১১। মোহাম্মদের ধর্মীয় পদ্ধতি

১১. মোহাম্মদের ধর্মীয় পদ্ধতি

ইসলামে রহস্যবাদ ট্রাডিশনের বিবর্তন যাকে বলা হয় (Arberry 1964, P. 63) The cult of Muhammad (মিল্লাতে মোহাম্মদ), কোরানে অনুরূপ ধারণায় তা “Cult of Abraham (Yusuf Ali, 1991, P. 406) বলে নামে পরিচিত (মিল্লাতে ইব্রাহিম)।

মিল্লাত শব্দটি হিব্রু কিন্তু আরামাইকের ‘মেমরা’ (memra) ধাতুগত এবং উভয়ই শব্দ মিল্লাত ও মেমরা গ্রিক লোগস (Logos)-এর মতো তাৎপর্যপূর্ণ। Logos অর্থ শব্দ (word)- Hughes, 1977, P. 349) ।

মিল্লাত-ই-মোহাম্মদ শক্ত শিকড় গাড়ল প্রফেট মোহাম্মদের মৃত্যুর পর। কয়েকটি গোত্র তার মতবাদের রহস্যনীয় দিকটা ধরে তার নেতৃত্ব-সত্তার ক্যারিশমাকে অধিদৈবিক (supernatural) রূপ দিয়ে শেষমেশ তাকে দেবতার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হলো অর্থাৎ দেবত্বারোপ (apotheosis) করা হলো। এই বিবর্তন কিভাবে শুরু হয়ে কোন কোন মহলে এই মতবাদটা চরম আকার ধারণ করল তার সংক্ষিপ্ত আলোচনায় আসা যাক।

১১.১ ঈশ্বরে বিশ্বাস

একেশ্বরবাদ (তৌহিদ) ইসলামের বহু পূর্বে আরবদের মধ্যে প্রচারিত হয়েছিল আরব সংস্কারকদের দ্বারা এবং প্যাগনদের মধ্যে এর ধারণা দিয়ে তাদের উদ্বুদ্ধ করা হয়েছিল। কাবাতে তীর্থ করতে এলে আরবরা বলত, ‘হে, আল্লাহ, তোমার কোনো অংশীদার নেই। তা সত্ত্বেও, বহুঈশ্বরবাদ ও মূর্তিপূজা বন্ধ হয়নি এবং মোহাম্মদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল মক্কায় অবতীর্ণ সূরার মধ্যে দিয়ে তাদের একেশ্বরবাদে দীক্ষা দেয়ার চেষ্টা করা এবং এক ঈশ্বরের পূজা করা।

কোরানের শিক্ষা খুবই সরল ও দ্ব্যর্থহীন। ঈশ্বর অদ্বিতীয় ও এক এবং তাঁর কোনো অংশীদার নেই। তিনি এক অস্তিত্ব নিয়েই আছেন এবং তাঁকে শুধু একত্ববাদের মধ্যেই অনুভব করা যায়। ঈশ্বরের সাথে কোনো কিছুকে সংযুক্ত করা মুসলিম ধর্মচেতনায় ঈশ্বরবিরোধী কাজ – শিরক।

ঈশ্বরের রূপ ভয়ঙ্কর; তিনি পূত, পবিত্র- মরণশীল মানুষ তাঁর কাছে পৌঁছতে পারে না এবং তাঁর সম্বন্ধে পরিপূর্ণ জ্ঞান লাভ করা সম্ভব নয়। তিনি সব কিছুই দেখেন, কিন্তু কোনোখানেই তিনি দৃশ্যমান নন (৬ : ১০৩)। মুসা কেবলমাত্র স্বর শুনেছেন, কখনোও দেখেননি (৭ : ১৩৯)।

মোহাম্মদ নিজে কিংবা তার কোনো সাহাবী কখনো দাবি করেননি যে, ঈশ্বরের সাথে মোহাম্মদের সরাসরি সম্পর্ক ছিল অথবা তিনি ঈশ্বরকে কোনো দিন দেখেননি বা তার স্বর শোনেননি। কোরানের বাণী এসেছে জিব্রাইলের মাধ্যমে এবং এমনকি তিনি (জিব্রাইল) মোহাম্মদ থেকে দূরে থাকতেন। যখন প্রফেট মিরাজে, স্বর্গে যান, ঈশ্বর থেকে তাকে আলাদা রাখা হয়েছিল হাজারটি দুর্ভেদ্য পর্দা দিয়ে। একটি হাদিসে আয়েশা বলেছেন : এটা চিন্তা করা জঘন্য মিথ্যা যে মোহাম্মদ ঈশ্বরকে দেখেছেন। (Gold ziher, 1971, P. 57)

১১.২ একটি আরব ধর্ম

মক্কায় প্রাথমিক দিনগুলোতে মোহাম্মদ ইহুদি ও খ্রিস্টানদের উচ্চ প্রশংসা করেছেন। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন বলে কথিত যে, মুসলিম সম্প্রদায় ইসরাইলের সন্তান ও খ্রিস্টানদের মতো একই পথ অনুসরণ করবে (Kister, 1980, XIV, P. 232)। কয়েকজন পণ্ডিতের মতে, মোহাম্মদের মূল উদ্দেশ্য ছিল তাঁর অনুসারীগণকে ইহুদি খ্রিস্টান-মুসলিম ফেলোশিপের অংশ হিসাবে তৈরি করতে, কারণ তিনি অনুভব করেছিলেন যে এই তিনটি ধর্ম এক মৌলিক বিশ্বাসের ভিন্নরূপ, যার বিভাজন উচিত নয় (৪২ : ১১)।

ইহুদি ও খ্রিস্টানদের প্রার্থনা পদ্ধতি তাদের নিজেদের সুবিধার কারণে নির্ধারিত। তাদের নিজেদের ভিন্ন প্রফেট আছে এবং তাদের নিজেদের ভাষায় রচিত ধর্মপুস্তকও আছে। আরবদেরও নিজস্ব একটি ধর্ম থাকা প্রয়োজন যা তারা নিজেদের দরকার মতো গ্রহণ করবে। যখন ঈশ্বরের ইচ্ছায় মোহাম্মদ প্রেরিত হয়েছেন এক নতুন ধর্মসহ, ইহুদি ও খ্রিস্টানদের ধর্মের সাথে তুলনীয়।

মিশনের শুরুতে মনে হবে, মোহাম্মদের কোনো বিশ্বজনীন মিশন ছিল না। ইসলামকে একটি জাতির ধর্ম হিসাবে (ethnic faith), বিশেষ করে আরব জাতির জন্যই চিন্তা করা হয়েছিল এবং মোহাম্মদ ইচ্ছা করেননি আরবের বাইরে এই ধৰ্মকে ছড়িয়ে দিতে। তার স্ত্রী খাদিজা, কাজিন ওয়ারাকা এবং তিনি নিজে, মক্কায় প্রচার কালে, বিশ্বাস করেছিলেন যে তিনি শুধুমাত্র আরবদের জন্য একটি ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছেন।

১১.৩ মধ্যপন্থী মানুষ

প্রফেটের প্রথম দিকের ঘোষণায় তিনি কোনো আক্রমণাত্মক আচরণ করেননি। একজন আধুনিক পণ্ডিত বলেছেন, ‘নমনীয়-ন্যায়শীলতা প্রকাশ পেয়েছিল তাঁর শাসনকালে (Guillaume)। প্রফেট কোনো কঠিন আইন প্রবর্তন করেননি তাঁর অনুসারীদের জন্য, কিন্তু আশা করেছিলেন তাঁর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে মুসলিমরা একটি সহনীয় সম্প্রদায় হবে। যেমন কোরান বলছে : ‘আমরা তোমাদের মধ্যপন্থী মানুষে পরিণত করেছি’ (২ : ১৩৭)।

মোহাম্মদ সব সময়ে সহজ মতবাদের পক্ষপাতী ছিলেন, বাড়াবাড়ি করতেন না। তিনি অপচয় (ইসরাফ) বা অতিরিক্ত ব্যয় না করাকে ধর্মের অঙ্গ মনে করতেন। আধ্যাত্মিকতা ও কামুকতার মধ্যে ব্যালেন্স করে চলতে বলতেন; আত্মত্যাগ ও স্বার্থপরতার মাঝে সমন্বয় করতে পরামর্শ দিতেন; ভাবলেশহীনতা ও আবেগপ্রবণতার মাঝে মধ্যপথ খুঁজতে বলতেন। ধর্ম-বিমুখতা ও ফ্যানাটিক আচরণের মধ্যপথ অবলম্বন করতে বলতেন। এটাই হলো ‘সঠিক পথ’ (সেরাতুল মুস্তাকিম) কোরানে প্রথম চ্যাপ্টারে।

ইবন আব্বাস, প্রফেটের কাজিন, ইসলামিক আইনের ও ট্র্যাডিশনের অথরিটি, বলেছেন যে, প্রফেট তাঁর অনুসারীদের জন্য তাদের কর্তব্যকর্মকে সহজ করে দিয়েছেন। তিনি অতিরিক্ত কঠোর পদ্ধতি পালনের কারণে মুসলিমদের পাপের মাত্রা বাড়িয়ে কিংবা অতিরিক্ত ফরজ কর্তব্য পালন করতে তাদের বাধ্য করেননি— ‘পুস্তকভারে অবনত গাধার মতো যা বহন করার ক্ষমতা তার নেই’ (৬২ : ৫)।

মোহাম্মদ ক্বচিৎ আনুষ্ঠানিক ধর্ম পালন করার জন্য চাপ সৃষ্টি করতেন; তাঁর কাছে যে ঐশী বাণী আসত তার সহজ ব্যাখ্যা করতেন। এক দৃষ্টান্তে দেখানো হয়েছে যে, একবার কতকগুলো লোক এসে প্রফেটকে জানাল যে, সঠিকভাবে অনুষ্ঠান পালন না করার জন্য সে চিন্তিত; তখন তিনি তাদের বলেন, ‘ক্ষতি নেই, (লা হরাজা), কোরানে আল্লাহ বলেছেন, ধর্মীয় ব্যাপারে তিনি তোমাদের ওপর কোনো কঠোরতা আরোপ করেননি (২২ : ৭৭)। উৎসর্গ সম্বন্ধে প্রফেটকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন- যে উৎসর্গ করতে চায়, সে যেন তার পশুর প্রথম শিশুটিকে উৎসর্গ করে, যদি না করে সে না করুক, ক্ষতি নেই। প্রার্থনা, হজ, খাদ্যদ্রব্য, সওম এবং সপ্তাহের বিশ্রাম পালন সম্বন্ধে কোনো কড়াকড়ি নিয়ম ছিল না, আর যদি থাকত তাহলে তা সহজভাবে পালিত হতো এবং সময় সময় নিয়ম বাতিল করাও হতো, তাতে এটাই বোঝানো হয় যে কোরানকে পাঠ করতে হবে বুঝে, তার স্পিরিট উপলব্ধি করে, আক্ষরিক বা কঠোর ভাবে ফরম্যালিটি পালন করে নয়।

বস্তুত মোহাম্মদ আচরণে বিভিন্নতার জন্য কোনো আপত্তি করেননি; তিনি বলতেন ‘আমার সম্প্রদায়ের যে অসাদৃশ্য (diversity), তা আল্লাহর করুণা (Swartz, 1981 P. 126)। বিশ্বাসীদের আল্লাহ স্বাধীনতা দিয়েছেন, যাতে অপরিবর্তনীয় বিধি- নিষেধের জন্য তারা যেন অসুবিধা বোধ না করে।

মোহাম্মদের মৃত্যুর পর মুসলিম আইনবিশারদদেরও ইমামদের অনমনীয় আইন ও বিধিবিধান তৈরি, প্রফেটের প্রাথমিক মিশনের বিরোধিতা। তিনি বেঁচে থাকলে ইমাম ও জুরিস্টদের রচিত কঠোর আইন ও বিধিবিধান অনুমোদন করতেন না।

১১.৪ খাদ্য ও রোজা

খাদ্য ও পানীয় ব্যাপারে মোহাম্মদ যথেষ্ট শিথিলতা দেখিয়েছেন। প্রথমে তিনি খাদ্য গ্রহণের সম্বন্ধে কিছু নিয়ম চালু করেন, কিছুটা ইহুদি প্রথায়, কিন্তু পরে প্রত্যেক ক্ষেত্রে বিধি-নিষেধ শিথিল করে দেন।

আহলে কিতাবিদের খাদ্য (ইহুদি ও খ্রিস্টান) কোরান বলে, অনুমোদিত (হালাল) এবং খাওয়া যেতে পারে (৫ : ৭)। কিছু মাংস নিষিদ্ধ (হারাম), শূকরের মাংসসহ (২ : ১৬৮) কিন্তু অতিরিক্ত ক্ষুধার্ত (৫ : ৫) বা প্রয়োজনে (২ : ১৬৮) বা বাধ্য হয়ে (৬ : ১১৯) নিষিদ্ধ দ্রব্য ভক্ষণ করলে পাপ হয় না। সর্বশেষে একটি শেষের দিকের সূরাতে বলা হয়েছে যে, যদি ঈশ্বরকে ভয় এবং সৎকর্ম করে, যে কোনো খাদ্য গ্রহণ করলে তার কোনো দোষ হবে না (৫ : ৯৫)।

ফজলুর রহমান বলেন, প্রথম দিকে মদ পান করার অনুমতি ছিল (1966, P. 38)। যখন মোহাম্মদের সাহাবীদের মধ্যে মদ্যপানের পার্টি জমত এবং ধর্মীয় কর্তব্য ভুলে যেত; তারপর কেউ কেউ মাতাল অবস্থায় মসজিদে নামাজে আসতে লাগল তখন প্রফেট তাদের কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দিয়ে, মদ্যপানকে পাপকর্ম বলে উভয়ের মধ্যে (মদ ও জুয়া) আছে মহাপাপ এবং মানুষের জন্য উপকারও; কিন্তু উহাদের পাপ উপকার অপেক্ষা অধিক (২ : ২১৬)। মদ শয়তানের কাজ এবং যদি এর ব্যবহারে ঈশ্বরকে স্মরণে না থাকে, তাহলে পরিহার করা উচিত (৫ : ৯১-৯২)।

কোরান বলে খেজুর বৃক্ষের ফল ও আঙুর থেকে তোমরা মদ তৈরি করো, ইহাতে অবশ্যই বোধ শক্তিসম্পন্ন সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শন আছে (১৬ : ৬৯)। কিছু কিছু ধর্মবিদ আঙুরজাত মদ (খামর), যা নিষিদ্ধ এবং খেজুরের রস (নাবিদ)-এর মধ্যে পার্থক্য করেছেন। খেজুরের রস বৈধ, গ্রহণ করা যায়, কারণ প্রফেট নিজেই এই রস পান করতেন। একটি হাদিসে বলে : আয়েশা বর্ণনা করেছেন যে প্রফেট বলেছেন- ‘তোমরা মদ পান করতে পার, কিন্তু মাতাল হয়ো না (Gold-ziher, 1981, P. 60)।

অন্যভাবে, মদকে স্বাস্থ্যকর বলা হয়েছে এবং মানবজাতির নিকট এটি আল্লাহর অবদানের চিহ্নস্বরূপ বলে গণ্য করা হয়েছে। (১৬ : ৬৯)। একাধিকবার বলা হয়েছে যে, স্বর্গে আনন্দদায়ক বস্তুর মধ্যে একটি (৫৬ : ১৮)।

মদ্যপানের জন্য ৮০ ঘা বেত মারার শাস্তি অনেক পরে প্রবর্তিত হয়েছে এবং এই শাস্তির বিধান কোরানে নেই। খলিফা আল মোতাওয়াকিল (মৃত ৮৬১), নিজে অর্থোডক্স সুন্নি হলেও নিজে মদে চুর হয়ে থাকতেন। আর একজন খলিফা, কাহির (মৃ. ৯৩৪) মদ্যপায়ীর বিরুদ্ধে কঠোর হলেও নিজে প্রায়ই স্খলিত পদ হতেন এবং সারা মুসলিম ইতিহাস জুড়ে অসংখ্য নেতা-ধর্মীয় ও রাজনৈতিক- গোপনে মদ্যপানের আসর জমাতেন।

যদিও আফিমের মতো ড্রাগ কোরানে নির্দিষ্টভাবে নিষিদ্ধ নয়; ইসলামী আইনে কিয়াসের দৃষ্টান্তে নিষিদ্ধ। যুক্তি দেখানো হয়েছে যে মদ (খামর) নিষিদ্ধ কারণ এটা মানুষকে মাতাল করে। আফিম ও অন্যান্য ড্রাগও উত্তেজক বস্তু, মাতাল করে দেয়, তাই এগুলো নিষিদ্ধ।

নিয়মিতভাবে উপবাস পালন করা ইহুদি ও খ্রিস্টানদের রীতি এবং মোহাম্মদ যখন ৩০ দিনের উপবাস চালু করলেন, তা পুরনো রীতি অনুযায়ী; অথবা কোরান বলে উপবাস তোমাদের জন্য নির্ধারিত হলো যেমন তোমাদের পূর্বে ছিল (২ : ১৭৯)। এখানেও কিছু শিথিলতা আছে। কোরান অনুযায়ী যারা উপবাস করতে পারবে না, তারা গরিব লোকদের খাওয়াবে। (২: ১৮০)

১১.৫ প্রার্থনা

কোরানে প্রার্থনার বিবরণ নেই বা নির্দিষ্টভাবে নিয়ন্ত্রিত করা হয়নি। পরবর্তী পর্যায়ে ধর্মীয় গুরুরা যে ফরম্যালিটি চালু করেছেন মোহাম্মদ নিজে বা তাঁর সাহাবীরা সেভাবে পালন করেননি। প্রার্থনার পদ্ধতি প্রবর্তন করতে মোহাম্মদ নিঃসন্দেহে খ্রিস্টান সাধুদের প্রার্থনা পদ্ধতির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন, যে পদ্ধতি খ্রিস্টান সাধুরা মধ্যপ্রাচ্যে পালন করতেন। যেমন, নিয়মিত বিরতি দেয়া, হাঁটু গাড়া, প্রণিপাত ইত্যাদি।

খ্রিস্টান মঠ, চার্চ, সিনেগগ ও মসজিদগুলোকে কোরানে উপাসনালয় বলা হয়েছে (২২:৪০)। এক হাদিস অনুযায়ী, সিনেগগ ও চার্চ সম্বন্ধে মুসলিমদের বলা হয়েছে- ‘তোমাদের প্রার্থনা সেখানেও করতে পার, এতে ক্ষতি নেই।’ মোহাম্মদ নিজে, বলা হয়েছে যে, সিনেগগ প্রায়ই পরিদর্শন করতেন। ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি নাজরান থেকে আগত একটি খ্রিস্টান ডেলিগেশনকে মদিনার মসজিদে প্রার্থনা করার অনুমতি দেন।

গণপ্রার্থনাকে, সাম্প্রদায়িক, প্রায় সামাজিক, অনিয়মিত এবং ক্যাজুয়েলভাবে পালনীয় বলে বিবেচনা করতেন। তিনি নিজে কখনো খালি পায়ে বা মোজা লাগিয়ে প্রার্থনা করেননি, যেমন এখন অর্থোডক্স মুসলিমগণ দাবি করেন। তিনি জুতা সমেত প্রার্থনায় দাঁড়াতেন, শুধু পাশে পাশে ধুলো ঝেড়ে নিতেন। শাহদান ইবন আউস বর্ণনা করেন যে মোহাম্মদ বলেছেন : ইহুদিরা যা করে তার উল্টো করো, কারণ তারা বুট বা জুতা পায়ে প্রার্থনা করে না। (Hughges, 1977 P. 470)। এক হাদিসে বলা হয়েছে যে, নামাজের সময় মুসল্লিরা একে অন্যের সাথে কথা বলতে পারত। প্রফেট নিজে সময়ে সময়ে তাঁর প্রিয় নাতনী উমামাকে কাঁধে করে গণপ্রার্থনায় যেতেন; সেজদার সময় তাকে নামিয়ে রেখে আবার তাকে ঘাড়ে তুলতেন। আর একটি হাদিসে আছে যে তার দুই নাতি, হাসান ও হোসেন, নামাজের সময় তার পিঠে লাফিয়ে উঠত।

কোরানে কোথাও নির্দিষ্টভাবে নেই যে, দিনে পাঁচ বার নামাজ (প্রার্থনা) পড়তে হবে এবং এর কোনো ভালো সাক্ষ্য নেই যে পরবর্তীতে অর্থোডক্স ইমামরা দিনে পাঁচবার নিয়ম করেছেন, তা সুনির্দিষ্টভাবে প্রফেটের জীবদ্দশায় নির্ধারিত হয়নি (Torrey, 1967, P. 135); এ বিষয়ে কোরানের আয়াতের বিশ্লেষণে নিশ্চিতভাবে বলা নেই, দিনে কোন সময়ে পাঁচবার প্রার্থনায় বসতে হবে এবং সূরাসহ কত রাকাত নামাজ (প্রার্থনা) করতে হবে।

বর্তমানে মুসলিমরা যত বার প্রার্থনায় বসেন এবং যে পদ্ধতি অনুসরণ করেন, সে সংখ্যা ও পদ্ধতি প্রফেটের প্রার্থনা-পদ্ধতির সাথে মিলে না। প্রফেট প্রার্থনা পছন্দ করতেন এবং তিনি বিভিন্ন সময়ে প্রার্থনায় বসতেন। ‘প্রায়ই দিনে পাঁচ বারের বেশি হতো এবং একই সময়ে হতো না। কোনো বাঁধাধরা নিয়ম ছিল না। জানা যায় যে, খ্রিস্টান সাধুদের মতো, তিনি এবং তাঁর কয়েকজন সাহাবী প্রায় দিনের দুই-তিন অংশ নামাজে অতিবাহিত করতেন অথবা অর্ধেক বা রাত্রের তৃতীয়াংশ।’ (৭৩ : ২০)

ইবন ইসহাক এক ঘটনা উল্লেখ করে বলেছেন, যখন প্রফেট মিরাজের সময় পর্দার সম্মুখে দাঁড়ান, তিনি জিজ্ঞাসা করেন মুসলিমদের কতবার প্রার্থনা করতে হবে। কণ্ঠস্বর এর জবাবে বলল, পঞ্চাশ বার দিনে। নিচে ফিরে আসার সময় মুসার সাথে দেখা হলে তিনি এই সংখ্যা কমিয়ে আনতে বলেন, কারণ এত বার প্রার্থনা করা মুসলিমদের জন্য সম্ভব হবে না। মুসা বারে বারে মোহাম্মদকে নামাজ কমাবার জন্য পাঠান এবং এই বারে তিরিশ, বিশ, দশ তারপর শেষে পাঁচ বার এসে স্থির হয়। মুসা তবুও এই সংখ্যা বেশি মনে করেন। কিন্তু বারবার যাওয়ার কারণে মোহাম্মদ আর ফিরে গিয়ে সংখ্যা কমাতে ইতস্তত বোধ করেন। তাই দিনে পাঁচ বার প্রার্থনার সময় নির্ধারিত হয়।

এই কাহিনীর মর্ম কথা এই নয় যে, মুসলিম পঞ্চাশ বা পাঁচ বার দিনে প্রার্থনা করবে, কিন্তু ঈশ্বরকে ঘনঘন চিন্তা করা তার উচিত (৩৩ : ৪১)- যেমন কোরান বলছে ঈশ্বরকে স্মরণ করো, দাঁড়িয়ে, বসে এবং হেলান দিয়ে (৩ : ১৮৮) এবং হাঁটতে হাঁটতে অথবা ঘোড়ায় চড়েও (২ : ২৪০)।

মুসলিমদের ভারমুক্ত করার জন্য মোহাম্মদ প্রার্থনার সময় কমিয়ে দেন। তার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে মুসলিমরা প্রার্থনা করবে; ভোরের আগে, ভোরের পরে, মধ্যাহ্নের পূর্বে ও পরে, সূর্যাস্তের আগে ও পরে, রাতে এবং আবার মধ্যরাতের পরে এবং বিশেষ করে ‘মধ্য প্রার্থনার’ সময়ে। ‘তোমরা সালাতের প্রতি যত্নবান হবে বিশেষত মধ্যবর্তী সালাতের এবং আল্লাহর উদ্দেশে বিনীতভাবে দাঁড়াবে।’ (২ : ২৩৯)। তিনি সকাল ও বিকালের প্রার্থনাকে এক করে দেন এবং সূর্যাস্তের পর ও রাতের প্রার্থনা, ওই ভাবে প্রার্থনা সংখ্যা কমিয়ে দিনে দু’বার করে দেন, যা মুসলিমগণ স্ট্যান্ডার্ড বলে গণ্য করেন। এটাকে কোরানিক ইনজাংশানের ওপর নির্ভর করে যেমন, ‘সালাত পালন কর সূর্যাস্তের পরে ও সূর্যোদয়ের পূর্বে’ (১৭:৮০) [সূর্য হেলিয়া পড়িবার পর হইতে রাত্রির ঘন অন্ধকার পর্যন্ত সালাত কায়েম করিবে এবং কায়েম করিবে ফজরের সালাত। নিশ্চয়ই ফজরের সালাত উপস্থিতির সময়- ১৭ : ৭৮ আল-কুরাজ্জুল করীম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ। -অনুবাদক।]

নামাজের সময় যে দিকে মুখ করে দাঁড়ানো হয়, সে সম্বন্ধেও সন্দেহ রয়েছে, মুতাজেলারা বিশ্বাস করে মক্কার দিকে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রয়োজনটা প্রফেট সাজেস্ট করে ছিলেন তাঁর অনুসারীদের সাধারণ জ্ঞান পরীক্ষা করার জন্য, কারণ কোরান বলছে স্পষ্ট করে ‘পূর্ব কিংবা পশ্চিম দিকে দাঁড়ানোর মধ্যে তোমার কোনো পুণ্য নেই’ (২ : ১৭২); আবার বলা হয়েছে ‘পূর্ব ও পশ্চিম যে দিকে মুখ ফেরাও সেই দিকেই ঈশ্বর রয়েছেন’ (২ : ১০৯)।

মোহাম্মদ আরবিতে প্রার্থনা করার জন্য বলেননি, কিন্তু তাঁর অনুসারীদের তাদের নিজের ভাষায় প্রার্থনা করতে অনুমতি দিয়েছেন, এই অনুমতি প্রথম দেয়া হয় সলমন ফার্সিকে (আমীর আলি, ১৯৬৫, পৃ. ১৬৬)।

মুসলিম সুফিরা মক্কার দিকে মুখ করে নিয়মিত প্রার্থনা করার ধারণাকে, নির্ধারিত পাঁচ বার, আরবি ভাষায় মন্ত্র পড়া যা অধিকাংশ মুসলিমদের বিদেশী ভাষা। নামাজের পূর্বে আবশ্যিকভাবে ওজু করা, মাটিতে হাঁটু ঠেকিয়ে সেজদা করা, যান্ত্রিকভাবে বিভিন্ন আসনে ওঠাবসা করা ইত্যাদিকে ধর্মের নামে ভান করা (sanctimony) আর ভণ্ডামি (hypocritical) ছাড়া আর কিছু নয় বলে মনে করেন।

১১.৬ হজ

শোনা যায় মোহাম্মদ মক্কার জাহেলিয়া সময়ে তাঁর উঠতি বয়সে বেশ কয়েকবার কাবাঘরে গেছেন, কিন্তু ৬১০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম রিভিলেশন (ওহি) পাওয়ার পর এবং তার পরবর্তী মক্কা-জীবনে ৬২২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কাবাঘর পরিদর্শন বা বড় হজ করার রেকর্ড নেই।

৬২৯ খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি মাসে, মদিনা থেকে তিন দিনের জন্য মক্কা যাওয়া শর্তে তিনি ছোট হজ (ওমরাহ) করেছেন, কাবাঘরে সাত পাক ঘুরেছেন খালি পায়ে, ভক্তি ভরে নয়, উটের পিঠে চড়ে এবং এই উটের পিঠ থেকে তিনি কখনো নামেননি। তিনি মোয়াজ্জন বিলালকে ডেকে কাবাঘরের ছাদে উঠে আজান দিতে বললেন। বিলালকে ছাদে ওঠানোর উদ্দেশ্য হলো, যে পুণ্য মন্দিরকে মক্কাবাসীরা শ্রদ্ধাভক্তি করে সেই স্থান একজন সাবেক হাবসী ক্রীতদাসের পায়ের তলে। ঐ একই সময়ে যখন একজন হাজী পবিত্র অবস্থায় ইহরাম বেঁধে থাকে, ঠিক সেই অবস্থায় তিনি মায়মুনাকে বিবাহ করে মিলন সম্পন্ন করলেন, যা ঐ সময়ে নির্ধারিত প্রথাবিরুদ্ধ এবং নারী-পুরুষের সঙ্গম অবৈধ।

৬৩০ খ্রিস্টাব্দে যখন তিনি মক্কা এলেন, তিনি প্রথামত কাবাঘরে সাত পাক ঘুরলেন আবার উটের পিঠে চড়ে এবং প্রত্যেক বার হাতের ছড়ি দিয়ে কালো পাথর ছুঁয়ে গেলেন। হিজরি অষ্টম মাসে মক্কা বিজয়ের পর এই পরিদর্শন হয় এবং গণসম্মুখেই হজ উদযাপন করার সুযোগ পান, কিন্তু তিনি তা করলেন না। ৬৩১ খ্রিস্টাব্দেও তিনি বার্ষিক হজে অংশগ্রহণ করেননি, আবু বকরকে পাঠিয়েছিলেন তাঁর পরিবর্তে। যদিও তিনি এখন মক্কানগরীর প্রভু, তিনি পরপর দু’বছর বার্ষিক হজে প্রথামতো অংশগ্রহণ করেননি।

৬৩২ খ্রিস্টাব্দে ৯ মার্চ মোহাম্মদ বিদায় হজ পালন করেন। এই এক হজে তিনি মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রধান হিসাবে অংশগ্রহণ করেন। এই সর্বশেষ হজে প্রফেট যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন তাই মুসলিমদের জন্য প্রথা রূপে নির্ধারিত হয়ে পালন করা বাধ্যতামূলক হলো, তবু এই হজ উপলক্ষে কয়েকটি বিশেষ বিষয় ছাড়া, তিনি পুরনো প্রথার ও নিয়মের কোনো পরিবর্তন করেননি এবং কিভাবে বার্ষিক হজ পালন করতে হবে তার নির্দিষ্ট কোনো বিধি-বিধান কোরানেও রেকর্ড করা হয়নি। উল্লেখ্য যে, এই কারণে বিভিন্ন গোষ্ঠী ও স্কুল, শিয়া সম্প্রদায়সহ, হজ পালনে বিভিন্ন ধরনের প্রথা অনুসরণ করে আসছেন (Aj Wensinck, in SEJ, 1974, P. 123)।

মোহাম্মদ তাঁর সকল আরব অনুসারীদের জন্য একটা সাধারণ ট্র্যাডিশনাল অনুষ্ঠান রূপে অবশ্য পালনীয় করেন এই মর্মে যাতে সব আরবের মধ্যে একতা ও সংহতি বজায় থাকে। তিনি কাবাঘরের সকল মূর্তি ও পুতুল ধ্বংস করে দেন, কিন্তু প্রাচীন প্রতীক রূপে কালোপাথর রেখে দেন এবং প্রায় সমস্ত প্রাচীন প্রথাও চালু রাখেন।

প্রাপ্তবয়স্ক ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী একজন মুসলিমকে জীবনে একবার হজ পর্ব পালন করা কর্তব্য, তবে শর্ত থাকে যে, তাদের আর্থিক সমর্থ থাকতে হবে, আসা-যাওয়ার খরচাপাতি ও তার অবর্তমানে পরিবারের সদস্যদের ভরণ-পোষণের জন্য।

প্রফেট যখন এই তীর্থ পালনের ব্যবস্থা করেন, তখন জনৈক ধার্মিক ব্যক্তি সোবাকা ইবন মালিক প্রফেটকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এই তীর্থ পালন প্রতি বছরের জন্য কিনা। শোনা যায়, এই প্রশ্ন প্রথম বার ও দ্বিতীয় বার এড়িয়ে যান। কিন্তু তৃতীয় বার প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘না’, কিন্তু যদি আমি বলতাম ‘হ্যাঁ’ তাহলে তোমাদের জন্য তা পালন করা কর্তব্য হয়ে দাঁড়াত এবং যদি কর্তব্য হতো তাহলে তোমরা তা পালন করতে পারতে না। সুতরাং আমি যা তোমাদের দিই না, তা নিয়ে আমাকে বিরক্ত করো না।’

বলা হয়েছে যে, প্রফেট কোনো অনুষ্ঠানের ওপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করেননি এবং সেসব অনুষ্ঠানের তাৎপর্য অতি অল্পই ছিল। আল-ওয়াকিদ এক হাদিসে উল্লেখ করে বলেছেন যে, আনুষ্ঠানিক ব্যাপারকে প্রফেট অসংশ্লিষ্ট (Irrelevant) বলে ঘোষণা করেন, পাথর ছোড়ার অনুষ্ঠানের কথা কোরানে উল্লেখ নেই, সাফা ও মারওয়ার মধ্যে ছোটাছুটিও প্রফেটের কাছে অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হয়েছে এবং এ সমস্ত ব্যাপারে বিধান দ্ব্যর্থবোধক যেমন, ‘না করলেও কোনো ক্ষতি নেই’ (২ : ১৫৩)।

শতাব্দি ধরে বহু মুক্তচিন্তার মুসলিম এই হজের ব্যাপারে আপত্তি তুলেছেন। বিখ্যাত বেশ কয়েকজন সুফি এটাকে পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন। রাবেয়া বসরী (মৃ. ৮০১) কাবা পরিদর্শন করে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন : ‘আমি শুধু ইট আর একটি ভবন দেখছি। এর থেকে আমি কি পুণ্য অর্জন করব?’ বায়েজিদ বোস্তামি (মৃ. ৮৭৪) হজে যাবার পূর্ব মুহূর্তে এক বৃদ্ধের সাক্ষাৎ লাভ করেন। সেই বৃদ্ধ ব্যক্তি তাকে বলেছিলেন, ‘আমাকে ঘিরে সাত বার চক্কর দাও। কাবাতে চক্কর দেয়া আর আমাকে চক্কর দেয়া একই কথা, সুবিধা হলো তোমার সময় বাঁচবে আর দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পাবে’। বায়েজিদ তাই করে বাড়ি ফিরে গেছেন।

এমনকি অর্থডক্স আল-গাজ্জালী (মৃ. ১১১১) মক্কা পরিদর্শনকালে হজ আনুষ্ঠানিকতা এবং হাজীদের কালো পাথর চুম্বনের দৃশ্য, মূর্তি পূজার আনুষ্ঠানিকতার সাথে তুলনা করেন এবং একেশ্বরবাদী ইসলামের জন্য সামঞ্জস্যহীন বলে মনে করেন।

অধুনা হজের অনুষ্ঠান শেষে আল্লাহর নামে অসংখ্য পশু নিধনের ব্যাপারে অনেকে আপত্তি তুলেছেন। লাখ লাখ পশু হত্যা করে তাদের দেহ চুন ভর্তি গর্তে ফেলে দেয়ার মাঝে কোনো পুণ্য অর্জন হয় কিনা, কেউ জানে না। প্রাণী হত্যা আর অপচয় ছাড়া এর অন্য কোনো অর্থ আছে বলে আধুনিক যুক্তিবাদী মুসলিমরা মনে করেন না। এটা অযৌক্তিক ও নিষ্ঠুরতা ছাড়া আর কিছু নয় এবং ব্যাপকভাবে পশু-মাংসের অপচয় যা অন্যভাবে মানুষের খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হতে পারত।

যারা এই হজের পুরো ব্যাপারটা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে তারা আশা করে, যে প্রফেট নিজে যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন : যেমন, এমন একদিন আসবে যখন ইথিওপিয়ানরা কাবাঘরকে ধুলোয় মিশিয়ে দেবে এবং তার আর পুনর্নির্মাণ হবে না, যাতে ইসলাম এক বিধর্মী অনুষ্ঠানের কবল থেকে মুক্তি পেতে পারে।

১১.৭ ঐশী গ্রন্থ

কোরান বলেছে যে, প্রত্যেক যুগে ঈশ্বর স্বর্গীয় গ্রন্থ নাজেল করেছেন (১৩ : ৩৮)। প্রেরিত ‘ঐশী গ্রন্থে’ ‘বিশ্বাস’ ইসলাম ধর্মের ছয়টি মৌলিক নীতির একটি। যেসব জাতি এই প্রেরিত ঐশীগ্রন্থ পেয়েছে তাদের বলা হয় ‘কেতাবী মানুষ’ – আহলে কিতাব People of the Book এবং শেষ বিচারের দিনে প্রত্যেক জাতি নিজেদের ধর্মগ্রন্থ মতে বিচারপ্রাপ্ত হবে।

কোরানে বলা হয়েছে, পূর্বে যেসব কিতাব প্রেরণ করা হয়েছে সেগুলোকে গ্রহণ করতে (৪ : ১৩৫), বিশেষভাবে মুসার পঞ্চ-পুস্তকে (তৌরাত) যেখানে ঈশ্বরের ইচ্ছা বিধৃত এবং দাউদের গীতসংহিতায় (জবুর) আর যিশুখ্রিস্টের গসপেলে (ইঞ্জিল)। কোরানে ১৩০টির বেশি প্যাসেজ আছে, যেখানে তৌরাত, গীতাসংহিতা ও ইঞ্জিলের নাম উল্লেখিত হয়েছে- উল্লেখ করা হয়েছে শ্রদ্ধার সাথে ঈশ্বর প্রেরিত গ্রন্থ বলে (Tisdall, 1911 P. 115) ।

মোহাম্মদের পূর্বে আরবরা অন্য জাতির পবিত্র গ্রন্থ গভীরভাবে পাঠ করতে পারত না অথবা তারা বুঝতে পারত না (৬ : ১৫৭) এবং এইভাবে তারা আব্রাহামের ধর্ম সম্বন্ধে অজ্ঞান ছিল। মোহাম্মদের মাধ্যমে ঈশ্বর তাদের কাছে তাদের জন্য কিতাব পাঠালেন আরবি কোরান (১২ : ২), যার দ্বারা তাদের ধর্ম ও তা পালন করার জন্য নির্দেশিত হয় (একই সময়ে মোহাম্মদ তাদের নিজেদের স্থানীয় ভাষায় কোরান পাঠ করার অনুমতি দেন)। কোরানে ঐ সমস্ত বাণীর পুনরাবৃত্তি হয়েছে, যেসব অন্য ধর্ম গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে। এই জন্য আরবদের ‘আহলে কিতাব’ বলা হয়েছে এবং তাদেরকে ইহুদি ও খ্রিস্টানদের সমমর্যাদা দেয়া হয়েছে।

মোহাম্মদ বলেছেন : কোরানে বিশ্বাস করো, বিশ্বাস করো জবুর, তৌরাত ও ইঞ্জিলে, তবে তোমাদের জন্য ‘কোরানই যথেষ্ট’। আলফ্রেড গিওম বলেছেন, কোরানের আয়াতের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ আয়াত আছে (1983, P. 30), যেখানে মোহাম্মদকে উপদেশ দেয়া হয়েছে এই বলে, যদি তিনি তাঁর কাছে প্রেরিত গ্রন্থ সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ পোষণ করেন তাহলে ‘তিনি যেন ঐ সব লোকদের জিজ্ঞাসা করেন যারা তাঁর পূর্বে ঐশী ধর্মগ্রন্থ পড়েছে’ (১০ : ৯৫), অর্থাৎ তিনি যেন ইহুদি ও খ্রিস্টানদের জিজ্ঞাসা করেন।

এই উপদেশ অনেক সময় অনুসরণ করা হয়েছে। কথিত আছে যে, দাগেস্তানের বিরুদ্ধে অভিযানকালে বিজয়ী নাদির শাহ (মৃ. ১৭৪৭) কাজভিনে কোরানের একটি আয়াত (৪৮ : ২৯)কে কেন্দ্র করে শিয়া-সুন্নির মধ্যে এক বিরোধে উপস্থিত ছিলেন। যেহেতু ঐ আয়াতে তোরাহ ও ইঞ্জিলের উল্লেখ ছিল, নাদির শাহ ইস্পাহানের ইমাম মির্জা মোহাম্মদকে নির্দেশ দিয়েছিলেন ইহুদি ও খ্রিস্টানদের কাছ থেকে ঐ আয়াতের সঠিক ব্যাখ্যা গ্রহণ করতে। ইহুদি ও খ্রিস্টানদের সাহায্যে সুন্নিদের পক্ষে এক সিদ্ধান্ত দেয়া হয়। আবার তাদের মতামত সম্বন্ধে সত্যতা যাচাই করার জন্য দ্রুজদের পরামর্শ শুধু কোরানের আয়াত সম্বন্ধে নয়, বাইবেল সম্বন্ধেও নেয়া হয় (Goldziher 1971 P. 111)।

কোরান বলে আহলে কেতাবিদের সাথে ঝগড়া বা বিরোধ সৃষ্টি করো না, যদি ভিন্নমত হয় ভদ্রভাবে তাদের সাথে আলোচনা করতে গিয়ে বলা উচিত- “আমাদের কাছে যা প্রেরিত হয়েছে তাতে বিশ্বাস করি এবং তোমাদের কাছে যা প্রেরিত হয়েছে তাতেও বিশ্বাস করি” (২৯ : ৪৫ – ৪৬) এবং আরও একটি প্যাসেজে আছে যে, যে গ্রন্থে ঈশ্বর মুসলিম ও অমুসলিমদের কাছে প্রেরণ করেছেন সকলই সমভাবে বৈধ এবং আমরা এদের মধ্যে কোনো পার্থক্য করি না (৩ : ৭৮)।

১১.৮ প্রফেটগণ

মুসলিম ধর্মে সমস্ত প্রফেটদের বিশ্বাস করা ছ’টি মৌলিক নীতির একটি। কোরান বলেছে যে, প্রত্যেক জাতির নিকট রসূল বা সংবাদবাহী প্রেরণ করা হয়েছে (১০ : ৪৮) এবং একটি সাধারণ হাদিস অনুযায়ী মোহাম্মদ নিজেই বলেছেন যে ১,২৪০০০ প্রফেট এবং ৩১৩ জন সংবাদবাহী (রসূল) দুনিয়ার মানুষের কাছে পাঠানো হয়েছে।

কোরানে মাত্র ২৭ জন প্রফেটের নাম উল্লেখ আছে (মোহাম্মদ ছাড়া), এদের মধ্যে ওল্ড টেস্টামেন্টে ২২ জন (প্রধান হচ্ছেন— আদম, নোয়াহ, আব্রাহাম ও মোসেস) এবং ৩ জন নিউ টেস্টামেন্টে (যাকারিয়া, তার পুত্র জন দ্য ব্যাপ্টিস্ট এবং জিসাস) অন্য দুজন হচ্ছেন জুলকারনাইন এবং লোকমানকে চিহ্নিত করা যায়নি, তবে মনে করা হয় আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট এবং এসপ (Aesop)। শেষের জনকে ডেভিডের (দাউদ) উজির বলে গণ্য করা হয়। এছাড়া আরও অনেক প্রফেট আছেন, যাদের সম্বন্ধে প্রফেট মোহাম্মদকে বলা হয়নি (৪ : ১৬২)। কোরান বলছে— ঈশ্বর তাদের কাছে কোনো প্রফেট প্রেরণ করেননি যারা নিজেদের ভাষা ব্যবহার করে না। (১৪ : ৪)। ইহুদি ও খ্রিস্টানদের মতো, মোহাম্মদের পূর্বে আরবদের কোনো প্রফেট ছিল না। ঈশ্বর মোহাম্মদকে আরব জাতির জন্য প্রফেট করে পাঠালেন, তাদের গাইড করার জন্য অর্থাৎ বিশ্বাসীদের গাইড করার জন্য, (১৭ : ৯), একটি আরবি বিশ্বাস প্রতিষ্ঠার জন্য (To create an Arab faith) এবং আরব ভাষায় তার ঘোষণা দেয়া হলো।

স্মরণীয় যে, মক্কায় প্রথম দিকে আল্লাহর বাণীই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, বহনকারী নয়। তিনি শুধুমাত্র ঘোষক (বশীর) ছিলেন, সরল কথায় একজন সাবধানকারী (নাদির) (২৯ : ৪৯), একজন সংস্কারক ও পবিত্রকরণকারী, উপদেশদাতা ও পরিচালক। তার মিশন আসলে একজন সংবাদবাহকের মিশন (৩ : ১৩৮), আরববাসীদের কাছে আল্লাহর বাণী পৌঁছে দেয়া, যাতে তারা আল্লাহর সেবায় নিযুক্ত হয়।

প্রথমে মোহাম্মদ নবীদের মধ্যে অসাধারণ বলে দাবি করেননি। তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন যে, তিনি কোনো নতুন ডকট্রিন (নীতি) আনয়ন করেননি (৪৬ : ৮), অথবা তাঁর রিভিলেশনে কোনো নতুন জিনিস আছে বলেও দাবি করেননি। কোরানের কথায় : ‘তোমার পূর্বেকার প্রফেটদের কাছে যা বলা হয়নি, তোমার কাছেও তা বলা হয়নি (৪১ : ৪৩) এবং আমরা প্রফেটদের মধ্যে কোনো প্রভেদ করি না’ (২ : ২৮৫)।

১১.৯ ধর্মীয় সহিষ্ণুতা

ধর্ম প্রচারের প্রথম দিকে মোহাম্মদ অন্যান্য ধর্মের প্রতি অত্যন্ত মহানুভবতা দেখিয়েছিলেন এবং কোনো প্রকার হিংসা বা দ্বেষ প্রকাশ করে তাদের সাথে বাক্য বিনিময় করেননি। একটি হাদিসে তিনি বলেছিলেন অন্য ধর্মকে নস্যাৎ করার অর্থ ঈশ্বরের প্রতি মন্দ আচরণ দেখানো।

ঈশ্বর বিভিন্ন প্রকার মানুষ ও গোত্র সৃষ্টি করেছেন এবং ঈশ্বর যদি চাইতেন তাহলে নিশ্চয়ই তোমাদের একটি জাতিতে পরিণত করতে পারতেন।

কোরান বলে : ঈশ্বর প্রত্যেক জাতির জন্য সঠিক পথ বলে দিয়েছে (৫ : ৫২), কী কর্তব্য পালন করতে হবে তাও বলেছেন (২২ : ৬৬) এবং কীভাবে ঈশ্বরের নাম স্মরণ করতে হবে সে আনুষ্ঠানিকতার পদ্ধতি বাৎলে দিয়েছেন (২২ : ৩৫) এবং তিনি প্রত্যেককে যা দিয়েছেন তাই দিয়েই পরীক্ষা করবেন, বিচার করবেন। (৫ : ৫৩) এবং সকলেরই স্বাধীনভাবে নিজ ধর্ম পালন করা উচিত। একটি আয়াত পরিষ্কারভাবে বলছে : ধর্মে জবরদস্তি নেই (২ : ২৫৭)।

ঈশ্বর বিশ্বাসীদের কাছে সেই একই ধর্ম পাঠিয়েছেন যা তিনি নূহ্, ইব্রাহিম, মুসা ও ঈসার কাছে পাঠিয়েছেন (৪২ : ১১)। ইহুদি হোক, খ্রিস্টান বা সাবিয়েন, যারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করে, শেষ বিচারের দিনে বিশ্বাস করে এবং সৎপথে চলে, তাদের পুরস্কৃত করা হবে (২ : ৫৯)। কোরানের এই সব সুনির্দিষ্ট আয়াত সব ধর্মকে একই কাতারে খাড়া করেছে।

যদিও তিনি মূর্তি পূজা বাতিল করেছেন, মোহাম্মদ তাঁর মিশনের প্রথম দিকে মূর্তিপূজকদের ওপর অত্যাচার করতে বলেননি। মক্কার প্যাগনদের তিনি শুধু বলেছিলেন তোমরা যাকে পূজা করো, আমি কখনো তার পূজা করি না এবং আমি যার পূজা করি. তোমরাও তার পূজা করো না। তোমার ধর্ম তোমার, আমার ধর্ম আমার (১০ : ৬)।

মোহাম্মদের মিশনের এই সময়ে তিনি ছিলেন শান্তির প্রতীক এবং প্রাথমিক ইসলাম সমন্বয় ও সহঅবস্থানের ইসলাম যার প্রকাশ পেয়েছে ‘সালাম’ সম্বর্ধনার মাঝে। তাঁর বিপক্ষের মানুষদের প্রতি আচরণে তিনি ভদ্র ও শান্তপ্রবণ ছিলেন, কোনো জবরদস্তি করেননি। তিনি কখনো সহিংসতার আশ্রয় নেননি, এমনকি আত্মরক্ষার জন্যও।

পরে এই শিশু-সম্প্রদায়কে অত্যাচার ও অনাচারের হাত থেকে রক্ষা পেতে তিনি তাঁর অনুসারীদের নিজেদের জীবন রক্ষার্থে যুদ্ধ করতে নির্দেশ দেন, কারণ যদি ঈশ্বর মানুষকে অত্যাচারীকে বাধা দিতে না অনুমতি দিতেন, তাহলে তাদের চার্চ, সিনেগগ ও মসজিদ এসমস্তই ধ্বংস হয়ে যেত (২২ : ৪১)।

মক্কার সূরাগুলোতে কোনো স্থানেই বলা হয়নি ধর্ম প্রসারের জন্য অস্ত্রধারণ বাধ্যতামূলক এবং কর্তব্য। এটা সত্য যে, কোনো প্রকারের সহিংসতাকে অস্বীকার করা হয়েছিল মক্কাতে থাকার সময়ে। প্যাগন আরবদের প্রথার বিরুদ্ধে, যেমন রক্তের বদলে রক্ত না নিলে পরিবারের জন্য বা গোত্রের জন্য লজ্জাকর ব্যাপার- মোহাম্মদের আদেশ ছিল এসব অপরাধকে আমলে না এনে, অপরাধীদের মার্জনা করে দেয়া (২৪ : ২২) এবং মন্দ কাজের পরিবর্তে ভালো কাজ করা (২৩ : ৯৮)। ঐসব মানুষের জন্য বেহেশত নির্ধারিত যারা ক্রোধ দমন করে, অন্যকে ক্ষমা করতে পারে (৩ : ১২৮)। কোরানের একটি আয়াতে বলা হয়েছে : যারা মন্দ সম্পর্কে সহনশীলতার সাথে সহ্য করে, পরিবর্তে সৎকর্মে তার প্রতিদান দেয়, তাদেরকে দ্বিগুণভাবে পুরস্কৃত করা হবে (২৮ : ৫৪)।

১১.১০ মানুষ মোহাম্মদ

কোরানে মোহাম্মদ ঘোষণা করেছেন- ‘সত্যি, আমি তোমাদের মতোই একজন মানুষ (১৮ : ১১০)। আমি তোমাদের অভিভাবক নই (১০ : ১০৮)। তোমাদের রক্ষকও নই (১৭ : ৫৬) অথবা তোমাদের ওপর খবরদারিও করতে আসিনি (৬ : ১০৪)।

তিনি দাবি করেননি যে, তিনি স্বর্গের সম্পদের অধিকারী বা কোনো গুপ্ত বস্তু সম্বন্ধে জ্ঞাত (৬ : ৫০), কারণ কেবলমাত্র ঈশ্বরই সব গুপ্তবস্তুর চাবিকাঠি (৬ : ৫৯) এবং শুধু ঈশ্বরই অদৃশ্য বস্তু সম্বন্ধে অবগত। (২৭ : ৬৬)। অনেক রহস্যজনক বিষয় সম্বন্ধে তাকে জানানো হয়নি। তিনি জানেন না কখন সেই বিচারের সময় উপস্থিত হবে কারণ শুধু ঈশ্বরই তা জানেন (৭ : ১৮৬) অথবা আমার জানা নেই তোমাদের কী হবে বা আমার কী হবে (৪৬ : ৮)।

তিনি কখনো অলৌকিক কর্ম (মোজেজা) দেখাতে পারার দাবি করেননি। যারা তাঁর কাছে অস্বাভাবিক কিছু দেখানোর জন্য জেদ করেছিল, তাদের তিনি বলেছেন যে, অলৌকিক কিছু করার ক্ষমতা একমাত্র ঈশ্বরেরই আছে (২৯ : ৪৯)। একমাত্র কোরানই অলৌকিক, যা পাঠানো হয়েছে (২৯ : ৫০)। কোরান সেই অলৌকিককতার চিহ্ন যদি একটা পর্বতের ওপর পতিত হতো, তাহলে পর্বত ভেঙে খান খান হয়ে যেত (৫৯ : ২১)।

একটি পুরনো ট্র্যাডিশন অনুযায়ী, একবার মক্কাবাসীরা দাবি করল যে, আহাম্মদ তার ঐশী মিশন প্রমাণ করার জন্য পর্বতকে সরিয়ে আনবে। জবাবে তিনি বলেন যে একমাত্র ঈশ্বরেরই ক্ষমতা আছে তা করার, কারণ ইসরাইলদের আইন পুস্তক দেয়ার সময় তিনি সিনাই পবর্তকে উত্তোলন করেছিলেন (২ : ৬০); তবুও যদি অবতীর্ণ হয়ে পর্বতকে নড়াতে পারত তাহলেও কাজ হতো না (১৩ : ৩০)। তারপর সাফা পর্বতের দিকে ফিরে মোহাম্মদ আদেশ করলেন তার কাছে আসতে, যখন কোনো কাজ হলো না, তখন তিনি উচ্চারণ করলেন আল্লাহর দয়া, যদি পর্বত আসত তাহলে ভূমিকম্প হতো অথবা আমাদের ওপর পতিত হয়ে সব ধ্বংস করে দিত। আমি বরং পর্বতের কাছে গিয়ে আল্লাহর করুণার জন্য ধন্যবাদ দিয়ে আসি। যদিও মুসলিম মোল্লারা বলেন যে, তাঁর প্রথম ঐশীডাকের পর মোহাম্মদ নিষ্পাপ ছিলেন, কিন্তু কোরান ও হাদিস অন্য কাহিনী বলে, কেউ পাপ বা অপরাধমুক্ত নয় এবং যদি ঈশ্বর মানুষের প্রতি অপরাধের জন্য শাস্তি দিতেন তাহলে পৃথিবীতে কোনো প্রাণীই বেঁচে থাকত না (৩৫ : ৪৫)।

মোহাম্মদও নিষ্পাপ ছিলেন না, কারণ কোরান বলছে, ঈশ্বর তার পূর্বের ও পরবর্তীতে কৃত পাপগুলো ক্ষমা করে দিয়েছেন। (৪৮ : ২)। তার পূর্বের ও পরের পাপগুলো কি ধরনের ছিল, এ প্রশ্ন আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মনে করা হয় যে তাঁর পূর্বেকার পাপগুলো হতে পারে ওহি আগমনের পূর্বে পৌত্তলিকতার দায়ে পাপকর্ম এবং ওহি পাওয়ার পর তাঁর পাপকর্ম বন্ধ হয়েছিল বলে বিশ্বাস করা হয়। যেমন কোরান বলেছে, “তোমাকে কি আমরা ভুল করতে দেখিনি এবং তোমাকে গাইড করিনি?’ (৯৩ : ৭)। তবুও গাইড করার পরও মানুষ পাপ করেছে এবং পরের পাপগুলো হয়তো যে কোনো অপকর্ম, অজানা ও অলিখিত তিনি হয়তো করেছেন যার জন্য তিনি অপরাধ বোধ করেন।

মানুষ হিসাবে তাঁর ভুলের জন্য মোহাম্মদ অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। অসংখ্য হাদিসে তিনি তাঁর ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন বলে কথিত, “হে প্রভু, আমার অনুতাপ মঞ্জুর করো। আমার অপরাধ (হাওবাতি) ধুয়েমুছে দাও এবং আমার অন্তর থেকে কুমতলব দূর করে দাও। তাঁর অন্য একটি প্রার্থনায় তিনি বলেন : ‘তুমি আমার প্রভু, আমি তোমার দাস। আমি আমার পাপ স্বীকার করি। ‘পাপকর্মের সচেতনতা তাঁকে সব সময়ে তাড়িত করেছে এবং একটি হাদিসে তিনি বলেছেন— আমি ঈশ্বরের ক্ষমা প্রার্থনা করি দিনে সত্তর বার (Schimmel, 1985, P. 54)।

১১.১১ চরিত্রের পরিবর্তন

অনেক পণ্ডিত ব্যক্তি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন প্রফেটের দুটি বিপরীতমুখী ব্যক্তিত্বের দিকে। একটির প্রকাশ ঘটেছিল তার মক্কার জীবনে; অন্যটি আস্তে আস্তে প্রকাশিত হয়েছে যখন তিনি মক্কা থেকে মদিনায় সরে এলেন এবং সেখানে প্রাপ্ত রিভিলেশনের প্রকৃতির মধ্যে তা প্রমাণিত হয়েছে যার আলোচনা পূর্বে করা হয়েছে। যে সময়ের মধ্যে মদিনায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন, তখন প্রফেট মোহাম্মদ বাস্তব জগতের মানুষ। তাঁর চরিত্রের এই পরিবর্তন, কয়েকজন পণ্ডিতদের মতে, সেরকম ছিল না যেমন ছিল মক্কাতে। স্যার উইলিয়াম মুইর (মৃ. ১৯০৫) এ সম্বন্ধে একটি কড়া মন্তব্য করেছেন মোহাম্মদের জীবনচরিতে। তিনি বলেছেন— ‘The student of history will trace for himself how the pure and lofty aspirations of Mohammed were first tinged and then debased by half unconscious self-deception’.

এই চারিত্রিক পরিবর্তনের দুটি সম্ভাব্য কারণ দেখানো হয়েছে। প্রথমে, মদিনাতে তাঁর স্ত্রী খাদিজা ছিলেন না রাশ টেনে ধরতে এবং তাঁকে গাইড করতে। তিনি হিজরতের প্রায় দু’বছর পূর্বে মারা যান এবং তাঁর মৃত্যুর সাথে, স্প্রেংগার যেমন বলেছেন, Islam lost in purity and the Koran in dignity’ – অর্থাৎ ইসলাম পবিত্রতা খুইয়েছে, কোরান মর্যাদা। আরও বলা হয়েছে যে, মোহাম্মদের ওপর যে আসর হতো, যার কোনো চিকিৎসা হয়নি; ধীরে কিন্তু গতিশীলভাবে, তাঁর মানসিক অবস্থাকে বিপর্যস্ত করেছে যা ক্রমে ক্রমে চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল মদিনায় বাকি দশ বছরের জীবনে।

খাদিজার জীবদ্দশায় মোহাম্মদ মনোগামী ছিলেন- বলা যায় বাধ্য ছিলেন; কিন্তু খাদিজার মৃত্যুর পরপরই তিনি বহুগামী হয়ে গেলেন, এমনকি বালিকা গমনেও তাঁর বাধেনি। মদিনা গমনের পর তাঁর শনৈ শনৈ নারী প্রবণতা আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। একই সময়ে তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষা আকাশ ছোঁয়া গতি লাভ করে। এখন তিনি জাগতিক সাফল্যের দিকে যত্নবান হয়ে রাজনীতিকভাবে সুযোগ-সন্ধানী হয়ে ওঠেন। তাঁর ব্যক্তিগত আচরণ ও ধর্মীয় শিক্ষার গুণগত মান হ্রাস পায় সমাজে, প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়ার সাথে।

মক্কাতে মোহাম্মদ ছিলেন অত্যাচারিত সংস্কারক, আর জাগতিক ক্ষমতা ছিল শূন্য, কিন্তু মদিনায় এসে তিনি হলেন রাজনীতিবিদ ও প্রশাসক, সেনাপতি এবং যুদ্ধবাজ, বিচারক এবং আইন প্রণয়নকারী, গোত্র শাসক এবং রাজকুমার, সার্বভৌম সম্রাট এবং জনগণের অধিকর্তা (Patriarch)। অপ্রতিদ্বন্দ্বী কর্তৃত্ব লাভ করে তিনি সম্পূর্ণরূপে একটি নতুন স্ট্যাটাস লাভ করলেন এবং ব্যক্তি, গোত্র এমনকি সম্পূর্ণ জাতির দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে গেলেন অর্থাৎ মানুষের জীবন ও মৃত্যুর ক্ষমতা তার হাতে এসে গেল। তার এই একচ্ছত্র ক্ষমতার যথেচ্ছ ব্যবহারের মুখে কারোর বাধা দেবার শক্তি থাকল না।

তিনি সহিষ্ণুতা থেকে ধর্মান্ধতায় সরে এলেন। একজন শান্তিবাহক যিনি তাঁর প্রতিপক্ষের প্রতি সদাচরণ করতেন, তিনি অসহিষ্ণু ও স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠলেন এবং প্রতিপক্ষের প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠেন। ইহুদি ও খ্রিস্টানরা তাঁর নবুয়তকে (Prophethood) অস্বীকার করার তিক্ততাকে পুনর্জীবিত করে তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। মক্কাবাসীদের দুরাচরণ তিনি ভুলতে পারেননি, তাই তিনি দলবল নিয়ে মক্কার ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের শান্তিপূর্ণ ক্যারাভান আক্রমণ করে সম্পদ ও পণ্যদ্রব্য লুটপাট করেন। যারা তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করেছিল বা উপহাস করেছিল তাদের বিরুদ্ধে গুপ্তঘাতক নিয়োগ করে হত্যা করার নির্দেশ দেন। তিনি বেশ কয়েকটি সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন এবং বিধর্মীদের গণহত্যার আদেশ দেন এবং ইসলাম প্রচারের জন্য যুদ্ধাভিযান প্রেরণ করেন।

মোহাম্মদ একবার বলেছিলেন যে “ঈশ্বর মানুষকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছেন যাতে তারা একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পারে (৪৯ : ১৩) এবং ঈশ্বরের কর্মের মধ্যে একটি হচ্ছে যে, তিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষের মধ্যে ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য (৩০ : ২১)। এখন, মদিনাতে আরবিকে আল্লাহ ও ফেরেশতাদের ভাষা বলে স্বীকৃতি দেয়া হলো। তখনই বলা হলো যে হাসরের দিনে পাপীদের মুখ কালো হয়ে যাবে এবং বিশ্বাসীদের মুখ ধবধবে সাদা হবে (৩: ১০২)। তখন থেকেই আরবরা জাতি হিসাবে অন্য জাতির চেয়ে উৎকৃষ্ট ও শ্রেষ্ঠ জাতি বলে চিহ্নিত হলো (৩ : ১০৬)।

মোহাম্মদের জীবনের শেষের দিকে তাঁর কিছু আগ্রহশীল (zealous) অনুসারী তাঁকে অতি-মানব হিসাবে প্রায় দেবতার মর্যাদায় ভূষিত করল (Glubb, 1979, P. 268)। তাঁর সাথে জড়িত সব কিছুকেই ঈশ্বরের আশীর্বাদপ্রাপ্ত (বারাকা) বলে গণ্য হলো। কেউ কেউ তাঁর গুণগান করতে শুরু করল। ইবন ইসহাক লিখেছেন, যখন মোহাম্মদ থুথু ফেলতেন, তার সাহাবীরা ছুটে গিয়ে তা মুছে নিত এবং গায়ে মাখত (Andrae, 1960, P. 158)। তাঁর সান্নিধ্য পাওয়া কিছু মহিলা প্রফেটের গায়ের ঘাম মুছে নিয়ে পারফিউম হিসাবে ব্যবহার করত। আয়েশাকে বলা হয়েছিল যে, প্রফেট বাহ্য করলে পরিত্যক্ত মল (excrement) মাটি গিলে ফেলত বলে দেখা যেত না।

মোহাম্মদের ধারণা ছিল যে তিনি সকল প্রফেটের চেয়ে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন এবং তাঁর রিভিলেশন যে অসাধারণ এবং ঈশ্বরের বিশেষ অনুগ্রহপুষ্ট এই দাবি, তাঁর ইন্তেকালের পর তাঁর অনুসারীরা ব্যাপকভাবে প্রচার করে। অন্যান্য ধর্মের সাধু ও সৎব্যক্তিদের ক্ষেত্রে যেমন হয়েছে, তেমনি মোহাম্মদের সাথে জড়িত বস্তু ও স্থান তাঁর মৃত্যুর পর পবিত্রতা লাভ করে। যে সমস্ত স্থানে তিনি গিয়েছিলেন, সেসব স্থান মাজারে পরিণত হয়েছে এবং সেখানে প্রার্থনা করা হয়। যেসব পাথর ও বালুতে তাঁর পদস্পর্শ হয়েছে সেসব সংগ্রহ করে জাদুটোনা করা হয়। তাঁর স্মারক বস্তুগুলো (relics)কে সংরক্ষিত করা হয়েছে, তাঁর স্যান্ডেল, গায়ের জামা, দাড়ি ও চুলের গুচ্ছ, দাঁত ও নখ এগুলোও সংরক্ষিত।

মোহাম্মদের শারীরিক কাঠামো এবং অবয়ব বিস্তৃতভাবে বর্ণিত হয়েছে হাদিসে ও পারস্যে, তুরস্কে এবং সিরিয়ার কিছু অঞ্চলে, মিসরে, উত্তর আফ্রিকায়। এসব দেশে প্রফেটের মুখের পেন্টিংও চিত্রিত পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়। তার মুখমণ্ডল শ্মশ্রুমণ্ডিত, তীক্ষ্ণ এক জোড়া চোখ, পাগড়ি ঘেরা মস্তক তার চারদিকে সূর্যচ্ছটা (Halo)। কিন্তু এই চিত্ররেখা কুচিৎ পাওয়া যায়। কারণ পশু ও মানুষের মূর্তিগড়া নিষিদ্ধ, বিশেষ করে প্রফেটের প্রতিকৃতি অঙ্কন তাঁর মতো পবিত্র ব্যক্তির জন্য অসম্মানজনক (Sacrilegious)। সাধারণত প্রফেটের প্রতিচ্ছবি অঙ্কিত হয়ে তাঁকে দেখানো হয় ঘোমটাবৃত বা তাঁর মুখটা ফাঁকা রেখে। এটা মনে করা হয় যে, কোনো ছবি সম্ভবত তাঁর মুখের সৌন্দর্য দেখাতে পারে না। তাছাড়া যে কোনো প্রতিকৃতিতে তাঁর ব্যক্তিত্ব ও ক্ষমতার প্রতিফলন সম্ভবপর নয়।

মোহাম্মদের নাম অতি শ্রদ্ধা ও ভক্তির সাথে স্মরণ করা হয়। তাঁর নামের পর ‘সাল্লাল্লাহি আল্লাহিস সাল্লাম’ বা সংক্ষেপে ‘সাঃ’ ছাড়া উচ্চারণ করা বা লেখা ধর্মীয়ভাবে নিষিদ্ধ (toboo)। অন্যান্য প্রফেটদের নাম ফরমুলা ছাড়া উচ্চারণ করা যায়, যদিও সময় সময় ছোট ফর্মুলা, ‘আলাহিস সাল্লাম’ বা (আঃ) ব্যবহার করা যায়।

মোহাম্মদের ব্যক্তিত্ব ক্ষুণ্ণ হয় এমন কোনো শব্দ উচ্চারণ করা যাবে না। সম্মান না প্রদর্শন করে তাঁর সম্বন্ধে কিছু বলা অপরাধ বলে গণ্য। তাঁর সমালোচনা করা বা সম্মানহানি করা ঈশ্বর অবমাননার চেয়েও গুরুতর অপরাধ। ভারতীয় কবি মোহাম্মদ ইকবাল (মৃ. ১৯৩৮) বলেছেন- তুমি ঈশ্বরকে অস্বীকার করতে পার, কিন্তু মোহাম্মদকে অস্বীকার করতে পার না। মুসলিম বিশ্বের কিছু অংশে বিশেষ করে ভারত উপমহাদেশে ঈশ্বরের সমালোচনা বা তাঁর প্রতি কটুকাটব্যে কেউ প্রতিবাদ করবে না, কিন্তু মোহাম্মদের সমালোচনা করতে গেলে তার জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা আছে।

১১.১২ সিল অব দ্য প্রফেট

মক্কার প্রচারক ও সাবধানকারী মদিনায় হলেন ধর্মীয় নেতা ও স্বর্গীয় কথক। সেখানে তিনি নিজের কথা এবং প্রফেটের কথা আর অন্য জাতির ধর্মপুস্তকের মাঝে কোনো পার্থক্য রাখলেন না, তিনি এখন আগের সব রিভিলেশনস ও ঐশী বাণীগুলোকে অসম্পূর্ণ ও ভুল বলে দাবি তুললেন এবং তার মাধ্যমে প্রেরিত ইসলাম একমাত্র পরিপূর্ণ ধর্ম এবং প্রত্যেক ধর্মের ওপর জয়যুক্ত করেছেন (৪৮ : ২৮)।

মোহাম্মদ তাঁর আগের সকল প্রফেটগণ কেবলমাত্র তাঁর অগ্রদূত। পূর্বে যেসব প্রফেটের কাছে ঐশীবাণী এসেছিল তাঁদের চেয়ে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বশেষ। তিনি প্রফেটদের মোহর স্বরূপ। তার সাথেই প্রফেট আগমনের ধারা বন্ধ হয়ে গেছে, প্রফেসির দরজাও বন্ধ হয়ে গেছে এবং প্রফেসির জিহ্বা স্তব্ধ হয়ে গেছে।

মক্কার সূরাগুলোতে আল্লাহই সর্বশক্তিমান, তিনি ছাড়া অন্য কেউ নেই। একমাত্র তাঁকেই মান্য করতে হবে। অন্য দিকে মদিনার সূরাগুলোতে জোর দিয়ে বলা হয়েছে মোহাম্মদ হচ্ছেন নতুন সম্প্রদায়ের নেতা এবং নতুন ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা। সংবাদবাহক মোহাম্মদ যে সংবাদ তিনি গ্রহণ করার জন্য ঈশ্বর কর্তৃক নির্বাচিত হয়েছিলেন, সেই ঐশীবাণীর মতোই তিনি গুরুত্বপ্রাপ্ত হলেন এবং যে আল্লাহর কাছ থেকে সংবাদ আসত প্রায় সেই আল্লাহর মতো হয়ে গেলেন। মোহরে এবং তাবিজে আল্লাহর নামের সাথে মোহাম্মদেরও নাম জুড়ে যুগলবন্দি হয়ে গেল।

আল্লাহর নামের সাথে মোহাম্মদের নাম একদমে উচ্চারিত হতে শুরু করল এবং আল্লাহর সাথে তাঁর প্রফেটের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা কর্তব্য হয়ে গেল। একটি হাদিসে মোহাম্মদ বলেছেন- ‘যে আমাকে বিশ্বাস করে না, সে আল্লাহকেও বিশ্বাস করে না’ (Kazi and Flynn, 1984, P. 123)। এখন যেহেতু মোহাম্মদ আল্লাহর কর্তৃত্বপ্রাপ্ত সুতরাং আনুগত্য তাঁরই প্রাপ্য। যেমন, কোরান বলেছে- ‘যে প্রফেটকে মান্য করে, সে আল্লাহকেও মান্য করে’ (৪ : ৮২)।

কোরানের একটি সূরার আয়াতে আছে— ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো ঈশ্বর নেই’ (There is no God but Allah) – 8৭ : ২১। এই সবল ও দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা ইসলামের নির্যাস

(essence) কোরানের চূড়ান্ত সূরার মধ্যে দেখা যায়— ‘মোহাম্মদ আল্লাহর রসূল (Apostle) (৪৮ : ২৯)। এই দুই পৃথক আয়াত, যা কোরানের কোথাও একত্রে নেই, একসঙ্গে জুড়ে দিয়ে মুসলিমদের কলেমা তৈরি করা হয়েছে- যা উচ্চারিত না করলে মুসলিম হওয়া যায় না। এই ফর্মুলাকে কলেমা শাহাদাত বলা হয় এবং একজন মুসলিমকে সারা জীবন ধরে বাধ্যতামূলকভাবে এই কলেমা পড়তে হয়। এই কলেমা ইসলাম ধর্মের পাঁচটি মৌলিক নীতির একটি। এই কলেমা এখন পড়তে দরকার হয় এই সত্যতাকে প্রতিষ্ঠা করতে, যে এক আল্লাহ এবং মোহাম্মদ তাঁর প্রেরিত পুরুষ এবং একমাত্র আরবিট্রেটর ইহজগত ও পরজগতের সব কিছুর জন্য।

মোহাম্মদের চিরশত্রু আবু সুফিয়ান এই কলেমার দ্বিতীয় অংশটুকু অগ্রাহ্য করেছিলেন। তিনি এই অংশ কোনো দিন উচ্চারণ করেন, কিন্তু মোহাম্মদের মক্কা বিজয়ের পর অনিচ্ছা সত্ত্বে বাধ্য হয়ে করেছিলেন। অনেক রহস্যবাদী আছেন যারা কলেমার প্রথম অংশটি পাঠ করেন। দ্বিতীয় অংশটি বাদ দিয়ে থাকেন।

আজান দেয়ার ব্যাপারে অনুরূপ ঘটনা ঘটেছে। প্রথমে এটা শুধুমাত্র মৌখিকভাবে চিৎকার করে ডাক দিয়ে যাওয়া হতো— গণপ্রার্থনায় এসো। আল্লাহ মহান। আল্লাহ ছাড়া কোনো ঈশ্বর নেই। তারপর একজন আগ্রহশীল (zealous) অনুসারী স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে মোহাম্মদের নাম আল্লাহর সাথে জুড়ে দেয়ার প্রস্তাব দিলে মোহাম্মদ নিজের নাম জুড়ে দিতে অনুমোদন দেন। তারপর ‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পরে ‘মোহাম্মদুর রাসূল্লাহ’ জুড়ে ফর্মুলা তৈরি করা হয়।

মুসলিমগণ যারা আজানের সাথে আল্লাহর নামের পরে মোহাম্মদের নাম জুড়ে দেয়ার জন্য আপত্তি তোলেন, তারা এ নাম জোড়ার জন্য অনুমোদন দেননি (Schimmel, 1975, P. 214)। তাঁরা মনে করেছিলেন এটা ইসলামের স্পিরিটের পরিপন্থী এবং এক ধরনের শিরকের অপরাধ যা মোহাম্মদ নিজেই প্রায়ই নিরুৎসাহিত করতেন।

১১.১৩ মোহাম্মদের পাপহীনতা

মোহাম্মদের ধর্মীয় পদ্ধতির (Cult) উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ছিল যে একদল অতি উৎসাহী মুসলিমদের ধারণা জন্মেছিল যে মোহাম্মদের আচরণ ত্রুটিহীন এবং সাধারণ মানুষের মনে যে অশুভ ইচ্ছা থাকে এবং নৈতিক অবক্ষয় ঘটে, মোহাম্মদ সেসব ত্রুটি থেকে মুক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন অভ্রান্ত এবং পাপহীন (ইমা)।

কথিত আছে যে, মোহাম্মদ যখন শিশু ছিলেন তখন জিব্রাইল তাঁর ঘুমন্ত অবস্থায় দেহ থেকে অন্তঃকরণ বের করে, আদমের আদি পাপের কারণে মানুষের অন্তরে যে আদি পাপের কালো রক্ত জমা থাকে তা নিংড়ে বের করে দেন। তারপর সেই অন্তঃকরণ (হার্ট) আবার যথাস্থানে লাগিয়ে দেন।

পরে মোহাম্মদকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন যে, তিনি যখন শিশু ছিলেন তখন দু’জন সাদা পোশাকধারী তাঁর সম্মুখে হাজির হয় তারপর মাটিতে ফেলে তাঁর বুক ও পেট চিরে ফেলে গলা থেকে নাভি পর্যন্ত; তারপর তাঁর হৃদযন্ত্র (হার্ট) বের করে ভালো করে ধুয়ে আবার যথাস্থানে লাগিয়ে দেয়। অন্য একটি বর্ণনায় বলা হয়েছে যে, যখন তিনি চার বছরের শিশু তখন হাঁটতে গিয়ে মাটিতে পড়ে যান। আর একটি ভার্সানে আছে এই সিনাচাকের ব্যাপারটি ঘটে যখন তিনি বয়স্ক মানুষ এবং কাবাতে প্রার্থনারত ছিলেন।

কিছু মোল্লা শ্রেণীর ব্যক্তি এই ঘটনার সূত্র কোরানে খুঁজে পেয়েছেন- ‘আমরা কি তোমার অন্তঃকরণ উন্মুক্ত করি নাই এবং তোমার ভারমুক্ত করি নাই’ (৯৪ : ১)। ‘তোমার ভার’ এই শব্দের অর্থ- অর্থাৎ ‘উইজকারা’-র অর্থ অনেক পণ্ডিত মিলে করেছেন ‘তোমার পাপ’ বলে, সিনাচাক করে হৃৎপিণ্ড পরিষ্কার নয় (Birkeland, 1956, P. 41) ।

মোহাম্মদের জীবদ্দশায় তাঁর পাপহীনতাকে সম্ভবত পুরোপুরি রূপ দেয়া যায়নি, কারণ মক্কাবাসীরা এবং তাঁর বেশির ভাগ অনুসারীরা এই ধারণাকে উপহাস ও বিদ্রূপ করেছে; কিন্তু এখন এই ধারণা বলতে গেলে সর্বজনীন, কিছু যুক্তবাদী মুসলিম ছাড়া।

১১.১৪ মোহাম্মদের মোজেজা (মিরাকল)

মোহাম্মদ তাঁর জীবনের বাইশ বছর ধরে স্বর্গীয়ভাবে ফেরেশতা ও দেবদূত সান্নিধ্য লাভ করেছেন, তাই তাঁর অনুসারীরা তাঁকে অলৌকিক কর্মকাণ্ডের আধার বলে মনে করত। তাঁর বংশধরদের মধ্যে কথিত আছে, কয়েক জনের দেহে এমন বিশিষ্ট চিহ্ন ছিল যাতে এই নির্দেশ করত যে তাঁদের বংশে একজন মহান প্রফেটের আগমন হবে। বলা হয়, তাঁর মাতা আমিনার কাছে দেবদূত এসে বলেছিল— ‘আমিনা, তুমি তোমার গর্ভে আরব জাতির এক প্রভুকে বহন করছ।’ আমিনা প্রফেটকে জন্ম দেবার সময় কোনো ব্যথা অনুভব করেননি এবং তার শিশুর জন্ম থেকেই খাৎনা করা ছিল।

তিনি তাঁর পিঠে একটি ‘মোহর’ চিহ্ন বহন করতেন যা দেখে সাধু বাহিরা তাকে প্রফেটদের মধ্যে বিশিষ্ট মর্যাদা দিয়েছিলেন। যখন হেরা পর্বতে প্রথম ওহি আসার সময় হলো, পবর্ত, পাথর, বৃক্ষ ইত্যাদি তাঁকে আল্লাহর রসূল বলে অভিনন্দন জানায় এবং একটি ষাঁড় ও গাধা তাঁর মহান গন্তব্য সম্বন্ধে সাক্ষ্য দেয় মানুষের মতো কথা বলে। তিনি দেবদূতের সাথে কথাবার্তা বলেন এবং কোরানে আছে যে তিনি কিছু জিনকে ধর্মান্তরিত করেন (৭২ : ১)।

হিজরতের কিছু পূর্বে তিনি অলৌকিকভাবে মক্কা থেকে জেরুজালেমে যান এবং ফিরে আসেন। বদরের যুদ্ধে স্বর্গ থেকে তিন হাজার ফেরেশতা পাঠানো হয়েছিল তাঁকে সাহায্য করার জন্য। তিনি একটুকরো মাংস ও কয়েকটি বার্লি রুটি দিয়ে অসংখ্য মানুষকে খাইয়েছিলেন। তিনি অলৌকিকভাবে রোগীদের আরোগ্য করে দিতেন এবং ভূতে পাওয়া একটি বালককে সুস্থ করেন। যিশুর যেসব মোজেজার কথা গসপেলে এবং অস্বীকৃত কিতাবে উল্লেখ আছে তার অনেক কিছুই তিনি নিজে দেখিয়েছেন এবং সেসব ঘটনার কথা হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে।

যিশু পানির উপর দিয়ে হেঁটেছেন এবং তাঁর শিষ্যদের বলেছেন যে বিশ্বাস থাকলে তারাও পর্বতকে টলাতে পারে (মথি, ১৭ : ২০)। মোহাম্মদও তাঁর শিষ্যদের বলেছেন, ‘যদি জানার মতো আল্লাহকে জানতে পার তাহলে তোমরা সাগরের উপর দিয়ে হেঁটে যেতে পার এবং তোমাদের আদেশে পর্বতও নড়ে যেতে পারে।’ এই বক্তব্য থেকে অনুমান করা হয়েছে যে মোহাম্মদ নিজেও এই সব গুহ্য শক্তির অধিকারী ছিলেন। যদিও একটি ঘটনায় দেখা গেছে যে মোহাম্মদ সামা পর্বতকে নড়াতে পারেননি যখন তাঁকে তা করে দেখাতে বলা হয়েছিল, তবুও বিশ্বাস করা হয় যে তিনি সে ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন।

অন্য একটি হাদিসের মতে, যখন অবিশ্বাসীরা তাঁকে মোজেজা দেখাতে বলল, তিনি চাঁদকে দ্বিখণ্ডিত করেন অঙ্গুলী হেলনের দ্বারা এবং পরে আবার খণ্ডিত চন্দ্রকে জুড়ে দেন। এই কাহিনীকে কোরানে দেখানো হয়েছে একটি আয়াতে— ‘চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত হইল’ (৫৪ : ১)। তারপরে বলা হয়েছে যেন সত্যায়িত করা হচ্ছে- যখন মানুষে মোজেজা দেখে তারা বলে – “এ তো চিরাচরিত জাদু’।

১১.১৫ অবতার মোহাম্মদ

প্রফেট মোহাম্মদ অতিমানব ছিলেন, তাঁর কোনো মানবীয় দোষ-ত্রুটি ছিল না। অভ্রান্ত ও ঈশ্বরের অবতার ছিলেন- এই সব ধারণা ও রহস্যবাদ প্রচারিত করেছে তাঁর অনুসারীরা প্রফেটের মৃত্যুর কিছুদিন পরে। একবার এই রহস্যবাদ শুরু হলে আর থেমে থাকেনি, উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে।

এই মতবাদ উন্নয়নে খ্রিস্টবাদের প্রভাব অনস্বীকার্য। ধর্মবেত্তা ইবন তাই মিয়া (মৃ. ১৩২৮) মুসলিম পণ্ডিতদের একজন, যিনি স্বীকার করেছেন যে জনপ্রিয় মুসলিম রহস্যবাদিতার অনেক সূত্রই খ্রিস্টান প্রথা ও চিন্তাধারায় প্রভাবিত। প্রফেটের চিত্র চিত্রণের ধারণায় উদ্দেশ্য ছিল যে- ‘সে ছবি যেন যিশুর ছবির চেয়ে কোনো অংশে অসুন্দর না হয়’ (Golziher, 1971 P. 346)।

খ্রিস্টানিটিতে যিশুর যে ব্যক্তিত্বের প্রভাব, মোহাম্মদবাদে (Mohammadanism) প্রফেট মোহাম্মদ-এর ব্যক্তিত্ব তেমনি কেন্দ্রীভূত। যিশুর মতোই প্রফেট ক্রমে ক্রমে জ্ঞানের মহিমায় সমুন্নত (cf I Cor। : 24); সব জান্তা, পাপহীন ও খাঁটি (১ জন ৩ : ৩); অলৌকিক কর্মে দক্ষ, অতিমানব, ঈশ্বরের সাথে বিশেষভাবে সম্পর্কযুক্ত এবং সর্বশেষে সর্বশক্তিমানের মতো ব্রহ্মাণ্ডের অতীত (Transcendent)। প্রফেসর কামরুদ্দিন খানের মতে জনপ্রিয় ইসলামিক চিন্তাধারায় গভীর প্রবণতা রয়েছে যে প্রফেটকে ঈশ্বরের অবতাররূপে চিহ্নিত করা, যাতে তাঁর ওপর যিশুর চেয়ে অধিক স্বর্গীয় সত্তারোপ করা যায় (Schimmel, 1985, P. 311), প্রফেসর স্বয়ং এই প্রবণতার পরিতাপ (deplore) করেছেন।

এই ধরনের ইসলামিক ধারণাকে অন্যান্য পণ্ডিত ব্যক্তিদের দ্বারা বাতিল হয়েছে এবং তারা জোরেশোরে এই ঈশ্বরদ্রোহী অধর্মের প্রতিবাদ করেছেন।

অ্যানমেরি শিমেল (Annemarie Schimmel) তাঁর পাণ্ডিত্যপূর্ণ কর্মে ইসলামী তাকওয়ার বিবর্তন সম্বন্ধে অনেক তথ্যের অবতারণা করেছেন। এই তথ্যগুলো তিনি সংগ্রহ করেছেন ইসলামী বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার মূল উৎস থেকে যেসব উৎসের রচয়িতা হলেন ধর্মবেত্তা, রহস্যবাদী ব্যক্তি, দার্শনিক ও কবি। যদিও প্রফেট মোহাম্মদের সঠিক জন্মতারিখ জানা যায়নি, তবুও একটা তারিখ করে, একাদশ শতাব্দি থেকে তাঁর জন্মদিন (মৌলুদ) পালন করা শুরু হয়েছে; সময় সময় সঙ্গীত, নৃত্য, ব্যানারসহ মোমবাতি জ্বালিয়ে শোভাযাত্রা করে। ১৭১৪ খ্রিস্টাব্দে ওসমানী সাম্রাজ্য থেকে আদেশ জারি করে কাবাঘরেও প্রফেটের জন্মদিন পালন করার নির্দেশ দেয়া হয়।

খ্রিস্টান ক্যারল (গান) অনুযায়ী কবিতা রচনা করে প্রফেটের সম্মানে গুণগান (না’ত) করা হয়, যেমন যিশুর উদ্দেশ্যে প্রার্থনা-গীত (hymn) গাওয়া হয়। অধুনা কিছু কিছু মুসলিম এই উৎসবকে খ্রিস্টানদের যিশু বন্দনার অনুকরণ বলে মনে করেন (Schimmel, 1985, P. 146)। কোরান বলে ঈশ্বর যিশুকে মানব জাতির দয়ার প্রতীক রূপে প্রেরণ করেছেন (১৯ : ২১)। তেমনি আল্লাহ জগতের সকল প্রাণীদের দয়ার প্রতীকরূপে পাঠিয়েছেন (২১ : ১০৭); ঈশ্বর দয়াময় এবং প্রফেট রহমান নামের মূর্ত প্ৰকাশ।

রহস্যবাদীরা মোহাম্মদ নামের মধ্যে যেসব গুপ্ত অর্থ নিহিত ছিল তার উদ্ঘাটন করেছেন। এই জন্য প্রফেটকে ‘আহমদ’ নামে উল্লেখ করা হয়েছে অর্থাৎ ‘প্রশংসিত’ (৬১ : ৬) এবং এক হাদিস অনুযায়ী, প্রফেট যেন বলেছেন, “আমি আহমদ তবে ‘ম’ অক্ষর বাদে।” অতএব তিনি আদ’ অর্থাৎ ‘এক’। আর এই ‘এক’ ঈশ্বরের টাইটেল। আবার ‘ম’ অক্ষর যেহেতু ‘মরণ’-এর প্রথম অক্ষর (মউত), এই ‘ম’ অক্ষর বাদ দিলে তিনি অমরত্ব লাভ করছেন- অর্থাৎ তিনি মরণশীল নন। প্রফেট আরও ঘোষণা দেন যে, “আমি একজন ‘আরব’, তবে ‘আ’ বাদে। সুতরাং তিনি ‘রব’ অর্থাৎ তিনিই ‘প্রভু’ যা ঈশ্বরের এক নাম। সুতরাং দেখা যাচ্ছে রহস্যবাদীরা মোহাম্মদের ওপর ঈশ্বরত্ব আরোপ করে, ঈশ্বরের ৯৯ নামের মধ্যে কিছু নাম তাঁকে দিয়ে ঈশ্বরের সমপর্যায়ভুক্ত করা হয়েছে। (Danner, 1988, P. 248)। বলা হয় যে, মরণশীল প্রাণী ঈশ্বরের নৈকট্য লাভ করতে পারে না। কিন্তু মোহাম্মদ ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করতে পারেন। একমাত্র তাঁর মাধ্যমে ঐশ্বরিক জ্ঞান ও স্বর্গীয় দয়া লাভ করা যায়। মোহাম্মদের মধ্যে স্বর্গীয় শক্তি সংযুক্ত এবং তাঁর মাধ্যমে স্বর্গীয় বিধান প্রকাশ পায়। কোনো পণ্ডিত বা পুরোহিত, ধর্মবেত্তা বা সাধু প্রফেটের সাহায্য ছাড়া কিছু করতে পারেন না।

মোহাম্মদের উপস্থিতিতে মুসার সামনে আগুন জ্বলেছে; তাঁর নাম নিয়ে সলেমন জ্বিন বশ করতেন, তার ওষ্ঠদ্বয় যিশুকে মৃত ব্যক্তি বাঁচাতে শিখিয়েছে। ‘সত্যিই’ (আরবি : ইন্না নিশ্চয়ই) কোরান বলছে, “আল্লাহ ও ফেরেশতারা প্রফেটকে আশীর্বাদ করে (৩৩ : ৫৬) মোহাম্মদ আল্লাহর প্রিয়জন। মানুষে আল্লাহর নামে শপথ নেয়, কিন্তু আল্লাহ নিজেই প্রফেটের নামে শপথ নেন- যেমন আল্লাহ যখন বলেন- লাউমরিক অর্থাৎ ‘তোমার জীবনের শপথ’ (১৫ : ৭২)।

মোহাম্মদকে স্বর্গরাজ্যে প্রবেশ করার জন্য খোলা অনুমতি দেয়া হয়েছে এবং আত্মাদের স্বর্গে প্রবেশ করানোর ক্ষমতা তাঁর হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। বাইবেলে যিশু বলেছেন তাঁর শিষ্যদের কাছে- ‘আমি তোমাদের স্বর্গরাজ্যে প্রবেশ করার চাবি দেব’ (মথি ১৬ : ১৯)। কোরান বলছে- স্বর্গ ও মর্ত্যের চাবি আল্লাহর হাতে (৩৯ : ৬৩), এবং এই সব চাবি, রহস্যবাদীরা বলেন- ‘মোহাম্মদের কাছে অর্পিত হয়েছে। কোরানে চাবির জন্য সিরিয়াক শব্দ ‘মিকালিদ’ ব্যবহার করা হয়েছে, যা গ্রিক শব্দ ‘ক্লেইস’ (kleis) থেকে আগত; ঐ একই শব্দ বাইবেলে ব্যবহৃত হয়েছে (Jefery 1938, P. 269)।

প্রফেটের নিত্যতা-তত্ত্বও (doctrine of eternality) তাঁর ধর্মীয়তত্ত্বের অংশ বিশেষ। বলা হয় যে, মোহাম্মদ তাঁর জন্মের পূর্বেও বিরাজ করতেন (Beth mann, 1953, P. 40)। একটি ট্র্যাডিশন অনুযায়ী, মোহাম্মদ বলেছেন- “আদম যখন কাদার মূর্তিতে ছিলেন, তখন আমার অস্তিত্ব ছিল।’ মিসরীয় কবি ও মিসটিক ইবন আল- ফরিদ (মৃ. ১২৩৫) লিখেছেন যে, মোহাম্মদ ছিলেন ঈশ্বরের প্রথম প্রকাশ (First Epiphany (manifestation) of the Godhead. (Arberry, 1964, P. 63)। মোহাম্মদের মাধ্যমে ঈশ্বর তাঁর অনন্ত শূন্যতার মধ্য থেকে প্রপঞ্চে বের হয়ে এসেছেন।

কোনো কোনো গোষ্ঠীর (Sect) মধ্যে এই ধারণা জন্মেছে যে স্বর্গীয়ভাবে অবতীর্ণ হয়ে (হুলুল) আল্লাহ মোহাম্মদের রূপ ধরেছেন এবং তাঁর মাধ্যমে কথা বলেছেন, কাজও করেছেন। মোহাম্মদের প্রাক-অস্তিত্বের আকার ঐশী শব্দে (কালাম) মিশে মাংসের আকার ধারণ করেছে এবং ইসলামী রহস্যবাদীদের শিক্ষার তাৎপর্য গসপেলের ‘লোগোস’-এর মতো (জন. ১ : ১৪) অর্থাৎ সেই বাক্যই (কালাম = Loges) মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করলেন এবং আমাদের মধ্যে বাস করলেন। ঈশ্বরের যে মহিমা, সেই মহিমা আমরা দেখেছি।

সর্বশক্তিমানের হাকিকা (বাস্তবতা), আল (যুক্তি) এবং রুহ (আত্মা) মোহাম্মদের মধ্যে বাস্তব রূপ গ্রহণ করেছে। এই স্বর্গীয় ত্রি-গুণ সত্তা একটি আদর্শ ব্যক্তির মধ্যে সমন্বিত হয়ে অবতাররূপে প্রকাশিত হয়েছেন, প্রাচীন হেলেনিস্টিক ধারণায় যাকে পারফেক্ট ম্যান (ইনসান-ই-কামিল) বলা হয়। তিনিই আদিম মানব মোহাম্মদ, সুন্দর সজ্জায় সজ্জিত (জামাল), রাজকীয় (জালাল) এবং পরিপূর্ণ (কামাল) – যার মধ্য দিয়ে আল্লাহর নূর প্রকাশিত।

যিশু বলেছেন— ‘আমি পৃথিবীর আলো’ (জন, ৮ : ১২)। কোরানের সূরা নূর- এর আয়াত ২৪ : ৩৫- “আল্লাহর জ্যোতির উপমা যেন একটি দীপাধার যার মধ্যে আছে এক প্রদীপ…” – এর ব্যাখ্যায় মিসটিক্ (রহস্যবাদীরা) বলেন যে, উল্লিখিত প্রদীপ হচ্ছে মোহাম্মদের জ্যোতি (নূর-ই-মোহাম্মদী)। মোহাম্মদ বলেছেন – “আল্লাহ যে প্রথম আলো সৃষ্টি করেন তা আমার জ্যোতি (Rodinson, 1976, P. 304) এবং সেই জ্যোতি থেকেই অন্য সব বস্তু এসেছে।” লোগোস সম্বন্ধে বাইবেলে বলা হয়েছে- যে সব বস্তুই সৃষ্টি করা হয়েছে তিনি ছাড়া তা সম্ভব হতো না (জন, ১ : ৩); তাই, মোহাম্মদ সম্বন্ধেও বলা হয়েছে যে, তাঁর জন্যই এবং তাঁর মাধ্যমেই এই পৃথিবীর সৃষ্টি। একটি হাদিসে আল্লাহ মোহাম্মদকে বলেছেন- ‘যদি তুমি না হতে (লাওলাকা), আমি এই পৃথিবী সৃষ্টি করতাম না (Schimmel, 1985, P. 131)।

মোহাম্মদের জ্যোতির মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসেছে সবই যা কিছু উপরে আছে এবং যা কিছু নিচে। অর্থাৎ স্বর্গ, ফেরেশতা, পদার্থ, পৃথিবী, মানবজাতি, জ্বিন এবং সমস্ত প্রাণী ও বৃক্ষলতাদি। এই নির্গমনের (emanation) ধারণা (ফায়েজ) এসেছে অজ্ঞেয়বাদ এবং নিও-প্ল্যাটোনিজম থেকে। একজন মুসলিম কবি লিখেছেন যদি ঈশ্বরের কাছে পৌছতে চাও, মোহাম্মদকে ঈশ্বর বলে জানো। (Schimmel, 1985, P. 140) এবং মোহাম্মদ নিজেই বলেছেন এক হাদিসে “যে আমাকে দেখে, সে আল্লাহকে দেখে” (Hughes 1977, P. 613)। যদিও সুফি রহস্যবাদীদের লক্ষ্য স্বর্গীয় জ্যোতির সাথে মিশে যাওয়া, কিছু কিছু মিস্টিক সুফি বলেন যে, মিস্টিক্যাল অভিজ্ঞতার শেষ পর্যায় হচ্ছে নির্বাণ (ফানা) নিজের মধ্যে লয় প্রাপ্তি, ঈশ্বরের জ্যোতির মধ্যে নয়, কিন্তু মোহাম্মদের জ্যোতিতে। বাইবেল অনুযায়ী, যিশুখ্রিস্ট ঈশ্বরের সিংহাসনে বসে আমাদের জন্য সোপারেশ করবেন (রোমান ৮ : ৩৪)। কোরানে দেখা যায় যে মানব জাতির জন্য ফেরেশতারা সোপারেশ করবে। (৪২ : ৩)। কিন্তু রহস্যবাদীদের বিশ্বাস যে মোহাম্মদ আল্লাহর আসনের পাশে বসে থাকবেন কারণ ঈশ্বর নিজেই তাঁকে সেখানে বসিয়েছেন। (Hughes 1977, P. 188)। সেখানে বসে মোহাম্মদ পাপী ও বিশ্বাসীদের জন্য ওকালতি করবেন, যাতে তাদের শাস্তি মওকুফ হয়। মোহাম্মদের সোপারেশ (সাফায়াত) ছাড়া, মানুষ আল্লাহর দয়া বা ক্ষমাপ্রাপ্ত হবে না।

যিশু বলেছেন, ‘দেখ, আমি তোমাদের সাথে সর্বদাই রয়েছি এবং শেষ দিন পর্যন্ত থাকব (মথি ২৮ : ২০)। তাঁর মতোই মোহাম্মদ সব সময়েই উপস্থিত এবং লক্ষ্য করছেন (হাজির ওরা নাজির)। মোহাম্মদকে দেখা যায় কসমিক (মহাজাগতিক) শক্তিরূপে, যিনি ব্রহ্মাণ্ডের অতীত (Transcendant) এবং বিশ্বব্যাপী (Immanent)। ঈশ্বর মোহাম্মদকে অর্পণ করেছেন এই বিশেষ প্রতিনিধিত্ব করতে, তাঁর পক্ষে আদেশ দিতে। সংরক্ষণ করতে এবং শাসন করতে।

পৃথিবীর শুরু থেকেই মোহাম্মদের মিশন পূর্ব নির্দেশিত এবং শেষ সময় পর্যন্ত এই মিশন চলতে থাকবে। যিশু যেমন প্রথম ও শেষ (আলফা ও ওমেগা) Rev. 21 : 6; তেমনি মোহাম্মদও প্রথম ও শেষ (আওয়াল ও আখির)। তিনি যেমন পৃথিবী সৃষ্টির পূর্বে ছিলেন, তেমনি পৃথিবী লয় প্রাপ্তির পরও টিকে থাকবেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *