১৫। ইসলামের উভয় সঙ্কট

১৫. ইসলামের উভয়-সঙ্কট

শতাব্দির প্রথম দিকে ইসলাম ও পশ্চিমা যোগাযোগে এটাই প্রমাণিত হয়েছিল যে মুসলিমরা নিঃসন্দেহে পশ্চিমা দেশবাসীর চেয়ে অধিক উন্নত ছিল। তাদের বিস্ময়ের দিনগুলো এমন পর্যায়ে ছিল যে তারা সে সময়ের পৃথিবীর অর্ধেকের মালিক ছিল; তারা সব কিছুরই ঊর্ধ্বে ছিল, কি শিক্ষায়, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি ও চারুকলায় সকলের শ্রেষ্ঠ ছিল। অন্যান্য বিষয়েও মুসলিমদের সমতুল্য কেউ ছিল না। তারা ইউরোপের দক্ষিণ- পূর্ব দিকে বিশাল অংশের অধিপতি ছিল এবং পশ্চিমাদের শিক্ষা গুরু ছিল।

তখন পশ্চিমা লোকজন অনুন্নত ছিল, সভ্যতার আঁচ তখনো গায়ে লাগেনি, সামাজিক ব্যবহারে অনভ্যস্ত ছিল, আতিথেয়তার নিয়মকানুন সম্বন্ধে সম্পূর্ণরূপে অনভিজ্ঞ। পরিবার সম্বন্ধে, সন্তানদের সম্বন্ধে প্রায় উদাসীন, ধর্ম সম্বন্ধে অশ্রদ্ধা। পশ্চিমারা ছিল রুক্ষ, অভব্য, আচার ব্যবহারে অশিষ্ট। এক কথায় বলতে গেলে বলতে হয়- “They were among the most stupid, rude and brutish of the nation of mankind.”

কিন্তু ইয়োরোপিয়ান শিক্ষা নিতে বা শিখতে শুথ ছিল না এবং ঐ শতাব্দিগুলোর মধ্যে যখন ইসলাম গৌরবের উচ্চ শিখরে তখন তারা মাত্র শিক্ষা ও সভ্যতার স্বাদ পেতে শুরু করেছে।

১৫.১ ইউরোপীয় জাতি

প্রথমে ইউরোপীয় জাতি শুরু করে ব্যবসা। তাদের কোনো দিগ্বিজয়ের আকাঙ্ক্ষা ছিল না এবং খ্রিস্টানিটিতে ধর্মান্তরও আরম্ভ করেনি। মুসলিমদের সাথে তাদের প্রথম সংঘর্ষ হয় ক্রুসেডের সময় যখন পবিত্র ভূমি প্রবেশ নিয়ে গোলযোগ বাধে, যদিও বলা হয় যে ১১৮২ খ্রিস্টাব্দে ফ্র্যাঙ্কিশ নাইটের মধ্যে একজন রেনাল্ড অব শাটিলন একদল সৈন্য নিয়ে মদিনা আক্রমণ করতে যান। তিনি মদিনা বন্দর ইয়েনবো অবতরণ করে মদিনাভিমুখে যাত্রা করলে সালাহুদ্দিনের ভাইপো কর্তৃক বিতাড়িত হন।

ভূমধ্যসাগরের তীরে মুসলিম রাষ্ট্র উন্নতি লাভ করে যখন তাদের সেই অঞ্চলে কর্তৃত্ব ছিল। মরক্কো থেকে ত্রিপোলিটানিয়া (লিবিয়া) পর্যন্ত বার্বার উপকূল এবং মিসরের সুলতানরা বিদেশী জাহাজের পণ্যের ওপর অতিরিক্ত কর বসাত তার পর তাদের পণ্যদ্রব্য ঐ সব অঞ্চল থেকে ছাড় পেত।

পঞ্চদশ শতাব্দির শেষ থেকে ইউরোপিয়ান শক্তিগুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠল ১৪৯২ সালে স্পেন থেকে মুরদের বিতাড়ন করা হলো। এটা হলো জানুয়ারি মাসে। ঐ বছর অক্টোবর মাসে কলম্বাস নতুন পৃথিবী আবিষ্কার করলেন। এর সাথে একটা নতুন চ্যাপ্টার পশ্চিম দেশের ইতিহাসে শুরু হলো। ১৪৯৮ সালে ভাস্কোদা-গামা কেপ অব গুড হোপ হয়ে ভারতের রাস্তা আবিষ্কার করলেন- এই রূপে ভারতের ও দূর প্রাচ্যের সাথে বাণিজ্যে একটি বিকল্প রাস্তা বের হলো।

এখন ইউরোপিয়ানরা তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য পূর্বাঞ্চলীয় দেশের সাথে বর্ধিত করল এবং তাদের কর্তৃত্ব সেখানে ফলাতে শুরু করল—প্রায়ই জলদস্যুদের সহায়তায়। স্পেনের মতো পর্তুগিজরা জাহাজ তৈরি স্পেনের সাথে ব্যবসার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমে বাণিজ্য শুরু করল। তারা ভূমধ্যসাগরের জলদস্যুদের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে সময় সময় মিসরের শাসকদের কর দেয়া বন্ধ করল।

ষোড়শ শতাব্দির মধ্যে ইউরোপীয়রা পারস্য উপসাগরে ঢুকে পড়ল এবং মাস্কাট অধিকার করে হোরমুজের পাশে কয়েকটি দুর্গ গড়ে তুলল। এর সাথে লোহিত সাগরের তীরেও দুর্গ নির্মাণ করে তাদের ট্রেডিং স্থাপনা গার্ড দেয়া আরম্ভ করল। পরে তারা বাইরে শত্রুদের আক্রমণ প্রতিহত করতে সমর্থ হলো। ১৫১৫ খ্রিস্টাব্দে, পর্তুগিজ ভারতের ভাইসরয়, আলফেন্সো আলবুকার্ক পরিকল্পনা করলেন কিন্তু মক্কা আক্রমণ করতে সমর্থ হননি এবং ১৫১৭ সালে লোপো সোরেস ডি আলবারগারিয়া শুধু হুমকি দিলেন কিন্তু জেদ্দা আক্রমণ করলেন না।

কয়েক দশক পরে তুর্কিরা বল্কান ও পশ্চিম ইউরোপ দখল করে এগিয়ে যেতে অস্ট্রিয়ার ডন জন সুলতান দ্বিতীয় সেলিমের তুর্কি নৌবহর ধ্বংস করে দেন ১৫৭১ খ্রিস্টাব্দে লিওপান্টোর যুদ্ধে। পরে জন সোরেস্কি ভিয়েনার ফটকের কাছে তুর্কি সেনাদের পরাজিত করেন (১৬৮৩)। ছোটখাটো সংঘর্ষ ও বড় যুদ্ধ চলতে থাকল মুসলিম সৈন্য ও ইউরোপীয় সেনাদের মধ্যে এখানে-সেখানে, যাতে আস্তে আস্তে তুর্কি অঞ্চল হাতছাড়া হতে থাকে।

যখন নেপোলিয়ান বোনাপার্টে অটোম্যান মধ্যপ্রাচ্য আক্রমণ করে ১৭৯৮ সালে মিসর আক্রমণ করেন, তখন দেখেন যে ধর্মীয় প্রভাব শিক্ষা ব্যবস্থার অনেক ক্ষতি করে ফেলেছে। সেখানে উপযুক্ত আরবি ভাষা জানা লোক খুঁজে পেলেন না যার হাতে স্থানীয় শাসনভার দেয়া যায়। বাধ্য হয়ে তিনি তুর্ক, আলবেনিয়া ও অন্য বিদেশী দিয়ে তার পোস্টগুলো ফিল আপ করলেন। তিনি তাঁর সাথে বৈজ্ঞানিক, ইঞ্জিনিয়ার, আর্কোলজিস্ট ও স্কলার এবং আরবি টাইপের প্রিন্টিং মেশিনও আনেন- এতে প্রিন্টিং প্রেস দিয়ে তিনি ঘোষণাপত্র প্রকাশ করেন এবং কাজে লাগিয়ে দেন।

ইউরোপীয়রা আসার পর বাণিজ্যপথ এবং শিপিং লাইনের নিরাপত্তা বেড়ে যায়- বিশেষ করে ফরাসি আসার পর এবং বোম্বে উপকূলে জলদস্যুদের উৎপাত বন্ধ হওয়ার পর। তখন ১৮৩০ সাল। কিন্তু ফরাসি ইঞ্জিনিয়ার ফার্দিনান্দ ডি লেসেপস্ ১৮৬৯ সালে সুয়েজ খাল তৈরি করার পর ভূমধ্যসাগরের মুসলিম ভূমিগুলোর গুরুত্ব বেড়ে যায়।

তারপর থেকে পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় ইউরোপীয়দের বাণিজ্য তৎপরতা আরো বেড়ে যায় এবং বাণিজ্য কেন্দ্র থেকে এসব দেশে রাজ্য বিস্তারের স্বপ্ন দেখতেও আরম্ভ করে। মুসলিম সাম্রাজ্যে নৈতিক চরিত্রের অবনতি, প্রশাসনিক দুর্নীতি এবং সামরিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ইউরোপীয় ডিসিপ্লিন্ড সেনাদলের হয়ে আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত মুসলিম রাজ্যগুলো দখল করতে খুব বেগ পেতে হয়নি।

ঊনবিংশ শতাব্দির মাঝামাঝি, ব্রিটেন, ফরাসি, স্পেন, পর্তুগাল, হল্যান্ড ও রাশিয়া জয় করেছিল, কলোনি তৈরি করেছিল, দখল করেছিল, কর্তৃত্বে রেখেছিল (Put up protection) বা অন্যভাবে শাসন করেছে মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোকে। শুধু সৌদি আরব, তুরস্ক, ইরান ও আফগানিস্তান– এই গুটি কয়েক মুসলিম দেশ টিম টিম করে তাদের নিজস্ব শাসন কোনো প্রকারে বজায় রেখেছিল- কারণ এগুলো পশ্চিমা জাতির উদ্দেশ্যে ‘নিউট্রাল রাজার রাজ্য’ হিসাবে টিকে ছিল।

যখন ইসলামী বিশ্বে ইউরোপীয়দের ঢল নামল মনে হলো যেন মুসলিম জাতি পৃথিবীর ইতিহাসের অগ্রস্রোত থেকে সরে পিছনে স্থির হয়ে গেল। পৃথিবীর যেখানে যেখানে মুসলিম রাজ্য ছিল সব যেন নেতিয়ে পড়ল। জার্মান দার্শনিক জি.ডাব্লিউ.এফ. হেগেন (মৃ. ১৮৩১) এতদূর পর্যন্ত লিখেছেন যে, ইসলাম ইতিহাস থেকে অনেক আগেই হারিয়ে গেছে এবং প্রাচ্য দেশীয় আরামে বিশ্রাম নিচ্ছে। ক্ষমতার শীর্ষে থাকার সময় ইসলাম যা নেবার অন্যদের কাছ থেকে নিয়েছে এবং যখন আর কিছু পায়নি, তখন আর কিছু না পেরে এখন প্রায় পাঁচ শতাব্দিকাল ধরে ঘুমে ঘুমাচ্ছে। এর গৌরবের সময় এসেছিল আর চলে গেছে এবং মধ্যযুগ থেকে ইসলামের আর সাড়াশব্দ নেই।

ইসলাম ধর্ম তার আধ্যাত্মিক শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। কোরান বলছে, ইসলাম আল্লাহর মনোনীত ধর্ম (সিবগা)। এখন ইসলাম মনে হয় মানুষের বহিরাবরণ মাত্র; রুটিন বিষয়— নামাজ, রোজা, হজ, জাকাতে সীমাবদ্ধ, আর ‘ওয়াইন’ ও ‘সোয়াইন’ এই দুটো বস্তু হারাম।

বহির্জগতে মুসলিম যেন মরা জাতি, কেতাব বন্ধ করে বসে আছে। আর তাদের ইচ্ছা নেই বইটা খুলে পড়তে। অনেক দিন আগে থেকে তারা প্রফেটের শিক্ষা ভুলে গেছে। তিনি বলেছেন, জ্ঞান আহরণ করতে চীন পর্যন্ত যাও। ইসলামের বুদ্ধিমত্তায় খিঁচ (rigor mortis) ধরে গেছে। ফরাসি লেখক আর্নেস্ট রেনন বলেছেন- ওরিয়েন্ট ও আফ্রিকাতে ‘বিশ্বাসী’দের মস্তকে ‘লৌহবলয়’ লেগে গেছে, তাদের মস্তকে নতুন কোনো ধারণা বা আইডিয়া ঢুকছে না।

পশ্চিমের পর্যটক, প্রত্নতত্ত্ববিদ ইত্যাদি আরবের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিজেদের জীবন বিপন্ন করে চলে যাচ্ছে এবং তারা উদ্ধার করছে হারিয়ে যাওয়া সব প্রস্তরলিপি যা হাজার বছর ধরে ভুলে গেছে মানুষে। আর এই সব লিপি উদ্ধার করে প্রাক-ইসলামী যুগে অতীতের সাথে আরবের বর্তমান অবস্থা তুলনা করছে।

আরবি পুস্তক প্রথমে ইউরোপে ছাপা হয় এবং মুসলিম দেশগুলোতে বিলি করা হয়। তার মধ্য দিয়ে মানুষ জানতে পারছে, বিগত দিনগুলোতে আরব কত উন্নত ছিল। অর্ধ-বিস্মৃত আরবি ক্লাসিক, পুনআবির্ভাব হয়ে নতুনভাবে সম্পাদিত হচ্ছে ইউরোপিয়ান স্কলার দ্বারা এবং এই এডিশনে আরবের প্রাথমিক লেখাগুলো নতুন আলোপ্রাপ্ত হচ্ছে।…

মুসলিম স্কলার নতুন স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিড় জমাচ্ছে এবং আরব ইতিহাস ও সাহিত্য সম্বন্ধে পশ্চিমা স্কলার লিখিত পুস্তকগুলো অধ্যয়ন করছে কিংবা আরবি ভাষায় লিখিত অনুবাদ পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। যারা পারছে, তারা ইউরোপে যাচ্ছে উচ্চ শিক্ষার জন্য, ইঞ্জিনিয়ারিং ও প্রযুক্তি বিদ্যায় জ্ঞান লাভ করার জন্য। আরব লেখকগণ সংবাদপত্র ও সাময়িকী বের করে তাদের মতামত প্রকাশ করছে, সংবাদ সরবরাহ করছে এবং প্রাচীন বিশ্বাস ও প্র্যাকটিস সম্বন্ধে প্রশ্ন করছে মুক্ত চিন্তা নিয়ে।

দখলকৃত ভূমিতে ইউরোপীয় শক্তি সরকারি প্রশাসনে ওয়েস্টার্ন প্রথায় নতুন পরিবর্তন আনছে। তার বিচার পদ্ধতিকে আধুনিকীকরণ করছে এবং অনেক মুসলিম সেই পরিবর্তিত সিস্টেম চালু রাখছে। রাজনৈতিকভাবে, নতুন নতুন আইডিয়া যেমন- গণতন্ত্র, কনস্টিটিউশনাল সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে প্রবর্তিত হচ্ছে। বলতে গেলে, ইসলাম পুনর্জাগরণ হচ্ছে এই সব নতুন সিস্টেমের কারণে। তাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের পেছনে ইউরোপিয়ান উৎসাহ বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।

ইন্ডিয়া ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের পর মোগল সাম্রাজ্যের পতন দেখেছে। তারপর ব্রিটিশ ভারতের শাসনভার হাতে তুলে নিয়েছে। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত শাসন করেছে। মালয়েশিয়া দখল করেছিল পরপর পর্তুগিজরা (১৫১১), ডাচরা, (১৬৪১) এবং ব্রিটিশরা ১৮২৪ সালে। এ দেশ স্বাধীন হয় ১৯৬৩ সালে। ইন্দোনেশিয়ায় ১৯৪৫ পর্যন্ত ডাচরা শাসন করছে। ব্রুনেই (বোর্নিও) ১৯৪৩ পর্যন্ত ব্রিটিশ প্রটেকটরেট ছিল।

উত্তর আফ্রিকা, মোরিতানিয়া, মরক্কো, আলজেরিয়া, তিউনিশিয়া এবং লিবিয়া স্বাধীনতা পেয়েছিল ১৯৫২ থেকে ১৯৬২ সালের মধ্যে; সিরিয়া ও লেবানন স্বাধীন হয় ১৯৪৬ সালে; মিশর ১৯৩৬ পর্যন্ত ব্রিটিশ প্রটেকটরেটে ছিল; ইরাক ছিল ১৯৩২ পর্যন্ত, জর্ডন ১৯৪৬ পর্যন্ত; প্যালেস্টাইন ১৯৪৮ পর্যন্ত।

মধ্য ও পূর্ব আফ্রিকায়, মালি, চাদ, সেনেগাল, গাম্বিয়া, নিজার এবং গিনিয়া ১৯৬০ সাল পর্যন্ত ফরাসির অধীনে ছিল। সুদান ছিল ব্রিটিশদের অধীনে ১৯৫৬ পর্যন্ত তারপর স্বাধীন হয়েছে। এডেন (দক্ষিণ ইয়েমেন) ছিল ব্রিটিশ ক্রাউন কলোনি ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত। সোমালিয়া ঊনবিংশ শতাব্দির শেষে ব্রিটিশ, ফরাসি ও ইতালির মধ্যে ভাগ হয়ে যায়; সোমালিয়া স্বাধীন হয় ১৯৬০ সালে। পারস্য উপসাগরের সব ছোট ছোট রাজ্য ব্রিটিশ প্রটেকটোরেট; কুয়েত স্বাধীন হলো ১৯৬১ সালে; তারপর বাহরাইন, কাতার ও অন্যান্য রাজ্য।

১৮৮১ সালের মধ্যে রাশিয়া দখল করে নেয় মধ্য এশিয়ায় তুর্কিস্তানের সমস্ত অঞ্চল। এরপর বিভক্ত হয় খানেট-এ, যেমন কাজাকাস্তান, কিরঘিজিয়া, তাজাকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান ও উজবেকিস্তান এই সব খানেট স্বাধীন হয় ১৯৯০-এ।

১৫.২ মৌলবাদী

মুসলিম দেশগুলোর ওপর ওয়েস্টের বিস্তৃত প্রভাব মোলবাদী ইসলামের মধ্যে প্রবল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করল। এই প্রতিক্রিয়ার পুরোভাগে ছিলেন মুসলিম মোল্লারা, ইমাম, আয়াতুল্লাহ, উলেমা আর মুফতি। তারা ওয়েস্টার্ন আইডিয়াকে প্রতিহত করতে চাইল কারণ এগুলো পরিবর্তনের দ্বার খুলে দিচ্ছে এবং মুসলিমদের মনে নতুন এক প্রকার বিদেশী ধারণা দিচ্ছে, যা তারা বুঝতে ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। ওয়েস্টের এই ক্ষমতা ইসলামে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে যা তাদের জীবনযাত্রার প্রতি হুমকি স্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আধুনিকীকরণ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও উদার আন্দোলনকে মোল্লারা ও গোঁড়াবাদীরা নাস্তিকতার উল্টো দিক মনে করে। এরা শুধু অধার্মিক নয়, ধর্মবিরুদ্ধ। ওয়েস্টার্ন জীবনযাত্রার কতকগুলো বিষয়কে মোল্লারা শয়তানি কারবার মনে করে, কারণ, এসব আন্দোলন শতাব্দিকাল ধরে গ্রথিত ইসলামী ধারাকে উৎখাত করতে চাচ্ছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, তারা মেয়েদের উৎসাহিত করছে স্বাধীনতা আদায় করতে যা ইসলামী আইনে অনুমতি দেয় না। অন্য দিকে ওয়েস্ট সিভিল স্বাধীনতার ওকালতি করে, যা মুসলিম কর্তৃত্বকে দুর্বল করবে এবং গণতন্ত্রকে উৎসাহ দিচ্ছে, যা মুসলিম সরকারের ক্ষতি করবে। ইসলামে স্বৈরাচারী শাসন চিরকাল চলে আসছে এবং গ্রহণীয় কারণ এটা ট্র্যাডিশনের মূলধারাকে মজবুত করে।

ইসলামের মূলনীতি সম্বন্ধে কোনো তদন্ত বা এর সত্যতা সম্বন্ধে প্রশ্ন তোলা যাবে না, কারণ ইসলামের মৌল আদর্শকে মুখ বুজে মেনে নিতে হবে, ট্যাঙ্কু চলবে না। কোরানে আধুনিককালের সব সমস্যার সমাধান আছে এবং প্রত্যেক অবস্থায় কোরানের গাইডনেস যথেষ্ট এবং যেহেতু আল্লাহর বাণী আক্ষরিকভাবে অবতীর্ণ। সেই রূপ আক্ষরিকভাবে এর ব্যাখ্যা করতে হবে, কোনো সংস্কারকদের অন্য প্রকার ব্যাখ্যা চলবে না।

মৌলবাদীরা জিদ ধরেছেন, শরিয়তে যেসব আইন-কানুন বিধৃত আছে তার পুনর্বহাল একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছে, শরিয়া আইনের কোনো কিছু পরিবর্তন চলবে না এবং একেই বর্তমান যুগের সাথে মিলিয়ে চলতে হবে, দরকার হলে ‘ফতোয়া’ তো আছেই। আর প্রতিষ্ঠা করতে হবে শরিয়া আদালত যার মাধ্যমে শরিয়া আইন প্ৰয়োগ করা হয় এবং সেই আদিকালের বাসি শাস্তিগুলো ইমপোজ করা হয়।

এই সব মোল্লা-আয়াতুল্লাহর দল ইসলামের সেই স্বর্ণ-যুগের স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছেন, ‘নস্টালজিয়ায়’ বাগদাদ, কাইরো আর কর্ডোভার ঢেঁকুর তুলছেন। তাছাড়া মদিনার সেই চার খলিফার ‘most Purest and perfect’ শাসন, সেই বিজয়ের দিনগুলো যখন ইসলাম-গৌরব সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল।

মুসলিম গোঁড়াবাদীদের যে গোঁড়ামি তার নড়ন চড়ন হবে না এবং তাদের সন্দেহ ও ভয়ের কারণে তারা এখন জঙ্গিভাবাপন্ন, একটা যুদ্ধংদেহি ভাব। র‍্যাডিকাল অ্যাক্টিভিস্টরা বিশ্বাস করে বোমা মেরে আচমকা আক্রমণ করে ভয় দেখালেই কাজ হয়ে যাবে। গুপ্ত-হত্যা, জিম্মি-বন্দি করলেই বোধ হয় কেল্লা ফতে হয়ে যাবে। সত্যি বলতে কি, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদে ইসলামী মৌলবাদীরা বিশ্বাস করে তারা বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে সপ্তম শতাব্দিতে ফিরে যাবার চেষ্টা করছে (তাহেরি, ১৯৮৭; HMT আহমদ, ১৯৮৯); তারা বিশ্বাস করে এই সন্ত্রাসবাদ অনন্তকাল জিহাদের শামিল। এই ডকট্রিন অব আন-এনডিং জিহাদ’ মৌলবাদীদের তরণী একদিন তীরে ভিড়িয়ে দিবে। এই চরমপন্থীরা সেই দিনের আশায় বসে আছে কখন তাদের ইসলামিক নুক্লিয়ার বোম’ আবিষ্কৃত হবে এবং সারা বিশ্ব জয় করে বিশ্ববাসীদের খাৎনা করে ছাড়বে।

১৫.৩ সংস্কারকগণ

সংস্কারের যারা প্রবক্তা তারা বলেন, মৌলবাদীদের ধারণা আলোকিত মুসলিম চিন্তাবিদদের যুক্তিযুক্ত ধারণার অনেক পিছে। মৌলবাদীদের বিজয়-অর্থ স্বেচ্ছাচারী সরকার, দমনকারী মোল্লা, যারা এতদিন অজ্ঞ, অশিক্ষিত, সরল ও ধার্মিক জনগণকে ঠকিয়েছে, তাদের দানে, উপঢৌকনে, খেলাতে সম্পদের পাহাড় গড়েছে।

পিছনে তাকিয়ে গৌরবের দিনগুলির গিলিত চর্বণ করে শরীরে পুষ্টি জোগায় না, গোবর-ঘাসি হয়ে যায়। এটা তো হারিয়ে গেছে, ফিরে পাওয়ার জো আছে কি? সে রামও নেই, অযোধ্যাও নেই। এটা মায়া ভ্রান্তি এই ক্রান্তি কালে; সে তো সোনার হরিণ যাকে ধরা যায় না, ছোঁয়াও যায় না। ইসলামের কোনো দিন স্বর্ণ-যুগ ছিল না। শুরু থেকেই (প্রফেটের মৃত্যুর পর) ইসলাম শত ফিরকায় ছিন্নভিন্ন। মুসলিম রাষ্ট্রগুলো সব সময়েই ভায়োলেন্সে পরিপূর্ণ এবং ইসলামী সাম্রাজ্য একটা না একটার সাথে ইতিহাস জুড়ে, যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে।

ইসলামে এখনো ঐক্য নেই, কেবলমাত্র, সম্ভবত ইসরাইলের ব্যাপারে একমত (তবু ও কয়েক মুসলিম দেশ তার সাথে বৈদেশিক সূত্র গড়েছে); একমত এই কারণে যে ইসলামী বিশ্বের অন্তরে ওয়েস্ট, ইসরাইলের মাধ্যমে জেঁকে বসেছে। ‘জিওনিজমের’ বিরুদ্ধে যে জেহাদ, মিসর, জর্ডান, সিরিয়া ও ইরাকের যৌথ শক্তি আরম্ভ করেছিল তা ছয় দিনের যুদ্ধে (৫-১০ জুন ১৯৬৭) লজ্জাজনক পরাজয়ে পরিণত হয়েছে, ইসরাইলের হাতে মার খেয়ে। ‘ইসলামিক নুক্লিয়ার বোম’ তৈরি করে ইসলামের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার করা পাগলের প্রলাপ ছাড়া আর কী হতে পারে। এ যেন ঢাল নেই, তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার।

বাস্তব কথা হচ্ছে, কোরান ও শরিয়া আইন কড়াকড়িভাবে পালন করে একেবারে পিউরিটান হয়ে যাওয়া, আজকের দুনিয়ায়, মুসলিমদের পরবর্তী জীবনযাত্রায় সেই সপ্তম শতাব্দির বেদুইন জীবনযাত্রা চিন্তা করাও যেন স্বপ্নাতীত। এর অর্থ এই হবে যে, এতদিন যে-সব সেক্যুলার মিউজিক ও খেলাধুলা ও অন্যান্য উপকরণকে বিসর্জন দেওয়া; এর অর্থ হবে যে, ছবি-সম্বলিত, বই-পুস্তক, মেগাজিন, পোস্টার এবং সবার ওপরে ফটোগ্রাফি, সিনেমা, টেলিভিশন সবই নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। কোরানের আইন কড়াকড়িভাবে প্রয়োগের অর্থ হবে, মেয়েদের ঘরে আবদ্ধ রাখা, সেই ক্রীতদাস-দাসী ও একাধিক উপপত্নী, জনসম্মুখে কোড়া মারা পদ্ধতির পুনঃপ্রবর্তন, শরীরের অঙ্গচ্ছেদ, শিরশ্ছেদ, ক্রুসিফিকেশন, পাথর মেরে হত্যা এবং বিধর্মীদের যেখানে পাও কতল করা। এই সমস্ত এবং আরো অনেক ‘প্রহিবিশন ও অবলিগেশন’ কোরান বা শরিয়া আইন দাবি করবে।

বর্তমান যুগে আমাদেরকে বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে মৌলবাদী আক্ষরিক ইন্টারপ্রিটেশের সম্মুখীন হতে হবে। যত মৌলবাদিত্বের দিকে আমরা ঝুঁকে পড়ব, ততই আমাদের আধুনিক জীবনযাত্রা অবাস্তব হয়ে অচল হবে এবং এই দুই মেরুতে বাস করা ইসলামকে বর্তমান যুগে একটা সমঝোতায় আসতে হবে যুগোপযোগী হয়ে, নিছক গোঁড়ামি করে ইসলামের নামে অশান্তি সৃষ্টি করা ইসলামের মর্মকথা নয়।

উদারপন্থীরা বলেন, জীবনের প্রত্যেক ক্ষেত্রে বেঁচে থাকার পূর্ব শর্ত হয় যুগের সাথে মানিয়ে চলা- ‘অ্যাডাপশন ও কম্প্রোমাইজ’। মুসলিমদের জানতে হবে এই নিয়ম পৃথিবীতে অনেকেই মেনে নিয়েছে। ওয়েস্টার্ন প্রভাবের মাধ্যমে বর্তমানে অনেক পরিবর্তন হয়েছে— যে প্রভাবকে বাদ দিয়ে চলা যায় না। ইসলামী বিশ্ব সাধারণ সমস্যা ভাগ করে নিয়েছে বাকি মানব জাতির সাথে এবং ওয়েস্টের সাথে যোগ দিয়ে আগামী শতাব্দির পৃথিবী যে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে তাকে মোকাবেলা করতে হবে।

সংস্কারকগণ মনে করেন, যে ওয়েস্টার্নাইজেশনকে অগ্রাহ্য করা বোকামি ও অসাধুও বটে, যখন প্রতিনিয়ত ইসলামী বিশ্বের লোকজন আজকে নির্ভর করেছে ওয়েস্টের প্রডাক্ট, মালামাল, আবিষ্কৃত বস্তু, এচিভমেন্ট ইত্যাদির ওপর, তাদের জীবনযাত্রা, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনোদন, আরাম-আয়াস, তাদের প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা, যোগাযোগ স্বাস্থ্য ও কল্যাণ পরিচালন ও পালনের জন্য।

ওয়েস্টের সাথে যোগাযোগের পর ইসলাম রেনেসাঁর অভিজ্ঞতা লাভ করেছে, কিন্তু এখন একটি রিফরমেশনের দরকার। যারা বহির্জগত থেকে এই সংস্কারের আপত্তি করে সংস্কারকরা বলেন যে, তাদের জন্য ওয়েস্টের গাইডেন্স দরকার নেই, এই সংস্কারের অন্বেষণে। শতাব্দি ধরে মুসলিম চিন্তাবিদরা ইসলামের ব্যবহারিক জীবনের রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় প্রতিটি ক্ষেত্রে চুলচেরা বিচার করে দেখেছে এবং অনেকে আজও দেখছে মৌলবাদীদের দাঁত খিঁচুনির প্রতিরোধ।

যারা কোরানের কাঠামোর বাইরে সংস্কারের আপত্তি ওঠায়, সংস্কারকগণ যুক্তি দেন যে, কোরানের, অন্যান্য ধর্ম পুস্তকের মতো, একটা ছাড়া বহু তাৎপর্য আছে, যেমন মেটাফোরিক্যাল, মেটাফিজিক্যাল, এলিগোরিক্যাল, সিম্বলিক এবং মুসলিমদের এগিয়ে চলা উচিত কোরানের অনেক উদার ও মডারেট অর্থ যুগের সাথে সমন্বিত করে খুঁজে বের করা; আক্ষরিক অনুবাদ ও অর্থকে একপাশে সরিয়ে রেখে।

ধর্মীয় ও স্বৈরাচারী রাজ্য চিন্তাশীল মুসলিমদের জন্য আর গ্রহণীয় নয়। এখন অত্যন্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছে রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে আলাদা করা নতুবা ইসলাম আবার সেই গোঁড়া মৌলবাদীদের মৃত-হস্তের ষড়যন্ত্রের পুতুল হয়ে যাবে, আর মুসলিম জীবনের তাজা গোলাপটি মরুভূমির তপ্ত বাতাসে শুকিয়ে শক্ত হয়ে বিকৃত রঙ ধারণ করবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *