১৪। ইসলামের সমালোচকগণ

১৪. ইসলামের সমালোচকগণ

ইসলাম কোনো দিনই সমালোচনা চায়নি, তবু প্রফেট মোহাম্মদের মিশন শুরুর দিন থেকেই ইসলামের বিরুদ্ধে আরবে মানুষের অভাব হয়নি। এখানে অবশ্য পশ্চিমা সমালোচকদের কথা বলা হয়েছে, যার শুরু হয়েছিল মধ্যযুগ থেকে যখন সমালোচনার ভাষা ছিল তীব্র।

আধুনিক পণ্ডিত ব্যক্তিদের মন্তব্য- আধুনিকতার সাথে যদিও ভাষার ব্যবহার নম্র ও সহনীয়, কিন্তু আক্রমণটা সুগার কোটেট। সতর্কতার সাথে পাঠ করলে দেখা যাবে শব্দ চয়নের মুসাবিদা ভদ্র হলেও প্রশংসার মাঝেও তীব্র তির্যক আক্রমণ সহজেই ধরা যায়। ইসলামের প্রশস্তি গেয়ে গেলেও তার সাথে জুদাইজম ও খ্রিস্টানিটির তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখানো হয় যে ইসলাম জুদাইজমের অংশ বিশেষ এবং তোরাহভিত্তিক।

পশ্চিমা সমালোচকগণ বুদ্ধিইজম, হিন্দুইজম প্যাগানিজম ও এনিমিজমকে সহিষ্ণুতার সাথে বিচার করলেও, যখন তারা ইসলামকে বিচার করতে যায় তখন ওয়াটের ভাষায়— They are prone to see only the worst in Islam and its Prophet অর্থাৎ ইসলাম ও তার প্রফেটের খারাপ দিকটাই চোখে পড়ে।

মুসলিমরা এই ইসলামবিরোধী আক্রমণকে এক কথায় বাতিল করে দেয় এই বলে যে, ইহুদি ও খ্রিস্টানদের বিদ্বেষ ও ঘৃণা এই সব সমালোচনার উৎস। কারণ প্রায় তেরশো বছর ধরে মুসলিমরা খ্রিস্টান বিশ্বকে শাসন করেছে এবং ক্রুসেডের পর থেকে মুসলিমরা খ্রিস্টানদের সব ধরনের আক্রমণকে সন্তোষজনকভাবে প্রতিহত করেছে। মুসলিমদের মতে, ইসলামের বিগত রাজ্য বিস্তার ও বিজয়ের জন্য ঈর্ষান্বিত হয়ে এখন বিরূপ সমালোচনা করছে কারণ মুসলিমরা এখন বিজ্ঞান ও ক্ষমতার দিক থেকে অনেক পেছনে পড়ে আছে।

অতীতে মুসলিমরা কী ছিল এবং কতটা সাফল্য অর্জন করেছিল বর্তমান প্রেক্ষাপটে তা আলোচ্য বিষয় নয়। বর্তমানে পশ্চিমা পণ্ডিতরা মনে করেন অতীতে মুসলিমরা যেসব মহাসমরে বিজয়ী হয়ে, আর বর্তমানে যে তেল-সম্পদের অধিকারী সেটা কথা নয়, কথা হচ্ছে, বর্তমানে তাদের মনে যে অবিশ্বাসের দানা বেঁধেছে তা থেকে উত্তরণের উপায় না খুঁজে অতিমাত্রায় গোঁড়ামি (fanatical) ও অস্থিরতায় ভুগছে। এমনকি সহানুভূতিশীল স্কলার ও পণ্ডিত ব্যক্তিরা প্রফেট মোহাম্মদের সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে সমস্যায় পড়ছেন তিনি স্বর্গীয় দূত গ্যাব্রিয়েলের দ্বারা পরিচালিত কিনা অথবা কোরানের বাণী গ্যাব্রিয়েল বাহিত কিনা।

বর্তমান পরিস্থিতিতে ইসলাম ও পশ্চিমের মধ্যে শুধু ভুল বোঝাবুঝি নয়, কেউ কাউকে এতটুকু বুঝবার চেষ্টা করছে না। দুই-এর মধ্যে সমঝোতার যে চেষ্টা সেটা লক্ষ্য পৌঁছবার চেষ্টা নয়, লাগাতার ঠাণ্ডা যুদ্ধের মাঝে সহঅবস্থান ছাড়া আর কিছুই নয়। সমালোচনার কয়েকটি প্রধান বিষয় তুলে ধরলে বোঝা যাবে পশ্চিমা সমালোচকরা কোন দিকে টারগেট করে মুসলিমদের মনে আরো বিষ ছড়াবার প্রয়াস পাচ্ছে।

১৪.১ প্রফেট ভণ্ড

পশ্চিমাদের কাছে প্রধান টারগেট হলো প্রফেট মোহাম্মদ নিজে। কোনো মহান ব্যক্তিত্বকে ইতিহাসে এমন আক্রমণ করে ইতিহাস লিখিত হয়নি, যেমন পশ্চিমা পণ্ডিতগণ প্রফেট মোহাম্মদকে নিয়ে লিখেছেন।

এটা অবশ্য সত্য যে তাঁর উচ্চ প্রশংসা করে অনেকেই লিখেছেন এবং পশ্চিমা লেখক কম নেই— এদের মধ্যে যার নাম প্রথমে করা যেতে পারে তিনি হলেন টমাস কারলাইল, যিনি বারে বারে এসব মন্তব্য বাতিল করেছেন যারা প্রফেটকে প্রতারক বা ফ্রড বলেছেন। কারলাইলের মতে, প্রফেট মোহাম্মদ একাধারে কবি, প্রফেট ও সংস্কারক ছিলেন। তিনি যদি আন্তরিক ও অকৃত্রিম না হতেন তাহলে তাঁর অনুসারীদের মধ্যে এতো দার্শনিক, মিস্টিক ও পণ্ডিত ব্যক্তি তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করত না।

অন্যান্য সমর্থনকারীদের মতে, প্রফেট মোহাম্মদের প্রাথমিক মিশন যা তিনি মক্কাতে আরম্ভ করেছিলেন, তখন তাঁর আন্তরিকতায় কোনো সন্দেহ ছিল না। প্রথমে তিনি অদম্য উৎসাহ নিয়ে আরবের সমাজের সংস্কার করার চেষ্টা করেন এবং তাঁর বিশ্বাস ছিল তিনি তা পারবেন। স্বর্গীয় বাণীর মাধ্যমে তিনি যে অনুপ্রেরণা পান তার ঘোষণা দিতে গিয়ে তিনি বিধর্মীদের উপহাস ও সমালোচনার পাত্র হয়েছিলেন।

তিনি ছিলেন মানুষের মহান নেতা, মিত্র ও বন্ধুর প্রতি তিনি ছিলেন বিশ্বাসী। তিনি তাঁর অনুসারীদের অনুপ্রাণিত করেন আনুগত্যে এবং সদা সদয় ছিলেন তাদের কল্যাণ কামনায়। তিনি রাষ্ট্র পরিচালনায় ছিলেন দক্ষ ও ক্ষমাশীল এবং শত্রুদের প্রতি উদার। সর্বোপরি তাঁর নৈতিক চরিত্র ছিল প্রবল, এই কারণে তিনি আরবদের মূর্তিপূজা থেকে সরিয়ে এনে একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী করে তুলতে সমর্থ হন এবং বিভিন্ন যুদ্ধবাজ গোত্রদের ঐক্যবদ্ধ করেন।

কিন্তু তিনি যে প্রতারক (imposter) ছিলেন এ কথা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। বহুবিবাহের প্রতি তাঁর অতিরিক্ত ঝোঁক ছিল। তাঁকে বিচার করতে হবে তখনকার প্রচলিত অবস্থায়, তাঁর মিশন ও বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠিত করতে এবং অরাজকতা, গোত্ৰ যুদ্ধের অবসান ঘটাতে তাঁর অবদান অতুলনীয়।

ভল্টেয়ার (মৃ. ১৭৭৮) বলেছেন যে, ইসলাম ধর্মে নতুন কিছুই নেই শুধু দাবি করা হয় যে মোহাম্মদ আল্লাহর প্রফেট। অন্যান্য যা কিছু সবই ধার করা। এডওয়ার্ড গিবন সংক্ষিপ্ত আকারে বলেছেন ইসলাম ধর্ম শাশ্বত সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং একটি প্রয়োজনীয় সত্যের সাথে বৈপরীত্যসূচক — a necessary fiction : বলা হয়েছে ঈশ্বর ব্যতীত অন্য কোনো ঈশ্বর নেই এবং মোহাম্মদ তাঁর প্রেরিত পুরষ। গিবন লিখেছেন, একজন সন্দেহ করতে পারে যে প্রফেট তাঁর শিষ্যদের বিশ্বাস প্রবণতায় গোপনে মৃদ্যু হাস্য করতেন – Secretly smiled at the credulity of his proselyes’।

‘বর্তমান সমালোচকগণ প্রফেট মোহাম্মদের আদর্শগত ভার্সান সম্বন্ধে প্রশ্ন উত্থাপন করেন। যারা একটু সহানুভূতিশীল, তাদের মধ্যে কয়েকজন দ্বিধাহীনভাবে প্রফেটকে সমর্থন করেন, তারাও মুসলিমদের উচ্চ প্রশংসার সব গ্রহণ করতে ইতস্তত করেন। তারা মনে করেন যে প্রফেট মোহাম্মদের বিশ্বাস ও তাঁর বাস্তবের মধ্যে যে পার্থক্য তাকে একত্র করা মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। মানুষ হিসাবে প্রফেটের দুর্বলতা ছিল এবং এই দুর্বলতা চাপা দিতে গিয়ে তিনি ইচ্ছাকৃত সত্যের অপলাপ সময়ে সময়ে করেছেন।

এই মন্তব্যের জন্য সাক্ষ্য দিতে ইহুদি ও খ্রিস্টানদের দরকার হবে না, বরং খোদ আরবদের মধ্যে, বিশেষ করে মক্কাতে তাঁর নিকট পরিবারের লোকজন এ সম্বন্ধে বলেছে কোরানের আয়াতে ও হাদিসে ও তাঁর জীবন চরিত্রে উল্লেখিত হয়েছে।

কথিত আছে, প্রফেট মোহাম্মদ সেই গুণের অধিকারী ছিলেন, আরবরা যাকে বলত হিলম, চাতুর্য, যে চাতুর্যকে তিনি ব্যবহার করেছেন তাঁর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যে পৌঁছুতে (Rodinson, 1976 P. 221)। ছলনায় তাঁর সমকক্ষ কেউ ছিল না, যখন যেমনটি দরকার তিনি তাই করেছেন। আবার যখন দরকার রূঢ় হয়েছেন। তাঁর মহানুভবতা বা উদারতা ছিল রাজনৈতিক কারণে; দয়া দেখানো দরকার হলে তিনি কাজ হাসিলের জন্য তাই করেছেন, অন্য দিকে তিনি ছিলেন বাস্তববাদী ও প্রতিহিংসাপরায়ণ এবং যে কোনো প্রতিবাদীকে তিনি নির্দয়ভাবে দমন করতেন।

মুসলিম কৈফিয়তদাতারা (apologist) বলে থাকেন প্রফেট মোহাম্মদকে বিচার করতে হবে তাঁর কালের সাথে; কিন্তু সমালোচকরা বলে যে পৃথিবীর অন্যান্য ধর্মীয় নেতারা যেমন বুদ্ধদেব, জোরাস্রার, কনফুসিয়াস, গুরু নানক এবং অন্যান্যদের যে কোনো মান (Standard) দিয়ে বিচার করুন, তারা তো এমন ছিলেন না। প্রফেট মোহাম্মদকে বলা হয়েছে উচ্চাকাঙ্ক্ষী, যে কোনো আরব শেখের মতো সুবিধাবাদী এবং বাস্তববাদী, যদিও বন্য-বেদুইন ও আরবদের তাঁর পতাকাতলে জড়ো করেছিলেন মালেগণিমতের হিস্যা ও বিচারহীন অনন্ত স্বর্গসুখ ও হুরের আশা দিয়ে।

অমুসলিম পশ্চিমা স্কলারগণ একমত যে, কোরান প্রফেট মোহাম্মদের নিজস্ব রচিত গ্রন্থ, এতে স্বর্গীয় রঙ ছড়ানো হয়েছে মানুষের পবিত্র গ্রহণযোগ্য বস্তু হিসাবে। মক্কায় প্রফেট মোহাম্মদের সমসাময়িক যারা ছিলেন তাদের অনেকেই এই মত পোষণ করেন যে, কোরানের বাণী তাঁরই বাণী, মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য ‘ওহী’র কথা ও জিব্রাইলের কথা বলা হয়েছিল, যা তিনি নিজেও অসত্য বলে জানতেন। তাঁর তোরাহ ও কোরান উভয়ই লোক ঠকানো বস্তু। “উহারা বলিয়াছিল ‘দুইটিই জাদু, একে অপরকে সমর্থন করে (২৮-৪৮)।” নিকট প্রাচ্যে শতাব্দি ধরে মানুষের মনে এই পুস্তক সম্বন্ধে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল। ফ্রেডেরিক-২ (মৃ. ১২৫০) বলেছিলেন যে, পৃথিবীতে তিনজন মহাপ্রতারক মুসলিম বিশ্বে দেখা দিয়েছে মোসেস, যিসাস ও মোহাম্মদ। এলয়স স্প্রেংগার (Aloys sprenger)-এর মতে প্রফেট মোহাম্মদ ছিলেন একজন চিত্তবিকারগ্রস্ত ব্যক্তি। (Schimmel, 1985 P. 248)।

প্রফেটের মানসিক অবস্থা প্রথম দিকে কিরূপ ছিল তা অনেকভাবে ব্যক্ত করেছেন। গুস্তাভ ওয়েল দেখাতে চেয়েছেন যে প্রফেট মোহাম্মদের মৃগীরোগ ছিল। এলয়স স্প্রেংগার বলতে চেয়েছেন মৃগী রোগ ছাড়া তাঁর মাঝে মাঝে খিঁচুনি স্বভাব (hysteried nature) ছিল। থিওডোর নলডেক বিশ্বাস করতেন যে তাঁর মোহান্বিত অবস্থায় প্রফেটের ব্যামোও ছিল, ডি. এস. মারগোলিয়থের মতে, প্রফেট মোহাম্মদের যে মাঝে মাঝে অদৃশ্য শক্তিতে ভর হতো তা অনেক সময় ইচ্ছা প্রসূত (artificially produced)। ডি. বি। ম্যাকডোনাল্ডও বিশ্বাস করতেন যে, এসব রোগ নামে মাত্র ছিল যার মাধ্যমে তিনি ঐশীবাণী শুনতে পেতেন।

১৪.২ অতিমাত্রায় গোঁড়ামি

পশ্চিমা পণ্ডিতদের লেখায় প্রকাশ পেয়েছে যে প্রফেট মোহাম্মদ তাঁর অনুসারীদের অনুপ্রাণিত করতেন ধর্মের জন্য প্রাণ পর্যন্ত বিলিয়ে দিতে অর্থাৎ গোঁড়ামির চরম করতে এবং যারা ধর্ম পরিত্যাগ করে তাদের প্রতি ভয়ানকভাবে অসহিষ্ণু হতে। ইসলামের জন্য এবং তাঁর নিজের প্রফেট হুডের ব্যাপারে তিনি কোনো আপোষ করতেন না। এমনকি সন্ধির শর্ত ও বন্ধুত্বের এবং পারিবারিক বন্ধনের প্রতি তাঁর কোনো আগ্রহ ছিল না।

তাই তাঁর অনুসারীরা ধর্ম ও প্রফেটের জন্য চরম ফ্যানাটিক ভাব দেখিয়েছে। যদি প্রফেট চাইতেন তাঁর শিষ্যরা তাদের বাবা ও ভাইদের খুন করতেও দ্বিধা করত না। হিশাম আল-কালবি লিখেছেন যে, আবদুল্লাহ ইবন ওবেইর পুত্র প্রফেটের অনুমতি চেয়েছিল তার নিজের বাবাকে খুন করে তার কাছে মাথা এনে দিতে, কিন্তু যেহেতু আবদুল্লাহ মদিনার প্রভাবশালী ব্যক্তি বিধায় প্রফেট সে অনুমতি দেননি আবদুল্লাহর পুত্রকে। এই রকম চরম গোঁড়ামি দেখানো হয়েছিল ইহুদি মার্চেন্ট ইবন সুনাইনার হত্যাকাণ্ডে।

যখন প্রফেট মোহাম্মদ তাঁর শত্রু বিনাশের হুকুম দিতেন তখন লোকজন সে কাজ করে মৃত ব্যক্তিদের মাথা এনে হাজির করত প্রমাণ স্বরূপ। মুসলিম হত্যাকারীদের মধ্যে মানুষের মাথা কেটে আনা একটা সাধারণ ব্যাপার দাঁড়িয়েছিল। ৬৮০ সালে কারবালায় হোসেনের মাথা কেটে এনে এজিদের সামনে আনা হয়েছিল এটা ঐতিহাসিকভাবে সত্য।

কোনো উদ্দেশ্যকে সম্পাদন করতে প্রফেট মোহাম্মদ তাঁর শিষ্যদের খুন-খারাবি করতে, দরকার হলে অনুপ্রাণিত করতেন। তিনি ব্যাখ্যা করতেন আল্লাহর ইচ্ছাকে পূর্ণ করতে যে কোনো পন্থা অবলম্বন করতে দ্বিধা করা উচিত নয়। তিনি অবিশ্বাসীদের প্রতি লাগাতার জিহাদ করার জন্য ওকালতি করেছেন; মুসলিমদের বলেছেন, শিক্ষা দিয়েছেন যে কোনো একজন বিধর্মী হত্যা করলে হত্যাকারী বেহেশত পাবে। অনুমোদন দিয়েছেন সমালোচক ও উপহাস করে এমন ব্যক্তিকে খুন করতে, মার্চেন্ট ক্যারাভানদের আক্রমণ করে লুটপাট করতে; অরক্ষিত শহর আক্রমণ করে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে সম্পদ দখল করতে; এর জন্য মারগোলিয়থ বলেছেন- তিনি ছিলেন – ‘ a captain of banditti’— লুণ্ঠনকারীদের সর্দার।

সমালোচকরা বলেন, এ ধরনের ব্যবহার যে কোনো ওজর-আপত্তির বাইরে কারণ এ আচরণের কোনো কৈফিয়ৎ নেই। ভলটেয়ার বলেছেন এ ধরনের আচরণকে কেউ সমর্থন করবে না, যদি সে অন্ধ আবেগে ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন না হয়।

প্রফেট মোহাম্মদের এই হত্যা-নীতি বহুদিন ধরে তাঁর অনুসারীরা নির্মমভাবে ধর্মীয় কর্ম বলে চালিয়েছিল। খালিদ ইবন ওয়ালিদ রক্তপিপাসু বিজয়ী সেনাপতি হলেও তাকে সম্মানিত করা হয় ‘আল্লাহর তরবারি’ Sword of Allah বলে (সাইফ আল্লাহ)।

৬৩৩ সালে খালিদ দক্ষিণ ইরাকে ওলাইসের যুদ্ধে (হিরা ও বসরার মধ্যে) জোরাস্ত্রিয়ান পার্সিয়ানদের পরাজিত করে এক আদেশ জারি করেন এই বলে যে যুদ্ধ বন্দিদের হত্যা করা হবে না। দু’দিন ধরে তার সেনা সব বন্দি ও পলাতক সেনা ঘেরাও করে একটা শুকনো নদীর বুকে জড়ো করে। পরে তাদের সকলকে নদীর বুকে হত্যা করে রক্তের বন্যা বইয়ে দেয়া হয়। তারপর থেকে সেই নদীর নাম হয় রক্তের নদী। এতে খলিফা আবু বকর সন্তোষ প্রকাশ করেন। খালিদ নিজে যুদ্ধে বন্দি সেনাপতির শিরশ্ছেদ করেন এবং তার কন্যার পাণি গ্রহণ করে উৎসব সম্পাদন করেন। আল্লাহ ও রসূলের নামে এই লোমহর্ষক হত্যার ঘটনা ইবন ইসহাক, ইবন হিশাম, আল ওয়াকিদী ও অন্যান্য মুসলিম জীবন চরিতকার ও ঐতিহাসিকগণ তাদের গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।

১৪.৩ রাজনৈতিক হত্যা

মুসলিম ঐতিহাসিকদের গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে প্রফেট মোহাম্মদের সময়ে ইহুদিদের হত্যা বিশেষ করে বানু কোরাইজার ঘটনা ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য। শুধু রাজনৈতিক কারণে নয়, ব্যক্তিগত কারণে যারা প্রফেটকে মান্য করেনি বা উপহাস করেছে তাদেরকেও মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, উমাইয়া মারওয়ান কন্যা কবি আসমা যে ব্যঙ্গ কবিতা লিখেছিল, আল ওয়াকিদির বর্ণনা মতে প্রফেটের নির্দেশে ওমাইর নামে এক অন্ধ ব্যক্তি ছুরিকাঘাতে খুন করে যখন আসমা ঘুমিয়ে ছিল তার সন্তানদের নিয়ে। তখন ৬২৪ সালের জানুয়ারি মাস। আসমার মৃত্যুর সংবাদ শুনে প্রফেট খুশি হন এবং ওমাইরকে ‘চক্ষুমান ওমর’ উপাধি দেন এবং বলেন, “তুমি আল্লাহ ও রসূলের জন্য ভালো কাজ করেছ’ (Rodinson 1976, p. 171)।

৬২৪ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে আমর গোত্রের আবু আফাক নামে ইহুদিবৃদ্ধ ব্যক্তি ইসলামের নামে কিছু বিরক্তিকর কবিতা লিখেছিল। কয়েকজন মুসলিম প্রফেটের কাছে অভিযোগ করে। ইবন হিশামের মতে প্রফেট সেই ব্যক্তির মৃত্যু কামনা করলে আমর গোত্রের এক ধর্মান্তরিত মুসলিম আবু আফাককে ঘুমন্ত অবস্থায় খুন করে।

আর একজন ভিকটিম হচ্ছে কাব ইবন আশরাফ। আশরাফ তাঈ গোত্রের একজন কবি, তার মা ছিলেন ইহুদি নাদির গোত্রের মহিলা। মক্কার লোকদের সাথে কাব-এর খাতির ছিল তাই বদর যুদ্ধে নিহত কয়েকজন মক্কাবাসীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে কবিতা লিখেছিলেন। ইবন ইসহাকের মতে, প্রফেটের ইচ্ছানুযায়ী তার একজন অনুসারী প্রফেটকে বলে যে, সে কা’বকে মরতে পারবে, তবে মিথ্যার আশ্রয় নিতে হবে, ছলনা করতে হবে। এতে প্রফেট কোনো আপত্তি করেননি (Ridinson 1976, P. 176)। সুতরাং ৬২৪ সালে জুলাই মাসে যখন কা’ব তার নতুন বৌর সাথে ছিল তখন সেই অনুসারী ছলনা করে কা’বকে বাইরে ডেকে আনে এবং তরবারির কোপে দেহ থেকে মস্তক বিচ্ছিন্ন করে এবং ছিন্ন মস্তক প্রফেটের পায়ে এনে রাখে।

ইবন ইসহাক বলেন – কাবের মৃত্যুর পর প্রফেট ইহুদিদের ওপর বিরক্তি প্রকাশ করে শিষ্যদের কাছে বলেন— ‘তোমাদের ক্ষমতার মধ্যে যে কোনো ইহুদিকে পেলে হত্যা করো।’ এতে মুহাইসা নামে এক মুসলিম সুনাইনা নামে এক ইহুদি সওদাগরকে হত্যা করে যদিও সেই ইহুদি তার নিজের গোত্রের মানুষ ছিল। যখন সুনাইনার ভাই মুহাইসার বিরুদ্ধে গোত্রের মানুষকে হত্যা করার জন্য অভিযোগ করে তখন মুহাইসা বলেছিল, আমাকে যিনি হত্যা করতে বলেছিলেন, তিনি যদি তোমাকেও হত্যা করতে বলেন, আমি তা-ই করবো (Andrae 1960, P. 149)।

আর একটি ঘটনায়, একজন মক্কার কবি আবু আড্ডা বদরের যুদ্ধে বন্দি হয়, কিন্তু প্রফেট তাকে এই শর্তে ছেড়ে দেন যে, সে মুসলিমদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরবে না। আজা মক্কায় ফিরে এসে মরু গোত্রদের প্রফেটের দলে যোগ না দেয়ার জন্য কবিতা লেখে; পরে ওহোদের যুদ্ধে আত্জা ধরা পড়লে, সে বলে যে, যুদ্ধে কোনো অস্ত্র মুসলিমদের বিরুদ্ধে সে ধারণ করেনি। কিন্তু প্রফেটের ইশারায় তাকে মেরে ফেলা হয়।

ঐ যুদ্ধেই (ওহোদ) মাবিয়া ইবন মুঘিরা নামে এক মক্কান যুদ্ধের পর পেছনে পড়ে যায় মক্কার সেনাবাহিনী চলে যাওয়ার পর। এরপর মাবিয়া ইবন মুঘিরা গোপনে মদিনায়, প্রফেটের জামাতা ওসমানের সাথে দেখা করতে আসে এবং প্রফেটের কাছ থেকে তিন দিনের শান্তি-চুক্তি করে নিতে সক্ষম হয়। কিন্তু প্রফেট মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য তাকে ক্ষমা করতে পারেননি এবং যখন মুঘিরা মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে তখন প্রফেট তার পেছনে কিছু লোক পাঠিয়ে হত্যা করান।

এর কিছুদিন পর লিহিয়ান গোত্র প্রধান সোফিয়ান ইবন খালিদ অন্য গোত্রের সাথে মিশে ওহোদের বিজয় মিছিলে যোগ দেয়। প্রফেট মোহাম্মদ এই সংবাদ শুনে আবদুল্লাহ ইবন ওনাইজকে পাঠান তাকে খুন করতে। তাকে নির্দেশ দেয়া হয় তার বিশ্বাস অর্জন করতে, দরকার হলে প্রফেটকে সে গালাগালি করতে পারে (Rodinson, 1974, P. 189)। সোফিয়ান আবদুল্লাহর ব্যবহারে সন্তুষ্ট হয়ে তাকে নিজের তাঁবুতে আমন্ত্রণ জানায়। পরে এক সময় আবদুল্লাহ সোফিয়ানকে খুন করে মাথা কেটে নেয় এবং ছিন্ন মস্তক প্রফেটকে এনে দেয় যখন তিনি মসজিদে ছিলেন, পুরস্কার স্বরূপ প্রফেট আবদুল্লাহকে নিজের লাঠি উপহার দেন (Muir 1912, P. 276)।

জীবনচরিতকার ইবন ইসহাস, ইবন হিশাম ও আল-ওয়াকিদী বর্ণনা করেন যে, ৬২৬ সালে প্রফেট একজন পেশাদার খুনি মক্কার আমর ইবন উমাইয়াকে নিযুক্ত করেন তার প্রধান শত্রু আবু সুফিয়ানকে হত্যা করার জন্য (Glubb 1979, P. 220)। আমর তার অভিযানে ব্যর্থ হয়, কিন্তু তিনজন মক্কীকে খুন করে চতুর্থজনকে ধরে এনে প্রফেটের কাছে হাজির করে। প্রফেট এই কাজের জন্য প্রশংসা করেন।

আল-ওয়াকিদী বর্ণনা করেন যে, নাদির গোত্রপ্রধান বয়স্ক ইহুদি আবু রাফি, প্রফেটের নির্দেশমতো সিরিয়ায় না গিয়ে, খায়বারের ইহুদি সম্প্রদায়ের সাথে রয়ে যায়। প্রফেট তার মৃত্যুর আদেশ দেন এবং ৬২৭ সালে ডিসেম্বর মাসে পাঁচ জনের একটি দল প্রতারণা করে তার বাসায় ঢোকে এবং সেই বৃদ্ধ ইহুদিকে খুন করে যখন সে ঘুমিয়ে ছিল। খুনিরা ফিরে এলে প্রফেট তাদের প্রশংসা করেন কিন্তু খায়বারের ইহুদিদের নিয়ে প্রফেট একটু বিচলিত হন, কেননা ওমাইর ইবন রাজিন তখন গোত্র প্রধান ছিলেন। ৬২৮ খ্রিঃ জানুয়ারি মাসে, প্রফেট একটা ডেলিগেশন খায়বারে পাঠান এই ডেলিগেশনের প্রধান ছিলেন যোদ্ধা-কবি আবদুল্লাহ ইবন রাবাহা। এই ডেলিগেশন ওমাইরকে মদিনায় আমন্ত্রণ জানান এই আশ্বাস দিয়ে যে তাকে খায়বারের শাসক বলে ঘোষণা দেয়া হবে। মদিনা ডেলিগেশনে বিশজন বাছাই করা খুনি ছিল। আবদুল্লাহ ইবন ওনাইজ তাদের মধ্যে একজন। রাস্তার মাঝে মদিনা ডেলিগেশন অতর্কিতে ওমাইর পার্টির ওপর চড়াও হয়ে ইহুদিদের খুন করে। মুসলিম ডেলিগেশন ইহুদিদের খুন করে মদিনায় গিয়ে প্রফেটকে সুসংবাদ দেয়। প্রফেট মোহাম্মদ তখন আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেন এই বলে যে শত্রুদের কাছ থেকে তিনি নিষ্কৃতি পেলেন (Muir, 1912, P. 349)।

৬৩০ সালে যখন প্রফেট মোহাম্মদ মক্কা বিজয় করেন তখন তিনি কয়েকজন নির্বাচিত লোককে খুন করার আদেশ দেন। কিছু প্রতাপশালী পরিবারের সদস্য ও যারা ইসলাম গ্রহণ করে তাদের বাদ দিয়ে বাকি সকলকে হত্যা করার নির্দেশ দেয়া হয়।

ভিকটিমদের মধ্যে দু’জন গায়িকা ছিল, যারা প্রফেটকে ব্যঙ্গ করে গান গেয়েছিল। ইবন ইসহাক এক গায়িকার নাম বলেছেন ফারতানা, অন্যজনের নাম জানা যায়নি। কয়েকজন হাওয়ারিসকেও হত্যা করা হয় যারা প্রফেটকে অপমানিত করেছিল যখন তিনি প্রথমে মিশন আরম্ভ করেন। এদের মধ্যে দুইজন কয়েকজন হাওয়ারিস্ ইসলাম গ্রহণ করে কিন্তু মক্কায় ফিরে এসে তারা আপন ধর্মে ফিরে যায়।

প্রফেট তার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই ভাবে নির্দেশ দিয়ে গেছেন। উদাহরণস্বরূপ আইহালা ইবন কাব-এর ঘটনা ধরা যায়। আইহালাকে প্রফেটের মৃত্যুর একদিন আগে হত্যা করা হয়।

কয়েকজন পশ্চিমা স্কলার বলেছেন যে, প্রফেট তার জীবদ্দশায় যে রাজনৈতিক সন্ত্রাসের উদাহরণ রেখে গেছেন শতাব্দিকাল ধরে বর্তমান সময় পর্যন্ত সেই নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে। ‘এসাসিন’ শব্দটি আসছে হাসান সাব্বা— সেই আলামুতের বৃদ্ধ ব্যক্তির গোষ্ঠীর নাম থেকে যারা গুপ্ত হত্যায় অনেক প্রসিদ্ধ ব্যক্তিদের হত্যা করেছে, নিজামুল মুলুক তাদের একজন।

উচ্চাকাঙ্ক্ষী শাসকদের জন্য গুপ্তহত্যা সহজ পথ। যার মাধ্যমে শত্রু নিধন করে ক্ষমতার রাস্তা পরিষ্কার করা হয়। এই পন্থায় অতি তাড়াতাড়ি বিরোধের অবসান হয়, প্রতিদ্বন্দ্বীকে স্তব্ধ করা হয়, ভয় দেখানো হয়, শত্রু নিধন হয়। সেই পথ মুসলিমরা এখনো অনুসরণ করতে কুণ্ঠিত হয় না, বিশেষ করে যারা ধর্মীয় গোষ্ঠী।

১৪.৪ অভিযান

মদিনায় স্থিতু হওয়ার দশ বছরের পর প্রফেট মোহাম্মদ ও তাঁর দল সওদাগরদের ক্যারাভান আক্রমণ করে ধনসম্পদ লুণ্ঠন শুরু করেন এবং নিজে কয়েকটি আক্রমণে নেতৃত্বও দেন। পশ্চিমা পণ্ডিতেরা প্রফেটের জীবনের এই অংশ বেশ ফলাও করে তুলে ধরেছেন।

সাধারণত এই সব অভিযানের (রাজিয়া বা খাজওয়া), বন্দি নারী ও শিশু, উট ও অন্যান্য দ্রব্যাদি তার দলের লোকজনদের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হতো। আর পুরুষ বন্দিদের জবরদস্তি ধর্মান্তরিত করা হতো বা ক্রীতদাসে পরিণত করা হতো, নির্বাসনে পাঠানো হতো বা মেরে ফেলা হতো।

প্রফেট মোহাম্মদ কিভাবে বন্দিদের প্রতি ব্যবহার করতেন তা প্রাথমিক ঐতিহাসিকগণ বর্ণনা করে গেছেন এবং বন্দিদের হত্যা করার পর তিনি যা বলতেন তা শুনে তার সাহাবীরাও চমকে উঠত। প্রায়ই প্রফেটের সম্মুখেই বন্দিদের হত্যা করা হতো এবং তিনি বলতেন আল্লাহ তাঁর রসূল ও কোরানকে অস্বীকার করার জন্যই এই শাস্তি। ৬২৪ খ্রিঃ মক্কানদের বিরুদ্ধে বদরের যুদ্ধের পর বন্দিদের অবস্থা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই ভাবেই হয়েছিল।

তাঁর প্রধান শত্রুদের মধ্যে একজন আবু জাহেলের ছিন্ন মস্তক যখন তাঁর পদতলে এনে ফেলা হয়, প্রফেট আল্লাহকে ধন্যবাদ দেন এবং তাঁর বিজয়ের উল্লাস প্রকাশ করেন। আবু জাহেল ৬২৪ খ্রিঃ বদরের যুদ্ধে মারা যান। তাঁর মন্তব্য ছিল, আরবের বাছাই করা উৎকৃষ্ট একটি উটের চাইতে এটা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য।’ একজন বন্দি নওফেল ইবন খোওয়ালিদকে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন আলী তাকে চিনতে পারেন। একবার প্রার্থনার সময় প্রফেট এই লোকটির মৃত্যু কামনা করেন এবং আলীর কানে এই প্রার্থনার শব্দ পৌছে অর্থাৎ তিনি পাশ দিয়ে যাবার সময় শুনতে পান। তাই আলী নওফেলকে দেখা মাত্র তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হত্যা করেন। এ সংবাদ শুনে প্রফেট চিৎকার করে ‘আল্লাহ মহান’ উচ্চারণ করেন এবং বলেন ‘এটা আমার প্রার্থনার উত্তর’ (Muir, 1912, P. 227)।

আর একজন ভিকটিম হচ্ছেন কোরেশ গোত্রের গল্পকার নাদির বিন হারিথ। হারিথ এক সময় হিরাতে লাখমিদ রাজার দরবারে বাস করতেন। নাদির স্বভাবত গর্ব করতেন নিজের গল্পের সাথে প্রাচীন কিংবদন্তি নায়ক পারস্য দেশের রুস্তম ও ইসফানদারের সাথে যেসব কাহিনীর কথা কোরানে উল্লেখ আছে। তার এই গর্বিত আচরণের জন্য প্রফেট মোহাম্মদ তার সম্বন্ধে বলেছিলেন, এই লোকটির জন্য এক লজ্জাজনক শাস্তি অপেক্ষা করছে (৩১ : ৫)। নাদিরকে প্রফেটের সম্মুখে উপস্থিত করা হলে তার চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরে পড়ে। নাদির তার পাশের বন্দিকে বিড়বিড় করে বলেছিলেন— ‘মৃত্যু সম্মুখে’। এর পর প্রফেটের নির্দেশে সাথে সাথে আলী তার মাথা কেটে ফেলেন।

আরও একজন বন্দির নাম ছিল ওকবা ইবন আবু মুয়াইত। নিজেকে মৃত্যুর সম্মুখে দেখে ওকবা ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিলেন, আমার ছোট কন্যাটি অনাথ হয়ে যাচ্ছে, তার ভার কে নিবে? প্রফেট মোহাম্মদ জবাবে বলেছিলেন- নরকের আগুন। তারপর আবার বলেন, আল্লাহকে ধন্যবাদ যে তোমার মৃত্যু আমার চক্ষু জুড়াবে।

প্রফেট মোহাম্মদ সঙ্কল্প করেছিলেন বদরের যুদ্ধবন্দিদের সকলকেই হত্যা করবেন, কিন্তু তাঁর সাহাবীগণ এই হত্যাকাণ্ড দেখে বিচলিত হন এবং মন্তব্য করেন এ হত্যাকাণ্ডে কোরেশ গোত্রের সাথে মুসলিমদের সম্পর্ক বেশি তিক্ত হবে এবং সব সময়েই যুদ্ধবিগ্রহ লেগে থাকবে। হয়তো এমনও হতে পারে কোরেশদের হাতে কোনো সময় পরাজিত হলে মুসলিম বন্দিদের দশা এমনই হবে। এই ভবিষ্যদ্বাণীতে প্রফেট কিছুটা নমনীয় হয়ে মুক্তিপণের বিনিময়ে বন্দিদের মুক্তির ব্যবস্থা করেন।

ইতিহাসবিদগণ বর্ণিত তাঁর অনেকগুলো ‘plundering forays’ ছাড়া, প্রফেট মোহাম্মদ ২৭টি বড় অভিযান সংঘটিত করেছিলেন এবং ৮৫টি অন্য ছোটখাটো পর্যায়ে অভিযান পরিচালনা করেন। এই অভিযানের প্রায় অনেকগুলো লাভজনক ছিল- আশাতীত যুদ্ধলব্ধ সম্পদ আহরিত হয় এবং প্রায় সমস্ত সম্পদ ধর্মীয় তাৎপর্যে ব্যবহৃত হয়।

অনেক সময় এই সব প্রাথমিক অভিযানগুলো পরে শত্রু ও বিধর্মীদের বিরুদ্ধে জেহাদের রূপ ধারণ করেছিল।

১৪.৫ মালে-গণিমত

কোরানে মুসলিমদের ‘rich booty’ শপথ করা হয়েছে (৪৮ : ২০) এবং এই শপথ বাস্তবায়িত হতে শুরু করে যখন প্রফেট মোহাম্মদ মদিনায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে মার্চেন্ট ক্যারাভানের ওপর অভিযান আরম্ভ করেন।

এই শপথ পরিপূর্ণ হতে থাকে যখন তিনি অন্য আরব গোত্রদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন— যেমন প্যাগন, ইহুদি ও খ্রিস্টান যারা তাঁকে প্রতিহত করতে চেষ্টা করে এবং যাদের জমি-জায়গা ও সম্পদ বাজেয়াপ্ত হয়। তাঁর সমস্ত অনুসারীগণ সেই যুদ্ধ-লব্ধ সম্পদের বখরা পেয়েছে, যার মধ্যে উট, ছাগল, ভেড়া এবং প্রায় পুরুষ ও নারী ক্রীতদাস শামিল ছিল। ১/৫ অংশ পেতেন প্রফেট নিজে (৮ : ৪২)।

কিন্তু প্রফেটের মৃত্যুর পর এই শপথ পরিপূর্ণ হয়েছিল যখন বিদেশীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়।

বলা হয় যে, যখন আরবরা পারস্যের শীতকালীন রাজধানী স্টেসিফোন (মেদিয়ান) ৬৩৭ সালে মার্চ মাসে অধিকার করে তখন তারা যে সৌন্দর্য ও সম্পদ দেখেছিল তখন চোখ কপালে উঠে যায় এবং আল্লাকে ধন্যবাদ জানায় এই বলে যে, এতদিনে শপথ পরিপূর্ণ হলো এবং ভাবল স্বর্গ তো পৃথিবীতেই।

চারদিকে সোনা-রুপার অলঙ্কার, দামি দামি বড় বড় চুন্নি, পান্না, পাথর এবং অন্যান্য মূল্যবান অমূল্য দ্রব্য আরবদের মাথা ঘুরিয়ে দেয়। কর্পূর, মিশক এবং মূল্যবান মশলাপাতির বস্তায় স্টোর রুম পরিপূর্ণ এবং প্রত্যেক কামরা ও বারান্দা পাফিউমের সুগন্ধে মৌ মৌ।

প্রত্যেক ঘরে কার্পেট পাতা যা তারা কখনো দেখেনি; একটা বড় ঘরের প্রবেশপথের সম্মুখে কার্পেট টাঙানো যেখানে বাগানের নকশা এবং এর জমিন নকশা করা হয়েছে সোনা, রুপার সুতো দিয়ে তার ওপর এমারেন্ড বসানো। ছোট নদী মুক্তা দিয়ে তৈরি, রুবি দিয়ে গাছ ও ফুল আঁকা – যেন স্বর্গের পরিবেশ। যেহেতু লব্ধ সম্পদগুলো নির্দিষ্ট অংশে ভাগ হবে, তাই এই মহামূল্য কার্পেটকে খণ্ড খণ্ড করা হয় যাতে সকলের ভাগে এক খণ্ড করে পড়ে, অন্যান্য দ্রব্যের সাথে।

প্রাথমিক বিজয়গুলোর বাহ্যত উদ্দেশ্য ছিল ইসলাম প্রচার করা; কিন্তু বিজয়ীরা শীঘ্র দেখতে পেল যে এই সমস্ত সম্পদ খোদা প্রদত্ত এবং এই ঈশ্বর প্রদত্ত ঐশ্বর্যের জন্য অভিযান ও আগ্রাসনের প্রয়োজন, যার অপরিমিত সুযোগ রয়েছে। বিজয়ীরা অনুভব করল যে আল্লাহ তাদের জন্য দুনিয়া জুড়ে সম্পদ ভাণ্ডার সঞ্চিত করে রেখেছে এখন শুধু অভিযান চালিয়ে সে সম্পদ দখল করা। প্রথম উদ্দেশ্য হলো অর্থনৈতিক; তারপর সাম্রাজ্য, কর আদায়, সম্পদ ও ক্রীতদাস।

প্রত্যেক বিজয়ের পর পাওয়া গেল সুন্দরী যুবতী নারী, যাদের মধ্যে অনেকে উচ্চবংশীয় তারা বিজয়ীদের সম্পূর্ণ অধিকারে। ৭৪৫ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় মারওয়ানের সময় কাস্পিয়ান অঞ্চল বিজয়ের পর সুন্দরী সারকেসিয়ান (circassion) রমণী পাওয়া গেল। খলিফা তার হারেমের জন্য ছয় শত এমনি যুবতীদের যোগাড় করতে আদেশ করলেন। খলিফা আল মোতোয়াকিলের চার হাজার উপপত্নী ছিল। প্রত্যেকের অবস্থান অনুযায়ী যেমন প্রিন্স, জেনারেল এবং অন্যরা তাদের পদমর্যাদানুসারে রমণী বাছাই করলেন। সাধারণ সৈনিকদেরও এই সব কোমল ও নরম দেহী মানুষের বণ্টন থেকে বঞ্চিত করা হলো না।

খ্রিস্টান লেখক আল-কিন্দি (মৃ. ৯১৫) তার পুস্তক ‘Apology তে যুদ্ধ বিজয়ের পর এসবের বিস্তৃত বর্ণনা দিয়েছেন।

সাম্রাজ্য বিস্তার প্রক্রিয়ায় খলিফারা অঢেল সম্পদ আহরণ করেছেন। আরব ঐতিহাসিকগণ খলিফাদের সম্পদের বর্ণনা দিতে দিশাহারা হতেন এমনকি তাদের অধীনে প্রধান অমাত্য ও সেনাপতিদের সম্পদের অবস্থাও তেমনি। এছাড়া ছোট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আঙুল ফুলে কলা গাছ। প্রত্যেক অভিযানে প্রত্যেক অশ্বারোহী আহৃত সম্পদ থেকে ব্যাপকভাবে সোনা-রুপা নিয়ে যেত।

হিসাব করে দেখা গেছে, প্রত্যেকে তাদের জীবনযাপন করেছে শত শত পুরুষ ও নারী ক্রীতদাসের মালিক রূপে। বিশাল আকারের জমি, উৎকৃষ্ট ঘোড়ার স্টেবল, উট, গরু-ছাগল-ভেড়ার পাল। ছালা ভরা সোনা-রুপা ও মূল্যবান পাথর মালিক হিসাবে। এক হিসাব অনুসারে বলা হয়- পৃথিবীর ইতিহাসে এমন সম্পদের চমক আর কোথাও দেখা যায়নি।

উমাইয়াদের সময় থেকে খলিফা ও দরবারি মানুষরা প্রভূত আরাম-আয়েসে বাস করেছেন। তারা তাদের জন্য বিশাল প্রাসাদ গড়েছেন। সুদৃশ্য স্থাপত্য ও পেনটিং-এ বৃক্ষ, প্রাণী ও নারীমূর্তির প্রতিরূপ অঙ্কন করিয়েছেন। তারা তাদের সপ্তাহ কাটিয়েছে হান্টিং-হাউসে যেখানে মদ্যপানের পার্টি হয়েছে, অসংখ্য ক্রীতদাস ও বাইজীর দ্বারা মনোরঞ্জন করেছেন এবং এই লাইফ-স্টাইল শুধু দামেস্ক ও আলেক্সজন্দ্রিয়ায় ছিল না, বাগদাদ ও বসরায় ছিল; ছিল না শুধু মক্কা ও মদিনা শহরে।

১৪.৬ বিজয় ও কনভারশন

প্রথম জীবনে প্রফেট মোহাম্মদ প্যালেস্টাইন ও সিরিয়ার বাণিজ্য যাত্রায় খ্রিস্টানদের সার্বজনীন সম্পর্ক দেখে অভিভূত হয়েছিলেন। যদিও প্রথমে তিনি ইসলামকে মূলত ‘আরব ধর্ম’ রূপে ভাবতেন কিন্তু তার প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়ার সাথে তিনি বিশ্বাস করেছিলেন যে ইসলামকে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত করার সুযোগ রয়েছে এবং শেষে তিনি কোরানে পরবর্তী সূরাতে বলেছিলেন যে আল্লাহ তাঁকে পাঠিয়েছেন “ইসলাম ধর্মকে সকল ধর্মের ওপর বিজয়ী করতে’ (৯ : ৩৩)।

তাঁকে প্রফেট হিসাবে অস্বীকার করায় তিনি খ্রিস্টান ও ইহুদিদের ওপর অসহিষ্ণুতার ভাব ব্যক্ত করেন এবং মক্কার বিরুদ্ধবাদীদের স্তব্ধ করে তিনি আরব থেকে অন্যান্য ধর্ম উচ্ছেদ করতে প্রয়াসী হন। ইহুদিদের উন্নত শহরগুলোকে যেমন, কাইনুকা, নাদির, কোরাইজা, খাইবার, একের পর এক দখল করতে থাকেন। ইহুদিদের উচ্ছেদের পর তিনি দৃষ্টি দেন খ্রিস্টানদের দিকে এবং তাঁর জীবনের শেষ দিকে, তিনি পরিকল্পনা করেন আরবের বর্ডার অঞ্চল দিয়ে অভিযান চালাবার জন্য কিন্তু জ্বর তাকে পৃথিবী থেকে তুলে নিয়ে যায়।

প্রফেট মোহাম্মদ যে পরিকল্পনা করেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর খলিফা আবু বকর ও ওমর তার বাস্তবায়নে রূপ দেয়ার চেষ্টা করেন। তৃতীয় খলিফা ওসমানের রাজত্বের শেষ দিকে, আরবে বসবাসরত সকল ইহুদি ও খ্রিস্টানদের জবরদস্তি মুসলমান করা হয় বা হত্যা করা হয় যাতে, যেমন প্রফেট মোহাম্মদ মৃত্যুশয্যায় দাবি করেছিলেন, অন্য কোনো দ্বিতীয় ধর্ম আরব পুণ্য ভূমিতে থাকবে না।

আরবের বাইরের দেশগুলি বিজয়ের পর সেই একই প্যাটার্ন অনুসরণ করা হয়। প্যালেস্টাইন, মেসোপটেমিয়া এবং সিরিয়ায় খ্রিস্টান রাজ্য ঘাসান, লাখমিদ ও তাঘলিব দখল করা হয় এবং সকলেই মুসলিম হয় কিংবা প্রাণ হারায়। মধ্যপ্রাচ্যে অনেক উন্নয়নশীল খ্রিস্টান সম্প্রদায় এবং আশপাশে যারা ছিল সকলেই এই ভাবে নির্মূল হয়।

সাসানিয়ান ও বাইজাইনটাইন প্রদেশগুলো যে দ্রুততার সাথে মুসলিম দখলে আসতে লাগল এতেই বিজয়ীরা উৎসাহিত হলো আরও আক্রমণ ও জয়ের জন্য। তাই তারা দৃষ্টি দিল অন্য দিকে। যে বেগ বিজয়ীদের মধ্যে সৃষ্টি হলো তাকে থামানো গেল না, অন্য এলাকার দিকে অভিযানের পরিকল্পনা শুরু হলো।

প্রায় মুসলিম ঐতিহাসিক দাবি করেন যে মুসলিম বিজয় জবরদস্তি কনভার্সনে জড়িত ছিল না। এই নতুন ধর্ম বুঝতে সরল ছিল এবং নীতিও খুব সহজ, কারণ এ ধর্ম সাম্য-বিশ্বাসী এবং বিজিত লোকেরা যে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে অনেক সুবিধা ও সুযোগ আছে। এই কনভার্সান জবরদস্তি নয়, স্বতঃস্ফূর্ত ও শান্তিপূর্ণ ছিল। অন্য পণ্ডিতদের মতে, বাস্তব ঘটনা অন্যরূপ। স্বতঃস্ফূর্ত কনর্ভাসন কদাচিৎ ঘটেছে, কিন্তু বেশির ভাগ মানুষ যারা নিজের ধর্মে অটল থাকতে চেয়েছে তাদের সম্মুখে বহু বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে যাতে তাদের প্রাণের ভয়ে ইসলাম গ্রহণ করা ছাড়া আর অন্য পথ ছিল না। মৃত্যুপথই অন্য পথ ছিল।

মুসলিম শাসকরা বিধর্মীদের পেছনে লেগে থাকত, তাদের প্রতি অত্যাচার ও হয়রানি করত ইসলাম গ্রহণ করতে। কনভার্সন শুধু প্রথম জেনারেশনে হতো তারপর আর দরকার হতো না কারণ যদি একবার জবরদস্তি মুসলিম হয়, তার বংশধররা মুসলিম থাকত, ঈমান ঠিক না থাকলেও ধর্ম অব্যাহত থাকত।

বিজয়ের পর মুসলিম সেনারা নির্মমভাবে রাজ্যদখল করেছে এবং ইসলামের প্রসার হয়েছে তারপর জবরদস্তি দীক্ষা নিয়েছে নতুন ধর্মে বিজিত দেশবাসীগণ, তাছাড়া গত্যন্তর ছিল না। উত্তর আফ্রিকা, মধ্যএশিয়া ও ইন্ডিয়ার বিশাল অংশ এইভাবে দখল হয়ে, কনভার্সন হয়েছে। যেখানে মুসলিম দখলদার রূপে গেছে ‘process of religious cleansing’.

পারস্যে প্রাচীন জোরাস্রার ধর্ম মুছে গেছে। মধ্যএশিয়ায় বুদ্ধবাদ, খ্রিস্টানিটি ও অন্য প্রাচীন বিশ্বাস পাশাপাশি বহুদিন বাস করার পর, ইসলাম যখন এলো তখন এসব ধর্ম আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল। পূর্বদিকে সিন্ধু দেশে এবং পরবর্তীতে ভারতের অন্য অংশে ভারতীয়রা নতুন ধর্মে যেভাবে দীক্ষা নিতে বাধ্য হলো হিন্দুরা আজও সে দৃশ্য ভোলেনি।

উত্তর আফ্রিকাতে সেই একই প্রক্রিয়া চলেছে, যদিও দুই শতাব্দির অধিককাল উপকূল এলাকায় মুসলিম বিজয় সীমিত ছিল। টলেমিক যুগের পর আলেক্সজন্দ্রিয়া ছিল খ্রিস্টানদের নগরী, আসলে উত্তর আফ্রিকার সমস্ত অঞ্চল মিসরের কূল থেকে মোরিতানিয়া (মরক্কো) পর্যন্ত বাইজানটাইনদের কবলে ছিল।

উত্তর আফ্রিকার অনেক শহরে খ্রিস্টান গভর্নর ছিল. এবং বিশাল খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের যোগাযোগ ছিল রোম, আলেক্সজন্দ্রিয়া ও কনস্ট্যান্টিনোপলের চার্চের সাথে। সিরেনাইকা (লিবিয়া) সাইনেসিয়াসের (মৃ. ৪১৩) সাথে যোগাযোগ রেখেছিল। সাইনেসিয়া টলেমাইসের (Ptolemais) বিশপ ছিলেন। কার্থেজ (টিউনিসিয়া) ‘ছোট রোম’ নামে অভিহিত ছিল যেখানে তারতুলিয়ান (মৃ. ৩০) এবং সেন্ট সাইপ্রিয়ান (মৃ. ২৫৮) উভয়ের বাসস্থান ছিল এবং কাজও করেছেন। নিউমিডিয়ার হিপ্পো (আলজেরিয়া তখন ছিল নিউমিডিয়া) সেন্ট আগাস্টাইনের (মৃ. ৪৩০) সহযোগী ছিলেন। মুসলিম দখলের সাথে উত্তর আফ্রিকার চার্চগুলো হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। খ্রিস্টানিটি বিলুপ্ত হলো; সমস্ত অঞ্চল ইসলামীকরণ হলো এবং সেখানকার প্রাচীন ধর্ম সব মুছে ফেলা হলো।

এশিয়া মাইনর (আধুনিক তুরস্ক) প্রখ্যাত সাধু ও ধর্মবিদদের শুধু পূর্বাঞ্চলীয় চার্চের জন্য নয়, সারা খ্রিস্টানডম জুড়ে— জন্য গর্ব করতে পারে। যেমন সেন্ট জন দ্য ডিভাইন (মৃ. ১০০)-এর পাটমস ও ইফেসাসের সাথে যোগাযোগ ছিল; পলিকার্প (মৃ. ১৫৫) ছিলেন স্মার্নার (ইজমির) সাথে; সেন্ট জর্জ (৩০০) ছিলেন প্যাফলাগোনিয়ার সাথে; থিওডোর অব মপসিউএসটিয়া (মৃ. ৪২৯) ছিলেন সাইলেসিয়ার সাথে এবং সেন্ট বাসিল দ্য গ্রেট (মৃ. ৩৭৯), গ্রেগরি অব নাজিয়ানসাস (মৃ. ৩৯০) এবং গ্রেগরি অব নাইসা (মৃ. ৩৯৫) ছিলেন কাপ্পোডোসিয়ার সাথে।

ঐ অঞ্চলে দশ আর্কবিশপ্রিক ছিল, ৪৫ মেট্রোপলিটানেট এবং ৩৭০৩-র বেশি ছিল বিশপ্রিক এবং শতাব্দি ধরে খ্রিস্টানদের ইতিহাস চলে আসছিল। কিন্তু অটোম্যান সেলজুকদের আগমনের পর ক্বচিৎ দু’একটি ছাড়া আর কিছুই থাকেনি।

১৪.৭ জিহাদ

‘জিহাদ’ শব্দের অর্থ প্রচেষ্টা আল্লাহর কারণে (৪ : ৩৯); কোরানের বেশ কয়েকটি স্থানে উল্লেখিত হয়েছে। সাধারণভাবে ব্যাখ্যা করা হয় বিধর্মীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অর্থাৎ ধর্মযুদ্ধ। যারা জিহাদ করে তাদের মুজাহিদ বলা হয় এবং তার ধর্ম হচ্ছে অবিশ্বাসীদের মুসলমান করা বা তাদের ধ্বংস করে ইসলাম বিস্তার করা।

প্রফেট বলেছেন, মুসলিম ঈশ্বরের কারণে কখনো যুদ্ধ বন্ধ করবে না। মুসলমানদের বদ্ধমূল ধারণা যে তরবারি হচ্ছে বিশ্বাসের প্রতীকী অস্ত্র যা ইসলামের জন্য সব সময়েই খোলা থাকবে এবং অনেক শতাব্দি ধরে জিহাদ মুসলমানদের ধর্মীয় কর্তব্য বলে মনে করা হয়েছে।

বিশ্বাস করা হয় যে জিহাদে মারা গেলে সে ব্যক্তি ‘শহীদ’ হয় এবং সরাসরি বেহেস্তবাসী হয়ে যায়! মনে করা হয় এই বেহেস্তেরও তার সর্বসুখ উপভোগের লোভ দেখিয়ে হয়তো সরল মানুষকে এই জিহাদের পথে টানা হয়েছিল যার জন্য সামান্য ছুতো ধরে মুসলিমরা অমুসলিমদের বিরুদ্ধে আগ্রাসন চালিয়েছিল।

অনেক মহলে জিহাদকে মনে করা হয় সারা দুনিয়ার মানুষ ইসলামভুক্ত করার এক অনন্ত প্রয়াস। এই ইসলামীকরণকে মনে রেখে আধুনিক জিহাদি প্রবক্তাগণ পুরনো ধারণাকে পুনর্জাগরিত করছেন এবং বলছেন যে সত্যিকারের মুসলিমদের জন্য পৃথিবীতে দু’টি ক্যাম্প বা শিবির বিরাজ করছে। একটি হচ্ছে দারুল ইসলাম অন্যটি হলো দারুল হাবার অর্থাৎ এক অংশ মুসলিমদের বাসভূমি, অন্য অংশ অমুসলিমদের, যেমন ইউরোপ ও আমেরিকা। খ্রিস্টানডম হচ্ছে বিরোধের জন্য উৎকৃষ্টভূমি। এই বিরোধ ভূমি সব সময়ের জন্য যুদ্ধক্ষেত্র রূপে পরিগণিত হবে যতদিন না এটাকে দারুল ইসলামে পরিণত না করা হয় (D. B. Macdonald in SEI, 1974 P. 69)।

পশ্চিমা গণতন্ত্র বিলুপ্ত (effete) বলে মনে হয়, যেখানে কোনো নীতির নির্দেশ নেই। স্বাধীনতা ও সহিষ্ণুতা রূপকথায় তারা অন্ধ, তারা ইসলামের আপোষহীন কর্তৃত্বের কাছে সহজে ভিকটিম হয়ে যাবে। পশ্চিমারা আজকে এমন আত্মস্থ যে তারা ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অবস্থান থেকে সরে গেছে। তাদের এখন অতি সহজেই ইসলামের পক্ষপুটে আনা যায়, সেই উদ্দেশেই এই আধুনিক জিহাদ।

মুসলিমরা ইউরোপ ও আমেরিকাতে অতি অল্প স্থানে মজবুত হয়ে গেড়ে বসেছে এবং মনে করে যে এইসব স্থানে সুসংহতভাবে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে আরো ভেতরে ঢুকতে পারবে। একবার পশ্চিম দেশগুলো ইসলামীকরণ হলে, অন্যান্য বিধর্মী দেশগুলো পাকা ফলের মতো টুপটুপ করে ইসলামের কোলে আশ্রয় নিবে। পশ্চিমা দেশ বিজিত হলে, প্রফেটের বাণী সারা পৃথিবীতে অগ্নিশিখার মতো ধাবিত হবে।

আজকাল বিধর্মী পশ্চিমা দেশে যেসব মুসলিম বাস করে, বলা হয়, তাদের ধর্ম পালন ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে স্বাধীনতা আছে, কোনো বাধা নেই। প্রচার ও ব্যক্তিগত সংযোগে প্রফেটের বাণী প্রচার করা প্রয়োজন। মাইনরিটি সম্প্রদায় হিসাবে বিশেষ- সুযোগ-সুবিধার জন্য দাবি জানাতে হবে। সরকারে, ব্যবসা-বাণিজ্যে, মিডিয়ায়, আইনি পেশাতে, চিকিৎসাবিদ্যায়, বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও টিচিং পেশায় বিশেষ স্থান অধিকার করতে হবে। সুযোগমতো মুসলিম সম্প্রদায়ের উপস্থিতি ও দাবি-দাওয়াকে জোরালো ভাষায় ও বক্তৃতায় তুলে ধরতে হবে।

ইসলামে নির্ধারিত পদ্ধতিতে অর্থাৎ বহু বিবাহের মাঝে জনসংখ্যার বৃদ্ধি করতে হবে এবং বৈধ ও অবৈধভাবে যত পারা যায় মুসলিমদের পশ্চিমা দেশে অভিবাসন করাতে হবে। স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় লেভেলে বাস্তবে বেশি করে মুসলিম প্রতিনিধি প্রেরণ করতে হবে এবং স্থানীয় ও কেন্দ্রিক অটোনমির জন্য চেষ্টা চালাতে হবে। যখন ব্যালেন্স ও পাওয়ার এদিক ওদিক হবে মাইনরিটি থাকলেও সরকারে অংশীদারিত্ব পেলে নীতি নির্ধারণ ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজে তখন কর্তৃত্ব খাটানো যাবে। তখন তারা ইসলামী মৌলবাদ বাধাহীনভাবে দেশে প্রতিপালন করতে পারবে- যেমন স্কুলে ও অফিসের কাজে নামাজের সময় পাওয়া যাবে এবং শিক্ষা কারিকুলামে ইসলামী আদর্শ এবং লিগ্যাল কোডে শরিয়া আইন যুক্ত করতে হবে।

মুসলিমদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে ইসলামী ও খ্রিস্টানিটি সম্পূর্ণ আলাদা ধর্ম। ইতিহাস থেকে প্রমাণিত হয় যে এই দুই জাতির মধ্যে কখনো সমঝোতা হবে না। দুই জাতিকে এক করার জন্য বা সহঅবস্থানের জন্য কখনও চিন্তা করা উচিত নয়, সমঝোতা বা কম্প্রোমাইজও সম্ভব নয়। যদি কোনো সুবিধা দেয়া হয় তাহলে তা হোস্ট কান্ট্রি দিবে।

অন্তত যতদিন তেলের গতি (ফ্লো) সচল থাকবে, মুসলিম ওয়েল স্টেটগুলোকে অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে হবে, যাতে বিদেশী শক্তি তাদের দেশে বাসরত মুসলিমদের ওপর কোনো হয়রানি না করে। ইসলামের জিহাদের মাধ্যমে জয় সুনিশ্চিত, তখন সারা দুনিয়ায় থাকবে অবিভাজ্য মুসলিম সম্প্রদায়।

অনেকে মনে করেন মুসলিমদের এক সম্প্রদায় এক পৃথিবী একটি অবাস্তব কল্পনা, স্বপ্ন-পাইপড্রিম। তাদের ধারণায়, সারা দুনিয়ায় মুসলিম সম্প্রদায় হলেও তারা সুখে বাস করতে পারবে না, কেননা শিয়া-সুন্নির মধ্যে নিজের দেশে এখনো মারকাট চলছে, তাছাড়া আহমাদিয়া ও বাহাই তো আছেই। এটা চিন্তা করা অবাস্তব যে, কিছু কনভারশন অর্থ এই নয় যে, বুদ্ধ, হিন্দু, শিখ ও ইহুদি এবং অন্যান্য বিধর্মী গ্রুপ যেমন নাস্তিক, হিউম্যানিস্ট, অজ্ঞেয়বাদী, ও মার্ক্সিস্ট সকলেই যে মুসলিম হয়ে যাবে তা সুদূর পরাহত, আর খ্রিস্টান বিশ্ব ভাঙ খেয়ে বসে থাকবে না যে ভেড়ার মতো সুড়সুড় করে ইসলামের গোয়ালে ঢুকে যাবে।

পৃথিবীটাকে দারুল ইসলামে ও দারুল হারাবে দুই শিবিরে ভাগ করা আধুনিক যুগে প্রলাপ উক্তি ছাড়া আর কিছু নয় – it makes no sense at all. মুসলিম সংস্কারকগণ পুরনো শরিয়া আইনকে সংশোধন করে একটা তৃতীয় পথ স্বীকার করে- যাকে বলা হয় আপোষের পৃথিবী (দারুল সুলহ্)। এই ভিত্তি হলো সন্ধি, যেটা মানতে হবে ঐ সব মুসলিমদের যারা অমুসলিম দেশে বাস করে। সাধারণত তাদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে যে, যে দেশে বাস করবে সেদেশের আইন-কানুন মেনে চলবে, একজন ভালো নাগরিক হিসাবে শান্তি, শৃংখলা রক্ষা করে চলবে।

জিহাদের ধারণাকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে বর্তমান যুগের প্রেক্ষিতে। মিলিট্যান্ট বা উগ্র জিহাদ যুক্তিযুক্ত ছিল ইসলামের প্রথম যুগে, যখন ইসলাম ধর্ম প্রচারের প্রক্রিয়া চলছিল এবং বিরোধী দলকে ঠেকাতে হয়েছিল। আজকাল জিহাদ সমাজ সংস্কারের অর্থে ব্যবহৃত করতে হবে, সামাজিক অপকর্মের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে, আর নিজের নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে হবে, যাকে বড় জিহাদ বলা হয়। সারা দুনিয়াটাকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করার জন্য সামরিক সংঘর্ষের কোনো কথা এখন অবাস্তব, আর খাটেও না। এখন যদি ঐ পুরনো ধারণায় কেউ জিহাদের ডাক ডাকে যে কোনো ছুতোকে কেন্দ্র করে তাহলে সে বা সে দেশ, উপহাসের পাত্র হবে মাত্র, আর এই জন্য এসব ডাকের গোঁড়া উপড়ে ফেলতে হবে।

১৪.৮ প্যাক্স ইসলামিকা

অমুসলিমদের প্রতি মুসলিমদের দৃষ্টিভঙ্গি বিভিন্ন শাসকের অধীনে বিভিন্ন রূপ ধারণ করেছে। কোনো কোনো শাসকের ন্যায়পরায়ণতা দৃষ্টান্তমূলক, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গোঁড়া মৌলবাদী যা ন্যায়বান শাসকদের নিষ্প্রভ করে দেয়। উমাইয়া খলিফা দ্বিতীয় ওমরের ননমুসলিমদের বিরুদ্ধে কড়া আইন-কানুন, আব্বাসি খলিফা আল- মুতওয়াক্কিলের সময় আরো কড়কাড়ি হয়েছে এবং একটা স্ট্যান্ডার্ড পলিসি খলিফারা পালন করে এসেছেন। প্যান ইসলামের অধীনে, কেবলমাত্র মুসলিমকে পূর্ণ নাগরিকত্ব দেয়া হয়েছে এবং এর খুব কম সাক্ষ্যই আছে, যেখানে মুসলিম শাসকরা অমুসলিমদের প্রতি সহিষ্ণু ছিল।

থিওরি অনুযায়ী মূর্তিপূজক ও নাস্তিক যারা মুসলিম রাষ্ট্রে বাস করত (দারুল ইসলাম) তাদের হয়তো ধর্মান্তর করতে হতো কিংবা ক্রীতদাসরূপে বিক্রীত হতে হতো, কিংবা তরবারির নিচে ঘাড় পেতে দিতে হতো। যদিও এই ধরনের আচরণ সাধারণত ঘটত না, তবে এটা সত্য যে রাষ্ট্রের কাছ থেকে তাদের কোনো নিরাপত্তা ছিল না এবং আইনে তারা, বলতে গেলে, ব্যক্তি হিসাবে গণ্য হতো না। তাই, প্রায় এই অবস্থায়, বাঁচার জন্য, সকলেই ইসলামে দীক্ষা নিত।

অমুসলিম ‘আহলে কিতাব’ যেমন ইহুদি ও খ্রিস্টান, যদিও তাদের জবরদস্তি মুসলিম করা হতো না, তবু হরেক রকম অসুবিধায় তাদের পড়তে হতো। এ ধরনের নন-মুসলিম মাইনরিটিদের জিম্মি শ্রেণীভুক্ত করা হতো এবং জীবনে নিরাপত্তা ও সংরক্ষিত স্বাধীনতা ছিল। বিনিময়ে তাদের জিজিয়া কর দিতে হতো; তারা ছিল দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। এই বৈষম্য নীতির কারণে অনেকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হতো।

জিম্মিরা তাদের নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে বসবাস করত এবং তাদের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক জীবনের উন্নয়ন করার কোনো স্কোপ বা রাস্তা ছিল না। তাদের সরকারি কোনো উচ্চপদে নিয়োগের সম্ভাবনা ছিল না, যদিও অনেক ইহুদি ও খ্রিস্টানকে সরকারি নিম্ন পদে নেয়া হতো এবং অনেকে অন্য দিক দিয়ে বেশ উন্নতি করে ফেলত; কারণ এই সম্প্রদায় লেখাপড়ার দিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখত এবং শিক্ষিত হওয়ার কারণে সরকারি কাজের জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠত।

জিম্মিদের থাকতে হতো এমন স্থানে যা সাধারণত লোকচক্ষুর অগোচরে। তাদের ভালো পাকা দালান বা প্রাসাদ তৈরি করতে দেয়া হতো না কিংবা বেশি স্টাইলের সাথে জীবনযাপন করতে দেয়া হতো না যদিও অনেকে তা পারত; কারণ এতে মুসলিমদের অপমান করা হবে। কোনো কোনো শাসকের অধীনে তাদের নির্দিষ্ট পোশাক পরিধান করতে হতো, যাতে মুসলিমদের সাথে তাদের তফাৎটা বোঝা যায়। অবিশ্বাসীরা মুসলিম রমণী বিবাহ করতে পারত না। এটা কোরানিক বিধান (৬০ : ১০), কিন্তু মুসলিমদের অমুসলিম মেয়ে বিয়ে করতে বাধা ছিল না। শরিয়া আইন প্রায়ই জিম্মিদের অসুবিধার সৃষ্টি করত। অমুসলিমদের সাক্ষ্য মুসলিমদের বিরুদ্ধে আদালতে গ্রাহ্য হতো না।

ধর্মীয় বৈষম্য ছিল কড়াকড়ি। খ্রিস্টানদের বেলায়, যদিও ধর্মীয় স্কুল ও চার্চ যা ছিল সেগুলো ধ্বংস করা হয়নি, চার্চ বা ধর্মীয় স্কুল নতুন করে প্রতিষ্ঠা করার নিয়ম ছিল না বা যা ছিল তা সংস্কার করারও অনুমতি মিলত না। কোনো কোনো সময়ে চার্চকে মসজিদে পরিণত করা হতো। ধর্মীয় অনুষ্ঠানে কড়াকড়ি ছিল যেমন বড় উৎসবে চার্চ প্রসেশন, চার্চ ঘণ্টা বাজানো বা জনসম্মুখে ক্রস প্রদর্শন নিষিদ্ধ ছিল। খ্রিস্টানদের ধর্ম প্রচার নিষিদ্ধ ছিল, ধর্মীয় পত্র-পত্রিকা বিলি করা বা প্রচার নিষিদ্ধ ছিল। ইসলাম ও প্রফেট মোহাম্মদের বিরুদ্ধে সমালোচনা অপরাধ বলে স্বীকৃত হতো। কোনো কোনো ক্ষেত্রে, যেমন তঘলিব খ্রিস্টানরা- তাদের সন্তানদের ব্যাপ্টাইজ করার অনুমতি ছিল না।

বেশির ভাগ মুসলিম দেশে নীতি ছিল অ-মুসলিমদের প্রতি চরম বৈষম্য বা শরিয়া আইন প্রচলন করা সকলের জন্য, সে মুসিলম হোক বা আর অন্য কিছু। সৌদি আরাবিয়া প্যাক্স ইসলামিক কড়াকড়িভাবে প্রয়োগ করে তার বিশাল অ-মুসলিম শ্রমিকদের জন্য কোনো উপাসনালয় তৈরি করতে অনুমতি দেয়নি- আর এতে নাকি সারা মুসলিম বিশ্বের নিঃশব্দ অনুমতি ছিল। কিন্তু মসজিদে মিনারেট নির্মাণের জন্য খ্রিস্টান ওয়েস্টের প্রধান প্রধান শহরে বিশাল অঙ্কের অনুদান দিয়ে থাকে সৌদি আরব।

বর্তমানকালেও ইসলামী রাষ্ট্রে জবরদস্তি ধর্মান্তকর চলছে যেমন মালয়েশিয়ার সাবা রাজ্যে ১৯৭০ দশকে হাজার হাজার অমুসলিমকে জোর করে মুসলিম করা হয়েছে। পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ার সরকার তাদের রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এনিমিস্ট ও প্যাগন সাবজেকটদের ধর্মান্তরিত করেছে। সুদান সরকার-নীতি অনুযায়ী হিসাব করে খ্রিস্টান ও এনিমিস্ট সাবজেকটদের গণহত্যা শুরু করে তাদের সাফ করে দিচ্ছে প্রায় এক দশক ধরে। তবুও কোনো মুসলিম অর্গানেইজেশন থেকে এ সবের বিরুদ্ধে টু শব্দ নেই, কোনো প্রতিবাদ নেই অথবা আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য কোনো উচ্চবাচ্য নেই। কেউ কানাঘুষাও করে না।

মুসলিম দেশগুলো ক্রমান্বয়ে তাদের মাঝে খ্রিস্টানদের অবস্থান দুর্বিষহ করে তুলছে। এই সব কর্মকাণ্ড ১৯৮৫ সালে লাহোরে প্রথম মুসলিম কনফারেন্সে যে নীতি গ্রহণ করা হয় পরবর্তীতে জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও অন্যান্য স্থানে অনুষ্ঠিত মুসলিম কনফারেন্সে গৃহীত নীতির প্রতিধ্বনি। এই সব কনফারেন্সের ঘোষিত নীতি ছিল যে মধ্যপ্রাচ্যের সরকারগুলো তাদের নন-মুসলিম সাবজেক্টদের জন্য কোনো সুযোগ-সুবিধা দেবে না, কিন্তু ক্রমে ক্রমে বর্তমানে যে শর্তে তারা বসবাস করছে সেগুলোকে আরো সঙ্কুচিত করবে যাতে আস্তে আস্তে তারা দেশ ছেড়ে দেয় এবং সারা মধ্যপ্রাচ্য ইসলামীকরণ হয়ে যাবে। এই প্রক্রিয়ায় ইহুদিরা নির্মূল হবে এবং খ্রিস্টান ও নন-খ্রিস্টান মাইনরিটি যারা আছে তাদের চাপ দিয়ে মুসলিম বানাতে হবে কিংবা সরিয়ে দেয়া হবে। তাদের চার্চ ও ভজনালয় কিনে নেয়া হবে কিংবা জোর করে দখল করতে হবে (Hiskett 1993, P. 245)।

১৪.৯ কাফের

কোরানে (২ : ৩৭) অবিশ্বাসীদের কাফের বলা হয়, কারণ সে প্রফেট মোহাম্মদের বাণীর দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়, পরিণামে সে সত্য ধর্মে বিশ্বাসী হয় না। ‘কাফের’ শব্দ সকল অবিশ্বাসীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এমনকি যারা মিথ্যা বিশ্বাস করে এবং সন্দেহবাদী তারাও কাফের। তাদের পাপ হচ্ছে অস্বীকৃতি এবং ঈশ্বরদ্রোহী (blasphemy); তাদের সাথে যোগাযোগ করলে অপরিচ্ছন্নতা (নাজাসা) আসবে, তাই যে কোনো উপায়ে তাদের পরিহার করো।

কাফেরদের মধ্যে বস্তুবাদীরাও (দাহরি) আছে। বস্তুবাদীরা নাস্তিক, যারা বলে ঈশ্বর প্রথম সৃষ্টি নয় (not first cause) এবং তার অস্তিত্বে বিশ্বাস করা ভুল। পলিথেইস্ট (ওয়াসান) বহুঈশ্বরে বিশ্বাস করে, তাই কাফের; যেহেতু সে মূর্তি (ওয়াসান) পূজা করে তাই কাফের এবং নাস্তিকের মতোই তাকে ঘৃণা করতে হবে।

এই সব লোকের উপস্থিতি সহ্য করা উচিত নয় এবং এদের বিরুদ্ধে কোরানে নির্দিষ্ট আছে— “যখন তুমি কাফেরের দেখা পাও, তার মাথা কেটে ফেলো, যতক্ষণ পর্যন্ত না তাদের সম্পূর্ণ রূপে পরাস্ত না করো” (৪৭ : ৪)। “তোমরা তাদের হত্যা করছ না, হত্যা করছে আল্লাহ” (৮ : ১৭)। একটা অতিরিক্ত কথা জুড়ে দেয়া হয়েছে ‘তরবারি আয়াতে’ (verses of the sword) যেখানে মুসলিমদের বলা হয়েছে, ‘খুঁজে বার করো, ওঁৎ পেতে বসে থাক, অবরোধ করো, ধরো এবং হত্যা করো কাফেরদের যেখানেই তাদের পাও, যদি না তারা মুসলিম হয় (৯ : ৫)। এই ধরনের কাফিরদের নরকের গভীরতম অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হবে।

তাহলে কেতাবিরা যেমন জোরাস্ত্রার, ইহুদি, খ্রিস্টান যারা মোহাম্মদকে শেষ ও শ্রেষ্ঠ নবী বলে মান্য করে না এবং যারা কোরান অস্বীকার করে তারাও কাফের পর্যায়ভুক্ত।

বলা হয় যে, জোরাস্ত্রিয়ানরা এক সময়ে সত্যিকার রিভিলেশন পেয়েছিল যা তারা এখন হারিয়ে ফেলেছে। তারা এখন জেন্দ ধর্ম অনুসরণ করে (জেন্দ আবেস্ত, তাদের বিকৃত পুস্তক)। তারা বিশ্বাস করে দু’টি অনন্ত নীতিতে- প্রিন্সিপল। একটা অন্ধকার, অন্যটা আলো। তাই এই দ্বিত্ববাদের কারণে তারা দোষী (জিনদিক)। কোরান স্পষ্টভাবে বলে যে, আল্লাহ নিজেই এনেছেন অন্ধকার ও আলো উভয়কেই (৬ : ১ এবং অতুলনীয় ইসাইরা ৪৫ : ৭)

ইহুদিরা আব্রাহামের ধর্মকে বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে এবং তার মূল শিক্ষা থেকে সরে গিয়ে নিজেদের পথ বেছে নিয়েছে, সত্যিকার ডকট্রিনকে ভ্রূকুটি করে, যে সত্য প্রফেট মোহাম্মদ আনয়ন করে কোরানে বিধৃত করেছেন। ইহুদিরা কঠিন অন্তঃকরণের লোক, তারা প্রফেট মোহাম্মদের মেসেজ দেখতে অস্বীকার করেছে এবং ইসলামে দীক্ষা নিতে অনীহা প্রকাশ করেছে। সুতরাং তারাও কাফেরদের মধ্যে গণ্য।

খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করে যে ঈশ্বর সরাসরি নেমে এসে (হুলুল) যিশুকে ভর করে অবতার হয়েছেন। এটা শিরকভুক্ত এবং ঘৃণ্য। অথবা ঈশ্বরের একত্বের সাথে যিশুকে যোগ করে তাকে ঐশী গুণে গুণান্বিত করা হয়েছে। এইরূপে খ্রিস্টানরা মুশরিক এবং জোরাস্ত্রার ও ইহুদিদের মতো তারাও নরকে যাবে। সুতরাং যারা মুশরিক, তারা কাফির গোত্রভুক্ত।

কাফির শুধু সেইসব অমুসলিম নয়, যারা প্রফেটের আগে ও পরে এসেছে, তাঁর বাণী শুনেছে বা জেনেছে কিন্তু গ্রহণ করেনি, বাতিল করেছে, কিন্তু প্রত্যেক ব্যক্তি যে পূর্বে বাস করেছে, কিন্তু কোরানিক রিভিলিশন সম্বন্ধে জানার কোনো সুযোগ হয়নি সে- ও এই গোত্রভুক্ত। এই সব লোকেরা নারকী।

বিভিন্ন শ্রেণীর মুসলমানরাও এই কাফেরের জালে আটকে যায়। একজন নিকট সাহাবী আবদুল্লাহ ইবন ওমর বর্ণনা করেছেন যে প্রফেট মোহাম্মদ একবার ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে, তার মৃত্যুর পর ফিতনা ফিরকা বেড়ে যাবে এবং কখনও এর দ্বার বন্ধ হবে না। ইহুদিরা যেমন ৭১ ফেরকায় বিভক্ত এবং খ্রিস্টানরা ৭২ ফেরকায় বিভক্ত, তাই তিনি বলেন যে তার সম্প্রদায় ৭৩ ফেরকায় বিভক্ত হবে এবং মুসলিম ফেরকাধারীরা সব দোজখে যাবে, শুধু একটি ছাড়া (নাজিলা) অর্থাৎ যারা সত্য ধর্ম পালন করেছে। লোকেরা যখন জিজ্ঞাসা করল কোন ফিরকা বেহেস্ত যাবে? প্রফেট জবাব দেন- আমার সাহাবী ও আমার ধর্ম যারা পালন করেছে।

অর্থডক্স মুসলিম গোষ্ঠীর সদস্যদের কাছে, অন্যান্য মুসলিম গোষ্ঠীর লোকজন কাফের দলভুক্ত। উদাহরণস্বরূপ, শিয়াদের মতে, সব সুন্নি কাফের (H. M. T. Ahmed, 1989 P. 7)। অনেক মুসলিমদের কাছে আহমদিরা ঘৃণ্য, তেমনি অধ- মুসলিম বাহাইরা, যদিও তারা প্রগ্রেসিভ জাতি।

এই বিষয়ের জটিলতার কারণে, কে কাফের আর কে নয় এটা নির্ধারণ করা মুশকিল। আল্লাহ এক (ওয়াহিদ) এবং সত্যিকারের মুসলিম হচ্ছে, যে এক আল্লাহয় বিশ্বাস করে (মুত্তায়াহিদ)। কিন্তু আল্লাহর একত্বকে স্পষ্ট করে ডিফাইন করতে হবে। এইরূপে একটি অস্তিত্বের একত্বে (ওয়াজ্দাত আল-উজুদ), যদি ব্যাখ্যা করা হয় যে প্রত্যেক বস্তুই ঈশ্বর, তাহলে সর্বেশ্বরের প্রশ্ন আসে এবং এটা একটা হেরেসি, বিরুদ্ধ বিশ্বাস। এমনি অনেক ফাঁক-ফুঁক বের হয়ে আসতে পারে তাদের জন্য যারা ঈশ্বরতত্ত্ব সম্বন্ধে বেশি ওয়াকিফহাল নয়।

যে মুসলিম ভান করে ইসলামে বিশ্বাস করে কিন্তু গোপনে মোহাম্মদকে উপহাস বা অস্বীকার করে সে মোনাফেক এবং দ্বান্দ্বিক নীতির জন্য (রিয়া) অপরাধী আল্লাহর কাছে, সুতরাং তারা লজ্জাজনকভাবে নরকে নিক্ষিপ্ত হবে।

কাফেরের আর একটি ঘৃণ্য অংশ হলো হেরেসি। অর্থাৎ যারা নতুন কিছু উদ্ভব করে (মুরতাদি)। ইসলামী ডকট্রিনে নতুন সংযোগ (বিদ্যা) করা বা অনুসরণ করা। যেমন, খারেজী, রাফেজী। আর এক প্রকার হলো যারা দ্বিতীয় ব্যাখ্যা করে ডিভিয়েটর (মুলহিদ); যে সত্য শিক্ষা ছেড়ে নিজের মতো কোরানের ব্যাখ্যা করে- এই সব পথভ্রষ্ট সংস্কারকগণ যারা নতুন নতুন আইডিয়া ও মতবাদ বের করেন যা গৃহীত ডকট্রিনের বিপরীত এবং বিশ্বাসীদের বিভ্রান্তি করে তারা দোজখী হবে এবং চিরকাল আগুনে জ্বলবে।

নিকৃষ্ট ধরনের কাফের হচ্ছে ধর্ম-ত্যাগী (মুরতাদ)। যে মুসলিম আপন ধর্ম পরিত্যাগ করে এবং তার ত্যাগে সে সত্য ধর্মের অপমান করে। ধর্মত্যাগ (ইরতিদাদ) বিশেষভাবে অপমানকর কেননা সে ব্যক্তি ইসলামের আশীর্বাদ গ্রহণ করে পরে তাকে ত্যাগ করল। এটা প্রফেটের জন্য অপমানকর এবং সারা মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য কলঙ্কজনক।

বোখারী তার হাদিস গ্রন্থে বর্ণনা করছেন একটি ঘটনা- যেখানে প্রফেট মোহাম্মদ এক দল উট চোর ও ধর্মত্যাগীদের শাস্তি দিচ্ছেন তাদের হাত-পা কেটে ও চোখ উপড়ে ফেলে, তারপর তাদের মরুভূমিতে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হলো। (Hughes, 1977 P. 64)। ৪র্থ খলিফা আলী কয়েকজন ধর্মত্যাগীকে জীবন্ত দগ্ধ করে শাস্তি দিয়েছেন।

ধর্মত্যাগীদের জন্য কোরানে শাস্তির কোনো উল্লেখ নেই, কিন্তু অনুমান করে তর্ক করা হয় যে, যেহেতু কোরান স্পষ্ট নির্ধারণ করছে যে কাফেরদের শাস্তি মৃত্যু, নিশ্চয় ধর্মত্যাগের জন্য তাদের সেই শাস্তি হওয়া উচিত, যদি না সেই দোষী ব্যক্তি তওবা করে ফিরে না আসে। ইসলামী প্রশাসকগণ সাধারণত খুব কড়াভাবে ধর্মত্যাগীদের সাথে ব্যবহার করে এবং তার শাস্তি বিভিন্ন রকমের হয় যেমন, সিভিল অধিকার হারায়, নির্বাসন বা সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত, বন্দি, নির্যাতন বা মৃত্যু।

১৪.১০ ইনকুইজিশন (অনুসন্ধান)

প্রফেট মোহাম্মদ মোনাফেক ও কুৎসাকারীদের বিরুদ্ধে ভীষণ কঠোর ছিলেন এবং তিনি নিজে ঐ সব ব্যক্তির প্রাণদণ্ডের আদেশ দেন যারা তাঁর বিরুদ্ধে ছিল।

৭৪৩ খ্রিস্টাব্দে আব্বাসী খলিফা মেহদি ইবন মনসুর একটি ডিপার্টমেন্ট প্রতিষ্ঠা করেন। এই বিভাগের প্রধান ছিলেন এক মন্ত্রী। তার কর্তব্য ছিল মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করে মুরতাদী (heresy), ও ধর্মত্যাগীদের খুঁজে বের করে ধর্মত্যাগী ও কাফেরদের শাস্তি দেয়া। প্রথম বছরেই এই অনুসন্ধান অফিসে (মিহনা) অনেক অপরাধী ধরা পড়ে এবং তাদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।

৪৩৩ সালে খলিফা মামুন মোতাজিলার পৃষ্ঠপোষক (এদের ডকট্রিন হলো যে কোরান অনন্ত নয়, সৃষ্ট)। এই ‘মিহনা’ অফিস লোকজনদের খুঁজে বের করত যারা মোতাজিলা নীতিবিরোধী। ইমাম হানবলকে ধরে আনা হয়েছিল, কারণ তিনি মোতাজিলা নীতিতে একমত ছিলেন না, সেই জন্য তাকে খলিফার নির্দেশে কোড়া মারা হয় ও বন্দি করে রাখা হয়।

এই প্রথায় কার্যক্রম বন্ধ হয় খলিফা আল-মুতাওয়াক্কিলের সময় ৮৫০ সালে। খলিফা মুতাত্তাক্কিল খ্রিস্টান ও ইহুদিদের ভীষণ অত্যাচার করেন, কারণ এই সব ধর্ম বাহুল্য- সুপার-ফ্লুয়াস। কিন্তু এই অনুসন্ধান অফিসের ধারণটা খুব কার্যকর ছিল তাই এই সরকারি অফিসটি বন্ধ করে তার একটা ছায়া অফিস সারা খিলাফত ধরে চলতে থাকল এবং এর চার্জে ছিল একজন গোঁড়া ধর্মবিদ (অর্থোডক্স থিওলজিয়ন)। এই অফিসের কাজ ছিল মুক্তচিন্তার লোকজনদের ধরে এনে শাস্তি দেয়া এবং এই সংক্রান্ত লিফলেট, প্রচারপত্র, পুস্তিকা বিলি বন্ধ ও নিষিদ্ধ করা এবং সেন্সর করা।

শতাব্দি ধরে হাজার হাজার লোকের তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, অত্যাচার করা হয়েছে এবং শাস্তি দেয়া হয়েছে, যেমন খ্রিস্টান স্পেনে ইনকুইজিটররা মানুষের ওপর অত্যাচার করত; কারণ ঐ সব লোকদের প্রফেট, কোরান এবং ইসলাম ধর্মের ধারণা প্রশ্নবোধক, আর তাদের সিদ্ধান্ত ক্ষমার অযোগ্য।

ইসলামের সাথে ভিন্ন মত পোষণকারী মহান ব্যক্তিদের পূর্ণ কাহিনী এখনো ইসলামের ইতিহাসে অলিখিত রয়ে গেছে; এখানে শুধু কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে যারা এই ইনকুইজিশনের ভিকটিম ছিলেন মুসলিম রাজত্বকালে। সরকারি ও বেসরকারিভাবে যারা ভিকটিম ছিলেন তারা হলেন :

ধর্মবিদ জাআদর ইবন দিরহাম ৭৩৭ সালে ওয়াসিতে মৃত্যুবরণ করেন ওমাইয়া খলিফা হিশামের আদেশে কারণ তিনি মোতাজিলা ডকট্রিন ‘কোরান সৃষ্ট’ এই ধারণার প্রচার করেন। দামেস্কের দার্শনিক ঘাইলানকে ৭৪৩ সালে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় মুক্তচিন্তা প্রকাশের জন্য। ধর্মবিদ জাহাম ইবন সাফওয়ানকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয় ৭৪৬ খ্রিস্টাব্দে তার থিওরির জন্য যে, মানুষ আল্লাহর হাতের পুতুলমাত্র এবং স্বর্গ ও নরকের একদিন বিলুপ্তি ঘটবে কেননা এসব চিরন্তন নয়।

ইবন আল মুকাফা মোহাম্মদের সমালোচনা করে একটা পুস্তক লিখেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন যে তিনি কোরানের স্টাইল নকল করতে পারেন। ৭৫৪ খ্রিস্টাব্দে তার এক একটা অঙ্গ কেটে ফেলে জ্বলন্ত আগুনে নিক্ষেপ করা হয়, তারপর তার গলাটা আগুনে ফেলা হয়। বেচারা অন্ধ কবি বাশার ইবন বারদকে ৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে বাতিহা জলাভূমিতে নিক্ষেপ করা হয়, কারণ তিনি ইসলামে দ্বিত্ববাদ আমদানি করেছিলেন এই অভিযোগ। দ্বিত্ববাদ মূলত জোরাস্ত্রারের নীতি।

ফায়াদ ইবন আলী, মিমিয়া বা মোহাম্মদিয়া গোষ্ঠীর প্রধানকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় ৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে, কেননা তিনি মোহাম্মদের অবতারত্ব প্রচার করেছিলেন, এই ধারণায় যে তিনি যিশুখ্রিস্টের মতো ঈশ্বরের অংশ ছিলেন। মনসুর আল-হাল্লাজকে ৯২২ সালে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় তার হেরেসির জন্য কেননা তিনি বলেছিলেন যে তিনি ও আল্লাহ অভিন্ন। তার সাথে আল্লাহর আধ্যাত্মিক মিলন হয়েছে।

শিয়া রহস্যবাদী শালমাযানীর মৃত্যুদণ্ড হয় ৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে কারণ তিনি বলেছিলেন মুসা ও মোহাম্মদ উভয়েই প্রতারক (ইমপস্টার) কেননা, মুসাকে আরন (হারুন) যে মিশন দিয়েছিলেন, তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন এবং মোহাম্মদকে আলী যে মিশন দিয়েছিলেন তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন।

শিহাবুদ্দিন ইয়াহিয়া সুহরাওয়ার্দিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় ১১৯১ খ্রিস্টাব্দে ধর্মত্যাগের জন্য (apostasy) সালাহুদ্দিনের আদেশে। পরে তাঁকে শহীদের দর্জা দেয়া হয় এবং খেতাব দেয়া হয় ‘আল-মাকতুল’- অর্থাৎ শহীদ। তিনি শিক্ষা দিয়েছিলেন যে, সব জীবন্ত বস্তুর মাঝে সত্য বিদ্যমান এবং আল্লাহকে প্রমাণ করেছিলেন প্রতীকী আলোর মধ্যে (on the symbolism of light). আবদুল ফুতুহ, পার্সিয়ান কাল্পনিক কবি ও লেখক যিনি সর্বেশ্বরবাদ প্রকাশ করেন, তাই হেরেসির জন্য দোষী সাব্যস্ত হয়ে ১১৯১ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন।

ফজলুল্লাহ পারস্যের খোরাসানের আসতারাবাদের নিবাসী। তিনি দাবি করেন যে আল্লাহ আদমের কাছে আরবির ৯টা অক্ষর প্রকাশ করেন, আব্রাহামের কাছে ১৪টি এবং মোহাম্মদের কাছে ২৮টি এবং মোহাম্মদের কাছে আরো চারটি অক্ষর (letters) বানান পদ্ধতিসহ প্রকাশ করে মোট ৩২টি অক্ষর পূরণ করেন। ১৩৯৮ খ্রিস্টাব্দে এঁকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। তর্ক কবি ইমামুদ্দিন নেসিমিকে ১৪১৭ সালে এলেপ্পোতে চাবুক মেরে হত্যা করা হয়। কারণ, তিনি দাবি করেন অক্ষরের রহস্য সম্বন্ধে তিনি ‘ওহি’ পেয়েছেন।

মোহাম্মদ সাঈদ সারমাদ মুসলিম হবার পূর্বে একজন রাব্বী ছিলেন। তিনি একজন নামকরা পার্সি কবি ও চিন্তাবিদ ছিলেন। তিনি পদার্থ (matter)-র বাস্তবতা অস্বীকার করেন। তাকে মেরে ফেলা হয় ১৬৬১ খ্রিস্টাব্দে, মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের নির্দেশে। তার কবর দিল্লিতে আছে, বহু লোক মাজার দর্শনে যায়।

মির্জা আলী মোহাম্মদ ‘বাব’ নামে পরিচিত। ‘বাব’ অর্থ গেট, ফটক। তিনি ‘বাবীইজম’-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং বাহাই-ইজম্-এর পূর্বসূরি। তিনি নিজেকে প্রফেট বলে ঘোষণা দেন, ফলে তবরিজ পাবলিক স্কোয়ারে ১৮৫০ সালে গুলি করে মারা হয়। তার অনুসারীদের নারী-পুরুষ ও ছেলেদের খুঁজে বের করে নির্দয়ভাবে মারা হয়।

মোহাম্মদ মাহমুদ তাহা-কে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় ১৯৮৫ সুদানে, কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন কোরানের মদিনা অংশ এখন আর প্রযোজ্য নয়।

ভারতে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচার শুরু হয়েছে বিংশ শতাব্দির শুরু থেকেই এবং লাগামহীনভাবেই পাকিস্তানে চলছে এবং এমন অসহিষ্ণুতা আর অন্য কোনো মুসলিম দেশে দেখতে পাওয়া যায় না। কানাডিয়ান স্কলার Dr. W. C Smith, যিনি মুসলিম সম্বন্ধে ভারত উপমহাদেশে একটি স্ট্যাডি করেছেন, বলেছেন, তাদের চরম উগ্রতা আহমদী সম্বন্ধে প্রকাশ পেয়েছে (Ahmed, 1989 P. 100)।

মৃত্যুর তিন মাস পূর্বে ১৯৮৯ ফ্রেব্রুয়ারি মাসে ইরানের ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লা খোমেনী, নভেল লেখক সলমন রুশদীর জন্য মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেছেন; সে ঘোষণা এখনো বলবৎ আছে, কারণ তার বিরুদ্ধে চার্জ হলো ধর্মদ্রোহিতা। উল্লেখ্য যে, কয়েকজন মুসলিম ধর্মনেতা, কায়রোর আল-আজহার-এর গ্র্যান্ড মসজিদের ইমামসহ, আয়াতুল্লাহর এই ঘোষণার সমালোচনা করেছেন।

১৪.১১ শাস্তি

প্রাক-ইসলামী আরবে ক্রাইম ও সিভিল অপরাধের জন্য প্রতিশোধের (কিসাস)-এর ব্যবস্থা ছিল। একই সময়ে শাস্তি এমনকি খুন ও ব্যভিচারের জন্য জরিমানা (দিয়া) দিয়ে মুক্তি পাওয়া যেত— টাকা লড়াও দিতে হতো উট, ভেড়া, ছাগল বা অন্য কোনো স্বীকৃত ক্ষতিপূরণ।

ইসলামী আইনে শারীরিক ক্ষতির জন্য শাস্তি হচ্ছে প্রতিশোধ বস্তুর বদলে। ইহুদিদের নীতির মতো (Exod. 21; 24) : জীবনের জন্য জীবন, চোখের জন্য চোখ, নাকের জন্য নাক, কানের জন্য কান (৫ : ৪৯)। ইসলামের কড়া শরিয়া আইনে, শাস্তি (হদ্দ) খুব কঠিন, প্রায়ই কোরানের সাপোর্টে এবং প্রায় কঠিনভাবে প্রয়োগ করা হয়।

মদ পান করার জন্য ৮০ ঘা চাবুক নির্ধারিত আছে, যদিও এর পিছনে কোরানের সাপোর্ট নেই।

চুরি ও ছোটখাটো ডাকাতির জন্য, সে নারী হোক আর পুরুষ, দক্ষিণ হস্ত কাটা যায় (৫ : ৪২)। প্রাথমিক মুহাদ্দিসরা বলেছেন যে, মোহাম্মদ নিজে একজন মেয়ে চোরের হাত কেটে নিয়েছিলেন। যখন তাঁর একজন সাহাবী মেয়ের জন্য ওকালতি করলেন, তিনি বললেন : আল্লাহ যা নির্ধারণ করেছেন তুমি কি তার সংশোধন করতে চাও? আমার কন্যা ফাতেমা যদি চুরি করত আমি তারও হাত কেটে দিতাম।

যারা বড় রাস্তার ওপর ডাকাতি করে এবং খুন করে, তাদের নির্বাসিত কিংবা মৃত্যুদণ্ড তরবারি দ্বারা বা ক্রুশবিদ্ধ করে। (সালাব) (৫ : ৩৭) ধর্মীয় অপরাধ অবিশ্বাস থেকে ভান করা বিশ্বাস পর্যন্ত অর্থাৎ মোনাফেক। যারা ঈশ্বরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ও মোহাম্মদের বিরুদ্ধাচরণ করে তাদের শাস্তি হলো বিপরীত হাত ও পা কেটে ফেলা বা মৃত্যুদণ্ড বা খোঁড়া করে দেয়া বা ক্রুশবিদ্ধ করা। ধর্মত্যাগের জন্য শাস্তি হলো মৃত্যু (যদিও কোরানে নেই)।

যৌন অপরাধের জন্য শাস্তির রকমফের আছে। আবুবকর একজন সমকামীকে (সডোমিস্ট) জীবন্ত আগুনে নিক্ষেপ করেছিলেন। কিন্তু অপরাধ ছিল ব্যাপক, যার জন্য ধরা পড়ত, শাস্তিও হতো।

বেশ্যা ও বেশ্যাবাজদের ১০০ ঘা চাবুক মারা হতো (28 : 2)। নারী-পুরুষকে ব্যভিচারের জন্য ১০০ ঘা চাবুক মারা হতো।

ব্যভিচার মারাত্মক অপরাধ ছিল; ৮০ ঘা চাবুক মারা হতো তাদের জন্য যারা ব্যভিচারের অভিযোগ এনে প্রমাণ করতে পারত না (২৪ : ৪)। এই আইন করা হয় আয়েশার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনার জন্য।

ব্যভিচারের জন্য পাথর মেরে হত্যা করার কথা কোরানে একবার লেখা ছিল এবং একের অধিক বার মোহাম্মদ নিজে ব্যভিচারের জন্য দোষী নর-নারীকে শাস্তি দিয়েছিলেন। মোহাম্মদের মৃত্যুর পর আয়েশা বলেছিলেন যে তিনি কোরানে এই শাস্তির কথা জানতেন; কিন্তু পরে পাথর মারার শাস্তির বদলে ১০০ ঘা বেতের শাস্তির উল্লেখ করা হয়েছে (২৪ : ২)।

কোরানে না থাকা সত্ত্বেও খলিফা ওমর নিজে ব্যভিচারে দোষী নারীকে পাথর মেরে হত্যার নির্দেশ দেন। হাদিসে অবশ্য উভয়কে পাথর মেরে হত্যার কথা আছে।

যারা শরিয়া আইন কড়াকড়ি মানেন তারা এখনও হাদিস ও কোরানের বিধান চালু করতে বলেন কিংবা ট্রাডিশনাল শাস্তির বিধান মেনে চলেন এবং কয়েকটি ইসলামী দেশে হাত কাটা আইন ও পাথর মেরে হত্যার আইন মাঝে মাঝে পালন করা হয়। আধুনিককালে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো সৌদি আরবে এক রাজকন্যা মিশাকে ও তার প্রেমিককে পাথর মেরে হত্যা করা হয় ১৯৭০ সালে।

১৪.১২ দাসত্ব

দাস দখল ও দাস ব্যবসা বহু প্রাচীন ব্যবসা। আরবেও ছিল। বাইবেল বলে যে, যখন মিদিয়ানাইটদের ক্যারাভান (উত্তর হিজাজ) জোসেফকে উদ্ধার করে গর্ত থেকে, যার মধ্যে তার ভাইরা ফেলে দিয়েছিল, তখন তারা যোসেফকে ইজিপ্টে গিয়ে বিক্রি করে দেয় (Gen. ৩৭ : ৩৬)।

মুসলিম বিজয়ের উদ্দেশ্য ছিল দাস সংগ্রহ করা। ধৃত দাসদের মধ্যে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিল, তাদের শরীর থেকে ক্রীতদাসের গন্ধ মিলিয়ে যায়নি। কারণ বর্ধিত রাষ্ট্রে তাদের সেবার দরকার ছিল। বিজিত দেশ থেকে অধিক সংখ্যক দাস পাঠানো হতো মুসলিম দেশে। ৭১২ সালে একটা ছোট অভিযানের পর ৬০,০০০ হাজার দাস কুফাতে পাঠানো হয়েছিল সিন্ধু দেশ থেকে।

খিলাফতে কোনো এক কর্মকর্তার প্রায় ১ হাজার দাস-দাসী ছিল। কোনো কোনো বাড়িতে দাসদের প্রতি অমানুষিক অত্যাচার করা হতো এবং সাধারণত তাদের ভাগ্য ছিল মন্দ। তাদের সম্পত্তি মনে করা হলো এবং তাদের শহরে ও গ্রামে শ্রমিক হিসাবে খাটানো হতো, কিন্তু কোনো বেতন ছিল না। বিশ্বাসীদের কাছে মেয়ে বন্দি থাকত যা তাদের দক্ষিণ হস্ত অধিকার করতে পারে (২৩ : ৫) এবং এসব দাসীর সাথে মালিকের সহবাস করার অধিকার থাকত, যদিও তারা অন্যের সাথে বিবাহিত ছিল।

পরবর্তী শতকে অনেক দাসীপুত্র মুক্ত হয়ে অতি উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হতে পেরেছিল। স্লেভ ডাইনেস্টি-দাস বংশ ছিল মিসরের মামলুকরা। ভারতেও দাস রাজবংশ ছিল। এসব দাস প্রায়ই কৃষ্ণাঙ্গ ছিল না, যেমন টার্ক, সার্কাসিয়ান এবং জর্জিয়ান। তারা যোসেফ (ইউসুফ)কে পিতৃপুরুষ ভাবে, কারণ যোসেফকে ফেরাউন মুক্ত করে দেয় এবং ইসমাইল আব্রাহামের উপপত্নী হাগারের সন্তান।

আবিসিনিয়ান দাস বিলালকে মুক্ত করে প্রথম মোয়াজ্জিনের পদে নিয়োগ করা হয়। প্রফেট মোহাম্মদের কাছে কোনো জাতি ও বর্ণের পার্থক্য ছিল না। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে বর্ণ বৈষম্য সাধারণ ব্যাপার। কালো দাস-দাসীদের নিচু চোখে দেখা হয় এবং ব্যক্তিগতভাবে তাদের অপছন্দ করা হয়। প্রত্যেক বছর হাজার হাজার কালো বালকদের খোজা করে, যাদের হারেম আছে সেখানে বিক্রি করা হয়। এটা লাভজনক ব্যবসা, কারণ প্রত্যেক ধনী মুসলিম পরিবারে হারেম পাহারার জন্য এদের ক্রয় করা হয় উচ্চ দামে। ৯১৭ খ্রিস্টাব্দে আব্বাসি খলিফা মুক্তাদিরের সময় বাইজানটাইন সম্রাট সপ্তম কনস্ট্যানটাইন এক দূত পাঠিয়েছিলেন বাগদাদে, সেই দূত লিখেছেন- দু’ হাজার কালো খোজা (ইউনাক) শুধু খলিফার দরবারের কাজে নিযুক্ত ছিল।

তুলনামূলকভাবে এখনও ট্রপিক্যাল আফ্রিকায় ক্রীতদাসের বিশাল ‘পুল’ আছে সেখান থেকে আমেরিকা ও অন্যান্য দেশে পাঠানো হয়। এই ব্যবসায়ে আরবরা মনোপলি বজায় রেখেছে।

দাস ব্যবসা ও তার সরবরাহ কয়েকটি পূর্ব দেশীয় শহরে এখনও চলছে, যদিও এর বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে, গ্রেট ব্রিটেনের নেতৃত্বে— অবশ্য একটু কমেছে; ঊনবিংশ শতাব্দির শেষের দিকে প্রত্যেক বছরে মিসর, আরাবিয়া, টার্কিতে যে পরিমাণ জাহাজ আসত তার সংখ্যা কমে ১৫ হাজার থেকে আট হাজার নেমে এসেছে। এই সব জাহাজ-বোঝাই দাস আসত গৃহভৃত্যের কাজের জন্য।

১৪.১৩ নারী

পশ্চিমা সমালোচকগণ মনে করেন নারীদের সম্বন্ধে মুসলিমদের ধারণা ইসলামের অন্যান্য বিষয়ের চেয়ে নিকৃষ্ট। তার উদাহরণ ও শিক্ষার মধ্য দিয়ে প্রফেট মোহাম্মদ মেয়েদেরকে সমাজে এমন কোনো আসন দেননি, যে কারণে মেয়েরা নিজেদের মানুষ বলে মনে করতে পারে।

কতিপয় রাব্বানিকাল অথরিটির মতে, প্রফেট মোহাম্মদ পুরুষকে চারটি স্ত্রী রাখতে অনুমতি দিয়েছেন, তবে কথা থাকে যে প্রত্যেক স্ত্রীকে সমানভাবে দেখতে হবে। ঐ একই সময়ে, মানুষের স্বভাব সম্বন্ধে কোরানে পরিষ্কারভাবে বলছে— “আর তোমরা যতই ইচ্ছা করো না কেন, তোমাদের স্ত্রীদের প্রতি সমান ব্যবহার করিতে কখনও পারিবে না” (৪ : ১২৯)। সেইজন্য কোরান বলেছে : ‘সুতরাং, যদি তোমরা মনে করো যে তোমাদের স্ত্রীদের প্রতি সমান ব্যবহার করতে পারবে না, তাহলে এক বিবাহ করা উচিত (৪ : ৩)।’

কয়েকজন পণ্ডিতদের মতে, এই দুই আয়াত এক বিবাহের জন্য পরিষ্কার নির্দেশ দিচ্ছে। কিন্তু মুসলিমরা সাধারণত এই আয়াত উপেক্ষা করেই, পাকাপাকিভাবেই চারজন স্ত্রী রাখার পক্ষে বিশ্বজুড়ে নিয়ম করে ফেলেছে। এছাড়া অনেকে এমনভাবে কোরানের ব্যাখ্যা করেছেন যে, যার চারজন স্ত্রী নেই, সে একসাথে চার স্ত্রী রাখতে পারবে, সমান চোখে দেখুন আর না দেখুন। এখানে মেয়েদের স্ট্যাটাস শার্ট-প্যান্টের মতো। পুরনো হলে ছেড়ে দিয়ে নতুন গ্রহণ করো।

প্রফেট মোহাম্মদ নিজে অন্তত বিবাহ করেছিলেন এগারো বার, চারটের অধিক স্ত্রী ছিল একই সাথে। বহুবিবাহ ইসলামে বহুল পরিচিত এবং পক্ষে বলা বা ওকালতি করার জন্য মোল্লা-মুফতির অভাব নেই কারণ তারাও এক স্ত্রী নিয়ে থাকতে পারেন না। আরো কারণ হলো যে প্রথায় প্রফেট নিজে বহুবিবাহ করেছিলেন, সুতরাং এটা করা সুন্নতও বটে।

স্ত্রী বদলানো যায় তালাকের (divroce) দ্বারা, যদিও হাদিস মতে বলা হয়েছে- বৈধ জিনিসের মধ্যে আল্লাহ তালাককে ঘৃণা করেন। বলা হয় যে মোহাম্মদ নিজে তার স্ত্রীদের মধ্যে দু’জনকে তালাক দিয়েছিলেন এবং অন্যদের তালাকের হুমকি দেন। প্রফেটের নাতি হাসান একসাথে চার জন স্ত্রী বিয়ে করেন এই ভাবে তিনি একশোবার বিবাহ করেন আর তালাক দেন, কিন্তু রাখেন চার জন।

চার জন বৈধ স্ত্রী ছাড়া, একজন মুসলিম অসংখ্য মেয়ে-মানুষ বা উপপত্নী রাখতে পারে (সারারি, বহুবচনে সুরিয়া), যারা ক্রীতদাসী (৪ : ৩), যুদ্ধলব্ধ বন্দি বা ক্রীত বা উপঢৌকন হিসাবে প্রাপ্ত বা দাস পরিবারের মেয়ে, কুমারী বা বিধবা বা তালাকী।

মুসলিম আইনে তালাকের জন্য কোনো কারণ লাগে না, স্বামীর মুখের কথাই যথেষ্ট। দু’জন সাক্ষীর সামনে শুধু বলতে হয় ‘তোমাকে তালাক দিলাম’। ব্যস ল্যাঠা চুকে গেল। আজকাল বেশির ভাগ মুসলিম দেশে, তালাকের আইন সহজ করা হয়েছে এবং মেয়েরাও স্বাধীনভাবে স্বামীদের তালাক দিতে পারে মামলার মাধ্যমে, সবখানে ফরম্যালিটি বেশি এবং সময়ও লাগে, বিশেষ করে পশ্চিমা দেশে।

বহুবিবাহ তারাই করে, যারা একের অধিক মেয়ে-মানুষ, সমান চোখে দেখে; কিন্তু অসুবিধা হলো, একজন পুরুষকে চারজনের দাবি মেটানো বড় মুশকিল হয়ে ওঠে, তাই প্রায় অভুক্ত মেয়েরা অন্য উপায় খোঁজে এবং অনেক ক্ষেত্রে আরব্য উপন্যাসের মতো পরিবারের অবস্থা হয়। হারুন অর রশীদের পুত্র খলিফা মামুনের শত শত উপপত্নী ছিল এবং কথিত আছে সমপরিমাণ বৃদ্ধারমণী ও খোজা (ইউনাক) এই সব উপপত্নীর খবরদারি করত।

বাহান্ন বছর বয়সে প্রফেট মোহাম্মদ আয়েশাকে বিবাহ করেন যখন তাঁর বয়স নয় বছর, অর্থাৎ বাল্যবিবাহ। এটা অবশ্য সাধারণ ব্যাপার ছিল প্রত্যেক দেশে। হিন্দুদের মধ্যেও গৌরীদানের বন্দোবস্ত ছিল। এই বাল্যবিবাহ প্রফেট মোহাম্মদের শতাব্দি পূর্বে পূর্ব ও পশ্চিম দেশে প্রচলিত ছিল।

প্রফেট, বলা হয়, সাময়িক বিবাহের অনুমতি দেন যুদ্ধের সময় যাকে ‘মুতা’ বিবাহ বলা হয়, এই ব্যবস্থা কোরানে সিদ্ধ আছে যেখানে বলা হয় ‘অন্য নারীকে অর্থ ব্যয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করিতে চাহিলে সে চাওয়া তোমাদের জন্য বৈধ করা হইল, অবৈধ যৌন সম্পর্কের জন্য নহে। তাহাদের মধ্যে যাহাদিগকে তোমরা সম্ভোগ করিয়াছ তাহাদের নির্ধারিত মোহর অর্পণ করিবে। মোহর নির্ধারণের পর কোনো বিষয়ে পরস্পর রাজি হইলে তাহাতে তোমাদের কোনো দোষ নেই।’ (৪ : ২৪)

সাময়িক বিবাহ (Muta- pleasure), অর্থ প্রদান করে চুক্তি, কয়েক দিন, কয়েক মাস, ইসলামী দেশে সাধারণ ব্যাপার, যদিও মুসলিম সমালোচকগণ একে ‘বৈধ বেশ্যাগিরি’ বলেছেন (সুন্নিরা এ বিবাহ রদ করেছে)। ইরানে এই ব্যবস্থা বিংশ শতাব্দির মাঝামাঝি চালু ছিল। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে লিখতে গিয়ে আলফ্রেড গিয়োম বলেছেন, শিয়া পারস্যে অধুনা (আজকাল) দালালরা উপযুক্ত স্থানে অপেক্ষা করে ভিজিটরদের পাকড়াও করে ‘স্ত্রী’-র বন্দোবস্ত করে দেয় বিদেশে যত দিন তার দরকার। এর জন্য পেমেন্ট করতে হয় (1983 P. 104)।

প্রফেট মোহাম্মদ তীব্রভাবে (drastically) মেয়েদের স্বাধীনতা খর্ব করেছেন, যে স্বাধীনতা মেয়েরা প্রাক-ইসলামীকালে আরবে ভোগ করত। মুসলিম সমাজে এখন নারীদের বন্দি জীবন ঘরের মধ্যে ও বাইরে বোরখা মোড়া আপাদমস্তক। এই সব নারী নিয়ন্ত্রণ ব্যাপারে শেষের দিকে অবতীর্ণ সূরাতে রেফারেন্স আছে এবং বিশ্বাস করা হয় যে তার বৃদ্ধ বয়সে তরুণী স্ত্রীদের কন্ট্রোল করার জন্য এই ব্যবস্থা চালু হয়েছে। এখন এই নিয়ম মুসলিম পরিবারে বাধ্য-বাধ্যকতার ব্যাপার।

কোরানিক বিধান অর্থ এই যে মেয়েদের ঘরের মধ্যে থাকতে হবে, আল্লাহ ও তাঁর রসূলকে মানতে হবে এবং নামাজ পড়তে হবে। (৩৩ : ৩৩) কোনো বেগানা লোক মেয়েদের সাথে কোনো বাক্যালাপ করতে পারবে, যদি সামনে পর্দা বা পার্টিশন না থাকে (হিজাব) (৩৩ : ৫৩)। মেয়েদের কোনো পুরুষের মনে বেপর্দা অবস্থায় দেখা করা বা কথা বলা নিষিদ্ধ, এমনি ঘরের মানুষ হলেও মাহরম পুরুষ ছাড়া অর্থাৎ অতি নিকট আত্মীয় ছাড়া (৩৩ : ৫৫ ও ২৪ : ৩১)। তাদের কোনো পুরুষের সাথে, যারা কুদৃষ্টি নিয়ে তাকায়, তাদের সাথে কোনো বাক্যালাপ করা চলবে না। এখানে শুধু নবী পত্নীগণের কথা বলা হচ্ছে। আয়াতে বলা হচ্ছে— “হে নবী পত্নীগণ, তোমরা অন্য নারীদের মতো নহ, যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় করো তবে পরপুরুষের সহিত কোমল কণ্ঠে এমনভাবে কথা বলিও না, যাহাতে অন্তরে যাহার ব্যাধি আছে, সে প্রলুব্ধ হয় এবং তোমরা ন্যায়সঙ্গত কথা বলিবে। (৩৩ : ৩২)। যখন তারা ঘরের বাইরে পাবলিক স্থানে যাবে তারা ইসলাম-পূর্ব কালের মতো সাজ-সজ্জা করবে না, কিন্তু যেন তাহাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের উপর টানিয়া দেয়।” (৩৩ : ৫৯)। এই আয়াতকে বিভিন্ন স্কুল বিভিন্ন ব্যাখ্যা করেছে এই অর্থে যে, তারা বাইরের চাদর দিয়ে কপাল, চুল বা চোখে বা মুখ বা মাথা বা সমস্ত শরীর মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢেকে রাখবে।

মেয়েরা বিশেষভাবেই একটা নির্দিষ্ট স্থানে নিজেদের সংরক্ষিত করবে বা হারেমে থাকবে; আর এখানে স্ত্রীগণ ও উপপত্নীগণ এক সাথে থাকবে কোনো পুরুষের প্রবেশ নিষেধ। ইসলামের যখন সুদিন তখন এই সব হেরেমে বাদশা সুলতানদের শত শত মেয়েরা ভর্তি থাকত, আবার নতুন দেশ জয় করলে আরো ফ্রেশ মেয়ে মানুষের ভিড় জমত।

কোরানে অন্যান্য ধর্মের ধর্ম-পুস্তকের মতো নারীর চেয়ে পুরুষ শ্রেষ্ঠ এবং তাদের ওপর (৪ : ৩৮) পুরুষের কর্তৃত্ব। মেয়েরা ছোটবেলায় পিতাকে মান্য করবে, বিয়ের পর স্বামী, যারা স্বামীকে মানবে না, তাদের ধমক দিবে, শয্যা ত্যাগ করবে, তারপর প্রহার করবে (৪ : ৮)। একজন পুরুষ যেমনভাবে ইচ্ছা তার স্ত্রীর সাথে সঙ্গম করতে পারে, কারণ কোরান বলছে, স্ত্রী শস্যক্ষেত্র এবং যেমন ইচ্ছা তেমনি করে সেক্ষেত্রে প্রবেশ করতে পারবে (২ : ২২৩)। মেয়েদের জীবন এমন বিড়ম্বিত যে, একটা প্রবাদ আছে— “যে তার কন্যাকে সমাধির সাথে বিবাহ দেয় সে উৎকৃষ্ট বর লাভ করে,” He who weds his daughter to the grave has found the best of bridegrooms.”

কোরান ও হাদিসের সূত্র ধরে, ধর্মীয় জুরিস্টগণ আরও কলঙ্ক লেপে দিয়েছেন মেয়েদের কপালে। শরিয়া কোর্টে মেয়েদের সাক্ষ্য দিতে হয় দুইটা, পুরুষের একটা। মেয়েদের ডাক্তারি বা আইন পড়ে ঐ পেশাতে যেতে নেই অথবা কোনো ব্যবসাতে নিজেকে জড়াতে নেই; তাদের মসজিদে নামাজ পড়তে নিরুৎসাহ করা হয়। কারণ তাদের দেখে পুরুষরা বিচলিত হতে পারে।

একে সমর্থন করতে গিয়ে মুসলিম প্রবক্তারা বলেন, পশ্চিমের নারীরা অনেক আইনি অক্ষমতা (legal disabilities) থেকে ভোগে বিশেষ করে সম্পত্তি ব্যাপারে যা মুসলিম নারীদের অজানা। তেমনি তাদের স্বাধীনতা। পশ্চিমে নারীদের স্বাধীনতা বেশিদিন হয়নি, এখনো তার পুরোপুরি বিকাশ ঘটেনি এবং এখানে কোনো যুক্তি নেই তাদের এ বিষয়ে আত্মতুষ্টি লাভ করা। প্রফেট মোহাম্মদ বহুবিবাহ ও উপপত্নীর ব্যবস্থা করেছেন জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য যা ইসলামের প্রসারতাকে সাহায্য করবে।

ঘোমটা হচ্ছে মেয়েদের পোশাকের একটা অংশ যা প্রায় সারা মধ্যপ্রাচ্যে দেখা যায় এবং ইসলাম এর জন্য আইন প্রণয়ন করে চালু রাখার জন্য; এটার সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয়তা ছিল। মুসলিম বিশ্বের অনেকাংশে যেমন ইন্দোনেশিয়া, কৃষ্ণ আমেরিকা ও কুর্দিস্তানে কখনও ঘোমটা দেখেনি এবং সেখানে এ সম্বন্ধে কোনো দাবি উত্থাপিত হয়নি

আজকাল স্বাধীনতার জন্য নারী আন্দোলন অনেক মুসলিম দেশে বেশ দানা বেঁধেছে এবং বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষিতে ও অন্যান্য সার্বিক অবস্থান বিচার করে, মনে হয় মুসলিম নারী একদিন নিজেদের অবস্থা এই আধুনিক বিশ্বে পরিবর্তন করে নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রাখবে।

১৪.১৪ অদৃষ্টবাদ, নিয়তিবাদ

কোরান বলে সব জিনিস এই পৃথিবীতে আল্লাহর ডিক্রিতে (কাদার) ঘটছে (৫৪ : ৪৯) আল্লাহের এই ডিক্রি কতটা সচল তার বিচারে শতাব্দি ধরে চুলচেরা বিচার হয়ে আসছে দু’টি দলের মধ্যে এবং মুসলিম দর্শনে বিচার্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে মানুষের মুক্তচিন্তা আছে কী না।

একটা স্কুল আছে কাদেরিয়া বলে। তাদের বক্তব্য হলো, যদি মানুষের মুক্তচিন্তা না থাকত তাহলে তার সমস্ত কর্ম আল্লাহর ক্ষমতার মধ্য দিয়ে পরিসমাপ্ত ঘটবে। তাহলে মানুষ তার কোনো কাজের জন্য দায়ী থাকবে না এবং ঈশ্বরের কোনো অধিকার থাকবে না তার কাজের বিচার করে শাস্তি দেয়া। কাদেরিয়ারা বলে যে, ডিক্রি দেওয়ার সময়, ন্যায়বান ও দয়াবান আল্লাহতালা যথেষ্ট পরীক্ষা চেয়েছেন মানুষের মুক্তিচিন্তা অপারেট করা। প্রত্যেক মানুষকে দেয়া হয়েছে বিচার-বুদ্ধি, কোনটা ভালো কোনটা মন্দ বিচার করার জন্য এবং এ ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে কোনটা সঠিক আর কোনটা ভুল।

এই ডকট্রিন প্রচার করে মাবাদ আল জোহনী (মৃ. ৬৭০)। ইনি জোরাস্রিয়ান পুরোহিত ছিলেন, পরে ইসলাম গ্রহণ করেন। তার এই ডকট্রিন গ্রহণ করেন দু’জন সুফি রহস্যবাদী— একজন বসরার হাসান (মৃ. ৭২৮); অন্যজন ওয়াসিল ইবন আতা (মৃ. ৭৪৯) এবং এই ডকট্রিন ওয়াসিল ইবন আতার কাছ থেকে মোতাজিলিরা গ্রহণ করেছিল।

এর বিপরীত ডকট্রিন প্রাচীন ইসলাম-পূর্ব আরবের ধারণা থেকে উদ্ভূত। সেই কনসেপ্টের নাম ছিল মানাইয়া। ‘মানাইয়া’-র অর্থ হলো ভাগ্যের ক্ষমতা, যাকে অতিক্রম করা যায় না। ভাগ্যে যা নির্ধারিত আছে তা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হবে। গোঁড়া মুসলিম স্কুলের প্রবক্তা বলে থাকেন সব কিছু পূর্ব নির্ধারিত। মুসলিম চিন্তাবিদ জাবারিয়ার বক্তব্য হলো আল্লাহ যা কপালে লিখে দিয়েছেন বা নির্ধারণ করে দিয়েছেন, সে মতে প্রতিটি ক্ষেত্রে তা ঘটবে, এর ব্যতিক্রম হওয়ার উপায় নেই। সব কিছু পূর্ব নির্ধারিত এবং অপরিবর্তনীয়। জাবারিয়ারা মনে করেন সব জিনিস বাধ্যতার মধ্যে (জবর) এবং আল্লাহর যা নির্ধারণ করেছেন সেই মতে কাজ করা। পূর্ব নির্ধারিত জাবারিয়ার যে ধারণা তা থেকেই অদৃষ্টবাদ বা নিয়তিবাদ ডকট্রিনের উদ্ভব যা মুসলিম ধর্মের ৬ নং আর্টিকেলে অবস্থান নিয়েছে।

এ ধারণাই বলে দেয় যে, অদৃষ্ট (তকদির) বা ভাগ্য (কিসমত), প্রত্যেক মানুষের, সম্প্রদায়ের, জাতির আল্লাহতায়ালা আগেই নির্ধারণ করেছেন যা অপরিবর্তনীয়। এই ধারণা ব্যাপকভাবে মুসলিমদের মনে-মগজে ঢুকে গেছে এবং জনপ্রিয় প্রবচনে পরিণত হয়েছে- “What is not distined cannot be; what is destined cannot but be. ‘ অর্থাৎ ভাগ্যে যা নাই তা হবে না; ভাগ্যে যা আছে তা কেউ রুখতে পারে না, হবেই। আবার, ‘কপালে যা আছে তাকে ফেলতে পার না, আর যা নাই তা অপ্রত্যাশিতভাবে আসে না’, ‘যদি তোমার ভাগ্যে খাদ্য থাকে, রুটি তোমার কাছে আসবে, যদি না থাকে তাকে খুঁজে হতাশ হবে।’

অদৃষ্টবাদের ডকট্রিনকে ক্লাসিক্যাল ফরম দিয়েছে ধর্মবিদ আবুল হাসান আলি আল আশারি (মৃ. ৯৩৪) যার নিয়তিবাদকে অনেক মুসলিম চিন্তাবিদ সমালোচনা করেছেন।

চরম ফরমে আল্লাহকে চিত্রিত করা হয়নি মহান প্রকৃতি পুরুষরূপে, বরং নির্মমভাবে ও রুদ্ররূপে, এই রূপে তার যে ৯৯ সুন্দর নাম আছে, আমরা তার মধ্য থেকে এই নামগুলো দেখতে পাই, যেমন, আল-মুজিল (ধ্বংসকারী), আল জার (উৎপীড়ক), আল মুমিত (হত্যাকারী), আল-ফাতাহ্ (সিদ্ধান্তদাতা), আল-কাবিদ (স্থগিতকারী), আল-মুনতাকিম (প্রতিহিংসা গ্রহণকারী), আল-মানি (বঞ্চনাকারী), আল-মুদহিল (অপমানকারী), আল-খাফিদ (মর্যাদাহানিকারী)।

একটি মুসলিম প্রার্থনা (Supplication) আছে- আল্লাহর নিকট থেকে আমরা আশ্রয় চাই তাঁর কৌশল থেকে (Stratagern)। কোরান বলছে : মানুষে কৌশল করে, আল্লাহও কৌশল করেন, কিন্তু সকল কৌশলকারীদের থেকে আল্লাহ উৎকৃষ্ট ষড়যন্ত্রকারী (best plotter) (৮ : ৩০) এই দুনিয়ার জীবনটা কেবলমাত্র একটা খেলা, সময় ক্ষেপণের জন্য (৫৭ : ১৯)। তাই বিজ্ঞলোকদের কাজ হলো নিয়তির হাতে নিজেকে সমর্পণ করা, যা মুসলিমদের কর্তব্য; কারণ ইসলাম অর্থই সমৰ্পণ।

আল্লাহর সিদ্ধান্ত তার ইচ্ছামতো এবং স্বেচ্ছাচারী কারণ আল্লাহ কোরানে বলছেন, আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকে তাঁর অনুগ্রহ দান করেন। (৫ : ৫৯)। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা মাফ করেন, যাকে ইচ্ছা শাস্তি দেন (৩ : ১২৪) এবং তিনি যাকে ইচ্ছা শাস্তি দেন, আর যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন (৫ : ৪০)। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বিপথগামী করেন, যাকে ইচ্ছা সৎপথে পরিচালিত করেন। (১৪ : ৪) এবং যেহেতু সব কিছুই আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে, তিনি তাকে সৎপথে আনয়ন করেন না যে বিপথগামী হয় এবং যারা এই ভাবে বিপথগামী হয় তাদের সাহায্য করার কেউ থাকে না। (১৬ : ৩৯)।

বিশ্বাস ও অবিশ্বাস এবং বিশ্বস্ততা ও অবিশ্বস্ততা সব কিছুরই তিনি নির্ধারণ করেন। আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত ঈমান আনা কারো সাধ্য নয়” (10 : 100), “তোমরা ইচ্ছা করিবে না, যদি না আল্লাহ ইচ্ছা করেন (৭৬ : ৩০)। ‘আল্লাহ যাকে আলো দান না করেন, কোনো সময়েই সে আলো পায় না’ (২৪ : ৪০)। ‘আল্লাহ তার অন্তঃকরণ তালাবদ্ধ করেছেন, কানে গালা ঢেলে দিয়েছেন, চোখের সামনে পর্দা টেনে দিয়েছেন, যে ইচ্ছা করে ভুল করে’ (৪৫ : ২২)।

কোরান বারে বারে পরিষ্কার করে বলেছে, ভাগ্য সম্বন্ধে আল্লাহর চূড়ান্ত নির্দেশ। আল্লাহ যা নির্ধারণ করেছেন, তাছাড়া আমাদের অন্য কিছু ঘটতে পারে না (৯ : ৫১)। প্রত্যেক মানুষের সময় নির্ধারণ করা আছে বা বরাদ্দ আছে এবং সেই সময় যখন আগত হয় (আজল), তখন আত্মা তাকে ছেড়ে চলে যায় (৬৩ : ১১)। আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কোনো মানুষ মরতে পারে না এবং কেতাব মতে সেইটুকু সময়ের জন্য তার জীবন নির্ধারিত (৩ : ১৩৯)। তেমনি প্রত্যেক জাতির জন্য একটা সময় নির্ধারণ করা আছে এবং যখন সে-সময় উপস্থিত হয় তার পতন কেউ রুখতে পারে না (৭ : ৩২)।

মৃত্যুর পর, আমাদের নিয়তিও পূর্ব-নির্ধারিত। ট্র্যাডিশনে বর্ণিত আছে যে আল্লাহ যখন মানব জাতি সৃষ্টি করেছিলেন তিনি একটুকরা কাদা হাতে নিয়ে দুই খণ্ড করেন। এক খণ্ড স্বর্গে নিক্ষেপ করে বলেন, ‘এগুলো বেহেস্তের জন্য যা আমি ইচ্ছা করি এবং অন্য খণ্ডটি অনন্ত প্রজ্বলিত অগ্নিতে নিক্ষেপ করে বলেন, এগুলো জাহান্নামের জন্য এবং আমি কেয়ার করি না। এটা কোরানে কনফার্ম করা হয়েছে- ‘মানুষের মধ্যে পার্থক্য করে একদল আল্লাহর ডান হস্তের (৫৬ : ২৬) যারা স্বর্গে যাবে এবং আর এক দল লোক তাঁর বাম হস্তের (৫৬ : ৪০) তারা অভিশপ্ত (ever damned)।

১৪.১৫ শেষ বিচারের দিন

কখন পৃথিবী শেষ হয়ে আসছে, তার জবাবে মুসলিমদের পরামর্শ দেয়া হয়েছে- ‘একমাত্র আল্লাহই এ সম্বন্ধে জানেন, কে বলবে?’ (৩৩ : ৬৩)। একই সময়ে এটা স্মরণ রাখা উচিত যে, দুনিয়া যে কোনো সময় শেষ হতে পারে- ‘সেই সময় অতি নিকটে, হাতের কাছে’ (৩৩ : ৬৩) এবং ‘সময় সমাগত’ (২১:১)।

প্রফেট মোহাম্মদ নিজে বিশ্বাস করতেন যে, সেই সময় (সাআহ্) বা দিন (ইয়ম) বেশি দূরে নয় যখন পৃথিবী শেষ হয়ে যাবে। তিনি যখন দেখলেন দুই জন লোক তাদের ঘর-বাড়ি মেরামত করছে তিনি মন্তব্য করেন, ‘আমি মনে করি এই মেরামতের কাজ শেষ হবে না।’ অনেকে এর অর্থ করেছেন যে তাদের প্রচেষ্টা শেষ বিচারের দিন গ্রাস করবে।

মুসলিম ট্র্যাডিশন মতে, কিয়ামতের আগে কতকগুলি চিহ্ন দেখা যাবে। যখন দুনিয়া শেষ হয়ে আসবে, আল্লাহ পৃথিবীটাকে মানুষের ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দিবেন। তখন সকলেই অবিশ্বাসী হবে, ঈমান হারাবে, নৈতিক চরিত্র থাকবে না, মানুষ দিন দিন অধার্মিক হয়ে যাবে।

কোরান যেহেতু আল্লাহর কাছ থেকে এসেছে, এটা তাঁর কাছেই ফিরে যাবে, পবিত্র পুস্তকের আস্তে আস্তে আয়াতগুলো মুছে যাবে, পাতাগুলো সাদা হয়ে যাবে, কিছুই থাকবে না। ইবন মাজার (মৃ. ৮৮৬) এক স্থানে উল্লেখ করেছে, মানুষের অন্ত :করণ থেকে কোরান মুছে যাবে এবং ঐ পুস্তকের জ্ঞান ও লিখিত সূরা, আয়াত সব পরিষ্কার ভাবে পৃথিবী থেকে মিলিয়ে যাবে।

মোহাম্মদের এক ভবিষ্যদ্বাণী মতে (Sale, 1886, P90), ইথিপিয়নরা কাবা ধ্বংস করে দিবে এবং আর কখনো পুনর্নির্মাণ হবে না। আরবরা আবার লাত ও উজ্জাকে পূজা করতে শুরু করবে এবং তাদের পূর্ব প্যাগন ধর্মে ফিরে যাবে। একটি হাদিসে মোহাম্মদ বলেছেন— ‘পৃথিবী ধ্বংস হবে না যত দিন না দাউসের নারীরা পাছা দুলিয়ে জুল খালাসার মূর্তি ঘিরে নাচতে শুরু করবে, যেমন তারা প্রাক-ইসলাম যুগে করত (Faris, 1952, P. 32) ।

বাইবেলে বলা হয়েছে, পৃথিবীর শেষ সময়ে এক ভয়ঙ্কর জন্তু বের হবে এবং ড্রাগনের মতো কথা বলবে (Rev. 13; 11), তেমনি কোরানও একটা জন্তুর কথা বলেছে (দাব্বা) যা পৃথিবীর শেষ দিনে আবির্ভাব হবে (২৭ : ৮৪) এবং মানুষের সাথে তিন দিন ধরে কথা-বার্তা বলবে। তারপর যিশু-শত্রু (এন্টি-খ্রাইস্ট) আসবে এবং সব লণ্ডভণ্ড করে দিবে যত দিন না যিশুখ্রিস্ট ফিরে আসেন এবং এন্টি-খ্রাইস্টকে পরাজিত করে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করবেন। যিশুর এই দ্বিতীয় আগমনই হবে কেয়ামতের শেষ চিহ্ন।

১৪.১৬ নরক

মৃত্যুর পর প্রত্যেক মানুষ কবরের মধ্যে শোবে এবং দুই জন কালো ফেরেস্তা মনকির ও নকির এসে তার ঈমান সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করবে। ঈমানদার ব্যক্তিরা সে প্রশ্নের সঠিক জবাব দিবে, কিন্তু বে-ঈমানদার যারা তার কি বলতে হবে জানবে না, আর ভুল-ভাল জবাব দিবে, তখন তাদের পেটানো হবে। জবানবন্দির পর, ঐ ব্যক্তি গভীর নিদ্রা মগ্ন হবে। পৃথিবী যখন শেষ হয়ে আসবে তখন একটা বিরাট চিৎকার (সাইহা) হবে এবং ব্রজধ্বনি (সাখা) হবে। পাহাড়গুলো ভেঙে ধুলোয় পরিণত হবে, সাগরের পানি ফুটে উঠবে, ইস্রাফিল, মৃত্যুর দূত, শিঙা ফুঁকবে (২৭ : ৮৯)। সূর্য অন্ধকার হয়ে আসবে, তারাগুলো পতিত হবে এবং আকাশ গুটিয়ে যাবে।

কিয়ামত (রিসারেকশন) সমাগত; সব মৃত লোক খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে যাবে এবং ভীত হয়ে বিচারালয়ে দৌড়ে যাবে। মুসলিম বিশ্বাস মতে যিশু এই ট্রাইব্যুনালে পৌরহিত্য করবেন (Kazi and Flynn, 1984, P. 53) এবং পৃথিবীতে যারা বাস করেছে, বিচার করে তাদের ভাগ্য নির্ধারণ করা হবে।

বিচারের পর প্রত্যেককে একটা ব্রিজ (সিরাত) পার হতে হবে, যে ব্রিজ চুলের মতো সরু এবং তরবারির চেয়েও তীক্ষ্ণ। ‘সিরাত’ কথাটা এবং এর ধারণা জোরাস্ত্রিয়ানদের কাছ থেকে নেয়া হয়েছে (Tisdall, 1911, P. 252)। সাতটা নরক আছে, আগুন গনগন করছে, তার সাতটা গেট (১৫-৪)– এই গেট নির্দিষ্ট টাইপ, পাপীদের জন্য। কোরান সাতটা নরকের সম্বন্ধে কিছুই বলে না, কিন্তু তফসিরকারগণ এই সব বর্ণনা দিয়েছেন। আর জাহান্নাম কথাটা আসছে হিব্রু শব্দ ‘জেহিন্নম’ থেকে এবং ৭টা নরকের ধারণা এসেছে ইহুদি গ্রন্থ তালমুদ থেকে।

প্রত্যেকেই নরকে যাবে, কেননা কোরান বলছে— ‘তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই, যে নরকের নিচে যাবে না। এটা আল্লাহ্র সিদ্ধান্ত। (১৯ : ৭২)। ভালো মুসলিম পুল পার হয়ে যাবে, কিন্তু শেষ মাথায় পৌছানোর পর সে নরকের উপরের দিকে পতিত হবে এবং সেখানে কিছু দিন নরক ভোগের পর পবিত্র হয়ে পাপমুক্ত হবে।

খ্রিস্টান ও ইহুদিরা জোরান্দ্রিয়ানদের অনুসরণ করে তাদের মতে পুলের অধিক পার হলে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ নরকে পড়বে। যেহেতু তারা আহলে কিতাব, সুতরাং তারা পুড়বে না, তবে আগুনের আঁচ পাবে এবং তারা দুঃখ করবে কেন আমরা ইসলাম গ্রহণ করলাম না।

পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম দোজখগুলো আরও ভয়ঙ্কর। এগুলো বিধর্মী : মূর্তিপূজক, মোনাফেক, ধর্মত্যাগীদের জন্য, আর যারা প্রফেটের বিরুদ্ধে গিয়ে তাঁকে উপহাস করেছে। তারা পরিবারবর্গসহ যাবে- ছোট বালিকা যে নরকের জন্য নির্ধারিত ছিল, কারণ তার বাবা ওকবা মোহাম্মদের বিরোধিতা করেছিল। এই সব লোকে পুল সিরাতে পা দিয়ে কয়েক পা যাওয়ার পর পড়ে যাবে গভীর গর্তে যেখানে গনগনে আগুন জ্বলছে এবং এখানে তারা চিরকালের জন্য নরক ভোগ করবে (২ : ৩৭)।

সবচেয়ে নিচের গর্তে পড়ে আগুনে পুড়বে তারা যারা প্রফেটের ব্যক্তিগত শত্রু। যেমন- আবু লাহাব ও তার স্ত্রী, আবু জাহেল এবং ইহুদি, যেমন জাবির। আর একজন ইহুদি, কোজমান যে প্রফেটের সাথে ওহোদের যুদ্ধে মারা যায়। সে দেশের জন্য ও দশের জন্য লড়াই করে মৃত্যুবরণ করে। সে নরকের আগুনের শিশু।

প্রফেট তাঁর, নিজের পূর্ব-পুরুষদের নরকবাসী করেছেন যারা প্রাক-ইসলামী যুগে বাস করেছে এবং ইসলাম গ্রহণ করেনি। তারা বিধর্মী, মূর্তিপূজক হিসাবে মারা গেছে তাই নরকবাসী। তাঁর মাতা আমিনা, যিনি ইসলামের ৩০ বছর আগে মারা গেছেন, তিনিও নরকে। তাঁর দাদা আবদুল মোতালেব ও চাচা আবু তালিব যারা তাঁকে পেলেছেন, পুষেছেন, আশ্রয় দিয়েছেন, তারাও নরকে অত্যাচারিত হবেন, তারা বিশ্বাসী ছিলেন না ও ইসলামও গ্রহণ করেননি।

কোরানে একটি আয়াত আছে (৯ : ১১৪) মোহাম্মদের কাছে অবতীর্ণ হয়েছিল, যেখানে তাকে বারণ করা হয়েছে, যে কোনো আত্মীয় বিধর্মী হয়ে মারা যায়, যদিও নিকট আত্মীয়, তবুও তার জন্য দোয়া-মাগফেরাত করতে নেই ‘তারা নরকবাসী’।

১৪.১৭ স্বৰ্গ

ক্ষণকালের বিরতির পর সত্যিকারের মুসলিমগণ কোন বাধা ছাড়া পুল পার হয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে। যেমন দোজখে আছে, তেমনি বেহেস্তে সাতটা অঞ্চল আছে এবং জান্নাতবাসীদের পুরস্কার সম্বন্ধে কোরানে ডজন খানের বেশি স্থানে বর্ণিত আছে। মোহাম্মদ তাঁর অনুসারীদের কাছে শপথ করেছেন : ‘আমি তোমাদের পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ বস্তু দিয়েছি, পরলোকেও পাবে।

কোরানের মতে বেহেস্তবাসীদের পুরস্কার হচ্ছে, পুরুষদের জন্য কিশোর বালক (ওয়ালদান) তাদের খেদমতে থাকবে, প্রস্ফুটিত বালক, মুক্তার মতো। যার মধ্যে তুমি আনন্দ পাবে এবং পাবে বিশাল রাজ্য। কোরানের ভাষায় : ‘তাহাদিগকে পরিবেশন করিবে চির কিশোরগণ, যখন তুমি উহাদিগকে দেখিবে তখন মনে করিবে উহারা বিক্ষিপ্ত মুক্তা। তুমি যখন সেথায় দেখিবে, দেখিতে পাইবে ভোগ-বিলাসের উপকরণ এবং বিশাল রাজ্য’ (৭৬ : ১৯ – ২০)।

সৌভাগ্যবানগণ হুরীদের মুখোমুখি শুয়ে থাকবে, নীলচক্ষু বিশিষ্ট পবিত্ৰ (৫৬ : ২২) কুমারী উন্নত বক্ষ (৭৪ : ৩৩), যাদের কোনো মানুষ বা জিন স্পর্শ করেনি এবং তুমি সেই হুরীর সাথে মিলিত হবে। গিলমান (বালক)দের মতো হুরীরা চির যৌবনা, সুন্দর, সব সময়েই তোমার সেবায় নিযুক্ত।

তফসিরকার স্বর্গের বর্ণনা যা দিয়েছেন তা অভূতপূর্ব, অপার্থিব এবং সেখানকার আনন্দ এবং প্লেজার অতুলনীয়। বিশ্বাসী স্ত্রীরা এবং সত্যিকারের মুসলিম নারীরাও বেহেস্তবাসী হবে (৪৩ : ৭০), কিন্তু তাদের জন্য কোনো যুবক সঙ্গী থাকবে না।

জেহাদীরা যারা ধর্ম যুদ্ধ করেছে ও শত্রু নিধন করেছে বা ইসলাম প্রসারের জন্য কোনো ভালো কাজ করেছে (৯ : ১১২) বা যে বিধর্মীদের হত্যা করেছে, তাদের জন্য বিচারের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে না, মৃত্যুর সাথে সাথে তাদের নিয়ে যাওয়া হবে বিশেষ সংরক্ষিত স্থানে জান্নাতের মধ্যে। গিবন বলেছেন- পৃথিবীর সৌন্দর্য ও সম্পদ ভোগ, বেহেস্তের আনন্দের কাছে কিছুই নয়, সেখানে শহীদদের জন্য আলাদা ভোগের বন্দোবস্ত আছে।

বেহেস্তের এই লোভের লালসায় দলে দলে জেহাদে যোগ দিয়েছে এবং শহীদ দরজা পেয়েছে বহু কাফিরকে হত্যা করে, কিন্তু তাদের আত্মা এখন কোথায় আছে, কে জানে, কারণ শেষ বিচারের আগে বেহেস্তের দরজা খুলবে কিনা সন্দেহ। বিচারের দিনের পূর্বে সরাসরি বেহেস্তে যাওয়ার কথা কোরানে নির্দিষ্টভাবে বলা নেই; শুধু মুখের কথা।

ইসলামের প্রথম শহীদ ১৬ বছরের বালক ওমর ইবন হুবাব। ছেলেটি এক মুঠে খেজুর খাচ্ছিল। বদরের যুদ্ধের সময় প্রফেট শহীদের বেহেস্তের নিশ্চয়তা দিলে বালকটি লাফিয়ে উঠে বলে, ‘খেজুর চিবানোর চেয়ে বেহেস্তের মেওয়া খাওয়া ভালো, এই বলে খেজুর পাশে রেখে তরবারি হাতে যুদ্ধে ছুটে গেল এবং মারা পড়ল।

বর্ণিত আছে সিমফিনের যুদ্ধে (৬৫৭ খ্রি.) একজন সিনিয়র নাগরিক ৮০ বছরের বৃদ্ধ একজন মানুষকে যুদ্ধে শহীদ হতে দেখল তারপর সে কল্পনা করল বেহেস্তের দরজা খুলে গেল এবং একজন নীল-নয়না তন্বী যুবতী স্বল্পবাসে বের হয়ে এসে সেই শহীদ ব্যক্তিকে আলিঙ্গন করে নিয়ে গেল। এই দৃশ্য দেখে তার আর তর সইল না। ঐ ভাগ্য পাওয়ার আশায় সে অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে যুদ্ধ ক্ষেত্রে ছুটে গেল এবং শীঘ্রই কাটা পড়ে। সে তন্বী যুবতীর আলিঙ্গন পেয়েছিল কিনা আল্লাহ জানে।

কোরানে বেহেস্তের যে ছবি ও দৃশ্য অঙ্কিত হয়েছে, বলা হয় যে, এটা কোনো স্বর্গীয় ভিশন নয়, নিছক যৌন ক্রিয়ার স্বপ্ন। তন্বী হুরী, কিশোর গিলমান আর হত্যাকারীর সমন্বয়ে যে স্বর্গের ধারণা মোহাম্মদ দিয়েছেন, তা সুস্থ মস্তিষ্কের কল্পনা নয়; মানুষের কাছে, বিশেষ করে ইহুদি ও খ্রিস্টানদের সমালোচনার বস্তু।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *