিয়ান ভূখণ্ড পরিভ্রমণ করেন প্রায় ৩০০০ লোকসংগীত আবিষ্কার বা রচনা করে থাকেন যা পরবর্তীকালে আর্মেনীয় ধর্মীয় সংগীতকে এক নতুন মাত্রা দেয় এবং আর্মেনিয়ান ধর্মীয় সংগীতের স্বর্ণযুগের সূচনা হয়। এভাবেই ধীরে ধীরে আর্মেনিয়ায় তার ধর্মীয় সংগীতের রচনা, ভাবধারা ও ব্যবহারের মাধ্যম নিয়ে আজও সমানভাবে চর্চা চলছে এবং এটি অনস্বীকার্য।
লোকসংগীত ও ধর্ম
সনাতনি আর্মেনিয়ান লোক বা চার্চসংগীতে ইউরোপের স্বরবিন্যাসের বা ইউরোপীয় সংগীতের স্বরবৈচিত্র্যের বিন্দুমাত্র প্রভাব দেখা যায় না। এটি মূলত tetrachord জাতীয় মাধ্যম। এই tetrachord-এর উপর প্রয়োগ আর্মেনিয়ান ধর্মীয় বা চার্চ- সংগীতকে প্রাচীন ইউরোপের চার্চসংগীত থেকে স্বতন্ত্র ও পৃথক বৈশিষ্ট্যনির্ভর করে তোলে। সোভিয়েত লোকসংস্কৃতি ও ভাবধারার মধ্যে আর্মেনীয় ধর্মীয় সংগীত যথেষ্ট রক্ষণশীলতা ও গোঁড়া ঐতিহ্যের পৃষ্ঠপোষকতা বজায় রেখেও নানাবিধ নতুন সুর ও স্বর রচনায় মন দেয়। খণ্ডানুসংগীতের মধ্যেও নানারকম প্রাচীন যন্ত্র যার মধ্যে ‘কানুন’, ‘দাভুল’, ‘আউদ’ ও ‘জুরনা’ অবস্থিত। এখানেই ‘ডুডুক’ ৬ সংগীতের কথা আমরা পেয়ে থাকি। রেনেসাঁ যুগে ডুডুক সংগীত আরও বিস্তার লাভ করে। বিখ্যাত ‘ডুডুক’ সংগীতকারদের মধ্যে মার্জার মারগ্যারিয়ান, লেভন মাদোয়ান, সারো ড্যানিলিয়ান ও ইয়োগিশ মানুকিয়ান ছাড়াও প্রবাদপ্রতিম ‘ডুডুক’ সংগীতকার জিভান গাসপ্যারিয়ান বর্তমান।
পূর্ববর্তী আর্মেনিয়ান ইতিহাসে, ‘খামাঞ্চা’৭ নামক তারের যন্ত্রের বহুল প্রচলন ছিল তার ব্যবহার সম্পর্কেও নানা তথ্য পাওয়া যায়। এই বিশেষ তারের যন্ত্রটি একটি বিশেষ আদিবাসী লোক চারণকবিরা ব্যবহার করতেন, যারা—’আসাউঘ’৮ (Ashough) নামে পরিচিত। ‘সায়াত নোভা’ নামের অষ্টাদশ শতাব্দীর এক ‘আসাউখ’-এর নানান রচনা আজও লোকমুখে পাওয়া যায়। আধুনিক যুগে এই বিশেষ যন্ত্র ও সম্প্রদায়ের চর্চা যারা করে থাকেন তাঁরা হলেন ‘আর্মেনাক শাহমুরাদিয়ান’, ‘রুবেন মেটোভেসিয়ান’, ‘হেয়রিক মুরাদিয়ান’, ‘রাফি হবহাসিয়ান’ প্রমুখগণ। আর্মেনীয় লোকধর্মীয় সংগীতের ধারায় মহিলা শিল্পীদেরও সক্রিয় ভূমিকা দেখা যায় যাদের মধ্যে—’ওফেলিয়া হামবারজুমান’, ‘রিমা সারিবেকইয়ান’, ‘সুসানা সাফারিয়ান’, ‘ফ্লোরা মার্তিরোসিয়ান’ প্রমুখ বিখ্যাত।
গণহত্যা ও উত্তরযুগ : আর্মেনিয়ান সংস্কৃতি জীবনে ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দ একটি রক্তাক্ত অধ্যায়। এই খ্রিস্টাব্দে নব্য টার্কি বা তুর্কি শাসনতন্ত্রের হাতে এক বিরাট গণহত্যা সাধিত হয়, যাতে প্রায় লক্ষাধিক আর্মেনিয়ানরা নিহত হয়। মূলত ধর্মীয় বিভেদ ও আর্মেনিয়ান বিদ্রোহ দমনের জন্যই এই পৈশাচিক হত্যালীলা৯ চলে। এর পরবর্তী যুগে আর্মিনিয়ার ধর্মীয় সংস্কৃতি সামাজিক রীতিনীতিতে গভীর রেখাপাত হয়। প্রতিবাদের বাঁধ ভেসে যায় সর্বত্র। ধর্মীয় সংগীতে ও সংস্কৃতিতেও এর সমান প্রভাব পড়ে। এই একই সময় আর্মেনীয় সাহিত্য-সংস্কৃতি-ধর্ম-সংগীত ও সামাজিক আচার-বিচার রক্ষার্থে রিচার্ড হাগোপিয়ান, জন বার্বারিয়ান, জর্জ তুতানজিয়ান, নার্সিক ইসপিরিয়ন প্রভৃতি বিখ্যাত সংগীতকারেরা আর্মেনীয় প্রতিবাদী সংগীতের প্রচলন করেন। ইরান ও তেহরানেও আর্মেনীয় লোকসংগীতের এক নতুন বিদ্রোহী ধারা নিকোল গালানডেরিয়ান (১৮৮১ – ১৯৪৬)-এর১০ ধারায় আরও বিকশিত, সমৃদ্ধ ও ব্যাপ্তি লাভ করে।
ধর্মীয় আরমানি সংগীত
আর্মেনীয় ধর্মীয় সংগীতের এক বৃহৎ অংশ আরমানি শাস্ত্রীয় ও লোকসংগীত দখল করে রেখেছে। শাস্ত্রীয় আরমানি সংগীতকারদের মধ্যে ‘কেমানি তাতোস একসারাসিয়ান’ এক প্রাতঃস্মরণীয় নাম যিনি শাস্ত্রীয় অটোমান সংগীতকে আরও সমৃদ্ধ করে গেছেন।
এর সঙ্গেই আর্মেনিয়ান অপেরার কথাও পাওয়া যায় যেখানে আলেকভার স্পেনদিরৎ (১৮৭১ – ১৯২৮ খ্রি.) আরমেন টাইগ্রারিয়ান (১৮৭৯ – ১৯৫০ খ্রি.) প্রমুখ ওপেরা সংগীতকারদের উল্লেখ আবশ্যিক।
অবিভক্ত সোভিয়েত রাশিয়ায় গেভর্গ আর্মেনিয়ান, এডওয়ার্ড মিরজোয়ান, বরিস পার্সাদারিয়ান, আপোহ জোহরারিয়াল ইত্যাদি সংগীতকারদের অসাধারণ রচনা ও ধর্মীয় সংস্কৃতির এক সম্পূর্ণ নতুন রূপায়ন করেন। এছাড়া ‘সোমরাগো হেকানুস’, ‘Gohar Gaspayan’, ‘Gohar Galachain’, লুমনো অশরা, সারা টালিয়ন প্রমুখ বিখ্যাত। সাহান১১ আজরুনী একজন প্রথম শ্রেণির আর্মেনিয়ান পিয়ানোবাদক যিনি আর্মেনিয়ান চার্চসংগীতের জন্য বহু চ্যাপেল, চ্যান্টস ও গসপেল রচনা করেছিলেন যা আজও গাওয়া হয়ে থাকে এবং সমান জনপ্রিয়।
পরবর্তী অধ্যায়ে আর্মেনিয়ান ধর্মীয় সংগীতেও ব্যাপক বিবর্তন আসে এবং সুজান ইয়াকার, উডী বেনকুলিয়ন, বেলা দারবিনয়ান, এলভিনা মাকারইয়ান প্রভৃতি সংগীতকারের আর্মেনিয়ান ধর্মীয় পপ মিউজিক১২ (Religious Pop) বিশেষ প্রসার পায়। এই সময় ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে প্রথম আর্মেনিয়ান জ্যাজ ব্যান্ড ‘ইরেভেন’ ধর্মীয় সাংগীতিক ধারাকে আরেক নতুন রূপ দান করে।
এই সকল সংগীত বা সাংগীতিক ধারা আর্মেনীয় ধর্ম-ধর্মীয়ভাবধারাকে বিশেষ আসনে নিয়ে যায়। ‘নোয়ার প্রার্থনা’ বা ‘আদানা’১৩ নামক বিখ্যাত রচনাগুলি বিশ্ব ধর্মীয় সংগীত সভায় আর্মেনিয়ান ধর্ম ও ধর্মীয় ভাবাদর্শকে বিশেষ জায়গা করে দেয়। ড্যানিয়েল ডেকার ও আরা গেভরজিয়ান-এর এই বিখ্যাত রচনা (Composition)-গুলি আর্মেনিয়ান ধর্মীয় সংগীতকে পুনরাবিষ্কার করে ও মহার্ঘ্যতা দান করে।
পরিশেষ
সুপ্রাচীন ‘ডুডুক’ সংগীত থেকে ‘নোয়ার প্রার্থনা’ এই বিশাল ধর্মীয় সাংগীতিক যাত্রায় আর্মেনীয় ধর্ম ও তার ব্যাপ্তি সত্যিই বিস্ময়কর। আরমো-আমেরিকান লোকসংগীতের ধারা এই ধর্মীয় সাংগীতিক ধারাকে আরও গভীরতা দান করে। প্রাচীন ‘সারাকানস’ লিপির স্তুতিসংগীত, আর্মেনিয়ান ক্যাথিড্রাল চার্চ সংগীত বা ‘ইরেভন’ (ধর্মীয় আর্মো জ্যাজ ব্যান্ড) বিশ্বসংগীতের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় অধ্যায় যা আজও আর্মেনীয় ধর্মীয় সাংস্কৃতিক ভাববাদ ও মতাদর্শকে অমর করে রেখেছে। আশা করা যায়, আধুনিক পৃথিবীর ইতিহাসেও এই ধর্মীয় সাংগীতিক ধারাটি চিরকাল লোকমানসপটে সংগীতের সুরমূর্ছনায় চিরসমাদৃত ও আদরণীয় হবে।
***
৭ম অধ্যায়
নোয়ার প্রার্থনা : আর্মেনিয়ান ধর্মীয় সংগীত
১. Simon Payaslian (2007) ; The History of Armenia, Palgrave-Macmillan, 978023060000645, p.11
২. Ibid, p. 56
৩. Jonathan Mc Collum (2004) ; Armenian Music : A comprehensive Bibliography, The Scarecrow Press, 9780810849679, p. 44
৪. Ibid, p. 49
৫. Ibid p. 131
৬. Levon Abrahemian (2001) ; Armenian folk arts, Culture & Identity, Indiana UP, 9788025337047, p. 95
৭. Ibid p. 119
৮. Ibid, p. 77
৯. Donald E. Miller (1999) ; Survivors : An Oral History of the Armenian Genocide, California UP, 978052019564, p. 25
১০. Ibid, p, 178
১১. Komitas V. Komits (1997) ; Armenian Sacred and folk music, Routledge, 9780700706372, p. 77
১২. Ibid, p.84
১৩. Ibid, p. 174