৭। কোরান

৭. কোরান

ইসলামের পবিত্র কেতাব কোরানকে ধর্মীয় মুসলিমরা আল্লাহ সমকালীন (Coeval) শাশ্বত ও অসৃষ্ট গ্রন্থ বলে মনে করে। এর বিষয়বস্তু, প্রতিটি ছত্র ও অক্ষর আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত বাণী, অপরিবর্তনীয় ও ফাইনাল। মূল কোরানকে বিশ্বাস করা হয় লৌহ মাহফুজে আলোর ছটার উপর লিখিত এবং রক্ষিত (৫ : ২২) যা আল্লাহর আসনের পাশে রাখা ছিল। এই প্রাচীন টেক্সট পৃথিবী সৃষ্টির বহু পূর্ব থেকেই স্বর্গে মওজুদ ছিল এবং বলা হয় এটা ‘উম্মুল কেতাব’ অর্থাৎ গ্রন্থের মাতা এবং সমস্ত ঐশীবাণী (ওহি) স্বর্গীয় (১৩ : ৩৯)—আল্লাহ যা ইচ্ছা তা নিশ্চিহ্ন করেন এবং যা ইচ্ছা তা প্রতিষ্ঠিত করেন এবং এই কিতাব আল্লাহর কাছে সংরক্ষিত ‘লৌহ মাহফুজ’ (৮৫ : ২২)।

আল্লাহর অনুগ্রহে, এই গ্রন্থের অংশ বিশেষ খণ্ড খণ্ড আকারে প্রফেট মোহাম্মদের কাছে তেইশ বছর ধরে প্রেরিত হয়েছে। এই বাণী বহন করে নিয়ে এসেছেন গাব্রিয়েল (জিব্রাইল)— মক্কা ও মদিনা উভয় শহরে এবং সব বাণী একত্রে সংকলিত করে এই কিতাব তৈরি করা হয়েছে।

কোরান নিজেই একটি মোজেজা-মিরাকল (২৯ : ৫০), খলুস আরবিতে লেখা, যা আল্লাহ ও ফেরেশতাদের ভাষা। প্রত্যেক সূরা (চ্যাপ্টার), ১১৪টি, প্রত্যেক আয়াত (৬২০৪ এবং ৬২৩৯ এর মধ্যে), প্রত্যেক শব্দ ও সিলেবল ও প্রতি অক্ষর (আয়াত, শব্দ, সিলেবল, অক্ষরে মুসলিম পণ্ডিতদের মতপার্থক্য আছে) আল্লাহ দ্বারা অনুপ্রাণিত, যখন কোনো আয়াতের উদ্ধৃতি দেয়া হয়, তখন বলা হয়, আল্লাহ বলেছেন (কালা আল্লাহ) কারণ এর রচয়িতা আল্লাহ।

বলা হয়, কোরান, পৃথিবীর ইতিহাসের সঠিক বর্ণনা দেয় এবং আদি পিতা ও প্রফেটদের জীবনী বর্ণনা আছে; এতে আছে কোনো প্রাচীন রাজার বিষয়বস্তু এবং যিশুর সত্য ঘটনা ও মানবজাতির নিয়তির কথা বলা হয়েছে যার সম্বন্ধে ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্ম গ্রন্থে অসম্পূর্ণ বাণী বিধান পাওয়া যায়। এটা বিশ্বলোকের জ্ঞানের বিশ্বকোষ। সত্যি অনেকে বলে থাকে মানব জ্ঞানের সবদিক, এমনকি বিজ্ঞানের ও প্রযুক্তির এবং দক্ষতার সকল উৎস এই কোরানে বলা আছে এবং এই গ্রন্থের রহস্যময়তা সম্বন্ধে যাদের অন্তর্জান আছে তারা রহস্যময় জগতের সবকিছু জানতে পারবে।

কোরান অপরিবর্তনীয়, একে বদলানো যায় না কিংবা সংশোধনও করা যায় না। আল্লাহর ঐশীবাণী এতে ধারণ করার পর ঐশীবাণীর কালি যে কলম থেকে বের হতো সে কলমের কালি শুকিয়ে গেছে এবং স্বর্গীয় অনুপ্রেরণা বন্ধ হয়েছে এবং আর কিছু বলার নেই। এতে আর কিছু যোগ করার নেই, বাদ দেয়ারও নেই। পৃথিবীর মানুষের নর- নারীর প্রতি পদক্ষেপ যা কিছু প্রয়োজন তার সব গাইডেন্স এই গ্রন্থে পাওয়া যায়। এই গ্রন্থে শুধু ধর্মীয় নয়, সামাজিক-সাংস্কৃতিক-বাণিজ্যিক-আনুষ্ঠানিক, সামরিক আইন, দেওয়ানি ও ফৌজদারি এবং প্রশাসনিক-মুসলিমদের জীবনযাত্রার যাবতীয় পথনির্দেশ পাওয়া যাবে।

৭.১ জিব্রিল ফেরেশতা

প্রফেট মোহাম্মদের কাছে যত বাণী আল্লাহ প্রেরণ করেছিলেন তার মাধ্যম ছিল জিব্রিল ফেরেশতা। সূরা তাকভিরে এ (৮১) ১৯ আয়াতে জিব্রিলকে বলা হয়েছে Illustrious Messenger সম্মানিত বার্তাবাহক, কারণ ইনিই আল্লাহর বাণী মোহাম্মদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন (গ্রিক শব্দ ‘angelos’ – angel-এরও অর্থ বার্তাবাহক)। এই দাবি জোর দিয়ে প্রমাণ করে যে, কোরানের কোনো ব্যক্তিগত চরিত্র নেই এবং এই ভাষ্যই মোহাম্মদের মক্কাবাসীদের অভিযোগ খণ্ডন করে, কারণ মক্কার বিরুদ্ধবাদীরা অপবাদ দিয়েছিল এই বলে যে কোরানের সব কথাই প্রফেট মোহাম্মদের নিজের আবিষ্কার।

কোরানে জিব্রিল ফেরেশতা সম্বন্ধে কোনো উল্লেখ নেই যতক্ষণ না মদিনা কাল আরম্ভ হলো হিজরতের পর এবং তারপর তাঁর নাম মাত্র দু’বার উল্লেখিত হয়েছে সেই দেবদূত যার মাধ্যমে কোরান অবতীর্ণ (২ : ৯১) এবং একজন সাহায্যকারী হিসাবে (৬৬ : ৪)। অন্যান্য আয়াতে তাঁর উল্লেখ আছে তবে নাম ধরে নয়। এইভাবে, সুউচ্চ পয়েন্টে প্রফেট মোহাম্মদ তাঁকে দেখতে পান (৫৩ : ৭) সেই পরিষ্কার দিগন্তে (Clear horizen) (৮১ : ২৩) এবং পরে তিনি অগ্রসর হলেন দুই ধনুকের দূরত্ব বজায় রেখে (৫৩ : ৯)। অন্য এক ঘটনায় মোহাম্মদ সিদ্রা গাছের (লোট ট্রি) কাছে তার ভিশন দেখতে পান যেখানে এই দুনিয়ার সাথে পরবর্তী দুনিয়ার বাউন্ডারি (সীমান্ত) টানা হয়েছে।

বিভিন্ন ট্র্যাডিশন অনুযায়ী, অন্য উৎস থেকেও অনুপ্রেরণা পাওয়া গেছে। কোনো সময়ে অনুপ্রেরণা এসেছে পবিত্র আত্মা থেকে, যে আল্লাহর কাছ থেকে নিয়ে এসেছে। কোনো সময়ে এসেছে সকিনার কাছ থেকে, যার রহস্য মতো অর্থ হচ্ছে ঈশ্বরের নারীরূপে– (Cabbalistic writings in the female aspect of God)।

এক বর্ণনায় মোহাম্মদ বলেছেন, ‘দেবদূতটি মানুষের রূপ ধরে আমার সামনে আসত, সেই মানুষটির বর্ণনা দিতে বলা হলে প্রফেট জবাব দিতেন যে তার দাড়ি ও মুখ মক্কার এক সুন্দর যুবাপুরুষের মতো, মাথায় সূচিকর্মের পাগড়ি ব্রকেডের জিনে (saddle) সজ্জিত শুভ্র খচ্চরের পিঠে চড়ে আসত। এই যুবাপুরুষটি দেখতে ছিল দাহিয়া ইবন খলিফার মতো, যিনি খ্রিস্টান কালবি গোত্রের সদস্যভুক্ত (Glubb, 1979, P. 249) ।

আর একটা ট্র্যাডিশন মতে, বর্ণনায় মুসা ইবন ওকবা, বলা হয়েছে; হিরা পর্বত গুহায় মোহাম্মদ প্রথম ‘ভিশন’ দেখার পর, খাদিজা তাঁকে এক খ্রিস্টান সাধু আদ্দাসের কাছে নিয়ে যান। আদ্দাস নিজে থেকে এসে মক্কায় স্থায়ী বাসিন্দা হয়েছিলেন। খাদিজা তাকে মোহাম্মদের ‘ভিশন’ সম্বন্ধে ব্যক্ত করলে সাধুপুরুষটি বিস্ময়ে বলে ওঠেন— ‘হে সম্ভ্রান্ত কোরেশী মহিলা এই মূর্তি পূজার দেশে গ্যাব্রিয়লকে কী ভাবে উল্লেখ করা হয়? তারপর তিনি খাদিজার কাছে ব্যাখ্যা করেন যে গ্যাব্রিয়েল হলো আল্লাহর ফেরেশতাদের প্রধান যাঁকে আল্লাহ পাঠান প্রফেটদের পথনির্দেশ করতে, গাইড করতে। তাবারির বক্তব্য অনুযায়ী ইহুদিরা বিশ্বাস করে যে মোহাম্মদের ওহিগুলো গ্যাব্রিয়েলের মাধ্যমে আনীত হয়নি, তার কারণগুলোর মধ্যে একটা হচ্ছে, গ্যাব্রিয়েল ধ্বংসকরণের ফেরেশতা, মিকাইলের মাধ্যমে এলে কথা ছিল, কারণ মিকাইল হলো ইহুদিদের গার্জেন (দানিয়েল ১২ : ১)। ইহুদিরা বিশ্বাস করে যে গ্যাব্রিয়েল মোহাম্মদ যে অনুপ্রাণিত করেছিল ইহুদিদের বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক অভিধানগুলো চালাবার জন্য যেমন বানু কুরাইজার ওপর করা হয়েছিল।

মোহাম্মদ স্বয়ং জিব্রাইলকে পছন্দ করতেন নূহ, মুসা ও ওমরের মতো, যারা কঠোর বিচারে অভ্যস্ত ছিল এবং মিকাইলকে তুলনা করতেন আব্রাহাম, যিশু ও আবুবকরের মতো, যারা ক্ষমা করার পক্ষপাতী ছিলেন। (Muir 1912 P.231) ইহুদি হিব্রু কাবালার (cabbala) রহস্যজনক ট্র্যাডিশন অনুযায়ী, গ্যাব্রিয়েল চন্দ্রের আত্মিক গুণাবলির সাথে সংযুক্ত, আর মিকাইলের সংযোগ হচ্ছে সূর্যের সাথে। (Frieling, 1976. P. 47)। গ্যাব্রিয়েল স্বপ্নের স্তরে অবস্থান করে, যা প্রায়ই প্রতারণামূলক এবং মিকাইল ভিশনের স্তরে অবস্থান করে যা ভবিষ্যদ্বাণী নির্দেশ করে (Matt, 1983 P. 229)।

৭.২ কোরানের অবতরণ

জিব্রিল মোহাম্মদকে কোরানে ওহি (রিভিলেশন) এনে দিতেন তা মোহাম্মদ স্বাভাবিকভাবে শুনতে পেতেন না, কিন্তু অবতরণ হতো প্রত্যক্ষভাবে তার মনে ও অন্ত রে। এই অবতরণ (তানজিল) কোনো সময় আসত শব্দ সমষ্টি হয়ে হয়ে, কোনো সময়ে ‘ভিশন’ আকারে, যা তিনি বুঝতে পারতেন এবং কোনো সময়ে আসত স্বপ্নে। মোহাম্মদ এসব ‘ওহি’ বা রিভিলেশন বলে দিতেন ‘খতিব’ বা লেখকদের কাছে প্রায়ই ওহি আসত অদ্ভূত শব্দের মাধ্যমে এবং চিহ্নরূপে।

অনেক সময় ওহি অবতরণ হতো অপ্রত্যাশিতভাবে এবং অসময়ে; যেমন- ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছেন, কিংবা চুলে পানি দিয়ে পরিষ্কার করছেন বা খাচ্ছেন, (A. J. Wensinck, in SEI, 1974, P. 624)। কোনো কোনো সময়ে পাবলিক মিটিং-এ উত্থিত কোনো প্রশ্নের জবাবে আলোকরশ্মি রূপে চলে আসত, অথবা যখন কোনো মতামত চাওয়া হলে তা টলাতে না পারলে চলে আসত, অথবা কোনো বিশেষ অবস্থায় তাৎক্ষণিকভাবে কোনো সিদ্ধান্তের কিনারা করতে নেমে আসত। এই সময় রিভিলেশন মুহূর্তেই কেউ যেন বলে দিত কোনো সিদ্ধান্ত নিতে যার জন্য সময়ের অপেক্ষা করা যেত না নিয়মিত অনুপ্রেরণার জন্য। এই সব সময়ে, বলা হতো, তিনি আল্লাহর কাছ থেকে ত্বরিত নির্দেশ পেতেন। ক্ষণস্থায়ী (একদিনের মতো) অপেক্ষা করা যায় এমন ঘটনা, সামান্য স্থানীয় সমস্যা বা অন্য কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয়া হতো কোরানের আয়াত থেকে। ব্যক্তিগত কারণে তাঁর শত্রুকে অভিশপ্ত করার আয়াত ছিল (১১১ : ১)। এটা এমনভাবে প্রচারিত হয় যে এক সময় এক সাহাবী আবু রুহুম আল গিফাবীর সাথে পথ চলতে তিনি হঠাৎ হোঁচট খান, আল গিফারী উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করেন হয়তো কোনো কোরানের আয়াত পাওয়া যাবে যাতে তিনি একটি উপযুক্ত নির্দেশ পেতে পারেন।

কিছু রিভিলেশন পেয়েছেন শত্রুদের আক্রমণে উত্তেজিত হয়ে এবং কিছু পেয়েছেন তাঁর আচরণ সম্বন্ধে উত্থাপিত আপত্তিগুলোকে খণ্ডন করতে। কিছু এসেছে কোনো রাজনৈতিক বা সামাজিক দাবি মেটানোর কারণে, কিছু এসেছে তাঁকে তাঁর শপথ থেকে মুক্তি দিতে (৪৭ : ৪)। অনেক আয়াত এসেছে যুদ্ধ ও অভিযান করার প্রচারপত্র হিসাবে অথবা ঐ দিন সেনাবাহিনীকে কী নির্দেশ দেয়া হবে সে সম্বন্ধে, অথবা কোনো গোত্র প্রধানের সাথে শান্তি চুক্তি করার ব্যাপারে কিংবা অভিধান শেষে মালেগণিমাত (booty) বিতরণ সম্বন্ধে (৮ : ৪২)

কতগুলো আয়াত এসেছে প্রফেটের স্ত্রীদের সম্বন্ধে তাদের পারিবারিক কলহ ও দাবি সম্বন্ধে। প্রফেটের এই প্রবণতা (tendency), বিশেষ করে মদিনায়, অর্থাৎ রিভিলেশন পাওয়ার প্রয়োজনীয়তাকে বাড়িয়ে দিয়েছিল তাঁর মতামতকে সমর্থন জোগাতে, যাতে তিনি পারিবারিক কলহ-কোন্দলের অশান্ত অবস্থাকে শান্ত করতে পারেন, আর এই মর্মে কিছু কোরানিক আয়াত এমন অসামঞ্জস্য ছিল যা বিরূপ মতামতের হাত থেকে রেহাই পায়নি। এটা মনে করা হয়েছিল যে, প্রফেট তাঁর প্রতিপক্ষকে যখন শান্ত করতে পারেননি তখন বারবার তিনি রিভিলেশন কামনা করেছেন অথবা স্ত্রীদের নিয়ন্ত্রিত করার জন্য অথবা আল্লাহর অনুপ্রাণিত কোনো বাণীর বিপরীতে সংঘটিত এমন অবস্থা থেকে নিজের পজিশনকে স্বচ্ছ করে তোলার কারণে, বারে বারে আল্লাহর সাহায্যপ্রার্থী হয়েছেন।

৭.৩ ওহি লেখকগণ (কাতিব)

প্রফেট মোহাম্মদ যখন তার মিশন শুরু করেন, তখন মক্কার অভিজাত সম্প্রদায় কোরেশ গোত্রের মধ্যে মাত্র সতের জন ছিলেন, যারা লিখতে পারত। হিসাবরক্ষক ও কেরানি হিসাবে বেশির ভাগ ইহুদি, খ্রিস্টান বা আবিসিনিয়ানদের মক্কার ধনী মার্চেন্টরা নিয়োগ করত। মোহাম্মদের প্রাথমিক দিনগুলোতে মদিনায় লেখকের সংখ্যা মক্কার মতোই ছিল, তাই প্রফেট মোহাম্মদ শিক্ষিত দরিদ্র যুদ্ধবন্দিদের মুক্তি দিতেন এই শর্তে যে, তারা তাঁর অনুসারীদের লেখাপড়া শেখাবে। শুধু লেখকদের সংখ্যা কম ছিল না, লেখার সরঞ্জামও বিরল ছিল, হঠাৎ পাওয়া যেত না। এটা প্রত্যয় করে বলা যাবে না, মক্কাতে অবতারিত প্রথম ওহিগুলো কারা লিখে রেখেছিল; তাতে পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় যে প্রথম দিকে অবতারিত মূল ওহির কিছু অংশ হারিয়ে গেছে।

মোহাম্মদের ওহি লেখকদের রাব্বীদের (মুহুরি) মতো দেখতে লাগতো, যারা প্রাচীন চারণকবিদের কবিতা নকলকারীদের মতো। প্রফেটের প্রথম লেখকরা ছিল খ্রিস্টান বা খ্রিস্ট ধর্মের লোক ছিল এমন সব ব্যক্তি- যেমন তার স্ত্রী খাদিজা, বৃদ্ধ জ্ঞানী ব্যক্তি ওয়ারাকা এবং মোহাম্মদের পালিত পুত্র জায়েদ ইবন হারিথ। অন্যেরা ছিলেন প্রফেটের অতি কাছের লোক, যেমন আবুবকর ও আলী। তাঁর স্ত্রীদের মধ্যে ছিলেন, জানা যায় যে, খাদিজা ছাড়া, আয়েশা, উম্মে সালমা এরা পড়তে পারতেন এবং হাফসা ও উম্মে কুলসুম এরা পড়তে ও লিখতে পারতেন। কিন্তু হাফসা ও উম্মে কুলসুম প্রফেটের ডিকটেশন লিখে রেখেছিলেন কিনা জানা যায়নি।

সময়ক্ষেপণের সাথে সাথে অনেকেই ওহি লিখে রাখতে শুরু করেন। এদের মধ্যে ছিলেন জায়েদ ইবন থাবিত যিনি কোরান সংকলনও করেছেন; ওসমান তৃতীয় খলিফা; আবদুল্লাহ ইবন সাদ, ওসমানের সৎভাই; ওবেই ইবন কাব (যিনি তাঁর নিজের কোরান সংকলন করেন; এ সম্বন্ধে পরে আলোচিত হবে); মাবিয়া, ওসমানের কাজিন, (ইনি প্রথম উমাইয়া খলিফা হন) এবং একজন ইহুদি লেখক ও (Sale, 1886 P. 46)। মোহাম্মদের মৃত্যুকাল পর্যন্ত চল্লিশ জনের বেশি ওহি লেখক নিয়োগ করা হয়েছিল।

মুতাজিলি ও আরব সমালোচকগণ কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করেন; যেমন (১) ওহি কেমন করে আসত এবং কেমনভাবে গ্রহণ করা হতো? (২) কেমন করে ওহি লেখকরা জানতে পারত কখন প্রফেট ‘অনুপ্রাণিত’ এবং কখন তিনি হুবহু সেই ওহি প্রকাশ করতেন এবং (৩) কেমন করে লেখক বুঝতে পারত কখন লেখা আরম্ভ করতে হবে এবং কখন থামতে হবে?

এটাই সম্ভাব্য যে, ওহি লেখকরা যা শুনে লিখল (সকলেই তো সমান দক্ষ ছিল না) হয়তো তাদের লেখার মধ্যে কিছু ভুল থাকা অস্বাভাবিক নয়, আর সব নকলকারীরা (Copyist) একই বিষয় লিখত না অর্থাৎ সকলের লেখা অক্ষরে অক্ষরে মিলতো না যদি মোহাম্মদ নিজে লিখতে বা পড়তে না জানতেন, যেমন দাবি করা হয়, তাহলে, কোরানে টেক্সটের ভ্রমশূন্যতার (accuracy) জন্য নির্ভর করতে হয় নিয়োগকৃত একাধিক ওহি লেখকদের (amanuenses) দক্ষতার ডিগ্রির ওপরে। এই জন্য কোনো কোনো পণ্ডিত ব্যক্তি এই মত পোষণ করেন যে, সময়ে সময়ে মোহাম্মদ ধারণকৃত ওহির বিধান পরিবর্ধন ও সংশোধন করেছেন।

৭.৪ মক্কার সূরা

পণ্ডিত ব্যক্তিগণ কোরানের সূরাগুলোর মধ্যে বিভাজন বা পার্থক্য করেছেন, যেসব সূরা মোহাম্মদ মক্কাতে এবং পরে মদিনাতে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ডিকটেট করেছেন। পরবর্তীতে কোরানের আরবি কপিগুলোতে প্রত্যেক সূরার শিরোনামে ‘মক্কা’ বা মদিনা’ উল্লেখ করা হয়েছে যাতে পাঠকদের বুঝতে অসুবিধা না হয় কোনটা মক্কার আর কোনটা মদিনার সূরা (চ্যাপ্টার)।

প্রাথমিক বা মক্কার সূরাগুলোতে অন্য ধর্মের প্রতি এমনকি প্যাগন আরবদের ধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতা দেখানো হয়েছে। এই সূরাগুলো উচ্চ আদর্শে পরিপূর্ণ যা গভীর ধর্মবোধ ও আধ্যাত্মিকতার দ্বারা প্রভাবিত; এটা করা হয়েছে ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মের ট্র্যাডিশনকে সমন্বিত করে। আল্লাহকে বলা হয়েছে আল-রহমান, দয়ালু।

এই সূরাগুলো, ধর্মীয় শিক্ষা, নৈতিক নীতি, সংক্ষিপ্ত সুসমাচার এবং অন্যান্য অনুপ্রাণিত বাণী যা প্রফেট বলেছেন, সেগুলো নির্দেশ করে। বাণীগুলো বলা হয়েছে ছোট ও সরলভাবে আবেগকণ্ঠে প্রাচীন মহাকাব্যের অংশ বিশেষ আবৃত্তি করার মতো, ভিশনারি ক্ষমতা ও জ্বালাময়ী বক্তব্য সংবলিত বাক্যসমৃদ্ধ এবং সাধারণত ছন্দময়ী ও গদ্য ছন্দ প্রভাবিত (সাজ)।

এইসব দ্যুতিময় ও আবেগাপ্লুত আয়াতগুলোর ছান্দিক গতিময়তা, রহস্যময়তা ও ধর্মীয় অন্তর্বোধ মানুষকে ও শ্রোতাকে মোহান্বিত করে; কারণ এগুলো প্রায়ই জাদুর স্পর্শের মতো মানুষকে অচেতন করার ক্ষমতা রাখে। বলা হয়ে থাকে, প্রফেটের বয়োবৃদ্ধির সাথে সাথে মক্কার সূরাগুলোর কার্যকর ক্ষমতা আস্তে আস্তে কমে যেতে থাকে মদিনায় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও তার প্রশাসনিক কারণে।

মক্কার সূরাগুলোতে আরবদের জন্য আব্রাহামের ধর্মের কথা বলা হয়েছে এবং সমগ্র কোরানের এক-তৃতীয়াংশ। মক্কার সূরার অধিকাংশ মুসলিমদের মুখে মুখে সম্পূর্ণ বা খণ্ডিতভাবে ধ্বনিত হতো। মৌখিকভাবে পঠিত বা আবৃত্ত হয়ে থাকলেও এগুলোর কোনো পরিবর্তন বা বিকৃতি হয়নি এবং এই সূরাগুলো ইসলামের বিশ্বাস ও ভিত্তির কেন্দ্র স্বরূপ। এর অনেক অংশ স্তোত্র-পাঠের মতো বা গীতিকাব্যের মতো। এগুলো তাই প্রার্থনার জন্য ইমামদের কাছে সুবিধাজনক। তাই গণপ্রার্থনায় ও অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এগুলোর নিয়মিত ব্যবহার করা হতো।

এটা মনে করা হতো যে, মোহাম্মদের মক্কা থেকে মদিনা যাত্রার পূর্বে প্রাথমিক মুসলিমদের মৌলিক বিশ্বাস ও অনুষ্ঠানাদি সবই নাজেলকৃত মক্কী সূরাগুলোতে নিহিত হয়েছে যদিও কোনো কোনো ক্ষেত্রে মূলসূত্র আকারে (rudimentary form)। এই প্রাথমিক ছোট ছোট সূরাগুলো নিয়মিত পাঠ করার কাজে লাগত এবং মানুষের প্রার্থনার বইরূপে পরিগণিত হতো যেমন ছিল খ্রিস্টানদের বাইবেল।

মোহাম্মদ যখন হিজরতের জন্য তৈরি হচ্ছিলেন, তিনি প্রথমে মুসাব ইবন উমাইরকে মদিনায় পাঠান সেখানকার মুসলিমদের নির্দেশ দেয়ার জন্য এবং অবস্থাটা বোঝার জন্যও। মদিনায় মুসাবকে পাঠানো হয়েছিল, কারণ তিনি কোরান আবৃত্তি করতে পারতেন, যাতে মানুষে বুঝত যে মৌলিক ধর্ম গ্রন্থ হিসাবে কোরান সম্পূর্ণ হয়েছে।

প্রখ্যাত ব্রিটিশ পণ্ডিত রিচার্ড বেল, কোরানের টেক্সট অতি সূক্ষ্মভাবে পর্যালোচনা করার পর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এই বলেছেন যে, বদরের যুদ্ধের সময় (৬২৪ খ্রিঃ) কোরান নিশ্চিতভাবে সম্পূর্ণ (completely closed) হয়েছে- অর্থাৎ হিজরতের দু’বছরের পর (Watt 1970, P. 158)। সেই সময় বলতে গেলে কোরান মূলত মক্কী সূরাগুলোই নিয়ে রচিত হয়েছিল।

৭.৫ মদিনার সূরা

মদিনায় এসে মোহাম্মদের মর্যাদা ও ক্ষমতা বেড়ে যাওয়ায় তাঁর চরিত্রে মৌলিক পরিবর্তন এসে গেল এবং কোরানের বাণী ও তার ধর্মীয় মাধুর্যও বদলে গেল। এই পরিবর্তন প্রতিফলিত হলো তাঁর কথা বলার ভঙ্গিমা ও বিষয়বস্তু উভয় ক্ষেত্রেই। মাদানী সূরাগুলো যেমন দীর্ঘ তেমনি পাঠ করতেও ক্লান্তিকর, যেমন বিদেশী সমালোচকরা বলে থাকেন।

মদিনাতে এসে ধর্মীয় উদ্দীপনা এবং মক্কার রিভিলেশনে যে স্বর্গীয় দ্যুতি ছিল মদিনায় লম্বা ও দীর্ঘ সূরাগুলোতে দেখা গেল না। কল্পনাপ্রবণ (visionary) প্রফেট প্রচারক হয়ে গেলেন; প্রফেট হয়ে গেলেন ধর্মতত্ত্ববিদ। নামে মাত্র মাদানী সূরাতে স্বর্গীয় প্রভাব থাকল না। প্রফেটের যে ধর্মীয় এনার্জি ছিল তার গতি বদলে অন্য দিকে গেল; আগেকার, সেই ঐশ্বরিক প্রেরণা জাগতিক ব্যাপারে নিবদ্ধ হলো। সূরাতে যে ছান্দিক গতি ছিল, যে মোহান্বিত ভাব ছিল, তার স্থানে দেখা দিল খাপছাড়া অপ্রাসঙ্গিক গদ্য। কোনো কোনো সূরার কোনো কোনো অংশে (Passage) তার নিজের মহিমার কথা বা ব্যক্তিগত সমস্যার কথা এবং আস্তে আস্তে তার সহিষ্ণুতা ও ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গিয়ে প্রতিপক্ষদের প্রতি যুদ্ধংদেহির ভাব এসে গেল।

স্পষ্টভাবে বোঝা যায়, মাদানী সূরাগুলো তার সচেতন মন থেকে উৎসারিত। এই সূরাগুলোতে উপদেশ (exhortation), আপিল, আইন-কানুন ও ঘোষণায় পরিপূর্ণ। এতে যে সুর ধ্বনিত হয়েছে তার মতবাদ ও শিক্ষা সম্বন্ধীয় এবং আইন, অপরাধ ও শাস্তি সম্বন্ধীয়। আবেগময় আবৃতি হয়ে গেল মামুলি পাঠ, নির্দেশ অনুসরণীয় ব্যাপার। মদিনায় অবস্থানকালে ‘কোরান’ শব্দটি আবৃত্তি হিসাবে ব্যবহৃত না হয়ে পরিচিত হলো ‘আল-কিতাব’ বা গ্রন্থ হিসাবে। জনগণের কাছে মক্কী সূরার মাদানী সূরার চাইতে পরিচিতি বেশি ছিল এবং গণপ্রার্থনায় মক্কী সূরার ব্যবহার ছিল। মাদানী সূরা ও তার বিষয়বস্তু সম্বন্ধে মানুষের ধারণা কম ছিল, এর আকার ছিল বিশাল, বৃহৎ এবং পাঠ- কষ্ট, ক্লান্তিকর। তাই প্রফেটের মৃত্যুর পর মাদানী সূরাগুলোর মধ্যে পরিবর্তন পরিবর্ধন করার সুযোগ ছিল বেশি।

মক্কী ও মাদানী সূরার মধ্যে যে পার্থক্য তা প্রথম থেকে মুসলিম মুফাসসিরদের (Commentalor) কাছে প্রথম থেকেই অজানা ছিল না এবং এ বিষয়ে তারা ঘনঘন আলোচনাও করেছেন। আধুনিক কালে, ইরানী লেখক আলি দস্তি এর পার্থক্য দেখিয়েছেন—প্রফেট মোহাম্মদ যেসব বাণী মক্কায় পেয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে যা মদিনায় পেয়েছিলেন। ইরানে ইসলামী বিপ্লবের কারণে, আলিদাস্তকে গ্রেফতার করা হয়, তার বিরুদ্ধে অধর্মের অভিযোগ আনা হয়, কারারুদ্ধ করা হয় এবং ভীষণভাবে পেটানো হয়, ফলে ১৯৮২ সালে জানুয়ারি মাসে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। সুদানীজ ধর্মতত্ত্ববিদ মাহমুদ মোহাম্মদ তাহা, সুদানে বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে সমঝোতার কারণ খুঁজতে গিয়ে জোর দিয়ে বলেছেন যে মদিনার সূরার ভিত্তিতে শরীয়া আইন না করে প্রাথমিক মক্কী সূরার ওর ভিত্তি করে রচনা করলে আধুনিক বিশ্বে তা গ্রহণীয় হতে পারত এবং মুসলিম বিশ্ব আরও এগিয়ে যেতে পারত উন্নতিশীল জাতির সাথে। মাহমুদের এই আবেদন ও পরামর্শ সুদান সরকারের কাছে গ্রহণীয় হয়নি, উপরন্তু তাকে ঈশ্বরদ্রোহীর অভিযোগে গ্রেপ্তার করে ১৯৮৫ জানুয়ারি মাসে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছে।

৭.৬ কোরান সংকলন

৬৩২ সালে যখন প্রফেট মোহাম্মদ মারা যান তখন বর্তমান আকারে কোরানের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। কিছু খণ্ডিত অংশ, একটি আয়াত থেকে পুরো সূরা পর্যন্ত লিখে রাখা হয়েছিল এবং গচ্ছিত ছিল বিভিন্ন ব্যক্তির হাতে (Private hands)। এর বেশির ভাগ অংশই মুখস্থ রেখেছিলেন সাহাবীরা, নিকট আত্মীয়রা, ক্বারী ও হাফেজরা। কেমন করে এই সব মেটিরিয়াল শেষ পর্যন্ত সংগৃহীত হয় সে সম্বন্ধে বেশ কতকগুলো স্ববিরোধী বক্তব্য রয়েছে।

৬৩৩ সালে রিদ্দা যুদ্ধের সময় খলিফা আবুবকর কোরান মুখস্থকারী (হাফেজ) কিছু ব্যক্তি এই যুদ্ধে মারা পড়েন। ইয়ামামার যুদ্ধে, পরের বছর, অবস্থা আরও গুরুতর হলো যখন ৩৯ জন সাহাবী-হাফেজ যুদ্ধে প্রাণ হারান।

প্রফেট মোহাম্মদের শ্বশুর ওমর উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন এই ভেবে যে যদি আরও হাফেজ যুদ্ধে প্রাণ হারান তাহলে কোরানের মেটিরিয়েল আর খুঁজে পাওয়া যাবে না, তাই তিনি আবুবকরকে পরামর্শ দিলেন যে, কোরানের যেসব মেটিরিয়াল বর্তমানে পাওয়া যাচ্ছে এবং কোরান টেক্সটে যা লিপিবদ্ধ আছে সব গুছিয়ে নিয়ে সামগ্রিকভাবে সংগ্রহ করা হোক যা দিয়ে একটি পরিপূর্ণ গ্রন্থ সংকলিত হয়। এই আইডিয়াকে সাধারণ মুসলিমরা ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারলেন না। অনেকে আপত্তি তুললেন এই বলে যে এটা করতে গেলে প্রফেট যা করতে পারতেন কিন্তু করেননি তাঁর প্রতি অসম্মান (saerilegious) দেখানো হবে, এমনকি আবুবকর পর্যন্ত সন্দেহবাদী ছিলেন, কারণ এটা এমন একটা কাজ যার জন্য তিনি প্রফেট মোহাম্মদের নিকট থেকে কোনো কৰ্তৃত্ব পাননি

যাই হোক আবুবকর শেষ পর্যন্ত অনুমোদন দিলেন এবং তিনি এ পবিত্র কাজের ভার প্রফেটের সেক্রেটারিদের মধ্যে একজনকে দিলেন তিনি হলেন মদিনার খাজরাজ গোত্রের জায়েদ ইবন থাবিত। জায়েদ আরবি ভাষা ছাড়া জানতেন পার্সিয়ান, গ্রিক, ইথিওপিক, কপটিক, সিরিয়াক ও হিব্রু এবং ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থও পাঠ করেছেন।

বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন উপায়ে যেসব খণ্ড খণ্ড আয়াত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছিল এই জায়েদ সেগুলো তাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করলেন। ট্র্যাডিশন বলছে যে, এইসব সংগৃহীত অংশের মধ্যে ভেড়া ও ছাগলের চামড়ার, অংশ, খেজুর পাতা, চ্যাপ্টা পাথর, কাঠের পাটা (ট্যাবলেট), চামড়ার খণ্ড এবং উটের ও ছাগলের স্কন্ধের এবং পাঁজরের হাড় আর ‘মানুষের বক্ষ’ (breast of man) – অর্থাৎ মুসলিমদের স্মরণশক্তি থেকে উদ্‌গীরিত অংশ।

৬৩৪ সালের শেষ দিকে যত খণ্ডাংশ ও হাফেজ বর্ণিত কোরানের বাণী সংগ্রহ করা হয়েছিল সেগুলোকে পরিশ্রম সহকারে আলাদা শিটে কপি করে (সুহুফ) পর্যায়ক্রম ও ভালোভাবে ছাঁটাই-বাছাই না করে (without critical selection) একটি অসম্পাদিত (unedited) গ্রন্থের খাড়া করা হলো। এতে অনেক পুনরাবৃত্তি, গরমিল অনৈক্য ও উপভাষার পরিবর্তন (dialect variation) রয়ে গেল। কোনো কোনো মুসলিম অথরিটি বলেন যে জায়েদের প্রথম সংকলনটা বিভিন্ন পণ্ডিতযোগ্য কেন্দ্রে (Scholastic centres) পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু অন্যেরা একথা অস্বীকার করেন।

সংগৃহীত মেটিরিয়েল, সম্ভবত চার কোণ বিশিষ্ট অক্ষরে লিখিত, আবুবকরকে দেয়া হয় এবং তার মৃত্যুতে এই কপি দ্বিতীয় খলিফা ওমরের হেফাজতে রাখা হয়। ওমরের মৃত্যুর পর অর্থাৎ ৬৪৪ সালে দশ বছর পরে এই কপি চলে যায় ওমরের কন্যা ও প্রফেটের বিধবা স্ত্রী হাফসার কাছে।

ইত্যবসরে সেই সংকলিত কোরানের বিভিন্ন সারাংশ, গোটা সূরা থেকে খণ্ডিত অংশ, যেসব প্রদেশে ইসলাম বিস্তার করেছে, সেখানে পাঠিয়ে দেয়া হয় আবৃত্তির জন্য তখন আরবি অক্ষরে স্ক্রিপ্ট (script) অসম্পূর্ণতা থাকার কারণে এই সব টেক্সটে পঠনে ও ব্যাখ্যায় পরিবর্তন (veriation) দেখা দেয় এবং প্রত্যেক পাঠ ব্যাখ্যাকারীদের নিকট অথরিটি বলে গণ্য হয়।

আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানে অভিযানকালে সিরিয়া ও ইরাকের মুসলিম সেনাবাহিনীতে ব্যবহৃত কোরানের পাঠ ও ব্যাখ্যার পরিবর্তন সম্বন্ধে বিরোধ শুরু হয়ে গেল। এই বিরোধ চরমে পৌঁছলে সেনাপতি হুজাইফা, তৃতীয় খলিফা ওসমানের দৃষ্টিগোচর করেন এবং তাকে এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার জন্য অনুরোধ করেন; কারণ এই বিভিন্নভাবে পঠন ও ব্যাখ্যা ইহুদি ও খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থের মতো পার্থক্য এনে দিতে পারে। এই অবস্থাতে তাৎক্ষণিকভাবে প্রয়োজন হলো একটি সমরূপ (uniform) ও প্রভুত্বব্যঞ্জক (authoritative) কোরান সংকলন করা, যাতে বর্তমানে ব্যবহৃত কোরান পাঠে বিভিন্নতা ও ব্যাখ্যার বিকৃতি সত্বর বন্ধ করা যায়।

সুতরাং খলিফা ওসমান সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, দ্বিতীয়বারের মতো একটি ব্যাপক (Comprehensive) ও চূড়ান্ত (definitive) কোরান সম্পাদন ও সংকলন অত্যন্ত জরুরি, যাতে শেষবার ও সর্বকালের মতো বিধিবিধান বা আইনকানুন নির্ধারিত হয়ে যায়। তিনি আবার জায়েদ ইবন থাবিতের ওপর এ কাজের ভার দিলেন আর সাথে দিলেন তিনজন কোরেশী সাহায্যকারী : আবদুল্লাহ্ ইবন আল জুবায়ের, সাদ ইবন আল-আস এবং আবদুল রহমান ইবন আল-হারিথ। (অন্য সাহায্যকারীদেরও লিস্ট আছে যারা এই বিশাল কর্মে অবদান রেখেছেন)। এই সময় তারা বিদ্যমান সকল ধরনের কপিগুলোকে, কোরানের চ্যাপটার বা ক্ষুদ্রাংশ এবং সেই সব মেটিরিয়ালের সাথে পূর্বে সংকলিত কোরান যা হাফসার কাছে ছিল, তার সাথে মিলিয়ে দেখলেন এবং গ্রন্থের চূড়ান্ত ভার্সান তৈরি করলেন, এই সিদ্ধান্ত নিয়ে যে কোনটা রাখতে হবে আর কোনটা বাদ দিতে হবে এবং গ্রন্থ রচনা, সূরার নাম্বার ও ক্রমবিন্যাস চূড়ান্তভাবে ঠিক করলেন।

ওসমানের কোরান-কমিশন অনেকগুলো সমস্যার সম্মুখীন হন : যেমন, সূরাগুলির ক্রমবিন্যাস ও সিকোয়েন্স। টেক্সট্ সম্বন্ধে প্রবল মতভেদ এবং এদের সঠিকভবে সাজানো, গোছানো (collation) ও উপস্থাপন, বিভিন্ন উপভাষায় লিখিত কোরানের আয়াতগুলো কোন ভাষায় সমন্বিত করা। ভাষার সমস্যাকে মেটাবার জন্য ওসমান জায়েদ ইবন থাবিতকে নির্দেশ দিলেন যে ভাষার পরিবর্তন থাকলে কোরেশী উপভাষাকে অগ্রাধিকার দিতে। উল্লেখ্য যে, জায়েদ ইবন থাবিত ছিলেন মদিনার খাজরাজ গোত্রের লোক, একজন অকোরেশী।

যেহেতু কোরানের অধিকাংশ অংশকে ছোট ছোট প্যাসেজে ডিকটেট করা হয়েছে, বর্তমান আকারে ও আলাদা সেকশন ও চ্যাপ্টারে নয়, সেহেতু বিষয়বস্তু বিন্যাসের যে সমস্যা (Problem of textual arangment), সে সমস্যা সমাধানের জন্য কোনো প্রামাণ্য দলিল বা পন্থা নেই। তাই কোরান সংকলন কমিশন পুরো মোটিরিয়েল ঢেলে সাজিয়েছেন এবং অসংশ্লিষ্ট খণ্ডাংশগুলোকে যথাসম্ভব সূরাতে (চ্যাপ্টারে) সন্নিবেশ করেছেন। পুনরাবৃত্তি ও খাপছাড়া অংশগুলোকে এড়িয়ে যাবার জন্য সামান্যই প্রচেষ্টা করা হয়েছে।

সূরাগুলোর ক্রমপর্যায়কে সঠিকভাবে নির্ধারণ করা অসম্ভব চিন্তা করে, কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়ে শুভ আরম্ভ করেছেন ‘ফাতিহা’ (উন্মোচন) সূরা দিয়ে যে সূরাটি প্রার্থনার আকারে রচিত। ‘বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে’, বলেছেন ফ্রান্টস্ বুহেল (Frants Buhl), “কমিশনের সুস্পষ্ট মুসলিম চিন্তাধারার অভাব এবং ইহুদি ও খ্রিস্টানদের পরিভাষার উপস্থিতির জন্য এমনটি ঘটতে পারে।” (SEI, 1974, P. 280)। তারপর অতিদীর্ঘ সূরাগুলো উপস্থাপিত করা হয় প্রথমেই; তারপর সাজানো হয় আকারে কম দীর্ঘ বা ছোট সূরাগুলোকে। এই বিন্যাস মূলত রিভিলেশনের ধারাবাহিকতাকে উল্টে সাজানো হয়েছে, কারণ সাধারণভাবে ছোট সূরাগুলো মক্কাতে অবতরণ করেছিল, মদিনার দীর্ঘ সূরাগুলোর আগে।

এই ক্রমবিন্যাসের ফলে, অনেক আয়াত তার মূল অবস্থান থেকে সরে গেছে, কিংবা ছিটকে পড়া খণ্ডিত আয়াতগুলো, যার জন্য কোনো উপযুক্ত স্থান পাওয়া যায়নি। সেগুলোকে যেখানে সেখানে (র‍্যানডম) উপস্থাপিত করা হয়েছে, কিংবা বিষয়বস্তুর সংশ্লিষ্টতা না থাকা সত্ত্বেও উদ্দেশ্যবিহীনভাবে (haphazardly) একসাথে জুড়ে দেয়া হয়েছে। কোনো কোনো স্থানে মক্কার আয়াত ও মদিনার আয়াত একসাথে উপস্থাপন করা হয়েছে, যদিও সেসব আয়াত বিভিন্ন সময়ে ডিকটেট করা হয়। দীর্ঘ সূরার মধ্যে বেশির ভাগ সূরার, যেমন তৃতীয় সূরার (Family of Imran) সংগৃহীত প্যাসেজগুলো বিভিন্ন সময়ের সাথে জড়িত (belonging to different periods)। এমনকি ছোট সূরাগুলো সময় সময় দুই বা ততোধিক বিভিন্ন অংশে গঠিত (Composite)।

এটা জানা যায়নি কে বা কারা এই সূরাগুলোর নাম দিয়েছিলেন ও বিন্যস্ত করেছেন। বলা হয়েছে যে প্রফেট নিজেই সূরাগুলোর টাইটেল দিয়েছেন, কিন্তু এদের বেশির ভাগ, প্রফেটের মৃত্যুর প্রায় পঁচিশ বছর ধরে রচনাগুলো জড়ো করে মিলানো (collated) হয়নি, এটা যুক্তিযুক্ত বলে ধরা যায় না। এটা বলা হয় যে, কয়েকটার অন্তত নাম দিয়ে থাকতে পারেন কিন্তু তাও নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। নাম দেয়ার জন্য কোনো নিয়ম বা পদ্ধতিও ছিল না। সংকলকগণ সূরার নাম দিয়েছেন টেক্সট-এর মধ্যে কিছু মুখ্য শব্দ বেছে নিয়ে অথবা কোনো বিশেষ শব্দকে ধরে যা দিয়ে এটা শনাক্ত করা সম্ভব। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটি সূরা জানা যেত দুটো টাইটেল দ্বারা, পরে অবশ্য একটিকে বাদ দেয়া হয়।

কমিশন যখন সংকলনের কাজ শেষ করেন, তখন হাফসাব মূল সংকলনটি তাকে ফেরত দেয়া হয়। বাকি যেসব কপি ছিল, টুকরো, খণ্ডিত, স্ব-বিরোধী বাণী ইত্যাদি সব কিছু জ্বালিয়ে দেয়া হয়। অনেক মুসলিম সেই সময়, এই খুচরো পাতা ও লিখিত বস্তু যা অতি যত্নসহকারে আল্লাহর ওহি বিচার করে লিখে রাখা হয়েছিল- এইভাবে জ্বালিয়ে দেওয়াকে জঘন্য কর্ম বলে মনে করেছিলেন।

কোরানে একটি সমরূপ ও প্রভুত্বব্যঞ্জক একটি টেক্সট প্রথম নির্ধারণ করা হলো ৬৫৫ সালে। হাফসার মৃত্যুর পর ৬৭০ খ্রিস্টাব্দে মদিনার গভর্নর মারওয়ান ইবন হাকাম, যিনি খলিফা ওসমানের সেক্রেটারি ছিলেন এবং পরে প্রথম মারওয়ান নাম ধরে খলিফা হন হাফসার হেফাজতে যত কোরান সংকলন সম্বন্ধীয় যেসব মেটিরিয়েল

কোরান

১৬৫

ছিল সব সংগ্রহ করে ধ্বংস করে দেন, যাতে আর কোনো প্রমাণ বা সাক্ষ্য না থাকে ওসমানী কমিশনের সংকলনের বিপক্ষে কোনো আপত্তি তুলতে বা প্রতিবাদ করতে। (বলা প্রয়োজন যে মূল সংকলনের সমালোচনামূলক সংশোধন (recension) আরো পরে করা হয়)

এই নতুনভাবে সংকলিত মাস্টার-টেক্সটের অনেকগুলো কপি করা হয় এবং ইসলামের প্রধান প্রধান কেন্দ্রে বিতরণ করা হয়। এক কপি মদিনায় রেখে অন্যগুলো কুফা, বসরা এবং দামেস্ক, সম্ভবত মক্কায়ও পাঠিয়ে দেয়া হয়। মূল বই থেকে কপি যারা করেছিল তাদের ভুলের জন্য সামান্য পার্থক্য দেখা দেয় অফিসিয়াল কপিগুলোতে; ভুল ছিল সাধারণত বানানে, উপভাষায় (dialect) এবং সূরা ও আয়াতের বিভাজনে।

ওসমানের সংকলন কোরানের একমাত্র সংকলিত গ্রন্থ ছিল না। প্রাথমিক সময় থেকে মুসলিম কাতিবরা যতদূর সম্ভব মোহাম্মদের বাণী লিখে রাখতেন এবং তাদের ব্যক্তিগত সংকলন হিসাবে ঐ পবিত্র আয়াতগুলো ধরে রাখতেন। পণ্ডিত ব্যক্তিরা এই ধরনের সংকলনের একজনের বেশি লিস্টি তৈরি করেন (মাসাহিফ একবচন মুসাফ) তার মধ্যে একটি লিস্ট তৈরি করেন আবু দাউদ (মৃ. ৯২৮) যা এখনো মজুদ আছে।

এইসব ওসমান পূর্ব সংকলন ওসমানের স্ট্যান্ডার্ড সংকলন থেকে ব্যাপকভাবে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় (Watt, 1970, P. 45)। কোনোটাতে পার্থক্য আছে অনুশাসন সম্বন্ধীয় ব্যাপারে; অন্যগুলো শব্দের ব্যবহারে, কমা ও ছেদ ইত্যাদিতে, আর আছে স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণে; সূরার পর্যায়ক্রম ব্যাপারে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে কোনো সূরার চ্যাপ্টারই বাদ দেয়া ও কোরানে ছিল না এমন কয়েক চ্যাপ্টারের সংযোজন।

৭.৭ সূরা প্রারম্ভে উল্লেখিত অক্ষরসমূহ

২৯টি সূরায়, বেশিরভাগ মাদানী সূরা, আরম্ভ হয়েছে কতকগুলো অক্ষর দিয়ে। এগুলো সূরার টেক্সটের অংশ বলে ধরা হয় না, কিন্তু সম্পাদনার। এই অক্ষরগুলোর মাহাত্ম্য অজানা এবং এর অর্থ সম্বন্ধে সন্তোষজনক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। কিছু নিশ্ছিদ্র রহস্য ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে যাকে ঘিরে শুধু কল্পনার জাল বোনা হয়।

সূরার প্রারম্ভে এই অক্ষরের সমষ্টিকে নিয়ে বিভিন্ন অতীন্দ্রিয় ও দুর্বোধ্য পদ্ধতির মাধ্যমে এর অর্থ খোঁজা হয়, যা অবাস্তব। আরবি বর্ণমালার প্রত্যেক অক্ষরের (হরফ) গুপ্ত অর্থ আছে বলে বিশ্বাস করা হয় এবং এই অর্থ অক্ষরের আকারের মতো- পরিবর্তন হয় তার অবস্থান অনুযায়ী যেমন আরম্ভে থাকলে একরকম অর্থ, মধ্যে থাকলে আর এক রকম অর্থ এবং শেষে থাকলে অন্যরকম। আরবি মূল শব্দের দুই অক্ষরের সমষ্টি বা তিন অক্ষরের সমষ্টি আরও জটিল আকার ধারণ করে। কোনো কোনো পদ্ধতিতে (আবজাদ) প্রত্যেক অক্ষরের গাণিতিক মূল্য আছে এবং এর অর্থ বের করা হয় জেমাট্রিয়া (gematria) নীতি ব্যবহার করে, যেমন গ্রিক ও হিব্রু পদ্ধতিতে করা হয়। (Rabbanial Hebrewতে বলা হয় gematriya, গ্রিক-এ geometria-এ থেকে আসছে geometry)।

এই প্রারম্ভিক হরফগুলোকে বিভিন্নভাবে বলা হয়, আল্লাহর নামের আদ্যাক্ষর বা তাঁর গুণাবলি বা তাঁর রায় (ডিক্রি) অথবা সূরার অব্যবহৃত টাইটেল। অনেকে বিশ্বাস করেন যে এগুলো হচ্ছে ঐসব লেখক বা খতিবের নামের চিহ্ন (initials) যারা আয়াত লিখে রাখতেন অথবা আবৃত্তিকার ও হাফিজদের চিহ্ন, অথবা সম্ভবত জায়েদ ইবন থাবিতকে যারা কোরানের মূল খণ্ডিত অংশ দিয়েছিল তাদের সঙ্কেত কিংবা যারা আয়াত সংগ্রহ করেছেন অথবা যারা সংকলন করেছেন।

কোনো কোনো অক্ষর বিশেষভাবে ব্যাখ্যাত। যেমন অক্ষর বা হরফ নুন (N) যা সূরা ৬৮-এর আগে বসানো হয়েছে, ‘মাছ’ বলে অভিহিত করা হয়েছে, সাগর-দানব ‘বেহেমথ’-কে চিহ্নিত করে। হরফ কাফ (Q) সূরা ৫০-এর আগে আছে, এর অর্থ হচ্ছে পর্বতমালার বেড়ী যা পৃথিবীকে ঘিরে আছে। KHYAS অক্ষরগুলো, বলা হয়েছে, সূরা ১৯-এর আগে দিয়েছিলেন মোহাম্মদের ইহুদি কাতিব যা “কোহিয়াস (Kohgas)-এর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে, অর্থ হলো” এইভাবে তিনি (মোহাম্মদ) আদেশ করেছিলেন।

আবার বলা হয়েছে, ঐসব হরফগুলো প্যাগন দেবতাদের নাম স্মরণ রাখার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। ২৯টি সূরার মধ্যে ১৩টি সূরা আরম্ভ হয়েছে প্রারম্ভিক অক্ষর AL দিয়ে। এদের মধ্যে ৬টি আরম্ভ হয়েছে ALM, পাঁচটি ALR এবং বাকি দুটির মধ্যে একটিতে ALMS অন্যটি ALMR দিয়ে। অক্ষর AL (আল) অর্থাৎ ঈশ্বর; অন্যের মধ্যে আছে প্যাগন দেবতাদের নাম লুক্কায়িত। মেসোপটেমিয়ার সূর্য-দেবতার নাম সিন, হাদ্রামাত পর্যন্ত আরবে যে দেবতার পূজা হয়। এর নাম লুকিয়ে থাকতে পারে সূরা ৩৬-এর পূর্বে বসানো ys অক্ষরের মধ্যে। এর আরবি নাম হলো yasin (ইয়াসিন)। অন্যভাবে এর অর্থ করা হয়েছে ‘ইয়া ইনসান’, অর্থ হে মানব। কিন্তু সরলভাবে মনে হয় সূর্য দেবতাকে আহ্বান করার উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, ‘O Sin’, ওহে ‘সিন’ দেবতা।

আধুনিক পণ্ডিত ব্যক্তিদের মধ্যে হার্সফিল্ড (Hirsfild) এই মত পোষণ করেন যে, S অক্ষর (সাদ) হাফসাকে উদ্দেশ্য করে, K আবুবকরের জন্য এবং N ওসমানের জন্য। এই তিনজনই নিবিড়ভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন কোরান সঙ্কলনের সাথে। অন্য দিকে, নলডেক বিশ্বাস করেন যে প্রারম্ভিক অক্ষরগুলো অর্থহীন প্রতীকী স্বরূপ অথবা ম্যাজিক চিহ্ন। অটো লথ (otto Loth) এই অক্ষরগুলোর সাথে ইহুদিদের ক্যাবালিস্টিক মিস্টিক সিম্বল অর্থাৎ ইহুদি রাব্বীদের গুপ্তমন্ত্রের দুর্বোধ্য প্রতীক। এই ধরনের কাল্পনিক ও গুপ্ত রহস্যের কথাবার্তা অনেকে বাতিল করেছেন এই বলে যে, এগুলো আজগুবি, অবাস্তব ও স্বেচ্ছাচারী কথার ব্যবহার মাত্র, কিন্তু এই অক্ষরগুলো এখনো পর্যন্ত পণ্ডিতদের গবেষণার বিষয়। এইসব থিওরিগুলোকে বিবেচনা করে মন্টোগোমারি ওয়াট বলেন— ‘এই হরফগুলো রহস্যজনক’ (1970, P. 61)।

৭.৮ কোরানের সমালোচকগণ

মোহাম্মদের জীবদ্দশায়, মক্কা ও মদিনা উভয় শহরে, কোরানিক রিভিলেশনের বাস্তব ও সঠিক প্রকৃতি সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। তাঁর মৃত্যুর প্রায় পঁচিশ বছর পরে সরকারিভাবে স্বীকৃত সংকলিত কোরান সম্বন্ধে সমালোচকদের তীর্যক দৃষ্টি এড়ায়নি। এমনকি যারা ইসলাম ধর্ম মেনে চলে, তাদের মধ্যে অনেকে আছেন যারা বিশ্বাস করেন যে প্রফেটিক অনুপ্রেরণা প্রায়ই দৈবক্রমে (casually) এসেছে, এলোমেলোভাবে ডিকটেড করা হয়েছে, অসতর্কভাবে লেখা হয়েছে অথবা অসম্পূর্ণভাবে সংযোজিত হয়েছে।

অনেকে কতকগুলো আয়াতের উপস্থাপনে আপত্তি তুলেছিলেন; অন্যেরা আপত্তি করেছেন লম্বা লম্বা সূরার অনুপ্রবেশ, অনেকে পুরোপুরিভাবে অনুমোদন করেননি। কয়েকটি গোষ্ঠীর (sect) নেতা তাদের মধ্যে কতকগুলো শিয়া ধর্মবেত্তাসহ মনে করেন যে কোরানে কিছু অতিরিক্ত জিনিস যোগ করা হয়েছে, কিছু ছাঁটাই হয়েছে, কিছু সংশোধিত হয়েছে এবং বর্তমান চলতি কোরানকে অবিশ্বাস্য বলে (Falsified) প্ৰমাণ করা হয়েছে (Gold zi her, 1971, P. 109)।

অনেকে জিজ্ঞাসা করেন আল্লাহর কী এমন দরকার ছিল মরণশীল জীবের কাছ থেকে শপথ নেয়ার- যেমন, সে শপথ করছে ডুমুর ও জলপাই-এর এবং সিনাই পর্বতের নামে (৯৫ : ১), পতোন্মুখ দিবসের নামে (আসর নামাজের সময়) (১০৩ : ১), নক্ষত্র, রাত্রি এবং প্রত্যুষের নামে (৮১ : ১৫ – ১৮) সর্বোপরি, তারা জিজ্ঞাসা করে কেন আল্লাহকে তাঁর নিজের নামে শপথ করতে হলো (৯১ : ৫) যদিও এগুলোর পূর্ববর্তিতা (precedence) আছে যে, ঈশ্বর তাঁর নিজের নামে শপথ করেছেন (আদিপুস্তক ২২ : ১৬)। অনেকে সব প্যাসেজগুলো মিথ্যা বলে বাতিল করেছেন যে আল্লাহ মোহাম্মদের প্রতিপক্ষকে অভিশাপ দিচ্ছেন অথবা সেগুলো- যেখানে তিনি মোহাম্মদের শত্রুদের আবু লাহাব ও তার স্ত্রীর মতো জাহান্নামে ফেলছেন (১১১ : ১)। এইসব নগণ্য প্রতিহিংসাপরায়ণতা সর্বশক্তিমান ও দয়াময় আল্লাহর জন্য প্রযোজ্য নয় (not worthy of Himself)।

অনেকে সমস্ত সূরাগুলো অথেনটিক অর্থাৎ প্রামাণিক বলে গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। যেমন, আজারিদা ও মায়মুনিয়া গোষ্ঠী (seet) ১২ নং সুরাকে বাতিল করেন অর্থহীন বলে কারণ এতে ইউসুফ-জুলেখার (পটিফার স্ত্রী) প্রেম-কাহিনী আছে, (যেখানে এক বিবাহিত মহিলা প্রফেটকে প্রলুব্ধ করেছে), যা একটি মহান পবিত্র ধর্ম পুস্তকের অংশ হতে পারে না

আবদুল্লাহ ইবন মাসুদ নামে প্রফেটের একজন ব্যক্তিগত ভৃত্য, যিনি কোরানের ব্যাখ্যাকার হয়েছিলেন, তিনি তার নিজের জন্য একটি কোরান সংকলন করেছিলেন। এই কোরান কুফাতে অত্যন্ত মর্যাদা ও শ্রদ্ধা পেয়েছিল। ইনি কোরানের প্রথম সূরা এবং শেষ দুটি সূরা (নং ১১৩ ও ১১৪) কোরানের অংশ বলে মনে করেন না এবং তার সংকলিত টেক্সট থেকে সম্পূর্ণভাবে বাদ দিয়েছিলেন।

যদিও সুফিরা সাধারণভাবে কোরানের কোনো প্রত্যক্ষ সমালোচনা করেন না, তবে অনৈষ্টিক (unorthodox) ব্যাখ্যা করেছেন অনেক আয়াত সম্বন্ধে এবং বলেছেন যে ঐ সমস্ত আয়াত দ্ব্যর্থহীনভাবে অনুমোদিত নয়, শুধু রূপক অর্থে ব্যবহার করা যেতে পারে।

আল্লাহ যে কোরান গ্রন্থের রচয়িতা (author) এ ধারণা অনেকে গ্রহণ করেন না। সত্য বলতে কি, বহু মুসলিম চিন্তাবিদ শতাব্দি ধরে তাদের সন্দেহ প্রকাশ করে আসছেন। গোঁড়াবাদীদের মত হলো যে, কোরান সৃষ্ট নয়, অনন্তকাল ধরে রক্ষিত হয়ে এসেছে পৃথিবী সৃষ্টির পূর্ব থেকেই। তাই তারা সন্দেহবাদীদের অগ্রাহ্য করে।

কোরানের প্রাথমিক সমালোচক হলো মোতাজিলিরা, যাদের ইসলামের মুক্তচিন্তক ও যুক্তিবাদী দল বলা হয়। এই গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা হলেন সুফি রহস্যবাদী ওয়াসিল ইবন আতা (মৃ. ৭৪৯)। তিনি বসরার হাসানের শিষ্য ছিলেন। মুতাজিলিরা গ্রিক ও আলেক্সান্দ্রিয়ান লেখকদের সাথে পরিচিত ছিল অর্থাৎ তাদের জ্ঞানবিদ্যার সাথে পরিচয় ছিল, তাই এরা অনেক গ্রিক ধারণা ন্যায়বাদ ও সন্দেহবাদসহ ইসলামী দার্শনিক ও ধর্মীয় আলোচনায় প্রয়োগ ও আমদানি করেছিলেন।

কোরান যে অনন্ত ও অসৃষ্ট এই গৌড়াবাদী মতবাদকে মোতাজিলিরা মনে করেন যে এ ধারণা পোষণ করলে কোরানকে আল্লাহর সমকালীন (Coeval) বলা হয় যা অবাস্তব। এ ধারণা তাদের মতে, দ্বিত্ববাদের ধারণা যা আল্লাহর একত্বের বিরুদ্ধে এবং শিরক, অংশীদারিত্ব। কারণ কোরানকে সর্বশক্তিমান আল্লাহর সমতুল্য ও অনন্ত করা হচ্ছে।

তারা এই মত পোষণ করেন যে, কোরানের বাণীর হাজার হাজার খণ্ডিত ও বিক্ষিপ্ত মূল কপি, হাফসার কপিসহ যা সংকলকদের হেফাজতে গচ্ছিত ছিল সেগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে ধ্বংস করে ফেলার ফলে এখন সুবিধা হচ্ছে দাবি করতে যে এটি অনন্তকাল ধরে ছিল এককরূপে এবং অপরিবর্তিত রূপে, তবে ইতিহাসকে ফাঁকি দেয়া তো চলে না। এই কিতাবের স্টাইল ও রচনা আহামরি নয় এবং অলৌকিকও নয়। এই গ্রন্থ খাঁটি আরবি ভাষায় লিখিত নয়, এতে বহু বিদেশী শব্দ আছে। অকাট্য প্রমাণও আছে যে এর মধ্যে অনেক কাহিনী, প্যারাবেল ধার করা এবং পরিবর্তিত; আর এতে মোহাম্মদের ব্যক্তিগত মতামতও সন্নিবেশিত। সংক্ষেপে বলা যায়, তারা বলেছেন ও মত প্রকাশ করেছেন এই বলে যে, কোরান মোহাম্মদের রচিত গদ্য-কাব্য, অন্য কিছু নয়।

কোরান সম্বন্ধে মোতাজিলিদের অভিমত যে, এই গ্রন্থ অনিত্য জয়, সৃষ্ট ও উমাইয়া খলিফা দ্বিতীয় মারওয়ান (মৃ. ৭৪৯)-এর পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন এবং আব্বাসী খলিফাদের সরকারি সমর্থন পেয়েছে। আব্বাসী খলিফা মামুন (মৃ. ৮৩৩) ধর্মীয় আদালত গঠন করে এর প্রচলনও করেছেন।

মোতাজিলিদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল ইখওয়ানুস সাফার (প্রায় ৯০০ খ্রিস্টাব্দে), প্রধানত বসরাতে, সদস্যরা। এরা মোহাম্মদের মতবাদ (ডকট্রিন) সম্বন্ধে অনেক প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। ইথওয়ানুস সাফা (পবিত্র ভ্রাতৃসংঘ) গ্রিক ও হেলেনিস্টিক ভাবধারায় পুষ্ট এবং তাদের রচিত বিশ্ব কোষ পঞ্চাশ খণ্ডে সমাপ্ত একটি অনবদ্য অবদান। এরা খুব উদার মনোভাবাপন্ন ছিল, তাই এদের নীতি ছিল জ্ঞান আহরণে কোনো গোঁড়ামী থাকা উচিত নয়, কিংবা কোনো মতবাদের ওপর ফ্যানাটিক হওয়াও মানুষের কর্ম নয়। তাদের মুক্ত চিন্তা-ধারা ও উদারমনোবৃত্তির জন্য তারা কোরানের ব্যাখ্যা মুক্তভাবেই করত, এই কারণে তারা গোঁড়া মতবাদীদের রোষানলে পড়ে এবং খলিফা মুস্তানজিদ (মৃ. ১১৭০)কে প্রভাবিত করে তাদের সমস্ত পুস্তকাদি বিশ্বকোষসহ গণসম্মুখে বাজার প্রাঙ্গণে পুড়িয়ে নষ্ট করে ফেলা হয়।

৭.৯ কোরানের হস্তলিপি (script)

প্রাচীন আরবের লিখন পদ্ধতি অনেক দিক দিয়ে অভাবগ্রস্ত ছিল। প্রফেসর গিব বলেন, কোরান যে সময়ে সংকলিত হয়, আরবি লেখন পদ্ধতি অসম্পূর্ণ ছিল, লেখক ছাড়া পাঠোদ্ধার করা মুশকিল ছিল কারণ আরবি ভাষায় বিশেষজ্ঞান ছাড়া হস্তলিপি পাঠ করা বেশ কষ্টকর ছিল (1974, P. 39)।

ওসমানের এই গ্রন্থে সমরূপ ব্যঞ্জনবর্ণকে আলাদা করে পাঠ করা প্রায় অসম্ভব ছিল. স্বরবর্ণ ছিল না (যদিও আলিফ, ওয়াও ও ইয়া পরে স্বরবর্ণরূপে ব্যবহৃত হয়েছে) এবং কোনো বিশুদ্ধ বানানের জন্য (orthographic) চিহ্ন ছিল না। প্রাথমিকভাবে সংকলিত কোরানের যেসব কপি বিভিন্ন শহরে পাঠানো হয়েছিল সেগুলো প্রাথমিক হস্ত লিপিতে লেখা হওয়ার জন্য অসমরূপে লিখিত হয়। এই কারণে টেক্সট সম্বন্ধে বিরোধ উত্থাপিত হতে থাকে। শব্দের বানান, স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ, উচ্চারণ ও অর্থ বিভিন্নতার কারণে পাঠান্তর ঘটে এবং গ্রন্থের স্ব-বিরোধী ব্যাখ্যা শুরু হয়। কুফার মুসলিমরা ওসমানের সংকলিত কোরান বাতিল করে তাদের নিজস্ব ব্যবহার করতে শুরু করে।

উমাইয়া খলিফা আবদুল মালেকের সময় (মৃ. ৭০৫), বিভিন্ন রকম পঠন ভ্ৰমাত্মক উচ্চারণের কারণে ফ্রি-স্টাইলে কোরান আবৃত্তি ও ব্যাখ্যা ব্যাপকভাবে শুরু হয়ে যায়। আবদুল মালেকের গভর্নর হাজ্জাজ ইবন ইউসুফ একজন আরবি স্কলার ছিলেন ও শিক্ষকরূপে জীবন আরম্ভ করেন। তাঁকে খলিফা বিষয়টি বিবেচনা করে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে আদেশ দেন। তিনি তখন একজন বিখ্যাত সুফি পণ্ডিত বসরার হাসানকে অনুরোধ করেন কোরান পাঠ ও ব্যাখ্যার যাবতীয় গণ্ডগোল দূরীভূত করার জন্য। বসরার হাসান জনৈক ইয়াহিয়া (জন) ইবন ইয়ামারকে (তিনি ও বসরাবাসী) নিয়োগ করেন সমস্যার সমাধানের জন্য।

নেস্টোরিয়ান খ্রিস্টান কর্তৃক ব্যবহৃত ডট্ পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে এবং সিরিয়াক ভাষায় ব্যবহৃত অক্ষর সম্বন্ধে ব্যবহৃত চিহ্ন (diacritical) ও স্বরবর্ণ প্রয়োগ করে ইয়াহিয়া প্রথমে আরবি বর্ণলিপিতে হ্রস্ব ও দীর্ঘ স্বরবর্ণের পার্থক্য নির্ধারণ করেন; পরে ব্যঞ্জনবর্ণের মধ্যে যে সমরূপ ছিল তার পার্থক্য ও শব্দ এবং যুক্ত-ব্যঞ্জনবর্ণের উচ্চারণ নির্ধারণ করেন। এর পর একটি বাক্যে শব্দের মধ্যে বিভক্তি এবং কমা, পূৰ্ণ ছেদ, সেমিকোলন, কোলন ইত্যাদি বিরামচিহ্ন (punctuation)গুলোকে কয়েক বছরের মধ্যে ব্যবহারে এনে পাঠ ও আবৃত্তি এবং অর্থ সহজ করে ফেলেন।

আরবি বর্ণলিপি বা লিখন পদ্ধতি এই নতুন জিনিসের আমদানি সহসা সর্বজন কর্তৃক গৃহীত হলো না বা প্রসার লাভ করল না। যেসব চিহ্নগুলো ব্যবহারে চালু হলো তা সমভাবে প্রয়োগ হলো না শব্দের বানানগুলোও হলো না। ব্যাখ্যা বা অর্থ মানুষের মর্জির (ইখতিয়ার) ওপর নির্ভর করল। এরপরও গোঁড়াবাদীয়া আপত্তি তুলল ঐসব ডট্ ও চিহ্ন তো ওহির অংশ নয় বরং দেখা যাচ্ছে পবিত্র কিতাবে বিধর্মীদের জিনিস এনে ঢোকানো হচ্ছে। মহান সুন্নি মোহাদ্দেস খালিক ইবন আনাস (মৃ. ৭৯৫) এই সব ব্যবহার নিষিদ্ধ করে বলেন যে, এই সংশোধিত কিতাব মসজিদ সার্ভিসে নিষিদ্ধ। অন্যান্য পণ্ডিত ও আলেম ব্যক্তি, কয়েক জন খলিফা ও স্থানীয় বাদশারাসহ অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন আগের ‘চিহ্নহীন’ কোরানই থাকুক যেমন সিগেগগে তোরাহ আছে। বলা হয়ে থাকে যে, খোরাসানের গভর্নরকে যখন এক পাতা নমুনাস্বরূপ ডট ও বিরাম চিহ্নসহ লিখে দেয়া হয়, তিনি এই বলে আপত্তি করেন, এর ওপর কেন ‘ধনের বিচি’ (coriander seed) ছড়ানো হয়েছে। তিনি ঐ ডট ও বিরাম চিহ্নগুলো উল্লেখ করে এ কথা বলেন।

সর্বপ্রথম যে মনীষী এই সব সমস্যাগুলোকে সমাধান ও সমন্বয় করে. একটি আরবি ভাষার শব্দ ভাণ্ডার প্রস্তুত করেন তিনি ছিলেন হারুন (আরন) ইবন মুসা (মৃ. ৮১৩)। ইনি ইহুদি ছিলেন, পরে ইসলাম গ্রহণ করেন। হারুনের বইটি সর্বপ্রথম আরবি শব্দকোষ তৈরি করার পথ ত্বরান্বিত করে।

এটা বলা জরুরি যে, এই সব উন্নয়ন কোরানিক ভাষা সমস্যা ও সমালোচনায় যে মতদ্বৈধতা তার পরিসমাপ্তি ঘটল না। কারণ আরবি বর্ণমালা সমস্যা চলতে থাকল। এই অসম্পূর্ণতা থাকার কারণে পঠন-পার্থক্য সমস্যা রয়ে যায় এবং বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে প্রত্যেকে কোরান পাঠের জন্য প্রশিক্ষিত কুরার (এক বচনে কারী) জন্য নিজেদের স্কুল প্রতিষ্ঠা করে। সুতরাং বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন পঠন সমস্যা প্রকটভাবে দেখা দেয়, তখন উদ্ভূত সমস্যাকে সমাধানের জন্য আপোষ নীতির এবং ইজ্‌যার (একমত) আশ্রয় নিতে হয়।

এ ব্যাপারে প্রথমে পদক্ষেপ যিনি নেন, বলা হয়, তিনি হলেন ইবন মুজাহিদ (মৃ. ৯৩৬)। তখন আব্বাসী খিলাফতের সময়। প্রথমে দশটি, পরে সাতটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়; প্রতিষ্ঠা করেন বিখ্যাত এবং গোঁড়া আলেমগণ। তিনটি স্কুল কুফাতে এবং একটি করে বসরা, দামেস্ক, মক্কা ও মদিনায় এই স্কুলগুলোকে ‘অথরিটি’ হিসাবে গণ্য করা হয় এবং তাদের পঠন পদ্ধতি, উচ্চারণ, বিরাম চিহ্ন ইত্যাদির সোপারেশকে শাস্ত্রসম্মত (Orthodox) বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়।

এই গোলমেলে অবস্থা শতাব্দি ধরে চলল। পরে ঊনবিংশ শতাব্দির শেষ থেকে প্রিন্টেড ও লিথোগ্রাফ কোরানের কপি খুব সতর্কতার সাথে তৈরি করে সমরূপভাবে, যদিও এখনো বিশ্বজনীনভাবে গৃহীত হয়নি, বিতরণ করা হয় ইস্তাম্বুল ও কাইরো কেন্দ্ৰ থেকে এবং বর্তমান আবৃত্তি পদ্ধতি মোটামুটিভাবে অনুমোদিত হয়।

কোরানের হস্তলিপি ও প্রিন্টেড উভয়ই কপিগুলোতে অক্ষর সম্বন্ধে ব্যবহৃত চিহ্ন (dia critical)গুলোকে গ্রন্থের শুরুতেই ছাপানো থাকে যাতে পঠন-পাঠন ইত্যাদি বিষয়ে নিশ্চয়তা দেয়া থাকে। প্রায়ই অক্ষর সম্বন্ধে বেশ কতকগুলো চিহ্ন ব্যবহার করা হয়। কিন্তু স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ পঠন পার্থক্য আগের মতোই থেকে গেছে। কোরানের একটি স্ট্যান্ডার্ড ক্রিটিক্যাল সংস্করণ, সব কিছু বজায় রেখে, এখনো অপেক্ষা করছে আধুনিক পণ্ডিতদের পাণ্ডিত্য থেকে।

৭.১০ কোরানের ভাষা

দাবি করা হয় যে, কোরান খাঁটি আরবি ভাষায় লিখিত এবং ভাষার পরিপূর্ণতাকে প্রতিনিধিত্ব করে। মুসলিমরা উল্লেখ করে থাকেন যে ঈশ্বর শুধু এই পবিত্র গ্রন্থের বাণীর জন্য অথরিটি নন, শব্দের পবিত্রতা, ব্যাকরণের পরিপূর্ণতা এবং গতিশীল স্ট্যাইলের জন্যও অথরিটি ।

মোহাম্মদ হাওয়াজিন বেদুইনদের মধ্যে তার বাল্যাবস্থা অতিবাহিত করেন। এই হাওয়াজিন গোত্র ও তার নিজের কোরেশী গোত্রের সাথে কোনো সম্পর্ক ছিল না। যৌবনাবস্থা প্রাপ্ত হলে তিনি বাণিজ্য যাত্রা করেছিলেন প্যালেসটাইন ও সিরিয়াতে এবং সেখানকার ভাষা কিছুটা রপ্ত করে থাকবেন। হেজাজ ও তার আশপাশে কথিত বেশ কয়েকটি উপভাষার সাথে তার পরিচয় ছিল।

মোহাম্মদ তাঁর প্রাপ্ত রিভিলেশনে যে ভাষা ব্যবহার করেছেন তার প্রকৃতি ছিল সংকর জাতীয়। কেননা সে ভাষায় বিভিন্ন ভাষার সংমিশ্রণ ছিল। বলা হয় যে, কোরান অবতরিত হয়েছিল সাতটি বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষাতে অথবা আরবি উপভাষাতে এগুলো হলো, কোরেশ, হাওয়াজীন, থাকিফ (তায়েফের উপভাষা) এবং হোদাইল, আর কাইতান ও আরবদের তিনটি উপভাষা- যেমন, তাঈ, তামিম এবং ইয়েমেনি (হিমিয়ারাইট)। পরবর্তী পণ্ডিতগণ যারা ভাষার খাঁটিত্ব সম্বন্ধে বেশি জানতে চেয়েছিলেন তাদের প্রাক-ইসলামী যুগে আরবি কবিতার ভাষার দিকেও ফিরতে হয়েছিল।

উত্তর আরবের কোনো কোনো অপ্রচলিত ভাষার আভাসও পাওয়া যায় কোরানে ব্যবহৃত ভাষার মধ্যে, যে ভাষা অন্য কোথাও প্রচলিত ছিল না। O’Leary বলেন যে কোরানে ব্যবহৃত আরবি ভাষা থেকে বোঝা যায় যে, এ ক্ষয়িষ্ণু ভাষা। (1927, P. 24) এই সব কম্পোজিট (সংমিশ্রিত) ভাষা ব্যবহার করে মোহাম্মদ আরবিক ভার্সান নির্ধারণ (Fixed) করে দেন পাকাপাকিভাবে এবং এইভাবে সৃষ্ট হয় কোরানিক আরাবিক যা অদ্বিতীয়, অবিচল এবং অপরিবর্তিত ভাষা এবং এ ভাষার কোনো সমালোচনা কেউ করতে পারবে না।

ইসলাম বিস্তারের কালে চলতি আরবি গড়ে উঠল এবং স্বাধীনভাবে উন্নতি করতে থাকল (flourished), এর সাথে যোগ হয়ে গেল বিজিত রাজ্যের শব্দ ব্যাকরণ ইত্যাদি। এই প্রচলিত চলতি ভাষা ব্যাপক ব্যবহারের ফলে সাধারণ মানুষ কোরানের ভাষা থেকে সরে যেতে লাগল এবং পরবর্তীতে সে ভাষা দূরবর্তী ও অপরিচিত বলে মনে হতে থাকল। (Lyall, 1930 P. XXXVIII) এবং অচিরেই সে ভাষার ব্যবহার বন্ধ হয়ে গেল। কথিত ভাষা রূপে ব্যবহার বন্ধ হওয়ার পর কোরানের ভাষা প্রাচীন আরবি ভাষা বলে গণ্য হলো।

বেশ কয়েকটি হাদিসে উল্লেখ আছে যে, প্রফেটের অনেকগুলি ভাষায় দখল ছিল। এই ট্র্যাডিশন অনুযায়ী বলা হয় যে, বিভিন্ন গোত্র এবং জাতি, পার্সিয়ানসহ থেকে যে সব প্রতিনিধি বা লোক এসে প্রফেটের সাথে দেখা করত তিনি তাদের ভাষায় কথা বলতে চেষ্টা করতেন এবং কয়েকটি শব্দ বলতেনও (Tisdall, 1911, P. 257)।

কোরানে বিভিন্ন ভাষার সংমিশ্রণ থেকে প্রমাণিত হয় যে, প্রফেট মোহাম্মদের বিদেশী শব্দ সম্বন্ধে জ্ঞান ছিল। আধুনিক গবেষকরা কোরানে ব্যবহৃত বিদেশী শব্দের লিস্ট তৈরি করে দেখিয়েছেন যে সেখানে ২৭৫টি বিদেশী শব্দ আছে। তাদের মধ্যে আছে : হিব্রু, আরামাইক, সিরিয়াক (বা খ্রিস্টান আরামাইক- এখান থেকেই বেশি নেয়া হয়েছে), সাবাতিয়ান, ইথিওপিক পার্সিয়ান ও গ্রিক। মুসলিম পণ্ডিত সিউতি (মৃ. ১৫০৫)-এর সাথে যোগ দিয়েছেন ভারতীয়, মিশরীয়, কপটিক, তার্কিশ, নিগ্ৰো এবং বার্বার।

প্রাচীন মুসলিম তফসিরকারগণ এই বিদেশী শব্দ আমদানি বা ঋণের কথা স্বীকার করেছেন কিন্তু পরবর্তী তফসিরকারগণ, বিশেষ করে ইমাম মোহাম্মদ আল শাফিইর (মৃ. ৮২০) প্রভাবে, এই বিধর্মী কথাবার্তা বাতিল করেন এবং বলেন ভাষার অপরিপূর্ণতা, কপি করার সময় ভ্রমাদি এবং স্বর্গীয় ওহি (Revelation)-এর মাধ্যম রূপে আরবি ভাষা ছিল অপ্রতুল (inadequate)। কোরানের প্রতিটি অক্ষর ও শব্দ আল্লাহ্ কর্তৃক অনুপ্রাণিত বলে তারা ঘোষণা করেন এবং বলেন খাঁটি ও অবিকৃত আরবি ভাষায় লিখে রাখা হয়েছে। এই পবিত্র পুস্তক সব প্রকারের মিশ্রণ থেকে মুক্ত, নকলের বাইরে। এটা পরিপূর্ণ ও অভ্রান্ত গ্ৰন্থ

একই সময়ে, জানা যায় যে, মোহাম্মদ খোলাখুলিভাবে আরববাসীদের নিজের উপভাষায় কোরান আবৃত্তি করতে অনুমতি দিয়েছিলেন (আমীর আলি 1965, P. 186), সুতরাং অনুমিত হয় যে ইসলামী বিশ্বে বহু স্থানে দেশীয় ভাষা প্রচলিত ছিল। বিখ্যাত আবু হানিফার (মৃ. ৭৬৭) স্কুল আরবি ভাষা ছাড়া যে কোনো ভাষায় কোরান পাঠের অনুমোদন করেন। ইনি আফগান বংশীয় এবং বিখ্যাত জুরিস্ট (Grunebaum 1961, P. 152) ।

তবুও, বর্তমান আকারে কোরান সংকলিত হওয়ার কিছু পরে অধিকাংশ মুসলিম মোল্লা (Theologians) কোরানের অন্য ভাষায় অনুবাদ নিষিদ্ধ করেন, এই সন্দেহে যে অন্য ভাষায় অনূদিত হলে এর ব্যাখ্যা বিকৃত হতে পারে, মূল টেক্সট-এর নির্যাস (essence) বা অস্তিত্ব থেকে সরে যেতে পারে। এর জন্য শতাব্দিকাল ধরে, অধিকাংশ নন-আরব মুসলিম, যারা বিদেশে বাস করেন, তারা না বুঝেই এই আরবি গ্রন্থ মুখস্থ ও পড়তে শুরু করে, যা ইসলামের স্পিরিট বহির্ভূত।

পরবর্তীতে কোরানের অন্য ভাষায় অনুবাদের প্রশ্নটি বহু মুসলিম পণ্ডিত উত্থাপন করেন। কারণ, কোরানই শিক্ষা দিচ্ছে যে আল্লাহ প্রত্যেক জাতিকে তাদের নিজের ভাষায় আইন প্রদান করেছেন, যাতে তারা পড়তে পারে, বুঝতে পারে ও আলোচনা করতে পারে (৪১ : ৪৪)। আরবদের জন্যও তাদের ভাষায় আরবি কোরান পাঠানো হয়েছে যাতে তারা বুঝতে পারে (১২ : ২)।

এই আলোচনার আলোকে যুক্তি দেখানো হয় যে, একজনকে বুঝতে যে আরবি কোরান শুধু আরবদের জন্য, অ-আরবদের নয়। সুতরাং অ-আরব মুসলিমদের তাদের নিজের ভাষায় কোরান পাঠ করা উচিত কোরানকে বুঝবার জন্য।

তাই কোরানের অনুবাদ বিভিন্ন ভাষায় শুরু হয়ে গেল এবং বর্তমানে সত্তরটি ভাষায়, ইন্ডিয়ান ও আফ্রিকান ভাষাসহ কোরান অনূদিত হয়েছে। যদিও আরবি কোরানকে অথরিটি বিবেচনা করা হয়, অন্য ভাষায় অনূদিত কোরানের অবদান ও ব্যাখ্যা ইসলাম প্রচারে যথেষ্ট ভূমিকা পালন করেছে।

৭.১১ কোরানের স্টাইল

কোরানে বিভিন্ন স্টাইলের সন্নিবেশ ঘটেছে উৎফুল্লজনক (ecstatic) আয়াত, ছোট ছোট আয়াত থেকে দীর্ঘ গদ্যছন্দের প্যাসেজ পর্যন্ত। এই স্টাইলের বিভিন্নতা পণ্ডিত ব্যক্তিদের সাহায্য করেছে মক্কা ও মদিনায় অবতীর্ণ আয়াতগুলোকে পার্থক্য করতে।

শ্রুতিমধুর ও গদ্যছন্দে কোরানিক স্টাইলে ছোট ছোট কবিতা মোহাম্মদের সময়ের বহু পূর্বে আরবি কবি ও ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কারকগণ লিখে গেছেন, যেমন জাইদ ইবন আমর, কস ইবন সাইদা, তায়েফের উমাইয়া এবং আরো অনেকে। প্রাচীন এই ছোট কবিতার অনেকই জনপ্রিয়তা অর্জন করে ও মানুষের মুখে মুখে আবৃত্ত হয় অনেক সময় মনোমুগ্ধকরভাবে। প্রফেটের মক্কান প্রতিপক্ষরা, তাঁর অনুপ্রাণিত বাণীর সাথে প্রাচীন আরবি ক্ষুদ্র কবিতায় জ্ঞান ও মাধুর্যকে তুলনা করে প্রাচীন কবিদের বাণীগুলোকে বেশি জ্ঞান সমৃদ্ধ মনে করত।

ওসমানের কোরান সম্পাদনা ও সংকলনের পর, সূরাগুলোকে প্রশিক্ষিত কারীদের দ্বারা ভাবগম্ভীর কণ্ঠে পবিত্র আয়াত পাঠ করানো হতো যাতে মানুষ মুগ্ধ হয়। শিশুকাল থেকে আরবদের এই আবৃত্তি শুনিয়ে বড় করা হতো মস্তিষ্ক ধোলাই করার জন্য। পবিত্রগ্রন্থ থেকে আয়াত পাঠ করা হতো প্রত্যেক ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠান শুরু করার পূর্বে এবং শিশুর জন্মের সময় ও বৃদ্ধের বা যে কোনো বয়সী মানুষের মৃত্যুর সময় কোরান পাঠ হতো এবং সময়ের সাথে সাথে শ্রোতাদের অন্তরের গভীর ধর্মীয় উদ্দীপনা জাগানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। বিশ্বাসীদের উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে কোরানের প্যাসেজ মুখস্থ করতে ধর্মীয় সম্পদ মওজুদ করার জন্য।

কিন্তু তবুও শুরু থেকে কিছু প্রতিবাদকারীও ছিল যারা বলতে চেয়েছে যে কোরানের স্টাইল ও মর্যাদা নিয়ে বাড়াবাড়ি করা হচ্ছে। মোহাম্মদ চ্যালেঞ্জ করেছিলেন তোমরা দশটা সূরা (১১ : ১৬) বা এমনকি একটি সূরা (১০ : ১৬) যেমন কোরানে আছে তৈরি করো এবং মোল্লারা করেছিল এর সমতুল্য কোনো সূরা মানুষের দ্বারা তৈরি করা সম্ভব নয়। এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে কয়েকজন কবি সূরা রচনায় হাত দেন এবং তারা স্টাইল ও বিষয়বস্তু উভয়েই কোরানের সূরার সমতুল্য, এমনকি একে ছাড়িয়ে গেল উৎকৃষ্টতায়। যখন একজন কবিকে বলা হয় যে তোমার কবিতায় বা সূরায় সেই উৎফুল্লব্যঞ্জকের দ্যোতনা নেই যেমন আছে কোরান আবৃতিতে, তখন সেই কবি জবাবে বলেছিল : “আমারটা একশো বছর ধরে মসজিদে আবৃত্তি করা হোক, তারপর দেখো’ (Rodinson, 1976, P. 92)।

যুক্তিবাদী ও মুক্ত চিন্তার অধিকারী মোতাজিলিরা, কোরান যে অলৌকিক গ্রন্থ, গোঁড়াবাদীদের এই মন্তব্যকে মোকাবেলা করার জন্য প্রাচীন আরবি কবি ও জ্ঞানীব্যক্তিদের রচনা জনগণের মধ্যে বিতরণ করেছিল এবং দেখাতে চেয়েছিল যে এই প্রাচীন কবিদের রচনা স্টাইল এবং নৈতিক শিক্ষায় কোরামের চেয়ে অনেক উন্নত। মোতাজিলি লেখক এবং আরবি গদ্যের একজন বিশেষজ্ঞ আমর ইবন বাহার (মৃ. ৮৬৯) আলজাহিজ নামে খ্যাত- বলেছিলেন যে, কোরান রচনায় ও ভাষায়, একটি ভালো গ্রন্থ বটে, তবে পরিপূর্ণ আরবি ভাষায় নয় (not in perfection of Arabic)।

শতাব্দিকাল ধরে বেশ কয়েকজন লেখক দাবি করেছেন যে তারা কোরানিক স্টাইলে লিখতে সমর্থ। তাদের এই দাবির জন্য কয়েকজনকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। কবি ও অনুবাদক ইবন মুকাফা (মৃ. ৭৫৮) কোরানের মতো লিখতে গিয়ে অত্যাচারিত হয়ে মারা যান। ইনি জোরাস্ট্রিয়ান ছিলেন, কিন্তু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে এবং আরবি সাহিত্যে প্রভূত অবদান রেখে গেছেন।

পারস্যে জন্ম আরবি কবি বাসার ইবন বুরদ (মৃ. ৭৮৪) মুক্ত চিন্তা করতেন এবং বসরায় বাস করতেন। তিনি বলেছিলেন তার যে কোনো কবিতা যদি উপযুক্ত প্রশিক্ষিত কারীদ্বারা আবেগভরে পাঠ করানো হয়, তাহলে তা কোরানের সমতুল্য হবে। যখন তিনি একজন গায়িকাকে তার একটি কবিতা আবৃত্তি করতে শোনেন, তিনি উল্লাস প্রকাশ করে বলেন যে এটা কোরানের সূরা হাশর-এর চেয়ে ভালো।

একজন মোতাজিলি নিঃসঙ্গবাসী (recluse) আবু মুসা আল-মজদার (মৃ. ৮৪০), একজন কারমাতি লেখক মুতানাব্বি (মৃ. ৯৬৫), অন্ধ কবি আবু আলা মাতারি (মৃ. ১০৫৭) এবং মুক্ত চিন্তক মুহাদাবুদ্দিন আল-হিলি (মৃ. ১২০৫)-এরা তখনকার আরবি লেখকদের মধ্যে অন্যতম- ব্যক্তিগতভাবে বা তাদের হয়ে দাবি করা হয় যে তাদের রচনা স্টাইলে ও ভাষার সৌকর্যে এবং নৈতিকগুণে কোরানের সমতুল্য।

পশ্চিমা লেখকদের/পণ্ডিতদের অনেকেই যারা বিষয়বস্তু সম্বন্ধে জানার জন্য কোরান পড়েছেন সমালোচনা করার কারণে নয়, তারা মনে করেন এর অধিকাংশ, আঁদ্রে যেমন বলেছেন, পাঠে বিরক্তি ধরে যায়; এটা সত্যি যে, বেশির ভাগ ধর্ম পুস্তক পাঠে একই রকম বিরক্তি জমে যায়।

ঊনবিংশ শতাব্দির পশ্চিমা পণ্ডিতদের মধ্যে টমাস কারলাইল মোহাম্মদের প্রশংসা করেছেন। কিন্তু কোরান সম্বন্ধে তাঁর মত হলো– ‘a wearisome confused jumble, crude, incondite’ and complained of its endless iterations, long windedness, entanglement –insupportable stupidity, in short! Nothing but a sense of duty could carrry any European. the through The Koran!’ (Ruthven, 1984. P. 102) অর্থাৎ এমন এলোমেলো ও বিশৃংখল যে পড়তে বিরক্তি ধরে, অশোধিত ও অসংস্কৃত, অসমাপ্ত; তিনি অভিযোগ করেন যে এতে অসংখ্য পুনরাবৃত্তি আছে, কুণ্ডলী পাকানো রচনায় যুক্তিহীন বক্তব্য আছে যা সমর্থন করা যায় না। এ পুস্তক পাঠ করে কোনো ইউরোপিয়ান পাঠকের কর্তব্য পালন ছাড়া আর কিছু পাওয়ার নেই।

থিওডোর নলডেক একজন প্রখ্যাত আরবি স্কলার; তিনি কোরানের স্টাইলে যে অসম্পূর্ণতা আছে তার বিস্তারিত আলোচনা করে বলেছেন— আরবি ভাষায় যদি নমনীয়তা (flexibility) না থাকত, তাহলে কোরানের শেষাংশ দ্বিতীয়বারের জন্য পাঠ করা অসহ্য ঠেকত।

৭.১২ কোরানের দূর্বোধ্যতা

আরবি হস্তলিপির অসম্পূর্ণতা, অনেক আরবি শব্দের একাধিক অর্থ এবং প্রায়ই দ্ব্যর্থ- বোধক ভাষাতে লিখিত কোরান বলেই অনেক ব্যাকরণ ও অর্থ সম্বন্ধীয় (Semantic) সমস্যা দেখা দেয়। ফলে এই পবিত্র গ্রন্থের পঠনেও বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দেয়ার যাতে তফসিরকারদের জন্য ব্যাখ্যা করা কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়ায়।

কোরানের টেক্সটের মধ্যে স্বাভাবিক অসুবিধা ব্যতিরেকে, কোরানের অধিকাংশ দুর্বোধ্য এবং সময় সময় সানে-নজুলের জ্ঞান না থাকলে সংশ্লিষ্ট অংশ বোধগম্য হয়ে ওঠে না; অর্থাৎ কোনো ঘটনা ও অবস্থাতে আয়াত নাজেল হলো এবং কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা গ্রুপকে বলা হচ্ছে তা জানা না থাকলে অর্থ উদ্ধার করা কঠিন হয়। এসব বিষয়ে যেসব ট্র্যাডিশন আছে সবই আন্দাজের ওপর নির্ভর করে বর্ণিত।

একটি দুর্বোধ্য আয়াতকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে চরিতকার ও তফসিরকাররা কোরানের প্যাসেজ পরোক্ষভাবে বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করে থাকেন তাদের নিজস্ব ভাবধারায়। বিশেষ কোনো একটি আয়াতকে সত্যনিষ্ঠ করার জন্য গল্পের অবতারণা করা হয় এবং বলা হয় অমুক সময়ে অমুক ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন যখন আয়াতের ওহি নেমে আসে। এসব গল্পের বেশির ভাগই কাল্পনিক ও স্বকপোলকল্পিত।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কোরান বলছে, ‘যারা কুৎসা রটায়, গিবত করে তাদের ওপর লানত (১০৪ : ১) অন্য কথায়, দুর্ভোগ প্রত্যেকের, যে পশ্চাতে ও সম্মুখে লোকের নিন্দা করে। এটা একটা সরল সাবধান বাণী হতে পারত। কিন্তু তফসিরকাররা এর কারণ খুঁজে বের করেছেন কেন প্রফেট একথা বললেন। এটা বোঝাতে গিয়ে তারা (অনেক তফসিরকার প্রফেটের মৃত্যুর অনেক পরে জন্মেছেন গল্প ফেঁদেছেন, সংলাপসহ, ঐ লোক সম্বন্ধে যে প্রফেটের নিন্দা করেছে এই কারণেই এই আয়াতের আগমন। এমনকি সময়, ক্ষণ ও লোকের নামও উল্লেখ করা হয়েছে। এই ধরনের এক অপরাধীর নাম আখনাস ইবন শোরাইখ, অন্যজন হলো ওয়ালিদ ইবন মোগাইরা এবং আরো একজন হচ্ছে উমাইয়া ইবন খাল্‌ফ।

ফল হলো যে, কয়েকটি ঘটনা এবং বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যা একই আয়াতের পক্ষে দেয়া হয়, আর এগুলো পরস্পরবিরোধী হয়ে দাঁড়ায়। একটা সিঙ্গল শব্দগুচ্ছকে (Phrase) ডজন তফসিরকার বারো রকমের ব্যাখ্যা করেছেন এবং প্রত্যেকে তাদের নিজস্ব ভিন্ন মত ব্যক্ত করেছেন। অনেকে আবার শেষে বলেছেন, এর আসল অর্থ একমাত্র আল্লাহই জানেন, আল্লাহই সর্বজ্ঞ।

৭.১৩ কোরানে পরিবর্তন

প্রফেট মোহাম্মদের অবিশ্বাসী প্রতিপক্ষের মতে, তাঁর ডিকটেট করা গ্রন্থটিকে স্বর্গের অপরিবর্তনীয় গ্রন্থ বলে বিবেচনা করা যায় না, কারণ প্রফেটের দ্বারাই এর ঘন ঘন পরিবর্তন ঘটেছে, যিনি সময়ে সময়ে এক আয়াতের স্থানে অন্য আয়াত উপস্থাপন করেছেন (১৬ : ১০৩)। কোরানে যদিও বলা হয়েছে যে মোহাম্মদ নিজের ইচ্ছায় কোনো পরিবর্তন করেননি, করেছেন নির্দেশপ্রাপ্ত হয়ে (১০ : ১৬), এই ভাষ্যে প্রতিপক্ষের বক্তব্যকেও দুর্বল করা হয় না।

তথাকথিত শয়তানের আয়াতগুলো জনসম্মুখে অবতীর্ণ, আবার জনসম্মুখেই প্রত্যাহার করা হয়। এটা অজানা নয় যে, অনেক আয়াত যা পূর্বে প্রফেট মোহাম্মদ ডিকটেট করেছিলেন, পরে হারিয়ে গেছে, খুঁজে পাওয়া যায়নি। একজন কাতিব (আয়াত লেখক) আব্দুল্লাহ ইবন মাসুদ (প্রখ্যাত সাহাবী) প্রফেটের ডিকটেশনে একটি আয়াত লিখেছিলেন, কিন্তু পর দিন সেই লিখিত পাতাটি আর খুঁজে পাননি। এ ব্যাপারটি তিনি প্রফেট মোহাম্মদের কাছে ব্যক্ত করলে তিনি তাকে বলেন যে, রাতে সেই আয়াতটি বাতিল হয়েছিল।

নিন্দুকরা বলে থাকে প্রফেট মোহাম্মদ তাঁর কিতাবে প্রায়ই কিছু না কিছু নির্দেশ দিয়ে পরে তা বাতিল করে অন্য আদেশ দেন। একাধিক দৃষ্টান্তে তিনি (প্রফেট) তাঁর রিভিলেশনে কিছু বিষয় জুড়ে দিয়ে মূল অংশ বদলে দিয়েছেন আশপাশে বেষ্টিত সাহাবীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে (Being prompted by them)।

একবার ডিকটেশন দেবার সময় প্রফেট বলেন : যেসব মুসলিম বাড়িতে বসে থাকে তাদের মর্যাদা মুজাহিদদের (যারা আল্লাহর কারণে যুদ্ধ করে) থেকে কম। একথা শুনে এক অন্ধ মানুষ আবদুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুম অভিযোগ করে বলে, যদি তার অন্যদের মতো চোখ থাকত, নিশ্চয়ই সে-ও যুদ্ধে যেত। একথা শুনে প্রফেট ধ্যানমগ্ন হলেন এবং একটু পরে তার আগের বক্তব্য বদলে নতুন আয়াত বলেন। আয়াতটি হলো : যেসব মুসলিম ঘরে বসে থাকে, অক্ষম না হলে, তারা মুজাহিদদের (জেহাদী) সমান নয় (৪ : ৯৭)।

অন্য একজন কাতিব (আয়াত লেখক) আবদুল্লাহ ইবন সাদ (তৃতীয় খলিফা ওসমানের সৎভাই) নিজেই আয়াতে পরিবর্তন করতেন (আমির আলী 1965. P. 295) এবং একবার প্রফেট মোহাম্মদের ডিকটেশনের পর শেষে এক শব্দগুচ্ছ (Phrase) জুড়ে আয়াতটি সম্পূর্ণ করেন (২৩ : ১৪) এবং এই শব্দগুচ্ছ কোরানে উপস্থাপিত হয়েছে।

পরে আবদুল্লাহ ইসলাম পরিত্যাগ করে (abjured) মক্কায় পালিয়ে গর্ব করে বলে বেড়ান যে, কোরানের একটি বাক্যের তিনি রচয়িতা, কারণ তিনি শব্দগুচ্ছ জুড়ে দিয়ে আয়াত সম্পূর্ণ করেন। তার মতে রিভিলেশনটি ছিল প্রতারণা (hoax), (Glubb, 1979, P. 308)। প্রফেট মোহাম্মদের মাথায় যা আসত তিনি ডিকটেট করতেন (Thaalibi, 1968 P. 69) এবং তিনি নিজেই রিভিলেশনের শব্দগুলো পরিবর্তন করতেন।

এটাও দাবি করা হয় যে আবুবকর তার কন্যা আয়েশার (প্রফেটের প্রিয় পত্নী) মাধ্যমে প্রফেটকে প্রভাবিত করেছেন বাণী রচনায় এবং এটা সত্য যে আয়েশার সঙ্গে থাকা অবস্থায় প্রফেট বেশ কয়েকটি রিভিলেশন পেয়েছেন। বলা হয় যে, অন্য কয়েকটি রিভিলেশন এসেছে ওমরের পরামর্শে। বহুবার এমনও ঘটেছে যে, প্রফেট মোহাম্মদ মনস্থির করতে ইতস্তত করেছেন এবং রিভিলেশন পাওয়ার পূর্বে পরামর্শ চেয়েছেন। ওমরও গর্ব করতেন (সম্ভবত বিনয়ী হয়ে) এই বলে যে তিনি প্রফেটকে অনেকবার পরামর্শ দিয়েছেন, পরে অলৌকিকভাবে তা রিভিলেশনে পরিণত হয়ে আকাশ থেকে নেমে এসেছে (Rodinson, 1976, P. 219)। মুসলিম ধর্মতত্ত্ববিদরা স্বীকার করেছেন যে কোরানের আয়াতে পরিবর্তন হয়েছে ২২০ বার, কিন্তু ব্যাখ্যা করে বলেছেন এসব পরিবর্তন হয়েছে ‘বাতিলনীতি’ (doctrine of abrogation) অনুসরণ করে। এই মতানুসারে কোনো কোনো বিষয়ে বিশেষ অবস্থায় অনুপ্রেরণা কাজ করেছে তাও অস্থায়ী ভাবে এবং অবস্থার পরিবর্তনে সংশ্লিষ্ট আয়াত পরিবর্তিত হয়েছে, বাতিলও হয়েছে। উল্লেখ্য, ভুলবশত সংকলনের সময় কোরানে ছোটখাটো যেসব পরিবর্তন হয়েছে বা অন্যভাবে আয়াত লেখক (কাতিব), হাফিজ, নকলবিদ্ ইত্যাদিদের দ্বারা যা কিছু ঘটেছে এসব পরিবর্তনের সাথে প্রফেট মোহাম্মদ কর্তৃক পরিবর্তন আলাদা ব্যাপার, কারণ প্রফেট যা করেছেন তা স্বজ্ঞানে অবস্থার পরিবর্তনে বা কোনো সমস্যাকে সামাল দিতে করেছেন; আর সংকলনে বা লেখার কারণে, ভুলবশত যে পরিবর্তন হয়েছে তা হয়তো অনিচ্ছাকৃত। তবে আবুবকর, ওমর, ওসমান এবং উমাইয়া খলিফাদের প্রথম কয়েকজন ইচ্ছাকৃতভাবে, স্বার্থের কারণে, কোরানের আয়াতসমূহ পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করেছেন, তার থিওরি আলাদা। এ সম্বন্ধে পরে আলোচনা হবে।

৭.১৪ অসম্পূর্ণ কোরান

কোরান যে অসম্পূর্ণ গ্রন্থ এ বিষয়ে অনেকে মত প্রকাশ করেছেন। বলা হয় যে, ‘রিভিল্ড কোরান’ স্বর্গীয় কিতাবের পরিপূর্ণ প্রতিলিপি (transcript) নয় বা এটা দাবি করাও হয় না। এটা অচিন্তনীয় যে আল্লাহ ইহকাল ও পরকাল সম্বন্ধে যা অবতীর্ণ করেছেন তা একটিমাত্র গ্রন্থে ধারণ করা সম্ভব। কোরানেই এ কথা সমর্থন করেছে (১৮ : ১০৯)।

কোরানে পরিষ্কার ভাষায় বলা হয়েছে যে অন্যান্য নবী-রসূলের কাছে আল্লাহ যা ‘রিভিল’ করেছেন তার সব কিছুই প্রফেট মোহাম্মদের কাছে করা হয়নি। (৪ : ১৬২) আরো বলা হয়েছে, কোরান নৈতিকতার সংক্ষিপ্তসার (Compendium) নয় এবং লিগেল কোডও নয় এবং মুসলিম আইন ক্বচিৎ এর ওপর নির্ভর করে, এতে আইনের নীতি ব্যাখ্যাত আছে যা আছে অন্যান্য ধর্মেও।

প্রফেট মোহাম্মদ যত কথা ও বাণী বলেছেন তার সব কিছুই কোরানে ধারণ করা হয়নি। মোতাজিলিরা বলেন- কাতিব ও হাফিজরা সব সময়েই প্রস্তুত থাকত না লেখার জন্য যখন প্রফেট মোহাম্মদ প্রথমে রিভিলেশন পেতে শুরু করলেন এবং তিনি যা বলেছিলেন তার সবই লিখে রাখা সম্ভব হয়নি। এই কারণে অনেক কিছু হারিয়ে গেছে। এটাও সম্ভব যে, প্রফেট মোহাম্মদ নিজেই অনেক কিছুকে কোরানের অংশ হিসাবে লিখে রাখার মতো বিবেচনা করেননি (Watt, 1953, P. 47); এমনকি যখন বাণীগুলো লেখা শুরু হলো, তখন অনেক সময় বরং উল্টো-পাল্টা (haphazard) ভাবে লেখা হয়েছে, যা স্বাভাবিক। তখনো পর্যন্ত প্রফেট মোহাম্মদ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বরূপে পরিগণিত হননি এবং কেউ চিন্তা করেনি তাঁর বক্তব্যের আদি-অন্ত লিখে রাখা ভবিষ্যতে গুরুত্ব লাভ করবে।

এটাও সম্ভব যে, প্রফেট মোহাম্মদ নিজে কিছু স্মরণে রাখতে পারেননি বা কিছু অংশ ভুলে যেতে পারেন যা তাঁর কাছে অবতীর্ণ হয়েছে- এ সম্ভাব্যতা কোরানেও উল্লেখ আছে (২ : ১০০)। আবার কিছু সূরা এবং অনেক আয়াত, যা এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিল, হাফেজরা মুখস্থ করছিলেন। এই সব হাফেজদের কিছু স্মরণ না-ও থাকতে পারে যা হারিয়ে গেছে। তাছাড়া স্বাভাবিক মৃত্যু বা যুদ্ধে,

বিশেষ করে ইয়ামামা যুদ্ধে, হাফেজদের মৃত্যুর কারণে হারিয়ে যেতে পারে, নষ্ট হতে পারে, মূল বাণী বিকৃত বা দূষিত হতে পারে।

প্রফেটের স্ত্রী আয়েশার একটি হাদিস অনুযায়ী একটি সূরা যাতে সত্তরটি আয়াত ছিল (এর পূর্বে বলা হয়েছিল ২০০-এর অধিক আয়াত), ওসমানের সময় যখন কোরান সঙ্কলন শুরু হয় তখন ঐ আয়াতগুলোকে খুঁজে পাওয়া যায়নি (Guillaume, 1983, P. 191)। বিশ্বাস করা হয় যে, একটি পাতায় ব্যভিচারের কারণে পাথর ছুড়ে মারার বিধান ছিল, সেটাও হারিয়ে গেছে। আয়েশা বলেছেন যে, ঐ পাতাটি প্রফেটের শেষ অসুখের সময় বিছানার বালিশের তলায় ছিল, কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর যে অবস্থার সৃষ্টি হয় ঐ সময় একটা ছাগল ঘরে ঢুকে আয়াতসহ পাতাটি খেয়ে ফেলে (Rahman 1966, P.65)। আয়েশার এই বক্তব্যটিকে পরে মোতাজিলিরা উল্লেখ করে বলে আল্লাহ কেমন করে একটা ছাগলকে ঘরে ঢুকে পাতাটি খেয়ে ফেলতে অনুমতি দিলেন এবং স্বর্গ থেকে আগত একটি আইনের বিধানকে চিরকালের জন্য নষ্ট হতে দিলেন যা বিশ্বাসীদের পালন করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছিল?

এ কথাও উল্লেখ করা হয় যে ব্যক্তিগতভাবে অনেক মুসলিমের কাছে খুচরো খুচরো আয়াত সংগ্রহে ছিল; আবুবকর ও ওসমান যখন বিক্ষিপ্ত আয়াতগুলোকে কমিটির কাছে জমা দিতে বলেন, অনেকে জমা দেয়নি। কাজেই ঐসব জমা-না-দেয়া আয়াতগুলো কোরানে সঙ্কলিত হয়নি। প্রফেট মোহাম্মদের কাতিবদের একজন ওবেই ইবন ক্কাব নিজের জন্য একটি কোরান গ্রন্থ সঙ্কলন করেন। এই কোরান সিরিয়াতে বিশেষভাবে আদৃত হয়। এই কোরানের মধ্যে দুটো সূরা ছিল যা স্ট্যান্ডার্ড কোরানে (ওসমানের কোরানে) দেখা যায় না।

শিয়ারা (আলীর পার্টি) সুন্নিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি (তাহরিফ) অভিযোগ এনে বলেছেন যে, এই কোরানের টেক্সটে ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু অংশ বিকৃত করা হয়েছে কিংবা সেগুলোকে চাপা (suppress) দেয়া হয়েছে। তারা অভিযোগ করে যে, ওসমানের নির্দেশে, আলীর পক্ষে একটা গোটা সূরা যা মূল রিভিলেশনের অংশ ছিল, ইচ্ছাকৃতভাবে বাদ দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। সুতরাং এটা মিথ্যা দাবি যে ওসমানের কোরান একটি সম্পূর্ণ কোরান।

ওসমানী কোরান সঙ্কলিত হবার পর কয়েক দশক ধরে সময়ে সময়ে হাফেজরা ছোট ছোট আয়াতের সমষ্টি আবৃত্তি করেছেন যার উল্লেখ ওসমানী কোরানে ছিল না। অনেক মুদ্রায় এবং প্রতিলিপিতে অনেক ছোট শব্দগুচ্ছ ‘কোটেশন’ রূপে পাওয়া যায়, প্রফেটের ডিকটেটেড আয়াত বলে ধরা হয়েছে, তারও উল্লেখ ছিল সঙ্কলিত কোরানে।

একটা প্রাচীন ট্যাডিশনে বলে : কেউ যেন না বলে যে, সে কোরানের সব কিছুই জানে, কারণ কেউ কি বলতে পারে এর পরিপূর্ণতা কোথায়, যখন এর অনেক কিছুই অদৃশ্য হয়ে গেছে? বরং সে বলুক যা বর্তমানে আছে সে সেইটুকুই জানে।’ (Sweetman, 1985, P. 37)

৭.১৫ কবিতা রূপে কোরান

কোরান বলে, যারা গোল্লায় গেছে তারা কবিদের অনুসরণ করে (২৬ : ২২৪)। প্রফেট মোহাম্মদের প্রতিপক্ষ নিন্দাবাদ দিয়ে বলেছেন, কোরান কবির কবিতারই প্রতিনিধি (৬৯ : ৪১), স্বপ্নের জগাখিচুড়ি (medley) ২১ : ৫ এবং বৃদ্ধ মহিলাদের কেচ্ছার পুনরাবৃত্তি যা লিখে রাখা হয়েছে। (২৫ : ৬)।

এই গ্রন্থে কবিরা চিহ্নিত হবে বলেই প্রফেট মোহাম্মদ কবিদের ও তাদের কবিতা অপছন্দ করেছেন। এক হাদিস অনুযায়ী প্রফেট বলেছেন : কবিদের চেয়ে কোনো প্রাণী আমার কাছে ঘৃণ্য নয় এবং এমনকি আমি তাদের উপস্থিতি সহ্য করতে পারি না। আমি কবি হলে বা জ্বিনগ্রস্ত হলে আমার দুর্ভাগ্য হতো বলে মনে করি। আবার অন্য দিকে কবিদের ক্ষমতা ও জনপ্রিয়তা তার অজানা ছিল না, তাই তিনি নিজের কাজের জন্য কবিদের নিয়োগ করেছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোকে খণ্ডানোর জন্য তিনি প্রখ্যাত কবি হাসান ইবন থাবিবকে নিয়োগ করেন।

তবু, প্রফেট ও কবিদের মধ্যে তুলনাটা ভিত্তিহীন নয়। প্রথম দিকে কোরানিক বন্ধনগুলো মাপা শব্দে গ্রন্থিত এবং প্রায়ই গদ্য ছন্দে (সাজ) এবং শব্দগুচ্ছ প্রশংসিত স্টাইলে গাঁথা। এর ধ্বনি, দ্যোতনা এবং অভ্যন্তরীণ ছন্দ মানুষের মনকে মাতিয়ে দেয়। সূরা তাকভীরের (৮১) ১ – ১৩ আয়াত এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

অন্য কবিদের মতো প্রফেট মোহাম্মদকে গণকের মতো মনে হতো (৫২ : ২৯), ভূতগ্রস্ত (৪৪ : ১৩), জাদুগ্রস্ত (২৫ : ৯)। ঐ সময়ের গণক ও কবিদের যে স্বভাব ও আচরণ ছিল প্রফেটের বেশভূষায় তা প্রকাশ পেত। তিনি সময় সময় তাঁর মাথা চাদর (বারদা) দিয়ে ঢাকতেন যখন রিভিনেশন আসত। কবিদের মতো তিনি তাঁর অনুপ্রাণিত বাণী কাতিবদের ডিকটেট করতেন। প্রথম দিকের অনেক সূরার (নং ৩৭, ৬৮, ৭৭, ৮৫ ইত্যাদি) কবি ও গণকদের মতো শুরু করেছেন শপথ ফরমুলা’ দিয়ে। কবি ও জাদুকরদের ন্যায় শত্রুদের প্রত্যক্ষভাবে অভিশাপ ও অমঙ্গল কামনা করেছেন।

কয়েকজন তফসিরকারের মতে, প্রফেট যে কবি ছিলেন না, তিনি যে পাগল ছিলেন না (৩৭ : ৩৫), তিনি যে ভূতগ্রস্ত ছিলেন না (৫২ : ২৯), তিনি যে প্রতারিত হননি (২১ : ৫) – এই দাবির পেছনে কাজ করত তাঁর সন্দেহ, অনিশ্চয়তা এবং উদ্বিগ্নতা যে পরে তিনি যেন বিভ্রান্তির শিকার না হন। কিন্তু তাকে আশ্বস্ত করা হয়েছিল কেননা কোরানে বলা হয়েছে আমরা (ঈশ্বর) তাঁকে (মোহাম্মদ) কবিতা লেখা শিক্ষা দেই নাই, এটা তাঁর জন্য সমীচীনও নয় (৩৬ : ৬৯)।

৭.১৬ কোরানের গ্রন্থকারত্ব

মক্কাতে ও পরে মদিনাতে প্রফেটের মিশনের শুরু থেকেই তার সমসাময়িক ব্যক্তিবর্গ কোরানের (গ্রন্থকার) রচয়িতা হিসাবে তাঁর দাবিকে উপহাস, মস্করা করেছেন। তাঁর রিভিলেশনগুলো বাঁকা চোখে দেখে ভ্রূকুটি করেছেন, সেগুলো তাঁর স্বচরিত বা আবিষ্কার বলে (১১ : ১৬); এটাও বলা হয়েছে যে এই সব আবিষ্কারের দ্বারা কাজ ও অ-কাজকে ও মতামতকে অনুমোদন দেয়ার চেষ্টা করেছেন। তারা জাল (forge) বলে এই পবিত্র গ্রন্থ বাতিল করেছে (২৫ : ৫) এবং কোরান তাঁর তৈরি করা বলে অপবাদ দিয়েছেন (১৬ : ১০৩)।

এটা ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, প্রফেট তাঁর বক্তব্যকে সমর্থন দিতে আল্লাহকে হাজির করানোর জন্য সোজা পন্থা অবলম্বন করেছিলেন। একটি সূরা বা আয়াত আরম্ভ করা হয়েছে ‘বল’ (কুল) শব্দ দিয়ে যেন আল্লাহ মোহাম্মদকে আদেশ দিচ্ছেন অনুসরণ করতে। এই ‘বল’ আদেশ কোরানে ৩০০ বারের অধিক উল্লেখ করা হয়েছে।

বিরোধ জড়িত বিষয় সম্পর্কে এই পন্থায় সময় সময় যুক্তিতর্কের অবতারণা হতো, যেখানে প্রফেট প্রতিপক্ষের আপত্তিগুলো তুলে ধরতেন এবং পরে নিজেকেই নির্দেশ দিতেন সেগুলোর জবাব দিতে। এই রূপে, নিষিদ্ধ মাসে কেন যুদ্ধ করা প্রয়োজন তার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি নিম্নোক্ত ওহি পান— “তাহারা (প্রতিপক্ষ) তোমাকে (ওহে মোহাম্মদ) জিজ্ঞাসা করে নিষিদ্ধ (পবিত্র) মাসে যুদ্ধ করা সম্বন্ধে। বলো (তাদের)— ‘যুদ্ধ করা পবিত্র মাসে ভালো নয়, কিন্তু আল্লাহর পথ থেকে সরে যাওয়া আরও খারাপ’ (২ : ২১৪)।

প্রফেট মোহাম্মদের শত্রুরা অভিযোগ করে যে, কোরানের অধিকাংশ তাঁর মোহাম্মদ) রচনা এবং অনেক প্যাসেজের মাল-মশলা অন্য উৎস থেকে নকল করা হয়েছে কিংবা অন্যের কাছ থেকে ডিকটেশন নেয়া হয়েছে। তারা জোর দিয়ে বলে যে তাঁর (মোহাম্মদ) অনেকগুলো সহকারী ছিল তাঁর রিভিলেশন রচনা করার জন্য, এদের মধ্যে ইহুদি ও খ্রিস্টানও ছিল এবং তাদের (ইহুদি ও খ্রিস্টান) কিতাব তোরাহ ও ইঞ্জিল থেকে অনেক মেটিরিয়েল কোরানে ঢোকানো হয়েছে।

মোতাজিলি মুসলিমদের সাথে ইখওয়ানাল সাফা ও অন্যান্য যুক্তিবাদী দলের সমালোচকরা ইসলামের ইতিহাসে অনুরূপ রায় বিভিন্ন প্রকারে প্রকাশ করেছেন। প্রফেট মোহাম্মদের মতামত উল্লেখ করে তারা কোরানকে বলেছে ‘বর্ধিত হাদিস’। আধুনিককালে প্রখ্যাত লেখক সৈয়দ আমির আলী, যিনি ইসলাম সম্বন্ধে একটি বহুল প্রচারিত (মুসলিম ও অ-মুসলিমদের মধ্যে) গ্রন্থ লিখেছেন, প্রফেট মোহাম্মদকে কোরানের রচয়িতা বলে মনে করেন (Guillaume, 1983, p. 160)।

পশ্চিমা স্কলারগণও এই বলে মন্তব্য করেছেন যে কোরান মনুষ্যকৃত, যেখানে প্রফেটের নিজস্ব ব্যক্তিত্বের প্রতিফলন ঘটেছে। মোহাম্মদের গ্রন্থকারত্ব প্রকাশ পায় ও প্রমাণ করে গ্রন্থের অভ্যন্তরীণ সাক্ষ্য থেকে। কারণ, কোরানের অনেক মেটিরিয়াল বাইরের গ্রন্থ থেকে ধার করা, কিছু অংশ বাতিল, নতুন উপস্থাপন করা (abrogation)। সংশোধন করা, পরস্পরবিরোধী কথাবার্তা, স্টাইলের ছন্দপতন, অনেক প্যাসেজের তদর্থক প্রকৃতি (ad-hoc nature) এবং প্রফেটের ব্যক্তিগত মতামতের ইঙ্গিত, তাঁর ইচ্ছা ও দাবি, তাঁর পছন্দ ও অপছন্দ ইত্যাদি। তারা জিব্রাইল ও তদ্রূপ এজেন্টের মাধ্যমে পাওয়া স্বর্গীয় গ্রন্থকারত্বের ধারণাকে বাতিল করার কথা বলেন। ইতালীয় আরবি ভাষাবিদ লিওন সিতানি কোরানকে বলেছেন এক ধরনের সংবাদপত্র, যাতে দৈনন্দিন নির্দেশ ছাপা হয়েছে। বুলেটিন পারিবারিক বিষয়ে রায় এবং চলতি বিষয়ে অনেক সংবাদ ছাপা হয়েছে। বিভিন্নভাবে বলা হয়েছে যে কোরান ছিল প্রফেট মোহাম্মদের ‘দিনের কড়চা’, ‘বক্তব্য’, ‘ডায়েরি’, ‘টেবিল টক’, ‘সারমন’, ‘আত্মকাহিনী’ কথা বা আলোচনা এবং সমস্তই তার নিজের কথা ও কাজ।

৭.১৭ পরিবর্তিত কোরান

আজকের যে কোরান তা বর্তমান আকারে সংকলিত করা হয়েছিল তাঁর মৃত্যুর অন্তত পঁচিশ বছর পর। এই সময়ের মধ্যে টেক্সটের অনেক পরিবর্তন ঘটেছে এবং আরও পরিবর্তন আসতে পারে।

মক্কায় অবতীর্ণ বেশির ভাগ ছোট ছোট সূরা নতুন ধর্মের আধ্যাত্মিক কেন্দ্রবিন্দু ছিল এবং এগুলো নিয়মিত প্রার্থনায় ও রিচুয়েলে ব্যবহার করা হয় এবং এগুলোর ওপরেও ঘষামাজা হয়েছে বলে ধারণা করা হলেও মোটামুটি আগের মতোই আছে। কিন্তু মদিনার সূরাগুলোকে পরিবর্তন ও সংশোধন করার যথেষ্ট সুযোগ ঘটেছে. এবং প্রয়োজন বোধে, এমনকি নতুন মেটিরিয়েল দিয়ে উপস্থাপিত করা হয়েছে।

বিশ্বাস করার মতোই কারণ রয়েছে যে, খলিফারা যারা কোরান সংকলনের আদেশ দিয়েছিলেন এবং যারা এই টেক্সট রচনায় হাত দেন তারা পরবর্তী সূরাগুলোতে (মদিনার সূরা) পরিবর্তন এনেছেন, এমনকি কিছু বাদ দিয়ে নিজেদের কথা ঢুকিয়েছেন।

প্রফেট মোহাম্মদের মৃত্যুর পর প্রথমে বিক্ষিপ্ত ও ছড়িয়ে থাকা সব সূরা ও আয়াত সংগ্রহ করে একটা অসম্পাদিত সংকলন করা হয়েছিল এক বছর ধরে আবুবকরের অধীনে। আবুবকরের মৃত্যুর পর দ্বিতীয় খলিফা ওমরের কাছে দশ বছর ধরে সেই অসম্পাদিত কোরান পড়ে ছিল। আবুবকর ও ওমর উভয়েই উচ্চাভিলাষী ছিলেন। তাদের কাছে সেই কোরান থাকার সময়ে তারা যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছেন এর মধ্যে পরিবর্তন আনতে কিংবা নতুন কিছু সংযোজন করতে। যখন ওমর মারা যান, তখন বিশাল গ্রন্থের উপকরণ হিসাবে মেটেরিয়াল তৃতীয় খলিফা ওসমানের দখলে চলে আসে।

ওসমান ব্যক্তিগতভাবে কমিশনের সদস্যদের নির্বাচন করেন গ্রন্থের টেক্সটকে সম্পাদনা করার জন্য হাতে পাওয়া উপকরণসমূহ থেকে। সম্পাদনার পর এটা গ্রন্থ হয় ‘অথরাইজড ভার্সান অব দ্য কোয়ান’- অর্থাৎ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত কোরান। এই প্রক্রিয়া চলেছিল প্রায় দশ বছর ধরে। যেহেতু, এর সব কিছুই ওসমানের তত্ত্বাবধানে হয়েছিল, তাকেই চার্জ করা হয় সমস্ত সূরা নষ্ট করার জন্য এবং আসলে বলা হয় তিনি গ্রন্থটিকে ‘ছিঁড়ে খুঁড়ে’ দিয়েছেন— ‘torn up the Book’।

ইসলামের প্রথম তিন খলিফার কাছে কোরানের মেটেরিয়াল পড়ে ছিল প্রায় পঁচিশ বছর ধরে তারপর ওসমান কর্তৃক বর্তমান কোরান অনুমোদিত হয় এবং অনেক মুসলিম গোষ্ঠী আছে যারা অভিযোগ করে যে কোরানে এমন সর মেটিরিয়েল ঢোকানো হয়েছে যেগুলো প্রফেটের মাধ্যমে অবতীর্ণ হয়নি (Hourani 1991, P. 21)। শিয়ারা বিশ্বাস করেন যে তত্ত্বগত কারণে প্রফেটের উত্তরাধিকারী খলিফাদের প্রশাসনিক কারণে কোরান পরিবর্তন হয়েছে এবং অনেক প্যাসেজ প্রপাগাণ্ডার উদ্দেশ্যে জাল করা হয়েছে; তাই অনেকে সেগুলোকে স্বর্গীয় অনুপ্রাণিত প্যাসেজ বলে গণ্য করেন না।

আধুনিক রিভিশনিস্টি স্কলাররা আরও এককাঠি বাড়া। তারা ইঙ্গিত দেন যে, ওমরের সময় থেকে মুসলিম রাজ দ্রুত গতিতে বেড়ে যাওয়ায় এবং আরবের বাইরের লোকদের সংস্পর্শে আসার কারণে – বিশেষ করে উমাইয়া রাজত্বকালে এবং ইহুদি ও খ্রিস্টানদের সাথে ধর্মীয় বিষয়ে বিরোধের কারণে শুধু ওসমানের কোরানের সংশোধনের প্রয়োজন হয়নি, নতুন বিষয়বস্তু (মেটেরিয়েল) উপস্থাপন করে আরও একটি সংকলনের সৃষ্টি হয়েছিল।

ঐতিহাসিক আল কিন্দি (মৃ. ৯১৫) বলেন যে, কোরানের টেক্সটের সম্পূর্ণটা প্রতিদ্বন্দ্বী দলের লোকেরা অন্যায়ভাবে হস্তক্ষেপ করেছে (tamper) (Abbott, 1939 P. 48), যেটা প্রচলিত ছিল উমাইয়া খলিফা আবদুল মালেকের রাজত্বকাল পর্যন্ত।

উমাইয়া খলিফা প্রথম মারওয়ান হাফজার কাছে যে মূল গ্রন্থটি ছিল সেটা ধ্বংস করে ফেলেন। এতেই তার পুত্র খলিফা আবদুল মালেকের চোখ খুলে যায় এই গ্রন্থে আরো পরিবর্তন আনার জন্য এবং এটা করেন ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ ইবন ইউসুফের মাধ্যমে। কোরানের মধ্যে বিভিন্ন ভার্সান ও পঠনে অসুবিধা দূর করার কথা বলে এবং স্বরবর্ণ, ডটমার্ক ও পাংচুয়েশন আমদানি করে কোরানের টেক্সট অধিকাংশ‍ই সংশোধন ও সংযোজন করেন। তারপর বলতে গেলে একটা নতুন সংকলন চালু করা হয় (Abbott 1939, P. 47)।

আবুবকর, ওমর ও ওসমান যেসব পরিবর্তন করেছিলেন তা ছিল ব্যক্তিগত বা তত্ত্বগত কারণে কিন্তু উমাইয়ারা যে পরিবর্তন করেন, বলা হয় তা ছিল রাজনৈতিক, বংশগত ও রাজতন্ত্রের কারণে। পরিবর্তন প্রয়োজন হয়েছিল মুসলিম ধর্মকে আরো জোরদার করার জন্য, বিশেষভাবে আরব ধর্মগ্রন্থের ওপর সমর্থন দেয়ার জন্য। আরববাদের দাবিকে মজবুত করার জন্য, আরবদের সংস্কৃতি, ধর্ম ও নেতৃত্বকে প্রতিষ্ঠা ও রক্ষা করার জন্য এবং ইসলামকে ইহুদিবাদ ও খ্রিস্টানিটির ওপরে উৎকৃষ্ট ধর্মরূপে উপস্থাপন করার জন্য।

আরবরা যে সৃষ্টির মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট জাতি এই বিশ্বাস (৩ : ১০৬), আরব পবিত্র ভূমি, মক্কা পবিত্র নগরী, কাবা পৃথিবীর মধ্যমণি (naval of the earth), কোরান রিভিলেশনের মুকুটস্বরূপ এবং মোহাম্মদ প্রফেটদের মধ্যে প্রধান- এই সব প্রতিষ্ঠা করে আরব স্পিরিট জাগিয়ে অন্ধ দেশপ্রেমকে সমুন্নত করে তোলা এবং মুসলিম বিজয় ও প্রশাসনকে ন্যায়সঙ্গত প্রমাণ করা।

তখন থেকেই এই কোরানকে প্রচার করা হলো উৎকৃষ্ট বলে, পরিপূর্ণ বলে, স্বর্গীয়ভাবেপ্রাপ্ত বলে, অভ্রান্ত ও পরিবর্তনীয় বলে এবং এটাই হলো নতুন আরববাদের মেনিফেস্টো এবং স্বয়ং প্রফেট মোহাম্মদকে মূল আদর্শ মানবে রূপান্তর করা হলো আরব জাতির পেট্রিয়ার্ক বলে এবং অনেক উৎসাহী আরব তাকে অবতার- লোগস (Logos) রূপে সেমি ডিভাইন আসনে অধিষ্ঠিত করেছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *