৫। আমি জাতিকে কী দিতে পারি?

৫. আমি জাতিকে কী দিতে পারি?

ভিশন জাতির বুদ্ধিবৃত্তিকে জাগ্রত করতে পারে

.

আমি জাতিকে কী দিতে পারি? অন্যান্য দেশের কাছে আমাদের দেশের সম্মান ও মর্যাদা আছে। আমাদের দেশের কোটি কোটি নারী পুরুষের মুখে হাসি। শুধুমাত্র দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন আর শিক্ষা প্রসারের মাধ্যমে এটা সম্ভব। সম্মান অর্জনের শ্রেষ্ঠ পথ শিক্ষা অর্জন। সৎ কাজের প্রতি শ্রদ্ধাবোধই আমাদের জনগণকে উন্নয়নের মূলধারায় চালিত করা যায়।

স্বাধীনতা দিবস এবং প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রাক্কালে রাষ্ট্রপতিকে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবার সুযোগ আছে। এই দুটো উৎসবের দিনে রাষ্ট্রপতি দেশের উন্নয়নের সম্বন্ধে বক্তব্য পেশ করেন। ইংরেজি ভাষায় ভাষণের পর হিন্দিতে ভাষণ দেওয়া হয়। যা হোক, প্রত্যেক ভাষণের শেষে আমি প্রথমে শুরু করা শুভেচ্ছা বাণী আবারও বলতাম। হিন্দি ভাষণে সারাংশটাই বলতাম। হিন্দির জ্ঞান আমার প্রাথমিক স্তরের। প্রজাতন্ত্র দিবসের ভাষণে সর্বদাই একটা থিম ছিল। আগে থেকেই একটা প্রস্তুতি নেওয়া হতো। আগে থেকেই কয়েকটা ড্রাফট করা হতো। তা দশটা কিংবা তারও বেশি অস্বাভাবিক ছিল না। ২০০৪-এর আর ডে এর বক্তৃতার ড্রাফট দশটা করা হয়েছিল। ২০০৫ এর ১৪ আগস্টের থিমটা ছিল উদ্দীপনাময়। ওই দিনকার ভাষণের ড্রাফ্‌ট করা হয় ১৫ টা। ২০০৭ এর ২৫ এপ্রিলে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের ভাষণের সবচেয়ে বেশি ড্রাফট করা হয়। ৩৫ টা ড্রাফট করা হয়। আমার দায়িত্ব পালনকালে আমি দশটা জাতীয় পর্যায়ের ভাষণ প্রদান করি। ভাষণের বিষয়গুলো ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তাতে মিশনের বক্তব্যেরই প্রতিফলন ছিল। আমার দেওয়া ভাষণগুলোতে আমি ভারতের উন্নয়নের কথাই ব্যক্ত করেছিলাম। আমার বক্তব্যের বিষয়গুলোতে সর্বজনগ্রাহ্য আইডিয়া জনগণের সামনে তুলে ধরেছিলাম, যাতে পেশাজীবী মানুষেরা স্ব স্ব ক্ষেত্রে উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত গতিতে বৃদ্ধি করতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ, উন্নয়নের জন্য দেশে জাত্রোফা চাষের জন্য জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করেছিলাম। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রাজ্য জাত্রোফা চাষ করে লাভবান হয়েছে। তাছাড়া জাত্রোফা চাষে বিশেষজ্ঞরা জাত্রোফা চাষে প্রসারকৃত আফ্রিকার দেশগুলো থেকে জ্ঞান আহোরণ করে আমাদের চাষিদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। বায়োফুয়েল উৎপাদনের জন্য তারা জাত্রোফা চাষ করেছিল। এটা পতিত জমিতেই ভালো ফলে। একবার চাষ করলে এক নাগাড়ে পঞ্চাশ বছর এই গাছ বেঁচে থাকে। প্রতি বছর যে ফল দেয় তার বীজ থেকে তেল পাওয়া যায়।

শিক্ষার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের ছাত্রছাত্রীদেরকে যাচাই বাছাই করে তাদের উপযোগী শিক্ষা কার্যক্রমের কথা আমি তুলে ধরেছিলাম। সেন্ট্রাল বোর্ড অব এডুকেশন মার্কিং এর পরিবর্তে গ্রেডিং প্রথা চালু করার পরামর্শ দিয়েছিলাম, যাতে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়।

নিজস্ব এনার্জি এর জন্য আমি একটা রূপরেখা তুলে ধরেছিলাম। আমি ২০২০ এর মধ্যে ৫৫,০০০ এম ওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন সৌর শক্তি প্ল্যান্ট গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছিলাম। ভারতের এনার্জির চিত্রটা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। ভারত শুধুমাত্র এনার্জি চাহিদার শতকরা ৮০ ভাগ মিটাতে সক্ষম। অন্যদিকে, প্রতিবছর বিদ্যুতের চাহিদা শতকরা ৫ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কয়লার উৎপাদন মাত্র শতকরা ১ ভাগ বেড়েছে। সারাদেশের অনেক রাজ্যে দিনে আট ঘন্টা বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন থাকে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিকল্প বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা একান্ত জরুরি।

আমাদের পরিবেশকেও নিয়ন্ত্রণে রাখা প্রয়োজন। কয়লা, তেল এবং গ্যাস ভিত্তিক পাওয়ার প্লান্টের সংখ্যা হ্রাস করা প্রয়োজন। বিদ্যুত উৎপাদনের জন্য সূর্য,বাতাস,আনবিক শক্তি ও হাইড্রো পদ্ধতির উপর জোর দিতে হবে। ২০২০ এর মধ্যে বাস্তবায়ন যোগ্য ২০.০০০ এম.ওয়াট শক্তির সোলার মিশন গ্রহণ করতে হবে। সৌরশক্তির উন্নয়নের জন্য অন্যান্য পদক্ষেপও নিতে হবে। উদাহরণ স্বরূপ, ফটোভোল্টিক সেলের ক্ষমতা ১৫ পার্সেন্ট থেকে কম পক্ষে ৫০ পার্সেন্টে উন্নিত করতে হবে। দিনের বেলার জন্য সৌর শক্তি আর রাতের জন্য বায়োফুয়েলের ব্যবস্থা করতে হবে। ফলশ্রুতিতে এনার্জি ধারাবাহিকভাবেই সহজলভ্য হবে। গুজরাটে প্রাইভেট সেক্টরের সাথে যৌথ উদ্দ্যোগে ৬০০ এম.ওয়াট সৌর শক্তি প্লান্ট চালু করা হয়েছে। প্রতিদিন তিন মিলিয়ন ইউনিট বিদ্যুত ব্যবহার করা হয় প্রতি ইউনিট ১৫ রুপি হিসাবে।

আজ রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের একটাই ভিশন ভারতকে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত জাতিতে পরিণত করা। এই সমস্ত উদাহরণের দ্বারা যে কেউ দেখতে পাবে যে রাষ্ট্রপতি সরাসরি নাগরিকদের সাথে সম্পৃক্ত যা থেকে জাতি উপকৃত হয়। আমি পার্লামেন্টে যে ভাষণগুলো দিয়েছিলাম তা আসলে জনগণের জন্যই। ১৯৯৯, ২০০০, ২০০১, আর ২০০২ এবং ২১ মার্চ ২০০৫- এ পার্লামেন্টে দেওয়া আমার ভাষণে আমি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টের উপর বক্তব্য পেশ করেছিলাম।

আমি বললাম, ভারতের কৃষ্টি সভ্যতার সমন্বিত ধারা স্বাধীনতা আর গণতন্ত্রের মধ্যে নিহিত। প্রকৃতপক্ষে আমাদেরকে ফিরে যেতে হয় প্রাচীন যুগে। সেযুগে সভা আর সমিতি আমাদের গ্রামগুলোর শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসাবে বিবেচিত হতো। আজ আমাদের প্রজাতন্ত্রে একই ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের মধ্যে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারা বর্তমান ছিল। আর এই ধারা প্রতিধ্বনিত হয় ভারতের সংস্কৃতিতে। ভারত পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বৃহত্তম সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হওয়ায় আমরা বিশেষভাবে গর্বিত। বহুধর্ম, বহুভাষা, বহু সংস্কৃতির দেশ ভারত। রাজনীতির দুটো ধারা আছে। আমরা জানি স্বাধীনতা আন্দোলনের লগ্নে লড়াই করা রাজনৈতিক দলগুলোর লড়াইয়ের কথা। যা হোক, আজ দেখতে হবে ভারতের জন্য কী প্রয়োজন? ২৬০ মিলিয়ন লোক দারিদ্রসীমার নিচে, শিক্ষিতের হার ৩৪ পার্সেন্ট, ৩৬ মিলিয়ন তরুণ-তরুণী চাকরি খুঁজছে। আমাদের মিশন ভারতকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করা যাতে জনগণ দারিদ্রতা, নিরক্ষরতা আর বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পায়। এই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য প্রয়োজন উন্নয়নকামী রাজনীতির।

আমি দেখতে পছন্দ করি এমন একটা অবস্থা যাতে আমাদের দেশে উন্নয়নকামী রাজনীতির চর্চা হয়। তাদের মেনোফেস্টোতে প্রতিফলিত হবে উন্নয়নের প্রতিদ্বন্দিতামূলক রাজনৈতিক ভিশন। আর তা কেমন হবে সেটাই আমি ব্যক্ত করতে চাই।

১. মনে করুন পার্টি এ বলে, পনেরো বছরের মধ্যে আমরা ভারতকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করবো। প্রত্যেক পাঁচ বছরের জন্য একটা ডেভেলপমেন্ট গ্রোথ অর্জন করতে সক্ষম হবে। পার্টি বি বলে, একটা স্বচ্ছ পরিকল্পনার মাধ্যমে আমরা ভারতকে বিশ বছরের মধ্যে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করবো। পার্টি সি বিভিন্ন দিকদর্শন আর ধ্যানধারণার মাধ্যমে জাতিকে উন্নত করবো গ্লোবাল এরিয়ায় আমাদের ভূমিকায়। এতে একটা রোড ম্যাপ অবশ্যই থাকবে যাতে ভারত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হতে পারবে একটা সময় কালের মধ্যে।

২. আমার অভিপ্রায় দুটো, এ পার্টি বলে, আমরা একটা নেশন সৃষ্টি করবো যেখানে কোন বেকার থাকবে না। তারা পরামর্শ দেবে চাকরি প্রার্থীর চেয়ে চাকরি দাতার সংখ্যা হবে বেশি। পার্টি বি বলবে আমরা চাকরির নিশ্চয়তা দেব প্রশাসনযন্ত্র কোর্টে কোন মামলা পেন্ডিং রাখবে না আর আইনশৃঙ্খলার নিশ্চয়তা বিধান করা হবে। সমস্যা মুক্ত পরিবেশে জনগণ সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশে শান্তিতে বসবাস করবে। পাটি সি বলে যে কোন ভারতীয় অভুক্ত অবস্থায় ঘুমাতে যাবে না। এর মাঝে একটা ভিশন আছে যা নিশ্চয়তা বিধান করবে যে পৃথিবীর সমস্ত রাষ্ট্র ভারতের দিকে তাকিয়ে দেখবে। তারা বুদ্ধিদীপ্ত নেতৃত্ব দান করবে সারা পৃথিবীতে। ভারত বসবাসের জন্য শান্তি, স্থিতিশীল সুন্দর স্থান হিসাবে বিবেচিত হবে।

৩. তৃতীয় দৃশ্যপটে, পার্টি এ বলবে, আমরা দশ বছরের মধ্যে প্রতিবেশি রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে লেগে থাকা সীমান্ত সংক্রান্ত বিবাদ মিটিয়ে ফেলার নিশ্চয়তা বিধান করছি। পার্টি বি বলবে, আমরা পাঁচ বছরের মধ্যে প্রতিবেশি রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে লেগে থাকা সীমান্ত সংক্রান্ত বিবাদ মিটিয়ে ফেলার নিশ্চয়তা বিধান করছি। পার্টি সি বলবে যে সীমান্ত বাণিজ্য জোরদার করার লক্ষ্যে আমরা বর্ডারলেস সীমান্ত বাণিজ্য চালু করবো। ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসারের সাথে সাথে শান্তিও প্রতিষ্ঠিত হবে।

জনগণ নির্দিষ্ট পার্টিকে সুযোগ দিলে তাদের উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য তখনই সমস্ত সদস্য বাস্তবতাকে উপলব্ধি করতে পারে। দেশ এবং জনগণ মহান পার্লামেন্টের দ্বারা প্রশংসিত হবে। গণতন্ত্র উন্নত জীবনযাপনের জন্য প্রত্যেককে সুযোগ দান করে। উন্নত জীবনযাপনের সুযোগ লাভ করলে জনগণ বুঝতে পারবে জাতির ভিশন কী। প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক আর জ্ঞান নির্ভর পৃথিবীতে সুন্দরভাবে টিকে থাকার জন্য আমাদের সমস্ত জনগণের মাঝ থেকে সম্পূর্ণভাবে দারিদ্রতাকে নির্মূল করা অত্যন্ত জরুরি। আজকের জটিল পৃথিবীতে আমাদের জনগণের আর জাতির নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করাও একান্ত প্রয়োজন। ‘রাজনৈতিক’ রাজনীতি থেকে উন্নয়নের রাজনীতিতে উত্তরণের মাধ্যমে বহুবিধ অভাব নিরসন করা সম্ভব।

পার্টির ভাবাদর্শকে মোকাবিলা করে জাতীয় ইস্যুগুলোকে সামনে নিয়ে আসা উচিত। ভারতকে উন্নত জাতিতে পরিণত করার লক্ষ্যে সামনে এগিয়ে যাওয়া দরকার। দেশের প্রত্যেক নাগরিকের জন্য বিশুদ্ধ পানি, সহজলভ্য বিদ্যুত, স্বাস্থ্যসেবা, আশ্রায়নের ব্যবস্থা করা সরকারের দায়িত্ব। তাছাড়া, যোগাযোগ ও কম্পিউটার ব্যবস্থাকে জনগণের হাতের কাছে পৌঁছে দেওয়াও সরকারের দায়িত্ব। জাতিকে সামনের কাতারে এগিয়ে নেবার জন্য পার্লামেন্টের ভূমিকা অপরিসীম। যে সমস্ত পুরুষ ও মহিলা সাংসদ হিসাবে নির্বাচিত, তাদের মধ্যে দেশের উন্নয়নের জন্য আদর্শগত আশা আকাঙ্খার প্রতিফলন অবশ্যই থাকতে হবে। আমি সাংসদদেরকে বলেছিলাম আমরা জেনেও এমন কিছু সত্যকে অস্বীকার করে থাকি। সেই সব কথা আপনাদের কাছে বলতে আমার দ্বিধা নেই। কারণ আমি আপনাদেরই একটা অংশ। আমি আপনাদের সবার মতোই পালামেন্টের একজন হয়ে আপনাদের মতোই সংসদীয় ব্যবস্থার সাফল্য কামনা করি। আমাদের নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্যে অস্বাভাবিকতা আছে। আসুন আমরা নিজেরাই সৎ হই। কিছু আসনে অগণতান্ত্রিক পদ্ধতির প্রয়োগের অভিযোগ আছে। এর ফলে জনগণের মনে নির্বাচন সম্পর্কে বিরুপ প্রতিক্রিয়া হওয়া অসম্ভব নয়। রাজনীতি যখন কানাগলিতে রুদ্ধ হয়ে যায় তখনই তা আর সুষ্ঠ রাজনীত থাকে না। আসুন আমরা কোন প্রকার ঝুকির মধ্যে না গিয়ে আমাদের সংবিধানকে সমুন্নত রাখি, যাতে ভারত টেকসইভাবে সুস্থ গতিশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে বেড়ে উঠতে পারে। ভারতীয় সভ্যতার আলোকে জনগণের জীবনধারা সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধারণ করে যেন আবর্তীত হয়। পার্লামেন্ট সঠিক রাজনীতির মাধ্যমে সঠিক কাজকর্মের দ্বারা জনগণের মুখে হাসি ফুটাতে পারে। জনগণের মধ্যে আস্থা আর বিশ্বাসের বাতাবরণ সৃষ্টি করতে হবে। ভারতীয় জনগণ অতীতে কাজের দ্বারা বহুবিধ অর্জন করেছে, তার নজির ভুরি ভুরি আছে। পার্লামেন্টের একটা মিশন থাকা প্রয়োজন যার উদ্দেশ্য হবে যেসব পুরনো আইন অর্থনীতির গতিকে বাঁধাগ্রস্ত করে সেইগুলোকে চিহ্নিত করা এবং সেইগুলিকে বাতিল করার ব্যবস্থা নেওয়া। এর ফলে জনগণের বৃহত্তর অংশের মনে ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ হবার আশা জাগবে। ভারত অবশ্যই আস্থা ভিত্তিক পদ্ধতির মাধ্যমে অগ্রগতির পথে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। আমাদের মহান পার্লামেন্টের সদস্যরাই এই পরিবর্তন আনতে পারেন। আমি তাদের প্রতি এজন্য উদাত্ত আহ্বান জানাই।

আমাদের মিশনকে সফল করার লক্ষ্যে পাঁচটি মূল লক্ষ্য স্থির করতে হবে। সেই লক্ষগুলো হলো ১) কৃষি ও ফল প্রক্রিয়াকরণ ২) শিক্ষা ও স্বাস্থ সেবা ৩) অবকাঠামো উন্নয়ন : নির্ভরযোগ্য আর গুণগতসম্পন্ন বিদ্যুত ব্যবস্থা, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং দেশের সমস্ত অংশের অন্যান্য ক্ষেত্রের অবকাঠামো উন্নয়ন। ৪) তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং জটিল প্রযুক্তি সম্পর্কে আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলা।

এই পাঁচটি ক্ষেত্র পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত। যদি সমন্বিত পন্থায় উন্নয়ন করতে হয়, তবে খাদ্য,অর্থ আর জাতীয় নিরাপত্তার প্রয়োজন। গ্রামীণ উন্নয়ন নিশ্চিতকরণের জন্য অবকাঠামোকে শক্তিশালী করা প্রয়োজন। গ্রামীণ এলাকার উন্নয়নের জন্য ব্যবহারিক,ইলেক্ট্রোনিক ও জ্ঞান এই তিনটির সাথে সম্পৃক্ততা বজায় রাখতে হবে। আর্থিক সচ্ছলতার প্রতিও নজর দেবার প্রয়োজন পড়বে। গ্রামের উন্নয়নের জন্য প্রোভাইডিং আরবান অ্যামেনিটিস ইন রুরাল এরিয়া (পিইউআরএ) এর আওতায় আনতে হবে। সারাদেশে পিইউআরএ এর ক্লাস্টারের সংখ্যা হবে ৭০০০।

আমাদের জিডিপি বছরে ৯ পার্সেন্টে পৌঁছালে আমরা খুশি। কিন্তু বাস্তবে এর দ্বারা এটাই প্রমাণ করে না গ্রামীন এলাকা এমন কি পৌর এলাকার বৃহত্তর জনগণের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা এখানে তুলে ধরতে পারি ন্যাশনাল প্রোসপারিটি ইনডেক্স (এনডিআই) কী? এটা হচ্ছে এ) বাৎসরিক জিডিপি,বি) দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থিত মানুষের জীবনযাত্রার গুণগত মানোন্নয়ন,সি) মানুষের জীবনের সর্বক্ষেত্রে ভারতের চমৎকার সভ্যতাভিত্তিক উত্তরাধিকার থেকে আসা মূল্যবোধের অবলম্বন এর সারসংক্ষেপ। তাহলে এনডিআই এ+বি+সি। প্রকৃতপক্ষে, ‘বি’ এর অন্তর্ভুক্ত বাসস্থানের সহজলভ্যতা, নিরাপদ পানি, পুষ্টি, স্বাস্থ্যসম্মত সেনিটেশন, মানসম্মত শিক্ষা, মানসম্মত স্বাস্থসেবা, চাকরির সুব্যবস্থা, আর ‘সি’এর কাজ যৌথপরিবার গঠন করতে উদ্বুদ্ধকরণ, সম্মিলিতভাবে কাজ করার স্পৃহা সৃষ্টি, সুস্থ জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধকরণ, সামাজিক বৈশম্য দূরীকরণ সর্বোপরি সংঘাত মুক্ত সৌহাদপূর্ণ সমাজ গড়ে তোলা। ফলশ্রুতিতে পরিবার ও সমাজে দুর্নীতির মাত্রা হ্রাস পাবে। কোর্টের মামলা মকদ্দমার সংখ্যা হ্রাস পেতে থাকবে। শিশু ও মহিলাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসও কমে আসবে। সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা হ্রাস পাবে। ২০২০ এ দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী লোকের সংখ্যা শূন্যের কোটায় গিয়ে দাঁড়াবে। ন্যাশনাল প্রোসপারিটি ইনডেক্স উন্নত পর্যায়ে পৌছা তখনই সম্ভব হবে, যখন আমাদের সমস্ত প্রকারের প্রচেষ্টার মাধ্যমে জাতির অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধিত হবে।

কেমন ভাবে আমরা আমাদের এই ভিশনকে উপলব্ধি করতে পারবো? এই ভিশন বোঝার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে কী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন?

আপনাদের অনেকের সাথে আলাপ আলোচনা করে এবং কেন্দ্রীয় ও রাজ্য পর্যায়ের নানা প্রোগ্রাম, প্রাইভেট ও বেসরকারি সংস্থার নানা সভাসমিতিতে নানা জনের সাথে মতবিনিময় করে আমার মধ্যে আস্থা জন্মেছে যে আমাদের সমাজ এইসব মিশনে কাজ করতে প্রস্তুত। আমি আপনাদেরকে পরামর্শ দিতে পারি এই বলে যে আপনারা দুটো গুরুত্বপূর্ণ মিশনে সম্মিলিতভাবে কাজ করুন।

১. এনার্জি ইন্ডিপেনডেন্স বিল প্রস্তুতকরণ : এনার্জি সম্পর্কে তিনটা দিক নির্দেশনা থাকবে যে গুলো থেকে পরিচ্ছন্ন পরিবেশ নিশ্চিতকরণ সম্ভব হবে।

২. ভিশন ২০২০ : একটা সিদ্ধান্ত প্রয়োগ যাতে ভারত রূপান্তরিত হবে একটি নিরাপদ, সমৃদ্ধশালী, সুখী আর আর্থিকভাবে স্বচ্ছল দেশে, যা ন্যাশনাল প্রোসপারিটি ইনডেক্স (এনপিআই) দ্বারা পরিমাপ যোগ্য হবে।

সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এই সমস্ত বিলের বাস্তবতা গুরুত্ব সহকারে অনুধাবন করতে আপনারা আমার সাথে একমত হবেন।

এই ইস্যুগুলোকে আমি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে আমি আমার বক্তৃতায় তুলে ধরেছি এবং পরে তা বইয়ে গ্রন্থিত করেছি।

রাষ্ট্রপতিভবনে থেকে আমি চমৎকার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলাম। যখনই আমি কোন নির্দিষ্ট রাজ্য কিংবা মন্ত্রণালয় ও সরকারি বিভাগের কোন ইস্টিটিউট এ কিংবা প্লানিং কমিশন কিংবা রাজ্য সরকারের কাছে সর্বশেষ তথ্য উপাত্ত চাইতাম তখনই তা রাষ্ট্রপতির সেক্রেটারিয়েটে সরবরাহ করা হতো। এইসব তথ্য উপাত্ত থেকে আমার ভাষণের খসড়া তৈরি করা সহজ সাধ্য হতো। পার্লামেন্ট এবং বিভিন্ন রাজ্যের অ্যাসেম্বলিতে, পাবলিক ও প্রাইভেট সেক্টরে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বক্তৃতায় আমি সেই সব তথ্য উপাত্তকে উপস্থাপন করেছিলাম। আমি রাষ্ট্রপতি হবার আগে এই সুযোগ পাই নি।

রাষ্ট্রপতিভবনে আমার অবস্থান কালে আমি বারটা স্টেট অ্যাসেম্বলিতে ভাষণ দিয়েছিলাম। সেই সব ভাষণে আমি দেশের সমৃদ্ধির জন্য আমার ভিশনের কথা ব্যক্ত করেছিলাম। তথ্যাদি সংগ্রহ করে বিচার বিশ্লেষণ করতে এক মাসের মধ্যে পনরো দিন লেগে যেত। এই প্রস্তুতির জন্য ভার্চুয়াল কনফারেন্স রাষ্ট্রপতি ভবনের মালটিমিডিয়া ফ্যাকাল্টি থেকে পরিচালিত হতো। আলোচনার জন্য যখন বিশেষজ্ঞদেরকে পাওয়া যেত তখন এই কাজ চলতো সন্ধ্যা ৮টা থেকে মাঝরাত পর্যন্ত। রাজ্যগুলো ছিল : জম্মু ও কাশ্মির, হিমাচলপ্রদেশ, গোয়া, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, কর্ণাটক, কেরালা, অন্ধ্রপ্রদেশ, মিজোরাম, মেঘালয়, সিকিম এবং পন্ডিচেরি।

রাজ্যগুলোর আর্থসামাজিক অবস্থা যাচাই করে এই রাজ্যগুলোকে নির্ধারণ করা হয়েছিল। রাজ্যগুলো নির্ধারণের ক্ষেত্রে পারক্যাপিটাল ইনকাম, লিটারেসি লেভেল, বেকারত্বের হার, দারিদ্র্যসীমার জনসংখ্যার হার, মাতৃত্ব আর মৃত্যুরহার, কৃষি, শিল্প আর চাকরির হার ইত্যাদি ফ্যাক্টরকে যাচাই-বাচাই করা হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ মিশন বিহারকে নির্ধারণ ‘করেছিল এইসব তথ্য উপাত্তের উপর ভিত্তি করে। ১) কৃষি আর উৎপাদিত ফসলের মূল্যের উপর ভিত্তি করে, ২) এডুকেশন ও উদ্যোগবিনিয়োগকারী, ৩) মানবসম্পদ, ৪) নালন্দা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ৫) হেল্থ কেয়ার মিশন, ৬) বন্যার পানির ব্যবস্থাপনা,৭) টুরিজম, ৮) অবকাঠামো, ৯) এক্সক্লুসিভ ইকোনোমিক জোন, ১০) ই-গভর্নেন্স। এই দশটা মিশন বাস্তবায়নের ফলে বিহারের পারক্যাপিটাল ইনকাম রুপি ৬৩০০ (২০০৫-০৬) থেকে রুপি ৩৫০০০ তে বৃদ্ধি পায় ২০১০ সালে। বন্ধুসুলভ পরিবেশের জন্য ২০০৫ এর ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ১০ মিলিয়ন বেকার / আধা বেকারের মাঝ থেকে বিপুল সংখ্যককে চাকরি দেওয়া সম্ভব

হয়েছিল। বিহার সরকার ২০১৫ এর মধ্যে শিক্ষা আর চাকরির ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্র ধার্য করে এক শত পার্সেন্ট। সরকার বহু স্কিম গ্রহণ করেছিল। আজকের দিনে বিহার উন্নতিতে শীর্ষে থাকায় আমি খুশি হয়েছিলাম। রাজ্য অ্যাসেম্বলির সদস্যরা এই রাজ্যের উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। আমি বিহার অ্যাসেম্বলিতে ভাষণ দেবার পর রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভাইস চ্যান্সেলরদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছিলাম। তাছাড়াও বিহার রাজ্যের চেম্বার অব কমার্সে এই থিমের উপর বক্তব্য পেশ করেছিলাম।

কেরালাতে মালইয়ালা মনোরমাতে কেরালার সমৃদ্ধির জন্য মিশনের কথাগুলোকে মালয়ালম ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করা হয়েছিল। জেলা পর্যায়ের ওয়ার্কসপগুলো পরিচালিত হয়েছিল মিশন যে সমস্ত বিষয় বাস্তবায়ন করতে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তার আলোকে। ওয়ার্কসপগুলোর সিদ্ধান্তগুলো সুপারিশের আকারে রাজ্য অ্যাসেম্বলিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অন্য রাজ্যগুলোর উন্নয়ন সম্পর্কে মিডিয়া সুন্দর কভারেজ করেছিল। আমি রাজ্যগুলোর বিভিন্ন সংস্থা থেকে অনেক অনেক ফিড ব্যাক পেয়েছিলাম।

[একই কৃষ্টি আর মূল্যবোধের সুতোয় কোটি কোটি লোককে সম্পৃক্ত করাই আমার স্বপ্ন ছিল। আমাদের মহাকাব্যগুলো আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয় আমাদের গৌরবময় অতীতের কথা। আর সেই ধারায়ই আমাদের সুন্দর ভবিষ্যত রচিত হবে।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *