১০। খ্রিস্টান ও মোহাম্মদ

১০. খ্রিস্টান ও মোহাম্মদ

প্রাথমিক সময় থেকেই অনেক খ্রিস্টান মোহাম্মদকে অর্থোডকস খ্রিস্টান মনে করত না সেমেটিক বা বাইবেলের প্রফেটও মনে করত না, মনে করত গোল্লায় যাওয়া একজন খ্রিস্টান যিনি উল্টোপাল্টা শিক্ষা দিচ্ছেন।

আরবীয় খ্রিস্টান ধর্মবিদ জন দামস্কাস (মৃ. ৭৪৯) মোহাম্মদের ধর্মকে বিপথগামী খ্রিস্টানিটি বলে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তিনি লিখেছেন যে মোহাম্মদ মনে হয়, অরিয়ন সাধুদের সংস্পর্শে থেকে ওল্ড ও নিউ টেস্টামেন্টের ওপর ভিত্তি করে নিজের স্বতন্ত্র এক গোষ্ঠী (sect) সংগঠিত করেন (Bettmann 1953 P. 17)।

মধ্যযুগের খ্রিস্টান পাদ্রিরা মোহাম্মদীদের (Mohammdans) একটি বিরোধী বা নন-খ্রিস্টান ধর্ম মনে করতেন না, মনে করতেন খ্রিস্টান ধর্মের দলছুট ধর্ম ও ঈশ্বরদ্রোহী।

দান্তেও (Dante) (মৃত ১৩২১) প্রফেট মোহাম্মদ সম্বন্ধে এমন বিরূপ মন্তব্য করেন যার জন্য ইতালির মুসলমানরা ব্যাভেনাতে তার কবর উড়িয়ে দেবার ধমকি দিয়েছিল।

জার্মান দার্শনিক নিকোলাস কুসা (মৃ. ১৪৬৪) কোরান বিশ্লেষণ করে বলেন, এই গ্রন্থ নেস্টোনিয়ানবাদের খিচুড়ি। [খ্রিস্টানিটির প্রথম শতাব্দিতে মধ্যপ্রাচ্যে নোস্টোরিয়ান খ্রিস্টবাদ চালু ছিল, বিশেষ করে সিরিয়াতে। নেস্টোরিয়ারা খ্রিস্টের প্রকৃতিকে দু’ভাগে ভাগ করেছিল— এক মানবিক, দুই স্থানীয়; যা দুটো বিপরীত বাধায় প্রভাবিত হতো এবং তিন, মনোফিসাইটস, যারা সংখ্যায় বেশি ছিল এবং বিশ্বাস করত যে খ্রিস্টের স্বর্গীয় রূপ তার মানবতার মাঝে বিলীন হয়েছিল অর্থাৎ খ্রিস্টের ভগবান রূপ মানুষ খ্রিস্টে একাকার ছিল। এই মতবাদের খ্রিস্টান সিরিয়ায় তখন বেশি ছিল। [অনুবাদক]

কয়েকজন আধুনিক অথরিটিও এই মতবাদ পোষণ করেন যে ইসলাম ফান্ডামেন্টাল খ্রিস্টানিটির একটি শাখা, কেননা এ বিশ্বাস খ্রিস্টান নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। তবে প্রকাশ পেয়েছে অন্যভাবে, কারণ ঐ পরিস্থিতিতে মোহাম্মদ নিজেকে বিকশিত করেন। তারা বলেন, এটা সত্য, যদি তিনি মদিনাতে থাকাকালীন মৌলিক খ্রিস্টান টিচিংস থেকে দূরে সরে না যেতেন, তাহলে খ্রিস্টান সম্প্রদায় আরবে আরাবিয়ার চার্চ প্রতিষ্ঠা করে ফেলত। (Muir, 1912, P. xcviii)।

১০.১ প্রাথমিক খ্রিস্টান প্রভাব

শিশু মোহাম্মদের প্রথম নার্স উম্মে আয়মান আবিসিনিয়ার একজন খ্রিস্টান মহিলা। যদিও সঠিকভাবে জানা যায়নি কতদিন শিশু মোহাম্মদ তার অধীন পালিত হয়েছিলেন, তবু এটা সত্য যে তিনি খ্রিস্টান পরিবেশে জন্মগ্রহণ করেছেন, পালিতও হয়েছেন। এটা মনে করা অসঙ্গত নয় যে, প্রাথমিক আত্মিক জাগরণ কমবেশি হয়েছিল খ্রিস্টানদের মাঝে, যাদের মধ্য থেকে তার ভবিষ্যৎ প্রফেটহুডের দানা বেঁধেছিল।

বারো বছর বয়সে মোহাম্মদ সিরিয়াতে সাধু বহিরার সাক্ষাৎ পান এবং ঐতিহাসিকদের মতে, বয়স বাড়ার সাথে সাথে তিনি উত্তর আরাবিয়া, প্যালেস্টাইন এবং সিরিয়ায় বাণিজ্যিক যাত্রা নিয়মিত করেন এবং জানা-অজানা খ্রিস্টানদের সাথে মেলামেশা করেন, আলোচনা করেন। জানা লোকদের মধ্যে ছিলেন খ্রিস্টান সাধু সারজিয়াস (সারকিস)। সারজিয়াস ছিলেন আবদুল কাইস গোত্রভুক্ত। এছাড়া ছিলেন জিরজিস (জর্জিয়াস) এবং নাস্তর (Nestor)।

প্রাথমিক ঘটনা মতে, এই সাধুদের মধ্যে একজন মোহাম্মদের কাছে ধর্মীয় ডকট্রিন ও আইন ব্যক্ত করেন এবং বাইবেল থেকে কিছু অনুপ্রাণিত প্যাসেজ আবৃত্তি করে শোনান সেগুলো মোহাম্মদ কোরানভুক্ত করেছেন, যাতে প্যাগন আরবরা একটি সত্য ঈশ্বরের সাথে পরিচিত হতে পারে। সত্য যা-ই হোক না কেন, এটা হলফ করে বলা যায় যে, মোহাম্মদ তার গভীর ধর্মীয় আগ্রহ ও অধ্যাত্মবাদের প্রতি ঝোঁকের কারণে এই সব তত্ত্বকথার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে মনোযোগ দিয়ে শুনতেন এবং খ্রিস্টান সাধুদের সাথে আলোচনাও করতেন।

এই সংশ্লিষ্টতার কারণে আরবের মধ্যে এবং বাইরে মোহাম্মদ ধর্মীয় প্রথা ও বিশ্বাসের সাথে পরিচিত হয়ে ওঠেন এবং যদিও তিনি খ্রিস্টান সন্ন্যাসবাদকে অনুমোদন করেননি, তবু খ্রিস্টান সাধুদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ছিল এবং তাদের প্রার্থনা- পদ্ধতি কিছু গ্রহণও করেন।

মোহাম্মদের মিশন আরম্ভের পূর্বে খ্রিস্টান সম্প্রদায় আরাবিয়ান শহরে-নগরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাস করত। খ্রিস্টান মার্চেন্টরা যারা হেজাজে বাণিজ্য করত তারা স্থানীয় মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছে।

কিছু খ্রিস্টান গোত্র মক্কাতে বাণিজ্য ডিপো প্রতিষ্ঠা করে সেখানে তাদের প্রতিনিধি বসিয়ে রেখেছিল। এমনি গোত্রের মধ্যে ছিল ইজিল। এদের সাথে কোরেশ গোত্র সহম-এর বাণিজ্য চুক্তি ছিল। তেমনি ছিল খ্রিস্টান ঘাসান গোত্র ও কোরেশ গোত্র জুহরার সাথে। এই যোগসূত্রের কারণে কাবাঘরের আশপাশে বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছিল খ্রিস্টানদের।

মক্কাতে ছোট হলেও প্রভাবশালী খ্রিস্টান জনসংখ্যা বাস করত, আরব ও বিদেশী খ্রিস্টান উভয়ই। আবিসিনিয়া, সিরিয়া, ইরাক ও প্যালেস্টাইন থেকে ক্রীতদাস ও স্বাধীন খ্রিস্টান ব্যক্তি ভিড় জমিয়েছিল মক্কাতে। এই সব খ্রিস্টান জনগণ ছিল কারিগর, রাজমিস্ত্রি, ব্যবসায়ী, ডাক্তার ও লেখক (কাতিব)। আজরাকি (মৃ. ৮৫৮) বলেছেন যে, মক্কাতে খ্রিস্টানদের একটি আলাদা কবরস্থান (Cemetery) ছিল (Trimmingham 1979, P. 260)।

ভ্রাম্যমাণ খ্রিস্টান প্রচারকগণ প্রায়ই হেজাজের মধ্যে বিচরণ করেছেন এবং তাদের মধ্যে একজন কস ইবন সায়দার সারমন, মোহাম্মদের মিশন শুরু হওয়ার পূর্বে, তার মনে গভীর রেখাপাত করেছিল।

খাদিজা মোহাম্মদের প্রথম জীবন সঙ্গিনী ছিলেন তাঁর জীবনের পরবর্তী চব্বিশ বছর ধরে। তিনি খ্রিস্টান ছিলেন এবং খ্রিস্টানদের সাথে তাঁর নিবিড় যোগসূত্র ছিল। তাঁর কাজিন ওয়ারাকা খ্রিস্টান ছিলেন। ওয়ারাকা মোহাম্মদকে প্যাগন আরবদের ধর্ম সংস্কারের প্রচেষ্টাকে উৎসাহিত করেছেন।

৬১৯ খ্রিস্টাব্দে মোহাম্মদের অনুসারীদের অনেকেই খ্রিস্টান আবিসিনিয়াতে হিজরত করেন। এদের মধ্যে তার তিনজন কাজিন ছিলেন জাফর, ওবাইদুল্লাহ ও জুবাইর; তিনজন মহিলা, যারা পরে প্রফেট মোহাম্মদের পত্নীর মর্যাদা পান তারা হলেন সওদা, উম্মে হাবিবা এবং উম্মে সালমা। সওদা ও উম্মে হাবিবা উভয়েই বিধবা ছিলেন এবং তাদের স্বামীরা ছিলেন খ্রিস্টান। মোহাম্মদের শ্যালক মালিক ইবন জামাআ, মোহাম্মদের কন্যা রোকেয়া এবং ওসমানও ছিলেন এই দলে। ওসমান পরবর্তীতে তৃতীয় খলিফা হয়েছিলেন।

হিজরতকারীদের মধ্যে অনেকেই খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করে আবিসিনিয়াতে রয়ে যান, এদের মধ্যে মোহাম্মদের কাজিন ওবাইদুল্লাহ এবং একজন কোরেশী সাকরান। প্রফেট মোহাম্মদের উক্ত তিনজন স্ত্রীদের মধ্যে প্রায়ই আবিসিনিয়ার নির্জনবাস স্মরণে আসত।

মোহাম্মদের পালিত পুত্র জায়েদ ইবন হারিথ এবং সলমন ফারসি যিনি ৬২৭ খ্রিস্টাব্দে খন্দরের যুদ্ধে মুসলমানদের সাহায্য করেছিলেন, উভয়েই প্রথমে খ্রিস্টান ছিলেন। হারিথ ইবন কালদা, মোহাম্মদের বন্ধু ও ডাক্তার, নেস্টোরিয়ান খ্রিস্টান ছিলেন। আবিসিনিয়ান ক্রীতদাস বেলাল, ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন, তার শেষ জীবন খ্রিস্টান টারসাসে অতিবাহিত করেন এবং হাসান ইবন থাবিত মোহাম্মদের ব্যক্তিগত কবি উভয়েরই নিবিড় খ্রিস্টান বন্ধন ছিল। মোহাম্মদের অতি প্রিয় উপপত্নী মেরি কিবতিয়া মিশরের খ্রিস্টান ক্রীতদাসী ছিলেন।

১০.২ খ্রিস্টান শিক্ষকগণ

ঐসব লোক ছাড়া যাদের কাছ থেকে মোহাম্মদ পরোক্ষভাবে প্রভাবিত হয়েছেন, এমন কতকগুলো খ্রিস্টান ছিলেন যাদের নিকট থেকে পরবর্তীতে তিনি প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং তার ডকট্রিনের পরিপূর্ণতার জন্য তাদের কাছে ঋণী ছিলেন।

প্রফেট মোহাম্মদের শত্রুরা জানত যে তিনি খ্রিস্টানদের টিচিংস সম্বন্ধে ওয়াকিফহাল হওয়ার জন্য স্থানীয় খ্রিস্টানদের বাড়িতে যাতায়াত করতেন তাই তাঁর শত্রুরা অভিযোগ তুলেছিল যে কোরানে কিছু অংশ তিনি খ্রিস্টানদের কিতাবের মেটিরিয়েল এবং কিছু অংশ বিভিন্ন উৎস থেকে সংগ্রহ করেন। তাঁকে দোষ দেয়া হতো এই বলে যে তিনি যেখানে কিছু শুনতে পেতেন তাতে কান পাততেন (৯ : ৬১) এবং সে সব গাল-গল্পকে গুরুত্বও দিতেন। তারা (তাঁর শত্রুরা) তাঁর বিরুদ্ধে চার্জ এনেছিল এই বলে যে তিনি অন্যের দ্বারা নির্দেশিত (৪৪ : ১৩) এবং সাহায্যপ্রাপ্ত। সেই সব মানুষ তাকে সকাল-সন্ধ্যায় প্রাচীন কাহিনী ও ঘটনা শোনাত (২৫ : ৬)। এছাড়া তার শিক্ষকদের মধ্যে কিছু বিদেশীও ছিল (৯১৬ : ১০৫)।

এই সব কাজের প্রতিবাদ করে প্রফেট মোহাম্মদ বলেছিলেন যে তিনি পূর্বে কোনো কিতাব পড়েননি বা সেখান থেকে কিছু লিখেও নেননি, গ্রহণও করেননি। (২৯ : ৪৭) এবং বিদেশী শিক্ষক ও তাদের ভাষা সম্বন্ধে প্রফেট বলেন যে তাদের ভাষা বিদেশী, দুর্বোধ্য কিন্তু কোরান লিখিত হয়েছে বোধগম্য আরবি ভাষাতে। ইয়াহিয়া আল-বাইদাবী, আলা-জামাখশারী, আব্বাসী জালালান ও অন্যান্য মুসলিম পণ্ডিত ও তফসিরকারদের লেখা থেকে ঐ সব ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা গেছে যারা আরব ও বিদেশী ছিল এবং তারা কোরান রচনায় সম্পৃক্ত; কিন্তু তাদের সম্বন্ধে বিস্তারিত অল্পই পাওয়া যায় তাই বিষয়টি অনিশ্চিত রয়ে যায়।

প্রফেট মোহাম্মদ জ্ঞানী ইহুদি পণ্ডিতদের কাছ থেকে সংবাদ সংগ্রহ করতে পারেন কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে তাঁর পরামর্শদাতা (mentor) ছিলেন খ্রিস্টান পণ্ডিতরা। তফসিরকার হুসাইন বলেছেন যে প্রফেট প্রত্যেক সন্ধ্যায় জনৈক খ্রিস্টানের কাছে তাওরাত ও ইঞ্জিল শুনতে যেতেন। বেশ কয়েক জন মুসলিম লেখকও বলেছেন যে, প্রফেট অন্য ধর্মের লোকদের সাথে যোগাযোগ করতেন এবং একথা কোরেশীরাও বলাবলি করেছে। যাদের কথা উঠেছে তাদের মধ্যে নিম্নে বর্ণিত পণ্ডিত ব্যক্তিদের নাম ‘ উল্লেখযোগ্য।

(১) কাইস ছিলেন আবদুল কাইস গোত্রের; তিনি খ্রিস্টান ছিলেন। প্রফেট মোহাম্মদ তার কাছে যাতায়াত করতেন।

(২) জাবরা যুবক গ্রিক খ্রিস্টান, তার পেশা ছিল তরবারি তৈরি করা এবং হাদ্রামাত থেকে আগত এক পরিবারের গৃহ ভৃত্য। এই পরিবার মক্কাতে স্থায়ী বাসিন্দা ছিল। জাবরা মুসার আইন সম্বন্ধে ভালো জ্ঞান রাখল; বাইবেলের অন্যান্য নবী ও যিশুর শিক্ষা সম্বন্ধেও তার জ্ঞান ছিল। সে প্রফেটের সামনে এই সব কিতাব পড়ে শোনাত এবং প্রফেট মোহাম্মদ তার কাছে নিয়মিত যেতেন।

(৩) আবু তাকবিহা গ্রিক ছিলেন এবং প্রফেট মোহাম্মদ তার আলোচনায় অংশ নিতেন।

(৪) সিনানের পুত্র সোহাইব গ্রিক ক্রীতদাস ছিল এবং দক্ষিণ মেসোপটেমিয়ার ওবোলার পার্সি গভর্নরের ভাতিজা, যাকে ওবোলা থেকে ডাকাতরা তুলে নিয়ে সিরিয়াতে চলে যায়। সিরিয়াতে বাইজানটাইন রূপে শিক্ষা গ্রহণ করে মক্কা পালিয়ে যায় সোহাইব। প্রফেট মোহাম্মদ এর কাছে যেতেন বলে প্রকাশ। এই সোহাইব পরে ইসলাম ধর্মে দীক্ষা লাভ করে।

(৫) আয়েশও একজন ক্রীতদাস। ভালো শিক্ষা-দীক্ষা ছিল। পরে প্রফেট মোহাম্মদের একজন অনুসারী হয়ে যায়।

(৬) খ্রিস্টান তামিম গোত্রের আবু রোকেয়া তার পবিত্র জীবনযাপনের জন্য খ্যাত ছিল। তার নিবেদিতপ্রাণ ও নিঃস্বার্থ সেবা; তাকে আখ্যায়িত করেছিল মানুষের সাধুব্যক্তি’ (Archer, 1924 P. 60)। পরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং প্রফেট মোহাম্মদের নিকট সাহাবীদের একজন হয়ে যান।

(৭) খ্রিস্টান তামিম আল-দারী, শোনা যায়, প্রফেট মোহাম্মদকে ‘শেষ বিচারের দিন’ সম্বন্ধে ধারণা দেন। তিনিও পরে মুসলিম হয়ে যান। সময় সময় তাকে আবু রোকেয়া বলে মনে হতো।

(৮) নিনেভের খ্রিস্টান সাধু আদ্দাস মক্কায় বসতি করেন। খাদিজা মোহাম্মদকে তার কাছে নিয়ে যান এবং তিনি মোহাম্মদের কাছে জিব্রাইল ফেরেস্তা সম্বন্ধে এবং ঐশীবাণী বহনকারী রূপে বিস্তারিত বর্ণনা দেন। তার সাথে মোহাম্মদ অনেক দিন ধরে আলোচনা করেন। এই আদ্দাস সেই আদ্দাস নন, যিনি ৬১৯ সালে তায়েফে আশ্রয় প্রার্থনার সময় সাহায্য করেছিলেন।

(৯) নিনেভের ইউনুছ সম্বন্ধে ইবন হিশাম বলেন যে, ইউনুছ নিনেভের আদ্দাসের ভাই ছিলেন এবং তিনি তাঁর আধ্যাত্মিক ও সাধুতার গুণে প্রফেটিক ক্ষমতা লাভ করেন। প্রফেট মোহাম্মদ তার কাছেও যাওয়া-আসা করেছেন।

(১০) ইয়াসরা বা আবু ফুকাইহা জ্ঞানী খ্রিস্টান ব্যক্তি ছিলেন। ইনি মক্কার একটি পরিবারে ভৃত্যরূপে কাজ করতেন। প্রফেট মোহাম্মদ এখানেও আসতেন। বর্ণনা করা হয় যে ইয়াসরা খ্রিস্টান গসপেল থেকে পড়ে শোনাতেন আর প্রফেট মোহাম্মদ মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। ইয়াসরার কন্যা “ফুকাইহা হাত্তাবকে বিবাহ করেন এবং আবিসিনিয়ার হিজরতে অংশ নেন।

(১১) তফসিরকার আব্বাসী বলেন যে, কাইন খ্রিস্টান ছিলেন, তিনি প্রফেট মোহাম্মদকে কয়েকটি কাহিনীর বর্ণনা দেন, যা পরে কোরানের অন্তর্ভূক্ত হয়।

(১২) ইয়ামামার রহমান, মোহাম্মদের সমসাময়িক ব্যক্তিরা বলেছেন, প্রফেট মোহাম্মদকে কিছু ধর্মীয় ধারণা দিয়েছিলেন। ইবন ইসহাক ব্যক্ত করেছেন যে, ইয়ামামার এক খ্রিস্টান আব্দুল রহমানের সাথে প্রফেট মোহাম্মদ যোগাযোগ করতেন। এই রহমানকে পণ্ডিত ব্যক্তিরা মুসাইলিমা বলে চিহ্নিত করেন।

১০.৩ খ্রিস্টানদের প্রতি সহিষ্ণুতা

নবী জীবনের শুরু থেকে মক্কাতে এবং মদিনায় প্রথম দিকে, প্রফেট মোহাম্মদ মেসিয়া যিশু, লোগস ও ঈশ্বরের সম্বন্ধে খ্রিস্টান মতবাদের প্রতি গভীর আগ্রহ ছিল।

কোরানে ঈশ্বর যিশুকে বলেন, তোমাকে যারা অনুসরণ করে আমি শেষ বিচারের দিন পর্যন্ত তাদের অবিশ্বাসীদের ওপর প্রতিষ্ঠিত করব (৩ : ৪৮)। কোরান ধারণ করে যে, খ্রিস্টানরা গর্বযুক্ত এবং মুসলিমদের সাথে বন্ধুত্ব বজায় রাখতে অতি আগ্রহী (৫ : ৮৫)।

৬২৮ খ্রিস্টাব্দে খ্রিস্টান ডেপুটশনের নেতাদের, যারা মদিনাতে তাঁর সাথে দেখা করে, তাদের নিজের বাসায় থাকতে দেন, তাদের মদিনার মসজিদে প্রার্থনা করার অনুমতি দেন এবং সেখানে খ্রিস্টান নেতারা প্রথামতো পূর্বদিকে মুখ করে প্রার্থনা করেন।

ঐ একই সালে নাজরানের খ্রিস্টানদের সাথে এক সন্ধি চুক্তিতে মোহাম্মদ এই শর্তে আশ্বাস দেন যে, তাদের তিনি আশ্রয় দিবেন এবং কোনো অত্যাচার করা হবে না। তাদের জীবনের, ধর্মের ও সম্পত্তির নিরাপত্তা দেয়া হবে; কোনো খ্রিস্টানকে তার ধর্ম পরিত্যাগ করতে জবরদস্তি করা হবে না এবং কোনো তীর্থযাত্রীকে বাধা দেয়াও হবে না; খ্রিস্টানের ওপর কোনো কর ধার্য হবে না অথবা তাদের তরফ থেকে কোনো সৈন্য দাবি করা হবে না; খ্রিস্টান মহিলা কোনো মুসলিমকে বিবাহ করলে সে তার নিজের ধর্ম পালন করতে পারবে; কোনো চার্চ ভেঙে মসজিদ গড়া হবে না; চাৰ্চ মেরামতের জন্য সাহায্য প্রদান করা হবে; কোনো বিশপকে চার্চ থেকে, কোনো সাধুকে মনাস্টরি থেকে, কোনো পুরোহিতকে তার বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হবে না, কোনো মূর্তি বা ক্রসধ্বংস করা হবে না; খ্রিস্টানরা প্রার্থনার সময়ে কাঠের মন্দিরা বাজাতে পারবে এবং উৎসবের সময় ক্রস বহন করতে পারবে। (Ameer Ali 1965, P. 273)। এই সব বিষয়ে মোহাম্মদ তাঁর নিজের শপথ দিয়েছিলেন। তিনি এবং তাঁর অনুসারীদের ব্যক্তিগতভাবে এই শর্ত মেনে চলার কথা দেন এবং ঘোষণা দেন যে কোনো মুসলিম এই শর্ত ভঙ্গ করলে সে ঈশ্বরের নির্দেশ ভঙ্গকারী রূপে চিহ্নিত হবে।

প্রফেট মোহাম্মদ যেমন একবার চিন্তা করেছিলেন প্রার্থনার সময় মুসল্লিদের ডাকার জন্য ইহুদিদের মতো ড্রাম (বুক) ব্যবহার করবেন। তেমনি তিনি ভেবেছিলেন খ্রিস্টানদের মতো ঘণ্টা বাজানো এবং কাঠের মন্দিরা (নাকুস) ব্যবহার করবেন প্রার্থনার সময়। যাই হোক ধাতুর তৈরি ঘণ্টার শব্দতে তার বিরক্তি ধরে, তাই তিনি কাঠের মন্দিরা (Clapper) বাজাবার সিদ্ধান্ত নেন। ইবন হিশাম বলেন, প্রফেট মোহাম্মদ কাঠের মন্দিরা তৈরি করতে নির্দেশ দেন এবং তা করাও হয়েছিল; ঠিক এই সময় তিনি মত পরিবর্তন করেন এবং আজান দেয়ার পদ্ধতি চালু করেন।

৬৩০ খ্রিস্টাব্দে মক্কা বিজয়ের পর নগর দখল করে মোহাম্মদ কাবাঘরের সব মূর্তি ভেঙে ফেলার ও দেয়াল চিত্র সব মুছে ফেলার নির্দেশ দেন। আব্রাহাম ও ইসমাইলের মূর্তিও ভেঙে ফেলা হয়, কেননা তাদের হাতে প্যাগন জ্যোতিষীদের মতো হাতে ভাগ্য নির্ধারণ তীর (Divining arrows) ধরা ছিল। কিন্তু বলা হয় যে, তিনি নিজের হাত দিয়ে মাতা মেরি ও শিশু যিশুর একটি চিত্র রক্ষা করেন (Esin 1963, P. 109)। এই ছবিটি চিত্রকর বাকুম (pachomias) কর্তৃক অঙ্কিত বলে কথিত। ৫৯৪ সালে যখন কাবাঘর পুনর্নির্মিত হয় তখন এই চিত্র অঙ্কিত হয়েছিল। পরে এই ছবির কি দশা হয়েছিল জানা যায়নি, তবে নিঃসন্দেহ যে কোনো এক সময়ে উপযুক্ত উপায়ে এই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল।

১০.৪ সমান্তরাল প্যাসেজ

পণ্ডিত ব্যক্তিগণ বাইবেল ও কোরানের প্যাসেজ, চ্যাপ্টার ও ভার্স পাশাপাশি রেখে দেখিয়েছেন যে প্রফেট মোহাম্মদ ইহুদি ও খ্রিস্টান সূত্র থেকে বহু মেটিরিয়েল ব্যবহার করেছেন। ক্যাননিক্যাল এবং এপ্রোক্রাইফাল অর্থাৎ আইন বিষয়ক যা বাইবেলের অন্তর্ভুক্ত এবং গুপ্ত বিষয়ে যা বাইবেল বহির্ভূত ও অস্বীকৃত উভয়ই, প্রফেট মোহাম্মদ ওল্ড এবং নিউ টেস্টামেন্টের প্যাসেজগুলো শুনে থাকবেন এবং পরে সেগুলো গুছিয়ে শ্রুত বস্তুরূপে নিজের মতো করে ব্যবহার করেছেন।

বাইবেল থেকে উদ্ধৃতি কোটেশন রূপে কোরানে কিছু ব্যবহার করা হয়েছে, যেমন— “মোত্তাকীগণ পৃথিবীর মালিক হবে (২১ : ১০৫)। এটা সরাসরি ওল্ড টেস্টামেন্ট থেকে নেয়া” (সঙ্গীতাবলী ৩৭ : ২৯)।

গসপেলের উদ্ধৃতি আছে : সেন্ট মার্ক-এর গসপেল বলে : জমি নিজে নিজেই ফসল জন্মাল; প্রথমে চারা, পরে শীষ এবং শীষের মাথায় পরিপূর্ণ শস্যের দানা (মার্ক ৪ : ২৮)। কোরানে এইরূপে বলা হচ্ছে : এবং ইঞ্জিলেও তাহাদের বর্ণনা এইরূপই। তাহাদের দৃষ্টান্ত একটি চারাগাছ, যাহা হইতে নির্গত হয় কিশলয়, অতঃপর ইহা শক্ত ও পুষ্ট হয় এবং পরে কাণ্ডের উপর দাঁড়ায় দৃঢ়ভাবে। (৪৮ : ২৯)।

অতি সুখকর দৃশ্য (beatific vision) নিউ টেস্টামেন্ট ও কোরানে এই ভাবে বর্ণিত : আমরা এখন যেন আয়নায় অস্পষ্ট দেখছি কিন্তু তখন সামনাসামনি দেখতে পাব (১ করিন্থ ১৩ : ১২)। কোরান বলছে : তাদের প্রভুর দিকে তাকিয়ে ঐ দিন তাদের মুখমণ্ডলই উজ্জ্বল হইবে (৭৫ : ২২)।

যিশু বলেছেন : যে তার পিতা বা মাতা-পুত্র বা কন্যাকে আমার চেয়ে বেশি ভালবাসে, সে আমার উপযুক্ত নয়। একটি হাদিসে প্রফেট মোহাম্মদ বলেছেন : কাউকে বিশ্বাসী বলা যাবে না, যদি না সে বিশ্বাস করে আমি তার কাছে তার বাবা, মা, সন্তান সমস্ত মানবজাতি থেকে প্রিয় (Brandon 1970, P. 277)।

বাইবেলের প্যারাবেল আছে জ্ঞানী ও নির্বোধ ভার্জিনদের সম্বন্ধে : নির্বোধ জ্ঞানী ব্যক্তিকে বলে, ‘তোমার তেল আমাকে দাও, কারণ আমাদের বাতিগুলো নিভে গেছে।’ কিন্তু বিজ্ঞ ব্যক্তি জবাবে বলে : “না, আমাদের জন্য যথেষ্ট না রেখে তোমাকে দেয়া যাবে না। তুমি বরং তোমার জন্য কিনে নাও” (মথিঃ 25 : 8-9)। কোরান বলছে : “ঐ দিন, মোনাফেকগণ নারী-পুরুষ উভয়েই বিশ্বাসীদের বলবে ‘আমাদের সাথে এসো যাতে তোমাদের আলোতে আমাদের বাতি জ্বালাতে পারি।’ তখন তারা বলবে : ফিরে যাও এবং তোমাদের নিজেদের জন্য আলো খুঁজে নাও, (৫৭ : ১৩)।’

যিশু বলেছেন : সুচের চোখ দিয়ে উট গলে যাওয়া সহজ একজন ধনী ব্যক্তির আল্লাহর রাজত্বে প্রবেশ করার চেয়ে (মথি ১৯ : ২৪)। কোরানের মতে : আমাদের যারা মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে তাদের জন্য স্বর্গদ্বার উন্মুক্ত হবে না, অথবা তারা স্বর্গে প্রবেশ করতে পারবে না, যতক্ষণ সুচের চোখ দিয়ে একট উট গলে যায় (৭ : ৩৮)। বাইবেল বলে : প্রভুর দিনে, স্বর্গগুলো লিখিত বর্গগজের মতো গুটিয়ে যাবে। (ইসাইয়া. ৩৪ : ১)। কোরান বলে : ঐদিন আমরা (ঈশ্বর) লিখিত কাগজের মতো স্বর্গগুলোকে গুটিয়ে ফেলবো (২১ : ১০৪)।

সেন্ট পল লিখেছেন : চোখও দেখেনি, কানও শোনেনি, মানুষের অন্তরেও প্রবেশ করেনি, ঐসব বস্তু তাদের জন্য ঈশ্বর তৈরি করেছেন যারা তাঁকে ভালবাসে (১ করিন্থ ২ : ৯)। প্রফেট মোহাম্মদ আবু হোরায়রাকে বলেছিলেন- আল্লাহ ভালো লোকদের জন্য যা তৈরি করেছেন, তা চোখ দেখেনি, কান শোনেনি বা কারোর অন্তঃকরণেও প্রবেশ করেনি (আমির আলী ১৯৬৫, পূঃ ১৯৯)। তারপর তিনি নিম্নোক্ত আয়াত আবৃত্তি করেন- ভালো কাজের জন্য যে কী পুরস্কার মানুষের দৃষ্টিকে আনন্দিত করবে, তা কারোর জানা নেই (৩২ : ১৭)।

বাইবেল বলেছে : যেখানে আমার নামে দু’তিন জন লোক জড়ো হয় আমিও তাদের মধ্যে থাকি (মথি : ১৮ : ২০)। কোরান বলে : তিন ব্যক্তির মধ্যে এমন কোনো গোপন পরামর্শ হয় না, যেখানে চতুর্থ জন হিসাবে আল্লাহ উপস্থিত থাকেন না (৫৮ : ৭)।

এমন অনেক জিনিস রয়েছে যা যিশু করেছেন, যদি কেউ তা লিখতে চায়, আমি মনে করি, লিখলে সারা বিশ্বে সেই সব পুস্তকের ঠাঁই হবে না (জন. ২১ : ১৫)। কোরান বলছে : সমুদ্র যদি কালি হয়, সারা পৃথিবীর বৃক্ষরাজি যদি কলম হয় তাও প্রভুর কথা লিখে সারা যাবে না। (১৮ : ১০৯)।

প্রফেট মোহাম্মদ নিজে এবং তার চরিতকারগণ তাঁর ও যিশুর জীবনের মধ্যে সমান্তরাল টানার চেষ্টা করেছিলেন। এইরূপে বলা হয় যে, যিশুর মতো মোহাম্মদ কয়েকজন শিষ্য চয়ন করেছিলেন ইসলামের বাণী ছড়িয়ে দিতে, যিশুর মতো মোহাম্মদ পর্বতের ওপর থেকে শেষ সারমন দিয়ে বলেন- এই দিন আমি তোমাদের ধর্ম পরিপূর্ণ করিলাম। যিশু নাজরাথের সিনেগগে ঘোষণা দেন : এই দিনে এই পুস্তক তোমাদের কর্ণকে পরিপূর্ণ করিল (লুক ৪ : ২১)। ক্রুশে উঠে যিশুর শেষ বাণী ছিল : শেষ হয়ে গেল (জন. ১৯ : ৩০)। এর প্রতিধ্বনি শুনতে পাওয়া যায় যখন মোহাম্মদ তার সারমনে শেষ বাক্য উচ্চারণ করেন— ‘আমি আমার কাজ শেষ করিয়াছি।

প্রফেট মোহাম্মদের মৃত্যুর পর তাঁর অনুসারীরা এই দুইটি জীবনের মধ্যে সাদৃশ্য (Similarities) খুঁজে চলেছে- মোহাম্মদের অলৌকিকতার মধ্যে, তাঁর পাপহীনতার ধারণার মধ্যে এবং তাঁর স্বর্গীয়-সমমর্যাদার মধ্যে।

১০.৫ পারিভাষিক শব্দ

শুধু পশ্চিম পণ্ডিতবর্গ নয় (Jeffery, 1938; Sweetrnan, 1967, et ab.) প্রথম দিকের কয়েকজন মুসলিম তফসিরকারও (exegetes) দেখিয়েছেন যে, অনেক মৌলিক ধর্মীয় শব্দ যা মোহাম্মদ ব্যবহার করেছেন, মূলত তা সিরিয়া ও আরবের খ্রিস্টান চার্চে ধর্মীয় পরিভাষার অন্তর্ভুক্ত ছিল যেমন সিরিয়াক (খ্রিস্টয়ান আরামাইক)কে দেখা যায় এবং সেই সব পরিভাষা সুবিধাজনকভাবে হাতের কাছে পেয়ে মোহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীরা ধার করা শব্দ (loanwords) হিসাবে গ্রহণ করেছেন। সেই সব পরিভাষা থেকে বাছাই করে কিছু অংশ নিম্নে উদ্ধৃত করা হলো :

ইসলাম শব্দটি সেমেটিক মূল (Root) SLM (এসএলএম) থেকে আগত অর্থ পরিপূর্ণতা বা নির্বিঘ্নতা। আরবে গৃহীত হয় মোহাম্মদের জন্মের কিছু পূর্বে, তার পর নির্দিষ্টভাবে এর অর্থ করা হয় আত্মসমর্পণ, আত্মত্যাগ, গ্রহণ বা সমর্পণ, নিবেদন ইত্যাদি। ধর্মীয় মতে টেকনিক্যাল টার্ম হিসাবে সিরিয়ান খ্রিস্টানরা এ শব্দকে ব্যবহার করত ঈশ্বরের নিকট সম্পূর্ণভাবে নিবেদন (Jeffary 1938. P. 63) এবং এটা ব্যবহার করা হতো বিশ্বাসকে বিকাশ করার জন্য। প্রফেট মোহাম্মদের এক সাহাবী আব্বাস ইবন মিরদাস একটি কবিতা রচনা করে তাতে তিনি বলেছিলেন ‘ইসলাম’ শব্দটি মোহাম্মদের পূর্বে প্রচলিত ছিল, তিনি শুধু এর ‘মেরামত’ বা সংস্কার করেছেন (Bravmann, 1972, P. 26)।

‘মুসলিম’ শব্দটিও একই সেমোটিক মূল থেকে উদ্ভূত। এই শব্দটিও খ্রিস্টানরা মোহাম্মদের পূর্বে ব্যবহার করেছে এবং এ শব্দ দ্বারা ঐ ব্যক্তিকে বোঝাত, যে নিজেকে ঈশ্বরের কাছে নিবেদন করেছে। আব্রাহামকে কোরানে মুসলিম বলা হয়েছে (৩ : ৬০) এবং লুতের ঘরবাড়িকে মুসলিম ঘরবাড়ি বলা হয়েছে (৫১ : ৩৬) এবং ইহুদি ও খ্রিস্টান যারা ইসলাম আগমনের পূর্বে মুসলিম ছিল (২৪ : ৫৩) এবং যিশুর শিষ্যদের মুসলিম বলে ডাকা হতো (৩ : ৪৫)।

প্রথমে মোহাম্মদ ব্যাপকভাবে মুসলিম শব্দ ব্যবহার করেছেন আব্রাহাম থেকে যিশু পর্যন্ত সকল নবীদের অনুসারীদেরকে। এ সমস্ত লোকদের মুসলিম বলা হয়েছে যারা ঈশ্বরের প্রতি নিবেদিত এবং যারা সত্য ধর্ম ইসলামকে অনুসরণ করেছে (৩ : ৭৮)। পরবর্তীকালে মুসলিম শব্দের অর্থকে সঙ্কীর্ণ করে শুধু মোহাম্মদ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ধর্ম ও তাঁর অনুসারীদের চিহ্নিত করা হয়েছে।

কোরান শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে কেরানা (Kerana) শব্দ থেকে যে শব্দটা সিরিয়ান খ্রিস্টানরা চার্চ সার্ভিসে বাইবেল টেক্সট থেকে পাঠ করার সময় ব্যবহার করত।

কোরানের চ্যাপ্টারকে যে ‘সূরা’ বলা হয়,” এই সূরা শব্দটি এসেছে সিরিয়ান খ্রিস্টান শব্দ সুরতা (Surta) থেকে। ‘সুরতা’ বলা হতো খ্রিস্টান স্ক্রিপচারের (পুস্তক) অংশবিশেষকে (Portion of scripture)। কোরানের ‘আয়া’ বা চিহ্ন তেমনি এসেছে সিরিয়ান খ্রিস্টান ব্যবহার থেকে।

কোরানে ব্যবহৃত ফুরকান’ শব্দটির অর্থ রিভিলেশন (ওহি), প্রাক-ইসলামী ও ইসলামী উভয়ই এবং স্যালভেশন অর্থাৎ ‘মুক্তি’ অর্থে। কোরানের ২৫ নং সূরার টাইটেলও ফুরকান এবং এই শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে সত্য ও ভুলের (Truth and error) মধ্যে পার্থক্যকে তুলে ধরতে। ফুরকান শব্দটি টানা হয়েছে আরামাইক খ্রিস্টান শব্দ পোরকান (Porkan) থেকে, যার অর্থও মুক্তি-স্যালভেশন (Dawood, 1990, P. 358)।

চার্চের যে পবিত্র সার্ভিস তাকে সিরিয়াক ভাষায় সালাত (Salat) বলা হয় এবং এই খ্রিস্টান ব্যবহারিক শব্দ মুসলিমদের প্রার্থনার অঙ্গকে চিহ্নিত করেছে এবং গৃহীত হয়েছে। ‘সাজদা’ শব্দটি মুসলিম প্রার্থনার সম্পূর্ণ প্রণিপাতকে বোঝায় (Deep prostration)। এটাও সিরিয়ান খ্রিস্টান থেকে ধার করা শব্দ। ‘জিকির’ শব্দটির দ্বারা বারবার ঈশ্বরের নাম স্মরণ করার পদ্ধতিকে বোঝায়; এই জিকির শব্দ সিরিয়ান খ্রিস্টান শব্দ জুরকরানা (Zurkrana) থেকে আগত, যার অর্থ একই অর্থাৎ প্রসট্রেশন, প্ৰণিপাত।

ধর্মকে ‘দীন’ বলা হয়, মার্টারকে ‘শহীদ’ বলা হয়। এগুলো ছাড়া আরো কতিপয় শব্দের উৎস সিরিয়ান খ্রিস্টান শব্দাবলির মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়। বাধ্যতামূলক দানের জন্য যে কর তাকে ‘জাকাত’ বলা হয়েছে এবং মিসকিনদের ভিক্ষা দেয়াকে ‘সাদাকা’ বলা হয়েছে– এই উভয় শব্দই খ্রিস্টান ও ইহুদি প্রথা থেকে নেয়া হয়েছে।

সাধারণ সেমেটিক পটভূমিতে সিরিয়াক ও আরবি ভাষার অনেক সাধারণ মূল (common roots) ভুক্ত, যা সিরিয়ান খ্রিস্টান ও মুসলিম ধর্মীয় পরিভাষায় ব্যবহৃত। কিন্তু, আসলে ঋণ করা শব্দগুলো (borrowed words) আরবি ভাষায় ছিল না এবং ধর্মীয় ধারণা ও আনুষ্ঠানিক প্রথা যা ইহুদি ও খ্রিস্টানরা অনুসরণ করত তা মোহাম্মদের মিশনের দুই শতাব্দি পূর্বে প্রচলিত। এতে নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে ইসলাম ধর্মে ব্যবহৃত উপরোক্ত শব্দগুলো খ্রিস্টানদের প্রচলিত রীতি থেকে অপরিবর্তিত রূপে গ্রহণ করা হয়েছে।

১০.৬ রহমান

‘রহমান’ শব্দটির অর্থ দয়ালু। প্রাচীন প্যাগন স্মৃতিফলকে দক্ষিণ আরবে, স্বর্গীয় দেবতাকে নির্দেশ করে এই অভিধা ব্যবহার করা হয়েছে। ইসলাম আগমনের পূর্বে ‘রহমান’ নাম দক্ষিণ আরবের খ্রিস্টানরা ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছে। এই নামের উল্লেখ দেখা যায় প্রাথমিক খ্রিস্টান কবিদের কবিতায় এবং বলা হয় যে, খ্রিস্টান প্রফেটরা, যেমন ইয়ামামার মুসাইলিমা ও আইহালা ইবন কাব, নিজেদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন।

রহমান শব্দের সাথে সম্পৃক্ত ‘রহিম’ শব্দটির একই উৎস। ‘রহিম’ শব্দের অর্থ করুণাময় (Compassionate)। ‘রহিম’ শব্দ স্ত্রীলিঙ্গে ব্যবহৃত, এর অর্থ লালন করা ও রক্ষা করা এবং বিশেষ্যরূপে এর অর্থ জঠর, জরায়ু – ‘womb’ (Ruthven, 1984, P. 115) খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দি থেকে সিরিয়া মরুভূমির আরবগণ ‘রহিম’ শব্দ দিয়ে ঈশ্বরের আহ্বান জানাত।

‘রহমান’ ও ‘রহিম’ উভয় অভিধা নাবাতিয়ানদের কাছে সুপরিচিত এবং উভয় শব্দ বিখ্যাত মুসলিম ফরমুলা ‘তাসমিয়া’তে উল্লেখিত। তায়েফের ওমাইয়া তাসমিয়ার শিক্ষা দেন এবং প্রফেট মোহাম্মদ তা গ্রহণ করেন।

স্বর্গীয় গুণাবলির মধ্যে প্রফেট মোহাম্মদ সর্বপ্রথম স্বীকৃতি দিয়েছেন দয়া ও করুণার ওপর। মুসলিমরা আল্লাহর যে মহান নিরানব্বইটি নাম দিয়েছে তার মধ্যে রহমান ও রহিম বিশেষভাবে সম্মানিত। প্রফেট মোহাম্মদ দয়াকে খ্রিস্টানদের চারিত্রিক সদগুণ মনে করেন। কোরান বলেছে যে, আল্লাহ যিশুকে পাঠিয়েছেন মানবজাতির দয়ার চিহ্নরূপে (১৯ : ২১) এবং তাদের অন্তঃকরণে দয়া আরোপ করেছেন যারা যিশুকে অনুসরণ করে (৫৭ : ২৭)।

‘আল্লাহ’-র সাথে প্যাগন আরবদের পূর্ব পরিচিতি সম্বন্ধে মোহাম্মদ সচেতন ছিলেন এবং মক্কাতে থাকার সময় তিনি আল্লাহ’র সাথে রহমান’ শব্দটি প্রচলিত করার জন্য বারবার প্রচেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হন। তিনি চেয়েছিলেন উভয় শব্দকে ঈশ্বরের অভিধারূপে ব্যবহার করতে (২০ : ৪)। ‘রহমান’ আল্লাহ্ গুণবাচক বিশেষণ যা কোরানে ঘন ঘন ব্যবহৃত হয়েছে ‘আল্লাহ’ নামের পরিবর্তে স্থায়ী (Substantive) নাম হিসাবে। স্বর্গীয় সিংহাসনে ‘রহমান’ রাজকীয়ভাবে সমাসীন এবং ‘রহমান’-এর সম্মুখেই আমাদের প্রণিপাত অপরিহার্য। কোরানে সূরা ৫৫-এর টাইটেল’ এবং প্রথম দিকের সূরার মধ্যে একটি।

মক্কার অধিবাসীদের কাছে ‘রহমান’ নাম অপরিচিত ছিল, কেননা কাবাঘরে বা অন্য কোথাও ‘রহমান’ নামে কোনো দেবতার মূর্তি ছিল না, তাই প্রথমে এ নাম তারা পছন্দ করেনি। (২৫ : ৬১)। এই কারণে হোদায়বিয়ার সন্ধির খসড়া প্রস্তুত করার সময় মক্কীরা এ নাম মুছে দেয়ার দাবি জানায়।

কোরানের একটি সূরাতে বলা হয়, ‘আল্লাহ নামে ডাক আর রহমান নামেই ডাক, যে নামেই আহ্বান করো না কেন, তার নাম অতি সুন্দর নাম’ (১৭ : ১১০)। পরে আল্লাহ এবং রহমান দু’টি আলাদা ঈশ্বর হাতে পারে এই সন্দেহে প্রফেট মোহাম্মদ ‘রহমান’ নাম ব্যবহার পরিহার করেছিলেন।

১০.৭ গসপেল

কোরানে একবচনে ‘গসপেল’ বলা হয়েছে, গসপেলকে ‘ইঞ্জিল’ বলা হয়। এই ইঞ্জিল শব্দ আসছে গ্রিক শব্দ ইভানজেল থেকে যার অর্থ সুসমাচার, good news।

কোরানে গসপেলকে স্বর্গীয় কিতাব বলে গণ্য করা হয় যা ঈসা নবীকে দেয়া হয়েছিল (৫৭ : ২৭)। গসপেল শব্দ কোরানে বারো বার উল্লেখ করা হয়েছে কিন্তু এর উল্লেখ অন্য ভাবেও করা হয়েছে। গসপেলকে হাদিসের সমতুল্য বলা হয়- অর্থাৎ বুশরা, সুসমাচার। কোরান অনুযায়ী গসপেল আল্লাহ দ্বারা অনুপ্রাণিত (inspired) এবং যারা একে গ্রহণ করে তাদের আহলে কিতাব people of the book বলা হয়। কোরান গসপেলকে কনফার্ম করে মানবজাতির পথপ্রদর্শকরূপে— as a guide of mankind (৩ : ২)। গসপেলে সত্য ধারণ করা হয়েছে (৯ : ১১২) এবং আলো ও নির্দেশ প্রদানকারী কিতাব (৫ : ৫০)। যদি লোকেরা গসপেলের নীতি অনুসরণ করে তারা ওপর ও নিচ থেকে প্রাচুর্য্যপ্রাপ্ত হবে (৫ : ৭০) অর্থাৎ স্বর্গমর্ত থেকে প্রভূত সম্পদ লাভ করবে।

প্রফেট মোহাম্মদ কোনো সময়ে গসপেলের প্রামাণ্যতা ও সত্যতা সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ প্রকাশ করেননি, এও কখনো বলেননি যে, খ্রিস্টান গসপেল বাতিল হয়ে গেছে। তিনি কখনো গসপেলের বাণীকে বিকৃত মনে করেননি, শুধু বলেছেন ভুল ব্যাখ্যা করেছে অথবা ভুলে গেছে (৫ : ১৭)। সংশোধন (তাবদিল) বা বিকৃত (তাহরিফ) যে চার্জ করা হয়েছে খ্রিস্টান কিতাবের বাক্য বা অর্থের, সেটা করেছেন মুসলিম ধর্মীয় মোল্লারা।

১০.৮ ত্রিত্ববাদ

ঈশ্বরের একত্বে বিশ্বাস রাখার জন্য ইসলামে ত্রিত্ববাদের ধারণাকে অস্বীকার করা হয়। কোরান বলে : ‘তারা নিশ্চয়ই বিধর্মী যারা বলে ঈশ্বর তিনের মধ্যে তৃতীয়’ (৫ : ৭৭) মোহাম্মদ মনে হয় খ্রিস্টানদের ত্রিত্ববাদকে তিন দেবতায় বিশ্বাস (Tritheisn)-এর সাথে গুলিয়ে ফেলেছেন। ‘এক আল্লাহতে বিশ্বাস করো এবং বলো না তিনজন ঈশ্বর আছেন’ (৪ : ১৬৯)।

আবার মোহাম্মদ ভুলবশত বুঝেছেন যে ত্রিত্ববাদ ঈশ্বর, মেরি ও যিশুকে নিয়ে গঠিত। শেষ দিবসে আল্লাহ যিশুকে জিজ্ঞাসা করবেন তিনি লোকদের বলেছেন কিনা- ‘আল্লাহ ছাড়া, আমাকে ও আমার মাতাকে আরো দুটি আল্লাহ বলে গ্রহণ করো’ এবং যিশু জবাবে বলবেন, ‘সব প্রশংসা তোমার। যা বলার অধিকার আমার নেই তা বলা আমার পক্ষে শোভন নয়। যদি আমি তা বলতাম তবে তুমি তা জানতে পারতে; আমার অন্তরের কথা তো তুমি অবগত আছ’ (৫ : ১১৬)।

ঈশ্বর, যিশু ও মেরি সমন্বয়ে ত্রিত্ববাদকে ইসলাম অস্বীকার করেছে বটে, কিন্তু এই আল্লাহর তিন অংশের ধারণাকে মুসলিম বিশ্বাসে ভ্রমক্রমে দাগ কেটে গেছে।

খ্রিস্টানদের ‘নোমাইন ফর্মুলা’-তে বলা হয় “পিতার নামে, পুত্রের নামে এবং পবিত্র আত্মার নামে। এই সূত্রের প্রতিফলন দেখা যায় বিখ্যাত ইসলামী ফর্মুলা ‘তাসমিয়া’-তে, যেখানে পড়া হয়— ‘আল্লাহর নামে (বিসমিল্লাহ) আর রহমান (দয়াময়) ও রহিম (দয়ালু)-এর নামে। আল্লাহ হচ্ছে গড, ঈশ্বর, রহমান দয়াময়, পুত্র এবং রহিম, তার নারীসত্তাকে ধরে ‘পবিত্র আত্মাকে’ বা মুসলিমদের অস্বচ্ছ ধারণাতে মেরি (মরিয়ম)। সত্যি হিজরির তৃতীয় শতাব্দি থেকে খ্রিস্টানরা মুসলিম ও খ্রিস্টান ফর্মুলার কোনো পার্থক্য না দেখে, তারা প্রায়ই খ্রিস্টান ফর্মুলা পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্মার পরিবর্তে বিসমিল্লাহ ফর্মুলা ব্যবহার করত (Abbott 1939 P. 21)।

১০.৯ পবিত্র আত্মা

কোরান বলে যে পবিত্র আত্মা (রহুল কুদ্দুস) সম্বন্ধে অতি অল্প সমাচার মোহাম্মদের কাছে পাঠানো হয়েছিল (১৭ : ৮৭)। পবিত্র আত্মা, যা ঈশ্বর থেকে আগত, যিশুকে দৃঢ় করেছে (২ : ৮১) এবং কোরানকে অনুপ্রাণিত (Inspired) করেছে (১৬ : ১০৪)। মোহাম্মদ মনে করেছিলেন খ্রিস্টান থিওরি, ত্রিত্ববাদে মেরিকে চিহ্নিত করে, এ ধারণা তখনকার অসমর্থিত ট্র্যাডিশন থেকে তিনি পেয়ে থাকবেন।

খ্রিস্টান প্রতীকীতে ঘুঘু পাখি পবিত্র আত্মা, প্যাগনদের সময়ে মহান দেবীর পাখি বলে বিশ্বাস করা হতো। ‘আত্মা’ শব্দকে হিব্রুতে ‘রুয়াহ’ (ruah) স্ত্রীলিঙ্গ এবং পবিত্র আত্মাকে অনেক সময় ‘সেকিনা’-র সাথে তুলনা করা হতো, অজ্ঞেয়বাদীদের সোফিয়ার মতো (Walker 1989, P. 41)। সোফিয়াকে ঈশ্বরত্বের স্ত্রী অংশ বলে বিবেচনা করা হতো। হিব্রুদের অসমর্থিত গসপেলে যিশু বলেন- ‘আমার মাতা পবিত্ৰ আত্মা।

১০.১০ মেরি

কুমারী মেরি (মরিয়ম)-কে প্রফেট মোহাম্মদ একজন পরিপূর্ণ (Perfect) রমণী বলে শ্রদ্ধা করতেন এবং মুসলিম সাধু ও রহস্যবাদীরা সেইভাবে মেরিকে শ্রদ্ধা করেছেন। একজন মরোক্কান মুসলিম আবদেল জলিল, যিনি পরে ফ্র্যান্সিসকান যাজক হয়েছিলেন তিনি কোরানে প্রদত্ত মেরির বিশেষ মর্যাদা সম্বন্ধে বিস্তৃত বর্ণনা দেন (১৯৫০)।

মোহাম্মদ মেরির পবিত্র গর্ভধারণ সম্বন্ধে বিশ্বাস করতেন তার অর্থ তিনি পাপ ছাড়াই গর্ভধারণ করেন (Gibb 1969, P. 31) এবং তিনি যে, পাপমুক্ত ছিলেন তা-ও বিশ্বাস করতেন (৩ : ৩৭)। হাদিসে মোহাম্মদ বলেছেন যে প্রত্যক নবজন্ম পাওয়া শিশুকে শয়তান স্পর্শ করেছে, শুধু মেরি ও তার পুত্র ছাড়া (৩ : ৩১)। বিশ্বের নারীদের মধ্যে তিনি নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ রমণী এবং ঈশ্বর দ্বারা পবিত্রকৃত (৩ : ৩৭), পবিত্রতায় রক্ষিত (৬৬ : ১২) এবং সমস্ত প্রাণীজগতের চিহ্নস্বরূপ (২১ : ৯১)।

কোরানে বলা হয়েছে দেবদূত (ফেরেশতা) এসে তাকে সুসংবাদ দিল- ‘মেরি, নিশ্চয়ই ঈশ্বর তাঁর কাছ থেকে সুসংবাদ পাঠিয়েছেন, তোমার অন্তরে যে আছে, তার নাম হবে মেসিয়া যিশু।’ (৩ : ৪০)। ঈশ্বর তার জঠরে আত্মা ফুঁকে দিলেন, সুতরাং যিশুর জন্ম ঈশ্বরের সৃষ্টিকর্ম একজন নিষ্কলুষ কুমারী উদরে (১৯ : ২০), যে তার কুমারিত্ব বজায় রেখেছিল এবং পবিত্রতার সাথে স্বর্গীয় আত্মা ধারণ করেছে।

১০.১১ যিশু

প্রফেট মোহাম্মদ একবার বলেছিলেন যে, তার মতো যিশুকে (ঈসা) কেউ ভালবাসতে পারে না (Esin 1963, P. 109)। কোরানে অন্য কোনো প্রফেটকে যিশুর মতো উচ্চ মর্যাদায় ভূষিত করা হয়নি, মানুষ হিসাবে একমাত্র তিনিই স্বর্গীয় সান্নিধ্যের কাছাকাছি অবস্থান করেন।

যিশু স্বর্গীয় শক্তির এক দৃষ্টান্ত। তার কোনো পিতা নেই, কুমারী মেরির গর্ভে ঈশ্বরের আত্মা প্রবিষ্ট হয়ে ভ্রূণের সঞ্চার হয় (৬৬ : ১২)। পবিত্র আত্মা তাকে দৃঢ় করেছে (২ : ২৫৪), যে আত্মা ঈশ্বর প্রদত্ত (৪ : ১৬৯) এবং পাপহীন।

যিশু হচ্ছেন একজন মেসিসা (মসিহ্) (৩ : ৪০); শব্দটি সিরিয়াক, যাকে ঈশ্বর আশীর্বাদ করেছেন (১৯ : ৩২)। তিনি সত্যের বাক্য (কাউল আল-হক) (১৯ : ৩৫); আল্লাহর বাণী (কলিমুল্লাহ) ৩ : ৪০ লোগোস-তত্ত্বের প্রতিবিম্ব এবং ঈশ্বর থেকে আগত আত্মা (রুহুল্লাহ) ৪ : ১৬৯।

যিশু আল্লাহর সংবাদবাহক (রসূলুল্লাহ) ৪ : ১৬৯; আল্লাহর নৈকট্য লাভ করেছেন এবং ইহলোক ও পরলোকে মহিমান্বিত (৩ : ৪০); তিনি মানুষের কাছে চিহ্ন রূপে (আয়া, ‘অলৌকিক’) নিয়োগপ্রাপ্ত এবং আল্লাহর দয়াপ্রাপ্ত (১৯ : ২১)। মৃত্যুর পূর্বে, কোরান বলে, আহলে কিতাবের সমস্ত মানুষ (ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলিম) তাহাতে বিশ্বাস স্থাপন করবে (৪ : ১৫৭)।

১০.১২ ঈশ্বরের পুত্র

বহুঈশ্বরবাদের ঘোর বিরোধী এবং ইহুদিদের নৈতিক সমর্থন পেয়ে, প্রফেট মোহাম্মদ যিশুর ত্রিত্ববাদ অংশে ও অবতারবাদে অস্বীকার করেন। যিশু ঈশ্বরের পুত্র নন, কারণ ঈশ্বর জন্মদাতা নন। (১১২ : ৩)। ঈশ্বর এক এবং তাঁর কোনো অংশীদার নেই। “ঈশ্বরের পুত্র থাকবে, তাঁর জন্য এটা সমীচীন নয় (১৯ : ৩৬)। ঈশ্বরের পুত্র থাকা তাঁর গৌরবের পরিপন্থী (৪ : ১৬৯)।

ইবন ইসহাক এক ঘটনায় বলেছেন যে, মোহাম্মদ দুই জন খ্রিস্টান সাধুকে বকাবকি করেন এই কারণে যে, তারা ঈশ্বরের পুত্র তত্ত্বে বিশ্বাস করে। যেহেতু কোরানেই বলা হয়েছে যে, যিশু একজন নিষ্কলুষ কুমারীর সন্তান; তারা তখন জিজ্ঞাসা করে তাহলে যিশুর পিতা কে হে মোহাম্মদ?’ প্রফেট, কথিত আছে, এই প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়ে নিশ্চুপ থাকেন (Guillaume, 1955, P. 272)। ঈশ্বর কতকগুলো আয়াত পাঠিয়েছিলেন যা এখন একটি লম্বা সূরার অংশ, কিন্তু এগুলো যে স্বর্গ থেকে আগত সে সমস্যার কোনো আলোকপাত করা হয়নি, কেবলমাত্র বলা হয়েছে, ঈশ্বর ইচ্ছা করলেই যা কিছু তৈরি করতে পারেন। যখন তিনি কোনো কিছু সৃষ্টি করার ইচ্ছা করেন, শুধু বলেন ‘হও’ (কুন) আরও ওমনিই হয়ে যায় (৩ : ৪২)। এসব জিনিস, যেমন কোরানে অন্য স্থানে বলা হয়েছে, ‘ঈশ্বরের জন্য খুবই সহজ’ (১৯ : ২১)।

যিশুকে ঈশ্বরের পুত্ররূপে বিশ্বাস করতে মোহাম্মদের আপত্তি এই কারণে যে, এই বিশ্বাস আরবে আবার বহুঈশ্বরবাদের দ্বার খুলে দিতে পারে। এই ব্যাপারে তিনি একবার অসুবিধায় পড়েছিলেন, যখন তিনি মক্কাতে প্যাগনদের সাথে একটা সমঝোতা করার জন্য আল্লাহর তিন কন্যার (আল-লাত, মানাত ও উজ্জা) একটা সিদ্ধান্ত নিতে চেষ্টা করেন।

কয়েকজন পণ্ডিতের মতে, কতকগুলি বিতর্কমূলক (Polemical) আয়াত কোরানে সন্নিবেশ করা হয়েছিল; খ্রিস্টানগণ তার দাবি অস্বীকার করলে তাদের সাথে প্রফেটের বিরোধ বাড়তে শুরু করে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায় সূরা ১৯-এর কতগুলো আয়াত।

কোরান আল্লাহর কাছ থেকে অভিসম্পাত এনেছে তাদের ওপর যারা যিশুকে ঈশ্বরপুত্র বলে (৯ : ৩০)। আর একটি প্যাসেজে আছে ‘যারা বলে যে দয়ালু ঈশ্বর একটি পুত্রের জন্ম দিয়েছেন এক বীভৎস নীতি (ডকট্রিন) প্রচার করতে, যাতে আকাশমণ্ডলী বিদীর্ণ হবে, পৃথিবী খণ্ড-বিখণ্ড হবে ও পর্বতমণ্ডলী চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে আপতিত হবে’ (১৯ : ৯১)।

অন্য দিকে মোহাম্মদকে দ্ব্যর্থহীনভাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল- “বলো, যদি দয়াময় ঈশ্বরের এক পুত্র থাকে, আমিই প্রথম তাকে পূজা করব (৪৩ : ৮১); এতে মনে হয় যে, আয়াতে যে কথা বলে দেয়া হয়েছে, তাতে ঐ ধারণা অচিন্ত্যনীয় ছিল না।

১০.১৩ যিশুর অলৌকিক কাণ্ড (মোজেজা)

কোরানে যিশুর এমন কতকগুলো মোজেজার কথা বলা হয়েছে যা গসপেলে ধারণ করা হয়নি। তিনি শিশু অবস্থা দোলনার কথা বলেছেন (৩ : ৪১)। শিশু অবস্থায় তিনি তার মায়ের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ খণ্ডন করেন (১৯ : ২৮-৩১)। তিনি কাদা দিয়ে পাখি তৈরি করেন এবং তাতে জীবন দেন। (৩ : ৪৩)। গসপেলের কিছু মোজেজার কথাও আছে কোরানে। যেমন, তিনি অন্ধকে দৃষ্টি দান করেন, কুষ্ঠ ব্যাধিগ্রস্ত লোকদের নিরাময় করেন এবং মৃত ব্যক্তিকে জীবন্ত করেন (৫ : ১১০)।

যিশু আরও একটি মোজেজা দেখান যখন তার শিষ্যদের খাওয়ানোর জন্য খাঞ্জাভরা খাদ্যদ্রব্য স্বর্গ থেকে আনয়ন করেন। ঈশ্বর সেই খাদ্যদ্রব্য পাঠিয়ে শিষ্যদের পুষ্ট করেন, কারণ তিনি মহান জীবিকাদাতা’ (৫ : ১১২-১১৫) সূরা ‘মায়দা-তে এই প্যাসেজ আছে’। ‘মায়দা’ অর্থ ‘খান্না’ (খাঞ্জা)—এই মায়দা’ শব্দটি আবিসিনিয়ান খ্রিস্টানরা ‘ঈশ্বরের খাঞ্জা’ টেকনিক্যাল টার্ম অর্থে ব্যবহার করেছে (Parrinder 1979, P. 88)। এই প্যাসেজটি স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে বিজন প্রদেশে (wilderness) ইসরাইল সন্তানদের কাছে ঈশ্বর প্রেরিত মান্না’ পাঠানোর ঘটনাকে (যাত্রাপুস্তক ১৬ : ১৫) ও প্রভুর রাতের খাবার (Lord’s Supper) মথি, ২৬ : ২০। এই খাদ্য দিয়ে যিশু বহু মানুষকে খাইয়েছিলেন (মথি ১৪ : ২০) এবং সাধু পিটারের ভার্সান যেখানে বলা হয়েছে স্বর্গ থেকে নেমে এলো বৃহৎ খাঞ্জা ভর্তি খাদ্যদ্রব্য (Acts, 10 : 11)।

১০.১৪ মৃত্যু ও পুনরুত্থান

মসিহ যিশু যে ক্রুশে মৃত্যুবরণ করেন কোরান তা অস্বীকার করে। যিশুকে ক্রুসিফাই করা হয়নি, কিন্তু তার আদলে অন্য একজন হীন ব্যক্তিকে ধরে ক্রুসে চড়ানো হয়। এই ক্রুসিফিকেশনের সময় ঈশ্বর তাকে (যিশু) আকাশে তুলে নেন (৪ : ১৫৬)। একটি মুসলিম ট্র্যাডিশনে বলা হয়েছে, যিশুর স্থলে যাকে ক্রুশে চড়ানো হয় তার নাম জুদাস।

আলা ওয়াকিদির মতে মোহাম্মদ ক্রুশকে (সালিব) ঘৃণা করতেন এবং ক্রুশের মতো দেখতে তার ঘরের সব বস্তুকে ভেঙে দেন। আবু হোরায়রার বর্ণনায় : মোহাম্মদ বলেছেন যখন যিশু স্বর্গ থেকে নেমে আসবেন, তিনি সব ক্রুশ ভেঙে ফেলবেন ও শূকর নিধন করবেন।

যদিও কোরান ক্রুসিফিকেশন অস্বীকার করে কিন্তু যিশুর মৃত্যুর পুনরুত্থান ও স্বর্গারোহণ গ্রহণ করেছে। শিশুকালে দোলনায় থাকা অবস্থায় যিশু বলেছেন ‘আমি যেদিন জন্মগ্রহণ করি, ঈশ্বরের শান্তি আমার ওপর বর্ষিত হয়েছে এবং যেদিন মরব সেদিনও হবে, আবার যখন পুনর্জীবন লাভ করব তখনও হবে’ (১৯ : ৩৪)।

কোরানে ঈশ্বর যিশুকে বলেন- ‘নিশ্চয়ই আমি তোমার মৃত্যু ঘটাব এবং আমার সম্মুখে জীবিত করব (৩ : ৪৮), যদিও যিশুর মৃত্যুর সঠিক সময় ও স্থান এবং সমাধি সম্বন্ধে কিছু বলা হয়নি। কোরানের অন্যস্থানে বলা হয়েছে- ঈশ্বর যিশু ও মেরির জন্য একটি নির্জন মনোরম স্থানে ও ঝর্ণাধারার কাছে বাসস্থান তৈরি করেছেন (২৩ : ৫২)। মুসলিম ধর্মবিদরা এই সব আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন যে, যিশু ও মেরি উভয়কেই ঈশ্বর শারীরিকভাবে স্বর্গে তুলে নিয়েছেন।

১০.১৫ প্যারাক্লিট

সুসমাচার অনুযায়ী, যিশু তার শিষ্যদের বলেছেন যে, তার মৃত্যুর পর ঈশ্বর তোমাদের কাছে চিরকাল থাকবার জন্য আর একজন সাহায্যকারী পাঠাবেন (জন. ১৪ : ১৬)। ‘সাহায্যকারী’ (comforter) কে গ্রিক ভাষায় প্যারাক্লিটস (Parakletos), সম্ভবত পেরিক্লিস (Periklytos) শব্দ থেকে আগত, যার অর্থ ‘বিখ্যাত’ (Renowned)। এই শব্দটিকে আরবিতে ‘আহমদ’ বলা হয়েছে- অর্থাৎ প্রশংসিত।

যেহেতু ‘আহমদ’ ও মোহাম্মদ’ নাম একই মূল (roots) থেকে উদ্ভূত, মোহাম্মদ দাবি করেন তিনিই প্যারাক্লিট। উপরোক্ত গসপেলের প্যাসেজকে কোরানে এই ভাবে রূপান্তরিত করা হয়েছে : “স্মরণ করো, যখন যিশু বলেছেন- নিশ্চয়ই আমি ঈশ্বরের সংবাদবাহক, তোমাদেরকে এই প্রফেট সম্পর্কে সুসংবাদ দিচ্ছি যে, তিনি আসবেন আমার পরে যার নাম হবে আহম্মদ” (৬১ : ৬)।

উল্লেখযোগ্য যে মানি অথবা মানেস (মৃত. ২৭৬ খ্রিঃ) পারস্যবাসী ছিলেন। তিনি এক প্রভাবশালী সেমি-খ্রিস্টান গোষ্ঠী (Sect) প্রতিষ্ঠা করেন যা মোহাম্মদের জন্মের পূর্বে আরবে সক্রিয় ছিল। তিনিও ঘোষণা করেন যে, তিনিই প্রফেটদের মধ্যে শেষ ও শ্রেষ্ঠ এবং প্যারাক্লিট। তার নামের ওপর ভিত্তি করে তিনি দাবি করেন যে তিনি মানবজাতিকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য এসেছেন (হিব্রু ম্যানস) (সংগীতাবলী : ৫৯ : ১৬) এবং জেসাস যেমন জীবনের রুটি (জন. ৩ – ৩৫) তেমনি মানি; সেই প্রতিশ্রুত প্রফেট যিনি স্বর্গ থেকে মানবজাতির জন্য খাপ্পাভরে খাদ্যদ্রব্য (মান্না) এনেছেন লোকজনকে পুষ্ট করতে।

খ্রিস্টানরা মোহাম্মদের প্যারাক্লিটের দাবি বাতিল করেছে এই বলে যে, বাইবেলের ভাষ্যকে বিকৃত করা হয়েছে। বাইবেলের ঐ চ্যাপ্টারে, (জন. ১৪ : ২৬) যিশু স্পষ্ট করে বলেছেন যে সাহায্যকারী (Comporter) হচ্ছেন পবিত্র আত্মা। মোহাম্মদ কখনও পবিত্র আত্মা বলে নিজেকে দাবি করেননি, সুতরাং তিনি প্যারাক্লিট হতে পারেন না। আবার কোরানে যিশুকে মেসিয়া বলা হয়েছে (৪ : ১৬৯) এবং কোনো প্রফেট মেসিয়াকে অনুসরণ করতে পারে না। সর্বশেষে খ্রিস্টানদের মতে, কম্ফর্টার (সাহায্যকারী) যিশুর ঊর্ধ্বগমনের দশদিন পরে পেন্টিকোস্ট দিবসে (ইহুদিদের পর্ব দিন) নেমে আসবেন; তারা বিশ্বাস করেন না যে প্যারাক্লিট যিশুর ঊর্ধ্বগমনের পর ছয় শতাব্দি অপেক্ষা করে মোহাম্মদের রূপে বা আকারে আবির্ভূত হবেন।

মোহাম্মদের পক্ষে সংশ্লিষ্ট প্যারাক্লিটের দাবিতে এবং তার আবির্ভাবের ভবিষ্যৎ বাণী বার্নাবাসের গসপেলে দেখা যায়। বার্নাবাসের গসপেল একটি অসমর্থিত গ্ৰন্থ (apocryphal work) যা মোহাম্মদের মৃত্যুর শতাব্দির পর একজন ইহুদি বা খ্রিস্টান ধর্মান্তরিত মুসলিম দ্বারা লিখিত। তার সুডো- গসপেলে (মিথ্যা-সুসমাচার), বলা হয়েছে যে জুদাসকে যিশুর বদলে ক্রুসিফাই করা হয়, যা মুসলিমরা বিশ্বাস করে। উক্ত পুস্তকে, যিশু অস্বীকার করেন এই বলে যে তিনি মেসিয়া নন, যেখানে কোরান একাধিকবার এ কথার স্বীকৃতি দিচ্ছে। পরিবর্তে, এই পুস্তকে মোহাম্মদকে মেসিয়া বলা হয়েছে- যে অভিধা মোহাম্মদ নিজে কোনো দিনই দাবি করেননি।

কট্টরবাদী মুসলিম পণ্ডিতরা ওল্ড ও নিউ টেস্টামেন্টের যে কোনো আয়াতকে দ্রুতভাবে পাশ কাটিয়ে গেছে যা মোহাম্মদকে পরোক্ষ ইঙ্গিত করেছে (allude)। Deut. 18 : 18তে যেমন আছে, সেই সূত্র ধরে আরাবিয়ান প্রফেটের দাবি উঠানো হয়েছে। যেখানে বিষয় উপযুক্ত মনে হয়েছে, হিব্রু শব্দ মাহম্মাদ’ (mahmad)-এর অর্থ ‘ভালো’, ‘প্রিয়’ বা ‘মনোহর’, যে শব্দ ডজনের বেশি ওল্ড টেস্টামেন্টে উল্লিখিত হয়েছে, যেমন সলেমনের পরমগীত ৫ : ১৬, সেখানেই মোহাম্মদের নাম টেনে আনা হয়েছে।

একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, যুক্তিবাদী মুসলিম অথরিটি এই সমস্ত দাবি গ্রাহ্য করেন না, এমনকি বার্নাবাসের গসপেলের ভাষ্য গ্রহণযোগ্য নয়, কেননা মোহাম্মদের সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয় অসমর্থিত তথ্যের ওপর নির্ভর করে না।

১০.১৬ দ্বিতীয় আগমন

মুসলিমদের চিন্তাধারা যিশুর আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, যা ইসলামী ট্র্যাডিশনে বলে যে, রোজ কেয়ামতের কিছু পূর্বে যিশুর পুনরাগমন হবে। এই বিষয়ে মোহাম্মদের কিছু ধারণা স্পষ্টত খ্রিস্টান উৎস থেকে আহরিত।

গোল্ড জিহার (Goldziher) লিখেছেন যে, মোহাদ্দেস ইবন হাজার, ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে প্রাচীন অথরিটি তামিম আল দারি শেষ বিচারের দিন সম্বন্ধে মুসলিমদের যে ধারণা দিয়েছিলেন তার সাথে একমত প্রকাশ করেছেন। তামিম আল-দারি খ্রিস্টান সাধুব্যক্তি ছিলেন এবং মোহাম্মদের সমসাময়িক। ইনি পরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে মোহাম্মদের সাহাবীর মর্যাদা লাভ করেন।

কোরান বলছে- যিশু শেষ দিনের প্রতীক (৪৩ : ৬১); হাদিসে লিখিত আছে যে, মোহাম্মদ একদা রূপক অর্থে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘যে মানব জাতির আমি শুরু এবং যিশু শেষ, সে জাতি কেমন করে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে’ (Me Auliffe 1991, P. 132)। খাবিতিয়া সম্প্রদায়ের (Sect) মতে, (আহমদ ইবন খাবিতের অনুসারী), যিশুর দ্বিতীয় আগমন কোরানের আয়াতেও বলা হয়েছে- ‘এবং যখন তোমার প্রতিপালক উপস্থিত হইবেন ও সারিবদ্ধভাবে ফেরেশতাগণও –’ (৮৯ : ২৩)। যিশুই সেই ব্যক্তি যিনি মানবজাতিকে ডাক দিবেন তার পরবর্তী জীবনে হিসাবের জন্য (Kazi and Flynn, 1984, P. 53)।

দ্বিতীয় আগমনের প্রতি বিশ্বাস ‘মেহেদির’ ধারণা এনে দিয়েছে। মেহেদি এক শক্তিশালী ব্যক্তিরূপে আবির্ভূত হয়ে শেষ দিবসে মানবজাতিকে নেতৃত্ব দিবেন এবং একটি শান্তির রাজ্য প্রতিষ্ঠা করবেন। কেউ কেউ বিশ্বাস করেন যে, মেহেদি মোহাম্মদের বংশধর থেকে আসবে, কিন্তু বেশিরভাগ ট্র্যাডিশন অনুযায়ী তা নয়। অনেকেই মেহেদি পদবির দাবি করতে পারেন, কিন্তু তারা সকলেই প্রতারক, কারণ একথা মোহাম্মদ ঘোষণা করেছেন। ‘মরিয়মের পুত্র যিশু ছাড়া অন্য কোনো মেহেদি নেই’ (D, B, Mac Donald, in SEI, 1974, P. 174)।

মুসলিম ট্র্যাডিশনে এই ধারণাও আছে যে, যিশুর দ্বিতীয় আগমনের পূর্বে একজন যিশু-বিরোধী (Autichrist) শক্তির আগমন হবে দাজ্জাল বলে। দাজ্জাল শব্দটি আরামেনিয়ান। এই দাজ্জালের সাথে যিশুর ভীষণ যুদ্ধ হবে এবং শেষে যিশু জয়লাভ করবেন।

এই বিজয়ের পরে ইসলাম যিশুর হাতে চলে যাবে এবং তিনি পৃথিবীতে ৪০ বছর শান্তিতে রাজত্ব করবেন। তারপর যিশুর স্বাভাবিক মৃত্যু হবে এবং মদিনায় তাকে কবরস্থ করা হবে, যেখানে মোহাম্মদ ও আবু বকরের কবরের মাঝখানে তার স্থান সংরক্ষিত থাকবে।

তারপর অনির্দিষ্টকাল বিশ্রামের পর এক ফেরেস্তা তিনবার ড্রামের ওপর আয়াত করবে আর মানবজাতির শেষ দিন ঘোষিত হবে।

১০.১৭ অসমর্থিত গসপেল

কুমারী মেরি ও যিশুর জন্ম, জীবন ও মৃত্যু সম্বন্ধে মোহাম্মদের মতামত এই ধারণা দেয় যে, তার সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে যেসব অসমর্থিত গসপেল এবং জনপ্রিয় খ্রিস্টান ট্র্যাডিশন বিক্ষিপ্তভাবে চালু ছিল, তাদের সাথে মোহাম্মদের পরিচয় ছিল। এই সব কাহিনীর কিছু কিছু সত্য বলে গ্রহণ করেছেন তিনি, কেননা সেই সব কাহিনী কোরানে বিধৃত হয়েছে তার ধর্মমতের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়ে।

ঈশ্বর, মেরি ও যিশুর ত্রিত্ববাদ যা কোরানের মতে খ্রিস্টানদের গৃহীত নীতি এই মতবাদ তখনকার কিছু মতান্তরগ্রাহী (sehismatic) সম্প্রদায় – যেমন, মরিয়ামাইট্স মান্য করত। আরবে কালরিডিয়ান (Collyridians) নামে একটি সম্প্রদায় ছিল তারা ধর্মীয় অনুষ্ঠান রূপে মেরিকে কেক (cake) নৈবেদ্যরূপে প্রদান করত (Kollyra)।

মেরির জন্ম সম্বন্ধে কোরানে যে বিস্তৃত বর্ণনা রয়েছে (৩ : ৩১) তা দেখতে পাওয়া যায় অসমর্থিত গসপেল ‘নেটিভিটি অব মেরি’-তে। জেরুজালেমের মন্দিরে মেরি সম্বন্ধে যে কাহিনী ব্যক্ত হয়েছে, যেখানে ফেরেশতারা তার জন্য খাদ্য এনে দিত (৩ : ৩২) সে কাহিনী পাওয়া যায় Protevangelium of James the Less এবং Coptic History of the Virgin-এ। খেজুর গাছ ও মেরির ঘটনা (১৯ : ২৩) নেয়া হয়েছে History of Nativity of Mary এবং The Infancy of the Saviour থেকে। যিশু যে কাদা দিয়ে পাখি তৈরি করে প্রাণ দিলেন (৩ : ৪৩) এ কাহিনী পাওয়া যায় Gospel of Thomas the Israelite-এ। যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়নি, হয়েছে তার মতো একজনকে (৪ : ১৫৬)-এ কাহিনীর উৎস হচ্ছে ‘Journeys of the Apostles এবং এই মত পোষণ করত ডসেটিস্ট (Docetists) অজ্ঞেয়বাদী সম্প্রদায়। ঈশ্বর এক এবং যিশু ঈশ্বর কর্তৃক নির্বাচিত ব্যক্তি এবং তার মধ্যে পর্যাপ্ত পরিমাণে পবিত্র আত্মাদ্বারা পরিপূর্ণ করা হয়েছিল – এ কাহিনী পোষণ করত সামোসোটার পল (Paul of Samosata), মৃত. ২৭২, দ্বারা পরিচালিত মনকিস্ট সম্প্রদায়। পল অব সামোসাটা এন্টিয়কের বিশপ ছিলেন।

বিভিন্ন তারিখের আরো কয়েকটি অসমর্থিত গ্রন্থ নেরেটিভস, ‘জানিস, অ্যাক্টস, ইনফ্যান্সি গসপেল ইত্যাদি অসমর্থিত গ্রন্থ (Apocrypha) সিরিয়াক, কপটিক, গ্রিস, আরাবিক ও আর্মোনিয়ান ভাষায় মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল এবং আগ্রহী পাঠকের জন্য এ সমস্ত কেচ্ছা কাহিনীর দ্বার উন্মুক্ত ছিল।

মদিনা কালে, মোহাম্মদ, সাতটি যুবক ও তাদের কুকুর, যারা একটি গুহায় অনেক বছর ধরে ঘুমিয়ে ছিল, সম্বন্ধে একটি ঐশীবাণী প্রাপ্ত হন। এই কাহিনী, ইফেসাসের সাতজন খ্রিস্টান যুবক ২৫০ খ্রিস্টাব্দে রোমান সম্রাট দেসিয়াস (Decius) – এর অত্যাচারের সময় সেলিয়ন পর্বতে দেয়ালঘেরা অবস্থায় বন্দি হয়; কিন্তু ২০০ বছর ঘুমিয়ে থেকে অলৌকিকভাবে বেঁচে যায়, কাহিনীর পরিবর্তিত রূপ। এই কাহিনী নেয়া হয়েছে সারুগের জ্যাকব নামে এক খ্রিস্টান লেখকের গ্রন্থ সিরিয়াক হোমিলিজ’ থেকে। জ্যাকব ৫২০ খ্রিঃ মারা যান। গ্রেগরি অব টুরস্ (Gregory of Tours)-এও এই কাহিনী লিপিবদ্ধ আছে এবং গিবন কর্তৃক রচিত Decline and Fall of the Roman Empire গ্রন্থেও উল্লেখ করা হয়েছে (১৭৭৬)।

১০.১৮ খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম

মদিনায় হিজরতের কিছু দিন পর খ্রিস্টানদের প্রতি মোহাম্মদের আচরণে পরিবর্তন দেখা দেয়। মক্কায় তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে তিনি তার খ্রিস্টান শিক্ষকদের নিকট থেকে কিছু ধর্মীয় নীতি (doctrine) গ্রহণ করছেন। এখন খ্রিস্টানরাই তাকে অস্বীকার করছে তাঁর শিক্ষা-নীতি ও খ্রিস্টানিটির অপব্যাখ্যার কারণে।

ইহুদিরা যেমন আব্রাহাম (পেট্রিয়ার্ক) সম্বন্ধে কোরানের কেচ্ছা কাহিনীগুলোকে অসত্য বলে মত প্রকাশ করেছিল, তেমনি খ্রিস্টানরাও যিশুর জীবনী ও তার শিক্ষা সম্বন্ধে কোরানে বর্ণিত কাহিনী সুসমাচারের বর্ণিত সত্য ঘটনার অপলাপ ও অপব্যাখ্যা বলে ঘোষণা দেয় এবং তারা মোহাম্মদকে প্রফেট বলে স্বীকৃতি দিতে কোনও ইচ্ছাও প্রকাশ করেনি।

খ্রিস্টানদের এই সমালোচনাকে সহজভাবে গ্রহণ না করে, মোহাম্মদ তাদের বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়ান। খ্রিস্টানিটি প্রতিদ্বন্দ্বী ধর্ম হয়ে দাঁড়ায়। এটাও একটা রিভিল্ড ধর্ম-শিক্ষা ও সত্য এবং শেষ ডকট্রিন বলে দাবি করা হয়। এটা একটি আন্তর্জাতিক বিশ্বাস বা ধর্ম, মানব-জাতির কাছে অগ্নিক্ষরা মিশন নিয়ে আত্ম-প্রকাশ করেছে; সুতরাং খ্রিস্টানদের আর বন্ধু বলে বিবেচনা করা যায় না।

খ্রিস্টানদের সমালোচনার জবাবে মোহাম্মদ বলেন, তারাই যিশুর বাণীকে ভুল বুঝেছে, যেমন ইহুদিরা মুসার বাণীকে বিকৃত ও অপব্যাখ্যা করেছে। কোরান বলে যে, খ্রিস্টানদের যা শেখানো হয়েছিল তার অংশ বিশেষ তারা ভূলে গেছে (৫ : ১৭)। তারা তাদের প্রফেট যিশুকে ঈশ্বরের রূপ দিয়ে ত্রিত্ববাদ সৃষ্টি করেছে।

এতদিন খ্রিস্টানদের প্রতি যে সদিচ্ছা ও বন্ধুভাব দেখানো হয়েছিল তার আমূল পরিবর্তন ঘটল, যেমন তার নিজের মিশনের গতি ঘুরে গেল। এই পরিবর্তন কোরানে প্রতিফলিত হলো : ‘হে বিশ্বাসীগণ, ইহুদি ও খ্রিস্টানদের আর বন্ধু বলে গ্রহণ করো না। যদি তাদের বন্ধু বলে গ্রহণ করো, নিশ্চয়ই তুমি তাদের-ই একজন (৫ : ৫৬)। আবার, তাদের বন্ধু বলে গ্রহণ করো না, যারা তোমাদের পূর্বে কিতাব পেয়েছিল অথবা যারা তোমার ধর্মকে খেলা ও মস্করা মনে করে’ (৫ : ৬২)।

কোরান খ্রিস্টানদের বিধর্মী (infidels) বলেছে (৫ : ১৯), কারণ তারা যিশু খ্রিস্টকে ঈশ্বরপুত্র বলে পূজা করে; এই বিশ্বাসে তারা অপরাধী। ‘ঈশ্বর তাদের সাথে যুদ্ধ করুন’ (৯ : ৩০) মোহাম্মদ শুধু ইহুদি ও খ্রিস্টানদের তিরস্কার করেননি, কিন্তু তাদের জন্য স্বর্গদ্বার বন্ধ করে নরকে স্থান দিয়েছেন (৫ : ৭৬), যেখানে তারা তাদের শিষ্যগণসহ অনন্তকাল ধরে বাস করবে। (৯৮ : ৫)। তাঁর এই তীব্র বিরোধিতা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বজায় ছিল। মৃত্যুকালে তার শেষ বাণীর মধ্যে একটি বাণী ছিল ‘প্রভু ইহুদি ও খ্রিস্টানদের ধ্বংস করবেন।

যুদ্ধ করার জন্য অধিকতর শক্তিপ্রাপ্ত হয়ে মোহাম্মদ প্রকাশ্যভাবে খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে প্রস্তুতি গ্রহণ করেন- বিশেষভাবে আরবে তাদের উপস্থিতিকে কেন্দ্র করে অর্থাৎ তিনি সমগ্র আরব দেশ হতে খ্রিস্টানদের বিতাড়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন। এই নীতি পরিশেষে বাস্তবায়িত হলো তাঁর পরবর্তী উত্তরাধিকারী আবু বকর ও ওমরের দ্বারা।

১০.১৯ খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে অভিযান

মোহাম্মদের জীবদ্দশায় ও তাঁর মৃত্যুর পরে আধুনিক তফসিরকারদের পরস্পরবিরোধী ভার্সান পাওয়া যায় আরব খ্রিস্টান গোত্রদের ধর্মান্তরিত সম্বন্ধে। কোনো কোনো বিবরণে দেখা যায় যে কিছু গোত্র নতুন রিভিলেশনের সত্যতায় আকৃষ্ট হয়ে স্ব-ইচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেছে; আবার অন্য বর্ণনায় দেখা যায় নতুন ধর্মের প্রতি যথেষ্ট প্রতিরোধ হয়েছিল এবং ঘুরে দাঁড়িয়েছিল এবং অনেকেই নিশ্চিহ্ন হবার ভয়ে আত্মসমর্পণ করেছে।

৬৩০ খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি মাসে মোহাম্মদ আমর ইবন আল-আসের অধীনে এক বাহিনী প্রেরণ করেন ওমানের খ্রিস্টান গোত্রদের বিরুদ্ধে; সেখানকার শাসকদের বলা হয় নতুন ধর্ম গ্রহণ করতে এবং নির্ধারিত কর প্রদান করতে। কিছু আলোচনার পর কতকগুলো গোত্র ধর্মান্তর গ্রহণ করে; কিন্তু মাজুনা গোত্র তাদের ধর্ম পালনে ইচ্ছা প্রকাশ করে, পরিবর্তে তারা মুসলিমদের অর্ধেক জমি ও সম্পদ প্রদান করতে বাধ্য হয়। এই শর্তে সন্ধি হয়।

ঐ মাসেই, ফ্রেব্রুয়ারি ৬৩০, আরবের দক্ষিণে হিমিয়ার খ্রিস্টান রাজকুমারদের কাছে একটি ডেলিগেশন পাঠানো হয়। ডেলিগেশনের হাতে মোহাম্মদ এক পত্র দেন মুসা ও ঈসার প্রতি তাঁর বিশ্বাস কনফার্ম করে, কিন্তু যিশুর অবতারবাদ ও ত্রিত্ববাদকে অস্বীকার করে। উক্ত পত্রে বলা হয় যে, ঈশ্বর এক এবং মোহাম্মদ তাঁর প্রফেট এবং সকলকে বলা হয় এই নতুন মন্ত্র ও বিশ্বাসকে গ্রহণ করতে। যারা হিমিয়ার ভাষা ব্যবহার করে, তাদের এখন থেকে আরবি ভাষা ব্যবহার করতে হবে। তাদের ইসলামে আত্মসমর্পণ করে নির্ধারিত কর প্রদান করতে হবে। যারা এই নির্দেশ অমান্য করবে তারা মোহাম্মদের শত্রু বলে গণ্য হবে। অগত্যা, জীবনের বিনিময়ে রাজকুমারগণ নতুন ধর্ম গ্রহণ করে পত্রের জবাব দেয়।

হেজাজের আশপাশে যেসব খ্রিস্টান বাস করত তাদের একইভাবে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয় এবং তারা প্রাণের ভয়ে তা-ই করে। ৬৩০ সালে জুলাই মাসে আলীকে পাঠানো হয় তাঈ সম্প্রদায়ের এক গোত্রের কাছে যারা তখনও ফালস্ (Fuls) দেবতার মূর্তি পূজা করত। আলী তাদের দেবতার মূর্তি ও মাজার ভেঙে গুঁড়ো করে দিল, সেখানকার লোকদের ধমক দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য করল। এরপর আলী তাঈ সম্প্রদায়ের খ্রিস্টানদের প্রতি দৃষ্টি দিল। তাঈ প্রধান আদি, বিখ্যাত হাতেম তাইয়ের পুত্র, সিরিয়ায় পালিয়ে গেলেন, কিন্তু পরে নিজ ভগিনীর আহ্বানে ফিরে এসে ইসলাম গ্রহণ করেন। আর এক তাঈ প্রধান জার ইবন সারদাস দেশত্যাগ করে প্রথমে খ্রিস্টান সিরিয়াতে যান, পরে সেখান থেকে যান কনস্ট্যান্টিনোপলে।

৬৩০ সালে অক্টোবর মাসে মোহাম্মদ বিশাল এক বাহিনী নিয়ে উত্তর-পশ্চিম দিকে অভিযান যাত্রা করেন এবং তাবুকে অবস্থান নেন। তাবুক মদিনার প্রায় ২৫০ মাইল উত্তর-পশ্চিমে। এখানে ইউহানা (জন) ইবন রুবা, আইলার (আধুনিক আকাবা) খ্রিস্টান প্রিন্স, প্রফেটকে অভ্যর্থনা জানিয়ে সন্ধি করেন এবং আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অধীনতা স্বীকার করে কর দিতে রাজি হন। মোহাম্মদ তাবুকে বিশ দিন অবস্থান করে মদিনায় ফিরে আসেন, কারণ তার বিভিন্ন গোত্র সমন্বয়ে গঠিত সেনাদলে অসন্তোষের সৃষ্টি হয়। তাবুকের অভিযান মোহাম্মদের ব্যক্তিগত সর্বশেষ অভিযান।

তাবুকে থাকাকালীন সময়ে মোহাম্মদ খালিদ ইবন ওয়ালিদকে ডুমা ওয়েসিসে প্রেরণ করেন। ডুমা তখন শাসিত হতো খ্রিস্টান আরব প্রিন্স কালব গোত্রের ওকাইদির বিন আবদুল মালিক। (ওকাইদির বড় ভাই বিশ্ব মক্কানদের লিখতে শিখিয়েছিলেন, প্রায় বিশ বছর হলো গত হয়েছেন)। সেই সময় ওকাইদির তার এক ভাইয়ের সাথে শিকারে গিয়েছিল, খালিদ ওৎ পেতে থেকে তার ভাইকে হত্যা করেন এবং ওকাইদিরকে বন্দি করে মদিনায় নিয়ে আসেন। মোহাম্মদ তার সাথে এক সন্ধিচুক্তি করেন। প্রিন্স ওকাইদির ইসলাম গ্রহণ করে ট্যাক্স দিতে রাজি হলে তার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়ে দেশে ফেরার অনুমতি দেয়া হয়। মোহাম্মদের মৃত্যুর পর ওকাইদির বিদ্রোহী হলে, খালিদ তাকে দমন ও হত্যা করে ডুমা ওয়েসিস ইসলামী রাজ্যভুক্ত করেন।

মোহাম্মদ যখন মদিনায় প্রথম পদার্পণ করেন, তখন আউস গোত্রের এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের সাথে লম্বা আলোচনা করেছিলেন। তার নাম আবু আমির এবং তিনি মদিনার কাছে বাস করতেন। তিনি আল-রাহিব (সাধু) নামেই পরিচিত ছিলেন তার সন্ন্যাস আচরণের জন্য। অনেক সময় তাকে ‘হানিফ’ বলে গণ্য করা হতো।

আবু আমির মোহাম্মদকে আব্রাহামের ধর্ম ও নীতি গ্রহণের জন্য তিরস্কার (censured) করেছিলেন এবং তাঁর ‘নবীত্ব’-কে অস্বীকার করেন। তিনি অভিযোগ করেন যে, ঐশী বাণীর দোহাই দিয়ে মোহাম্মদ একেশ্বরবাদ তত্ত্বকে বিকৃত করছেন। পরে তিনি রাজনৈতিক, সামাজিক ও নৈতিক কারণে মোহাম্মদের বিরোধিতা করেন। তিন মার্চেন্ট ক্যারাভানের ওপর মোহাম্মদের আক্রমণকে রাহাজানি বা লুণ্ঠন (brigandage) বলে আখ্যায়িত করেন এবং বিশ্বাস করেন যে মোহাম্মদ বিপজ্জনকভাবে উচ্চাকাঙ্ক্ষী।

মোহাম্মদের প্রতিহিংসা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আবু আমির মক্কাতে চলে যান, পরে পঞ্চাশ জন অনুসারী পরিবেষ্টিত হয়ে সিরিয়াতে মাইগ্রেট করেন। ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে একজন খ্রিস্টান হিসাবে সিরিয়াতে তার মৃত্যু হয়। আবু আমির সেই ব্যক্তি যিনি ঈশ্বরের বিরুদ্ধে এবং তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে গেছেন বলে কোরানে উল্লেখ করা হয়েছে (৯ : ১০৮)।

আবু আমিরের অনুসারীরা মদিনার গানিস গোত্রভুক্ত ছিল, তারা মদিনার ওয়েসিসের কাছে (কোবাতে প্রফেটের প্রথম মসজিদের নিকট) একটি ভজনালয় প্রতিষ্ঠা করে। এই ভজনালয় দুস্থ ও দরিদ্র মানুষের আশ্রয় কেন্দ্রও ছিল এবং প্রফেটের মসজিদ কোবা থেকে প্রার্থনাকারীদের আকর্ষণও করত। প্রফেট যখন তাবুক যাত্ৰা করেন তখন গানিস গোত্রের লোকজন তাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে সেই আশ্রয়কেন্দ্র পরিদর্শন ও তাদের সাথে প্রার্থনায় যোগ দিতে বলে। তিনি রাজি হন, কিন্তু তাবুক থেকে ফেরার সময় সিদ্ধান্ত নেন যে, যে মসজিদ তাঁর অনুমতি ছাড়া নির্মিত সেখানে তিনি যেতে পারেন না। তিনি ঘোষণা করেন যে আবু আমিরের সমর্থনকারী যারা ঐ ভজনালয় তৈরি করেছে, সেখানে অধর্ম শিক্ষা দেয়া হয় যা মুসলিমদের অনুভূতিতে আঘাত করে। তাছাড়া এদের নেতা আবু আমির প্রফেটের নেতৃত্ব অস্বীকার করেছিল। কোরানে এ ঘটনার উল্লেখ আছে (৯ : ১০৮)। মোহাম্মদ এই ভজনালয়কে পুড়িয়ে দিতে নির্দেশ দেন এবং তা পালিত হয়। পরে একে গোবরস্থানে (dunghill) রূপান্তরিত করা হয় (Sale, 1886, P. 152)।

মোহাম্মদের আচরণ প্রকটভাবে প্রকাশ পেল দুটি খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ওপর-একটি দক্ষিণের, অপরটি উত্তরের। ৬৩১ খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি মাসে, দক্ষিণ আরবের খ্রিস্টান হানিফা গোত্রের এক প্রতিনিধি মদিনায় মোহাম্মদের কাছে এলো। আলোচনায় কি হলো বোঝা গেল না। কিন্তু তাদের প্রস্থানের সময়, মোহাম্মদ সেই প্রতিনিধির নেতাকে একপাত্র ওজু করার পরিত্যক্ত জল দিয়ে আদেশ দেন, ‘দেশে ফিরে যাও এবং তোমাদের চার্চ ভেঙে ফেলে এই জল ছিটিয়ে তার ওপর মসজিদ তৈরি করোগে’ (Muir, 1912, P. 458)। এই আদেশ তারা মানতে বাধ্য হয়। এক মাস পরে, ৬৩১ সালে এপ্রিল মাসে খ্রিস্টান তাঘলিব গোত্রের একদল প্রতিনিধি সোনার ক্রুশ গলায় ঝুলিয়ে মোহাম্মদকে দর্শন দিতে আসে। প্রফেট তাদের সাথে একটি চুক্তি করেন এবং তাদের খ্রিস্টান ধর্ম পালন করতে অনুমতি দেন এই শর্তে যে তারা তাদের সন্তানদের খ্রিস্ট ধর্মে আর ব্যাপটাইজড করতে পারবে না।

অন্যান্য ঘটনায়, যার সম্বন্ধে ভিন্নমত রয়েছে, নাজরান থেকে খ্রিস্টান ডেলিগেশন মদিনায় মোহাম্মদের কাছে আসে। চৌদ্দজন বিশিষ্ট খ্রিস্টান ব্যক্তি নিয়ে গঠিত আর একটি দলও আসে ৬৩১ সালে, এই দলের নেতা ছিলেন কিন্দা গোত্রের আব্দুল মসিহ; বকর গোত্রের বিশপও এসেছিলেন এবং বনেদি দায়ান পরিবারের একজন প্রতিনিধিও এলেন।

সব দলের খ্রিস্টান প্রতিনিধিরা মোহাম্মদের কথা শুনলেন। মোহাম্মদ কোরান থেকে একই প্যাসেজ আবৃত্তি করে শোনালেন তাদের এবং তাদের আমন্ত্রণ করলেন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে; কিন্তু খ্রিস্টান প্রতিনিধির নেতারা অস্বীকার করেন। এর পর উভয় দলের মধ্যে গভীর আলোচনা শুরু হলো এবং প্রতি পয়েন্টে দ্বিমত পোষণ করল দুই দল। তখন মোহাম্মদ প্রস্তাব করেন— ‘এসো আমাদের পরিবারের সদস্যদের ডাকি এবং একে অন্যকে অভিসম্পাত দিতে শুরু করি, যাতে ঈশ্বরের অভিশাপ সেই পরিবারের ওপর পড়বে যারা মিথ্যা বলবে’ (৩ : ৫৪)। খ্রিস্টানরা এই অদ্ভুত শাপশাপান্ত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে অস্বীকার করে। (Rodinson 1976, P. 271)। প্রত্যাবর্তনের পূর্বে প্রফেট খ্রিস্টানদের আশ্বস্ত করেন এই বলে যে তারা তাদের ধর্ম পালন করলে কেউ বাধা দিবে না এবং তাদের ধনসম্পত্তি ও অধিকার সব কিছুই বজায় থাকবে। কিন্তু পরে ঐ বছরেই ৬৩১ সালের শেষের দিকে মোহাম্মদ খালিদ ইবন ওয়ালিদের অধীনে এক অভিযান পাঠিয়ে নাজরান খ্রিস্টান গোত্রকে ইসলাম গ্রহণ করতে বলেন নতুবা অস্ত্র ধরতে বললে প্রাণের ভয়ে তারা মুসলিম হয়ে যায়। কারণ তারা খালিদের রণকৌশল সম্বন্ধে জ্ঞাত ছিল। কিন্তু ঘটনাচক্রে, খালিদ অন্য সমস্যা নিয়ে জড়িত হয়ে পড়লে, মোহাম্মদের মৃত্যু পর্যন্ত আর কোনো খ্রিস্টান গোত্র বিপদের সম্মুখীন হয়নি।

বালাধুরির মতে, নাজরানের খ্রিস্টানরা ছিল সংখ্যায় বেশি, প্রভাবশালী এবং ক্ষমতাশালী এবং দ্বিতীয় খলিফা ওমর তাদের নতুন ধর্ম ইসলামের প্রতি হুমকি স্বরূপ মনে করলেন। তাই নতুন অভিযানের ভয় দেখিয়ে আরবে অবস্থিত অধিকাংশ খ্রিস্টানদের দীক্ষিত করেন এবং নেতৃস্থানীয় অনেক খ্রিস্টান ব্যক্তিদের এখানে-ওখানে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেন। অনেক নির্বাসিত খ্রিস্টান কুফাতে স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে সেখানকার সাংস্কৃতিক জীবনে যথেষ্ট অবদান রাখেন। নাজরানের খ্রিস্টানরা এখানে- ওখানে ছড়িয়ে গেল এবং গোপনে প্রায় দু’শতাব্দি ধরে খ্রিস্ট ধর্ম পালন করতে থাকল।

প্রফেট মোহাম্মদের জীবদ্দশায় নাজরান ও নেজদের কয়েকজন খ্রিস্টান গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব দক্ষিণ ও মধ্য আরবে প্রভূত প্রভাব স্থাপন করে। প্রাচীন মুসলিম ইতিহাসে বিক্ষিপ্তভাবে তাদের জীবনীর সন্ধান পাওয়া যায়। যদিও ঐসব এলাকায় স্থানীয়ভাবে বিশ্বাসী ও প্রথার সাথে মিশে গেছে, তবু সেখানে খ্রিস্টানদের শিক্ষা-দীক্ষার সূত্র খুঁজে পাওয়া যায়।

তাদের মধ্যে একজন সংস্কারকের নাম তোলাইহা। এই তোলাইহা তালহা নামের ক্ষুদ্র সংস্করণ, বলা যায় নিন্দনীয় সংস্করণ। শক্তিশালী খ্রিস্টান আসাদ গোত্রের প্রধান এবং মক্কার কোরেশ গোত্রের মিত্র গোত্র। তালহা সব সময়ে মোহাম্মদের বিরুদ্ধাচরণ করেছে এবং তাঁকে ভণ্ড বলত। মোহাম্মদও তাহাকে ভণ্ড প্রফেট বলে ডাকতেন। তোলাইহা মানুষকে যৌন সংযত হতে বলতেন, মদ ছুঁতে বারণ করতেন এবং নিয়মিত প্রার্থনায় মনোনিবেশ করতে বলতেন। তিনি সেজদা করাকে কদর্য ও পৌত্তলিকতা বলে প্রত্যাখ্যান করেন। ৬৩২ সালে তোলাইহা দাবি করেন যে তিনি গ্যাব্রিয়েলের মাধ্যমে ঐশী নির্দেশ পেয়েছেন এবং মধ্য আরবে প্রচারণা করে এক ধরনের খ্রিস্টবাদ প্রচারে সাফল্য লাভ করেন। তার বিরুদ্ধে খালিদ ইবন ওয়ালিদের অধীনে একটি মুসলিম বাহিনী প্রেরিত হলে তিনি তাদের মোকাবেলার জন্য উত্তরমুখে অগ্রসর হন। তোলাইহা পরাজিত হন ও সিরিয়ায় ‘পালিয়ে’ যান। তার মা ও অনেক অনুসারী ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকার করলে তাদের পুড়িয়ে মারা হয় এবং যারা ইসলাম গ্রহণ করে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। শোনা যায় কিছু দিন পরে তোলাইহা নিজে ক্ষুণ্ণ মনে ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নেন। তোলাইহা ও তার গোত্রের ইসলামে আনুগত্যের কথা কোরানে বিধৃত আছে (৪৯ : ১৪)।

আউস গোত্রের আর একজন অদ্ভুত বিদ্রোহী ছিলেন আইলাহা ইবন কাব। তার অন্য নাম ছিল ‘বোরখাধারী’ বা কৃষ্ণমূর্তি (আল-আসওয়াদ) কিংবা ‘গাধার মালিক’। বিখ্যাত বক্তা হিসাবে তার নাম ছিল। তিনিও ঘোষণা দেন যে দু’জন ফেরেস্তা এসে তাকে ‘রহমানের’ বাণী দিয়ে গেছে। বহু লোক তাকে প্রফেট মান্য করে তার শিষ্য হয়ে পেছনে দাঁড়িয়ে গেল এবং কিছু দিনের জন্য তিনি নাজরানের বৃহত্তর খ্রিস্টান অঞ্চলের আসল মালিক হয়ে যান এবং বাহরাইন, তায়েফ ও ইয়েমেনে তার প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে।

মোহাম্মদ তাকে প্রতারক আখ্যা দেন এবং তাকে হত্যা করার জন্য একদল গুপ্তঘাতক নিয়োগ করেন। এর পূর্বে আইহালা হিমিয়ারের শেষ গভর্নর বাদানের পুত্র শারকে হত্যা করে তার বিধবা স্ত্রীকে জোরপূর্বক বিবাহ করেছিলেন। সেই মহিলার যোগসাজশে গুপ্তহত্যাকারী দল রাতে তার বাসায় ঢুকে মাথা কেটে ফেলে। কর্মটি করা হয়েছিল প্রফেট মোহাম্মদের মৃত্যুর আগের রাতে।

প্রফেট মোহাম্মদের মৃত্যুর পর আরব গোত্রের বেশির ভাগ, যারা ইসলামে আনুগত্য এনেছিল, সরে পড়ে এবং কর দেয়া বন্ধ করে দেয়। তাদের বিরুদ্ধে খলিফা আবু বকর সেনাবাহিনী পাঠিয়ে শায়েস্তা করেন। খ্রিস্টান গোত্রের মধ্যে ইয়ামামা গো তাদের ধর্মে অটল ছিল। এই গোত্রে খ্রিস্টান কিং হাওদা ইবন আলীর কাছে মোহাম্মদ তার জীবদ্দশায় চিঠি পাঠিয়েছিলেন ইসলাম গ্রহণ করার জন্য।

হাওদার মৃত্যুর পর ইমামার শাসনভার গ্রহণ করেন খ্রিস্টান হানিফা গোত্রের মুসাইলামা, সম্ভবত মধ্য আরবের সংস্কারকদের মধ্যে তিনি অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। তার আসল নাম ছিল মাসলামা কিন্তু মুসলিমরা তার মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করার জন্য ‘মুসাইলামা’ বলে ডাকত, যার অর্থ ‘ক্ষুদ্র মুসলিম’-পেটি মুসলিম। এই নামেই তিনি বেশি পরিচিত। ৬০৮ খ্রিস্টাব্দে মুসাইলামা তার সংস্কার কর্ম শুরু করেন হানিফদের নীতি অনুসারে এবং মোহাম্মদের পূর্বেই প্রফেট বলে পরিচিতি পান। শান্তি বাণীর মাধ্যমে তিনি অসংখ্য অনুসারী ও শিষ্য সংগ্রহ করতে সমর্থ হন এবং দাবি করেন যে, আরবের অর্ধেক ‘তার দখলে’।

৬২৫ খ্রিস্টাব্দে কোনো এক সময়ে তিনি তামিম গোত্রের মহিলা প্রফেট সাজাজ বা সাজাহ্-র সাথে জোট বেঁধে কাজ শুরু করেন। সাজাহ্ মেসোপটেমিয়াতে খ্রিস্টানরূপে পালিত হন এবং তার গোত্রীয় লোকজনদের কাছে প্রচারকার্য চালিয়ে জনপ্রিয়তা লাভ করেন। মুসাইলামার হানিফা রাজ্য সীমানার উত্তর-পূর্বে তামিম গোত্র অবস্থিত। এই দুইজন সংস্কারকের জীবনী মুসলিম ইতিহাসে সংক্ষিপ্তভাবে অঙ্কিত এবং সেখানে দু’জনের ব্যক্তিগত চরিত্রের ওপর অভিযোগ এনে তাদের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করার চেষ্টা করা হয়েছে। তাদের কাছে আগত ঐশী বাণীর (রিভিলেশন) কিছু কিছু অংশ আরও ঐতিহাসিকদের দ্বারা উদ্ধৃত— এমনভাবে উদ্ধৃত, যাতে এ দু’জনকে হেয় প্রতিপন্ন করা যায়। ৬৩২ খ্রিস্টাব্দের দিকে সাজাহ মেসোপটেমিয়ায় ফিরে যান এবং তারপর তার সম্বন্ধে আর কিছু শোনা যায়নি।

মুসাইলামার ধর্মীয় নীতি (ডকট্রিন) মোহাম্মদ পূর্ব আরবে প্রচারিত এবং বলা হয় যে মোহাম্মদ তার দ্বারা অনুপ্রাণিত। অক্সফোর্ডের প্রফেসর মারগোলিয়থ এক থিওরিতে বলেন যে, ‘মুসলিম’ শব্দটি মূলত মুসাইলামার অনুসারীদের বলা হতো (Bravmann, 1972 P. 8)। এ ধারণা অবশ্য, যেমন আশা করা গেছে, সাদরে গৃহীত হয়নি।

মুসাইলামা তার রিভিলেশনগুলোকে গদ্য ছন্দে (সাজ) সাজিয়েছিলেন কোরানের স্টাইলে মক্কান সূরার মতো। তিনি শেষ বিচারের দিন সম্বন্ধে সাবধান বাণী দিয়েছেন, সন্ন্যাসের প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছেন, রোজা রাখা ও মদ্যপান পরিহার করতে নির্দেশ দেন। সন্তান জন্মদানের পরে স্ত্রীর সাথে যৌন সম্পর্কে বিশেষভাবে সংযমী হতে বলেন। তিনি প্রার্থনা পদ্ধতিতে হাঁটু ভেঙে বসতে বলেন, সেজদা (Prostration) নয়। তিনি বলেন ঈশ্বর তার পূজারীদের প্রণিপাত করিয়ে অসম্মান করতে দাবি করেননি। তিনি ঈশ্বরকে ‘আল-রহমান দয়াময়’ বলেছেন এবং নিজেকে বলতেন ‘আবদুর রহমান’- রহমানের দাস।

মোহাম্মদের প্রতিপক্ষরা মক্কাতে প্রচার করত এই বলে যে তিনি ইয়ামামার কোনো এক রহমানের কাছ থেকে তার মতামতের অনেক কিছুই আহরণ করেছেন এই রহমানকে স্পষ্টভাবে মুসাইলামাকে বোঝায়। তাঁর কাছে থেকে মোহাম্মদ কিছু মতবাদ ধার করেন আর না করেন, তিনি (মোহাম্মদ) এটা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে মুসাইলামা সংস্কারক হিসাবে তার প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী। তিনি মুসাইলামাকে প্রতারক বলে, মিথ্যাবাদী বলে অভিযোগ করেন এবং প্রচার করেন যে মুসাইলামা মানুষকে ঠকাচ্ছে, প্রতারিত করছে, মোজেজা দেখানোর ভান করছে আর কোরানের বাণী নকল করছে। তার মৃত্যুর শয্যায় মোহাম্মদ, কথিত আছে, মুসাইলামার ধ্বংস কামনা করেছিলেন।

মোহাম্মদ যখন মারা গেলেন, তার পর পরই মুসলিম সেনা বাহিনী সারা আরব ভূমি ইসলামাইজ করতে নেমে গেল অস্ত্রের জোরে এবং এই সাথেই মধ্য আরবে খ্রিস্টানদের প্রতি তাদের দৃষ্টি আরো দৃঢ়ভাবে নিবদ্ধ হলো। প্রাথমিক সংঘর্ষে মুসলিম বাহিনী মুসাইলামার অনুসারীদের হাতে পরাজিত হয় এবং দ্বিতীয়বারে ইয়ামামার যুদ্ধে (৬৩৪ খ্রিঃ) মুসলিম বাহিনী আরো ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বিধ্বস্ত হয়; কথিত আছে মদিনাতে এমন কোনো পরিবার ছিল না যেখান থেকে কান্নার রোল ওঠেনি।

ইয়ামামার দ্বিতীয় যুদ্ধে মুসলিম ইতিহাসে মারাত্মক ক্ষতিটা হয়েছিল অন্য কারণে, আর তা হলো এই যুদ্ধে মৃত্যুর মধ্যে ৩৯ জন কোরানে হাফেজ শহীদ হন যারা প্রফেটের প্রধান সাহাবীদের মধ্যে অন্যতম। এই ঘটনা ঘটেছিল প্রায় বিশ বছর পূর্বে যখন খলিফা ওসমান স্ট্যান্ডার্ড কোরান সঙ্কলনে হাত দেন।

ঐ একই বছরে (৬৩৪), কয়েক মাস পরে খলিফা আবুবকর তার কৃতী সেনাপতি খালিদ ইবন ওয়ালিদের নেতৃত্বে এক বিশাল বাহিনী প্রেরণ করেন মুসাইলামাকে ধ্বংস করতে। আকরাবায় ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হয় এবং সেই যুদ্ধে এত সৈন্য মারা পড়ে যে, ঐ অঞ্চলকে ‘মৃতের বাগান’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। এখানে মুসাইলামার দশ হাজার অনুসারী মারা পড়ে এবং মুসাইলামা নিজেও প্রাণ হারান; বাকি যারা ছিল তাদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করে জবরদস্তি করে ইসলামে দীক্ষা দেয়া হয়।

মুসাইলামার শিক্ষা ও নীতি তার অনুসারীদের মধ্যে গোপনে আলোচিত হতে থাকে বিশেষ করে নেজদে। নেজদের হানিফা গোত্রে যারা মুসাইলামার শিষ্য বা অনুসারী ছিল তাদের নেজদিয়া বলা হতো। ৬৯৩ খ্রিস্টাব্দে নেজদিয়ারা প্রকাশ্যে মুসাইলিমা মতবাদ প্রচারণা শুরু করলে তাদের তাৎক্ষণিকভাবে দমন করা হয়। তারপর আরবে কোনো উল্লেখযোগ্য খ্রিস্টান গোত্র বা নেতার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *