১৩. বিদেশী প্রভাব
মৌলবাদতত্ত্ব ও আইন পদ্ধতি লিপিবদ্ধ করার পূর্বেই মুসলিম রাজ্য পৃথিবীর অধিকাংশ অঞ্চল দখল করে নেয়। সাংস্কৃতিকভাবে আরবরা অথবা তত্ত্বগতভাবে ইসলাম, আরব থেকে সুসজ্জিত হয়ে আসেনি, তখন তাদের সাংগঠনিক কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না, ছিল না কোনো বিশেষজ্ঞ যা অধিকৃত এলাকাগুলোতে সুশাসন প্রবর্তন করতে পারে।
দ্রুত সামাজ্য বিস্তারের কারণে মরুবাসী আরবদের অন্য দেশে (বিজিত দেশের সংস্কৃতির সম্মুখীন হতে হয়েছে এবং তারা দেখতে পেল উন্নত সভ্যতার হঠাৎ আলোর ঝলকানি। বিজিত পারস্য রাজ্যের নগরী স্টেসিফোন (ctesiphon)-এর আলো ঝলমলে তারা অভিভূত হলো।
সেই সময় মেসোপটেমিয়া, পারস্য, সিরিয়া, প্যালেস্টাইন ও মিসর ছিল প্রাচীন সভ্যতার কেন্দ্রভূমি এবং প্রত্যেক নগরীর ছিল হাজার হাজার বছরের সভ্যতার ইতিহাস, তখন প্রফেট মোহাম্মদের জন্ম হয়নি। তাদের সমসাময়িক উত্তরাধিকারী সাসানিয়ান, সেলুসিড, টলেমি এবং বাইজানটাইনের ছিল বহু প্রাচীন সামাজিক ও প্রশাসনিক কাঠামো এবং গভীর মূল-সমৃদ্ধ ধৰ্মীয় ট্র্যাডিশন।
আরবরা যে ট্রাডিশানাল আদর্শ সাথে নিয়ে এসেছিল তা এইসব অতি উন্নত সভ্যতার ওপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি বরং যে সমস্যার মধ্যে পড়েছিল তা শুধু কলেমা, নামাজ, রোজা, হজ, যাকাত দিয়ে সমাধানের উপায় ছিল না। প্রফেট মোহাম্মদোত্তরকালে মধ্যপ্রাচ্যে এ সমস্ত প্রাচীন সাংস্কৃতিক কাঠামোতে ‘ইসলামিক’ আখ্যা দেওয়ার যে প্রবণতা তা ছিল অতিরিক্ত এবং তাকে গভীরভাবে পরীক্ষা ও পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজন। পুনর্মূল্যায়ন না হওয়ায় অনেক প্রাচীন সংস্কৃতি স্বীকৃতি পায়নি, যদিও মুসলিম সংস্কৃতির বীজ বপন সেখানেই করা হয়েছিল এবং পরবর্তীতে তা ফলে-ফুলে প্রসার লাভ করেছে।
স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, এখন যাকে ‘ইসলামিক স্টাডিজ’ বলা হয়, তার মধ্যে ‘ইসলামিক’ কতটুকু বিচার্য বিষয়। মুসলিম ঈশ্বরতত্ত্ব ও আইন পদ্ধতি বা জুরিস প্রুডেন্সকে ইসলামিক বলা যেতে পারে, কিন্তু যখন আমরা ইসলামিক বিজ্ঞান নক্ষত্রবিদ্যা বা চিকিৎসাবিদ্যা ও ঔষধ সম্বন্ধীয় কথা বলি তখন আমাদের মনে হয় এর সবই ইসলামের উত্তরকালে বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতার সোর্স থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। মুসলিমদের কয়েকটি কৃতিত্বপূর্ণ কাজ আছে যা মৌলিক। ইসলামের আবির্ভাবে এমন কিছু নতুনত্ব দেখা যায় না এবং যখন ধর্মীয় বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয় তখন প্রায় অন্য বিষয়ে গুরুত্ব কমে যায়। আলফ্রেড গিয়োম বলেন : ইসলামের লিগেসি প্রমাণ করে যেখানে ধর্ম প্রভাব খাটায়, সেখানে অন্য বিষয় নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে (Arnold and Guillaume, 1965, P. v)। প্রফেট মোহাম্মদ ও কোরানের বিধি-নিষেধের কারণে এটা বলা যেতে পারে যে স্থাপত্য বিদ্যায়, সাহিত্যে, সঙ্গীতে এবং শিল্পে মুসলিম বিশ্বে কোনো উন্নয়ন হয়নি ধর্মের কারণে, যা হয়েছে তা শুধু ইসলাম বহির্ভূত উৎসের প্রভাব থেকে।
ধর্মান্তরিত মুসলিম জনগণ আরবি ভাষা শিখেছিল শুধু কোরান পাঠ করার জন্য এবং ইসলামের প্রসারের সাথে আরবি ভাষা বাক্যবিনিময়ের মাধ্যম হয়ে যায় ইসলামী বিশ্বের বিভিন্ন অংশে। নন-আরব ও নন-মুসলিম স্কলারগণ আরবিতে লিখতেন এবং আরবি ভাষাতে নিজেদের স্থানীয় ভাষার বহু শব্দ আরবি ভাষায় গ্রহণ করে নেন, যা এখন মৌলিক আরবি ভাষা বলে গণ্য।
বেশ কিছু সংখ্যক জাতি ও ধর্মমত (creed) ইসলামী তরিকায় (order) তাদের উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে এবং প্রত্যেকে সেই তরিকাকে নিজের মতো সংশোধনও করেছে। ইসলামী কালচারে সমরূপ (uniform) বলে কিছু নেই; বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিষ্ঠান বিভিন্নভাবে গড়ে উঠেছে। তাই বিভিন্ন মুসলিম দেশে দেখা যায় বিভিন্ন কালচার যা স্থানীয় কালচারের সমরূপ, ইসলাম ধর্মমতের সাথে এই কালচারের মিল নেই বরং সেখানে একটা নির্দিষ্ট অঞ্চলে তাদের দেশীয় শিক্ষা, সংস্কৃতির প্রভাব পড়েছে।
দামেস্কে উমাইয়ারা, বাগদাদে আব্বাসিরা, কাইরোতে ফাতেমিদ, ইস্পাহানে সাভাবিদ, দিল্লিতি মোগল এবং ইস্তাম্বুলে অটোম্যান যে কৃষ্টি ও সভ্যতা গড়ে উঠেছে তা আরব বা ইসলামী ধর্ম থেকে গড়ে ওঠেনি, সেখানে প্রতিফলন ঘটেছে প্রাচীন কালচার যা সিরিয়া, মেসোপটেমিয়া, মিসর, ইন্ডিয়া ও বাইজানটাইনে আগে থেকেই ছিল। যেহেতু এই অঞ্চল ইসলাম রাজ্যভুক্ত হয়েছে, তাই আত্মীকরণে সমস্যা দেখা দেয়। বিজয়ী ও বিজিতের মধ্যে যোগাযোগে বিরোধ দেখা দিলে পরে আপোষ রফা হয়। আরবরা একটা নতুন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় যা আরব মরুর পরিবেশ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাই রাজ্য বিস্তারের কারণে ভিন্ন পরিস্থিতির সাথে আরবদের মেনে নিতে হয় এবং মিশিয়ে দিতে হয় আঞ্চলিক পরিবেশে। এই প্রক্রিয়ায় মিশে যায় বিশ্বজনীন ভাবধারা, যা ঘটনাচক্রে ইসলামী গোঁড়ামির পরিবর্তন এনে বিজিত রাজ্যে আঞ্চলিক ধারা গ্রহণ করতে হয়েছিল, নইলে প্রজা শাসন সম্ভব হতো না। দেশ জয়ের, সাথে সেখানকার মানুষের মন জয়েরও প্রশ্ন উঠেছিল পরিস্থিতির কারণে।
বিজয়ী আরব বিজিত রাজ্যের ভাবধারা মুছে ফেলতে পারেনি এবং প্রজাদের স্থানীয় সামাজিক প্যাটার্ন, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, সাংস্কৃতিক প্রথা এবং প্রচলিত আইন কোনো কিছুকে একেবারে পরিত্যাগ করা হয়নি। আরবরা বিজয়ী রূপে প্রবেশ করেছে বটে, কিন্তু বিজিত রাজ্যের স্থানীয় কৃষ্টি, সভ্যতা, সমাজ ও রাজনীতির কাছে পরাজিত হয়ে।
শুরুতে আরবদের কোনো পেশাতে দক্ষতা ছিল এবং তারা শিল্প ও বিজ্ঞানকে ঘৃণা করেছে। তারা বিশ্বাস করত কোনো কোনো পেশাতে দক্ষতা ছিল পারিবারিক উত্তরাধিকার সূত্রে সংরক্ষিত। যেমন ইহুদিরা দক্ষ ছিল অর্থ সংক্রান্ত ব্যাপারে, গ্রিকরা ছিল প্রযুক্তিতে, স্থাপত্যে ও শিল্পে এবং খ্রিস্টানদের ছিল আইন, মেডিসিন, শিল্প এবং প্রশাসনে। তাই বিজয়ী আরবরা এই সব সম্প্রদায়ের লোকজনকে তাদের সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে কাজ চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিল।
যারা ইসলামী সভ্যতায় বেশি অবদান রেখেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ইবন খালদুন। তিনি আরব ছিলেন না। তিউনিসিয়ার ঐতিহাসিক। মারা যান ১৪০৬ খ্রিস্টাব্দে। বিখ্যাত স্কলার ছিলেন; ধর্ম ও রাজনৈতিক বিষয়ে তার জ্ঞান ছিল প্রগাঢ়। মুসলিম ছাড়া কিছু নন-মুসলিম ও ইসলামী সভ্যতার অবদান রেখেছেন এবং শুরু থেকেই ইসলামী শিল্পে, সাহিত্যে, দর্শনে অমুসলিমদের অবদান তুচ্ছ ছিল না।
ইসলামী জীবনে এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে বিদেশীদের প্রভাব ফেলে দেবার নয়। ভাষাতে, ব্যাকরণে, ইতিহাসে, চরিত্র রচনায়, ভূগোলে, দর্শনে, ধর্মতত্ত্বে, আইনে, যুক্তিতর্কে, জুরিস প্রুডেন্সে, প্রশাসনে, প্রাকৃতিক ইতিহাসে, রসায়নে, পদার্থবিদ্যায়, চক্ষু চিকিৎসাশাস্ত্রে, সার্জারিতে, গণিতবিদ্যায়, নক্ষত্রবিদ্যায়, স্থাপত্যে, সঙ্গীতে, সাহিত্যে এবং শিল্পে বিদেশীদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
বিস্তৃত বিশাল মুসলিম রাজ্য বিভিন্ন সম্প্রদায়ের স্কলার-পণ্ডিতগণ মিলে যে অবদান বিভিন্ন ক্ষেত্রে রেখে গেছেন, সেই সমন্বিত প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছে ইসলামী সভ্যতা। এই সভ্যতায় আরবদের অবদান অতি সামান্যই।
১৩.১ যুদ্ধবিগ্রহ
প্রাচীন আরবে গৃহপালিত পশু ছিল উট এবং এই উটের উপর চড়ে তীর-ধনুক ব্যবহার করত কিন্তু বহির্শত্রুর আক্রমণ থেকে তাদের বন্ধুরূপে রক্ষা করত আরবের বিশাল মরু অঞ্চল। গ্রিক ভূগোলবিশারদ স্ট্র্যাবো লিখেছেন- “আরবরা বেশিরভাগ সময় যানবাহন এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে নিজেদের ব্যস্ত রাখত; তারা যোদ্ধার জাত ছিল না তারা অস্ত্রেরও খুব ভালো ব্যবহার জানত না, অস্ত্রের মধ্যে ছিল তীর, ধনুক, বর্শা, তরবারি আর গুলতি; কিন্তু অধিকাংশ লোকেরা দু’ধারী কুড়াল ব্যবহার করত। আবদুল মোত্তালেব হিমিয়ার গভর্নর আব্রাহাকে আরবে প্রবেশাধিকার দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন যে আরবরা যুদ্ধবিদ্যায় বেশি পারদর্শী নয়।
তারা দক্ষ ছিল ছোটখাটো অতর্কিত আক্রমণে লুটপাট করতে এবং স্থানীয় যুদ্ধে (যেমন বদরের যুদ্ধ এবং ওহদের যুদ্ধ) তাদের আক্রমণ ছিল বিক্ষিপ্ত, অতর্কিত। কিন্তু ইসলাম যখন আরব পেনিনসুলায় রাজত্ব স্থাপন করল, মুসলিমরা তখন ধীরে ধীরে যুদ্ধবিদ্যায় দক্ষ হয়ে উঠল। সালমান ফারসি মদীনার লোকদের পারস্যের পদ্ধতির পরিখা খনন করে প্রতিরক্ষা করার উপায় দেখিয়ে দেন এবং অগ্নি গোলা নিক্ষেপের কায়দা-কানুন শিখিয়ে দেন। আরবের সামরিক ইতিহাস সম্বন্ধে খুব অল্পই জানা যায়; বাইজানটাইন, সিরিয়া এবং পার্শিয়ান, ইরাক কেমন করে বিজিত হয়েছিল সে যুদ্ধের কথা শুধু মুখে মুখে প্রচারিত হয়েছে, এ সম্বন্ধে কোনো ইতিহাস লিখিত হয়নি এবং বর্তমানে এ সম্বন্ধে যে তথ্য পাওয়া যায় তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কোনো কোনো ঐতিহাসিক বিশ্বাস করেন যে, ঐ সময়ে যুদ্ধ ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেওয়ার সামরিক প্রধান অতি অল্পই ছিল।
প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার মতো উপযুক্ত সামরিক সম্ভার ছিল না, ছিল না বড় যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা। আক্রমণ করা ও প্রতিরক্ষা করার Srategy জানা ছিল না। আরো জানা ছিল না দুর্গ অবরোধ করে আক্রমণ পদ্ধতি; তারা নগরীকে Blocked বা অবরোধ করতে পারত কিন্তু দখল করার দক্ষতা আয়ত্ত করতে পারত না।
প্রথম বিদেশী রাজ্য যা আরবরা কব্জা করেছিল মদীনায় খিলাফতের সময় তা ছিল পারশিয়ান ও বাইজানটিন সাম্রাজ্যের প্রদেশগুলো। যে প্রদেশগুলো আরবের বর্ডার সংলগ্ন ছিল এবং যদিও পারস্য ও বাইজানটিয়ান নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে বিধ্বস্ত হয়েছিল তবুও আরবদের প্রতিহত করতে পারেনি অভ্যন্তরীণ কারণে, তাছাড়া স্বেচ্ছাচারী জুরাস্ট্রিয়ান পার্সিয়ান এবং খ্রিস্টান বাইজেনটিয়ানদের সাধারণ লোকের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল এবং স্থানীয় জনসাধারণ অর্থনৈতিক এবং সামাজিক কারণে উভয় দেশের সম্রাটদের প্রতি বিক্ষুব্ধ ছিল। এই কারণে সাধারণ লোকজনের কাছ থেকে পারস্যের বা বাইজানটাইনের সম্রাট কোনো সাহায্য পায়নি বরং সাধারণ লোকজন বহিরাক্রমণের শত্রুদের স্বাগত জানিয়েছেন। এটাও বলা হয় যে আরবদের প্রাথমিক বিজয়ের কারণ ছিল গেরিলা আক্রমণ, প্রায়ই দেখা গেছে যে, মুসলিমরা ত্বরিত আক্রমণ করেছে ঐসব বিদেশী প্রদেশকে সেখানে থেকে কোনো প্রতিরোধের ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি বরং তারা স্বাগত জানিয়েছে। আর যারা প্রতিরোধ করতে চেষ্টা করেছিল তারা সুসংবদ্ধ হওয়ার পূর্বেই দুর্ধর্ষ আরব জাতি তাদের ওপর আক্রমণ করে বসে, প্রতিআক্রমণের কোনো সময় দেয়নি।
পারসিয়ান, ইরাক এবং পারস্য মুসলিমরা জয় করে নেয় এবং দক্ষিণ দিকের বাইজানটাইন প্রদেশগুলোকে দখলে আনে। বাইজানটাইন এবং পারসিয়ান সেনা দলে সৈনিক এবং অফিসার ক্যাডারভুক্ত ছিল। এর বাইরে থেকে লোকজন সেনা দলে ভর্তি হতে পারত না। অন্যদিকে আরব সেনাদলে জাতিভেদ নির্বিশেষে উপযুক্ত ব্যক্তিদের সেনাদলে ভর্তি করা হয়েছে ফলে মুসলিম আরব সেনাদলে অনেক বিদেশী নন-আরব সেনাপতি ছিলেন যাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল এবং দক্ষতার জন্য জয় করা সহজ হয় এবং নিম্নস্তরের সেনাদলের শিক্ষার ব্যবস্থা বা প্রশিক্ষণের বন্দোবস্ত করা হয়। এছাড়া বহু নন-আরব সেনাদের ভাড়া করা হতো, অনেক লুণ্ঠনকারী এবং ডাকাত আরব সেনা দলে যোগদান করেছে মালেগণিমতের আশায় এবং এই সব লোকদের ব্যবহার করা হয়েছে অদক্ষ আরবদের পরিবর্তে। ঐতিহাসিক মাকরেজি (মৃ. ১৪৪২ খ্রিঃ) বলেছেন যে, ৮৩৫ খ্রিঃ খলিফা মুতাসেম বহু আরব সেনাকে সরিয়ে তুর্কি ভাড়া করা সৈন্য নিয়োগ করেন। ভবিষ্যতে এই তুর্কিরা খলিফার দরবারে খুব প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। মুসলিম বিজয়ের সাথে সাথে দেখা গেল যে আরব জেনারেলদের সরিয়ে তাদের ঐ স্থানে নিয়োগ করা হয়েছে পারসিয়ান, গ্রিক, তুর্কি আর্মেনিয়ান, মিসরীয়, মঙ্গোল, বারবার, ভিজিগত ও অন্য বিদেশীদের। পরবর্তীতে দেখা গেছে এইসব বিভিন্ন জাতি মুসলিম বিশ্বে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের ‘আমির’ পদ গ্রহণ করে নিজেদের বংশ প্রতিষ্ঠা করেছে। সিরিয়া এবং ইজিপ্টের নাবিকদের নিয়ে মুসলিম রাষ্ট্রের নৌ-বাহিনী সৃষ্টি হয় কিন্তু এই নৌ-বাহিনী বিশেষ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারেনি যদিও মুসলিমরা এক মাসের মধ্যে সারা পারস্য দেশ জয় করে নেয় এবং এক শতাব্দির মধ্যে তাদের সাম্রাজ্য ইন্ডিয়া থেকে আটলান্টিক পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে পড়ে। কিন্তু বাইজানটাইন মুসলিমরা তখনও দখল করতে পারেনি, তবে মুসলিমদের লক্ষ্য ছিল যে একদিন না একদিন তারা বাইজানটিয়ান নগরী ‘কনস্ট্যানটিনোপল’ দখল করবে।
৬৭০ খ্রিঃ উমাইয়া খলিফা মাবিয়া দার্দানালিস প্রণালীর মধ্য দিয়ে কনস্টানটিনোপল অবরোধ করার চেষ্টা করেন এবং সাত বৎসর ধরে সেই অবরোধ চলে কিন্তু কৃতকার্য তিনি হতে পারেননি। বহু ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে তার সেনাদলকে ফিরে আসতে হয়। ৭১৬ খ্রিঃ আরেকজন উমাইয়া খলিফা সোলেমান ৮০ হাজার সৈন্যসামন্ত এবং ১৮ শত যুদ্ধ জাহাজ নিয়ে কনস্ট্যান্টিনোপল অবরোধ করেন। তখন বাইজানটাইনের সম্রাট ছিলেন তৃতীয় লিও, কিন্তু বাইজানটাইনদের গোলাগুলির কারণে অবরোধ তুলে নিতে বাধ্য হন বহু ক্ষয়-ক্ষতি স্বীকারের পরে। এর কিছুদিন পরে খলিফা সোলেমান মারা যান।
ঐ সময় বাইজানটিয়ান যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এভাস, স্লাভস্, বুলগার, মেগিয়ার, সেলুজুক এবং অন্যান্য জাতির সাথে; এই কারণে বাইজানটাইনের প্রতিরক্ষা ক্ষমতা অনেক পরিমাণে হ্রাস পায়। ১২০৪ সালে চতুর্থ ক্রুসেডের সময় ক্রুসেডরা, প্রধানত ফ্রেঞ্চ এবং ভেনিশিয়ানরা কনস্ট্যানটিনোপল আক্রমণ করে লুট করে নগরীতে আগুন লাগিয়ে দেয়। এই ঘটনার পর থেকে পূর্ব দিকে এই খ্রিস্টান সাম্রাজ্যে নৈতিক অবনতি ঘটে এবং এর পর আড়াই শতাব্দি যাবৎ তারা কোনো রকমে রাজ্য চালিয়ে যায়।
মুসলিম সৈন্যবাহিনী কনস্ট্যান্টিনোপল আক্রমণে কখনো নিরুৎসাহী হয়ে পড়েনি। মাবিয়ার প্রথম আক্রমণের পরে সাত শত বছর অতিক্রম হয়েছে। মুসলিম বিশ্বে তখন তুর্কিরা খুব প্রভাবশালী জাতি, তুর্কি সুলতান ২য় মাহমুদ ১৪৫৩ খ্রিঃ কনস্ট্যান্টিনোপল অবরোধ করেন এবং শেষ পর্যন্ত দখল করে নেন।
১৩.২ আরব জাতীয়তাবাদ
প্রফেট মুহম্মদ বলেছিলেন ‘সকল জাতি থেকে আরবরা শ্রেষ্ঠ জাতি’ (৩ : ১০৬) এবং আরবরা যখন আরো রাজ্য জয় করল তখন খলিফা ওমর ঘোষণা করলেন যে, “ঈশ্বর আরবদের শ্রেষ্ঠ বিজয়ী করেছেন।’ মূলত ইসলামকে বলা হয় আরবদের জন্য বিজয়ের ধর্ম এবং এই বিজয় শুধু আরব জাতির জন্য যারা আরব পেননসুলায় বসবাস করে এবং আরবি ভাষা বলে।
অনেক দিন ধরে মুসলিমরা ভাবত যে তারা শুধু আরব বংশোদ্ভূত এবং পৃথিবীর অভিজাত শ্রেণীর মুসলিম একটা আলাদা জাতি যারা অন্যসব জাতির ওপর কর্তৃত্ব করে। আরবদের কাছে ইসলাম অর্থ আরব নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব যেখানে শুধু আরবরাই একচ্ছত্রভাবে রাজত্ব করবে। একজন নন-আরব মুসলিম পরিপূর্ণ মুসলিম বলে গণ্য নয় অথবা একজন নন-মুসলিম পরিপূর্ণ আরব নয়।
পূর্ণ status তাকেই দেওয়া হতো যে ব্যক্তি মুক্ত, ক্রীতদাস নয়, পুরুষ, নারী নয়, আরব, নন-আরব নয়, মুসলিম, নন-মুসলিম নয়। আরবে গোত্রযুদ্ধের সময় যে সমস্ত বন্দির ধমনিতে আরব রক্ত প্রবাহিত তাদের মুক্ত করে দেওয়া হতো এবং যারা নন- আরব তাদের হত্যা করা হতো, এমনকি আরব ক্রীতদাসকে অল্প মুক্তিপণ দিয়ে মুক্ত করা হতো, কিন্তু নন-আরবদের তা করা হতো না। আরব মুসলিম, আরব-নন মুসলিম, নন-আরব মুসলিম এবং নন-আরব বিধর্মী এদের মধ্যে পার্থক্য করা হতো। কোনো কোনো সময় বিজিত রাজ্যের অভিজাত বংশের ধর্মান্তরিত মুসলিমদের অবৈতনিক সেমি-আরব status দেওয়া হতো এবং কোনো আরব পৃষ্ঠপোষক তাদের মাওয়ালী হিসাবে গ্রহণ করত, এমনকি মাওয়ালীরাও যারা আরবদের সাথে যুদ্ধ করত তারা আরব মুসলিমদের সুবিধা পেত না। নন-আরবদের ধর্মান্তকরণ আরবদের চেষ্টা হয়েছিল কিন্তু কতকগুলো সমস্যা দেখা দেয় যখন আরব সাম্রাজ্য বিস্তার লাভ করে, আর এই ধর্মান্তকরণ হতো ট্যাক্স থেকে বাঁচবার জন্য। সমস্ত মুসলিমদের আরব ও নন-আরব আয়কর (যাকাত) দিতে হতো। এই যাকাত বাধ্যতামূলক এবং ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে একটি (২৩ : ৪)। ‘যাকাত’ শব্দটি কোরানে উল্লিখিত হয়েছে যা মুসার Covenent-এর সাথে সম্পর্কযুক্ত (২ : ৮৩) এবং এর কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা নেই। এর উৎস হলো আরামাইক এবং ইসলামের পূর্বে ব্যবহৃত হতো বাধ্যতামূলক খ্রিস্টান ও ইহুদি সম্প্রদায়ে দান হিসাবে, (Jeffery 1938, P. 153)। এই ট্যাক্স সাদাকা থেকে আলাদা। সাদাকা দেয়া আরবিদের দান হিসাবে ভলান্টারি দান। বাধ্যতামূলক নয়, তবে দিলে পুণ্য হয়। এই ‘সাদাকা’ শব্দও আরামাইক এবং ইহুদি ও খ্রিস্টানরা দান হিসাবে (ডোনেশন) দিত। আর একটা অতিরিক্ত কর ছিল যাকে খারাজ বলে, এটাও আরামাইক শব্দ। এই খারাজ দিতে হতো নন-আরব, মুসলিম ও নন-মুসলিমদের।
পরিশেষে, আরও একটি ট্যাক্স ছিল যা বিধর্মীদের দিতে হতো, এর নাম জিজিয়া এই ট্যাক্সের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু দিতে হতো। পরে যখন একযোগে সবাই মুসলিম হয়ে যায় তখন ট্যাক্স বন্ধ হয় এবং রাজস্বে বেশ ঘাটতি পড়ে।
এই শ্রেণী বিভাগের জন্য রাজ্যে বেশ অসন্তোষ দেখা দেয় এবং গণআন্দোলন (শুরিয়া) হয় মুসলিম রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে, কোনো কোনো স্থানে সশস্ত্র আন্দোলন ও হয়েছে। নন-আরব কনভার্টরা আরবদের সমান স্ট্যাটাস দাবি করে ব্যর্থ হলে তারা তাদের আন্দোলন করে এবং তাদের পুরনো কৃষ্টি ও সভ্যতায় ফিরে যেতে চায়। এই বিচ্ছিন্নবাদীরা মরুর তাঁবুবাসীদের সাথে নিয়ে আন্দোলনে নামে। এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন আবু ওবাইদা (মৃ. ৮৭৫); তিনি কোরানের ভাষ্যকার ও ভাষাবিশারদ ছিলেন। কেউ বলে তিনি নাবিতিয়ান কেউ বলে ইহুদি। ইরাক, প্যালেস্টাইন ও মিসরের আন্দোলনকারীরা তাদের পূর্ব-পুরুষের জাত্যাভিমান এবং কৃতিত্বের কথা আরবদের সাথে তুলনা করে আন্দোলন আরও জোরদার করে তোলে। আন্দোলনের গতিকে জোরদার করে তুলল কিছু এন্টি-আরব দেশপ্রেমী পারস্যবাসী, যারা বলে যে আরবদের চেয়ে বেশি গর্ব করার আছে তাদের পূর্বপুরুষদের জন্য এবং তাদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের, তাদের শিক্ষা ও সাহিত্যের। পারসিরা আরবদের চেয়ে বেশি রাজ্য বিস্তার করেছে, মহাশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। তারা দাবি করত তাদের অবদানের কথা যা মুসলিম সংস্কৃতি ও সভ্যতাতে রেখে গেছে।
তারা অভিযোগ করে যে আরবদের বংশ তালিকা তৈরি করা, বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে সন্দেহজনক বিবাহের মধ্যে বংশের যোগসূত্র অথবা ক্রীতদাসীর রক্ত মিশ্রিত। তাদের নিজেদের দলিলপত্র প্রমাণ করে যে গর্বিত অভিজাত বেদুইন গোত্ৰ মিশ্র বংশোদ্ভূত এবং আংশিক ইহুদি বংশ। ইরানিরা আরবদের ভেড়ার পাল রক্ষক, উষ্ট্র চালক, মরুবাসী (ফার্সি ‘সাহারা-নিশিন’ থেকে আসছে ‘সেরাসিন’ নাম) এবং টিকটিকি ভক্ষক এবং কোরেশদের মধ্যে অধিকাংশ সমকামী (Thaalibi, 1968, P. 25)। তারা বলে আরবরা বন্য, নোংরা ও অসভ্য জাতি এবং যে ভদ্র আচরণ (আদব) শিখেছে তা শুধু পার্সিয়ানদের কাছ থেকে।
শুবিয়া আন্দোলন স্পষ্টভাবে প্রকাশ করে যে বিভিন্ন ইসলামিক জাতি কখনো এক সম্প্রদায় (উম্মা : আরামাইক) হিসাবে দেখা দেয়নি। কোরান, রোজা ও হজ মুসলিমদের একমাত্র বন্ধন। মুসলিমরা অনেক কারণে বিভিন্নভাবে বিভক্ত। জাতিগত বিভেদ, আঞ্চলিক ইতিহাস, স্থানীয় সামাজিক ভাষা এবং সাংস্কৃতিক বন্ধন ইত্যাদি প্যান-ইসলামিক বন্ধনকে বাধা দেয়।
মুসলিমদের অধিকাংশ নন-আরব এবং তাদের নিজস্ব ট্র্যাডিশন এবং আলাদা জীবনযাত্রা আছে। মাগরিবের লোকজন (লিবিয়া, তিউনিস, আলজিরিয়া, ও মরক্কো) আরব গোত্রভুক্ত নয় এবং বার্বাররাও আরবদের আধিপত্য অনেক দিন থেকে বাধা দিয়ে এসেছে। আফ্রিকার নিগ্রো এবং অন্যান্য সেমিটিক লোকজন কট্টর ন্যাশালালিস্ট নন-আরব। এটা সমভাবে প্রযোজ্য মিসরীয়, পার্সি, আফগান, তুর্ক ও উজবেকদের ক্ষেত্রে। মধ্য এশিয়ায় তাজিকও এদের দলে। ইরাকের কুর্দ, সিরিয়া, তুর্কি ও ইরান, বলা হয় যে, প্রাচীন মেডেস (Medes) থেকে আগত। ভারত উপমহাদেশে এবং ইন্দোনেশিয়ার লোকজনরা প্রধানত হিন্দু, বৌদ্ধরা সর্বপ্রাণবাদী থেকে ধর্মান্তরিত মুসলিম এবং মিশ্র জাতি-গোত্রভুক্ত।
পরিশেষে, মুসলিম রাষ্ট্র নন-মুসলিম মাইনরিটির প্রভাব ইসলামের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করেছে। মিসরে প্রায় ১০% জনসংখ্যা খ্রিস্টান কপট, লেবাননে অর্ধেকের বেশি খ্রিস্টান জনসংখ্যা। সিরিয়া ও জর্ডানে খ্রিস্টানরা হচ্ছে ধনী মাইনরিটি।
কোনো কোনো পণ্ডিতদের মতে এই ব্যতিক্রম আরবদের জন্য কোনো সমস্যা নয়। আরবদের ইতিহাসে দেখা যায় তাদের নিজের ইচ্ছায় চলার প্রবণতা আছে। কিছু ব্যতিক্রম থাকলেও আরবরা সব সময়ই আরব জাতির বড়াই করেছে, ধর্মের করেনি, ধর্মীয় গোঁড়ামি আরবে দেখা দেয়নি, দেখা দিয়েছে নন-আরব রাষ্ট্রে। আরবরা মনে করে তারা একটি আলাদা জাতি, তাদের ইতিহাস-গৌরব আলাদা এবং তাদের অনেকেই আরবের অতীত দেখে, ইসলামকে নয়। একজন ইউরোপীয় যেমন ইউরোপের ইতিহাস লিখতে খ্রিস্টানিটিতে উল্লেখ করে না। তেমনি বলা হয়, আরবের ইতিহাস কেউ লিখলে মুসলিম ধর্মকে বাদ দিয়েই লিখবে। সত্যি বলতে কি ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদে এমনি একটি প্রকল্পে হাত দেয়া হয়েছিল (Akhters 1989 P. 84)।
১৩.৩ আন্তঃগোত্র বিবাহ (Miscgenation)
মুসলিমদের আন্তঃগোত্র বা আন্তঃজাতি বিবাহ একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। আরবরা নন-আরব রমণীদের স্ত্রীরূপে গ্রহণ করে বিদেশের উপাদানগুলো ধর্মের সাথে মিশিয়ে গুলিয়ে ফেলেছে যার ফলে ইসলামিক সভ্যতায় বিদেশী উপাদানের প্রভাব প্রকট। এই ইন্টারম্যারেজ ইসলামের জন্মলগ্ন থেকেই আরম্ভ হয়েছে। প্রফেট মোহাম্মদ নিজেই বিবাহ করে ঘরে এনেছেন মিশ্র প্যাগন গোত্রের রমণী, ইহুদি স্ত্রী এবং খ্রিস্টান ও ইহুদি উপ-পত্নী।
ইসলামী সাম্রাজ্য পারস্য ও বাইজানটাইনে বিস্তৃত হলে, মুসলিমরা বিয়ে করেছে খ্রিস্টান, ইহুদি ও জোরাস্ত্রিয়ান এবং বুড্ডিস্ট রমণীদের ব্যাপক হারে, কারণ তাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতি উঁচুস্তরের ছিল আর বিশেষ কারণ ছিল এই সব রমণীদের অঙ্গ- সৌষ্ঠব ছিল আবেদনমূলক। উচ্চ শ্রেণী মুসলিমদের অনেকেই, খলিফা প্রশাসক এবং ধর্মবেত্তাসহ, নন-আরব মহিলা বিবাহ করেছেন এবং তাদের বংশ তালিকা জটিল হয়েছে, কেননা পুত্র-কন্যা জন্মে নন-আরব ও উপপত্নীদের মাধ্যমে। এই বিবাহে ধর্মান্তরকরণ পূর্বশর্ত ছিল না এবং যদিও কনভারশন হয়ে থাকে, তার অর্থ এই ছিল না যে সে-স্ত্রী তার পূর্ব বিশ্বাস পরিত্যাগ করবে। নামকা ওয়াস্তে কনভারশন হলেও স্ত্রীরা তাদের নিজ নিজ ধর্ম পালন করেছে, কোনো বাধা ছিল না। সুতরাং তলে তলে নন-মুসলিম বিশ্বাস ট্র্যাডিশন ও সাংস্কৃতিক প্রভাব পরিবারে অবশ্যই পড়েছে।
নাইলা বিন্ত আল ফুরা ফিসা তৃতীয় খলিফা ওসমানের স্ত্রী ছিলেন খ্রিস্টান কাল্ব গোত্রের কন্যা। ওসমানকে তরবারির আঘাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে তাঁর তিনটি আঙুল কাটা যায় বলে কথিত। তার সম্মুখেই তাঁর স্বামী খলিফা ওসমানকে হত্যা করে বিদ্রোহী মুসলিমরা।
চতুর্থ খলিফা আলীর পুত্র হোসেন বিবাহ করেছিলেন ৩য় ইয়াজদেগার্ডের এক কন্যাকে। ইয়াজদেগার্ড ছিলেন পারস্যের শেষ সাসানিয়ান সম্রাট, ধর্মে জোরাস্ত্রিয়েন। এই জুটির পুত্র জয়নাল আবেদীন শিয়াদের ৪র্থ ইমাম। প্রাচীন পারস্য পরিবারের সাথে শিয়া ইমাম ও নেতাদের বৈবাহিক সূত্র ছিল শুরু থেকেই এবং এই যোগসূত্র অনেক দিন পর্যন্ত ছিল।
দামেস্কর উমাইয়া বংশের অনেক সদস্যের বিবাহ হয়েছে সিরিয়ার খ্রিস্টান রমণীর সাথে এবং অনেকের হয়েছে বাইজানটাইন অভিজাত পরিবারের কন্যাদের সাথে। মদিনার ধার্মিক ব্যক্তিদের প্রতিবাদ ধোপে টিকেনি। প্রথম উমাইয়া খলিফা মাবিয়ার পত্নী ছিলেন মাইসুন বিন্ত বাহ্দাল, কাল্ব গোত্রের খ্রিস্টান রমণী। তিনি তার বাবা ও পরিবারের সকলেই খ্রিস্টান ছিলেন। মাবিয়া দামস্কে একটি চার্চ নিৰ্মাণ করে স্ত্রীকে উপহার দেন। এই মহিলা প্রথম এজিদের মাতা।
উমাইয়ারা তাদের মিশ্র বংশ তালিকা অস্বীকার করেনি। দ্বাদশ খলিফা তৃতীয় এজিদ তার বংশ সম্বন্ধে গর্ব করে বলতেন, আমার পূর্বপুরুষ ছিল পারস্য সম্রাট এবং বাইজানটাইন সম্রাটগণ তুর্কি খানরা উভয়েই আমার পূর্বপুরুষ।
আব্বাসি খলিফাদের মধ্যে অতি অল্পই ছিলেন খাঁটি আরব। এদের বংশসূত্র বের করতে গিয়ে বাগদাদের পণ্ডিত ব্যক্তি ইবন হাবিব (মৃ. ৮৬০) দেখিয়েছেন যে প্ৰায় সকলেই ছিলেন নন-আরব, বেশির ভাগ পার্সিয়ান প্রায়ই জোরাস্ত্রিয়ান মাতার সন্তান। অনেকেই বিদেশী রক্তের ক্রীতদাসী রমণীদের পুত্র। মাত্র তিন আব্বাসি খলিফা স্বাধীন রমণীর সন্তান ছিলেন। মনসুর (মৃ. ৭৭৫) পার্সিয়ান ক্রীতদাসীর পুত্র; মামুন (মৃ. ৮৩৩) এক বার্বার রমণীর সন্তান; ওয়ার্থিক (মৃ. ৮৪৭) মুদাদির (মৃ. ৯৩২) ছিলেন গ্রিক রমণীদের পুত্র। মুন্তাসিরের (মৃ. ৮৬২), মাতা ছিলেন তুর্কি গৃহপরিচারিকা।
ওবাইদুল্লাহ, ফাতেমি বংশের প্রতিষ্ঠাতা, ছিলেন ইহুদি ও জোরাস্ত্রিয়ান বংশোদ্ভূত বলে কথিত এবং তার পরের খলিফারাও ছিলেন মিশ্র বিবাহের ফসল। পঞ্চম ফাতেমিদ খলিফা আজিজ বিবাহ করেন খ্রিস্টান রমণী যার দুই ভ্রাতাকে জেরেমিয়া ও আরভেনিয়াস জেরুজালেম ও আলেক্সান্দ্রিয়ার বিশপ পদে নিযুক্ত করেন।
স্পেনে মুসলিমরা যে অভিনব সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিলেন তা সম্ভব হয়েছিল খ্রিস্টান ও মুসলিমদের মাঝে ঘন ঘন ইন্টার-ম্যারেজের ফলে। মরক্কো এবং স্পেনের দক্ষিণ অংশ বিজয়ী মুসা বিন জুসাইর- তিনি প্যালেস্টাইনের খ্রিস্টান বালী গোত্রোদ্ভূত। মুসার পুত্র আব্দুল আজিজ ভিজিগথ রাজা রডারিকের বিধর্মী স্ত্রী এজিলোনাকে বিবাহ করেন।
তারিকের সাথে সেসব বার্বার জিব্রাল্টার অতিক্রম করে স্পেনে বসবাস করেছে, কথিত যে তারা যথেচ্ছ স্থানীয় লোকজনের কন্যাকে বিবাহ করেছে এবং স্পেনের মূল ভূমি দখলে যেসব সৈন্যরা অংশ নিয়েছিল তারা ছিল খ্রিস্টান কাল্ব গোত্রের এবং এরাই কর্ডোভা ও গ্রানাডাতে স্থায়ী বসবাস আরম্ভ করে আর সেভিলে এবং ভেলেন- সিরায় করে কাইস গোত্রের খ্রিস্টান সেনাদল।
বার্বার, আরব ও সিরিয়ার লোকজন দ্বিধাহীনভাবে মেলামেশা করেছে স্থানীয় লোকজনদের সাথে যারা ছিল স্লাভ, ফ্র্যাঙ্ক, ভিজিগথ ও ভ্যান্ডেল এবং শুরু থেকেই উত্তর অঞ্চলের মহিলাদের আরব-বার্বার মধ্যে বেশ চাহিদা ছিল। দশম শতাব্দির মধ্যে স্পেনে মিত্র রক্তের প্রবাহ বয়ে গেছে। আইবেরিয়ান পেনিনসুলা জুড়ে, মুসলিম শাসক শ্রেণী, সামন্ত, স্কলার, ধর্মবেত্তা এবং বুদ্ধিজীবী প্রায় সকলেই মিশ্র-রক্ত-যুক্ত। মোজারেব বা আরবীয় খ্রিস্টান, যারা স্পেনে শিক্ষায়, সংস্কৃতি ও শিল্পে বিশেষ অবদান রেখেছিল তারা প্রায়ই মিশ্র বিবাহের ফসল।
কর্ডোভার মহান উমাইয়া খলিফা ৪র্থ আব্দুর রহমান (মৃ. ৯৬১)-এর লাল চুল ও নীল চক্ষু ছিল। তিনি আরবি ও রোমান ভাষার সুপণ্ডিত ছিলেন এবং উভয় ভাষাই বলতে পারতেন। তিনি ছিলেন আনদালুসিয়ার টিপিক্যাল দো-আঁশলা। তার বাবা ছিলেন অর্ধেক আরব আর মা ছিলেন ফ্র্যাঙ্ক রমণী। তার দাদি ছিলেন প্রিন্সেস ইনিগা প্যামপ্লোনার রাজা ফরচুন গার্সেসের কন্যা। অন্য এক উমাইয়া খলিফা ২য় হিশাম (মৃ. ১০১৩) ছিলেন বাসক রমণীর পুত্র।
তুর্কির অটোমেন লাইন ছিল গ্রিক, আরমোনিয়ান এবং স্লাভ গোত্রের মিশ্র বিবাহের লাইন। এছাড়া ইহুদি ও অন্য জাতের রক্ত ছিল সুলতানদের ধমনীতে। কদাচিৎ দু’একজন ছিল খাঁটি তুর্কি শাসক, ভিজির বা সামন্ত। এসব সপ্তদশ শতাব্দির কথা। অটোমেন প্রধান ওরখান, এই লাইনের দ্বিতীয় সুলতান, বিয়ে করেছিলেন বাইজানটাইন সম্রাট জন ভি প্যালিও লোগাসের কন্যাকে। ১৩৬৬ খ্রিস্টাব্দে ওরখানের উত্তরাধিকারী ১ম মুরাদ বুলগেরিয়ান রাজা ৩য় শিশম্যানের ভগিনীকে বিবাহ করেন। মুরাদের পুত্র ও উত্তরাধিকারী ১ম বায়েজিদ এক খ্রিস্টান রমণী লেডি ডেসপয়নাকে বিবাহ করেন। ইনি সার্বিয়ার শাসকের ভগিনী ছিলেন। সুলতান মুরাদকে মঙ্গল সম্রাট তৈমুর লং পরাস্ত করে খাঁচায় ভরে নিয়ে যান বলে কথিত। গ্রিক, আর্মেনিয়ান, স্লাভ এবং অন্যান্য বিদেশী পত্নী ও উপপত্নীতে ভরপুর ছিল সুলতানদের হেরেম।
সামন্ত শ্রেণীর ও রাজকীয় সভাসদদেরও বিদেশী পত্নী ও উপপত্নী ছিল। বলা হয় যে, ২৯২ গ্র্যান্ড ভিজিরের মধ্যে অটোমেন সাম্রাজ্যে কেবলমাত্র ৭৮ জন ভিজিরের পিতামাতা ছিল তুর্কি।
ভারতে, মঙ্গল, টার্কিশ, পার্সিয়ান এবং হিন্দুর কন্যা দ্বারা মোগলদের মহান বংশ মিশে গিয়েছিল। ঐ সময়ের মধ্যে ইউরোপীয় ও ইউরোশিয়ান মহিলা মোগল সম্রাটদের ও সামন্ত সভাসদদের হেরেমে (Dover 1937, P. 121)। গায়ের চামড়া সাদা হওয়ার কারণে পশ্চিমা নারীদের বেশি কদর ছিল।
শাহ ইসমাইলের মাতা ছিলেন প্রিন্সেস মার্থা। ইনি কমেনি সম্রাট ও খ্রিস্টান ট্রেবিজন্ড (১২০৪-১৪৬১) বংশের কন্যা। পারস্য সম্রাজ্ঞী হয়ে তার নাম হয় হালিমা আলম শাহ বেগম। শাহ ইসমাইল পারস্যে সাফাবিদ বংশের (১৪৯৯-১৭৩৬) প্রতিষ্ঠাতা
এই সমস্ত তথ্য থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে উত্তর আফ্রিকা থেকে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত মুসলিম বংশের সম্রাট, সুলতান ও রাজপুত্ররা বিবাহ করেছিলেন, স্থানীয় শাসকবৃন্দের মহিলাদের অথবা বিজিত রাজ্যের মহিলাদের স্ত্রী রূপে গ্রহণ করেছেন এবং প্রায়ই ইউরোপীয় মহিলা বেছে নিতেন ফর্সা সন্তান-সন্তনাদি পাওয়ার জন্য।
মধ্যযুগের কাহিনী থেকে মুসলিম ও খ্রিস্টানদের মধ্যে বেশ কয়েকটি প্রেম কাহিনী পাওয়া যায়। এর মধ্যে ত্রয়োদশ শতাব্দিতে একটি উল্লেখযোগ্য কাহিনী হচ্ছে কাউন্ট অকেসিন এবং সুন্দরী সারাসিন বন্দি নিকোলেটের রোমান্স। এইসব ঐতিহাসিক পটভূমিতে উপন্যাস রচিত হয়েছে। ইমামুদ্দিন জঙ্গি সেলজুক আর্মির এক তুর্কি অফিসার; ইনি মেসোপটেমিয়া ও উত্তর সিরিয়াতে ক্ষুদ্ররাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন এবং ক্রুসেডারদের কাছ থেকে এডেসা দখল করে নেন ১১৪৪ খ্রিস্টাব্দে। বলা হয়, ইনি খ্রিস্টান দম্পতির সন্তান। খিলিজ আরসালান (মৃ. ১১৭৮) সেলজুল সুলতান ছিলেন। ইনি উত্তর-পূর্ব আনা তোলিয়ায় দানিশমন্দ বংশে মুখ্য ভূমিকা রেখেছেন। বলা হয় ইনিও খ্রিস্টান ওরিজিন।
ক্রুসেড খ্যাত সুলতান সালাদিনের মাতা ছিলেন খ্রিস্টান মহিলা, কাউন্টেস অব পনথিউ, মিসরের উপকূলে জাহাজ ডুবি হওয়ার কারণে সালাদিনের পিতার ঘরণী হন। টমাস বেকেট (মৃ. ১১৭০) ক্যান্টাবেরির আর্ক বিশপ যিনি শহীদ হয়েছিলেন তাঁর মাতা ছিলেন একজন সেরাসিন মহিলা, যদিও বলা হয় যে তিনি ছিলেন নর্মান পিতামাতার সন্তান।
১৩.৪ প্রশাসন
জটিল রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় অল্প অভিজ্ঞ আরবরা নতুন রাষ্ট্রের পুরনো কর্মচারী- কর্মকর্তাদের পদচ্যুত করেনি, অভিজ্ঞ কর্মচারীরা তাদের নিজ নিজ স্থানে বহাল থেকে শিশু মুসলিম রাষ্ট্রের শাসনকার্য চালিয়ে গেছে। দ্বিতীয় খলিফা ওমর চলমান প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা উপলব্ধি করে তাঁর গভর্নরদের নির্দেশ দেন বাইজানটাইন ও সাসানিয়া শাসন ব্যবস্থা চালু রাখতে এবং বিদ্যমান ব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন না করতে (zakaria, 1989 P. 48) ।
উমাইয়া খলিফাদের সময়ে হেলেনিস্টিক ও সাসানিয়ান ব্যবস্থার আরো জোরদার হয়, যাতে আরবীয় ব্যবস্থা এর অনুকরণে গড়ে ওঠে। বার্নার্ড লুই বলেছেন : পার্সিয়ান ও বাইজানটাইন রাষ্ট্র যেমন ছিল, আরব রাষ্ট্র তখন তেমন ছিল না (1966 P. 66)।
খিলাফতের সরকারি প্রধান প্রধান অফিসগুলোতে কর্ণধার ছিল ইহুদি ও খ্রিস্টানরা, যারা গ্রিক ও বাইজানটাইন প্রশাসনে কাজ করেছে। দ্বিতীয় ওমর পরে চেষ্টা করেছিলেন সরকারের চাকরি থেকে ইহুদি ও খ্রিস্টানদের সরিয়ে দিতে, কারণ কোরান মুসলিমদের তাদের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে বলেছে (৫ : ৫৬), কিন্তু এতে এতো গোলযোগ শুরু হয়েছে প্রশাসনে যে খলিফাকে সে আদেশ রহিত করতে হয়।
বেশ কয়েকজন খলিফা খ্রিস্টান সেক্রেটারি ও পরামর্শদাতা নিয়োগ করেছিলেন। সার্জিয়াস (সার্জুন) ইবন মনসুর (মৃ. ৬৮৪) মাবিয়ার প্রধান সেক্রেটারি ও বিশ্বস্ত পরামর্শদাতা ছিলেন এবং পরে আরও তিন খলিফার সেক্রেটারির কাজ করেন। সার্জিয়াসের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সিরিয়ান ধর্মবেত্তা দামেস্কর জন খলিফাদের দরবারে খ্রিস্টানদের প্রতিনিধিত্ব করেছেন এবং উপদেশও দিয়েছেন। বানু ওয়াহাবের খ্রিস্টান সদস্যরা (এদের মধ্যে কয়েকজন মুসলিম হন) উমাইয়াদের সেক্রেটারি রূপে কাজ করেছেন এবং আব্বাসি খলিফাদেরও উপদেশ দিয়েছেন। যে সময়ে আব্বাসি বংশ রাজ্যভার গ্রহণ করে, অনেক খ্রিস্টান তাদের পদে বহাল ছিল। খলিফা মুতাসিমের সেক্রেটারি ফজল ইবন মারওয়ান খ্রিস্টান ছিলেন, পরে তিনি ইসলামে দীক্ষা নেন। স্টেফেনাস (মৃ. ৯৩৫) খলিফা মোক্তাদিরের সেক্রেটারি ছিলেন।
সাধারণত আব্বাসি খলিফারা পার্সিয়ানদের পছন্দ করত এবং সাসানিয়ান মডেলে রাজকার্যে পরিবর্তন আনে। এতে গোঁড়া মুসলিমরা ইসলামবিরুদ্ধ বলে নিন্দাবাদ করে। খলিফা পার্সিয়ান মডেলে দেওয়ান ব্যবস্থা প্রবর্তন করে অর্থ, ট্যাক্স, পুলিশ ও নৌবহরের স্থাপনা করেছে।
সাসানিয়ান শাসন ব্যবস্থার আদলে আব্বাসিরা উজিরের পদ প্রবর্তন করে। উজির অর্থে প্রধানমন্ত্রী বোঝায়। উজির শব্দ সম্বন্ধে চিন্তা করা হয় যে শব্দটি আরাবিক, কারণ কোরানে উল্লেখ আছে যে আরন মুসার উজির (সাহায্যকারী) (২৫ : ৩৭) ছিলেন। কিন্তু এখন এটা পাহলভি (মধ্য পার্সিয়ান) বলে ধরা হয়। আব্বাসি উজিরদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিবার ছিল বার্মা সাইদ-আরাবিয়ান নাইট্স-এ উল্লেখ আছে।
প্রথমে সরকারি ভাষা ছিল দুটা, আরবি ভাষার সাথে সাথে স্থানীয় ভাষাও চালু ছিল। সিরিয়াতে দপ্তরি নথিপত্র দুটি ভাষাতেই ইস্যু হতো— গ্রিক ও আরবিতে; প্যালেস্টাইনে আরামাইক ও আরবি, মিশরে কপটিক ও আরবি; পারসে, পহলভী ও আরবি।
৬৯০ খ্রিস্টাব্দে, আবদুল মালেকের রাজত্বকালে, রাষ্ট্রভাষা আরবি করা হয়। কিন্তু পরবর্তী কয়েক দশক ধরে আরবি ও স্থানীয় ভাষা উভয়ই ব্যবহার করা হয়েছে।
সাম্রাজ্যে সংহতি বজায় রাখার জন্য উমাইয়ারা এবং তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ করার পক্ষে বাইজানটাইন প্রকৌশল ভাড়া করে হাইওয়ে রাস্তা ইত্যাদি তৈরি করান। এতে যোগাযোগের ব্যবস্থা সুপ্রশস্ত হয়। রাস্তাঘাট তৈরি হওয়ার পর ঘোড়ার ডাকের প্রবর্তন খিলাফতের প্রতিটি অঞ্চলে ত্বরিৎ সংবাদ পাঠানোর ব্যবস্থা হয় যাতে প্রদেশের সকল গভর্নরকে রাজ্যের হালচাল সম্বন্ধে ওয়াকিফহাল করা যায়। এতে কর আদায় করা সহজ হয়ে ওঠে।
ইসলাম-পূর্ব কালে, মেসোপটেমিয়া, সিরিয়া, পারস্য রাজ্যে হিসাব বিভাগ ছিল স্থানীয় ইহুদি বা খ্রিস্টানদের হাতে। সাসানিয়ান রাজত্বকালে অর্থ উপদেষ্টা ছিল সাধারণত খ্রিস্টান, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ইয়াদেন (৬২০), যিনি ২ খসরুর প্রধান কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। উমাইয়া খলিফারা রাজ্যভার গ্রহণ করার পর তাঁরা প্রচলিত অর্থনৈতিক কাঠামো রেখে দেন, কোনো রকম পরিবর্তন করেননি t
সুদ, অতিরিক্ত মুনাফা বা ঋণের ওপর অতিরিক্ত অর্থ আদায় বন্ধ করা হয় কোরানের বিধান মতে। কোরান বলে : যারা সুদ খায় তারা সেই ব্যক্তির ন্যায় দাঁড়াবে যাকে শয়তান স্পর্শ দ্বারা পাগল করে। এটি এই জন্য যে, তারা বলে- ক্রয়-বিক্রয় তো সুদের মতো। অথচ আল্লাহ ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল ও সুদকে হারাম করেছেন। যারা সুদ গ্রহণ করবে তারা চিরকাল অগ্নিবাসী হবে। (২ : ২৭৬)। সুদ বন্ধের কারণে কৃষক এবং ব্যবসাদার যার টাকার দরকার তাদের বাধ্য হয়ে নন-মুসলিম সুদখোরদের কাছে হাত পাততে হয়। এর ফলে অর্থনৈতিক কাঠামো ও লেনদেন পুরোপুরি ইহুদি ও খ্রিস্টানদের হাতে চলে যায়। ব্যাংকিং সিসটেমও তারা নিয়ন্ত্রণ করে শুধু খিলাফতি রাজ্যে নয়, বাইরেও। আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যে এবং পণ্য আদান-প্রদানে তারা যথেষ্ট সাহায্য করেছে।
বহু বছর ধরে মুসলিম দেশগুলোতে মুদ্রা আদান-প্রদানে নিয়োজিত ছিল গ্রিক, বাইজানটাইন ও রোমান। দক্ষিণ আরাবিয়াতে এথেন্সের মুদ্রা চালু ছিল আরব বিজয়ের পরেও। আলোক্সজান্দ্রিয়ান বণিক ও ভ্রমণকারী এবং পরে সাধু কসমস ইন্ডিকপ্লিয়াসটেস (মৃ. ৫৬০) লিখেছেন যে, রোমান মুদ্রা ছিল আন্তর্জাতিক মূল্যমানের এবং তার সাহায্যে ব্যবসা-বাণিজ্য চলত। তদ্রূপ বাইজানটাইন মুদ্রার কদর ছিল, এমনকি খিলাফত রাজ্যেও এ মুদ্রার গ্রহণযোগ্যতা ছিল।
৬৯০ খ্রিস্টাব্দে খলিফা আবদুল মালেকের রাজত্বকালে দামেস্কে নতুন ধরনের মুদ্রা তৈরি করা হয় পুরাতন মুদ্রার আদলে; বাইজানটাইন দিনারিয়াসের অনুকরণে স্বর্ণ দিনার এবং বাইজানটাইন ড্রাকমার অনুকরণে রৌপ্য দিরহাম, আর বাইজানটাইন ফলিস-এর অনুকরণে তামার কুলুস বা ফিল্স চালু করা হয়।
১৩.৫ স্থাপত্য
হেজাজের আরবদের বিল্ডিং ট্র্যাডিশন ছিল না বললেই চলে, এমনকি কাবাঘর ছিল সরল, সাদাসিধা চৌকো কাঠামো ডিজাইন। যখন ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দে এই ঘর আগুন ও বন্যায় ধ্বংস হয়ে যায় তার পর এর পুনর্নির্মাণ করে কপটিক খ্রিস্টান শ্রমিকরা। প্রফেট মোহাম্মদ আলিশান রকমের তৈরি ভবনের বিরুদ্ধে ছিলেন। একবার তিনি বলেছিলেন ভবন নির্মাণের জন্য মুসলিমদের বেশি খরচ করা ঠিক নয় এটা লাভজনক নয় (Hughes 1977 P. 178)। তিনি বিশাল ভবন তৈরি করা এবং বেশি অর্থ খরচ করার পক্ষে ছিলেন না। তিনি বলেন মুসলিমদের ভবনের পেছনে খরচ ছাড়া অন্য খরচের জন্য পুরস্কার আছে। কারুকার্য খচিত অধিক অর্থব্যয়ে নির্মিত ভবন যেমন অর্থের অপচয় তেমনি সময়েরও। সময় ও অর্থের মূল্য অনেক, এভাবে খরচ করা ঠিক নয়।
তিনি চার্চ এবং অনুরূপ আকারের স্থাপত্য পছন্দ করতেন না। মদিনার কোথায়ও প্রফেটের মসজিদ ছিল আদিম নির্মাণ কাঠামো তৈরি করা হয়েছিল; অমসৃণ পাথর, কাদার শুকনো ইট ও কাদা দিয়ে তৈরি; ছাদ ছিল খেজুর গাছের পাতা, তাতে ঠেকা দেয়া হয় খেজুর গাছের গুঁড়ি দিয়ে। মদিনার মসজিদে তাই ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির পানি পড়ত আর মেঝে ছিল কাদা-মাটির। ছাদ মেরামত হবে কিনা জিজ্ঞাসা করায় প্রফেট জবাব দেন— ‘না’। মসজিদ হবে সাদাসিধা, মোসেসের ‘বুথ’-এর মতো। মসজিদ ঘর এই অবস্থায় ছিল তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত
বর্তমানে মসজিদে গম্বুজ, আর্চ, মিনার মিম্বার, নিশ (niche – ইমামের বসবার স্থান) সব কিছুই আছে যদিও প্রফেটের সময় এগুলো প্রতীক রূপে ছিল। মসজিদ শব্দ আরবি আরামাইক ‘মাসজেদা’ থেকে আগত (O’Leary, 1927, P. 200) এবং এই মাসজেদাতে খ্রিস্টানরাও প্রার্থনা করেছে।
প্রফেট মোহাম্মদ মদিনার মসজিদে নামাজে নেতৃত্ব দিতেন খেজুর গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে। দাঁড়িয়ে থেকে তিনি ক্লান্ত বোধ করতেন, তখন সাহাবীদের একজন প্রস্ত াব দেন ‘সিরিয়ার চার্চে যেমন দেখেছি, তেমনি আপনার বসার জন্য একটি মিম্বার তৈরি করে দেব কি? প্রফেট রাজি হন; তখন তাঁর জন্য এক বাইজানটাইন কাঠমিস্ত্রি ডেকে উঁচু মিম্বার (পুলপিট) তৈরি করে দেয়া হয়। মিম্বারে তিনটা সিঁড়ি ছিল, একটি বসার। পরে এক হাদিসের বর্ণনা মতে খ্রিস্টানদের অনুকরণে তৈরি মিম্বার বাতিল করা হয়। মিসরে যখন প্রথম মিম্বার তৈরি হয় তখন এর বিরুদ্ধে হৈচৈ ওঠে। ফলে খলিফার আদেশে তা ভেঙে দেয়া হয়।
মদিনার প্রফেটের মসজিদের উত্তর দিকে একটা খণ্ড কালো পাথর বসানো হয় জেরুজালেমের দিকে লক্ষ্য করে। এটাই ছিল কিবলাব নিদর্শন। প্রথমে জেরুজালেমের দিকে মুখ করে নামাজ পড়া হতো; পরে যখন দিক পরিবর্তন করে কিবলা মক্কার দিকে নির্ধারিত হয় তখন সেই কালো পাথর সরিয়ে মক্কার দক্ষিণ দিকে বসানো হয়। উমাইয়া খলিফা ১ম ওয়ালিদের সময় কালো পাথর সরিয়ে দেয়াল কেটে কুলুঙ্গি (Niche) তৈরি করা হয় যা কিবলাকে নির্দেশ করে। এটাকে গোঁড়া মুসলিমরা আপত্তি করে, কেননা এটাও খ্রিস্টানদের অনুকরণে। বর্তমানে এর নাম হয়েছে ‘মিহরাব’।
প্রফেটের সময়ে নামাজের জন্য রাস্তায় হেঁটে নামাজীদের ডাকা হতো। অথবা কোনো ভবনের ছাদে উঠে ডাকা হতো। যেমন কাবাঘরে ছাদে উঠে ডাকা হয়েছিল, মক্কা বিজয়ের সময়। উমাইয়াদের সময় লাইট হাউসের অনুকরণে মিনারেট প্রবর্তন করা হয় আজানের জন্য। একদা এই মিনারা খ্রিস্টান চার্চের অঙ্গ ছিল। এই টাওয়ারে একটা প্রদীপ সারাক্ষণ জ্বালিয়ে রাখা হতো। ‘মিনারা’ শব্দটি সিরিয়াক শব্দ ‘মেনারটা’ এবং হিব্রু শব্দ ‘মেনোরা’ থেকে নেয়া হয়েছে যার অর্থ মোমবাতি।
প্রথম মিনারেট মসজিদে খাড়া করা হয় ৭০৫ খ্রিস্টাব্দে ১ম ওয়ালিদের রাজত্বকালে। তারপর থেকে এই পদ্ধতি চালু হয়ে এসেছে। মসজিদের দেয়াল থেকে উঁচু মিনার তৈরি করার জন্য প্রথমে মোল্লারা আপত্তি তুলেছিল এবং অনেক স্থানে আন্দোলনও হয় কিন্তু পরে সব থেকে যায়। এখন মিনার সারা দুনিয়ার মসজিদের সাথে গড়ে উঠেছে।
মুসলিম স্থাপত্যে অনেক নতুন নতুন অঙ্গ সংযোজন হয়েছে মুসলিম বিশ্বের বাইরে থেকে আমদানি করে। গম্বুজ প্রথমে দেখা যায় এশিয়া মাইনরে, তারপর বাইজানটাইন তাদের স্থাপত্যে ব্যবহার করে। তারপর মুসলিমরা (strzygowski – 1921 P. 271)
এই সিস্টেম শুরু হয়েছিল প্রাক-ইসলামী পারস্যে। সাসানিয়ান রাজমিস্ত্রিদের কাছ থেকে আরবরা এই প্রযুক্তি কাজে লাগায়। কলামের (স্তম্ভ) মাথায় (Capital) যে কারুকার্য তা আরবরা প্রবর্তন করে প্রাচীন কারিগর দিয়ে।
ঘোড়ার খুরের মতো খিলান (Horse shoe arch) তুর্কিস্তানে বুড্ডিস্ট স্থাপত্যকে কপি করা হয়েছিল। সেমি সার্কুলার ও পয়েন্টেড আর্ট সাসানিয়ান ইরান থেকে সিরিয়ায় তারপর মুসলিমরা এর অনুকরণ করে। স্থাপত্যের অন্যান্য অঙ্গ বুড্ডিস্ট ইন্ডিয়া বা সেন্ট্রাল এশিয়া থেকে আমদানি করা হয়েছে।
মুসলিম নগরীর সাথে যে প্রযুক্তি ব্যবহার হয়েছে তা পূর্বেও ছিল মধ্যপ্রাচ্যে প্রাক- ইসলামী আমলে। যে প্যাটানূ মেসোপটেমিয়ান, হেলেনিস্টিক, রোমান, সাসানিয়ান সেন্ট্রাল এশিয়া নগরীতে ব্যবহৃত হয়েছে সেসব উত্তরাধিকার হিসাবে চলে এসেছে ইসলামী রাজ্যে। রাজকীয় প্রাসাদ, ভিলা, মন্দির, চার্চ ও বিভিন্ন রকমের প্রাইভেট বিল্ডিং, যেমন ছিল বিজয়ী মুসলিম শাসকরা, তার সবই অনুকরণ করে শহর নগর গড়ে তুলেছে। এমনকি বাজার-হাটও গড়ে উঠেছে সেই প্যাটার্নে।
প্রাসাদ ও ভবন নির্মাণে বাইজানটিয়ান-হেলেনিটিক লিগেসিও প্যাগন প্রতিবেশীদের কাছে যেমন ঋণী, তেমনি খিলাফতের সময়ে যেসব নগর ভবন গড়ে উঠেছে তার জন্য, মুসলিম স্থাপত্যবিদ্যা বাইজানটিয়ানদের কাছে ঋণী। ২য় আব্দুর রহমান (মৃ. ৭৯৬) যখন কর্ডোভায় পৃথিবীর মধ্যে সুন্দর মসজিদ তৈরি করার মনস্থ করেন তিনি বাইজানটিয়ান থেকে স্থপতি ডেকে পাঠান বিল্ডিং সুপারভাইস করার জন্য।
জানা যায় যে, বাইজানটাইন স্থাপত্যের কয়েকটি উপাদান বিশেষ করে গম্বুজযুক্ত বিল্ডিং যেমন কনস্ট্যান্টিনোপলের সেন্ট সোফিয়ার চার্চ (খ্রিঃ ৫৩৭), কনস্ট্যান্টিনোপল ১৪৫৩ খ্রিঃ দখল করার কয়েক শতাব্দি পূর্বে মুসলিম বিল্ডিং স্টাইলে সুদূরপ্রসারী প্রভাব রেখে যায়। একজন পরিব্রাজক যিনি চতুর্দশ শতাব্দিতে কনস্ট্যান্টিনোপল দর্শন করেন, তিনি অতি উৎসাহের সাথে বলেছিলেন এই বিল্ডিংকে একমাত্র বাগদাদের প্রাসাদের সাথে তুলনা করা যায়।
উমাইয়ারা প্রথম প্রাচীন পারস্য ও বাইজানটাইন স্থাপত্য শিল্পের সুবিধা কাজে লাগায়। তারা এই বিল্ডিং ট্র্যাডিশন আয়ত্ত করে দামেস্কে তাদের রাজধানী সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তারপর অন্য স্থানে যেমন কুসের আমরা ও মাশাত্তা, জেরুজালেমে ডোম অব দ্য রক (Dome of the Rock) তৈরি করে বাইজানটাইন স্থপতি দিয়ে। উমাইয়াদের কয়েকটি মসজিদ নির্মিত হয় খ্রিস্টান কারিগরের সাহায্যে এবং অলংকৃত করা হয় রুপা ও সোনা দিয়ে যাতে এই মসজিদ একমাত্র তুলনীয় ছিল কনস্ট্যান্টিনোপলে খ্রিস্টান ক্যাথিড্রালের সাথে।
দামেস্কে বিশাল মসজিদ নির্মাণ করা হয় সেন্ট জন ব্যাপ্টিস্টের বেসিলিকাতে (চার্চ) যার এক অংশ মসজিদের জন্য ব্যবহৃত হয়। এই বেসিলাকা পূর্বে খ্রিস্টানরা তৈরি করেছিল রোমান মন্দিরের ওপর। যে মন্দির তৈরি হয়েছিল প্যাগনদের উপাসনালয়ের ওপর। দামেস্ক মসজিদের অভ্যন্তর, আইল ও ট্র্যান্সেপ্ট ছিল চার্চের মতো এবং মার্বেল মোজাইক দিয়ে কারুকার্য করা ছিল।
আব্বাসিদের সময় বাইজানটাইন স্টাইল আংশিকভাবে পরিবর্তিত করে পার্সিয়ান সাসানিয়ান স্টাইল প্রবর্তন করা হয় এবং এই দুই প্রাচীন স্থাপত্য স্টাইলে আব্বাসিরা তাদের বিল্ডিং ও ভবন, প্রাসাদ ইত্যাদি নির্মাণ করেছে। এই সময় আর অন্য কোনো স্টাইলে বিল্ডিং বা ভবন তৈরি হয়নি যতদিন না ভারতে মোগল ও পরে অটোম্যান তুর্ক নতুন ধারায় প্রাসাদ, মসজিদ ও ভবন তৈরি করেছে।
মোগল স্থাপত্যে ছিল সেন্ট্রাল এশিয়া ও হিন্দুদের মিশ্র স্টাইল। সম্রাট বাবর (মৃ. ১৫৩০) কনস্ট্যান্টিনোপল থেকে আমন্ত্রণ করে আনেন আলবেনিয়ার বিখ্যাত স্থপতির সাগরেদদের তার মসজিদের কাজের জন্য। ড. কালি কিঙ্কর দত্ত মন্তব্য করেন যে, আগ্রার নিকটে আকবরের (মৃ. ১৬০৫) স্মৃতিসৌধ প্রভাবিত হয়েছিল কম্বোডিয়ার খেমার স্থপতি দ্বারা এবং আসলে এটা তাদেরই কাজ।
মোগল বাদশা ভারতে বহু অর্থ ব্যয়ে প্রাসাদ, স্মৃতিসৌধ, মসজিদ মনুমেন্ট তৈরি করে গেছেন, তার মধ্যে তাজমহল অন্যতম। এমনকি ফতেপুর সিক্রির একটি শহর তৈরি করে সেখানে বসতি স্থাপন করা হয়নি। বলা হয় যে, এই নগরী গড়তে যা খরচ হয়েছিল তা তোলা হয় অতিরিক্ত ট্যাক্স আদায় করে। অনেক শ্রমিককে তাদের মজুরির এক অংশ কেটে রাখা হয়।
যে বিশেষজ্ঞ ও কারিগর তাজমহলের প্ল্যানিং ও নির্মাণের জন্য দায়ী ছিল তাদের আনা হয়েছিল কাইরো, বাগদাদ, শিরাজ, সমরকন্দ, বলখ এবং কান্দাহার থেকে। অনেকে মনে করেন যে, এই মহল নির্মাণে ইউরোপিয়ান স্থপতিদের কাজে লাগানো হয়েছিল (Majumdar 1974, P. 597)।
কথিত আছে যে জেরম ভেরেনিও নামে এক ভিনিসিয়ান তাজমহলে মার্বেল পাথর বাছাই করে দেন যাতে রৌদ-তাপে নষ্ট না হয় এবং এই মহল ডিজাইনও তিনি করেছিলেন। কিন্তু কোন অথরিটি এই গল্প বাতিল করে দেন (Rawlinson, 1954, P. 361)। তবে, এ কাহিনী মনে রাখার মতো। মুসলিমরা তাজমহল নির্মাণের কৃতিত্ব কোনো বিদেশী মাস্টার প্লানারকে দিতে রাজি নয়। তবুও রেকর্ড ও ইতিহাস বলে যে তাজমহলের প্রধান ডিজাইনার ও স্থপতি ছিলেন ওস্তাদ ঈসা অর্থাৎ মাস্টার (জসাস)।
ষোড়শ শতাব্দিতে অটোম্যান তুর্কি যখন ক্ষমতার শীর্ষে তখন একজন খ্রিস্টান বিল্ডার অটোম্যান স্টাইলে স্থাপত্য সৃষ্টি করেন। তিনি যে কতগুলি নতুন স্টাইল পত্তন করেন তার বেশির ভাগ নেয়া হয়েছিল সেন্ট্রাল এশিয়া এবং বাইজানটাইন মডেল থেকে। ইনি ছিলেন বিখ্যাত স্থপতি ইউসুফ সিনান দ্য গ্রেট। সিনানের পিতা-মাতা ছিলেন গ্রিক অর্থোডক্স। তার পিতা ছিলেন কাঠমিস্ত্রি, রাজমিস্ত্রি এবং মাস্টার বিল্ডার। পিতার কাছ থেকেই সিনান স্থপতি টেকনিক আয়ত্ত করেন। অটোম্যান সাম্রাজ্যে নিয়ম মতে এই মেধাবী খ্রিস্টান যুবককে সরকারি চাকরিতে নেয়া হয়। সিনানের প্রতিভা অটোম্যান সুলতানের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং চব্বিশ বছর বয়সে তাকে ড্রাফটসম্যান ও বিল্ডিং-এর কাজে লাগানো হয়।
সিনান অটোমেন ক্লাসিক্যাল স্থাপত্যের জন্য দায়ী। তিনি প্রাসাদ, রাজকীয় লজ, কলেজ, মাদ্রাসা, লাইব্রেরি, হাসপাতাল, জলাধার, গণশৌচাগার, কবরস্থান, ক্যারাভ্যান সরাই, হোস্টেল, ভিক্ষা সদন, শস্যাধার, ঝরনাসহ ২৫০টি প্রকল্প শেষ করেন। এদের মধ্যে অনেক প্রকল্প মুসলিম জগতের উল্লেখযোগ্য অবদান। তার কাজের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল কনস্ট্যান্টিনোপলে সুলতানের মসজিদ; এই মসজিদ সেন্টসোফিয়ার আদলে তৈরি করা হয়। সলেমানের পুত্র ২য় সেলিমের আড্রিয়ানোপলে, বাইজানটাইন চার্চের মডেলে তৈরি মসজিদটিও সিনান কর্তৃক তৈরি হয়েছিল।
সিনানের বিল্ডিং স্টাইল অটোমেন স্থপতিদের প্রেরণা জোগায় এবং পরবর্তীতে যেসব প্রধান ভবন তৈরি বা পুনর্নির্মাণ করা হয়েছিল সেখানে সিনানের স্টাইলের প্রতিফলন ঘটেছে, এমনকি মক্কা ও মদিনার স্থাপত্য শিল্পে।
১৩.৬ পবিত্র নগরী
মদিনার খলিফা ওমর ও ওসমান খ্রিস্টান প্রকৌশলীদের ডেকে কাবাঘরকে বন্যার হাত থেকে বাঁচাবার জন্য খাল ও বাঁধ তৈরি করতে বলেন। হেজাজে চাষাবাদ উন্নয়নের জন্য উমাইয়া খলিফারা গ্রিক প্রকৌশলীদের ডেকে পানি ধরে রাখার জন্য কূপ খনন ও জলাধার তৈরি করান যাতে প্রয়োজনমতো চাষাবাদের জল সরবরাহ করা হয় চাষীদের (Oleary 1927. P. 8)।
সাধারণত উমাইয়ারা পবিত্র নগরী মক্কা ও মদিনাকে অবহেলা করেন। আল- জুহুরি লিখিত একটি ট্র্যাডিশনের দোহাই দিয়ে উমাইয়ারা বলেন যে, প্রফেট মোহাম্মদ মক্কা, মদিনা ও জেরুজালেমকে একইভাবে মূল্যায়ন করতেন, কিন্তু অন্য নগরীর চেয়ে জেরুজালেমকে বেশি শ্রদ্ধা দেখাতেন। দামেস্ক থেকে মক্কা ও মদিনা বেশ দূরে। সেখান থেকে এক দুই পবিত্র নগরীকে নিয়ন্ত্রণ করার চেয়ে পবিত্র নগর জেরুজালেম নিয়ন্ত্রণ করা সহজ ছিল। তাই উমাইয়ারা জেরুজালেমকে মক্কা-মদিনার চেয়ে বেশি মর্যাদা দেন। তাছাড়া প্রথম উমাইয়া খলিফা মাবিয়া এই জেরুজালেম নগরে নিজেকে খলিফা হিসাবে ঘোষণা দেন এবং ৫ম উমাইয়া খলিফা আবদুল মালেক জেরুজালেম শহরকে উন্নয়ন করে ধর্মীয় কেন্দ্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে এবং হজের বিকল্প স্থান করতে মনস্থ করেছিলেন।
বলা হয়েছিল যে, জেরুজালেম সেই স্থান মোরিয়া পর্বতের অবস্থান যেখানে ছাপান্ন ফুট লম্বা, বিয়াল্লিশ ফুট চওড়া এবং প্রায় অর্ধচন্দ্র আকারের পবিত্র পাথর (সাখারা) স্থাপিত হয়েছিল আব্রাহামের পুত্রকে কোরবানি দেয়ার জন্য (অন্য একটি ট্র্যাডিশনে আছে যে কোরবানি ঘটনা মোরিয়া পর্বতে ঘটেনি, ঘটেছে মক্কার নিকটবর্তী পর্বত হাবিবের ওপর)।
আরো বলা হয় যে, এই মোরিয়া পর্বতে প্রফেট দাউদ (ডেভিড) একটি বেদী তৈরি করেন এবং সোলেমান সেই স্থানকে সমতল করে মন্দির নির্মাণ করেন। ঐ স্থানের চূড়ায় পবিত্র স্থানে (হারামআল-শরীফ) দূরবর্তী মসজিদ (আল-আকসা মসজিদ) অবস্থিত। যেখান থেকে প্রফেট মোহাম্মদ মিরাজে যাত্রা করেন। ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে খলিফা ওমর জেরুজালেম জয় করে, জাস্টিনিয়ান যেখানে বাইজানটাইন সেন্ট মেরি চার্চ তৈরি করে তার দক্ষিণ দিকের শেষে ওমর এক কাঠের মসজিদ খাড়া করেন। খলিফা ওমর ভেবেছিলেন যে এই স্থান থেকেই প্রফেট মোহাম্মদ মিরাজে গমন করেন; কিন্তু কেউ নির্দিষ্টভাবে বলতে পারে না আসলে কোন স্থান থেকে প্রফেট মিরাজে যান। আবার এই জেরুজালেমের দিকে মুখ করে মুসলিমরা প্রথমে নামাজ পড়েছিল, মক্কার দিকে নয়। অর্থাৎ মুসলিমদের প্রথম কিবলা ছিল জেরুজালেম। ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে খলিফা আবদুর মালেক বাইজানটাইন স্থপতিদের ডেকে সেই পবিত্র পাহাড়ের ওপর একটা ভবন (edifice) নির্মাণ করতে বলেন যা আজকে ডোম অব দ্য রক (Kobat-at-Sakhra) বলে খ্যাত। এই স্থানটিকে প্রথাগতভাবে সলেমানের মন্দির বলা হয়। খলিফা ঘোষণা করেন যে এই নতুন পবিত্র স্থানে সাত বার চক্কর দিলে কাবাঘরের পুণ্য লাভ হবে; তফাৎ এই যে ডোম অব দ্য রক-এ ঘুরতে হয় ক্লক- ওয়াইজ অর্থাৎ বাঁয়ে থেকে ডাইনে আর কাবাতে ঘুরতে হয় অ্যান্টি ক্লক ওয়াইজ, অর্থাৎ ডাইনে থেকে বাঁয়ে। এই একই সময়ে, খলিফা এক সরকারি আদেশে হাজীদের মদিনার প্রফেটের মাজার জিয়ারত নিষিদ্ধ করেন।
গম্বুজ বিশিষ্ট গোল ইমারতটি ছিল অষ্ট কোণ বিশিষ্ট বাইজানটাইন মডেলে যেমন হলি সেপালকার চার্চ। ডোমটি ছিল কাঠের ভেতরের আস্তরণ ছিল গিলটি করা কারুকার্য খচিত এবং বাইরের দিকে সিসা দিয়ে মোড়া। ডোমটি গোড়াতে সোনার পাত-মোড়া ছিল কিন্তু যখন চুরি হয়ে যায়। তখন এলুমিনিয়াম-সোনা দিয়ে আবার চকচকে করে পবিত্র নগরীর উপযুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। প্রায় সমস্ত উপকরণ যেমন- কলাম (স্তম্ভ) এবং কলামের কারুকার্য করা শীর্ষদেশ (Capital) ইত্যাদি সবই বাইজানটাইন ও রোমান বিল্ডিং থেকে নেয়া হয়েছে এবং কোনো কোনো উপাদান এ চিহ্নও রয়ে গেছে।
বিশ্বাস করা হয় যে, ডোম অব দ্য রকে প্রফেট মোহাম্মদের পদচিহ্ন (খ্রিস্টানরা বলে যিশুর পদচিহ্ন) ও দাড়ির কেশও সংরক্ষিত আছে। ডোম কিন্তু মসজিদ নয় এবং এখান থেকে যে প্রফেট মোহাম্মদ মিরাজে গিয়েছিলেন তার চিহ্নও নেই।
ডোম অব দ্য রকের একটু দূরে অবস্থিত ঊর্ধ্বগমনের ডোম (কোবাত-আল মিরাজ) এবং অনেকের মতে এটাই সেই স্থান যেখান থেকে প্রফেট মোহাম্মদকে স্বর্গে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
৭১২ খ্রিস্টাব্দে উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদ ওমরের কাঠের মসজিদ ভেঙে ফেলেন এবং বাইজানটাইন স্থপতি ও মাস্টার কারিগর দিয়ে আর একটি মসজিদ গড়ে তোলেন। এই মসজিদ হলো আল-আকসা মসজিদ।
বলা হয় এই মসজিদ সেই স্থানে নির্মিত যে স্থানে প্রফেট মোহাম্মদ ঊর্ধ্বে গমনের জন্য রফরফ বা বোরাকে আরোহণ করেন। এই মসজিদের মিম্বারের পেছনে একটা পাথর আছে যে পাথর যিশুর ঊর্ধ্বগমনের চার্চ থেকে আহরিত। এই পাথরে যিশুর পদচিহ্ন আছে, কেননা ঊর্ধ্বগমনের পূর্বে এই পাথরে যিশু পা রেখেছিলেন। এই মসজিদের ওপরে খলিফা ওয়ালিদ কাঁসার ডোম উপস্থাপিত করেন। এই কাঁসার ডোমটি সরানো হয়েছিল বালবেকের খ্রিস্টান চার্চ থেকে। (বালবেক লেবাননের প্রাচীন নগরী)। এক ভূমিকম্পে এই মসজিদ ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে এটা পুনর্নির্মিত হয় ৭৮০ খ্রিস্টাব্দে, রৌপ- ডোম-সহ, আব্বাসি খলিফা মেহদির রাজত্বকালে। উমাইয়ারা যখন দামেস্ক এবং জেরুজালেমকে তিলোত্তমা নগরীতে পরিণত করেছিলেন তখন আরব পেনিনসুলা ছিল অবহেলিত ইসলাম-পূর্ব গোত্র-আরবের রূপ ধারণ করে। প্রফেটের মৃত্যুর ৩০ বছর পর আরাবিয়া উমাইয়া খিলাফতের একটা হতচ্ছেদ্দা প্রদেশে পরিণত হয়, শুধুমাত্র হজের কেন্দ্রভূমি আর কিছু নয়। ৬৮০ সালের মধ্যে মক্কার ধর্মীয় জীবন বলতে গেলে শূন্যের কোঠায় এসে দাঁড়ায়। সব ধরনের আবিলতায় পরিপূর্ণ নগরী, পাপকর্ম ফ্রি-স্টাইলে। তীর্থ যাত্রীদের নৈতিক পরিবেশ পঙ্কিলতায় আবর্তিত। রাস্তায় রাস্তায় বক্তৃতাসহ সান্ধ্যভোজের আয়োজন; এমনকি মসজিদে থেকে কারণ বরির কারবার।
মদিনার অবস্থাও তথৈবচ। প্রফেটের সময় মদিনার যে কদর ছিল উমাইয়াদের সময় এ শহর পূতিগন্ধময় (আল-নাতনা) এবং নোংরা (আল-খাবিতা)।
সহসা এই নগরী দুষ্কৃতকারী ভোগ সুখপরায়ণ ব্যক্তিদের লীলাক্ষেত্র হয়েও ওঠে বাইজী, বেশ্যা, ক্রীতদাসী ও তরুণ বালকদের ঘিরে মাতলামো; তাড়ি, গাঁজা ও বেশ্যালয়ের স্বর্গোদ্যান। পৃষ্ঠপোষকদের মধ্যে যারা এই স্বর্গোদ্যানে ঘনঘন আসা- যাওয়া করতেন তারা অনেকেই সাহাবীদের সন্তান ছিলেন।
এই দুই পবিত্র নগরীর দুর্দশা আরও বেড়ে গিয়েছিল মাবিয়া পুত্র ১ম এজিদের সময় এবং ৬৮২ সাল থেকে ৬৯০ সাল পর্যন্ত বেশ কয়েকটি অভিযান চালানো হয়েছে এই দুইটি নগরীর বিরুদ্ধে। মদিনার বিদ্রোহীদের সিরিয়ান সেনাবাহিনী দিয়ে খলিফা বিদ্রোহী সমূলে উপড়ে দেন, নগরী আক্রমণ করে গণহত্যা চালানো হয় আর মদিনার মসজিদকে আস্তাবলে পরিণত করা হয়। কিছু দিনের জন্য এই পবিত্র নগরী বন্য পশুদের বিচরণ ভূমিতে পরিণত হয় (Ameer Ali, 1965, P. 303)।
মক্কা বিদ্রোহও নৃশংসভাবে দমন করা হয়। উমাইয়াদের সিরিয়ান পদাতিক বাহিনী নগরী অবরোধ করে কাবাঘরে আগুনের গোলা নিক্ষেপ করা হয়; এই গোলার একটি কালো পাথরে আঘাত হেনে তিন টুকরো করে দেয়; (Esin, 1983, P. 134)। নিক্ষিপ্ত আগুনের গোলায় কাবাঘরের অধিকাংশ ধ্বংস হয়ে যায়। কারাঘরের এই বিপজ্জনক অবস্থায় মনে হচ্ছিল যে এখনি হয়তো গোটা কাঠামোটা ধসে যাবে।
আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি অতি কঠোরতার সাথে নরম্যাল করে আনেন হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। খলিফা আবদুল মালেক সন্তুষ্ট হয়ে হাজ্জাজকে ইরাকের গভর্নর পদে প্রমোশন দেন। মক্কার বিদ্রোহীদের নেতা ও গভর্নর আবদুল্লাহ ইবন জুবায়েরকে হত্যা করে তার শির নগরীর গেটে প্রদর্শিত হয়।
যখন উমাইয়ারা দুইটি পবিত্র নগরীর উন্নয়নের দিকে দৃষ্টিপাত করল তখন তারা পুরনো ভবনগুলোকে ভেঙে নতুন করে গড়ার কাজে হাত দিল। আসন্ন পুনর্নির্মাণে দুটি নগরীকে এক প্রকার ঢেলে নতুন রূপ দেবার চেষ্টা করে। মক্কা-মদিনার গোত্রদের নির্মাণ কাজে অভিজ্ঞতা না থাকায় এই দুই নগরীতে বিদেশী শ্রমিক, খ্রিস্টানসহ এনে শহর ভরিয়ে দেয়। মক্কা-মদিনার পবিত্র কাবাঘর ও মদিনার প্রফেটের মসজিদের পুরনো কাঠামো বদলিয়ে নতুনভাবে নির্মিত হয়। কাবাঘরের চারদিকে কয়েকটি কলামের (স্তম্ভ) স্থলে গ্রিসীয় স্থাপত্যের কলাম জুড়ে দেয়া হয়। কোবাতে ইসলামের প্রথম মসজিদ যেখানে প্রফেট নিজে হাত লাগিয়েছিলেন, ভেঙে বড় করা হয়; পরে পুরানো কাঠামো ভেঙে দিয়ে কারুকার্য খচিত নতুন মসজিদ নির্মিত হয়। এইসব মেরামত কাজের জন্য আরবরা অভিযোগ করে এই বলে যে, পবিত্র মসজিদ ভেঙে সেই স্থানে চার্চ তৈরি করা হয়েছে।
খলিফা ১ম ওয়ালিদ মদিনার প্রফেটের মসজিদ ভেঙে দিয়ে পুনর্নির্মাণ করেন। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হলে তা অগ্রাহ্য করা হয়। প্রথমে মসজিদের বহির্দেয়াল ভাঙতে শুরু করলে প্রফেট মোহাম্মদের স্মৃতিসৌধ (মওসোলিয়াম) ধসে যায় এবং যে স্থানে প্রফেট আবুবকর ও ওমরকে কবরস্থ করা হয় তার মাটি বের হয়ে পড়ে। ওমরের কবর ভেঙে যায় এবং অভ্যন্তর দৃশ্যমান হয়। প্রফেটের স্মৃতিসৌধের নির্মাণকর্ম আলীর অনুসারীদের দিয়ে সম্পন্ন করা হয়।
নতুনভাবে প্রফেটের মসজিদ নির্মিত হলে আশপাশের স্থান প্রশস্ত করতে গিয়ে প্রফেট ও তাঁর পরিবারের বাসস্থান মাটির সাথে মিলিয়ে দেয়া হয়, ফাতেমার বাড়ি ভেঙে দেয়া হয় এবং তার খেজুর বাগানের গাছগুলোকে উপড়ে ফেলা হয় এবং সেখানে আর যারা বাস করত তাদের উচ্ছেদ করা হয়। এই নতুন মসজিদের জন্য গ্রিক সম্রাট ২য় জবাস্টিয়িন সোনার বার, কারুকার্য করা রৌপের বাতি এবং চল্লিশটি উটের পিঠে পাথরের খণ্ড বোঝাই করে উপহার স্বরূপ পাঠান। তার সাথে পাঠিয়ে দেন একশো জন কপটিক ও গ্রিক খ্রিস্টান ওস্তাগার কারুকাজ করার জন্য ও মোজাইক করার জন্য অভিজ্ঞ মিস্ত্রি পাঠিয়ে দেন।
মক্কার পুনর্নির্মাণ মদিনার মতো ঢেলে সাজানো হয়। আমিনার বাড়ি যেখানে প্রফেট জন্মগ্রহণ করেন, ভেঙে বড় করা হয় এবং সুসজ্জিত করা হয়। পরে এই ভবন উমাইয়া গভর্নরের আবাসভূমিতে পরিণত করা হয়। মক্কার মহান মসজিদ (মসজিদ আল-হারাম) প্ল্যানিং ও পুনর্নির্মাণের আদেশ হয় যে প্ল্যানিংয়ে গ্যালারি ঝাড়বাতি থাকবে। এখানেও সিরিয়া ও মিসর থেকে খ্রিস্টান স্থপতি আমদানি করা হয় নির্মাণকর্ম সুসম্পন্ন করার জন্য। এই সময়ে বিদেশ থেকে বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি প্রতিনিধি এসে ভিড় জমান বিশেষ করে মুসলিম দেশ উত্তর আফ্রিকা ও মধ্য এশিয়া থেকে প্রতিনিধি আসে এবং তারা মক্কাতে নতুন অফিস প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে কাবাঘরে যে দরজা বসানো হয়েছে তা ১৬৩৩ সালে ইস্তাম্বুল থেকে আনা হয়।
পরবর্তী সময়ে এই দুই পবিত্র নগরীতে গোত্রযুদ্ধ লেগেই ছিল। পবিত্র স্থানগুলো ক্ষতি হয়েছে, সম্পদ লুটপাট হয়েছে এবং যারা এই দুই পবিত্র স্থানের, কাবাঘর ও প্রফেটের মসজিদ, হেফাজতকারীরাই এই লুটপাটে অংশগ্রহণ করেছে। মোট কথা লোভী শাসক ও সরকারি কর্মকর্তারা এ ধরনের নাশকতামূলক কাজে জড়িত ছিল এবং শতাব্দি ধরে অরাজকতা বিরাজ করেছে। ১০২০ খ্রিস্টাব্দে ৬ষ্ঠ ফাতেমিদ খলিফা হাকাম মদিনাতে তার এজেন্ট পাঠিয়েছিলেন প্রফেট মোহাম্মদ, আবু বকর ও ওমরের দেহ কবর থেকে তুলে মিসরে নিয়ে যেতে, কিন্তু এই উদ্যোগ ব্যর্থ হয়।
১২৫৬ খ্রিস্টাব্দে মদিনায় প্রফেটের মসজিদ ভূমিকম্পে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তারপর জ্বলন্ত বাতি থেকে আগুন লেগে আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
১৪৯০ খ্রিস্টাব্দে প্রফেটের স্মৃতিসৌধ এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় যে প্রফেটের, আবু বকরের ও ওমরের কবর নিশ্চিহ্ন হয়েছিল এবং পরবর্তীতে আর চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। ট্রাডিশন মতে জানা যায়, যে কবরগুলো দক্ষিণ দিকের দেয়ালের কাছাকাছি ছিল এবং এখানে নতুনভাবে চিহ্নিত করে নতুন কবর নির্মিত হয় প্রায় সঠিক স্থানে (Esin 1963, P. 160) এবং যখন এই পবিত্র কর্ম প্রক্রিয়াধীন ছিল তখন ঐ স্থানে সশস্ত্র প্রহরী পাহারায় ছিল যাতে বেদুইন ও দস্যুদের প্রতিহত করা যায়।
ওহাবী গোষ্ঠী ১৭৩৫ খ্রিস্টাব্দে পত্তন হয় এবং ১৮০৩ সালে ওহাবীরা এই দুই নগরী দখল করে। তারা অনেক মাজার ধ্বংস করেছে এবং বহু উপহারদ্রব্য সরিয়ে ফেলেছে কারণ তাদের মতে এই সব বস্তু মূর্তিপূজার শামিল। যেহেতু ইসলামের প্রথম দিকে মিনারেট অজানা ছিল তাই ওহাবীরা যেখানে গেছে সেখানকার মিনারেট ভেঙে দিয়েছে (Highes, 1977, P. 662)। মক্কায় হিরা পর্বতের উপরে একটি বিশিষ্ট পবিত্র মাজার ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। এই মাজার তৈরি করা হয়েছিল সেই গুহার উপর যেখানে প্রফেট মোহাম্মদ প্রথম ওহিপ্রাপ্ত হন। মদিনাতে প্রফেটের মাজারে সব গহনা, স্বর্ণ খুলে নেয়া হয়, পুড়িয়ে দেয়া হয় দামি গেলাফ আর গম্বুজ ভেঙে ফেলা হয়। মদিনার বাইরে বাকি কবরস্থানে, যেখানে প্রফেট মোহাম্মদ ও তার সাহাবীরা জেয়ারত করতে যেতেন, ভেঙে সমান করে দেয়া হয়।
১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে অটোমেন তুর্কিরা মদিনার প্রফেটের মসজিদের অনেক পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মক্কার শেরিফ যুদ্ধে যোগ দেয়ার কারণে সাধারণ মানুষের যে ভোগান্তি হয় তার জন্য প্রতিবাদ জানালে, তুর্কি বিমান বাহিনী শেরীফের প্রাসাদে বোমা মেরে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এই বোমাবাজির জন্য কাবাঘরেরও ক্ষতি হয়।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিভিন্ন সময়ে শাসন কর্তাদের দুরাচরণের ফলে মক্কা-মদিনার ভবন ও মাজারের সাবেক অবস্থা (Originality) টিকে থাকেনি। এখন যে কাঠামো নিয়ে পবিত্র স্থানগুলি দাঁড়িয়ে আছে, সেগুলো উমাইয়া ও আব্বাসি খলিফাদের নতুন করে গড়া, পরে অটোমেন তুর্কি ও সৌদিরা এসবের পুনর্নির্মাণ করেছে। অতীতের চিহ্ন কুচিৎ দেখা যায়।
১৩.৭ শিল্পকলা
প্রফেট সঙ্গীত ও কবিতা অনুমোদন করেননি এবং সাধারণত শিল্পকলাকে নিরুৎসাহিত করেছেন এবং বলেছেন এসব বাজে চর্চা। তিনি বিলাসিতার নিন্দা করেছেন বিশেষ করে সোনা-রুপার গহনা ও সিল্কবস্ত্র পরিধান করা পছন্দ করতেন না। ইসলামী আর্টকে তাই বলা হয় প্রথাবিরুদ্ধ।
কোরান মূর্তিপূজা (আসনাম; একবচনে সানাম) নিষিদ্ধ করেছে (১৪ : ৩৮)। এই নিষিদ্ধকরণের জন্য সব ধরনের মূর্তি বা ভাস্কর প্রতিমূর্তি বা কোনো জীবন্ত প্রাণীর ছবি আঁকা বারণ। প্রফেট মোহাম্মদ অভিশপ্ত করেছেন তাদের যারা মানুষ বা প্রাণীর ছবি আঁকে বা প্রতিমূর্তি গড়ে। এমনকি শিশুদের জন্য পুতুল খেলাও নিষিদ্ধ; শিশুর হাতে পুতুল দেখলে তা তখনি ভেঙে ফেলা হয়েছে। মুসলিম ধর্মবেত্তারা বলেন, যে কোনো বস্তু যা মানুষের মনকে ধর্ম-বিমুখ করে তাকে সন্দেহের চোখে দেখতে হবে। পারস্যে শিল্পকলা দেখে আরবদের মনে যে মুগ্ধতা এনেছিল অর্থোডক্সের মতে তা শয়তানি কর্ম বলা হয়েছে।
ইসলামী আর্ট ইউরোপীয় বা চীনা আর্ট বলে ধরা হয় না। মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামের কালে যে শিল্পকলা গড়ে উঠেছিল তা জ্যামিতিক এবং ফ্লোরাল-পুষ্প সম্বন্ধীয়। এছাড়া টেক্সটাইলে নাম আরবি ফর্মে ইংরেজি ভাষায় পরিচিতি পেয়েছে- যেমন মোসুল থেকে মসলিন, দামাস্কাস থেকে দামেস্ক; বালাদাশিন বাগদাদ থেকে, ফাসতিয়ান ফুসটাত (প্রাচীন কাইরো) থেকে; পার্সিয়ান থেকে টাফেট ও শাল এবং রং ও কাপড় উভয় ব্যবহার করে ট্যাব্বি (এটাও পারস্য থেকে)। এই আরবি শব্দের ব্যবহার থেকে অনেক পণ্ডিত ব্যক্তি মনে করেন যে, (যা সঠিক নয়) ঐসব কাপড় মুসলিম বিশ্ব থেকে সর্বপ্রথম তৈরি হয়েছে।
পারস্যের সূক্ষ্ম টেক্সটাইল (বিশেষ করে শাল) ও সিরিরা, মিসর ও মধ্য এশিয়া থেকে উৎপাদিত দ্রব্য উন্নত ছিল মুসলিম উত্থানের পূর্ব থেকে। বাইজানটাইন তাঁতিদের দ্বারা বিভিন্ন ধরনের নকশাসহ মূল্যবান কাপড় তৈরি হতো। গাছগাছালি থেকে রং বের করত এবং সোনা ও রুপার সুতা দিয়ে সূচিকর্মও করত। তখন প্রফেট মোহাম্মদের জন্ম হয়নি। কাপড় ও টেক্সটাইল ছাড়া কাঠের আসবাবপত্র, সোফা, তোষক, ডিভান ইত্যাদি তৈরি করত তখনকার কারিগররা। নির্মাণ কাজে বিল্ডিং তৈরি, স্টোর হাউস; ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে টেরিফ, চেক; খাদ্য ও পানীয় যেমন শরবত, কফি, দই, হালওয়া, কাবাব এবং পোলাও এসবেরও চালু ছিল।
এটা সত্য যে শিল্পকলা ক্ষেত্রে দেওয়ার চেয়ে আরবরা অন্যের কাছে ধার করেছে বেশি। ইসলামিক সাম্রাজ্যে বিভিন্ন দেশের মধ্যে অতিদ্রুত ক্র্যাফ্ট ও দক্ষতার আদান-প্রদান হয়েছে, এর মধ্যে বিদেশী শিল্পকলার বেশি প্রভাব ফেলে ইসলামিক আর্টকে উন্নত করেছে। কপাটিক ও আবিসিনিয়ান শ্রমিকদের মক্কা ও মদিনাতে, বাইজানটাইন ক্র্যাফটসম্যান উমাইয়াদের জন্য কাজ করেছে, আর্মেনিয়ান রাজমিস্ত্রিদের নিয়োগ করা হয়েছিল মুরিশ স্পেনে এবং স্থপতিদের আনা হয়েছিল মধ্য এশিয়া থেকে। তারা মরক্কো থেকে মোগল ভারতে বিল্ডিং নির্মাণে কাজ করেছে।
এটা প্রতিষ্ঠিত যে ইসলামের অনেক পূর্বে সিরামিক আর্ট ও ক্র্যাফট-এ রঙিন টাইলস ও কলসিসহ হাতির দাঁতের কাজ, কার্পেট তৈরি করা, মোজাইক করা, ফ্রেসকো, বই বাঁধাই, ক্ষুদ্র পেন্টিং-এর কাজ, পাণ্ডুলিপির কাজ এবং কুটির শিল্প এই সমস্ত এন্টিক ও ক্র্যাফটের চরম উৎকর্ষতা প্রকাশ পেয়েছে মিসরে, মেসোপটেমিয়ায়, পারস্যে ও বাইজানটিয়ানে। সাসানিয়ান ও বাইজানটাইন, তাদের রাজত্বকালে এই সব শিল্পকর্ম ধার করেছিল দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা, নিকট প্রাচ্য এবং মধ্য এশিয়া থেকে।
খ্রিঃ পূঃ ৬ষ্ঠ শতাব্দি থেকে মধ্যপ্রাচ্যে সব রকমের মেটাল বা ধাতু শিল্পে- যেমন তামা, ব্রোঞ্জ, রুপা ও সোনার কাজ অতি উন্নত ছিল। মোঘলের বিখ্যাত ধাতুর শিল্প এবং দামেস্কের তরবারি বিশ্বখ্যাত ছিল। তাছাড়া এনামেলের কাজ, মীনার কাজ তৃতীয় খ্রিস্টাব্দে রোন ও দানিয়ুব উপকূল থেকে এসেছিল বাইজানটিয়ানে এবং চরম উৎকর্ষতা লাভ করে।
খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতাব্দির মধ্যে কাচের উপরে কারুকর্ম এসেছিল টলেমি আলেকজান্ডার থেকে সেলুসিড দামেস্কে। সিরিয়ানদের অতি সূক্ষ্ম কাচের কাজ যথেষ্ট সুনাম অর্জন করে। বাইজানটাইন শিল্পীরা প্রাকৃতিক আর্ট-চমৎকার নমুনা আঁকতে পারত, জীবন্ত প্রাণীর প্রতিকৃতি থাকার বিরুদ্ধে নিষেধ থাকা সত্ত্বেও উমাইয়ারা বাইজানটাইন শিল্পীদের তাদের ও বাড়িঘরে মানুষ ও জীবজন্তুর ছবি আঁকিয়েছে। মানুষ ও প্রাণী ছাড়া বাইজানটাইন শিল্পীরা জ্যামিতিক আর্টে যথেষ্ট দক্ষ ছিল। ঐতিহাসিক এ.এইচ. ক্রিস্টি লিখেছেন যে, ইসলামী আর্ট আরবদের একমাত্র অবদান ছিল। আরবি বর্ণমালা (আর্নল্ড ও গিয়োম ১৯৯৫ ১১০ পৃষ্ঠা); আরব ছাড়া ক্যালিওগ্রাফিতে খ্রিস্টান শিল্পীদের অবদান ছিল। ক্যালিগ্রাফি স্টাইলে অনেক পাণ্ডুলিপি চিত্রিত করা ছাড়া বিল্ডিং মনুমেন্টে কুফিক স্টাইলে কোরানের আয়াত ও কলেমা উৎকীর্ণ হয়েছে- খ্রিস্টান ক্যালিগ্রাফারদের মধ্যে আকুলার নাম উল্লেখযোগ্য।
১৩.৮ সঙ্গীত
লায়াল (Lyall) বলেছেন, আরবে প্রথম দিকে কোনো স্থানীয় সঙ্গীত প্রথা ছিল না বললেই চলে এবং ইসলামের ব্যাপকভাবে সাম্রাজ্য বিস্তারের পূর্বে অনেক বছর ধরে সঙ্গীতের চর্চা ছিল না। (1930, P. 37) তারা শুধু কয়েকটি আদিম মন্ত্র সুর করে উচ্চারণ করত যাতে শুধু একঘেয়েমি ছিল।
প্রফেট মোহাম্মদ সঙ্গীত অনুমোদন করেননি। ইবন ওমর বর্ণিত একটি হাদিসে (৬৬০ সালের দিকে) বলা হয়েছে, বাঁশির সুর শুনতে পেলে তিনি কানে আঙুল দিতেন। আর একটি হাদিসে আছে যেখানে তিনি আলীকে নির্দেশ দিয়ে বলেছিলেন ঈশ্বর যেমন আমাকে পাঠিয়েছেন, আমিও তোমাকে পাঠিয়েছি সব বাঁশি ও কাঁসি ভেঙে দিতে যেহেতু এটা প্রফেটের শিক্ষার বিপরীতে। তাই সঙ্গীত বাজনা মসজিদে নিষিদ্ধ হয়েছে এবং ধর্মীয় ব্যাপারে এর কোনো ভূমিকা নেই।
কিন্তু প্রফেটের জন্মের আগে থেকে আরবে সঙ্গীত আরব গোত্রের মধ্যে প্রচলিত এবং জীবনে এর গুরুত্ব অনেক। ইসলাম প্রবর্তিত হওয়ার পরেও ঘাসান ও হীরার আরব সাম্রাজ্যে বাইজানটাইন (গ্রিক) ও সাসানিয়ান (পারস্য) থিওরি ও প্র্যাকটিস উভয় ক্ষেত্রে সঙ্গীত অত্যন্ত উন্নত পর্যায়ে ছিল।
সঙ্গীতের আরবি সমশব্দ ছিল ‘মুসিকা’। উৎসবে ও ভোজসভায় সিরিয়া থেকে গ্রিক গায়িকা ও মেসোপটেমিয়া থেকে পার্সি গায়িকা আসত আনন্দ দান করত। তারা নিজের ভাষায় গাইত, আরবদের দেখেই শাস্তি। আব্বাসী খিলাফতকালে পার্সি বাজনা ও সঙ্গীত খুব জনপ্রিয় ছিল কিন্তু গ্রিক বা গ্রিক গায়িকাদের চাহিদা ছিল বেশি। কথিত আছে যে, একজন দর্শনপ্রার্থী খলিফা মামুনের (মৃ. ৮৩৩) দরবারে এসে দেখে বিশ জন গ্রিক গায়িকা হাতে জলপাই গাছের শাখা ও গলায় ক্রস ঝুলিয়ে মূল্যবান পোশাক পরে ঘিরে ঘিরে নাচছে, তবে যেহেতু সঙ্গীত নিষিদ্ধ ছিল বলে তারা গান গায়নি।
আরবে সঙ্গীত চর্চা শুরু হলো দর্শন ও আধ্যাত্মিক চর্চার নামে নবম শতাব্দি থেকে যখন গ্রিক সঙ্গীতে বইপত্র আরবিতে অনুবাদ হতে লাগল। পিথাগোরাস (৫০০ খ্রিঃ পূ.), এথেন্সের অ্যারিসটোক্সেনাস (মৃ. ৩০০ খ্রিঃ পূ.), কনস্ট্যান্টিনোপলের থেমিসটিয়াস (মৃ. ৩৮৮ খ্রিঃ) এবং আলেক্সান্দ্রিয়ার সিমপ্লিকিয়াস পর্যন্ত সঙ্গীতের যত ক্লাসিকেল নোটেশন ছিল, অনূদিত হয়ে গেল।
মুসলিম লেখকদের মধ্যে মাসুদী (মৃ. ৯৫৬) সঙ্গীত সম্বন্ধে কয়েকটি পুস্তক রচনা করেন। এই সব পুস্তকে তিনি আরবের প্রাথমিক সঙ্গীতের ধারা ও বিদেশী সঙ্গীত সম্বন্ধে আলোচনা করেছেন। পার্সিয়ান পণ্ডিত ইস্পাহানের আবুল ফজল আল- ইস্পাহানী বলে বেশি পরিচিত, তিনি আরবি সঙ্গীতের সমঝদার ছিলেন এবং তিনি আরব গায়ক, সুরকার ও কবিদের নিয়ে ২১ খণ্ডের বিশ্বকোষ রচনা করে গেছেন। আরব ও পারস্য থেকে যেসব যন্ত্র সঙ্গীত সেই সময় প্রচলিত ছিল তার কিছু নাম ইংরেজি ভাষায়, ইউরোপীয় ভাষায় ধারণ করা হয়েছে যেমন লিউট, রেবেক, গিটার, তাবোর, বান্দোর, ও স্যাকবাদ। এই সব বাদ্যযন্ত্র তৈরি হয়েছিল প্রাচীন মিসর, ব্যাবিলন, গ্রিস ও পারস্যে। তুর্কিস্তানের দার্শনিক আল ফারাবি (মৃ. ৯৫০) আরব সঙ্গীত থিওরির ওপর কাজ করে বিখ্যাত হয়েছেন। তিনি কিবোর্ডসহ একটি বাদ্যযন্ত্র আবিষ্কার করেন। প্রাচীন প্রিমিটিভ হারমোনিয়ামের মতো। এই যন্ত্রের তিনি নাম দেন ‘উরঘানাম’- যার গ্রিক নাম ছিল অরগ্যানন। আল-ফারাবির শিক্ষক ছিলেন একজন গ্রিক।
ইসলামী রহস্যবাদে সুফিদের মাধ্যমে সঙ্গীত একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। সুফিরা এই সঙ্গীত বলতে গেলে খ্রিস্টান সাধুদের কাছ থেকে গ্রহণ করেছেন। সঙ্গীতের সুরের মাধ্যমে আধ্যাত্মিকভাবে লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়। সে সম্বন্ধে ভাববাদী সুফিরা নিঃসন্দেহ হয়েছেন। সুফি, রহস্যবাদী জুন নুন (মৃ. ৮৫৯) লিখেছেন যে, সঙ্গীতের ওপর স্বর্গীয় প্রভাব আছে এবং যারা শোনে আধ্যাত্মিকভাবে, তারা ঈশ্বরের নৈকট্য লাভ করে। পার্সিয়ান দার্শনিক আল-গাজ্জালী (মৃ. ১১১১) লিখেছেন যে কোরান পাঠের চেয়ে গান করলে মোহান্বিত অবস্থায় (ecstacy) জলদি পৌঁছানো যায় (H. G. Farmer, in Amold and Guillaume 1965, P. 359)।
১৩.৯ শিক্ষা
প্রাচীন পারস্যবাসী শিক্ষা ও জ্ঞানকে বেশি গুরুত্ব দিত এবং জোরাস্ত্রিয়ান সাধু, ম্যাগিয়া জ্ঞানসমৃদ্ধ ছিলেন। মহামতি আলেকজান্ডার পারস্য একামিনিয়ে রাজধানী পার্সিপলিস আগুন লাগিয়ে আংশিক ধ্বংস করেন এবং সেখানকার বিখ্যাত লাইব্রেরির সমস্ত পুস্তকাদি ও পাণ্ডুলিপি সম্পদ পাঁচ হাজার উট ও দশ হাজার গাধা গাড়ি বোঝাই করে ৩৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রতিষ্ঠিত তার নতুন রাজধানী আলেক্সান্দ্রিয়ায় পাঠিয়ে দেন।
এই পাণ্ডুলিপিগুলো দিয়ে টলেমিরা আলেক্সান্দ্রিয়ার বিখ্যাত লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ এনে দেয় এবং ৪র্থ শতাব্দির (খ্রিঃ) মধ্যে এই লাইব্রেরিতে সাত লক্ষ ভলিউম এবং দুই লক্ষ স্ক্রল ধারণ করতে সক্ষম হয়, যদিও মাঝে মধ্যে আগুন লেগে কিছু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
লাইব্রেরিসহ শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছিল টলেমি ও সেলুসিড বা তাদের বিজিত রাজ্যগুলোতে। ইসলামী স্কলার মাকরিজী লিখেছেন যে, ইসলাম-পূর্ব মিসর ও মধ্য প্রাচ্যের অন্যান্য দেশে জ্ঞানের ভাণ্ডার (দারুল হিকমা) বা দারুল ইস্ম যেখানে পণ্ডিত ব্যক্তিরা বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিতেন, এরূপ অনেক একাডেমি পরবর্তীতে খ্রিস্টানদের শিক্ষার কেন্দ্রভূমিতে পরিণত হয়। আলেক্সান্দ্রিয়া, দামেস্কাস, এন্টিয়ক, এলেপ্পোর শিক্ষা কেন্দ্রগুলো বাইজানটাইন সম্রাটের অধীনে পরিচালিত হয়েছে। তখন বাইজানটাইনদের রাজধানী ছিল কনস্ট্যান্টিনোপল। এই কনস্ট্যান্টিনোপলে পরে একটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ৪২৫ খ্রিস্টাব্দে। খ্রিস্টান আরবদের মধ্যে সিরিয়ার গোত্র ও ঘাসানের স্কলারগণ এইসব শিক্ষা কেন্দ্র ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাইজানটাইন পৃষ্ঠপোষকতার সুবিধা গ্রহণ করেছে।
অন্যান্য শহরে – যেমন এডেসা, নিসিবিস এবং সোদুসিয়া নেস্টোরিয়ান খ্রিস্টানদের শিক্ষা কেন্দ্র ছিল। এডেসায় (আধুনিক উরফা) একটা বিখ্যাত নেস্টোনিয়ান কলেজ ছিল যেখানে সিরিয়াক স্টাডিজের বিশেষত্ব ছিল। মেসোপটেমিয়ার আরব গোত্র এবং হিরার লাখমিদ গোত্র সাসানিয়ান শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে।
টলেমি ও সেলুসিডদের মতো সাসানিয়ানরাও তাদের রাজ্যে শিক্ষা বিস্তারের প্রয়াসী ছিল। এশিয়ায় বলখে তাদের সবচেয়ে প্রাচীন কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়, (বখ হচ্ছে আধুনিক ওয়াজিরাবাদ)। আরবদের কাছে বল্খ ‘শহরের মাতা’ (উম্মুল বিলাদ) বলে পরিচিত। কথিত আছে, এই বখে জোরাস্টার খুন হয়েছিলেন।
৩২৮ খ্রিঃপূর্বাব্দে মহামতি আলেজান্দ্রার বেকট্রিয়া প্রদেশ (রাজধানী বখ) দখল করেন এবং তার মৃত্যুর পর সেলুসিড রাজ্যের অংশ হয়ে যায়। পরে বেকট্রিয়া স্বাধীন হয়েছিল এবং বেকট্রিয়া গ্রিকদের দখলে ছিল (২৯০ খ্রিঃ পূ. ৯০ খ্রিস্টাব্দে)। তৃতীয় শতাব্দির মাঝামাঝি বল্খ জোরান্দ্রিয়ান, মিথ্রাাইক, বুড্ডিস্ট, হিন্দু, গ্রিক এবং নেস্টোরিয়ান শিক্ষা কেন্দ্র হয়ে ওঠে। এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে তাজিবা, উজবেক এবং খোরাসান পেরিয়ে তুর্কমেন অঞ্চল থেকে উত্তর পারস্য ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে। বলখ্ মুসলিমরা দখল করে নেয় ৬৬৩ খ্রিস্টাব্দে।
৫৩১ সালে, মুসলিম বিজয়ের এক শতাব্দি পূর্বে, সাসানিয়ান কিং ১ম খসরুর আমন্ত্রণক্রমে নেস্টোরিয়ানরা পার্সিয়ান উপসাগরের কাছে দক্ষিণ-পশ্চিম পারস্যে জান্দিশাহপুরে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। জান্দিশাহপুর প্রাচীন শহর সুসা থেকে বেশি দূরে ছিল না। সুসা ছিল দারাউস-এর রাজধানী। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে কয়েকটি কলেজও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। ইউনিভার্সিটি লাগোয়া একটি বড় লাইব্রেরি ও অবজারভেটরিও তৈরি করা হয়।
জান্দিশাহপুর থেকে অনেক পণ্ডিত ব্যক্তি বসরাতে বসবাস শুরু করে যাদের প্রভাব পড়েছিল আরব বেয়াকরণদের ও কোরানের তফসিরকারদের ওপর ইখওয়ানুস সাফার যুক্তিবাদীদের লেখার ওপরও এদের যথেষ্ট প্রভাব পড়েছিল। পার্সিয়ান স্কলার সিবাওয়ে (মৃ. ৭৯৩) আরবি গ্রামারের নীতির ওপর একটি পুস্তক রচনা করেন যা আরবি ভাষা ও সাহিত্যের ওপর প্রভূত প্রভাব ফেলেছিল।
এই সময় শিক্ষার ক্ষেত্র চারদিকে প্রসারিত হয়। সেই সাথে আলেক্সান্দ্রিয়া লাইব্রেরি থেকে হেলেনিস্টিক ধারণাও ছড়িয়ে পড়ে। অনেকে বলেন খলিফা ওমর মুসলিম রাজ্যে হেলেনিটিক চিন্তাধারার প্রভাবকে রোধ করার জন্য আলেক্সান্দ্রিয়া লাইব্রেরি নষ্ট করে দেয়ার আদেশ দেন। ৬৪১ খ্রিস্টাব্দে, কথিত আছে, খলিফা ওমর বলেছিলেন যদি এ লাইব্রেরিতে এমন জ্ঞান থাকে যা কোরানের সাথে মিলে যায় তাহলে সেটা অতিরিক্ত, আর যদি না মিলে তাহলে মুসলিম বিশ্বাসের বিরুদ্ধ- সুতরাং ঐ গ্রন্থাগার থাকা উচিত নয়। খলিফার নির্দেশ মতে, কথিত আছে, ঐ লাইব্রেরির সব পুস্তকের কিছু জ্বালিয়ে দেয়া হয় আর বাকি যা ছিল ছ’মাস ধরে গণস্নানাগারে জ্বালানি হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
মুসলিম স্কলারগণ, যুক্তি দেখিয়ে, এ কাহিনী অস্বীকার করেন, কিন্তু কোনো কোনো অথরিটি মনে করেন এ কাহিনী সত্য কারণ এই লাইব্রেরির কিছু অংশ ৭২० খ্রিস্টাব্দের মধ্যে দামেস্কের পথে দেখা গেছে।
আব্বাসি খলিফারা পরবর্তীতে দামেস্কের লাইব্রেরি উঠিয়ে নিয়ে বাগদাদে নিয়ে যান। এখানে খ্রিস্টান স্কলারদের নিয়োজিত করা হয় বাগদাদের লাইব্রেরিকে সাজিয়ে- গুছিয়ে তোলার জন্য। এই লাইব্রেরির পরিচালক ছিলেন ইউহানা ইবন মুসা, দামেস্কের নেস্টোরিয়ান খ্রিস্টান।
৮২০ খ্রিস্টাব্দে খলিফা মামুন বাগদাদে জ্ঞানগৃহের (House of wisdom) পত্তন করেন। সেখানে লেকচার রুম, পড়ার ঘর, বিতর্কের ঘর ও লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে শিক্ষার সমস্ত ক্ষেত্রে সুষ্ঠুভাবে কাজ চালানো হয়। একটি অনুবাদ টিম তৈরি করা হয় গ্রিক দর্শন ও অন্যান্য বিষয় আরবিতে অনুবাদ করার জন্য।
৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে খলিফা মোতায়াক্কিল লাইব্রেরি ও অনুবাদ শাখা সম্প্রসারণ করার সিদ্ধান্ত নেন। মোতায়াক্কিল কট্টর অর্থোডক্স মুসলিম হলেও উপযুক্ত মুসলিম পণ্ডিত না থাকায় বাধ্য হয়ে এ কাজের ভার দেয় হুনায়ুন বিন ইসহাক একজন খ্রিস্টানকে। হুনায়ুন বিন ইসহাক এক বিখ্যাত অনুবাদক ছিলেন এবং আব্বাসি খলিফাদের এই জ্ঞানগৃহে তার অবদান অতুলনীয়।
বাগদাদের এই জ্ঞানগৃহের অনুকরণে কাইরোতে ফাতেমিদ খলিফা মুইজ একটি লাইব্রেরি ও পাঠকক্ষ নির্মাণ করেন। এখানে গ্রিক দর্শন ও বিজ্ঞানকে বেশি প্রাধান্য দেয়া হয় (Watt, 1990, P. 215)। এই জ্ঞানগৃহকে আরও সম্প্রসারণ করেন মুইজের উত্তরাধিকারী খলিফা আজিজ ও হানিফ।
সালাউদ্দিন যখন ফাতেমিদ খলিফাকে পরাজিত করে মিশর দখল করেন ১১৭১ খ্রিস্টাব্দে, তখন তিনি প্রায় এক মিলিয়ন বই, পাণ্ডুলিপি ও স্কুল নষ্ট করে ফেলেন এই কারণে যে এগুলো শিয়া সম্প্রদায়ের নীতি প্রচার করে। সালাউদ্দিন কট্টর সুন্নি ছিলেন। কিছু বিক্রি করে দেয়া, কিছু জ্বালিয়ে দেয়া হয় আর কিছু নীলনদে ফেলে দেয়া হয়।
মধ্যপ্রাচ্যে এই মুসলিম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং এরূপ প্রতিষ্ঠান স্পেনে যা ছিল, সেগুলো প্রধান শিক্ষা কেন্দ্ররূপে শুধু মুসলিম বিশ্বে নয় সারা দুনিয়ার শিক্ষা কেন্দ্র রূপে খ্যাতি লাভ করে। ইউরোপ ও অন্যান্য পশ্চিম দেশ থেকে এই শিক্ষা কেন্দ্রগুলো থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা করেছে। কিন্তু এখন আর তেমন জৌলুস নেই। দশম শতাব্দি থেকে ইউরোপে স্কুল পত্তন হয় এবং মুসলিম শিক্ষা কেন্দ্র থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞান আহরণ করার পর শনৈ শনৈ উন্নতি হয়ে বর্তমান পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে।
ইউরোপের শহরগুলো বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠে বিভিন্ন সময়ে— প্যারিসে (১১৫০), বলগ্না (১২০০), পাদুয়া (১২২২), অক্সফোর্ড (১২৪৯), কেমব্রিজ (১২৮৪) এবং মন্টপেলিয়ার (১২৮৯)।
১৩.১০ অনুবাদকগণ
এটা অনুমান করা মুশকিল কী ধরনের বিদেশী প্রভাব পড়েছিল মুসলিম চিন্তাধারায়। এটা বুঝতে গেলে প্রাচীন জ্ঞান ভাণ্ডার থেকে বিশেষ করে গ্রিক দর্শন ও বিজ্ঞান আরবি ভাষায় অনুবাদকর্মে মনোনিবেশ করতে হয়। এই অনুবাদের মাধ্যমে মুসলিম দর্শন, বিজ্ঞান, চিকিৎসাবিদ্যা এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে মুসলিমরা তাদের অবিস্মরণীয় অবদান রেখে গেছেন।
সাধারণত অধিকাংশ অনুবাদ হয়েছিল গ্রিক দর্শন ও বিজ্ঞান থেকে তারপর ছিল ল্যাটিন ও কপটিক মেটিরিয়েল। অনুবাদ শুরু হয় প্রথমে সিরিয়াতে কারণ প্রায় তৃতীয় শতাব্দি থেকে সিরিয়াক (নিও-আরামাইক ও খ্রিস্টান আরামাইক) পশ্চিম এশিয়ার ভাষা হিসাবে গ্রিক ভাষার স্থলে স্থান করে নেয় (Arnold and Guillaume, 1965, P. 313) ।
এই অনুবাদকর্ম শুরু হয় আরবি ভাষা আগমনের তিন শতাব্দি পূর্বে। অনুবাদ হয় সিরিয়া, প্যালেস্টাইন, মিশর ও মেসোপটেমিয়ার মঠগুলোতে এবং পঞ্চম শতাব্দির মাঝামাঝি এই অনুবাদ পূর্বাঞ্চলের চার্চগুলোতে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া জান্দিশাহপুরে ও নেস্টোরিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা উন্নত ধরনের অনুবাদ বিভাগ ছিল।
মুসলিম রাজ্য প্রসারের সাথে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনুবাদের প্রয়োজন পড়ে আরবি ভাষায়, এ কাজ শুরু হয় উমাইয়া খলিফাদের সময়ে এবং আব্বাসীয় খলিফাদের সময়ে এই অনুবাদ কাজ দ্রুতভাবে গড়ে ওঠে।
খলিফারা খ্রিস্টান পণ্ডিতদের বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ করেন পুস্তকাদি ও পাণ্ডুলিপি গ্রহণ করতে। মিশরে, আলেক্সান্দ্রিয়ায়, মেসোপটেমিয়ায় হারআন, জেরুজালেমের বস্ত্রা, এলেপ্পোতে, এডেসা, এন্টিয়ক এবং সিরিয়ার অন্যান্য কেন্দ্রে; এমনকি খ্রিস্টান বাইজানটাইন ও গ্রিসে। (Grunebaum, 1961, P. 54) বাইজানটাই সম্রাট তৃতীয় মাইকেল (মৃত. ৮৬৭)-এর সাথে খলিফা মুনতাসির এক সন্ধি করেন। সেখানে বলা হয় যে, বাইজানটাইন সম্রাট গ্রিক পাণ্ডুলিপি বাগদাদে পাঠাবেন। বিভিন্ন স্থান থেকে গাড়ি বোঝাই করে বিদেশী ভাষার বই-পুস্তক দামেস্কে ও বাগদাদে আনা হয় আরবি ভাষায় অনুবাদ করার জন্য। খলিফার এজেন্টরা মুসলিম রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে প্রাচীন সাহিত্য পুঁথি সংগ্রহ করে আনে (আমীর আলী, ১৯৬৫ পৃ. ৩৭১)।
বেশির ভাগ আরবি অনুবাদ করা হয়েছিল সিরিয়ার ভাষা থেকে এবং কিছু সরাসরি গ্রিক ভাষা থেকে। এই অনুবাদকর্মের শিরোনাম শত শত নামে লেখা হয় এবং অনেক পশ্চিমা সাহিত্য আরবি ভাষায় এখন মুসলিমদের আয়ত্তের মধ্যে। প্রাচীন গ্রিক এবং বিদেশী দর্শন ও বিজ্ঞান থেকে যখন আরবিতে অনুবাদ করা হয় তখন আরবরা বিস্ময় প্রকাশ করে মন্তব্য করেছিল যে, “প্রফেটের আগমনের পূর্বে পৃথিবীতে যথেষ্ট জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রচলন ছিল।” বলা হয় যে, কোনো কোনো খলিফা মূল গ্রিক ও ল্যাটিন পাণ্ডুলিপি থেকে অনুবাদ করে মূলকপি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। যাতে কোনো সাক্ষী না থাকে যে এইগুলি বিদেশী জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনুবাদকর্ম।
অনেক গ্রিক, রোমান, আলেক্সান্দ্রিয়ান ও হেলেনিস্টিক উৎস থেকে শত শত বই ও পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করা হয়েছিল এবং আরবিতে অনুবাদ করা হয়। এই অনুবাদকরণের মধ্যে ছিল হোমার (মৃ. ৮৫০ খ্রিঃ পূ.), পিথাগোরাস (মৃ. ৫০০ খ্রিঃ), হিপোক্রাটস, (মৃ. ৩৬০ খ্রিঃ পূ.), প্লেটো, (মৃ. ৩৪৭ খ্রিঃ পূ.) এবং এরিস্টটল (মৃ. ৩২২ খ্রিঃ পূর্বাব্দ)-এর মূল গ্রন্থ থেকে; অনুরূপভাবে বিখ্যাত গাণিতিকদের কাজ যেমন- ইউক্লিড-এর কাজ (মৃ. ২৮৩ খ্রিঃ পূ.), কোনিক্স অব এলোপোনিয়াস (মৃ. ২৮০ খ্রিঃ পূ.), ফিনোর নিউমেটিক্স (মৃ. ২৭০ খ্রিঃ পূর্ব), মেনেলাউসের স্কেরিকস (মৃ. ১০৫ খ্রিঃ পূ.) এবং নিও পিথাগোরিয়েনের গণিত এবং নিকোমেকাসের জ্যামিতি (মৃ. ১২০ খ্রিঃ পূ.)।
জ্যোতিবিদ টলেমির (মৃ. ১৬১ খ্রিঃ পূ.) গ্রিকরা যাকে ম্যাজিস্ট্রি বলত এবং আরবরা যাকে বলত অ্যাল-মাগেস্ট, মুসলিম বিশ্বে বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার ওপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিল। তেমনি ডায়োফেন্টাস (মৃ. ২৯০ খ্রিঃ পূ.)-এর এ্যালজাব্রা।
আবিষ্কারকদের মধ্য থেকে যেসব তথ্য আরবিতে অনুবাদ করা হয় তার মধ্যে ছিল আর্কিমিডিসের তত্ত্ব, আলেক্সান্দ্রিয়ার হেরোর (মৃ. ৭০ খ্রিঃ পূ.) গণিত সম্পর্কে বইপুস্তক আরবিতে অনুবাদ করা হয় এবং এই অনুবাদিত কাজের জন্য মুসলিম রাজ্যে জ্যোতির্বিদ্যার পারদর্শিতা লাভ করেন।
অনুবাদিত লেখকদের মধ্যে চিকিৎসাবিজ্ঞানে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ডিওসকোরাইড (মৃ. ৬৫ খ্রিঃ), আর একজন ছিলেন গালেন (মৃ. ২১০ খ্রিঃ) যিনি গ্রিক। গালেন কয়েকজন রোমান সম্রাটের চিকিৎসক রূপে কাজ করেছেন এবং মেডিকেল বিজ্ঞানে তাঁকে অথরিটি বলা হতো। আরবিতে সবচেয়ে বেশি অনুবাদ করা হয় গালেনের কাজ থেকে।
পল অব এজিনা (মৃ. ৬৯০), তার এপিটোমে সার্জারি সম্বন্ধে তখনকার দিনে যা ছিল সবই লিপিবদ্ধ করেছিলেন। সার্জারিতে একটি বিখ্যাত পুস্তক রচনা করেছিলেন কর্ডোভার আবুল কাসিস (মৃ. ১০১৩) পল-এর এপিটোমের ওপর ভিত্তি করে।
অনুবাদ ক্ষেত্রে প্রথম সৈনিক ছিলেন মনোফিজাইট খ্রিস্টান পুরোহিত রেসাইনার সার্জিয়াস (মৃ. ৫৩৬)। তিনি ছিলেন মেসোপটেমিয়ায়। গ্রিক মেডিক্যাল পুঁথিপত্র ও পুস্তকের তিনি সিরিয়াকে অনুবাদ করেন। পরে এর থেকে অনেকগুলো অনুবাদ হয় আরবিতে। অন্যদের মধ্যে ছিলেন বালাদের জেকোবাইট আথানাসিয়াস (মৃ. ৬৯৬)। এডেসার জেকব (মৃ. ৭০৮), তিনি ছিলেন নেস্টোরিয়ান এবং কুফার জর্জ (মৃ. ৭২৪)। জর্জ ‘আরবদের বিশপ’ ছিলেন যিনি গ্রিক থেকে চিকিৎসাবিদ্যা, নক্ষত্রবিদ্যা ও দর্শন অনুবাদ করেন।
উমাইয়া খলিফা দ্বিতীয় ওমরের সময় বসরার একজন পার্সিয়ান ইহুদি মাসারজাওয়ে (মৃ. ৭২৫) চিকিৎসাবিজ্ঞানের পুস্তক অনুবাদ করেন। এডেসার থিওফিলাস (মৃ. ৭৮৫) একজন খ্রিস্টান পণ্ডিত ও জ্যোতির্বিদ ছিলেন। তিনি অনুবাদ করেন হোমারের ইলিয়াড ও ওডেসি সিরিয়াক ভাষায়। আব্বাসি খলিফা মেহদির খুব কাছের লোক। তার এই অনুবাদ থেকে অনূদিত হয়েছে আরবি ভাষায়। আর একজন নামকরা নেস্টোরিয়ান খ্রিস্টান পণ্ডিত বালাবাক্কি (মৃ. ৮৩৫) অনুবাদ করেছিলেন গ্রিক জ্যামিতি, গণিত, নক্ষত্রবিদ্যা ও প্রকৌশল।
অনুবাদকের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলেন হুনায়েন ইবন ইসহাক (মৃ. ৮৭৪)। তিনি ছিলেন ইবাদ গোত্রের নেস্টোরিয়ান খ্রিস্টান জান্দিশাহপুরের ডাক্তার। তার অনুবাদকর্মের মধ্যে ছিল হিপ্পোক্রেটস্, প্লেটো, গালেন এবং আরো অনেকের মেডিকেল ও বিজ্ঞান বিষয়ক পুস্তকাদি।
হুনায়েনের স্কুলে প্রায় ১০০ জনের মতো ছাত্র ও অনুবাদক ছিল, তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিলেন এহিয়া ইবন বিত্রিক। তিনি অনুবাদ করেন এরিস্টটল, গালেন ও অন্যান্যদের কাজ থেকে। আবদুল মসিহ ইবন আবদুল্লাহ ছিলেন জেকোবাইট। তিনি অনুবাদ করেন নিওপ্লেটোনিক দার্শনিক প্লোটিনাসের পুস্তক এবং অন্যান্য তর্কবিদ্যা। ইসহাক ইবন হুনায়েন (হুনায়েনের পুত্র) অনুবাদ করেন অ্যারিস্টটল, ইউক্লিড ও টলেমির আলমাজেস্ট থেকে। হুবায়েশ, হুনায়েনের ভাইপো, অনুবাদ করেন অনেক মেডিকেল পুস্তক থেকে।
একজন সাবিয়েন জ্যোতির্বিদ, গাণিতিক ও ডাক্তার আবিত ইবন কুররা বিজ্ঞান বিষয়ক পুস্তক থেকে প্রায় ডজন খানেক অনুবাদ করেন। তার পুত্র সিনান ইবন হাবিত পরে বিখ্যাত হয়েছিলেন এক মহান আরব জ্যামিতি বিশেষজ্ঞ হিসাবে।
কুস্তা ইবন লুকা (মৃ. ৯৩২) অনুবাদ করেন গ্রিক ও আলেক্সান্দ্রিয়ান লেখকদের বিজ্ঞান বিষয়ক পুস্তক থেকে।
আবু ইয়াহিয়া আল-মারওয়াজি (মৃ. ৯২০) ছিলেন নেস্টোরিয়ান দার্শনিক ও বৈয়াকরণ। তিনি অনুবাদকদের জন্য আর একটি স্কুল বাগদাদে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যা শতাব্দিকাল ধরে চলে। তার ছাত্র ও উত্তরাধিকারী ছিলেন একজন নেস্টোরিয়ান তর্কবিদ্যাবিদ্ ও বৈয়াকরণ নাম ছিল আবু বিসির মাত্তা। তিনি দার্শনিক আল-ফারাবির বন্ধু; তার ছাত্র ও উত্তরাধিকারী ইয়াহিয়া ইবন আদি ছিলেন জেকোবাইট দার্শনিক ও অ্যারিস্টটলের ভাষ্যকার; তার ছাত্র ও উত্তরাধিকারী হাসান ইবন সুয়ার ছিলেন নেস্টোরিয়ান দার্শনিক ও চিকিৎসক। এইসব অনুবাদক ও পণ্ডিত ব্যক্তিদের নিকট ইসলামী বিশ্ব ঋণী, কারণ দুর্বোধ্য গ্রিক, ল্যাটিন ও কপটিক ভাষা থেকে মূল্যবান বইপুস্তক আরবি ভাষায় এরা অনুবাদ করেছেন। এই সব অনুবাদকরা ছিলেন ভাষাবিদ, বিভিন্ন ভাষার ওপর তাদের দখল ছিল। শিক্ষার বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই সব অনুবাদক যে সম্পদ আরবি ভাষায় রূপান্তর করে গেছেন তা দামেস্কাস ও টলেডো পণ্ডিতদের প্রভূত পরিমাণে সাহায্য করেছে। এই সব অনুবাদ না হলে আরবি ভাষা এতটা উন্নতি লাভ করতে পারত না এবং সাহিত্য দর্শন, বিজ্ঞান ও চিকিৎসাবিদ্যায় পারদর্শিতা লাভ করা মুসলিম পণ্ডিতদের জন্য সম্ভব হতো কিনা বলা মুশকিল। এই অনুবাদের কল্যাণে ইসলামিক রেনেসাঁর, আরব বিশ্ব ও মুসলিম বিশ্বে, প্রবর্তনে প্রভূত সাহায্য করেছে।
১৩.১১ সাহিত্য
প্রফেট মোহাম্মদ কবিতা অপছন্দ করতেন এবং তাঁর মৃত্যুর পর ধর্মবেত্তাগণ সেকুলার লেখা বা সাহিত্যের বিরোধিতা করেছেন যার জন্য সাহিত্য রচনার কোনো সুযোগ গড়ে ওঠেনি। যা কিছু লেখা হতো অর্থোডক্স মোল্লাদের তাতে সম্মতি নিয়ে হতো।
কবিতা লেখার ক্ষেত্রে প্রেমের কবিতার প্রচলন ছিল যাকে বলা হতো ‘উদরি’ কারণ এ কবিতার উন্নয়ন হয়েছে সিরিয়ার খ্রিস্টান গোত্র বানু উদ্রা। এ ধরনের কবিতা আরবদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং তা ছড়িয়ে পড়ে বাগদাদ থেকে স্পেন পর্যন্ত। আর কবিরা প্রেমের কবিতার থিম্ গ্রহণ করত ইউসুফ-জোলেখা, পারস্যের দ্বিতীয় খসরু ও সিরিয়ার খ্রিস্টান দুহিতা শিরিন থেকে, কবি আন্তারা (মৃ. ৫৯৫) ও তার মিস্ট্রেস আলা এবং উধরা গোত্রের কবি জমিল (মৃ. ৭১০) এবং তার প্রিয়া সুন্দরী বুথাইনা থেকে।
উমাইয়া খলিফা মাবিয়া কবিতা ভালোবাসাতেন। তিনি তাঁর পুত্র প্রিন্স এজিদের জন্য কবিতার সংকলন করতে আদেশ দেন, কারণ কবিতা তার পুত্রকে সাহিত্যমনা করবে এবং এর মধ্য দিয়ে তার জীবন সুশৃঙ্খল হবে এবং আদব-কায়দা শিখবে, আর সাহসী হয়ে সাহসিকতার কাজ করতে অনুপ্রেরণা দিবে। এই সংকলন প্রাচীন আরবের প্রথম কবিতা সংকলন যেখানে বিখ্যাত কবিদের কবিতা ঠাঁই পেয়েছিল।
এর পর খলিফা আবদুল মালেক দ্বিতীয় সংকলন তৈরি করতে বলেন, যা অনেক দিন ধরে কবিতার উৎস গ্রন্থ বলে টিকে ছিল। খলিফার রাজকবি ছিলেন তঘলিব গোত্রের একজন খ্রিস্টান কবি, নাম ছিল আখতাল (মৃ. ৭১০)। খলিফা আখতালকে মোটা অংকের টাকা এবং পেনশন দিতে চেয়েছিলেন এই শর্তে যে তাকে মুসলিম হতে হবে। আখতাল বিনয়ের সাথে অস্বীকার করে এই কারণ দেখিয়ে যে তিনি মদ ছাড়তে পারবেন না। খলিফা আর কিছু না বলে ঘোষণা করেন যে আখতাল খলিফার কবি এবং ‘আরবের শ্রেষ্ঠ কবি’ উপাধি দেন (Nicholson, 1969, P. 242)।
আর একজন কবি ছিলেন তামিম গোত্রের খ্রিস্টান। তারও যথেষ্ট খ্যাতি ছিল এবং দামেস্কের খলিফাদের সভাকবি ছিলেন। তার নাম ফারাজদাক (মৃ. ৭২৯)। তার সমসাময়িক ও প্রতিদ্বন্দ্বী মুসলিম কবি ছিলেন কোলাইব গোত্রের জারির ইবন আতিয়া। ইনি হাজ্জাজের প্রিয় পাত্র ছিলেন। হাজ্জাজ তখন ইরাকের গভর্নর।
যখন আরবিতে গ্রিক ছন্দ অনূদিত হয়ে বের হয় তখন আরব কবিরা এর প্রভাবে গীতি কবিতা লিখতে শুরু করে। গ্রুনেবাম (Grunebaum) লিখেছেন স্মরণ রাখা দরকার যে গ্রিক গীতি কবিতার ওপর আরব কবিদের নির্ভর সুদূরপ্রসারী ছিল (1961, P. 317)
কোদামা ইবন জাফর (মৃ. ৯২২) খ্রিস্টান কবি ছিলেন, পরে ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি এরিস্টটলের কাব্যে বিশেষজ্ঞ ছিলেন এবং তিনিই প্রথম আরব সাহিত্য থিওরিতে গ্রিক প্রথা চালু করেন। তিনি কবিতা, কবিতার ছন্দ ও গতি ইত্যাদির ওপর লেখালেখি করে সুনাম অর্জন করেন।
গ্রিক ধারায় প্রভাবিত হয়ে আরব লেখকরা কেচ্ছা-কাহিনী সংগ্রহ করে আলিফ লাইলা ওয়া লাইল— অ্যারাবিয়ান নাইটস্ রচনা করেন। এই গল্পগুলো প্রথমে পলভী ভাষায় রচিত হয় পরে আরবিতে অনূদিত হয়ে একাদশ শতাব্দিতে সমাপ্ত হয়; সঙ্কলিত হয়ে পুস্তক হিসাবে বর্তমান আকারে রূপ নেয় ১৪০০ খ্রিস্টাব্দে। কাহিনীগুলো দেখে স্পষ্ট মনে হয় এগুলো বৌদ্ধ, ইহুদি ও হেলেনিস্টিক উৎস থেকে ধার করা। (Grunebaum, 1961, P. 294)।
আব্বাসিদের সময়ে কাগজ তৈরি ও কাগজের ব্যবহারের জন্য সৃজনশীল লেখালেখি ও জ্ঞান বিস্তারে প্রসারতা লাভ করে। প্রথমে সাধারণ লেখালেখিতে প্যাপাইরাস ব্যবহার করা হতো, কিন্তু যে সময় কোরান লেখা শুরু হয় তখন প্যাপাইরাসের বদলে গ্রিকে রোমান বিশ্বে, যে চামড়ার কাগজ ব্যবহৃত (পার্চমেন্ট) হতো, সেই পার্চমেন্ট ব্যবহৃত হয়। কোরানে পার্চমেন্টকে ‘কিরতাস’ বলা হতো। (৬ : ৭) এই কিরতাস শব্দ গ্রিক কার্টেস (Chartes) থেকে এসেছে অর্থ- চামড়ার একটা পাতা (a sheet of parchment)।
কোরানের আয়াত লিখিয়েরা (কাতিব) অন্যান্য বস্তুর সাথে ‘পার্চমেন্ট’ ব্যবহার করতেন।
৭৫১ খ্রিস্টাব্দে মধ্য এশিয়ায় যুদ্ধের সময় মুসলিম বাহিনী কয়েকজন চীনা কাগজ প্রস্তুতকারীকে বন্দি করে সমরকন্দে এবং আরবরা তাদের কাছ থেকে কাগজ তৈরি করার কৌশল (টেকনিক) শিখে নেয়। পরে ৭৯৪ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদে একটি কাগজ কারখানা তৈরি করা হয়, এরপর অন্যান্য কেন্দ্রেও কারখানা গড়ে ওঠে। তারপর আস্তে আস্তে ইউরোপেও কাগজের ব্যবহার ছড়িয়ে পড়লে প্যাপাইরাস বন্ধ হয়ে যায়।
১৩.১২ ইতিহাস লিখন
প্রাচীনকাল থেকে ইতিহাস লিখন পদ্ধতি শুরু হয় পর্বত গাত্রে, বিভিন্ন লিপিতে- যেমন মোসনাদ, তালমুদিক, সাফাইটিক, নাবাতাইয়েন। শতাব্দিকাল ধরে এই সব লিপি থাকেনি, মুছে গেছে বা নষ্ট হয়ে গেছে কিংবা বেদুইনদের দ্বারা ধ্বংস হয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দির শেষের দিকে কয়েক জন ইউরোপিয়ান পণ্ডিত পর্বত গাত্রের বা টুকরো থেকে লিখনের অর্থ উদ্ধার (dicipher) করার কাজ শুরু করেন ইসলাম-পূর্ব আরবের ইতিহাসের খোঁজে (Philby, 1947, P. 128)।
এই সব বস্তু ইতিহাস স্বীকৃত না হলেও বিভিন্ন কালে বিভিন্ন শাসকের অধীনে তখনকার আরবের অবস্থা কী ছিল তার ধারণা চিত্র পাওয়া যায়। নতুবা ইসলাম-পূর্ব ও পরের ঘটনার বিস্তৃত ইতিহাস গ্রহণ করা হয় এই সব উৎস থেকে যেমন প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ঘটনা সূত্র থেকে; ইহুদি, গ্রিক, সিরিয়ান ও রোমান লেখকদের লেখা থেকে; ইসলাম-পূর্ব কবিতা থেকে এবং বিভিন্ন পেশাদার কাহিনীকারদের (কাসাস) ট্রাডিশন থেকে।
মুসলিম লেখকরা প্রফেট-পূর্ব ঘটনার কাহিনী অল্পই ব্যক্ত করেছেন। ইসলাম-পূর্ব ঘটনা লিপিবদ্ধ করতে স্কলারদের নিরুৎসাহ করা হয়েছে এবং ফারিস বলেন যে প্যাগন আরবদের ইতিহাস লিপিবদ্ধ না করার অফিসিয়েল সিদ্ধান্ত আছে (1952, P. Vii)। একটি হাদিসে প্রফেট বলেছেন বলে বলা হয় যে, ‘ইসলাম-পূর্ব সব কিছুকেই ধ্বংস করে দিয়েছে’ ‘ঐতিহাসিক’ (আখবারি) শব্দের অপমানজনক (derogatory) অর্থ ছিল এবং হিশাম আল-কাবি (মৃ. ৮২০) যিনি প্রফেটপূর্ব আরব সম্বন্ধে যা লিখেছেন মোল্লারা তার বিরুদ্ধাচরণ করেছেন। ফলে ইসলাম-পূর্ব ঘটনার তথ্য যা অর্থোডক্স মুসলিমদের মনোপূত নয় সেগুলোকে নষ্ট করা হয়েছে বা অবহেলা করে নষ্ট হতে সাহায্য করেছে এবং সেইগুলোকে রাখা হয়েছে যা পরিবর্তনের পর গ্রহণযোগ্য করা হয়েছে।
ইতিহাস বা জীবন চরিত ইসলামোত্তর যুগে হয়েছে প্রফেটের মৃত্যুর এক শতাব্দি ও তারও বেশি সময়ের পর। এই সময়ের মধ্যে যেসব হাদিস সংগৃহীত হয়েছে তা ছিল খাপছাড়া ও খণ্ড খণ্ড, ফলে মুখে মুখে যা পাওয়া গেছে তা বা সে তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা খুব কমই ছিল এবং বেশির ভাগই ছিল কোনো বিশিষ্ট গোত্র বা গোষ্ঠীর পক্ষে। পরে যা লিখিত হয়েছে সেগুলো ছিল পূর্ব ভাষ্যের সংশোধিত ভাষ্য দলীয় গোত্রকে সাপোর্ট করে। তাই অনেক ট্রাডিশনের ভাষ্য বা তথ্য পরস্পর বিরোধিতায় দুষ্ট হয়েছে। এই কারণে আসল চিত্র বা ইতিহাস চাপা পড়েছে। অমুসলিম ঐতিহাসিকরা ইসলামের ইতিহাস যা লিখেছেন তাকে রেকর্ডভুক্ত করা হয়নি এবং যেসব কাহিনী গৃহীত হয়েছে সেগুলোকে ইতিহাস সমৃদ্ধ বলা যেতে পারে না।
প্রাচীন কাহিনীকারদের বিবরণ প্রায়ই কেচ্ছা-কাহিনী বা মিও বলা যেতে পারে এবং সেখানে অতিশয়োক্তি বেশি। ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে লেখা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে দ্বিতীয় খলিফা ওমর তার দেহের গুরুত্বপূর্ণ অংশে ছ’টার বেশি ছিদ্র করেছিলেন এবং সেই সব ছিদ্র ক্ষত দিয়ে ঝরনার মতো পানি বের হয়েছে এবং তিনি পান করেছেন। তবুও তিনি বেঁচে গেছেন ও জনগণের উদ্দেশ্যে নাতিদীর্ঘ বক্তব্যের সাথে তাদের নির্দেশ-উপদেশ দিয়েছেন। এ ধরনের কথাবার্তায় কোনো সামঞ্জস্যতা ছিল না, একটা ঘটনার সাথে অন্য ঘটনার মিল ছিল না এবং পরস্পরবিরোধী তথ্যগুলোর কোনো সমন্বয় করা সম্ভব হয়নি। প্রধান প্রধান ঘটনা ও যুদ্ধগুলোর সঠিক বর্ণনা নেই এমনকি ওমর কখন জেরুজালেম দখল করলেন সে তারিখেরও মিল নেই। তাছাড়া প্রথম দিকের ইতিহাসের পর্যায়ক্রম না থাকায় ঘটনাগুলোর সিকোয়েন্স নির্ধারণ করা যায় না।
প্রফেটের জীবন চরিত্রে এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের জীবন সম্বন্ধে এবং তার সাহাবীদের সম্বন্ধে যথেষ্ট অসামঞ্জস্যতা রয়েছে। তাই পারস্য, মিসর ও সিরিয়া, মেসোপটেমিয়া, প্যালেস্টাইন বিজয়ের ঘটনায় যথেষ্ট বিশৃঙ্খল অবস্থা দৃষ্ট হয় এবং এ বিশৃঙ্খল অবস্থা (confusion) আরব ঐতিহাসিকদেরও অজানা নয়।
প্রায় নবম শতাব্দি থেকে উল্লেখযোগ্য মুসলিম ঐতিহাসিকদের আগমনে তথ্য সম্বলিত ইতিহাস লেখা শুরু হয়। অনেকে বিশ্ব-ইতিহাস, সৃষ্টিতত্ত্ব থেকে তার মৃত্যু পর্যন্ত, ধারণ করে গেছেন।
ভূগোল সম্বন্ধেও তেমনি, প্রাচীন গ্রিক ও ল্যাটিন লেখকদের কথা, শহর ও শহরবাসীদের কথা, উদ্ভিদ ও প্রাণীদের কথা, পাহাড়-পর্বত, নদী-নালার কথা, অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশ সম্বলিত ম্যাপসহ সঠিকভাবে লিখেছেন মুসলিম ভূগোলবিদগণ। উল্লেখযোগ্য যে, এইসব ঐতিহাসিক, ভূগোলবিদরা, যারা আরবি ভাষায় ইতিহাস ও ভূগোল লিখেছেন, তাঁরা জন্মগতভাবে আরব ছিলেন না।
মক্কা ও মদিনার ইতিহাস ও ট্রাডিশনের বেশির ভাগ লিখেছেন মুহাম্মদ আল- আজরাকি (মৃ. ৮৫৮) তার দাদা কর্তৃক সংগৃহীত তথ্যগুলোকে বিস্তার করেছেন। ইনি ঘাসান খ্রিস্টান প্রিন্সের বংশধর।
আহমদ আল-ইয়াকুবী (মৃ. ৮৯৭) ছিলেন ইতিহাস ও ভূগোলবিদ। তিনি বিশ্ব ইতিহাস লিখেছেন আদম থেকে যিশু পর্যন্ত, সাথে সংযুক্ত ছিল ইসলাম-পূর্ব মিসর, নিনেভ, ব্যাবিলন, ভারত, চীন, গ্রিস, রোম, রাজ-রাজড়াদের লিস্টসহ প্রফেট মোহাম্মদের সময় থেকে ইসলামের ইতিহাস।
আল মাসুদী সম্বন্ধে বেশি কিছু জানা যায় না কিন্তু তাকে ‘আরবদের প্লিনি’ (Pliny) বলা হয়। তিনি নাম করা পর্যটক ছিলেন, চীন দেশ পর্যন্ত ভ্রমণ করেছেন। অন্যান্যদের মতো তিনি আরবি ভাষায় লিখেছেন, কিন্তু নিজের সম্বন্ধে কিছু লিখে যাননি; সম্ভবত তিনি অ-আরব ছিলেন। ইতিহাস বিশ্বকোষ তিরিশ খণ্ডে লিখে গেছেন তার মধ্যে দু’টি খণ্ড আমাদের হাতে এসেছে।
অ-আরব ঐতিহাসিক, যারা আরবিতে লিখেছেন, তাদের মধ্যে আল-তারাবি (মৃ. ৯২৩) ছিলেন পার্সিয়ান। গিবস তাকে বলতেন ‘আরবদের লিভি’ এবং বারুনী (মৃ. ১০৫০) ছিলেন আর্মেনিয়ান। বারুনী প্রায় ৪০ বছর ভারতে ছিলেন এবং ভারত সম্বন্ধে তার বর্ণনা বিখ্যাত হয়ে আছে। বারুনী একজন জ্যোতির্বিদও। তিনি একটা যন্ত্র আবিষ্কার করে মুসলিম ক্যালেন্ডারের তারিখ হিসাব করেন, কিন্তু ব্যবহার করেছিলেন বাইজানটাইন মাস যার জন্য তাকে ‘বিধর্মী’ (infildel) অপবাদ দেয়া হয়।
বিখ্যাত ভূগোলবিদ ইদ্রিসি (মৃ. ১১৪০) সিসিলিতে নরম্যান রাজা দ্বিতীয় রোজারের রাজসভায় কাজ করেছেন। রাজা রোজার তাকে বিশ্বসম্বন্ধে বিস্তৃতভাবে লিখতে বলেন যা তিনি সম্পূর্ণ করেছিলেন ম্যাপ ও একটি রুপার গ্লোবসহ। ঐতিহাসিক ইয়াকুব ইবন আবদুল্লাহ (মৃ. ১২২৯) শহর ও স্থানের ডিক্সনারি ও গেজেটিয়ারের রচয়িতা ছিলেন। জন্মগতভাবে তিনি ছিলেন আনাতোলিয়ান গ্রিক এবং মুসলিম ভূগোলবিদদের মধ্যে অন্যতম।
ইবনে সাঈদ (মৃ. ১২৭৪) পশ্চিম আফ্রিকান উপকূলে জরিপ করে একটি জরিপ পুস্তক রচনা করেন। তিনি ছিলেন আন্দালুসিয়ান (স্পেন)। ইবন খালিকান (মৃ. ১২৮২) জীবনচরিতের ডিক্সনারি রচনা করেন। তিনি বিখ্যাত বারমিকিডের বেক্ট্রিয়ান পরিবারভুক্ত ছিলেন। ইবন বতুতা (মৃ. ১৩৬৯), যিনি সমস্ত মুসলিম দেশ ভ্রমণ করেন, ছিলেন একজন মরোক্কান। তিনি পরিভ্রমণ করেন আফ্রিকা, সিলোন এবং মালদ্বীপ। ইবন খালদুন (মৃ. ১৪০৬) মুসলিম দার্শনিকদের মধ্যে বিখ্যাত ছিলেন। তিনি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ের ওপর জোর দিয়ে ইতিহাস রচনা করেছেন। তিনি তিউনিসিয়ার লোক।
১৩.১৩ ওষুধ ও চিকিৎসা
ইসলাম-পূর্ব আরব কবিদের লেখা থেকে জানা যায় যে প্রাচীন আরবরা তাদের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান দিয়ে গাছগাছড়া থেকে ওষুধ তৈরি করে অসুখ-বিসুখের চিকিৎসা করত; কিছুটা কাটা-ছেঁড়া করতেও পারত, কিন্তু বৈজ্ঞানিকভাবে চিকিৎসার জ্ঞান আরবের বাইরে থেকে অর্জন করেছে। অন্যান্য দেশের মতো খ্রিস্টান আরবগণ রোগীদের ও বৃদ্ধব্যক্তিদের যত্ন নিত ও তাদের কল্যাণের প্রতি নজরও দিত। তীর্থ যাত্রী ও পথিকদের জন্য তারা বিশ্রাম ঘর তৈরি করে গরিব ও দুস্থ ব্যক্তিদের জন্য খাদ্যও পানীয়ের ব্যবস্থা রাখত, তাছাড়া হাসপাতালের ব্যবস্থাও ছিল রোগীদের চিকিৎসার জন্য।
পঞ্চম শতাব্দিতে টাইগ্রিস নদীর তীরে এজিকেলের মঠ তৈরি হয়, সেখানে পাগল ও পরিত্যক্ত সন্তানদের খাওয়া ও থাকার বন্দোবস্ত ছিল এবং সারা মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে এর নামডাক ছিল।
মুসলিম রাজ্য বিস্তারের পঞ্চম শতাব্দিতে চিকিৎসাবিদ্যা ও ওষুধে খ্রিস্টানদের একচেটে আধিপত্য ছিল। শোনা গেছে বেশির ভাগ খ্রিস্টান ও কিছু ইহুদি চিকিৎসক মুসলিম দেশগুলোতে এবং তাদের ডিসপেন্সারিতে নেস্টোরিয়ান খ্রিস্টানদের লিখিত মেডিকেল বইপত্র ব্যবহৃত হয়েছে।
৭০৭ খ্রিস্টাব্দে জান্দিশাহপুরে নেস্টোরিয়ানদের হাসপাতালের নমুনা দেখে, উমাইয়া খলিফা প্রথম ওয়ালিদ ইসলামী রাজ্যে সর্বপ্রথম হাসপাতাল তৈরি করেন। তারপর ৮০০ খ্রিস্টাব্দে আব্বাসি খলিফা হারুন-অর-রশীদ, খ্রিস্টান বখত-ইস্যু পরিবারের এক সদস্যের উদ্যোগে, বাগদাদে প্রথম হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। এর দেখাদেখি দশম শতাব্দির শুরুতে আরও চারটি হাসপাতাল তৈরি হয়।
তখন খিলাফতের অধিকাংশ চিকিৎসক হিপোক্রাফ্ট (৩৫০ খ্রিঃ পূ) ও গ্যালেনের (২১০ খ্রিঃ) স্কুলের পদ্ধতি অনুসরণ করত। এগারো শতাব্দির শেষের দিকে একজন মিসরীয় চিকিৎসক হ্যালি রোডোয়াম দাবি করেন যে তিনি তার পেশাগত বিদ্যায় হিপ্পোক্র্যাটিক পদ্ধতির যাবতীয় টেকনিক অর্জন করেছেন।
সার্জারিতে সরল অপারেশন এবং সিজারিয়েন পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। সেই সময় ইসলামী দেশগুলোতে কাটাছেঁড়ার ব্যাপারে ছুৎমার্গ থাকায় এ বিষয়ে বেশি দূর উন্নতি সম্ভব হয়নি। তারপর এজিনার পলের লিখিত সার্জারি সম্বন্ধে পুস্তক অনূদিত হবার পর এ বিষয়ে কিছুটা উন্নতি হয়।
উমাইয়া ও আব্বাসি খলিফারা তাদের চিকিৎসার জন্য বেশি নির্ভর করতেন খ্রিস্টান চিকিৎসকদের ওপর। আব্বাসি খলিফা মনসুর যখন অসুস্থ হতেন, তিনি তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক জার্জিস ইবন গ্যাব্রিয়েলকে (মৃ. ৭৬০) ডেকে পাঠাতেন। জার্জিসকে তিনি বাগদাদের মেডিকেল ফ্যাকাল্টির প্রধান হিসাবে নিযুক্ত করেন। জান্দিশাহপুরের শিক্ষিত জার্জিস বাগদাদে মেডিকেল গবেষণার কাজে যথেষ্ট অবদান রাখেন।
জার্জিস ইবন গ্যাব্রিয়েল খ্রিস্টান পরিবার বখত ইসু সদস্য; এই পরিবার অষ্টম শতাব্দি থেকে এগার শতাব্দি পর্যন্ত সপ্তম জেনারেশন ধরে বিখ্যাত চিকিৎসক সরবরাহ করেছে। তারা রাজসভা চিকিৎসক হিসাবে খলিফা হাদি (মৃ. ৭৮৮) এবং খলিফা হারুন-অর-রশিদ (মৃ. ৮০৯) এবং আরও কতিপয় খলিফার রাজসভায় কাজ করেছেন এবং গরিব ও দুস্থদের জন্য বিনামূল্যে ডিসপেনসারি তৈরি করার দায়িত্ব পালন করেন।
ইউহানা ইবন ম্যাসাওয়ে, একজন নেস্টোরিয়ান চিকিৎসক আব্বাসি দরবারে কাজ করেন। তিনি গ্যালেনের লিগ্যাসিকে বিস্তৃত করেন। তার কাজ পারস্য চিকিৎসক হ্যালি আব্বাস (মৃ. ৯২৮)কে সরাসরি প্রভাবিত করা। তার লিখিত মেডিসিনের ওপর এনসাইক্লোপেডিক সার্ভে ল্যাটিনে অনূদিত হয় এবং পশ্চিমে জনপ্রিয়তা লাভ করে, যতদিন পর্যন্ত না আবু সিনার ক্যানন প্রকাশিত হয়েছিল। আবু সিনাকে ‘ইসলামের গ্যালেন’ বলা হতো। তিনি মারা যান ১০৩৭ খ্রিস্টাব্দে। ম্যাসাওয়ে চক্ষু-চিকিৎসা সম্বন্ধে আরবি ভাষায় প্রথম পুস্তক রচনা করেন। এই পুস্তক আল- হ্যাজেন (মৃ. ১০৩৮)কে প্রভাবিত করলে তিনি চক্ষু চিকিৎসা সম্বন্ধে এক বিখ্যাত পুস্তক রচনা করেছেন।
বাগদাদের খ্রিস্টান চিকিৎসক, দার্শনিক ও ধর্মবেত্তা ইবন বুতলদান (মৃ. ১০৬৬) গ্যালেনের সমালোচনা করে একটা বিতর্কিত থিসিস লেখেন দেহ তত্ত্ব বিষয়ক কতকগুলো মৌলিক নীতির ওপর। তিনি একটি মূল্যবান পুস্তক রচনা করেন। যেখানে তার সমসাময়িক পণ্ডিত ব্যক্তিদের নাম উল্লেখ করেন যারা বিজ্ঞান, দর্শন ও সাহিত্যে পণ্ডিত ছিলেন।
উল্লেখযোগ্য যে, বিখ্যাত ধর্মবেত্তা আল-গাজ্জালী ইবন বুতলানের মেডিকেল বই পুস্তকগুলোকে বিশ্লেষণ করেন। এই সময়ে ইবন তিলমিদ সাধারণ মেডিকেল প্রাকটিস ও সার্জারির যথেষ্ট উন্নতি সাধন করেন। তিলমিদ (মৃ. ১১৬৫) খ্রিস্টান ছিলেন।
একজন জোকোবাইট খ্রিস্টান আবুল ফারাজ বলেও পরিচিত বহু ভাষাবিদ ছিলেন। তিনি হিব্রু, সিরিয়াক, আরাবিক ও গ্রিক ভাষায় পণ্ডিত ছিলেন। তার নাম ছিল জর্জিয়াস বার হেব্রাউস (মৃ. ১২৮৬)। তিনি দর্শন, বিজ্ঞান ও চিকিৎসাবিদ্যা সম্বন্ধে মূল্যবান পুস্তক রচনা করেন। এছাড়া তিনি পৃথিবীর ইতিহাসও রচনা করেছেন।
খ্রিস্টান চক্ষু চিকিৎসক আলী ইবন ঈসা (মৃ. ১২৯০) বাগদাদবাসী ছিলেন। তার অন্য নাম ছিল জেসু হালি। চক্ষু চিকিৎসা সম্বন্ধে একটি পুস্তক রচনা করে তিনি বিখ্যাত হম। এই পুস্তকটি হ্যান্ড বুক ছিল ১৭৫০ সাল পর্যন্ত, আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান শুরু না হওয়া পর্যন্ত।
বিশ্বে সেই সৃজনশীল দিনগুলো আর নেই, যদিও ছোটখাটো কিছু হচ্ছে তাও আগেকার উৎস থেকে নকল, মৌলিক কিছু নয়।
১৩.১৪ বিজ্ঞান
ফরাসি লেখক আর্নেস্ট রেনন বলেছেন আরবরা বলতে গেলে গ্রিকদের ছাত্র এবং তথাকথিত আরব বিজ্ঞান হলো গ্রিক বিজ্ঞানের ধারাবাহিকতা ছাড়া অন্য কিছু নয়। কিন্তু আরব বিজ্ঞানের মূল খুঁজতে গেলে গ্রিক নয়, খুঁজতে হয় মেসোপটেমিয়া, চীন ও ইন্ডিয়ায়।
উন্নত গণিত ও জ্যামিতি ব্যাবিলনের হাম্মুরাবির সময় থেকে অজানা নয়। তখন কাল ছিল ১৭৫০ খ্রিঃ পূর্বাব্দ। প্রাচীন ব্যাবিলন মেকানিকস ও হাইড্রলিক্সে উন্নত ছিল, আর সেই সূত্রে সেচ কর্ম খাল প্রকৌশল (Canal Enginering) ও বন্যা নিয়ন্ত্রণে বিশেষজ্ঞ ছিল। তাছাড়া জমি জরিপ এবং প্রাচীন বিশ্বে গ্রহ, নক্ষত্রের চর্চা ছিল উন্নত ধরনের। আরবে নক্ষত্রদের নাম ছিল অ্যালদেবারেন, অ্যালটাইর, রিগেল ও বেতেলজেউস – এদের চার্ট ব্যাবিলনেই তৈরি হয়।
তেমনি ইসলামী বিশ্বে বিখ্যাত অবজারভেটরি প্রাচীন বিশ্বের মতো। ব্যাবিলিয়নের জিগ্গুরাত (Ziggurat), কথিত আছে, মন্দির ও অবজারভেটরি উভয় অর্থেই ব্যবহৃত। গ্রিক অবজারভেটরি রোডেসে তৈরি হয় হিপ্পারকাসের দ্বারা ১৫০ খ্রিঃ পূর্বাব্দে। হিপ্পারকাস নক্ষত্রবিদ্যায় উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার করেছেন।
ইসলাম-পূর্ব অবজারভেটরি ছিল পারস্যের জান্দিশাহপুরের নেস্টোরিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ঢঙে সিন্দ ইবন আলি (মৃ. ৮৫০) বাগদাদে আর একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। যশস্বী আরব জ্যোতির্বিদ আলবেটেগনিয়াস (Albategnius), (মৃ. ৯১৫) যার নাম কোপারনিকাস তার পুস্তক De Revolutionibus-এ উল্লেখ করেছেন, তিনি ছিলেন উত্তর মেসোপটেমিয়ার নক্ষত্র পূজারী সাবিয়েন সম্প্রদায়ভুক্ত। উজবেক জ্যোতির্বিদ আল-খারাজমি (মৃ. ৯৭৫) যে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টেবল রচনা করেছিলেন ইন্ডিয়ার হিন্দু জ্যোতির্বিদদের-অনুকরণে এবং সেখানে যে অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ চিহ্নিত করা হয় তার বেশিরভাগের সূত্র টলেমি নির্ভর।
তথাকথিত আরব সংখ্যা- চিহ্ন (numeral) বলা হয় ইন্ডিয়া অরিজিন এবং ডেসিম্যাল পদ্ধতি ইত্যাদি চীন দেশ থেকে আহরিত (Needham, 1969 P. 12)। সিরিয়ান বিশপ সার্ভেরাস (৬৮০) ইন্ডিয়ান পদ্ধতির গুণগান করে একটি প্রবন্ধ লিখেন যা আরবদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
এটাও লক্ষণীয় যে আরবরা যা আবিষ্কার করেছে বলে ধরা হয় তারও পূর্ব সূত্র ছিল। যেমন নাবিকদের কম্পাস কোনো একটা দিকে চায়নিজ, কার্থেজিয়ান ও নর্সম্যানদের সম্পৃক্তি ছিল। সূর্যের ও অন্যান্য গ্রহের অলটিচুড মাপার যে যন্ত্র আরবদের আবিষ্কার বলে লোকে মনে করে, অন্যান্যদের সাথে গ্রিকদের সম্পর্ক ছিল। স্থানীয় আবিষ্কারের মধ্যে মেকানিকেল খেলনা, ওয়াটার ক্লক ইত্যাদি আলেক্সান্দ্রিয়ার হিরোককে মূল সূত্র বলা হয় যার কথা জানা যায় থাবিত ইবন কুররা অনুবাদ কর্ম থেকে। ঐতিহাসিকদের মতে, আব্বাসি খলিফা হারুন-অর-রশিদ শার্লামেনের কাছে একটি ওয়াটার ক্লক মুসলিম আবিষ্কার বলে উপহার রূপে পাঠিয়েছিলেন।
রসায়ন ক্ষেত্রে আরবদের যে অবদানের কথা বলা হয় সম্ভবত মিসরীয় (আলেক্সান্দ্রিয়ান) আরজিন। যেমন এলকোহল, এলিক্সির, এলেমাবিক, কারবয়, অ্যালকালি, নাফথা, নেট্রন, অ্যালকেমি, বোরাক্স, ট্যাঙ্ক এবং বেনজিন ঐতিহাসিকভাবে, প্রথম মুসলিম অ্যালকেমিস্ট ছিলেন খালিদ (মৃ. ৬৮০)। খালিদ ছিলেন ১ম এজিদের পুত্র। খালিদ আলেক্সান্দ্রিয়ার দার্শনিক অ্যালকেমিস্ট স্টিফেনাস- এর (মৃ. ৬৪১) লেখা পুস্তক পড়ে রসায়নে আগ্রহ বাড়ে এবং তিনি সিরিয়ার খ্রিস্টান সাধু মরিনিয়াস রোমানাসের কাছ থেকে অ্যালকেমিক্যাল প্রক্রিয়া সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করেন। এই খ্রিস্টান সাধু নিজেই মিসরের আলোন্দ্রিয়া থেকে আলকেমি সম্বন্ধে শিক্ষা লাভ করেন।
কয়েকজন আরব দার্শনিক ও অ্যালকেমিস্ট ছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন জাবির ইবন হাইনে (মৃ. ৮১৬)। ইনি হাররানের সাবিয়েন ছিলেন এবং সালফারিক এসিড ও হাইড্রোক্লোরিক এবং নাইট্রিক এসিড মিশিয়ে একোয়া রেজিয়া (রয়েল ওয়াটার) আবিষ্কার করেন। এই একোয়া সোনা ও প্লাটিনামকে দ্রবীভূত করতে পারত। এদের মধ্যে নামকরা তিনজন ছিলেন জুন নুন (মৃ. ৮৫৯০), রাজী (মৃ. ৯৪০) এবং আল ফারাবি (মৃ. ৯৫০)।
আরবরা স্পেনে অ্যালকেমি নিয়ে যায় এবং সেখানে উত্তর আফ্রিকা থেকে ম্যাজিক ও অন্যান্য দ্রব্য মিলিয়ে জাদুবিদ্যা উদ্ভাবন করেন। এই জাদু বা গুপ্তবিদ্যার শিক্ষা কেন্দ্র খোলা হয় গ্রানাডা, সেভিল ও কর্ডোভার বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং সেখান থেকে দক্ষিণ দিকের চাহিদা পূরণ করা হয় এবং উত্তর দিকে চাহিদা পূরণের জন্য কেন্দ্র খোলা হয় টলেডো, সালামানকা ও সারাগোসাতে।
মেটালারজি, ড্রাগ, অ্যালকেমি, অ্যাস্ট্রোনমি এবং অন্যান্য বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে নামকরা লেখক ছিলেন জাবের (মৃ. ১২৯০)। তার ল্যাটিন নাম ছিল জাবিন-ইবন আফলাহ। আর একজন বিখ্যাত লেখক ছিলেন খাজিনি (মৃ. ১২১০)। তিনি ছিলেন বাইজানটাইন গ্রিক এবং ওজন করা মেসিন সম্বন্ধে পুস্তক রচনা ছাড়া আরও অনেক বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় পুস্তক রচনা করে অনেক সমস্যার সমাধান করেছেন।
১৩.১৫ দর্শন
গ্রিক ‘ফিলসোফস’ থেকে আরবিতে হয়েছে ‘ফিলাসুফ’ অর্থাৎ দার্শনিক এবং এই নামের সাথে অনেক গ্রিক দর্শন আরবে ঢুকে গেছে। পিথাগোরাস এবং প্লেটো থেকে রোমান স্টোইক (দার্শনিক জেনোর শিষ্য) পর্যন্ত ইসলামী দর্শনকে সমুন্নত করেছে। গ্রিক দর্শনের কেন্দ্রভূমি ছিল- হেলিনস্টিক স্কুল অব টলেমিজ্, সেলুসিড এবং বাইজানটাইন।
অন্যান্য ফ্যাক্টর থেকেও মুসলিম দর্শনের বিবর্তনকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছে। অন্যান্য প্রাচীন ধর্মমত, যেমন— বৃড্ডিইজম, জোরাস্ট্রিজম, জুদাইজম ও খ্রিস্টানিটি, বিজয়ী মুসলিম নতুন নতুন চিন্তাধারার সংমিশ্রণে পুরানো ও নতুন মিলে একটা খিচুড়ি দর্শন হয়েছে (আর্নল্ড ও গিয়োম ১৯৬৫ পৃ. ২৩৯)।
ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে অনেকে পুরনো বিশ্বাস ভুলতে পারেনি যা কালক্রমে ইসলামের সাথে মিশে সংশোধিত হয়ে নতুন ধারণায় পরিণত হয়েছে। ফলে ইসলামাইজেশন কখনো পরিপূর্ণ হয়নি অনেক স্থানে; তাই যখন পরিপূর্ণতা লাভ করেছে তখন দেখা গেছে ইসলামের আর ইসলামিত্ব থাকেনি, নবরূপে উদিত হয়েছে।
আরব থেকে অ-আরবরা কোরান পাঠে বেশি আগ্রহী ছিল এবং তারাই ছিল ধর্মীয় দর্শনের প্রবক্তা। ফলে অ-আরব মুসলিম যারা বেশি চর্চা করত তারাই ব্যাখ্যা দিয়েছে এবং এই ভাবে শরিয়ত সংশোধিত হয়ে স্থানীয় প্রথা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কোরানের বিখ্যাত তফসিরকারদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কাব আল-আহবার (মৃ. ৬৫৫) ছিলেন ইহুদি; ইকরামা (মৃ. ৭২৩) ছিলেন বার্বার আরজিন; মাকহুল (মৃ. ৭৩১) ছিলেন আফগান; আতা ইবন রাহাব (মৃ. ৭৩২) ছিলেন আফ্রিকান বংশধর এবং এজিদ ইবন আবু রাহিব (মৃ. ৭৪৫) ছিলেন নুবিয়েন।
প্রথমে আরবদের কোনো স্বচ্ছ ধর্মীয় জুরিসপ্রুডেন্স ছিল না এবং ধর্মবেত্তাগণ, (মুতাকালিম বা প্রবক্তা) বিদেশীদের (খ্রিস্টানসহ) সাথে তর্কাতর্কির পর ধর্মীয় আইন কোড উন্নত করতে শুরু করেন। এই রূপে দামেস্কোর জন (মৃ. ৭৪৯) এবং থিওডোরাস আবুকারা (মৃ. ৮৫০), হাররানের মেলচাইট বিশপ এই বিষয়ে যথেষ্ট অবদান রেখেছেন (আমীর আলী, ১৯৬৫, পৃ. ৩৬৫)।
অমুসলিমদের সাথে এই মুখোমুখি বাক্যব্যয়ের কারণে মুসলিম ধর্মবেত্তাগণ তাদের দুর্বলতা কাটিয়ে ধর্মীয় ব্যাপারে তর্ক করার আর্ট শিখে ফেলে এবং অমুসলিমদের শেখানো অস্ত্রে মুসলিম ধর্ম পণ্ডিতরা অমুসলিমদের আক্রমণ করতে থাকে (মাকদিসি ১৯৮১, পৃ. ১০৫)।
মুসলিম চিন্তাবিদদের ইতিহাসে বহু বিখ্যাত পণ্ডিতের নাম জুড়ে আছে, তাদের মধ্যে অনেকেই বহুমাত্রিক ছিলেন অর্থাৎ বিবিধ বিষয়ে পণ্ডিত, যেমন ইতিহাস, ভূগোল, গণিত, নক্ষত্রবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, ভাষাবিদ্যা, সঙ্গীত ও ধর্ম সব ক্ষেত্রেই পণ্ডিত। গ্রিক চিন্তাবিদদের সাহচর্যে এসে তর্কবিদ্যা ও যুক্তিবিদ্যাকে ন্যায়সঙ্গত বিবেচনা করেন এবং যুক্তিবিদ্যাকে ধর্ম ও রহস্যবিদ্যার ওপরে ঠাঁই দিয়ে যুক্তিবাদী হয়ে ওঠেন। এর পর তাঁরা যেসব রচনা করেছেন তা যুক্তিতর্কের ওপরে ভিত্তি করেই করেছেন এবং তা ধর্মবেত্তাদের বক্তব্যের বিপরীতে দাঁড়িয়েছে।
ইসলাম দর্শনের পিতা ছিলেন আল-কিন্দি (মৃ. ৮৬৮), পশ্চিম দেশে আলকিন্দুস বলে পরিচিত। তিনি খ্রিস্টান গোত্র কিন্দা পরিবারের মানুষ, তাই নাম হয়েছিল আল- কিন্দি। আল-কিন্দি একমাত্র দার্শনিক, যিনি খাঁটি আরব রক্তের। আলফ্রেড গিয়োম তার সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বলেছেন- ‘আরবের প্রথম এবং শেষ দার্শনিক’ (Amold and Guillaume 1965, P. 251)। আল-কিন্দি গ্রিক দর্শন ও আরবিতত্ত্বের সংমিশ্রণে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেন এবং গ্রিক দর্শনকে ইসলামী বিশ্বে গ্রহণযোগ্য করে তুলেন। তিনি খলিফা মামুনের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে পরে খলিফা মুতাসিমের এক পুত্রের গৃহশিক্ষক নিযুক্ত হন।
দার্শনিক এবং চিকিৎসক আল-রাজী পার্সিয়ান ছিলেন। পশ্চিমে রাজেস (মৃ. ৯২৫) বলে পরিচিত। পারস্যের রাই শহরে জন্মগ্রহণ করেন এবং বাগদাদে শিক্ষা লাভ করেন। খ্রিস্টান পণ্ডিত হুনায়েন ইবন ইসহাকের এক শিষ্যের সাগরেদ ছিলেন। পরের বছরগুলোতে তিনি মেসোপটেমিয়ার উত্তরে হাররানের গ্রিক স্কুলের সাথে জড়িত ছিলেন এবং সেখানে প্লেটোর ‘তিমাউস’ (Timaeus) দ্বারা প্রভাবিত হন। যুক্তিবাদের ওপর জোর দিয়ে বলেন, একমাত্র যুক্তিই মানুষকে দিকনির্দেশনা দিতে পারে এবং ‘ওহী’কে মিথ্যা প্রমাণিত করে মন্তব্য করে, ধর্ম বিপজ্জনক বস্তু। (Hourani 1991, P. 78)।
মুসলিম দার্শনিকগণ এরিস্টটলের নীতির ওপর বিশ্বাসী ছিলেন। অভিজ্ঞতা লাভ হয় পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ দ্বারা এবং এই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্য দিয়ে তারা নিজেদের ধারণাকে বিকাশ করে বিখ্যাত হয়েছেন। তুর্কি দার্শনিক আল-ফারাবি (মৃ. ৯৫০) আমু দরিয়ার নিকট ফারাব শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বাগদাদে এসে খ্রিস্টান শিক্ষকদের কাছ থেকে সঙ্গীত, দর্শন ও গ্রিক বিজ্ঞানে জ্ঞান লাভ করেন। প্লেটোনিজম ও নিও- প্লেটনিজিম দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন এবং বিশেষ করে এরিস্টটল দর্শন তাকে এমনভাবে প্রভাবিত করেছিল যে তিনি নিজেই দ্বিতীয় এরিস্টটল হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন।
আর একজন বিখ্যাত মুসলিম দার্শনিক পণ্ডিত আবু সিনা (মৃ. ১০৩৭)। ইনি বুখারায় জন্মগ্রহণ করেন এবং বখে লেখাপড়া করেন। এই বল্খ একদিন ছিল বুড্ডিস্ট ও জোরাম্ব্রিয়ান শিক্ষা কেন্দ্র। তিনি কয়েকটি ক্ষেত্রে, বিশেষ করে চিকিৎসাবিদ্যায় বিশাল অবদান রেখে গেছেন। গ্রিক দর্শনকে তিনি আরো বিস্তৃত করেন, বিশেষ করে এরিস্টটলের ওপর এবং মুসলিম বিশ্বে এই দর্শনের ব্যাপ্তি এনে দেন। এই কারণে তাকে তৃতীয় এরিস্টটল বলা হয়। পশ্চিমে এই বিখ্যাত দার্শনিক ‘এভিসিনা’ বলে পরিচিত।
আল গাজ্জালি বা আল গ্যাজেল পারস্যের তুস শহরে জন্মগ্রহণ করেন এবং বাগদাদে ১০৯৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শিক্ষা লাভ করেন। পরে কিছু সময়ের জন্য তিনি লেখাপড়া ছেড়ে সুফিবাদ গ্রহণ করেন, যদিও অর্থোডক্স মুসলিম ছিলেন। তিনি কঠিন ধর্মীয় তত্ত্ববাদী আল-ফারাবি ও আবু সিনার সমালোচনা করেন এবং ধর্মীয় বা ঈশ্বর তত্ত্বকে দর্শনের ওপরে ঠাঁই দেন; পরে তিনি রহস্য কবি রুমী কর্তৃক অভিযুক্ত হন এই বলে যে আল-গাজ্জালীর সত্যিকার অর্থে আধ্যাত্মিকতার অভাব ছিল, যে অধ্যাত্মবাদ তার ছোট ভাই আহম্মদ আল গাজ্জালীর লেখায় প্রকাশ পেয়েছিল, আহম্মদ আল- গাজ্জালী প্রেমতত্ত্বের ওপর রহস্যবাদের পুস্তক রচনা করেছিলেন।
অবশেষে বড় ভাই আল-গাজ্জালীর শিক্ষা পূর্ব দিকের মুসলিম জগতে জয়ী হয় সাধারণ দর্শনের ওপর এবং অর্থোডক্স ইসলাম চেপে বসে; যদিও মুরিশ স্পেনে ইবন বাজ্জা (মৃ. ১১৩৮) বা এভেস্পেস (Avempace)-এর লেখনীর মাধ্যমে সাধারণ দর্শনশাস্ত্র আগের মতোই চলতে থাকে। ইবন বাজ্জা দর্শন ছাড়া, চিকিৎসা, মেটিরিওলজি, গণিত এবং সঙ্গীতে লেখালেখি করে এই সব ক্ষেত্রে যথেষ্ট অবদান রেখেছেন। দার্শনিক আবুবেকার বা ইবন তুফায়েল (মৃ. ১১৮৫) গণিত চিকিৎসাবিদ্যা ও স্বাধীন জীবনের অপর দর্শন সম্বন্ধে নতুন তথ্যের দ্বার উদ্ঘাটন করেন।
আন্দালুসিয়ান দার্শনিক এভেরুশ (আবু রুশদ) (মৃ. ১১৯৮) এরিস্টটলকে ‘পার্ফেক্ট ম্যান’ ‘আদর্শ মানব’ বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি গ্রিক মাস্টার এরিস্টটলের ওপর অরিজিনাল তফসির লিখেছিলেন এবং তফসিরকার বা ব্যাখ্যাকার আখ্যা লাভ করেন। তিনি এরিস্টোটলিয়ন টার্মে কোরানের ব্যাখ্যা করেন এবং মুসলিম দর্শনের একটি পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করেন যা পরে ধর্মবিরুদ্ধ মতামতের কর্মশালা রূপে দাঁড়ায়। আবু রুশদ কর্ডোভাতে বিচারকের পদ অলংকৃত করেন কিন্তু তার ধর্মবিরুদ্ধ মতামতের জন্য চাকরিচ্যুত হয়ে নির্বাসিত হন। আর্নেস্ট রেনান আবু রুশদকে যুক্তিবাদী মানুষরূপে বর্ণনা করেন এবং তাকে মুক্তচিন্তার জনক বলে আখ্যায়িত করেন।
আল ফারাবি, আবু সিনা ও আবু রুশদ্ এরিস্টটলের শিক্ষার অনুসারী ছিলেন এবং এমন সব মতামত প্রকাশ করেন যা ইসলামের মৌলিক নীতিবিরুদ্ধ। সুতরাং এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই যে অর্থোডক্স ধর্মবিদরা এই সব প্রাচীন মতামত ও শিক্ষা-দীক্ষার (ইলম্ উল কাদিম) ধারণাকে রুখে দাঁড়াবেন। কেননা এই সব শিক্ষা ও মতামত অমুসলিম সূত্র থেকে আহরিত। তারা গ্রিক দর্শন ও সেকুলার জ্ঞানকে অবিশ্বাস করেছে কারণ তারা বিশ্বাস করত এই শিক্ষা ও মতবাদ ইসলামে গণ্ডগোল সৃষ্টি করে বিভিন্ন গোষ্ঠীতে মুসলিম উম্মাহকে ভাগ করে দিবে।
সাধারণত দর্শনবিদ্যাকে তা মুসলিম হোক আর অমুসলিম- সন্দেহের চোখে দেখা হয়েছে। মুক্তচিন্তা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার দ্বার বন্ধ করে দেয়া হয় এবং যেমন খ্রিস্টান রাজ্যে হয়েছিল তেমনি বিরুদ্ধ মতাবলম্বীদের অত্যাচারিত ও নিপীড়িত হয়ে হয়েছে।
ত্রয়োদশ শতাব্দির শেষ দিকে এটা স্পষ্ট হয়ে দেখা দিল মুসলমানরা শিক্ষার যে কোনো ক্ষেত্রে, যেমন বিজ্ঞান, চিকিৎসাবিদ্যা ও দর্শন, সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া থেকে সম্পূর্ণরূপে স্তব্ধ হয়ে গেল মোল্লাদের গায়ের জোরে এবং আস্তে আস্তে শিক্ষা ও জ্ঞানের সূর্য মুসলিম বিশ্ব থেকে অস্তমিত হয়ে পশ্চিমে উদিত হলো; আর মুসলিম-বিশ্ব ডুবে গেল গাঢ় অন্ধকারে। এর জন্য দায়ী আল-গাজ্জালী ও আল-আশারীর একগুঁয়েমি।
১৩.১৬ সুফিবাদ
ইসলামের অঙ্গ হিসাবে সুফিবাদ পশ্চিমে অতি সমঝোতার সাথে স্বীকৃত। সুফিবাদকে মনে করা হয় বিশ্বজনীন একটা বিশ্বাস (universal faith)। উদার শিক্ষানীতি ও সহিষ্ণুতার মতবাদ এই সুফিবাদ।
বিভিন্ন দল, গোষ্ঠী ও তরিকার সংমিশ্রণে এই সুফিগোষ্ঠী সংঘবদ্ধ সর্বেশ্বরবাদে গুপ্ত আধ্যাত্মিক ভাবধারা (mysticism), নির্গমন (emanation), স্বর্গীয়ে জ্যোতিকে আলোকিতকরণ (illumination)-এর মোহান্বিত অবস্থায় সুফিদের অবস্থান যা কট্টর অর্থোডক্সের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তারা ব্যক্তিগত আধ্যাত্মিক বিবর্তনের কাছে শরিয়া আইনের মূল্য নগণ্যই প্রদান করে। সুফিবাদের প্রথম দিকে সাধকগণ ছিলেন মরমীবাদের স্থলে প্রকৃতপক্ষে সংযমী ও সংসারত্যাগী এবং মানসিকভাবে প্রশান্ত। ব্যক্তি বিশেষের মাঝে সমস্ত অশুভ অকৃত্রিম ও কুচিন্তার ধ্বংস সাধন করা ‘ফানা’ বা আত্মশুদ্ধির মাঝে। ‘ফানা’ অর্থাৎ লীন প্রাপ্তি ভারতীয় নির্বাণ পদ্ধতির অনুরূপ। নির্বাণের সাথে পার্থক্য এই যে ‘ফানা’ বা আত্মশুদ্ধিতে মোক্ষলাভ হয় না; এর পর ‘বাকা’ স্তর অর্থাৎ সাধক প্রেমিকের আত্মা সৃষ্টিকর্তার আত্মার সাথে বিলীন হয়ে যাওয়া।
সুফি শব্দের উৎস অনেকের মতে গ্রিক শব্দ জ্ঞান (Sophia) থেকে উদ্ভূত, কিন্তু এটা সর্বজন স্বীকৃত যে, ‘সুফ’ (পশম – wool) থেকে সুফি শব্দের উৎপত্তি। খ্রিস্টান সাধুদের মতো মুসলিম সন্ন্যাসীগণ সংসার ত্যাগ করে পশমের লম্বা কোট পরিধান করেন সিরিয়ান সাধুদের মতো। এই লম্বা কোটকে ‘খিরকা’ (cloak) বলা হতো। খিরকা বিভিন্ন রঙের কম্বল থেকে তৈরি করা হতো।
প্রফেট মোহাম্মদ স্বাভাবিক কারণেই মুসলিম সমাজ থেকে বৈরাগ্যবাদ নিষিদ্ধ করেছিলেন- জুহুদের (zuhd) বিরোধী ছিলেন। ‘লা রাহবানিয়াত ফিল ইসলাম’- কি এই প্রসিদ্ধ হাদিসের অর্থ হচ্ছে, ইসলামে বৈরাগ্যের (manasticism) ঠাঁই নেই। কোরানের মতে খ্রিস্টানরা বৈরাগ্যবাদ আবিষ্কার করেছিল ঈশ্বরকে খুশি করতে কিন্তু তারা সম্যকরূপে পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে। কোরান বলেছে- “কিন্তু বৈরাগ্য, ইহা তো উহারা নিজেরাই আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য প্রতিষ্ঠা করিয়াছিল, আমি উহাদিগকে ইহার বিধান দিই নাই’ (৪৭ : ২৭)। সুফিদের মধ্যে যারা বৈরাগ্য পছন্দ করেন তারা ব্যাখ্যা করেন যে এটি স্বর্গীয় বিধান কিন্তু একে নষ্ট করা হয়েছে।
মনে রাখতে হবে ইসলামসম্মত জুহুদ হলো নফলসহ এবাদতগুলো সম্পাদন করা, জাগতিক বস্তুগুলোর প্রতি কোনো আকর্ষণ না রেখে। কিন্তু নফল এবাদত অত্যধিক বাড়াবাড়ি যেমন- সারা জীবন নামাজে মশগুল থাকা, স্ত্রীর প্রতি কর্তব্যে অবহেলা করে সারারাত নামাজ পড়া, সংসার বিরাগী হয়ে বিয়ে না করা ইত্যাদি ইসলাম কোনোকালে সমর্থন করেনি। খ্রিস্টানদের রাহবানিয়া বা বৈরাগ্য হলো ‘সেলিবেসি’, বিয়ে না করে কোনো মঠের সাথে যুক্ত থাকা। মংক ও নান-রা বিয়ে করে না কারণ খ্রিস্টধর্ম ‘সেলিবেসি’কে প্রাধান্য দিয়েছে অর্থাৎ বিয়ে না করে ধর্ম জীবন পালন করা বেশি পুণ্যের। ইসলাম এ প্রকার সন্ন্যাসবাদ নিষিদ্ধ করেছে। হাদিসে আছে— “বিবাহ আমার সুন্নত, যে আমার সুন্নতকে অবহেলা করিবে, সে আমার দলভুক্ত নহে।’ ইসলামের প্রধান সুফিদের অনেকেই বিবাহিত ও সংসারী। অথচ তারা কঠোর সংযমী ও জাহিদ ছিলেন।
প্রফেটের নিষেধ সত্ত্বেও সুফিগণ সঙ্গীত ও বাদ্যযন্ত্রের যথেচ্ছ ব্যবহার করেছেন। এবং কবিতার প্রসারও সুফিদের কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত।
ধর্মীয় অভিজ্ঞতা লাভের জন্য সুফিগণ বিভিন্ন ধরনের কলাকৌশল রপ্ত করেন। এর থেকে মোহান্বিত অবস্থার (ecstasy) উদ্ভব হয়, যাকে ‘হাল’ বলা হয়। এই রূপ নীরব দরবেশরা (মধ্য এশিয়ার নকসবন্দি তরিকা) তাদের এবাদত নীরবেই প্রতিপালিত হতো, অন্যদিকে চক্রাকারে নৃত্যরত দরবেশ (তুর্কি তরিকা-মাওলানা রুমি প্রবর্তিত); উত্তর আফ্রিকার রিফাই তরিকায় হুলুধ্বনি দিয়ে আল্লাহর জিকির করা; কালান্দার তরিকায় ভবঘুরে দরবেশরা কখনো এক স্থানে অবস্থান করেন না, দূর দেশান্তরে ঘুরে বেড়ায় এবং এই তরিকায় আত্মার শুদ্ধি করে।
বিদেশীদের সাথে সংযোগে সুফিরা কয়েকটি বিদেশী পদ্ধতি আয়ত্ত করেন। এইরূপে এবাদতের সময় নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের কৌশল আয়ত্ত করেন একাদশ শতাব্দির গ্রিসীয় হেসিচাস্ত (Hesychast) সাধুদের কাছ থেকে; বিশেষ করে সিরিয়া ও তুরস্কের সুফিসাধকরা জিকিরের সময় নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের (breathing exercise) ব্যায়াম করেন আর ভারতের মুসলিম রহস্যবাদীদের কাছে থেকে যোগ ব্যায়ামের আসন আয়ত্ত করেন।
ইসলামী রহস্যবাদীদের উদাহরণস্বরূপ সুফিবাদ নাকি ধর্মবিরুদ্ধ। কোনো কোনো পণ্ডিত ব্যক্তি যেমন- এ. সি. বুকে (Bouquet) বলেন যে, সুফিবাদ ইসলাম থেকে সাধারণভাবে উদ্ভব হয়নি কিন্তু এটা বিদেশী ভাব দ্বারা প্রভাবিত এবং সত্যি ইসলামী ডগ্মার সাথে সামঞ্জস্য নয়। আর সি জেহনার (Zaehner) লিখেছেন যে সুফিবাদ ইসলামী অর্থডক্সতত্ত্বের বিকৃত রূপ এবং এটা একটা আলাদা ধর্ম বলা যায়। তা সত্ত্বেও, সুফিবাদ ইসলামে একটা স্থায়ী সংযোগ সাধন করে এখনো পর্যন্ত প্রভাব খাটিয়ে আসছে।
কারণ এই রহস্যবাদী কোনো কোনো ব্যক্তি বা দল ইসলামের আওতায় থেকে শরিয়াবিরুদ্ধ তালে চলছে তাই এদের আইন বহির্ভূত (বিশার) দল বলে এবং এই দলকে ‘বিশরিয়া’ বলা হয়। বিশরিয়া ভাববাদীদের ধর্মবেত্তারা অনৈসলামিক ভাববাদী বলে চিহ্নিত করেছেন এবং তাদের ডকট্রিনকে ‘বাতিল’ বলে ঘোষণা করেন।
মূলত বিশারিয়া যারা তারা বিশ্বাস করেন যে কোনো গুরুর সাহায্য ছাড়া এবাদতের দ্বারা সরাসরি আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করা যায়। এদের প্রবক্তা বলেন মানুষ অন্ধকারে মোমবাতি খোঁজে (মোহাম্মদ, কোরান ও শরিয়া), কিন্তু যখন সূর্যের আলো বিকিরণ হয় তখন মোমবাতি নিভিয়ে পাশে রাখা হয়।
‘বিশারিয়া’ বিদ্রোহীরা কাবাঘরের কালো পাথরকে ‘ফালতু’ মনে করে, যার ওপর অন্যান্য মুসলিম লেখকগণ প্রশ্ন রেখেছেন। বলা হয় যে, মক্কা শহরের জন্য আরব দেশ পবিত্র এবং প্রফেট মোহাম্মদ বহু পূর্বে মক্কা প্যাগনদের কাছে পবিত্র ছিল কিন্তু প্রফেট মোহাম্মদ মক্কার চেয়ে মদিনাকে গুরুত্ব দিয়েছেন এবং জেরুজালেমকে এই দুটি শহরের চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করতেন। মক্কা পবিত্র ছিল কাবাঘরের জন্য, এই কাবাঘর অনেকবার ধ্বংস হয়েছে এবং পুনর্নির্মাণ হয়েছে। সুতরাং আরব পবিত্র ভূমি কিসে? মক্কা পবিত্র নগর আর কাবা পবিত্র ঘর যেখানে কালো পাথর যা প্যাগনরা পূজা করত আর চারপাশ প্রদক্ষিণ করে, প্রার্থনা করত। সেই কালো পাথর এখনো আছে এবং হজের সময় মুসলিম সেই প্যাগন রীতি পালন করছে। কালো পাথরের চারদিকে পাক দিচ্ছে।
ইসলাম মূর্তি পূজার বিরুদ্ধে, কিন্তু বিশরিয়ারা যুক্তি দেখায় যে আসল মূর্তি পূজা হচ্ছে কোনো পুরনো রীতি বা নিয়মকে অনুসরণ করা। ধর্মবিদরা মনে করেন আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক অনুশাসন ইসলামের প্রাণহীন বস্তু, এ যেন বাহরানের দেয়ালে সিংহের মূর্তি পেন্ট করার মতো। পার্সিয়ান সুফি আল হিরি (মৃ. ৯১১) লিখেছেন- ‘ফরম্যাল ধর্ম পালন যারা করে তাদের আমি অপছন্দ করি।’ ‘আনুষ্ঠানিক কর্ম পালনে পবিত্রতা থাকে না, দায়সারা হয়। বলেছেন আল ওয়াসিতি (মৃ. ৯৩২)। ঈশ্বর আল-নিফারি (মৃ. ৯৬৫)কে বলেছিলেন বলে কথিত যে ‘জেনে রাখ আমি তোমার কাছ থেকে কোনো সুন্নাহ গ্রহণ করব না।’
সারা ইসলামের ইতিহাসে অনেক সুফি, রহস্যবাদী, সাধু, মুক্ত-চিন্তক শরিয়ার দিকে পিছন করে তাদের নিজস্ব বিবিধ রকমের নিয়ম গ্রহণ করেছেন। শরিয়া বা আইনের বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে তারা নিজের ভুবনে স্বাছন্দ্য বোধ করেছেন।
ইসলামে মুতাজিলা, বাতেনী, বেশরিয়া দলের এবং সুফিদের আবির্ভাবের পেছনে মুসলিম যুগে-পূর্বে মধ্যপ্রাচ্যে প্রচলিত মুক্ত-চিন্তক গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের প্রভাব ছিল। সুফিরা দাবি করেন যে তাদের শিক্ষার ধারা প্রফেট মোহাম্মদের মিশনের অনেক পূর্বে অজানা ছিল না। তারা বিশ্বাস করেন তাদের নীতি ও শিক্ষা প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে। উদাহরণস্বরূপ ইদ্রিস নবীর (ইনক) সময়ে এই সন্ন্যাস দর্শনের উৎস পাওয়া যায়; পরে ইলিয়াস (এজাইজা), খিজির (জাওয়া বা ইউয়াসা-রা আলেকজান্ডারের এক সেনাপতি) জুলকিফি (এজিকেল বা জাকারিয়া জন দ্য ব্যাপ্টিস্টের বাবা) এবং জিরজিস (সেন্টজর্জ) এই মতবাদ প্রচার করেছেন। অজ্ঞেয়বাদ ও মানিকিয়েন্স এবং রহস্যবাদী নিও-প্লেটনিকগুলো মিলে ইসলামের রহস্যবাদী ও সুফিবাদীদের বিবর্তনে প্রভাবিত করেছে। পিথোগোরিয়ান ও টাইয়ানার এপোলোনিয়াস (৮০ খ্রিস্টাব্দ) এদের লিখিত পুস্তকাদি ম্যাজিক ও অ্যালকেমিক্যাল অপারেশনের উৎস ছিল। এপোলোগিয়াস আরবদের কাছে বেলিনাস বলে পরিচিত।
আমরা মাসুদি, বাগদাদি ও অন্যান্য মুসলিম পণ্ডিতদের কাছ থেকে জানতে পারি যে ইসলামের শুরুতে মুসলিমগণ মার্সিয়েন (মৃ. ১৬৫), ভেলেনটিনাস (মৃ. ১৭৫) এবং অন্যান্য অজ্ঞেয়বাদীদের শিক্ষা-দীক্ষার সাথে পরিচিত ছিলেন এবং শিয়াদের কিছু ডকট্রিন, বিশেষ করে ইসলামীয় অজ্ঞেয়বাদীদের শিক্ষায় প্রভাবিত (আমির আলী ১৯৬৫, পৃ. ৩৪৩)।
নিউপ্লেটোনিক ধারণা, মুসলিম ঈশ্বর তত্ত্ব ও দর্শনতত্ত্বকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছিল। প্লাটিনাম (মৃ. ২৬৮)কে মর্যাদা দেয়া হয়েছিল ‘গ্রিক মাস্টার’ বলে (শেখ আল ইউনানী) এবং তার দর্শন ও শিক্ষা এবং সৃষ্টিতত্ত্ব ও ঈশ্বরের ধারণা মুসলিম অতীন্দ্রবাদীদের লেখার বিষয়বস্তু হয়েছিল।
খ্রিস্টানদের ধারণাও বহুল প্রচলিত ছিল। ঐতিহাসিকভাবে সুফিবাদের শুরু হয় ইরাক থেকে; দক্ষিণ ইরাক এবং এর প্রাথমিক উন্নয়ন হয় বসরা ও কুফার মধ্যকার অঞ্চলে আর এই সমস্ত অঞ্চলে খ্রিস্টানদের প্রবল প্রভাব ছিল (Nicholson. 1969 P 473)। ইসলামী রহস্যবাদীতে খ্রিস্টানদের প্রভাব- যেমন খ্রিস্টান সাধুরা যে পদ্ধতি পালন করত তার পুরোপুরি প্রভাব সুফিদের ওপর পড়েছিল।
প্রাথমিক মুসলিমদের মধ্যে যিশু ও তার মাতা মেরির (মরিয়ম) প্রতীক চিহ্ন ও ধ্যানের বস্তু ছিল এবং তাঁদের স্মরণে যে দুটি উৎসব পালিত হতো মুসলিম সুফিগণ প্রথম দিকে সেসব উৎসবে শরিক হতেন। প্রফেসর গিব বলেছেন- মধ্যযুগে মুসলিম বিশ্বে সরকারি উৎসব দিনগুলোতে (official feasts) খ্রিস্টান উৎসবও এক সাথে পালন করা হতো জাঁকজমকের সাথে।
মুসলিম মিস্টিকগণ যিশুকে দরিদ্র, পবিত্র ও পুণ্যবান রূপে মডেল বা আদর্শ রূপে শ্রদ্ধা করতেন ‘যিশুকে সাধু ব্যক্তিদের মোহর’ রূপে আখ্যায়িত করেন (Seal of the saints)। কোরানে যিশুকে ‘রুহুল্লাহ’ বলা হয়েছে, এই সূত্রে মুসলিম মিস্টিকদের কাছে যিশুর ব্যক্তিত্ব আরও উচ্চস্তরে স্থাপিত করেছিল।
মুসলিম মিস্টিকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজনের সংক্ষিপ্ত আলোচনা আলোচিত হলো।
হাসান আল বসরী (মৃ. ৭২৮) একজন সন্ন্যাসী ও আরব স্কলার যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন মুক্ত চিন্তায় বিশ্বাসী। তিনি যিশু সম্বন্ধে বলেছেন- ‘আত্মার প্রভু’ Lord of the Spirit and word’ (Arberry, 1964, P. 59) এবং তার অনুসারীদের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। হাসান আল-বসরীর জনপ্রিয়তা এত বেশি ছিল যে, তার মৃত্যুর সময় সারা বসরায় মানুষ জানাজায় শরিক হয়।
ওয়াসিল ইবন আতা (মৃ. ৭৪৯) হাসান আল বসরীর ছাত্র ছিলেন এবং কোনো এক বুড্ডিস্ট সাধুর (সুমানী) বাসায় যাতায়াত করতেন। সেই বাসায় মানিকিয়েন্স, জোরাস্ট্রিয়ান ও অজ্ঞেয়বাদীদের (Gnostic) আসর বসত এবং দর্শনতত্ত্ব ও ধর্ম আলোচনা হতো। ওয়াসিল হাসান আল-বসরীর নামে একটি পাঠচক্র রেখে যান যেখানে মুতাজিলিরা যুক্তিবাদ আলোচনা করে ধর্মীয় গোঁড়ামির সমালোচনা করত।
আবদুল্লাহ ইবন মায়মুন (মৃ. ৭৬০) জন্মগতভাবে জোরাস্ট্রিয়ান ছিলেন। তিনি সিরিয়াতে বসবাস করেন এবং অজ্ঞেয়বাদী পলিকেন্সের দ্বারা প্রভাবিত হন। তার অনুসারীরা বাতেনী গোষ্ঠী পত্তন করেন। এই বাতেনী বিদ্যায় গুপ্ত ব্যাখ্যা কোরানে উল্লেখ আছে, যার ব্যাখ্যা সাধারণভাবে করা যায় না, রূপক অর্থে করা হয়- কোরানের ভাষায় যাকে মোতাশাবিহ্ বলা হয়, এটা মোহকামের বিপরীত। মোহকাম সরল ব্যাখ্যা। আবদুল্লাহ ইবন মায়মুনের অনেক ডকট্রিন মিসরীয় ফাতেমীরা গ্রহণ করেছে।
ইব্রাহিম ইবন আদহাম (মৃ. ৭৭৭)-এর কথা লে হান্টের কবিতা আবু বেন আহ হেমে উল্লেখ করা হয়েছে। আবু ইবন আদহেম বলখের প্রিন্স ছিলেন। সিরিয়া যাত্রাকালে তিনি এক খ্রিস্টান ফাদার সাইমেনের সাথে অবস্থান করেন এবং তাঁর কাছ থেকে মোরাকাবা (মেডিটেশন) মারিফাত লাইন অর্জন করেছিলেন (gnosis)।
রাবেয়া আল-বসরী (মৃ. ৮০১), বিখ্যাত মহিলা সুফি সুন্দরী মহিলা ছিলেন বলে কথিত। তিনি বহু জনের কাছ থেকে বিবাহের প্রস্তাব পান এবং তিনি সব প্রস্তাবই প্রত্যাখ্যান করেন এই বলে যে, ‘আমি একমাত্র ঈশ্বরের’। প্রফেটকে তিনি ভালোবাসেন কিনা জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার প্রেম শুধু ঈশ্বরের জন্য আর কারোর জন্য নয়।’ তিনি সব পবিত্র অনুষ্ঠানকে অর্থহীন ভাবতেন এবং কাবাঘরকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলেছিলেন- ‘আমি শুধু এর মধ্যে ইট আর পাথর দেখতে পাই। এর থেকে আমি কী লাভ করব?’ তার একটি প্রার্থনা ছিল অতুলনীয়। তিনি প্রার্থনায় বলতেন— ‘হে ঈশ্বর আমি যদি স্বর্গের লোভে তোমার আরাধনা করি, সে-স্বর্গ থেকে আমাকে বাদ দাও। নরকের ভয়ে যদি আমি তোমাকে ভালোবাসি, নরদাগ্নিতে আমাকে দগ্ধ করো।’
মাআরুফ আল খারকি (মৃ. ৮১৫) খ্রিস্টান পিতামাতার সন্তান, কিন্তু ইসলামে দীক্ষা নেন। যদিও তার বেশির ভাগ বক্তব্য মৌলিকভাবে খ্রিস্টান প্রভাবিত। তিনি যখন মারা যান, ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলিম সকলেই দাবি করেছিল যে মাআরুফ তাদেরই একজন ছিলেন।
আহমদ ইবন খাবিত (মৃ. ৮২০) খাবিতিয়া গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা। তিনি বিশ্বাস করতেন আল্লাকে ধারণা করা বা জানা যাবে না; সকল প্রচেষ্টা এবং কর্ম সবই মিথ্যা বলে প্রমাণিত হবে, তার দিশা পাওয়া যাবে না। সেই অধরাকে ধরতে হলে মেসিয়ার (মস্হি) শরণাপন্ন হতে হবে বা থ্রাইস্টকে ধরতে হবে যিনি নিজের প্রাণ ও দেহ মানবতার উদ্দেশ্যে বলি দিয়েছিলেন।
হারিথ আল মুহাসিবি (মৃ. ৮৫৭) ধর্মপালন বিষয়ে তাঁর একটি গ্রন্থে বলেছেন যে মানসিক উন্নতির উদ্দেশ্যে (for edification) ইহুদি ও খ্রিস্টান উৎসের মাধ্যমে আত্মনিয়োগ প্রয়োজন। তার শিষ্যের মধ্যে প্রধান মিস্টিক ছিলেন জুনায়েদ আল-বসরী এবং পরবর্তী মিস্টিকদের মধ্যে তিনি প্রভাব ফেলেছিলেন পারস্য দার্শনিক আল- গাজ্জালীর ওপর।
জুন নুন (মৃ. ৮৫৯) ছিলেন মিসরীয় সাধু। মিস্টিক এবং রসায়নবিদ। তিনি হারমেটিকতত্ত্ব ও হেলেনিস্টক বিজ্ঞানে পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন এবং কথিত আছে যে তিনি প্রাচীন মিসরের হেরোগ্লিফিক (দুর্বোধ্য লিপি) পড়তে বা বুঝতে পারতেন। তিনি নসিস (gnosis)-এর ধারণার অর্থাৎ (মুক্তির জন্য জ্ঞানের প্রয়োজন, বিশ্বাস নয়।) প্রবক্তা ছিলেন এবং ইসলামিক থিওজফির (ঈশ্বর সম্বন্ধে জ্ঞান) জনক বলে পরিচিত ছিলেন।
হাল্লাজ (মৃ. ৯৯২) জোরাস্রিয়ান পুরোহিতের নাতি ছিলেন। তার পিতা ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি জেরুজালেমে খ্রিস্টান বসতিতে বাস করতেন যেখানে মাজদিনিয়েন সম্প্রদায় বাস করত। সরকার সন্দেহ করত যে হাল্লাজের কারমাতিদের সাথে যোগাযোগ আছে। তিনি বলতেন কাবাঘর ধ্বংস করে দেয়া দরকার এবং তীর্থযাত্রীরা নিজের ঘরে তীর্থ পালন করুক। এতে বেশি পুণ্য আছে। তিনি শেখাতেন যে যিশুর মধ্যে দেবত্বের সন্ধান পাওয়া যায়। হাল্লাজের ডকট্রিন খ্রিস্টানিটির ওপর নির্ভরশীল এবং অনেকে তাকে খ্রিস্টানই ভাবতেন। প্রফেটের চেয়ে সাধু-সন্ন্যাসীদের মূল্য
তিনি বেশি দিতেন এবং প্রফেট মোহাম্মদকে যোগ্য মর্যাদা দিতেন না; তাই ধর্মদ্রোহিতার অপরাধে তাকে অপরাধী করা হয়। তাছাড়া ‘তিনিই সত্য’ এই ঘোষণা দেওয়াতে তার অপরাধ আরও বেড়ে যায় এবং এই অপরাধে তাকে কষাঘাতে মেরে ফেলা হয়, যদিও তিনি ক্রুসিফিকেশনের জন্য অনুরোধ করেছিলেন।
আবু সৈয়দ (মৃ. ১০৪৯) একজন ফার্সি সুফি ছিলেন। তিনি লিখেছিলেন : ‘আমাদের পবিত্র ধর্ম শেষ হবে না যতদিন পর্যন্ত মসজিদগুলো ধ্বংসে পরিণত হয় এবং ধর্ম বিশ্বাস উচ্ছেদ হয়। তিনি ধর্ম পালনের মাঝে বন্ধন খুঁজে পান এবং শরিয়া ফালতু জিনিস আর কাবা পাথর ঘর ছাড়া আর কিছু নয়। তিনি জীবনে হজ করেননি; তিনি বলতেন, যদি তিনি ইচ্ছা করেন কাবা এসে মাথার চারদিকে ঘুরবে। তিনি তার শিষ্যদের গান ও নাচ করতে উৎসাহ দিতেন এবং তাদের বারণ করতেন আজানের সময় নাচগান বন্ধ না করতে।
ওমর খৈয়াম (মৃ. ১১২৩) পারস্যে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি গাণিতিক, জ্যোতির্বিদ ও চারপদী কবিতার রচয়িতা ছিলেন। তার রুবাই ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে এডওয়ার্ড ফিটজারেল্ড ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। পারস্যে নিশাপুরে জন্ম হলেও তিনি প্রথম দিকে কয়েক বছর বলখে বাস করেন এবং নিশাপুরে তার কবর হয়। তিনি তার রুবাই-এ ঘন ঘন সুরা ও সাকির কথা উল্লেখ করেন যাকে কেউ রহস্যপূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করেন, আবার কেউ সরল ব্যাখ্যাও দিয়েছেন যেখানে আধ্যাত্মিকতার লেশমাত্র ছিল না।
সানাই (মৃ. ১১৩১) পার্সিয়ান কবি ও মরালিস্ট ছিলেন। পারস্যের অন্যান্য কবিদের মতো তিনি ছিলেন মিস্টিক কবি এবং সুফিবাদে প্রভাবিত। তিনি সন্ন্যাস ও ভাববাদের মহাকাব্য রচনা করেন এবং যিশুকে উচ্চ মর্যাদায় তুলে ধরেন এবং তার সম্বন্ধে সচিত্র কাহিনী অঙ্কিত করেন।
ইবন আরাবি (মৃ. ১২৪০) কবি ও সুফি ছিলেন। তিনি সেই সময়কার, বিখ্যাত থিওজফিস্ট বলে পরিচিত ছিলেন। তিনি তাঈ-এর খ্রিস্টান গোত্রের প্রাক-ইসলামী যুগের হাতিম তাঈ-এর বংশধর বলে দাবি করেন। তিনি নব্য প্লেটোবাদ ও সন্ন্যাসবাদ কর্তৃক প্রভাবিত এবং প্রফেট যিশু ও মোহাম্মদ উভয়ের জন্য কলেমা (লোগোস) আখ্যা বর্জন করেন। তিনি উদার চিত্তের মানুষ ছিলেন এবং গর্ব করে বলতেন যে তিনি ইহুদিদের সাথে সিনেগগে, খ্রিস্টানদের সাথে চার্চে এবং মুসলিমদের সাথে মসজিদে সমভাবে প্রার্থনা করতে পারেন, তিনি গোঁড়াবাদী দ্বারা অভিশপ্ত (execreated) হন এবং তার সমস্ত রচনা পুড়িয়ে ফেলা হয়।
রুমি (মৃ. ১২৭৩) পারস্যের মহান সুফি ছিলেন। কুনিয়ায় (প্রাচীন আইকোনিয়াম) তার জন্ম যেখানে গ্রিক ও খ্রিস্টান ট্র্যাডিশন বেশ প্রচলিত ছিল এবং সেখানকার বাসিন্দারা গ্রিক ভাষা বলত। রাজধানীর অদূরে খ্রিস্টানদের মঠের বসতি এবং সেখানকার খ্রিস্টান শিক্ষা-দীক্ষা তার ওপর বেশ প্রভাব ফেলেছিল। তার বিখ্যাত রচনা ‘মসনবী’ পারসে ‘কোরান’ বলে খ্যাতি লাভ করে। অন্যান্য সুফি কবিদের মতো তিনি খ্রিস্টানদের প্রতি নমনীয় ছিলেন।
হাফিজ (মৃ. ১২৮৯) বিখ্যাত পার্সিয়ান গীতি কবি ও সুফি ছিলেন। ওমর খৈয়ামের মতো তিনি সুরা-সাকিকে প্রতীক রূপে তার কবিতায় ব্যবহার করেছেন। অন্যান্য সুফি কবিদের মতো খ্রিস্টানদের প্রতি তার ঝোঁক ছিল। তার রুবাই-এর মধ্যে একটি ছিল-
যেখানে দরবেশ পাগড়ি মাথে/ দিন রাত আল্লাহ আল্লাহ ডাকে/ যেখানে প্রার্থনার জন্য চার্চের ঘণ্টা বাজে/ এবং যেখানে যিশুর ক্রস বিরাজে।
‘Where the turbaned anchorite /Chanteth Allah day and night/Church bell rings the call to prayer/ And the Cross of Christ is there’ (Nicholson, 1963 P. 88)