১২. উদ্যানে
আমি আনন্দ-বেদনাকে বন্দি করতে কোন দেওয়াল তুলি না
উৎসর্গ কিংবা অর্জন,লাভ কিংবা ক্ষতি,
আমি সব খোলা জায়গায় ফুল জন্মাই,
পুকুর আর নদীতে লিলি ফুলগুলো ভাসতে থাকে।
.
আমাকে ১৯৯৭ এ ভারতরত্ন পুরস্কার দেবার সময় চিত্রা নারায়ণন (রাষ্ট্রপতি কে. আর. নারায়ণনের মেয়ে) আমাকে, আমার ভাই আর তার নাতিকে মোঘল গার্ডেনের চারদিক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখানোর জন্য নিয়ে যান। সেটা ছিল উৎফুল্ল হবার মতো একটা অভিজ্ঞতা। আমি তার কাছে পূর্ণিমার একটা রাতে মনোমুগ্ধকর উদ্যানটি দেখবার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলাম। রাষ্ট্রপতি আর তার স্ত্রী মিসেস ঊষা নারায়ণন আমার ইচ্ছের কথা জানতে পারেন। তারপর যখনই অফিসিয়াল ভোজসভায় যোগদান করেছি তখনই রাষ্ট্রপতি এবং ফার্স্ট লেডি আমাকে রাষ্ট্রপতিভবনে অবস্থান করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আমি তখন উপলব্ধি করতে পারি নি ভবিষ্যতে রাষ্ট্রপতিভবনে ষাটটি পূর্ণিমার রাত আমি কাটাতে পারবো।
এক সময় আমি রাষ্ট্রপতিভবনে এলাম। মোঘল গার্ডেন আমার কাছে প্রয়োগিক অর্থে একটা প্লাটফরম হয়ে উঠলো। এই উদ্যানটি আমার সাথে প্রকৃতি আর দেশের নাগরিকদের যোগাযোগের একটা ক্ষেত্র হয়ে উঠলো। ওখানেই আমি দেশের সর্বস্তরের মানুষের সাথে মিলিত হই। যাদের সাথে আমি মিলিত হই তাদের মধ্যে ভেষজ উদ্ভিদের বিশেষজ্ঞরাও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। পশু- পাখিরা আনাগোনা করে অবিরতভাবে। তারা আমার সার্বক্ষণিকের সাথী ছিল। উদ্যানের শান্তসমাহিত পরিবেশে বেড়ে উঠা গাছগুলোর মধ্যে আমি শান্তির আবেশ অনুভব করলাম।
বেশ কয়েকটা অনুষ্ঠানে আমি সফররত রাষ্ট্র বা সরকার প্রধানদের সাথে এই উদ্যানে হেঁটেছিলাম। ২০০৭ এর সার্ক দেশগুলোর রাষ্ট্রপ্রধানদের সাথে এই উদ্যানে বেড়ানোর কথা স্মৃতিতে বিশেষভাবে ভাস্বর হয়ে আছে। আমার মনে পড়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শওকত আজিজের মন্তব্য, যদি আমরা মোঘল গার্ডেনে বসে দ্বিপাক্ষিক সমস্যাগুলো সম্বন্ধে আলোচনা করতে পারতাম তবে আমাদের দু’দেশের মানুষের মনের জমানো বরফ গলতে শুরু করতো। শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রীকে এক ঘন্টার জন্য এই উদ্যানে চা পানে আপ্যায়ন করেছিলাম। আমি এখানকার সুন্দর লনে আমাদের রিজিয়নের উন্নয়নের জন্য আলাপ আলোচনার আয়োজনও করেছিলাম। আমি উদ্যানে দুটো কুটির তৈরি করিয়েছিলাম, দুটোর ডিজাইনই পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রাকৃতিক উপকরণ দ্বারা তৈরি করানো হয়। একটা তৈরি করেছিলেন ত্রিপুরার কারিগররা। ওটার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘থিংকিং হাট’ আমি আমার বহু ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সাথে এই কুটিরে উইকএন্ড এ আলাপ আলোচনা করতাম। এই কুটিরে বসে আমি আমার ইনডোমিটেবল স্প্রিট বইখানার অধিকাংশটাই লিখেছিলাম। দ্বিতীয় কুটিরটির নাম দিয়েছিলাম। এই কুটিরটি ষোলটি গাছ, চৌত্রিশ প্রকারের ভেষজ গাছের বাগান, একটি মিউজিকাল চত্বর এবং একটা বায়োডাইভারসিটি পার্ক দ্বারা বেষ্টিত ছিল। ‘ইমমোট্রাল হাট’ এ বসে আমার বন্ধু প্রফেসর অরুণ তেওয়ারির সাথে আলাপ আলোচনার ভিত্তিতে গাইডিং সোল নামের আমার লেখা বইখানিতে মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে আমার অভিমত প্রকাশ করি। কঠিন জাতীয় ইস্যু সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেবার প্রশ্ন দেখা দিলেই আমি এই দুটো কুটিরে বসে চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই কুটিরে বসে আমি আমার কবিতা লেখার অনুপ্রেরণাও পেয়েছি।
.
রাষ্ট্রপতিভবনের জমির পরিমাণ ৩৪০ একরেরও বেশি। অন্যদিকে, মোঘল গার্ডেন পনেরো একর আয়তনের। উদ্যানটিতে তিনটি বড় বড় চত্বর রয়েছে। চত্বরগুলো আয়তকার। আয়তকার চত্বর এবং মূল মোঘল গার্ডেনে সুন্দর সুন্দর জিনিসে ভরপুর। চারটি খাল, ছয়টা ঝর্ণা, ৭০ বর্গ মিটারের কেন্দ্রীয় লন (এই লনে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক জাতীয়সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। প্রজাতন্ত্র দিবস এবং স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানও এখানেই অনুষ্ঠিত হয়।) পত্রপল্লবে সুসজ্জিত বৃক্ষরাজি, সুন্দর সুন্দর গোলাপের বাগান, বিভিন্ন আকারের আরো কয়েকটি লন। উদ্যানটি বড় একটা লম্বা লনের সাথে যুক্ত, যেখান থেকে দ্বিতীয় চত্বরটা আরম্ভ হয়েছে। লম্বা লনটাতে ৫০ মিটার লম্বা মূল পথ। মাঝখানটা লতানো ফুলের গাছের সমারোহ। পথের উভয় পাশে গোলাপের বেড আর চাইনিজ অরেঞ্জের সারি। লম্বা উদ্যানটা পশ্চিম দিকের তৃতীয় অংশের সাথে যুক্ত। গোলাকার চত্বরটাকে গোলাকার উদ্যান বলা হয়। সব ফুল ফুটলে এটাকে মনোমুগ্ধকর মনে হয়। বিখ্যাত লনটাতে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ ডবলু. শ, তার পত্নী এবং তার সাথে আসা অতিথিদেরকে ভোজে আপ্যায়ন করা হয়েছিল। রাষ্ট্রপতিভবনের এই ভোজসভায় বিখ্যাত বিখ্যাত শিল্পী, বুদ্ধিজীবী, গণ্যমাণ্য ব্যক্তিদেরকেও আপ্যায়ন করা হয়েছিল। ভোজসভায় উপস্থিত হয়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট দম্পতি গভীরভাবে আপ্লুত হয়েছিলেন।
মোঘল গার্ডেনের ওই তিনটা চত্বরের অন্যান্য উদ্যানগুলো ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে মার্চের মাঝামাঝির মধ্যে সুন্দরভাবে সেজে উঠে। শীতকালীন ফুলগুলো সম্পূর্ণরূপে বিকশিত হয় আর অন্যদিকে গোলাপ, লতানো ফুলের গাছ আর ঝোপঝাড় ফুলে ফুলে ভরে যায়।
ড. ব্রহ্মা সিং অফিসার অন স্পেশিয়াল ডিউটি মোঘল গার্ডেনের ফুলের বাগানগুলোকে নানা ফুলের সমারোহে সুজ্জিত করার জন্য তালিকা তৈরি করতে লেগে পড়েন। অ্যাক্রোস্তিনিয়াম, অ্যানটিরহিনাম, ব্রাসিকম, বেগোনিয়া, ক্যালেন্ডুলা, ক্যাম্পানুলা, ক্যন্ডিটাফটন্ডিটা, করোনেশন, ক্রিসানথেমাম, সেলোসিয়া, চায়না, অস্টার, সিনেরারিয়া, ক্যালিওপসিস, কসমস, ক্লার্কিয়া, কর্ণফ্লাওয়ার, ডেইজি, ডেলফিনিয়াম, ডায়ানথাস, ডালিয়া এবং আরো অনেক নামের ফুলে ফুলে ভরে উঠে ফুল বাগানগুলো।
হাজার হাজার মানুষ এই উদ্যানের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়। কোন প্রকার প্রবেশমূল্য ছাড়াই উদ্যানটি জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। এখানে বিশেষ বিশেষ অতিথিদের জন্য জাতীয় দিবসগুলোতে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এইসব অতিথিদের মধ্যে থাকেন কৃষক, প্রতিরক্ষাবাহিনীর লোকজন, সিনিয়র সিটিজেন, শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধিরা সহ আরো অনেকেই। ড. ব্রহ্মা সিং রাষ্ট্রপতিভবনের বৃক্ষরাজিকে সুন্দরভাবে ইলাস্ট্রাটেড করে পুস্তক প্রকাশ করেন।
২০০২ এর দিকে আমি ভাবলাম কেমন করে রাষ্ট্রপতিভবনের জমিকে আরো ফলফুলে সুসজ্জিত করে তোলা যায়। কিভাবে বেশি আরো জায়গাকে সবুজ অরণ্যে পরিণত করা যায়। পাহাড়ের উচ্চতায় পাহাড়ি মাটিতে শাকসব্জি আর ফুল বাগান করা আমার কাজ করার অভিজ্ঞতার আলোকে আমি রাষ্ট্রপতিভবনকে বৃক্ষলতা আর ফলফুলে সাজিয়ে তোলার পরিকল্পনা নিলাম। ডিআরডিও-এর কৃষি বিজ্ঞানী ও ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব সায়েন্টিফিক এন্ড এগ্রিকালচারাল রিচার্স এবং কাউন্সিল অব সায়েন্টিফিক এন্ড ইন্ডাসট্রিয়াল রিচার্স (সিএসআইআর) সাথে পরামর্শ করলাম। ড. ব্রহ্মা সিং এর সহায়তায় বারটি গার্ডেন তৈরি করে খুশি হলাম।
.
ভারত এবং বিদেশে খুব কম সংখ্যক ট্যাকটাইল গার্ডেন আছে। লাখনৌ এর সিএসআইআর এর ন্যাশনাল বোটানিক্যাল রিচার্স ইনস্টিটিউট (এনবিআরআই) এ একটি ট্যাকটাইল গার্ডেন আছে। আমি তাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ২০০৪ এ রাষ্ট্রপতিভবনে ট্যাকটাইল গার্ডেন তৈরি করলাম। এটা একটা ইলিপটিক্যাল গার্ডেনও হলো। গার্ডেনটাতে একটা ঝর্ণা, একটা পাথরের পথ, আর সুগন্ধি গাছ, ভেষজ, মশলা, ফল আর অলঙ্করণযুক্ত ফুলের গাছের চৌত্রিশটি বেডের একটা হাউস তৈরি করা হলো। প্রত্যেক বেডে একটা সাইনবোর্ডও লটকানো হলো গাছের বিবরণ ব্রেইল, হিন্দি ও ইংরেজি ভাষায় লিখে। এই গার্ডেন পরিদর্শন করে অনেকেই রোমাঞ্চিত হলো।
.
এক রবিবারে ‘ইমমোর্টাল হাট’ এ বসে ড. ব্রহ্ম সিং ও আমার বন্ধু ড. ওয়াই. এস. রাজনের সাথে আলোচনাকালে একটা মিউজিক্যাল গার্ডেন তৈরির আইডিয়া মাথায় এলো। আমরা অনুভব করলাম বটবৃক্ষের বন আর বায়োডাইভারসিটি
পার্কের ক্ষতির কারণে মিউজিক্যাল পার্কের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। ২০০৬ এ একটা মিউজিক্যাল ফাউন্টেনের আয়োজন করা হলো। এই প্রোজেক্ট এর সাথে সম্পৃক্ততা ছিল বহুমুখী প্রযুক্তি, যেমন ডিজিটাল ইলেক্ট্রোনিক্স, ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিসম, হাইড্রোডাইনামিকস, হাইড্রোস্ট্যাটিক্স আর হিউম্যান ক্রিয়েটিভিটি। ভেতর দরজার মধ্যে আলোর বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে অপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা করা যায়। রাষ্ট্রপতিভবনে মিউজিক্যাল গার্ডেন তৈরি করাছিল একটা গর্বের বিষয়। এক পূর্ণিমার রাতে মনমুগ্ধকর মুহূর্তে রাষ্ট্রপতিভবনের মিউজিক্যাল গার্ডেনে ৫০০ শ্রোতার সামনে পন্ডিত শিবকুমার শর্মার সানতুর বাজনা ছিল মনে রাখার মতো।
.
কয়েক প্রকারের পশুপাখির প্রজাতি সংখ্যা বাড়ানো, একটা জলপ্রপাত, ফিস পন্ড, খরগোশ, হাঁসের ঘর, পাখিদের বাসা, অসুস্থ পশুদের আশ্রয় স্থল তৈরির মাধ্যমে কয়েক বছর ধরে বায়োডাইভারসিটি পার্কের উন্নয়নের কাজ চলছিল। পার্কটি শুধুমাত্র প্রকৃতি আর পশুপাখিদেরকে ভালোবেসেই করা হয় নি, সুখ আর শান্তির অন্বেষায় এটা তৈরি করা হয়েছিল। একদিন প্রাত:ভ্রমণে গিয়ে আমি পরিত্যাক্ত একটা হরিণের বাচ্চা দেখতে পেলাম। আমার সাথী ড. সুধীর আর আমি দেখতে পেলাম তার দুটো পা তার জন্মের সময়ই দুর্বল হওয়ায় হরিণ বাচ্চাটি দাঁড়াতে পারছে না। ড. সুধীর তার পা দুটোতে হাত বুলিয়ে দেখলো। তারপর আমরা ওটাকে তার মায়ের কাছে পৌঁছে দেবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমরা ব্যর্থ হলাম। আমি প্রতিদিন বোতলে দুধ ভরে খাওয়াতে থাকলাম। এক সপ্তাহের মধ্যে হরিণ শিশুটি উঠে দাঁড়ালো, আর এক সময় সে হাঁটতে শুরুও করলো। সে আমাকে দেখলেই দুধের জন্য ছুটে আসতো। কয়েক সপ্তাহ পরে হরিণ শিশুটিকে হরিণের দলের কাছে ছেড়ে দেবার ব্যবস্থা করা হলো। হরিণের দলটি তাকে সাদরে গ্রহণ করলো। আমি স্বস্তিবোধ করলাম।
//রাষ্ট্রপতিভবনের দিনগুলো আমাকে নস্টালজিক অনুষঙ্গে ধরা দেয়। মোঘল গার্ডেন আর অন্যান্য গার্ডেনের সুখানুভুতি আমাকে নাড়া দেয়। ওখানটাতে যে আনন্দ ছিল তা আমি অন্যের সাথে শেয়ার করেছিলাম- উদাহরণস্বরূপ গার্ডেনে দেশের প্রখ্যাত শিল্পীদের সংগীতানুষ্ঠানের কথা বলা যায়। আমাকে প্রকৃতিকে উপভোগ করার সুযোগ দেওয়ার জন্য আমি সর্বশক্তিমানের কাছে মাথা নত করি।//