১৩। বিতর্কমূলক সিদ্ধান্তসমূহ

১৩. বিতর্কমূলক সিদ্ধান্তসমূহ

সচেতন আত্মার আলো

.

রাষ্ট্রপতি থাকাকালে এবং তার আগে পরে আমার চিন্তাভাবনা এবং কাজকে বিশ্লেষণ করা কষ্টকর। একজন ব্যক্তির তিনটি সময়কালের পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে অভিজ্ঞতার ধরন একেক রকম। সংঘটিত কাজগুলো যুক্তিতর্ক আর কার্যকারণের উপর ভিত্তি করে আমার ব্যক্তিগত আবেগের উপর প্রভাব বিস্তার করেছিল। বিহার অ্যাসেম্বলি ভেঙ্গে দেবার পরিপ্রেক্ষিতে আমার ব্যক্তিগত আবেগের উপর প্রথম প্রভাবটা পড়লো। আমি এই ইস্যু নিয়ে বহুবার আলোচনা করেছি। আমার আমলে আইটি সেক্টরে প্রভূত উন্নতি হয়েছিল। রাষ্ট্রপতিভবনের সাথে ইলেকট্রোনিক্যাল সংযোগ সুপ্রতিষ্ঠত হয়। যখনই প্রয়োজন তখনই আমি যেকোন স্থানের যে কোন ব্যক্তি কিংবা সংস্থার সাথে যোগাযোগ করতে পারি। তাৎক্ষণিক যোগাযোগের জন্য ইমেলেরও সুবিধা আছে। আমি মস্কো থাকাকালে মনমোহন সিং আমাকে ফোন করে জানালেন যে বিহার অ্যাসেম্বলি ভেঙ্গে দেবার সুপারিশ করে ক্যাবিনেট একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। আমি প্রধানমন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলাম, হঠাৎ করে কিভাবে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। প্রধানমন্ত্রী বললেন যে তিনি কল ব্যাক করছেন। মস্কো টাইম ১ টায় প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে দ্বিতীয় বার ফোন পেলাম। আমি তার সাথে আলোচনা করার পর এটা বললাম। আমি ক্যাবিনেটের সিদ্ধান্তের সাথে একমত না হলেও আমাকে রাজি করানো হবে। তাই আমি স্থির করেছি অ্যাসেম্বলি ভেঙ্গে দেবার

এটা কোর্ট পর্যন্ত গড়ালো। বিহারের গভর্নর ভারতের রাষ্ট্রপতির কাছে দুটো রির্পোট পাঠিয়েছিল। একটা ২০০৫ এর ২৭ এপ্রিল আর একটা ২০০৫ এর ২১ মে। সংবিধানের ১৭৪ আর্টিকেলের ক্লজ ২ এর সাব ক্লজ (বি) এর বিধান মোতাবেক ২০০৫ এর ২৩ মে নোটিফিকেশন ইস্যু করা হয়। সংবিধানের ৩৫৬ আর্টিকেলের আওতাধীনে নোটিফিকেশন জিএসআর ১৬২ (ই) ২০০৫ এর ৭ মার্চ পঠিত হবার পর বিহার অ্যাসেম্বলি তাৎক্ষণিকভাবে ভেঙ্গে যায়। সুপ্রিমকোর্ট এই ইস্যুটির উপর অনেক যুক্তিতর্ক, মতামত আর আলোচনা শুরু করে। সুপ্রিম কোর্ট বিচারে এটাই নির্দেশিত করে যে ২০০৫ এর ২৩ মে তারিখের নোটিফিকেশন একটা চমৎকার মামলার অবতারণা করেছে। এই কোর্টে দাখিল করা আগের মামলাগুলোতে অ্যাসেম্বলি ভেঙ্গে দেবার বিধান জারি করা হয়েছিল যখনই ক্ষমতাশীল পাটি অ্যাসেম্বলি সংখ্যা গরিষ্ঠতা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছিল। বর্তমান কেসটি হচ্ছে নিজস্ব ধারার। লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলির প্রথম মিটিং হবার আগেই অ্যাসেম্বলি ভেঙ্গে দেবার আদেশ জারী করা অবৈধ্য। এই ধারা অব্যাহত থাকলে সংবিধান লঙ্ঘিত হবে। কোর্ট চারটি প্রশ্ন করলো :

১. প্রথম মিটিং অনুষ্ঠিত না হবার আগেই সংবিধানের আর্টিকেল ১৭৪ (২)(বি) ধারা মতে লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি ভেঙ্গে দেওয়া কি বিধিসম্মত?

২. ২০০৫ এর ২৩ মে তারিখে বিহার লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি ভেঙ্গে দেবার ঘোষণা দেওয়া কি অবৈধ্য ও অসংবিধানিক নয়?

৩. যদি এই দুটি প্রশ্নের উত্তর ইতিবাচক হয় তবে কি ২০০৫ এর ৭ মার্চ কিংবা ২০০৫ এর ৪ মার্চের পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়া উচিত নয়?

৪. আর্টিকেল ৩৬১ মতে গভর্নরের কি সুযোগ আছে লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি ভেঙে দেবার?

সুপ্রিম কোর্ট এই ইস্যুর উপর বিতর্ক শুরু করলে নানা মতামত উঠে এলো। আমি পিএম কে বললাম যে পদ্ধতিতে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে তা সুপ্রিম কোর্টে যথাযথভাবে উপস্থাপন করা হয় নি। এই কথাটা আমি তাকে একবার টেলিফোনে, আর একবার সামনাসামনিও বললাম। পিএম উল্লেখ করলেন যে তিনি আইনজীবীদেরকে বুঝিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি মস্কোতে থাকাকালে আমাদের অনেকবার আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টাতে রাষ্ট্রপতি সম্মতি দিয়েছিলেন। আমি আইনজীবীদের বুঝাতে পারলে ও তারা কিন্তু আমার বক্তব্যের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন নি। সুপ্রিম কোর্টের বিচারকরা বিধান লঙ্ঘনের জন্য গভর্নর তথা সরকারকেই দোষারোপ করলো। মোটের উপর এর সব দ্বায়দায়িত্ব আমার ও ক্যাবিনেটের উপর এসে বর্তালো।

রায়টা জানা মাত্র আমি একটি পদত্যাগপত্র লিখে উপরাষ্ট্রপতি ভোইরো সিং শেখোয়াতের কাছে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত করে রাখলাম। তিনি একজন ঝানু রাজনীতিবিদ। আমি তার সাথে এ বিষয়ে আলাপ করে পদত্যাগপত্রটা তার হাতে দিতে চাইলাম। উপরাষ্ট্রপতি বাইরে ছিলেন। এক সময় বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনার উদ্দেশ্যে পিএম আমার সাথে দেখা করতে চাইলেন। বিকেলের দিকে অফিসে আমরা মিলিত হলাম। আলোচনা শেষে আমি তাকে বললাম যে আমি রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তাকে আমার লেখা পদত্যাগপত্রটাও দেখালাম। আমি উপরাষ্ট্রপতি ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করছি। প্রধানমন্ত্রী বিস্ময়ে চমকে উঠলেন।

সে মুহূর্তে যে অভাবনীয় দৃশ্যের অবতারণা হলো তা আমি বর্ণনা করতে চাই না। প্রধানমন্ত্রী আমাকে বোঝালেন এই সংকটময় মুহূর্তে আমার পদত্যাগ করা উচিত নয়। তিনি আরো বললেন যে আমার পদত্যাগের ফলে এমন একটা ঘটনার উদ্ভব হবে যাতে সরকারেরও পতন ঘটে যেতে পারে। এই বিষয়ে আলোচনা করার মতো আর কেউ আমার নেই, শুধুমাত্র আমি আমার বিবেকের কাছেই বিষয়টা সম্বন্ধে জানাতে পারি। বিবেক হচ্ছে আত্মার আলো, আমাদের হৃদয়ের প্রকোষ্ঠে প্রকোষ্ঠে প্রজ্জ্বলিত থাকে। ওই রাতে আমি ঘুমাতে পারলাম না। আমি নিজেকে প্রশ্ন করলাম বিবেকই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ না জাতি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পরদিন সকাল সকাল বিছানা ছেড়ে রোজকার মতো নামাজ পড়লাম। তারপর আমি ঠিক করলাম পদত্যাগপত্র দাখিলের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের যাতে সরকার বিপন্ন অবস্থায় না পড়ে।

দেশের খুব কম লোকই ই-গভর্ন্যান্স ব্যবহার সম্বন্ধে অবগত, যাকে আমি সীমান্তহীন জগত বলে মনে করি। আমি একে ভারত ও বিদেশের মধ্যে যোগসূত্র হিসাবে গড়ে তোলবার ইচ্ছে করেছিলাম। লোকজন ফাইল নিয়ে দৌড়াদৌড়ি না করে ই-গভর্ন্যান্স এর মাধ্যমে অফিস আদালতের কাজ সমাধা করবে সেইটাও ছিল আমার বাসনা। বিহার অ্যাসেম্বলি (তা পড়ে কার্যকর হয় না) ভেঙ্গে দেওয়ার কাজটি কি আমার বিবেকের সিদ্ধান্ত ছিল!

.

দান গ্রহণের বিরুদ্ধে মনু প্রত্যেক মানুষকে সতর্ক করে দিয়েছেন। দান গ্রহণ করলে গ্রহণকারীকে দাতার নিকট দায়বদ্ধ থাকতে হয়। তিনি বলেন, দান গ্ৰহণ করা খারাপ কাজের মধ্যে পড়ে।

প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, পার্লামেন্ট অ্যাক্ট ১৯৫৯ (অযোগ্যতা প্রতিরোধ) এ বলা হয়েছে সরকারের সঙ্গে সংশিষ্ট কেউ অফিস অব প্রোফিট গ্রহণ করতে পারবে না। তা পার্লামেন্টের সদস্যদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। ২০০৬ এর মাঝামাঝি সাংসদদের কাছ থেকে আমি অভিযোগ পেলাম কতিপয় সদস্য অফিস অব প্রোফিট লাভ করছেন। আমাকে অভিযোগ সম্বন্ধে খোঁজ খবর নিতে হলো। প্রয়োজনীয় তদন্ত করার জন্য আমি এই বিষয়টি চিফ ইলেকশন কমিশনারের কাছে পাঠালাম। এ সম্বন্ধে দু’জন সদস্যের কাছ থেকে অভিযোগ পেলাম। একজন হচ্ছেন মিসেস জয়া বচ্চন আর একজন হলেন মিসেস সোনিয়া গান্ধী, বিপুল সংখ্যক সদস্য আমাকে জিজ্ঞেস করলেন কেন রাষ্ট্রপতি এই বিষয়ে তদন্ত করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। অনুমোদন প্রদানের জন্য এর মাঝে আমি অফিস অব প্রোফিট বিল পার্লামেন্ট থেকে পেলাম। আমি বিলটা পড়ে দেখলাম তার মধ্যে অনেক অস্বাভাবিকতা আছে। প্রস্তাবিত অফিস অব প্রোফিট বিল এ আমি খুঁজে পেলাম না কোন সিস্টেমেটিক অ্যাপ্রোচ যা থেকে বোঝা যায় অফিস অব প্রোফিট এর সংগা কী! শুধুমাত্র সাংসদের অধিকারে থাকা অফিসগুলো সম্বন্ধেই বলা হয়েছে। আমার সাথে সংশ্লিষ্ট সুপ্রিম কোর্টের তিন জন বিচারকের সাথে অফিস অব প্রোফিট বিলের অস্বাভাবিকতা সম্বন্ধে আলোচনা করলাম। আমি, আমার টিম ও ওই তিনজন বিচারকের সাথে পরামর্শ করে একটা পত্ৰ প্রস্তুত করলাম। আমি মতামত দিলাম এই বলে যে অফিস অব প্রোফিট সম্বন্ধে খোলামেলা আর গ্রহণযোগ্য স্বচ্ছ ও পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে। রাজ্য ও ইউনিয়ন টেরিটোরিগুলোর ক্ষেত্রেও অফিস অব প্রোফিট সম্পর্কে নীতি নির্ধারণ করতে হবে।

তারপর প্রশ্ন উত্থাপিত হলো আমার পত্রের ভিত্তিতে অফিস অব প্রোফিট ক্যাবিনেট কিংবা পার্লামেন্টে উপস্থাপন করতে হবে কিনা। আমি সংবিধানের আর্টিকেল ১১১ তে দেখলাম পুনর্বিবেচনার জন্য কোন বিলকে পার্লামেন্টে ফেরত পাঠানো যেতে পারে। অফিস অব প্রোফিট বিল ক্যাবিনেটের দ্বারা আমার কাছে অনুমোদনের জন্য আসবে না। অনুমোদনের জন্য আসতে হবে পার্লামেন্ট থেকে। যা হোক, আমি বিলটি পার্লামেন্টের উভয় হাউস লোকসভা ও রাজ্যসভার সেক্রেটারি জেনারেলের কাছে পুনর্বিবেচনার জন্য ফেরত পাঠালাম। এটাই ছিল পার্লামেন্ট কিংবা রাষ্ট্রপতিভবনের ইতিহাসে প্রথম রাষ্ট্রপতির কোন বিলকে পুনর্বিবেচনার জন্য পার্লামেন্টে ফেরত দেওয়া। অবশ্যই পরদিন আমার পত্র পার্লামেন্টে ফেরত দেওয়া সম্পর্কে ইলেকট্রোনিক আর প্রিন্ট মিডিয়াতে লিড নিউজ হিসাবে প্রকাশিত হলো। এটা গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্যবিষয় হিসাবে লোকের মুখে মুখে ফিরলো। আমি শুধুমাত্র মনু স্মৃতির ‘দান গ্রহণ করার ফলে একজন মানুষের স্বর্গীয় আলো প্রাপ্তির আশা নি:শেষ হয়ে যায়।’এই বাণীর আলোকে প্রোফিট কিংবা গিফট এর অর্থ অনুধাবন করতে পারলাম। একটা হাদিসে বলা হয়েছে, ‘যখন সর্বশক্তিমান একজন মানুষকে একটা অবস্থান দান করেন তখন তিনি তার প্রয়োজনের প্রতি লক্ষ্য রাখেন। যদি কোন লোক এর বিনিময়ে কোন কিছু গ্রহণ করে তবে তা অবৈধ অর্জন বলে বিবেচিত হবে।’

অফিস অব প্রোফিটকে ফিরিয়ে দেওয়া আমার বিবেচনার বিষয়। বিলটি পুনর্বিবেচনা করে অনুমোদনের জন্য আমার কাছে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হলো। প্রধানমন্ত্রী আমার সাথে সাক্ষাৎ করেন। পরদিন আমি বিলটি স্বাভাবিকভাবে অনুমোদন করে ফেরত পাঠিয়ে দিলাম। আর কোন অজুহাত না দেখিয়ে বিলটিতে সহি করে পাঠিয়ে দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রী বিস্মিত হলেন। আমি বললাম পার্লামেন্ট থেকেই কিছু করা প্রয়োজন। কোনকিছু করা হয়েছে কিনা তা আমি জানি না। প্রধানমন্ত্রী বললেন পার্লামেন্টে আমার মতামতের ভিত্তিতে অফিস অব প্রোফিট বিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার জন্য জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটি (জেপিসি) গঠন করেছে। অবশ্যই এই বিলের মিনিমাম রিকোয়ারমেন্ট পূরণ সাপেক্ষেই আমি অনুমোদন দিয়েছিলাম।

এই ইস্যু সম্বন্ধে আলোচনা করার জন্য অনেক পার্টির প্রতিনিধিরা আমার সাথে দেখা করতে এলেন। আমি তখন উত্তর পূর্ব ভারত সফর করছিলাম। দিল্লির পথে কোহিমা থেকে বিমানে গৌহাটিতে পৌঁছিলাম। আমার সফরের প্রাক্কালে আমি অফিস অব প্রোফিট বিল পার্লামেন্টের অনুমোদনের জন্য জেপিসি গঠনের বার্তা পেলাম। কয়েক মাস পরে পার্লামেন্ট জেপিসি এর রিপোর্ট অনুমোদন করলো।

সম্প্রতি আমরা দুনীতির বিরুদ্ধে দুটো অনশন আন্দোলন প্রত্যক্ষ করলাম। এতে অনেকেই দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য অনুপ্রাণিত হলো। আমি নিজেকে প্রশ্ন করলাম কেন আমাদের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এ ধরনের আন্দোলনের প্রয়োজন পড়লো। বস্তুতপক্ষে, দুর্নীতি প্রতিরোধ করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া পার্লামেন্টের নিজেরই দায়িত্ব। আমি মতামত প্রকাশ করতে চাই যে পার্লামেন্টকে ওয়াক আউট ব্যাতিরেকে দুর্নীতি সম্পর্কিত ইস্যুর উপর কমপক্ষে দু’সপ্তাহ আলোচনা করে সময় নির্ধারণ পূর্বক এজেন্ডা গ্রহণ করে জনজীবন থেকে এই দুষ্টগ্রহকে নির্মূল করা উচিত। এরই অংশ হিসাবে সাংসদদের জন্য কোড অব কনডাক্ট প্রকাশ করা উচিত। যদি জনগণের প্রতিনিধিরা তাদের মিশন কার্যকর করতে ব্যর্থ হয় তবে জনগণ তাদের হতাশা ব্যক্ত করতে পারেই। প্রত্যেক রাজনৈতিক পার্টিকে নিজস্ব পন্থায় পার্লামেন্টের মাধ্যমে দুর্নীতি নির্মূল করতে হবে। পার্লামেন্টের উভয় হাউসের এগিয়ে আসার সময় এসেছে দুর্নীতি সম্পর্কিত ইস্যুগুলোকে সাংবিধানিক পদ্ধতিতে সমাধান করার। পার্লামেন্টের এই ধরনের পদক্ষেপের ফলে নাগরিকদের মধ্যে আস্থা গড়ে উঠবে এবং ফলশ্রুতিতে সমাজে শান্তি ও সৌহার্দ্য বৃদ্ধি পাবে, তাতে জাতির উন্নতি ঘটবে।

.

রাষ্ট্রপতি হিসাবে আমার জন্য অধিকতর কঠিন কাজ ছিল আপিলের পরে কোর্টের দেওয়া সর্বোচ্চ শাস্তি প্রাপ্ত আসামীদের রাষ্ট্রপতির ক্ষমা ঘোষণা সম্পর্কিত। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কেস রাষ্ট্রপতিভবনে বেশ কয়েক বছর যাবত পেন্ডিং পড়ে আছে। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত মামলাগুলোর ফয়সালা করা রাষ্ট্রপতিদের একটা দায়িত্ব, সেই দায়িত্ব পালন করতে কোন রাষ্ট্রপতিই খুশি ভাব দেখান নি। আমি ভাবলাম এই সমস্ত পেন্ডিং কেসগুলো সাধারণ নাগরিকের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অপরাধ খতিয়ে দেখবো। সর্বোচ্চ শাস্তি প্রাপ্ত আসামীদের ব্যক্তিগত সামাজিক ও আর্থিক অবস্থা যাচাই করে দেখা যেতে পারে। আমি কেসগুলো স্টাডি করে দেখে বিস্মিত হলাম, অধিকাংশ পেন্ডিং পড়ে থাকা কেসই সামাজিক ও অর্থনৈতিক কলহের কারণে ঘটেছে। আমি অনুভব করলাম আমরা যে লোকটিকে শাস্তি দিতে যাচ্ছি সেই লোকটির প্রত্যক্ষভাবে ক্রাইম করার ইচ্ছে ছিল না। তবে একটা কেস দেখলাম, নি:সন্দেহে লোকটি মেয়েটিকে রেপ করে হত্যা করেছে। ওই কেসটিতে আমি দন্ডাদেশ বহাল রাখতে সম্মতি দিলাম।

.

রাষ্ট্রপতির দায়িত্বগুলোর মধ্যে আর একটা দায়িত্ব সাধারণ নির্বাচনের পর দেশের প্রধানমন্ত্রীকে নিয়োগদান করা। স্থিতিশীল সরকার গঠন করতে একক পার্টি কিংবা কোয়ালিশন পার্টিগুলোর ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সদস্যের দরকার হবে। একাধিক দল থেকে সরকার গঠনের দাবি উত্থাপন করলে রাষ্ট্রপতির পক্ষে তখন সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা কঠিন হয়ে পড়ে। ২০০৪ এর নির্বাচনটা ছিল একটা মজার ঘটনা। নির্বাচন শেষ হবার পর ফলাফল ঘোষিত হলো। কোন পার্টিই সরকার গঠনের জন্য সংখ্যা গরিষ্ঠতা পেল না। কংগ্রেস দল সবচেয়ে বেশি সিট পেল। এটা সত্ত্বেও তিন দিন অতিবাহিত হয়ে গেল। কোন পার্টি কিংবা কোয়ালিশন সরকার গঠনের জন্য এগিয়ে এলো না। আমার কাছে বিষয়টা বিব্রতকর হয়ে উঠলো। আমি আমার সেক্রেটারিদেরকে বৃহত্তম দলের নেতার কাছে একটা পত্র পাঠাতে বললাম। এক্ষেত্রে কংগ্রেস এগিয়ে এসে সরকার গঠনের জন্য দাবি জানালো।

আমাকে বলা হলো যে সোনিয়া গান্ধী ১৮ মে ১২.১৫ টায় আমার সাথে সাক্ষাৎ করতে আসবেন। তিনি যথাসময়ে আসলেন, কিন্তু তিনি একা না এসে ড. মনমোহন সিংকে সাথে নিয়ে আসলেন। আমার সঙ্গে সাক্ষাতের পর বিভিন্ন পার্টির সমর্থনের পত্রগুলো আমাকে দেখালেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমি তাদেরকে ধন্যবাদ জানালাম। আপনাদের পছন্দ মত সময়ে আমি শপথ অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে পারি। সোনিয়া গান্ধী আমাকে বললেন ১৯৯১ এর অর্থনৈতিক সংস্কারের স্থপতি ড. মনমোহন সিংকে প্রধানমন্ত্রী পদে মনোনয়ন দান করছি। নিশ্চিতভাবে এটা ছিল আমার কাছে অবাক করা ব্যাপার। রাষ্ট্রপতিভবনের সেক্রেটারিয়েট প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নিয়োগপত্র দেবার জন্য আবার কাজ শুরু করলো। তাকে নতুন সরকার গঠনের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হলো।

পরিশেষে, ২২ মে তারিখে সুসজ্জিত অশোকা হলে ড. মনমোহন সিং এবং ছিষট্টি জন মিনিস্টারের শপথ অনুষ্ঠান হলো।

গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সুসম্পন্ন করতে পেরে আমি হাঁফ ছাড়লাম। সত্যি সত্যি তিন দিনের মধ্যে কোন পার্টি সরকার গঠনের দাবি না জানানোর জন্য আমি উদ্বিগ্ন ছিলাম।

//আমার আমলে আমি কঠিন কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলাম। লিগ্যাল ও সাংবিধানিক বিশেষজ্ঞদের মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে আমি আমার মনকে পুরোপুরি দৃঢ় অবস্থায় রাখতে সমর্থ হয়েছিলাম। আমার সিদ্ধান্তগুলোর প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল আমাদের সংবিধানকে সমুন্নত রাখা।//

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *