৬। মদিনা ও তারপর

৬. মদিনা ও তারপর

মিশরের প্রাচীনকাল থেকে ইথবের শহর পরিচিত, মক্কার উত্তরে ২৩০ মাইল দূরে অবস্থিত। ইথবের ইহুদিদের কাছে মদিনা বলে পরিচিত ছিল। আরামাইক শব্দ মেদিনতা থেকে মদিনা- এর অর্থ শহর। মদিনাত-আল-নবী’ থেকে যে মদিনা হয়েছে এটা সত্য নয়। মদিনাত-আল-নবী অর্থ ‘প্রফেটের শহর’ (Rodinson 1976 p. 139)।

ট্রাডিশন মতে, মদিনার প্রধান গোত্র আউস ও খাজরাজ কাহতান গোত্রভুক্ত। এরা মূলত দক্ষিণ-আরবের বাসিন্দা এবং মক্কানদের থেকে আলাদা শাখাভুক্ত। এরা প্রথমে উত্তর আরবে অথবা আদনান জাতীয়ভুক্ত। প্রফেট মোহাম্মদের মদিনার সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল। মদিনায় নাবাতিয়ানদের একটা বাজার ছিল এবং এখানে হাশিম, প্রফেটের প্রপিতামহ, বাণিজ্য উপলক্ষে আসা-যাওয়া করতেন। এই রকম একটা বাণিজ্য যাত্রাকালে আমরের কন্যা সালমার সাথে তার দেখা হয় এবং তিনি তাকে বিবাহ করেন। আমর মদিনার খাজরাজ জাতির নাজ্জার (সূত্রধর) গোত্রভুক্ত ছিলেন। এই বিবাহের কারণে প্রফেটের দাদা আবদুল মোতালেবের জন্ম হয় এবং তিনি এখানেই পালিত হন। প্রফেটের পিতা আবদুল্লাহ মদিনায় বাণিজ্য উপলক্ষে আসতেন এবং মদিনায় মৃত্যুবরণ করলে এখানে সমাধিস্থ হন। প্রফেট যখন শিশু, তখন তার মা আমিনা তাঁকে মদিনায় নিয়ে আসেন আত্মীয়স্বজনদের সাথে দেখা করতে, মক্কায় ফেরার পরে তিনিও মারা যান।

প্রফেট তাঁর ‘মিশন’ সম্বন্ধে মক্কাতে বেশ সুবিধা করে উঠতে না পারায় তাঁর উদ্দেশ্য স্থবির হয়ে পড়ে। বলা হয়েছে যে অত্যাচারের জন্য নয় (যার ন্যূনতম সাক্ষ্য- প্রমাণ পাওয়া যায়), কিন্তু তাঁর মিশনের কোনো উন্নতি হচ্ছে না দেখে তিনি মদিনায় চলে যাবার কথা চিন্তা করেন এবং সেখান থেকে মক্কাবাসীদের ওপর বাণিজ্য বিষয়ক ব্যাপারে চাপ সৃষ্টি করে তাদের অর্থনৈতিকভাবে অসুবিধায় ফেলার কথা চিন্তা করেন।

তিনি মক্কানগরী পরিত্যাগ করতে ইচ্ছা করেননি, তবে লোকদের বোঝাতে চেয়েছিলেন যে তাঁকে মাতৃভূমি থেকে নির্বাসিত করা হচ্ছে। তাই কোরানে মুসলিমদের নিষেধ করা হয় মক্কাবাসীদের সাথে বন্ধুত্ব করতে কারণ তাঁরাই প্রফেটকে তাঁর দেশ থেকে নির্বাসিত করেছে (৬০ : ৯)।

পরবর্তীতে, মদিনায় প্রফেট মোহাম্মদের সাফল্য তাকে উদ্বুদ্ধ করেছে মদিনাকে আপন দেশ হিসেবে গ্রহণ করার জন্য। তিনি সেখানে তার বাকি জীবনটা কাটিয়েছেন এবং তার সব অভিযানের-সামরিক ও ধর্মীয়-হেড কোয়ার্টার প্রধান কার্যালয় রূপে ব্যবহার করেছেন। সেখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন এবং তাঁর মসজিদের পিছনে তাঁকে সমাহিত করা হয়।

৬.১ আকাবার শপথ

৬২০ সালে মক্কায় বাৎসরিক হজের সময় মদিনার খাজরাজ গোত্রের ছয়জন লোকের যাঁদের সাথে প্রফেটের আত্মীয়তা ছিল, তাদের সাথে দেখা করেন এবং কথাবার্তা বলেন। তারা মনে করেছিল যে মদিনাতে যে সামাজিক, বাণিজ্যিক বিশেষ করে যে গোত্রীয় সমস্যা ছিল, এগুলোর সমাধানে প্রফেটের সাহায্য মিলতে পারে। তাঁর যদি কোনো ধর্মীয় আদর্শও থাকে সে সম্বন্ধেও তিনি মতামত প্রকাশ করতে পারেন। পরের বছর ৬২১ সালে মদিনার ১২ জনের একটি দল (১০ জন খাজরাজ গোত্র এবং ২ জন আউস গোত্র) প্রফেটের সাথে আবার আকবায় দেখা করে এবং একটি চুক্তিপত্র হয়, এতে তারা শপথ করে যে, তারা মূর্তি পূজা করবে না, মিথ্যা বলবে না, ব্যভিচার করবে না, কিংবা মেয়ে শিশু মেরে ফেলবে না। তারা প্রফেটের আদেশ মেনে চলবে। একে আকাবার প্রথম শপথ বলা হয়। তারা মদিনায় ফিরে গেল সাথে কোরান শিক্ষার জন্য নিয়ে গেল প্রফেটের এক শিষ্য মোসাব ইবন ওমরকে।

পরের বছর (৬২২), প্রথম শপথকে নবায়ন করল মদিনার ৭৫ জন লোক এবং দুইজন স্ত্রীলোক। অতিরিক্ত শর্ত হলো যে মদিনায় যেসব মুসলিম চলে যাবে তাদের জানমালের নিরাপত্তা তারা দিবে। একে আকাবার দ্বিতীয় শপথ বলা হয়। এই শপথকে সিমিটিক কায়দায় সত্যায়িত করা হয় ‘বায়া’-র দ্বারা অর্থাৎ মোহাম্মদ তাঁর হাত বাড়িয়ে দিলেন এবং মদিনার পুরুষেরা সেই হাতের ওপর হাত রাখল। মেয়ে শুনেই শপথ গ্রহণ করল।

এই দল থেকে প্রফেট মোহাম্মদ ১২ জনকে শিষ্য হিসাবে গ্রহণ করে বললেন- মুসা তার অনুসারীদের মধ্যে থেকে ১২ জনকে শিষ্য নিয়েছিলেন এবং যিশুও তাই করেন, তোমরা বারো জন সব সময়ের জন্য আমার জামিনদার হলে (Muir 1912 p. 130)।

মদিনাবাসীরা তারপর প্রফেটের কিছু অনুসারীকে নিয়ে মদিনায় ফিরে এলো প্রফেটের মদিনায় চলে আসার পথ প্রস্তুত করতে। পরে মদিনাবাসীদের ওপর প্রফেট মোহাম্মদের প্রভাব উত্তরোত্তর বাড়তে লাগল। তারপর মাত্র কয়েক জন মক্কায় রয়ে গেলেন তারা হলেন প্রফেট মোহাম্মদ নিজে, আবুবকর আলী ও কিছু হাতেগোনা বিশ্বাসী সহচরবৃন্দ।

৬.২ মক্কা থেকে মদিনায় আগমন (হিজরত)

৬২২ সালের জুন মাসে কোনো এক সময়ে (সঠিক তারিখ সম্বন্ধে পণ্ডিত ব্যক্তিদের মতভেদ আছে) প্রফেট মোহাম্মদ, মদিনাতে তার অভ্যর্থনার ব্যবস্থা করে, রাতে মক্কানগরী পরিত্যাগ করলেন। সাথে নিলেন আবুবকর ও অবশিষ্ট কিছু অনুসারী, শুধু বিশ বছরের কাজিন আলীকে রেখে। আলী ও আর একজন সাথী কিছুদিন পরে তাদের অনুসরণ করবেন। এই ঘটনাকে হেজিরা বলা হয়। (আরবিক হিজরা ইমিগ্রেশন, প্রস্থান, নির্বাসন বা পলায়ন)

প্রফেটের মক্কা থেকে চলে যাওয়া এবং তার পিছে মক্কাবাসীদের ধাওয়া সম্বন্ধে রংচড়ানো (embellished) ঘটনাপঞ্জি রচিত হয়েছে। যেমন, প্রফেট ও তাঁর পার্টি মক্কার বাইরে তিন মাইল দূরে থাউরের গুহায় আশ্রয় নেন। এখানে গুহার মুখে মাকড়শা তাৎক্ষণিকভাবে জাল বুনে দেয় এবং এতে ধাওয়াকারীরা গুহার মধ্যে কেউ থাকতে পারে না ভেবে ফিরে যায়। সেখান থেকে প্রফেট ও তাঁর দল এক বেদুইনের সাহায্যে বিভিন্ন ঘাট পেরিয়ে মদিনায় এসে পৌঁছেন। এই যাত্রায় প্রায় নয়দিন অতিবাহিত হয় এবং ২৮ জুনের (৬২২) মধ্যে মদিনায় আসেন।

যখন প্রফেট মোহাম্মদ ও তাঁর দল মদিনা মরূদ্যানের তিন মাইল দক্ষিণে কোবা (koba) গ্রামে এসে পৌঁছেন, তখন তাদের দেখে একজন ইহুদি তৎক্ষণাৎ মদিনাবাসীদের সংবাদ দেয়। এই সংবাদ শুনে, মদিনার মুসলিমরা বের হয়ে এসে প্রফেটকে স্বাগতম জানায়। তিনি তাদের কোবাতে একটি মসজিদ তৈরি করার নির্দেশ দেন তাঁর শুভ আগমনের স্মরণিকা রূপে। সাদাসিদে একটা মসজিদ তৈরি হয় এবং এতে প্রফেট নিজে অংশগ্রহণ করেন। এই মসজিদ নতুন ধর্মের প্রথম উপাসনালয় রূপে পরিচিত হয়।

তিন দিন পর আল-কাসওয়াতে প্রফেট তাঁর উটে আরোহণ এবং মদিনার কেন্দ্রস্থলে যাত্রা করেন। তিনি উটের লাগাম ছেড়ে দিয়ে সিদ্ধান্ত নেন যে, উটটি যেখানে তাকে নিয়ে যাবে তিনি সেখানেই যাবেন। উটটি একটি ফাঁকা গোরস্থান মাঠে এসে দাঁড়ায়। এখানে প্রফেট একটি প্লট খরিদ করেন এবং নিজের ও পরিবারের জন্য বাড়ি নির্মাণের কাজে হাত দেন। এখানে একটি মসজিদও তৈরি করা হয় ‘মসজিদ আল-নবী’ বলে।

মদিনাতে প্রফেট মোহাম্মদ একজন বীরের সংবর্ধনা পান এবং কিছু মহল ছাড়া, তাঁর প্রভাব অন্য সব মহলের ওপর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। কিছুদিনের মধ্যেই শহরের ‘রাজা’ (ruler) বনে গেলেন।

প্রফেটের মৃত্যুর ছ’বছর পর ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে খলিফা ওমর, গ্রিক ও রোমানদের জীবনযাত্রা বিবেচনা করে, প্রফেট মোহাম্মদের হিজরতের তারিখ থেকে মুসলিম যুগ হিজরি সাল প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এই যুগ বা বর্ষ শুরু করার নির্ধারিত দিনটি হয় যে চান্দ্র মাসে হিজরত হয়েছিল ঐ মাসের প্রথম তারিখটি। ৬২২ খ্রিস্টাব্দে এই দিনটি পড়েছিল শুক্রবার ১৬ জুলাই। ৩৩টি সৌর বছরে চান্দ্র বছর হবে ৩৪টি। এখন আন্তর্জাতিক সুবিধার জন্য প্রায় সব মুসলিম দেশ গ্রেগরিয়ান সৌর ক্যালেন্ডার ব্যবহার করেন।

৬.৩ প্রথম (কনভার্টস) মোহাম্মাডানস্

প্রথমে যারা মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করে, ট্রাডিশনালি বলা হয়, তাদের সংখ্যা ছিল সত্তর জন। এদের বলা হতো ‘রিফিউজি’– মোহাজির বহু বচনে (মোহাজিরিন)। এই মোহাজিরিনদের সংখ্যা পরে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় প্রথম থেকেই যারা ইসলামে দীক্ষা নিয়েছে তারা এবং আকাবা শপথের পর যারা মক্কা ছেড়ে মদিনায় গেছে, যারা প্রফেটের সহযোগী ও পরে অনুসরণ করেছে তারা এবং পরে তাঁর সাথে, ৬৩০ সালে মক্কা বিজয়ের আগ পর্যন্ত যোগদান করেছে। মদিনায় প্রথম দীক্ষিত ব্যক্তিরা যারা নতুন মোহাজেরদের সাহায্য (নসর) এবং পরবর্তীতে যারা সাহায্য করেছে সেই সব মদিনার লোকদের আনসার বলা হয়। এই শব্দটি অর্থাৎ আনসার কোরানে প্রথম ব্যবহৃত হয় যিশুর শিষ্য ও সাহায্যকারীদের জন্য (৩: ৪৫)।*

[* সূরা আল-ইমরানে স্পষ্টভাবে এ বাক্য নেই- এখানে ফেরেশতাগণ আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি ‘কালেমার’ সুসংবাদ দিচ্ছে, যিশুর শিষ্যগণ ও সাহায্যকারী নেই- অনুবাদক।]

মদিনার সাহায্যকারীরা প্রধানত ছিল দুইটি প্রতিদ্বন্দ্বী দলের যারা মদিনার মরূদ্যান নিয়ন্ত্রিত করত। একদল হলো খাজরাজ প্রফেটের প্র-মাতামহের দিক থেকে আত্মীয় এবং এর প্রধান ব্যক্তি ছিল সাদ ইবন ওবাইদা, অন্য দলটি আউস, একদা ইহুদিদের সাথে আঁতাত ছিল। এর প্রধান ব্যক্তি সাদ ইবদ মুয়াদ।

যারা প্রফেটের সহযোগী বা সাথীদের (আসাব; একবচন সাহাব; উৎস পাশ্চাত্য শব্দ সাহিব) মধ্যে বিভিন্ন ধরনের মানুষ নিকট সম্পর্ক থেকে যারা তাঁর সঙ্গে কথা বলেছে, এমনকি নাম শুনেছে বা এমনকি তার জীবদ্দশায় তার বাসস্থানের আশপাশে বাস করেছে। এক সময় তার অনুসারীরা নিজেদের বলত হানিফ- ইসলাম-পূর্ব যুগে যারা নিজেদের একেশ্বরবাদী বলত। পরে এরা ‘বিশ্বাসী’ শব্দটি ব্যবহার করেছে- ‘মুমিনুন’ –একবচনে মুমিন। এবং এ-ও তারা বলত যে তারা ‘আল্লাহর দলের লোক। (হিজবি-ই-আল্লাহ)। অন্য অর্থে ‘হিজবুল্লাহ’।

প্রফেট মোহাম্মদ একবার বলেছিলেন তাঁর মৃত্যুর পর যেসব দল-উপদল সৃষ্টি হবে, তার মধ্যে কেবল একটিই বিশ্বাসী দল। বাকি সবই অবিশ্বাসী (infidels) শুরু থেকেই তিনি যে তত্ত্ব কথা প্রচার করেছেন তাতে তার নাম বহন করেছে। এমন কি হিজরতের পূর্বে প্রফেটের অনুসারীদের বলা হতো ‘মোহাম্মদী সম্প্রদায়’—উম্মা মোহাম্মদীয়া এবং এ কথা বা এর ব্যবহার শতাব্দি ধরে চলে এসেছে।

মুসলিম ইতিহাসে অনেক গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় দাবি করেছে যে তারা নিখাদ মোহাম্মদী সম্প্রদায়। এছাড়া অনেক রহস্যবাদী দলও আছে যারা বলে যে তারা ‘মোহাম্মদী পথে’-র তীর্থযাত্রী (তরিকা মোহাম্মদীয়া) কারণ তারা প্রফেট কর্তৃক শুধু প্রবর্তিত আইন ও নীতি মেনে চলে, অনুসরণ করে; বিকৃত বা ভ্রান্ত তরিকা, যা ঢুকে গেছে, তার থেকে ভিন্ন। ভারতে ‘মোহাম্মদী তরিকা’ উদ্ভাবন করেছেন সংস্কারক আহমদ সিরহিন্দী (মৃ. ১৬২৪)। উর্দু কবি খাজা মীর ডারদ (মৃ. ১৭৮৫)-ও এ বিষয়ে যথেষ্ট এ-প্রক্রিয়ার উন্নতি করেন বলে প্রচলিত। অধুনা ইন্দোনেশিয়াতে মুসলিমদের মধ্যে মোহাম্মদীয়া আন্দোলন প্রবল আকার ধারণ করেছে।

একবিংশ শতাব্দির শুরু পর্যন্ত মুসলিমদের মধ্যে এবং পাশ্চাত্য বিশ্বে ‘মাহমেডান’ পদবিটি প্রচলিত ছিল। প্রফেট মোহাম্মদ কর্তৃক প্রবর্তিত ধর্ম এই নামেই পরিচিত ছিল এবং এখনো আছে।

অধুনা, মুসলিমগণ এই ‘মহমেডান’ শব্দটির ব্যবহারে আপত্তি তুলেছে এই কারণে যে এই ধর্মটির সৃষ্টিকারক প্রফেট মোহাম্মদ অথবা এমনকি প্রফেট মোহাম্মদ পূজনীয় বস্তু বা ব্যক্তি বোঝায়। ‘মুসলমান’ ফার্সি শব্দরূপে যা বিশ্বজনীন ব্যবহৃত হয়েছিল, ‘মুসলিম’ শব্দের পরিবর্তে, তা-ও ব্যবহারের বাইরে চলে যাচ্ছে।

মুসলিমগণ ‘ইসলাম’ শব্দটিকে বেশি মর্যাদা দিচ্ছে এবং এর অনুসারীদের মুসলিম বলা হচ্ছে।’ ইসলাম ও মুসলিম উভয় শব্দ মূলত ইসলাম-পূর্ব যুগে খ্রিস্টানরা ব্যবহার করেছে (as Christian usage) এবং প্রফেট মোহাম্মদ প্রথমে সাধারণ অর্থে এই দুটি শব্দ ব্যবহার করেছেন কারণ আব্রাহাম থেকে যিশু পর্যন্ত সকল প্রফেটদের ধর্ম বিশ্বাস রূপে তাদের অনুসারীগণ ব্যবহার করেছেন।

৬.৪ মোনাফেকগণ

প্রফেট মোহাম্মদ জানতেন যে তাঁর অনুসারীদের মধ্যে বেশ কিছু মুসলিম দ্বৈত- চরিত্রের এবং তারাই কোরানে ৬৮ নং সূরার বিষয়বস্তু।

কোরান বলে, কিছু লোক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার ভান করে, কিন্তু অন্তরে তারা মিথ্যাবাদী এবং তাদের আত্মায় মোহর মারা। তাদের বিশ্বাসে তারা অস্থিতিশীল ছিল, আনুগত্যে আস্থাহীন। কর্তব্যে ছিল অনিয়মিত এবং সংকটের সময় তাদের বিশ্বাস করা যেত না। তারা সমালোচনা করত, দল পাল্টাত এবং ক্ষুব্ধ ছিল, আর গোপনে অন্তরে অনাস্থা পুষে রাখত। তারা ওহিতে সন্দেহ প্রকাশ করত এবং ধর্মমতে বিশ্বাসী ছিল না। এই ধরনের লোকদের কোরানে, সন্দেহবাণী বা মুক্তচিত্তক হোক, মোনাফিক বলা হয়েছে- বহুবচনে মুনাফিকুন। কোরানের এই শব্দ (term) ইথিওপীয় উৎসের- অর্থ, ‘উপহাসকারী’ ‘বিদ্রূপকারী’ (scoffer)।

এইসব মোনাফেকদের মধ্যে অনেকেই নামাজ ও রোজার আনুষ্ঠিকতাকে বিদ্রূপ করত খোলাখুলিভাবে, যেসব কথা মুসলিমরা বলতে ইতস্তত করেছে। এই বিদ্রূপকারীদের মধ্যে ছিল রাফা বিন জায়েদ এবং সোয়াইদ ইবন হারিথ। এরা ইসলাম গ্রহণ করলেও গোপনে উপহাস করেছে এবং প্রফেটের অনুসারীদের মধ্যে কোনো কোনো দলের কাছে বেশ জনপ্রিয়তা লাভও করেছে।

প্রফেট মোহাম্মদ জানতেন সত্যিকারের বিশ্বাসী পাওয়া মুশকিল। যেমন, একবার তিনি স্বীকার করেছিলেন, আমি কখনো কাউকে ইসলাম গ্রহণ করতে আমন্ত্রণ জানাইনি, কিন্তু যারা গ্রহণ করেছিলেন তারা ছিলেন দ্বিধান্বিত, সন্দেহবাদী এবং দোনামোনা, একমাত্র আবু বকর ছাড়া।’

মানুষেরা তাদের বিশ্বাসে অটল ছিল না। তাই দলত্যাগী ঘনঘন হতো এবং তাদের আস্থা ছিল ভঙ্গুর। মক্কায় যখন নতুন মুসলিমদের ওপর কিছুটা অত্যাচার শুরু হলো, তারা অনেকেই ধর্ম ত্যাগ করে। অন্যান্যরা তাদের পুরনো বিশ্বাসের ওপর জোর দিয়ে আস্থা রেখেছিল, নতুন ধর্মের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করে। প্রফেটের মুখে মিরাজের কাহিনী শুনে অনেকেই উপহাস করে নিজের ধর্মে ফিরে গেছে, বিশ্বাস করেনি। পাগলের প্রলাপ বলেছে। এমনকি প্রফেট মোহাম্মদ যখন হোদায়বিয়ার সন্ধি সই করেন তখন ওমরের মতো দৃঢ়চিত্ত মানুষ সন্ধির শর্তগুলোকে অসম্মানজনক মনে করে নতুন ধর্ম ত্যাগ করার কথা চিন্তা করেন।

৬.৫ হাসান ইবন থাবিত

মদিনাতে পৌছানোর কিছু পরেই প্রফেটকে নিয়ে অনেক ব্যঙ্গাত্মক কবিতা লেখা হয়েছে তাঁর মিশনকে কেন্দ্র করে। অনেকে উপহাস করেছে তাঁর দাবিকে। তারা ঘোষণা করেছে যে কোরান প্রফেট মোহাম্মদের নিজের রচনা। তারা গর্ব করে বলত এমন কাহিনী নিয়ে কবিতা তারাও লিখতে পারে এবং তাঁকে উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও মিথ্যাবাদী বলে অভিযুক্ত করেছে। প্রফেট মোহাম্মদ এই সব আক্রমণে ও প্রতিক্রিয়ায় আবেগপ্রবণ হয়ে উঠতেন এবং এর মোকাবেলা করতেন জোরেশোরে। ফলে অনেকেই তাদের এই হটকারীতার জন্য প্রাণ দিয়ে মূল্য দিতে হয়েছে।

প্রফেট মোহাম্মদ কোরানিক প্রেরণাকে কবির কল্পনা মনে করে ঘৃণা করতেন এবং একাধিক বার তিনি পরিষ্কার করে বলেছেন যে, তিনি কবিতাকে ঘৃণা করেন এবং কবি গোষ্ঠীকে নিন্দা করেন। এ সম্বন্ধে তাঁর এক হাদিস আছে, ‘পেটভরা কবিতার চেয়ে পুঁজভরা পেট অনেক ভালো’। তিনি বিখ্যাত ইসলাম-পূর্ব কবি ইমরুল কায়েসকে বলেছিলেন সে নরকের নেতা। তিনি ওকাজ মেলায় যে কবির লড়াই ও কবিতার প্রতিযোগিতা হতো তা বন্ধ করে দেন। কিন্তু তিনি নিজেই কবিদের নিয়োগ করেন তাঁর বিরুদ্ধে রচিত কবিতার জবাব দিতে এবং তাঁর সামরিক অভিযানের গুণগান গাইতে এবং শত্রুদের কবিতার উচিত জবাব দিতে।

তাঁর নিয়োজিত কবিদের মধ্যে প্রধান কবি ছিলেন হাসান ইবন থাবিত। খাজরাজ গোত্রের কবি। হাসানের পূর্বপুরুষেরা কবি ছিলেন, তিনি ঘাসানের খ্রিস্টান যুবরাজদের দলে অনেক দিন কাটিয়েছেন কবিয়াল হিসাবে, অন্যান্য খ্রিস্টান কবিদের মতো তিনি মদের প্রশংসা করে কবিতা লিখেছেন।

মিশরের গভর্নর প্রফেটকে দু’টি খ্রিস্টান বালিকা উপহার দেন। তার মধ্যে একটি হাসানকে দিয়ে, অন্যটি নিজে রেখে দেন। তিনি ছিলেন ‘মেরি কিব তিয়া’ – Mary the Copt. প্রফেট মোহাম্মদ হাসানকে একজন খ্রিস্টান বালিকা উপহার দেয়ায় মনে করা হয় হাসান নিজেও খ্রিস্টান ছিলেন। প্রফেটের মৃত্যুর পর হাসান তৃতীয় খলিফা ওসমানের অনুসারী হন এবং ওসমানের মৃত্যুর পর মাবিয়ার খলিফা হওয়ার পক্ষেই তিনি মত প্রকাশ করেন।

৬.৬ প্রাথমিক যুদ্ধবিগ্রহ

৬২৩ খ্রিস্টাব্দে, মদিনায় কয়েক মাস অবস্থানের পর প্রফেট মোহাম্মদ মক্কান ক্যারাভানের ওপর প্রথম আক্রমণের (রাজিয়া) ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এর পরপর আরও কয়েকটি আক্রমণ চালানো হয়েছিল। এর মধ্যে কয়েকটি তিনি ব্যক্তিগতভাবে পরিচালনা করেন। উদ্দেশ্য ছিল মক্কার ব্যবসায়ীদের হয়রানি করে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করা। তাঁর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল অর্থ সংগ্রহ করা, সংগঠনকে শক্তিশালী করা। আর মদিনার বাণিজ্য ব্যবস্থাকে সাহায্য করা, কেননা তারা মূলত চাষবাস করেই দিনাতিপাত করত। ৬২৪ সালে জানুয়ারি মাসে আরবি পবিত্র মাসে যখন যুদ্ধবিগ্রহ নিষিদ্ধ, প্রফেটের অনুসারীগণ নাখালা উপত্যকায় একটি মক্কার ক্যারিভানকে আক্রমণ করে। এই আক্রমণে একজন কোরেশী নিহত হয় আর দু’জন বন্দি হয়। ক্যারাভানকে মদিনায় নিয়ে আসা হয় মালেগণিমত হিসাবে। পবিত্র মাসে এই আক্রমণ হওয়ায় শহরে বেশ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় পুরনো ট্র্যাডিশন ভঙ্গ করার জন্য কিন্তু প্রফেট সময় মতো ‘ওহি’ দ্বারা বিষয়টিকে জায়েজ করে ফেলেন এই বলে যে, এই আক্রমণ আল্লাহর কারণেই হয়েছিল (২ : ২১৪)। এই অভিযানের নেতা ছিলেন আবদুল্লাহ ইবন জাহাশ— তিনি খেতাব পেলেন ‘আমিরুল মুমেনিন’–এ খেতাব খলিফারা পরে ব্যবহার করেছেন।

ঐতিহাসিকভাবে প্রফেট মোহাম্মদের সাথে কোরেশদের গুরুত্বপূর্ণ মোকাবেলা হয় ১৫ মার্চ ৬২৪। প্রফেট মোহাম্মদ জানতে পারেন যে, মক্কানদের কয়েকশ’ উটের পিঠে বিশাল এক সম্পদের বহর সিরিয়া থেকে বাণিজ্য করে মক্কায় ফিরছে এবং এই বিরাট কাফেলা মক্কা থেকে বিশ মাইল দূরে বদর নামক এক স্থান দিয়ে অতিক্রম করবে। প্রফেট মোহাম্মদ এখানেই ঐ কাফেলাকে ‘এমবুশ’ করার পরিকল্পনা করেন। উমাইয়া প্রধান উক্ত ক্যারাভানের নেতৃত্বে ছিলেন।

মদিনাবাসীদের পরামর্শ মতো, প্রফেট মোহাম্মদ দলবল নিয়ে অগ্রসর হলেন এবং অবস্থান নিলেন একটি জলশূন্য কূপের কাছে। উদ্দেশ্য ছিল মক্কার ক্যারাভানকে পানি থেকে বঞ্চিত করা। যদিও মরু সম্প্রদায়ের কাছে কূপের পানি জলশূন্য করা মারাত্মক অপরাধের শামিল কিন্তু প্রফেট এই অবস্থায় এ নীতি অনুসরণ করা সমীচীন মনে করেননি। আবু সুফিয়ান প্রফেটের এই পরিকল্পনা টের পেয়ে দমদম নামে এক সংবাদবাহককে মক্কায় পাঠালেন প্রফেটের আক্রমণকে প্রতিহত করতে, সেনাবাহিনী পাঠানোর অনুরোধ করে। তারপর আবু সুফিয়ান লোহিত সাগরের উপকূল ঘেঁষে ভিন্ন পথ ধরে তার কাফেলা নিয়ে নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে যান।

এদিকে মক্কানরা একটা বাহিনী সংগঠন করে বদর অভিমুখে শত্রুর মোকাবেলা করার জন্য রওয়ানা দেয়। তার পর একটা রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম শুরু হয় যার বর্ণনা মুসলিম ঐতিহাসিকগণ বিস্তারিতভাবে দিয়েছেন। প্রফেট মোহাম্মদ নিজে কোনো সক্রিয় অংশ এই যুদ্ধে গ্রহণ করেননি, তবে খেজুর বৃক্ষের কাণ্ড ইত্যাদি দিয়ে তৈরি একটি ছাউনির সামনে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ পরিচালনা ও তদারক করেন। এই ছাউনির পেছনে দ্রুতগামী উটের বহর রাখা হয়েছিল, মদিনার আউস গোত্রের প্রধান এর ব্যবস্থা করে প্রফেটকে বলে- যদি যুদ্ধের গতি বিপরীত হয় তাহলে তিনি এই উটের সাহায্যে মদিনা অভিমুখে যাত্রা করতে পারেন নিরাপদ স্থানে পৌঁছানোর জন্য (Glubb 1979 p. 184)।

প্রফেট মোহাম্মদ তাঁর ছাউনিতে দাঁড়িয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে থাকেন, এই সীমাহীন আবেদন আবুবকরকে পীড়িত করে, তাই তিনি প্রফেটকে বলতে বাধ্য হন— ‘হে আল্লাহর রসূল আপনার এই লাগাতার আবেদনে হয়তো আল্লাহ বিরক্ত হতে পারেন। কারণ তিনি নিশ্চয়ই আপনাকে সাহায্য করবেন ও মনোবাঞ্ছা পূরণ করবেন। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে প্রফেট মোহাম্মদ অতিরিক্ত টেনশন ও উত্তেজনার কারণে এক সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।

যখন যুদ্ধ ঘোরতর আকার ধারণ করে তখন হঠাৎ আচমকা এক ধূলিঝড় উঠে মক্কানদের বিপর্যস্ত করে তোলে। এই অবস্থা দেখে প্রফেট মোহাম্মদ চিৎকার করে বলে ওঠেন- শত্রুদের ওপর হাজার ফেরেশতার আক্রমণ হচ্ছে’। এই ঘটনা কোরানেও উল্লেখিত হয়েছে, ‘যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সিদ্ধান্তে অটল থাক এবং শত্রু তোমার ওপর হামলা চালায় তখন আল্লাহ তাঁর পাঁচ হাজার ফেরেশতা পাঠিয়ে সাহায্য করবে (৩ : ১২২)।

মুসলিম ট্র্যাডিশনে বলা হয়েছে যে, বদর যুদ্ধে মক্কাবাসীদের জোয়েল ইবন সাকোরা, স্থানীয় গোত্রের প্রধান শয়তানের বেশ ধরে সাহায্য করেছে। সে মক্কাবাসীদের যুদ্ধজয়ের নিশ্চয়তা প্রদান করেছিল, কিন্তু যুদ্ধের গতি যখন উল্টে যায় তখন সে পালিয়ে প্রাণ বাঁচায়। পলায়নপর গোত্র প্রধানকে জিজ্ঞাসা করলে জবাবে সে বলে- ‘তোমরা যা দেখনি, আমি তা দেখেছি’ (৪ : ৫০) অর্থাৎ ফেরেশতারা মুসলিমদের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধ করছিল।

ঐতিহাসিকগণ বলেন – ৭০০ মক্কাবাসী ৩৫০ জন মুসলিম সেনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে এবং মুসলিমরা জয়ী হয়। প্রফেটের দিকে ১৫ জন হত হয়, আর মক্কাবাসীদের ৫০ জন। মক্কানদের মধ্যে নিহত হয়েছিল আবু জাহেল এবং অন্য প্রধান ব্যক্তিরা এদের মধ্যে ছিল আবু সুফিয়ানের জ্যেষ্ঠ পুত্র। এই যুদ্ধে উভয় পক্ষ খুব বেশি হিংসাত্মক ছিল না, কারণ মক্কাবাসীরা হঠাৎ আক্রমণে বিব্রত হয়ে আত্মরক্ষা ও কাফেলা রক্ষায় ব্যস্ত ছিল। আর মুসলিমদের কাছে যারা বন্দি হয়েছিল তাদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করা হয়নি। বেশ কয়েক জনকে মুক্তিপণ দিয়ে মুক্তি দেয়া হয়।

৬২৪ সালে জুলাই, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে প্রফেট মোহাম্মদ বদর যুদ্ধ জয়ে উদ্বুদ্ধ হয়ে মক্কানদের বাণিজ্য কাফেলায় আরও তিনটি আক্রমণ চালান এবং বেশ কিছু মালেগণিমত অর্জন হয়। শেষে মক্কাবাসী আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে তিন হাজার সমর্থ লোকদের নিয়ে এক বাহিনী গঠন করেন এবং ৬২৫ সালে ২৩ মার্চ মক্কা থেকে প্রায় ৬ মাইল উত্তরে মদিনার কাছাকাছি ওহুদ পাহাড়ে মদিনা আক্রমণে প্রস্তুতি নেয়া হয়। এই ওহুদ যুদ্ধে উভয় পক্ষের মোকাবেলা হয়।

ঐতিহাসিকদের মতে, মুসলিম পক্ষে ৭০০ জন যোদ্ধা ছিল যা অতি সহজেই মক্কাবাসীরা ছত্রভঙ্গ করে দেয়। প্রফেট মোহাম্মদ পলায়নপর লোকদের থামাতে চেষ্টা করে বলেন যে, তিনি খোদার প্রেরিত পুরুষ, তাঁর ওপর বিশ্বাস রেখে ঘুরে দাঁড়াও কিন্তু কোনো ফল হয়নি। মক্কানদের একটি ক্ষুদ্র দল প্রফেটকে আক্রমণ করলে তিনি বল্লাম দিয়ে একজনকে আঘাত করেন ফলে তার মৃত্যু হয়। প্রফেট নিজে একখণ্ড পাথর দ্বারা মুখে আঘাত পান ফলে তার ঠোঁট কেটে যায় ও দুটো দাঁত পড়ে যায়। তিনি তার গালে ও পায়েও আঘাত পান এবং গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে তিনি মারা গেছেন। তার জীবন রক্ষা পায় একদল নিবেদিত অনুসারীদের প্রাণপণ প্রচেষ্টায়, যারা তাদের ঘিরে এক নিরাপদ গুহাগাত্রে আশ্রয় নেয়। সেখানে তাঁর ক্ষতস্থান ধৌত করে প্রাথমিক চিকিৎসা করা হয়।

মক্কাবাসীদের জয়ের জন্য প্রধান কারণ ছিল খালিদ ইবন ওয়ালিদের অসাধারণ রণদক্ষতা। খালিদ ছিলেন মাখজুম গোত্রভুক্ত। ইনি পরবর্তীতে মুসলিম দলে যোগ দেন এবং মুসলিম সেনাবাহিনীর এক মহান জেনারেল হিসাবে ইসলামের ইতিহাসে স্থান করে নেন।

ওহোদের যুদ্ধে মুসলিম পক্ষে ৭০ জন নিহত হয় যার মধ্যে প্রফেটের চাচা হামজাও ছিলেন। আর মক্কাবাসীদের মাত্র ১৭ জন প্রাণ হারায়। এই যুদ্ধে মুসলিম সেনাবাহিনীর মনোবল প্রায় ভেঙে যায়। লোকজন হতাশ হয়ে পড়ে বিশেষ করে ঐশীবাণীর নিশ্চয়তার প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে যেখানে বলা হয়েছে- “দশজন সবল মুসলিম ২০০ জন বিধর্মীকে পরাস্ত করবে, আর একশ’ জন করবে ১০০০ হাজারকে (৮ : ৬৬)। বদরের যুদ্ধের জয় ফেরেশতাদের অংশগ্রহণের কাহিনী ওহোদ যুদ্ধের পরাজয়ের গ্লানিকে মুছে দিতে পারল মানুষের মন থেকে। একে সুসমন্বয় করে আশ্বাস বাণীসহ পরবর্তী ওহি নেমে এলো (৩ : ১২০ – ২০০) আল্লাহ এই পরাজয়ে মুসলিমদের পরীক্ষা করলেন- এই বলে সান্ত্বনা দেওয়া হলো।

এই বিজয়ের সূত্র ধরে মক্কাবাসীরা আর আক্রমণ চালায়নি এবং ৬২৬ সালের এপ্রিল হতে, এক বছর বিশ্রাম নিয়ে প্রফেট মোহাম্মদ আবার মার্চেন্ট ক্যারাভান আক্রমণ শুরু করলেন। এই সব আক্রমণ থেকে মালেগণিমতের (spoils) শনৈ শনৈ আয়তন বৃদ্ধি পেল এবং মদিনার মুসলিম সম্পদ হিসাবে উট, দাস, বন্দি নারী ও শিশুর সংখ্যা বেড়ে যেতে থাকল! এই না দেখে মুসলিম দলে অন্যান্য গোত্র যোগ দিয়ে বাণিজ্য ক্যারাভান আক্রমণে অংশ নিয়ে নিজেদের অবস্থান নিরাপদ করল, আবার মালেগণিমতের ভাগীদারও হলো।

কিছুদিন ধরে প্রফেট মোহাম্মদ সম্পদশালী ইহুদিদের অবস্থান (Settlement) দখল করার চিন্তাভাবনা করছিলেন, এখন তিনি তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে স্থির সিদ্ধান্ত হন। ৬২৪ সাল থেকে তিনি একে একে ইহুদিদের অবস্থানের ওপর দখল নেয়ার চেষ্টা করেন এবং সফলও হয়েছেন এবং ৬২৮ সালের মধ্যে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ ইহুদি গোত্র মদিনা বা এর আশপাশে আর রইল না। এই সময়ের মধ্যে অ- ইহুদি গোত্রদের বিরুদ্ধে অভিযান ও আক্রমণ চলতে থাকল এবং সাফল্যও এলো। সর্বমোট, এই অবস্থায় পৌঁছতে, প্রফেট মোহাম্মদকে ১০০শ’র বেশি আক্রমণ ও অভিযান সংগঠিত করতে হয়েছিল।

৬.৭ পার্সি সলমন

৬২৭ সালে এপ্রিল মাসে মক্কাবাসীরা একটা মরণপণ আক্রমণ করার পরিকল্পনা করল যাতে মদিনার মুসলিমদের বিষদাঁত ভেঙ্গে দেয়া যায়। এই উদ্দেশ্যে সাত হাজার লোকবল নিয়ে মদিনার দিকে যাত্রা শুরু হলো। মক্কানদের সাথে বেদুইন ঘাফতান ও আসাদ গোত্রও যোগ দিল, তাদের ওপর মুসলিমদের আক্রমণের প্রতিশোধ নিতে অবস্থা গুরুতর দেখা দিল এবং এই গুরুতর অবস্থায় প্রফেট মোহাম্মদ তাঁর সাথী (সাহাবী) পার্সি সলমনের পরামর্শ চাইলেন।

মদিনার দুর্বল দিকে সলমন ফার্সি পারস্য-স্টাইলে পরিখা খনন (খন্দক) করার পরামর্শ দিলেন এবং সেই পরামর্শে কাজ হয় যার ফলে শহরটি আক্রমণের হাত থেকে বেঁচে যায়। ‘আরবদের এমন খন্দক’ সম্বন্ধে কোনো ধারণা না থাকায় তারা আক্রমণের পথ খুঁজে পায়নি। তবুও মক্কাবাসীদের দুর্বল আক্রমণ মদিনাবাসীরা প্রতিহত করতে সমর্থ হয় এবং এইরূপে যুদ্ধে কোনো পক্ষই বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি। মক্কাবাসীরা ফিরে যায়। এই যুদ্ধ ‘খন্দকের যুদ্ধ’ নামে পরিচিত।

সলমন ফার্সি পূর্বে জোরান্দ্রিয়ান ছিলেন পরে খ্রিস্টান হন। পারস্যে জান্দিশাপুরে নেস্টোরিয়ান কলেজে তিনি শিক্ষা লাভ করেন এবং পরে সিরিয়াতে খ্রিস্টান কাব গোত্রে অনেক বছর অতিবাহিত করেন। পরে মদিনায় চলে যান। তিনি প্রফেট মোহাম্মদের ওহি লেখকদের (কাতিব) মধ্যে কেউ ছিলেন না, তবে প্রফেটের সঙ্গী হিসাবে আলাপ-আলোচনা করতেন। কথিত আছে যে, কোরানে শেষ বিচারের দিন, ফেরেশতা ও শয়তান-ইবলিস ইত্যাদি যে কথা বিধৃত আছে তার ধারণা সলমন ফার্সি ই দিয়েছেন।

প্রফেট মোহাম্মদ সলমন ফার্সির প্রজ্ঞাতে এতই মগ্ন হয়েছিলেন যে তিনি তাঁর অনুসারীদের বলেছিলেন— ১যদি সপ্তকন্যা নক্ষত্রপুঞ্জেও (Pleiades) জ্ঞান ভাণ্ডার থাকে তাহলে এই পারস্য জাতি সেই ক্ষেত্র থেকেও জ্ঞান আহরণ করে থাকে।’ দুষ্টু লোকেরা বলত প্রফেট সলমন ফার্সির কাছ থেকে অনেক মূল্যবান সলাপরামর্শ পেয়েছিলেন।

সলমন ফার্সি একান্ত মুসলিম ছিলেন কিনা এটা পরিষ্কার নয়। প্রফেটের মৃত্যুর পর তিনি মদিনা পরিত্যাগ করেন কারণ আলীর পরিবর্তে আবু বকরের খলিফা নির্বাচন তার মনোপূত হয়নি। তিনি মেসোপটেমিয়ায় রাবিয়াতে খ্রিস্টান গোত্র, হতে ইসলাম গ্রহণকারীদের সাথে বাস করার জন্য চলে যান। সেখানেই তার মৃত্যু হয় এবং স্টেসিফোন অথবা জেরুজালেমে সমাহিত হন।

শিয়া সম্প্রদায়ের নুসাইরিয়াদের জন্য যথেষ্ট কাজ করেছেন সলমন যার জন্য তাকে মুসাইরি সম্প্রদায় দেবতা জ্ঞান করে তাকে রহস্যবাদী ত্রিত্ববাদে পরিণত করেছিল প্রফেট মোহাম্মদ ও আলীর সাথে। অনেক সময় সলমন ফার্সিকে নুসাইরিরা ত্রিত্ববাদের অন্য দুটি অংশের চেয়ে বেশি মর্যাদা দিয়েছে (G. Levi della Vida, in SEI, 1974 p. 501) ।

৬.৮ প্রফেট মোহাম্মদের পত্নীগণ

প্রফেট মোহাম্মদের পারিবারিক জীবন সম্বন্ধে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন, ইবন ইসহাক, ইবন হিশাম, ইবন সাদ, ইবন হানবল, আল-তারাবী এবং অন্য ঐতিহাসিকগণ। হাদিসেও তাঁর ব্যক্তিগত পারিবারিক জীবন সম্বন্ধে বর্ণনা রয়েছে। একটি হাদিসে বলা হয়েছে যে প্রফেট মোহাম্মদের তিনটি প্রিয় দ্রব্য ছিল- সালাত, সুগন্ধি এবং নারী। কোরানেও নারীর জন্য প্রফেটের দুর্বলতার ইঙ্গিত আছে (৩৩ : ৫২)। ইবন আরাবীর মতে, প্রফেট বলেছিলেন যে নারীর মধ্যে তিনি স্বর্গীয় অনুভূতি পেতেন। আল্লাহ নারীকে আমার কাছে প্রিয় বস্তুরূপে দান করেছেন (Sehuon, 1976, p. 185)। তুর্কি পণ্ডিত নাবিয়া এবট-এর মতে, প্রফেট মোহাম্মদ ছিলেন ইসলামের এবাদতকারী ও সুগন্ধি প্রিয় রসূল এবং “avowedly a great lover of ladies” -দুর্দান্তভাবে নারীপ্রিয়।

বলা হয় যে প্রফেট মোহাম্মদ একবার প্রিয় তরুণী পত্নী আয়েশাকে বলেছিলেন যে, যদি তিনি প্রফেটের পূর্বে মারা যান তাহলে তার শেষকৃত্য অতি সম্মান ও জাকজমকের সাথে করবেন। উত্তরে আয়েশা বলেন- ‘হ্যাঁ তা করবে, তবে তার পরেই সোজা অন্য নারীর কাছে যাবে আনন্দ করতে; তারপর আর একটি নতুন কচি বৌ আমার স্থলে নিয়ে আসবে।’ একথা শুনে ইবন ইসহাক লিখেছেন, প্রফেট মুচকি হেসেছিলেন।

প্রফেট মোহাম্মদের নারীপ্রীতি এবং ঘন ঘন বিবাহ তাঁর সমসাময়িকদের মধ্যে আলোচ্য বিষয় ছিল। তাঁর বিরুদ্ধবাদীরা অভিযোগ করেছিল এই বলে যে, তিনি নিজেকে মেয়েদের সান্নিধ্যে ডুবিয়ে রাখতেন, যা একজন প্রফেটের চরিত্রের সাথে সামঞ্জস্য নয়- (not in keeping with the character of a Prophet) এবং তিনি এক দাম্পত্য সমস্যা সম্পর্কে স্বর্গীয় নির্দেশ ও অনুপ্রেরণা পাওয়ার ভান করতেন।

ইহুদিরা একটা প্রবাদ বাক্য অনুসরণ করত- Carnality precludes prophecy- ইন্দ্রিয়বিলাস ভবিষ্যদ্বাণী নিবারণ করে; তাই তারা বলত যদি প্রফেট মোহাম্মদ একজন প্রফেট বলে দাবি করেন তাহলে তার নারী প্রিয়তা থাকা উচিত নয়। তারা বলত ‘এ কী ধরনের প্রফেট যে কেবল বিবাহের চিন্তা করে’? (Andrae, 1960 p. 188)। এবং যে সন্দেহজনক পরিস্থিতিতে তিনি তাঁর জন্য নারী গ্রহণ করেন- যেমন রায়হানা ও সাফিয়া। এ আচরণ একজন ঐশী নির্দেশপ্রাপ্ত ব্যক্তির ব্যবহারের সাথে খাপ খায় না।

কোনো কোনো মুসলিম লেখক প্রফেটের স্বভাবের এই দিকটাকে মনে করেন “Superior Virility” অর্থাৎ অতি উন্নত পুরুষত্ব এবং সত্য সত্য তারা বলে গেছেন যে তিনি এক রাতে তার সব ক’টি স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করতে পারেন। তারা তাঁর বহু বিবাহকে কয়েকটি কারণে সমর্থন করেছেন : যেমন, যখন কোনো সম্প্রদায়ের মধ্যে হৃদ্যতা বা আনুগত্য লাভের কারণে সে গোত্রের কন্যার পাণিগ্রহণ করেন; কোনো কোনো পরিবারের বাধ্যতা আদায়ের কারণে সে পরিবারের কন্যাকে গ্রহণ করেন। সামাজিক মর্যাদা বাড়ানোর জন্য একাধিক স্ত্রী প্রয়োজন হয়েছিল; কিছু বিধবার স্বামী ও এতিম কন্যার পিতারূপে অসহায় বিধবা ও এতিম কন্যাদের আশ্রয় দিয়েছেন এবং তিনি ‘পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা’ এই প্রবচনে বিশ্বাস করে একাধিক বিবাহ করেন তাঁর ওপর আরোপিত ‘আবতারা’ পুত্রহীন অপবাদ ঘুচাবার জন্য।

কোরান মুসলিমদের জন্য চারটির বেশি স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি দেয়নি, কিন্তু প্রফেটের জন্য “বিশেষ ওহি’ দ্বারা এ বিধানের ব্যতিক্রম ছিল। সাধারণ হিসাবে প্রফেটের এগারো জন স্ত্রী ছিল, কোনো কোনো হাদিস মতে তার ছিল বাইশটি (Hughes 1977 P. 400)। এই বাইশটি পত্নীর মধ্যে কয়েকটি অকার্যকর (invalid) হয়, কারণ শর্ত পূরণ হয়নি, কয়েকজনের সাথে মিলন হয়নি (never cousumated) এবং কয়েকজন তালাকপ্রাপ্ত। কয়েকজন ইচ্ছাকৃতভাবে প্রফেটকে ছেড়ে গেছে। কয়েকটি বিবাহ স্থির করেও শেষ মুহূর্তে ভেঙে যায় এবং কয়েকটি ছিল অস্থায়ী।

এইভাবে প্রফেট ৬৩০ সালে দুটো বিবাহ করেন। একজন আসমা বিন্ত নুমান কিন্দা গোত্রের কন্যা, কিন্তু তিনি (প্রফেট) তাকে ফেরত পাঠিয়ে দেন কোনো কারণে। অন্য জন ছিল কিলাব জাতির ওয়াহিদ গোত্রের এয়াজিদের কন্যা আমরা। তিনি প্রফেটকে বিয়ে করতে অনিচ্ছুক ছিলেন কারণ তার বাবা মুসলিম কর্তৃক নিহত হয়েছিলেন, পরে বিয়ে হলেও প্রফেট তাকে তালাক দেন। ট্র্যাডিশনে আরও আছে যে প্রফেট একবার ইবন আব্বাসের শিশুকন্যা উম্মে হাবিবকে হামাগুড়ি দিতে দেখে ব্য করেন এই মেয়ে বড় হলে এবং তিনি বেঁচে থাকলে, তাকে বিয়ে করবেন। কিন্তু মেয়েটির শিশু অবস্থাতেই প্রফেট মারা যান (Guillaume 1960, P. 55)।

প্রফেট মোহাম্মদের মদিনায় নিয়মিত (regular) স্ত্রীদের জন্য এক রুমঅলা এপার্টমেন্ট ছিল যা মসজিদের পূর্ব দিক সংলগ্ন এবং স্ত্রীর সংখ্যা বাড়ার সাথে ঘরের সংখ্যাও বেড়ে যায়। সাধারণভাবে গৃহীত স্ত্রী-সংখ্যা নিম্নরূপ :

(১) খাদিজা প্রফেট মোহাম্মদের প্রথম স্ত্রী। মক্কায় থাকা অবস্থায় তিনি মারা যান। প্রফেট মোহাম্মদ চব্বিশ বছর ধরে স্ত্রী-আনুগত্য (fidelity); মনে করা হয় আংশিকভাবে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা যা তার প্রতি ছিল; কিন্তু এটা বলা হয়ে থাকে যে অর্থ ও সম্পদের কারণে এবং যে প্রভাব ও নিরাপত্তা খাদিজা দিয়েছিলেন সেই জন্য স্বামীকে এক বিবাহে সন্তুষ্ট থাকতে বাধ্য করার মতো অবস্থা খাদিজার ছিল। তাই খাদিজার জীবদ্দশায় প্রফেট দ্বিতীয় বিবাহের চেষ্টা করেননি। যাই হোক, আরব লেখকদের মতে, প্রফেটের অদম্য পুরুষত্ব, খাদিজার মৃত্যুর প্রায় এক মাস পরেই তিরিশ বছরের বিধবা সওদাকে বিবাহ করে ঘরে তোলেন, যদিও স্ত্রী খাদিজার মৃত্যু তাঁকে দুঃখ দিয়েছে।

(২) সওদা বিনত জামাআ সাকরানের বিধবা স্ত্রী। প্রফেটের সাথে বিয়ে হয় ৬১৯ খ্রিস্টাব্দে যখন তাঁর বয়স প্রায় তিরিশ। সময়ের সাথে বয়স বাড়লে প্রফেট তাকে অবজ্ঞা করতে থাকেন এবং ৬৩০ সালে তালাক দেন। কিন্তু সওদা এই অপমান এড়ানোর জন্য প্রফেটের কাছে আবেদন করেন যে তার পালাটা তিনি আয়েশাকে দিলেন, যদি তাকে ফিরিয়ে নেয়া হয়। প্রফেট এই শর্তে তাকে পরিবারে রেখে দেন।

(৩) আয়েশা, প্রফেটের প্রিয় পত্নী- আবু বকরের কন্যা, পরে খলিফা হন। আয়েশা ইসলামের প্রাথমিক যুগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

(৪) ওমরের কন্যা হাফসা। ওমর দ্বিতীয় খলিফা হন পরে। স্বামী খুনাইজ যখন মারা যায়, হাফসার বয়স ছিল সতের। বদরের যুদ্ধে (৬২৫) তার স্বামী নিহত হলে প্রফেট হাফসাকে বিয়ে করেন। হাফসা ও আয়েশা দু’জনেই বন্ধু ছিলেন। ৬৭০ সালে হাফসা মারা যান।

(৫) জয়নাব বিনত খোজাইমা ওবাইদার স্ত্রী ছিলেন। ওবাইদা বদরের যুদ্ধে মারা যান; তিনি প্রফেটের কাজিন ছিলেন। প্রফেট ৬২৬ সালে জানুয়ারি মাসে জয়নাবকে বিয়ে করেন, তখন তার বয়স ছিল তিরিশ। বিয়ের আট মাস পরেই জয়নাব মারা যান।

(৬) উম্মে সালমা ছিলেন মঞ্চজুম গোত্রের মেয়ে বিবাহ হয় আবু সালামার সাথে। ৬২৫ সালে ওহুদের যুদ্ধে আহত হওয়ার কারণে মারা যান। প্রফেট এবং তাঁর দুই শ্বশুর আবু বকর ও ওমর তিনজনই প্রার্থী ছিলেন এই বিধবার পাণি গ্রহণে। উম্মে সালমা প্রফেটের উদ্দেশে বলেন যে, তার চারজন স্ত্রী বর্তমান সওদা, আয়েশা, হাফসা ও জয়নাব; সুতরাং এ বিবাহ হয় কি করে? তখন চারের অধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি দিয়ে প্রফেটের জন্য ওহি নাজেল হয় (৩৩ : ৪৯)। ৬২৬ সালে মার্চ মাসে প্রফেট উম্মে সালমাকে বিবাহ করেন। তখন তার বয়স ঊনত্রিশ। প্রফেটের হেরেমে তিনি আলীর পত্নী (প্রফেটের কন্যা) ফাতিমার সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন। প্রফেটের মৃত্যুর পর তিনি বেঁচে ছিলেন।

(৭) জয়নাব বিনত জাহাশ প্রফেটের পালক-পুত্র জায়েদ ইবন হারিথের স্ত্রী। জায়েদ জয়নাবকে তালাক দিলে প্রফেট তাকে বিবাহ করেন।

(৮) জুয়াইরিয়া আবু দিরারের পুত্র হারিখের কন্যা। আবূ দিরার বানু মুস্তালিকের গোত্র প্রধান। বানু মুস্তালিক খোজা গোত্রের শাখা। জুয়াইরিয়ার বিবাহ হয় ঐ গোত্রের একজনের সাথে। বানুমুস্তালিক গোত্রের বিরুদ্ধে এক অভিযানকালে জুয়াইরিয়া বন্দি হন। প্রফেট মোহাম্মদ মুক্তিপণ দিয়ে এক নাগরিকের কাছ থেকে মুক্ত করে ৬২৮ সালে জানুয়ারি মাসে বিয়ে করেন। তখন তিনি বাইশ বছরের সৌন্দর্যময়ী নয়নন্দন তরুণী।

(৯) উম্মে হাবিবা (মৃত ৬৬৫) আবু সুফিয়ানের কন্যা এবং ওবাইদুল্লাহর স্ত্রী। ওবাইদুল্লাহ আবিসিনিয়াতে মৃত্যুবরণ করেন ৬২৮ সালে। প্রফেট তাকে বিবাহ করতে মনস্থ করেন ইদ্দত কাল শেষ হওয়ার পর, আবিসিনিয়ার শাসকের সম্মুখে ‘প্রক্সি’ দিয়ে এ বিবাহ সম্পন্ন হয়। উম্মে হাবিবা প্রফেটের সাথে মদিনায় যোগ দেন ৬২৮ সালেই। তখন তার বয়স পঁয়ত্রিশ। ফাতিমার সাথে এর সখ্য গড়ে ওঠে I

(১০) সাফিয়ার প্রফেটের সাথে বিবাহ হয় যখন তিনি ইহুদি অবস্থান খাইবার দখল করেন। আয়েশার সাথে সখ্য গড়ে ওঠে। মারা যান ৬৭২ খ্রিস্টাব্দে।

(১১) মায়মুনা, হারিথের কন্যা, উম্মুল ফজলের বোন ও আব্বাসের (প্রফেটের চাচা) শালি। শিষ্ট স্বভাবের বিধবা মহিলা। ছাব্বিশ বছর বয়স। প্রফেট ৬২৯ সালে মক্কায় হজের সময় মায়মুনাকে বিবাহ করেন। প্রফেটের মৃত্যুর পর বেঁচে ছিলেন, বিরাশি বছরে মারা যান। ‘আল্লাহর তরবারি’ খালিদ ইবন ওয়ালিদের খালা বা ফুপু অর্থাৎ আন্টি ।

৬.৯ আয়েশা

৬২১ খ্রিস্টাব্দে হিজরতের পূর্বে প্রফেট মোহাম্মদ সাত বছরের এক বালিকার সাথে বাগদত্ত হন। আয়েশা আবু বকর ও তার স্ত্রী উম্মে রুমানার কন্যা। প্রফেট মোহাম্মদের সাথে যোগসূত্র মজবুত করার জন্য জুবের ইবন মোতাম নামক এক যুবকের সাথে বাগদান ছিন্ন করেন প্রফেটের স্থান করার জন্য। জুবেরের পিতামাতা প্যাগন ছিলেন, এই সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ায় তারা খুশিই হয়েছিল। কারণ তারা ভয় করেছিলেন বিয়ের পর হয়তো তার সন্তান মুসলমান হয়ে যাবে।

৬২৩ সালে হিজরাতের ন’মাস পরে আয়েশার বয়স হলো ন’বছর। সূত্র মতে, তখনো সে পুতুল নিয়ে খেলত। এই ন’বছর বালিকার সাথে ৫২ বছরের প্রফেট বিবাহ-মিলন সম্পূর্ণ (consummate) করেন। আয়েশা একমাত্র কুমারী স্ত্রী এবং তাদের দাম্পত্য জীবনে কোনো সন্তান আসেনি। খাদিজার মৃত্যুর পর আয়েশা প্রফেটের প্রিয়তমা পত্নী হিসাবে ছিল প্রফেটের মৃত্যু পর্যন্ত। তাঁর ঘরেই বুকে মাথা রেখে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

আয়েশার বর্ণনা মতে, প্রফেট মোহাম্মদ যখনই কোনো কারণে বা অভিযানে মদিনার বাইরে যেতেন তিনি লটারি করতেন তার সাথে কোন স্ত্রী যাবে। ৬২৭ খ্রিস্টাব্দে বানু মুস্তালিকের বিরুদ্ধে অভিযানকালে তিনি আয়েশাকে সাথে নেন। পরের মাসে ফিরে আসার সময়, মদিনা পৌঁছবার মুখে একস্থানে বিশ্রাম গ্রহণ করেন। কাকভোরে, আয়েশা একটু অন্ধকার থাকতে, তার হাওদা ছেড়ে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে যান এবং এই সময়ে তার অজান্তে গলার হার পড়ে যায়। যখন ফিরে এলেন তখন লোকেরা যাত্রা করার জন্য তাঁবু গোটাতে শুরু করেছে। এই সময়ে তিনি গলায় হাত দিয়ে বুঝতে পারেন হার কোথাও পড়ে গেছে। তিনি ফিরে গিয়ে মরুর বালুতে খুঁজতে শুরু করেন এবং শেষে পেয়েও যান।

তাঁবুর কাছে ফিরে এসে দেখেন যে তাদের কাফেলা তার হাওদাসহ উঠে গেছে কিন্তু কারোর নজরে পড়েনি যে তিনি নিজের হাওদায় নেই। তিনি নিজেকে তার চাদরে জড়িয়ে নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন, এই আশায় যে হয়তো তাকে না দেখে কেউ ফিরে আসবে তাকে নিতে। ইত্যবসরে ঐ দলের অন্য একটি গ্রুপের এক তরুণ সদস্য সাফওয়ান ইবন মোযাত্তাল (সোলাইম গোত্র) পেছনে আসছিলেন। আয়েশাকে দেখে প্রফেটের স্ত্রী বলে চিনতে পারলেন সাফাওয়ান, তাই তার উটকে আয়েশার সামনে বসিয়ে চড়তে বলেন। আয়েশা উটের পিঠে উঠে বসলে সাফওয়ান উটের রশি ধরে হাঁটা শুরু করেন। আয়েশা কোনো কথা না বলে চুপচাপ ছিলেন, কিন্তু মুখে পর্দা ছিল, শরীর ছিল চাদরাবৃত্ত।

পরের দিন সকালে মদিনাতে মূল পার্টির সাথে যখন দেখা হয়, আয়েশা তখন ঘটনার বিবৃতি দেন; কিন্তু লোকেরা এর অন্য অর্থ করে আয়েশার চরিত্রের বিরুদ্ধে গুজব ছড়ানো শুরু করে। হামনা বিনত জাহাশ, প্রফেটের স্ত্রী জয়নাবের বোন, এমনও অভিযোগ তুলল যে আয়েশা ও সাফাওয়ান অনেক দিন ধরেই একে অন্যকে চেনে এবং এর পূর্বেও তাদের মধ্যে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। আয়েশার বিরুদ্ধে অপবাদকারীদের মধ্যে ছিল আব্দুল্লাহ ইবন ওবেই, খাজরাজ গোত্র প্রধান এবং প্রফেট মোহাম্মদের নিয়োগকৃত কবি হাসান বিন থাবিত। প্রফেট মোহাম্মদের জামাতা আলী (ফাতিমার স্বামী) প্রফেটকে বলেন মেয়ের কি অভাব আছে। ওকে ত্যাগ করে নতুন একটা গ্রহণ করুন।

এই স্ক্যান্ডালে প্রফেট হতচকিত হয়ে ভীষণভাবে বিমর্ষ হয়ে পড়েন এবং পরবর্তীতে কী করবেন ভেবে পান না, তবে আয়েশা থেকে দূরে সরিয়ে রাখেন নিজেকে; কিন্তু তাঁর এই ক্ষণ বিচ্ছেদের ভার তাঁর সহ্যের বাইরে চলে যায়। তারপর এক মাস গত হলে তিনি ওহি পান (২৪ : ১১) যেখানে আয়শাকে সন্দেহাতীতভাবে নির্দোষ বলা হয় এবং এই ঐশী নির্দেশে অপ্রীতিকর অবস্থার নিষ্পত্তি হয়। কিন্তু আর কখনো কোনো ভবিষ্যৎ অভিযানে আয়েশাকে একা সঙ্গে নেননি। গুজব- ছড়ানোকারীদের মধ্যে কয়েকজন পুরুষকে, কবি হাসান ইবন থাবিতসহ, চাবুক মারা হয়; তবে আব্দুল্লাহ ইবন ওবেই-কে তার পদমর্যাদার জন্য ছেড়ে দেয়া হয়।

আয়েশার ঘরটি মদিনা মসজিদের চত্বরের দিকে খোলা ছিল যে চত্বরে প্রফেট কোনো ব্যক্তি বা দলের সাথে সামাজিক এবং রাজনৈতিক আলোচনা করতেন। এই কারণে কি আলোচনা হয় বা বিষয়বস্তু কি, সে সম্বন্ধে আয়েশার জানতে অসুবিধা হতো না। বিশ্বাস করা হতো যে আয়েশা এই সব আলোচনার বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রশ্ন জড়িত থাকলে তার সারাংশ তার পিতা আবু বকরকে অবহিত করতেন যাতে তার রাজনৈতিক জীবনকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করত।

এটা আরো বলা হয়েছে যে আয়েশা তার প্রতি প্রফেটের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে প্রফেটের মতামতকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করতেন। প্রফেটের হেরেমের মধ্যে দুটি প্রধান দল ছিল যা একে অপরের সাথে তিক্ত-শত্রুতা বিরাজ করত। একটা দলের নেতৃত্ব দিতেন আয়েশা, তার সাথে ছিলেন ওমরের কন্যা হাফসা আর প্রফেটের ইহুদি স্ত্রী সাফিয়া। অন্যটির নেতৃত্বে ছিলেন প্রফেটের কন্যা ফাতেমা, সাথে ছিলেন উম্মে সালমা আর উম্মে হাবিবা।

আল-বোখারী, ইবন হানবাল এবং ইবন সাদ-এর মতে প্রফেট মোহাম্মদ, আয়েশা কাছে থাকলে, অনুপ্রাণিত হতেন, বেশি ওহি পেতেন এবং এই অনুপ্রাণিত ওহি নিয়ে রচিত সূরার সংখ্যা বেশিই হতে পারে। যখন উম্মে সালমা আয়েশার প্রতি পক্ষপাতিত্বের কারণে প্রফেটের কাছে অভিযোগ করেন তখন সে-অভিযোগ নাকচ করে বলেছিলেন— আয়েশা সম্বন্ধে আমাকে বিরক্ত করো না। সেই একমাত্র স্ত্রী যে সাথে থাকলে আমি যে কোনো ওহি পেতে পারি।

এটাও গুরুত্বপূর্ণ যে, ২০০০ বেশি হাদিস আয়েশা দ্বারা বর্ণিত এবং যদিও জ্ঞানী পণ্ডিতদের দ্বারা তার বেশির ভাগ হাদিস বাতিল হয়েছে তবুও ১৭০-র বেশি হাদিস সত্য বলে গৃহীত এবং বলা হয় যে প্রফেট স্বয়ং নিজেই তাঁর বাণী আয়েশাকে দিয়েছিলেন।

তরুণী পত্নী হিসাবে আয়েশা প্রফেট মোহাম্মদ ও তাঁর শিক্ষার গতিকে বেশ ভালোভাবেই বুঝতে ও আয়ত্ত করতে পেরেছেন। একটা ট্রাডিশন আছে যে, মদিনা থেকে বাইরে গেলে তাঁর অবর্তমানে তিনি তার অনুসারীদের নির্দেশ দিয়ে যেতেন এই বলে যে, যদি কোনো ধর্মীয় সমস্যা উত্থাপিত হয় তাহলে আয়েশার মতামত নিতেন। (Armstrong, 1991 P. 240)

প্রফেট যখন মারা যান তখন আয়েশার বয়স আঠারো বছর এবং তিনি যেমন বুদ্ধিমতী ছিলেন তেমনি সুন্দরী, কিন্তু অন্য স্ত্রীদের মতো তিনিও কোরানের বিধান মতে দ্বিতীয় বিবাহ করতে পারেননি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি তাঁর রাজনৈতিক জীবনে বড় সক্রিয় ছিলেন। তিনি তৃতীয় খলিফা ওসমান ও চতুর্থ খলিফা আলীর বিরুদ্ধাচরণ করেছেন এবং প্রফেটের মৃত্যুর পঁচিশ বছর পর তিনি আলীর বিরুদ্ধে উটের যুদ্ধে তার মিত্রদের নিয়ে যুদ্ধরত ছিলেন।

৬৭৮ খ্রিস্টাব্দে ৬৪ বছর বয়সে অজানা এক রোগে মারা যান। নাবিয়া এবট তার শেষ অসুখের বিবরণ পড়ে বলেন যে, আত্মিক বিজয় বা স্বর্গীয় অনুভূতির কোনো চিহ্ন তিনি রেখে যাননি, যা একজনের বিস্ময়ের উদ্রেক করে। সত্যি, তিনি বলতেন তার জন্ম না হলেই ভালো হতো এবং তিনি আশা করতেন, বিস্মৃতির তলে তলিয়ে যেতে। তিনি নির্দিষ্টভাবে বারণ করেছিলেন, তার সমাধি যেন প্রফেটের পাশে না হয়; মদিনার বাইরে বাকি সমাধি ক্ষেত্রে তাকে সমাহিত করা হয়।

৬.১০ জয়নাব বিনত জাহাশ

শুধু আয়েশার ব্যাপারটা নিয়ে তৎকালীন মুসলিমদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়নি; আরও একটি ঘটনা এর আঠারো মাস পূর্বে ঘটেছিল, যে-ঘটনা কম আলোড়ন সৃষ্টি করেনি। এ ঘটনাটি ছিল প্রফেটের ফুপাতো বোন জয়নাব বিনত জাহাশের (ওবাইদুল্লাহ ইবন জাহাশের বোন) সাথে প্রফেটের বিবাহের ব্যাপারটি। জয়নাব সে সময়ে প্রফেটের পালিত পুত্র (দত্তক পুত্র) জায়েদ বিন হারিথের বৈধ স্ত্রী।।

প্রফেট মোহাম্মদ তাঁর সাহাবী ও অনুসারীদের সাবধান করেছিলেন তারা যেন কারোর অবর্তমানে তার গৃহে পদার্পণ না করে। ৬২৬ সালে আগস্ট মাসে তিনি নিজেই জায়েদের গৃহে গমন করেন এবং জায়েদকে অনুপস্থিত দেখে ফিরে আসার জন্য তৈরি হন তখন, তারাবী বর্ণনায়, তিনি হঠাৎ জয়নাবকে মনোহর মূর্তিতে (ravishing) দেখতে পান। জয়নাব তখন স্বল্পবাসে আবৃত ছিলেন। তিনি দৃষ্টি ফিরিয়ে নেন। কিন্তু জয়নাবের রূপমাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে আর একবার সেদিকে তাকিয়ে মুগ্ধকণ্ঠে বলে ওঠেন— সব প্রশংসা আল্লাহর যিনি মানুষের হৃদয় তার ইচ্ছামতো পরিচালিত করেন। পরে সকলকে সাবধান করে দেন, কোনো নারীর প্রতি দ্বিতীয়বার দৃষ্টি না দিতে, প্রথম দৃষ্টি ধর্তব্যের মধ্যে নয়, তবে দ্বিতীয় দৃষ্টি নিষিদ্ধ।

তাৎক্ষণিকভাবে ঘরে ফিরে এসে তিনি তার পঞ্চম পত্নী জয়নাব বিনত খোজাইমার সাথে শয্যা গ্রহণ করেন। একটি হাদিসে আছে প্রফেট বলেছেন : যখন কোনো রমণীকে দেখে তুমি আকৃষ্ট হও, তৎক্ষণাৎ ঘরে ফিরে স্ত্রী সহবাস করবে; কারণ সেই নন্দিত নারীর যা আছে, তোমার স্ত্রীরও তাই আছে। (Mernissi, 1975 P. 11)।

জয়নাব বিনত জাহাশ মেজাজকুট্টি মহিলা ছিলেন। তিনি এক সাবেক ক্রীতদাসের সাথে তার বিবাহ কোনো মতেই মেনে নেননি। তার স্বামী (জায়েদ) ফিরে এলে ঘটনা বিবৃত করেন এবং প্রফেট মোহাম্মদ তাকে সে অবস্থায় দেখে যা বলেছিলেন তা-ও ব্যক্ত করেন। প্রফেটকে আকৃষ্ট করেছে জেনে, জয়নাব তার স্বামীকে শাস্তিতে থাকতে দেননি যতক্ষণ পর্যন্ত জায়েদ তার সাথে সম্পর্ক ছেদ করে প্রফেটের সাথে বিবাহের জন্য তালাক না দেয়।

চার মাসকাল ইদ্দত পালনের পর প্রফেট মোহাম্মদ জয়নাব বিনত জাহাশকে বিবাহ করেন ২৭ মার্চ ৬২৭ খ্রিস্টাব্দে জয়নাবের বয়স যখন বত্রিশ বছর যখন তিনি প্রফেটের সপ্তম স্ত্রী হয়ে হেরেমে প্রবেশ করেন। তিনি মারা যান ৬৪১ সালে।

পালিত পুত্রের স্ত্রীর সাথে বিবাহ আরব রীতি মতে নিষিদ্ধ এবং যেমন ইবন হিশাম বলেন, এই ঘটনা আরবে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং মদিনার মুসলিম সম্প্রদায় সাধারণ মানুষ নিন্দিত করে এই বলে যে এই বিবাহ অজাচার তুল্য।

কিন্তু সমস্যার সমাধান হয় যখন প্রফেট মোহাম্মদ একটি বিশেষ নির্দিষ্ট ওহি পেলেন, যা কোরানে বিধৃত, ‘…অতঃপর জায়েদ যখন জয়নাবের বিবাহ সম্পর্ক ছিন্ন করিল, তখন আমি তাহাকে তোমার সহিত পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ করিলাম। আল্লাহ যখন অনুমতি দিয়াছেন, প্রফেটর কোনো দোষ দেয়া যায় না। পরে জয়নাব গর্ব করে বলতেন যে প্রফেটের সাথে তার বিবাহ আল্লাহর আদেশেই হয়েছে এবং এর ঘটক আল্লাহ নিজেই (who was her match maker)। এই গর্বিত উক্তি আয়েশার বিরক্তির কারণ হতো। এই ওহিকে উল্লেখ করে আয়েশা প্রফেটের কাছে বক্রোক্তি করতেন এই বলে যে ‘আপনার প্রভু আপনার ইচ্ছা মিটাতে খুব তড়িঘড়ি সিদ্ধাস্ত দেন।’

৬.১১ মেরি দ্য কপ্‌ট

প্রফেটের বৈধ স্ত্রী ছাড়াও তার দু’জন উপপত্নী ছিল। একজন রায়হানা যাকে প্রফেট ৬২৭ সালে ঘরে এনেছিলেন ইহুদি গোত্র কোরাইজা নিধনের পর। অন্যজন ছিল মেরি দ্য কপট (মারিয়া কিবতিয়া) দু’জন খ্রিস্টান ক্রীতদাসের মধ্যে একজন যাদের ৬২৮ সালে মিশরের গভর্নর প্রফেটের কাছে পাঠিয়েছিলেন।

মেরি সুন্দরী ছিল এবং তার মাথার চুল ছিল কোঁকড়ানো। এই মহিলার কাছে প্রফেট দিনে-রাতে ঘন ঘন যাতায়াত করতেন। একবার হাফিসা মেরি ও প্রফেটকে একসঙ্গে ধরে ফেলেন। হাফিসা শুধু তার নিজের কামনায় তার বিছানায় যুগলবন্দি দেখেননি, ঐ দিনটি ছিল আয়েশার পালার দিন।

প্রফেট হাফসাকে অনুরোধ করেন এ ঘটনা আয়েশার কানে না তুলতে, এই শর্তে যে তিনি আর কোনো দিনই মেরির সঙ্গ হবেন না। হাফসা রাজি হন, কিন্তু ব্যাপারটি আয়েশার কাছে ব্যক্ত করায় সারা হেরেমে স্ক্যান্ডেল ছড়িয়ে পড়ে। এতে প্রফেট স্ত্রীদের কাছে, হেরেমের নিয়ম ভঙ্গের কারণে, শীতল আচরণ পেতে থাকেন।

মেরির সঙ্গে পুনর্মিলনের অঙ্গীকার থেকে মুক্ত হবার জন্য (কারণ তিনি মেরির সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন) তিনি এই ওহি পেলেন- “হে নবী আল্লাহ তোমার জন্য যাহা বৈধ করিয়াছেন, তুমি তাহা নিষিদ্ধ করিতেছে কেন? তুমি তোমার স্ত্রীদের সন্তুষ্টি চাহিতেছ? আল্লাহ তোমাদের কসম হইতে মুক্তি লাভের ব্যবস্থা করিয়াছেন এবং আল্লাহ তোমাদের কর্ম বিধায়ক” (৬৬ : ১-২)।

হাফসা ও আয়েশা মেরির সঙ্গলাভের ও তার কাছে যাওয়ার কারণে প্রফেট মোহাম্মদকে খোঁচা দিতে থাকেন, এতে প্রফেট ধৈর্য হারা হয়ে তাদের তালাক দিবেন বলে ধমকি দেন এবং আবার ঐশী নির্দেশে তাদের সাবধান করে বলেন যে, যদি তিনি তাদের পরিত্যাগ করেন আল্লাহ তাকে এর পরিবর্তে তাদের চেয়ে উৎকৃষ্ট কুমারী, তালাকপ্রাপ্ত ও বিধবা মহিলা দান করবেন (৬৬ : ৫)।

এই সাবধান বাণীতে তাঁর স্ত্রীরা চুপ করে গেলেন, কিন্তু প্রফেট স্থির করলেন যে, মেরিকে এদের কাছ থেকে সরিয়ে মদিনার অন্য কোনো কোয়ার্টারে আলাদাভাবে রাখার বন্দোবস্ত করলে ভালো হয়। সেই ব্যবস্থা হলো এবং প্রফেট সেভাবেই আলাদাভাবে মেরির সাথে মিলিত হতে থাকলেন। মেরির প্রতি অত্যধিক আকর্ষণের কারণে তাঁর কাছে অন্য কেউ গেলে তিনি ঈর্ষান্বিত হতেন। কিন্তু যখন গুজব ছড়াল যে তার কাজিন মাবুর নিয়মিত মেরির বাসায় যাতায়াত করে, তখন তিনি আলিকে পাঠান বিষয়টি তদন্ত করতে। আলি যখন দেখলেন মাবুব মেরির বাড়ির দিকে যাচ্ছে, তখন তিনি নাঙ্গা তলোয়ার নিয়ে তাকে তাড়া করেন। মাবুর দৌড়ে পালায়,

কিন্তু এক পর্যায়ে হোঁচট খেয়ে মাটিতে পড়ে যায় প্রায় উলঙ্গ অবস্থায় তখন আলি দেখতে পান যে মাবুরের পুরুষাঙ্গ নেই। আলি খাপে তলোয়ার ভরে প্রফেট মোহাম্মদকে ঘটনা জানালে তিনি আল্লাহকে ধন্যবাদ দেন এবং মাবুরকে ডেকে নির্দেশ দেন খবরদার কখনো মেরির সাথে আর দেখা করবে না।

৬৩০ খ্রিস্টাব্দে এপ্রিলে মেরি এক পুত্র সন্তানের মা হয়, প্রফেট যার নাম রাখেন ইব্রাহীম (আব্রাহাম)। এই নামের প্রতি তার গভীর শ্রদ্ধা ছিল। কিন্তু ৬৩২ সালে জানুয়ারি মাসে, আংশিক সূর্যগ্রহণ কালে, ১৫ মাসের মাথায় শিশু ইব্রাহিম মারা যায়। এতে প্রফেট গভীর শোকে আচ্ছন্ন হন।

তাঁর প্রথম স্ত্রী খাদিজা এবং মেরি দ্য কপ্‌ট প্রফেট পরিবারের এই দুই মহিলা, সন্তান ধারণ করেছিলেন। মেরি, প্রফেটের মৃত্যুর প্রায় পাঁচ বছর পর মারা যায়।

৬.১২ হেরেম সঙ্কট

প্রফেট মোহাম্মদ যখন মধ্য পঞ্চাশে তখন থেকেই তার হেরেমের স্ত্রীদের মধ্যে সমস্যা শুরু হয় এবং তাঁর বয়স যখন ষাট বছরে পৌঁছে তখন সঙ্কট চরম অবস্থা ধারণ করে এবং তাঁর আয়ত্তের বাইরে চলে যায়। তাঁর নতুন স্ত্রীদের মধ্যে কেউ কেউ একজন গত-যৌবন স্বামীর সাথে সন্তোষজনক বিবাহিত জীবনের স্বাদ থেকে বঞ্চিত ছিল, স্বামীর মর্যাদা বা প্রতিপত্তি যা-ই হোক না কেন। কথিত যে, পুরানো স্ত্রীরা নতুনদের এমনভাবে সলাপরামর্শ দিত, যাতে নববধূরা স্বামীর বাহু বন্ধন এড়িয়ে যেত। এই অবস্থায় একটি কোরানিক আয়াত প্রযোজ্য- “আমি তোমাদের কাছ থেকে আল্লাহর আশ্রয় কামনা করি” (১৯ : ১৮)। কত বার তিনি এই আয়াতের শরণাপন্ন হতেন, তা জানা যায়নি (এবট, ১৯৮৫ পৃ. ৬২)।

প্রফেট মোহাম্মদের বর্ধিত হেরেম, তাঁর বয়সের কারণে ক্ষমতা হ্রাস ইত্যাদির কারণে তিনি তাঁর স্ত্রীদের নিরপেক্ষভাবে সন্তুষ্ট রাখতে সমর্থ ছিলেন না, যেমন আল্লাহ বলেছেন প্রত্যেক স্ত্রীর সাথে সমান আচরণ বাঞ্ছনীয় (৪ : ৩)। মেরি ছাড়া তাঁর আরো কয়েকটি প্রিয় পত্নী ছিলেন— যেমন আয়েশা এবং এর কিছু কম ডিগ্রিতে ছিলেন উম্মে সালমা এবং জয়নাব বিনত জাহাশ। এই অবস্থায় আর একটি ‘ওহি’ তিনি পান যেখানে তাঁকে স্ত্রীদের প্রতি নিরপেক্ষ হতে রেহাই (exempt) বা অব্যাহতি দেয়া হয় (৩৩: ৫১)।

তাঁর স্ত্রীরা তাঁকে প্রায় নানান অভিযোগে ও দাবিদাওয়া পেতে ব্যতিব্যস্ত করে তুলত। স্ত্রীদের মধ্যে তার সাথে ‘পালার’ অধিকার নিয়ে বা রাত বরাদ্দ নিয়ে ঝগড়াঝাঁটি লেগেই থাকত। তারা তাদের মর্যাদা ও স্ট্যাটাস নিয়েও ঝগড়া করত। তাঁর হেরেমে স্ত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি ও তাদের সাথে স্বল্প সময় দিয়ে সঙ্গ লাভের জন্যও বিরক্তি প্রকাশ করত। দাম্পত্য জীবনযাত্রারও অন্যান্য সন্তুষ্টি থেকে বঞ্চিত হয়ে তারা বেছে নিল আরাম আয়েশের জীবন, ভালো পোশাকপরিচ্ছদ ও বিলাসিতা; এতে হেরেম সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করে।

মেরির সাথে মিলনে বাধা পেয়ে যে সমস্যার উদ্ভব হয় এতে প্রফেটের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে এবং অবস্থা এমন অসহ্য হয়ে দাঁড়ায় যে তিনি সব স্ত্রী থেকে নিজেকে আলাদা করে ফেলতে বাধ্য হলেন; তখন আবার ওহি এলো। আল্লাহ বল্লেন : তোমার স্ত্রীদের দুইটি চয়েসের মধ্যে একটাকে বেছে নিতে বল : তারা তোমার সাথে থাকবে, না সম্মানজনকভাবে তালাক গ্রহণ করবে (৩৩ : ২৮)।

তালাকের ধমকির গুজব ছড়িয়ে পড়লে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে মারাত্মক অবস্থা সৃষ্টি হয়, কারণ তালাক দিলে স্ত্রীদের পরিবারের সাথে ও গোত্র সম্পর্কে- আবু বকর (আয়েশার পিতা), ওমর (হাফজার পিতা) এবং খালিদ ইবন ওয়ালিদ (মায়মুনার ভাইপো) চিড় ধরতে পারে। তাই, চিন্তা করা হয় যে কিছু কম ক্ষমতাসম্পন্ন স্ত্রীকে তালাক দেয়া যেতে পারে, কিন্তু ঠিক হলো আয়েশা এবং আরো আট জন তার সাথে রয়ে যাবেন (Watt, 1961, P. 226)।

স্ত্রীদের এই আচরণের সূত্র ধরে, ঐ সময় প্রফেট মোহাম্মদ বেশ কয়েকটি ওহি পান যাতে স্ত্রীদের স্বাধীনতা সীমিত করে দেয়া হয়। তিনি চাইলেন না যে তাঁর স্ত্রীরা সেই স্বাধীনতা ভোগ করবে, যে স্বাধীনতা ইসলাম-পূর্ব আমলে মেয়েরা ভোগ করত (৩৩ : ৩৩)। আল-বাইদাবী বর্ণনা করেছেন যে প্রফেট মোহাম্মদ তাঁর হেরেমের মহিলাদের জন্য অন্দর মহলের পুরুষ থেকে আলাদাভাবে থাকার ব্যবস্থা চালু করতেন যদি তিনি কখনো মেহেমানদারির সময় দেখতে পেতেন যে পরিবেশন করার সময় তার তরুণী স্ত্রী আয়েশার হাত কোনো অতিথির হাত স্পর্শ করেছে।

তবুও অন্য একটি ওহিতে বলা হয়েছে যে ঘরের লোকজন ছাড়া বাইরের পুরুষের সাথে প্রফেটের স্ত্রীদের পর্দার পেছনে ছাড়া সম্মুখ কথাবার্তার অনুমতি দেয়া হয়নি, কারণ এতে প্রফেট অস্বস্তি বোধ করতেন (৩৩ : ৫৩)। প্রফেটের স্ত্রীদের মধ্যে কেউ স্পষ্টত কোনো অশ্লীল কর্ম করলে তারা দ্বিগুণ শাস্তি পাবে (৩৩ : ৩০) কিন্তু যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলকে মান্য করবে দ্বিগুণভাবে পুরস্কৃত হবে এবং বেহেশতে সম্মানজনক স্থান লাভ করবে (৩৩ : ৩১); এবং তারা অন্য মহিলাদের মতো নয় (৩৩ : ৩২)।

ইবন সা’দ তার এক হাদিসে বর্ণনা করেছেন, তালহা ইবনে ওবাইদুল্লাহ (আবু বকরের কাজিন)কে বলতে শোনা গেছে যে তিনি, প্রফেট মারা গেলে, আয়েশাকে বিবাহ করবেন। প্রফেট মোহাম্মদ একথা শুনে ভাবতে শুরু করেন তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর সুন্দরী স্ত্রীদের কপালে কি ঘটবে। এরপরই তিনি ওহি পান এই মর্মে যে তাঁর মৃত্যুর পর কেউ তার স্ত্রীদের বিবাহ করতে পারবে না। (৩৩ : ৫৩)। এই নিষিদ্ধকরণকে আরো মজবুত করার জন্য তাদের মর্যাদা দেয়া হয় ‘মোমেনগণের মাতা’ বলে। (৩৩ : ৬)।

এক কাহিনীতে বলা হয়েছে যে প্রফেটের বিধবা বলে এক মহিলাকে আবু জাহেলের পুত্র ইকরাম বিবাহ করেছে। এই সংবাদে মুসলিমদের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয় এই কারণে যে সংবাদ সত্যি হলে প্রফেটের স্মৃতির অবমাননা করা হবে। কিন্তু আবুবকর বিষয়টি সামাল দেন এই বলে যে ঐ মহিলার সাথে প্রফেটের বিবাহ ছিন্ন হয় এবং তাদের মধ্যে মিলন হয়নি (had not actually been consummated)।

প্রাক-ইসলামী যুগের সাথে তুলনা করলে প্রফেট মোহাম্মদ মহিলাদের স্বাধীনতা অনেক খর্ব করে দিয়েছেন এবং অনেকেই মনে করেন যে মহিলাদের মর্যাদা, অন্দরবাস, পর্দা এবং সাধারণ আচরণের জন্য যে মুসলিম বিধান বা আইন তৈরি হয়েছে তার বেশিরভাগই নির্ধারিত হয়েছে প্রফেটের প্রবীণ বয়সকালে তার তরুণী স্ত্রীদের সাথে অভিজ্ঞতা অর্জনের ফলশ্রুতি হিসাবে।

৬.১৩ হোদায়বিয়ার সন্ধি

কোরেশীদের প্রতিবাদের আধিক্যকে উপলব্ধি করার জন্য প্রফেট মোহাম্মদ মক্কায় হজ করতে মনস্থ করেন। তাই ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে মার্চ মাসে সাথে ১৪০০ লোকজন নিয়ে মদিনা থেকে যাত্রা করেন। কোরবানির জন্য পশুও সাথে নেন।

মক্কার মধ্যপথে, আরওয়াতে তিনি থামেন এবং মা আমেনার কবর জেয়ারত করেন। আল-বাইদাবী বলেন যে প্রফেট তাঁর মায়ের আত্মার মুক্তির জন্য আল্লাহর অনুমতি প্রার্থনা করেন কিন্তু একটা ওহির মাধ্যমে তার প্রার্থনা নামঞ্জুর হয়। তারপর প্রফেট আবার মক্কাভিমুখে যাত্রা শুরু করেন।

যখন মক্কাতে তার আগমন সংবাদ পৌছাল। কোরেশীরা তাদের সিদ্ধান্তে অটল রইল। তারা প্রফেট মোহাম্মদের উত্তরোত্তর ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং বাণিজ্য পথে ক্যারাভান নিয়ন্ত্রণ করার মধ্যে তার বারগেনিং ক্ষমতার সম্বন্ধে অবহিত ছিল। তারা জানত যে তাঁর সাথে শত্রুতা করতে গেলে তিনি মক্কাবাসীর বাণিজ্যের সম্ভাব্য ক্ষতি করতে পারেন। কিন্তু অন্য দিকে তারা স্থির সিদ্ধান্ত নিল মক্কা নগরীতে প্রবেশ করতে দিবে না এবং তাঁকে এ ধারণাও দেওয়া হবে না যে যখন ইচ্ছা তিনি মক্কায় এসে বড় হজ ছোট হজ করতে পারবেন। তাই মক্কাবাসীরা আশপাশের গোত্র প্রধান ও তাদের লোকবল নিয়ে নগরের বাইরে বাধা দেওয়ার জন্য সশস্ত্র প্রস্তুতি গ্রহণ করল।

এ সম্বন্ধে পূর্বে সংবাদ পেয়ে প্রফেট মোহাম্মদ প্রধান সড়ক ছেড়ে মক্কার সাত মাইল দূরে হোদাইবিয়ায় ক্যাম্প গাড়লেন। মক্কাবাসীদের পক্ষ থেকে প্রফেটের কাছে দূত পাঠানো হলো এই সংবাদ জানিয়ে যে যদিও তারা শান্তির বার্তা সাথে নিয়ে হজ করতে এসেছে, তবুও তাদের মক্কা নগরীতে হজ পালন করতে দেয়া হবে না। এই দূতালির মধ্যে আবু সুফিয়ানের জামাতা তায়েফের প্রধান ওরওয়া কাটখোট্টা মানুষ ছিল। সে বলে বসল যে, মক্কাবাসীরা তোমাদের আবর্জনা শহরে ঢুকতে দিতে রাজি নয়। এই বলে সে প্রফেটের দাড়ি ধরতে চেষ্টা করে। কিন্তু তাঁর (প্রফেটের) দলের সদস্যরা তাকে বাধা দেয়।

প্রফেট মোহাম্মদ তখন মক্কাতে তাঁর দূত পাঠাতে সিদ্ধান্ত নিলেন। তাঁর প্রথম দূতের সাথে মক্কানরা দুর্ব্যবহার করে। তখন প্রফেট ওমরকে পাঠাতে মনস্থ করলেন, কিন্তু ওমর এই বলে রাজি হলেন না যে সেখানে তাকে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করার কেউ নেই। তখন আবু সুফিয়ানের কাজিন ওসমান যেতে রাজি হন।

যখন কয়েক ঘণ্টা অতিবাহিত হলো এবং ওসমান ফিরলেন না তখন সকলের ধারণা হলো যে তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। তখন প্রফেট মোহাম্মদ নিজের নিরাপত্তার জন্য চিন্তিত হন। এই অবস্থায় প্রফেট সিদ্ধান্ত নেন, যদি মক্কাবাসীরা আক্রমণ করে তাহলে শেষ পর্যন্ত তাঁরা লড়াই করবেন। এই সিদ্ধান্ত তিনি আকাশিয়া বৃক্ষের নিচে (৪৮ : ১৮), তাঁর অনুসারীদের শপথ ও প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করেন এই মর্মে যে, তারা শেষ প্রাণীটি পর্যন্ত তাঁকে রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর। এই শপথ ‘বৃক্ষের নিচে শপথ’ বলে বিখ্যাত হলো ইসলামের ইতিহাসে। [একে বায়াতে রেদওয়ান’ও বলা হয়- অনুবাদক]

দেখা গেল ওসমান নিরাপদে ফিরে এসেছেন। তিনি এসে বললেন কোরেশীরা দুই পক্ষের মধ্যে একটা সন্ধি করতে চায়। কোরেশীদের প্রতিনিধিরা এলে এদের নেতৃত্ব দেন সোহাইল ইবন আমর।

প্রফেট মোহাম্মদ তাঁর জামাতা আলীকে ডাকলেন এবং সন্ধির শর্ত ডিকটেট করতে শুরু করলেন। প্রথমে ‘বিসমিল্লাহ আর রাহমান আর রহিম’ বলেই সোহেল বাধা দিলেন, তিনি বললেন, ‘রহমান’ বলা যাবে না আল্লাহর নাম বলে, কারণ তিনি এ নামে আল্লাকে (God) চেনেন না। তাই রহমান নাম বাদ দেয়া হলো এবং প্রফেট আবার ডিকটেশন শুরু করলেন : এই সন্ধি মোহাম্মদ ‘রসূলুল্লাহ’ ও কোরেশদের মধ্যে বলতেই সোহেল আবার বাধা দিয়ে বললেন যে, ‘মোহাম্মদ ও আল্লাহর রসূল এটা ধারণা মাত্র এবং গ্রহণযোগ্য নয়। শুধু আপনার ও আপনার বাবার নাম লিখুন।’ আল- বোখারী ও মুসলিম ইবন আল-হাজ্জাজ উভয়েই হাদিসে বলেন যে, প্রফেট মোহাম্মদ তখন আলীর হাত থেকে কলম নিয়ে ‘রসূলুল্লাহ’ কেটে দিয়ে নিজের হাতে লেখে দেন ‘আবদুল্লাহর পুত্র’।

সন্ধির শর্ত মতে, দশ বছরের জন্য শান্তি বজায় থাকবে। যদি কোনো মক্কান প্রফেটের দলে চলে যায়, তাহলে তাকে মক্কাতে ফেরত পাঠাতে হবে। কিন্তু কোনো মুসলিম মক্কায় চলে গেছে, তাহলে কোরেশরা তাকে মদিনায় ফেরত পাঠাতে বাধ্য নয়।

হজ সম্বন্ধে শর্ত হলো : মুসলিমদের এখন মদিনায় ফিরে যেতে হবে, কিন্তু পরের বছর তারা ফিরে আসতে পারে ছোট হজ (ওমরা) করার জন্য। তারা মক্কায় মাত্র তিন দিন থাকতে পারে। তারা আসবে খাপের মধ্যে তরবারি বন্ধ রেখে। এই লজ্জাজনক শর্তের কারণে প্রফেটের দলে অনেকেই অপমানিত বোধ করেন। প্রফেট তাদের শান্ত হতে বলেন, কিন্তু ওমর প্রফেটের সাথে একমত না হয়ে, শুধু গুমরে গুমরে চুপ করে থাকলেন। আল-ওয়াকাদি লিখেছেন- ওমর পরে বলেছিলেন প্রায় ১০০ জন মুসলিম তার মতে মত দিলে ইসলাম পরিত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিলেন। (Andrae, 1990 P. 160)।

প্রফেট মোহাম্মদ এবং তাঁর পার্টি সাথে যেসব পশু এনেছিলেন, সেগুলোকে হোদাইবিয়াতে কোরবানি দিয়ে মদিনায় ফিরে গেলেন। ফেরার পথে আল্লাহর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ঘোষণা করেন যে হোদায়বিয়ার সন্ধিতে বিজয় সূচিত হলো। (৪৮ : ১)।

৬.১৪ বহির্দেশে যোগাযোগ

নিজের অবস্থানকে আরো শক্ত করতে প্রফেট মোহাম্মদ আরবের অন্যান্য গোত্রের সাথে সম্পর্ক গড়তে আগ্রহী হলেন। উদ্দেশ্য ছিল সিরিয়ার দিকে বাণিজ্য পথে নিরাপত্তা নিশ্চয়তা করা। ৬২৮ সালে শরৎকালে তিনি কয়েকটি গোত্রের সাথে যোগাযোগ করে চুক্তি সই করেন— বিশেষ করে খ্রিস্টানদের সাথে- যেমন দক্ষিণ প্যালেস্টাইনে জুদহাশ এবং সিরিয়াতে কাল্‌ব গোত্র।

একই সময়ে, প্রফেট মোহাম্মদ সিদ্ধান্ত নেন তাঁর প্রফেটহুডকে যতদূর সম্ভব ঘোষণা দিয়ে ছড়িয়ে দিতে হবে এবং এই মর্মে আরবের বড় বড় রাজ্য প্রধানকে যেমন ইয়ামামা, ওমান ও বাহরাইনের রাজাদের পত্র দিয়ে ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দিতে হবে।

ওমান ও বাহরাইনের জবাবে কোনো মন্তব্য ছিল না; কিন্তু ইয়ামামার খ্রিস্টান হানিফা গোত্রের প্রধান হওদা ইবন আলী মধ্য আরাবিয়ার ক্ষমতাধর ব্যক্তি ছিলেন। তিনি তাঁর জবাবে লিখেন : ঐশীবাণীটা খুবই চমৎকার যার দ্বারা আমাকে দাওয়াত দেয়া হয়েছে। আমাকে আপনার অংশের ভাগীদার করলে আমি আপনার প্রতিষ্ঠানে যোগ দিতে পারি। এই জবাব পেয়ে প্রফেট মোহাম্মদ হওদাকে অভিশাপ দেন। ফলে কথিত আছে পরের বছরেই হওদা মৃত্যুবরণ করেন।

বিদেশী শাসকদের কাছেও ঐ দিন পত্র পাঠানো হয় ইসলামে দীক্ষা নিতে। বলা হয় যে, রোমের (রুম) সম্রাট হেরাক্লিয়াস ঐ দাওয়াতপত্র পড়ে দেখেন যে তাকে যিশু ও মেরিকে পূজা না করে মোহাম্মদের মিশন গ্রহণ করতে বলা হয়েছে; এতে তিনি পাগলের প্রলাপ বলে পত্রটি ছুড়ে ফেলে দেন। ঐতিহাসিকরা বলেন যে বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের অধিকাংশ রাজ্য মুসলিম সেনারা কিছুদিন পরেই অধিকার করে নেয়। ঘাসানের খ্রিস্টান গোত্রের যুবরাজ প্রথম হারিথকে অনুরূপ পত্র দিয়ে ইসলামে দীক্ষা নিতে বলা হয়। তখন হারিথ সিরিয়ায় বসরাতে বাইজানটাইন গভর্নর ছিলেন। এখানে যে দূতকে পাঠানো হয়েছিল তাকে পাগলের প্রতিনিধি বলে দরবার থেকে বের করে দেয়া হয়। পরের বছর হারিথ মারা যান এবং ঐতিহাসিকদের মতে, তার রাজ্য অচিরেই মুসলিম রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।

পারস্যে দ্বিতীয় খসরুর কাছে প্রফেটের পত্র পৌঁছিবার আগেই খসরু মারা যান; কিন্তু তার উত্তরাধিকারী দ্বিতীয় কোবাদ চিঠির বক্তব্য পড়েই ছিঁড়ে টুকরো করে দেন। যখন এই সংবাদ প্রফেটের কাছে পৌঁছে তখন আল্লাহর কাছে আবেদন করেন— “হে আল্লাহ তার রাজ্য বিদীর্ণ করে দাও।’ তাই হয়েছিল।

মিশরের রোমান গভর্নর (মুকাও কিস) প্রফেটের দূতকে সম্মানের সাথে অভ্যর্থনা জানান এবং চিঠির বন্ধুসুলভ একটি জবাব প্রেরণ করেন, আর নিয়মমতো দুটি খ্রিস্টান ক্রীতদাসী উপহার। এদের মধ্যে মারিয়া কিবতিয়া (মেরি)কে প্রফেট নিজে বেছে নেন এবং অপরটি তাঁর কবি হাসান ইবন থাবিতকে উপহার দেন।

আবিসিনিয়ার রাজা নেগাসকে যে পত্র দেয়া হয় ভদ্রভাবে তিনি তাঁর স্বীকৃতি দেন। তাঁর নিজের বিবেচনা মতে নেগাস বিশ্বাস করতেন যে প্রফেটের নতুন ধর্ম খ্রিস্টান ধর্মের প্রকৃতি। প্রফেট মোহাম্মদ নেগাসের কাছে তাঁর দ্বিতীয় পত্রে অনুরোধ করেন যে তাঁর নিকট আশ্রয় প্রার্থী বাকি মুসলিমদের (প্রায় ষাট জনের মতো) মদিনাতে যেন পাঠিয়ে দেয়া হয়।

পশ্চিমা ঐতিহাসিকরা প্রফেট মোহাম্মদকে এই সব সরকারি পত্রের (missives) কাহিনীকে অতি সামান্যই গুরুত্ব দিয়ে থাকেন এবং তিনি যে বিদেশী সম্রাটদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে দাবি জানিয়েছিলেন তার সামান্যই মূল্যায়ন করেছেন। এইসব চিঠি পত্রের ও তার জবাবের যেসব কপি মুসলিম ঐতিহাসিকরা রক্ষণ করেন তার অধিকাংশেরই গ্রহণযোগ্যতা নেই (apocryphal)। এসব ঐতিহাসিকরা এই পত্রগুলির বিরুদ্ধে বিবরণ দিয়ে থাকেন কারণ এদের তারিখ, প্রেরণের সময় এবং প্রাপকদের নাম এমনকি পত্রের বিষয়বস্তু ও শব্দ গঠনের সঙ্গতিপূর্ণতার অভাব রয়েছে। প্রফেট মোহাম্মদের তখনকার অবস্থার সাথে তার দাবি সামঞ্জস্যহীন।

যে সময় এসব পত্র বিলি করা হয়েছিল বলে ধরা হয়, তখন প্রফেট মোহাম্মদের ক্ষমতা মদিনার বাইরে অতি নগণ্য ছিল। এমনকি তখনো তিনি মক্কাকে তাঁর করতলগত করতে পারেননি। তখন তাঁর পক্ষে কোনো স্বাধীন নৃপতিকে ইসলাম গ্রহণ করার মতো দাবি জানানোর অবস্থা ছিল না এবং বাস্তবে এ ধরনের পদক্ষেপ নেয়ার মতো ক্ষমতা ছিল না। তিনি হয়তো ঐ সব নৃপতির কাছে নিকট সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য বন্ধুভাবে পত্র (Friendly letters) লিখে থাকবেন। এ-ও হতে পারে আরবের যে অংশে তিনি রাজ্য স্থাপন করেছেন তার বিবরণ দিয়ে, তার বিরুদ্ধে মক্কানদের আক্রমণাত্মক আচরণের জন্য সাহায্য চাইতে পারেন। মিশর ও আবিনিসিয়া থেকে যে নম্র জবাব পেয়েছিলেন তাতে এই বোঝানো হয়েছে যে এর বেশি তারা কিছু করতে পারবে না।

ঐসব ঐতিহাসিক সরকারি পত্রের কাহিনী মনে হয়, ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে ট্র্যাজিক পরাজয়কে খণ্ডন (counter) করার উদ্দেশ্যে লেখা হয়ে থাকবে। অবশ্য এই পত্রগুলোর প্রভাবে প্রফেটের মৃত্যুর দশ বছর পর মুসলিম সেনাবাহিনীকে অনুপ্রেরণা জোগাতে পারে।

৬.১৫ ওমরা হজ

৬২৯ খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি মাসে প্রফেট মোহাম্মদ দু’হাজার অনুগামীদের নিয়ে মক্কায় ওমরা হজ করতে যান। আগের বছরে হোদায়বিয়ার সন্ধির শর্ত মতে, কোরেশ বাহিনী মক্কা শহর ত্যাগ করে আশপাশের পর্বতের ধারে তাঁবু স্থাপন করে।

প্রফেট মোহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীরা কাবাঘরে সাতপাক দিয়ে সাফা ও মারওয়াতে সাতবার দৌড়াদৌড়ি করেন এবং সাথে যেসব পশু এনেছিলেন তাদের কোরবানি হয়।

মক্কায় থাকাকালে প্রফেট তাঁর গোত্র হাশেমীদের সাথে একটা সমঝোতা করার চেষ্টা করেন। আগেকার গোত্র প্রধান তাঁর চাচা আবু লাহাব মারা যান ৬২৪ সালে। তখন গোত্র প্রধান ছিলেন তার আর এক চাচা আব্বাস। তিনি ছিলেন একজন ব্যাংকার। মূর্তিপূজারী ও ইসলামের শত্রু আব্বাস বদরের যুদ্ধে প্রফেট মোহাম্মদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন; পরবর্তীতে তিনি নিরপেক্ষ ভাব ধারণ করেন।

এখন ভাইপোর ক্ষমতার ঊর্ধ্বগতি দেখে আব্বাস ইসলাম গ্রহণ করতে সম্মতি জ্ঞাপন করেন। এই নতুন সম্পর্ককে গাঢ় করার জন্য প্রফেট মোহাম্মদ তার চাচি উম্মুল ফজল (আব্বাসের স্ত্রী)-এর বোন মাইমুনাকে বিবাহ করলেন। এর কিছুক্ষণ পরে মহান সেনাপতি খালিদ ইবন ওয়ালিদ, প্রফেটের নতুন স্ত্রী মায়মুনার ভাইপো, ইসলাম গ্রহণ করলেন এবং মুসলিম সেনাবাহিনীতে যোগ দিলেন।

বন্ধুভাব প্রদর্শন করে, প্রফেট মোহাম্মদ মক্কাবাসীদের জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি মক্কা শহরে আরো কিছুদিন থাকতে পারবেন কিনা, যাতে তিনি তার নতুন বিবাহের ওয়ালিমা সম্পন্ন করতে পারেন। কিন্তু মক্কানরা অভদ্রতার সাথে তাকে জবাব দেয় যে তারা তাঁর কাছ থেকে কোনো ভোজের আশা করে না। পরে তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয় যে, শর্তমতে তিন দিন অতিবাহিত হয়েছে সুতরাং তাদের শহর পরিত্যাগ করা দরকার।

আব্বাস মক্কায় রয়ে গেলেন প্রফেট মোহাম্মদের ফেলে আসা কাজগুলো সম্পন্ন করার জন্য, এই আব্বাসের বংশধররা পরে ৭৫০ সালে খলিফা হয়েছিল।

৬.১৬ অভিযানসমূহ

মার্চেন্টদের ক্যারাভানের ওপর আক্রমণের সাথে সাথে প্রফেট প্রতিবেশী গোত্র ও শহরের বিরুদ্ধে অনেকগুলো অভিযান চালান। ৬২৪ এবং ৬২৮ সালের মধ্যে তিনি তখন ক্ষমতাধর ইহুদি সম্প্রদায়ের ওপর বিজয় শেষ করে তার দৃষ্টি আরও বড় বিজয়ের দিকে নিক্ষেপ করেন।

যাই হোক, আরব গোত্রদের বিরুদ্ধে তার বেশির ভাগ অভিযান ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে (হিজরি সপ্তম বছর) তুঙ্গে ওঠে এবং শেষ হয় পরাজয়ের মধ্যে। ফেব্রুয়ারি মাসে একটি মুসলিম দলকে পাঠানো হয় ফাদাকের দিকে বানু মুরার বিরুদ্ধে, কিন্তু মুসলিম দলের একজনও বাঁচেনি, সকলেই নিহত হয়। কয়েক মাস পরে প্রফেট মোহাম্মদ মুরারকে পরাজিত করে প্রতিশোধ গ্রহণ করেন। এপ্রিল মাসে বানু সোলাইম-এর বিরুদ্ধে একটি মুসলিম বাহিনী প্রেরিত হলে তারা বিধ্বস্ত হয়। দলের সকল সদস্যের হত্যা করা হয়, শুধু দলপতি কোনো রকমে প্রাণ নিয়ে পালাতে সক্ষম হয়। জুন মাসে বানু লায়েদের বিরুদ্ধে মক্কার পথে এক অভিযান করা হলে, তারা অধিকাংশ হত হয়, বাকিরা যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়।

জুলাই মাসে প্রফেট মোহাম্মদ সিরিয়ার বর্ডারের কাছে ধাত আতলাতে এক বাহিনী প্রেরণ করেন এবং তাদের লোকদের মুসলিম হতে বলা হয়। এর জবাবে তারা অনবরত তীর বর্ষণ করে মুসলিম বাহিনীকে বিব্রত করে, মুসলিম বাহিনী ঘুরে যুদ্ধেরত হলে সকলেই মারা পড়ে, মাত্র একজন বেঁচে গিয়ে যুদ্ধের কাহিনী বর্ণনা করে।

৬২৯ খ্রিস্টাব্দে সেপ্টেম্বর মাসে প্রফেট মোহাম্মদ ঘাসান যুবরাজদের কাছে তাঁর প্রতিনিধি পাঠালেন। ফিরে আসার পথে সেই প্রতিনিধিকে বেদুইন গোত্র মেরে ফেলে, ফলে প্রফেটের পালিত পুত্র জায়েদ ইবন হারিথের অধীন একটি মুসলিম ফোর্স পাঠানো হয়, পরে পাঠানো হয় খালিদ ইবন ওয়ালিদকে। তারা বাইজানটাইন ফ্রন্টিয়ার পর্যন্ত অগ্রসর হয়, সেখানে তাদের সাথে খ্রিস্টান ও প্যাগন সেনাবাহিনীর সাথে মোকাবেলা হয় এবং মুতার যুদ্ধে মুসলিমদের ভীষণভাবে পরাজয় ঘটে এই যুদ্ধে জায়েদ ইবন হারিথ, আলীর ভাই জাফর এবং যোদ্ধা কবি আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা অন্যদের সাথে মারা পড়ে।

মুসলিম বাহিনীতে যারা বেঁচে ছিল তাদের নেতৃত্ব দিয়ে খালিদ ইবন ওয়ালিদ মদিনায় ফিরে এসে উপহাসের পাত্র হন। মদিনার লোকেরা তাদের ঢিল মেরে ধিক্কার দেয় যুদ্ধ ক্ষেত্র ছেড়ে পালিয়ে আসার জন্য। শেষমেশ প্রফেট ক্রুদ্ধ লোকজনদের বুঝিয়ে ঠাণ্ডা করেন এবং তাদের বলেন যে মুতার যুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছে তাদের তিনি বেহেশতের বারান্দায় গদি-আঁটা আসনে হেলান দিয়ে বসে থাকতে দেখেছেন।

[৬৩২ সালে জুলাই মাসে অবশ্য মুতা যুদ্ধের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়া হয় প্রফেটের মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ পরে। যখন জায়েদ ইবন হারিথ এবং উম্মে আইমানের পুত্র ও সামা মুতা প্রান্তরে অভিযান চালিয়ে সেখানকার সব কিছু ধূলিতে মিশিয়ে দেন। বহু লোককে হত্যা করা হয় এবং যারা বেঁচে ছিল তাদের বন্দি করে আনা হয়।]

সামরিক অভিযান ৬৩০ ও ৬৩১ সাল পর্যন্ত চলেছিল। জোট বাহিনীর মধ্যে যে যোদ্ধা ও অফিসাররা অংশ নিয়েছিল, তারা এই লাগাতার অভিযানের কারণে বেশ অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে। এদের অনেকেই প্রফেটের আদেশ পালনে অসম্মতি জানায়। যারা অংশগ্রহণ করেছিলেন সেনাবাহিনীতে অসম ব্যবহারের কারণে বিক্ষুব্ধ হয়। অনেকেই অপ্রয়োজনীয় ও লম্বা মার্চিং-এর জন্যও বিরক্ত হয়; বিশেষ করে যুদ্ধের মালেগণিমতের (booty) অন্যায্য ভাগাভাগির জন্যও ক্ষুব্ধ হয়।

একবার এক ঘটনায় সেনাবাহিনীর জোয়ানরা প্রফেট মোহাম্মদকে ঘিরে ধরে এবং মালেগণিমতে ন্যায় অংশ পাওয়ার জন্য হৈচৈ শুরু করে দেয়। এমন বন্য ব্যবহার তাঁর সাথে তারা করেছিল যার ফলে তাঁর ম্যানেটল (জোব্বা) খুলে নেয় এবং পোশাক ছিঁড়ে দেয়। বাধ্য হয়ে তাঁকে একটি বৃক্ষের নিচে আশ্রয় নিতে হয়। মদিনায় ফেরার পথে, প্রফেটকে পাহাড়ের উপর থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করার মতলবও করে (Rodinson, 1976 p. 277)।

এই সব দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার জন্য প্রফেট মোহাম্মদ ভবিষ্যতে আর কোনো অভিযানে নেতৃত্ব না দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। যুদ্ধে ব্যক্তিগতভাবে সর্বশেষ অংশগ্রহণ হয় ৬৩০ সালে অক্টোবর মাসে তাবুকের যুদ্ধে যেখানে তিনি খ্রিস্টান গোত্রদের সাথে একটি সন্ধি সম্পাদন করেন।

৬.১৭ মক্কা বিজয়

মুতা যুদ্ধে পরাজয়ের কিছু সময়ের পর কোরেশ মিত্রদের সাথে মুসলিমদের মারপিট শুরু হয়ে যায়। প্রফেট মোহাম্মদ এই সব গণ্ডগোলকে হোদায়বিয়ার সন্ধির শর্তভঙ্গের কারণ হিসাবে গণ্য করে, গোপনে গোপনে সুযোগ খুঁজতে থাকেন মক্কার সাথে হোদায়বিয়ার দশ বছর মেয়াদের চুক্তি যাতে ভেঙে যায়। হোদায়বিয়ার চুক্তির মেয়াদ তখন মাত্র দু’বছরের কম অতিবাহিত হয়েছে। ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে হোদায়বিয়া যাত্রার পর ৬২৯ সালে ওমরা হজ পালন করে তিনি বুঝতে পারেন যে মক্কার পক্ষে একটা বিরাট বাহিনীকে আর মোকাবেলা করার ক্ষমতা নেই; তাই তিনি মক্কা অভিযানের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন।

কোরেশরা আবু সুফিয়ানকে প্রফেটের সাথে আলোচনা করার জন্য পাঠায়। বৃদ্ধ আবু সুফিয়ান প্রথমে তার কন্যা উম্মে হাবিবার (প্রফেটের স্ত্রী) সাথে দেখা করেন এবং তার (কন্যার) হস্তক্ষেপ কামনা করেন। কিন্তু উম্মে হাবিবা তার কথায় কান দিলেন না, এমনকি তার ঘরে আবু সুফিয়ানকে বসতেও বললেন না। ঘরে যে কার্পেট পাতা ছিল সেটাকে গুটিয়ে রাখা হলো। আবু সুফিয়ান কন্যাকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠেন, ‘প্রিয় কন্যা আমার, হয় কার্পেটটি আমার জন্য উপযুক্ত নয়, কিংবা আমি কার্পেটের উপযুক্ত নই।’ কন্যা জবাবে বললেন, ‘পিতা, এটা প্রফেটের কার্পেট এবং তুমি একজন অবিশ্বাসী (unbliever)।’ বাবা ক্ষুব্ধ হয়ে মন্তব্য করলেন : ‘সত্যিই বেটি, আমাকে ছেড়ে আসার পর তুমি গোল্লায় গেছ।’

আবু সুফিয়ান যখন প্রফেট মোহাম্মদের সাথে দেখা করলেন রাস্তাতে এবং কথা বলার জন্য থামলেন, প্রফেট তাকে না দেখার ভান করে পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন। প্রফেটের সাথে সাক্ষাৎলাভে বিফল হয়ে আবু সুফিয়ান তার উটে উঠলেন এবং মক্কায় ফিরে গেলেন।

৬৩০ খ্রিস্টাব্দে জানুয়ারি মাসে, প্রফেট মোহাম্মদ মক্কাভিমুখে দশ হাজার সেনা নিয়ে যাত্রা করলেন, এই বাহিনীতে বেদুইন দলও ছিল। এই বাহিনী তাঁবু গাড়লো মক্কা শহর থেকে একদিনের যাত্রা পথ দূরে। মক্কাবাসীরা আতঙ্কিত হলো এই ভেবে যে তাদের শহর দখল হতে চলেছে। প্রফেটের চাচা আব্বাস, যিনি প্রফেটের এজেন্ট হিসাবে মক্কাতে বাস করছিলেন, ভাতিজার সাথে দেখা করার জন্য শহর থেকে বের হয়ে এলেন। কিছু পরেই আবু সুফিয়ানও এলেন প্রফেটের সাক্ষাৎ প্রার্থী হতে। পরের দিন সাক্ষাতের বন্দোবস্ত হলো।

মিটিং-এর সময় আবু সুফিয়ানকে জিজ্ঞাসা করা হলো যে তিনি এখন এক আল্লাহ এবং প্রফেট মোহাম্মদ তাঁর রসূল এই কথায় বিশ্বাস করেন কিনা। তখন আবু সুফিয়ানের বয়স প্রায় সত্তরের কাছাকাছি এবং তার চৌদ্দ-পুরুষের ধর্ম পরিত্যাগ করতে অনিচ্ছুক থেকে ইতস্তত করে বললেন- দেখ বাপু তোমার কাব্যের প্রথম অংশটুকু আমি বিশ্বাস করতে প্রস্তুত, কিন্তু দ্বিতীয় অংশটি সম্বন্ধে আমার মনে সন্দেহ আছে।

তার এই মন্তব্য শুনে ওমর তার কোষ থেকে তরবারি বের করে তাকে কতল করার ধমক দিতেই বৃদ্ধ ব্যক্তি অতি ক্ষীণ স্বরে আবৃত্তি করলেন আল্লাহ ছাড়া কোনো প্রভু নেই। তারপর একটু দম নিয়ে যোগ করলেন এবং মোহাম্মদ তাঁর রসূল। পরে তিনি গোপনে আব্বাসের কাছে স্বীকার করেন, ‘তোমার ভাইপোটি সত্যি একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে উঠেছে।

এরপর আবু সুফিয়ানকে মক্কায় পাঠানো হলো শহরে প্রফেট মোহাম্মদকে গণমাধ্যমের সাথে প্রবেশ করার বন্দোবস্ত করার জন্য। মক্কাবাসীদের আশ্বাস দেয়া হলো যে তাদের জীবন ও সম্পত্তির কোনো ক্ষতি হবে না যারা বশ্যতা স্বীকার করবে। তাদেরকে অস্ত্র পরিহার করে ঘরের মধ্যে থাকতে বলা হলো।

প্রফেট মোহাম্মদ ৬৩০ সালে ১১ জানুয়ারি লোকজন নিয়ে বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করলেন। তিনি কাবা দর্শন করলেন, হিজরতের পর দ্বিতীয়বারের মতো ওমরা পালন করেন। তারপর তিনি কাবাঘরে ও তার আশপাশে প্রতিষ্ঠিত ৩৬০টি মূর্তিকে ধ্বংস করার আদেশ দেন। দেয়ালে ও পিলারে যেসব পেন্টিং ছিল সব মুছে ফেলতে বলেন। কাবাঘরের সিলিং থেকে কোরেশদের দেবতা-রূপী একটি কাঠের কবুতরকে তিনি নিজের হাতে ভেঙ্গে দেন।

একই সময়ে প্রফেট তাঁর সেনাপতি খালিদ ইবন ওয়ালিদকে আদেশ দিলেন প্রতিবেশী গোত্রের যত প্যাগন মন্দির আছে সব ধ্বংস করতে। (জাজিমা গোত্রকে বলা হলো, তোমরা বলো যে ‘তোমরা মুসলিম’ কিন্তু তারা বলল ‘আমরা সাবিয়েন’। এতেই খালিদ পুরো গোত্রকে হত্যা করেন)।

প্রফেট মোহাম্মদ পরে তাঁর প্রথম স্ত্রী খাদিজার কবর জিয়ারত করলেন; তারপর সাফাতে গিয়ে একটা পাথরের ওপর বসলেন। এখানে পূর্বে একটি প্যাগন মূর্তি ছিল, কোরেশরা যার পূজা করত। সব মূর্তি ও মন্দির ধ্বংস করার পর প্রফেট, পূর্বে যারা তার বিরুদ্ধতা করেছিল, তাদের সাথে নমনীয় ভাব দেখালেন এবং সম্মিলিত জনতার উদ্দেশ্যে তিনি আশ্বাসের বাণী দিয়ে তাঁর আনুগত্য গ্রহণ করতে বলেন।

যখন তিনি মক্কায় মহিলাদের উদ্দেশে বলেন, তখন তাঁকে বারে বারে বাধা দেয়া হয় এবং প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করা হয়। বিশেষ করে একজন মহিলা চিৎকার করেই যাচ্ছিল, থামছিল না। তার পরিচয় জিজ্ঞাসা করা হলে সে বলে তার নাম হিন্দা আবু সুফিয়ানের স্ত্রী। সেই বিখ্যাত মহিলা যে অন্যান্য মেয়েদের সাথে দাঁড়িয়ে ওহুদের যুদ্ধে কোরেশদের উৎসাহিত করেছিল। সে-যুদ্ধে প্রফেটের পরাজয় হয়েছিল। প্রফেটের বিরুদ্ধে আবু সুফিয়ানের তীব্র বিরোধিতা প্রকাশ নিয়ে তার স্ত্রী হিন্দার আচরণে, তার অপমানকর উক্তির জন্য, শাস্তি দিতে চাইলে, রাজনৈতিক কারণে প্রফেট মোহাম্মদ তাঁর বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেননি।

দুই সপ্তাহ শহরে অবস্থানের পর প্রফেট মোহাম্মদ মক্কা পরিত্যাগ করলে মক্কাবাসীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

৬.১৮ তায়েফের পতন

যখন প্রফেট মোহাম্মদ সাথে ১২ হাজার লোকজন নিয়ে মক্কা ত্যাগ করেন, তখন দশ মাইল উত্তর-পশ্চিমে হোনায়েনে এসে তিনি দেখতে পান যে হাওয়াজিন গোত্রের একটি সশস্ত্র ফোর্স তার গতি রোধ করেছে। এই হাওয়াজিনের সাথে তায়েফের তাকিফ গোত্রের একটি কন্টিনজেন্ট যোগ দেয়। তায়েফ দলের সাথে ছিল প্রায় চার হাজার যোদ্ধা। প্রফেট মোহাম্মদের যোদ্ধারা অতি বিশ্বাসী ছিল বিজয়ের জন্য, কারণ সংখ্যার দিক দিয়ে তারা দলে ভারি ছিল; কিন্তু হাওয়াজিনরা এমন প্রবলভাবে আক্রমণ করে যে প্রফেটের যোদ্ধারা পালাতে পথ পায় না। এই ঘটনা কোরানে উল্লেখ করা হয়েছে— সংখ্যাধিক্যের জন্য মুসলিমগণ এবং পরবর্তীতে শত্রুর আঘাতের কারণে পলায়ন (৯ : ২৫) করে।

বিজয়ের জন্য ডাক দিয়ে প্রফেট মোহাম্মদ একমুঠো ধুলো নিয়ে শত্রুর আক্রমণের দিকে ছুড়ে দেন এবং বেশ কষ্ট করে সৈন্যদের আবার যুদ্ধে ফিরিয়ে আনেন। ঐশী সাহায্যের ফলে, মুসলিম সেনা আবার জড়ো হয় এবং ভীষণযুদ্ধের পর মুসলিম সেনারা হাওয়াজিন ও থাকিফ সেনাদের অটাসের উপত্যকা পর্যন্ত তাড়িয়ে নিয়ে যায় এবং শেষমেশ তাদের পরাজিত করে। হোনায়েনের যুদ্ধে মুসলিমদের বিজয় হলেও (১ ফেব্রুয়ারি ৬৩০) এতে উভয় পক্ষে সেনাবাহিনীর অনেক লোক হতাহত হয়।

প্রফেট মোহাম্মদ তখন তায়েফের দিকে ঠেলা মারেন। ৬১৯ সালে এই তায়েফ শহরে তিনি সঙ্গীসহ অপমানিত হয়েছিলেন সে ঘটনা তাঁর মনে পড়ে, তাই প্রতিশোধ নিতে বদ্ধপরিকর হন। সলমন ফার্সিতাকে উপদেশ দেন গুলতি ব্যবহার করতে (পাথর ছুড়ে মারার যন্ত্র Catapult) তখন গুলতি দিয়ে অপারেশন শুরু হয়। কিন্তু তায়েফ শহরের দেয়াল থেকে তাদের তীরন্দাজরা তীর ছুড়ে যখন প্রফেট বাহিনীর কয়েকজন লোক মেরে ফেলে, তখন গুতি বন্ধ করে শহর দখল করার ইচ্ছা পরিহার করেন। এর পরিবর্তে তিনি তায়েফ শহরের বাইরে অবস্থিত ফলের বাগান ও দ্রাক্ষাকুঞ্জ লুণ্ঠন করে ধূলিসাৎ করার আদেশ দেন এবং মদিনা ফেরার পূর্বে এ কাজ সম্পন্ন করা হয়।

মদিনার আশপাশের গোত্ররা যখন প্রফেটের কাছে আত্মসমর্পণ করতে থাকল, তখন তায়েফের তাকিফ প্রধান আরওয়া ইবন মাসুদ মদিনায় এসে প্রফেটের কাছে ইসলাম দীক্ষা নেন। এই আরওয়া আবু সুফিয়ানের জামাতা হোদায়বিয়ার সন্ধির সময় প্রফেটের সাথে দুর্ব্যবহার করেছিলেন। তায়েফে ফিরে তিনি শহরের সব লোকদের নতুন ধর্ম গ্রহণ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে গিয়ে তাদের হাতে তীর বিদ্ধ হয়ে মারা যান। এর কয়েক মাস পরে, যাই হোক, তায়েফের তাকিফ গোত্র দেখল যে ইসলাম গ্রহণ থেকে তাদের বেশি দিন ঠেকিয়ে রাখা যাবে না; তাই ৬৩০ সালে ডিসেম্বর মাসে ছয় দলের এক প্রতিনিধি মদিনায় গিয়ে প্রফেটের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে কী শর্তে ইসলাম গ্রহণ করা যায় তার বিবেচনা করে।

প্রতিনিধি দল প্রস্তাব করল যে তাদের অতি শ্রদ্ধেয় দেবী আল-লাতকে তিন বছরের জন্য প্রতিষ্ঠিত থাকার অনুমতি দিতে হবে। প্রফেট রাজি হলেন না; তারপর তারা তাদের অনুরোধ কমিয়ে এক বছর, ছ’মাস শেষে এক মাস পর্যন্ত অনুমতি চাইল; কিন্তু প্রত্যেকবারই প্রফেট তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। পরিশেষে তারা বলে যে আল-লাতের মূর্তি তারা ভাঙ্গতে পারবে না, বাইরের কাউকে দিয়ে ভেঙ্গে দিতে হবে, যাতে তারা এ পাপকর্ম থেকে বেঁচে যায়। প্রফেট আবু সুফিয়ানকে পাঠান তাঁর প্রতিনিধি রূপে তাঁর কর্ম সমাধা করতে। আবু সুফিয়ান মন্দিরের বাইরে দাঁড়িয়ে ভেতরে ঢুকলেন না—পরে পূজনীয় দেবী মূর্তি ভাঙ্গতে অস্বীকার করলেন। তখন একজন মুসলিম এই কাজটি সমাধান করে। মূর্তিটি ভাঙ্গার সময় সারা শহরে মহিলাদের মধ্যে মাতম, রোনা-পিটনা শুরু হয়ে যায়।

পরবর্তীতে তায়েফিরা তাদের ব্যবহারের জন্য বন্যপশু শিকারের জন্য বিখ্যাত বনভূমি ওয়াজ তাদের কাছে রাখার জন্য আবেদন জানালে সে আবেদন মঞ্জুর হয়। আরো অনুমতি দেয়া হলো মুসলিমদের মতো কড়াকড়িভাবে রমজান পালন না করতে, একটু শৈথিল্য দেখানো হলো। কিন্তু তাদের নিজেদের দ্রাক্ষাকুঞ্জের দ্রাক্ষা দিয়ে তৈরি মদ পান করার অনুমতি দেয়া হয়নি।

তায়েফিরা তাদের জন্য নামাজ পড়া থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার অনুমতি চাইলে বলা হয়, যেহেতু এটা ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের একটি সুতরাং অনুমতি খারিজ করা হলো। পরিশেষে তারা আবেদন করল নামাজ তারা পড়বে তবে পাছা উঁচু করে সেজদা করাটা অপমানকর সুতরাং সেজদা দেয়া থেকে অব্যাহতি দিতে হবে। এ বিষয়ে যে ট্র্যাডিশন আছে তা পরস্পরবিরুদ্ধ। তাই আসলে কী সিদ্ধান্ত হয়েছিল এ বিষয়ে তা জানা যায়নি (Kister, 1980, XT P.।)

এক বর্ণনায় বলা হয়েছে, যখন এই দাবি করা হয় তখন প্রফেট মোহাম্মদ নীরব ছিলেন। মনে হচ্ছিল যেন রাজি হবেন। তায়েফিরা আগ্রহভরে প্রফেটের মুখের দিকে চেয়ে জবাবের জন্য অপেক্ষা করছিল। তখন ওমর মনে করলেন প্রফেট এতে রাজি হলে অন্য মুসলিমদের জন্য সেজদা দেয়া অপমানজনক হতে পারে; তাই তিনি সে মুহূর্তে তরবারি তুলে তায়েফ প্রতিনিধি দলকে বলেন- ‘তোমরা, হে তাকিফদের দল, প্রফেটের হৃদয়-জ্বালিয়ে দিয়েছ, এখন তোমাদের হৃদয় আল্লাহ জ্বালিয়ে দিবেন” আল- জামাখশারি এ প্রসঙ্গে বলেন তখন তাকিফীরা ওমরকে জবাবে বলে, বাপু হে আমরা তোমার কাছে শুনতে আসিনি, এসেছি প্রফেট মোহাম্মদের কাছে।

বলা হয় কোরানে এ প্রসঙ্গে প্রফেটের ইতস্তত করা এবং ওমরের হস্তক্ষেপের কথা উদ্ধৃত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট আয়াত বলছে : ‘আমি তোমার প্রতি যাহা প্রত্যাদেশ করিয়াছি তাহা হইতে উহারা পদস্খলন ঘটাইবার চেষ্টা প্রায় চূড়ান্ত করিয়াছিল আমি তোমাকে অবিচলিত না রাখিলে তুমি উহাদের দিকে প্রায় ঝুঁকিয়া পড়িতে তখন তাহারা তোমাকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করিত (১৭ : ৭৩-৭৫)।’ এখানে রডিনসন বলেছেন (1951, P. 170) যে, আয়াতের শেষ বাক্য ‘তখন তাহারা তোমাকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করত’–এর স্থলে উপস্থাপিত হয়েছে- ‘But at the last moment a friend (Omar) reprehended you’—এখানে আয়াত ৭৫-এ আছে- তাহা হইলে অবশ্যই তোমাকে ইহজীবনে দ্বিগুণ ও পরজীবনে দ্বিগুণ শাস্তি অস্বাদন করাইতাম, তখন আমার বিরুদ্ধে তোমার জন্য কোনো সাহায্যকারী পাইতে না।’ এখানে ‘সাহায্যকারী’ অর্থে ওমর।

এই জন্য প্রফেট মোহাম্মদ জেদ ধরলেন যে তোমাদের (তাকিফী) সেজদা করতে হবে এবং ইবন হিশাম বলেন তখন তাকিফীরা রাজি হয়ে বলে আমরা নামাজ ঐভাবে পড়ব, যদিও এটা অপমানজনক।

প্রফেট ও তাকিফিদের মধ্যে এই চুক্তির কোনো লিখিত রেকর্ড নেই কিন্তু জানা যায় যে, হোদায়বিয়ার সন্ধিরমতো, এখানে ‘মোহাম্মদ ইবন আবদুল্লাহ’ বলা হয়েছে, ‘রসূলুল্লাহ’ বলা হয়নি (Rodinson, 1976, P. 270)।

৬.১৯ প্রতিনিধি দলের বছর (Year of Deputations)

হিজরির নবম সাল (৬৩১ খ্রিঃ)-কে প্রতিনিধি দলের বছর বলা হয়। ঐতিহাসিকরা বলেন যে, মূর্তিপূজা ও বহু দেবতাবাদের ওপর প্রফেটের যুদ্ধবিগ্রহের কথা শীঘ্র সারা আরবে ছড়িয়ে পড়ে এবং তার মক্কা দখলই প্রমাণ করে যে, তার ইচ্ছাকে প্রয়োগ করার জন্য তাঁর যথেষ্ট শক্তি রয়েছে।

তাই আরবের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিভিন্ন গোত্রের দূরবর্তী প্রদেশগুলো থেকেও প্রতিনিধি দল তাড়াতাড়ি প্রফেটের সাথে সন্ধি করে তাঁর দাবি মেনে ও আনুগত্য এনে এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে শান্তি স্থাপনে আগ্রহী হয়ে ওঠে। বলা হয়, তাঁর ব্যক্তিগত ক্ষমতা, তাঁর উক্তির প্রতি বিশ্বস্ততা এবং সরল জীবনযাপনের জন্য বহু গোত্র স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে প্রফেটের জাগতিক ও আধ্যাত্মিক কর্তৃত্বে স্বীকৃতি দিয়ে তাঁর বশ্যতা স্বীকার করে। যারা তাঁর সাথে বিরুদ্ধমত প্রকাশ করার জন্য এসেছিল তারাও তাঁর সাথে আলাপ করে তাঁর মতের স্বীকৃতি দেয়, তাদের আপত্তি করার রাস্তা থাকে না। আর যারা অবন্ধুরূপে ঝগড়া করার জন্য এসেছিল তাঁর সম্মুখে এসে সে মনোভাব দূরীভূত হয়।

আধুনিক পণ্ডিতরা এখন দেখতে পান যে তার সম্বন্ধে এসব প্রশংসনীয় উক্তির সাথে বাস্তবতা ও সত্যতার কিছুটা ভিন্ন রঙ পাওয়া যায়। পরের বছরে যখন প্রফেট মারা যান, আরবের অধিকাংশ অংশ তখনও প্যাগন ও অমুসলিম ছিল। বেশির ভাগ গোত্র প্রফেটের মিশনকে অবজ্ঞা করেছে। কেবলমাত্র নগণ্য কয়েকটি দল প্রফেটের মত গ্রহণ করে এবং বেশ কিছু সংখ্যক গোত্র তার দাবি অগ্রাহ্য করে F. Buhl in. SEI, 1974, P. 403) ।

তাঁর অনুসারীদের মধ্যে প্রধানত মদিনা ও মক্কার গোত্রের সদস্যরা এবং কিছু ছড়িয়ে ছিল সিরিয়ার বাণিজ্য পথে এবং নাজরান ও ইয়েমেনের দিকে এবং এদের মধ্যেও কিছু ছিল যারা কতল হওয়ার ভয়ে ও তাঁর অভিযান থেকে নিরাপদে থাকতে অথবা মালেগণিমতে ভাগ পেতে মুসলিমদের দলে ভিড়েছিল।

ধর্মান্তরিত যা হয়েছিল তা শুধু তরবারির ভয়ে, বাস্তবতার বিশ্বাসের কারণে নয়। কারণ প্রফেটের মৃত্যুর পরেই অনেকে ধর্ম ত্যাগ করেছে, বিদ্রোহী হয়েছে, অনেকে প্রফেট বলে নিজেকে ঘোষণা দিয়েছে যাদের পরবর্তী সময়ে দমন করতে হয়েছিল মুসলিম সামরিক অভিযানে।

৬.২০ বিদায় হজ

৬৩২ সালে ২০ ফেব্রুয়ারি প্রফেট মোহাম্মদ মক্কার উদ্দেশ্যে মদিনা ত্যাগ করলেন বড় হজ করার জন্য, যাকে বাৎসরিক হজ বলা হয়। তার সাথে গেলেন সব স্ত্রী ও বিশাল অনুসারীর দল আর কোরবানির জন্য একশত উট। তিনি স্পষ্টভাবেই জানতেন যে এটা তার জীবনের শেষ হজ নয়, তবুও মুফাসসিরগণ বহু হাদিসে বলেছেন যে তিনি এটা জানতেন।

তিনি বিদায় হজ (হজ্জাত-আল ওয়াদা) পালন করলেন ৬৩২ সালে ৯ মার্চ এবং এটা করে হজ পালনে প্রাক-ইসলাম যুগের পদ্ধতিকে অনুমোদন করলেন অনুসারীদের পালন করার জন্য, যার মধ্যে ছিল প্রাচীন ফরমুলা (archaic formula) যেসব প্যাগনরা পালন করত। শুধু কাবা মন্দিরকে পরিষ্কার করা হলো মূর্তিগুলো ধ্বংস করে আর কেবলমাত্র আল্লাহর নামে উৎসর্গ করা হলো। যেসব প্রাচীন নিয়মকানুন ও পদ্ধতি ছিল সবই অপরিবর্তিত থাকল এবং পুরোপুরিভাবে প্যাগন সংস্কারমুক্ত হয়নি।

এই প্রাচীন প্যাগন প্রতীকীগুলোর সাথে কট্টর একেশ্বরবাদ, যা প্রফেট প্রচার করেছিলেন তার সাথে সামঞ্জস্যহীন ছিল এবং এর বিরুদ্ধ মানুষে বিরূপ মন্তব্য করতে ছাড়েনি। ইসলামী যুগের শুরু থেকেই শতাব্দিকালের মধ্য দিয়ে কিছু কিছু মুসলিম বিশেষ করে সুফি রহস্যবাদীরা এসবের বিরুদ্ধে তাদের মন্তব্য প্রকাশ করেছেন, এমন কি এ ধরনের হজ পালনের প্রয়োজন আছে কিনা, সন্দেহ প্রকাশ করেন। কয়েকজন, ওমরসহ, কালো পাথরের পূজাকে ঘৃণ্য অনুষ্ঠান বলে মনে করেছেন।

হজের শেষে প্রফেট মোহাম্মদ বিশাল জনসমাবেশের সম্মুখে ভাষণ দেন আরাফাত পর্বতের শীর্ষে আরোহণ করে যাকে আমির আলী বলেছেন ‘পর্বতের ভাষণ’ (Sermon of the Mount) – 1965, P. 114)।

প্রফেট শুরু করেন, হে লোক সকল আমার কথাগুলো শোন, কারণ আমি জানি না এ বছর পর আমি ভবিষ্যতে তোমাদের সাথে এইভাবে এখানে মিলিত হব কিনা; কোরানের এক আয়াত দিয়ে ভাষণ শেষ হয়। এই দিনে আমি তোমাদের ধর্মকে পরিপূর্ণ করিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের ধর্ম বলে মনোনীত করিলাম। (৫ : ৫)। তারপর আকাশের দিকে মুখ তুলে তিনি বলেন- ‘হে আল্লাহ আমি আমার ভাষণ বিবৃতি করলাম, আমি আমার কাজ সম্পূর্ণ করলাম।

আধুনিক পণ্ডিতগণ আর একবার এই ভাষণের টেক্সটের সত্যতা সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করে সন্দেহবাদী হয়েছে যে, প্রফেট মোহাম্মদ যখন মক্কায় ছিলেন তখন অনেকের সাথে গোপন আলাপ (private talks) করেছেন এবং জনসভায় ভাষণও দিয়েছেন— সেই সময় তিনি অনেক নির্দেশ ও উপদেশ দিয়েছিলেন। বলা হয় যে, বহু দশক ধরে সেই গণভাষণ ও গোপন আলাপের বিষয়বস্তু (contents) সংগ্রহ করা হয়েছে, গোছানো হয়েছে এবং আলেম ব্যক্তিদের দ্বারা সুশোভিত হয়ে (embellished) শুভ কামনায় আলোচনা (valedictory discouse) আকারে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।

এই বিদায় হজের ভাষণে সংক্ষিপ্তকারে বলা হয়েছে- মুসলিমদের সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার, ধর্মভীরুতা এবং উম্মার ঐক্য সম্বন্ধে। এর সাথে আরো বলা হয়েছে পবিত্র মাসের সাথে জড়িত বিষয় সম্বন্ধে চান্দ্র মাসের ক্যালেন্ডার, সুদ খাওয়ার অবসান, রক্ত-জড়িত কলহ বন্ধ করা, স্বামী-স্ত্রীর অধিকার, ব্যভিচারের জন্য পাথর ছুড়ে হত্যা, মিথ্যা দাবি যারা করে তাদের ঘৃণা করা, ঈশ্বরের নিন্দাবাদ ও ফেরেশতাদের ওপর বিশ্বাস এবং ক্রীতদাসদের সাথে সদয় ব্যবহার এবং আগামী দিনের আশা ছেড়ে বর্তমান ধারণাকে লালন করা ইত্যাদি।

এই বিদায় হজের পর প্রফেট মোহাম্মদ মদিনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন আর কখনো মক্কাতে ফেরার সুযোগ হয়নি।

৬.২১ প্রফেট মোহাম্মদের মৃত্যু

প্রফেট মোহাম্মদের মৃত্যু সম্বন্ধে অনেক বিবরণ আছে এবং এর বিস্তৃত ব্যাখ্যা যা সুন্নি (অর্থোডকস), আয়েশা, শিয়া (আলীব দল), আব্বাসের দল এবং অন্যান্য মতবাদীরা দিয়েছেন তা একের সাথে অন্যটি মেলে না অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সাথে।

মৃত্যুর পূর্বে প্রফেট অনেক সময়ে মুসলিমদের মধ্যে অনৈক্য দেখে হতাশ হন এবং বিবদমান গোত্রগুলোকে সংঘবদ্ধ করতে না পেরে তিনি মন্তব্য করেছিলেন, ‘আমি তাদের সাথে বসবাস করে দেখেছি যে তারা কখনো ঝগড়া-ফ্যাসাদ বন্ধ করেনি, তারা আমার পোশাক ধরে টানাটানি করেছে, আমার অঙ্গে ধুলো দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছে, যতদিন পর্যন্ত আমি আল্লাহর কাছ থেকে বিশ্রাম না পেয়েছি।’

৬৩২ সালের মে মাসের শেষের দিকে মৃত্যুর দশ দিন পূর্বে তিনি তাঁর এক সাহাবীকে সাথে করে বাকি কবরস্থানে গিয়েছিলেন এবং কিছুক্ষণের জন্য কবরের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিলেন। দলীয় কোন্দল সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সচেতন থেকে তিনি মৃতদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন— ‘হে কবরবাসীগণ তোমরা নিশ্চয়ই যারা বেঁচে আছে তাদের চেয়ে অনেক সুখে আছো। আমার উম্মাহর মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ, মারামারি-হানাহানি তমসা-তরঙ্গের মতো তাদের ওপর পতিত হচ্ছে এবং তারা অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে।

বাকি সমাধি ক্ষেত্র থেকে তিনি বাড়িতে ফিরলেন ভীষণ মাথা-যন্ত্রণা ও জ্বর নিয়ে এবং মায়মুনার ঘরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। তাঁর জ্বর এক সপ্তাহের মতো ছিল তার পর তিনি একটু সুস্থ বোধ করলে তিনি তাঁর অনুসারীদের সাথে কথাবার্তা বলেন, যদিও তিনি আবুবকরকে মসজিদে নামাজ পরিচালনা করতে বলেছিলেন। ৬ জুন তিনি আবার জ্বরে আক্রান্ত হন এবং স্ত্রী উম্মে সালমার ঘরে যান- সেখানে তাঁর আরো দুই স্ত্রী আয়েশা ও উম্মে হাবিবা উপস্থিত ছিলেন।

রাতে তাঁর জ্বর বাড়াতে তিনি কাতর হয়ে পড়েন এবং যন্ত্রণায় জোরে গোঙাতে থাকেন; তখন আয়েশা তাঁকে বলেন যে অন্যদের অসুখের সময় তিনি যেভাবে সান্ত্বনা দিতেন, নিজেকেও সেইভাবে সান্ত্বনা দিলে আরাম বোধ করবেন। তিনি বলেন- হে প্রফেট, আমাদের মধ্যে যদি কেউ কেউ অসুখে এই ভাবে গোঙাতো, নিশ্চয়ই আপনি তাকে তিরস্কার (reprimand) করতেন। জবাবে তিনি বলেন, “তা ঠিক, তবে আমার জ্বর-যন্ত্রণা তোমাদের দুই জনের মতো তীব্র।’ তিনি আরো বলেন- যন্ত্রণা ভোগের অর্থ হলো পাপ মোচন (expiation for sin) এবং তার পূর্বে যেসব প্রফেট যন্ত্রণায় ভুগেছিলেন তাদের নাম উচ্চারণ করেন।

পরদিন, ৭ জুলাই তাঁর যন্ত্রণা এতো তীব্র হলো যে তিনি জ্ঞান হারালেন, উম্মে সালমা প্রস্তাব করলেন আবিসিনিয়ার রেসিপি অনুযায়ী গাছ-গাছড়ার মূল বেঁটে তার রস খাওয়ানো হোক এবং তা-ই করা হলো। এই রস পান করার পর একটু জ্ঞান ফিরলে তিনি সন্দেহ প্রকাশ করে বলেন- ‘তোমরা আমাকে কী খাইয়েছ? এবং রাগান্বিত হয়ে বলেন— ঐ ওষুধ আমার সামনে এই ঘরে যারা আছ সকলেই খাও। মৃত্যুপথযাত্রী প্রফেটের সম্মুখে তখন সকলেই গ্রহণ করলেন।

তখন মেয়েদের মধ্যে কথাবার্তা ফিরে দাঁড়াল আবিসিনিয়ার ওষুধ থেকে খোদ আবিসিনিয়াতে। উম্মে সালমা এবং উম্মে হাবিবা উভয়েই সে দেশে নির্বাসনে ছিলেন। তারা সেখানকার সুন্দর মারিয়া ক্যাথিড্রালের কথা এবং তার দেয়ালে আঁকা সুন্দর সুন্দর ছবির কথা উল্লেখ করলেন। তাদের একথা শুনতে পেয়ে প্রফেট মোহাম্মদ চিৎকার করে বলে উঠলেন- ‘আল্লাহ ইহুদি ও খ্রিস্টানদের ধ্বংস করুক, আল্লাহর আগুন তাদের বিরুদ্ধে জ্বলে উঠুক। এই আরব দেশে ইসলাম ছাড়া আর কোনো ধর্ম যেন না থাকে।’ প্রফেট মোহাম্মদের এই নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালিত হয়েছিল প্রফেটের মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকারী খলিফা- বিশেষ করে আবুবকর ও ওমর। আরব দেশের ইহুদি-খ্রিস্টানরা সম্পূর্ণরূপে বিতাড়িত হয়েছিল।

পরের দিন সকালে সোমবার ৮ জুন ‘ঐ অভিযুক্ত রমণী’ শিয়ারা যেমন তাঁকে সব সময়েই বলে থাকে, প্রফেটকে তার ঘরে নিয়ে যাবার জন্য তাঁকে বোঝালেন, তিনি রাজি হলেন। আয়েশার দাবি ছিল ৮ জুন তার পালার তারিখ, যদিও এ সম্বন্ধে মতভেদ আছে। গুজব ছিল যে, প্রফেট তার ঘরে যাবার পর, আয়েশা প্রফেটের ঘনিষ্ঠ হয়ে তাকে প্রভাবিত করতে লাগলেন যাতে তার মৃত্যুর পর আয়েশার পিতা আবু বকর খলিফা হতে পারেন।

এই সময়ের মধ্যে প্রফেটের কয়েকজন সাহাবা (সঙ্গী) সেই ঘরে প্রবেশ করেন। শিয়াদের মতে, প্রফেট মোহাম্মদ ইচ্ছা করেছিলেন তাঁর পরে আলী খলিফা হবে এবং যদিও তিনি দিন দিন দুর্বল হয়ে যেতে থাকেন, তবুও তিনি কলম ও কালি নিয়ে আসতে বললেন তাঁর উত্তরাধিকারী সম্পর্কে লিখে যাবার জন্য। ইবন আব্বাস এই ঘটনা সম্বন্ধে বলে গেছেন এবং বর্ণনা করেছেন আল-বোখারী ও মুসলিম ইবন আল- হাজ্জাজ। ট্র্যাডিশন বলে যে, ওমর ভয় করলেন হয়তো প্রফেট আলী সম্বন্ধে লিখতে পারেন, ওমর আলীর চেয়ে আবুবকরকে পছন্দ করতেন তাই তিনি যারা কালি-কলম আনতে গিয়েছিলেন তাদের ডেকে পাঠান। তিনি তাদের ডেকে বললেন, ওগুলো এখন রাখো; দেখছ না প্রফেট ভুল বকছেন জ্বরের ঘোরে, এ বিষয়ে কোরান আমাদের জন্য যথেষ্ট’ (Hughes, 1977 P. 386)।

অন্যরা জেদ করল কালি-কলম নিয়ে আসতে; এতে উভয় পক্ষের মধ্যে কথা কাটাকাটি, গোলমাল শুরু হলো মরণাপন্ন প্রফেটের বিছানা ঘিরে। যতক্ষণ না প্রফেট বিরক্ত হয়ে তাদের চুপ করতে বলেন। তিনি বললেন আমার সামনে ঝগড়া করো না, আর কিছু বলতে পারলেন না, শুধু বললেন খিলাল নিয়ে এসো। তাকে খিলাল দেয়া হলে মুখ তুলে দাঁত পরিষ্কার করলেন। তারপর তিনি আবার শুয়ে পড়লেন।

১৫২

প্রফেট মোহাম্মদ মারা গেলেন প্রায় বাষট্টি বছর বয়সে, আঠারো বছরের তরুণী স্ত্রী আয়েশার বুকে মাথা রেখে। আয়েশা যেমন বলেন : প্রফেট আমার দুই বাহুর মধ্যে মারা যান। তাঁর মাথা ছিল আমার বুকে, সে দিন আমার পালা ছিল, এতে আমি অন্য কারোর সাথে অন্যায় করিনি।

প্রফেটের মৃত্যুর সংবাদ মদিনাতে সাথে সাথে প্রচার হয়ে গেল। শোকাহত মুসলিমরা দিকহারা হয়ে পড়ল। এক সমসাময়িক ব্যক্তি উল্লেখ করেছেন ‘বৃষ্টির রাতে ভেড়ার দলের মতো’। কেউ কেউ তাঁর হঠাৎ মৃত্যুর জন্য উদ্বিগ্ন হলেন। প্রফেট নিজেই কোনো দিন চিন্তা করেননি যে তিনি এমনি হঠাৎ মৃত্যুমুখে পতিত হবেন। তিনি অনেক পরিকল্পনা করেছিলেন এবং আর একটা অভিযানের জন্য তৈরি হচ্ছিলেন।

মানুষ এ কথা বিশ্বাস করতে পারছিল না, কেমন করে প্রফেট হঠাৎ মারা গেলেন? তাঁর কাছে মৃত্যুর পূর্ব সংবাদ আসেনি কেন? কেন আল্লাহ তাঁর রসূলকে ওহি পাঠিয়ে সাবধান করেননি? কেমন করে তিনি অশোভন (unedifying) ভাবে যুবতী স্ত্রীর বুকে ও কোলে শুয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারেন? কেমন করে তিনি কোনো পুত্ৰ সন্তানকে উত্তরাধিকারী হিসাবে না রেখে ‘পুত্রহীন ভাবে চলে যেতে পারেন (আবতার) কোরানে যাকে ‘স্বর্গীয় শান্তির চিহ্ন (Sign of divine punishment) বলে গণ্য করা হয়েছে (১০৮ : ৩)। কেমন করে আল্লাহ উত্তরাধিকারীর প্রশ্নটিকে ‘সেটেল’ না করে তাঁকে দুনিয়া ছেড়ে চলে যাবার অনুমতি দিলেন?

অনেকে বিশ্বাস করে যে প্রফেট একটা ‘পবিত্র সম্মোহের’ (holy trance) মধ্যে সাময়িকভবে জ্ঞানহারা (coma) ছিলেন এবং হয়তো শীঘ্র তাঁর জ্ঞান ফিরে আসত। যখন এই ‘দেহের পুনরুত্থান’ (bodily resurrection) ঘটেনি, অনেকেই হতাশ হন। ওমর শোকে পাগল হয়ে গেলেন, তরবারি খিঁচে জনতার মধ্যে ছুটে গিয়ে চিৎকার করে বলেন- প্রফেট মারা গেছেন যে বলবে আমি তার মাথা কেটে ফেলব। যিশুর মতো তাকে স্বর্গে তুলে নেয়া হয়েছে (Kazi and Flynn, 1984 P. 18)। কিন্তু অল্প সময়ের জন্য এবং যিশুর মতো আবার ফিরে আসবেন (Esin 1963 P. 118)।

প্রফেটের মৃত্যুর সময় আবুবকর মদিনার বাইরে সানেহ্-তে ছিলেন। মৃত্যুর সংবাদ পেয়েই মদিনায় ফিরে আসেন। তিনি ওমরকে শান্ত করেন এবং জনগণের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন- হে লোকসকল যদি মোহাম্মদকে কেউ পূজা করে থাকে, সে জানুক যে তিনি মৃত। কিন্তু যদি কেউ আল্লাহকে পূজা করে থাকে, সে জানুক যে আল্লাহ বেঁচে আছেন এবং সর্বকালের জন্য তিনি অমর। তারপর তিনি কোরান থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলতে থাকেন যে, ‘সকলের মতো, হে মোহাম্মদ তুমিও মারা যাবে’ (৩৯ : ৩১)। আবার ‘মোহাম্মদ একজন রসূল ছাড়া কেউ নন এবং তাঁর আগে সব রসূলই মারা গেছেন তবুও যদি তিনি মারা যান বা নিহত হন, তবে তোমরা কি পৃষ্ঠ প্রদর্শন করিবে?’ (৩ : ১৪৪)

পরে অনেকে, ওমরসহ, অপ্রমাণিত অভিযোগ করেছিল যে, এই সব বক্তব্যের কোনো সংকলিত রেকর্ড নেই, এর অর্থ এই ছিল যে পরিস্থিত বুঝে আবুবকর এসব আবিষ্কার করেন এবং কোরান সংস্কারের সময় তার এই বক্তব্য জুড়ে দেয়া হয়। কিন্তু বেশির ভাগ পণ্ডিতরা তা মনে করেন না।

৬.১২ দাফন

প্রফেটের মৃত্যুর সময় পরস্পর বিপরীত যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, মৃত্যুর তাৎক্ষণিক পরেও ঘটনা বর্ণনায় বিক্ষিপ্ত অবস্থা দেখা যায় অর্থাৎ এক বর্ণনা অন্যটার সাথে মিলে না।

আগেই বলা হয়েছে যে, উত্তরাধিকার নিয়ে মরণাপন্ন প্রফেটের সামনেই দুই দলে (শিয়া-সুন্নি) ঝগড়া শুরু হয়েছিল। তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই এবং তাঁর মৃতদেহ উষ্ণ থাকাকালীন অবস্থায় আরো কমড়াকামড়ি শুরু হয় বিবদমান দলের মধ্যে। মৃতদেহ আয়েশার ঘরেই ছিল এবং মদিনার শোকাহত লোকজন এক এক করে দেখে যায়। ঘরে পুরুষ মানুষের ভিড় থাকার জন্য আয়েশা প্রফেটের অন্য বিধবার ঘরে আশ্রয় নেন।

প্রফেট মোহাম্মদের দু’জন শ্বশুর – আবুবকর ও ওমর আয়েশার ঘরেই ছিলেন, তখন পড়তি বিকালবেলায় সাদ ইবন ওবাইদা তাদের (আবুবকর ও ওমরকে) জানান যে, খাজরাজ গোত্রের নেতা, বানু সাইদাতে এক মিটিং ডেকেছে, প্রফেটের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার ও এই বিষয়ে অন্যান্য প্রশ্ন আলোচনা ও সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য।

আবুবকর ও ওমর তখন সিদ্ধান্ত নেন যে জানাজার জন্য কালক্ষেপণ না করে বানু সাইদাতে যাওয়া দরকার। তাই পরিবারের সদস্যদের আলীর অধীনে

মৃতদেহকে দেখাশোনার ভার দিয়ে তারা ত্বরিত গতিতে মিটিং-এর উদ্দেশ্যে রওনা দেন। এর ফলে, বর্ণনা মতে, সারা দিনের মতো মৃতদেহ অবহেলা করে ফেলিয়ে রাখা হয়। আলী ও তার সাপোর্টারগণ মিটিং সম্বন্ধে কোনো খবর রাখলেন না এবং কেউ তাদের এ সম্বন্ধে জানাতে উৎসাহী হয়নি (zakaria, 1983 P. 44)। আয়েশাকে তার বাবা মিটিং সম্বন্ধে জানিয়েছিলেন। আয়েশা তখন মিটিং-এ সংবাদ পাঠান যে প্রফেট মৃত্যুকালে ইচ্ছা প্রকাশ করতে যান যে, আবুবকর তার খলিফা হবে।

দুইটি প্রধান দল নির্বাচক মণ্ডলীরূপে প্রতিনিধিত্ব করে। একটা মদিনার আনসার দল, তাদের নেতা খাজরাজ গোত্রের প্রধান সাদ ইবন ওবাদা। অন্য দলটি মক্কার মোহাজের দল, নেতৃত্ব দেন প্রফেটের ঘনিষ্ঠ সাহাবী তিনজন সকলেই কোরেশ গোত্রভুক্ত। এদের মধ্যে ছিলেন আবুবকর, ওমর আর আবু ওবাইদা। এদের মিত্রদল ছিল মদিনার আউস গোত্র খাজরাজ গোত্র বিরোধী ও নেতৃত্বের প্রতিদ্বন্দ্বী।

মিটিং সোমবার (যে বারে প্রফেট মারা যান) সারারাত ধরে চলে। শুরু থেকেই উত্তপ্ত আলোচনা তর্ক-বিতর্ক চলতে থাকে উত্তরাধিকার নিয়ে। আনসাররা দাবি করল যে মদিনার একজন নেতা প্রফেটের উত্তরাধিকারী হওয়া উচিত। কিন্তু আবুবকর জেদ ধরেন যে কেবলমাত্র কোরেশ গোত্র থেকেই উত্তরাধিকারী সকল আরবদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে এবং ওমরের সহযোগিতায় এবং আয়েশা কর্তৃক নেপথ্যে যে সঙ্কেত পাঠান আবুবকর খলিফা নির্বাচিত হন।

তারপর প্রফেটের দাফন নিয়ে শুরু হলো বিশদ আলোচনা। মক্কার মোহাজেরগণ চাইল মৃতদেহ মক্কাতে নিতে হবে যেখানে তিনি জন্মেছেন, জীবনযাপন করেছেন, আনসারগণ চাইল দাফন হবে মদিনাতে, এখানেই তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, এবং মৃত্যুবরণও করেছেন। কয়েকজন প্রস্তাব করে যে মৃতদেহ জেরুজালেমে নিতে হবে কারণ সেখানে অন্যান্য প্রফেটদের সমাধি আছে, শেষমেশ সুবিধার কারণে ও অন্যান্য বিষয়ে দেখভাল করার জন্য সকলেই সম্মত হলেন যে দাফন মদিনাতেই হোক।

কোন শহরে দাফন হবে ঠিক হওয়ার পর, প্রশ্ন উঠল কোথায় দাফন কোথায়? মদিনার কোনো স্থানে দাফন হবে। অনেকে বললেন— মদিনার বাইরে বাকি কবরস্থানে দাফন হোক, কারণ সেখানে তাঁর পুত্র ইব্রাহিম, কন্যা রোকেয়া ও অনেক সাহাবীর কবর রয়েছে। অন্যরা বলল – মসজিদের মিম্বরের কাছে যেখানে তিনি ইমামতি করতেন সেখানে হোক। আলোচনায় উপস্থিত যারা ছিলেন তাদের কেউ জানত না যে দাফনের কাজ তাড়াহুড়ো করে অন্য স্থানে ব্যবস্থা হচ্ছে।

এক বর্ণনা অনুযায়ী প্রফেটের মৃতদেহ শবাধারেই পড়ে ছিল চব্বিশ ঘণ্টা। আবুবকর ও ওমর বানু সাইদার মিটিং থেকে ফিরে এসে মোনাজাত ও ভাষণ সেরে মঙ্গলবার সন্ধ্যায়, আয়েশার ঘরেই মৃতদেহ দাফন করা হলো।

অন্য আর একটি বর্ণনা মতে বলা হয়েছে যে, আবুবকরের নির্বাচনের সংবাদ সোমবার রাতে আলীর কাছে পৌঁছানো হয়, যখন তিনি তার শ্বশুরের মৃতদেহের পাশে চুপচাপ বসে ছিলেন, তার সাথে ছিলেন আব্বাস, প্রফেটের চাচা, আব্বাসের পুত্র ফজল এবং প্রফেটের পালিত পুত্র জায়েদের ছেলে ওসামা।

আলী মনে করেন জানাজা নিশ্চয়ই আবুবকর পরিচালনা করবেন, তাই এটাকে এড়াবার জন্য আর দেরি না করে প্রফেটের মৃতদেহের দাফনের বন্দোবস্ত করেন আয়েশার ঘরেই যেখানে তাঁর মৃত্যু হয়, সেই মতে মৃতদেহ তাড়াতাড়ি গোসল করিয়ে দাফনের বন্দোবস্ত করা হয়, পরে তিনটি জোব্বা (Cloaks) দিয়ে কাফন করা হয়। তারপর কবর খোঁড়া শুরু হয়। ইবন হিশাম বলেন— কবর খোঁড়ার শব্দ প্রফেটের বিধবাদের কানে পৌঁছে এবং তারা বুঝতে পারে যে দাফন কার্য চলছে। মঙ্গলবার ৯ জুন সকালে কবরের নিচে মৃতদেহ নামানো হয় এবং মাটি চাপা দেয়া হয়। আবুবকর বা ওমর কেউ উপস্থিত ছিলেন না।

আবুবকরের নির্বাচনে আবু সুফিয়ান বাধা দেন এবং আলীর দল শিয়ারা এ নির্বাচন কখনো গ্রহণ করেনি। এই বিরোধ শুরু হলে পরবর্তী সপ্তাহ ধরে চলতে থাকে তারপর মাস ও বছর ধরে। শিয়া সুন্নির এই বিরোধ কখনো থেমে থাকেনি এবং ইসলাম বিভিন্ন সম্প্রদায় ও মতবাদে ভাগ হয়ে ধর্মীয় দ্বন্দ্বাকারে রূপ নেয়। অন্য বিরোধে সামান্য মতভেদ থাকলেও উত্তরাধিকার নিয়ে যে দ্বন্দ্ব, মতবাদ ও অনুষ্ঠান তার আজ পর্যন্ত কোনো সুরাহা হয়নি। অনন্তকাল পর্যন্ত এই দ্বন্দ্ব চলতে থাকবে হয়তো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *