৬। অন্যান্যদের কাছ থেকে শিক্ষালাভ

৬. অন্যান্যদের কাছ থেকে শিক্ষালাভ

যাদের কেউ নেই আমি তাদের রক্ষক হতে পারি
ভ্রমণকারীদের জন্য হতে পারি পথপ্রদর্শক।
আমি সেতু, নৌকা ও জাহাজ হতে পারি
যারা নদী পার হতে চায় তাদের জন্য।

– আচার্য শান্তিদেব
৮ম শতাব্দীর বৌদ্ধ পন্ডিত

আমি সর্বদাই আমার মনটাকে সৃজনশীল কাজের দ্বারা ভরিয়ে তুলতে চাইতাম। এটা সহজ কাজ ছিল না। রকেট আর মিসাইলের উন্নয়নের জন্য একটা দলের প্রচুর কাজ করতে হয়। আমি চিন্তা করছিলাম মানুষের উন্নতির জন্য। ইন্ডিয়া ২০২০ ভিশন বাস্তবায়নের জন্য আমি ভাবনায় ছিলাম। রাষ্ট্রপতি হবার পর আমি অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ লাভ করি। সমস্ত রকমের মতামত আর জিজ্ঞাস্য বিষয়গুলো মানুষের জ্ঞানভাণ্ডারকে ঋদ্ধ করে। আমার জীবনকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল আমার জীবনের এমন কয়েকটি ঘটনা এখানে বর্ণনা করতে পারি।

উপহারগুলো আমার জীবনে গভীরভাবে রেখাপাত করে।

আমি এইসব ঘটনা সংক্ষেপে বর্ণনা করবো। আমার পিতা জনাব আভুল পাকির জয়নুল আবেদিন আমার বালক বয়সে আমাকে যথাযথভাবে শিক্ষাদান করেছিলেন। ১৯৪৭ এ ভারত স্বাধীন হবার পরের ঘটনা সেটা। রামেশ্বরম পঞ্চায়েতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। আমার পিতা ভিলেজ কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট হলেন। তিনি নির্দিষ্ট ধর্ম ও সম্প্রদায় এবং আর্থিক স্বচ্ছলতার কারণে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন না। তিনি তার মনের মহানুভবতার জন্য প্রেসিডেন্ট হন। যেদিন আমার পিতা প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হলেন সেদিনই একজন মানুষ আমাদের বাড়িতে এলেন। আমি তখন স্কুলে পড়ি। আমি জোরে জোরে পড়ছিলাম। এক সময় আমি আমার দরজা ধাক্কা দেবার শব্দ শুনতে পেলাম। সেই সবদিনে রামেশ্বরমে আমরা কখনো দরজা বন্ধ করতাম না। একটা লোক আমার ঘরে ঢুকে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন যে আমার বাবা কোথায়। আমি তাকে বললাম বাবা এশার নামাজ পড়ছেন। তারপর তিনি আমাকে বললেন যে তিনি আমার বাবার জন্য কিছু জিনিস এনেছেন। জিনিসগুলো কোথায় রেখে যাবেন, তা তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন। আমি তাকে সেগুলো চৌকির উপর রেখে যেতে বলে আমি পড়ায় মন দিলাম।

আমার বাবা ফিরে এসে চৌকির উপর একটা রূপোর প্লেটে কিছু উপহারসামগ্রী দেখতে পেলেন। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন কে এগুলো রেখে গেছে। আমি বললাম একটা লোক এসে এগুলো রেখে গেছেন। তিনি উপহারগুলো খুলে দেখলেন তার মধ্যে দামী কাপড়চোপড় আর কয়েকটা রূপোর কাপ, কিছু ফলমূল আর কিছু মিষ্টি আছে। তিনি উত্তেজিত হয়ে উঠে এক পর্যায়ে রেগে গেলেন। আমি তার ছোট সন্তান। আমার বাবা আমাকে ভালোবাসেন। আমিও তাকে বড় ভালোবাসি। আমি প্রথম বাবাকে এমন রাগ করতে দেখলাম। আমি সেবারই তার হাতের মার খেলাম। আমি ভয়ে কেঁদে ফেললাম। পরে আমার বাবা আমাকে তার রাগের কারণ ব্যাখ্যা করে আমাকে উপদেশ দিলেন এই বলে যে তার অনুমতি ছাড়া কারো উপহার না নিতে। তিনি হাদিস থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বললেন, ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহ যখন একজন মানুষকে একটা পদ দান করেন তখন তিনিই তার হেফাজত করে থাকেন। যদি একজন মানুষ সর্বশক্তিমানের দেওয়া দানের ক্ষমতা বলে কারো কাছ থেকে কোন উপহার গ্রহণ করে তবে তা অবৈধ অর্জন হিসাবে বিবেচিত হয়।’

তারপর তিনি আমাকে বললেন যে কোন উপহার গ্রহণ করা ভালো অভ্যাস নয়। সব সময়ই উপহার দেবার মধ্যে একটা উদ্দেশ্য নিহিত থাকে, তাই এগুলো বিপদজনক জিনিস। এটা সাপের গায়ে হাত দেবার সমতুল্য। সাপের গায়ে হাত দিলে সাপ বিষ ঢালবে তাতে বিচিত্র কী। বাবার এই শিক্ষা আশি বছর বয়সে আজও আমার মনে গাঁথা হয়ে আছে। সেই ঘটনাটা আমার মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে আর তার ফলে আমার মধ্যে এটা মূল্যবোধ হয়ে গড়ে উঠে। এমনকি এখনও কোন মানুষ উপহার সামগ্রী নিয়ে আমার সামনে উপস্থিত হলে আমার শরীর ও মন কেঁপে উঠে।

পরবর্তী জীবনে আমি মনু স্মৃতি বা মনুর আইন— হিন্দু চিন্তাচেতনা মৌলিক গ্রন্থ পাঠ করি। সেই গ্রন্থে উপহার গ্রহণ সম্পর্কে পরিষ্কার করে বলা হয়েছে। মনু প্রত্যেক ব্যক্তিকে সাবধান করে দিয়েছেন এই বলে যে দান গ্রহণের ফলে দানগ্রহীতাকে দাতার কাছে দায়বদ্ধ থাকতে হয়। দাতা সুযোগ বুঝে গ্রহীতার কাছ থেকে অবৈধ ও অনৈতিক ফায়দা আদায় করে নেয়।

শিক্ষার মূল্যবোধ সৃষ্টির পদ্ধতি

কয়েক মাস আগে আমার বড় ভাই বয়স তখন নব্বই বছর রামেশ্বরম থেকে আমাকে ফোন করেন। ইউনাইটেড স্টেটস থেকে বেড়াতে আসা আমার এক বন্ধুর প্রসঙ্গে আমার সাথে তিনি আলাপ করলেন। বন্ধুটি আমার বড় ভাইয়ের সাথে আলাপ আলোচনা কালে আমার বড় ভাইকে জিজ্ঞেস করেন, আপনাদের বাড়িটা এত পুরনো কেন? ভাই জবাবে বলেন, “বাড়িটা আমার বাবা একশ’ বছরেরও বেশি সময় আগে তৈরি করেছিলেন। আমার ছোট ভাই ও আমার উপার্জনক্ষম নাতি ছেলেরা বাড়িটা ভেঙ্গে নতুন একটা বাড়ি বানানোর প্রস্তাব দিয়েছে।” আমার বন্ধুটি তাকে বললেন যে তিনি এই ঐতিহাসিক বাড়িটা ভেঙ্গে ফেলা হোক তা চান না। তিনি বাড়িটাকে একটা ট্রাস্টের মাধ্যমে একটা জাদুঘর, একটা লাইব্রেরিতে রূপান্তর করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। অন্যদিকে, আমার ভাই ও তার পরিবারবর্গের বসবাসের জন্য আর একটা বাসস্থানের ব্যবস্থা করার জন্য তিনি তাকে পরামর্শ দিলেন। আমার বড় ভাই জানালেন যে তিনি আমার বন্ধুর প্রস্তাবের সঙ্গে একমত নন। আমি যে বাড়িটাতে বড় হয়েছি এবং নব্বই বছর কাল কাটিয়েছি সেই বাড়িটাকে জাদুঘর বানাতে পারি না। আমি ওই জায়গাটিতেই আমার আত্মীয়-পরিজনদের উপার্জিত অর্থে একটা নতুন বাড়ি বানাতে চাই। আমি এ ছাড়া অন্য কোন কিছু করতে চাই না। তুমি তোমার বন্ধুকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ধন্যবাদ জানিও।’ এই কথাগুলো আমার মনে গভীরভাবে দাগ কাটলো। ওখানটাতে একটা মানুষ কারো সাহায্য ছাড়াই তার নিয়মে জীবন কাটিয়ে আসছেন। এটা আমার জন্য একটা বড় শিক্ষা। আমি আমার বড় ভাইয়ের মধ্যে আমার পিতার আদর্শের প্রতিফলন দেখতে পেলাম। আমার পিতা আমাদেরকে নিয়ে একটা ঐতিহ্যকে ধারণ করে ১০৩ বছর বেঁচে ছিলেন।

একজন হজ্জ্বযাত্রী

ব্যস্ত একটা দিন। আমার সাথে সাক্ষাতের জন্য অনেক মানুষ এসেছিলেন। বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়া আর ফাইলগুলোতে মতামত দেবার কাজে ব্যস্ত ছিলাম। সেই মুহূর্তে আমার ভাইয়ের নাতি মক্কা থেকে ফোন করলো। সে একটা বিশাল বড় কাজের ব্যবস্থা করেছে। সেই কাজটা ছিল আমাদের পরিবারের তিন জন সদস্যকে তীর্থযাত্রায় যাবার ব্যবস্থা করা। সে আমাদের তিন প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করছে। নব্বই বছর বয়সী আমার বড় ভাই তার মেয়ে ও নাতি সাথে নিয়ে চেন্নাই থেকে ২০০৫ এর শেষ দিকে হজ্জ্ব করতে গিয়েছিলেন।

এই হজ্জ্বযাত্রা আমার মনে বিশেষভাবে রেখাপাত করলো। ভাইয়ের হজ্জ্বে যাবার ইচ্ছে পূরণ হওয়ায় আমি খুবই খুশি হলাম। আমার ভাইদের হজ্জ্বে যাবার সম্বন্ধে জ্ঞাত হবার জন্য সৌদি আরবে আমাদের দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত রাষ্ট্রপতিভবনে আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। আমার ভাইদেরকে প্রয়োজনীয় সাহায্য করার প্রস্তাব তিনি আমার কাছে রাখলেন। আমি তাকে বললাম, ‘রাষ্ট্রদূত মহোদয়,আমার ভাইয়ের একটা অনুরোধ আছে যে তারা কোন প্রকার সরকারি সাহায্য ছাড়াই সাধারণ নাগরিক হিসাবে হজ্জ্বে যেতে চান। এটা তার ব্যক্তিগত ইচ্ছা। আমার ভাই আমাকে বলেছেন যে তিনি হজ্জ্ব যাত্রার জন্য হজ্জ্ব কমিটির দ্বারা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মনোনীত হয়ে হজ্জ্বে যেতে ইচ্ছুক। তার নাতি ব্যক্তিগতভাবে স্বাভাবিক পদ্ধিতে আবেদন জমা দিয়েছে। আল্লাহর রহমতে তারা হজ্জ্ব কমিটির স্বাভাবিক নিয়ম মেনেই তাদেরকে হজ্জ্বে যাবার ব্যবস্থা করেছে। আমি আমার ভাইয়ের মেয়ে এবং তার নাতিকে বললাম হজ্জ্ব পালন কালে ভাইকে দেখাশোনার কথা বললে আমার ভাই তাতে বিরক্তি প্রকাশ করলেন। তিনি তার নাতিকে তার দায়িত্ব নিতে নিষেধ করলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে হজ্জ্ব পালন কালে তার নাতি প্রবল জ্বরে আক্রান্ত হলো। আমার ভাই এই অবস্থা মোকাবিলার দায়িত্ব গ্রহণ করলেন বাড়িতে কোন সমস্যা হলে যেমনটা দায়িত্ব তিনি নিয়ে থাকেন সেভাবেই। তিনি মসজিদে গেলেন, খাবার সংগ্রহ করলেন এবং তিনি নিজেই ডাক্তারকে খবর দিলেন। তার নাতি আমাকে বলেছিল যে তিনি তার পাশে দাঁড়িয়ে তিন ঘন্টা নামাজ আদায় করেন। তারপর তার নাতি আরোগ্য লাভ করে আবার হজ্জ্বের বিধিবিধান পালন করেছিল। হজ্জ্ব পালনের শেষ দিকে কী কী ঘটনা ঘটেছিল তার নাতি আমাকে বিস্তারিতভাবে বলতে লাগলো। মিনায় তাবুতে থাকার পর তাদেরকে আরাফাতের উদ্দেশ্যে রওনা হতে হয়। আরাফাতে পাঁচ মিলিয়ন হাজী জমায়েত হন। আমি কল্পনা করতে পারি আমার ভাই সেখানে তার হাত দু’খানা উপরের দিকে তুলে নামাজ আদায় করেছিলেন। একদিন নাতি গ্রান্ড মসজিদের উপর তলা থেকে নামাজ আদায় করে ফিরছিল। দুর্ঘটনা এড়াবার জন্য হাজীরা এক্সালেটরের সিঁড়িতে পা রেখে নিচে নেমে আসছিলেন। এতো লোকের মধ্যে সিঁড়িতে পা রাখা কষ্টকর ব্যাপার ছিল। নাতিটি জনতার জটলার হাত থেকে বাঁচার জন্য দেওয়ালের সাথে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়েছিল। সে ভালোভাবে নিঃশ্বাস নিতে পারছিল না। হঠাৎ করে সে অনুভব করলো চাপটা বেশ একটু কমেছে, তার চারপাশটা বেশ ফাঁকা। সুস্বাস্থ্যের অধিকারী একজন আফ্রিকান তাকে ভিড়ের মাঝ থেকে রক্ষা করতে ছুটে এলো। এর মাঝে তারা গ্রাউন্ড ফ্লোরে পৌঁছে গেল। তাকে ধন্যবাদ দেবার আগেই সেই হাজীটি ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেলেন।

দ্বিতীয় দুর্ঘটনাটা ছিল আরো মর্মান্তিক। আরাফাত থেকে নামাজ আদায় শেষ করে তারা মিনা ফিরে আসছিলেন। একই দিনে ১৫ মিলিয়ন হাজী ১৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সোজা মিনাতে ফিরে আসতে হয়। তাদের গাড়ির এয়ারকন্ডিশন ব্যবস্থা বিকল হয়ে যাওয়ায় মরুভূমির প্রচণ্ড উত্তাপ তাদেরকে সহ্য করতে হয়। আমার ভাই পানি ও খাবার খাওয়া থেকে বিরত থেকে সারাটা পথেই নামাজ পড়েন। গাড়ি ইঞ্চি করে এগোচ্ছিল। মিনায় পৌঁছাতে আট ঘন্টা সময় লাগে। ড্রাইভার পরিশেষে এক সময় তাদেরকে বাকী পথ পায়ে হেঁটে চলার জন্য পরামর্শ দেন। তাদেরকে আধা ঘন্টা পায়ে হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে। ভাই সেই পরামর্শ মতো চলার সিদ্ধান্ত নিলেন। ভাইয়ের অনিচ্ছা সত্ত্বেও নাতি তাকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে রওনা হলো। পথে সংকীর্ণ ছোট্ট একটা ভাঙ্গা। ভাই হুইলচেয়ার থেকে নেমে ওই জায়গাটা হেঁটে পার হচ্ছিলেন। দু’জন হাজী ভাইকে রাস্তার মাঝে বসে পড়তে দেখলেন। নাতি কিছু বলার আগেই সেই দু’জন হাজী ভাইকে হুইলচেয়ারে তুলে ওই জায়গাটা পার করে দিলেন। তাদেরকে ধন্যবাদ দেবার মতো সময় তারা আমার ভাইকে দিল না।

জায়গাটার নাম মুজদালিফা, তারা সেখানে খোলা জায়গায় রাত কাটালেন। মরুভুমির কনকনে ঠাণ্ডা রাত। তারা শুধুমাত্র একটা মাদুর পেতে সেখানেই রাত্রি যাপন করলেন। তাদের গায়ে ছিল শুধুমাত্র পাতলা কাপড়। পরদিন সকালে প্রাতকৃত্য সারার জন্য বিরাট লাইন। প্রত্যেক লোকই নিজের পালার জন্য অধীর আগ্রহে ধৈর্যের সাথে অপেক্ষা করছিলেন। অপর আর একটা লাইনে একজন ভদ্রমহিলা প্রায় এক ঘন্টা অপেক্ষা করছিলেন। একজন তরুণী মেয়ে সাঁড়ি থেকে এগিয়ে এসে ভদ্র মহিলাটিকে সরে গিয়ে তাকে ভিতরে যাবার অনুমতি চাইলেন। সাঁড়িতে দাঁড়ানো অন্যান্য মহিলারা মেয়েটিকে ভিতরে যেতে দিতে বলায় তিনি মেয়েটিকে ভিতরে যেতে দিলেন। এই ঘটনার কিছু সময় পর একজন বৃদ্ধ ভদ্রমহিলা এগিয়ে এসে তাকে আগে ভিতরে যেতে দেবার জন্য দাবি করলেন। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন এই দৃশ্য দেখে ভাবলো ওই মহিলাটি আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবে। তাদের মনে হলো এবার দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষমান মহিলাটি বৃদ্ধ ভদ্রমহিলাটিকে ভিতরে যেতে এবার হয়তো দিবেন না। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার তিনি তাৎক্ষণিকভাবে বৃদ্ধ মহিলাটিকে ভিতরে যাবার ব্যবস্থা করে দিলেন। একজন ভাবলেন, তারা একে-অপরের ভাষা বোঝে না। শুধুমাত্র ঈশারার উপর নির্ভর করে তারা চলেন। এই দৃশ্যাবলী থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে একটা ছোট্ট ঈশারাও আমাদের জীবনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।

সঙ্গীদের প্রতি ভালোবাসা দেখিয়ে মানুষ নদীর মতো বহমান হতে পারে। সমস্ত রকমের ভেদাভেদ মুছে ফেলতে পারে। আমার ভাইয়ের মেয়ে নাজিমা আর নাতি গোলাম কে. মঈনউদ্দিনের বর্ণনা থেকে সেই কথাই আমি জানতে পেরেছিলাম

ফিল্ড মার্শাল স্যাম মানেকশ

২০০৬ এ আমি কোইম্বাটুর সফর কালে ফিল্ড মার্শাল মানেকশ এর কাছ থেকে রাষ্ট্রপতিভবনে একটা টেলিফোন আসে। বিষয়টা আমাকে জানানো হলে আমি বললাম, আমি অবশ্যই ওয়েলিংটনের আর্মি হাসপাতালে তাকে দেখতে যাব। তারপর তার সাথে আমার প্রথম মিলিত হবার কথা মনে ভেসে উঠলো।

১৯৯০ এ একদিন আমি ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনস এর বিমানে ভ্রমণ করছিলাম। আমি আমার পাশে এস, এইচ, এফ. জে স্যাম মানেকশ কে দেখতে পেয়ে আমি তার কাছে নিজেকে আরএম(রক্ষা মন্ত্রী অর্থাৎ ডিফেন্স মিনিস্টার) এর বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা হিসাবে নিজের পরিচয় দিলাম। আমি এই কথা বললে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তিনি কি তার ভালো সফর সঙ্গী?’ তারপরই তিনি আমাকে বললেন ‘আপনার বয়স কত হলো?’ আমি বললাম যে আমার বয়স উনষাট বছর। তিনি সেকথা শুনে বলে উঠলেন, ‘সবে বাচ্চা মাত্ৰ। আমি ভাবতেই পারি নি তিনি আর্মড ফোর্সের সুপ্রিম কমান্ডার মানেকশ। আমি তার রুমে প্রবেশ করা মাত্র তিনি প্রত্যেককে বাইরে যেতে বললেন। তিনি আমাকে কাছে বসিয়ে আমার হাতটা নিজের হাতের মাঝে নিয়ে বললেন, ‘তুমি কেমন ধরনের রাষ্ট্রপতি আমি ক্ষমতায় নেই তবুও তুমি আমাকে সম্মান করছো।’ তিনি আমাকে কাছে পেয়ে বড়ই খুশি হলেন। তিনি তখন বেশই বৃদ্ধ, শয্যাশায়ী অবস্থায় দিন কাটাচ্ছিলেন। তখন পর্যন্ত তার মনটা আমাদের সেনাবাহিনীর উন্নতির জন্য ভাবিত ছিল। তিনি বললেন, ‘তা ক্রমে ক্রমে শক্তিশালী হবে। একটা মজার প্রশ্ন করলেন, ‘কালাম, তুমি কি আমাকে বলতে পার অন্যদশকে বর্তমানের অস্ত্রপাতি কি অকেজো হয়ে পড়বে না? আর তার জায়গায় ইলেক্ট্রোনিক আর সাইবার যুদ্ধাস্ত্র স্থান করে নেবে না? মানেকশ এর এই প্রশ্ন আমার মনে গভীরভাবে রেখাপাত করলো। আমি একজন আধ্যাত্মিক নেতার সাথে মিলিত হবার পর পৃথিবী নিউক্লিয়ার অস্ত্রের দিকে ধাবিত হচ্ছে এই বিষয়টা নিয়ে তার সাথে আলোচনা করেছিলাম। আমি ফিল্ড মার্সালকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমি আপনার জন্য কী করতে পারি?’ তিনি বললেন ‘আমি জানি না, তবে একটা জিনিস তোমাকে আমি বলতে চাই, দেশের একজন ফিল্ড মার্শাল কিংবা সমমর্যাদার একটা জাতির জন্য বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।’ তার এই মন্তব্যও আমার মনে গভীরভাবে দাগ কাটলো।

আমি দিল্লি ফিরে এসেই প্রধানমন্ত্রীর সাথে অন্যান্য বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং এ বসলাম। আমি প্রধানমন্ত্রীকে বললাম দেশের জন্য ফিল্ড মার্শাল মানেকশয়ের চরমতম সেবাদানের জন্য তার প্রতি আমাদের আরো অনেক কিছু করা প্রয়োজন। ওই দিনই সফররত বিদেশি অভ্যাগতদের সম্মানে আয়োজিত ডিনারে উপস্থিত আর্মি চিফ ও এয়ার চিফের সাথে আমি মিলিত হলাম। এয়ার ফোর্স চিফ গুরুত্ব দিয়ে বললেন যে ফিল্ড মার্শাল মানেকশ ও বিমান বাহিনীর অর্জুন সিং এর প্রতি যথাসাধ্য সম্মান প্রদর্শন করা প্রয়োজন। আমি তাৎক্ষণিকভাবে আমার সেক্রেটারি পিএম নায়ারকে তলব করলাম প্রয়োজনীয় নোট তৈরি করে জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠানোর উদ্দেশ্যে। সরকার স্বাদরে আমার প্রস্তাব গ্রহণ করলো। দেশের জন্য তার অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তার ভাতার পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া হলো। ফিল্ড মার্শাল মানেকশয়ের জীবিত কালেই তার অবদানের স্বীকৃতি দেওয়ায় আমি খুশি হলাম।

অনুকরণীয় খুশবন্ত সিং

আমি খুশবন্ত সিং এর সাথে মিলিত হয়ে বিশেষ অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম। সে সময় তার বয়স ছিল নব্বই। আমি তার লেখা বেশ কয়েকটা বই ততদিনে পড়ে ফেলেছি। ‘হিন্দুস্তান টাইমসে’ তার কলাম আমি নিয়মিত পড়ি। আমাকে অনেকেই প্রশ্ন করলেন কেন আমি তার সাথে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলাম। তাদের প্রশ্নের জবাবে আমি বললাম, আমি বিশেষভাবে তার লেখা বই পছন্দ করি। খুশবন্ত সিং একজন নিবেদিত লেখক নব্বই বছর বয়সেও। তিনি ২০০৭ পঁচানব্বই বছর বয়সেও তিনি আমাকে নিয়ে লিখেছেন। তার মতামত আর আমার মতের সাথে যে বিষয়ে মিল পেয়েছিলাম তার সংক্ষিপ্ত সার তুলে ধরছি।

কয়েক মাস আগে প্রজাতন্ত্রের একাদশতম রাষ্ট্রপতি তার পুরো পাঁচ বছর মেয়াদ উত্তীর্ণ করে অবসর গ্রহণ করেছেন। তিনি তৃতীয় মুসলিম রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে আসীন ছিলেন। এটাকে ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের নিদর্শন হিসাবে আমরা দাবি করতে পারি। আমাদের প্রতিবেশিদের এটা শিক্ষণীয় বিষয় হতে পারে।

তিনি বৈজ্ঞানিক গবেষণা কর্মে, কোন না কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যাবেন, না সন্ন্যাস নিবেন সে বিষয়ে আমার কোন ধারণা নেই। তার সাথে আমার আধা ঘন্টা কাটানোর সুযোগ হয়েছিল। তিনি আমার বাসায় এসে আমাকে সম্মানীত করেছিলেন। রাষ্ট্রের প্রধান একজন সাধারণ কলমজীবীর বাসায় আগমন করায় তার মানবিক গুণাবলীর কথা অনেকেরই মুখে মুখে ফেরে।

আমরা তামিল খুব কমই জানি। তিনি একজন তামিল। আমি তামিল ভাষার দুটো শব্দ জানি, সেই শব্দদুটো হচ্ছে ভেনাক্কাম ও অই-ইয়ো। যদিও কালাম প্রগাঢ়ভাবে একজন ধার্মিক মানুষ। আমি একজন অজ্ঞেয়বাদী,আমি বিশ্বাস করি বিজ্ঞান আর ধর্ম এক সাথে চলতে পারে না। একটা কার্যকারণের উপর প্রতিষ্ঠিত আর অপরটি বিশ্বাসের উপর। আমি তার সাথে কথা বলে এবং তার লেখা বইপত্র পড়ে জেনেছি, তার ধর্মীয় বিশ্বাস মহাত্মা গান্ধীর মতো। বাপুর সবকিছুকে আমি গ্রহণ করতে অপারগ হলেও আমি নিজেকে একজন গান্ধীয়ান বলে বিবেচনা করি। কালাম আমাকে দেখান বিজ্ঞান ও ধর্মের মধ্যে কোন বিভেদ নেই। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম যদি আপনি বিশ্বাস করেন বিচারের দিনের পুরস্কার কিংবা শাস্তির বিষয়ে, তবে আমাদেরকে পরকালের কথা অবশ্যই ভাবতে হবে। তিনি জবাবে বললেন, ‘স্বর্গ ও নরক মনের মধ্যে…’

তাহলে ঈশ্বর সম্বন্ধে কালামের কনসেপ্ট কী? তার ধারণাটা আল্লাহ বনাম ঈশ্বর, খুদা ভগবান নয়। তিনি মসজিদ কিংবা মন্দিরের খোঁজ করেন না; তিনি লড়াই করে শহীদ হতে চান না বিভিন্নধর্মের প্রধানদের মতো। অন্যেরা একে- অপরের রক্ত ঝরায় ঈশ্বরের নামে গর্জন করে।

হঠাৎ আলোর ভিতর থেকে মেঘের একটা গর্জন,
আমি তোমাদের কারোই নই! সবাই শোন!
‘ভালোবাসা আমার মিশন আর তোমরা সময় কাটিয়ে দিলে ঘৃণা প্রকাশ করে,
আমার আলোকে হত্যা করে তোমরা জীবনকে রুঢ় করো
তোমরা সবাই জেনে রাখ : খোদা আর রাম
উভয়েই এক, ভালোবাসায় প্রস্ফুটিত।’

কোন যুক্তিবাদী কালামের স্বর্গ সম্পর্কিত ভিশনের বিরুদ্ধাচারণ করতে পারি না। কেউ কেউ বলেন ঈশ্বর সত্য, অন্যরা বলেন ভালোবাসা। ঈশ্বরত্ব সম্পর্কে কালামের কনসেপ্ট হচ্ছে অপরের দুঃখে দুঃখবোধ করা…

আমি তার লেখা থেকে উদ্ধৃতি করছি কারণ আমি মনে করি একজন লেখকের পক্ষে দুষ্প্রাপ্য সম্মান যিনি তার অধিকাংশ সময় ব্যয় করেছেন আমার কাজ বিশ্লেষণ আর ঈশ্বর, ধর্ম সম্বন্ধে আমার পন্থায় চিন্তাভাবনা করেছেন যা থেকে উত্তম মানুষের উদ্ভব ঘটে।

আমাদের অর্জনকে বিলিয়ে দেওয়া

আপনাদের অনেকেই সম্পদের অধিকারী হতে পারেন। এখানে আমি একজন মহান মানুষের গল্প বলবো। তিনি পৃথিবীতে সুখে শান্তিতে স্বাধীনভাবে বসবাস করেন। আমি ২০০৭ এ সিদ্ধাগঙ্গা মঠে শ্রী শ্রী শিবাকুমারা স্বামীগালু এর ১০০ বছর পূর্তি বার্ষিকী উদ্বোধন করার জন্য আমাকে ব্যক্তিগতভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়। আমি সেখানে পৌছে দেখলাম সেখানে বিশাল জমায়েত। লাখ লাখ ভক্ত উপস্থিত হয়ে ভক্তি জানাচ্ছে। ডায়াসে অনেক রাজনৈতিক নেতা ও আধ্যাত্মিক গুরুরা উপবিষ্ট আছেন। তারা সবাই বক্তব্য পেশ করার পর স্বামীজী হাতে কোন কাগজপত্র না নিয়েই বক্তব্য দেবার জন্য উঠলেন। তিনি ভক্তদেরকে আশীর্বাদ করে জ্ঞানগর্ভ ভাষণ দিলেন। আমি এই দৃশ্য অবলোকন করে বিস্মিত হলাম। ১০০ বছরের বৃদ্ধ ভবিষ্যতদ্রষ্টা একইভাবে হাসি হাসি মুখে বক্তৃতা দিলেন। আমার মনের মধ্যে এক ধরনের অনুসন্ধিৎসা জাগলো তিনি কেমন করে এতটা উদ্দীপনার সঙ্গে এত সুন্দর বক্তব্য পেশ করলেন। আমি ভাবলাম মুক্ত মনে বক্তব্য দেবার কারণে এটা তার পক্ষে সম্ভব হয়েছে। তিনি শত শত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অনেক অনাথ আশ্রম প্রতিষ্ঠিত করেছেন। প্রতিদিন তিনি হাজার হাজার দরিদ্র মানুষের খাবার যোগান। সেবা প্রদানের অক্লান্ত কার্যক্রমের জন্য নিরক্ষতা দূরীকরণ করতে পেরেছেন। ফলে এই এলাকার ছিন্নমূল মানুষেরা বিশেষভাবে উপকৃত হয়েছে। আমি তার উদ্দেশ্যে লিখলাম।

আমি কী দিতে পারি?
ওহ আমার সাথী দেশবাসী,
সুখ দিলে তোমরা সুখ পাবে
শরীর আর মনে।
তোমাদেরকে সব কিছু দেওয়া হবে,
যদি তোমাদের জ্ঞান থাকে তবে ভাগ করে নাও।
যদি তুমি সম্পদশালী হও, তবে অভাবীদেরকে ভাগ দাও।
তোমার মন আর হৃদয়কে ব্যবহার করো।
কষ্টে আছে যারা তাদের কষ্ট দূরে হঁটিয়ে দাও
কষ্টে ভরা হৃদয়কে উৎফুল্ল করে তোলো।
কিছু দান করলে তুমি সুখ পাবে।
তোমার সব কাজের জন্য সর্বশক্তিমান তোমাকে আশীর্বাদ করবেন।

প্রধানমন্ত্রীর সাথে মতবিনিময়

আমি প্রধানমন্ত্রীর সাথে ডিআরডিআই এর ডিরেক্টর,ডিফেন্স মিনিস্টারের বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা, ক্যাবিনেটের প্রধান বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা এবং ভারতের রাষ্ট্রপতি হিসাবে মতবিনিময় করেছিলাম। বহু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি যেমন ড. সতীশ ধাওয়ান, ড. রাজা রামান্না, ড. ভি. এস. অরুণাচলম, আর. ভেঙ্কাটারমন, পি. ভি. নরসীমা রাও, এইচ. ডি. দেবে গৌড়া, আই. কে গুজরাল, অটল বিহারী বাজপেয়ী ও ড. মনমোহন সিং এর সাথে আলাপ আলোচনার সুযোগ হয়েছিল। তাদের সঙ্গে মতবিনিময় অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছিল। তারা আমার মনে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল। আমার বস এবং আইএসআরও এর চেয়ারম্যান ড. সতীশ ধাওয়ানের কাছ থেকে শিখেছিলাম জটিলতর সমস্যার মুখোমুখি হলে চ্যালেঞ্জের জবাব দিয়ে সমস্যাকে প্রতিহত করার মন্ত্র। তিনি বলতেন সমস্যা যেন তোমার মাথায় চেপে না বসে, তোমাকে সমস্যা মোকাবিলা করার শিরোমণি হতে হবে, তাহলেই তুমি সমস্যাকে মোকাবিলা করে সফলতার মুখ দেখবে। এটাই হচ্ছে জটিল মিশনের মূলমন্ত্র। ড. রাজা রামান্না, ড. ভি. এস. অরুণাচলম আমাকে শিখিয়েছিলেন কীভাবে ব্যক্তির মূল্যবোধ সম্বন্ধে জ্ঞাত হয়ে সঠিক ব্যক্তির কাছ থেকে জটিল কাজ সমাধা করতে হয়। ডিফেন্স মিনিস্টার হিসাবে আর.ভেঙ্কটারমন দেখিয়েছিলেন কিভাবে বিশাল একটা ফোর্সকে পরিচালনা করার জন্য যথাযথ সিদ্ধান্ত নিতে হয়। নরসীমা রাও ছিলেন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ। দেশের উন্নয়নের জন্য তার প্রতিটা বিষয়েই যথেষ্ট জ্ঞান ছিল। একবার তিনি ডিফেন্স কনসাল্টিভ কমিটির সভায় সভাপতিত্ব করার সময় সাপ্লাইস এন্ড ট্রান্সপোর্ট এএসসি (আর্মি সাপ্লাই কোরপস) এর ডিরেক্টর জেনারেল ডেইরী ফার্মের উন্নয়নের জন্য পরিকল্পনা উপস্থাপন করলেন। তার প্লান উপস্থাপনা কালে তিনি বললেন মহিষগুলোর স্থলে জার্সি গাভী পালন করা যেতে পারে। রাও তাৎক্ষণিকভাবে উপলব্ধি করলেন আমাদের দেশে মহিষ পালনই লাভজনক। তারা আমাদের এই গরম দেশে সস্তা খাবার খেয়ে উচ্চ প্রোটিন সমৃদ্ধ দুধ দিতে পারে। দেশীয় সম্পদের ক্ষতি করার কথা ভাবা ঠিক নয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টা পর্যালোচনা করে দ্রুততার সাথে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবার জন্য রাও আর্মির ডেইরী ফার্মকে নির্দেশ দিলেন।

অন্য আর এক উপলক্ষ্যে ১৯৯৫ এ আমি আত্মনির্ভর প্রতিরক্ষা সম্বন্ধে প্রতিবেদন উপস্থাপন করি, রাও সেটা দেখে তাৎক্ষণিকভাবে জানালেন আমাদের জিডিপি এর চেয়ে তিন পার্সেন্ট নিচে গিয়ে দাঁড়াবে। তিনি বললেন, “আমরা একটা লিমিট বেঁধে দিতে পারি না। আমাদের এমনটাই করা উচিত যাতে জাতির জন্য শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে। জিডিপি অবিরতভাবেই উঠানামা করে থাকে। হিসাবের খাত থেকে আমরা ব্যয় বাড়াতে কমাতে পারি না।

আর একটা উদাহরণ আমার মনে আছে। ডিআরডিও অগ্নি মিশাইল সিস্টেমের জন্য ফলো আপ প্রোগ্রাম নিতে চাওয়ায় রাও বিষয়টা উপলব্ধি করে ৮০০ কোটি রুপির একটা প্রোগ্রাম তাৎক্ষণিকভাবে অনুমোদন করলেন। এই অনুমোদনের পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রস্তাবের ফাইল তখনকার অর্থমন্ত্রীর হাত ঘুরে ভারত সরকারের সেক্রেটারিদের কাছে এলো। এটাই ছিল উচ্চপর্যায় থেকে আসা প্রোগ্রামের বাস্তবায়ন সম্পর্কিত কথা।

২০০৪ এ ড. মনমোহন সিং এর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তিনি অর্থনীতি সম্পর্কিত সমস্ত দক্ষতা কাজে লাগিয়েছিলেন যাতে সাম্প্রতিক বছরে গ্রোথ ৯ পার্সেন্ট হয়। তিনি প্রধানমন্ত্রীর অফিসে প্রাণের স্পন্দন সৃষ্টি করে সবাইকে কাজে ব্যাপৃত করেছিলেন। তরিত সিদ্ধান্ত গ্রহণে অটল বিহারী বাজপেয়ীর কর্মদক্ষতাকেও আমি বিশেষভাবে লক্ষ্য করেছিলাম। ১৯৯৮ এ প্রধানমন্ত্রী হওয়া মাত্র তিনি আমাকে নিউক্লিয়ার টেস্ট করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, বাজপেয়ী জাতীয় ইস্যুতে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পিছপা হন নি। তিনিই ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি ২০০২ এর আগস্টে রেডফোর্ডের দুর্গ প্রাকার থেকে ঘোষণা করেছিলেন ২০২০ সালের মধ্যে ভারত উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হবে, যে কথা আমি আগেই উল্লেখ করেছি। তার আগে ১৯৯৮ এ এইচ .ডি. দেবে গৌড়া ইন্ডিয়া ২০২০ প্রোগ্রামকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।

[ভালো মানুষদের সাথে মিলিত হবার অভিজ্ঞতা হচ্ছে নিজেকেই শিক্ষিত করে তোলা। আমার জীবনের বিভিন্ন স্তরে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষের সাথে মিলিত হয়ে নিজের ধ্যানধারণাকে বিনিময় করার সুযোগ পাওয়ায় আমি সৌভাগ্যবান।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *