১। প্রাচীন সংযোগ

১. প্রাচীন সংযোগ

আরব পেনিনসুলার একটি বিরাট অংশ বালুময়, পতিত ভূমির মতো। ক্লাসিক্যাল ভাষায় বলা হয় আরারিয়া ডেজার্টা। দক্ষিণের একটি বিশাল শূন্য অঞ্চল এই মরুভূমির সাথে সংযুক্ত আরব দেশে। রাব আল খালি বলে পরিচিত। উত্তর দিকে একটি অঞ্চলকে বলা হয় ‘নেফাদ’; আরও উত্তর দিকে আছে সিরিয়া মরুভূমি। কিন্তু এদেশের অনেক অংশ উর্বর ক্ষেত্র। প্রাচীনকাল থেকে এ দেশ অন্য দেশের সাথে বাণিজ্য করে বেশ ধনী হয়েছে।

ভৌগোলিকভাবে যদিও এদেশের বিরাট অংশ সিরিয়া মরুভূমি ও ভারত মহাসাগরের মধ্যে অবস্থিত, কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে আরব অঞ্চল শুধু নয় আরাবিয়ান, পেনিনসুলা, সিরিয়া, প্যালেস্টাইন ও মেসোপটেমিয়ার অংশও এর সাথে সংযুক্ত।

যে অঞ্চলে আরবরা বাস করে তা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পথের দ্বারা ক্রুশাকারে ছেদন করা (Criss-crossed) এবং শতাব্দী ধরে মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে লাগাতার সম্পর্কযুক্ত; ফলে বিভিন্ন দেশের সভ্যতার সংস্পর্শে আরবের সংস্কৃতি অন্তহীন প্রক্রিয়ায় পরিবর্তিত ও উন্নত। এই কারণে বিভিন্ন দেশের ব্যবসাদারদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। বিদেশী সওদাগরদের চলাচলের সুবিধার জন্য আরবরা উট এবং গাইড সরবরাহ করেছে, এমনকি সশস্ত্র প্রহরীও যোগান দিয়েছে, বেদুইনদের আক্রমণ প্রতিহত করে নিরাপদে গন্তব্য স্থানে পৌঁছানোর জন্য। এই সুবিধার জন্য অনেক জাতি এই অঞ্চলে বাণিজ্যের কারণে জড়িয়ে পড়ে। বাণিজ্য এজেন্ট এবং বিভিন্ন ধর্মের মিশনারি এই অঞ্চলে তাদের স্থায়ী আবাসস্থল স্থাপনও করতে পেরেছে।

আরবরা ভবঘুরে বেদুইন ছিল, স্থায়ী বাসিন্দাও ছিল। বাণিজ্যের সংস্পর্শে এসে প্রাচীন মিশর, মেসোপটেমিয়া ও পারস্যে ঐতিহাসিক তথ্য ও নথিপত্রের সাথে পরিচিত হয়ে ওঠে; ইহুদি, গ্রিক ও রোমানদের ইতিহাস ও সংস্কৃতির সংস্পর্শেও আসে। এই সব প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতি আরবের সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে উন্নত করে। সিরিয়াক ও বাইজানটাইন লেখন পদ্ধতির মাধ্যমে এসব দেশের সাথে নিগূঢ়ভাবে পরিচিত হয়। যাই হোক, মোসলেমদের রাজত্বকালে আরবীয় লেখক ও ঐতিহাসিকগণ এই সংস্পর্শের কথা বিস্তারিতভাবে লিপিবদ্ধ করার সুযোগ পাননি, হয়তো রাজনৈতিক বা অন্য কোনো কারণে। তবে এটা স্পষ্ট যে, এক সময়ে আরবরা বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ছিল তবে আরাবিয়া মধ্যপ্রাচ্যের একটি অংশবিশেষ বলে গণ্য হতো এবং সব সময়েই পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের সংস্পর্শে এসে ধীরে ধীরে ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়ে। বিদ্যমান নথিপত্র যা পাওয়া যায়, তার থেকে একটা অবস্থার ধারণা পাওয়া গেছে, নিম্নে বর্ণিত ইতিহাস থেকে সে সূত্র মিলে।

১.১ মিশর

প্রাচীনকাল থেকে মিশর মিসর’ বলে পরিচিত। ওল্ড টেস্টামেন্টে এদেশ মিজরাইম’ বলে চিহ্নিত। ঐতিহাসিকভাবে প্রামাণ্য সাক্ষ্য মিলে যে মিশর তখন উন্নত সংস্কৃতির দেশ এবং বিশ্বের সকল সভ্যতার মাতামহী (Grandma) বলে স্বীকৃত।

মিশরের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারে লোহিত সাগরের মুখ্য ভূমিকা আছে।

প্রায় খ্রিঃপূর্ব ২৭৫০ সাল থেকে মিশরের শাসকবর্গ নৌ-পথে আক্রমণ শুরু করে; উদ্দেশ্য ছিল নুবিয়া থেকে হাতির দাঁত ও দাস-দাসী সংগ্রহ করা, কারণ অন্য পথের চেয়ে নদী পথেই নুবিয়া যাওয়া সহজতর ছিল। এছাড়া ‘পুনট’, ওল্ড টেস্টামেন্টে ফুট (Phut), সম্ভবত আফ্রিকার সোমালিয়া থেকে সোনা, সিনাই থেকে তামা, হাবিলা (সম্ভবত নাজরান) থেকে মশলাপাতি ও দামি মেটালদ্রব্য আনা। দক্ষিণ আরবের হিমিয়ার অঞ্চল থেকে মৃতদেহ সংরক্ষণের জন্য ও দেবতাদের পূজোর কারণে ধূপ ও অন্যান্য দ্রব্যাদি আমদানি হতো। মিশরির মন্দিরের নথিপত্র উদ্ধৃত করে গ্রিক ঐতিহাসিক হিরোডোটাস (মৃত খ্রিঃপূঃ ৪২৫) বলেছেন যে, প্রথম সিসোট্রিস (Sesostris I) বাণিজ্য পথের নিরাপত্তার কারণে লোহিত সাগরের তীরবর্তী অঞ্চলে অভিযান চালিয়ে তার দখলে আনেন।

১ম থুতমাসিসের সময়ে (মৃ. প্রায় খ্রিঃপূঃ ১৫১২) (১৮তম বংশের সম্রাট) প্যালেস্টাইন, উত্তর আরাবিয়া, মেসোপটেমিয়া ও সিরিয়ায় অভিযান চালিয়ে সেসব অঞ্চল করায়ত্ত করেন, এতে মিশরের ফেরাওরা তাদের সাম্রাজ্যের পূর্ব দিকে ইউফ্রেটিস পর্যন্ত সীমানা বিস্তৃত করে।

খ্রিঃপূঃ ১৪৯০-এ রানী হাটশেপসুট (Hatshepsut) সিনাই-এর তামার খনিকে পরিবর্ধন করেন, যা শতাব্দি পূর্বে মিশরীয়রা দখল করেছিল এবং এরপর থেকে এই খনি মিশরে তামা সরবরাহে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। হাটশেপসুট লোহিত সাগর এলাকায় এবং পুনট-এ অভিযান চালিয়ে ঐ সব এলাকা সুরক্ষিত করেন নিরাপদ বাণিজ্যের কারণে। এই সময়েই মিশরীয়রা সিনাই, উত্তর আরব ও মেসোপটেমিয়ার মধ্য দিয়ে যাত্রার সুবিধার জন্য রাস্তাঘাট তৈরি করে। একটি রাস্তা আকাবা বন্দর থেকে তাইমার মধ্য দিয়ে ব্যাবিলনের উত্তর সীমানায় চলে যায়, যার কারণে মিশরের সম্রাটের সাথে মেসোপটেমিয়ার শাসকের বেশ কয়েকটি সংঘর্ষ সংঘটিত হয়। পরবর্তীতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মিশরীয় হাইওয়ে তাইমিয়া থেকে হিজাজ ও সিমিয়ার পর্যন্ত চলে যায়, মাঝে স্থানে স্থানে বিরতির স্থান তৈরি হয় বিশ্রামের জন্য। এই হাইওয়ের এক বিরতি স্থানে এক সময় ইথরেব (মদিনা) শহর গজিয়ে ওঠে। এই শহরের ইথরের নাম মূলত মিশরীয়, কারণ এর সাথে নীলনদের মুখে ব-দ্বীপে এবং আপার ইজিপ্টে অবস্থিত আথরিবিস (Athribis) শহরের সাথে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। প্রাচীন ভূগোলবিদদের কাছে ইথরিব লাথরিপ্পা বলে পরিচিত ছিল।

বিদেশীদের প্রভাব যে আরবে পড়েছিল তার নিদর্শন পাওয়া যায় দক্ষিণ আরবে সেচ কর্মের জন্য বিশালাকার ড্যামের (Dam) অস্তিত্ব নদীমাতৃক দেশের সংস্কৃতিতে এবং এই সংস্কৃতি হয় মিশরীয় নয়তো মেসোপটেমিয়ার (ইরাক)। তাছাড়া আরবে যে স্থাপত্য শিল্পের উপস্থিতি ছিল তার নিদর্শনও মিশর কিংবা মেসোপটেমিয়ার সাথে মিলে যায়। তাই এই সব নিদর্শন ও প্রভাব নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে দেয় আরবের ওপর এই দুই বিদেশী দেশের প্রভাব।

একেশ্বরবাদের প্রথম উত্থান হয় মিশরে ফেরাও আথেনাটেন-এর সময় (মৃ. খ্রিঃপূঃ ১৩৬২) এবং সেই সময় মিশরে যেসব ইহুদি বসবাস করছিল তাদের এই মিশরীয় ঈশ্বরবাদ প্রভাবিত করতে পারে। পণ্ডিত ব্যক্তিরা এই একেশ্বরবাদের চিহ্ন খুঁজে পান বেশ কিছু হিমিয়ারাইট (দক্ষিণ আরব) উৎকীর্ণ লিপিতে (Inscriptions); এ নিদর্শন হিব্রুদের সংস্পর্শে এসে তাদের একেশ্বরবাদে উৎসাহিত করতে পারে।

মিশরীয় সর্বেশ্বরবাদও মক্কার চারদিক জুড়ে যেসব দেব-দেবী বিরাজ করত সম্ভবত সেগুলোকেও প্রভাবিত করেছিল।

১.২ মেসোপটেমিয়া (ইরাক)

টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদী বেষ্টিত যে ভূমাঞ্চল আরবদের কাছে ‘জেজিরা’ (দ্বীপ) বলে পরিচিত ছিল, পরবর্তীতে উত্তর অঞ্চলের নদীবেষ্টিত এলাকাকে প্রাচীন পণ্ডিতরা দ্বীপ বলেই চিহ্নিত করেছেন।

মিশরের মতো এই অঞ্চল খ্রিঃপূঃ ২৫০০ সাল থেকে আরব দেশের সংস্পর্শে আসে, এর নিদর্শন পাওয়া যায় আক্কাদিয়ানদের উৎকীর্ণ কিলক লিপি (Cuneiform inscription) থেকে।

আক্কাদিয়ানরা উত্তরের সিমিটিক দলভুক্ত। মধ্য এশিয়া থেকে আগত নন- সিমিটিক সুমারিয়ানরা এদেশের উত্তরাঞ্চলে বসবাস করত।

এই সুমারিয়ান জাতি আস্তে আস্তে সারা মেসোপটেমিয়ার ওপর প্রভুত্ব বিস্তার করে। পরবর্তীতে এই কারণে এই অঞ্চলে সিমিটিক ও নন-সিমিটিক মিশ্র লোক সংখ্যায় পরিণত হয় এবং সেই থেকে আজ পর্যন্ত এই মিশ্র লোক সংখ্যায় এ দেশ পরিপূর্ণ। সুমারিয়ার একটি নগর রাজ্য ইরেক থেকেই আধুনিককালের ইরাক নামে স্থিতি লাভ করে। এরেকের দক্ষিণে আর একটি মেসোপটেমীয় শহর কলদীয় ‘উর’ নামে পরিচিত ছিল। প্রাচীন সেমিটিক শব্দ ‘উর’ অর্থ দুর্গ। এই উর শহর আব্রাহামের পৈত্রিক শহর। আব্রাহামই ইহুদিদের পূর্ব-পুরুষ এবং উত্তর-আরবদেরও।

এই মেসোপটেমিয়ায় আক্কাদিয়ান ও সুমারিয়ানদের পর আসে এসিরিয়ান ও ব্যাবিলনিয়ানরা। এরা পূর্বসূরিদের মতো স্থানীয় বাসীদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখলেও পার্শ্ববর্তী ও প্রতিবেশী জাতির সাথে ঘন ঘন বিরোধে জড়িয়ে পড়তো।

মেসোপটেমিয়ার শাসকবর্গ দিলমুন (বাহেরায়েন), হাসসা (প্রাচীন গেরহা)-এর ওমানের দক্ষিণ দিক পর্যন্ত তাদের বাণিজ্যতরী পাঠিয়েছিল। এসিরিয়ান রাজা তুকুলতি নিনিব (প্রায় খ্রিঃপূঃ ১২৬০)-এর নথিপত্র থেকে পাওয়া যায় যে, এসব অঞ্চল ও দেশ তার অধীনে ছিল, কিন্তু এওহতে পারে যে সেসব দেশ শুধু বাণিজ্য বন্ধু দেশ ছিল (Friendly trading countries)।

খ্রিঃপূঃ ৪৫৪-এ এসিরিয়ান উৎকীর্ণ লিপিতে আরিবি (আরব) নাম পাওয়া যায়। বর্ণিত যে, গিন্দিবু বলে এক আরব এসিরিয়ান রাজা তৃতীয় লাল শালমেনসের (Shalmaneser III)-এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিল এবং রাজার শত্রুদের সাহায্যে এক হাজার উট সরবরাহ করেছিল। ৭৩৮ খ্রিঃপূর্বে এক উৎকীর্ণ লিপিতে প্রকাশ যে আরিবির এক রাজা আরাবিয়ান কেদার গোষ্ঠীর পুরোহিত রানী জাবিবাকে পরাস্ত করে উত্তর হিজাজ দখল করে নেয়। এই উৎকীর্ণ লিপি পাওয়া যায় এসিরিয়ান কিং তৃতীয় তিগলাত পাইলেসার (Tiglath Pileser III)-এর সময়ে। কেদার গোষ্ঠী তাম্বুবাসী এবং যুদ্ধপ্রিয় আরব দল। তারা তীর-ধনুকে অতি পারদর্শী ছিল। এদের কথা বাইবেলে উল্লেখ আছে। আরবের এই কেদার গোষ্ঠীর আদি পুরুষ (Progenitor) ছিল কেদর, ইসমাইলের পুত্র (আদি পুস্তক ২৫:১৩)। দামেস্কের দক্ষিণ-পশ্চিমে একটা বিশাল এলাকা জুড়ে তারা বসবাস করত।

৭১৫ খ্রিঃপূর্বাব্দে এসিরিয়ার দ্বিতীয় সারগন (Sargan II) আরব গোষ্ঠীদের উচিত শিক্ষা দেয়ার মনস্থ করেন, ইয়েমেন থেকে হাদ্রামাত পর্যন্ত বাণিজ্য পথে আরবদের লুটতরাজ বন্ধ করার জন্য। এই আরব গোষ্ঠীতে থামুদ ও আরাবি অন্তর্ভুক্ত ছিল। এদের মধ্যে যারা সারগনকে শ্বেত উষ্ট্র উপহার দিয়েছিল, তাদের মধ্যে উত্তর মরুভূমির আরবি সম্রাজ্ঞী শমসি এবং দক্ষিণ আরবের সাবার রাজা ইয়াথামরের নাম উল্লেখযোগ্য।

খ্রিঃপূঃ ৭০৩ অব্দে আরিবির রানী ইয়াতি তার ভাইয়ের অধীনে একদল সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন ব্যাবিলনিয়ানদের সাহায্যে এসিরিয়ার সেনাচেরিবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রার; ফলে সেনাচেরিব ৬৯০ খ্রিঃপূর্বাব্দে আরিবিদের বিরুদ্ধে একটি পিটুনি অভিযাত্রার আয়োজন করেন তাদের সায়েস্তা করতে। কিন্তু আরবরা এতে বিচলিত না হয়ে তাদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে থাকে। এর ফলশ্রুতিতে ৬৭৬ খ্রিঃপূর্বাব্দে এসিরিয়ার রাজা এসারহেডন (Esarhedon) আরবের রানী তাইল খুনুকে (Tayl Khunu) আটকে তার বোন তুববা (Tubwa)সহ নাইনেভে নির্বাসিত করেন। কেননা তারা সর্বদা এসিরিয়ার বিরুদ্ধে ব্যাবিলনকে সাহায্য জুগিয়ে চলছিল। কেদার গোষ্ঠীর রাজা হাজাইলের সাথে পরে তুববার বিয়ে দেয়া হয়। পরবর্তীতে কোনো এক আরব গোত্র প্রধান উয়াবুর (ওয়াহাব) অধীনে এক বিদ্রোহ দেখা দিলে এসিরিয়ানরা তা সমূলে উৎপাটন করে।

৬৬০ খ্রিঃপূর্বাব্দে এসিরিয়ার শেষ কৃতী সম্রাট অসুরবানিপাল (গ্রিকদের কাছে সারদানাপলাস) আরিবিদের বিরুদ্ধে অভিযান চালান। পরে, ৬৪৮ খ্রিঃপূর্বাব্দে তিনি উণ্ড (Ushu) (পালমিরা) অঞ্চলে এক আরব বিদ্রোহ দমন করেন। এই বিদ্রোহীদের মধ্যে কেদারের রাজা আমুলাদি ও তার সহযোগী পার্শ্ববর্তী গোত্রের রানী আদিয়াসহ ধরা পড়েন।

৬১২ খ্রিঃপূর্বাব্দে ব্যাবিলনের নাবোপোলাসার (Nabopolassar) এসিরীয় রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং নিওব্যাবিলনীয় (কলদীয়) রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে ব্যাবিলনিয়া অধিকার করেন। ৬০৬ খ্রিঃপূর্বাব্দে তিনি মেডেস-এর সাথে বন্ধুত্ব করে এসিরীয় রাজধানী নাইনেভ দখলে নেন। তারপর থেকেই ব্যাবিলনের শক্তি ও বিক্রম বাড়তে থাকে।

৫৮০ খ্রিঃপূর্বাব্দে আবার আরবদের সাথে যোগ দিয়ে বিশৃংখলা সৃষ্টি করায় ব্যাবিলনীয় সম্রাট দ্বিতীয় নেবুচেদনজর (Nebuchadnezzar II) কেদারদের ধমক দিলে তারা কর দিতে প্রস্তাব করে। কিন্তু সম্রাট এই দুষ্কৃতকারী আরবদের একটা উচিত শিক্ষা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এই অভিযানে যেসব আরব প্রাণ হারায় তাদের মধ্যে নেতৃত্বদানকারী যোদ্ধা আদনান অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই নেতার পুত্র মাআদ, হত্যাযজ্ঞ থেকে কোনো প্রকারে প্রাণ বাঁচিয়ে হেজাজে পলায়ন করে। এই মাআদ প্রফেট মোহাম্মদের দূরবর্তী পূর্বসূরিদের মধ্যে একজন বলে অনেকে ধারণা করেন।

৫৫২ খ্রিঃপূর্বাব্দে নাবোনিদাস (Nabonidus) ছিলেন ব্যাবিলনের শেষ রাজা। তিনি উত্তর হেজাজের এক শহর দখল করেন। এই শহরের নাম তাইমা, পরে তাঈ গোষ্ঠীর কেন্দ্রভূমিতে পরিণত হয়। রাজা নাবোনিদাস ব্যক্তিগতভাবে এই শহর পরিদর্শন করে একে তাঁর ক্ষমতার আসনে রূপান্তর করেন এবং ইথরিব (মদিনা) পর্যন্ত আরবদের দমন করেন ও পুত্র বেলশাহজারে (Belshazzar) হাতে ব্যাবিলনের ভার দেন। পরে ব্যাবিলন পারস্যদের দ্বারা ৩৫৯ খ্রিস্টাব্দে অধিকৃত হয়। বেলশাহজার পরাজিত ও নিহত হন।

১.৩ ইহুদি জাতি

প্রাচীন আরব ইতিহাসকে জানতে হলে ওল্ড টেস্টামেন্টের ওপর ভরসা করতে হয়। ঐতিহাসিকদের জন্য ওল্ড টেস্টামেন্ট শুধু সূত্র খোঁজার মূল কাঠামো নয়, ধর্মের উৎস খুঁজে যেসব ছাত্র হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ায় তারাও এই গ্রন্থের সাহায্যপ্রার্থী হয়। আরবরা, যাদের পূর্ব-ইতিহাস নেই, তারাও বাইবেলনির্ভর হয় এবং উপযুক্তভাবে গ্রহণ করে আব্রাহাম ও তার বংশধরদের কাহিনী, আরবদের প্রাথমিক ইতিহাস গড়তে।

ইহুদিদের মতো আরবরাও আব্রাহামের বংশধর বলে দাবি করে। যদিও আব্রাহামের সম্পর্কে যে ট্রাডিশন বর্তমান তাতে ইহুদি ও আরবদের ভার্সানে ভিন্নতা আছে। সেই ভিন্নতাকে পরিষ্কার করা দরকার নয় কি?

আব্রাহাম (প্রায় খ্রিঃপূর্ব ১৮০০) মেসোপটেমিয়ার কলদিয়ার একটি শহর থেকে আগত। তিনি উর নগরী, স্ত্রী সারাহসহ পরিত্যাগ করেন জেরুজালেমে কেনান ভূমিতে বাস করার জন্য। দুর্ভিক্ষের কারণে তারা উভয়েই কেনান থেকে মিশরে চলে যান। যেখানে আব্রাহাম হ্যাগার নামে এক মিশরীয় উপপত্নী গ্রহণ করেন স্ত্রী সারাহর সেবা কর্মের জন্য। হ্যাগারের মধ্যে দিয়ে আব্রাহাম ইসমাইলের পিতা হন। এই ইসমাইল উত্তর আরবদের পূর্বপুরুষ। পরবর্তীতে সারাহ আব্রাহামকে একটি পুত্র সন্তান উপহার দেন যার নাম ইসহাক, ইনি ইহুদিদের পূর্বপুরুষ।

আরব ট্র্যাডিশন মতে, ঈশ্বরের আদেশে আব্রাহাম হ্যাগার ও পুত্র ইসমাইলকে সঙ্গে নিয়ে হেজাজে গিয়ে মক্কার কাছাকাছি আরাফাত পার্বত্যাঞ্চলে যান এবং সেখানে আব্রাহাম আল্লাহর প্রতি আনুগত্যে পুত্রকে কোরবানি (উৎসর্গ) করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। পুত্রকে নিয়ে উৎসর্গ করার স্থানে যাওয়ার পথে শয়তান সম্মুখে আবির্ভূত হয় মুজদালিফা পর্বতে এবং আব্রাহামকে তার কর্ম থেকে বিরত থাকার জন্য চেষ্টা করে। কিন্তু পিতামহ (Patriarch) আব্রাহাম শয়তানকে পাথর মেরে তাড়িয়ে দেন।

আব্রাহাম মিনার কাছে থাবির (Thabir) পাহাড়ের দিকে এগিয়ে যান (মক্কার পূর্বে) পুত্রকে কোরবানি দেয়ার জন্য এবং খড়্গগ উত্তোলন করে কোপ দেবার সময় স্বর্গীয় হস্তক্ষেপে অবিশ্বাস্যভাবে পুত্রের পরিবর্তে একটি ভেড়া কোরবানি হয়ে যায়। কোরআনে এই ঘটনার বিবরণ আছে (৩৭:১০১)। কোরআনে যদিও আব্রাহামের কোনো পুত্রের নাম উল্লেখ নেই তবুও ইসমাইলকে অনুমান করা হয়।

মক্কাতে এক গৃহ কাঠামোকে কেন্দ্র করে বলা হয় যে এই কাঠামো আদম কর্তৃক তৈরিকৃত; কিন্তু প্লাবনে ধ্বংস হয়ে যায়। আব্রাহাম ও ইসমাইল এই গৃহকে মন্দির রূপে খাড়া করেন যা কাবাগৃহ বলে পরিচিত (২২:২৭)। এই গৃহ নিৰ্মাণ কৰ্ম শেষ করে আব্রাহাম হ্যাগর ও ইসমাইলকে মক্কার মরুভূমিতে ছেড়ে রেখে স্ত্রী সারাহর কাছে ফিরে যান।

ছাতিফাটা তৃষ্ণা নিয়ে পানির খোঁজে হ্যাগার মক্কার নিকটবর্তী সাফা ও মারওয়া পর্বতের মাঝে ছুটোছুটি করেন। হ্যাগার ও তার পুত্র তৃষ্ণায় মারা যেত যদি না এক দেবদূত তাদের কাছে জমজম কূপের সন্ধান দিত। জমজম কূপ এখন মক্কার কাবা ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে। বলা হয় যে, হ্যাগর ও ইসমাইলের কবর কাবা ঘরের উত্তর দিকে অবস্থিত।

বাইবেলের মতে, (আদি পুস্তক ২১ : ১৪) আব্রাহাম হ্যাগার ও ইসমাইলকে কেনানের দক্ষিণ দিকে বীরশেবা মরুপ্রান্তরে ছেড়ে যান, মক্কার পর্বতের কাছে নয়। বাইবেল বলে যে, (আদি পুস্তক ২১ : ২১) পরানের মরু প্রান্তরে ইসমাইল বসবাস করতে থাকেন যা সিনানে অবস্থিত, হিজাজে নয়। বাইবেলের ভার্সানে আব্রাহাম যে পুত্রকে বলি দিতে চেয়েছিলেন তিনি ইসমাইল নন, সারাহর পুত্র আইজাক (ইসহাক)। স্থিরীকৃত বলির স্থান মক্কার নিকট থাবির পর্বত নয়, জেরুজালেমের কাছে মোরিয়া পর্বত।

বাইবেলে এমন কোনো বিশ্বাসযোগ্য কাহিনী বর্ণিত হয়নি যে, আব্রাহাম ও ইসমাইলের হিজাজের সাথে কোনো সম্পর্ক ছিল। অথবা মক্কা ও কাবার সাথে। প্রাক ইসলামী যুগের কোনো ট্রাডিশনে একথাও ছিল না যে হ্যাগার ও ইসমাইলের কবর কাবার পাশে। ইসমাইল ও তার মায়ের কাহিনী পরবর্তী সময়ে বের হয়ে আসে হিজরতের পরে।

এ বিষয়ে মুসলিম পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে, দুই দল আছে। ইবনে মাসুদ, আল বাইদাবি এবং অন্য তফসিরকারগণ বলেন যে, পুত্র ইসমাইলকে-ই কোরবানি দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু ইবনে ওমর ইবনে আব্বাস ও আবদুল্লাহ ইবনে আহমদ-এর মতো তফসিরকারগণ বাইবেলের ভার্সানের সাথে একমত হয়ে বলেন যে, কোরবানির পুত্র ছিল আইজাক।

আধুনিককালে মিশরীয় পণ্ডিত ব্যক্তি তাহা হোসেন মন্তব্য করে প্রশ্ন তোলেন, আদতে আব্রাহাম মক্কায় গিয়েছিলেন কী না? (দ্রঃ গিয়োম, ১৯৮৩, পৃঃ ১৫৬)।

‘আব্রাহামের ধর্ম’কে প্রফেট মোহাম্মদ প্রাধান্য দেন, যখন ইহুদিরা তাঁকে অস্বীকার করে প্রফেট বলে। ইসলাম ধর্মে আব্রাহাম নতুন ভূমিকায় উদয় হন (তিনি ইহুদি ছিলেন না, খ্রিস্টানও ছিলেন না, ছিলেন মুসলিম)।

আব্রাহাম ও আরবদের মধ্যে যে সম্পর্কই থাক না কেন, এটা পরিষ্কার যে পরবর্তীতে আরব ও ইহুদিদের মধ্যে একটা বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। বাইবেলে বর্ণিত আছে যে আব্রাহামের দৌহিত্র জেকবের সময় আরব ব্যবসায়ীরা মশলাপাতি, মলম এবং গিলিড (Gilead) পর্বত থেকে সুগন্ধি দ্রব্য ইত্যাদি মিশরে বহন করে নিয়ে যেত বিক্রয়ের জন্য (আদিপুস্তক ৩৭:২৫)। জর্ডনের পূর্ব দিকে গিলিড উল্লেখযোগ্য বাণিজ্য এলাকা ছিল। এই পার্বত্য অঞ্চলকে গাশান (Ghassan) গোত্র অধিকার করে।

দক্ষিণ আরবের ওফির (জোফার) থেকে বাদশা সলেমন কাঠের তক্তা, মশলা, সুগন্ধি দ্রব্য এবং মূল্যবান পাথর আমদানি করতেন (১ রাজাবলী ১০:১১)। খ্রিঃপূঃ প্রায় ৯৯০-এ শেবার রানী (দক্ষিণ আরবে সাবা) কিং সলোমনের দরবারে যান রাজকীয় তোহফা সাথে করে (১ রাজাবলী ১০:১-২)। বাইবেলের বর্ণনা মতে, সেই সময়ে আরবের সব রাজা ও গভর্নরেরা কিং সলোমনকে সোনা-রুপা উপহারস্বরূপ প্রদান করেছিলেন।

খ্রিঃপূঃ আনুমানিক ৮৮০ অব্দে জুদার রাজা জেহোশাফট আরবদের কাছ থেকে ৭৭০০ ভেড়া ও ৭৭০০ ছাগল কর স্বরূপ গ্রহণ করেন। (২ ক্রনিকেল, ১৭:১১)। এর কয়েক বছর পরে ৮৭০ খ্রিঃপূর্বাব্দে ইথোপিয়ার কাছে বসবাসকারী আরবরা (২ ক্রনিকেল-২১:১৬) সম্ভবত হিজাজে জুদা আক্রমণ করে (তখন জুদার রাজা ছিলেন জেহারাম), রাজপ্রাসাদ তছনছ করে এবং তার স্ত্রীদের, পুত্রদের, কনিষ্ঠপুত্র ছাড়া তুলে নিয়ে গিয়েছিল। কনিষ্ঠ পুত্রের নাম ছিল জেহোয়াহাজ। এরপর কোনো এক সময় ইহুদিরা শক্তি সঞ্চয় করে এবং ৭৯০ খ্রিঃপূর্বাব্দে জুদার রাজা উজ্জিয়াহ, আরবদের পরাভূত করে। (২ ক্রনিকেল ১৭:৭)

৭০১ খ্রিঃপূর্বাব্দে হেজেকিয়াহ রাজত্বের সময় কয়েকটি আরব গোত্র মিলে এসিরিয়ার সেনাচেরিবের সাথে জেরুজালেম আক্রমণ করে। কিন্তু এই এসিরিয়ান সৈন্য দলে প্লেগ আরম্ভ হলে অভিযান পরিত্যক্ত হয়, কয়েক হাজার সৈন্য রোগে মারা পড়ে (২ রাজাবলী ১৯:৩৫)।

এক শতাব্দি পরে খ্রিঃপূঃ ৫৯৭ অব্দে ব্যাবিলনের নেবুচেদনজর (দ্বিতীয়) জুদা আক্রমণ করে অধিকার করে। জেরুজালেমের মন্দির ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং ব্যাবিলনে অধিকাংশ ইহুদি লোকজনকে বন্দি করে নিয়ে যান। বন্দিদের মধ্যে প্রফেট এজিকেলও ছিলেন। তিনি আরবের অনেক স্থানের কথা উল্লেখ করে বলেছেন- আরবরা অনেক মূল্যবান দ্রব্যাদি ব্যাবিলনে রপ্তানি করত। (এজিকেল ২৭:১৯-২৪)

বাইবেলে আরবদের ব্যাপারে শেষ বক্তব্যটি হলো যে, ৪৪৫ খ্রিঃপূর্বাব্দে জেশেম বলে একজন আরব অন্যদের সাথে মিলে নেহেমিরাহকে জেরুজালেম শহর ও দেয়াল পুনঃনির্মাণে বাধা দিয়েছিল। (নেহে. ২:১৯)।

১.৪ ভারত

সিন্ধু উপত্যকায় ও দক্ষিণ মেসোপটেমিয়ায় খনন করার ফলে যে সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া যায় তা থেকে প্রমাণিত হয় যে আদিকাল থেকে প্রাক এরিয়ান ভারত ও সুমেরিয়ার মধ্যে যোগাযোগ ছিল। ব্যাবিলনিয়ানকালে ভারতের বাণিজ্য জাহাজ পার্সিয়া ও পার্সিয়ান গালফের আরব তীর প্রান্ত, বাহরায়েন ও ওমান হয়ে শাতিল আরব যাত্রা করেছিল। বাহারায়েন (প্রাচীন দিলমুন) ছিল ট্রানজিট পোর্ট, আরব দেশ থেকে ভারতে বিলাসী দ্রব্যের রপ্তানির জন্য সমুদ্রগামী ভারতীয় জাহাজ সিন্ধু নদী ও অন্যান্য আর্যভাষী ভারত বন্দরের মুখ থেকে ছেড়ে যেত। ভারতের দক্ষিণ অঞ্চলে দ্রাবিড়ভাষী বন্দর তীর থেকেও জাহাজ ছাড়তো। দক্ষিণ আরাবিয়ার সাথেও বাণিজ্য ছিল ভারতের। এডেন বন্দর এই অঞ্চলে সবচেয়ে বড় বাণিজ্য বন্দর ছিল। দক্ষিণ আরব ও পারস্য উপসাগরের ওয়ার-হাউসগুলো ভারত ও শ্রীলঙ্কা থেকে আগত পণ্যদ্রব্যে ভর্তি থাকত।

আরব দেশ থেকে প্রধান রপ্তানি দ্রব্য হলো সুগন্ধি গুল্ম ও পারফিউম। ভারত থেকে আরবে রপ্তানি হতো মণিমানিক্য, হাতির দাঁত, দারুচিনি, গোলমরিচ, আদা, চাল, চন্দন, কর্পূর, রং ও দুষ্প্রাপ্য প্রজাতির প্রাণী যেমন ময়ূর ও বানর। স্ট্রারো (মৃ. খ্রিঃ ২১) উল্লেখ করেন যে, তৈরি মধু (মোমাছিজাত নয়) বা গুড়ও ভারত থেকে রপ্তানি হতো।

ভারতের তুলার কাপড়ের নাম ছিল। তাই সাদা কাপড়ের ও খুব রঙিন কাপড়ের চাহিদা ছিল আরব বিশ্বে। চীন ও ভারত থেকে সিল্ক রপ্তানি হতো। ভারতীয় তীর- ধনুকের গুণগত মানের কদর ছিল আরব দেশে এবং প্রখ্যাত আরবীয় তীরন্দাজরা এই সব তীর-ধনুক ব্যবহার করত যুদ্ধক্ষেত্রে। ভারত থেকে বাঁশও আমদানি হতো বর্শার ফলকের ওপর লাগানোর জন্য। বর্শার লম্বা হাতলটা ভারতীয় বাঁশের তৈরি।

আরবে শক্ত কাঠের অভাব ছিল। তাই ভারতীয় কাঠ ও তক্তার কদর ছিল ব্যাবিলনীয় সময় থেকেই এবং শতাব্দি ধরেই তা চলেছে। বলা হয় যে, তৃতীয় খলিফা ওসমান (৬৪৪-৬৫৬) মদিনাতে প্রফেটের মসজিদ পুনর্নির্মাণের জন্য ভারত থেকে টিক কাঠের তক্তা আমদানি করেন মসজিদের ছাদ তৈরির জন্য।

১.৫ পারস্য

খ্রিঃপূঃ ৫৩৯ অব্দে মহামতি সাইরাস-এর অধীনে পারস্য সৈন্যদল ব্যাবিলন জয় করে এবং পারস্য সাম্রাজ্যের (আকামেনিয়ান) সূচনা করা হয়। আরবের ভাড়াটে সৈন্যরা সাইরাসের সৈন্যদলে যোগ দিয়ে ব্যাবিলনের পতন ঘটায়। এই সংঘর্ষে ব্যাবিলনের শেষ যুবরাজ বেলশাজার নিহত হন। তারপর সাইরাস উত্তর আরাবিয়ার দিকে অগ্রসর হয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র তাইমা অধিকার করেন। এই তাইমা ছিল ব্যাবিলনের প্রতিরোধ দুর্গ। এটাও রক্ষা পেল না।

৫২৫ খ্রিঃপূর্বাব্দে সাইরাসের পুত্র কেমবাইসেস (Cambyses) আরব বেদুইনের সহযোগে মিশর বিজয় করেন। এই অভিযান সম্বন্ধে হিরোডেটাস মন্তব্য করেন যে, অভিযানকালে মরু প্রান্তরে আরবরা লাগাতার পানি সরবরাহ করেছিল পারস্য সৈন্যদের।

কেমবাইসের উত্তরাধিকার ১ম দারায়ুস মধ্যপ্রাচ্যের আরও কিছু অংশ অধিকার করে নেন ভূমধ্যসাগর থেকে সিন্ধুনদ পর্যন্ত। তিনি স্কাইলাক্স (Skylax) নামে এক গ্রিক কাপ্তানকে সিন্ধুনদ থেকে ভারত মহাসাগরের ওপর দিয়ে লোহিত সাগরে আধুনিক সুয়েজ খালের কাছে আর্সিনো (Arsinoe) পর্যন্ত সমুদ্রযাত্রায় পাঠান (খ্রিঃপূঃ ৫১২-৫১০)। দারায়ুসের এক উৎকীর্ণ লিপি থেকে জানা যায় যে, আরব দেশ তখন পারস্যের এক করদ রাজ্যের মর্যাদায় ছিল এবং তা চলেছিল পরবর্তী দু’শতাব্দি ধরে।

৪৮০ খ্রিঃপূর্বাব্দে হেরোডেটাসের ভাষ্যমতে, আরবরা অন্যান্য ৫৬ জাতির মধ্যে একটি যারা পারস্য সম্রাট জারাক্সেসের সৈন্য দলে কাজ করেছিল এবং গ্রিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধও করেছে।

৩৩১ খ্রিঃপূর্বাব্দে গ্রিক বীর মহামতি আলেকজান্ডার পারস্য সম্রাট তৃতীয় দারায়ুসকে আরবেলার (Arbela) যুদ্ধে পরাজিত করে পারস্য দখল করেন। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর পারস্য রাজ্য আলেকজান্ডারের সেনাপতি সেলুকাসের ভাগ্যে পড়ে।

খ্রিঃপূঃ আনুমানিক ২৫০ অব্দে উত্তর-পূর্ব পারস্যে পার্থিয়েন (Parthians) বাহিনী গড়ে ওঠে এবং প্রথম আরসাসের (Arsaces) দখলকারী সেলুসিডের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং পার্থিয়ান (আরসাসিড) বংশের পত্তন করে (খ্রিঃপূঃ ২৪৭-২৪)। এই পার্থিয়েনরা প্রাচীন পারস্য রাজা আকামেনিডদের বংশধর বলে দাবি করে। এই পার্থিয়েনদের নেতা প্রথম আরসাসেস আকামেনিয়ানদের মতো জোরাস্ত্রিয়ান ধর্ম পালন করে সেই ধর্ম চালু করে যান।

প্রথম মিথরিডেটস (Mithridates I)-এর সময় পার্সিয়ান সাম্রাজ্য বর্ধিত ছিল ইউফ্রেটিস থেকে সিন্ধুনদ পর্যন্ত, বলতে গেলে সেলুসিডদের সমগ্র রাজ্য সিরিয়া পর্যন্ত। এদের প্রাদেশিক রাজধানীর মধ্যে একটি ছিল স্টেসিফোন (Ctesiphion) বর্তমান মধ্য ইরাকের মাদায়েন। আধুনিক বাগদাদ থেকে দক্ষিণ-পূর্বে টাইগ্রিস নদীর তীরে সেলুসিয়া গ্রিক ক্যাম্পের বিপরীতে অবস্থিত।

খ্রিস্টাব্দ প্রথম শতাব্দিতে নিকট প্রাচ্যের অধিকাংশ অংশ রোমানরা গ্রিকদের সরিয়ে দখল করে নেয়, শুধু সেলুসিডরা বাকি থেকে যায় পুরানো শত্রু হিসাবে। অনেক দিন ধরে রোম ও পার্থিয়া প্রাধান্য পাওয়ার জন্য মুখোমুখি যুদ্ধ করেছে। দ্বিতীয় খ্রিস্টাব্দে যখন পারস্যে সাসানিয়ান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়, রোমকে এদের সাথেও পাঞ্জা লড়তে হয়েছে। সাসানিয়ানরাও জোরাস্ত্রিয়ান ধর্মধারী

আরবে প্রাথমিকভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পারসিয়ানরা উট দিয়ে পানি টেনে সেচের জন্য একটি নতুন পদ্ধতি চালু করে। একে পানি চাক্কা বলা হতো (Water-wheel)। এ ছাড়া পার্সিয়ানরা আরবে খাল কেটেও ভূমিতে সেচের ব্যবস্থা করে। উপরন্তু পার্সিয়ানরা তথাকথিত আরবি ঘোড়ার প্রজনন ও শিক্ষার বন্দোবস্ত করে। হাজার বছর পূর্বে ব্যাকট্রিয়ায় বন্য ঘোড়া পোষ মানানোর ব্যবস্থা ছিল। তাদের পূর্বপুরুষরা ছিল লিবিয়ান (আরাবিয়ান) এবং মঙ্গোলিয়ান ধারার। পারস্য ঘোড়া বেশি মূল্যায়িত হতো যুদ্ধক্ষেত্রে ও সন্ধির সময়। যুদ্ধ ও রেসের (দৌড়) জন্য বিশেষভাবে ঘোড়ার প্রজনন ও লালন হতো সেখানে।

ঘোড়দৌড় প্রাচীন আরবদের প্রিয় সখের জিনিস। ঘোড়াদের আরোহী ছাড়া দৌড়ানো হতো। যেমন রোমে করসকো (Corsco) তে করা হতো। অনেক পরে ঘোড়ার পিঠে আরোহী চাপানো হয়েছে। যুদ্ধে উটের পিঠে চড়ে যোদ্ধারা আরোহী শূন্য ঘোড়াদের তাড়িয়ে নিয়ে যেত যুদ্ধ ক্ষেত্রে পৌঁছানো পর্যন্ত। শত্রুদের মুখোমুখি হওয়ার অবস্থায় ঘোড়ার পিঠে সওয়ারী উঠতো। প্রফেট মোহাম্মদ তাদের নিন্দা করেছেন যারা স্থানীয় ঘোড়া ছেড়ে পার্সিয়ান ঘোড়া পছন্দ করত। (গোল্ডজিহার, ১৯৬৭ পৃঃ ১৫৬)।

পার্সিয়া থেকে আগত উৎকৃষ্ট মানের তরবারি ও তার খাপের প্রশংসা করেছে আরব কবিরা। বর্ম ও হেলমেটও পারস্য থেকে আমদানি করা হতো প্রাক ইসলামী যুগে। শুধু আরব নয়, তুর্কিরা ও ক্রুসেডাররাও এসব যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহার করত।

১.৬ আবিসিনিয়া

ফ্যারাওদের সময় থেকে আবিসিনিয়ায় (বাইবেলে কুশ Cush) কুশেরা বাস করত। এরা সেমেটিক গোত্রের; মূল ও দক্ষিণ আরবীয়া থেকে লোহিত সাগর পার হয়ে আরবরা সেখানে ভিড় জমিয়েছিল।

মিশরীয় ধর্মগ্রন্থে প্রধান গোত্রকে বলা হতো হাবাশা অথবা আহাবিশ। আনুমানিক ৮০০ খ্রিঃপূর্বাব্দে একজন হাবাশা প্রধান দাবি করে যে কিং সলোমান ও শেবার রানীর পুত্র প্রথম মেনেলিক (Menelik I)-এর এরা বংশধর, যিনি আবিসিনিয়ায় রাজ্য স্থাপন করেন। (বলা হয় যে কিং সলোমন শেবার রানী বিলকিসকে বিয়ে করেছিলেন। ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত নয় : অনুবাদক)

খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দি থেকে আবিসিনিয়ানরা আরবে সাবা প্রদেশের সাথে যোগাযোগ বজায় রেখে চলেছে। সাবা ছাড়া হিমিয়ার ও হিজাজের সাথেও এদের যোগাযোগ ছিল। মিশরের সাথেও তাদের নিগূঢ় সম্পর্ক ছিল। তবে খ্রিঃপূর্বাব্দের শেষ শতাব্দি থেকে হেলেনাইজড মিশরীয়দের দ্বারা এরা প্রভাবিত হয়েছে।

খ্রিস্টাব্দের শুরুতে, নেগাস (আরবে নাজাসি) তার শাসনামলে বিভিন্ন গোত্রকে এক করে আকসুম (Aksum) রাজ্যের পত্তন করেন। লোহিত সাগর তীরে বন্দর আদুলিসে ভারত, পূর্ব আফ্রিকা ও পারস্য উপসাগর হতে আগত কার্গো ওঠানামা করেছে। আকসম ও আরবের দক্ষিণ-পশ্চিম রাজ্যের সাথে বাণিজ্য সম্পর্কও এই সময়ে জোরদার হয়।

এজানার (Ezana) রাজত্বকালে (খ্রিঃ ৩২৪-৪২) আকসুম ক্ষমতার শিখরে ওঠে। এজনাকে আবিসিনিয়ার কনস্ট্যানটাই বলা হয়। ৩৩০ খ্রিস্টাব্দে তিনি বিশপ ফ্রুমেন্টিয়াস (Frumentius)-এর হাতে খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করেন। ফ্রুমেন্টিয়াসকে আবিসিনিয়ানরা আব্বা সালামা বলে। আকসুমের প্রথম বিশপ আলেকজান্দ্রিয়ার সেন্ট আথানাসিয়াস এই উপাধি দেন। আবিসিনিয়ার খ্রিস্টানিটি মনোফিসাইট (কপটিক) ছিল এবং এই ধর্ম রাষ্ট্রধর্ম রূপে আবিসিনিয়ায় গৃহীত হয়। ফলে এদেশ বাইজানটিয়ানের কাছে বন্ধুদেশে দেশে পরিণত হয়।

৩৪৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে আলামিদার রাজত্বকালে হিমিয়ারের কিছু অংশ আক্রমণ করে এরা কর্তৃত্ব বিস্তার করে এবং সেখানে খ্রিস্ট ধর্ম প্রবর্তিত হয়। তিরিশ বছরের মতো, খ্রিঃ ৩৭৫ পর্যন্ত এই দখলদারি ও কর্তৃত্ব বজায় থাকে, এর পরেই এক আরব প্রধান হিমিয়ার থেকে আবিসিনিয়ানদের তাড়িয়ে দেশবাসীদের ইহুদি ধর্মে দীক্ষিত করে।

৫২৫ খ্রিস্টাব্দে আকসুমের কিং কালে (এলাসবেহা) এক সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন ইহুদি রাজা ধু নুবাস (Dhu Nuwas)-এর অত্যাচার থেকে খ্রিস্টানদের রক্ষা করার জন্য। আবিসিমনিয়া নাজরেন দখল করে সেখানে (ঐ অঞ্চলে) একজন ভাইসরয় নিযুক্ত করে। প্রায় ৫০ বছর পরে ৫৭৬ খ্রিঃ সাসানিয়ান অন পারসিয়ারা নাজরেন অধিকার করে নেয়।

উল্লেখ্য যে, প্রফেট মোহাম্মদ-এর মিশন যখন শুরু হয় তখন মক্কাতে আবিসিনিয়ার একটি ছোট কলোনি ছিল সদাগর ও শ্রমিকদের। ৬১৫ খ্রিস্টাব্দে যখন প্রথম মুসলিমদের ওপর অত্যাচার শুরু হয় মক্কাতে, সেই সময় আবিসিনিয়ার শাসক আশামা (Ashama) (আরমা) নতুন ধর্ম গ্রহণকারী অনেক মুসলিমদের আশ্রয় দিয়েছিলেন।

১.৭ আরামায়েন

আনুমানিক খ্রিঃপূঃ ১৩০০ অব্দ থেকে সিরিয়াতে আরামায়েনরা বসবাস শুরু করে। বাইবেলের মতে তারা সেমেটিক জাতি এবং শেমের পুত্র আরামের বংশধর (আপুঃ ১০:২২)। তারা উত্তর আরাবিয়া থেকে সিরিয়ায় চলে যায়। গ্রিকরা প্রথমে সিরিয়ানদের আরামায়েন বলে জানতো।

আরামায়েনরা দামেস্ক (প্রাচীনকালে আরাম নামে পরিচিত) পালমিরা (বাইবেলে ট্যাডমর), এলেপ্পো, এডেসা (আধুনিক তুর্কিস্তানে ‘উরফা’) ইউফ্রেটিস নদীর তীরে কারশেমিশ এবং অন্যান্য স্থানে স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করেছিল- এসবের কথা মিশরীয় আক্কাদীয়, এসিরীয় ও ব্যাবিলনীয় নথিপত্রে উল্লেখিত আছে। বাইবেলেও এ সম্বন্ধে ঘনঘন রেফারেন্স আছে। বহু বছর ধরে এসব রাজ্য এসিরীয়দের পথের কাঁটা ছিল। ফলে আরামীয়দের বিভিন্ন স্থানে নির্বাসনে যেতে হয় যখন এসিরীয়রা এ স্থান দখল করে। তারা ভ্রাম্যমাণ জাতি বলে পরিচিত ছিল এবং তাদের বিস্তৃত এলাকা জুড়ে বাণিজ্য কর্মকাণ্ড ছিল, কিন্তু মৌলিক ও সৃষ্টিশীল সংস্কৃতি কর্মে এরা পিছিয়ে ছিল। তাদের বিশাল ও মিশ্র সর্বদেবতার মন্দিরের ধারণা বিদেশী লোকদের কাছ থেকে ধার করা। তাদের প্রধান দেবতা ছিল ঝড়ের দেবতা হাদাদ, আকাশ দেবতা আলাহা, আর দেবীর নাম ছিল আথারগাটিস।

খ্রিঃপূঃ ৭০০ থেকে আরামায়েনদের ক্ষমতা দিন দিন কমতে লাগল যখন একের পর এক এসিরীয়, ব্যাবিলনীয়, পার্সিয়া, মেসিডোনিয়ান, সেলুসিড রোমানদের আক্রমণ প্রতিহিত করতে হলো।

মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতিতে তাদের শ্রেষ্ঠ অবদান লিপি (Script)। ফোনিশিয়ানদের বর্ণ লিপিকে গ্রহণ করে তারা খ্রিঃপূঃ ৮৫০ থেকে একে আরো সহজতর ও উন্নত করে একটা স্থায়ী ফরমে নিয়ে আসে। আরামায়েন ভাষা আরামাইক আশেপাশে অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং খ্রিঃপূঃ ৪০০ অব্দের মধ্যে আশপাশে বর্ডারে ছড়িয়ে পড়ে, তারপর পরিপার্শ্ব দেশের জাতীয় ভাষা মুখের ভাষায় পরিণত হয় এবং সিরিয়া থেকে মেসোপটেমিয়া, মিশর থেকে এশিয়া মাইনর ও ককেসাস, পার্সিয়া থেকে পাঞ্জাব পর্যন্ত দাপ্তরিক ও বাণিজ্যের ভাষার মর্যাদা পায়। ভারতীয় সম্রাট অশোক (প্রায় খ্রিঃপূঃ ২৩২) ও তার পাথরের রাজাজ্ঞা নির্দেশ ও ঘোষণায় তিনটি ভাষা ব্যবহার করতেন আরামাইক, গ্রিক ও প্রাকৃত।

ওল্ড টেস্টামেন্টের কিছু অংশ এই আরামাইক ভাষায় লিখিত হয়েছিল এবং যিশু এই ভাষা ব্যবহার করতেন আর প্যালেস্টাইন হিব্রুরা এই ভাষা বুঝতে পারত। হিব্রু, আরাবিক, পালমিরিন, নাবাটিয়েন এবং অন্য আঞ্চলিক ভাষা আরামাইক বর্ণ-লিপির কাছে ঋণী এবং তাদের শব্দকোষের অধিকাংশই ছিল আরামাইক ভাষা থেকে ধার করা।

সিরিয়াক ভাষা হলো খ্রিস্টান আরমাইক এবং মূল আরমাইক থেকে আহৃত ও সংশ্লিষ্ট। এই সিরিয়াক ভাষা সিরিয়ার কথ্যভাষা যা চালু ছিল দ্বিতীয় থেকে দ্বাদশ শতাব্দি পর্যন্ত। অনেক চার্চের ভাষা ছিল সিরিয়াক, যেমন হিব্রু স্বর্গীয় ভাষার মর্যাদা পেয়েছিল। কোনো কোনো পূর্বাঞ্চলীয় খ্রিস্টান চার্চে পুরোহিতদের ভাষা হিসাবে এখনো টিকে আছে আরমাইক ভাষা। আনুমানিক খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দির মধ্য থেকে গ্রিক, ল্যাটিন ও সিরিয়াক ভাষা থেকে অনেক ধর্ম পুস্তক, দর্শন পুস্তক, চিকিৎসাবিদ্যা পুস্তক ও বিজ্ঞান পুস্তক ভাষান্তর হয়েছে এবং এই ভাষান্তরিত পুস্তক থেকে প্রাথমিক মুসলিম যুগে আরবিতে রূপান্তর হয়ে মুসলিম বিশ্বে জ্ঞানের বর্তিকা প্রজ্বলিত করেছে।

১.৮ নাবাতিয়েন

বিতর্কিত হলেও প্রথাগতভাবে ধরা হয় যে ইসমাইলের প্রথম সন্তান নাবাজোথ তার বংশধর রেখে গেছেন নাবাতিয়ানদের মধ্যে। আদিপুস্তক ২৫:১৩তে বলছে, আপনি আপন নাম ও গোষ্ঠী অনুসারে ইশ্মায়েলের সন্তানদের নাম এই। ইশ্মায়েলের জ্যৈষ্ঠ পুত্র নাবাযোৎ পরে কেদার…। সেমেটিকদের মধ্যে নাবাতিয়েনরা উল্লেখযোগ্য। খ্রিঃপূর্ব ৫ম অব্দের পূর্বে কোনো এক সময়ে এরা আরবের পেট্রাতে বসবাস শুরু করে, সিনাই অঞ্চলে। সিনাই হচ্ছে ওল্ড টেস্টামেন্ট মতে এডোমাইটদের বাসস্থান, আর নিউ টেস্টামেন্ট মতে ইদুমিয়েনদের। এই সিনাই-এ প্রচুর তামা পাওয়া যায়। সিনাই থেকে ক্যারাভান পথে মিশর, প্যালেস্টাইন, সিরিয়া ও মেসোপটেমিয়া সহজেই যাওয়া চলে এবং শতাব্দিকাল ধরে মশলা, ধূপ ও রুপোর ব্যবসা করে অর্থনৈতিকভাবে এটা সমৃদ্ধশালী অঞ্চল ছিল। খ্রিঃপূঃ ৩১২ অব্দে আলেকজান্ডারের উত্তরসূরি প্রথম এন্টিগোনাস নাবিতিয়ানদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে দখলের চেষ্টা করেন। কিন্তু পেরে ওঠেননি। নাবিতিয়ানদের সমুদ্রবন্দর ছিল আইলা (বাইবেলে এলাম; এখন আকাবা) এবং উল্লেখ্যযোগ্য বাণিজ্য শহর ছিল রস্ট্রা (বসরা), যেখানে বণিক মোহাম্মদের সাথে সাধু বাহিরার সাক্ষাৎ হয়। এই সাধু বাহিরা, প্রচলিত আছে, তার মিশনের ভবিষ্যদ্বাণী করেন।

নাবাতিয়ানের রাজধানী ছিল সেলা (Sela) (Rock of Edom) লাটিনে বলা হতো পেট্রা। জন বার্গেন (মৃ. ১৮৮২) এই পেট্রা শহরকে প্রায়ই উল্লেখ করে বলতেন A red rose city, half as old as time. পেট্রার বর্তমান ধ্বংসাবশেষে পাওয়া গেছে একটা বিশাল থিয়েটার মঞ্চ, আর এক মন্দির যার বেদী অর্ধচন্দ্রাকৃতি।

ইতিহাসে নাবাতিয়েনদের প্রতিভাধর বলা হতো। তাদের রাজ্য দামেস্ক থেকে হিজাজ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এবং হিজর, তাইমা, এল-ওলা, দুমা এবং দেদানের মতো স্থানগুলো ২৫ খ্রিঃপূর্বাব্দ পর্যন্ত তাদের অধিকারে ছিল। যে স্থান তারা শাসন করেছে সেখানেই তারা হেলেনিস্টিক (গ্রিক) সংস্কৃতির নিদর্শন রেখে গেছে যার ধ্বংসাবশেষ এখনও পর্যন্ত দেখা যায়। বহু স্থানে, যেমন নেগেভ। তারা সেচকর্মে যে টেকনিক ও দক্ষতা দেখিয়েছে তা আধুনিক ইঞ্জিনিয়ারদের তাক লাগিয়ে দেয়।

নামকরা শাসকদের মধ্যে ছিলেন চতুর্থ এরটাস (মৃ. ৪০ খ্রিঃ)। এ সময় দামেস্কর গভর্নর সেন্ট পলকে বন্দি করেন (২ করিস্থ ১১:৩১)। আর দ্বিতীয় রাব্বাল (Rabbal) ১০৬ খ্রিঃ) রোমান সম্রাট টাইটাসকে পেট্রা থেকে প্রসিদ্ধ আরাবিয়ান ধনুর্ধর পাঠিয়েছিলেন জেরুজালেম অধিকার করতে।

নাবিতিয়ানরা দৈনন্দিন কথাবার্তা আদান-প্রদানে আরবি বলত, এর জন্য আরামাইক বর্ণমালা থেকে মাত্র বাইশটা অক্ষর উদ্ভাবন করেছিল, যে অক্ষরগুলো আরবি লিখন পদ্ধতির উৎস হিসাবে কাজ করেছে।

নাবিতিয়ানরা প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বা দেশের দেব-দেবীদের পূজা-অর্চনা করত, এদের মধ্যে ছিল সিরিয়ান গড় হাদাদ; এল, আল অথবা আল্লাহ্; হুবাল; দেবী আল- লাত, উজ্জা ও মানাত; কাইস (Kayis) আজিজ, নসর, ওয়াদ সোয়া ধু-ঘাবত, He of the thicket; ধু-শারা He of the highlands’ – একে পূজা করত কালো পাথরের (Black stone) আকারে; শাই আল কায়ুম; আরা, বালশামিম এবং রাহামানকে রহিমের সাথে শ্রদ্ধা করত।

এই সব দেব-দেবীদের মধ্যে কতকগুলো ধীরে ধীরে খ্রিস্টিয়ানিটি প্রবর্তনের সাথে রূপান্তরিত হলো। খ্রিস্টানদের দেব-দেবী রূপে চার্চ ঐতিহাসিক এপিফানিয়াস (মৃ. ৪০৩ খ্রিঃ) লিখেছেন যে, পেট্রাতে তারা মেরি মাতার জন্য আরবিতে বন্দনা-গীতি গাইতে শুরু করল। কুমারী মেরি মাতাকে আরবি নাম দিল ছাবোস (Chhabos)। আরবিতে কুমারীকে কাব বলা হয় এবং তার পুত্রকে নাম দিল দুসারেস (ধুসারা) অর্থাৎ একমাত্র পুত্র।

১০৬ খ্রিস্টাব্দে পোপের দূত (legate) কর্নেলিয়াস পালমা রোমে সম্রাট ট্রোজান- এর প্রতিনিধি রূপে সিরিয়াতে এসে নাবাতিয়াকে রোমের রাজ্যভুক্ত করেন। এর সাথেই নাবিতিয়েন রাজ্যের ইতি ঘটে। তখন থেকে আরবীয়াতে নাবেতিয়া রোমের একটি প্রদেশ বলে গণ্য হলো। রাজধানী হলো বসট্রন। এই রাজ্যের পতনের পর তিন শতাব্দি ধরে নাবিতিয়ান বর্ণ-লিপি আরবি ভাষাভাষীদের মধ্যে চলতে থাকলো।

১.৯ গ্রিক

প্রাচীন সাহিত্যে আরবদের নাম ঘনঘন উল্লেখিত হয়েছে। অনেক পণ্ডিত ব্যক্তি মনে করেন হেমারের কাব্যে আরিময় ও এরেমবয় আরমানিয়ান ও আরবদের নির্দেশ করে।

ক্ষুদ্র কবিতা ও মুদ্রার সপ্রমাণে বোঝায় যে, প্রায় ৩৫০ খ্রিঃপূর্বাব্দে গ্রিক সংস্কৃতি সাবা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল এবং দক্ষিণ আরবেও এর প্রভাব যে পড়েছিল সে প্রমাণও পাওয়া যায়।

প্রায় ৩২৫ খ্রিঃপূর্বাব্দে মহামতি আলেকজান্ডার তার নৌ সেনাপতি নিয়ারকাসকে সিন্ধু ও পারস্য উপসাগরে পাঠিয়েছিলেন। নিয়ারকাস আধুনিক বসরার কাছে চ্যারাক্স (Charax) বন্দর নির্মাণ করে, অবশ্য এখন তার কোনো চিহ্ন নেই। আলেকজান্ডারের অন্য এক নৌসেনাপতি এনাক্সরেটস (Anaxicrates) এরিথ্রিয়েন সাগর পর্যন্ত (আরাবিয়ান সাগর ও লোহিত সাগর) নৌযাত্রা করেন, এই যাত্রা করেছিলেন বাবেল মান্ডেবের মধ্য দিয়ে। বলা হয় যে, আলেকজান্ডার দক্ষিণ আরাবিয়া অভিযান করার প্ল্যান করেছিলেন এবং তার গুপ্তচর বাহিনীর ঐসব অঞ্চল ও বন্দরের অবস্থান অজানা ছিল না।

৩২৩ খ্রিঃপূর্বাব্দে আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তার সাম্রাজ্য তার দুই সেনাপতির মধ্যে টলেমি ও সেলুকাস ভাগ-বণ্টন করে দেয়া হয়। মিশর থেকে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে সেন্ট্রাল এশিয়া পর্যন্ত টেলেমিরা (৩২৩-৩০ খ্রিঃপূঃ) এবং সেলুসিডরা (৩২৩-৬৪ খ্রিঃপূঃ) যে গ্রিসিয়ান সভ্যতা প্রচলন করেন তা হেলেনিস্টিক সভ্যতা বলে পরিচিত এবং এই সভ্যতা গ্রিসের হেলেনিক বা অ্যাট্রিক সভ্যতা থেকে ভিন্ন ছিল।

গ্রিকদের সাধারণ ফরম (কয়েন গ্রিক) পশ্চিম এশিয়া ও পূর্ব ভূমধ্যঅঞ্চলে আন্তর্জাতিক ভাষা রূপে গণ্য হয় এবং এর ফলে এই অঞ্চলে, আরব দেশসহ গ্রিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের অনেক মুদ্রা ব্যবহৃত হয়েছে বহু শতাব্দি ধরে। প্রথম টলেমি সতার (Soter) মৃত ২৮৩ খ্রিঃপূঃ মিশরের অধিকর্তা ছিলেন এবং তার রাজধানী ছিল আলেক্সান্দ্রিয়া এবং তার উত্তরসূরি টলেমিরা মিশর শাসন করেছে তিনশো বছর ধরে। এই সময়ের মধ্যে তারা আরবীয় শাসকদের সাথে নিকট সম্পর্ক বজায় রাখে এবং বাণিজ্য পথ উন্মুক্ত রেখে ইথরেবের (মদিনা) মধ্য দিয়ে দক্ষিণ আরব পর্যন্ত সুগন্ধি দ্রব্যের লাভজনক কারবার চালিয়ে যায়। প্রথম টলেমির রাজত্বকালে গ্রিক উদ্ভিদবিদ থিওফারসটাস আরবের সুগন্ধি গুল্মের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে পুস্তক রচনা করেন, যে পুস্তকে আলেক্সান্ডারের নিজস্ব উদ্ভিদবিদদের সংগৃহীত তথ্যাদি সংযোজিত হয়েছিল।

দ্বিতীয় টলেমি ফিলাডেলফিয়াস আলেক্সান্দ্রিয়ায় জাদুঘর ও পুস্তকাগার প্রতিষ্ঠা করেন এবং তা হাজার হাজার শতেক পাণ্ডুলিপির দ্বারা পরিপূর্ণ করেন। এই বিশাল লাইব্রেরি পরে মুসলমানদের অধিকারে আসে। ২৬৫ খ্রিঃপূর্বাব্দে তিনি লোহিত সাগরে একটি নৌ অভিযান চালান ইথরেবের সমুদ্র বন্দরে ইয়েনরো কোস্টের (Coast) ওপর বেস নির্মাণ করার জন্য। এরই সূত্র ধরে দেদানের লিহিয়ানাইটসদের সাথে একটি বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদিত হয়। তিনি মিশরের থিবসের নিকটবর্তী কপটোস থেকে লোহিত সাগরের তীরে বেরেনিক বন্দর পর্যন্ত বিস্তৃত পথ পুনরুদ্ধার করেন। কপটোস স্ট্রাবোর মতে, আরব ও মিশরীয়দের মধ্যে একটা সাধারণ শহরে পরিণত হয়েছিল।

খ্রিঃপূঃ ১৯০ অব্দে আলেক্সান্দ্রিয়ার লাইব্রেরিয়ান ইরাটসথেনস্ আরব পেনিনসুলার বহিরাংশের গঠন, স্থলপথের বাণিজ্য পথগুলো এবং প্রধান গোত্রদের অবস্থান ও তাদের চলাফেরার সব খবরাখবর রাখতেন।

খ্রিঃপূর্ব ১৪০ অব্দে অষ্টম টলেমি ইউয়ারগেটস (Euergetes) সাইজিকাসের গ্রিক নেভিগেটর ইউডোকসাসের অধীন পিলর অব হারকিউলাস (জিব্রালটার প্রণালীর) মধ্য দিয়ে মিশর থেকে এক অভিযান প্রেরণ করেন এবং তারপর আফ্রিকার উপকূল ধরে ভারতের সাগর পথ খোঁজার চেষ্টা করেন। প্রথম যাত্রায় তিনি আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলে পৌঁছান এবং যাত্রা করার প্রমাণস্বরূপ সেখানকার কিছু আদিবাসী ও দ্রব্যাদি নিয়ে ফিরে আসেন। তিনি আরো একটি অভিযানের চেষ্টা করেন কিন্তু সফল হননি। খ্রিঃপূঃ ১১৬ অব্দে একাদশ টলেমি ল্যাথিরোসের রাজত্বকালে ঐতিহাসিক ও বৈয়াকরণ আগাথারচাইডস লোহিত সাগরের একটি বিবরণ রেখে যান। দক্ষিণ আরবের লোকজন ও প্রাণীকুলেরও একটি বর্ণনা তিনি দিয়েছিলেন।

৩০ খ্রিঃপূর্বাব্দে ক্লিওপেট্রার মৃত্যুর সাথে টলেমি রাজ্য রোমানরা দখল করে নেয়। প্রথম সেলুকাসের অন্য একটা নাম ছিল নিকাটর (Nicator) — মৃত ২৮০ খ্রিঃপূর্বাব্দে। আলেক্সকজন্ডারের এশিয়ায় বিজিত রাজ্যগুলো এর ভাগে পড়ে। তিনি সিরিয়া রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন ২৮০ খ্রিঃপূর্বাব্দে। এন্টিয়কে স্থাপন করেন একটি সামরিক ঘাঁটি এবং টাইগ্রিস নদীর তীরে সেলুসিয়া নগরী। এন্টিয়কওরনটেস এখন বর্তমানে বাগদাদ নগরী। এই বাগদাদ তখন গ্রিক সভ্যতার কেন্দ্রভূমি ছিল। সেলুকাসের সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল সিরিয়া, প্যালেসটাইন, এশিয়া মাইনর, ব্যাবিলন, পারস্য, বেকটেরিয়া, মেডিয়া ও পার্থিয়া।

প্রায় ২৫০ খ্রিঃপূর্বাব্দে পার্থিয়ানরা সেলুসিড দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়ে পার্থিয়েন সাম্রাজ্য স্থাপন করে। এই রাজ্য আস্তে আস্তে সেলুসিড সাম্রাজ্যের অধিকাংশ গ্রাস করে শুধু সিরিয়া, প্যালেসটাইনের অংশ এবং কিছু ক্ষুদ্র গ্রাম ছাড়া।

৬৪ খ্রিঃপূর্বাব্দে রোমানরা পম্পির নেতৃত্বে ত্রয়োদশ এন্টিওকাস এশিয়াটিকাসকে পরাজিত করে সিরিয়া রোমান সাম্রাজ্যভুক্ত করে এবং পারস্য উপসাগরের গেরহা পর্যন্ত তাদের প্রভাব বিস্তার করে। এন্টিওকাস এশিয়াটিকাস সেলুসিডের শেষ সম্রাট।

পরে যেসব শহর ইসলামের প্রসিদ্ধ কেন্দ্রভূমি ছিল, যেমন দামেস্ক (পৃথিবীর একটি অতি প্রাচীন শহর যার কথা ওল্ড টেস্টামেন্ট উল্লেখ আছে। আদিপুস্তক ১৪:১৫) আলেক্সান্দ্রিয়া, পালমিরা, মসুল, এমেসা (Homs) নিসিবিস, কারচেমিশ, এডেসা এন্টিয়ক, এলেপ্পো ও অন্যান্যের মধ্যে হিট্টাইটস এসিরিয়ান, মিশরীয় মিত্তানি আর্মেনিয়ান, পার্সিয়ান, গ্রিক (টেলেমি ও সেলুসিড) এবং রোমানদের সাথে ঐতিহাসিক যোগসূত্র ছিল।

খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দিতে আরবরা যখন তাদের বিজয় অভিযান শুরু করে তখন মিশর, প্যালেস্টাইন, সিরিয়া সম্পূর্ণরূপে গ্রিক সভ্যতায় ডুবে ছিল এবং প্রায় হাজার বছর ধরে এর প্রভাব মুক্ত হতে পারেনি। মেসোপটেমিয়া পুরোপুরি না হলেও গ্রিক সভ্যতা থেকে মুক্ত ছিল না।

খ্রিস্টানিটির শুরু থেকে এই শহরগুলোর অনেকই খ্রিস্টিয়ানইজড হয়েছিল বিশেষ করে দামেস্ক, নিসিবিস ও এন্টিওক। এই শহরগুলো ধর্মীয় ও সাধারণ শিক্ষার কেন্দ্রভূমি ছিল। ইসলামের অধীনে আসার ছয় শতাব্দি পূর্ব পর্যন্ত এই শহরগুলোর অধিবাসীরা খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত ছিল

মেসোপটেমিয়ার ট্রাডিশনাল সুসমাচার প্রচারক সাধু আদ্দাই (Addai) রাজা পঞ্চম আবজারের সময় এডেসা চার্চ প্রতিষ্ঠা করেন। এটাই সর্বপ্রথম চার্চ ছিল এই অঞ্চলে। সিরিয়া ও প্যালেস্টাইনের অধিকাংশ অঞ্চল খ্রিস্টান বাইজানটাইন সম্রাটের অধীনে এসেছিল।

হেলেনিস্টিক সভ্যতার সংস্পর্শে ইসলামের শুধু বহিরাঙ্গ নয় ইসলামিক চিন্তাধারাকেও উন্নত করে। বানার্ড লুই বলেছেন হেলেনিস্টিক প্রভাব এত মহান ছিল যে, গ্রিক ও ল্যাটিন খ্রিস্টীয় রাজ্যের পর ইসলাম তৃতীয় জাতি হিসাবে হেলেনিস্টিক লিগ্যাসির ধারক ছিল। কোনো কোনো মুসলিম পণ্ডিত মনে করেন যে ক্রুসেড বা মঙ্গল আক্রমণ ইসলাম ধর্মের ওপর যতটা না সামরিক প্রভাব ফেলতে পেরেছে, হেলেনিস্টিক চিন্তাধারা ইসলামের গভীরে পৌঁছে সুদূরপ্রসারী অবদান রেখে গেছে।

১.১০ রোমান

রোমানরা ধীরে ধীরে তাদের সাম্রাজ্যের অন্তর্গত মধ্যপ্রাচ্যে শক্তি বাড়াতে লাগালা। তারা হেলেনাইজড বিশ্বে বিশেষ করে সেলুসিডে তাদের জয়ের ধারা অব্যাহত রেখে সিরিয়া ও আশপাশ এলাকা গ্রাস করল। তখন ৬৫ খ্রিঃপূঃ। কেবলমাত্র পার্থিয়ানরা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ৫৩ খ্রিঃপূর্বাব্দে উত্তর মেসোপটেমিয়ার বারহার (হারবান) যুদ্ধক্ষেত্রে রোমান কনসাল ক্রাশাস সম্পূর্ণরূপে পার্থিয়েনদের হাতে বিধ্বস্ত ও নিহত হন। রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাসে এ ধরনের পরাজয় আর হয়নি।

রোমানদের ভাগ্য অতি শীঘ্র ফিরে আসে এবং তারা সিরিয়া মরুভূমির আরবদের পার্থিয়া ও রোমানদের মাঝে নিরপেক্ষ জাতি হিসাবে পেয়ে খুশি হয়। তাছাড়া পশ্চিম দিকে মিশরের ক্লিওপেট্রার মৃত্যুর পর ৩০ খ্রিঃপূর্বাব্দে টলেমি সাম্রাজ্যের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে।

প্রায় ২৪ খ্রিঃপূর্বাব্দে, অগাস্টাসের রাজত্বকালে মিশরের রোমান প্রিফেক্ট অলিয়াস গ্যালাস এক রোমান সেনাবাহিনী নিয়ে লোহিত সাগরের উত্তর তীর ধরে দক্ষিণে মারিব ও সানা পর্যন্ত চলে যান। ভূগোলবিদ স্ট্যারো এই অভিযানের সঙ্গী ছিলেন এবং এর এক বিস্তৃত বর্ণনা রেখে যান। রোমানদের নাবাতিয়ান গাইডের অজ্ঞতার কারণে ভুল পথ অতিক্রম করে নাজরেনের বর্ডারে পৌঁছতে ছয় মাস লেগে যায়। এক ধাক্কায় নাজরেন শহরের পতন হয় এবং অলিয়াস গ্যালাস সারাতে চলে যান। তখন সেখানে শাসক ছিলেন ইলাসারাস। কিন্তু মাত্র দু’দিন যাত্রার পর আলিয়াস গ্যালাস সৈন্যদলে পানির অভাবে অভিযান পরিত্যাগ করেন। আর এই কারণে তিনি তার গন্তব্যস্থল প্রসিদ্ধ মশলা নগরী হাদ্রামাতে পৌঁছাতে পারেননি। তিনি নাজরেনে ফিরে আসেন এবং খাইবার-হিজর হয়ে মিশরে ফিরে আসেন। এই ফিরতি যাত্রায় তার দুই মাস লেগে যায়। রোমান সৈন্যদলের অধিকাংশ তৃষ্ণা, দুর্ভিক্ষ ও রোগে শেষ হয়ে যায়, কিন্তু মাত্র সাতজন মারা যায় যুদ্ধে।

খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দির শেষ দিকে রোমানগণ তাদের বাণিজ্যক্ষেত্র লোহিত সাগর ও ভারত মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত করেছিল। এডেন (গ্রিকদের কাছে আরাবিয়া আর রোমানদের কাছে আট্টানা বলে পরিচিত) তখন প্রসিদ্ধ বাণিজ্য কেন্দ্র এবং লোহিত সাগর, সোমালিয়া উপকূল ও পারস্য উপসাগরের মুখ-পথ এই বাণিজ্য কেন্দ্ৰ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

স্থানীয় প্রশাসক রোমানদের এই বাণিজ্য প্রচেষ্টায় বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে ১৫ খ্রিঃপূর্বাব্দে রোমানরা এডেনের ওয়ারহাউস অধিকার করে এবং বন্দর ভাঙ্গতে শুরু করে। এতে স্থানীয় প্রশাসক রোমানদের সেখানে বাণিজ্যকুঠি গ্যারিসনসহ স্থাপন করতে অনুমতি দেয়। এডেনের পূর্ব ও পশ্চিম উপকূলীয় ওসোলিস ও কেন (Kene) বন্দরের প্রশাসকদের সাথেও রোমানরা বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে তোলে।

শতাব্দি ধরে গ্রিসীয় প্রদেশগুলোর ওপর রোমানদের শাসনামলে, গ্রিক নাবিক ও পণ্ডিতরা তাদের অন্বেষণ কর্ম চালিয়ে যাচ্ছিল এবং কিছু অবদানও রেখেছে নিজ নিজ ক্ষেত্রে। খ্রিস্টীয় ৫০ শতাব্দির দিকে হিপ্পালাস নামে এক গ্রিক নাবিকের মাধ্যমে মৌসুমী বায়ুর নিয়মিত গতিপথ বদলের কথা পশ্চিম বিশ্ব জানতে পারে। এই আবিষ্কারের কারণে নিরাপদে নৌপথে ভারতে আসার পথ সহজ হয়। এর ফলে পূর্বাঞ্চলে ভারতের সাথে আরব বিশ্বের, বিশেষ করে আর একচেটে বাণিজ্য চালিয়ে যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যায়।

৮০ খ্রিস্টাব্দের দিকে একজন অজ্ঞাতনামা গ্রিক সমুদ্র জাহাজের ক্যাপ্টেন মিশরে বসবাস করছিলেন। তিনি ‘Periplus of the Erythraean sea’ (আরবসাগর প্রদক্ষিণ) নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। গ্রিক ভাষায় লিখিত এটি নাবিকদের গাইড বুক আরব সাগর সম্বন্ধে যেমন প্রধান বন্দর, নদীর মুখ-পথ ও তথ্যাদি, পোতাশ্রয়, বাণিজ্য ও বাণিজ্যদ্রব্য ইত্যাদির বিস্তারিত বিবরণ এতে আছে। এলিজস (El-Azd) কে বলা হয়েছে ‘হাদ্রামতের কিং’।

গ্রিক জ্যোতির্বিদ আলেক্সান্দ্রিয়ার টলেমির (মৃত ১৬০ খ্রিঃ) কাছে আরাবিয়া সম্বন্ধে বেশ কয়েকজন গ্রিক লেখকের গ্রন্থ ছিল। তিনি সেই গ্রন্থগুলি থেকে এবং আরও অন্যান্য তথ্যাদি সংগ্রহ করে বিশেষ করে পাঁচ খণ্ডে প্রকাশিত প্রসিদ্ধ রচনা আরাবিকা এবং চার খণ্ডে রচিত আরাবিয়া আর্কলজি-তাঁর বিখ্যাত ভৌগোলিক গ্রন্থ রচনা করেন। এই গ্রন্থের সাথে বিভিন্ন দেশের সকল স্থানের নাম, অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশসহ একটা ক্যাটালগও ঐ গ্রন্থের অংশ হিসাবে সংযোজন করেন। এছাড়া তিনি আরব দেশের নাম ও অবস্থাসহ পৃথিবীর একটি ম্যাপও অঙ্কিত করে ঐ পুস্তকের পরিশিষ্ট হিসাবে জুড়ে দেন। এখানে বলে রাখা ভালো যে, ‘আরাবিকা’ গ্রন্থটি পাঁচ খণ্ডে রচনা করেছিলেন কোনো এক গ্রিক পণ্ডিত ইউরেনাস (মৃ. প্রায় ৫০ খ্রিঃ) আর আরাবিয়ান আর্কলজি চার খণ্ডে রচিত হয়েছিল আর এক গ্রিক পণ্ডিত গ্লাকাস কর্তৃক (মৃ. ৯০ খ্রিঃ) লিখিত গ্রন্থের সূত্র ধরে!

ইত্যবসরে রোমানরা তাদের পূর্বাঞ্চলের রাজ্যসীমা বিস্তার করে চলেছে। সম্রাট ট্রাজন (মৃত ১১৭ খ্রিঃ) পার্থিয়ানদের বিরুদ্ধে এক অভিযান পরিচালনা করে আর্মেনিয়া ও মেসোপটেমিয়ার কিছু অংশ দখল করে নেয়, যদিও তারা মাঝে মাঝে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে।

সম্রাট সেপ্টেমিয়াস সেভারাস (মৃ. ২১১)-এর সাথে সিরিয়ান আরব বংশের এক সম্রাটকে যৌথভাবে অভিষিক্ত করা হয়। সেপ্টিমিয়াস সেভেরাস ছিলেন আফ্রিকান, জন্মেছিলেন লেপ্টিস শহরে (লিবিয়ার টিপোলিটানিয়া ফোনিশিয়ান শহর) এবং ইবোরেকাম-এ (ইংল্যান্ডের ইয়র্ক শহর) মারা যান। তিনি একটি সিরিয়ান রমণী জুলিয়া ডোমনাকে বিবাহ করেন। জুলিয়া এমেসার আরব পুরোহিত রাজার কন্যা। তাদের নিষ্ঠুর ও লম্পট পুত্র সারাকালা (মৃ. ২১৭ খ্রিঃ) এডেসাতেই রাজনৈতিক হত্যাযজ্ঞের শিকার হন।

সারাকালার মৃত্যুর পর তাঁর ভাতিজা হেলিওগাবালাস রাজা হন। তিনি সিরিয়াতে জন্মগ্রহণ করেন। সেপ্টিথিনাস সার্বাস ও জুলিয়া ডোমনা তার দাদা-দাদি ছিলেন গ্রান্ডসন নয়, গ্রান্ডনেফিউ। হেলিওগাবালাস এমেসাতে যে ফোনিশিয়ান দেবতা এলোগবালোর পূজা হতো, সে পূজার প্রচলন রোমেও প্রবর্তন করতে চান। এই দেবতার নামের সাথে মিল রেখে তার নাম হেলিওগাবাস হয়েছিল। দেবতা এলোগাবালোর প্রতীক ছিল কলার মোচার মতো (Conical) একখণ্ড কালো কর্কশ পাথর- শিবলিঙ্গের মতো। লাম্পট্যের কারণে প্রিটোরিয়ান গার্ডদের দ্বারা খুন হয়ে যান। তার মৃত্যুর পর কাজিন পালক পুত্র আলেক্সান্ডার সেভেরাস (Severus) রাজা হন। মারা যান ২৩৫ খ্রিস্টাব্দ। ইনি সিরিয়া আরব লাইনের শেষ রোম সম্রাট।

২৪৪ থেকে ২৪৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মার্কাস জুলিয়াস ফিলিপাস রোমের সম্রাট ছিলেন। তিনি জন্মগতভাবে আরবের অধিবাসী— তাই তিনি ‘আরবের ফিলিপ’ বলে পরিচিত ছিলেন। খ্রিঃ ২৪৮-এর এপ্রিল মাসে রোমের হাজার বর্ষ পূর্তি উৎসব পালন করেন। তিনি পারস্যের সাথে সন্ধি করেন কিন্তু তিনি ও তার পুত্র উভয়েই খ্রিস্ট ধর্ম বিরোধী ডেসিয়াসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নিহত হন। ডোসিয়াস রোমের সম্রাট হন। চার্চ লেখকদের দ্বারা ফিলিপাস রোমের সর্বপ্রথম খ্রিস্টান সম্রাট বলে সম্মান লাভ করেন।

প্রায় এই সময়ের মধ্যে সাসানিয়ান পার্সিয়ানরা রোমানদের মধ্যপ্রাচ্যে প্রধান শত্রুরূপে আবির্ভূত হয়। খ্রিস্টীয় ২৬৫ অব্দে পালমিরার আরব নেতা ওদাইনা (Odenathus) সাসানি সম্রাট প্রথম শাহপুরকে পরাজিত করে তার রাজধানী স্টেসিফোন (Ctesiphon) পর্যন্ত তাড়িয়ে নিয়ে যান। পুরস্কার স্বরূপ রোম সম্রাট গ্যালিনাস রোম রাজ্যের পূর্বাঞ্চলে তাকে সর্বাধিনায়ক রূপে অধিষ্ঠিত করেন। ঐ অঞ্চলে তার স্ত্রী জেনোবিয়া (Zenobia) রাজত্ব করতেন। তিনি তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করার জন্য স্বাধীন সাম্রাজ্য স্থাপনের চেষ্টা করেন কিন্তু ২৭২ খ্রিস্টাব্দে রোম সম্রাট অরেলিয়ান (Aurelian) তাকে আক্রমণ করে পরাস্ত করেন। জেনোবিয়া বন্দি হয়ে রোমে যান। তাকে সম্রাট তার রথের পেছনে রেখে বিজয়যাত্রা (Triumph) প্রদক্ষিণ করেন রোমের রাজপথে। তার পর তিনি বন্দি জীবনযাপন করেন। তার স্বামী ওদাইনা মধ্যপ্রাচ্যে স্ত্রীর স্থলাভিষিক্ত হন। এটাই তার পুরস্কার।

১.১১ সাসানিয়ান

২২৬ খ্রিস্টাব্দে সাসান নামে জোরাস্ত্রীয় পুরোহিতের দৌহিত্র আর্দেসির (Ardashir) একদল পারস্য উচ্চবংশীয় যুবককে নেতৃত্ব দিয়ে পার্থিয়েন শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তাদের পরাজিত করেন এবং পারস্যে সাসানিয়া বংশের গোড়াপত্তন করেন। জোরাস্ত্রীয় উত্তরসূরিদের এই বংশের ধারা আকামেনিয়ান ও পার্থিয়েনদের সূত্র টেনে অনেক দূর প্রবাহিত হয়েছিল।

সাসানিয়ানরা ইরানের সমতল ভূমিতে তাদের রাজধানী স্থাপন করেনি, করেছিল টাইগ্রিস নদীর তীরে স্টেসিফোনে (Ctesiphon)। পূর্বে এই স্টেসিফোন হেলেনিস্টিক সেলুসীয় স্থাপনায় পার্থিয়েনদের সামরিক ঘাঁটি ছিল। সেলুসিয়া ও স্টেসিফোন এই দুই শহর মিলে মাদায়েন রূপে পরিচিত হয় যার অর্থ নগরী।

সাসানিয়ানদের লিখিত ভাষা ছিল পহলেভী (মধ্যপারস্য) এবং ধর্ম ছিল জোরাস্ত্রীয়। এই ধর্মের অনুসারীদের সাধারণত ম্যাগি বলা হতো, কোরানের ভাষায় মাজুস (২২:১৭)। প্রাথমিক ইসলামী যুগে এরা হানিফ শ্রেণীভুক্ত ছিল কারণ এরা পৌত্তলিকতা পরিত্যাগ করেছিল।

প্রাচীনকাল থেকে আরবে জোরাস্ত্রীয় কওম বসবাস শুরু করে। প্রাচীন আরবি পুস্তকে এই গোত্রের অগ্নি মন্দিরের উল্লেখ পাওয়া যায়, তাদের মধ্যে একটি ছিল মুজদালিফায় যেখানে হজের সময় হাজীরা আশ্রয় নেয়। কাবার জমজম কূপ প্রাথমিক জোরাস্ত্রীয়দের কাছেও পবিত্র বস্তু ছিল। কাবাঘরের কালো পাথরকে স্মারক দ্রব্য রূপে তারা ছেড়ে যায় বলে কথিত। জোরাস্ত্রীয় দেবদূত ও দানব কাহিনী ইহুদি, খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্মকে প্রভাবিত করেছে।

শতাব্দি ধরে সাসানিয়ানরা রোমানদের পথের কাঁটা স্বরূপ ছিল। রোম সাম্রাজ্য বিভাজিত হওয়ার পর (৩৯৫ খ্রিঃ) মধ্যপ্রাচ্যে এরা বাইজানটাইনদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ও জাতশত্রু। সাসানিয়ানরা যখন ক্ষমতার তুঙ্গে তখন তাদের রাজ্য বিস্তৃত ছিল ইরান থেকে মধ্য এশিয়া হয়ে মেসোপটেমিয়ার নিম্নভূমি পর্যন্ত। আরব গোত্রের রাজাদের মধ্যে হিরা ছিল সাসানিয়ানদের প্রধান মিত্র রাজ্য এবং এই রাজ্যের মধ্য দিয়ে তারা দক্ষিণ-পশ্চিম আরব পর্যন্ত তাদের কর্তৃত্ব ছড়িয়ে দিয়েছিল। ষষ্ঠ শতাব্দির (খ্রিঃ) মধ্যে মদিনার ওপর সাসানীয় সম্রাট তার নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেছিলেন এবং সেখানে শান্তি- শৃঙ্খলা বজায় রাখা ও কর সংগ্রহের জন্য একজন প্রশাসকও নিযুক্ত করেছিলেন।

ইরানে সাসানিয়া বংশ এবং বাইজানটিয়ামের মধ্যে যে দীর্ঘ দ্বন্দ্ব ও বিরোধিতা ছিল তার সমাপ্তি ঘটে ৬২৭ খ্রিস্টাব্দে যখন সাসানিয়া সম্রাট খসরু দ্বিতীয় পারভেজ নিনেভে পরাজিত হন। খসরু যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালান। কিন্তু আপন সৈন্যদের হাতে নিহত হন। তার পুত্র দ্বিতীয় কোবাদ সিংহাসনে আরোহণ করে সন্ধির প্রস্তাব করেন। পার্সিয়ানদের এই পরাজয়ের কারণে আরব সাম্রাজ্য বিস্তারের পথ প্রশস্ত হয়। সাসানীয় শেষ সম্রাট তৃতীয় ইয়াজদেগার্ড মুসলিম বাহিনীর দ্বারা ইউফ্রেটিস নদীর তীরে ৬৩৬ সালে কাদিসিয়ার যুদ্ধে এবং ৬৪১ সালে মিদিয়ায় নিহাবন্দের যুদ্ধে সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হন। এর সাথেই মধ্যপ্রাচ্যে ইরানি প্রভুত্ব শেষ হয়।

১.১২ বাইজানটিয়াম

খ্রিস্টপূর্ব ৬৬৭ অব্দে গ্রিসের মেগারা থেকে কিছু উপনিবেশ স্থাপনকারী বাইজানের (By zan or By zas) নেতৃত্বে এশিয়া মাইনরের উত্তর-পূর্বে একটি ছোট স্থাপনা গড়ে তোলে। এই বাইজানের নাম থেকে ঐ স্থানের নাম হয় বাইজানটিয়াম। এক হাজার বছর পরে রোমান সম্রাট মহামতি কনস্ট্যানটাইন এই স্থানটিকে গুরুত্বপূর্ণ চিন্তা করে (কারণ এখানকার সপ্ত-পর্বত থেকে ইউরোপ ও এশিয়ার প্রবেশপথ নিয়ন্ত্রণ করা যায়) ৩২৮ খ্রিস্টাব্দে কনস্ট্যান্টিনোপল নগরীর ভিত্তি স্থাপন করেন। তিনি ৩১৩ খ্রিস্টাব্দে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেন এবং এই সাম্রাজ্যের ধর্মরূপে খ্রিস্টধর্ম গৃহীত হয়।

চতুর্থ শতাব্দির শেষ দিকে, রোমান রাজ্য দুই খণ্ডে ভাগ হয়ে যায়- রোমকে রাজধানী করে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্য এবং কনস্ট্যান্টিনোপলকে রাজধানী করে পূর্ব রোমান সাম্রাজের উদয় হয়। সাধারণত রোম কনস্ট্যান্টিনোপলের বিরুদ্ধবাদী হয়ে ওঠে, কারণ ছিল অনেক, যেমন রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ঈর্ষা ও রেষারেষী এবং রোমের ল্যাটিন চার্চ ও কনস্ট্যান্টিনোপলের গ্রিক চার্চের ধর্ম বিধান নিয়ে মতপার্থক্য ইত্যাদি।

জাস্টিনিয়নের সময় (রাজত্বকাল ৫২৭-৬৫ খ্রিঃ) বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ছিল এশিয়া মাইনর, সিরিয়া, প্যালেস্টাইন, মিশর, উত্তর আফ্রিকা, মরক্কোর সীমান্ত, দক্ষিণ স্পেন, ইতালি (একাদশ শতাব্দি পর্যন্ত দক্ষিণ ইতালি বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের অংশ ছিল) এবং বল্কানস। স্থাপত্য শিল্পের অপূর্ব নিদর্শন বিশালাকার চার্চ সেন্ট সোফিয়া (হাগিয়া সোফিয়া-স্বর্গীয় জ্ঞান) জাস্টিনিয়নের নির্দেশে নির্মিত হয়। জাস্টিনিয়ন রোমান আইন গ্রন্থের রূপকার। এই রোমান আইন সারা ইউরোপে (কিছুটা মুসলিম সাম্রাজ্যেও) প্রভূত প্রভাব বিস্তার করেছিল।

মধ্যপ্রাচ্য মূলত বাইজানটাইন ও সাসানিয়ানদের মধ্যেই নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। বাইজনটাইনদের কর্তৃত্ব ছিল সিরিয়া, প্যালেস্টাইনও মেসোপটেমিয়ার উপরিভাগে। আনুমানিক পঞ্চম শতাব্দির মধ্যভাগ থেকে এই দুই পরাশক্তি তাদের রাজ্য সংলগ্ন আরবাঞ্চলগুলোকে বাগে আনবার জন্য লড়ালড়ি করত। এই কারণে দুই শক্তির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেড়েছিল যার ফলে ঘাসান রাজ্য বাইজানটাইনের অনুগত ছিল এবং হিরা ছিল সাসানিয়ানদের।

প্রত্যাশিতভাবে আরব দেশের ওপর আধিপত্যের কারণে এই দুই পরাশক্তির মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ বেধে যায় এবং তা প্রায় চলতে থাকে ৪৩০ খ্রিঃ থেকে ৬৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। এই দীর্ঘকালের বিরোধ শেষে ৬১৫ খ্রিস্টাব্দে তুঙ্গে পৌঁছে যখন সাসানিয়ান সম্রাট দ্বিতীয় খসরু বাইজানটিয়ান সম্রাট হেরাক্লিয়াসকে পরাজিত করে। পরে দুই শক্তির গুঁতোগুঁতির পর ৬২৫ খ্রিস্টাব্দে বাইজানটাইন সেনাবাহিনী সাসানিয়ানদের ওপর চড়াও হতে শুরু করে এবং ৬২৭ খ্রিস্টাব্দে বাইজানটাইন সম্রাট হেরাক্লিয়াস নিনেভে সাসানিয়ানদের ওপর চরম বিজয় লাভ করেন, সাসানিয়ান সম্রাট পরাজিত হন। এর কিছু পূর্বে ৩৩১ খ্রিঃ পূর্বাব্দে আরবেলাতে আলেক্সান্ডার তৃতীয় দারায়ুসকে পরাজিত করেছিলেন।

প্রফেট মোহাম্মদের প্রাথমিক প্রচারকালে এই ঘটনাগুলো ঘটেছিল। বাইজানটিয়ানদের প্রথম পরাজয় ও পরে বিজয়ের কাহিনী কোরানে উল্লেখ আছে (সূরা রুম) সাধারণত প্যাগন আরবরা সাসানিয়ানদের পক্ষে ছিল এবং প্রফেট মোহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীরা ছিল রোমানদের প্রতি।

বাইজানটাইন সাম্রাজ্য-কাঠামো থেকে বোঝা যায় যে মূলত এই রাজ্য বা সাম্রাজ্য পুরোপুরি হেলেস্টিক চিন্তাধারায় আবৃত ছিল, ফলে ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে ও তার পরেও মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহের সংস্কৃতি ছিল হেলেস্টিক প্রভাবিত। মুসলিম রাজত্বকালে বাইজানটাইন ছিল একমাত্র বিধর্মী শক্তি যার ওপর মুসলমানদের কিছুটা শ্রদ্ধাভক্তি ছিল। মুসলমানরা বাইজানটাইন সভ্যতার সৌকর্যে ছিল মুগ্ধ, তাদের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা ব্যবস্থা, শিল্প ও স্থাপত্যে, বিজ্ঞান ও চিকিৎসাবিদ্যা, আইন ও প্রশাসনে যে বিস্ময়কর বিকাশ ঘটেছিল তা থেকে মুসলমানরা প্রভূত পরিমাণে সাহায্য গ্রহণ করতে কুণ্ঠা বোধ করেনি। ক্বচিৎ দু’একটি ক্ষেত্র ছিল যেখানে মুসলিম সংস্কৃতি এর প্রভাবমুক্ত ছিল বলা যেতে পারে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *