প্রাককথন : আলাপ ও বিস্তার

প্রাককথন : আলাপ ও বিস্তার

সংগীত। জাদুশব্দে মোড়া আরেক ভুবন। আরেক জগৎ, গ্যালাক্সি, মিল্কি ওয়ে এবং ব্ল্যাকহোল। সংগীত বলতে ঠিক যে আমরা কী বুঝি তা হয়তো নিজেরাও জানি না। সংগীত কি শুধুই বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণ, সনাতনি শ্লোকবিন্যাস অথবা উপনিষদ-এর শ্রুতিযোগ? নাকি মুনলাইট সোনাটা, গ্রেগোরিয়ান চ্যান্টস, বাখ, মোৎসার্ট, চাইকোভস্কির স্বরলিপির জাদু? নাকি আউল-বাউল-লোকসংগীত-লোরচন্দ্রাণী, কবিরের দোঁহার কুয়াশা অথবা রবীন্দ্রনাথের ‘শেষ পাড়ানির কড়ি?’

মনে হয় না এতসব কিছু দিয়েও বোঝানো যেতে পারে ‘সংগীত’-এর প্রকৃত মর্মার্থ। আসলে এর উত্তর বোধহয় লুকিয়ে রয়েছে আমাদেরই সত্তায়। এ এক প্রাকৃত সম্পর্ক। সেই সম্পর্ক যা নিহিত রয়েছে সদ্যোজাতের কান্না থেকে শুরু হয়ে শ্মশানবন্ধুদের ‘হরিবোল’ ধবনির পরতে পরতে। ‘ইহা অনস্বীকার্য’।

যদিও ভাষাতাত্ত্বিক বিচারে প্রাচীন গ্রিক শব্দ ‘Mousike’ থেকে এর আবির্ভাব যার অর্থ—‘(art) of the muses’, তবু মনোবীক্ষণের বিচারে সৃষ্টির আদিপর্বে মানবসভ্যতার উদ্ভব ও ক্রমবিকাশের সমান্তরালেই এর উৎস। ডারউইনের অরিজিন অব স্পিসিস রচনার মূলস্রোতের বিপরীতে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ ড. স্যামুয়েল জে. ফ্লেচার বলেছিলেন, ‘ক্রোম্যাগনন’ বা আদিমানব-শ্রেণিভুক্ত নিয়ানডারথালদের হাতেই প্রথম সংগীতের নথিকরণ।’ মৃত বন্যপশুর ফাঁপা হাড় ঘাঁটতে গিয়ে এরাই প্রথম নাকি বের করেছিল সুর। যদিও তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয় বলেই স্বীকৃত। এই আদিমানবরাই প্রথম মেঘের ডাক, বৃষ্টির আওয়াজ, পাখির কুহু, ঝরনার ধবনি ও শিকারের শব্দে সংগীতের স্বাক্ষর চিনতে পারে।

মানবসভ্যতার বিকাশে এমন একটি সময় ছিল যখন মানুষ মুখে মুখেই ভাবের তথা জ্ঞানের আদান-প্রদান করত। লিপি বা বর্ণমালা তখনও অনাবিষ্কৃত। লব্ধজ্ঞান উত্তরসূরিদের মুখে মুখে বংশপরম্পরায় ঘুরত। আমাদের দেশে একে ‘শ্রুতি’ বলা হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে এই ‘সময়’ এখন থেকে অন্তত আনুমানিক সাত-আট হাজার বছর আগের। কথিত আছে এই ‘শ্রুতি’-র একটি সাংগীতিক রূপ ছিল যা অনায়াসরপ্ত। প্রাচীন পুথিতে পরবর্তীকালে লেখা প্রার্থনা, পূজাপাঠের মন্ত্র, জাদুবিদ্যা, মহাকাব্য, বীর অথবা শোকগাথা ইত্যাদিতে সংগীতের এক বিরাট প্রভাব আজও লক্ষণীয়। শুধু ভারতবর্ষে নয়, পৃথিবীর সমস্ত সভ্য দেশের ইতিহাসও এই একই স্বাক্ষ্য বহন করে।

পৃথিবীর প্রাচীনতম তিনটি পুথি বা গ্রন্থ এক্ষেত্রে উদাহরণযোগ্য। সুমেরীয় সভ্যতার গিলগামেশ, প্রাচীন মিশরীয়দের মৃতের লিপি (The Egyptian Book of the Dead ) এবং বৈদিক ভারতের ঋগবেদ। বয়সের দিক থেকে ঋগবেদ এবং লিপির বয়সানুসারে গিলগামেশ সর্বাপেক্ষা প্রাচীন। গিলগামেশ মহাকাব্য প্রাচীন সেমেটিক বা সুমেরীয় সভ্যতার এক অতুলনীয় দান যা মাটির ফলকের উপর ‘ক্যুনিফর্ম’ লিপিতে খোদিত। এর ভাষা আক্কাদিয়।

মিশরীয়দের মৃতের লিপি হল অবিস্মরণীয় কিছু মন্ত্রের অনবদ্য সংকলন। মন্ত্রগুলির মধ্যে বেশ কিছু শোকগাথা (elegy) এবং কিছু জাদুমন্ত্র (magical witch-craft rhymes) রয়েছে। কিছু কিছু প্রার্থনাও রয়েছে অবশ্য একই সঙ্গে। এইসব মন্ত্রগুলি ‘হাইয়ারোগ্লিফিকস’ নামক চিত্রলিপিতে ‘প্যাপিরাস’ পাতার ওপর লেখা। কিছু কিছু লিপি আবার প্যাপিরাসের বদলে ‘পার্চমেন্ট’ বা চামড়াতেও লেখা হয়েছে। এগুলি বেশিরভাগই ‘পিরামিড টেক্সট’ যা বিভিন্ন মন্দির বা সমাধিতে খোদিত।

ঋগবেদ তার চারটি ভাগ অর্থাৎ সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও সূত্র ছাড়াও ১০টি মণ্ডল, ১০২৮টি ঋক বা মন্ত্র নিয়ে এক বিশাল আর্য-কীর্তি। এটি সম্ভবত বৈদিক সংস্কৃতে এবং কিয়দংশে প্রত্ন-খরোষ্ঠিলিপিতে লেখা হয়েছিল নানা ধরনের ভূর্জপত্রে। বিখ্যাত ঐতিহাসিক স্যার জেমস প্রির্চাড ও টি. জি. অ্যালেনের মতানুসারে এই সবক-টি গ্রন্থই আনুমানিক সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার বছরের পুরোনো এবং এ সবক-টিরই প্রথম মাধ্যম ছিল সংগীত। সেই সময় এই সমস্ত লিপিই রীতিমতো মুখস্থ করে সুর করে গেয়ে গেয়ে ‘manifest’ করা হত। আরও প্রাচীন তিববতীয় ধর্মগ্রন্থ ও প্রাচীন চিনাভাষার লিপিতেও ভাষা ও ভাবের সাংগীতিক প্রকাশের সাক্ষ্য মেলে।

প্রকৃতপক্ষে মনুষের জীবনে সংগীতের বিবর্তন প্রকৃতিজাত। প্রাকৃতিক শব্দ, পাখির ডাক, জন্তুজানোয়ারের আওয়াজই মানুষের সাংগীতিক বোধের প্রথম প্রত্ন বর্ণমালা। এভাবেই আমরা মিল খুঁজে পাই জাপানি শাকুহাসি (Shakuhaci) এবং নিয়ানডারথালের হাড়ের বাঁশির ভেতর। সামবেদ-এও এর প্রভাব লক্ষণীয়। আর্যসভ্যতার পথ ধরে আমরা একে একে মিশরীয়, চৈনিক, গ্রিক, সুমেরীয়, তুর্কি, আরবি ও জাপসংগীতের মধ্যে খুঁজে পাই সেই অমোঘ ‘বৈপরীত্যের মেলবন্ধন’। বিখ্যাত আরব-পণ্ডিত আল-ফারাবির লেখা কিতাব আল-মিউসিকি আল-কবির আমাদের চিনতে শেখায় ইসলামি সংগীতের মুনশিয়ানা ও অভাবনীয় বিবর্তনের ধারাবাহিকতাকে। বিশ্বসাংগীতিক বিবর্তন ও ধর্মীয়-সামাজিক-রাজনৈতিক রীতিনীতিস্থ সংগীতের এক উজ্জ্বল দলিল এই বইটি। পৃথিবীতে এরকম বই আগামী একশো বছরেও আর লেখা হবে কিনা সন্দেহ!

মধ্যযুগের গোড়ায় (৫০০ – ১৪০০ খ্রিস্টাব্দ) পাশ্চাত্যের ইউরোপীয় সংগীতে আসে এক বিরাট পরিবর্তন। এই সময়ের একমাত্র সাংগীতিক ভাবধারা আমাদের কাছে পরিস্ফূট হয়ে ওঠে রোমান ক্যাথলিক চার্চের স্তবগাথার মধ্য দিয়ে, যাকে আমরা ‘গ্রেগোরিয়ান চ্যান্টস’ নামে জানি। প্রথম প্রথম এই ‘চ্যান্টস’ ক্যাথলিক চার্চের যাজক শ্রেণিভুক্ত কোনো বিশেষ পুরুষ অথবা নারীর কণ্ঠে ধবনিত হত।

পরবর্তীকালে রেনেসাঁস যুগে (১৪০০ – ১৬০০ খ্রিস্টাব্দ) এবং তার মধ্যভাগে (১৫০০ খ্রিস্টাব্দ) একে একে বিভিন্ন সুরকার, গায়ক এবং বাদ্যযন্ত্রীরা একত্রিত (Chorus) হয়ে নানা পবিত্র ‘চ্যান্টস’ রচনা করেন, যা গুটেনবার্গের সদ্য আবিষ্কৃত ছাপাখানার দৌলতে বহুলভাবে প্রচারিত হয়ে প্রচুর মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় হয়।

বারোক (Baroque)১০ যুগে (১১০০ – ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দ) আবির্ভাব হয় প্রথম অপেরার যেখানে একই সঙ্গে সমবেত মহিলা গোষ্ঠীর সংগীতের (Contrapuntal chorus music) প্রকাশ ঘটে।

রেনেসাঁস যুগ থেকে মহিলাদের চার্চ-সংগীতে অংশগ্রহণ করা অনেক জায়গাতেই শুরু হয়েছিল—মধ্যযুগে যা একেবারেই অভাবনীয়। বারোক যুগে যেন এর পূণর্জন্ম হয়। জার্মান বারোক সংগীতকারেরা এর বিকাশে অগ্রগণ্য ভূমিকা নেন। এই সময়েই ছোটো ছোটো নানান রচনা বা ‘composition’-এর উদ্ভব হয়। উদ্ভব হয় একই সঙ্গে নানান তারের যন্ত্র, ব্রাশ, ড্রামস এবং ‘wood winds’ বা বাঁশির। সেই সঙ্গে উঠে আসে কয়্যার, পাইপ-অর্গ্যান, হারপিসকর্ড এবং ক্ল্যাভিকর্ডের রমরমা উপস্থিতি। এই সময়েই বহু সাংগীতিক ধারা বা মিউজিকাল ফর্মের আত্মপ্রকাশ। আত্মপ্রকাশ ঘটে সোনাটা ও কনসার্টের। ক্ল্যাসিকাল যুগে (১৭৫০ – ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে) এর ব্যাপ্তি আরও প্রশস্ত হয়। সোনাটা ও কনসার্টের পাশাপাশি উঠে আসে ‘সিম্ফনি’। জোসেফ হেইডন ও উলফগ্যাং ম্যোৎজার্ট এই সময়ের দুই চির উজ্জ্বল সংগীত জ্যোতিষ্ক।

উনিশ শতকের রোম্যান্টিক যুগের (১৮০০ – ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দ)১১ পথনির্দেশকরূপে এগিয়ে আসেন লডউইগ ভন বিঠোফেন ও ফ্রানজ শ্যুবার্ট। এই রোম্যান্টিক যুগেই প্রথম সংগীতের বিষয়, বৈশিষ্ট্য, সামাজিক দায়বদ্ধতা ইত্যাদি নিয়ে প্রচুর ভাবনাচিন্তা ও পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু হয়। ভাবনা চলে সংগীতের এই ক্রমবিবর্তনকে আরও নতুন রূপে, আলাদা মাত্রায় ও সৃজনশীলতার ছোঁয়ায় রাঙিয়ে তোলার। এই যুগেরই শেষ প্রান্তে অর্কেস্ট্রা, কনসার্ট-এর নাটকীয় রূপান্তর ঘটে যায় তৎকালীন গ্রামীণ ও নগরকেন্দ্রিক সভ্যতায় প্রবল ব্যাপ্তির মধ্য দিয়ে।

বিংশ শতাব্দীর দোরগোড়ায় সংগীতের ছন্দ, শব্দ ও ‘স্টাইল’ নিয়ে মাতামাতি শুরু হয়। মাতামাতি চলে এর সহজলভ্যতায়, দর্শক বা শ্রোতাদের চাহিদায় এবং পুঁজিবাদী সমাজে এর গ্রহণীয়তা নিয়েও। ইগোর স্ত্রাভিনস্কি, স্ক্রোয়েনবার্গ ও জন কেজ-এর মতো কিংবদন্তিরা এখানে তাদের সংগীত প্রতিভার প্রভূত উজ্জ্বল নিদর্শন রেখে এই বিংশ শতাব্দীতেই সূচনা করেন জ্যাজ-সংগীতের (Jazz Music)। সে এক ঐতিহাসিক অধ্যায়!

এবার তাকানো যাক ভারতীয় উচ্চাঙ্গ বা মার্গসংগীতের স্বর্ণযুগের দিকে। হিন্দুসভ্যতার প্রচুর পুথি, ভার্স্কয ও চিত্রশিল্পে প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত ও বাদ্যযন্ত্রের উদাহরণ পাওয়া যায়। উদাহরণ পাওয়া যায় ঋগবেদ ও সামবেদ-এর মন্ত্রে। প্রাচীন ভারতে সংগীতবিদ্যা বহুযুগ ধরেই চলে আসছে। হিন্দুধর্মের প্রাচীন সংগীতকোষ সংগীত রত্নাকর-এ অনেক সংগীতাচার্যের নাম পাওয়া যায়। যেমন—বিশাখিল, দত্তিল, কম্বল, বায়ু, বিশ্বাবসু, রম্ভা, অর্জুন, নারদ, হনুমান, রাবণ, বিহুরাজ, শম্বুক, রুদ্রট, ভোজ, মাতৃগুপ্ত এবং তাদের ব্যাখ্যাকর্তারা, যথা—লোল্লট, উদ্ভট, অভিনব গুপ্ত, কীর্তিধর প্রমুখ।১২

হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সংগীতকে কখনোই কোনো বিশেষ যুগ, সময় বা কাল দ্বারা চিহ্নিত করা সম্ভব নয়। মূলত সামবেদ-কেই সংগীতের উৎপত্তিস্বরূপ এখানে মানা হয়ে থাকে। পুরাণ অনুসারে ব্রহ্মা থেকে বেদ-এর উৎপত্তি। আবার মতান্তরে মহাদেব তাঁর পঞ্চমুখ থেকে পাঁচটি রাগ ও পার্বতীর মুখ থেকে একটি রাগের সৃষ্টি করেন।১৩ ব্রহ্মা এই ছ-টি বিশেষ রাগকে ছ-টি ঋতু অনুযায়ী ভাগ করেন। যেমন—গ্রীষ্মে দীপক, বর্ষায় মেঘ, শরৎ-এ ভৈরব, হেমন্তে শ্রী, শীতে মালকোষ ও বসন্তে হিন্দোল। মজার ব্যাপার, এই সকল রাগই পুরাণানুসারে ছ-টি করে ভার্যা বা স্ত্রীর অধীশ্বর এবং এইভাবেই ছত্রিশটি রাগিণীর উৎপত্তি। দেবর্ষি নারদ রচিত সংগীতশাস্ত্রকল্প -য় এর প্রসঙ্গ উল্লেখিত।

হিন্দুস্থানী সংগীতের প্রাথমিক রূপ পাওয়া যায় কবি জয়দেবের লেখা গীতগোবিন্দ-য়। হিন্দুস্থানি মার্গসংগীতে এই গ্রন্থের ভূমিকা ও প্রভাব অনস্বীকার্য। কৃষ্ণলীলায় পরিপূর্ণ এর সব কবিতাই বহু বিখ্যাত রাগ, রস ও তানাশ্রিত।

তবে বোগদাদের হারুণ-অল-রশিদ এই সংগীতের বিশেষ উন্নতিসাধন করেন। গজনীর মামুদ কনৌজ আক্রমণের সময় (১০১৮ খ্রিস্টাব্দ) সেখানে ৬০০০০ গায়ক বর্তমান। শুধুমাত্র সোমনাথ মন্দিরেই ৩০০ গায়ক ছিল। আলাউদ্দিনের সময় হিন্দুস্থানী সংগীতে দরবারির প্রথম ব্যবহার। এই সময়েই বিখ্যাত গায়ক বৈজুবাওরা (জন্ম-সাল নিয়ে মতান্তর) সংস্কৃত ও পালিভাষার ধ্রুব, প্রবন্ধ ও ছন্দ থেকে ধ্রুপদের সৃষ্টি করেন। আর এক বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞ নায়ক গোপাল দাক্ষিণাত্য থেকে উত্তর ভারতে এসে হিন্দুস্থানী সংগীতের পূর্ণাঙ্গ রূপদান করেন যার মধ্যে সংগীতসাধক হরিদাস স্বামী ও তানসেনের অবদানও প্রাতঃস্মরণীয়।

দিল্লির পাঠান সম্রাট আলাউদ্দীন খিলজীর সময়১৪ (চতুর্দশ শতাব্দীর প্রারম্ভে) দরবারি সংগীতের প্রচলন ও তার ঐতিহ্য আজও বিস্ময়কর। ইনিই প্রথম পারস্য থেকে বিখ্যাত সংগীতসাধক জনাব আমির খসরুকে নিমন্ত্রণ করেন। আমির খসরু একাধারে কবি, দার্শনিক, সংগীতজ্ঞ ও রাজনীতিক ছিলেন। খসরু সুফি সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন। তাঁর রচিত গান ও কবিতায় গুজরাতি, ফারসি, সংস্কৃত ও মৈথিলি ভাষার সমন্বয় দেখা যায়। বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ফারসি সুর, যেমন—সাজগিরী, ইমন, ওসাক, মাফেক, জীলাফা (পরবর্তী জিলা কাফি) খসরু প্রচলন করেন।১৫ তিনি গানও গাইতেন পারসিক পদ্ধতিতে! তাঁর ধারার ১২টি মোকাম বা রাগ, ২৪টি সুধা বা রাগিণী এবং ৪৮টি গুস্যা বা উপরাগ পাওয়া যায়। বহুবিধ যন্ত্রবাদ্য আবিষ্কৃত তাঁর হাতেই, যা আজ শুধু ভারতে নয় গোটা বিশ্বে সমাদৃত। এছাড়াও তানসেন-পরবর্তী যুগে ষোড়শ শতাব্দীতে গোয়ালিয়ার মহারাজ মান (মানসিংহ নন) হিন্দুস্থানি সংগীতের পুনর্জন্ম ঘটান। কর্নেল ক্যানিংহামের Archaeological Report of Gwalior-এ মহান এই রাজার সৃষ্ট নানান বিচিত্র রাগ-রাগিণীর উল্লেখ পাওয়া যায়।

এই ভাবেই কালের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সনাতনি ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের জয়যাত্রা চলে। আজও সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। এভাবেই যুগযুগান্ত ধরে কাল থেকে কালান্তরের পথে চলেছে সংগীতের যাত্রা। যাত্রা চলেছে প্রাচীন মানবসভ্যতা থেকে আধুনিক সভ্যতার পথে। যাত্রা চলেছে ঋগবৈদিক, পুরাণের যুগ থেকে আরব, মধ্য এশিয়া, চিন, জাপান, জাভা, বোর্নিও, সুমাত্রার পথে। যাত্রা চলেছে রোমান ক্যাথলিক চার্চ থেকে জ্যাজ, পপ, রক, রেগে, ব্লুজ-এর পথে। যাত্রা চলেছে বোবা কান থেকে সবাক চাউনির ইঙ্গিত পর্যন্ত।

এই এগিয়ে চলার পথে লণ্ঠন ধরেছেন হোমার নামের সেই অন্ধ পাগল কবি যিনি পূর্ব কায়েশের প্রপৌত্র গুবালের তৈরি হার্প বাজিয়ে ট্রয়ের যুদ্ধে গ্রিক সেনাদের উদবুদ্ধ করেন। উদবুদ্ধ করেন সেই বধির সুরকার বেঠোফেন যাঁর বিখ্যাত রচনা আজও আমাদের ভাবায়। উদবুদ্ধ করেন মূক-বধির সেই দ্বাদশবর্ষীয় বিস্ময়কর বেহালাবাদক ক্রিস বাক। উদবুদ্ধ করেন বিখ্যাত প্রাণীসংগীতজ্ঞ (Zoomusicologist) জার্জ হারজঘ যিনি আমাদের প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন, ‘Does animal have music?’১৬। উদবুদ্ধ করেন তানসেন যাঁর দরবারি কানাড়ায় মোহিত হয়ে অদৃশ্য ঘাতক অস্ত্র ফেলে দেয়। উদবুদ্ধ করেন চাইকভৎস্কি, লিওনেত্তিরা। উদবুদ্ধ করেন ভাস্কর বুয়া, আল্লাদিয়া ও ফৈয়াজ খাঁ সাহেবরা। উদবুদ্ধ করেন রবিশঙ্কর, বিলায়েত, আলি আকবর, আলাউদ্দিন ও নিখিল ব্যানার্জিরা। আমরা উদবুদ্ধ হই। উদ্দীপ্ত হই। হতে ভালোবাসি।

পরিশেষে বলতে হয় সংগীতকে যতই ধর্মান্তরিত করা হোক না-কেন এটি সকল ধর্মের অতীত। সব ধর্মের, সব কালের, সব যুগের যুগরূপ। মানবজন্মের সৃষ্টি থেকে ধবংস, সভ্যতার বিবর্তন থেকে সভ্যতার বিমোচন সর্বত্রই এর গতি অবাধ, এর যাতায়াত অপ্রতিরোধ্য। তাই বোধ হয় বিখ্যাত দার্শনিক, সংগীতজ্ঞ Jean–Jacques Nattiez১৭ বলেছেন :

There is no noise, only sound, only music.

উপনিষদ-বেদ-পুরাণ-কোরান-বাইবেল-ত্রিপিটক যেখানে এক সূত্রে গাঁথা। একই মন্ত্রে দীক্ষিত। স্থল-জল-মহানভ অঙ্গন—সব মিলিয়ে যার ব্যাপ্তি অসীম। এই সেই দর্শনের ‘আলো’ যার গন্ধে ঘন্টা বাজে।১৮ এই সেই আদি-অনাদি ও পরিসমাপ্তির কালরেখা। সদ্যভূমিষ্ঠ শিশুর কান্না থেকে চিতার কাঠ পোড়ার শব্দে বিশ্ব থেকে মহাবিশ্বে, আদি থেকে অনাদি, সসীম থেকে অসীম গন্তব্যের পাথেয়। এই সেই আত্মপরিচয়। আত্ম-উপলব্ধির অনির্বাণ আলো। সমস্ত বাধা-বিপত্তি-লোভ-কাম-ক্ষুধার ঊর্ধ্বে উচ্চারিত মহেন্দ্রধবনি। এই সেই ‘সোহম’, এই সেই ওঁ। পৃথিবীর আদিশব্দ। ধবনি, বর্ণ, যতি, আঘাত।

এই সেই স + মগ + ঈকার + তৎ। সম-গৈ + ক্ত। সংগীত!

ইতিহাস আমাদের অনেক কিছু শেখায়। চিনতে শেখায় আমাদের ভবিষ্যৎ, আমাদের বর্তমানকে। হয়তো তার জন্যই এতটা প্রেক্ষাপটের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। প্রয়োজন হয়ে পড়ে সংগীতের, যা সভ্যতার আগ্রাসীকরণ ও বিবর্তনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে সাধারণ জীবনে। সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্মীয় রীতিনীতি, সামাজিক সম্পর্ক, আচার-ব্যবহার ও শিক্ষাদীক্ষার সঙ্গে সংগীতের বহুদিনের একাত্মীকরণ। সংস্কৃতির অভিব্যক্তি বলতে আমরা সম্ভবত এই বুঝি। কোনো বিশেষ জাতির বা গোষ্ঠীর সংস্কৃতি বলতে তার সামগ্রিক জীবন থেকে শুরু করে ধর্মীয় আচারকলা, শিষ্টাচার ও সমাজসংস্কার পর্যন্ত। এরই মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হল ধর্মীয় মনোভাব।১৯

আদিম যুগে যখনই বন্য, বর্বর মানুষ প্রথম প্রকৃতির করালরূপের সম্মুখীন হয়, তখন থেকেই ধর্মীয় সংগীত ভাবনার অঙ্কুরোদগম। এই আদিম মানুষেরাই প্রথম প্রকৃতির স্তব সৃষ্টি করে।২০ সৃষ্টি করে তাদের নিজেদেরই মঙ্গল বা সমাজের হিতসাধনের উদ্দেশ্যে। রচিত হয় অসংখ্য স্তব অগ্নি-বায়ু-পর্বত-নদী-সমুদ্র-আকাশকে নিয়ে। মানুষ চিরকালই অসহায়, নিঃসম্বল থাকেনি। সমাজের ঐক্যবদ্ধকরণ, সমাজব্যবস্থার উন্নয়ন ও সমাজজীবনের উন্নতিসাধনের জন্য এভাবেই ধীরে ধীরে সৃষ্টি হয় ধর্মের। সৃষ্টি হয় উপাসক ও উপাসনার। সৃষ্টি হয় দেবদেবী, আচারবিচার ইত্যাদির। সৃষ্টি হয় সংগীতের—স্তব-স্তুতির। ধর্মীয় সংগীতের যাত্রা শুরু হয় এভাবেই। কালের পথ ধরে।

ধর্মীয় সংগীতের ব্যাপ্তি দিগন্তব্যাপী। সময়ের চাকা বেয়ে সমাজ ও ধর্মীয় ভাবধারার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিপুল পরিবর্তন এসেছে সংগীতেও। বহুযুগ ধরে বহু দেশে বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠনের পৃষ্ঠপোষকতায় সাবলীলভাবে উঠে এসেছে এই ধর্মীয় সংগীত। আজানের সুর থেকে ক্যাথলিক চার্চের গসপেল সংস, সামবেদের স্তুতি থেকে আহুরা মাজদার অতীন্দ্রিয় সুর সর্বত্র সংগীতের—অনন্ত বিস্তার। গ্রামবাংলার রমণীদের উলুধবনি থেকে শামানিষ্ঠদের গালবাদ্য, মন্দিরের আরতির ঘন্টাধবনি থেকে সূর্য উপাসক ইনকাদের হলোগ্রাম, খ্রিস্টানদের কনসার্ট থেকে পারস্যের সুফি সম্প্রদায়ের পবিত্র ‘ঘূর্ণন’, এ সবই কি সংগীতের আধার নয়? নয় কি বিভিন্ন সভ্যতার এক অনিবার্য মেলবন্ধন? এখানেই আমাদের সংস্কৃতির ‘বৃন্দাবন’। ধর্মের আলোর পথ ধরে মানুষের যাত্রাপথ ‘সুধা সাগর তীরে’। এখানেই সমস্ত শব্দের শেষ, শেষ সমস্ত অক্ষর ও জ্যোতি-প্রাকারের। এখানে শুধু সংগীত। নাদ। শব্দ। শব্দ নয়, শব্দব্রহ্ম। সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় ও পুনঃসৃষ্টির সাম্যরূপ। ‘ইহাই ধর্মের সংগীত এবং ইহাই সংগীতের ধর্ম’!

স্বীকৃতি

অধ্যাপক রবার্ট র‌্যেইলে, ইস্তানবুল টেকনিকাল ইউনিভার্সিটি, তুরস্ক

অধ্যাপক হেলেন রিজ, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র

অধ্যাপক ফ্যাবরিজিও ফারারি, ইউনিভার্সিটি অব চেস্টার, ইংল্যান্ড

অধ্যাপক টম সলোমন, ইউনিভার্সিটি অব বার্জেল, নরওয়ে

অধ্যাপক এম জাফর ওজেন, ইউনিভার্সিটি অব স্ট্যাভেনগার, নরওয়ে

অধ্যাপক জোসেফ টি ও’ কোনেল, ইউনিভার্সিটি অব টরন্টো, কানাডা

অধ্যাপক এ কে স্যান্ডার্স, ইউনিভার্সিটি অব গুটেনবার্গ, সুইডেন

অধ্যাপক রেজাউদ্দিন আকিল, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, ভারত

অধ্যাপক অম্লান দাশগুপ্ত, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, ভারত

অধ্যাপক দীপক ঘোষ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, ভারত

অধ্যাপক ভাস্বর মৈত্র, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, ভারত

অধ্যাপক সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, ভারত

মুখ্য গ্রন্থাগার আধিকারিক, সুলেমানিয়া লাইব্রেরি, তুরস্ক

মুখ্য গ্রন্থাগার আধিকারিক, এশিয়াটিক সোসাইটি, ভারত

মুখ্য গ্রন্থাগার আধিকারিক, ন্যাশনাল লাইব্রেরি, ভারত

মুখ্য গ্রন্থাগার আধিকারিক, সেন্ট্রাল লাইব্রেরি, তেহরান ইউনিভার্সিটি, ইরান

মুখ্য গ্রন্থাগার আধিকারিক, বিশপস কলেজ, ভারত

মুখ্য গ্রন্থাগার আধিকারিক, সেন্ট্রাল লাইব্রেরি, বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়, ভারত

মুখ্য গ্রন্থাগার আধিকারিক, সেন্ট্রাল লাইব্রেরি, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, ভারত

আধিকারিক, সংস্কৃতি মন্ত্রক, ভারত সরকার, নয়া দিল্লি, ভারত

ক্রসওয়ার্ডের সৌরভ, প্রচ্ছদশিল্পী সৌরীশ, নতুন বন্ধু ময়ূখ ও শুভঙ্কর,পারুল প্রকাশনীর কর্ণধার শ্রীগৌরদাস সাহা এবং

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সমস্ত শুভানুধ্যায়ী, মা, বাবা, বোন, বন্ধুবান্ধব ও সহকর্মীবৃন্দ

ধর্ম

ধর্মীয় সংগীতের ইতিহাস ও তত্ত্বালোচনার আগে আমাদের জেনে নেওয়া উচিত—ধর্ম আসলে কী? এর উৎপত্তি কোথায়? অথবা, সমকালীন বিষয়ে এর প্রাসঙ্গিকতাই বা কতখানি এবং ধর্মের প্রকৃত সংজ্ঞাই বা কী?

আমাদের জীবনে আজও অনেক কিছুই রহস্যাবৃত, যার কোনো যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা দেওয়া অসম্ভব। জন্ম ও মৃত্যুর রহস্য আমাদের সাধারণ বুদ্ধির অগোচর। সৃষ্টির রহস্যতত্ত্ব নিয়ে অনেক আলোচনা আগেও হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। তবুও কোথাও-না-কোথাও আমাদের স্থিতির প্রয়োজন হয়। সদুত্তর পাওয়া যায় না সব কিছুর। প্রাকৃতিক ঘটনাবলি (অপ্রাকৃতিক তো বটেই!) আমাদের নিয়ন্ত্রণের ঊর্ধ্বে। কখন, কোথায়, কেন, কীভাবে ঝড় উঠবে, মহাপ্লাবন আসবে, দুর্ভিক্ষ, মহামারি হবে বা আদৌ একে প্রতিরোধ করা যাবে কিনা দার্শনিক চিন্তাধারায় এ সবের ব্যাখ্যা দুষ্কর এবং সাধারণের নিয়ন্ত্রণাতীত। এই জাতীয় রহস্যের সঠিক সমাধান না-করতে পেরেই সর্বকালে সর্বদেশের মানুষ কোনো এক ইন্দ্রিয়াতীত (Supernatural power) শক্তির কথা কল্পনা করেছে। বস্তুত এর থেকেই ধর্ম এবং ধর্মীয় চিন্তাভাবনার উদ্ভব হয়েছে বলে বিজ্ঞানী এবং পণ্ডিতেরা মনে করেন। James G. Frazer তাঁর বিখ্যাত বই The Golden Bough-এ ধর্মের যা সংজ্ঞা দেন তা হল :

Powers superior to man which are believed to direct and control the course of nature human being.

অন্যদিকে অগর্বান ও নিমকফ-এর সংজ্ঞানুসারে ‘Religion is an attitude towards super-human powers’। সংস্কৃতে ধর্মকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে ধৃ (= ধারণ) + ম (র্তৃ)। অর্থাৎ ধারণ করা হয়েছে যা তাই ধর্ম। এ অর্থে ধর্ম হল—ঈশ্বরোপাসনার পদ্ধতি। আচার-আচরণ, ইহকাল ও পরকাল ইত্যাদি বিষয়ে নির্দেশ ও তত্ত্ব। এখানেই উঠে আসে পুণ্যকর্ম, সৎকর্ম, কর্তব্য, শাস্ত্রবিধান, সুনীতি (ধর্মসংগীত), সাধনার পথ ও পাথেয়। হিন্দুধর্মে ধর্মের অধিরাজ যম। যমের অংশজাত যুধিষ্ঠির। এইসব অতিপ্রাকৃত শক্তির প্রতি সম্ভ্রমপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই নানারকম সুসংগত বিশ্বাস, আচার-আচরণের জন্ম। কালক্রমে এগুলিই ধর্মীয় বিশ্বাসের রূপ নেয়। অপরপক্ষে অনেক দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের মতে, আত্মার অবিনশ্বরতা সম্পর্কে বিশ্বাস থেকে ভগবান বা ঐশ্বরিক পুরুষ (Superman)-এ বিশ্বাস জন্মায়। এই বিশ্বাসই হল ধর্মের সার। ঊনবিংশ শতাব্দীতে সমাজতাত্ত্বিক দিক থেকে ধর্মের প্রকৃতি ও উদ্ভব ব্যাখ্যার চেষ্টা করা হয়। এখানে দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারা অনুসরণ করতে দেখা যায়। একটি বিবর্তনবাদের নিয়মে অপরটি কর্মনির্বাহী তত্ত্বানুসারে (functional theory)। আশা করি ধর্ম সম্পর্কে আর বেশি তত্ত্ব কচকচানির কড়াক্কড় বাঁধনে না-জড়িয়ে এবার এগোনো যেতে পারে ধর্মীয় সংগীত প্রসঙ্গে। উপরের আলোচনা থেকে এটুকুনি অন্তত বোঝা যায় সমাজজীবনে ধর্মের ভূমিকা জটিল, বিতর্কমূলক অথচ ‘unputdownable’। যারা ধর্মীয় ভাবধারায় অনুপ্রাণিত তাদের কাছে ধর্ম আশীর্বাদস্বরূপ। তাদের মতে ধর্ম না-থাকলে জীবন অর্থহীন হয়ে পড়ে। অপরদিকে যারা নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেন তাদের কাছে ধর্মীয়তত্ত্ব এক অলীক দর্শন ও প্রগতির বিরোধী। তবে মনে রাখা প্রয়োজন ধর্ম বলতে প্রতিষ্ঠিত ধর্মীয় ব্যবস্থাকে (institutionalised religion) নির্দেশ করা হচ্ছে এবং ধর্মীয় ভাবধারাকে মূলস্রোত থেকে বিচ্যুত না-করার উদ্দেশ্যেই ধর্মীয় সংগীতের প্রবর্তন।

মানুষের জীবনে নানা প্রকার সংকট, বিপর্যয়, দুঃখ, শোক, মৃত্যু ও মনঃস্তাপ ইত্যাদির প্রভূত উপস্থিতি লক্ষণীয়। অসহায় মানুষ সৃষ্টির আদি থেকেই এই সংকটের দু-ভাবে মোকাবিলা করার চেষ্টা করে। একটি ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান (Religious culture) এবং তুকতাকের (Black magic) সাহায্যে। আমাদের বিষয়-এর প্রথম খণ্ডটিকে নিয়ে।

ধর্মীয় আচারের একটি অপরিহার্য ও অবিচ্ছেদ্য অংশ হল—ধর্মীয় সংগীত। সাধারণত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান বা সংগীত কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যকে সামনে রেখে অনুসরণ করে না। ভক্তগণ যুগে যুগে বিভিন্ন দেশে, বিভিন্নকালে বিভিন্ন উপাসকের উপাসনা বা প্রার্থনা নিবেদন করে সর্বশক্তির সেই আধারের কাছে কৃপা যাচঞা করেন। ভগবৎকৃপা লাভই যার মুখ্য উদ্দেশ্য, পার্থিব লাভ নয়। এভাবেই যুগযুগান্তর ধরে মানুষের মধ্যে কৃপা-শক্তি-সাহস লাভের উদ্দেশ্য ধর্মীয় আচারের মাধ্যমে গঠিত। সংগীত শুধু তার এক অপরিহার্য মাধ্যম যা সহজ-সরল অথচ গভীর প্রভাবান্বিত।

মানবসভ্যতার বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দেশে যে ভাবে সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের একই গতিবেগে সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন ধর্মের, ধর্মীয় আচার-আচরণের। সৃষ্টি হয়েছে ধর্মীয় সংগীতের। নানারূপে, নানাভাষায় ও নানা বৈচিত্র্যের। এভাবেই সৃষ্ট সংগীত যুগযুগ ধরে রক্ষা করে চলেছে ধর্মীয় ভাবধারা। রক্ষা করে চলেছে ধর্মীয় বিশ্বাস-নির্ভরশীলতা ও ধর্মের নিশানকে। লোকায়ত সংস্কৃতি তাকে দিয়েছে প্রগাঢ়তা। সৃষ্টি হয়েছে উপাসক ও উপাসকের স্তুতি। সনাতনী ধর্মীয় আদর্শ পর্যবসিত ও প্রতিফলিত হয়েছে এইসব সংগীতের মধ্য দিয়ে। প্রথম দিকে এই স্তুতি বা সংগীত যাজকশ্রেণিভুক্ত হয়ে থাকলেও অচিরেই তা গভীর রেখাপাত করে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষকে। তখন এর ব্যাপ্তি হয়ে পড়ে ব্যক্তিনির্ভর ও অসীম।

সনাতনী ধর্মীয় সংগীতের উদাহরণ নানান সভ্যতায় পাওয়া যায়।১০ সুমেরীয় থেকে অ্যাজটেক অথবা ব্যাবিলনীয় সভ্যতা থেকে আর্যবৈদিক সভ্যতা সবেতেই এর সফল পদক্ষেপ লক্ষ করা যায়। যুগ যুগান্তর ধরে হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ স্তুতি সংগীতের উজ্জ্বল ও ভাবগম্ভীর পরিবেশনায় সমাজতান্ত্রিক সভ্যতার উন্নয়ন ও স্থিতিশীল প্রজ্ঞার কথা ধর্মাচরণের মধ্য দিয়ে তুলে ধরা হয়েছে ভবিষ্যতের সম্মুখে। বিস্তারিতভাবে এই আলোচনায় যাবার আগে স্বল্প পরিসরে প্রাচীন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানিক ধর্মের ধর্মীয় সংগীতের ইতিহাসে বরং নজর দেওয়া যাক।

খ্রিস্টধর্ম

ধর্মীয় সংগীতের ইতিহাস খ্রিস্ট ধর্মে যথেষ্টই সুদীর্ঘকায়। বিশেষ করে খ্রিস্টীয় চার্চসংগীতের ইতিহাস। সে যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রূপকার বলা হয়ে থাকে যোহান সেবাস্টিয়ান বাখ-কে যিনি অধিকাংশ রচনাই (composition) উৎসর্গ করেছিলেন লুথেরান চার্চের উদ্দেশ্যে। ধর্মীয় সংগীতও মাঝে মাঝে কালের অমোঘ নিয়মে পরিবর্তনশীল। সমসাময়িক খ্রিস্টীয় ধর্মীয়সংগীত এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কারণ প্রথম এই ধর্মীয় সংগীতই রচনার মূলসুরে আমূল পরিবর্তন আনে তার মধ্যে জনপ্রিয় লোকসংগীত বা আধুনিক composition-এর সমন্বয় ঘটিয়ে।১১ যদিও সংগীতের স্বর-রচনা (lyrics) বিন্দুমাত্র ধর্মীয় নিবেদনের (Religious approach) বহির্ভূত হয়ে ওঠেনি। গসপেল সংগীতের ক্ষেত্রেও এই পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। অতীতের খ্রিস্টীয় চার্চ সংগীতের তেমন বিশেষ কোনো আলেখ্য এই ধর্মের ইতিহাসে পাওয়া যায় না, শুধুমাত্র New testament-এর কিছু কিছু খণ্ড-কাব্য ছাড়া যা শুধুমাত্র ধর্মীয় মন্ত্র ব্যতীত অন্য কিছু নয়। এই সমস্তু খণ্ড-কাব্য বা মন্ত্রগুলি আজও গোঁড়া খ্রিস্টানদের রক্ষণশীল চার্চে শোনা যায় সংগীতের আকারে, উদাহরণস্বরূপ জাগরণী মন্ত্র ‘Awake, awake O sleeper!’ গাওয়া হয়ে থাকে সদ্যোজাত শিশুকে আশীর্বাদকালে অথবা কাউকে ধর্মান্তরিত করার সময়। এছাড়াও আমরা উল্লেখ পাই Phos Hilaron-এর বিশেষ করে যা প্রগতি প্রার্থনায় (Matins)১২ পুরোনো চার্চগুলিতে শোনা যায়। এই বিশেষ মন্ত্রটি বর্ণনা দেয় দিনের প্রথম সূর্যালোকের। পুরাতন কিংবদন্তি অনুসারে যিশু এবং তার শিষ্যরা (ইহুদি পরিবারভুক্ত) এই ধর্মীয়- সংগীতটি মুখস্থ করে গাইতেন বলে মনে করা হয়। এই বিশেষ ধরনের মন্ত্রগুলিকে বলা হত ‘Psalms’. খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে খ্রিস্টানরা এই সমস্ত মন্ত্র (Psalms) গেয়ে গেয়ে জড়ো হত ইহুদি উপাসনার স্থানগুলিতে (synagogues)। আধুনিক গির্জা সংগীতের রূপকারদের মধ্যে টিম হিউজেম ও ম্যাট রেডম্যান প্রসিদ্ধ।

হিন্দুধর্ম

ধর্মীয় সংগীতের ইতিহাসে আরও এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। সনাতনি হিন্দুধর্মে ধর্মীয় সংগীত অসম্ভব বৈচিত্র্যপূর্ণ ও রঙিন। হিন্দু লোকাচারে ঘন্টাধবনি, শঙ্খধবনি, নাকাড়া, উলুধবনি, হাততালি, খঞ্জনী, গালবাদ্য, ডম্বরু নিনাদ ইত্যাদি উল্লেখনীয়। হিন্দু ধর্মীয় সংগীত মূলত অন্যান্য ধর্মের মতোই হিন্দুধর্ম অনুপ্রাণিত।১৩ এই বিশেষ ধর্মীয় সংগীতে হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সংগীত, কর্ণাটকী ও উত্তর ভারতীয় শাস্ত্রীয় গীতি, কীর্তন, ভজন, অংগীরা, ভাওয়াই, টুসু, ভাদু ইত্যাদির উল্লেখ পাওয়া যায়। হিন্দুধর্মে ‘সুফি’ সংগীত বা বাউল গান ও তর্জাগীতিও অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সপ্তদশ শতাব্দীতে ভক্তি আন্দোলনের পথ ধরে হিন্দুধর্মে ধর্মীয় সংগীতের এক বিশাল অভ্যুত্থান ঘটে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু, কবির, নানক ও দাদুর মতো ধর্মীয় গুরুদের পদাঙ্কনুসরণ করে। আজও সমগ্র ভারতবর্ষে (বিশেষত উত্তর ভারতে) ‘ওম জয় জগদীশ হরে’ ও ‘হরে রাম হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে’ জনপ্রিয়তার শীর্ষে। সাধারণত এটি স র গ ম প ধ ন অনুসারে গাওয়া হয়ে থাকে।

শিখধর্ম

এই ধর্ম মূলত কীর্তন প্রধান। শিখধর্মে বিশেষত শিখজাতির পবিত্র ধর্মগ্রন্থ শ্রীশ্রী গুরু আদিগ্রন্থ সাহেব থেকে উল্লেখিত পবিত্র স্তোত্র বা শ্লোকগুলিকে কীর্তনের আকারে গাওয়া হয়ে থাকে। এই সংগীতে প্রধানত হারমোনিয়াম, সেতার, তবলা, খঞ্জনী, মন্দিরার উল্লেখ পাওয়া যায়।১৪ সমস্ত শিখজাতির বিশেষ কর্তব্যের মধ্যে একটি এই কীর্তনসভায় সপরিবারে অংশগ্রহণ ও সাধ্যমতো তাকে গাওয়ার চেষ্টা। শিখধর্মে আরও একটি বিশেষ উল্লেখ মার্গ হচ্ছে ‘দাধি ভরণ’ যেখানে ‘ধাদ’ বা ‘ধার সারেঙ্গী’-র ব্যবহার হয়ে থাকে নামকীর্তনের মাধ্যমে শিখজাতির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস বর্ণনে।

ইহুদি বা জিউশধর্ম

খ্রিস্টীয় ধর্মের বা ধর্মীয় সংগীতের প্রচুর পূর্ব-ব্যবহার এই ধর্মে দেখা যায়। জেরুজালেমের পবিত্র মন্দিরগুলিতে ইহুদিদের ধর্মীয় সংগীতের বিকাশ লক্ষণীয়। উপাসনার গৃহে বা বিশেষ ধর্মীয় নির্দেশিত স্থানগুলিতে পবিত্র তালমুদ থেকে শ্লোক বা জিউশসংগীত, রচনা ও গাওয়া হয়ে থাকে। পবিত্র তালমুদ অনুসারে বিখ্যাত সাধক জাসুয়া বিন হানানিয়া বা হানিয়া, যিনি পবিত্র ‘লেভির’ বংশধর ও ইহুদি যাজকশ্রেণির চারণকবিদের অন্যতম, ইহুদিদের পথনির্দেশ করেছেন কীভাবে সমবেত সংগীতকারের দল উপাসনার স্থানে জড়ো হয়ে ইহুদিদের মঙ্গলার্থে সংগীতসাধনা করেছেন (তালমুদ, সুক 53A)।১৫ রাখালিয়া সংগীত (Shepherdic music) জিউশ ধর্মের অন্যতম বৈশিষ্ট্য, বিশেষত স্প্যানিশ জিউশদের বা মধ্যযুগীয় স্পেন-এ বিস্তার লাভ করে ও পরবর্তীকালে রাজসভাতেও পরিবেশিত হয়। তখন থেকেই এটি স্পেন, মরক্কো, আর্জেন্টিনা, তুরস্ক (পারস্য) ও গ্রিসে জনপ্রিয়তার শিখর ছোঁয়। এই রাখালিয়া বা ‘Jewish Shepherdic Song’কে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়, যা হল—আনন্দ ও বীরগাঁথা, প্রেমরস সংগীত এবং আধ্যাত্মিক সংগীত। বহু ভাষায় এর চর্চা হলেও মূলত হিব্রু ও লাতিনেই সর্বজনবিদিত।

ইসলামধর্ম

ধর্মীয় সংগীতের আরও এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ইসলামিক সংগীত মূলত মুসলিম ধর্মীয় সংগীত যা মূলত প্রকাশ্য জনসভায় বা মাজার-দরগা ও ইদগাহ (মসজিদ)-তে গাওয়া হয়ে থাকে। ইসলামের মূল কেন্দ্রবিন্দু আরব, মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, মিশর, ইরান, মধ্য এশিয়া, ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে। আল-ফারিবী বিরচিত কিতাব আল মিউজিক-আল কবীর (১০ম শতাব্দী) অনুসারে ফজর থেকে ঈশা এই পাঁচ রোজের নামাজে যে আজান দেওয়া হয় তা সম্পূর্ণ শাস্ত্রীয় সংগীত নির্ভর। এছাড়াও ইসলামি সংগীতে ‘হমদ-এ-খুদা’ ও ‘নাদ-এ-রসুল’-এর পরিচয় পাওয়া যায় যা মূলত শ্রেষ্ঠ পয়গম্বর হজরত মহম্মদের স্তুতিগাথা। এছাড়াও এখানে সবচেয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ অধ্যায় হচ্ছে ইসলামি ‘সুফি’ সংগীত বা আধ্যাত্মিক সংগীত। মূলত খাদিম, পীর, দরবেশ জাতীয় ফকির শ্রেণির সাধকেরা এই সংগীতের প্রবক্তা।১৬ এছাড়াও এতে পাওয়া যায় ‘কাসিদা’ বা ‘কওয়াসিদা’ নামক কাব্যরূপের কথা, যা সর্বশক্তিমান আল্লার উদ্দেশ্যে গাওয়া ও পাঠ করা হয়ে থাকে। এটি চার ধরনের : ১. হমদ (মন্ত্র), ২. নত (মহম্মদের কৃপা যাচঞা করে রচিত),৩. মনকাবাত (সুফি ও অন্যান্য সাধকদের উদ্দেশ্যে স্তুতি) এবং ৪. মদাহ (শ্রদ্ধেয়দের প্রতি আদাব জানানো)।১৭ এখানে আরও দুটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সাংগীতিক রূপ আমরা পাই, কাওয়ালি এবং গজল। সাধারণ লোকে মনে করে থাকেন ইসলামে সংগীত নিষিদ্ধ (পবিত্র কোরান অনুসারে)। আশা করি সে ধারণা এবার ভাঙবে।

বৌদ্ধধর্ম

বৌদ্ধসংগীত বা বৌদ্ধিক ধর্মীয় সংগীত আরও এক চিরস্মরণীয় অবস্থান। সাধারণত এই সংগীত বৌদ্ধদর্শন অনুপ্রাণিত ও বৌদ্ধকলার এক অনিবার্য অঙ্গ। এই ধর্মে সাংগীতিক ভাবধারণা শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্করের সাহচর্যে লালিত হয়। প্রথম প্রথম বৌদ্ধসংগীত বৌদ্ধ সংঘগুলিতেই গীত হত। গাওয়া হত পালি-সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষায় জাতক ও ত্রিপিটক-এর নির্বাচিত অংশ নিয়ে। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের নিয়মিত সাংগীতিক চর্চায় থাকতে হত। এতে আমরা উল্লেখ পাই ‘হনকিওকু’ (Honkyoku)-র যা ‘শাকুহাচি’ বা ‘হোচিকু’ সংগীতের অন্তর্গত এবং জাপানি জেন সন্ন্যাসীদের দ্বারা গাওয়া হত—যাঁদের বলা হয় ‘কোমুসো’১৮ (kyomuso)। এই ‘কোমুসো’-রা ত্রয়োদশ শতাব্দীর গোড়ায় ‘হনকিউকু’ চর্চা শুরু করে বোধি বা জ্ঞানের আশায়। এরপর জেন সংগীতে প্রভূত পরিবর্তন আসে। নির্মাণ হয় ‘হাইকু’ নামক ত্রিপদী-পদ্যের যা গাওয়াও হয়ে থাকে তিববতে।১৯ বৌদ্ধসংগীতে তন্ত্র- সাধনার উন্মেষ ঘটেছিল সপ্তদশ শতাব্দীর শেষে যা এই ধর্মীয় সংগীতকে আরো ভাবগম্ভীর দর্শনের আধার করে গড়ে তোলে। আজও এই সংগীত ভারত, নেপাল, ভুটান, চিন, জাপান ও মঙ্গোলিয়ায় সমাদৃত।

সামাজিক ধর্ম ও তার বিবর্তনের পথে সংগীতের যে মহান ভূমিকা তা এই আলোচনায় হয়তো কিছুটা উপলব্ধি করা যায়। বিশ্বের এই প্রধান ধর্মগুলি ছাড়াও ধর্মীয় সংগীত অন্যান্য ধর্ম ও জাতীয়তাবাদেও তার স্বাক্ষর রেখেছে।২০ বিশ্বের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ধর্ম ও তার ধর্মীয়সংগীতের অবস্থান নিয়ে আমরা আলোচনায় যাব। কিন্তু যাওয়ার আগে এটা বলে রাখা দরকার : ধর্মের জন্য সংগীত বা সংগীতের জন্য ধর্ম—তা হয়তো আমাদের বিষয় নয়। বিস্ময় এবং বিষয় শুধু আমাদের মননে, যান্ত্রিক কোষে, ধর্মীয় সংস্কৃতির প্রভাব ও তার সাংগীতিক মাধুর্য থেকে আমাদের কতটা প্রাপ্তি—তা নিয়ে। আশা করি, কালের পথ ধরে হেঁটে একদিন এই সমস্যা বা বিতর্কেরও সমাধান হবে। এখন শুধু অপেক্ষা। ধর্মীয় চিন্তার রেশ মেখে আলোকোত্তীর্ণ সেই মোক্ষের পথে যেদিন শুনব কালের ঘন্টাধবনি।

***

সূত্রাবলি ও গ্রন্থপঞ্জি

সূত্রাবলি

প্রাককথন
 আলাপ ও বিস্তার

১. Penelope Murray and Peter Wilson (2004) ; Music and the Muses ; The Culture of Mousike in Classical Athenian City, OUP, 978–0199242399, p.5

২. Samuet Fleischacker (1997) ; Integrity and Oral Relativism : Philosophy of history and Culture, Brill Academic Press, 978–9004095267, p. 128

৩. Brian Fagan (2010) ; The Cro-Magnon, Bloomsbury, Bloomsbury press, 978–1596915824 ; p. 85

৪. N. Ramanathan (1997), Sruti in Ancient, Medieval and Modern Context, (available at www.musicresearch.in), p. 32

৫. N.K. Sanders (1972), Introduction to the Epic of Gilgamesh, Penguin, p. 16

৬. Jahn Taylor (2010) ; Ancient Egyptian Book of the Dead, British Museum Press, London, 978–0714119939, p. 7

৭. Karol Weaver (1994), A Popular Dictionary of Hinduism, Curzon Press, 0700710493, p. 24

৮. Prof. Sayed Hussein Nassir and Prof. Mehdi Aminrazavi (2007) ; An Anthology of Phiosophy in Prersia, Vol 1, I, B. Tauris, p. 135

৯. Richard O’ Nidel, World Music : The Basics, Routledge, pp. 219-222

১০. Ibid, p. 237

১১. Ibid, p. 249

১২. Raj. Anand Krishna (1998), Sarangdeva and His Sangit-ratnakara, New Delhi, Sangeet Natak Academy, pp. 25–36

১৩. বীরেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী (২০০৬) ; হিন্দুস্থানী সংগীতে তানসেনের স্থান, থীমা : কলকাতা ; পৃ. ১৩

১৪. তদেব, পৃ. ১৪

১৫. তদেব, পৃ. ১৬

১৬. Jean Jacques Nattiez (1990), Music and Discourse, Princeton University Press, 0691027145, pp. 48-55

১৭. Ibid, p. 62

১৮. কৃষ্ণরূপ চক্রবর্তী (১৯৯০), সুকুমার রায়ের আর্শ্চয জগৎ, আনন্দ পাবলিশার্স : কলকাতা, পৃ. ৩৩

১৯. Sri Chinmoy (1982), Sound and the Silence, part 2, Agni Press, Delhi, p. 67

২০. Ibid, p. 68

প্রেক্ষাপট
 ধর্মীয় সংগীত : সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, পর্যালোচনা

১. Graham Harvey (2000); Indigenous Religions : A Companion, Cassell: London and New York, p. 6

২. James George Frazer (2009) ; The Golden Bough, OUP, 9780199538829, p. 20

৩. William F. Ogburn and M. F. Nimkoff (1960), A Handbook of Sociology, Routledge and Kegan Paul, 9780710032553, p. 8

৪. S. Radhakrishnan (1969), Religion and Society, George Allen and Unwin, UK, p. 52

৫. Ibid, p. 101

৬. Upton Sinclair (2004) ; The Profits of Religion, Kessinger Pub, 97814167942268, p. 128

৭. S. Radhakrishnan (1923) ; Indian Philosophy-Vol 1, New Delhi, OUP, p. 66

৮. R.E. Hume (1921), The thirteen principles of Upanishads, OUP, Delhi, p. 23

৯. Peter B. Clarke (1993), The Religions of the World : Understanding in Lining Faiths, Marshall Edu. Ltd, USA, p. 131

১০. Ibid, p. 133

১১. VIv Broughton (1996), Too Close to Heaven : The Illustrated History of Gospel Music, Midnight Books, 1900516004, p. 87

১২. Ibid. p. 92

১৩. Carl T. Jackson (1994), Vedanta for the West, Indiana University Press, 025333098X, p. 134

১৪. Khushwant Singh (2006), The illustrated History of the Sikh, OUP, India, 9780195677478, pp. 47–53

১৫. Vilvel Pasternak (2003), The jewish Music Companion, Tara Publication, 9781928918240, p. 9

১৬. Amnon Shiloah (1995), Music in the world of Islam, Wayne State University Press, 0814325890, p. 44.

১৭. Ibid, p. 47

১৮. Corey Bell, (2006), Sounds of Dharma : Buddhism and Music, Buddha’s Light Pub, p. 63

১৯. Ibid, pp. 72–74

২০. Richard O’ Niel, The World Music : The Basic, Routledge, p. 39

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *