৭। একটা প্রতিযোগিতামূলক জাতির প্রতি

৭. একটা প্রতিযোগিতামূলক জাতির প্রতি

প্রতিযোগিতার মাধ্যমেই জাতির উন্নয়ন সম্ভব। জ্ঞানের দ্বারাই প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়। টেকনোলজি এবং আবিষ্কারের মাধ্যমেই জ্ঞান অর্জিত হয়।

.

ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী গ্রামে বসবাস করে। এটাই বৈজ্ঞানিক সমাজের জন্য প্রকৃত চ্যালেঞ্জ; প্রযুক্তির ফলেই ৭৫০ মিলিয়ন মানুষের সমৃদ্ধি ঘটতে পারে। বিজ্ঞান আর টেকনোলজি পেশায় আমার পঞ্চাশ বছরের জীবনে আমি সব সময়ই বিশ্বাস করে এসেছি যে এই দুটো ক্ষেত্রের বিকাশ ঘটলেই জাতির উন্নয়ন সম্ভব। তিনটা প্রধান ক্ষেত্রের প্রতি আমরা আলোকপাত করতে পারি। ক্ষেত্র তিনটি হলো ন্যানোটেকনোলজি,ই-গভার্ন্যান্স আর বায়ো ডিজেল। আবিষ্কারের জন্য অনুকূল পরিবেশ কেন রাষ্ট্রপতিভবন থেকে শুরু করা যাবে না?

জটিল আর নতুন পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য প্রয়োজন বহু সংখ্যক বিশেষজ্ঞের মিলিত চিন্তাভাবনা। বিভিন্ন মতামত আর সম্মিলিত চেষ্টার দ্বারা মিশনকে সফল করা সম্ভব। এই বিষয়ে তিনটি চমৎকার ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়। একটা রাষ্ট্রপতিভবনে, আর একটা রাষ্ট্রপতি নিলমে, অন্যটি সেকান্দ্রাবাদের রাষ্ট্রপতির অবসর ভবনে। এইসব স্থানে ন্যানোটেকনোলজি, ই-গভার্ন্যান্স এবং বায়োডিজেল কনফারেন্স হয়েছিল। দেশের ভবিষ্যতের উন্নতির জন্য এই কনফারেন্সগুলো বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

আমি বেঙ্গালুরের জওহরলাল নেহেরু সেন্টার ফর এডভান্সড সায়েন্টিফিক রিসার্চের অনারারী প্রেসিডেন্ট প্রফেসর সি.এন.আর রাও এর সঙ্গে আমি দীর্ঘ আলোচনা করেছিলাম। ন্যানো সায়েন্স টেকনোলজির ভবিষ্যত উন্নয়ন ও রিচার্স এবং কৃষি, ওষুধ, মহাকাশ আর এনার্জির ভবিষ্যত উন্নয়ন সম্পর্কে ভারতীয় আর বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সাথে আমি অনেক আলোচনা করেছিলাম। এইসব আলোচনা থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমি রাষ্ট্রপতিভবনে সারাদিন ব্যাপী আলোচনার ব্যবস্থা করলাম। আলোচনা থেকে পাওয়া সুপারিশের ভিত্তিতে ১০০০ কোটি রুপির সমন্বিত প্রোগ্রামের পরিকল্পনা করা হলো। প্রোগ্রামটাতে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের কথা ছিল। বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি উৎপাদনের একটা সিম্পল মেথড গ্রহণ করেছে যেনে আমি আনন্দিত হলাম। কার্বন ন্যানো- টিউব ফিল্টারস সক্রিয়ভাবে পানি থেকে মাইক্রো-টু ন্যানো-স্কেল কনটামিন্যান্টস এবং পেট্রোলিয়াম থেকে হেভি হাইড্রোকার্বনস অপসারণ করতে পারে। প্রাইভেট কোম্পানী ডাবর এর অংশীদারিত্বে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদগণ সফলতার সাথে একটা ওষুধের উন্নয়ন সাধন করেন যা টিউমার সেলের উপর কার্যকর।

ভারতের উন্নয়ন আর জ্ঞানী সমাজ প্রতিষ্ঠার পূর্ব শর্ত হচ্ছে উপযুক্ত, সফল, স্বচ্ছ সরকার। ভারতের উন্নয়নের জন্য গ্রাম, জেলা ও রাজ্য পর্যায়ে সমন্বিতভাবে বিকেন্দ্রীয় করা একান্ত প্রয়োজন। প্রাইভেট আর পাবলিক সেক্টরের অংশ গ্রহণের মাধ্যমে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত পরিকল্পনা সমূহ বাস্তবায়ন করা। এই লক্ষ্যকে মাথায় রেখে সংশ্লিষ্ট এজেন্সি সমূহের অংশ গ্রহণে একটা ই-গভার্ন্যান্স কনফারেন্সের আয়োজন করা হয়েছিল। আমরাও রাষ্ট্রপতিভবনে ই-গভার্ন্যান্স সিস্টেম চালু করেছিলাম। আমি এই বিষয়ের উপর জুডিশিয়ারী, অডিট এজেন্সি ও অন্যান্য সেক্টরের সভায় ভাষণ দিয়েছিলাম। কমনওয়েলথ মিটিংয়েও এই বিষয় উপস্থাপন করা হয়েছিল। আমি আশা করেছিলাম ই-গভার্ন্যান্স এর সাহায্যে প্রত্যেক নাগরিককে পরিচয়পত্র পদান করা সম্ভব। ফলে উগ্রপন্থী ও সন্ত্রাসবাদীদের সাথে আমাদের লড়াই করা সহজ হবে।

আমি বিশ্বাস করি ভবিষ্যতে পানি ও এনার্জি এই দুটো বিষয়ে সংকট দেখা দেবে। গভর্নরদের কনফারেন্সের ভাষণে আমি জাতীয় ও রাষ্ট্র পর্যায়ে পানি সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণের উপর জোর দিয়েছিলাম। অপর বিষয়টা ছিল এনার্জি সমস্যা। আমি বায়োগ্যাস এর উন্নয়নের জন্য বিশেষ নজর দেবার জন্য বলেছিলাম। এই উপলক্ষ্যে সচেতনা বৃদ্ধির জন্য আমি রাষ্ট্রপতি নিলম-এ একটা সমন্বিত কনফারেন্সের আয়োজনও করেছিলাম। এই কনফারেন্সে অভিজ্ঞ কৃষকরা উপস্থিত ছিলেন, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভাইস চ্যান্সেলররা এই বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদান করেছিলেন। বায়োফুয়েল উৎপাদনের জন্য অকৃষি জমি বরাদ্দের কথা বলা হয়েছিল। কনফারেন্স শেষে সুপারিসমালা সংশ্লিষ্ট পক্ষের কাছে বিলি করা হয়। বায়োফুয়েল পলিসির কথা উপস্থাপিত হওয়ায় আমি খুশি হয়েছিলাম।

এই তিনটি কনফারেন্স ছাড়াও রাষ্ট্রপতিভবন থেকে আরো পদক্ষেপ গ্ৰহণ করা হয়েছিল।

.

২০০৬ এ তৎকালীন আইএসআরও এর চেয়ারম্যান চাঁদে অভিযান চালানোর জন্য চন্দ্রায়ন মিশন নামে চন্দ্রাভিযানের পরিকল্পনার কথা আমাকে জানিয়েছিলেন। আমি নিশ্চিত ছিলাম এটাই হবে প্লানেটারি অভিযানের প্রথম ধাপ। প্রস্তাবিত চন্দ্রাভিযান সম্পর্কে তিনি আমাকে বলেছিলেন চাঁদের রাসায়নিক, খনিজ ও প্রাণীজ সম্পদের অস্তিত্ব আছে। তিনি আমাকে আরো বলেছিলেন যে এই মিশন বহুবিধ বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি বহন করে নিয়ে যাবে। আইএসআরও এ বিষয়টা চূড়ান্ত করার কাজ চলছে। আমি আমার মন্তব্যে বলেছিলাম চন্দ্রাভিযানের জন্য একটা সমন্বিত এন্ট্রি প্যাকেজ গ্রহণ করা যেতে পারে কমপক্ষে একটি টেলিমেট্রি চ্যানেল সংযোজন করে যার সাহায্যে চাঁদের ডেনসিটি কিংবা প্রেসার পরিমাপ করা সম্ভব হবে। চেয়ারম্যান তা করার জন্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এই পরিকল্পনার ফল হিসাবে ২০০৮ এর ১৪ নভেম্বর চন্দ্রায়ন মিশনের অংশ হিসাবে চাঁদের পূর্ব নির্ধারিত মাটিতে ভারতের যান নেমেছিল। আমি এতে খুবই উল্লসিত হয়েছিলাম। এই সুন্দর অভিযানের জন্য আমি আইএসআরও কে অভিনন্দন জানিয়েছিলাম।

.

আমি ২০১১ এর গ্লোবাল ইনোভেশন রিপোর্ট পড়ে দেখলাম যে গ্লোবাল ইনোভেশন ইনডেক্স র‍্যাংক সুইজারল্যান্ড ১, সুইডেন ২, সিঙ্গাপুর ৩, হংকং ৪, আর ভারত ৬২। ইনোভেশন ইনডেক্স এবং কমপিটেটিভনেস এর মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে। ২০১০-১১ এ ভারতের ইনোভেশন ইনডেক্স র‍্যাংক ৬২, আর অন্যদিকে গ্লোবাল কমপিটেটিভনেস র‍্যাংক ৫৬। যদি ভারতকে উন্নত দেশের পর্যায়ে (টপ ১০)পৌঁছাতে হয় তবে কমপিটেটিভনেস বৃদ্ধি করা একান্ত প্রয়োজন। আমাদেরকে দেশীয় ডিজাইন ক্যাপাবিলিটি গড়ে তোলাও একান্তভাবে দরকার। টেকনোলজিগুলোর উন্নতি, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার আর পেটেন্ট ভিত্তিক হওয়ায় দশ থেকে পনেরো বছর আগে বর্তমান গ্রোথ অর্জিত হয়েছিল। বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির সর্বশেষ ফল উন্নত দেশ থেকে ভারতে সহজলভ্য হতে কমপক্ষে এক দশক লাগবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে রিচার্স একান্ত জরুরি বিশেষ করে ব্যাসিক সায়েন্স এ যদি ভারতকে গ্লোবাল কমপিটেটিভনেস স্তরে পৌঁছাতে হয়। ভারতকে উন্নত দেশের পর্যায়ে পৌছাতে হলে আমি নিচে একটা লক্ষ্যমাত্রার কথা তুলে ধরবো।

.

আমরা সম্প্রতি একটা মাইলফলক অতিক্রম করলাম। ২০১২ এর ১৯ এপ্রিল উড়িষ্যা উপকূলের উৎক্ষেপন এলাকা হুইলার আইল্যান্ডে ৫০ টন, ১৭.৫ মিটার উচ্চ অগ্নি ভি মিসাইল উৎক্ষেপন করা সম্পর্কে আমরা দু:চিন্তার মাঝে ছিলাম। মিসাইলটিতে উল্লম্বভাবে স্থাপন করে উৎক্ষেপনের আগে পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরুর শেষে সকাল ৮.০৭ থেকে কাউন্ট ডাউন শুরু করা হলো। বিশাল একটা আগুনের গোলক মিসাইল থেকে বেরিয়ে আসা মাত্র প্রথমে মিসাইলের মঞ্চে আগুন প্রজ্জ্বলিত হয়ে অগ্নি ভি উৎক্ষেপন মঞ্চ ছেড়ে সুন্দরভাবে উপরের দিকে ধাবিত হলো। বিজ্ঞানীরা উৎক্ষেপন লক্ষ্য করলেন। তাদের মুখে কোন কথা ছিল না। দর্শকদের মনে টেনশন অবশ্যই ছিল। ৯০ সেকেন্ড পরে প্রথম স্টেজ পুড়ে গিয়ে আলাদা হয়ে গেল। মিসাইলটি সঠিক গতিবেগ পেল। তারপর পরিকল্পনা মাফিক দ্বিতীয় স্টেজটি পুড়ে গিয়ে পৃথক হয়ে গেল।

কয়েক মিনিটের মধ্যে মিসাইলটি ২০০০ কিলোমিটার গতিতে চলতে লাগলো যে পর্যন্ত না ইকুইডোর পার হোল। তারপর ৩০০০ কিলোমিটার গতিবেগে মকরক্রান্তি ছাড়িয়ে বায়ুমন্ডলে পুনরায় প্রবেশ করে আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে পতিত হলো। উৎক্ষেপন থেকে ভুপাতিত হতে বিশ মিনিট সময় লাগলো। ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজগুলো প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মিসাইলের প্রতি নজরদারী করেছিল।

১৯৮৩ এ আইজিএমডিপি ৪০০ কোটি রুপি বরাদ্দ দিয়েছিল। এই প্রোগ্রামের আওতায় চারটি মিসাইল উৎক্ষেপন করে। মিসাইল চারটি হলো : ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপক মিশাইল (পৃথ্বি), মাঝারি পাল্লার ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপক মিশাইল (আকাশ),স্বল্প পাল্লার দ্রুতগতি সম্পন্ন ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপক মিশাইল (ত্রিশূল), আর অন্যটি ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী মিশাইল (নাগ), এছাড়াও টেকনোলজি ডেমোনেস্ট্রেশন মিসাইল (অগ্নি) এই প্রোগ্রামের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৮৯ এর মে তে উড়িষ্যায় প্রথম এই টেকনোলজির ব্যবহার করে। চূড়ান্তভাবে ডিআরডিও এর বৈজ্ঞানিক ও ইঞ্জিনিয়াররা অগ্নি ৫ উড্ডোয়নের সুযোগ সুবিধা দেয়। এই মিসাইলটির গতিবেগ ৫০০০ কিলোমিটার। এই মিসাইলগুলো এমটিসিআর (মিসাইল টেকনোলজি কন্ট্রোল রিজিম) এবং অন্যান্য বিভাগ এর আওতায় ছিল। অগ্নি ৫ মিসাইলের সফল পরীক্ষা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমার বন্ধু ড. ভি. কে. সারাওয়াত এবং তার দলবল অগ্নি ৫ উৎক্ষেপন সম্বন্ধে আমাকে জ্ঞাত করান।

এ সম্পর্কে আমাকে কিছু বলার অনুমতি দিবেন। ১৯৮৪ এর একটা আলোচনা এবং ১৯৯১ এর অন্য একটা ঘটনার কথা আমি এখানে উল্লেখ করছি। আমি হাদ্রাবাদের ডিআরডিএল এর ডিরেক্টর ছিলাম। ১৯৮৩ এ প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তার ক্যাবিনেটের মাধ্যমে আইজিএমডিপি বরাদ্দ দেন ও তা থেকেই ডিআরডিএল গঠিত হয়। পরের বছর এই প্রোগ্রামের রিভিউ করা হয়। আমরা যখন প্রোগ্রামের অগ্রগতি উপস্থাপন করছিলাম তখন ইন্দিরা গান্ধী কনফারেন্স রুমে ওয়ার্ল্ড ম্যাপ দেখছিলেন। তিনি আমাদেরকে উপস্থাপনা বন্ধ রেখে ওয়ার্ল্ড ম্যাপের দিকে মনোযোগ দিতে নির্দেশ দিলেন। তিনি আমাকে বললেন, কালাম, ম্যাপটার দিকে তাকিয়ে দেখ, আর দূরত্বটাও দেখ। (তিনি ভারত থেকে ৫০০০ কিলো মিটার দূরের একটা জায়গা নির্দেশ করলেন।) অবশ্য এখন আমাদের ডিআরডিও মহান দেশনেত্রীর স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে পেরেছে।

বস্তুতপক্ষে, যখন পৃথ্বি সঠিকভাবে উৎক্ষিপ্ত হলো তখন সেনাবাহিনী একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয়তার কথা জানালো। আর্মি চাচ্ছিল ল্যান্ডরেঞ্জে একটা কনফার্মিট্রি টেস্ট করাতে। আমাদের মরুভূমিতে পরীক্ষা চালাতে গিয়ে জিওপলিটিক্যাল সমস্যা দেখা দিল। এই সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে আমাদেরকে পূর্বাঞ্চলের উপকূলে জনবসতিহীন একটা দ্বীপ খুঁজতে হলো। নৌবাহিনী হাইড্রোগ্রাফিক ম্যাপ সরবরাহ করলো। আমরা ম্যাপে বঙ্গোপসাগরের মাঝে কয়েকটা দ্বীপ ধর্মা (উড়িষ্যা উপকূলে) দেখতে পেলাম। আমাদের রেঞ্জ টিমের এস, কে. সালবান এবং ড. ভি. কে.সারাস্বত ধর্মা থেকে একটা নৌকা ভাড়া করে দ্বীপটির সন্ধানে বের হলেন। ম্যাপে এই দ্বীপগুলো ‘লং হুইলার’, ‘কোকনাট হুইলার’ নামে পরিচিত। টিমটি একটা ডিরেকশনাল কম্পাস সাথে করে নিয়ে গিয়েছিল। তারা পথ হারিয়ে ফেলায় হুইলার দ্বীপটির অবস্থান নিরুপণ করতে ব্যর্থ হন। সৌভাগ্যক্রমে, তারা কয়েকটা জেলে নৌকার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তাদের কাছে হুইলার দ্বীপের পথটা সম্বন্ধে জানতে চাইলে তারা বললো যে তারা হুইলার দ্বীপ চেনে না, তবে ওদিকটাতে ‘চন্দ্রচূড় নামে একটা দ্বীপ আছে। তারা ভাবলেন যে দ্বীপটা তারা খুঁজছেন ওটা সেই দ্বীপও হতে পারে। জেলেদের কথা মতো চন্দ্রচূড় দ্বীপের দিকে যাত্রা করলেন। জেলেদের নির্দেশ অনুযায়ী তাদের টিমটি চন্দ্রচূড় দ্বীপে পৌঁছে গেলো। পরে তারা নিশ্চিত হলেন যে এই ছোট্ট দ্বীপটিই হুইলার। দ্বীপটিতে রেঞ্জ অপারেশন চালানো সম্ভব তারা ভেবে দেখলেন।

দ্বীপটি পাবার পর, আমরা উড়িষ্যা সরকারের স্মরণাপন্ন হলাম। চিফ মিনিস্টারের (১৯৩০)অনুমতি প্রয়োজন। ওই সময় বিজু পট নায়েক ছিলেন শক্তিশালী নেতা। তিনিই ছিলেন উড়িষ্যার মুখ্য মন্ত্রী। তার কাছ থেকে মতামত এলো কয়েকটি কারণে দ্বীপটি উড়িষ্যা রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। যা হোক, আমাদের অনুরোধে পটনায়কের সাথে মিলিত হবার ব্যবস্থা হলো। আমরা যখন তার অফিসে পৌঁছালাম তখন তার সামনেই ফাইলটা ছিল। সিএম আমাকে বললেন, ‘কালাম, আমি বিনামূল্যে পাঁচটা দ্বীপ তোমাকে দিলাম। (ডিআরডিও), যখন তুমি আমার কাছে একটা প্রতিজ্ঞা করবে তখনই আমি ফাইলে সই করে দেব।’ তিনি আমার হাতটা ধরে বললেন, ‘তোমাকে একটা মিসাইল তৈরি করতে হবে, যা দূরবর্তী স্থানের ভয় থেকে আমাদেরকে রক্ষা করতে পারবে।’ আমি জবাবে বললাম, ‘স্যার, আমরা এ কাজটা করবোই।’ আমি তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টা আমাদের ডিফেন্স মিনিস্টারকে জানালাম। চিফ মিনিস্টার ফাইলে সই করে দিলেন। ছোট্ট হুইলার দ্বীপটি আমরা পেলাম।

.

পাঠকদেরকে জানাতে চাই ২০১২ এর ২৬ এপ্রিল আইএসআরও সফলতার সাথে প্রথম রাডার ইমেজিং স্যাটেলাইট (আরআইএসএটি-১) উৎক্ষেপন করে। শ্রীহরিকোটা সতীশ ধাওয়ান স্পেস সেন্টার থেকে পোলার স্যাটেলাইট লঞ্চ ভিইকল (পিএসএলভি-সি১৯) উৎক্ষেপন করা হয়। স্যাটেলাইটকে মহাকাশের কক্ষ পথে পাঠানোর জন্য আরআইএসএটি-১) এর সি ব্যান্ড সিন্থেটিক অ্যাপেচার রাডার এর সোলার প্যানেল ও এন্টিনা প্যানেল সফলভাবে স্থাপন করা হয়েছিল। এছাড়াও একগুচ্ছ ফোর অরবিট-রেইজিং ম্যানোভার এর মাধ্যমে সফলভাবে পোলার সান সিনক্রোনাস অরবিট এ স্যাটেলাইটকে স্থাপন করা হয়। গঙ্গোত্রি থেকে গুণগত মানের ছবি পাঠাতে শুরু হয় ভোপাল এবং উত্তর কর্ণাটক ছাড়িয়েও ২০১২ এর ১ মে হতে।

মিশন বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে সক্ষম হয় আমি সংক্ষেপে তার কথা বলতে চাই। (আরআইএসএটি-১)

সিন্থেটিক অ্যাপেচার রাডার ভূপৃষ্ঠের ছবি র‍্যাডারের মাধ্যমে পাঠাতে শুরু করে। এর ফলে সূর্যের আলো ছাড়াও মেঘাচ্ছন্ন আকাশ থাকলেও ছবি পাবার সুযোগ সৃষ্টি হলো। আরআইএসএটি-১ এর বহুমুখী কাজের ফলে ইমেজিং রেজুলেশন হলো ১ থেকে ৫০ মিটার অন্যদিকে কভারেজ এরিয়া হলো ১০ কিলোমিটার থেকে ২২৩ কিলোমিটার। আরআইএসএটি-১ এর গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে ছিল কৃষি বিভাগের ধান,খরিফ শষ্যসহ বিভিন্ন কৃষিক্ষেত্রের ম্যাপ তৈরি করা। বন্যা, সাইক্লোন এর দুযোগের পূর্বাভাষ দিতেও আরআইএসএটি-১ কার্যক্ষমতা বিশাল। এছাড়াও আরআইএসএটি-১ এর কার্যক্রম বিবিধ।

এইসব সফলতার ফলে আমাদের আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল। আমি এছাড়াও বহুবিধ সফলতার খতিয়ান দিতে পারি। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় আংশিক মেঘলা দিনে নৌবাহিনীর বেঙ্গালুরুর লাইট কম্বাট এয়ারক্রাফট (এলসিএ)এর সাফল্যের কথা। এলসিএ এর প্রথম ফ্লাইট ছিল সফল। ভারত ‘স্কি টেক অব বাট এ্যারেস্টেড রিকোভারী’ (এসটিওবিআর) মাধ্যমে ডিজাইনিং, ডেভেলপিং, ম্যানুফ্যাকচারিং, টেস্টিং এর ফোর্থ জেনারেশন ক্যারিয়ার বোর্ন ফ্লাই এর দেশগুলোর অন্তর্ভুক্ত হয়ে এলিট ক্লাবে যোগদানের মর্যাদা লাভ করলো। নৌবাহিনী প্রথম চেষ্টা করে স্বয়ং সম্পূর্ণ মেরিন ফোর্স হিসাবে গড়ে উঠতে যাতে একুশ শতকে ভারতীয় নৌবাহিনী যুদ্ধের নিপুণ ক্ষমতার অধিকারী হতে পারে।

ইনফরমেশন টেকনোলজি আর কমুনিকেশন টেকনোলজির মাঝেই চরম উন্নতি অর্জন করতে পেরেছে। ইনফরমেশন টেকনোলজি ও বাইয়োটেকনোলজির মেলবন্ধনে বায়ো-ইনফরমাটিক সৃষ্টি হয়েছে। অনুরূপভাবে, ফটোনিক্স ল্যাব থেকে ক্লাসিকাল ইলেকট্রোনিকস ও মাইক্রোইলেকট্রোনিকসে পৌঁছে গেছে। ভোক্তাদের কাছে তা নতুন মাত্রা পেয়েছে। এখন ন্যানোটেকনোলজির যাত্রা শুরু হয়েছে। ভবিষ্যতে মেডিসিন, ইলেকট্রোনিকস আর ম্যাটারিয়াল সায়েন্সে নতুন যুগের সূচনা হবে।

যখন ন্যানোটেকনোলজি আর আইসিটি একসাথে মিলিত হয়ে সিলিকন,ইলেক্ট্রোনিক,ফটোনিক্স পরষ্পরের সাথে সম্পর্কিত হবে। এ থেকে বলা যেতে পারে যে ম্যাটারিয়াল কনভার্জেন্স ঘটবে। ম্যাটারিয়াল কনভার্জেন্স আর বায়োটেকনোলজি একত্রিত হয়ে একটা নতুন বিজ্ঞানের সৃজন হবে, যাকে বলা যেতে পারবে ইনটেলিজেন্ট সায়েন্স। বায়োসায়েন্সের সৃজনের ফলে রোগমুক্ত সমাজের উদ্ভব ঘটবে, আর এর ফলে মানুষ দীর্ঘজীবী হবার ক্ষমতা অর্জন করবে।

কনভার্জেন্স অব সায়েন্স হচ্ছে পারস্পরিক সম্পর্কিত। আমাকে একটা উদাহরণ দেবার অনুমতি দিতে পারেন। সম্প্রতি, আমি হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে ছিলাম। সেখানে আমি ল্যাবরেটোরিগুলো পরিদর্শন করি। ওখানে হার্ভার্ড স্কুল অব ইঞ্জিনিয়ারিং এবং অ্যাপলায়েড সায়েন্স থেকে আসা বহু প্রখ্যাত প্রফেসরদের সাথে আমি মিলিত হই। আমার স্মরণ আছে প্রফেসর হংকুন পার্ক আমাকে দেখান তার আবিষ্কৃত ন্যানো নিডিলস, যা কারো স্থিরিকৃত সেলগুলো প্রবেশ করতে পারে ওষুধ ঢুকানোর জন্য। ওইটা হচ্ছে ন্যানোপার্টিকেল সায়েন্স যা বায়োসায়েন্সের সাথে সম্পর্কিত। তারপর আমি প্রফেসর বিনোদ মনোহরণ এর সাথে মিলিত হই, তিনি আমাকে প্রদর্শন করেন কিভাবে বায়োসায়েন্স ন্যানোম্যাটারিয়ালে রূপ নেয়। তিনি ডিএনএ ম্যাটারিয়ালকে ব্যবহার করে সেল্ফ অ্যাসেম্বলিং পার্টিকেলস এর ডিজাইন আমাকে দেখান। যখন একটা নির্দিষ্ট ধরনের ডিএনএ একটা পার্টিকেলে এটোমিক লেভেলে প্রয়োগ করা হয় তখন তা থেকে পূর্ব নির্ধারিত আচরণ প্রকাশ পেয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মিলিত হয়। এটাই স্বয়ংক্রিয়ভাবে মিলিত হবার ডিভাইস হিসাবে বিবেচিত হতে পারে। মধ্য মহাকাশে মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই কলোনি গড়ার ডিভাইস হতে পারে এটা, যা ড. কে. এরিক ড্রেক্সলার এর বিবেচিত বিষয়। আমি দেখতে পেলাম কিভাবে দুটো পৃথক সায়েন্স একে অপরের সাথে মিলিত হতে পারে। বিজ্ঞানের পারস্পরিক মিলিত শক্তির ভবিষ্যত আমাদের জন্য কল্যাণকর হতে পারে।

পরিশেষে বলতে হয়, টেকসই পদ্ধতিগুলো আমাদের উন্নতির জন্য কার্যকর হবে, পদ্ধতিগুলোর মধ্যে টেকনোলজির ভূমিকাই হবে সবচেয়ে প্রধান। এটা হবে একুশ শতাব্দীর জ্ঞানভিত্তিক সমাজের নতুন দিকদর্শন। সে সময় বিজ্ঞান, টেকনোলজি আর পরিবেশ এক সাথে মিলে মিশে অবশ্যই কাজ করবে। এভাবেই বায়ো-ন্যানো-ইনফো-ইকো এই চারটি দিকদর্শন ভিত্তিক নতুন যুগের সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে।

[আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করতে পছন্দ করি আপনার কি এসব পছন্দ করতে মনে লাগে? আপনার এ বিষয়ে লেখা উচিত। তা হতে পারে একটা গুরুত্বপূর্ণ অবদান, একটা আবিষ্কার, একটা উদ্ভাবন কিংবা একটা পরিবর্তন যা আপনি সমাজকে দিতে পারেন যার জন্য জাতি আপনাকে মনে রাখবে।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *