৪। ইসলাম-পূর্ব আরব

৪. ইসলাম-পূর্ব আরব

৪.১ আরবি ভাষা

আরবি সেমেটিক ভাষাগুলোর মধ্যে একটি। ইসলামের পূর্বে এ ভাষার যথেষ্ট উন্নতি হয়েছিল এবং ৪৮০ খ্রিস্টাব্দেই জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং আরবের অধিকাংশ অঞ্চলে এ ভাষা দ্রুত প্রসার লাভ করে। কবিরা এ ভাষায় কবিতা বর্ণনা করেছে এবং কস বিন সাইদা ও তায়েফের উমায়া এই ভাষাতে সংস্কার ও শিক্ষা-দীক্ষা দিতে শুরু করেন।

এই ভাষার প্রধান পৃষ্ঠপোষক আরাবিরা খ্রিস্টান রাজ্যগুলোতে প্রধানত হিরার লাখমিদদের মধ্যে। এই লাখামিদরা সরকারি ভাষা হিসাবে আরবিকে প্রথমেই গ্রহণ করে ৫২০ খ্রিস্টাব্দে এবং ষষ্ঠ শতাব্দির শেষের দিকে এই ভাষা সারা আরব পেনিনসুলাতে ছড়িয়ে পড়ে কবিদের কবিতা ও ভ্রাম্যমাণ গাতকদের দ্বারা (হুমায়ূন আহমেদ গাতক শব্দটি চালু করেছেন)। এই আরবি সাহিত্য, ব্যাকরণ ও শব্দভাণ্ডার পরিপূর্ণ হয়েছে নন-আরব বিদেশী শব্দের দ্বারা, বিশেষ করে আরামাইক, সিরিয়াক, হিব্রু, পাহলবি, ইথিওপিক, গ্রিক ও গ্রিক ইউনান এবং বাইজানটাইন (রুম)।

এই নতুন ভাষা উত্তরোত্তর প্রসার লাভ করতে থাকল, শব্দ ব্যবহার ও প্রকাশের ধারাকে অবস্থার সাথে সঙ্গতিপূর্ণভাবে কিছুটা পরিবর্তন করে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে হিজাজের অবস্থান মধ্যপথে, তাই আরবে অন্যান্য অঞ্চল থেকে হিজাজে বিদেশীদের দ্বারা বেশি প্রভাবিত এবং এখানেই পরবর্তীতে কোরানিক আরবি ভাষার উৎপত্তি। প্রফেট মোহাম্মদের পূর্বে হেজাজে কোরানিক ভাষার পরিচিতি ঘটেছিল বেশি কেননা সংকলনের সময় হেজাজে প্রচলিত ভাষা ব্যবহৃত বেশি হয়েছে বলে অনেকে ধারণা করেন।

ইসলামের পরে এই ভাষার আরো উন্নতি হয় লেখক ও পণ্ডিত ব্যক্তিদের দ্বারা, প্রধানত খ্রিস্টান অধ্যুষিত এলাকা কেন্দ্র নাজাফ (পূর্বে হিরা), কুফা (একদা একুলা বলে কথিত) এবং বসরা (পূর্বে খ্রিস্টান স্থাপনা)। কুফা ও বসরা উভয়ের বাসিন্দা পরিশুদ্ধ ভাষায় কথাবার্তা বলে থাকে, যে অঞ্চলে একদা খ্রিস্টান লাখমিদ বংশ রাজত্ব করেছে এবং তাদেরই সাংস্কৃতিক ট্র্যাডিশন এখনো বজায় আছে।

৪.২ আরাবিক হস্তলিপি

আরবি হস্তলিপি আবিষ্কারের বহু পূর্বে আরবের বিভিন্ন অঞ্চলে আঞ্চলিক স্থানীয় কথিত শব্দে লিখিত হতো এবং এর মধ্যে অনেকেই ছিল খ্রিস্টের জন্মের বহু শতাব্দির পূর্বে। এই সব হস্তলিপির প্রতিলিপি খোদিত ছিল বিভিন্ন প্রস্তর খণ্ডে যার প্রথম নিদর্শন পাওয়া যায় দক্ষিণ আরবে মোসনাদ প্রতিলিপিতে। এইসব লিপি ছিল হিমিয়ারাইট। সাবিয়েন, মিনায়িয়েন এবং অন্যান্য দক্ষিণ অঞ্চলে ডায়ালেক্ট কথাভাষা। এছাড়া ইসলাম-পূর্ব প্রতিলিপি ছিল তালমুদ, লিহিয়ানাইট এবং সাফাইট (উত্তর-পশ্চিম দক্ষিণের সাফা)। উল্লেখযোগ্য অন্যান্য প্রমাণ ছিল মোসনাদ আরামাইক, নাবা তিয়ান, সিরিয়াক ও গ্রিক হস্তলিপির, যা পাওয়া গিয়েছিল ২৬৭ খ্রিস্টাব্দে হিজরে, নামারায় (৩২৮ খ্রিঃ), এলেপ্পোর দক্ষিণ-পশ্চিমে জাবাদে (৫১২ খ্রিঃ) এবং হাররানে (৫৬৮ খ্রিঃ)।

এটি অনুমিত যে, ৫২০ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ আরবের হস্তলিপির মতো কিছু পাওয়া গেছে হিজাজে, যদিও এখন এর কোনো প্রমাণ নেই। এই অঞ্চলে হিব্রু ও সিরিয়াক হস্তলিপি অজানা ছিল না।

প্রাথমিক আরবি হস্তলিপির ইতিহাস পরিষ্কার নয়, ধোঁয়াশাপূর্ণ, বিক্ষিপ্ত। বিশ্বস্ত সূত্রের এ তথ্য ভ্রান্তিপূর্ণ এবং উৎসও ছেঁড়া ছেঁড়া। পুরনো ট্রাডিশনের অনেকটা এ বিষয়ে সংকলন করেন হিশাম আল-কালবি (মৃ. ৮২০) এবং হাইথাম ইবন আদি (মৃ. ৮২১); পরে সংকলিত হয়েছে কালাধুরি (মৃ. ৮৯২) কর্তৃক সংগৃহীত কিছু নতুন মালমশলা থেকে। এই সংকলিত গ্রন্থ ব্যাফ্রিয়ান ঐতিহাসিক ইবন খালিকান (মৃ. ১২৮২) কর্তৃক আরও নতুন আঙ্গিকে পরিবর্ধিত করা হয়েছে।

কথিত আছে যে প্রায় ৫১০ খ্রিস্টাব্দে খ্রিস্টান তাঈ উপজাতির বাইয়ান গোত্রের তিনজন মানুষ হারামাইক বর্ণমালার অক্ষর গ্রহণ করেছিল। এই বর্ণমালা দ্বিতীয় শতাব্দিতে নাবাতিয়ানরা ব্যবহার করত। নাবতিয়ানরা এই বর্ণমালা থেকে বাইশটি অক্ষরের আরবি হস্তলিপির মূল কাঠামো উৎপন্ন করে। এই হস্তলিপি পরে আনবারের মোরামির ইবন মোরা কর্তৃক পরিশীলিত হয়। আনবার ছিল খ্রিস্টান উপজাতি ইয়াদ (Iyad)-এর রাজধানী।

মোরামির এক সিরিয়াক পণ্ডিত ব্যক্তির আরবি নাম। এই পণ্ডিতের আসল নাম ছিল মার আমের। তিনি এই বাইশ অক্ষরের সাথে আরও ছয়টি অক্ষর যোগ দিয়ে মোট আটাশটি অক্ষর করেছেন।

নতুন অক্ষরের আকৃতি প্রাচীন সিরিয়ায় চৌকো মডেল থেকে গ্রহণ করা হয়েছে এবং একে অনেককাল ধরে ইবাদ উপজাতির আকুলা শহরের খ্রিস্টান ক্যালিগ্রাফাররা পারফেক্ট করে তুলেছেন। এ লেখার ধারা ছিল খোদাই করা, যেমন পাথর কেটে লিখে পরে চার্চের দেয়ালে বসিয়ে দেয়া। যে আকুলা শহরে এই সব উন্নয়নের কাজ হয় তার নাম পরিবর্তন হয়ে এখন কুফা হয়েছে কারণ এই লিখন পদ্ধতির নাম ছিল কুফিক (Kufic)। এই পদ্ধতি স্মারকলিপির উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতো, পরে আলঙ্কারিত পদ্ধতিতে কোরান লিখিত হয়। কুফিক বর্ণমালা বা অক্ষর হিরাতে সংশোধিত হয়ে আছে এবং এখানে বক্রাকারে লিখন পদ্ধতিকে ‘নাসখি’ বলা হয় এবং লিপিকাররা সংস্কার করে পাণ্ডুলিপি থেকে বোধগম্য ভাষায় লিখতে আরম্ভ করে। আরবি বর্ণমালার সূত্রানুসন্ধান করতে গিয়ে পণ্ডিত আল-সুলি (মৃ. ৯৪৬) বলেন কেমন করে আরবরা হিরার লোকজনদের কাছ থেকে লিখন শিল্পের শিক্ষা গ্রহণ করে (Grunebanum, 1964 P. 344)।

এই হিরা থেকেই কিতাব (book) ও কাতিব (writer) শব্দাবলি আরবদের মধ্যে ছড়িয়েছিল। লেখার ব্যাপারে অন্যান্য শব্দ যা আরবিতে মিশে গেছে তার মধ্যে ক্রল (সিজিলি), কবর (সিফর), কলম (কালাম, গ্রিক-কালামস), পাতা (সহিফ), কাগজ (কিরতাস) অন্যতম।

প্রায় ৫৬০ খ্রিস্টাব্দে বশির ইবন আব্দুল মালেক নামে কালবের এক খ্রিস্টান প্রিন্স হিরাতে লিখন দক্ষতা লাভ করেন। তিনি দুমার শাসনকর্তা ছিলেন। তিনি মক্কায় গমন করেন এবং আবু সুফিয়ানের দাদার (উমাইয়ার পিতা) হারবকে নাসখি লেখা শেখান পরে হারব-ই এই নতুন লিখন পদ্ধতির দক্ষতা অন্যদের শিখিয়েছেন। ফলে নাসখি পদ্ধতি পুরানো লিখন পদ্ধতিকে সরিয়ে স্থান দখল করে নেয় এবং এখনও তা চলছে।

এখন পর্যন্ত যতটুকু লিখন পদ্ধতির উন্নতি হয়েছিল তাতেও গলতি ছিল, এই গলদ কোরান সংকলনের সময়েও দেখা যায়। প্রথমে সব আরবি বর্ণমালায় (সেমেটিক লিপির সমতুল্য) শুধু ব্যঞ্জনবর্ণ ছিল (Diringar, 1947, P. 275) এবং স্বরবর্ণের প্রয়োগ অনেক পরে হয়েছে। তাই অনেককাল ধরে প্রাথমিকভাবে আরবি লিপি এক প্রকার ক্ষুদ্রলিপি (Shorthand) ছিল বলা যায়

অনেক আরবি অক্ষর ছিল ত্রি-অক্ষরে অর্থাৎ মূলে তিন-অক্ষর যুক্তাক্ষরে এবং প্রায় অনেক কথা একই মূলাধারে যুক্ত ছিল। তাই স্বরবর্ণের অ-বর্তমানে, উসুল (মূল- Root- QTL কাফ-তে-লাম) = কাল, কাতালা বা কাতিল— এই তিন শব্দকেই বোঝাত যার অর্থ হত্যা, হত্যা করা, সে হত্যা করেছে বা হত্যাকারীও বোঝাত। এতে মানুষ অর্থ করত ভ্রান্তিমূলক। তাছাড়া যেমন ইংরেজিতে আছে ব্যঞ্জনবর্ণ HRD (স্বরবর্ণ ছাড়া) এ থেকে পড়া যেত Hard, Heard, Horde, Heard, Herod, Hired ইত্যাদি। তেমনি আরবিতেও এই গোলমাল ছিল স্বরবর্ণ ছাড়া।

আবার ইংরেজি যে ‘C’ অক্ষর-এ ‘ক’, ‘স’ শব্দ বেরিয়ে আসে— যেমন- Come (কাম) আবার Cent (সেন্ট), তেমনি পুরনো আরবি অক্ষরেও ছিল। যেমন, বে এবং ‘তে’, ‘জিম’ ও ‘হে’, ‘সিন’ ও ‘শিন’ অক্ষরগুলো একই আকারের কিন্তু এদের কোনো চিহ্ন বা নোক্‌তা দিয়ে আলাদা করা হয়নি; তাই পঠন ক্রিয়ায় মুশকিল হতো।

যেমন নিকলসন বলেছেন- ‘It is impossible to read the same combination of consonants, bnt, net, byt, tnb, ntb, nyb and in various other ways’ (1969 P. 201)

সংক্ষেপে বলতে গেলে বলা যায় যে, সে সময় আরবি লেখা হতো শুধু ব্যঞ্জনবর্ণ দিয়ে, এতে কোনো প্রকার পার্থক্য থাকত না। যেখানে কোনো চিহ্ন থাকত না স্বরবর্ণ বোঝাতে, অক্ষর সংশ্লিষ্ট চিহ্ন সম্বন্ধে বৈশিষ্ট্যমূলক কোনো প্রকার সংকেতও থাকত না।

পরিশেষে, আরবি বাক্যে শব্দগুলো বা অক্ষরগুলো একের সাথে অন্যটা জড়ানো থাকত, মধ্যে কোনো ফাঁকা বা যতি চিহ্ন থাকত না— কোথায় থামা দরকার, ভাগ করা দরকার কোনো প্রকার ইঙ্গিত বা চিহ্ন ছিল না, এর জন্য কোরান পাঠে, প্রাথমিক যুগে নির্ভুল পাঠ ও নির্ভুল ব্যাখ্যা করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াত।

৪.৩ কবিতা

প্রাচীন আরবদের মধ্যে দৈনন্দিন জীবনে ভাষা বা গদ্যকথাকে স্মৃতি ধারণের জন্য যথেষ্ট বলে মনে করা হতো না এবং কোনো উল্লেখযোগ্য গদ্য সাহিত্য প্রাক-ইসলামী যুগ থেকে আমাদের হাতে নেমে আসেনি। অন্য দিকে কবিতাকে উৎসাহদাতা ভাষা মাধ্যম বলে গুরুত্ব দেয়া হতো। পদ্য ছিল উত্তেজনাপূর্ণ আবৃত্তি যাতে অন্তরে রণধ্বনি সৃষ্টি করত, চেতনা করত জাগ্রত। কিন্তু এ বিষয়ে মতভেদও ছিল এবং আরবরা কবিতার প্রতি তাদের মনোবৃত্তিকে ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত করত।

সাধারণত কবিদের মনে করা হতো আধ-পাগলা, ভাবালু, খেয়ালি। তারা নির্ভর করত এই ধারায় যে কবি-সত্তার অনুপ্রেরণা অদৃশ্য শক্তি থেকে লাভ করা যায়। এদের জাদুকর বা ম্যাজিশিয়ান (সাহির) বলা হতো। কবিরা ভূতগ্রস্ত হতে পারত (মাশুর) এমনকি জীনে ‘অধিগ্রস্ত (মাজনুন)। দুষ্ট আত্মা কর্তৃক পরিচালিত হয়ে সে মিথ্যা বাণী প্রচার করে প্রবঞ্চনা করার চেষ্টা করত।

কবিতাকে ঐশীবাণী এবং ম্যাজিক কর্ম বলে ধরা হতো এবং কারোর ক্ষতি করা বা অভিশাপ দেওয়ার জন্য মানুষেরা কবিদের সাহায্যের আশা করত। কবিরা প্রয়োজনে তাদের মাথা আবরিত করে রাখত কাপড় বা বড় চৌকো রুমাল দিয়ে (বারদা), মনে হতো যেন তারা তার আড়ালে কোনো অদৃশ্য শক্তির কাছ থেকে বার্তা চেয়ে পাঠাচ্ছে। জাদুকরদের মতো কবিরা মন্ত্রপাঠ করে শপথ নিত এবং পৃথিবী ও স্বর্গের কাছ থেকে সাহায্য চাইত তাদের উচ্চারণ ও বাক্যে সাফল্যের জন্য।

কবিদের পক্ষে অবশ্য ভালো বলারও কিছু ছিল। বিশ্বাস করা হতো যে কবিরা অনুপ্রেরিত অবস্থায় জ্ঞানী বলে মনে হতো। শাইর বা স্বর্গীয় সত্তা বা ভবিষ্যৎ বক্তা (কাহিন)। কবিরা উপযুক্ত সময়ে তাদের আবেগের মুহূর্তে চমৎকার কবিতার চরণ রচনা করে ফেলতে পারত। যখন তাদের কোনো অনুষ্ঠানে বা আয়োজনে ডাকা হতো কবিতা বর্ণনার জন্য তারা অদৃশ্যকে আহ্বান করে কবিতা রচনার মাধ্যমে গৃহস্থের জন্য শান্তি ও মঙ্গল কামনা করত। যদিও তাদের এই আচরণের ও স্বভাবের জন্য সময়ে সময়ে তাদের চারিত্রিক উৎকর্ষের জন্য প্রফেটের স্বীকৃতি দেয়া হতো কিন্তু তারা সে মর্যাদা পেত না ওল্ড টেস্টামেন্টের নীতির কারণে।

প্রাচীন আরবি কবিরা বিশেষ করে রাজদরবারের কবিদের মর্যাদা আলাদা ছিল তাদের কাব্যিক ও ছান্দিক গুণাবলির জন্য। তাদের কবিতার স্টাইল, ছন্দের মাধুর্য, পঠনে সঙ্গীতের ধ্বনি, স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের সুষম ব্যবহার অপূর্ব দ্যোতনায় আন্দোলিত ছিল। তারা নতুন ছন্দ ও গদ্যের মিল এবং ইত্যাদি আবিষ্কার করে তাকে আরও উন্নত করত এবং ভাষা ও কাব্যের চমৎকারিত্ব সৃষ্টি করত এবং উৎকর্ষের মান এমনভাবে গ্রন্থিত করত যা পরবর্তী কবিদের জন্য অনুকরণীয় হতো।

এমনকি ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে এই কবিতার মান, ছন্দ, স্টাইল, শব্দের ব্যবহার ইত্যাদি উৎকর্ষের চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল, যা পরবর্তী কবিদের আর নতুন করে এর উন্নয়নের জন্য কোনো কবিকে চিন্তা করতে হয়নি।

আরবি কবিতায় বিভিন্ন ধরনের ছন্দ ব্যবহার করা হতো। তার মধ্যে ‘সাজ’ ছিল ছান্দিক ও গতিময় গদ্য, ছোট ছোট শব্দ সমষ্টি দ্বারা গঠিত। এই বিশেষ ধরনের কবিতা কাহিন বা জাদুকরেরা ব্যবহার করত অভিশাপ আরোপের সময় এবং কোনো প্রকার গুহ্য ব্যাপারকে কেন্দ্র করে। অন্য আর এক প্রকার কবিতা ছিল কাসিদা বা কাউকে উদ্দেশ্য করে তার গুণগান করা। আর এক ধরনের ছিল ‘বাসাজ’ দুই অক্ষর পদ বিশেষ (iambic); আর ছিল গজল প্রেমগাথা (lyric)। এই গজল পরে আরও উন্নত হয় উধরার খ্রিস্টান গোত্রের দ্বারা। কিছু কবিতাকে অভিশাপ দেয়ার জন্য ছড়া আকারে উচ্চারণ করলে অন্তরে বেশ আঘাত হানত এবং ‘হিজা’ বিদ্রূপাত্মক কবিতার রূপ ছিল ধ্বংসাত্মক। কিছু কবিতা ছিল যেসব উৎসবকালীন গীত হতো, কারোর জন্য প্রশংসাসূচক গাথা, যুদ্ধ কাব্য এবং শোকগাথা রূপে ব্যবহৃত হতো।

প্রথমে, প্রায়ই প্রাচীন কবিতা বা কাব্য মৌখিকভাবে- পেশাদার আবৃত্তিকারের মাধ্যমে (রাবী) বলা হতো। এরা স্মরণ রাখত, ঘনঘন পুনরাবৃত্তি করত এবং পরবর্তী বংশধরদের দিয়ে যেত। প্রত্যেক পেশাদার কবির, যারা লিখতেও পারত এদের নিয়েও একজন রাবী থাকত, তার কাছে তার কবিতা মুখস্থ করিয়ে দিত, আবার এই রাবীরাও অন্যদের কাছেও সে কবিতা শিখিয়ে দিত। প্রাচীন প্রাক-ইসলামী বিখ্যাত কবি ইমরুল কায়েসও অন্য এক কবির রাবী ছিলেন। কবি ধু-রুমা (মৃ. ৬৩৮) লিখতে-পড়তে জানতেন না, কিন্তু রাবীরা তার কাছ থেকে মুখে কবিতা শুনে মুখস্থ করে নিত।

রাবীরা কবিদের বংশ তালিকা জানতেন কাব্যের বা কবিতার মর্ম বোঝার জন্য এবং কোন সময় ও পরিবেশে কবিতাটি লেখা হয়েছিল তাও মনে রাখত।

প্রাচীনকালে নিয়মিতভাবে কবিতার প্রতিযোগিতা হতো, ছান্দিক গদ্য এবং তাৎক্ষণিকভাবে রচিত কবিতা, সাথে সাথে তর্ক-বিতর্ক ইত্যাদি বিভিন্ন মেলায় অনুষ্ঠিত হতো। দক্ষিণে নাজরান শহরে, মক্কার কাছে মাজনাতে, ধুউল মাজাজে- যা আরাফাত পাহাড়ের নিচেই অবস্থিত। সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতা প্রতিযোগিতা হতো মক্কার পূর্বে নাখালা উপত্যকার পাশে উন্নয়নশীল মার্চেন্ট শহর ওকাজ-এ।

ধু-আল-কাদা মাসে সাত দিনব্যাপী ওকাজ-এ বিশাল জনসমাবেশ ঘটে। ধু- আল-কাদা পবিত্র মাস— এ মাসে যুদ্ধ-মারামারি-হানাহানি ইত্যাদি নিষিদ্ধ।

এই ওকাজের মেলা বা সমাবেশ শুরু হয়েছে খ্রিস্টান তামিম গোত্রের তত্ত্বাবধানে, এই মেলায় যে কবিতা জয়লাভ করত তা নিকটে পবিত্র মন্দিরে টাঙিয়ে রাখা হতো। ওকাজ মেলা প্রাচীন আরবের সামাজিক, সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক জীবনের মিলন কেন্দ্র ছিল। মুক্ত ও অবাধ আলোচনা, যুক্তি-তর্ক, বিভিন্ন গোত্রের মানুষের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ঘটত এবং এই প্রতিযোগিতার ফলাফলকে সমগ্র পেনিনসুলার মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া হতো, প্রচলিত প্রবাদবাক্য ছিল— ‘ওকাজ আজকে যা বলে সারা আরবে আগামীকাল পুনরাবৃত্তি হয়।

প্রাচীনকালের কবিদের রচনাই ছিল প্রাক-ইসলামী যুগের আরব সাহিত্য। ইসলামের আবির্ভাবের পর পুরনো সাহিত্যের অনেক কিছু উপেক্ষিত হয় কিংবা নষ্ট করে ফেলা হয় অবহেলায় এবং এটা সত্যই বিস্ময়ের; তবুও অনেক কিছু রয়ে গেছে।

ক্ষমতা গ্রহণের কিছু পরে প্রফেট মোহাম্মদ ওকাজের মেলা-উৎসব বন্ধ করে দেন কিছুটা তার কবিদের প্রতি বীতশ্রদ্ধ ভাব, আর কিছুটা তার প্রচলিত নব্যধর্মের প্রতি সম্ভাব্য প্রতিবাদকে প্রতিরোধ করার জন্য।

মুসলিম ধর্মবিদরাও প্রাক-ইসলামী যুগের কবিতা ও সাহিত্যের মাধ্যমে আবেগ প্রকাশের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন না। কবিদের মদ্যপ্রীতি, নারীদের প্রতি মুক্ত প্রেম-ভালবাসা প্রকাশ, তাদের জীবনযাত্রা ও চিন্তাধারা, প্রাচীন আরবের (যাকে ইসলাম জাহেলী যুগ বলেছে) গুণগাথা ও শৌর্যবীর্য কীর্তন এবং প্যাগন দেব-দেবীর প্রতি জাগরণের আহ্বান প্রাচীন কবিদের অর্থোডক্স ইসলামবাদীদের সন্তুষ্ট করেনি। বলা হয়েছে যে যদি কেউ পুরানো কবিদের উল্লেখ করে কোনো উপমা গড়ার চেষ্টা করেছে তাদের প্রতি মুসলিমরা বীতশ্রদ্ধ হতো এবং ‘আল্লাত’-এর পরিবর্তে ‘আল্লাহ’ উচ্চারণ করিয়ে ছাড়ত।

মিশরীয় পণ্ডিত তাহা হুসেন, ১৯২৫ সালে লিখতে গিয়ে বলেন, যে প্রাক-ইসলামী যুগের অতি সামান্য মূল্যবান সাহিত্য উদ্ধার করা হয়েছে এবং যা কিছু অতি অল্প উদ্ধার হয়েছে তাও আবার ইসলাম প্রবর্তনের পরে তার ‘মুসলমানি’ করা হয়েছে। (Kritzeek 1964, P. 60)। অনেক পণ্ডিত ব্যক্তির ধারণা, এখন যা প্রাক-ইসলামী সাহিত্য বলে ধরা হয় তা আসলে প্রাচীন আরবি কবিদের রচিত কিনা সন্দেহের কারণ আছে।

প্রাক-ইসলামী যুগে অনেক খ্রিস্টান কবি ছিলেন, কিংবা কোনো খ্রিস্টান গোত্রের সাথে যুক্ত ছিলেন বা খ্রিস্টান প্রিন্সের দ্বারা পরিবেষ্টিত আরবি কবিতা ও সাহিত্যে খ্রিস্টান কবি-সাহিত্যিক ও গোষ্ঠীগোত্রদের দ্বারা উন্নত, এর কারণ আরবের সাথে খ্রিস্টান গোষ্ঠী-গোত্রের সম্পর্ক সাধারণত সেখানকার আদিবাসিন্দার মতো।

প্রাচীন ট্র্যাডিশন মতে কবিদের মধ্যে ছিলেন আইয়ুব ইবন মাহরুফ (প্রায় ৪৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত) তিনি ছিলেন তামিম গোত্রভুক্ত। ইবন আরাবীর মতে, তিনিই ছিলেন প্রথম খ্রিস্টান আরব কবি। যুদ্ধ কবি মুহাল্লিল ইবন রাবিয়া (৫০০ সালে প্রতিষ্ঠিত) ছিলেন খ্রিস্টান তাঘলিব গোত্রভুক্ত। তিনিই প্রথম আরবি গীতিকাব্য রচনা করেন। বিস্তাম ইবন কাইস (৫১০ সালে প্রতিষ্ঠিত) ছিলেন খ্রিস্টান কিন্দা গোত্রের।

কবি সামাওয়াল (স্যামুয়েল) ইবন আদিয়া (৫৩৫ সালে প্রতিষ্ঠিত) ইহুদি ধর্ম গ্রহণ করেন। তার আনুগত্য প্রবাদ প্রমাণ ছিল এবং একথা প্রত্যেক মরুবাসীর মুখে মুখে ফিরত কারণ তিনি তার কাছে গচ্ছিত ইমরুল কায়েসের (তখন তিনি কনস্ট্যান্টিনোপলে) মালামাল কাউকে দিতে অস্বীকার করেন। এই প্রতিরোধের কারণে অপরের হাতে তার চোখের সামনে নিজের পুত্রের মৃত্যু পর্যন্ত তাকে দেখতে হয় তবুও তিনি ইমরুল কায়েসের মাল হাতছাড়া করে অবিশ্বাসী হতে চাননি। মুতালামিস (মৃ. ৫৭০) মদ্যপায়ী ছিলেন। তার আসল নাম ছিল জারির ইধন আবদুলমসিহ। তিনি তামিম গোত্রের খ্রিস্টান, তার আসন ছিল হিরার রাজদরবারে।

কবি আদি ইবন জাইদ (৫৮৭ সালে প্রতিষ্ঠা) আয়ুব গোত্রভুক্ত ছিলেন। পারস্য রাজ প্রথম খসরুর অধীনে চাকরি করতেন এবং লাখিমিদ রাজদরবার কর্তৃক পরিপোষিত। মদের জন্য কবিতা লিখে তিনি নাম করেন, যদিও তিনি খ্রিস্টান ছিলেন। আরব ট্র্যাডিশনের কয়েকজন কবির গভীর অনুভূতি প্রকাশ পেয়েছে আদির গীতিকাব্যের একটি চরণে যে চরণে তিনি মক্কার প্রভু এবং যিশুর ক্রুশকে লক্ষ্য করে আহ্বান জানান।

পুরাতন সূত্র থেকে প্রাপ্ত যে, আরবে সাতটি অতি উত্তম গীতিকাব্য আছে যার নাম ‘মোয়াল্লাকাত’,- সম্মানজনক অতি-পঠিত। এই শব্দের আর একটি অর্থ মুলতবি (Suspended)। কারণ এই সম্প্রীতি কবিতা বা কাব্য প্রত্যেকটি ষাট থেকে একশো পয়ার ছন্দে রচিত এবং কথিত যে এই সব ছন্দ সোনার অক্ষরে পর্দার কাপড়ে লিখিত এবং এই পর্দা কাবাকে অলংকৃত করেছে। মহামূল্যবান এই সব ছন্দ বহু বছর ধরে সংগৃহীত। এই সাতটি গীতি কবিতার সাথে পরে আরও দুটি সংযোজিত হয়ে একুনে নয়-এ দাঁড়িয়েছে। এই নয়টি স্থানীয় কবিতার কয়েকটি রচিত হয়েছে খ্রিস্টান কবিদের দ্বারা। মোয়াল্লাকাতের কবিদের মধ্যে হচ্ছেন :

ইমরুল কায়েস (মৃ. ৫৪০), ইনি কিন্দার রাজকীয় পরিবারের একজন যুবরাজ। বেশির ভাগ সময় ইনি বাইজানটাইন রাজদরবারে সময় কাটিয়েছেন এবং একে প্রাক- ইসলামী যুগের শ্রেষ্ঠ কবিদের মধ্যে একজন ধরা হয়। খলিফা ওমর এবং খলিফা আলী উভয়েই এর প্রতিভার প্রশংসা করেছেন। মোয়াল্লাকাতের মধ্যে কায়েসের গীতি কবিতা উৎকৃষ্ট বলে গণ্য।

আমর ইবন কুলসুম (মৃ ৫৭০), ইনি খ্রিস্টান তাঘলিব গোত্রভুক্ত এবং ইমরুল কায়েসের পৌত্র। কালব বা বকর গোত্রের হারিথ ইবন হিলিজার পৌত্র। হিলিজা মারা যান ৫৭০ সালে। ইনি হিরার রাজা আমর ইবন হিন্দের রাজদরবারের কবি।

তারাফা (মৃ. ৫৬০), ইনি তার চাচা কুলসুমের মতো হিরার দরবারের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। তারাফার ক্ষুরধার বাণীর জন্য তিনি রাজরোষে পতিত হন এবং আমর ইবনে হিন্দ মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে তাকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করেন।

অন্তরা (মৃ. ৫৯০) আস গোত্রের আরব-নিগ্রো কবি। তিনি সব ধরনের কবিতা লিখতে চেষ্টা করতেন, কিন্তু অনুযোগ করতেন যে তার পূর্বসূরিরা তার জন্য নতুন কিছু রেখে যাননি।

নাবিঘা (মৃ. ৬১০)। লাখামিদ গোত্রের মানুষ। তার সময়ের বেশির ভাগ তিনি কাটিয়েছেন ঘাসান ও হিরার রাজদরবারে। তিনি খ্রিস্টান ধর্ম সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিফহাল ছিলেন এবং লোকে বলে তিনি নিজেও খ্রিস্ট ধর্ম পালন করতেন বলে কথিত। যদিও অনেকে এ ব্যাপারে একমত ছিলেন না।

জুহাইর (মৃ. ৬২৫)। লাখমিদ গোত্রের আর একজন সদস্য, খ্রিস্টান বলে পরিচিত, তবে অনেকে তা অস্বীকার করেছে। তিনি প্রফেটের সময়ে বেঁচে ছিলেন, কিন্তু ইসলাম গ্রহণ করেননি। তিনি বলতেন আল্লাহই জানে সত্য কোনটা এবং বিচারের দিনে এর প্রকাশ ঘটবে।

যে দু’জন কবি পরে এই সাতজনের সঙ্গে সংযুক্ত হন তারা হলেন আশা এবং লাবিদ। আশা (মৃ. ৬২৯) আরব কবিদের সমগোত্র। কথিত আছে যে ইবাদি (যদিও মদের ব্যবসা করতেন) তাকে খ্রিস্ট ধর্ম শিক্ষা দেন। তিনি হিরাতে বেশির ভাগ সময় কাটাতেন এবং এক লাখমিদ যুবরাজের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হন। এছাড়া তিনি নাজরানের বিশপেরও বন্ধু ছিলেন। লাবিদ (মৃ. ৬৬২)। প্রাক-ইসলামী যুগের শেষ জেনারেশনের কবি। লাখমিদ শাসকদের তিনি সহানুভূতি ও সাহায্য পেয়েছেন। ৬০১ সালে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন, এর পর তিনি আর কবিতা লেখেননি। ১১২ বছর বয়সে তিনি মারা যান।

প্রাক-ইসলামী যুগের কবিরা তৃণমূলের কবি ছিলেন এবং আমজনতার সাথে জড়িত থেকে গদ্য জীবন ও দৃষ্টিভঙ্গি সম্বন্ধে লিখে গেছেন। বিশেষ বিষয়ের ওপর তারা রচনা করেছেন কাব্য ও গাথা; প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, মরু জীবনের সুখ-দুঃখ, খামর বা মদের আনন্দ, রোমান্টিক প্রেম, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং জীবন ও মৃত্যুর একের ওপর অন্যের প্রতিফলন। অনেক কবি ছিলেন যারা আরবের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত বিচরণ করতেন, মানুষের দ্বারা সংবর্ধিত হতেন এবং তাদের কাছ থেকে কবিতাগাথা শুনতে ভালবাসতেন। কথিত আছে কবিদের বাণী মরুর উপর দিয়ে তীরের চেয়ে বেগে উড়ে বেড়াত।

মরুর বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে কবিতা একটা অদৃশ্য বন্ধন গড়ে তুলেছিল। আরবের বিশ্বস্ততার মহিমা, সাহস, আতিথিয়েতা, আত্মত্যাগ ও অন্যান্য মহৎ গুণাবলি এবং তাদের দেব-দেবীদের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা, আর একেশ্বরবাদের ওপর একাগ্রতা (আল্লাহর ধারণা ও ক্ষমতা)— এসবই তাদের সামাজিক, ধর্মীয় ও নৈতিক চেতনায় একটি একক জাতিতে অর্থাৎ আরব জাতিতে পরিণত করেছে।

এই সব কবিতার মাধ্যমে আরবের মধ্যে অতীতের যোগসূত্রকে দৃঢ় করেছে। কবিদের বলা হতো আরবের ঐতিহাসিক লেখ্যাগার (Archievs of the Arab)। তাদের কবিতার চরণগুলো আরবের হারিয়ে যাওয়া জাতিদের স্মরণ করিয়ে দেয়, যেমন তসম, জাদিস ও বাহম, পুরনো গোত্রদের সাথে তাদের সম্পর্ক; সময়ের কালে ভুলে যাওয়ার যুদ্ধ-বিগ্রহের ইতিহাস যার আর এখন কোনো চিহ্ন নেই। প্রাচীন আরবের রীতি-নীতি ধর্ম সম্বন্ধে অনেক তথ্য জোগায়, আর গোষ্ঠীগাথা, গ্রাম্যনীতি, ট্রাডিশন ও প্রথা, জাতির ইতিহাস যা এখন সব হারিয়ে গেছে, তার ঠিকানা মেলে এই কবিতা ও গাথার মাধ্যমে।

আরবের প্রাচীন কবিতা পাঠে পুরনো কবি ও মানুষদের জীবন সূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। কবিরা যেসব রাজা, যুবরাজ ও প্রশাসকদের কথা লিখে গেছেন তাদের ঐতিহাসিক ও সামাজিক পটভূমি জানতে পারা যায়। তার সাথে পাওয়া যায় কবিদের জীবনী।

এই কবিতার মধ্যে আরবের বিশাল শব্দ ভাণ্ডার, লিখন পদ্ধতি, কবিতার পদ, ছন্দ, ব্যাকরণের ব্যবহার ইত্যাদি যা কবিরা প্রয়োগ করেছেন সেগুলো এখন আরবের ভাব ও সংস্কৃতির গবেষণার উৎস হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে; সেইমত আরবি পণ্ডিতগণ যারা এখন ইসলামের অরিজিন এবং কোরানের ব্যাখ্যা নিয়ে আলোচনা করছেন তারা এখনকার যুগের কবিদের কাব্য ও কবিতার ওপর আলোকপাত করার সুযোগ পাচ্ছেন।

এটা মনে করা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ যে আরবি সাহিত্যের মান বা স্ট্যান্ডার্ড কোরানের ভাষায় প্রতিষ্ঠিত হয়নি, হয়েছে প্রাক-ইসলামী যুগের কবিদের ভাষা ও শব্দ ভাণ্ডার এবং গ্রন্থিত রচনার মাঝে এবং আরবি ভাষাতত্ত্ব (philology) অভিধান সংকলন বিদ্যা (Lexicography) এবং ব্যাকরণ কোরানের ওপর ভিত গড়ে ওঠে, কিন্তু উঠেছে প্রাচীন কবিতার মধ্যে (Gibb 1974. P. 39)।

আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস (মৃ. ৬৮৭) প্রফেট কাজিন ছিলেন। তিনি ছিলেন বাইবেল ও কোরানের (টীকাকার) exigesis, ইনিই কোরানের কোনো অপ্রচলিত শব্দ বা ব্যাখ্যার সূত্র খুঁজতে প্রাক-ইসলামী যুগের কবিতার সাহায্য গ্রহণ করতেন।

প্রফেটের একজন বিজ্ঞ অনুসারী আবু আসওয়াদ আল-দুয়ালি (মৃ. ৬৮৮) যখন কোরানের শব্দের প্রয়োগ রীতির ওপর একটি সরল ব্যাকরণ ও শব্দকোষ প্রস্তুত করার কথা চিন্তা করেন (বাইবেলের মত), তখন তিনি তার সাহায্যকারী হিসাবে আব্দুল কাইস গোত্রের খ্রিস্টান কবি-পণ্ডিত ব্যক্তিদের নিয়োগ করেন।

আরব ভাষাতত্ত্ববিদ ও বৈয়াকরণ খলিল ইবন আহম্মদ (মৃ. ৭৯০) প্রাচীন কবি ও ওমানের মাজুন গোত্রের লোকদের সাহায্য নিয়েছিলেন আরবি ছন্দ প্রকরণের (Prosody) নিয়মাবলিকে সুসমন্বত করতে। তার এই মূল্যবান গ্রন্থ এখনো আরবি সাহিত্যে সমুজ্জ্বল। কঠিন ও অপ্রচলিত আরবি শব্দের একটি বিশাল অভিধান সংকলন করেছেন আলেম ও পণ্ডিত ব্যক্তি আবু ওবায়েদ আল-কাসিম সাল্লাম (মৃ. ৮৩৯)। ঐসব শব্দ-সম্ভার নিয়ে সেসব শব্দ আরবি কবি ও সাহিত্যিকরা- বিশেষ করে প্রাক- ইসলামী যুগের কবিরা ব্যবহার করে গেছেন। আবু ওবায়েদ আল কাসিম সাল্লাম হেরাটবাসী এক গ্রিক দাসের পুত্র।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *