২য় অধ্যায় – মহানির্বাণের সুর : বৌদ্ধ ধর্মীয় সংগীত এবং অন্যন্য

২য় অধ্যায় – মহানির্বাণের সুর : বৌদ্ধ ধর্মীয় সংগীত এবং অন্যন্য

ধর্মারোহণ

বৌদ্ধধর্মের জয়যাত্রার পুরোধা হলেন গৌতম বুদ্ধ বা সিদ্ধার্থ। গৌতমের জন্ম হয় খ্রিস্টপূর্ব ৫৬৩ অব্দের কাছাকাছি কোনো এক সময়ে। তার পিতা শুদ্ধোদন ছিলেন শাক্যবংশীয় রাজা। এছাড়াও বিনয়পিটক  ও বুদ্ধচর্যা থেকে জানা যায় ভদ্দীয় ও দন্তপানি নামক শাক্য রাজাদের কথা।

সিদ্ধার্থের জন্ম হয় কপিলাবস্তু থেকে কয়েক মাইল দূরে লুম্বিণী নামে এক শালবনে। সিদ্ধার্থের জন্মের ৩১৯ বছর পর আপন রাজ্যাভিষেকের বিংশতিবর্ষে সম্রাট অশোক এই স্থানে একটি প্রস্তরশিলা স্থাপন করেছিলেন যা আজও বর্তমান। জন্মের পরমুহূর্তে সিদ্ধার্থের মাতৃবিয়োগ ঘটলে মাসি গৌতমীর তত্ত্বাবধানে তিনি বড়ো হয়ে ওঠেন।

ছোটোবেলা থেকে সিদ্ধার্থকে সংসার-বিষয়ে উদাসীন এবং সর্বদা চিন্তামগ্ন থাকতে দেখে পিতা শুদ্ধোদন ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে সন্তান হারানোর ভয়ে প্রতিবেশী কোলীয় গণরাজ্যের কন্যা যশোধরার সঙ্গে পুত্রের বিয়ে দেন। তাদের একটি সন্তান হয়, যার নাম রাহুল।

বৃদ্ধ, পীড়িত, মৃত ও সন্ন্যাসী—এই চার দৃশ্য দেখে সিদ্ধার্থ সংসার সম্পর্কে আরো উদাসীন হয়ে পড়েন এবং একদিন গৃহত্যাগ করেন ‘মোক্ষ’-র সন্ধানে। বুদ্ধগয়ায় একটি পিপুলগাছের তলায় বসে ধ্যান করার সময় তিনি ‘বোধি’ লাভ করেন ও গৌতম বুদ্ধ নাম গ্রহণ করেন।

সিদ্ধার্থের এই জ্ঞানদর্শন ছিল :

দুঃখই দুঃখের কারণ, দুঃখের বিনাশ আছে ও দুঃখ নিরোধের পথও আছে।

যে ধর্ম বর্তমান তা সবই কোনো হেতু থেকে জাত এবং সেই হেতুরও বিনাশ আছে।

মহাশ্রমণের এটিই ছিল শ্রেষ্ঠ অভিমত।

গৌতম ২৯ বছর বয়সে গৃহত্যাগ করেন (৫৩৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে)। গভীর চিন্তনের মাধ্যমে ছত্রিশ বছর বয়সে তাঁর ‘বোধি’ লাভ হয় (৫২৮ খ্রিস্টপূর্বে) এবং বৌদ্ধধর্মের সূচনা ঘটে। এরপর ৪৫ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি তাঁর ধর্মের প্রচার সাধন করেন এবং ৪৮৩ খ্রিস্টপূর্বে আশি বছর বয়সে কুশীনগর নামক স্থানে তাঁর নির্বাণ ঘটে। সেই মুহূর্তের একশো বছরের মধ্যে ভারত, চিন, জাপান, শ্যামদেশ তথা অন্যান্য জায়গায় বৌদ্ধধর্মের বিকাশ লক্ষণীয় এবং আজও এই প্রভাব সমভাবে বর্তমান।

নেপথ্য সংগীত

বৌদ্ধধর্মের প্রতিস্থাপনের সময় থেকেই বৌদ্ধ ধর্মীয় সংগীতের উদ্ভব বলে পণ্ডিতেরা মনে করেন। বৌদ্ধ ধর্মীয় সংগীত মূলত বৌদ্ধশিক্ষা ও দর্শন—এই প্রধান দুটি অবলম্বনের ওপর দণ্ডায়মান। কালক্রমে এই ধর্মীয় সংগীতও বিভিন্ন ভাগে, যেমন শিন্টো ধর্মীয়, তাও ধর্মীয়, জেন ধর্মীয় ভাবধারায় উদবুদ্ধ হয় এবং এতে প্রচুর বিবর্তন পাওয়া যায়। এই বিশেষ সংগীত ভারতীয় দর্শনের প্রবহমান ধারার মধ্যে নব্য গবেষণা, নব্য আলোচনার ধারার সৃষ্টি করেছিল। তিববতীয় বৌদ্ধসংগীত এই ধারাকে আরও ভাবগম্ভীর ও কালোত্তীর্ণ করে তোলে। বৌদ্ধমন্ত্র, বৌদ্ধ পুথি অবলম্বিত এই বিশেষ ‘শাস্ত্রীয়’ সংগীত বৌদ্ধ দর্শনকে সমগ্র পৃথিবীর কাছে এক অনন্যসাধারণ রূপদান করে। বৌদ্ধকলা, ধর্ম ও দর্শনের এটি এক অসাধারণ মেলবন্ধন। প্রাচীনযুগ থেকে আধুনিক যুগধারায় যা আজও এক বিস্ময়কর সৃষ্টি।

বৌদ্ধধর্ম

খ্রিস্টপূর্ব ৪৭৮ অব্দ থেকেই বৌদ্ধধর্মের পাশাপাশি বৌদ্ধ সংগীতের বিকাশ। এই সংগীত পারতপক্ষে বৌদ্ধ দর্শন অনুপ্রাণিত এবং বৌদ্ধ শিল্পকলার এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এই প্রাচীন মন্ত্রগুলির উচ্চারণের মাধ্যমে গীতসংগীত মূলত বুদ্ধের চারটি মূল সিদ্ধান্তের প্রতিধবনি।

১. ঈশ্বরকে অস্বীকার করা (অন্যথায় মানুষ স্বয়ং নিজের প্রভু—এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করা হয়)

২. আত্মাকে নিত্য স্বীকার না-করা (অন্যথায় নিত্য একরকম মানলে তার পরিশুদ্ধি ও মুক্তি অসম্ভব)

৩. কোনো গ্রন্থকে মূল প্রামাণ্য হিসেবে স্বীকার না করা (অন্যথায় বুদ্ধিমত্তা ও অভিজ্ঞতা মূল্যহীন)

৪. জীবনপ্রবাহকে এই শরীরের মধ্যে সীমিত করা (অন্যথায় জীবন ও তার নানা বৈচিত্র্য কার্যকারণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উৎপন্ন না-হয়ে শুধুমাত্র এক আকস্মিক ঘটনারূপে প্রতিভাত হবে) কে প্রতিবিম্বিত করে।

বৌদ্ধ শিক্ষা, দর্শন ও সংগীত এই চার সিদ্ধান্তের উপর বিরাজমান। প্রথম তিনটি শিক্ষায় এটি বৌদ্ধধর্মকে অন্যান্য ধর্ম থেকে এবং চতুর্থটিতেবস্তুবাদ থেকে পৃথক করে। বৌদ্ধসংগীত এই চারটি ধারায় সুস্নাত হয়ে বৌদ্ধধর্মের দর্শনকে আলোকোত্তীর্ণ পথে পরিচালনা করে।

বৌদ্ধধর্মে তার সাংগীতিক ভাবধারা, মতানুসারে শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্করের মাধ্যমে বিকশিত হয়। প্রথম প্রথম এটি বৌদ্ধ সংঘ বা মঠগুলিতে গাওয়া হয়ে থাকত। বৌদ্ধ ধর্মীয় সংগীত গাওয়া হত পালি-সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষায় জাতক ও ত্রিপিটক-এর নির্বাচিত অংশ নিয়ে। বৌদ্ধ ভিক্ষুরাই মূলত এই গানগুলি গাইতেন বা প্রাচীন তারের যন্ত্রে তা বাজাতেন। তাদের একসময় নিয়মিত সাংগীতিক চর্চায় লিপ্ত থাকতে হত।

বৌদ্ধ ধর্মীয়সংগীত মূলত আমরা যেটি পাই তা হল—’হনকিওকু’ (Honkyoku)। এটি বৌদ্ধ সংগীতের একটি বিশেষ খণ্ডরূপ। ‘হনকিওকু’ আসলে ‘শাকুহাচি’ (Shaku hachi) বা ‘হোচিকু (Hochiku) সংগীতের অন্তর্গত। বিশেষত জাপানি জেন সন্ন্যাসীরা এইগুলি গাইতেন যাঁদের প্রচলিত নাম ‘কোমুসো’ (Kyomuso)। এই ‘কোমুসো’রাই ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ‘হনকিওকু’ চর্চা শুরু করেন পূর্ণব্রহ্ম বা বোধিলাভের আশায়। এর পরেই জেন ধর্মতেও সংগীতের আমূল পরিবর্তন আসে। সৃষ্টি হয় বৌদ্ধ ধর্মীয়সংগীত ও তার নবরূপীকরণ। নির্মাণ হয় ‘হাইকু’-র (Hyku) এবং এই ত্রিপদী পদ্যও কালক্রমে গোটা তিববতে প্রচলিত হয়। এরপরে সপ্তদশ শতাব্দীর শেষে (আনুমানিক) বৌদ্ধ সংগীতে তিববতি তান্ত্রিকধারার মূল প্রভাব লক্ষ করা যায় যা বৌদ্ধ ধর্মীয় আঙ্গিককে আরো ভাবগম্ভীর করে তোলে।

এরপরে অষ্টাদশ শতাব্দীতে আমরা উল্লেখ পাই কিনকো কুরাসাওয়ার (Kinko Kurasaur) যিনি কিনা ‘কোমুসো’ সম্প্রদায়ভুক্ত এবং যিনি সারা জাপান ঘুরে বেড়ান বহুবছর ধরে সেই বিশেষ সংগীত ‘হোচিকু’র সন্ধানে। বহুবছর ভ্রমণের পর ছত্রিশ রকমের ‘হোচিকু’র খণ্ডস্বরলিপি উদ্ধার করে আনেন তিনি। এগুলি সেই সন্ন্যাসীর নামানুসারে ‘কিনকো-রু-হনকিওকু’ নামে সর্বজনবিদিত হয়। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে বৌদ্ধ ধর্মীয়সংগীতের একটি বড়ো পর্যায় বৌদ্ধধর্মীয় মন্ত্র বা শ্লোকনির্ভর। বৌদ্ধ মন্ত্রগুলি বৌদ্ধ দর্শন ও ভাবধারায় অনুপ্রাণিত এবং নানান নামে বা বৈশিষ্ট্যে নানা জায়গায় সমৃদ্ধ, যেমন—

অমিতাভ নামের পুনরুচ্চারণে আদি বৌদ্ধ সংঘগুলিতে।

শৌম্য (Shomyo) নামে জাপানি তেনডাই (Tendai)১০ এবং সীঙ্গন (Shingon) বৌদ্ধধর্মে।

এটি বিশেষ গালবাদ্য ও ওঁঙ্কার ধবনিরূপে তিববতি বৌদ্ধধর্মে পরিচিত।

তিববতি বৌদ্ধধর্ম ও তার সংগীত সর্বাপেক্ষা বৃহৎ বৌদ্ধদর্শন ও সাংগীতিকরূপ হিসেবে তিববতে প্রতিষ্ঠিত। এর মধ্যে সুপ্রাচীন যন্ত্রসংগীত বিশেষত তারের যন্ত্র এবং সাতটি মুখওয়ালা বৃহৎ ‘শাকুহাসি’ বাঁশি তথা শঙ্খ এবং চামড়ার ড্রাম জাতীয় (নাকাড়া) বাদ্য বিদ্যমান। এই তিববতি সংগীত বেশির ভাগই প্রাচীন তিববতি-ব্রাহ্মী বা সংস্কৃতে পাওয়া যায়। এই শ্লোকগুলি অধিকাংশই জটিল, তত্ত্বসাপেক্ষ ও নানান ধর্মীয় উৎসবে গাওয়া হয়ে থাকে। এর মধ্যে ‘কিসিয়াং’ বা ‘ইয়াং’ মন্ত্রটি সময়সাপেক্ষে ব্যাপ্তি ও পরিধি বিস্তারে সক্ষম। অন্যান্য ঘরানাগুলির মধ্যে (তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মমতানুসারে) সনাতনি ‘গেলুপা’ (Gelugpa school), রোমান্টিক ‘নিংমাপা’ (Nyingmapa school) এবং ‘সাকোপা’ ও ‘কাওপা’তে বিভক্ত।১১ ‘সোম-ইয়া’ বা ‘শৌম্য’ ঘরানাতেও ‘ইয়োকোকু’ ও ‘রিকোওকু’ দ্রষ্টব্য।

শিন্টোধর্ম ও তার সংগীত

বৌদ্ধধর্ম পরবর্তী ও তার বহুলপ্রভাব বিজরিত এই ধর্ম মূলত জাপানে বিশেষ সমৃদ্ধ। আধুনিক জাপানের এক-তৃতীয়াংশ লোক এই শিন্টোধর্মাবলম্বী। এটি অষ্টম শতাব্দীতে জাপানে পরিচিতি লাভ করে। শিন্টো শব্দটি মূল চিনা শব্দ ‘শিনটাও’ (Shin-tao) অর্থাৎ ঈশ্বর বা মোক্ষলাভের পথ থেকে জাত। এর নামকরণই একে বৌদ্ধধর্ম থেকে সামান্য আলাদা করে দেয়। জাপানে এর আদিনাম ‘কামি-নো মিচি’ (kami-no-michi)।১২ প্রত্নতাত্ত্বিক ধর্মোৎসবের অঙ্গরূপেও এটি সর্বদা দর্শনের সনাতনী ভাবধারা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি থেকে একটু ভিন্ন। বিশেষত, শিন্টোধর্মের মূল প্রবক্তা—’ইয়ামাতো’ (Yamato) নামের একটি অতীন্দ্রিয় গোষ্ঠী, যারা বৌদ্ধধর্মের প্রভাব ও বৈশিষ্ট্যমুখী হয়েও একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাবধারা, বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক মতবাদে বিশ্বাস করত এবং এদেরই লেখনী দ্বারা এটি অষ্টম শতাব্দীতে সর্বজনবিদিত হয়। ধর্মশাসনের পাশাপাশি ইয়ামাতোরা অনেকেই স্বদেশশাসনে নিজেদের নিয়োজিত করেছিল যাদের আমরা ‘কোকুতাই শিন্টো’১৩ নামে জানি। এই ‘ইয়ামাতো’ গোষ্ঠী পদাঙ্কনুসরণ করেই শিন্টোর ধর্মীয় ইতিহাস প্রথম লেখা হয় এবং আজও এই সংগীত জাপান ছাড়াও অন্যান্য প্রতিবেশী দেশগুলিতে সমানভাবে সমাদৃত।

শিন্টোসংগীত হল মূলত শিন্টোধর্মের নানান উৎসবের সংগীত। শিন্টোধর্মীয় সংগীত বৌদ্ধধর্মের মতোই পুরাতনী সাংগীতিক ভাবধারায় উদবুদ্ধ। এটি আসলে ‘গাগাকু’ (Gagaku)-র একটি বিশেষ ভাগ, যেটি হল প্রাচীন জাপানি সংগীত ও নৃত্যকলার ভাণ্ডার। এছাড়াও শিন্টোসংগীতে পাওয়া যায় ‘কাগুরা’-র১৪ বৈশিষ্ট্যাবলি। ‘কাগুরা’ও প্রাচীন শিন্টো ধর্মীয়সংগীতের একটি মূল অধ্যায়, যার দুটি ভাগ :

১. মি-কাগুরা (Mi-kagura) যেটি সুপ্রাচীন শিন্টো ধর্মীয়সংগীতের অংশ

২. সাটো-কাগুরা (Sato-kagura) যেটি প্রাচীন শিন্টোসংগীত হলেও প্রাচীন ভাবধারামুক্ত।

এছাড়াও শিন্টো ধর্মীয়সংগীতে নানাবিধ যন্ত্রসংগীতের উপাদান লক্ষণীয়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল—’ফিউ’ (Fue) নামের একটি বিশেষ বাঁশি, ‘সুজুমি’ (Tsuzumi) নামের চামড়ার বাদ্যযন্ত্র। শিন্টো লোকসংগীতের মধ্যে অন্যতম হল ‘সাটোকাগুরা’ (Satokagura)।১৫ ‘তাইকো’ (Taiko) সংগীত এই ধর্মীয় সংগীতের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। বিখ্যাত ‘সাটো-কাগুরা’ যা কিনা প্রাচীন শিন্টোলোক-সংগীতের অংশ তা প্রথম প্রথম ‘ইয়ামাতো’ সন্ন্যাসীরা গেয়ে গেয়ে বেড়াতেন। পরবর্তীকালে এই সংগীতের পবিত্র দার্শনিক ভাবধারা, সহজধর্মিতা ও একমুখীকরণ জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় নেয়নি।

তাও বা ডাওধর্ম ও তার সংগীত

তাও বা ডাওধর্ম প্রাচীন চিনের সর্বাপেক্ষা বৃহৎ ধর্ম ও দার্শনিক মতবাদের নাম। এই ধর্মের প্রবর্তন ছয় খ্রিস্টপূর্বাব্দে বিখ্যাত ধর্মগুরু ‘লাও জু’র (Lao TZu) লেখা তাও তে চিং গ্রন্থের মাধ্যমে ঘটে। তাও তে চিং বিশেষত অতীন্দ্রিয় শক্তির পথপ্রদর্শক।১৬ তাও ধর্মের এই সুপ্রাচীন ধর্মগ্রন্থটি মূলত প্রাচীন প্রাকৃতিক শক্তি ও প্রকৃতির মধ্যে এক অভাবনীয় মেলবন্ধনের নজির। যেখানে ব্যক্তিবিশেষ তার আদিসত্তার নিকট ও তার প্রকৃতি মূল্যায়নে সক্ষম সেটিই তাও-এর মূল উৎস। এই ধর্ম মূলত বৌদ্ধ মতবাদ, কনফুসীয় দর্শন ও প্রাচীন চৈনিক অতীন্দ্রিয়বাদের যোগসূত্রধার।১৭ এই বিশেষ ধর্মীয় মতবাদে তাও তে চিং ছাড়াও ‘চুয়াং জু’, ‘লি জু’ ও ‘হুই নান জু’ যুগে যুগে এই বিশেষ ধর্মীয় চিন্তাধারাকে আরও উন্নত পর্যায়ে সংহত করেছে। ‘তাও’ বা ‘ডাওইজমের’ প্রকৃত ব্যাপ্তি ঘটে বিখ্যাত ‘হান’ সাম্রাজ্যের (২৩ – ২২০ খ্রি.)-এর শেষ ভাগে। এরা মূলত ‘পবিত্র ত্রয়ী’র উপাসক যারা স্বর্গ-মর্ত্য ও মানুষের অধীশ্বর।১৮

কনফুসীয় ভাবধারার উন্মেষ অনেকাংশে তাওইজমেও পরিলক্ষিত হয়। এই তাও সংগীত এরই পরিপূরক। তাও সংগীত তার ধর্মের মতোই যথেষ্ট প্রভাবশালী ও মানবমননে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থানের অধিকারী যা প্রাচ্য দর্শনের ইতিহাসে বৌদ্ধ সংগীতের ও মতবাদের সমসাময়িক। সংগীতের সাথে ‘তাও’ ধর্মের সম্পর্ক বহুদিনের এবং ধর্মীয় সংগীত হিসেবে এর ভূমিকা ও প্রভাবও লক্ষণীয়। ‘তাও’ বা ‘ডাও’ ধর্মীয় সংস্কৃতিতে সংগীতের ভূমিকা নানাবিধ। তাও ধর্মাবলম্বীরা মনে করেন সংগীতই হল ‘ঈশ্বরের সহিত কথোপকথনের’ একমাত্র মাধ্যম। এটি তাওধর্মাবলম্বীদের উৎসাহপ্রদানে, আত্মার অন্তরঙ্গ ধবনি শুনতে এবং এই বিশেষ ধর্মটিকে আরও ভালোভাবে জানতে সাহায্য করে। তাওকে অনুসরণ করতে হলে আগে নিজের অন্তর্ধ্বনিকে জানতে হবে। এই ধর্মীয় বিশ্বাসটি ‘ইন’ ও ‘ইয়াং’—এই দুটি ভিন্ন সংগীতের মাধ্যমে প্রতিস্থাপিত। এই বিশেষ সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় উৎসবটি অস্ট্রেলিয়ার ‘চিরসবুজ’ তাওয়িস্ট চার্চে১৯ ‘ডিয়াগন’ (Deagon) বা ‘কুয়ান ইন’-এর জন্মদিবস পালন উপলক্ষ্যে উদযাপিত হয়। ধর্মীয় সংগীত ও তার যন্ত্রানুষঙ্গ এখানে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করে। তাও ‘ধর্মীয়’ ধর্মগুরু বা যাজকেরা ‘কুয়ান ইন’-এর—যিনি ক্ষমার দেবতা—তাঁর স্তুতিপাঠ করেন। বিশেষত ‘চেলো’, ‘হার্প’, ও ‘দ্রামস’-এর যন্ত্রানুষঙ্গ কাজ করে থাকে। এই উৎসব তাও ধর্ম্বালম্বীদের একটি পবিত্র উৎসব যা তাও মতবাদীদের ধর্মমাহাত্ম্য, তাও দর্শন ও সংস্কৃতির পরিচায়ক। তাও ধর্মীয় সংগীত পরিবেশন কালে অধ্যক্ষগুরু হাত নাড়িয়ে এটি পরিচালনা করেন যা চিনা অতীন্দ্রিয়বাদের পৃষ্ঠপোষকতা করে। এক্ষেত্রে জনপ্রিয় ‘ইয়াং’ সংগীতের পরিবেশন হয় এবং ‘কুইং’ (ধাতব সংগীতযন্ত্র) ও ‘ফাকি’ (ধর্মীয় বাদ্যযন্ত্রবিশেষ) এই দুটি মুখ্য যন্ত্রের ব্যবহার হয়ে থাকে। এটি মূলত ধ্যানে, সমাধি ও পরমাত্মার আহ্বানকে জানানোর সংগীত। এছাড়াও ‘কুইং’ ও ‘মুইয়ু’২০ নামের আরো বিশেষ দুটি যন্ত্রের মধ্যে দিয়ে ধর্মীয় পরিবেশের সৃষ্টি করা হয়।

‘তাও’ বা ‘ডাও’ ধর্মীয় সংগীতের এরূপ অসাধারণ ‘Manifestation’ খুব কম ধর্মেই দেখতে পাওয়া যায়। অনেক সময় মহান ধর্মগুরু লাও-জু-র লেখা তাও তে চিং থেকে নির্বাচিত অংশ পাঠ করে গাওয়া হয়ে থাকে এবং প্রাচ্য দর্শনের সেই আলোকোজ্জ্বল পথের পাথেয়রূপে একে গ্রহণ করা হয়। বিখ্যাত এই ধর্মীয়- সংগীত তাও-ধর্ম্বাবলম্বীদের রোজকার জীবনের একটি অপরিহার্য ও অবিচ্ছেদ্য অঙ্গরূপে বিবেচিত হয়।

কনফুসীয়ধর্ম ও তার সংগীত

কনফুসীয়ধর্ম বা ধর্মীয় মতবাদের জনক হলেন বিখ্যাত গুরু কনফুসিয়াস(৫৫১ – ৪৭৯ খ্রি.পূ.)। কনফুসিয়াসের উপদেশ ও কনফুসীয় মতবাদের ভাবধারায় আপ্লুত এই ধর্মের মূল রসদ তার সংগীত। কনফুসিয়ানধর্ম মহাগুরু কনফুসিয়াসের পঠনপাঠনআশ্রিত যা ছ-টি সর্বকালের সর্বজনবিদিত গ্রন্থ :

১. পরিবর্তন

২. ইতিহাস

৩. সংগীত

৪. ধর্মীয় স্তোত্র

৫. ধর্মীয় সংস্কৃতি ও আচার-আচরণ এবং

৬. ধর্মীয় তত্ত্ব ও প্রশ্নাবলি২১

চিন প্রদেশে সবচেয়ে পুরোনো ও আধ্যাত্মিক এই দুনিয়ার ধর্মীয় সংগীতের প্রভাব বৃদ্ধিমাত্র একই সঙ্গে চিনদেশীয় ‘হান’ সাম্রাজ্যে এটির ব্যাপ্তি ঘটে। কনফুসীয় ধর্মে সংগীতের প্রভাব অপরিসীম। বিশেষত কনফুসীয় ধর্মসংগীত বৌদ্ধ ও জেনধর্মীয় সংগীতের মতোই সামঞ্জস্যপূর্ণ। কনফুসীয় ধর্মীয় সংগীতে মূলত বাঁশি, শিঙা, চেলো ইত্যাদির বিশেষ উল্লেখ পাওয়া যায়। এই ধর্মীয় সংগীত ‘কোরাসে’ গাওয়া হয়২২–যা সাধারণ মানবজীবনের দুঃখ-কষ্ট ভুলিয়ে তাকে এক উন্নত মার্গের সন্ধান দেয়। এই সংগীত দিয়ে থাকে সেই প্রাচীন দীক্ষা যা বৌদ্ধ, জেন, শিন্টো ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত এবং প্রাচ্য দর্শনের এক বিশেষ সাংগীতিক রূপ ও দর্শনের আলোকমণ্ডলের ঠিকানা।

নিয়ো-কনফুসিয়ানিজম

নিয়ো-কনফুসীয় ধর্ম প্রকৃতপক্ষে কনফুসীয় ধর্মেরই একটি উত্তর-আধুনিক রূপ। কনফুসীয় ধর্মের আরও উন্নত এবং আধুনিক ধর্মসাধন এই ধর্মে লক্ষণীয়। মূল কনফুসীয় ভাবধারায় এটি অনুপ্রাণিত হলেও বৈশিষ্ট্য, ধর্মাচরণ ও ধর্মীয় রীতিনীতির দিক থেকে এটি কনফুসীয় ভাবধারা থেকে স্বতন্ত্র। এর মূল যোগসূত্র ‘তাং’ (Tang Dynasty) সাম্রাজ্যে এবং বিখ্যাত তাত্ত্বিক ‘তাং-জি তিয়ান’-এর (Tang xie Tian) ভাবাদর্শে এটি উদবুদ্ধ। পূর্ব এশিয়া যথা চিন, জাপান ও কোরিয়ায় বিস্তার। বিখ্যাত নিয়ো-কনফুসীয় সংগীতজ্ঞ হু জিং (Znu xi) ওয়াং ইয়ামমিং (wong yangming) কনফুসীয় সাংগীতিক ভাবধারাকে এক নতুন পথে চালিত করেন, যদিও এই ধর্মের বাদ্যযন্ত্রের পূর্বপরিগণিত বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে বিশেষ পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না।

উপসংহার

পাশ্চাত্য ধর্মীয় সংগীতের তুলানান্তরে প্রাচ্যধর্ম ও ধর্মীয় সংগীতের অবদান বেশি বই-কম নয়। যুগ যুগ ধরে প্রাচ্য ধর্ম ও ধর্মীয় সংগীতের ইতিহাসে এই বিশেষ পরিমণ্ডলটি ভাববাদ-অতীন্দ্রিয়বাদ ও দর্শনের মূল বিষয়কে সংগীতের সুনির্মল পরিবেশনায় বিশ্বের মুক্ত মানবজাতিকে আকৃষ্ট করেছে। বিংশ শতাব্দীতে এর সৌকর্য ও নানান তত্ত্ব সাংগীতিক ভাবধারাকে ছাড়িয়ে সৃষ্টি করেছে এক অমোঘ নির্দেশ যা কালক্রমে নির্দেশিত হয়েছে ‘সংগীতই ঈশ্বরলাভের প্রকৃত উপায়’ এই মোক্ষবাদে।

***

২য় অধ্যায়
 মহানির্বাণের সুর : বৌদ্ধ ধর্মীয় সংগীত এবং অন্যান্য

১. Andrew Skitton (2004), A concise history of Buddhism, wind horse, 978-09044766929, p.41

২. Julianne Schober (2002), A sacred biogrphy in the Buddhist tradition of South-East Asia, Motilal Banarsidass, p. 20

৩. Mark fowler (2005), Zen Buddhism : Belief and practice, Sussex academy press, p. 32

৪. Julianne Schober, p. 63

৫. Ibid, p. 128

৬. Deborah Wong (2001), sounding the centre : history and aesthetics in Thai Buddhist performance, Univ. Of Chicago press, 978–0226905860, p.28

৭. Robort E. Buswell (2003) ; Encyclopaedia of Buddhism ; Machillan, 0028657187, p. 57

৮. Ibid, p. 130

৯. Thomas Merton (1967) ; Mysteries and Zen Master, Farrar, Straus and Giroux, New York, 0374520011, p. 87

১০. Jacqueline Stone (2003), Original Enlightenment and the transformtion of medieval Japanese Buddhism, University of Hawaii, 08247820266, p. 15

১১. Graham Coleman (1993) ; The Handbook of Tibetan Culture, shambhala, 1570620024. p. 71

১২. C. Scott. Littleton (2002), Shinto : Origin, rituals, festivals, spirits and secret places, OUP, 0195218868, p. 49

১৩. Ibid, p.55

১৪. Ibid, pp. 63–65

১৫. Ibid, p. 117

১৬. Russell Krikland (2004) ; Taoism : Enduring Tradition, Routledge, 0415263220, p. 52

১৭. Ibid, p. 61

১৮. Ibid, p. 63

১৯. John Bowker (2000), The Music, the Oxford Dictionary of World Religions, p. 239

২০. Ibid, p. 241

২১. Jonathan Clements (2008) ; Confucius : a biography, Sutton,978-0750947756, p. 167

২২. Ibid, pp. 179–181

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *