১। কখন আমি ভারতের গান গাইতে পারি?

১. কখন আমি ভারতের গান গাইতে পারি?

প্রকৃতিকে সুন্দর রেখে তার আশীর্বাদ পেতে যত্নবান হও
তাহলেই সব কিছুর মধ্যে পবিত্রতা খুঁজে পাবে।

.

আমার রাষ্ট্রপতি পদের শেষ দিনটা ছিল ২০০৭ এর ২৪ জুলাই। দিনটি নানা আয়োজনে ঠাসা। সকালবেলা আমি আমার ব্যক্তিগত কাজে ব্যস্ত ছিলাম। দিনের শেষ দিকে ৩.২৫ টা থেকে সিএনএন-আইবিএন এর রাজদীপ সারদেশাই ও দিলীপ ভেঙ্কটারমন এর সাথে একটা সাক্ষাৎকার ছিল। তারপরই চন্ডিগড়ের গভর্নর ইএসএল নরসীমহান এর সাথে এবং উত্তরাখন্ডের হেল্থ এন্ড ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার এন্ড সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি মিনিস্টার ড. রমেশ পোখারিয়াল ‘নিশাঙ্ক’-এর সাথে মিলিত হই। বিকাল ৪টায় দিল্লি কলেজের ছাত্রী মিস চারিসমা থাঙ্কাপপ্পান আমার সাথে সাক্ষাত করেন। তার সাথে তার বাবা-মাসহ আরো পাঁচজন ছিলেন। তারপর আমি মিলিত হই বিদেশ মন্ত্রণালয়ের প্রটোকল প্রধান সুনীল লাল ও তার স্ত্রী গীতাঞ্জলী ও মেয়ে নিতিকার এর সাথে। রাত ৮টা পর্যন্ত বেশ কয়েকটা বিদায় সম্বর্ধনার অনুষ্ঠান হলো। আমি নব নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি, প্রধান মন্ত্রী এবং মন্ত্রিসভার সম্মানে একটা ডিনারের আয়োজন করলাম।

আমার ফেয়ারওয়েলে এবং সাক্ষাতে মিলিত হওয়া লোকজন আমার সামান্য জিনিসপত্রে ভরা দুটো সুটকেস দেখতে পেল। সত্যিকথা বলতে আমি তাদেরকে বললাম আমি শুধুমাত্র ওইগুলোই সাথে নিয়ে যাচ্ছি। ফলে সবার মনে এক ধরনের নেতিবাচক ভাবনার উদয় হলো। যারাই আমার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন কিংবা আমার সাথে কথা বলেছিলেন তারাই তাদের মনে জাগা প্রশ্নটা সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলেন। তাদের মুখে একই প্রশ্ন! আমি আগামীতে কী করে সময় কাটাবো? আমি কি বাইরে কোন কাজে যুক্ত থাকবো? নাকি আমি আবার শিক্ষকতার পেশায় ফিরে যাব, নাকি আমি সক্রিয় জীবন থেকে সম্পূর্ণ অবসর নেব। আমাকে যারা চেনেন তারা শেষ প্রশ্নের উত্তরটা জানেন। রাষ্ট্রপতিভবনে গত পাঁচটা বছরে আমার মনটা তরতাজা ছিল। মোঘল গার্ডেনের প্রস্ফুটিত পুষ্পের হাসি, ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খানের শেষ অনুষ্ঠান আর অন্যান্য সঙ্গীতজ্ঞের সুর মূর্ছনা, ভেষজ উদ্যানের সুরভি, ময়ূরের নাচানাচি আর গ্রীষ্মের দাবদাহ এবং শীতের কনকনে ঠাণ্ডার মাঝে দণ্ডায়মান প্রহরীরা ছিল আমার দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমি গত পাঁচ বছরে এক অনাস্বাদিত অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলাম।

সর্বস্তরের লোকজন জাতির উন্নতির জন্য তাদের অভিজ্ঞতা আমাকে জানিয়েছিলেন। রাজনীতিবিদরা প্রতিক্ষেত্রেই তাদের ধ্যানধারণা আর উচ্চাশা আমার সমীপে উপস্থাপন করেছিলেন। বিজ্ঞানীরা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোর সমাধান করার আকাঙ্খা আমার কাছে ব্যক্ত করেন। শিল্পী ও লেখকরাও আন্তরিকভাবে ভারতের জন্য অনুরাগ প্রকাশ করেন।। ধর্মগুরুরা খোলামনে একই মঞ্চে আধ্যাত্মিক সমন্বয়ের বাণী প্রচার করেছিলেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞরা জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে তাদের চিন্তাভাবনা আমার কাছে তুলে ধরেছিলেন। সকল নাগরিকের প্রতি সমান আর সুন্দর আচরণ সম্পর্কীয় সাম্প্রতিককালের ইস্যুগুলো সম্বন্ধে আইনজীবী সম্প্রদায় তাদের যথাযথ ধ্যান-ধারণা পেশ করেছিলেন। অনাবাসী ভারতীয়দের সাথে আমার যখন যেখানেই সাক্ষাৎ হয়েছে তারা তাদের জন্মভূমিতে ফিরে এসে দেশের উন্নয়নের জন্য কাজ করার ইচ্ছে ব্যক্ত করেছেন। দেশের বিভিন্ন অংশে পরিভ্রমণকালে আমি চমৎকার চমৎকার সব অভিজ্ঞতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলাম। সেই সব অভিজ্ঞতা থেকে আমি জনগণের আশাআকাঙ্খার প্রতিফলন লক্ষ্য করেছি। অনেককেই ভালো ভালো কাজ করতে দেখেছি। বিশেষ করে যুবকদের কাছ থেকে শক্তির পরিচয় পেয়েছি।

চিকিৎসকদের সাথে খোলামেলা আলাপ-আলোচনা করে জেনেছি গ্রামীণ নাগরিকদের চিকিৎসা সেবা প্রদানের লক্ষ্যে তাদের নিরলসভাবে কাজ করে যাবার কথা। গবেষণা কাজে উৎসাহ দান, ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে যোগ্য লোকজনদের যোগ্য কাজের ব্যবস্থা করা, সিনিয়র সিটিজেনদের কাছে জীবনযাপনের ধারা পরিবর্তনের বার্তা পৌঁছে দিয়ে স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিষেধক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সচেষ্ট হয়েছি। ভারত এবং ভারতের বাইরে থাকা যে সমস্ত নার্সরা আমার সাথে দেখা করেছিলেন তারা তাদের গুণগতমান বৃদ্ধির কথা জানিয়েছিলেন। তারা গ্রামের জনগণের সেবায় নিবেদিত সেকথাও আমাকে বলেছিলেন।

দুঃস্থ তুলাচাষি সহ সকল কৃষকের সাথে আমার আলাপ হয়েছিল। আমি তাদের সমস্যাবলি বুঝতে সক্ষম হই। তারা যে সমস্ত সমস্যাবলির মুখোমুখি তার সমাধানের জন্য কৃষি বিশেষজ্ঞদের কাছে আমি আমার ধ্যানধারণা জ্ঞাপন করি। আমি পোস্টম্যানদের সাথেও মতবিনিময় করি। তারা গ্রামীণ জনগণের ডাক সেবাদানে ব্রতী থাকায় শিক্ষিত সমাজে পোস্টাল সেবাদানে বিশেষ ভূমিকা রাখছেন।

পুলিশম্যানরাও আমার সাথে সাক্ষাৎ করেন। পুলিশ বিভাগের সংস্কার, পুলিশ স্টেশনের অবকাঠামো উন্নয়ন এবং তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিতকরণের ধ্যানধারণা প্রদানের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ বিভাগের সংস্কারের জন্য আমি সংশ্লিষ্ট ফোরামে আমার মতামত উপস্থাপন করি।

পঞ্চায়েত প্রধান বিশেষ করে মহিলা প্রধানরা তাদের গ্রাম উন্নয়নের পরিকল্পনা ও কর্মপদ্ধতি ব্যক্ত করেন। সেইসাথে তারা যে সমস্ত সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন তাও আমাকে জানান।

আমি যেখানেই গিয়েছি সেখানেই শিক্ষকরা আমাকে নিশ্চয়তা দান করেছেন যে জাতি গঠনের জন্য তরুণ সমাজকে বিকশিত করা তাদের ব্রত। তারা আমাকে বলেন যে তারা তরুণদের মাঝে এমন মূল্যবোধের বিচ্ছুরণ ঘটাচ্ছেন যাতে তারা আলোকিত মানুষ হিসাবে গড়ে উঠতে পারে।

সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে বাচ্চাকাচ্চা, পিতামাতা, শিক্ষক, চাকরিজীবী, প্রশাসকগণ, আইনজীবী, চিকিৎসক, সেবিকারা সহ অন্যান্যদের কাছ থেকে যে শপথ উচ্চারিত হয় তার অভিজ্ঞতার আলোকে আমি আলোকিত হই। শপথগুলো লোকজনের বিভিন্ন গ্রুপের সাথে আলাপ-আলোচনা থেকে গৃহীত হয়। সাধারণত শপথগুলো পাঁচ, সাত, কিংবা দশটা মতামতেরই সমষ্টি। সমবেত জনতার শপথের মধ্যে সর্বসম্মত উদ্দেশ্য নিহিত থাকে। আর এই শপথগুলোর মধ্যে তাদের জীবনযাপনের একটা বার্তা অবশ্য ছিল।

অবাক না হয়ে পারার মতো একটা অনুষঙ্গ ছিল। আমি রাষ্ট্রপতি থাকাকালে অগণিত চিঠিপত্র, ই-মেল আমার কাছে এসেছিল। চিঠিপত্রগুলো এসেছিল শিশু কিশোর, যুবক, বয়স্কদের কাছ থেকে। শিক্ষক এবং বিজ্ঞানীরাও আমাকে অনেক অনেক চিঠি লিখেছিলেন। অবিশ্বাস্য হলেও প্রতিদিন হাজার হাজার চিঠি আসতো। সমস্ত চিঠির প্রশ্নের জবাব দেওয়া সম্ভব ছিল না। তবুও আমরা জবাব দেবার চেষ্টা করি। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবার জন্য অনেক ক্ষেত্রেই চিঠিগুলোকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। চিকিৎসা সংক্রান্ত চিঠির ক্ষেত্রে উপযুক্ত হাসপাতালে ভর্তি হবার পরামর্শ দেবার চেষ্টা করেছিলাম। কোন কোন সময়ে পত্র প্রেরকদেরকে আমরাই প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও উপদেশ দান করেছিলাম। আবার কোন কোন সময় যৎসামান্য আর্থিক সাহায্যও দেওয়া হয়েছিল। পত্রগুলো আমাদের দেশবাসী কতটা আশা, ভরসা আর বিশ্বাস নিয়ে লিখেছিল তা ভাবলে অবাক হতে হয়। তাদের পত্রগুলোর মধ্যে দু:খ, কষ্ট, ব্যথা বেদনা আর লক্ষ্য অর্জনের অনুরণন ছিল। দুঃস্থ অবস্থার মাঝে নিপতিত একটা পরিবারের এক যুবতী মেয়ের কাছ থেকে আসা একটা চিঠি আমার হৃদয় স্পর্শ করেছিল। তার হৃদয়স্পর্শী পত্র আমার অন্তরাত্মাকে আলোড়িত করায় তার জীবনটাকে সুন্দর করতে সমর্থ হয়েছিলাম। আমরা তার পত্রটাকে এমন একজনের কাছে পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত ছিলাম যাতে ভয়ঙ্কর অবস্থা থেকে মেয়েটির পরিবার আলোর মুখ দেখতে পারে।

‘আমার পরিবার কষ্টের মাঝে দিনাতিপাত করছে। ২৩ বছর যাবত আমার পরিবার নানাবিধ সমস্যার মধ্যে কালাতিপাত করছে। একটা দিনের জন্যেও আমি এবং আমার পরিবার কখনো সুখের মুখ দেখেনি। আমি পড়াশোনায় ভালো। আমি আমাদের কেন্দ্রে পঞ্চম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিলাম। আমি একজন ডাক্তার হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমি পরে আর কখনোই প্রথম, হতে পারি নি। তারপর থেকে আমি সব ক্লাসেই দ্বিতীয় না হয় তৃতীয় হয়েছি। বি.এ. তে আমি মাত্র শতকরা ৫০ নম্বর পেয়েছিলাম। অভাব অনটনের জন্য আমার ডাক্তারী পড়া হয়ে উঠে নি। আমি চৌদ্দটা বছর অভাব অনটনের মধ্যে আছি…’

এ ধরনের বহু চিঠিপত্র এসেছিল। রাষ্ট্রপতিভবন থেকে সাহায্য পাওয়া যাবে এই বিশ্বাস আর ভরসায় এইসব মর্মস্পর্শী চিঠিপত্র তারা আমাকে লিখেছিল।

বিভিন্ন সমিতি আর সংস্থা থেকে আসা চিঠিপত্রে আস্থার অভিব্যক্তি প্রকাশ পেয়েছিল। ‘প্রিয় রাষ্ট্রপতি কালাম, আমরা অ্যাডভান্স ন্যানোটেকনোলজির উপর একটা কন্ফারেন্সের আয়োজন করতে যাচ্ছি, (কিংবা অন্যকোন বিশেষায়িত বিষয়, যেমন বায়োডাইভার্সিটি, কার্বন কমপোজিটস, রকেট প্রোপালশন টেকনোলজি, কারডিওথোরাসিক সার্জারি, ইফেক্‌টিয়াস ডিজিজেজ, স্ট্যার্টজি ফর রিডিউসিং পেনডেন্সি অব কোর্ট কেসেস, কিংবা ই-গভর্ন্যান্স…), আমরা এই কনফারেন্সের মূলবিষয়াদির উপর বক্তৃতা দেবার জন্য আপনাকে পাবার বাসনা করেছি।’ এই কোর্সগুলোর উপর কথা বলা আমার পক্ষে সহজতর হলেও কনফারেন্সের দিনতারিখ, বিষয় এবং আমার জ্ঞানের উপরই বিষয়টা নির্ভর করে। ইন্ডিয়া ২০২০ জন্য তরুণী মেয়েটির দেখভাল করে জীবনকে সুচারু করা এবং কনফারেন্সে টেকনোলজির বিকাশ সম্বন্ধে ভাষণ দেওয়া আমার জন্য প্রয়োজনীয় ছিল।

এইসব চিন্তাভাবনা থেকেই আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম পরবর্তীকালে আমার কী করা উচিত। আমাকে কী নীরব হয়ে যাওয়া উচিত না নাকি আমার কিছু একটা করা উচিত? কী করতে হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া আমার পক্ষে সহজ নয়। আমি একটা আশার আলো দেখলাম। জাতির উদ্দেশ্যে আমার বিদায় ভাষণে আমার সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করার জন্য একটা সুন্দর ভাষণ প্রস্তুত করার কথা আমি ভাবলাম।

আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমি আমার বিদায় ভাষণে দেশবাসীকে ধন্যবাদ জানাবো এবং ভারতের উন্নয়নের জন্য তাদেরকে অংশ নিতে অনুরোধ করবো, যে কথা আমি আমার পাঁচ বছর মেয়াদকালে তাদেরকে অনেক অনেকবার বলেছি।

বিদায় ভাষণে আমি তাদেরকে বললাম, ‘আমার প্রিয় দেশবাসী, আসুন আমরা একটা দেশের মিশনকে সফল করতে কাজ চালিয়ে যাই যাতে সমৃদ্ধি, স্বাস্থ সেবা, নিরাপত্তা, সুখ ও শান্তির ধারা টেকসইভাবে প্রগতির পথে চালিত হয় গ্রাম আর পৌর এলাকার মাঝে বিভাজন কমে আসে। সরকার যেন দায়িত্বশীল, স্বচ্ছ ও দুর্নীতি মুক্ত হয়। আমি আমার বইয়ে বারবার উল্লেখ করেছি ভারতের উন্নয়নের জন্য দশ দফা প্রোফাইলের বাস্তবায়ন ঘটানোর কথা।

আমার জীবনের ব্রত আমাদের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি ভারতের লাখো কোটি মানুষের হৃদয়মনের সাথে একাত্ব হয়ে ‘আমরাও সফল হতে পারি’ এই আত্মবিশ্বাসকে সমুন্নত করার উদ্দেশ্যে উন্নয়নের দশ দফার সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করা। আমি সদাসর্বদা অবশ্যই আপনাদের সাথে থাকবো, আমার প্রিয় দেশবাসী, ২০২০ এ ভারতকে একটা উন্নত রাষ্ট্রে পৌঁছে দেবার মিশনে আমি আপনাদের সাথেই থাকবো।

[বেশ কয়েকটা ঘটনায় আমার দিগন্ত আলোকিত, তা থেকেই আমার ওষ্ঠে হাসির রেখা, এ থেকেই আমি আমার দেশবাসীকে ভালোবাসতে শিখেছি।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *