১ম অধ্যায় – বেথলেহেম-বাইবেল-গ্রেগোরিয়ান চ্যান্টস : খ্রিস্টীয় ধর্মীয় সংগীত
নেপথ্য ভাষণ
দৃশ্য ১
খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী। রাত্রি দ্বিতীয় প্রহর। বেথলেহেম শহরের সবাই একে একে এসে জড়ো হচ্ছে অখ্যাত সেই গোয়ালঘরের ভগ্নস্তূপে। ক্লান্ত, অবসন্ন মা মেরির কোলে সদ্যোজাত সেই দৈবশিশুর হাসির আলোয় ভরে উঠছে চারপাশ। আকাশ থেকে ক্রমাগত হয়ে চলেছে ঐশ্বরিক আশীর্বাদস্বরূপ তারাবৃষ্টি। এসে উপস্থিত হয়েছেন পুবের সেই সাধকত্রয়ী যাদের আমরা ‘ম্যাজাই’১ (Magi) নামে চিনি। তাঁরা এনেছেন উপহার—বহুদূর হতে—সদ্যোজাত সেই শিশুর জন্য। ছোট্ট গোয়ালঘরটি ভরে উঠছে ক্রমশ সেই সাধকদের অদ্ভুত স্তুতিগানে। দিগদিগন্ত জুড়ে অদ্ভুত সেই সংগীতের সুর যেন প্রতিধবনিত হচ্ছে।
দৃশ্য ২
৩০ খ্রিস্টাব্দ। বনপ্রান্তর, দিগদিগন্ত ঝলসে উঠছে বিদ্যুৎচমকে। জেরুজালেমের জুডেয়ার (Judaea) নিকটবর্তী সেই রুক্ষ গলগোথা পাহাড়ের ঢালে দাঁড়িয়ে রয়েছে তিনটিত্রুশ কাঠ। দুটি ত্রুশকাঠে গেঁথে দেওয়া হয়েছে দুটি ছিঁচকে চোরকে যারা প্রাণ ভয়ে তখনও চিৎকার করছে, অথচ মধ্যস্থিত তৃতীয় ত্রুশকাঠের ব্যক্তিটির মুখে কোনো শব্দ নেই। নেই কোনো ক্ষোভ-ভয়-বিদ্বেষ। সারা শরীর তার রক্তাক্ত। রক্তাক্ত মাথায় তার চেপে বসে আছে কাঁটার মুকুট। আকাশের দিকে তাকিয়ে শেষবারের মতো কেঁপে উঠল তার ঠোঁট—’হে পিতা, তুমি এদের ক্ষমা করো! এরা জানে না এরা কী করছে!’২ আরও একবার আছড়ে পড়ল ঝড়, ঝলসে উঠল বিদ্যুৎ, বৃষ্টি নেমে এল বধ্যভূমিতে। তারপর সব শান্ত, সৌম্য, নিস্তব্ধ! শুধু দূরে বসে থাকা কিছু মানুষের চোখে জল। তাদের কণ্ঠে কান্নার ধবনি। বিলাপের সুর। সেই সুর, সেই সংগীত যা রোমান সাম্রাজ্যকে কখনো শান্তিতে ঘুমোতে দেয়নি আর।৩
মনে হয় না, খ্রিস্ট্রীয় ধর্মে সংগীতের এরূপ প্রভাবশালী প্রয়োগ অন্যত্র কোথাও দেখা গেছে। যিশুর সঙ্গে সেদিন একাত্ম হয়েগেছিল জেরুজালেমের প্রান্তীয় সংগীত। খ্রিস্টীয় ধর্মীয় সংগীতের একটি কিংবদন্তি রূপ সেদিন ধর্মীয় সংগীত-এর রূপে চিরকালীন হয়ে গিয়েছিল এই ধর্মের মানসমন্দিরে। খ্রিস্টানরা আজও সে-সব অশ্রুত সুর, সংগীতের ধর্মীয়করণরূপে গেয়ে থাকেন। গেয়ে থাকেন ধর্মীয় উৎসবে, আমন্ত্রণে, শোকসমাবেশে। এর কোনো শেষ নেই, যেমন এর শুরু বলে কিছু নেই।
শাখা-উপশাখা
খ্রিস্টীয় ধর্মীয় সংগীত মূলত সেই বিশেষ প্রকারের সংগীত যা খ্রিস্টানদের শুধুমাত্র তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের জায়গায় নয়, বরং তাদের সামাজিকরূপেও সমানভাবে গভীর প্রভাব ফেলেছে। উদবুদ্ধ করেছে শুধু খ্রিস্টানদের নয়, সমানভাবে সব ধর্মের মানুষকে এবং তাদের ঐক্যবদ্ধতাকে সহনশীলতার ও ভ্রাতৃত্ববোধের চরম শিখরে নিয়ে যাবার জন্য। খ্রিস্টীয় ধর্মীয় সংগীত তাদের ধর্মের মতোই সমান গৌরবোজ্জ্বল ও কীর্তিধর। খ্রিস্টীয় ধর্মীয় সংগীতের মূল চারটি বিষয় হল—স্তুতি, উপাসনা, অন্তস্থঃকরণ এবং শোকযাপন।৪ অন্যান্য ধর্মীয় সংগীতের সাংগীতিক ভাবধারার মতো এটিও কালক্রমে বিবর্তিত হয়েছে খ্রিস্টীয় সংস্কৃতি, সমাজচেতনার আধার ও তার ভাবসমাধির অনুধ্যানে। এই ধর্মীয় সংগীত নানান শাখা-উপশাখায় অনুশীলিত হয়ে পরিস্ফূট হয়েছে ব্যক্তিনির্ভর মতাদর্শ ও ঐক্যের মানদণ্ডে। যুগ যুগ ধরে বিবর্তিত হয়েছে—স্তুতি, পাঠপরিক্রমণ, সনাতন ভাবদর্শন, সমসাময়িক সন্ধিক্ষণ ও নগরকেন্দ্রিক চার্চ সংস্কৃতিতে।৫ এর মধ্যে উপবিভাজনীয় শাখায়, যথা—রক্ষণশীল চার্চসংগীত, লোকগান, রক, জ্যাজ, মেটাল এবং হিপহপে।
পরিবেশন
খ্রিস্টীয় ধর্মীয় সংগীতকে তার পরিবেশনার আধারেও সমানভাবে বিভক্ত করা যায়। সনাতনি প্রথায় ব্যক্তিবিশেষে এই সংগীতকে শুনে শুনে রপ্ত করার প্রবণতা লক্ষণীয়। যা মূলত পুরোনো ক্যাথলিক চার্চগুলির তত্ত্বাবধানে লালিতপালিত। এটি পরিবেশনের দুটি বিশেষ দিক হল—১. যন্ত্রানুসংগীতের মাধ্যমে, অথবা ২. যন্ত্রাংশ ছাড়াও। রক্ষণশীল চার্চগুলিতে মূলত মধ্যযুগের প্রথমার্ধে যন্ত্রানুসংগীত ছাড়াই গাওয়া হয়ে থাকত। পরে অবশ্য বারোক যুগে, সেখানে প্রথম এর তুমুল পরিবর্তন পাই যা এই সংগীতকে আরও উন্নত ও জনপ্রিয় করে তোলে।৬ প্রথম প্রথম এই সংগীত যাজক সম্প্রদায়ের কেউ গাইত পরে অবশ্য তাতে ‘কয়ার’ বা সমবেত সংগীতের বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। মূলত এর পরিবেশনের স্থানগুলি হল উপাসনাগৃহ যা ক্যাথলিক চার্চগুলিতে প্রতিদিন রোববার সকালে পরিবেশিত হত। যদিও ধীরে ধীরে এটি প্রকাশ্য জনসমক্ষে, কনসার্ট হলে এমনকী স্থানীয় পানাগারেও (Alehouse) পরিবেশিত হতে দেখা যায়। এখান থেকেই Worship band, church band এবং choir৭-এর উৎপত্তি।
সময় পরিধি
যদিও ত্রুসেডের সময় থেকেই নব্য খ্রিস্টীয় ধর্মীয় সংগীতের প্রচলন তবু মধ্যযুগে (৫০০ – ১৪০০ খ্রিস্টাব্দ) রোমান ক্যাথলিক চার্চগুলি থেকেই এর জয়যাত্রা শুরু। এরপর রেনেসাঁস যুগ (১৪০০ – ১৬০০ খ্রিস্টাব্দ), বারোক (১৬০০ – ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দ) এবং ক্ল্যাসিকাল পিরিয়ডে (১৭৫০ – ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ) এর ব্যাপ্তি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।৮ রোমান্টিক যুগে বেটোফেন, বাখ, ও শুবার্টের তত্ত্বাবধানে এটি নন্দনশিল্পের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্তরূপে দেখা যায়। বিংশ শতাব্দীর প্রথমে আধুনিক সংগীতের ভাবধারায় খ্রিস্টীয় ধর্মীয়সংগীত নবরূপে, নবকলেবরে ধর্মীয় সংগীত জগতের আসরে উপস্থিত হয়।৯ এই সময়সীমা ও তার বিস্তার সত্যিই অবিস্মরণীয়।
সংগীত সম্মেলন ও উৎসব
সারা পৃথিবী জুড়ে নানান ধরনের খ্রিস্টীয় ধর্মীয় সংগীত সম্মেলন দেখা যায়। এর মধ্যে সর্বপ্রথম ও বিখ্যাত উৎসব হল Ichtus Music Festival যেটি ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয়।১০ সর্বাপেক্ষা বৃহত্তম ধর্মীয় সংগীত মহোৎসবগুলির মধ্যে ‘কর্নার স্টোন’ (cornerstone) এবং ‘ক্রিয়েশন’ (creation Festival) উল্লেখযোগ্য, যেখানে প্রতিবছর প্রায় ২ লক্ষ মানুষের সমাগম ঘটে।১১ ধর্মীয় গসপেল সং থেকে শুরু করে গ্রেগোরিয়ান চ্যান্টস, ব্লুজ, রক, চার্চ মেটাল ও জ্যাজ সংগীতও এখানে পরিবেশিত হয়। অনেক সময় ধর্মযাজকরাও এতে অংশ নেন।১২
গ্রেগোরিয়ান চ্যান্টস
খ্রিস্টীয় ধর্মীয় সংগীতের সবচেয়ে পুরোনা, ঐতিহ্যশালী ও জনপ্রিয় রূপটি হল গ্রেগোরিয়ান চ্যান্টস। বিশেষত খ্রিস্টীয় ধর্মীয় উৎসব ও অন্যান্য আচার-অনুষ্ঠানে পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন এই সংগীতটি পরিবেশিত হয়ে থাকে। খ্রিস্টীয় ১০ম শতাব্দীতে এর প্রথম উদ্ভব ঘটলেও নানান পণ্ডিতদের মতে মূলত এটি মধ্যযুগীয় সংগীত যা রেনেসাঁস যুগে প্রথম লিপিবদ্ধ হয় গুটেনবার্গের ছাপাখানার১৩ দৌলতে। এটি মূলত গাওয়া হয়ে থাকে ‘পবিত্র কর্ম’রূপে দিনে ন-বার বিশেষ বিশেষ সময়ে—বিখ্যাত সন্ত বেনেডিক্টের নিয়মানুসারে। যদিও এর পিছনে প্রাচীন লোকসংগীতের প্রভাব বিশেষ লক্ষণীয়, তবু জনসাধারণের বিশ্বাস এটির প্রথম আবিষ্কারক হলেন পোপ সেন্ট গ্রেগরি যার নামানুসারে এই ধর্মীয় সংগীত সর্বজনবিদিত। বারোক যুগে এর ব্যাপ্তি ও প্রসার অভাবনীয়। ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে এর মধ্যে প্রভূত আধুনিকীকরণ এলেও এই সংগীত তার মূল ভাবধারা আজও অক্ষুণ্ণ রেখেছে। এটি একটি বিশেষ স্বরলিপিতে লিপিবদ্ধকরণ হয়ে থাকে যা ‘নিউমেস’১৪ (Neumes) নামে পরিচিত। এটি মূলত সনাতনী ধারায় গাওয়া হয়ে থাকে যাতে পুরুষ ও নারীদের ধর্মীয় বিধান অনুসারে নির্মিত দলে ভাগ হয়ে পরিবেশন করতে হয়। গ্রেগোরিয়ান চ্যান্টের নানান পর্যায়গুলি, যথাক্রমে—অ্যামব্রোসিয়ান, মোজারাবিক চ্যান্টস ইত্যাদি। বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে এটি প্রথম চার্চের বেড়াজাল টপকে সাধারণের জন্য প্রকাশিত হয় ক্যাসেট ও সিডির আকারে যাতে বহু বিখ্যাত শিল্পীর যেমন Noirin Ni Rain-এর সাংগীতিক প্রতিভার প্রমাণ পাওয়া যায়। এই মুহূর্তে নিউ টেস্টামেন্ট অনুসারে যিশুর ‘লাস্ট সাপার’-এর অংশবিশেষ গ্রেগোরিয়ান চ্যান্টের উত্তরাধুনিক রূপান্তরে যথেষ্ট জনপ্রিয়।১৫
উপসংহার
খ্রিস্টীয় ধর্মীয় সংগীতের ইতিহাস বিশ্ব ধর্মীয় সংগীতের এক উজ্জ্বল অধ্যায়। বহুযুগ ধরে এর উর্বরতা খ্রিস্টী ধর্মকে আরও সবুজ করে তুলতে সক্ষম। এ এক অসীম রত্নভাণ্ডার যা শেষ হয়েও অনিঃশেষ রয়ে যায়। যিশু খ্রিস্টের অবদান, উদারতা ও আত্মোৎসর্গের উপাখ্যান এই ধর্মীয় সংগীতের মাধ্যমে যুগ যুগ ধরে ছড়িয়ে পড়েছে। আমেন!
***
১ম অধ্যায়
বেথলেহেম বাইবেল গ্রেগোরিয়ান চ্যান্টস : খ্রিস্টীয় ধর্মীয় সংগীত
১. Biblical Magi (2 : 1–12), Gospel of Mathew
২. ‘father…forgive them, for they know not what they do’ ; (23 : 34), Gospel of Luke
৩. Michael Grant, Jesus (2004), Rigel, 978189799887, pp. 156–157
৪. Geoffrey Wainwright and Karen B. Tucker (2006), The Oxford History of Christian worship, OUP, UK, 019538864, p. 168
৫. Ibid, pp. 171–175
৬. Viv Broughton (1996), Too Clse to Heaven : The Illustrated History of Gospel Music, Midnight books, 19005160064, p. 221
৭. Ibid, p. 239
৮. Donald J. Grout (1996), A History of Western Classical Music, W. W. Norton and Co., 0-393-928039, p. 77
৯. Ibid, p. 191
১০. Robert Darben (2005), People get ready : A New History of black Gospel Music, Continuum, 0826417593, p. 99
১১. Ibid, p. 113
১২. Ibid, p. 123
১৩. Richard Hoppin (1978), An Anthology of Medieval Music, W. W. Norton, 039309809, p. 51
১৪. Ibid, p. 69
১৫. Katherine Lemee (19940 ; Chant : The Origins, Form, practice and healing power of Gregorian Chant, Harmony, 0517700379, p. 155