৬ষ্ঠ অধ্যায় – গঞ্জিকা-গীতি ও জিওনিজম : রাস্তাফারিয়ান ধর্মীয় সংগীত
সূচনা
পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন ধর্মীয় ও অতীন্দ্রিয়বাদের পুরোধা হল আফ্রিকার ‘রাস্তা’ বা ‘রাস্তাফারি’ বা ‘রাস্তাফারীয়’ ধর্ম। এই বিশেষ ধর্মীয় ভাবধারাটির উদ্ভব হয় জামাইকায় যা তৎকালীন ইথিওপিয়ান রাজা ‘হেইলে স্যেলসিও’১ সিনিয়রের তত্ত্বাবধানে ও পৃষ্ঠপোষকতায় বিস্তার লাভ করে। ‘প্রথম হেইলে স্যেলসিও’ অনেক রাস্তাফারিদের মতে ‘যাহ’ অথবা ‘যাহ রাস্তাফারি’ নামে পরিচিত হন যার অর্থ ‘ঐশ্বরিক আবির্ভাব’ বা ‘ঈশ্বরের মানবসংস্করণ’। অত্যন্ত জনপ্রিয় এই রাজার অকৃত্রিম পৃষ্ঠপোষকতায় ‘রাস্তাফারি’-র বিকাশ ঘটে। ‘হেইলে স্যেলসিও’কে খ্রিস্টধর্মের সেই ‘পবিত্র ত্রিত্ববাদ’-এর২ (Holy trinity) অংশরূপেও কল্পনা করা হয় যেখানে বাইবেল নির্দেশিত সেই ‘মসিহা’ বা ‘রক্ষাকর্তা’র কথা বলা হয়েছে যিনি মানবজীবনের কল্যাণসাধনের জন্য ফিরে আসবেন পৃথিবীতে।
‘রাস্তাফারি’ ধর্মের অন্যান্য প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হল—গঞ্জিকা বা গাঁজা৩ (cannabis) সেবনের মাধ্যমে আধ্যাত্মিকচর্চা, প্রাচ্যের ভাবাদর্শকে অস্বীকার, ঔপনিবেশিক আফ্রিকার রাজনৈতিক ও সমাজতান্ত্রিক চেতনা এবং ধর্মীয় আত্মীকরণের এক নতুন বিশ্বদর্শন। এই ধর্মই আফ্রিকাকে এক বিশেষ ‘চিহ্নিত স্থান’-রূপে বিবেচনা করে যেখানে প্রথম মানবজাতির উন্মেষ ও কালো মানুষদের মধ্যে স্ব-অধীনতার জাগরণ নির্দেশ করা হয়।
‘রাস্তাফারি’ শব্দটি প্রথম পাওয়া যায় ‘রাস’ বা প্রধান এবং ‘তাফারি’ বিখ্যাত চিন্তাবিদ ও শাসক হেইলে স্যেলসিও’-র পূর্ব উপাধি থেকে। মূলত এটি প্রাচীন জামাইকান ভাষা-রূপ।
অন্তর্দর্শন ও মতবাদ : আফ্রিকা মহাদেশের এই বিশেষ বৈচিত্র্যপূর্ণ ধর্মটির সামাজিক বৈশিষ্ট্য, রীতিনীতি ও ভাবাদর্শ রীতিমতো উল্লেখনীয়। এই ধর্মের অর্থাৎ ‘রাস্তাফারি’-র অন্তর্দর্শন ও বিভিন্ন মতবাদ নিয়ে আলোচনা করা হল :
১. যাহ (Jah)
রাস্তাফারি ধর্মাবলম্বীরা মূলত একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী যাদের এঁরা ‘যাহ’৪ (Jah) বলে সম্বোধিত করেন। খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের মতো ‘রাস্তা’-রাও বিশেষভাবে মনে করে থাকেন যে ‘যাহ’ রা মূলত ‘পবিত্র ত্রিত্ববাদে’-র (Holy trinity) অংশ যেখানে ঈশ্বরকে পিতা, পুত্র এবং পবিত্র আত্মা এই তিন সমন্বয়ে সাধিত বলে মনে করা হয়। ‘রাস্তা’রা বিশ্বাস করেন যে ‘যাহ’, মূলত পবিত্র আত্মার সমন্বয় সাধনকালে এঁরা মানবজাতির মধ্যে বসবাস করে। এক্ষেত্রে অনেকাংশে এঁরা ‘আমিই সে’ (সংস্কৃতে ‘সোহম’) এই রূপে নানাবিধ আচার-আচারিদের মাধ্যমে নিজেদের গঠিত করেন। এঁরা বিশেষরূপে খ্রিস্টীয় ধর্মাবলম্বীদের তত্ত্ব মেনে চলে যেখানে ঈশ্বর ধরাধামে প্রকট হয়েছেন যিশু খ্রিস্ট নামে মানবজাতির কল্যাণসাধনের জন্য। তাঁরা এটাও মনে করেন ব্যাবিলনের উত্থানের ফলে এই রাস্তাফারীয় ধর্মটির আংশিক মান কমেছে। এঁরা আবার মনে করে থাকেন ‘শব্দ বা ধবনি হল প্রকৃত সাংস্কৃতিক শক্তির আধার’। ‘যাহ’ শব্দটি আবার হিব্রুতে ‘য়সুহা’৫ ও আমহারিকে ‘লিয়েসাস’ নামেও পরিচিত। ‘রাস্তা’ বা ‘রাসতাফারি’য়ানদের বিশেষ ও সাধারণ অন্তর্দর্শনটি হল যে ‘যাহ’, উদ্ধারকর্তা (মসীহা)৬ অথবা খ্রিস্ট পুনরায় ফিরে আসবেন এবং এইবার ইথিওপিয়ান রাজা ‘হেইলে সেলাসিও’র রূপে বিরাজিত হবেন। এঁরা এখনও এই ভাবাদর্শের ওপর বেঁচে থাকেন। বেঁচে থাকেন স্বধর্ম শাসন ও ধর্মীয় আচার-আচারিদের সক্রিয়তায়।
২. পবিত্র ত্রিতত্ত্ববাদ (Holy trinity)
রাস্তাফারীয় মতবাদ খ্রিস্টীয় ‘পবিত্র ত্রিত্ববাদে’-র মূলক ধারক ও বাহক। তাঁদের মতে ‘হেইলে স্যেলসিও’৭ শব্দটি এই পবিত্র ত্রিতত্ত্ববাদের মূল ভাববাদের ছায়াসঙ্গী। বহু রাস্তাফারিয়ানদের মতানুযায়ী প্রথম হেইলে সেলাসিও বস্তুত ঈশ্বরের পিতৃ, সন্তান ও পবিত্র আত্মার মতাদর্শকে একই সূত্রে বাঁধেন ও চিন্তাধারার বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেন।
৩. যিশু খ্রিস্ট (Christ)
এই বিশেষ ধর্মাবলম্বী মানুষেরা, খ্রিস্টানদের মতোই মনে করেন যে যিশু খ্রিস্ট আসলে পৃথিবীতে ঈশ্বরের পুনর্জন্ম (ঈশ্বরের সন্তান বা অভিপ্রেত দূত নয়) ছাড়া অন্য কিছু নন। এঁরা বিশ্বাস করেন প্রভু যিশুর হাত ধরেই ‘যাহ’-রা প্রথম মানবধর্ম বিকাশের পাঠ গ্রহণ করেন পরে যা ব্যাবিলনের উত্থান ও ভাবাদর্শ দ্বারা বিক্ষিপ্ত হয়। ফলে পৃথিবীতে প্রভু যিশুর পুনরাগমনের লক্ষণ আরও একবার পুনর্গঠিত হয়। রাস্তাফারিয়নরা বিশ্বাস করেন পবিত্র হেইলে সেলাসি’-র মাধ্যমে এই ভবিষ্যদবাণী পরিপুষ্ট হবে। এঁরা আরও বিশ্বাস করেন যে প্রভু যিশু আসলে নিগ্রো ও নেগ্রিটো (Black)৮ বা কালো মানুষদের প্রতিনিধি যিনি ‘সাদা চামড়ার’ সমাজে অজ্ঞানতাবশত তাদের প্রতিনিধি হিসেবে পরিচিত। এই ভ্রান্তি আফ্রিকার কালো মানুষদের সত্যতা ও মূল পরিচয় থেকে বঞ্চিত করে। আজও এই মতাদর্শ নিয়ে রাস্তাফারিয়ানদের সঙ্গে খ্রিস্টান ক্যাথলিক চার্চের মতানৈক্য বিদ্যমান।
৪. হ্যেইলে স্যেলসিও
ইথিওপিয়ার প্রবাদপ্রতিম সম্রাট হ্যেইলে স্যেলসিও (১৮৯২ – ১৯৭৫ খ্রি.) দীর্ঘ ৪৪ বছর (১৯৯০ – ১৯৭৪) ইথিওপিয়ায় রাজত্ব করেন। রাস্তাফারিয় ধর্ম্বাবলম্বীরা এঁকে প্রভু যিশুর পুনর্জন্মের স্বরূপ বলে মনে করেন এবং মনে করেন এঁর থেকেই ‘যাহ’ দের সৃষ্টি। এঁরা বিশ্বাস করেন এই সম্রাটের হাত ধরেই একদিন ‘প্রকৃত’ পৃথিবী এই মর্ত্যে নেমে আসবে যাকে ‘জিওন’৯ বলা হয়। রাস্তাফারিয়ানরা মনে করেন এই বিখ্যাত সম্রাটের আবির্ভাব বাইবেলের মূলখণ্ডে বহুপূর্বেই উল্লেখিত এবং এঁর রাজ্যাভিষেকে বাইবেলে পূর্ব নির্দেশিত উপাধি ‘রাজার রাজা’ বা ‘ঈশ্বরের নির্বাচিত’ ইত্যাদি এঁকেই প্রদান করা হয়। ‘রাস্তাফারি’ নামকরণটি এঁর নাম থেকেই পাওয়া যায়। রাস্তাফারিয়ানরা বিশ্বাস করেন ঈশ্বরের মৃত্যু নেই,১০ এবং ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে হ্যেইলে স্যেলসির তথাকথিত মৃত্যুও একটি বিবর্তন ছাড়া আর কিছুই নয়। রাস্তাফারিয়ানদের মতে প্রথম সেলাসীই তাদের ভগবান, রাজা ও পথপ্রদর্শক। এঁর সাম্রাজ্যেই আফ্রিকায় ধর্মীয় ভাবধারা, খ্রিস্টীয় দর্শন ও জাতীয়তাবাদের তুমুল জনজোয়ারের আবির্ভাব ঘটে যা আফ্রিকার কালো মানুষদের ঐক্যবদ্ধ করে এক আলোকোজ্জ্বল ও সমৃদ্ধিপূর্ণ ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। এই বিশেষ ধর্মীয় সাম্রাজ্যের আড়াইশো বছরের ইতিহাসে আজও ইথিওপিয়ায় সেলাসি সাম্রাজ্যের প্রভূত উন্নতি ও বিস্তার দেখা যায় এবং এই সাম্রাজ্যে জনকরূপে বাইবেলের সময়কার রাজা সলোমন ও রানি শিবা আজও এদেশে বিশেষ শ্রদ্ধেয় ও সমাদৃত হয়ে থাকেন। ইথিওপিয়ার জাতীয় মহাকাব্য কেবরা নেগাস্ত (Kebra Negast)১১ অনুসারে পূর্ব উল্লেখিত তথ্যের পাশাপাশি পাওয়া যায় ‘রাস্তাফারীয়’-দের সঙ্গে আধুনিক পাশ্চাত্য সমাজের মতানৈক্য ও বৈপরীত্যের প্রসঙ্গ। ইথিওপিয়ায় এই বিশেষ ধর্মীয়গ্রন্থ অনুসারে ‘যাহ’ উল্লেখিত ‘রাস্তা’ দের সেই পবিত্র ও কাঙিক্ষত ভূমিটি হল মাউন্ট জিওন পর্বত। এই ‘নির্বান ভূমি’-র সন্ধান বা একে লাভ করতে হলে ‘রাস্তা’-দের অবশ্যই আধুনিক পাশ্চাত্য সমাজের আধুনিকীকরণ, হিংসা-বিদ্বেষ ও লোভ-লালসার দুনিয়াকে উপেক্ষা করতে হবে যা ‘ব্যাবিলন’ নামে পরিচিত এবং যা অত্যন্ত কলুষিত। বাইবেলে উল্লেখিত রাজা নিমরো-র১২ (King Nimroh) সময় থেকেই ‘ব্যাবিলন’-কে পৃথিবীর ‘প্রকৃত ও কাঙ্ক্ষিত শাসক’ (যাহ) শ্রেণির বিরোধিতা করতে দেখা যায়। ফলস্বরূপ ‘রাস্তাফারিয়ান’রা এই বিশেষ পাশ্চাত্য সমাজটিকে সযত্নে বিরোধিতার সঙ্গে এড়িয়ে চলে। বিখ্যাত সংগীতকার যেমন বব মার্লে, দামিয়ন মার্ল, বেন হার্নার ও লরেন হিল ইত্যাদির গানেও এই ‘জিওনবাদ’-এর প্রভূত ব্যাপ্তি ও সমৃদ্ধির কথা শুনতে পাওয়া যায়।
৫. অ্যাফ্রোসেন্ট্রিজম ও কালো মানুষের গর্ব
রাস্তাফারি-ধর্মের অন্যতম মূল উদ্দেশ্য আফ্রিকার প্রাচীন সংস্কৃতি, ভাবাদর্শ ও কালো মানুষের হৃতগৌরব পুনরুদ্ধার করা। এদের মতে আফ্রিকায়, মূলত ইথিওপিয়ায়, একদিন ভূস্বর্গের বা ‘জিওন’-এর আবির্ভাব ঘটবে এবং সেই পবিত্র স্থানে আফ্রিকার সুপ্রাচীন আদর্শ ধর্মসংস্কৃতি, ধর্মীয় মতাদর্শ ও শিল্পসংস্কৃতির গৌরব ফিরে আসবে যা একদা ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে লুণ্ঠিত হয়েছিল। এদের দৃঢ় বিশ্বাস এই ‘মহা আগমন’-এর পথ ধরেই সাদা চামড়ার লোকেদের আধিপত্য ও ভুয়োধর্মাচারণের পরিসমাপ্তি ঘটবে। পরিসমাপ্তি ঘটবে কালো মানুষদের উপর পাশ্চাত্যের সাদা চামড়ার লোকেদের মালিকানা। পরিসমাপ্তি ঘটবে অভাব-অনটন, দুঃখ-দুর্দশা, দাসত্বের ইতিহাসের। প্রাচীন আফ্রিকার সমাজ-সংস্কৃতির হৃতগৌরব এভাবেই একদিন ফিরে আসবে অ্যাফ্রোসেন্ট্রিসিজমের১৩ পথ ধরে, যার মূলে আফ্রিকার প্রাচীন ধর্মীয় সামাজিক রীতিনীতি, ভাবাদর্শ, ও প্রগতিশীল চেতনার। জাতিবর্ণধর্ম বিদ্বেষ ও পরাধীনতার জাল ছিঁড়ে আফ্রিকা সেদিন আবার বিশ্ব দরবারে স্বমহিমায় উপস্থিত হবে। এর চাইতে কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন আফ্রিকার মানুষদের আর কিই-বা হতে পারে?
উৎসব বা পার্বণ
রাস্তাফারিয়ান ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে মূলত দু-প্রকারের ধর্মীয় উৎসব দেখতে পাওয়া যায়, যা হল :
১. ধর্মীয় জমায়েত (Reasoning)
ধর্মীয় জমায়েত ‘রাস্তাফারি’-দের একটি সাধারণ অনুষ্ঠান যেখানে ‘রাস্তা’ ধর্মাবলম্বীরা একত্রিত হন, ক্যানাবিস বা গঞ্জিকা সেবন করেন এবং ধর্ম, সমাজ, রাজনীতি ও অতীন্দ্রিয় নিয়ে নানান আলোচনায় নিমগ্ন হন। যিনি এই সভার পৃষ্ঠপোষকতা করেন সেই ‘রাস্তা’-কে একটি ছোটো ধর্মীয় স্তুতিপাঠ বা গানের মাধ্যমে গাঁজার ছিলিমে সুদীর্ঘ টান মেরে এই আলোচনার সূচনা করতে হয়। আলোচনা চলাকালীন বা তার শেষে বাইবেল ও কেবরা নেগাস্ত থেকে নানান অধ্যায় সংগীতের১৪ মাধ্যমে পাঠ করা হয়ে থাকে (যা মূলত আফ্রিকার প্রাচীন লোকসংগীতের রূপ) এবং গাঁজার ধূমপানের মধ্যে দিয়ে এই আলোচনাকে আরও সমৃদ্ধ করা হয়। ইথিওপিয়া, আদ্দিস আবাবা ও জামাইকার নানান স্থানে এই প্রকার ধর্মীয় রীতিনীতি ও সংগীতের প্রচলন আজও বহুলাংশে দেখা যায়।
২. আল বিঙিঘ (Grounation)
আল বিঙিঘ আসলে একটি পবিত্র ধর্মীয় দিন যা রাস্তাফারি ধর্মাবলম্বীরা বহুদিন ধরে পালন করেন। ‘বিঙিঘ’ নামকরণটি মূলত প্রাচীন আফ্রিকান ‘নিয়াবিঙিঘ’১৫ থেকে জাত যা মূলত একটি প্রাচীন অধুনালুপ্ত ধর্মীয় লোকাচার। ‘বিঙিঘ’-রা মূলত নাচ, গান, মোচ্ছব, গঞ্জিকা সেবন-এর মাধ্যমে এই প্রাচীন ধর্মীয় রীতিনীতির পালন করে থাকে। ‘বিঙিঘ’রা নানান ধর্মীয় লোকসংগীত চারণের মাধ্যমে ও ছিলিমে অগ্নিসংযোগের প্রাকমুহূর্তে নানান ধর্মীয় আচার-আচরণের মধ্য দিয়ে এই প্রথার সূচনা করে থাকেন। প্রাচীন আফ্রিকায় মূলত প্রধান ছয়-দিন। যেমন—জানুয়ারি ৭ তারিখ (ইথিওপিয়ান ক্রিসমাস), ফেব্রুয়ারি ৭ তারিখ (ইথিওপিয়ান নববর্ষ), এপ্রিল ২১ তারিখ (সম্রাট হেইল স্যেলাসি ১ম-র জামাইকায় আগমন), জুলাই ২৩ তারিখ (সম্রাট হেইল স্যেলাসির জন্মতিথি), আগস্ট ১৭ তারিখ (মার্কাস গাভের জন্মতিথি ও নভেম্বর ২ তারিখ (সম্রাট হেইল স্যেলাসির রাজ্যাভিষেক)-এ এই উৎসব পালিত হয়। সাধারণত রাস্তাফারিরা কোনোদিন কোনো চার্চে বা ঈশ্বরের মন্দিরে যেতে আগ্রহী নয় কারণ এঁরা বিশ্বাস করেন মানবশরীরের মধ্যেই ঈশ্বরের প্রকাশ তাই তাকে আলাদা করে কোনো মন্দিরে বা চার্চে প্রতিস্থাপন করা অসম্ভব। রাস্তাফারি ধর্মালম্বীদের এই ধরনের অনন্যসাধারণ ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি ও ধর্মীয় মতবাদ তাদের অন্যান্য ধর্ম থেকে স্বতন্ত্র করে তোলে। রাস্তাফারীয় সংগীত ধর্মীয় সংগীত-এর অনবদ্য এক অধ্যায় যা প্রাচীন আফ্রিকার গৌরবমণ্ডিত সভ্যতা ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহকরূপে চিহ্নিত হয়ে থাকে।
ধর্মীয় সংগীত
সংগীত বা ধর্মীয় সংগীতের এক বিশাল প্রভাব দেখতে পাওয়া যায় রাস্তাফারীয়দের মধ্যে। রাস্তাফারিয়ান ধর্মীয় সংগীত মূলত আফ্রিকার প্রাচীন লোকসংস্কৃতির এক উজ্জ্বল নিদর্শন যা শুধুমাত্র ধর্মীয় চেতনার উন্মেষই ঘটায় না বরং এই বিশেষ ধর্মীয় আন্দোলনের ভাবধারা, মতাদর্শ ও আফ্রিকার আর্থ-সামাজিক সংস্কৃতির মূলধারাকেও প্রকাশ করে থাকে।
রাস্তাফারিয়ান ধর্মীয় সংগীত পৃথিবীর প্রাচীন আদিবাসী লোকসংগীত। এই ধর্মীয় সংগীত বিশেষত নানান ধরনের হয়ে থাকে, যার মধ্যে—’কুমিনা’, ‘নিয়াবিঙিঘ’, ‘মেন্টো’, ‘স্কা’, ‘রেগে’, ‘ডাব’, ‘রাগামাফিন’১৬ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে ‘নিয়াবিঙ্গি’ ও ‘রেগে’ প্রাচীন আফ্রিকা তথা আধুনিক আফ্রিকান সমাজে বিশেষ জনপ্রিয়।
১. নিয়াবিঙ্গি
‘নিয়াবিঙিঘ’ মূলত এক প্রকার প্রাচীন ধর্মীয়স্তুতি যা রাস্তাফারিয়ানদের নানান পুজা-পার্বণে ব্যবহৃত হয়। এই বিশেষ ধর্মীয় সংগীতে বাদ্যযন্ত্র (drumning), স্তুতিপদ, আদিবাসী নৃত্যশৈলী বর্তমান। ‘নিয়াবিঙিঘ’-তে এ ছাড়াও নানান প্রার্থনাসংগীত ও গঞ্জিকা সেবনের প্রচলন আছে। প্রাচীন রাস্তাফারীয়দের ধর্মীয় জমায়েতে নানা প্রকার প্রার্থনা, বাদ্যযন্ত্রের পাশাপাশি প্রাচীন নৃত্যশৈলী, প্রাচীন স্তব ও নানান প্রকার ও প্রাচীন জনসংগীতের ভাবধারা বিশেষ পরিলক্ষিত। ‘নিয়াবিঙিঘ’ এরই একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
১৮৫০ থেকে ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ‘নিয়াবিঙিঘ’১৭-র প্রচলন দেখতে পাওয়া যায়। ‘নিয়াবিঙিঘ’ একটি প্রাচীন আদিবাসী ধর্মীয় সংগীত। এই ‘নিয়াবিঙিঘ’ শুধুমাত্র ধর্মীয় ভাবধারার প্রকাশ করে না বরং প্রাচীন রাস্তাফারীয়দের উত্থান তার ক্রমবিকাশ, উন্নতিসাধন, পাশ্চাত্য সভ্যতার সাথে তুলনামূলক বৈচিত্র্যের নানান দিক এখানে চর্চিত হয়। ‘নিয়াবিঙিঘ’ সংগীতে ড্রাম বা চামড়ার বাদ্যযন্ত্রের এক সপ্রতিভ ভূমিকা লক্ষণীয়। রাস্তাফারীয়ানরা মনে করেন ‘পবিত্র যাহ’-দের আত্মা ওই বাদ্যযন্ত্রে সমাদৃত। বাদ্যযন্ত্রের এই বিশেষ মতালোকে আর এক বিশেষ চামড়ার বাদ্যযন্ত্রের অধ্যায় যা ‘বুড়ু’ নামে বিখ্যাত জামাইকা ও ইথিওপিয়ার প্রান্তর সীমান্তে। এই অপ্রচলিত বাদ্যযন্ত্রের ধারাটি পরবর্তীকালে আধুনিক জামাইকান সংগীতকার ‘কাউন্ট ওসি’র১৮ সাহচর্যে পুনরাবিষ্কৃত হয়। প্রাচীন এই বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার ‘নিয়াবিঙিঘ’ সংগীতেও বহুল পরিমাণে ব্যবহৃত হয়েছে।
ঔপনিবেশিক ও উত্তর ঔপনিবেশিক আফ্রিকার ধর্মীয় সংগীতে ‘নিয়াবিঙিঘ’র অবদান অসামান্য। পরবর্তী আধুনিক যুগে এর নানাবিধ বিবর্তন (যেমন— মেন্টো, জোকানো, Kumina) ঘটলেও আজও এই সংগীতের ধর্মীয় মাহাত্ম্য ও তার ব্যবহারিকরণ বিশেষভাবে বিশ্ব সংগীতের আসরে সমাদৃত। আফ্রো-ক্যারিবিয়ান সংগীতে ধর্ম ও ধর্মীয় বাতাবরণের ঐতিহ্যে এই সকল সাংগীতিক রূপের অনবদ্য প্রভাব আজও চিরস্মরণীয়।
২. র্যেগে (Reggae)
প্রাচীন জামাইকার ‘র্যেগে’-র উৎপত্তি নিয়ে সংগীতজ্ঞদের মধ্যে নানান মতানৈক্য রয়েছে। এদের একশ্রেণির বক্তব্য প্রাচীন জামাইকান আদিবাসীদের ধর্মীয় ভাবধারার রূপান্তর এই ‘র্যেগে’, অন্যদিকে আরেক শ্রেণির পণ্ডিতরা একে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের অধীনে শোষিত, নিষ্পেষিত ও নিগৃহীত কালো মানুষদের স্বাধীনচেতনার বহিঃপ্রকাশ। মতভেদ যাই থাকুক না-কেন প্রাচীন জামাইকার এক ঐতিহ্যপূর্ণ সাংগীতিক বিবর্তনের আধুনিক নিদর্শন হল—’র্যেগে’।১৯ ‘র্যেগে’ বস্তুত রাস্তাফারিয়ান ধর্মীয় সংগীতের এক প্রধান অধ্যায় যা সনাতনি আফ্রিকান লোকসংগীত ও ধর্মীয় আচারের উত্তর-ঔপনিবেশিক রূপকল্প। ‘নিয়াবিঙিঘ’ সংগীতেও ‘র্যেগে’-র প্রভাব বিদ্যমান। এটি মূলত রাস্তাফারীয় ধর্মীয় স্তুতি-সংগীত ও ‘বিঙিঘ’ নাচ-গান ও বাদ্যযন্ত্রের এক অপরূপ মেলবন্ধন। একে অনেকে ethnic jamaican jazz form বলেও অভিহিত করে থাকেন।
সংগীতজ্ঞদের মতে প্রথম জামাইকান ‘র্যেগে’-র উল্লেখ পাওয়া যায় ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে লিটল রয়-এর ‘বঙ্গো ম্যান’২০ গানটিতে। অন্যান্য শিল্পীদের মধ্যে ‘রাস্তাফারিয়ান র্যেগে’-র বিভিন্ন উদাহরণ, যেমন—পিটার টশ, বানি ওয়হিটলার, প্রিন্স ফার ১, লিনভ্যাল থম্পসন প্রমুখের সংগীতে রাস্তাফারি ধর্মের নানান স্তুতি-সংগীতের উদাহরণ পাওয়া যায়। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত জ্যজ গায়ক বব মার্লের হাত ধরে র্যেগের আধুনিকীকরণের পথ চলা শুরু। ‘রাস্তাফণ চ্যান্টস’২১ এই গানটিতেও প্রথম ‘র্যেগে’-র ব্যবহার ও প্রয়োগ বিস্ময়কর। বব মার্লেই প্রথম আফ্রিকান সোশ্যালিজম, রাস্তাফারি ধর্মের ভাবচেতনা, ও জাতীয়তা-বাদের এক অসাধারণ মেলবন্ধন ঘটান। অন্যান্য বিখ্যাত রাস্তাফারিয়ান র্যেগে’ সংগীতকারদের মধ্যে পিটার টশ, ব্ল্যাক উহুরু, ফ্রেডি ম্যাক গ্রেগর, ডন কার্লোস, মাইকেল প্রফেট, ডেনিস ব্রাউন প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
মূলত সাংগীতিক ধারাগুলি বিভিন্ন ও বৈচিত্র্যপূর্ণ হলেও সেগুলি বিশেষত ‘যাহ’ সংস্কৃতি, রাস্তাফারীয় ধর্ম ও ধর্মীয় ভাবাদর্শকে উদবুদ্ধ করে, অনুপ্রাণিত করে। এটিই এর মূল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।
পরিশেষ
প্রাচীন আফ্রিকান ‘নিয়াবিঙিঘ’ থেকে বব র্মালের আধুনিক ‘রাস্তাফারিয়ান র্যেগে’ পর্যন্ত প্রাচীন আফ্রিকান ধর্মীয় সংগীতের এক উজ্জ্বল বিবর্তন। ভারতবর্ষের বাউল ও ইরানের সুফি সম্প্রদায়ের সঙ্গে বিশেষ মিলগত বৈশিষ্ট্যাবলির সঙ্গে সঙ্গে রাস্তাফারিয়ান ধর্মীয়সংগীত তার সাংগীতিক দর্শন-এর ভাবধারায় সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। জুডাইজম ও খ্রিস্টানধর্ম থেকে প্রবর্তিত এই নব্য ধর্মীয় সংগীত তার সাংগীতিক দর্শন-এর মাধ্যমে আজ বিশ্বের কাছে এক অনন্ত বিস্ময়। এই বিশেষ ধর্মীয় আন্দোলনটি ধর্মাচারণ অপেক্ষা এক নতুন জীবন দর্শনের আধাররূপে বেশি সমাদৃত। এটি এমনই এক ধর্মীয় মতাদর্শ যা সংগীত ও গঞ্জিকার আধ্যাত্মিক ব্যবহারের মাধ্যমে মোক্ষলাভের পথ নির্দেশ করে। যেখানে বস্তুবাদ, জড়বাদ তার ধর্মীয় বিবর্তনের মাধ্যমে রূপান্তরিত হয়ে থাকে অতীন্দ্রিয়বাদের সুগভীর ভাবসমাধিতে। আজও এই ধর্মীয় সংগীত শতাব্দীর পর শতাব্দী অসহায়, লোকসম্বন্ধহীন মানুষদের সাধনার পথ ধরে মুক্তির আলো দেখায়। এখানেই এর স্বতন্ত্র সার্থকতা। ‘নিয়াবিঙিঘ’, ‘র্যেগে’, ‘বাইবেল’, ‘জিওনিজম’, ‘গঞ্জিকা’ ও ‘কেগরা নেগাস্ত’-এর প্রেক্ষাপটে রচিত সেই অনবদ্য পৃথিবী যা স্বয়ং ঈশ্বরকে পুনরুজ্জীবন দান করেছিল।
***
৬ষ্ঠ অধ্যায়
গঞ্জিকা-গীতি ও জিওনিজম : রাস্তাফারিয়ান ধর্মীয় সংগীত
১. Stephan D. Glazier (2001) ; Encyclopaedia of African and Afro-American Religions, Routledge, 9780415922456, p. 263
২. Ibid, p. 271
৩. Ibid, pp. 273-275
৪. Nathaniel S. Murrell (1998) ; Chanting down babylon : The Rastafari Reader, Temple UP, 97811566 39847, p.95
৫. Ibid, p. 97
৬. Stephan D. Glazier, p. 278
৭. Jah Ahkell (1999); Rasta : Emperor Hailey Sellasie and the Rastafarians, Frontline, 97800948390012, p. 8
৮. Ibid, p. 14
৯. Ibid, p. 16
১০. Ibid, pp. 19-21
১১. Gerald Housman (2008) ; The Kebra Negast : Lost Bible of Rastafarian Wisdom, St. Martin’s Press, 97800312167936, p.9
১২. Ibid, p.12-13
১৩. Ibid, p. 126
১৪. Leonard E. Barrett (1997) ; The Rastafarians, Beacon Press, 9780807010396, p. 147
১৫. Ibid, p. 221
১৬. David Moskowitz (2005), Caribbean Popular Music : An Encyclopaedia, Greenwood, 9783133331589, p. 85
১৭. Ibid, p. 225
১৮. Ibid, pp. 231-233
১৯. Hank Bordowitz (2004), Every little thing gonna be alright : The Bob Marley Reader, DA Capo Press, 97800306813405, p. 45
২০. Ibid, p. 53
২১. Ibid, p. 126