৫. মক্কার সময়কাল
প্রাক-ইসলামী আরবদের ঐতিহাসিক ও জৈবনিক (Biographical) ধারাবাহিক কোনো রেকর্ড বংশধারা সম্বন্ধে ছিল না, এই কারণে প্রফেট মোহাম্মদের বাল্য জীবনের ইতিহাস পাওয়া মুশকিল। তাই গোত্র প্রধান মুখে মুখে বর্ণিত খণ্ড খণ্ড সংবাদ এবং পেশাদার গল্পকারদের (Story teller) সূত্র ধরে প্রফেটের জীবনী গ্রন্থিত করেছেন প্রাথমিক জীবনীকারগণ। এই সব সংবাদ মুখে মুখে শতাব্দিকাল ধরে চলে এসেছে এবং কোনো জীবনীকার তাঁকে চাক্ষুষভাবে দেখেননি। আর একটা কথা ইসলামে কোনো গসপেল (সুসমাচার) নেই।
যারা প্রফেট মোহাম্মদের জীবন কাহিনী পড়ছেন এবং যে প্রাথমিক কাহিনীকাররা বর্ণনা করেছেন, মনে হয়, তাদের তিনটি উদ্দেশ্য ছিল :
(১) তাঁর জীবনকাহিনী ও তাঁর পারিবারিক ইতিহাস সম্বন্ধে যেসব সত্য-মিথ্যা তথ্য পাওয়া যায় সেগুলোকে সমাধান করা। (২) প্রফেটের মদিনা জীবনে প্রাথমিক অভিযাত্রা ও সামরিক যুদ্ধ-বিগ্রহ (মাঘাজি)-এর ঐতিহাসিক রেকর্ড তৈরি করা যেগুলোতে জীবনীকার ও ঐতিহাসিকরা তার ধর্মীয়তত্ত্ব প্রসারের চেয়ে বেশি আগ্রহশীল ছিল, কেননা পরবর্তীতে মুসলিম সম্রাট ও বাদশারা দেশ ও রাজ্য জয়ের জন্য বেশি অনুপ্রেরণা লাভ করে এবং (৩) কোরানে বিধৃত যেসব চ্যাপ্টারে দ্ব্যর্থ- বোধক ভাষ্য দেখা যায় তার পরিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা প্রদান করা।
প্রফেট মোহাম্মদের ঘটনাপূর্ণ জীবনের ধারাবাহিকতা পরিষ্কার নয় এবং প্রথমে যে চরিতকাররা তার জীবনী রচনা করেছেন তাঁরা ঘটনা ও বিষয়গুলোকে পর্যায়ক্রম অনুসারে সাজিয়ে বর্ণনা করেননি। ঘটনার কাহিনীর তারিখ ঘটনার সাথে উল্লেখ করা হয়েছে ঘটনা উল্লেখ করে, তারিখানুসারে নয় যেমন- “আমিনার মৃত্যুর ছ’বছর পর কিংবা আবু তালিবের মৃত্যুর আট বছর পর” ইত্যাদি।
প্রফেট মোহাম্মদের জন্ম তারিখ সম্বন্ধে কোনো সঠিক বক্তব্য নেই। এক একজন এক একটি দিন-ক্ষণ উল্লেখ করেছেন। প্রফেটের বাল্য ও কৈশোর জীবন এবং তাঁর প্রথম ধর্ম প্রচার ও প্রসারের তারিখ ও বিকৃত বর্ণনা খণ্ডভাবে পাওয়া যায়। ঐ সময় প্রফেটকে ব্যক্তি বা বক্তা রূপে অতি অল্পই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি কি বলেছেন বা প্রচার করেছেন মক্কার লোকেরা বিশেষ করে তাঁর পরিবারের মানুষরা কোনো আমলে আনতো না। তাঁর প্রথম ওহির অবতরণের তারিখও ‘মনে হয়’-এর মতো (approximately)। ৬২২ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে সমস্ত তারিখগুলো, যখন প্রফেট প্রায় বাহান্ন বছর বয়সে মক্কা থেকে মদিনায় আশ্রয় নিলেন এবং যখন থেকে মুসলিম সনের শুরু- বিতর্কিত বিষয়।
এই নির্দিষ্ট তারিখের বিষয় ছাড়া, প্রফেটের ব্যক্তিগত ও জনজীবনের ঘটনার যে বিবরণ পাওয়া যায় তা যথেষ্ট নয়। এই তাঁর জীবনের দুই-তৃতীয়াংশের ইতিহাস আসলে প্রশস্ত ব্যাহ্যিক আঁচড় মাত্র (broad outline)। (Dermenghem, 1958 P. 5) এবং তাঁর ঘটনাবহুল জীবনী নিয়ে বহু স্ব-বিরোধী ট্রাডিশন রচিত হয়েছে- এমনকি তাঁর মৃত্যুর অবস্থাকেও ঘিরে।
জানা যায় যে তাঁর জীবনী তথ্য সময় সময় সংগৃহীত হয়েছে ঐ সব ব্যক্তির নিকট থেকে যারা সংগ্রহ করেছে প্রাচীন সূত্র থেকে। এই সব মানুষরা তাদের জ্ঞান সেই পরিমাণ বিক্রি করত বদলে যতটুকু দাম পেত। অন্য কোনো স্থানেও এই কারবার অজানা ছিল না। কোরানে এ সম্বন্ধে উল্লেখ আছে যারা কম পয়সায় মুসার কেতাব থেকে বিকৃত সংবাদ বিনিময় করত (২ : ৭৩)।
প্রফেটের জীবনীর রচনার কারণে খবরা-খবর বেচা-কেনা চলেছে তাঁর মৃত্যুর অনেক বছর পরেও। এ ধরনের এক কুখ্যাত মানুষের নাম ছিল শুরা বিল ইবন সাদ (মৃ. ৭৪০)। ইনি একটি সাহাবার (যারা প্রফেটের সাথে উঠাবসা করেছেন) লিস্ট তৈরি করেছিল। যদি কোনো সংবাদ সংগ্রাহক উচিত মূল্য দিতে রাজি না হতো তাহলে বদরের যুদ্ধে প্রফেটের সঙ্গী কারা কারা ছিলেন তা দিতে অস্বীকার করত। পুরনো ঐতিহাসিকদের অনেকেই ইবন ইসহাকসহ, হয়তো তাদের কাউকে পাননি।
ঐতিহাসিকগণ এই মৌখিক সংবাদের ভিত্তিতে যা রেকর্ড করে গেছেন তা থেকে নিজেরা কিছু বাছাই করেছেন। তাদের কর্মের সংশ্লিষ্ট কিছু অংশ পরবর্তী লেখকগণ ইচ্ছামতো গ্রহণ বা বর্জন করেছেন। প্রত্যেক গ্রন্থকার চেষ্টা করেছেন পরবর্তী লেখকের চেয়ে তার গ্রন্থ উচ্চ মানের হোক, গ্রহণযোগ্য হোক।
প্রফেটের জীবনীতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শোনা কথা ও জনপ্রিয় ট্রাডিশন থেকে রচিত। প্রাথমিক জীবনীকারগণ তাই জানতেন যে তার গ্রন্থে বর্ণিত প্রফেটের সম্বন্ধে ঘটনাগুলো বা বর্ণনাগুলো অথেনটিক বলা যাবে না; কারণ কোনো কোনো স্থানে হয়তো তাদেরকে শুধু শোনা কথার ওপর বিশ্বাস করতে হয়েছে যার কোনো প্ৰমাণ ছিল না। সময়ে সময়ে তাদের সন্দেহকে ব্যক্ত করে খোলা মনে স্বীকার করেছেন- আল্লাহই জানেন এর সত্য-অসত্য সম্বন্ধে।
প্রফেট মোহাম্মদের প্রথম চরিতকার হচ্ছেন ইবন ইসহাক। তার সমসাময়িক মালিক ইবনে আনাস (মৃ. ৭৯৫) তার বিরুদ্ধে মিথ্যা ট্রাডিশন আমদানি করার অভিযোগ এনেছেন। অন্য আর একজন চরিতকার, ইবন হিশাম, খোলাখুলিভাবে স্বীকার করেছেন যে তিনি বিভিন্ন কারণে তার রচনা থেকে অনেক আইটেম বাদ দিয়েছেন। বিভিন্ন চরিতকারের রচনায় কি কি গ্রহণ ও বর্জন করতে হবে এই যে সমস্যা তা কখনো সমাধান হয়নি।
৫.১ প্রফেট মোহাম্মদের চরিতকারগণ
প্রফেট মোহাম্মদের চরিতকারদের মধ্যে মদিনার ইবন ইসহাক-ই (মৃ. ৭৬৮) তার জীবনী সংকলন করেন। ইবন ইসহাকের দাদা ইয়াসার নামির গোত্রের একজন খ্রিস্টান ছিলেন। ৬৩৩ খ্রিস্টাব্দে ইরাকের আইন-আল তামার চার্চে তিনি ধৃত হন এবং মুসলিম সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদ দাস হিসাবে তাকে মদিনায় নিয়ে আসেন।
ইবন ইসহাকের এই মহৎ কর্মটি তার পরবর্তী উত্তরাধিকারীদের দ্বারা বিশ্বাসযোগ্য বর্ণনা মনে করা হয়। এতে প্রফেট মোহাম্মদের আকৃতি, দৈনন্দিন জীবন এবং অভ্যাস, তাঁর যুদ্ধ অভিযানের বিস্তারিত বর্ণনা উল্লেখ করা হয়েছে। এই সব বর্ণনার মালামাল (মেটিরিয়াল) তিনি তাঁর সমসাময়িক সঙ্গী আল-জুহরীর নিকট থেকে গ্রহণ করেন। আল জুহরী এ সম্বন্ধে বহু ট্রাডিশন সংগ্রহ করেছিলেন। আল-জুহরি জুহরা গোত্রভুক্ত ছিলেন, যে গোত্রে প্রফেটের মা আমেনাও ছিলেন। ইবন ইসহাকের মূল জীবন গ্রন্থ হারিয়ে গেছে, কিন্তু এর অধিকাংশই তাঁর উত্তরাধিকারীদের গ্রন্থে বিস্তৃতভাবে উদ্ধৃত হয়েছে।
উমর আল-ওয়াকিদী (মৃ. ৮২৩) মদিনাবাসী ছিলেন। প্রফেট সম্বন্ধে যে জীবনী তিনি রচনা করেন তাতে প্রফেটের সামরিক অভিযানের ওপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। আল-ওয়াকিদী প্রাথমিক চরিতকার হিসাবে মোটামুটি বিশ্বাসযোগ্য। বসরার ইবন হিশাম (মৃ. ৮৩৪) ইবন ইসহাকের রচনার সম্পাদনা করেন এবং কিছু অংশ পরিবর্তন করে সম্প্রসারিত করেন এবং কিছু নতুন অংশ জুড়ে দেন। ইবন সাদ (মৃ. ৮৪৫) আল-ওয়াকিদীর সেক্রেটারি ছিলেন। তিনি যে জীবনী রচনা করেন ঐতিহাসিকভাবে তা অস্পষ্ট (Dubious)। এতে প্রফেটের ও তাঁর সমসাময়িক সাহাবাদের বংশ লতিকার আধিক্য বেশি, ঘটনাবহুল নয়। আবু জাফর আল-তাবারি পারস্য-বংশোদ্ভূত ঐতিহাসিক ছিলেন। তিনিও প্রফেটের জীবনী রচনা করেন যা প্রায়ই পরবর্তী গ্রন্থকারদের দ্বারা উদ্ধৃত হয়েছে।
প্রফেটের এই সব জীবনীতে উল্লেখিত ঐতিহাসিক মূল্য সম্বন্ধে অনেক পশ্চিমা পণ্ডিত সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। কয়েকজন, যেমন হেনরি লেমেনস (Lemmens)-এর মতে কোরানিক টেক্সট্ ভাষ্যমূলক ব্যাখ্যা বিশুদ্ধ (জেনুইন) হলেও প্রায় বেশির ভাগ ঐতিহাসিক বিষয়গুলো আবিষ্কৃত অর্থাৎ বানানো। অন্যান্য পণ্ডিত মনে করেন যে প্রফেটের জীবনী সম্বন্ধে কোনো কিছুকে নির্ঘাত সত্য বলা যাবে না। শুধুমাত্র কোরানিক কনফারমেশন ছাড়া।
মুসলিম চরিতকারদের রচনা ছাড়া কিছু অল্প-স্বল্প প্রফেটের জীবনী সম্বন্ধে তথ্য পাওয়া অমুসলিম সূত্র থেকে এর মধ্যে এমন কিছু আছে যা ইবন ইসহাকারেরও পূর্বে রচিত। ৬৩৪ ও ৬৪৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে গ্রিক ও সিরিয়াক ভাষায় রচিত সামান্য কিছু লেখা, ৬৩৮ সালে যখন মুসলমানরা জেরুজালেম দখল করে তখনকার হিব্রুতে কিছু লেখা পাওয়া যায় এবং ৬৬০ খ্রিস্টাব্দে একটি আরমেনিয়ান ঘটনাপঞ্জি (Chronical) পাওয়া গেছে এগুলোতে প্রফেট মোহাম্মদের জীবনের প্রাথমিক ঘটনাবলির কিছু তথ্য আমাদের সরবরাহ করে (Cook. 1983 P. 73)। এই সব তথ্য মুসলিম চরিতকারদের রচিত গ্রন্থে বর্ণিত ঘটনার সাথে কিছু অমিল পাওয়া যায়। এ ব্যাপারে কুক-এর বর্ণিত ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য (Cook. 1983 P. 73)।
যাই হোক এ পর্যন্ত মুসলিম ও অমুসলিম জীবনীকারগণ যেসব পুস্তক রচনা করেছেন তারা মূলত মুসলিম সূত্র ব্যবহার করেছেন, অমুসলিম সূত্রকে টেনে আনেননি।
৫.২ প্রফেটের পূর্বপুরুষ
পঞ্চম শতাব্দির মাঝামাঝি কোরেশ নেতা কোশে মক্কা নগরীর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন। তার পুত্র আবিদ মনাফ তার স্থলাভিষিক্ত হন। আবিদ মনাফের চার পুত্র ছিল। এই চার পুত্র বিভিন্ন দেশে বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে তোলেন- যেমন আবদ্ মোতালেব ইয়েমেনে, নোফেল ইরাক ও পারস্যে, আবদ্ শামস্ আবিসিনিয়ায় এবং হাশিম সিরিয়াও মেসোপটেমিয়ায়।
আবদ শামস ও হাশিম জমজ সন্তান, দু’জনে কাঁধে লেগে ছিল। আবদ শামস মায়ের পেট থেকে প্রথমে বের হয়। এই যমজ সন্তানদের কাঁধ কেটে বিচ্ছিন্ন করা হয় তখনকার পদ্ধতিতে।
ষষ্ঠ শতাব্দির প্রায় মাঝামাঝি অর্থাৎ প্রফেটের জন্মের প্রায় অর্ধশতাব্দি পূর্বে আবদ মনাফের পুত্র হাশিম এবং আবদ শামসের পুত্র উমাইয়ার নেতৃত্বে দুই প্রভাবশালী গোত্র গড়ে ওঠে এবং এই দুই গোত্রের মাঝে ক্ষমতা লাভের জন্য চরম দ্বন্দ্ব শুরু হয়। উল্লেখ্য, হাশিম ও উমাইয়া ছিল চাচা-ভাতিজা ।
হাশিমকে বাইজানটাইন রাজদরবারে নিমন্ত্রণ করা হয় এবং মক্কা থেকে সওদাগরদের পণ্যদ্রব্য সিরিয়ায় নিরাপদে নিয়ে যাবার জন্য সনদ দেয়া হয়। হাশিম গোত্র কাবাঘরেরও দায়িত্ব লাভ করে এবং তীর্থযাত্রীদের দেখভালের দায়িত্বভার তাদের ওপর ন্যস্ত হয়।
হাশিম সালমা নামে মদিনার এক মহিলাকে বিবাহ করেন এবং আবদুল মোত্তালেব নামে তাদের এক পুত্র সন্তান হয়। এই আবদুল মোত্তালেবের ওপর পড়ে তীর্থযাত্রীদের খাওয়া-দাওয়া ও জল সরবরাহের দায়িত্ব। তিনি মজে যাওয়া জমজম কূপের সংস্কার করেন যা কাবাঘরের আঙ্গিনায় অবস্থিত। মক্কার অন্যান্য ধর্মীয়মনা মানুষের মতো তিনিও শহরের পাশে পর্বতে গিয়ে উপবাস করতেন। ৫৫০ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইয়েমেনের আবিসিনিয়ার গভর্নর আব্রাহাকে মক্কা আক্রমণ থেকে বিরত করেন। কোরেশ মাখজুম গোত্রের আমর বিন আইদ-এর কন্যা ফাতিমাকে আবদুল মোত্তালেব বিবাহ করেন, তাদের সন্তান আবদুল্লাহ যিনি আমিনাকে বিবাহ করেন। কোরেশের জোহরা গোত্রের ওহাবের কন্যা আমিনা। এদের পুত্র মোহাম্মদ তার পিতার মৃত্যুর চার মাসের পর জন্মগ্রহণ করেন। ট্রাডিশন অনুযায়ী মোহাম্মদের জন্ম সোমবার, কিন্তু তার আসল জন্ম তারিখ জানা যায় না। তবে অনেকের মতে ৫৬৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৫৭৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে, তবে সাধারণত ধরা হয় ৫৭০ সালে তাঁর জন্ম হয়।
এটা সত্য যে, গোত্রগতভাবে প্রফেট মোহাম্মদের মক্কা ও মদিনাতে উভয় স্থানে যোগ-সূত্র ছিল, যা তাঁর জীবনে পরবর্তীতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বালক মোহাম্মদ যখন যৌবনে পদার্পণ করেন তখন হাশিম গোত্র কোরেশী বংশধারা থেকে স্থানচ্যুত হয়ে যায় এবং ক্ষমতার রাশ উমাইয়াদের হাতে পড়ে এবং কাবাঘরের কর্তৃত্বও (গার্জেনশিপ) প্রতিদ্বন্দ্বী গোত্র উমাইয়াদের হাতে পড়ে। এরপর উমাইয়া গোত্রের নেতা আবু সুফিয়ান প্রফেট মোহাম্মদের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে খাড়া হন।
৫.৩ বাল্যকাল ও যৌবন
প্রফেট মোহাম্মদের জন্মকালে যদিও পরে অনেক কথা-কাহিনী, কিংবদন্তি ও মোজেজার কথা যোগ করা হয়েছে, তবুও ঐতিহাসিকভাবে তাঁর শিশু বা যৌবনকালের কিছু কাহিনী জানা যায়।
তার প্রথম নার্স ছিল আবিসিনিয়ার খ্রিস্টান আইমান। তখন আইমানের বয়স ষোল/সতের (পরে যায়েদ বিন হারিথের সাথে তাঁর বিয়ে হয়। বিন হারিথ প্রফেটের দত্তক পুত্র ছিল)। শিশু মোহাম্মদের দ্বিতীয় নার্স ছিল থুআইবা, যে কয়েক সপ্তাহ মাত্র তার পরিচর্যা করেছে।
তাঁর তৃতীয় নার্স ছিল হালিমা। হাওয়াইন উপজাতির বেদুইন গোত্রের বানু সাদের রমণী। কোরেশ গোত্রের নয়। আমিনা তার চার বছরের পুত্রকে হালিমার কাছে দিয়েছিলেন এই ভেবে যে মক্কার অস্বাস্থ্যকর (insalubrious) আবহাওয়া থেকে মরুর স্বাস্থ্যকর পরিবেশে তার পুত্র বেড়ে উঠবে। পরে প্রফেট বলেছিলেন যে, বানু সাদের পরিবেশে তিনি শুদ্ধ আরবি ভাষা রপ্ত করতে পেরেছেন। পাঁচ বছর বয়সে হালিমা অসুস্থতার কারণে শিশু মোহাম্মদকে তার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেয়।
শিশু মোহাম্মদ যখন ছ’বছরের তখন তাঁর মা মারা যাওয়ায় তাঁর প্রতিপালনের দায়িত্ব পড়ে দাদা আবদুল মোত্তালেবের ওপর। বলা হয় যে, ছয় বছরের শিশুকে তাঁর দাদা কাবাঘরের হুবাল দেবতার কাছে নিয়ে যায়। দাদা আবদুল মোত্তালেবের মৃত্যুর পর চাচা আবু তালিব শিশু মোহাম্মদের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন, তখন তাঁর বয়স আট বছর।
বাল্যকালের বছরগুলোতে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি যা উল্লেখযোগ্য, তাই বালক মোহাম্মদ, মক্কার অন্যান্য বালকদের মতো, মক্কার আশপাশে ছাগল ও ভেড়ার দেখাশোনায় নিযুক্ত হন। প্রায় ৫৮২ সালে, যখন তাঁর বয়স বারো, আবু তালিব তাঁকে সাথে করে ব্যবসার কারণে কয়েক মাসের মতো সিরিয়ায় গমন করেন। তারা পেট্রা, জেরাশ, আম্মান এবং অন্যান্য প্রসিদ্ধ শহরের মধ্য দিয়ে সিরিয়ায় খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের কাছে এসে পৌঁছান। মক্কায় ফিরে যাবার পথে সিরিয়ার বসরাতে তারা থামেন; এখানে ক্যারাভান পথের বড় একটা জংশন রোড বিভিন্ন স্থান থেকে পাঁচটি বড় রাস্তা মিশেছে। তাছাড়া এটা খ্রিস্টানদের একটি কেন্দ্রভূমি, একটা বড় ক্যাথিড্রাল আছে। কথিত আছে এই বসরায় সাধু বহিরা বালক মোহাম্মদের কাঁধের আকৃতি দেখে তাঁর সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করেন এই বলে যে, ভবিষ্যতে ছেলেটির বিখ্যাত ব্যক্তি হওয়ার লক্ষণ পাওয়া যাচ্ছে। তারপর বহিরা বালক মোহাম্মদের সাথে কথাবার্তা বলেন এবং বলেন, এই বালক ভবিষ্যতে আরবের প্রফেট হবে। তাদের মূর্তিপূজা থেকে সরিয়ে আনবে এবং কাবা গৃহ পরিষ্কার করে ফেলবে মূর্তি থেকে।
সতের এবং উনিশ বছর বয়সে মোহাম্মদ তাঁর চাচার সাথে স্থানীয় গোত্র যুদ্ধে যোগ দেন। এই যুদ্ধ সময় সময় পবিত্র মাসে নিষিদ্ধ হলেও ঘটত। একে ফিজার যুদ্ধ বলা হয়। এই যুদ্ধ অনেক দিন ধরে চলেছিল। তরুণ মোহাম্মদ এই যুদ্ধে শুধু শত্রুদের ছোড়া তীরগুলো কুড়িয়ে নিয়ে নিজের দলের লোকদের দিতেন ব্যবহারের জন্য।
বিশ বছর বেশি বয়স পর্যন্ত তখন মোহাম্মদ তাঁর চাচা আবু তালেবের সাথে উত্তর আরব, প্যালেস্টাইন ও সিরিয়াতে ক্যারাভানসহ বাণিজ্য যাত্রা করেছেন। এই বাণিজ্য কালে তিনি বিভিন্ন ধরনের মানুষের সাথে মিশে তাদের জীবনযাত্রার সাথে পরিচিত হন। সেই সাথে তিনি বিদেশী বাণিজ্য সম্বন্ধে প্রাথমিক অভিজ্ঞতা লাভ করেন এবং একটি দেশের উন্নয়ন ও অর্থনৈতিকভাবে টিকে থাকার কথা উপলব্ধি করেন। তিনি নিজেই আবিসিনিয়ার সাথে চামড়ার ব্যবসা শুরু করেন, এই ব্যবসায় তার অংশীদার ছিল মখজুম গোত্রের আল-সাইব। (এই মখজুম গোত্রের রমণী ছিলেন তাঁর দাদি ফাতিমা)। তাঁদের ব্যবসার পণ্যদ্রব্য মক্কাতে আল-সাইবের গুদাম ঘরে জমা থাকত।
৫৯৪ সালে মোহাম্মদের ২৪ বছর বয়সে একটি অগ্নি দুর্ঘটনায় ও পরবর্তীতে বন্যার করণে কাবাঘরের বেশ ক্ষতি হয়, ফলে এই মন্দিরকে ভেঙ্গে নতুনভাবে গড়ে তোলার প্রয়োজনবোধ করে কোরেশরা। সেই সময় কাবাঘরের দেয়াল ছিল ছোট এবং কোনো ছাদ ছিল না। কোরেশরা তাই এই মন্দির ঘরকে উঁচু করে নতুনভাবে তৈরি করার কথা চিন্তা করে। কিন্তু এই ঘর নির্মাণে প্রয়োজনীয় কাঠ ও শ্রমিক স্থানীয়ভাবে পাওয়া গেল না।
ঠিক এই সময় লোহিত সাগরে জেদ্দা বন্দরে একটি গ্রিক জাহাজ নষ্ট হয়ে যায়। এই জাহাজে আবিসিয়ান চার্চ নির্মাণের জন্য কাঠ বোঝাই করে আনছিল। সেই জাহাজে ক্রুদের সাথে একজন কপটিক ক্রিশ্চান কাঠমিস্ত্রিও ছিল—তার নাম বাকুম (পাচোমিয়াস?)। এই কাঠ ও মিস্ত্রি দিয়ে কাবাঘরের পুনর্নির্মাণ শুরু হয়। তরুণ মোহাম্মদ অন্যান্যদের সঙ্গে পাহাড় থেকে পাথর বয়ে আনেন এবং কালো পাথর পুনঃস্থাপনে সাহায্য করেন। কথিত আছে, এই কালো পাথর বসানোর সময় গোত্ৰ নেতাদের মাঝে ঝগড়া শুরু হয় কোন গোত্র পাথরটি তার স্থানে পুনঃস্থাপন করবে। তখন মোহাম্মদ একটি কম্বলের উপর পাথরটি বসিয়ে প্রত্যেক গোত্র প্রধানদের কম্বলের কোণ ধরে পাথরটিকে উঁচু করে তুলে ধরতে বলেন এবং সমপরিমাণ উঁচু অবস্থায় উঠলে তিনি পাথরটি নিজেই তার স্থানে বসিয়ে দেন। এইভাবে সমস্যাটির সমাধান হয়। তারপর মহাদেবতা হুবালকে তার নিজ আসনে বসানো হয়। এই পুনর্নির্মাণে সর্বপ্রথমভাবে কাবাঘরের ছাদ তৈরি করা হলো।
এই সময়ের মধ্যে মোহাম্মদ তাঁর বাপ-দাদাদের ধর্ম-কর্মে অংশগ্রহণ করেন এবং বাৎসরিক তীর্থের সময় পরিবারের সদস্যদের তীর্থের রীতিনীতিও পালন করেন। ঐতিহাসিক কালবি এবং ইয়াকুবের বর্ণনা মতে, প্রফেট বলেছিলেন যে, মাত্র একবার তিনি উজ্জা দেবীর থানে একটি ভেড়ি বলি দেন এবং তার মাংস গ্রহণ করেন। তার পরেও তিনি পরিবারের নিয়ম-রীতি অনুযায়ী বলির মাংস খেয়েছেন।
ওহি পাবার পূর্ব পর্যন্ত, মোহাম্মদ হানিফদের সাথে এবং তাদের কর্মপদ্ধতির সাথে খুব ভালোভাবেই পরিচিত ছিলেন এবং হেজাজের কয়েক জন ধর্ম সংস্কারকের সাথেও তাঁর পরিচয় ঘটে, এদের মধ্যে কয়েকজন তাঁর পরবর্তী জীবনে প্রভাব ফেলেছিলেন। ওহি আগমনের পর প্রফেট মোহাম্মদের জীবনের গতি সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তিত হয়।
৫.৪ জায়েদ ইবন আমর
জায়েদ ইবন আমর কোরেশী দ্বিতীয় খলিফা ওমরের চাচা ছিলেন। ইনি একজন প্রতিশ্রুত হানিফ। তিনি নিজেকে আব্রাহামের ধর্মের অনুসারী বলে পরিচয় দিতেন। তার গোত্রের পৌত্তলিকতা সম্বন্ধে প্রকাশ করে কবিতা লিখতেন এবং নারী-শিশু হত্যা ও মূর্তি পূজাকে নিন্দা করতেন। সারা রমজান ধরে তিনি হিরা পর্বতে নির্জনে কালাতিপাত করতেন।
৫৯৫ খ্রিস্টাব্দে মোহাম্মদ জায়েদের সাথে দেখা করেছিলেন, আলাপ-আলোচনা চলত এবং দেবতার কাছে উৎসর্গীকৃত পশুর রান্না করা গোস্ত নিয়ে যেতেন তার সাথে খাওয়ার জন্য। জায়েদ সে খাদ্য খেতে অস্বীকার করতেন। মোহাম্মদকে মূর্তিপূজা থেকে নিবৃত করার চেষ্টা করতেন এবং বকাবকি করতেন দেবতার কাছে বলি দেয়া পশুর মাংস খাওয়ানোর জন্য (দ্র. Acts 15: 29)। পরে মোহাম্মদ বলেছেন যে সে সময় থেকে তিনি জ্ঞাতসারে কোনো দেবতার দোরে যাননি, কিংবা কোনো পশু উৎসর্গও করেননি।
জায়েদ কাবার প্রাঙ্গণে বসে প্রার্থনা করতেন— হে ঈশ্বর আমি জানি না তোমাকে কিভাবে পূজা করব। যদি জানতাম, তাহলে সেই ভাবেই করতাম।
মক্কার মানুষের দ্বারা বিদ্রূপিত হয়ে তিনি সিরিয়া ও ইরাকে চলে যান এবং রাব্বি ও সাধুদের প্রশ্ন করেন। ৬০৮ খ্রিস্টাব্দে মক্কায় ফেরার পথে দুর্বৃত্তের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে মারা যান। হিরা পাহাড়ের নিচে তার সমাধি হয়েছে।
প্রফেট মোহাম্মদ তাঁর বাণীতে বলেছেন যারা অবিশ্বাসী তাদের অবস্থান নরকের আগুনে, কিন্তু, বলা হয় যে, প্রফেট জায়েদের জন্য আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ প্রার্থনা করেছেন এই বলে যে, যদিও তিনি মুসলিম ছিলেন না, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন। প্রফেট বলেছিলেন, ‘জায়েদ রোজ কেয়ামতে মুসলিম সম্প্রদায়ের একজন হয়ে জীবিত হবেন এবং তার জন্য বেহেস্তে স্থান করা আছে। আমি সেখানে তাকে দেখেছি।
৫.৫ কস ইবন সাঈদা
একটি মুসলিম ট্র্যাডিশনে বর্ণিত যে প্রফেট মোহাম্মদের মিশন আরম্ভ হওয়ার পূর্বে, নাজরানের বিশপ আইয়াদ গোত্রের কস ইবন সাঈদা মক্কার ওকাজের বাজারে প্রচার করছিলেন। তিনি মাস্ত হয়ে প্রাথমিক কোরানের সূরা পাঠের মতো সুর করে গদ্য ছন্দে (সাজ) কবিতা আবৃত্তি করছিলেন। তার প্রচার এত হৃদয়গ্রাহী ছিল যে, সে-কথা লোকে মুখস্থ করে ফেলেছিল; এখনো নাকি কিছু খণ্ডিতভাবে চালু আছে। কবিতাটি এইরূপে আরম্ভ হয়।
‘হে লোক সকল কাছে এসো/ শোনো এবং ভয় করো/আয়াতগুলো পঠিত/কিছু পাবার আশায় নয়;/তারকারাজি উদয় হয় আবার অস্ত যায়/সমুদ্র কখনো শুকিয়ে যায় না/ছাদের ওপরে অনন্ত আকাশ/দূরে দিগন্তে পৃথিবীর সাথে মিশেছে/বৃষ্টি পড়ে/বৃক্ষরাজি তাজা হয়/নারী পুরুষে বিবাহ করে/সময় চলমান, চলে যাচ্ছে/হে মরণশীল মানুষ বলো/আজ তোমাদের গোত্ররা কোথায়/যারা একবার অবাধ্য হয়েছিল/শুভকর্মে আইন/কোথায় তারা?/নিশ্চয়ই আল্লাহ দিয়েছে/তাদের আলো যারা বাঁচতে চায়।’
কস তারপর প্রচার করেছেন মানুষের নৈতিক ত্রুটি (Fafraitlyth) সম্বন্ধে, দুর্বলতা সম্বন্ধে, ঈশ্বরের করুণা ও শেষ বিচারের দিন সম্বন্ধে।
প্রফেট মোহাম্মদ মুগ্ধ হয়ে কসের সু-সমাচার শুনে গভীরভাবে বিচলিত হন। কসের সারমন তার মনকে উত্তেজিত করে, আত্মাকে নাড়া দিয়ে তোলে। মুতাজিলি জাহিজ (মৃ. ৮৬৯) এক ট্র্যাডিশনে বর্ণনা করেছেন প্রফেট মোহাম্মদ সেই সারমনের দৃশ্য এবং বাণী পুনর্ব্যক্ত করেছিলেন, তিনি ভোলেননি।
অনেক বছর পর যখন আইয়াদ গোত্রের এক ডেপুটেশন মক্কা গমন করে, প্রফেট মোহাম্মদ কস সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করে জেনেছিলেন যে তিনি প্রায় ৬১৩ খ্রিস্টাব্দে মারা যান। প্রফেট শ্রদ্ধার সাথে তাকে স্মরণ করে বলেছিলেন যে তিনি প্রচার করেছিলেন ‘সত্যিকারের সার্বজনীন বিশ্বাসের বাণী’- ‘The true universal faith’।
৫.৬ তায়েফের উমাইয়া
উমাইয়া ইবন আবু আল-সাত (মৃ. ৬২৯) তায়েফের থাকিফ গোত্রের একজন সংস্কারক ছিলেন। তিনি প্রফেট মোহাম্মদের সমসাময়িক হলেও বয়সে বড় ছিলেন। তিনি কবি ও সত্যসন্ধানী ছিলেন এবং পরে প্রফেটের প্রতিদ্বন্দ্বী ও মতপার্থক্য পোষণ করেন; তার কবিতাগুলো কোরানের মতো পঠিত হতো। তিনি নিজেকে হানিফ বলে পরিচয় দিতেন এবং হানিফদের ধর্ম (দ্বীন) সত্য এবং তা পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত টিকে থাকবে বলে বিশ্বাসী ছিলেন।
উত্তর আরব, নাবিতিয়া, প্যালেস্টাইন ও সিরিয়া ভ্রমণকালে তিনি ইহুদি ও খ্রিস্টান ডকট্রিন (তত্ত্ব-নীতি) পাঠ করেন এবং খ্রিস্টান আইয়াদ গোত্র কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত স্কুলকে অনুমোদন করেছিলেন।
নাকতিয়ার খ্রিস্টানরা ইহুদিদের একটি রীতি অনুসরণ করত তোরাহ-র ওপর ভিত্তি করে, যেখানে ঈশ্বরকে করুণাময় এবং মহৎ বলে উল্লেখ করা হয়েছে (যাত্রা পুস্তক ৩৪:৬)। আরবিতে এই ফরমুলাকে তাসমিয়া’ অথবা ‘বাসমালা’ নামে একই অর্থে আল্লাহকে আহ্বান করা হতো। তায়েফের উমাইয়া এই ফরমুলা গ্রহণ করেছিলেন এবং পরে আরবে কোরেশদের এই ফরমুলা শিক্ষা দেন। (Rodwel (1915, p. 19) প্রফেট মোহাম্মদও এই ফরমুলা গ্রহণ করে সব সময়েই ব্যবহার করতেন। ‘তাসমিয়া’ এইভাবে পড়া হতো- “আল্লাহর নামে (বিসমিল্লাহ), আর-রহমান আর-রহিম” ‘In the name of God (Bismillah) The Merciful (al-Rahman), The Compassionate (al-Rahim)। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, রহমান শব্দে খ্রিস্টান মৌলিক অর্থের তাৎপর্য বেশি ছিল- had strong Christian connstation.
‘তাসমিয়া’ মুসলিমদের তাৎপর্যপূর্ণ ফরমুলায় পরিণত হয় এবং কোরানে প্রতিটি সূরা প্রথমে ব্যবহার করা হয়েছে [সূরা তওবা (৯ নং) বাদে)- ৯নং সূরাতে ‘তাসমিয়া’ ব্যবহৃত হয়নি কারণ এই সূরা প্রথমে ৮ নং সূরার অংশ বিশেষ ছিল। প্রার্থনার পূর্বে ‘তাসমিয়া’ পুনঃ পুনঃ উচ্চারিত হয়। ওজু করার সময় এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠান আরম্ভ করার পূর্বে উচ্চারিত হয়। শুধু তাই নয়, খাবার পূর্বে, যাত্রার পূর্বে, ভালোবাসার পূর্বে (making love) এবং অনুরূপ কোনো কাজ আরম্ভের পূর্বে ব্যবহৃত হয়।
পশু নিধনের পূর্বে কিংবা যুদ্ধ বা জেহাদের পূর্বে ব্যবহৃত হয় না, এসব কর্মে আল্লাহের দয়া বা করুণার গুণাবলি উল্লেখ করা হয় না, পরিবর্তে মুসলিমরা উচ্চারণ করে অন্য ফরমুলা- আল্লাহর নামে, যিনি মহান In the name of ‘God’, God most great। এই শব্দাবলির শেষাংশ অর্থাৎ ‘আল্লাহু আকবর’কে ‘তকবির’ বলা হয়।
৫.৭ খাদিজা
প্রফেট মোহাম্মদ তাঁর চাচা আবু তালেবের কাছে অনুরোধ করেছিলেন, তাঁর কন্যা উম্মে হানির পাণি গ্রহণের জন্য। যদিও ভাতিজার জন্য তার স্নেহের অন্ত ছিল না, কিন্তু প্রফেটের দারিদ্র্যের কারণে আবু তালেব তার কন্যার সাথে বিবাহে সম্মতি দেননি।
প্রফেট মোহাম্মদের যখন বয়স পঁচিশ, আবু তালিব তাকে কোরেশ গোত্রের এক ধনী বিধবার কাছে সোপারেশ করেন। থুয়ালিদের কন্যা খাদিজা দু’দফা বিধবা হন এবং তার পূর্বে স্বামীদের দ্বারা দু’টি পুত্র ও একটি কন্যার জন্ম হয়। প্রফেট মোহাম্মদ খাদিজার অধীনে চাকরি গ্রহণ করেন এবং তাঁর ওপর খাদিজার ব্যবসা ও বাণিজ্য ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পড়ে এবং এই সূত্রে খাদিজার প্রতিনিধি রূপে তিনি আরব, সিরিয়া, দামেস্ক এবং এলেপ্পোর বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেন। ব্যবসা-বাণিজ্যে তার অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান খাদিজার ব্যবসার সুফল বয়ে আনে।
৫৯৫ খ্রিস্টাব্দে, চাকরিতে যোগদানের কিছুদিন পরে, প্রফেট মোহাম্মদ খাদিজাকে বিবাহ করেন এবং মদিনায় ৬২২ খ্রিস্টাব্দে হিজরত পর্যন্ত তিনি খাদিজার গৃহে বাস করেন। দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠার পর, বিবাহের কারণে প্রফেট মোহাম্মদের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন হয়, যদিও মানসিকভাবে তাঁর অস্থিরতা কেটে ওঠেনি। এ ব্যাপারে কোরানে বলা হয়েছে- ‘আমি কি তোমার বক্ষ তোমার কল্যাণে প্রশস্ত করিয়া দেই নাই? (৯৪:২)। অন্য এক আয়াতও প্রাসঙ্গিক : তিনি তোমাকে পাইলেন নিঃস্ব অবস্থায়, অতঃপর অভাবমুক্ত করিলেন (৯৩:৮)। এখন তিনি আরবের বিধর্মী আচরণের (প্যাগানিজম) সংস্কারে বেশি সময় নিয়োজিত করলেন এবং খাদিজাও তাঁকে এ বিষয়ে অকুণ্ঠ সহযোগিতা করলেন।
প্রফেট মোহাম্মদের সাথে খাদিজার যখন বিবাহ হয় তখন সাধারণত বলা হয়েছে তার বয়স হয়েছিল চল্লিশ; কিন্তু একজন লেখক ইবনে হাবীব, বলেছেন তখন তার বয়স ছিল আটাশ। এটি বেশি বিশ্বাসযোগ্য, কারণ খাদিজা এই বিবাহ সূত্রে দু’টি পুত্র কাসিম ও আব্দল্লাহ উভয়েই শিশুকালে মারা যায় (প্রফেট মোহাম্মদকে প্রায় লোকে আবুল কাসেম-কাসেমের বাবা বলে সম্বোধন করত) এবং চারটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। জয়নবের বিবাহ হয় খাদিজার ভাইপো আবুল আস-এর সাথে; রোকেয়া, উম্মে কুলসুম ও ফাতিমা। কেবলমাত্র ফাতিমা প্রফেটের মৃত্যুর পর বেঁচে ছিলেন এবং কেবলমাত্র ফাতিমার বংশের মাধ্যমেই প্রফেট চিরকাল স্মরণীয়। প্রফেট মোহাম্মদের বর্তমান বংশধররা এবং মহান ইমামগণ (শিয়াদের) সকলেই খাদিজার বংশধর।
খাদিজার সাথে বিবাহের পর থেকে হেরা পর্বতে প্রথম ‘ওহি’ অবতরণের মধ্যে ১৫ বছর প্রফেটের জীবন সম্বন্ধে অতি অল্পই জানা যায়, কিন্তু এই সময়ের মধ্যে প্রফেট জীবনকে খাদিজা যেভাবে পরিচালিত করেছেন সে অবদান অনস্বীকার্য। এই সময়ে প্রফেট যখন ‘ভুলপথে চলছিলেন’ (wandering in error), এ সময় তিনি যে সঠিক পথের সন্ধান পান, সে ‘গাইডেনস’ খাদিজার কাছ থেকে এসেছিল— এ সম্বন্ধে প্রথম দিকের একটি আয়াত তুলনীয়— যেমন, তিনি তোমাকে পাইলেন পথ সম্পর্কে অনবহিত, অতঃপর তিনি পথের সন্ধান দিলেন। (৯৩:৭)।
প্রফেট যখনই বিচলিত হতেন তিনি তখন খাদিজার কাছে সান্ত্বনার জন্য গমন করতেন। খাদিজা প্রথম মহিলা যিনি প্রফেটের মিশনে বিশ্বাস করেন এবং প্রফেটকে তিনি তাঁর বিশ্বাসে অটল থাকতে বলেন।
খাদিজা প্রায়ই প্রফেটের সাথে যেতেন যখন তিনি (প্রফেট) মরুতে আরাধনা করেন, খাদিজা প্রফেটের মনে তার মিশন সম্বন্ধে দৃঢ়তা এনে দেন এবং অনবরত উৎসাহ দিতেন তাঁর বিশ্বাসে দৃঢ় থাকতে। খাদিজা বিরুদ্ধ মতবাদীদের প্রতিবাদকে পাত্তা দিতেন না, বলতেন এসব নিরর্থক, প্রফেট গভীর হতাশায় ভেঙে পড়লে তিনি আন্তরিকভাবে সান্ত্বনা দিতেন, প্রফেটের অন্ধকার দিনগুলোয় খাদিজা আলোর বর্তিকা বহন করেছেন, সাহস জুগিয়েছেন, সুপরামর্শ দিয়েছেন উৎসাহের সাথে। তিনিই ছিলেন প্রফেটের প্রধান পরামর্শদাত্রী, কাউন্সিলার।
৬১৯ সালে খাদিজা মারা যান। তার সমাধি মক্কার শীর্ষে উপত্যকায়, মুসলিম তীর্থযাত্রীরা এখনো দর্শন করে থাকেন। তার মৃত্যু প্রফেটের জীবনে অপূরণীয় ক্ষতি বহন করে আনে, দীর্ঘদিন ধরে প্রফেট স্ত্রী-বিয়োগে বিমর্ষ ছিলেন। তার মৃত্যু ও প্রফেটের পুনর্বিবাহের বহু বছর ধরে খাদিজার জন্য তার অন্তরে গভীর সচেতনতা বিরাজ করেছে। যখন কোনো কণ্ঠস্বর খাদিজার মতো শোনাত এবং কখনো তার নাম উচ্চারিত হলে তিনি দুঃখে-শোকে মুহ্যমান হতেন এবং তার দু’চোখ বেয়ে আঁসু ঝরে পড়ত।
খাদিজার কথা স্মরণ করলে প্রফেটের সুন্দরী তরুণী স্ত্রী আয়েশা প্রতিবাদ করেন। খাদিজাকে না দেখলেও অন্যান্য স্ত্রীদের চেয়ে আয়েশা ঈর্ষান্বিত হতেন। একবার আয়েশা যখন গর্ব করে বলেছিলেন ঐ বুড়ির পরিবর্তে কি আমি ভালো নই, প্রফেট রাগত হয়ে জবাব দেন— না, তার পরিবর্তে আল্লাহ আমাকে কোনো ভালো স্ত্রী দেননি। আমি যখন দরিদ্র ছিলাম, তিনি তাঁর সম্পদ আমাকে দেন; অন্যরা যখন আমাকে প্রত্যাখ্যান করে, তিনি আমাকে বিশ্বাস করেছেন, সান্ত্বনা দিয়েছেন। অন্যরা যখন আমাকে মিথ্যাবাদী বলেছে, তিনি আমাকে সত্যবাদী বলেছেন, আমার কথায় বিশ্বাস করেছেন। তাঁর মধ্য দিয়ে আল্লাহ আমাকে সন্তান-সন্ততি দিয়েছেন, অন্য কোনো স্ত্রী আমাকে সন্তান দেয়নি ।
খাদিজা একমাত্র ব্যক্তিত্ব যিনি এককভাবে প্রফেটের জীবনে প্রভাব ফেলতে পেরেছেন— অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব। সম্ভবত ইসলামের ইতিহাসে তিনি ছিলেন অসাধারণ মহিলা এবং অত্যন্ত সঠিকভাবে তাকে ‘মহান খাদিজা’ উপাধিতে ভূষিত করা হয় (খাদিজা আল-কুবরা)। প্রফেট মোহাম্মদ পৃথিবীর ইতিহাসে খাদিজাকে চারজন আদর্শ নারীর একজন বলেছেন- অন্য তিনজন হলেন আসিয়া, ফেরাউনের কন্যা যিনি মুসাকে পালন করেন, যিশুর মাতা কুমারী মেরি, আর খাদিজার গর্ভে তার কন্যা ফাতেমা।
খাদিজার ধর্মীয় বিশ্বাস সম্বন্ধে অতি অল্পই জানা যায়, কিন্তু আল-তাবারীর মতে, তিনি সব ঐশী গ্রন্থ (scriptures) পাঠ করেছেন এবং প্রফেটদের ইতিহাস সম্বন্ধে তিনি জ্ঞাত ছিলেন। খ্রিস্টানদের লেখা বইপত্রের সাথে তার পরিচয় ছিল এবং খ্রিস্টানদের সম্বন্ধে অনেক কিছু জানতেন। হতে পারে, তিনি নিজেই খ্রিস্টান ছিলেন।
খ্রিস্টান ধর্মের সাথে তার যোগাযোগ ছিল দৃঢ়, অবিচ্ছিন্ন। ওসমান ইবন হাওয়ারিথ, খাদিজার কাজিন, খ্রিস্টান ছিলেন এবং তিনি মক্কার ধর্ম সংস্কারের চেষ্টা করেন। তার অন্য কাজিন ওয়ারাকাও খ্রিস্টান ছিলেন। তার দ্বিতীয় স্বামী আবু হালা খ্রিস্টান তামিম গোত্রভুক্ত। তার তৃতীয় স্বামী প্রফেট মোহাম্মদকে এক খ্রিস্টান দাস উপহার দেন, যার নাম ছিল জায়েদ বিন হারিথ, এই জায়েদকে তিনি পোষ্যপুত্র রূপে গ্রহণ করেছিলেন।
যারা প্রফেট মোহাম্মদকে যিশুর জীবনী সম্বন্ধে বলেছিলেন, তাদের মধ্যে খাদিজা একজন। যিশুর সম্বন্ধে অনেক ওহি প্রফেট মোহাম্মদ প্রাপ্ত হন। শিক্ষিত নারী হিসাবে, খাদিজাই প্রথম ব্যক্তি যিনি প্রফেটের কাছ থেকে ওহির ‘ডিকটেশন’ লিপিবদ্ধ করেন। তিনি নিশ্চয়ই প্রফেটকে খ্রিস্টান রীতিমতে একজন স্ত্রী গ্রহণ করার জন্য বলে থাকবেন, এবং একথা বলার মতো অবস্থা তার ছিল, কারণ প্রফেট কখনই খাদিজার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করেননি। এই কারণেই তাদের বিবাহিত জীবনের ২৪ বছরেও প্রফেট দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করেননি।
হতে পারে যে খাদিজা প্রফেটের সম্মুখে আরবের প্রচলিত ধর্মীয় অবস্থা সংস্কারের কথা বলেছেন এবং নারী-শিশু হত্যা করার মতো কু-প্রথা বন্ধ করার জন্য পরামর্শ দেন। এ ছাড়া আরবের হানিফদের আচার-ব্যবহারও প্রফেটের জন্য অনুপ্রেরণা স্বরূপ ছিল, যে কারণে আরবে অনেক অধর্ম-আচরণ ও বর্বর প্রথার তিনি উচ্ছেদ সাধন করেছেন। যদিও বলা হয় যে, খাদিজা প্রফেট মোহাম্মদের ধর্ম ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, তেমনি এটাও সমভাবে সত্য যে প্রথমে প্রফেট মোহাম্মদকে একেশ্বরবাদে বিশ্বাস করানোর জন্য খাদিজাই দায়ী ছিলেন – it would be equally true to say that She was responsible for His conversion in the first place.
৫.৮ সওদাগর
৬১০ খ্রিস্টাব্দে ওহি পাওয়ার পূর্বে প্রফেট মোহাম্মদ ২৫ বছরের অধিক ব্যবসা- বাণিজ্যের সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি ও তাঁর পরিবার ব্যবসা-বাণিজ্যে শুরু থেকেই জড়িত এবং বারো বছর বয়সে তিনি নিজ চাচা আবু তালিবের তত্ত্বাবধানে বাণিজ্যে হাতেখড়ি নেন এবং পরবর্তীতে এ সম্বন্ধে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। ২০ বছর বয়সে তিনি খাদিজার বাণিজ্য ও ব্যবসার দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং খাদিজার সাথে বিবাহের পরও স্ত্রীর ব্যবসার কাজ চালিয়ে যান। হয়তো খাদিজার মৃত্যুর পর তাঁর জীবনযাত্রা নির্বাহের জন্য, বেশ কয়েক বছর ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজ চালিয়ে যেতে হয়েছিল।
ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান ছিল অসাধারণ, ক্যারাভান পরিবহন ও বিদেশ বাজার সম্বন্ধে ভালো ধারণা ছিল এবং অন্যান্য বাণিজ্য সম্প্রদায় সম্বন্ধে, গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথ সম্বন্ধে তিনি সম্পূর্ণরূপে জ্ঞাত ছিলেন। এ সম্বন্ধে কোরানে অনেক সূত্রের উল্লেখ আছে। এই সব সূত্র সংগ্রহ করে ১৯৮২ সালে একজন আমেরিকান গ্রন্থকার চার্লস টোরে (Charles Torrey) একটি পুস্তক রচনা করেন।
শীতকালে ও গ্রীষ্মকালে ক্যারাভানে বাণিজ্যযাত্রা, পণ্যদ্রব্যের হিসাব, শেষ বিচারের দিন, প্রত্যেক মানুষের প্রাপ্য হিসাব, তারাজুর কথা, প্রত্যেক মানুষের ভালো- মন্দ কর্মের ওজন, শপথ গ্রহণ ও তার জন্য কাজ করা, প্রফেটের জন্য সাপোর্ট ইত্যাদির কথা কোরানে বিস্তৃতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রফেট মোহাম্মদের বাণিজ্য সম্পর্ক সম্বন্ধে তীক্ষ্ণ জ্ঞান তাঁর জীবনে অনেক সময় কাজে লেগেছে। ৬১৫ খ্রিস্টাব্দে আবিসিনিয়াতে একজন অনুসারীকে পাঠানো হয়েছিল বিপক্ষ মক্কাবাসীদের জানানোর জন্য যে, সে দেশের সাথে তাঁর সম্পর্ক গড়ার উদ্দেশ্যে। তাঁর মদিনাতে গমনের উদ্দেশ্য ছিল ৬২২ সালে সেখানে একটা কেন্দ্র গড়ে তোলা, যাতে মক্কাবাসীদের বাণিজ্যে তিনি বাধা দিতে পারেন এবং অর্থনৈতিকভাবে তাদের ক্ষতিসাধন করা। মদিনা এমন এক গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য পথে অবস্থিত যেখান থেকে তাঁর পরিকল্পনা মতে মক্কাবাসীদের বাণিজ্য ক্যারাভান আক্রমণ করতে পারেন এবং তাদের হয়রানি করতে পারেন ক্যারাভান যাত্রীদের। ফলে মক্কাবাসীদের বাণিজ্যে পরিশেষে তিনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। মদিনায় যাওয়ার পর মক্কার ক্যারাভানের ওপর বার বার আক্রমণ ও তাদের পণ্যদ্রব্য অধিগ্রহণ মক্কাবাসীদের বাণিজ্য ব্যবস্থাকে দুর্বল করে তোলা প্রফেটের পরিকল্পিত ব্যবস্থা এবং তীক্ষ্ণ ব্যবসায়িক বুদ্ধির পরিচয়। এইভাবে আক্রমণের মাধ্যমে প্রফেট কোরেশদের অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করে, তাঁর নেতৃত্ব গ্রহণ ও মিশনকে স্বীকৃতি দিতে কোরেশদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন।
৫.৯ হীরা পর্বতের গুহা
প্রফেট মোহাম্মদ চিন্তাপ্রবণ ব্যক্তি ছিলেন, মনে হতো সদা দুঃখভারাক্রান্ত এবং ত্রিশ দশকের শেষের বয়সে তিনি আরো বেশি যেন গুটিয়ে গেলেন, মনে হলো অসুস্থ মানুষ। তাঁর দেশের মানুষের জন্য গভীর অনুভূতি ছিল এবং সর্বদা এই চিন্তা তাঁকে কুরে কুরে খেত তাঁর পূর্বপুরুষের ধর্ম বিশ্বাস সম্বন্ধে। সব সময়েই ভেবে আকুল হতেন তিনি পূর্বপুরুষদের অধর্ম আচরণের স্থলে একেশ্বরবাদ প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন কিনা। রমজান মাসে সময় সময় তিনি স্ত্রী খাদিজাসহ মক্কার পার্শ্ববর্তী পর্বতে নির্জন বাস করতেন শুধুমাত্র জীবনধারণের জন্য কিছু প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি নিয়ে। তার দাদা এবং অন্যান্য ধার্মিক ব্যক্তি এবং হানিফরাও এই ভাবে পর্বতে সময় সময় নির্জন বাস করতেন।
একদিন (৬১০ খ্রিঃ) প্রফেটের বয়স যখন চল্লিশের মতো, তিনি একাকী হিরা পর্বতের পাদদেশে এক গুহায় নির্জন বাস চলে যান। প্রায় তিন মাইল উত্তর-পূর্ব দিকে হিরা একটি পাথুরে-পাহাড়। এই গুহাতেই হানিফ জাইদ ইবন আমর প্রায় আরাধনা করতেন। ঐ দিনরাতে রমজান মাসের ২৭ তারিখে লায়লাতুল কদর— ‘শক্তির রাত্রি’ Night of Power (১৪৭ : ১) প্রফেট গভীর আরাধনায় নিমগ্ন, হঠাৎ তিনি কণ্ঠস্বর শুনলেন কে যেন তাঁকে আদেশ করে বলছে : পড় (ইকরা) এবং প্রফেট জিজ্ঞাসা করলেন আমি কী পড়বো? (তুলনীয় : একটি কণ্ঠস্বর বলছে ‘কাঁদো’ [হিব্রু ‘কারা’ অর্থ পাঠ করা] এবং আমি বললাম- আমি কী বলে কাঁদবো?” ইসাইয়া ৪০:৬)
প্রফেট মোহাম্মদ বললেন যে তিনি পড়তে জানেন না, এ সময়ে তিনি অনুভব করলেন কে যেন তাকে বুকে চেপে ধরেছে এবং তার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আবার কণ্ঠস্বর হলো : ‘পড়, আল্লাহর নামে যিনি এক বিন্দু রক্ত থেকে মানুষ সৃষ্টি করেছেন। পড়, তোমার প্রতিপালকের নামে যিনি মহিমান্বিত এবং যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন।
বলা হয় এটা প্রফেটের নিকট প্রথম ঐশীবাণী এবং যে আয়াত তিনি শুনেছেন তা সূরা আলাকে বিধৃত (৯৬ : ১-৪)। এই অভিজ্ঞতায় প্রফেট মোহাম্মদের ভীষণ কম্পন শুরু হলো। তিনি বিব্রত হয়ে বাড়ি ফিরলেন, মনে হলো কে যেন তার দেহে ভর করেছে। স্ত্রী খাদিজাকে বললেন— আমাকে ঢেকে দাও, আমাকে ঢেকে দাও, আমি আমার জন্য চিন্তান্বিত। খাদিজা জিজ্ঞাসা করলেন- ব্যাপার কি? এবং তিনি প্রফেটকে সাহস দিয়ে শান্ত হতে বললেন এবং তাঁকে পরীক্ষা করলেন কোনো অশুভ আত্মা হতে ভালো-মন্দ শুনে থাকবেন।
খাদিজা প্রফেটকে বললেন আবার সেই আগন্তুক উদয় হলে প্রফেট যেন খাদিজাকে বলেন। ইবনে ইসহাক-এর বর্ণনা মতে, পরবর্তীতে যখন সেই ‘ভিশন’ দেখা দিল, খাদিজা প্রফেটকে তার বাঁ ঊরুতে বসতে বললেন, তারপর তাঁর ডান ঊরুতে এবং পরে তাঁর কোলে বসতে বললেন এবং প্রত্যেক বার প্রফেট জানালেন যে সেই ভিশন রয়ে গেছে। তারপর কোলে বসা অবস্থায় খাদিজা নিজেকে উন্মুক্ত করে তার স্বামীকে তার দুই জানুর মধ্যে টেনে নিতেই প্রফেট জানালেন যে সেই “ভিশন’ অদৃশ্য হয়ে গেছে।
সম্ভবত এই অবস্থাদৃষ্টে খাদিজার ধারণা বদ্ধমূল হলো যে, যিনি দেখা দিয়েছিলেন তিনি ‘দেবদূত’ ‘শয়তান’ নয়। খাদিজার নিশ্চিত অনুমান যে প্রফেট মোহাম্মদ আল্লাহর মনোনীত ব্যক্তি আরবে মূর্তিপূজা দূরীভূত করার জন্য। খাদিজা প্রফেটকে আশ্বাস দিয়ে বললেন, আনন্দ করুন, নিশ্চয় আল্লাহ সু-সংবাদ পাঠিয়েছেন আমি আশা করি আপনি আপনার লোকদের জন্য নবী নিযুক্ত হবেন।
চরিতকার মুসা ইবন ওকবার (মৃ. ৭৫৮) অথরিটিতে বর্ণিত এক ট্রাডিশন অনুযায়ী এবং অন্য বর্ণনা মতে, খাদিজা প্রফেট মোহাম্মদকে নিনেভ থেকে আগত এক খ্রিস্টান ধার্মিক ব্যক্তি আদ্দাস-এর কাছে নিয়ে যান; আদ্দাস মক্কাতে স্থায়ীভাবে বসবাস করছিলেন। আদ্দাস সব ঘটনা শুনে দেবদূত গ্যাব্রিয়েল সম্বন্ধে যা জানতেন তাদের কাছে সেসব ব্যক্ত করলেন।
৫.১০ ওয়ারাকা
এরপর খাদিজা গেলেন তার কাজিন ওয়ারাকা ইবন নওফেলের কাছে। ইনি কোরেশ গোত্রের। বিপুল অভিজ্ঞতাসম্পন্ন জ্ঞানী ব্যক্তি ওয়ারাকা গোত্র পুরোহিত বংশোদ্ভূত। তিনি মক্কার নিকটে দেবী উজ্জার মন্দিরের চার্জে ছিলেন। খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত ওয়ারাকা হিব্রু জানতেন এবং ইহুদি ও খ্রিস্টানদের ধর্ম পুস্তক অধ্যয়ন করেছেন। তিনি খ্রিস্টানদের গসপেল ও কিছু লেখার আরবিতে অনুবাদ করেন আংশিকভাবে। ওয়ারাকার ভগিনীও বিদুষী ও জ্ঞানী মহিলা ছিলেন এবং নিয়মিতভাবে গসপেল পাঠ করতেন। (Glubb, 1979, P. 68)।
খাদিজার কাছ থেকে ঘটনা শোনার পর ওয়ারাকা জবাব দেন তুমি যা বলেছ, তা সত্য হলে, খাদিজা, আমি তোমাকে বলতে পারি, প্রফেট মোহাম্মদের কাছে নামুসের আত্মা এসেছিল [গ্রিক নোমস (nomos) শব্দ থেকে নামুস অর্থ আইন] যা মোসেসের কাছেও এসেছিল এবং মোহাম্মদ তাঁর লোকদের নবী হবেন। সুতরাং তাকে সন্তুষ্টচিত্তে থাকতে বলো। খাদিজা বাড়ি ফিরে প্রফেটকে ওয়ারাকা যা বলেছিলেন সব বললেন।
এর কিছুদিন পর প্রফেট মোহাম্মদ নিজেই ওয়ারাকার কাছে গমন করে ঘটনার পুনরাবৃত্তি করেন। সব শুনে ওয়ারাকা আবার সেই একই কথা বললেন যা খাদিজাকে বলেছিলেন। তিনি অবশ্য যোগ দেন যে, এতে মানুষে তার বিরুদ্ধে দুর্নাম রটাতে পারে, মন্দ কথা বলতে পারে, এমনকি ঘৃণ্য ব্যবহারও করতে পারে, আপনাকে তারা মিথ্যাবাদী বলবে, অস্বীকার করবে, অত্যাচার করবে, যুদ্ধ করবে, এমনকি গোত্র থেকে বহিষ্কারও করবে। যদি ঈশ্বরের ইচ্ছা হয়, আমি বেঁচে থাকলে সাহায্য করবো সেই ভাবে যেভাবে ঈশ্বর আজ্ঞা করবেন।’ তারপর তিনি প্রফেট মোহাম্মদের ললাট চুম্বন করলেন। প্রফেট নিঃসঙ্গচিত্ত হয়ে বাড়ি ফিরে এলেন এবং নিজের মনকে শক্ত করলেন। ওয়ারাকা যে উৎসাহ প্রফেটকে দেন তা তার অন্তঃকরণকে উন্নত করে, আলোকিত করে (Watt 1953, P. 51)।
ঐ একই বছরে (৬১০), ওয়ারাকা খ্রিস্টান হিসাবে মারা যান। অনেক ইসলামী পুস্তকে ওয়ারাকাকে হানিফ বলা হয়েছে অথবা বলা হয়েছে সত্য ধর্মের অনুসারী।
৫.১১ বিরতি (ফাত্রা)
হেরা পর্বতে গুহার প্রথম ‘ওহি’ অবতরণের পর বেশ কিছু সময়ের জন্য ওহি বন্ধ ছিল। এই বিরতিকে ফাত্রা বলা হয়। সূরা আলাক (৯৬) ও পরবর্তী সূরার মধ্যে বিরতি ছিল কারোর মতে সাত মাস, আবার অন্যের মতে সাত বছর। আবার কেউ বলেন তিন বছর এবং এটা সম্ভবত সঠিক ব্যবধান অনেক পণ্ডিতের মতে।
আল-তাবারীর মতে, লোকেরা প্রফেট মোহাম্মদকে উপহাস করত এই বলে যে তার প্রভু (রব) অথবা সাথী (সাহিব) তাকে ত্যাগ করেছে। এক মহিলা- অনেকে বলেন উম্মে জামিল আবু লাহাবের পত্নী- বলেছিলেন- ‘তোমার শয়তান তোমাকে ত্যাগ করেছে এবং সে তোমাকে ঘৃণা করে।
এই বিরতির প্রথম দিকে প্রফেট মোহাম্মদ বেশ মানসিক যন্ত্রণায় ভুগেছেন। তিনি প্রায় সময় বিমর্ষ হয়ে থাকতেন, এমনকি আত্মহত্যা করার চিন্তা করেন (১৮ : ৫)। তফসীরকার ইবন হিশাম এবং আল বোখারী বলেছেন যে প্রফেট অনেকবার চেয়েছিলেন যে পাহাড়ের শীর্ষ থেকে লাফ দিয়ে জীবন অবসান করে দেন। তিনি তাঁর মিশনে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন এবং বিস্মিত হয়েছিলেন এই ভেবে যে তাকে হয়তো ঠকানো হয়েছে।
এই ক্রাইসিস ও হতাশা থেকে তিনি আশাহত জীবনে আশার আলো পেয়েছিলেন খাদিজার অনবরত আশ্বাসবাণী ও উৎসাহের দ্বারা। খাদিজা তাকে বিশ্বাসী হতে বলেন, সহিষ্ণু হতে বলেন এবং তার প্রচেষ্টাকে খাদিজা উৎসাহ দেন এবং একেশ্বরবাদীতে আরো বেশি করে বিশ্বাসী হতে বলেন। এই সময়ের মধ্যে প্রফেট মক্কাতে বসবাসরত খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সদস্যদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করতে থাকেন এবং তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন।
পরবর্তী তিনটি ওহি অবতরণের পর্যায়ক্রম ও তারিখ নিয়ে পণ্ডিতদের মতভেদ আছে, কিন্তু সাধারণত মনে করা হয় ঘটনা ঘটেছিল এই ভাবে। একদিন ৬১৩ খ্রিস্টাব্দে এই লম্বা বিরতির অবসান হলো যখন প্রফেট মোহাম্মদ ঐশীবাণী পেলেন, যাতে তার প্রভু (রব) তাকে আশ্বাস দিলেন যে তিনি প্রফেটকে ত্যাগ করেননি এবং তার প্রতি অসন্তুষ্টও নন (৯৩ : ৩)। এর পরেই কার্পেটে চাদর গায়ে শোয়া থাকা অবস্থায় তিনি আরও দু’টি ওহি পান উভয়ই শুরু হয়েছিল- ‘হে বস্ত্রাবৃত’ তারপর আদেশ হয় উঠে দাঁড়াও ও প্রার্থনা করো (৭৩ : ২); তারপরেই অন্য আদেশ হলো ওঠ, এবং প্রচার করো। (৭৪ : ২)। এরপর থেকেই ধারাবাহিকভাবে তিনি ওহি পেয়েছেন এবং সেগুলো মুখস্থ করা হয় এবং লিখে রাখা হয় তার সঙ্গীসাথীদের ও খতিবদের দ্বারা; পরবর্তীতে সংকলিত হয় সম্পূর্ণ একটি কোরানের আকারে।
৫.১২ অশিক্ষিত প্রফেট
হেরা পর্বতের গুহায় অবতীর্ণ প্রথম ওহির রাত্রের তাৎপর্য নিয়ে এবং প্রফেট মোহাম্মদ যেভাবে ‘পাঠ করা’র জন্য আদিষ্ট হয়েছিলেন তার প্রকৃতি ও অর্থ নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে অনেক বিতর্কের সূচনা হয়েছে। এই প্রথম ভিশনের সময় প্রফেটকে স্বর্গীয় পুস্তকের একটি পৃষ্ঠা দেখিয়ে পড়তে আদেশ করা হয়। পরে তাঁকে স্বর্গীয় সুবিধাও দেওয়া হয়েছিল পাঠ করার জন্য, কারণ বলা হয় তিনি অশিক্ষিত ছিলেন।
প্রফেট মোহাম্মদ সম্বন্ধে কোরানে বলা হয়েছে, তিনি অক্ষরজ্ঞানহীন unletted (উম্মি) (৭ : ১৫৭)। তিনি কোনো গ্রন্থ পড়তে পারতেন না, লিখতেও পারতেন না (২৯ : ৪৭)। মুসলিম ধর্মীয় পণ্ডিত বা আলেমরা জোর দিয়ে বলে থাকেন যে প্রফেট মোহাম্মদকে বলা যাবে না যে তিনি পুস্তক থেকে জ্ঞান আহরণ করেছেন, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন অন্য উৎস থেকে। একটা পবিত্র ধর্মপুস্তক বর্ণনা করার জন্য তার কয়েকটি প্রজ্ঞাকে ‘কেতাবী জ্ঞান’ দিয়ে কলুষিত না করাই শ্রেয়। তাই প্রফেটের অক্ষরজ্ঞান তীব্রতা এভাবেই প্রমাণ করে যে কোরান অলৌকিক ঘটনা থেকে উৎসারিত।
এক কাহিনীতে বলা হয়েছে যে প্রফেট মোহাম্মদের প্রথম যুগের শত্রু ইবন সিয়াদকে তিনি যখন জিজ্ঞাসা করলেন ‘তুমি কি সাক্ষ্য দাও যে আমি আমি আল্লাহর নবী?’ জবাবে ইবন সিয়াদ বলেন, ‘আমি সাক্ষ্য দিই যে তুমি অশিক্ষিত ও মূর্খ লোকদের নবী।
পাশ্চাত্য পণ্ডিতগণ অস্বীকার করেন যে প্রফেট মোহাম্মদ অশিক্ষিত ছিলেন। তিনি এক প্রভাবশালী পরিবারের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন যে পরিবার প্যাগন আরবের অতি পবিত্র ধর্মীয় পীঠস্থানের তত্ত্বাবধায়ক ছিল। তিনি বছরের পর বছর ধরে বাণিজ্য সংক্রান্ত ব্যাপারে বিদেশ ভ্রমণ করেছেন এবং হয়তো তার নিজের ভাষা আরবির নিশ্চয়ই ভালো পরিচয় বা জ্ঞান ছিল, অন্য কোনো ভাষা না জানলেও।
তার স্ত্রী খাদিজা একজন খ্যাতনামা ও সফল ব্যবসায়ী রমণী ছিলেন এবং শিক্ষিত পরিবারের সদস্যা- এমনকি যদি ধরা হয় যে খাদিজার সাথে বিবাহের সময় তিনি অশিক্ষিত ছিলেন, এটা খুবই অবাস্তব যে তাদের ২৫ বছরের বিবাহিত জীবনে এবং একত্রে বাস করা সত্ত্বেও তিনি তার স্বামীকে লিখতে ও পড়তে বলার জন্য অনুরোধ করবেন। প্রফেট পরবর্তী জীবনে শিক্ষার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন এবং বদরের যুদ্ধে ধৃত কয়েকজন মক্কাবাসীকে মুক্তিপণের বদলে মদিনাবাসীদের লেখাপড়া শিক্ষা দিতে বলেন।
প্রফেট মোহাম্মদ অনুভব করে থাকতে পারেন যে আরবদের ঐশী গ্রন্থ নেই, কেননা তারা অশিক্ষিত, তাই “তিনিই উম্মীদের মধ্যে একজন রাসূল পাঠাইয়াছেন তাহাদের মধ্যে হইতে”- (৬২ : ২); এতে প্রমাণিত যে আরবরা অশিক্ষিত ছিল, যেমন ইবন সিয়াদ প্রফেট মোহাম্মদকে বলেছিলেন ‘তুমি অশিক্ষিত মানুষদের নবী।’
হেরা পর্বতের গুহায় সেই ‘ভিশন’কে ব্যাখ্যা করা হয়েছে প্রফেট মোহাম্মদের অবচেতন মনের নির্দেশ বলে যাতে তিনি ইহুদি ও খ্রিস্টানদের ধর্মপুস্তক অধ্যয়ন করতে পারেন, তাদের লেখকদের হাতে কলম দেওয়া হয়েছিল ঈশ্বরের বাণী পুস্তকে বিধৃত করতে যে লেখার জ্ঞান আরবদের ছিল না।
কোরানে যে নির্ভুল বাণী লিখিত তা নির্ভর করে প্রফেটের শিক্ষার জ্ঞানের ওপরে, যারা লিখেছেন তাদের ওপরে নয়। কয়েকজন পণ্ডিত ব্যক্তির মতে, প্রফেট মোহাম্মদ ব্যক্তিগতভাবে কিছু আয়াত বিন্যাস করেন এবং সে আয়াতগুলো পরিবর্ধনও করেন। হোদায়বিয়ার সন্ধির খসড়া প্রস্তুত করার সময় তিনি নিজের হাতে কিছু শব্দের পরিবর্তন করেন। মৃত্যুশয্যায় বলা হয়েছে, তিনি লিখবার জন্য কাগজ-কলম চেয়েছিলেন তাঁর উত্তরাধিকারী সম্বন্ধে সমস্যার সমাধান করার মানসে, কিন্তু তাঁর সে অনুরোধ রক্ষা করা হয়নি।
৫.১৩ ঘূর্ণিরোগ ও মৃগীরোগ
বাল্যকাল থেকে মোহাম্মদ ঘূর্ণিরোগে আক্রান্ত হতেন ফলে তিনি অচেতন অবস্থায় মাটিতে পড়ে যেতেন। নার্স হালিমার কাছে চার বছর বয়সে প্রথমে এই রোগে তিনি আক্রান্ত হন। হালিমার পুত্রের সাথে, বেদুইনদের তাঁবুর কিছু দূরে, হাঁটা-চলার সময় হঠাৎ মাটিতে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যান। হালিমা মনে করেন বালক মোহাম্মদ জীর্ণ বা ভূতগ্রস্ত হয়ে অজ্ঞান হয়েছে (Nicholson, 1969 P. 147), এই ভয়ে বালক মোহাম্মদকে তাঁর মাতার কাছে হালিমা ফিরিয়ে দেন।
এই মৃগী বা ঘূর্ণ রোগ তাঁর জীবনের বেশির ভাগ জুড়ে চলেছিল এবং একে কেন্দ্ৰ করে বিভিন্ন বর্ণনা ও কেচ্ছা কাহিনীর জন্ম হয়েছে। সাধারণত এ রোগ শুরু হতো মাথা ধরা থেকে অর্থাৎ প্রথমে মাথা ধরত তারপর অসম্ভব মানসিক যন্ত্রণাসহ অব্যক্ত ভীতি তাঁর সারা দেহ-মনকে আচ্ছন্ন করত। কে যেন আক্রমণ করতে আসছে এই ভয়ে তিনি নিজেকে লুকিয়ে রাখতে ইচ্ছা করতেন। তাঁর দুই চোখ এদিক থেকে ওদিকে ঘুরতে থাকত। মাথা ভারি হয়ে দাঁড়াতে পারতেন না, পড়ে যেতেন।
এমনকি শীতের দিনে, তার কপালে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম দেখা দিত তারপরেই ভীষণভাবে ঘেমেনেয়ে উঠতেন অর্থাৎ ঘামে সারা দেহ ভিজে যেত। তারপর মনে হতো যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে, দেহ সঙ্কুচিত হচ্ছে কোনো এক অদৃশ্য চাপে, এতে যন্ত্রণা হতো অসহ্য। তাঁর ঠোঁট দু’টি দপদপ করে কাঁপতে আরম্ভ করত এবং সেই সাথে সারা দেহে কাঁপন বেড়ে যেত মাথা থেকে পা পর্যন্ত। তার শ্বাসকষ্ট শুরু হতো, গোঙ্গাতে থাকতেন আর ভীষণ কর্কশ শব্দে চেঁচিয়ে উঠতেন উটের বাচ্চার কান্নার মতো (cry out like camet colt) I
তিনি নিজের জিহ্বা কামড়াতেন, সারা মুখ ফেনায় ভরে যেত, মুখ লাল হয়ে আসত মৃগী রোগীর মতো। তারপর হঠাৎ মুখ লাল হয়ে রক্ত ঝরত এবং গায়ের রঙ সাদা হয়ে যেত। এর পরেই তিনি নিস্তেজ হয়ে আসতেন অথবা মাতালের মতো ধপ করে মাটিতে পড়ে যেতেন (Andrae, 1960 P. 50). তারপর খিঁচুনি শুরু হতো এবং অচেতন হয়ে পড়ে স্থির হয়ে যেতেন সম্মোহ মূর্ছারোগগ্রস্ত রোগীর মতো। এই অভিজ্ঞতাকে বর্ণনা করতে গিয়ে একবার তিনি আবদুল্লাহ ইবন ওমরকে বলেছিলেন ‘আমি একটা বিকট শব্দ শুনি, তারপর মনে হয় কে যেন ভীষণ একটা ঘুষি কষলো, এতে অনুভব করি আমার আত্মা যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে, পরান বের হয়ে যাচ্ছে।’
অন্য সময়ে তিনি অদ্ভুত শব্দ শুনতে পান, মাথায় গোলমাল শুরু হয়, কান ভোঁ ভোঁ করে যেন মৌমাছির ভোঁ ভোঁ শব্দ; অগুনতি মৌমাছির পাখার শোঁ শোঁ শব্দ, তারপর কানের কাছে ফিসফিস শব্দ (হাতিফ), এ শব্দ প্রাণকে বিব্রত করে তোলে, তারপর ঘণ্টার প্রতিধ্বনি। এই ঘণ্টার শব্দ তার কছে অদ্ভুত লাগে, অত্যন্ত বিরক্তিকর শব্দ, অসহ্য এ শব্দ তার অন্তঃকরণকে ছিন্ন-ভিন্ন করে দেয়। এমনকি প্রতিদিন যে মন্দিরে ঘণ্টা বাজে তাতেই তিনি মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন, অদ্ভুত মনে হয় সে ঘণ্টা ধ্বনি। তাঁকে এ শব্দ উদ্বিগ্ন ও অস্বস্তি করে তোলে, মনে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। এই কারণেই তিনি প্রার্থনার জন্য ডাকতে যে ঘণ্টাধ্বনি বাজানো হতো তা বন্ধ করে দেন।
প্রফেট মোহাম্মদের কিছু অনুসারী তার বাল্যকালের এই মূর্ছা রোগের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন যে, দেবদূতরা এসে তাকে অচেতন করে অন্তর হতে আদিপাপ বা বদ রক্ত বের করে দিত।
সাক্ষ্য প্রমাণে, প্রফেটের সমসাময়িক যারা ছিলেন তাদের ধারণা যে তাঁর হঠাৎ অজ্ঞান হওয়া বা খিঁচুনি রোগ (epilepsy) থেকে ভুগতেন বাল্য অবস্থা থেকে। ঐ সময়ের আরবেরা অন্যান্য প্রাচীন লোকদের মতো খিঁচুনি বা মূর্ছারোগকে পবিত্র অসুখ বলে বিবেচনা করত যা স্বর্গীয় আশীর্বাদস্বরূপ। মৃগী রোগীর মতো প্রফেটের প্রায়ই আক্রান্ত হওয়ার পূর্বে সাবধান বাণী পেতেন এবং সাথে সাথে লুকিয়ে যেতেন বা তাঁর চাদর দিয়ে নিজেকে অথবা মস্তক ঢেকে ফেলতেন। এই অবস্থা ও অন্যান্য নিদর্শন আরবের লেখকগণ মৃগী রোগের বা মূর্ছা রোগের লক্ষণ বলে বর্ণনা করেছেন। যাইহোক প্রফেট মোহাম্মদের প্যাগন আত্মীয়স্বজনরা প্রথম দিকে এ রোগের চিকিৎসা করে সারতে চেষ্টা করে।
পরবর্তীতে, আল-ওয়াকিদির মতো লেখকরা ব্যাখ্যা করেছেন যে রোগটা হয়তো জ্বর বা কম্পজ্বর (ague) বা মাথাব্যথা (মাইগ্রেন) জাতীয় হবে, আবার অনেকে ব্যাখ্যা করেছেন পবিত্র সম্মোহনভাব (holy trance) এবং অনেকে বলেছেন অন্য কিছু যার মধ্য দিয়ে তিনি সমাধিপ্রাপ্ত হতেন এবং ‘ওহি’ অবতরণ হতো ঐ সময়ে এবং সেই অবস্থাতে তিনি ঐশীবাণী আবৃত্তি করতেন এবং সত্যি বলতে কি, প্রফেটিক জীবনের শুরুতে ‘ওহি’ পাওয়ার পূর্বে এই মূর্ছাবস্থায় ‘সমাধি’প্রাপ্ত হতেন।
এই ‘সমাধি’প্রাপ্ত অবস্থার কালভেদ ছিল অর্থাৎ ক্ষণস্থায়ী বা দীর্ঘস্থায়ী হতো। সময়ের বিবর্তনে এই মূর্ছা রোগের মাত্রা কমে গেল এবং মদিনাতে ‘এ ঘটনার’ পুনরাবৃত্তি ঘটত খুব কম। আরো বলা হয়েছে যে, শুরুতে এই রোগে বেগ কম ছিল, তাই ভালোমতো কোনো চিকিৎসা হয়নি এবং এর ফলে ক্রমে বৃদ্ধি পেতে পেতে আবার কমে গেছে যার ফলাফল দেখা গেছে মক্কায় ‘ওহি’ অবতরণের এবং পরবর্তীতে মদিনায় ‘ওহি’ অবতরণের পুনঃপুনঃ সংঘটন থেকে (Frequency)। কারণ- মক্কায় সূরা নেমেছে ৯০ বার আর মদিনায় ২৪ বার (কোরানে সংকলিত সূরার সংখ্যা মোট ১১৪)।
মদিনা কালে দেখা গেছে যে, সে সময় প্রফেটের সচেতনতা বেশি ছিল এবং সেই অবস্থায় কোনো কোনো পণ্ডিত ব্যক্তি মনে করেন যে কিছু ‘সম্মোহন অবস্থা’ অকৃত্রিম (genuine) ছিল এবং পরের ঘটনা যদিও দেখাত স্বতঃস্ফূর্ত (spontaneous), মনে হতো নিয়ন্ত্রিত এবং কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে আত্মোভূত (Torrey 1967. P. 59)। প্রফেট মোহাম্মদ অনুভব করতে পারতেন যে তার এই পবিত্র সমাধি ভাবের মাত্রা কমে যাওয়াতে তার অনুসারীরা বিশ্বাস করত যে, এই পরিবর্তিত অবস্থায় তার অনুপ্রাণিত প্রকৃতির কথাবার্তার মাত্রাও কমে গেছে। তার এই বিচ্ছিন্ন ‘সম্মোহনভাব’কে তিনি সমন্বিত করতে পেরেছিলেন ভবিষ্যদ্বক্তা হিসাবে। অর্থাৎ তার বাণীকেই তার অনুসারীগণ ঐশীবাণীই বলে বিবেচনা করেছেন।
মুসলিম পণ্ডিতরা এইসব অনুমানকে পক্ষপাতগ্রস্ত ও ভিত্তিহীন বলে বাতিল করেন। প্রফেট মোহাম্মদের যে মৃগী রোগ বা মূর্ছারোগ ছিল এ সম্বন্ধে আরব দেশে কোনো দলিল নেই। কোনো সময়েই তার এই তথাকথিত রোগের লক্ষণ দেখা দেয়নি এবং তার একজন সাহাবীও কখনো বলেননি যে, প্রফেটের মানসিক অস্থিতি ছিল। আরবের বন্য গোত্র-দ্বন্দ্বকে শান্ত ও নিয়ন্ত্রিত করতে, ইসলামের পক্ষপুটে বিধৰ্মী আরবদের টেনে আনতে, কোরানে যেসব পবিত্র ও পূত বাণী আমরা দেখি তার গ্রহীতারূপে যে মহান পুরুষটি সক্ষম হয়েছিলেন, এই সব স্পষ্ট ঐতিহাসিক সত্যগুলো, মুসলিম পণ্ডিতরা বলেন, প্রমাণ করে যে প্রফেট মোহাম্মদ ছিলেন যুক্তিবাদী, পরিষ্কার মস্তিষ্ক এবং প্রকৃতিস্থ এবং তাঁর জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এই অবস্থায় ছিলেন।
৫.১৪ ভূতাবেশ
প্রাচীন লোকদের মধ্যে ভূতগ্রস্ত হওয়া বা ভূতে পাওয়া সাধারণ বিশ্বাস ছিল, এখনো আছে। তাই আরবে খ্রিস্টান বেদুইনদের মধ্যে মোহাম্মদের বাল্যাবস্থার ভূতগ্রস্ত হওয়ার কাহিনী অস্বাভাবিক ছিল না, তাই তখনকার আরববাসী সন্দেহ করত যে মোহাম্মদ বাল্যাবস্থায় ভূতগ্রস্ত হতেন। পরে তার এই রোগ সম্বন্ধে অনেক থিওরির অবতারণা হয়েছে। এটা হতে পারে যে তিনি কোনো রমণীর অশুভ দৃষ্টিতে (ইসাবাত আল-আয়েন) ক্ষতি করার জন্য জাদু করত ঈর্ষাবশত (হাসাদ) এবং দড়ি বা সুতোয় গিঁট দিয়ে তাদের দুষ্ট মানস চরিতার্থই করত। প্রফেট মোহাম্মদ আরবদের মধ্যে প্রচলিত এই নিয়ম বা পদ্ধতি সম্বন্ধে অজ্ঞাত ছিলেন না (১১৩ : ৪-৫)।
যারা বিশ্বাস করতেন যে প্রফেট মোহাম্মদ কুদৃষ্টির দ্বারা জাদুগ্রস্ত হয়েছেন তাদের সংখ্যা কম ছিল না। তাঁর স্ত্রী খাদিজা এটা পছন্দ করতেন না যে তার স্বামী এই পদ্ধতির দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হন, তাই তিনি এক বৃদ্ধাকে ডেকে এনে এর প্রতিরোধ করতেন। যখন প্রফেট মোহাম্মদ ঐশীবাণী পেতে আরম্ভ করলেন, তখন এই বৃদ্ধা মহিলাকে বিদায় করেন। প্রফেট মোহাম্মদের শত্রুরা তাঁর মধ্যে যে রহস্যজনক লক্ষণ দেখতে পায় সেটা তাদের কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়। তিনি যে দাবি করতেন গ্যাব্রিয়েলের মারফৎ আল্লাহর বাণী পেতেন এটা তার বিরুদ্ধ দলের মনে বদ্ধমূল করেছিল এই মর্মে যে কোনো অশুভ অস্তিত্ব এই সব গায়েবী আওয়াজের জন্য দায়ী প্রফেট মোহাম্মদ জাদুগ্রস্ত বা ভূতগ্রস্ত হয়ে কোনো দুষ্ট আত্মার মুখপাত্র হয়ে এসব কথাকে আল্লাহর বাণী বলে চালাচ্ছে। “অতএব উহারা তাহাকে অমান্য করিয়া বলে ‘সে শিক্ষাপ্রাপ্ত এক পাগল’ (৪৪:১৩)। কেউ শনাক্ত করল যে প্রফেটকে জ্বিনে ভর করেছে। (৫২ : ২৯), যে তাকে দিয়ে বলাচ্ছে। কেউ বলল জাদুগ্রস্ত মানুষ (২৫ : ৯)। কেউ বলল ম্যাজিসিয়ান (৩৭ : ১৫) কিংবা ভবিষ্যদ্বক্তা (Soothsayer)-৬৯ : ৪২)। জোহরা গোত্রের আসওয়াদ ইবন আব্দুল ইয়াগুত, প্রফেটের মায়ের তরফের কাজিন, অপবাদ দিল জাদুকর ও পাগল বলে- এমনকি প্রফেটকে খুন করার জন্য খুনি ভাড়া করার চেষ্টা করে (থালিবি, ১৯৬৮, পৃঃ ৯০)।
প্রফেট মোহাম্মদ বিশ্বাস করেন যে শয়তান বা দুষ্ট ব্যক্তিরা মানুষদের বিভ্রান্ত করছে। এই দুষ্ট প্রকৃতি রাতে প্রার্থনার সময় মানুষের অন্তরে প্রবেশ করে তাদের সত্য পথ থেকে বিপথে চালাবার চেষ্টা করছে। শয়তান আদমকে ধোঁকা দিয়েছিল তাই তাকে বেহেস্ত থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। (২ : ৩৪) অতীতে সে মহান প্রফেটদের বেপথু করার চেষ্টা করেছে। এক স্মরণীয় ঘটনায় প্রফেট নিজেই শয়তান দ্বারা সাময়িকভাবে ধোঁকা খেয়ে যান।
প্রফেটের শত্রুরা বলত অশুভশক্তি তাকে ভর করেছে কোনো দুষ্টবুদ্ধি কাজে লাগানোর জন্য এবং এর জন্য তারা উপহাস করেছে, বিরুদ্ধে বলেছে। এরূপ পাঁচ জন উপহাসকারী ও বিদ্রূপকারী এক দিনেই মারা গেছে। প্রফেট তার চাচা আবু লাহাবকে অভিশাপ দেন এবং কিছু দিনের মধ্যে বদরের যুদ্ধে আবু লাহাব মারা যান।
বদরের যুদ্ধে প্রফেট মন্ত্র পড়ে শত্রুদের প্রতি নিক্ষেপ করেন। প্রথমে তিনি তাঁবুতে বসে ধ্যান করতেন তারপর বের হয়ে এসে আনুষ্ঠানিক পদ্ধতিতে একমুঠো কাঁকর তুলে শত্রুদের প্রতি নিক্ষেপ করে বলতেন তাঁদের ভূতে পাক-নিপাত যাক। হুনায়েনের যুদ্ধেও তিনি এই একই পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন এবং একমুঠো ধুলো নিক্ষেপ করে বলেছেন- তোদের ধ্বংস হোক।
অন্য একটা ঘটনায় বলা হয়েছে যে, যখন একটি খ্রিস্টান ডেলিগেশন নাজরান থেকে প্রফেট মোহাম্মদের সাক্ষাতে এলেন, তারা উভয় ধর্মের তত্ত্ব সম্বন্ধে আলোচনায় অংশ নেন। এক পর্যায়ে প্রফেট বলেন যে বিষয়টি সাব্যস্ত হোক একে অন্যকে অভিশাপ প্রদানের মাধ্যমে (৩ : ৫৪)। এতে খ্রিস্টান ডেলিগেশন সম্মত হয়নি।
মুসলিম বর্ণনাকারীদের মতে, প্রফেট মোহাম্মদ ঘটনাকে প্রভাবিত করতেন তার কথার দ্বারা এবং এই ক্ষমতা কোনো অশুভ শক্তি থেকে তিনি পেতেন না, পেতেন আল্লাহর কাছ থেকে যিনি তাঁকে সারা জীবন ধরে পরিচালিত করেছেন। এই আল্লাহর শক্তি ও সাহায্যে তিনি তাঁর শত্রুদের ও প্রতিবাদী শক্তিকে ধ্বংস করেছেন।
৫.১৫ জায়েদ ইবন হারিথ
খাদিজার পর ইসলামে দীক্ষিত দ্বিতীয় ব্যক্তি হলেন জায়েদ ইবন হারিথ (৫৮০-৬২৯)। তিনি খ্রিস্টান কাল্ব গোত্রে দক্ষিণ সিরিয়াতে জন্মগ্রহণ করেন। দস্যুদের দ্বারা অপহারিত হয়ে তিনি বিক্রীত হন খাদিজার ভাইপোদের কাছে এবং সেখানেই পালিত হন। খ্রিস্ট ধর্মে বিশ্বাস রেখেই তিনি খাদিজার অধীনেই ছিলেন।
খাদিজা যখন প্রফেট মোহাম্মদকে বিবাহ করেন তখন তিনি বালক জায়েদকে উপহার দেন স্বামীকে। তখন জায়েদের বয়স পনের বছরের মতো। জায়েদ দাস হিসাবেই কাজ করতেন। যখন তাঁকে মুক্তি দিয়ে তাঁর গোত্রের কাছে ফিরে যেতে বলা হলো, জায়েদ ঐ বাড়িতেই থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তার আন্তরিকতায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করে জায়েদকে নিয়ে কাবাঘরে যান প্রফেট মোহাম্মদ এবং সকলের সম্মুখে দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে ঘোষণা দেন যে তিনি জায়েদকে নিজ পুত্র হিসাবে দত্তক নিলেন। যুবক জায়েদ তখন থেকেই জায়েদ ইবন মোহাম্মদ বলে পরিচিত হন।
জায়েদই কেবলমাত্র প্রফেট মোহাম্মদের সাহাবীদের মধ্যে কোরানে উল্লেখিত হয়েছেন (৩৩ : ৩৭)। প্রফেট মোহাম্মদ প্রথমে জায়েদের বিবাহ দেন তার প্রথম খ্রিস্টান নার্স উম্মে আয়মানের সাথে। তিনি বারাকা নামেও পরিচিত। জায়েদের চেয়ে বারাকা ১৫ বছরের বড় ছিলেন এবং তিনি জায়েদকে এক পুত্র সন্তান উপহার দেন। তার নাম ওসামা। পরে জায়েদ বিবাহ করেন প্রফেটের কাজিন, সুন্দরী জয়নাবকে, তাকে পরে তালাক দেয়া হয়। প্রফেট মোহাম্মদ তখন নিজেই জয়নাবকে বিবাহ করেন।
যখন প্রফেট মোহাম্মদের কাছে কোরানের বাণী অবতরণ করতে শুরু করে তখন জায়েদের বয়স প্রায় তিরিশ। জায়েদ সুশিক্ষিত ছিলেন এবং আরবি ভাষার ওপর ভালো দখল ছিল। তিনি প্রফেটের প্রাথমিক ওহি ধারকের মধ্যে একজন ছিলেন। প্রফেটের ধর্মীয় প্রচার ও প্রসারের ওপর জায়েদের প্রভাব ছিল যথেষ্ট। প্রফেট মোহাম্মদ যখন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত তখন জায়েদ প্রফেটের বিশ্বাসী ব্যক্তিরূপে সকলের কাছে সম্মানীয় ছিলেন। বলা হয়েছে যে, ৬২৯ সালে মুতার যুদ্ধে তার অকাল মৃত্যু না হলে হয়তো তিনিই প্রফেট মোহাম্মদের উত্তরাধিকারী হতেন (Watt, 1961, P. 157)।
৫.১৬ প্রথমে যারা ইসলাম গ্রহণ করেন
প্রথমে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, তার মধ্যে আবুবকর ছিলেন বেশ প্রভাবশালী ব্যক্তি। তিনি ধনাঢ্য বণিক, প্রফেটের চেয়ে দু’বছরের ছোট। পরে ইনি প্রফেটের শ্বশুর হন এবং প্রথম খলিফা বা প্রফেটের উত্তরাধিকারী। আবু বকর, ওসমান ইবন আফ্ফানকে প্রভাবিত করেন ইসলাম গ্রহণে। ওসমান শক্তিশালী কোরেশী উমাইয়া গোত্রভুক্ত। পরে তিনি ইসলামী রাজ্যের তৃতীয় খলিফা হন।
অন্যান্যদের মধ্যে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তারা হলেন খাদিজার ভাইপো এবং নামকরা যোদ্ধা জুবাইর ইবন আওয়ান (জুবাইরের পুত্র অরওরা ইসলামী প্রাথমিক ট্র্যাডিশনের একজন অথরিটি ছিলেন।) খাদিজার আর একজন আত্মীয় আবদুল্লাহ ইবন উম্মে মাখতুম ইসলাম গ্রহণ করেন কিন্তু প্রফেট তাকে প্রথমে ফিরিয়ে দেন কারণ তিনি অন্ধ ছিলেন, কিন্তু পরে তাকে গ্রহণ করা হয় (৪০ : ১। তিনি দু’দুইবার মক্কার গভর্নর পদে অধিষ্ঠিত হন। প্রফেটের চাচা হামজা প্রথমে ইসলামবিরুদ্ধ ছিলেন, কিন্তু মক্কার একটি বিরুদ্ধ দলের হাত থেকে প্রফেটকে রক্ষা করতে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। প্রাথমিক বিশ্বাসীদের মধ্যে আবু তালিবের পুত্র আলীও ছিলেন। আলী ছিলেন প্রফেট মোহাম্মদের চাচার পুত্র, তের বছর বয়সের আলীকে প্রফেট নিজ সংসারের অন্তর্ভুক্ত করেন। পরে আলী ফাতিমাকে বিবাহ করে প্রফেটের জামাতা হন, তারপর হন চতুর্থ খলিফা। তিনি শিয়াদের প্রথম ইমামও।
প্রথম দিকে নতুন ধর্ম ইসলামকে অতি সতর্কতার সাথে পালন করতে হতো, কারণ শক্তিশালী কোরেশীদের প্রতিবাদ ও অত্যাচারের ভয় ছিল। গোল্ডজিহার লিখেছেন যে, প্রথমে মুসলিমদের প্যাগন মক্কানদের অগোচরেই প্রার্থনা ও অন্যান্য রিচুয়েল পালন করতে হতো (1967, P. 42) এবং এমনকি ইসলাম ধর্ম পালন যখন খোলাখুলিভাবে চালু হলো তখনও প্রার্থনার সময় সেজদা করাকে মক্কানরা উপহাস ও বিদ্রূপ করত।
ট্র্যাডিশন মতে, আবু তালিব তার যুবক পুত্র আলী ও প্রফেট মোহাম্মদের মক্কার নিকটস্থ এক স্থানে প্রার্থনা করার কথা জানতেন না, তাই তাদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন এটা তোমরা কি করছো। প্রফেট মোহাম্মদ জবাবে বলেন যে, ঐশী নির্দেশ মতে তিনি ইসলামের অনুসরণ করছেন এবং আবু তালিবকেও তাদের দলে যোগ দিতে বলেন। আয়েশার বর্ণনা অনুযায়ী, বৃদ্ধব্যক্তি (আবু তালিব) জবাব দিয়েছিলেন যে তিনি তার বাপ-দাদাদের ধর্ম-বিশ্বাস ত্যাগ করতে পারেন না এবং এমন একটা প্রার্থনায় যোগ দিতে পারেন না- ‘যেখানে মাথার উপর পশ্চাৎদেশ উঠে যায়’ (Glubb, 1979, P. 98)। পরে তায়েফের শহরবাসীরা ইসলামে যোগ দিতে রাজি হয় এই শর্তে যে তারা ‘সেজদা’ বাদ দিতে চায় প্রার্থনা থেকে। তাদের এ প্রস্তাব অবশ্য গৃহীত হয়নি।
যখন মক্কার লৌহমানব ও বদমেজাজী এককালীন ইসলামবিরোধী ওমর ইবন আল-খাত্তাব ইসলাম গ্রহণ করেন তখন মুসলিমদের সাহস ও আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। তার নিজের বোন ফাতিমা ও তাঁর স্বামী সাঈদ (হানিফ জায়েদের পুত্র) প্রফেট মোহাম্মদ-এর অনুসারী হয়েছে, তখন ওমর তাদের বাসায় গিয়ে দেখেন যে তাদের দাস খাবাব জোরে জোরে কোরানের পাণ্ডুলিপির এক অংশ পাঠ করছে। রেগেমেগে প্রথমেই তিনি বোনকে আঘাত করেন ফলে তার রক্তপাত হয়। নিজেকে সামলে নিয়ে যখন তিনি একটু শান্ত হন তখন খাবাব তাকে সে আয়াত (সূরা ২০ থেকে) পাঠ করতে এবং নতুন ধর্ম সম্বন্ধে শুনতে অনুরোধ করে। এর পর ওমর নিজেই মুসলিম হন। পরে ওমর দ্বিতীয় খলিফা হয়েছিলেন।
প্রফেট মোহাম্মদ তার প্রাথমিক শিষ্যদের নিয়ে নিজের বাসাতে আলোচনা করতেন না, আলোচনা করতেন কোরেশ গোত্রে মাখজুম আল-আকরামের বাসায়, সেটা মক্কার বাইরে একটা নির্জন স্থানে অবস্থিত ছিল। বিভিন্ন অথরিটি প্রাথমিক মুসলিমদের লিস্টি দিয়েছেন বিভিন্নভাবে এবং তাদের পর্যায়ক্রম। আবুবকর বা আলী মনে করেন না যে খাদিজা ও জায়েদ ইবন হারিথ বিশ্বাসীদের মধ্যে প্রথম।
সম্ভবত খাদিজ মহিলা বলে তার নাম উল্লেখিত হয়নি; আর জায়েদকে বাদ দিতে পারা যায়নি ক্রীতদাস বলে, কারণ অন্য ক্রীতদাসদের নামের উল্লেখ আছে। সম্ভবত উভয়কে বাদ দেয়া হয়েছে খ্রিস্টান বলে, কেননা খ্রিস্টান বলে তারা সত্যিকারের ইসলাম গ্রহণকারী হতে পারেন না।
ক্রীতদাসদের মধ্যে প্রথম দিকে মুসলিম ছিল খাবাব, জোহরা গোত্রে কাজ করত কামার হিসাবে। তার মা ছিল পেশাদার খাতনাকারী। অন্য জন ছিল আম্মার ইবন ইয়াসির, যে আল-আকরামের বাসায় যাতায়াত করত। তার মায়ের দ্বিতীয় স্বামীর মধ্য দিয়ে তাঁর খ্রিস্টানদের সাথে যোগাযোগ ছিল। তাঁর মায়ের দ্বিতীয় স্বামী মূলত গ্রিক মুক্ত দাস এবং সম্ভবত খ্রিস্টান।
আবুবকর একবার এক ক্রীতদাসকে মুক্তিপণ দিয়ে খালাস করেন। তার নাম বিলাল। বিলাল তার মক্কান মালিক কর্তৃক নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতিত হতো। বিলাল এক আবিসিনিয়ান ক্রীতদাসীর পুত্র এই কারণে খ্রিস্টানিটি সম্বন্ধে জ্ঞান ছিল। সে আবুবকরের পরিবারে যোগ দিয়ে পরে অন্যান্য মুসলিমদের সাথে মদিনায় চলে যায়। তার দরাজ কণ্ঠস্বরের কারণে সে প্রথম মোয়াজ্জিন হয়েছিল এবং মসজিদের কাছে একটি উঁচু ছাদের উপর থেকে আজান দিয়ে মুসল্লিদের জামাতে ডাক দিত।
৬৩০ সালে তাবুকে যখন প্রফেট মোহাম্মদ আইলার খ্রিস্টান প্রিন্স জনকে সংবর্ধনা জানান, তখন তিনি বিলালকে আতিথেয়েতার ভার দেন, কারণ বিলাল খ্রিস্টানদের রীতিনীতির সাথে পরিচিত ছিল। প্রফেট মোহাম্মদ বিলালকে এক খণ্ড জমি দান করেন, কিন্তু প্রফেটের মৃত্যুর পর দ্বিতীয় খলিফা ওমর বিলালের দাসত্বের কথা ভুলেননি, তাই সে জমি বাজেয়াপ্ত করেন। কিন্তু কারণ দেখানো হয় বিলাল সে- জমি আবাদ করতে ব্যর্থ হয়েছে। ওমরের অনুমতি নিয়ে, বিলাল মদিনা ত্যাগ করে খ্রিস্টান সিরিয়ায় চলে যান। ৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে সিরিয়া অধিকার করে ওমর যখন সিরিয়ায় আসেন তখন তার বিলালের আজান শোনার ইচ্ছা হয়। বেলাল শেষ বারেরমতো আজান দেন। অন্য এক বর্ণনায় বেলাল দামেস্ক মারা যান এবং তার সমাধি বলে কথিত একটি স্থানকে এখনও প্রদর্শন করা হয়। অন্য আর একটি বর্ণনা অনুযায়ী বেলাল দামেস্ক থেকে আনাতোলিয়ায় খ্রিস্টান তারসাসে গমন করেন এবং সেখানে মৃত্যু হয়। তাঁর সমাধি তারসাসে বা আলোপ্পোতে যে কোনো এক স্থানে হতে পারে। উল্লেখযোগ্য যে, নতুন কনভার্ট মুসলিমদের মধ্যে প্রায় চল্লিশজন ছিল নিম্নসামাজিক স্তরের- আবিসিনিয়া অথবা বাইজানটাইন অরিজিন। প্রফেটের অতি ঘনিষ্ঠ সাহাবীদের মধ্যে- যারা মক্কাতে ছিলেন- খ্রিস্টান ছিলেন অথবা খ্রিস্টান শিক্ষা- সংস্কৃতি সংযুক্ত আর কিছু কনভার্ট হয়েছিল আল আকরামের বাসাতে।
প্রফেট মোহাম্মদ ‘ওহি’ পেয়ে প্রথমেই যাদের দ্বারা লিখাতেন তাদের মধ্যেও বেশ খ্রিস্টান ছিল। মক্কায় প্রথম দিকে প্রফেট ঘনিষ্ঠভাবে খ্রিস্টানদের সাথে যোগাযোগ রাখতেন— গ্রিক (বাইজানটাইন)ও ছিল। ঐ সময়ে বাইজানটাইনরা সিরিয়া ও মিশর নিয়ন্ত্রণ করত এবং আবিসিনিয়ার বন্ধু দেশ ছিল। যখন ৬১৫ খ্রিস্টাব্দে পারস্যরাজ দ্বিতীয় খসরু পারভেজ হেরাক্সিয়াসের অধীন সেনাদের পরাস্ত করেন, তখন প্রফেটের বিরুদ্ধ মক্কাবাসীরা আনন্দ-উৎসব করেছিল, কারণ পারস্যরা তাদের মতোই অগ্নি- পূজারী রূপে মূর্তি পূজক ছিল। এদের সাথে ইসলামের মিল ছিল না (Rodwell, 1915. P. 210) I
কিন্তু প্রফেটের সহানুভূতি ছিল বাইজানটাইনদের ওপর এবং তিনি একটি ‘ওহি’ পান। যেমন গ্রিকরা অতি নিকট ভূমিতে পরাজিত হয়েছে। কিন্তু এই পরাজয়ের পর তারা তাদের শত্রুদের পরাজিত করবে (৩০ : ১-২)। দশ বছর পর ৬২৫ খ্রিস্টাব্দে মুসলিমদের ক্যাম্পে আন্দোৎসব হয় যখন বাইজানটাইনরা পারসিকদের বিধ্বস্ত করে পরাজিত করে এবং প্রফেট মোহাম্মদের ভবিষ্যদ্বাণী ফলে যায়। বলা হয় যে, যখন বাইজানটাইনের বিজয়ের সংবাদ সকলে জানতে পারে, তখন অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করে।
৫.১৭ মক্কাবাসীদের প্রতিবাদ
৬১৫ খ্রিঃ হামজা ও ওমরের মতো শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের ইসলাম গ্রহণ করার পর প্রফেট মোহাম্মদ খোলাখুলিভাবে জনসম্মুখেই প্রচার আরম্ভ করে দিলেন।
প্যাগন আরবদের ধর্ম বিশ্বাসের কিছু মুখ্য আদর্শকে আক্রমণ করার কারণে মক্কার কোরেশগণ প্রফেট মোহাম্মদকে বিভেদ সৃষ্টিকারী বলে অপবাদ দিয়ে অভিযোগ আনল যে তিনি একটি নতুন ধর্ম (মুহদাত) প্রচার করছেন (২১:১), যে ধর্ম আরবদের বিশ্বাস ও পূর্বপুরুষদের ধর্মের বিপরীত। (অন্যান্য বিষয়ের সাথে আরবরা তখনো পর্যন্ত স্বর্গ, নরক অথবা শেষ বিচারের দিন সম্বন্ধে কিছুই জানত না)। মক্কার প্যাগনরা ভয় পেল এই ভেবে যে একেশ্বরবাদ যার ওপর প্রফেট মোহাম্মদ জোর গুরুত্ব আরোপ করেছেন, তাতে আরবদের প্রধান ধর্মীয় কেন্দ্র হিসাবে মক্কা গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে এবং এর ফলে মক্কার বাণিজ্যের মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ৬১৭ খ্রিস্টাব্দে মক্কাবাসীরা তাই মুসলিমদের সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে বয়কট করার সিদ্ধান্ত গ্ৰহণ করল।
কোরেশদের এই প্রতিরোধের সময়ও প্রফেট মোহাম্মদ চাচা আবু তালেবের সমর্থন ও প্রটেকশন পেতে থাকলেন। এই সময় একটি মক্কান ডেলিগেশন আবু তালিবের বাড়িতে প্রফেট মোহাম্মদের সাথে দেখা করে তাকে বোঝাবার চেষ্টা করে। এই ডেলিগেশনের নেতা ছিলেন কোরেশের মখজুম গোত্রের আমর ইবন হিশাম তার উপনাম ছিল আবু হুক্ষ অর্থাৎ বিচারের পিতা। ইসলামের ইতিহাসে তিনি আবু জাহেল অর্থাৎ ‘নির্বুদ্ধির পিতা’ বলে খ্যাত, কারণ তিনি প্রফেট মোহাম্মদের তিক্ত প্রতিবাদী ছিলেন।
আবু জাহেল প্রফেট মোহাম্মদকে জিজ্ঞাসা করেন মক্কাবাসীরা কি করলে তিনি তার এই প্রচার কাজ বন্ধ করতে পারেন এবং জবাবে তিনি বলেন ‘শুধু বলুন আল্লাহ ছাড়া দ্বিতীয় ঈশ্বর নেই’। এই সময় প্রফেট মোহাম্মদ আল্লাহর নবী বলে দাবি করেননি, কিন্তু অন্য বর্ণনা মতে, বলা হয়েছে যে, এর সাথে তিনি যোগ করেছিলেন- ‘এবং মোহাম্মদ আল্লাহর বার্তাবাহক’ আবু জাহেল এ শর্ত অস্বীকার করে ডেলিগেশনসহ চলে আসেন।
আবু জাহেল প্রফেট মোহাম্মদকে প্রতারক ভাবতেন এবং তার বাণীকে পাগলের প্রলাপ বলতেন। দশ বছর পর যখন তিনি বদরের যুদ্ধে মারা যান, তখন প্রফেট মোহাম্মদ উল্লাস প্রকাশ করেছেন তার ছিন্ন মস্তক দেখে (exulted over his severed head)। আবু জাহেল সম্বন্ধে কোরানে উল্লেখ আছে- সে বিতণ্ডা করেছে লোকদিগকে আল্লাহর পথ থেকে ভ্রষ্ট করার জন্য। ইহলোকে ও কিয়ামত দিবসে সে তার ফল লাভ করবে এবং তার স্থান হবে নরকে (২২ : ৮ – ৯)।
মক্কাবাসীরা তখন আবু তালিবকে অনুরোধ করলেন তার ভাইপোর ওপর প্রভাব খাটিয়ে এই গোত্র-বিরোধ এবং মক্কার ধর্মীয় ঐতিহ্যকে ক্ষুণ্ন করার পন্থা থেকে বিরত থাকতে। বৃদ্ধ ও দুর্বল আবু তালিব তখন প্রফেট মোহাম্মদকে বোঝালেন এবং তাকে কোরেশ গোত্রে ও পরিবারে অশান্তি সৃষ্টি করা থেকে ও নতুন ধর্ম প্রচার থেকে সরে থাকতে আবেদন জানালেন। একটি নির্ভরযোগ্য ট্রাডিশন মতে, প্রফেট মোহাম্মদ জবাবে বলেছিলেন- আমার ডান হাতে সূর্য এবং বাম হাতে চন্দ্র এনে দিলেও আমি আমার সত্য পথ থেকে সরে আসব না, আর আমার প্রচেষ্টাও বন্ধ হবে না।
যদিও প্রাথমিক মুসলমানদের ওপর কোরেশদের নির্মম অত্যাচারের কথা সম্বন্ধে অনেক দলিল পাওয়া যায়, কিন্তু আসলে অত্যাচারের মাত্রা মৃদু ছিল (mild in character) (Watt, 1953 p. 123) এবং এর মাত্রাকে অতিরঞ্জিত করা হয়েছে। যে বয়কট করা হয়েছিল তা কড়াভাবে পালিত হয়নি। দরিদ্র ও অরক্ষিত প্রাথমিক মুসলিমদের সময় সময় তাদের বিশ্বাসের জন্য হয়রানি করা হয়েছে, কিন্তু তা ছিল বিদ্রূপ ও উপহাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ, আর ছোটখাটো শারীরিক নির্যাতন, যেমন খোঁচা দেওয়া বা চড়-থাপড় মারা। কোরানে কোনো বড় ধরনের নির্যাতন বা অত্যাচারের কথা ক্বচিৎ উল্লেখ আছে।
৬১৯ খ্রিস্টাব্দে আবু তালিব কোরেশদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বয়কট প্রত্যাহার করাতে সমর্থ হন এবং অবস্থা আগের মতোই ফিরে আসে।
৫.১৮ আবু সুফিয়ান
ঐ সময়ে উমাইয়া গোত্রের নেতা ছিলেন ধনী, সম্পদশালী ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি আবু সুফিয়ান। তিনি কোরেশী এবং উমাইয়ার পৌত্র এবং প্রফেট মোহাম্মদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। আবু সুফিয়ান যোগ্য নেতা ছিলেন এবং মক্কা সিনেটের (মালা) অধ্যক্ষ। তাছাড়া কাবাঘরের চাবি ছিল তাঁর হাতে এবং কাবার পতাকারও রক্ষক ছিলেন। এই কারণে বলতে গেলে, কোরেশী রাষ্ট্র বাহিনীর প্রধান সেনাপতি ছিলেন তিনি।
মক্কার প্রধান মার্চেন্টের একজন হিসাবে আবু সুফিয়ানের শক্তি ও প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল। ৬০৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি একটি বণিক প্রতিনিধির নেতৃত্বে পারস্যের রাজধানী যান এবং সাসানিয়ান সম্রাট দ্বিতীয় খসরু পারভেজের সমীপে নীত হন। হিরার দরবারে ও তিনি কিছু সময় অতিবাহিত করেন এবং থালাবির মতে, তিনি হিরার খ্রিস্টান দরবার থেকে নমনীয় ধর্মীয় মতবাদ গ্রহণ করেন (heterodoxy doctrine) (1968, p. 92)।
বালাধুরির বর্ণনা মতে, প্রফেট মোহাম্মদ অর্থ লগ্নী করেন কিছু পণ্যদ্রব্যে যা আবু সুফিয়ান ক্যারাভান নিয়ে সিরিয়ায় বাণিজ্যে যান এবং এই বাণিজ্য থেকে প্রফেট কিছু লভ্যাংশ পেয়েছিলেন।
পরবর্তীতে কিছু ক্ষমতা সংগ্রহের পর, প্রফেট মোহাম্মদ আবু সুফিয়ানের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। এর পর থেকে আবু সুফিয়ান প্রফেটের বিরুদ্ধে মক্কাবাসীদের নিয়ে অভিযান শুরু করেন এবং ইসলামের ঘোর শত্রুরূপে পরিচিত হন (the arch enemy of Isam)। বদরের যুদ্ধে (৬২৪) আবু সুফিয়ানের জ্যেষ্ঠ পুত্র ও উত্তরাধিকারী হানজালা মুসলিম বাহিনী কর্তৃক নিহত হয়। ঐ যুদ্ধে আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দার বাবাও মারা যায়। ওত্ত্বা ইবন রাবিয়া তার ভাই ও চাচা, প্রত্যেকে আবু সুফিয়ানের সাথে যোগ দিয়ে প্রফেটের বিরুদ্ধে নেমে পড়ে। হিন্দা কখনও তার ঘৃণা ও বিদ্বেষ (প্রফেটের প্রতি) চেপে রাখতে পারেনি।
আবু সুফিয়ানকে বাগে আনতে না পেরে প্রফেট ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে হত্যা করার জন্য এক এজেন্ট প্রেরণ করেন, কিন্তু সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। নিজের জ্ঞাতিবর্গের সাথে প্রফেটের ব্যক্তিগত শত্রুতা অন্তহীনভাবে চলেছিল যা কোরানে ব্যক্ত হয়েছে এবং সেখানে তাঁকে (আবু সুফিয়ান) বলা হয়েছে ‘ঐ শয়তানটা’ (৩ : ১৬৯)।
আবু সুফিয়ানের ভগ্নী উম্মে জামিল, প্রফেটের অন্য এক বিরোধী ব্যক্তি আবু লাহাবের স্ত্রী ছিলেন। আবু সুফিয়ানের জামাতা উবাইদুল্লাহ আবিসিনিয়ায় গিয়ে খ্রিস্টান হয়ে যায়। অন্য এক জামাতা উরওয়া, ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে মক্কায় ফিরে আলোচনার চেষ্টা করেন, তখন প্রফেটের সাথে ভালো ব্যবহার করেনি।
এমনকি ৬৩০ সালে ইসলাম গ্রহণের পরে আবু সুফিয়ান চাপের মুখে ও অনিচ্ছা সত্ত্বে প্রফেট ও ইসলামের প্রতি তার প্রতিবাদী মনোভাব বজায় রেখেছিলেন। যদিও হুনায়নের যুদ্ধে (৬৩০), তিনি মুসলিমদের পক্ষে ছিলেন, তিনি মুসলিমদের প্রাথমিক পরাজয়ে খুশি হন এবং তাঁর এক মক্কার সহযোগীর কাছে চুপে চুপে বলেন- ‘এ যুদ্ধ থামবে না।’ ইয়ারমুকের যুদ্ধেও (৬৩০), তিনি মুসলিম পক্ষে বাইজানটাইনদের বিরুদ্ধে থাকলেও তিনি যুদ্ধে শত্রু পক্ষের প্রতিটি সুবিধাজনক অবস্থায় আনন্দ প্রকাশ করেন।
যদিও তার কাজিন, ওসমান তৃতীয় খলিফা হন, তবুও তিনি তাঁর মতে, প্রফেটের গোত্র হাশিমের বিরুদ্ধাচরণ করেছেন। আবু সুফিয়ানের পুত্র মাবিয়া উমাইয়া বংশের প্রথম খলিফা হয়েছিলেন এবং তিনি ও তার উত্তরাধিকারীরা প্রফেটের হাশেমী দলের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধাচরণ করে গেছেন।
৫.১৯ আবু লাহাব
৬১৯ খ্রিস্টাব্দে ৪৯ বছর বয়সে প্রফেট মোহাম্মদ তার বিশ্বস্ত স্ত্রী খোদেজাকে হারান। অর্থাৎ খোদেজার মৃত্যু হয় ৬১৯ সালে। এর কয়েক সপ্তাহ পরে মারা যান তার চাচা আবু তালিব। মৃত্যুশয্যায় প্রফেট মোহাম্মদ তাঁর কাছে যান এবং ইসলাম গ্রহণ করতে অনুরোধ করেন, কিন্তু বৃদ্ধ ব্যক্তি তার নিজ ধর্মে অটল থেকে বলেন যে তিনি তার বাপ-দাদার ধর্ম পরিত্যাগ করতে পারেন না। তিনি আরও বলেন যে, প্রফেট মোহাম্মদের ‘ভিশন’ ভ্রান্তিপূর্ণ (delusion) এবং এই ধর্ম গোত্র দ্বন্দ্বের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। প্রফেট মোহাম্মদের প্রধান দুইজন রক্ষাকারীর মৃত্যুর সাথে তার শত্রুদের তরফ থেকে তার ব্যক্তিগত জীবনের ঝুঁকি ও বিপদ বেড়ে যায়।
আবু তালিবের মৃত্যুর পর হাশিম বংশের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন তার ছোট ভাই আবদুল উজ্জা-আবু লাহাব বলে বেশি পরিচিত। তিনি যদিও প্রফেট মোহাম্মদের ভিশনের দাবিকে অস্বীকার করতেন, তবুও তিনি প্রফেটকে সমর্থন ও রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দেন। কিছু পরে এক গুজব সম্বন্ধে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে প্রফেটকে জিজ্ঞাসা করেন যে, তাঁকে সব সময় সাহায্য করা ও রক্ষা করার পরও কি তাঁর দাদা আবদুল মোত্তালেব ও চাচা আবু তালেব, তাঁর নতুন ধর্ম বিশ্বাসে, তারা নরক বাস করছেন, কারণ তারা ইসলাম ধর্মের অনুসারী ছিলেন না? প্রফেট মোহাম্মদ স্বীকার করে জবাবে বলেন- সত্যই তারা নরকবাসী হয়েছেন। শুধু তাই নয়, মক্কাবাসীদের সব পূর্বপুরুষেরা নরক যন্ত্রণা ভোগ করছেন কারণ তারা বিধর্মী ও মূর্তিপূজারী ছিলেন।
প্রফেটের অকৃতজ্ঞতা ও পরিবারের প্রতি বিরূপ ভাব লক্ষ্য করে আবু লাহেব রাগে অগ্নিশর্মা হলেন এবং নতুন ধর্মের বর্বর শিক্ষা সম্বন্ধে মুহ্যমান হন। যে ধর্মের প্রবর্তক কে যে মহান দুই পুরুষ— আবদুল মোত্তালেব ও আবু তালিব – স্নেহ ও প্রাণ দিয়ে পালন ও রক্ষা করলেন সেই প্রবর্তকের ধর্ম-শিক্ষা তাদের ঠাঁই দিল নরকে? আবদুল উজ্জা প্রফেটের মিশনকে প্রকাশ্যভাবে নিন্দা করে তার ওপর থেকে সমর্থন ও তাঁকে রক্ষার শপথ প্রত্যাহার করেন। স্থান পরিত্যাগ করার পূর্বে বললেন- তুই উচ্ছন্নে যা, আজ থেকে আমি তোর ঘোর শত্রু হলাম। প্রফেট মোহাম্মদও বলে বসলেন, তুমি ধ্বংস হও এবং অনির্বাণ অগ্নিশিখায় জ্বলতে থাকো। এই ঘটনার পর থেকে আবদুল উজ্জার নাম হয়ে গেল আবু লাহাব, অগ্নিশিখার পিতা। প্রফেট মোহাম্মদ তখনই ‘ওহি’ পেলেন আবু লাহাব ও তার স্ত্রী উম্মে জামিলের (আবু সুফিয়ানের ভগিনী) জন্য যে, তাদের নরকবাস হবে (১১১ : ৩)। আবু ৬২৪ খ্রিস্টাব্দে, এক সপ্তাহ পরে, বদরের যুদ্ধে প্রাণ হারান। অনেকে দিন ধরে তার দেহ সমাহিত হয়নি।
প্রফেট মোহাম্মদের দুই কন্যা রোকেয়া ও উম্মে কুলসুমের বিবাহ হয়েছিল ওত্বা ও ওতাইবার সাথে। এরা উভয়েই আবু লাহাবের পুত্র। ওতবা পরে রোকেয়াকে তালাক দিয়ে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করে (J. Barth, in SEI, 1974, p. 11)। প্রফেট রোকেয়াকে ওসমান ইবন আফফানের সাথে বিবাহ দেন; যখন ৬২৪ সালে ওতাইবা উম্মে কুলসুমকে তালাক দিলে তার বিবাহও ওসমানের সাথে হয়।
৫.২০ আবিসিনিয়ায় নির্বাসন
প্রফেট মোহাম্মদের সময় আবিসিনিয়া ও হেজাজের সাথে গাঢ় বাণিজ্যিক সম্পর্কে ছিল। আবিসিনিয়ার মার্চেন্টগণ ও কারিগরগণ মক্কাতে জমিয়ে ব্যবসা করত এবং বসবাসও করত। ধনী মক্কার বণিকরা বেকার আবিসিনিয়ানদের ভাড়া খাটাত তাদের সৈন্যদলে, বাসায় ও ওয়ার হাউসে নিরাপত্তা প্রহরী হিসাবে।
প্রফেট মোহাম্মদ তাঁর ব্যবসায়ী অভিজ্ঞতা থেকে উপলব্ধি করেছিলেন যে আবিসিনিয়া কোরেশদের জন্য বেশ লাভবান বাজার, তিনি এও জানতেন যে মক্কার সাথে বাণিজ্য প্রতিযোগিতায় আবিসিনিয়া গুরুত্বপূর্ণ স্থান। যেহেতু ইসলাম ও খ্রিস্টানিটির মধ্যে ধর্মনীতি প্রায় একই, তাই সেদেশের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করতে বিশেষ অসুবিধা হবে না। এই ধর্মীয় যোগসূত্র বন্ধুত্বের বন্ধনকে ত্বরান্বিত করবে, কারণ নেগাস মূর্তিপূজারী কোরেশদের চেয়ে একেশ্বরবাদী ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের অগ্রাধিকার দিবে।
এই সময়ে যখন মুসলমানদের বিরুদ্ধে কোরেশদের শত্রুতা তুঙ্গে উঠেছে, সেই সময়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে, যদিও ঘটনাগুলোর সত্যতা সম্বন্ধে বর্ণিত ইতিহাস ও কাহিনীর অনেক স্থলে গোঁজামিল আছে।
সামাজিক বয়কটের সময়, কিছুসংখ্যক মুসলিম, বিশেষ করে যারা দরিদ্র ও গোত্র সমর্থনহীন ছিল, ভুল স্বীকার করে ইসলাম পরিত্যাগ করে। এই ভাবে দলত্যাগী মুসলিমদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবার পূর্বে প্রফেট মোহাম্মদ সিদ্ধান্ত নেন তাঁর অনুসারীদের মধ্য থেকে কিছু সংখ্যক মুসলিমকে আবিসিনিয়ায় পাঠাবেন। তাই তিনি তাদের বোঝান যে, আবিসিনিয়া খ্রিস্টান রাজা দয়ালু, ন্যায়বিচারক এবং সেখানকার মানুষও বন্ধুভাবাপন্ন, সুতরাং সেখানে মুসলিমদের কোনো অসুবিধা হবে না। পরে মক্কার অবস্থা স্বাভাবিক হলে তারা ফিরে আসতে পারে।
এই অধিবাসীদের (ইমিগ্রান্ট) মধ্যে শুধু দরিদ্র ও নিরাপত্তাহীন মুসলিম ছিল না, কিছু প্রভাবশালী মক্কান পরিবারের সদস্যও ছিল। এই দলের মধ্যে কিছু সংখ্যক স্বাধীনচেতা মানুষ ও সাহাবী ছিলেন, যাঁরা বিদ্যমান পরিস্থিতিতে গোলযোগ সৃষ্টি করতে পারেন। এই কারণে প্রফেট সেই সব প্রভাবশালী ব্যক্তিদেরও আবিসিনিয়ায় পাঠিয়ে দিয়ে নিজে মক্কায় থেকে তাঁর কর্তৃত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করবেন। এই সব প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কেমন করে আবিসিনিয়ায় যেতে রাজি করানো হয়েছিল সে ঘটনা পরিষ্কার নয়। তবে প্রফেট মোহাম্মদ তাদের বুঝিয়েছিলেন এই বলে যে, দলে কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির প্রয়োজন নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য এবং মক্কার সংকট না শেষ হওয়া পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করার জন্য এবং কোনো সমস্যা হলে তার সমাধানের উপায় বের করার জন্য।
এই ব্যবস্থা অনুযায়ী ৬১৫ খ্রিস্টাব্দে এবং পরের কয়েক মাস ধরে ছোট ছোট দলে মুসলিমরা আবিসিনিয়ায় মক্কার প্রাচীন বন্দর শোরাইবাতে যাত্রা করে সেখান থেকে আলাদাভাবে আবিসিনিয়ার ছোট জাহাজ করে সে দেশে গমন করার জন্য। শোয়াইবা বন্দর জেদ্দা থেকে বেশি দূরে ছিল না।
প্রাথমিক মুসলিম লেখকগণ— ইবন ইসহাক ও ইবন হিশামসহ এই যাত্রাকে ইসলামের প্রথম হেজিরা (এমিগ্রেশন) বলে উল্লেখ করেছেন, এর সাত বছর পর ৬২২ সালে মক্কা থেকে মদিনাতে মহান হিজরত হয়েছিল যখন প্রফেট নিজেই সেখানে শামিল ছিলেন।
এ প্রথম হেজিরাতে সর্বমোট ৮৩ পুরুষ ছিল, এদের অনেকের সাথে তাদের স্ত্রী- পুত্রগণ শামিল ছিল, এতে সর্বমোট সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫০। আবিসিনিয়াতে তাদের স্বাগতম জানানো হয় এবং তারা আকসুমে অর্থাৎ রাজধানীতে বসতি স্থাপন করেন। বর্ণনাকারীরা এই দলে যেসব মুসলিম ছিলেন তাদের একটি লিস্টও তৈরি করেছেন, এদের মধ্যে প্রধান প্রধান ব্যক্তি ছিলেন :
এই দলের নেতা ছিলেন আবু তালিবের পুত্র জাফর, আলীর বড় ভাই এবং প্রফেটের কাজিন। ইনি পরে মদিনাতে প্রফেটের সাথে মিলিত হন এবং মুতার যুদ্ধে প্রাণ হারান (৬২৯)। জাফরের সাথে ছিল তার স্ত্রী আসমা বিনত উম্মাইস। জাফরের মৃত্যুর পর আসমা আবুবকরকে বিবাহ করেন এবং তার মৃত্যুর পর বিবাহ করেন আলীকে অর্থাৎ জাফরের ছোট ভাইকে।
জুবাইর ইবন আওয়ান খাদিজার ভাইপো ও প্রফেটের কাজিন ছিলেন। তিনিও আবিসিনিয়া থেকে ফিরে এসে প্রফেটের সাথে যোগ দেন মদিনাতে। পরে উটের যুদ্ধে (৬৫৬) মারা যান।
ওসমান ইবন আফ্ফান উমাইয়া গোত্রের সদস্য। তিনি আবিসিনিয়ায় যান স্ত্রী প্রফেটের কন্যা রোকেয়াকে সাথে নিয়ে। পরে মদিনায় ৬৪৪ সালে ওমরের মৃত্যুর পর খলিফা হন।
প্রফেট মোহাম্মদের দশ বছরের সিনিয়র আবু সালামা স্ত্রীসহ আবিসিনিয়ায় যান। তিনি বদরের যুদ্ধে অংশ নেন এবং ৬২৫ সালে ওহোদের যুদ্ধে আহত হয়ে পরে মারা যান। তাঁর বিধবা স্ত্রী উম্মে সালামাকে প্রফেট মোহাম্মদ বিবাহ করেন। আবদুর রহমানের পুত্র আবু সালামা আর এই সালামা কিন্তু ভিন্ন ব্যক্তি।
খালিদ ইবন সাঈদ প্রথম দিকেই মুসলিম হন এবং পিতা কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে প্রফেটের বাড়িতে বসবাস করেন। আবিসিনিয়ায় থাকাকালে তিনি লোহার পাতের রিংয়ে রুপার দ্বারা খোদিত ‘আল্লাই সত্য’ লিখে ধারণ করতেন। ফিরে এসে প্রফেট এই রিং-এর বদলে তার নিজের সোনার রিং তাকে উপহার দেন। এই রিং প্রফেটের স্মারক চিহ্নরূপে তার বংশধরেরা ব্যবহার করেছেন এবং পরে খলিফা ওসমানের কাছ থেকে এই রিং হারিয়ে যায়।
ওসমান ইবন মাজুন জুমার কোরেশ গোত্রের লোক। তিনি তাঁর দুই পুত্রকে সাথে করে আবিসিনিয়ায় গমন করেন। তিনি সুফি সাধক ছিলেন, পরে প্রফেটের স্ত্রী আয়েশার সতীত্ব সম্বন্ধে অভিযোগ তোলেন। আবু বকর বা উমর উভয়েই তাঁর গোঁড়ামি পছন্দ করতেন না। তিনি স্বাধীন মতবাদের মানুষ ছিলেন এবং তার দলের মানুষরা তার মতোই গোঁড়া মতবাদী ছিলেন।
হাত্তাব তার স্ত্রী ফুকাইহাসহ আবিসিনিয়ায় গমন করেন। ফুকাইহার বাবা ইয়াসরা খ্রিস্টান ছিলেন। কোরেশীরা দাবি করত যে প্রফেট মোহাম্মদ ধর্মীয় নির্দেশ ইয়াসরার কাছে থেকেই পেতেন।
মুসাব ইবন ওমাইয়া গোঁড়া মুসলিম ছিলেন। তিনি তাঁর প্যাগন মাতাকে মুসলিম করার চেষ্টা করেন, কিন্তু মহিলা জবাবে বলেন— ‘আমি তোমার ধর্মমত মূর্খের মতো গ্রহণ করব না। তুমি চলে যাও, আমি তোমার মতো পুত্র চাই না এবং আমি আমার ধর্ম বিশ্বাস নিয়েই থাকব। সুসাব তাঁর স্ত্রী হামনা বিন্ত জাহাশকে নিয়ে আবিসিনিয়ায় যান। হামনা ওবাইদুল্লাহ ইবন জাহাশের ভগিনী, মায়ের দিকে হামনা খ্রিস্টান আসাদ গোত্রভুক্ত। ৬২০ সালে মুসাব মক্কায় ফিরলে প্রফেট তাকে মদিনায় ইসলাম প্রচারে প্রেরণ করেন। বদরের যুদ্ধে মুসা অংশগ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু ওহোদের যুদ্ধে মারা যান।
জুহরা গোত্রের আবদুর রহমান ইবনে আউফ প্রফেট মোহাম্মদের দশ বছরে ছোট। প্রাথমিক মুসলিম রূপে আবিসিনিয়ায় যান এবং ফিরে এসে মদিনায় প্রফেটের সাথে মিলিত হন। তিনি ধনাঢ্য মার্চেন্ট হন এবং বেশ কয়েকটি যুদ্ধে অংশ নেন। ৬২৭ সালে তিনি কাল্ব গোত্রের খ্রিস্টান প্রধানের কন্যা তোমাদিরকে বিবাহ করেন। বিখ্যাত জুরিস্ট কনসাল্ট আবু সালামার এরাই পিতা-মাতা।
সাকরান ইবন আমরের মাতা ওমাইমা আবদুল মোত্তালেবের কন্যা, তাই ইনি প্রফেটের কাজিন। তিনি স্ত্রী উম্মে হাবীবাসহ আবিসিনিয়া যান। উম্মে হাবীবা আবু সুফিয়ানের কন্যা। আবিসিনিয়ায় গিয়ে তিনি গোঁড়া খ্রিস্টান হয়ে যান। ইবন ইসহাক বর্ণনা করেছেন যে তিনি প্রফেটের সাহাবীদের বলতেন- ‘আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই, কিন্তু তোমাদের চোখ অর্ধভাবে উন্মুক্ত।’ তিনি ৬২৮ সালে আবিসিনিয়ায় মারা যান খ্রিস্টানরূপে। প্রফেট মোহাম্মদ তার বিধবা পত্নীকে ফিরে আসার পূর্বেই প্রক্সি দিয়ে বিবাহ করেন। তিনি ওবাইদুল্লাহর ভগিনী জয়নাব বিন্ত জাহাশকেও বিবাহ করেন।
মক্কাবাসী, যাদের আবিসিনিয়াদের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল, তারা শঙ্কিত হয় এই ভেবে যে, প্রফেট মোহাম্মদের পার্টি সেখানে তাদের ব্যবসার ক্ষতি করতে পারে। এই জন্য তারা দুই সদস্য বিশিষ্ট একটি বাণিজ্য ডেলিগেশন নেগাস আসহামাকে অনুরোধ করেন সেখানকার মুসলিম আশ্রয় প্রার্থীদের ফেরত পাঠানোর জন্য। মক্কান ডেলিগেশনের নেতৃত্বে ছিলেন আমর ইবন আল-আস, পরে যিনি মিশর জয় করেন।
নেগাস মক্কান ডেলিগেশনের অনুরোধ নাকচ করে বলেন যে, আশ্রয় প্রার্থীদেরও কথা শুনতে চান। এই বলে তিনি মুসলিমদের ডেকে পাঠান এবং তাদের বক্তব্য রাখতে বলেন। তাঁদের মুখপাত্র জাফর তাঁদের বক্তব্য তুলে ধরেন। যেখানে বিশপ ও পুরোহিতগণ যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের দেখিয়ে জাফর বলেন যে, এরা একদা মূর্তি পূজারী ছিলেন এবং প্রফেট মোহাম্মদ তাদের সত্য পথের সন্ধান দেন। তখন জাফরকে প্রফেট মোহাম্মদের পাওয়া ‘ওহি’ পড়ে শোনাতে বলেন নেগাস। তখন জাফর সূরা ১৯ (মরিয়ম) পড়ে শোনান। এই সূরাতে ব্যাপ্টিস্ট জনের জন্মকথা ও জেসাসের অলৌকিক জন্মেরও ইতিহাস আছে।
কেবলমাত্র প্রথম ৩৫টি আয়াত পড়ার পর ৩৬নং আয়াতের শুরুতেই বলা হয়েছে ঈশ্বরের কোনো পুত্র থাকা উচিত নয়’ আর এতেই প্রকাশ পায় যে যিশুর পুত্রত্ব প্রফেট মোহাম্মদ অস্বীকার করেছেন। এই বক্তব্যে নেগাস বিরক্ত হয়ে ওঠেন। কোনো কোনো অথরিটি বিশ্বাস করেন যে তখন সূরা ১৯-এর আয়াত সংখ্যা ছিল ৩৫টি এবং জাফর এখানেই পাঠ শেষ করেন। সূরার বাকি আয়াতগুলো ভিন্ন স্টাইল, তাল ও ছন্দ আছে এবং পঠনের ভাষণ বিতর্কমূলক (Polemical)। এর পরের আয়াতগুলো নিশ্চয় পরে যোগ করা হয়েছে যখন আরবের খ্রিস্টানদের সাথে প্রফেট মোহাম্মদের বিরোধিতা শুরু হয় ধর্মতত্ত্ব নিয়ে।
ঘটনা যাই হোক, আসহামা সন্তুষ্ট হয়েছিলেন সম্ভবত এই ধারণায় যে মুসলিম খ্রিস্টানের অংশ বিশেষ (Sect) বা গোষ্ঠীভুক্ত (Glubb. 1979, p. 122), তাই তিনি সরাসরি মক্কান ডেলিগেশনের অনুরোধ নাকচ করে মুসলিমদের আবিসিনিয়ায় থাকতে দেন। এই সংবাদ যখন প্রফেট শুনলেন তখন তিনি চিন্তামুক্ত হন।
এই ঘটনার কয়েক মাস পর প্রফেট সংবাদ পেলেন যে নেগাসের মৃত্যু হয়েছে। তিনি তখন তাঁর অনুসারীদের ডেকে তাঁদের মর্যাদা অনুযায়ী তাঁর পেছনে দাঁড় করিয়ে চার বার ‘আল্লাহ আকবর’ তকবির দিয়ে আসহামার জন্য প্রার্থনা করলেন, যখন তাঁর অনুসারীরা তাঁকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি উত্তরে বলেন যে, নেগাসের সহানুভূতি ও সদয় ব্যবহারকে স্মরণ করলেন। অন্য একটি বর্ণনায় বলা হয়েছে, কতকগুলো দর্শক চিৎকার করে বলেছে যে, তিনি একজন মৃত খ্রিস্টান ব্যক্তি, যাকে তিনি কখনো দেখেন নাই, তার জন্য প্রার্থনা করেছেন। প্রফেটের স্ত্রী আয়েশার এক ট্রাডিশনে জানা গেছে যে নেগাসের সমাধির ওপর সবসময় একটা আলো দেখা যায়।
উদ্বাস্তুরা আবিসিনিয়াতে নিরাপত্তা, শান্তি ও ভালোভাবেই বিভিন্নরূপে ১৩ বছর এবং কয়েক মাসের মতে বসবাস করেছে। কয়েকজন নির্বাসনে মারাও গেছে। কিছু সেখানে থেকে খ্রিস্টানও হয়ে গেছে এবং স্থায়ীভাবে রয়েও গেছে। এক বছরের মধ্যে প্রায় তিরিশটি পরিবার মক্কাতে ফিরে এসেছে, যখন তারা জেনেছিল যে কোরেশগণ এখন মুসলিমদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়েছে, যখন প্রফেট মোহাম্মদ তাদের কিছু সুবিধা (Concession) প্রদান করেছেন। চৌদ্দটি মানুষের একটি দল জাফর ও ওসমান ইবন আফ্ফান পরিবারবর্গসহ মহান হিজরতের পূর্বেই (৬২২) ফিরে এসেছেন। মদিনাতে প্রফেট মোহাম্মদের প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর বত্রিশ জন ব্যক্তি তাদের পরিবারসহ ৬২৮ সালে মদিনায় চলে আসেন। তখন আবিসিনিয়ায় যে নেগাস রাজত্ব করছিলেন তিনি সেই দলকে দুটো জাহাজ দেন লোহিত সাগর পার হওয়ার জন্য।
৫.২১ স্যাটানিক ভার্স
প্যাগন মক্কানদের কিছু সুবিধা দেওয়ার জন্য প্রফেট মোহাম্মদের ওপর উত্তরোত্তর চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছিল এবং আল-তাবারীর ভাষ্য মতে, তিনি নিজেও ইচ্ছুক ছিলেন মক্কানদের কিছু সুবিধা দিতে যাতে তারা তার ধর্মমত গ্রহণ করে। এই সদিচ্ছা নিয়ে ৬১৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি বহু-ঈশ্বরবাদীদের সাথে তাদের দেবী লাত, উজ্জা ও মানাত সম্বন্ধে একটা সমঝোতায় আসার চেষ্টা করলেন। এই তিনটি দেবী মক্কা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় খুবই জনপ্রিয় বিধায়, দেবীদের পক্ষে একটা সম্মানজনক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
তিনি কাবাঘরে গিয়ে মক্কার মুরব্বিদের সামনে কোরানের আয়াত পাঠ করলেন (৫৩ : ১৯-২০) এই তিন দেবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তারপর তিনি এই শব্দগুলো যোগ করলেন— These are the exalted damsels (gharanik variously (gharanik-variously translated as ‘females’, ‘birds’, ‘swans’ ‘herons’, ‘crane’) mounting upwords to heaven whose intercessions may be sought” অর্থাৎ এই তিন মহীয়সী রমণী (ঘারানিক- বিভিন্নভাবে যার অর্থ করা হয়েছে ‘নারী’, ‘পক্ষী’, রাজহংস’, ‘বক’ ও সারস বলে) যারা স্বর্গ পানে ধাবিত হয় তাদের মধ্যস্থতা (intercession) আকাঙ্ক্ষা করা যেতে পারে।
মূর্তিপূজকরা মহাখুশি প্রফেটের এই ঐশীবাণী শ্রবণ করে যা তাদের দেবীদের স্বর্গীয় মর্যাদা দান করে পূজার যোগ্য করা হলো এবং যদিও প্রফেটের একেশ্বরবাদের প্রতি দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থেকে গেল, তবুও সাধারণভবে তারা টেনশনমুক্ত হলো। এই সমঝোতা আবিসিনিয়ায় নির্বাসিতদের কানে পৌঁছতেই তাদের মধ্যে কয়েকজন মক্কায় ফিরে এলো।
কিন্তু কিছু পরেই (কেউ বলেছেন ঐদিন সন্ধ্যা বেলাতেই, কেউ বলেছেন কয়েক সপ্তাহ, আবার কেউ বলেছেন কয়েক মাস) প্রফেট বুঝতে পারেন যে ‘সমঝোতা’ অকার্যকর হবে। পরে তিনি যা বলেছিলেন সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে গেলেন এবং সকলকে বুঝিয়ে বললেন যে, অতিরিক্ত আয়াত পাঠ করা হয়েছিল তা শয়তান কর্তৃক তার ভাববাদী অবস্থায় তার মুখ দিয়ে বলিয়েছে, এটা তাঁর নিজের ভাষ্য ছিল না। সেই মতে ঐ ‘স্যাটানিক ভার্স’ শয়তানি আয়াত অন্য আয়াত দ্বারা উপস্থাপিত করা হয়েছে। উপস্থাপিত আয়াত এখন এইভাবে পঠিত : “What, Shall men have male progeny, and God female? This is a most unfair distinction” (53 : 21-2) – অর্থাৎ, তবে কি তোমাদের জন্য পুত্র সন্তান এবং আল্লাহর জন্য কন্যা সন্তান? এই প্রকার বণ্টন তো অসংগত। এই পরিবর্তনের পর এই অর্থ হলো যে, যদি এই তিন দেবী পুরুষ হতেন নারীর পরিবর্তে তাহলে তাদের জন্য হয়তো আপত্তি থাকত না বা কমে যেত। এই অর্থকে আরো মজবুত করা হলো আর একটা আয়াত দ্বারা “God brings to nought that which satan suggested (2251) অর্থাৎ শয়তান যা প্রস্তাব করে, আল্লাহ তা নাকচ করেছেন। প্রফেট তার শিক্ষার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে জোর দিয়ে বলেন- সেগুলো অভিশপ্ত শয়তানের ডকট্রিন হতে পারে না। (৮১ : ২৫)।
এই ‘শয়তানী আয়াত’-এর কাহিনী নিয়ে অনন্ত ও তিক্ত তর্কাতর্কি হয়েছে। ঐতিহাসিকগণ ও তফসিরকারগণ— যেমন আল-ওয়াকিদী, ইবন হিশাম, ইবন সাদ, আল-তাবারী, আল-জামাখশারী, আল বায়দাবী এবং জালালুদ্দিন এদের মধ্যে অন্যতম, যারা উল্লেখ করেছেন তাদের এ বিষয়ে সুচিন্তিত মতামত। পরবর্তী আলেমরা মনে করেন তার কাছে ‘সত্য’ আগমনের পর, প্রফেট ভুল করেছেন বলে মনে করলে তাকে ধর্ম-বিরোধী (heretical) বলা যেতে পারে এবং এই ঘটনা, পরবর্তীতে যারা প্রফেটের চরিত রচনা করেছেন তারা ক্বচিৎ উল্লেখ করে থাকেন এবং বর্তমানে অনেক মুসলিম এ ঘটনাকে অস্বীকার করে।
৫.২২ তায়েফ গমন
মক্কাতে শত্রুতা বৃদ্ধির তীব্রতা দেখে, প্রফেট মোহাম্মদ, একটি নির্ভরযোগ্য নিরাপদ স্থানের খোঁজে এ-গোত্র থেকে সে-গোত্রে আবেদন জানান এবং জনশ্রুতি যে, তাঁর সে আবেদনে কোনো গোত্র-প্রধানই সাড়া দেয়নি। কারণ কোনো গোত্র প্রভাবশালী কোরেশীদের অসন্তুষ্টির কারণ হতে চায়নি। ৬১৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি পরিশেষে তাঁর পালিত পুত্র জায়েদকে নিয়ে তায়েফ গমনে সিদ্ধান্ত নিলেন।
মক্কার দক্ষিণ-পূর্বে প্রায় ৪০ মাইল দূরে এই সবুজ পার্বত্য-শহর তায়েফ অবস্থিত। এই শহর আঙুর ও ফলমূলের শহর বলে খ্যাত ও ব্যস্ত বাণিজ্য কেন্দ্র। এখানে তাকিফ গোত্রের বাস। মক্কার অসহ্য উষ্ণতা ও ধূলিবালি এড়ানোর জন্য গ্রীষ্মকালে বেশ কয়েকটি ধনাঢ্য মক্কার বণিক এখানে এসে আড্ডা গাড়ে। এই শহরটি একটি ছোট কেন্দ্রও বটে মদ্য ব্যবসার জন্য, ইহুদিরা তৈরি করে বিক্রিও করে।
প্রফেট মোহাম্মদ তায়েফে এসে দশ দিন ছিলেন এবং কয়েকজন নেতা গোছের লোকের সাথে দেখা করেন। তিনি তাঁদের সাহায্য প্রার্থনা করেন এবং তাদের ধর্মীয় আদর্শের ওপর থেকে মক্কানদের নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার করানোর জন্য প্রস্তাব করেন। তিনি তাঁর মিশন সম্বন্ধে তাঁদের অবহিত করেন এবং তাঁদের শুধু ঈশ্বরের পূজা করতে আহ্বান জানান। তাঁর কথাবার্তা শুনে তায়েফ নেতাদের আমোদ ও বিরক্তি উভয়ই উদ্ভিক্ত হয়। বণিকদের মধ্যে কয়েকজন জানালেন যে এ বিষয়ে তাদের কিছু করার নেই। কিন্তু তবুও প্রফেট তাদের কাছে বারবার একই প্রস্তাব উপস্থাপিত করায় তারা শেষমেশ বিরক্ত হয়ে তাদের শহর থেকে বের করে দেওয়ার জন্য কিছু লোক ভাড়া করে।
আশাহত হয়ে প্রফেট ও জায়েদ শহরের দু’মাইল বাইরে একটি খ্যাতনামা দ্রাক্ষাকুঞ্জে আশ্রয় নেন। এখানে আদ্দাস নামে এক খ্রিস্টান দাস, এক থালা আঙুর ও কিছু নাস্তা এনে তাদের সেবা করে, এতে প্রফেট মোহাম্মদ সন্তুষ্ট হয়ে তাকে দোয়া করেন।
এরপর নোফাল গোত্রের মোতিম ইবন আদি নিরাপত্তার আশ্বাস দিলে প্রফেট ও জায়েদ মক্কায় ফিরে এলেন, কিন্তু তাঁর অবস্থার পরিবর্তন বা সহজ হলো না।
পরবর্তী কয়েক মাসের মধ্যে তিনি বিভিন্ন মেলাতে যাযাবরদের মাঝে তাঁর বাণী প্রচার শুরু করলেন— গোত্রদের মধ্যে ছিল কিন্দা, কাল্ব, হানিফা এবং আমির। প্রথম তিনটি গোত্র, পুরোপুরি কিংবা আংশিক খ্রিস্টান ছিল তাই তারা তার বাণী প্রচারে সাড়া দেয়নি। আমির গোত্রও প্রথমে কোনো সাড়া না দিলেও পরে প্রফেটের দলে যোগ দেয়।
৫.২৩ নৈশভ্রমণ (মিরাজ)
অনেক ধর্মে কাহিনী বা কিংবদন্তি আছে যে প্রফেট কিংবা সাধুব্যক্তি স্বর্গ এবং নরক দর্শন করে এসেছেন— কেউ একা গেছেন কেউবা গেছেন দেবদূতের সঙ্গে। এই যাত্রায় কেউবা যানবাহন ব্যবহার করেছেন, কেউবা সিঁড়ি দিয়ে উঠে স্বর্গ বা নরকে পৌছে গেছেন। এই কেচ্ছা কাহিনীর মধ্যে সিঁড়ি বেয়ে স্বর্গে যাওয়ার কথা আছে জ্যাকবের (আদিপুস্তক ২৮ : ১২) ইথিওপিক বুক অব জুবিলিজ’-এ এই যাত্রাকে বলা হয়েছে ‘মা-আরেগ’ (maareg) এলিজা স্বর্গে গেছেন অগ্নি-রথে চড়ে (২ কিং ২ : ১১); এনোক বিভিন্ন স্বর্গে ও নরকে এমনি উঠে গেছেন যার বর্ণনা আছে ইথিওপিক ও স্লাভানিক ‘বুকস অব এনক’-এ (প্রায় খ্রিঃ পূঃ ৫৯); যিশুখ্রিস্ট স্বর্গে উঠে গেছেন (লুক ২৪ : ৫১); সেন্টপল যানবাহনে গেছেন তৃতীয় স্বর্গ পর্যন্ত (২ করিন্থ ১২ : ২); এবং এই যে ঊর্ধ্ব-রাজ্যে আরোহণ এতে সাহায্য করেছে দেবদূতেরা যেমন বর্ণনা আছে ‘এসেনসেন অব ইশাইয়া’ কেতাবে (প্রায় ৮০ খ্রিস্টাব্দ)।
কয়েকজন মহাত্ম ব্যক্তির স্বর্গে ও নরকে গমন এবং পরিদর্শনের কথা আছে প্রাচীন ‘নসটিক রাইটিংস-এ’ (Gnostic writings)। বলা হয় এগুলো পলভি কিতাব- প্রফেট মোহাম্মদ-এর চার শতাব্দি পূর্বে। এখানে পুরোহিত আরতা বিরাফের (Arta viraf) স্বর্গে গমনের কাহিনীতে যে যাত্রার কথা আছে সে-যাত্রা গাইড করেছিলেন মহাদেব দূত (আরচেঞ্জেল); সারোশ দেবতা অরজমন্ডের সম্মুখে পৌঁছে তার দর্শন লাভের পর তিনি অন্যান্য অঞ্চল পরিদর্শন করেন। অরজ়মন্ড ইরানের শুভ দেবতা।
প্রফেট মোহাম্মদ ও অন্যান্য ধর্মভীরু কোরেশ ব্যক্তিরা নিশ্চয়ই এই সব ঊর্ধ্বগমনের কাহিনীর সাথে ভালোভাবেই পরিচিত ছিলেন। কোরানে বর্ণিত প্রফেটের বিরোধীরা বলেছিল যে তারা প্রফেটের মিশনে কখনোও বিশ্বাস করবে না যতক্ষণ না তিনি ‘সিঁড়ি বেয়ে স্বর্গে উঠে যাবেন’ (১৭ : ৯৫)
একবার আবু তালিবের কন্যা উম্মে হানির বাড়িতে রাত কাটানোর সময় (৬২১ খ্রিঃ) প্রফেট মোহাম্মদ দাবি করেন যে তিনি ঊর্ধ্বগমনের অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন। বলা হয় যে, তিনি যেহেতু মক্কাবাসীরা এই অলৌকিক ঘটনা ঘটানোর দাবি করেছিল, তাই তাদের বিশ্বাস জাগানোর জন্য তিনি এই ঘোষণা দেন।
কোরানের একটি আয়াতে আছে যে প্রফেট মোহাম্মদকে রাত্রিকালে মক্কার পবিত্র মন্দির থেকে দূরবর্তী মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয় (১৭ : ১)। ‘দূরবর্তী’ (আল-আকসা) মন্দিরের নাম নেয়া হয়নি, কিন্তু জেরুজালেম বলে কথিত এবং পরবর্তীতে মোরিয়া পর্বতের কথিত স্থানে একটি মন্দির নির্মাণ করা হয়। (কোরানে কোথাও জেরুজালেমের নাম কখনো উচ্চারিত হয়নি)।
এই কাহিনীকে (রাত্রিভ্রমণ)-ইসরা-ঘিরে বহু কেচ্ছা গল্পের জাল বোনা হয়েছে, যা কোরানের কোনো স্থানেই উল্লিখিত হয়নি। গৃহীত ভার্সান মতে কাহিনী হচ্ছে : মক্কাতে এক রাতে, হিজরতের কয়েক মাস পূর্বে, প্রফেট যখন ভাত-ঘুম অবস্থায়, তখন জিব্রাইল তাঁর নিকট হাজির হয়, বোরাক নামে এক দেখনধারী ঘোড়া নিয়ে। ঘোড়াটির মুখ নারীর মতো, লেজে ময়ূরপুচ্ছ এবং সফেদ রঙ এবং এক ধাক্কায় একজনকে নিয়ে যায় দৃষ্টির বাইরে- বলেছেন ইবন ইসহাক।
প্রফেট ঘোড়ায় চড়লেন এবং জেরুজালেমে মোরিয়া পর্বতে চলে গেলেন। এখানে এসে তিনি সোনার মই-এর শেষ পা-দানি ধরে ফেলে মই-এ চড়লেন, যা স্বর্গ থেকে ঝুলছিল। তারপর জিব্রাইল এক এক করে সপ্ত-স্বর্গে উঠে গেলেন। স্বর্গদ্বারে পৌছে আদম, এনক, জোসেফ, মোসেস, আরন, আব্রাহাম ও যিশুর সাথে এক এক করে দেখা করলেন। শেষে তিনি শেষ পর্দার দুই-ধনুক সমান দূরে গিয়ে দাঁড়ালেন। একটু সম্মুখে হাজার পর্দার পেছনে ঈশ্বর অপেক্ষায়। সেখানে তিনি বা জিব্রাইল কেউ যেতে পারেন না। ঈশ্বর মানুষের সাথে কথা কন না ‘ভিশন’-এ দেখা দেন কিংবা পর্দার পেছনে। (৪২ : 50)
ফিরে আসার পূর্বে তিনি এক নজর দোজখ দেখে নিলেন। এই যে এত ঘটনা ঘটে গেল তা ঘটল এক পলকের মধ্যে, এক সেকেন্ডের অংশ বিশেষ।
বলা হয় যে, যখন প্রফেট মোহাম্মদ পরদিন সকালে বাসার লোকজনদের কাছে তাঁর এই অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেন, তখন উম্মে হানি ভীষণভাবে বিরক্তি প্রকাশ করে বলেন—দোহাই একথা যেন মানুষের সামনে বলে উপহাসের পাত্র হবেন না এবং নিজের সুনাম নষ্ট করবেন না। কিন্তু তিনি অবশ্য এ কাহিনী তাঁর একান্ত বিশ্বস্ত অনুসারীদের কাছে ব্যক্ত করলেন। আবু বকর বিশ্বাস করলেন, কিন্তু অন্য সকলে বিব্রত বোধ করলেন এবং অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য ও অবাস্তব বলে মনে হওয়ায় অনেকে ধর্ম পরিত্যাগ করে (Glubb, 12979 p. 136)।
প্রফেট মোহাম্মদ পাবলিক স্কোয়ারে তার এই নৈশভ্রমণের কথা ব্যক্ত করলে, যেমন আশা করা হয়েছিল, লোকজনে বিশ্বাসই করল না। তাঁর মাথায় গোলমাল হয়েছে কিনা, তাই সন্দেহ করল।
দুরন্ত কোরেশীরা এই পাগলের প্রলাপ বলে উড়িয়ে দিল। তাদের এই ধারণাকে পাল্টে দেয়ার জন্য একটি হাদিসের উৎপত্তি হলো। বর্ণনায় আছে প্রফেট বলেছেন- আমার চোখ বন্ধ ছিল ঘুমে, কিন্তু আমার অন্তঃকরণ ছিল জাগ্রত। অন্য হাদিস আছে আয়েশার বর্ণনায় ‘রসূলের দেহ যেখানে ছিল সেখানেই ছিল, কিন্তু আল্লাহ তাঁর আত্মাকে রাত্রে তুলে নিয়েছিলেন।’ পরবর্তী অনেক মুসলিম আলেম ও ধর্মবিদ বলেছেন যে, প্রফেটের ঐ নৈশভ্রমণ একটি রহস্যময় অভিজ্ঞতা ছাড়া আর কিছু নয় এবং অন্যেরা বলেছেন এই অভিজ্ঞতাকে প্রতীকী অর্থে ধরে নিতে হবে।