৩। আমার জীবনের সাত সন্ধিক্ষণ

৩. আমার জীবনের সাত সন্ধিক্ষণ

তুমি নানা সমস্যার শিরোমণি
সমস্যাগুলোকে হটিয়ে সফল হও।

.

আমি শেখাতে আর গবেষণা করতে ভালোবাসি। আমি কখনো বারবার কথা বলে ক্লান্ত হই না। আমার একাডেমিক জীবন চিন্তাচেতনা আর সৃজনশীলতায় ভরপুর। তরুণ-তরুণী ও তাদের শিক্ষকদের সাথে আমার পারস্পরিক সম্পৃক্ততাই আমার নিজের অন্তরের খাদ্য। আমি সচেতনভাবে শিক্ষাঙ্গনে এবং গবেষণার ক্ষেত্রে ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।

আমি সবেমাত্র বর্ণনা করেছি হঠাৎ করে দেশের রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করার ইতিবৃত্ত। যদিও আমি তখন পূর্ণমাত্রায় একাডেমিক ক্যারিয়ার গড়ে তোলবার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেছিলাম। রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণের ঘটনা ছাড়া আরো ছয়টা ঘটনা যা আমার স্মৃতিতে সর্বদা জাগরুক থাকে। রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব শেষ হবার পর ভারত আর বিদেশের একাডেমিক লাইফের সাথে যুক্ত হবার সুযোগ আবার আমি পেলাম।

.

১৯৬১ ছিল আমার জীবনের প্রথম সন্ধিক্ষণ। এয়ারনটিক্যাল ডেভেলপ্‌মেন্ট এস্টাবলিশমেন্ট (এডিই) এ একজন সিনিয়র সায়েন্টিফিক এ্যাসিটেন্ট হিসাবে কাজ করার কথা এখনো স্মরণে আছে। আমি একটা হোভারক্রাফ্‌ট এর চিফ ডিজাইনার ছিলাম। হোভারক্রাফ্টটির নাম দেওয়া হয়েছিল নন্দী। হোভারক্রাফ্ট রেডি হলে আমরা উড্ডয়ন সম্পর্কে ভিজিটরদেরকে ধারনা দিতাম। একদিন (এডিই) এর ডিরেক্টর ড. গোপীনাথ মেডিরাত্তা শ্মশ্রুমণ্ডিত দীর্ঘকায় সুদর্শন একজন ভিজিটরকে নিয়ে এলেন। তিনি আমাকে মেশিন সম্বন্ধে কয়েকটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন। তার চিন্তার স্পষ্টতা আমার মনকে নাড়া দিল। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি আমাকে হোভারক্রাফটে চড়াতে পার?’

ক্রাটে আমরা দশ মিনিট চড়ে ছিলাম। তা ভূমি থেকে কয়েক সেন্টিমিটার উপর দিয়ে উড়ে গেল। যানটির পাইলট ছিলাম আমি। ভিজিটরটি বিস্মিত হলেন। আমার সম্বন্ধে তিনি আমাকে কয়েকটি প্রশ্ন করলেন। যানটিতে চড়ানোর জন্য আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে তিনি প্রস্থান করলেন। তিনি আগে তার পরিচয় আমাকে দেন নি। পরে আমি জানতে পারলাম তিনি টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিচার্সের প্রফেসর এম. জি. কে. মেনন। এক সপ্তাহ পরে আমি ইন্ডিয়ান কমিটি ফর স্পেস রিচার্স অর্গানাইজেশন (আইসিএসআর) থেকে ফোন করে রকেট ইঞ্জিনিয়ার পদের জন্য একটা সাক্ষাৎকার নেবার জন্য আমাকে আহ্বান করলেন। এই সংস্থার নাম পরে ইন্ডিয়ান স্পেস রিচার্স অর্গানাইজেশন (আইসিআরও) হয়।

সাক্ষাৎকার দেবার জন্যে বোম্বে গিয়ে আমি প্রফেসর বিক্রম সারাভাইকে দেখে বিস্মিত হলাম। তিনি ছিলেন (আইসিএসআর) এর চেয়ারম্যান। অন্যদিকে মেনন আর সারাফ ছিলেন এইসি (অ্যাটোমিক এনার্জি কমিশন) ডেপুটি সেক্রেটারি। ইন্টারভিউ বোর্ডে প্রফেসর সারাভাই আমাকে প্রশংসা করায় আমি অভিভূত হলাম। তিনি আমার জ্ঞান আর দক্ষতা সম্বন্ধে কোন কিছু যাচাই করলেন না, বরং আমার সম্বন্ধে জানার ইচ্ছাই তার প্রশ্নের মধ্যে প্রকাশ পেল। এতে আমি তার প্রতি মুগ্ধ হলাম। তিনি যেন আমার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করলেন। ফলশ্রুতিতে তার মত একজন বড় মাপের মানুষ আমাকে নিয়ে একটা স্বপ্ন দেখলেন।

পরবর্তীসন্ধ্যায় ওই পদের জন্য আমাকে মনোনীত করার কথা জানানো হলো। আমি ১৯৬২ এ নতুনভাবে গঠিত আইএসআরও) এর একজন রকেট ইঞ্জিনিয়ার পদে নিয়োগ পেলাম। এটা ছিল আমার জীবনে সবচেয়ে বড় ঘটনা। প্রফেসর সতীশ ধাওয়ান আমাকে ইন্ডিয়ার উপগ্রহ উৎক্ষেপনের দায়িত্ব দিলেন ভেইকল প্রোগ্রামের প্রোজেক্ট ডিরেক্টর হিসাবে।

.

আমার জীবনের দ্বিতীয় সন্ধিক্ষণ ছিল ১৯৮২ এ ইন্ডিয়ার মিসাইল প্রোগ্রামের সঙ্গে যুক্ত হওয়া। ডিফেন্স ইন্‌স্টিটিউট অব ওয়ার্ক স্টাডি (ডিআইডবলুএস) এর ড. রাজা রামান্নার সাথে আমার মিলিত হবার ফলশ্রুতিতে আমি এই পদে নিয়োগ পেলাম। এখন ওই সংস্থা মিসৌরী ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি ম্যানেজমেন্ট নামে পরিচিত, এখন ওখানে ডিফেন্স সিস্টেম ম্যানেজমেন্টের অফিসারদেরকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এসএলভি-৩ এর প্রোজেক্ট ডিরেক্টর হিসাবে কর্মরত থাকা কালে আমাকে ডিআইডবলুএস এর উপর একগুচ্ছ বক্তৃতা দেবার জন্য বলা হলো। প্রথম ভারতীয় উপগ্রহ রোহিনী কক্ষ পথে প্রেরণ করা হলো সে সম্বন্ধে আমার বক্তব্য উপস্থাপন করলাম। ড. রামান্না তার লেকচারে বললেন কিভাবে তিনি ১৯৭৪ এ ভারতের প্রথম নিউক্লিয়ার টেস্ট সম্পন্ন করেন।

আমাদের লেকচার সম্পন্ন হবার পর আমরা উভয়েই দেরাদুন ভ্রমণ করি, সেখানে একদল বিজ্ঞানীর সাথে আমরা চা পান করলাম। দেরাদুনে থাকাকালে ড. রামান্না আমাকে হায়দ্রাবাদের ডিফেন্স রিচার্স এন্ড ডেভেলপমেন্ট (ডিআরডিএল) এর পদ গ্রহণে প্রস্তাব দেন মিসাইল সিস্টেমের উন্নয়নের জন্য। হায়দ্রাবাদের এই ডিফেন্স রিচার্স এন্ড ডেভেলপমেন্ট ল্যাবোরেটরির নাম পরে ডিফেন্স রিচার্স এন্ড ডেভেলপ্‌মেন্ট অর্গানাইজেশন (ডিআরডিও) হয়। আমি তাৎক্ষণিকভাবে তার অফার গ্রহণ করি। আমি সব সময়ই স্পেস রকেট টেকনোলজিতে মিসাইল টেকনোলজি প্ৰয়োগ করতে চেয়েছিলাম। আইএসআরও এর চেয়ারম্যান ও আমার চিফ প্রফেসর ধাওয়ান কিন্তু আমার পরবর্তী মিশনে যেতে অনুপ্রাণিত করলেন না।

বেশ কয়েক মাস কেটে গেল। আইএসআরও এবং ডিআরডিও এর মধ্যে অনেক পত্র বিনিময় হলো। পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যমে কাজ করার জন্য সেক্রেটারিয়েট অব ডিফেন্স অরগানাইজেশন এবং ডিপার্টমেন্ট অব স্পেস-এর মধ্যে অনেকগুলো মিটিংও অনুষ্ঠিত হলো। বিজ্ঞান উপদেষ্টা ড.ভি.এস অরুণাচলম তৎকালীন ডিফেন্স মিনিস্টার আর. ভেঙ্কটারমনের সাথে যোগাযোগ করে প্রফেসর ধাওয়ান এ বিষয়ে তার সাথে আলোচনার ব্যবস্থা করলেন। এই আলোচনার ভিত্তিতে ১৯৮২ এর ফেব্রুয়ারিতে আমাকে ডিআরডিএল এর ডিরেক্টর পদে নিয়োগ দেওয়া হলো।

.

১৯৯২ এর জুলাই এ আমি ড. অরুণাচলম-এর কাছ থেকে ডিফেন্স মিনিস্টার এবং ডিপার্টমেন্ট অব ডিফেন্স রিচার্স এন্ড ডেভেলপমেন্ট সেক্রেটারির বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টার দায়িত্ব বুঝে নিলাম। এটাই ছিল আমার জীবনের তৃতীয় সন্ধিক্ষণ। ১৯৯৩ এ আমি তামিলনাড়ুর তৎকালীন গভর্নর ড. চেন্না রেড্ডির কাছ থেকে আমন্ত্রণ পেলাম মাদ্রাজ ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর হবার জন্য। আমি এই দায়িত্ব পেলাম বাষট্টি বছর বয়সে। যা হোক, প্রতিরক্ষামন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা প্রধানমন্ত্রী পি. ভি নরসীমা রাও আমাকে বললেন যে আমি কয়েকটা জাতীয় প্রোগ্রামের সাথে সম্পৃক্ত থাকলেও আমাকে অবশ্যই বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টার দায়িত্বও পালন করতে হবে। এখানে উল্লেখ করতে চাই, নরসীমা রাও এর সাথে কাজ করে আমি লক্ষ্য করেছিলাম রাও ডিফেন্স ইস্যু সম্পর্কে খুবই সক্রিয় ও সচেতন। বিশেষ করে দেশীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে তার খুব আগ্রহ ছিল। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে মজবুত করার লক্ষ্যে তার দীর্ঘ মেয়াদি একটা ভিশন ছিল। আমি সত্তর বছর বয়স পর্যন্ত ডিফেন্স মিনিস্টারের বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেছিলাম।

১৯৯৮ এ নিউক্লিয়ার টেস্ট ছিল আমার জীবনের চতুর্থ সন্ধিক্ষণ। এগুলোর পিছনে একটা মজার গল্প আছে। আমাকে সেই গল্প বলার জন্য ১৯৯৬ এর মে এ ফিরে যেতে হবে। সে বছর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার মাত্র কয়েক দিন আগে আমি নরসীমা রাও এর সাথে সাক্ষাৎ করেছিলাম। তিনি আমাকে বললেন, ‘কালাম, তুমি তোমার দলবল নিয়ে নিউক্লিয়ার টেস্টের জন্য প্রস্তুত হও। আমি তিরুপতি যাচ্ছি। ক্ষমতা লাভের সময় পর্যন্ত তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে। ডিআরডিও-ডিএই এর টিম নিয়ে কাজে নামার জন্য অবশ্যই প্রস্তুত থাকবে।’

নির্বাচনে ভালো ফলাফলের জন্য ভগবানের আশীর্বাদ প্রার্থনা করাই ছিল তার তিরুপতি সফরের আসল উদ্দেশ্য। যা হোক, ১৯৯৬ এর নির্বাচনের ফলাফল তার আশার বিপরীতছিল। কংগ্রেসের আসন সংখ্যা নেমে দাঁড়ালো ১৩৬ এ। বিজেপি ও তার জোট মাত্র দুই সপ্তাহের জন্য বাজপেয়ীর নেতৃত্বে ক্ষমতায় এলো। তারপর তৃতীয় ফ্রন্ট এইচ. ডি. দেবে গৌড়া প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন। দু’সপ্তাহের জন্য ক্ষমতায় থাকলেও বাজপেয়ী সরকার নিউক্লিয়ার টেস্ট চালানোর জন্য বিশেষ চেষ্টা করেছিল।

রাত ৯টায় ৭ রেসকোর্স রোড থেকে আমি একটা ফোন পেলাম, তাতে আমাকে তাৎক্ষণিকভাবে নতুন প্রধানমন্ত্রী ও বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী রাওয়ের সাথে সাক্ষাত করার জন্য অনুরোধ জানানো হলো। রাও আমাকে নিউক্লিয়ার প্রোগ্রাম সম্বন্ধে বাজপেয়ীকে বিস্তারিত তথ্যাদি জানাতে বললেন, যাতে নতুন সরকারকে গুরুত্বপূর্ণ প্রোগ্রামগুলো সম্বন্ধে যথাযথ তথ্য হস্তান্তর করা সম্ভব হয়।

দু’বছর পরে বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ফিরে এলেন। ১৯৯৮ এর ১৫ মার্চ প্রায় মধ্যরাতে আমি বাজপেয়ীর কাছ থেকে ফোন পেলাম। তিনি বললেন তার কেবিনেটের মন্ত্রীদের তালিকা চূড়ান্ত করছেন। তিনি আমাকে মন্ত্রীসভায় নেবার ইচ্ছা প্রকাশ করলে আমি তাকে বললাম এ বিষয়ে আমার ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে। তারপর তিনি আমাকে পরদিন সকাল ৯টায় দেখা করতে বললেন। বাজপেয়ীর ফোনের পরিপ্রেক্ষিতে মাঝরাতেই আমার কয়েকজন বন্ধুর সাথে আলোচনায় বসলাম। ক্যাবিনেটে যোগদান করা আমার উচিত কিনা সে সম্পর্কে আমরা রাত ৩টা পর্যন্ত যুক্তিতর্ক চালিয়ে গেলাম। একটা মোদ্দা কথা বের হয়ে এলো যে আমি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দুটো মিশনের সাথে পুরোপুরিভাবে সম্পৃক্ত। সেগুলো চূড়ান্ত সফলতার মুখ দেখার অপেক্ষায় আছে। সেগুলো ত্যাগ করে রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবেশ করা আমার উচিত নয়।

পরদিন সকালে আমি ৭ সফদারজং রোডে গেলাম। ওখানেই প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন। তিনি তার ড্রয়িংরুমে আমাকে স্বাগত জানিয়ে প্রথমেই বাড়ির তৈরি মিষ্টি খেতে দিলেন। আমি তাকে বললাম, ‘আমি আমার দলবল নিয়ে দুটো গুরুত্বপূর্ণ প্রোগ্রামে ব্যস্ত আছি। একটা হলো অগ্নি মিসাইল সিস্টেম আর অন্যটি হলো ডিএই (ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাটোমিক এনার্জি) এর অংশীদারিত্বে নিউক্লিয়ার প্রোগ্রামের সফল রূপায়ন ঘটানো সম্পর্কীত। আমি মনে করি এই দুটো প্রোগ্রামের সাথে সার্বক্ষণিক সম্পৃক্ত থেকে আমি জাতির জন্য অনেক কিছু দান করতে অবশ্যই পারবো। অনুগ্রহ করে আমাকে ওই কাজগুলো চালিয়ে যাবার সুযোগ দেবেন।’

‘তোমার কথার মধ্যে সামনে এগিয়ে যাবার অভিব্যক্তি আমি উপলব্ধি করতে পারছি। ঈশ্বর তোমার সহায় হোন।’ বাজপেয়ী আমার কথার প্রেক্ষিতে বললেন। অগ্নি মিসাইল সিস্টেম থেকে পাঁচ পাচঁটা নিউক্লিয়ার টেস্ট করার ফলে ভারত এখন নিউক্লিয়ার অস্ত্রের অধিকারী দেশ। মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করতে অস্বীকার করার ফলে আমি দুটো বৃহৎ কাজ সমাধা করতে পেরেছি যা থেকে জাতি বিশাল ফল লাভের অধিকারী হয়েছে।

.

আমার জীবনের পঞ্চম সন্ধিক্ষণ ছিল ১৯৯৯ এর শেষ দিকে, আমি ওই সময় ভারত সরকারের ক্যাবিনেট মিনিস্টারের পদমর্যাদার প্রিন্সিপাল সায়েন্টিফিক এ্যাডভাইজার (পিএসএ) নিযুক্ত হলাম। আমার দলে যুক্ত হলেন ড.ওয়াই.এস.রাজন, ড. এম. এস. বিজয়ারাঘবন, তিনি ইলেক্ট্রোনিক এন্ড ইনফরমেশন সায়েন্স এর বিশেষজ্ঞ ছিলেন। তিনি আমার সাথে টিআইএফএসি তে কাজ করেছিলেন। এইচ. সেরিডন ছিলেন আমার ব্যক্তিগত সেক্রেটারি। আমি বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা থাকাকালে তিনি আমার স্টাফ অফিসার ছিলেন। কাজ শুরু করার সময় আমাদের কোন অফিস ছিল না। আমরা এক সময় অফিস পেলাম। এজন্য ডিআরডিও কে ধন্যবাদ জানাই, বিশেষ করে ডিআরডিও এর সিভিল ওয়ার্ক এন্ড এস্টেট এর প্রধান কে. এন. রাই এবং ডিআরডিও তে থাকা আরএন্ডডি এর মেজর জেনারেল আর. স্বামীনাথনকে। ভারতের ২০২০ ভিশন ভারত সরকার কতৃক গৃহীত হলো। দেবে গৌড়া সরকারের আমলে প্রথম এই ভিশন পেশ করা হয়। ১৯৯৮ সালে আই. কে গুজরাল প্রধানমন্ত্রী হলেন তারপর আবার বাজপেয়ী। এই তিনটি সরকারই এই পরিকল্পনাকে বাস্তবায়নের জন্য সুপারিশ করে। আমরা বিজ্ঞানভবন অ্যানেক্সে একটা অফিস পেলাম। ওটা বিশাল ভবন, সেখানে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর অবস্থিত। বিজ্ঞানভবনের কাছেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কনফারেন্সের স্থান। অ্যানেক্সটা উপরাষ্ট্রপতির বাসভবনের কাছেই অবস্থিত। এখান থেকে সাউথ আর নর্থ ব্লকে গিয়ে কাজ করা বেশই সহজসাধ্য ব্যাপার ছিল।

সাধারণত আমার কর্মসূচির মধ্যে ভ্রমণও অন্তর্ভুক্ত ছিল। ২০০১ এর সেপ্টেম্বর এ আমি অল্পের জন্য হেলিকপ্টার দুর্ঘটনা থেকে প্রাণে বেঁচে যাই। ঝাড়খন্ডের বোখারো স্টিল প্লান্টে হেলিকপ্টারটি অবতরণ করার সময় বিধ্বস্ত হয়। আমি লাফ দিয়ে বের হয়েই পাইলট আর কোপাইলটের কাছে ছুটে গিয়ে বললাম, আমার জীবন বাঁচানোর জন্য তোমাদের ধন্যবাদ, ঈশ্বর তোমাদের মঙ্গল করুন।’ পাইলটরা প্রায় কেঁদেই ফেললো। আমি কিন্তু তাদেরকে বললাম এমনটা ঘটা স্বাভাবিক। এখন আমাদেরকে সমস্যাটা খুঁজে বের করে সমস্যার সমাধান বের করতে হবে। ওইদিন সন্ধায় আমার পাঁচটা অনুষ্ঠানে যোগদান করতে হবে। আমাকে শ্রোতাদের সামনে বক্তৃতা দিতে হবে। শ্রোতাদের মধ্যে অফিসিয়াল, ইঞ্জিনিয়ার এবং স্টিল প্লান্টের স্টাফরাও উপস্থিত থাকবেন। বোকারোর কিছু সংখ্যক ছাত্রছাত্রীর থাকার কথা। হেলিকপ্টার ক্রাস হবার খবর মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লো। টেলিভিশনের জাতীয় চ্যানেলগুলোও এই খবরটা প্রচার করলো। আমি যখন ছেলেমেয়েদের সাথে মিলিত হলাম তখন তারা যেন কাঁপছিল। আমি তাদের সাথে করমর্দন করে তাদেরকে সাহস জুগিয়ে উৎফুল্ল করে তুললাম।

আমি তাদেরকে বললাম এটা একটা সাধারণ ঘটনা।

সাহস

ভিন্ন রকম ভাবার সাহস,
আবিষ্কার করার সাহস,
অপ্রত্যাশিত পথে ভ্রমণের সাহস,
সমস্যা মোকাবিলা করে সফল হবার সাহস,
এইগুলোই হচ্ছে যুবকদের চমৎকার গুণাবলি
আমার দেশের একজন যুবক হিসাবে
আমি অবশ্যই কাজ করবো সাহসের সাথে কৃতকার্য হবার জন্য
আর এটাই হচ্ছে আমার মিশন।

ওই একই দিনে একটা মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনা ঘটে। সেই বিমান দুর্ঘটনায় মাধব রাও সিন্ধিয়া এবং আরো ছয়জন সাংবাদিক, তার স্টাফ এবং ক্রুরা নিহত হন। এই দুটো দুর্ঘটনার খবরই রামেশ্বরমে আমার পরিবারবর্গের কাছে পৌঁছে, আমার বন্ধুবান্ধবসহ দেশে বিদেশে তা ছড়িয়ে পড়ে। আমি কেমন আছি জানার জন্য তারা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে। আমি আমার ভাইয়ের সাথে কথা বলি। আমার পরিবারকে আশ্বস্ত করি এই বলে যেসব কিছু ঠিকঠাক আছে আর আমি সুস্থ আছি।

পরে ওইদিন সন্ধ্যায় দিল্লি ফিরে এসেই আমি প্রধানমন্ত্রীর অফিসের একটা জরুরি বার্তা পেলাম। বার্তায় আমাকে বাজপেয়ীর সাথে দেখা করার অনুরোধ জ্ঞাপন করা হয়েছে। তিনি আমাকে স্বাগত জানিয়ে আমার দুর্ঘটনা সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলেন। তিনি আমাকে সুস্থ ও সবল দেখতে পেয়ে খুশি হলেন। তারপর তিনি আমাকে বললেন যে ইন্ডিয়া ২০২০ ভিশন এর ডকুমেন্ট নিয়ে শিল্পপতিদের সাথে আলোচনা করেছেন। ক্যাবিনেটেও আলোচনা হয়েছে। পরবর্তী কার্যক্রম পার্লামেন্টে ঘোষণা দেওয়া। কিন্তু এই ভিশনের মধ্যে কিছু কিছু সমস্যা আছে। আমি তাকে বললাম আমিও ওইগুলো নিয়ে ভেবেছি।

দুর্ঘটনার ফলে দুটো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটলো। একটা ছিল আমার বই ইগনাইটেড মাইন্ডস লেখা যাতে আমি তরুণদেরকে উৎসাহিত করলাম আমি যা করতে পারি তা আত্মা থেকে উৎসারিত। আর দ্বিতীয় ঘটনা হলো রাঁচি থেকে কুইলোন ভ্রমণ আর আম্মা…মাতা অমৃতানন্দময়ী এর সাথে সাক্ষাৎ। তার কাছ থেকে আমি আধ্যাত্মিকভাবে উদ্দীপ্ত হলাম। আমি রাষ্ট্রপতি হবার আগেই ইগনাইটেড মাইন্ডস প্রকাশিত হলো। বইটি সফলতার মুখ দেখলো। প্রচুর কপি বিক্রিও হলো। আম্মা একজন আধ্যাত্মিক সাধিকা। তিনি সমাজের কল্যাণের কাজে ব্রতী, বিশেষ করে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, অনাথ আর দুস্থদের সেবায় তিনি নিবেদিত। আমি তার সাথে দেখা করতে যাই আমার দু’জন বন্ধুকে সাথে নিয়ে। আমি তাদের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেই পিএসএ থেকে পদত্যাগ করার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে পত্র দিতে। তারপর আমার ২০২০ ভিশন আর যথাযথ শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে আমি মুক্তমনে আম্মার সাথে দেখা করতে গেলাম।

সে সময়টা ছিল পিএসএ পদ পাবার পর প্রায় দু’বছরের মাথায় ২০০১ এর নভেম্বর এ। পত্রে আমি লিখলাম আমি শিক্ষা কার্যক্রমে ফিরে যেতে চাই। অবশ্যই কারণটা ছিল গভীরে, আমি অনুভব করলাম যে পিইউআরএ (প্রোভাইডিং আরবান এমেনিটিস ইন রুরাল এরিয়াস) এবং আমার ভিশন ইন্ডিয়া ২০২০ এর ব্যবস্থাপনার সাথে যুক্ত থাকাকে অগ্রাধিকার দেওয়া ঠিক নয়। কোথায় সমস্যার উদ্ভব? আমি চাচ্ছিলাম যতটা সম্ভব নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রত্যেকটা প্রোগামের সফলতা। প্রোগ্রামকে সফল করার জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল সংগ্রহ করে যথাযথ দায়িত্ব সম্পাদন করা দরকার। পরিবেশটা এমন সরকারের সিস্টেমের উপর পুরোপুরি নির্ভর করে লক্ষ্যে পৌঁছানো কষ্টসাধ্য ব্যাপার। মিশনের উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়িত করতে বহু মন্ত্রণালয় এবং ডিপার্টমেন্টের উপর নির্ভর করতে হয়। তাদের লক্ষ্য আর প্রোগ্রামকে অবশ্যই বাদ দিয়ে নয়। কৃষি বিভাগের কথাই উদাহরণ স্বরূপ ধরা যাক। যদি কেউ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য লক্ষ্যমাত্রা শতকরা ৪ নির্ধারণ করে তবে ওয়াটার রিসোর্সেস, পাওয়ার, ফার্টিলাইজার, কেমিক্যাল, রুরাল ডেভেলপমেন্ট, পঞ্চায়েত রাজ, রেলওয়ে ইত্যাদি ইত্যাদি মন্ত্রণালয়ের সম্মতির প্রয়োজন হবে। সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর জন্য সমন্বিত একই লক্ষ্যমাত্রা নেই। দ্বিতীয়ত, পিএসএ এর একটা এডভাইসারি ভূমিকা আছে, কিন্তু ডাইরেক্টরে কোন কতৃত্ব নেই। এইগুলোই হচ্ছে মিশনকে বাস্তবায়িত করার প্রতিবন্ধকতা। আর এ থেকেই আমি আমার এসাইনমেন্ট থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেই। আন্না ইউনিভার্সিটিতে টেকনোলজির প্রফেসর হিসাবে যোগদানই ছিল আমার জীবনের ষষ্ঠ সন্ধিক্ষণ।

রাষ্ট্রপতি থাকা কালে শেষ তিন মাসের সময় দ্বিতীয়বারের মতো রাষ্ট্রপতির পদপ্রার্থী হওয়া সম্পর্কে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হয়। আমি তার আগেই মনস্থ করে ফেলেছিলাম যে টিচিং প্রফেশনে ফিরে যাবার এবং ভারতের ২০২০ ভিশন বাস্তবায়ন করাই আমার লক্ষ্য। হঠাৎ করে জুলাইতে শাসক কংগ্রেস পার্টি রাষ্ট্রপতি পদে কয়েকজন সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম প্রস্তাব করতে দেখা যায়। বিরোধীরা অন্য রকম চিন্তা ভাবনা করতে থাকে। জাতি রাজনৈতিকভাবে সরগরম হয়ে উঠে। বিভিন্নদলের নেতারা আমার সাথে সাক্ষাৎ করতে আসেন। তারা আমাকে দ্বিতীয়বার রাষ্ট্রপতি পদের প্রার্থী হবার জন্য পরামর্শ দেন। জনগণ, প্রখ্যাত ব্যক্তিবর্গ এবং যুব সমাজ থেকে আমি বেশকিছু অনুরোধ গ্রহণ করি। অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে এবং ই-মেলের মাধ্যমে আমাকে দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য রাষ্ট্রপতি পদের প্রার্থী হবার জন্য অনুরোধ জানান। মনোনয়ন পত্ৰ জমাদানের সময় নিকটবর্তী হলে রাজনৈতিক নেতাদের একটা দল আমার সাথে দেখা করেন। তারা আমাকে বলেন যে তারা শাসক দল সহ সমস্ত দলের সমর্থন পাবে যদি আমি নির্বাচনে দাঁড়াই।

আমি তাদেরকে বললাম যে যদি অধিকাংশ দল রাজি হয় তবে বিবেচনা করে দেখার সম্ভাবনা আছে। নেতারা আমার কাছে ফিরে এসে আমাকে জানালেন যে শাসক দল আমাকে প্রার্থী করতে রাজি নয়। তারা কিন্তু আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন যে আমি নির্বাচনে প্রার্থী হলে তারা আমার সাফল্য সম্পর্কে আস্থাশীল। কোন প্রকার ইতস্তত ভাব না দেখিয়ে আমি তাদেরকে বললাম যে যদি এমন হয় তবে আমি নির্বাচনে প্রার্থী হবো না। আমি বিশ্বাস করি রাষ্ট্রপতিভবন পার্টি পলিটিকস থেকে মুক্ত নয়। স্বভাবতই নেতারা আমার কথা মেনে নিলেন। একটা প্রেস রিলিজ ইস্যু করা হলো এই বলে যে আমি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হবো না। আমি সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমি শিক্ষকতা, গবেষণায় ফিরে যাবো আর সেই সাথে আমি ২০২০ এর মধ্যে ভারতকে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে কাজ করে যাবো।

[আমি সব সময়ই বিশ্বাস করি কাপুরুষেরা কখনোই ইতিহাস তৈরি করতে পারে না। ইতিহাস তৈরি হয় জনগণের সাহস আর জ্ঞানের দ্বারা। সাহস হচ্ছে ব্যক্তি মানস থেকে উৎপন্ন, জ্ঞান উৎপন্ন অভিজ্ঞতা থেকে।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *