৪৩. সকাল দশটায় অপারেশন

সকাল দশটায় অপারেশনে সাহায্য করার জন্যে শহরের ডাক্তার এবং নার্সেরা পৌঁছে গেলেন। তার আগেই মিসেস অ্যান্টনি কঙ্কাবতীকে তৈরি করে রেখেছিলেন। ডাক্তার আঙ্কল এবার সাহায্যকারী ডাক্তারদের সঙ্গে কঙ্কাবতীর কেস নিয়ে আলোচনা করে নিলেন। গত রাতেই তাকে প্রয়োজনীয় ইনজেকশনগুলো দেওয়া হয়েছিল। অপারেশন থিয়েটারে যখন কঙ্কাবতীকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ঠিক তখন তিনটে ম্যাটাডর ভ্যান ধীরে ধীরে নিরাময়ের সামনে দিয়ে এগিয়ে গেল চার্চের দিকে। তিনটে ম্যাটাডর ভর্তি হয়ে আছে বড় বড় বাক্সে। যারা তখনও নিরাময়ের সামনে বসেছিল তারা অবাক হয়ে গাড়িগুলোকে দেখল। শেষ ভ্যান গতি কমাতেই বিষ্ণুপ্ৰসাদকে নেমে পড়তে দেখা গেল। সে দ্রুত নিরাময়ে চলে এল। নীচে কাউকে দেখতে না পেয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে সায়নের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে দেখতে পেল সে ঘুমোচ্ছ।

বিষ্ণুপ্ৰসাদ ঘরে ঢুকে সায়নকে একবার ডাকতেই সায়ন উঠে বসল। খুব উত্তেজিত হয়ে বিষ্ণুপ্ৰসাদ বলল, প্রচুর জিনিস এসেছে। গুড়ো দুধ, শুকনো খাবার, গরম জামা, আরও কত কী। তিন তিনটে ম্যাটাডর ভাড়া করতে হয়েছে ওসব আনতে। ম্যাডাম বলেছেন আজ দুপুর থেকে গ্রামগুলোতে যাওয়া হবে ওগুলো সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে। তোমায় খবর দিতে বললেন। তুমি কি অসুস্থ?

সায়ন মাথা নাড়ল, না।

তাহলে চলে এসো। আমি একবার বাড়ি ঘুরে ম্যাডামের কাছে চলে যাচ্ছি। বিষ্ণুপ্ৰসাদ বেরিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে কঙ্কাবতীর কথা মনে পড়ল সায়নের। কঙ্কাবতীর অপারেশন কি হয়ে গেছে! কেমন আছে ও!

খাট থেকে নামতেই ছোটবাহাদুর ঘরে ঢুকল। তার হাতের প্লেটে মিষ্টি আর গ্লাসে দুধ, খেয়ে নাও। আর সায়নবাবু, তোমার বন্ধুরা এভাবে ঘরে চলে আসছে জানতে পারলে ডাক্তারবাবু আমাদের খুব বকবেন!

কঙ্কাবতী এখন কোথায়?

অপারেশন রুমে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

অপারেশন হয়ে গেছে?

এত তাড়াতাড়ি? মিসেস অ্যান্টনি বললেন এখনও অনেক দেরি। কী সব পরীক্ষা হবে আগে তারপর সব ঠিক থাকলে অপারেশন হবে। কথাগুলো বলে ছোটবাহাদুর একটু থামল, তুমি ঘুমোচ্ছিলে তাই কিছু জানো না।

কী হয়েছে?

কয়েকজন গুণ্ডা এসে পদমকুমারকে এমন মার মেরেছে যে ওকে শিলিগুড়িতে নিয়ে যেতে হয়েছে। ডাক্তার তামাং সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।

পদমকুমারকে মেরেছে? কারা? হতভম্ব হয়ে গেল সায়ন।

গাড়ি করে এসেছিল। এখান থেকে ফিরে যাওয়ার পথে ওকে ধরেছিল।

ওর সঙ্গে কেউ ছিল না?

ছিল। কিন্তু তারা ভয়ে পালিয়েছিল। রক্ত দেওয়ার জন্যে লোক জড়ো করেছিল বলে বেচারা শাস্তি পেল।

পুলিশ আসেনি?

এসেছিল। দুজন সেপাই নীচে পাহারা দিচ্ছে। ছোটবাহাদুর চলে গেল।

পদমকুমারের মুখ মনে পড়ল। কী দোষ করেছিল ও? সায়নের চোয়াল শক্ত হল। কিছুক্ষণের মধ্যে তৈরি হয়ে নিয়ে দুধ-সন্দেশ খেয়ে নীচে নামল সে। আজ সকালে ওষুধ খেতে একটুও ইচ্ছে হল না।

অপারেশন যে ঘরে হবে তার দরজায় লাল আলো জ্বলছে। এই ঘর সচরাচর ব্যবহার করা হয় না। কিছুক্ষণ দাঁড়াবার পর মনে হল দাঁড়িয়ে থাকার কোনও মানে হয় না। তার কিছু করার নেই শুধু প্রার্থনা করা ছাড়া। কিন্তু কার কাছে প্রার্থনা করবে? যেখানে পদমকুমারদের ওপর আক্রমণ হয় সেখানে প্রার্থনা করে কী লাভ! যার কিছু করার নেই সে নিজের সান্ত্বনার জন্যে, নিজেকে প্রবোধ দেওয়ার জন্যে প্রার্থনা করে।

সায়ন বেরিয়ে এল নিরাময় থেকে। সেপাই দুটো তাকে দেখে কপালে হাত ছোঁয়াল গদগদভাবে। সায়ন জিজ্ঞাসা করল, যারা আজ পদমকুমারকে মেরেছে তাদের কি আপনারা ধরতে পেরেছেন?

লোক দুটো নিজেদের মুখ চাওয়াচায়ি করল। একজন বলল, আমরা তখন ডিউটিতে ছিলাম না। ধরা ঠিক পড়বেই, কোথায় যাবে।

দ্বিতীয়জন মাথা নাড়ল, সেটা ঠিক বলা যায় না।

সায়ন আর দাঁড়াল না।

.

বাক্স খুলে মালপত্র বের করা হয়ে গিয়েছিল। এগুলো ম্যাডাম পেয়েছেন তাঁর আমেরিকান বন্ধুদের কাছ থেকে অনুদান হিসেবে। সায়নকে দেখে খুশি হলেন তিনি, কনগ্রাচুলেশন। কাল তুমি একদিনেই যে কাজ করেছ তাতে আমি খুব খুশি। আমি বলেছিলাম তুমি ওদের উদ্বুদ্ধ করতে পারবে। হ্যাঁ, মেয়েটা কেমন আছে?

অপারেশনের জন্যে সবাই তৈরি।

ঈশ্বর নিশ্চয়ই ওর মঙ্গল করবেন। শুনলাম কাল রাত্রে তুমি রক্তের জন্যে এখানে এসেছিলে। তারপর প্রচুর মানুষ গিয়েছিল রক্ত দিতে। তাই তো!

হ্যাঁ।

তাহলে দ্যাখো, গুণ্ডাদের ভয়ে মানুষ ঘরবন্দী হয়ে থাকে না।

কিন্তু যে ছেলেটি উদ্যোগ নিয়েছিল তাকে গুণ্ডারা এমন মেরেছে যে শিলিগুড়িতে নিয়ে যেতে হয়েছে বাঁচাবার জন্যে।

ম্যাডামের মুখ বিমর্ষ হয়ে গেল। নিচু গলায় বললেন, কর্তৃত্ব হারাবার ভয়ে মানুষ কী নিষ্ঠুর হয়ে যায়।

ঠিক হল, দুধের প্যাকেটগুলো সমানভাবে ভাগ করে গ্রামগুলোতে পৌঁছে দেওয়া হবে প্রথমে। তারপর একে একে অন্য জিনিসগুলো। দুধ শিশুদের জন্যে, তাই ওটার ব্যবস্থা করা জরুরি।

ম্যাডাম অনুমান করতে পারেননি। সায়ন যখন এসেছিল তখনও সে কাউকে দেখেনি কিন্তু তারপরই এক একজন করে মানুষ এসে দাঁড়াতে লাগল ম্যাডামের বাড়ির সামনে। ম্যাথুজ বাইরে বেরিয়ে কথা বলে এসে জানাল ওরা জেনেছে ওদের জন্যে খাবার এসেছে তাই সেগুলো এখনই হাতে হাতে চায়।

ম্যাডাম বিরক্ত হলেন। ম্যাথুজকে বললেন, ওদের বলো জিনিসগুলো ওরাই পাবে কিন্তু সেটা যে যার গ্রামে দাঁড়িয়ে নেবে। এখানে আমরা বিতরণ করব না। প্রত্যেককে শৃঙ্খলা মানতে হবে।

ম্যাথুজ বাইরে বেরিয়ে চিৎকার করে বলতে লাগল কিন্তু জনতা অত ধৈর্য ধরতে রাজি নয়। একজন চেঁচিয়ে উঠল, আমাদের নাম করে আনা জিনিস তোমরা বিক্রি করে দেবে না তার কী বিশ্বাস আছে?

ম্যাথুজ ঘাবড়ে গেল, বিক্রি করে দেব?

তাই তো দেয়। সেবার ভূমিকম্পের পর দেশবিদেশ থেকে কত সাহায্য এসেছিল আমরা তার কটা হাতে পেয়েছি? সবই তো কর্তারা চোরাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে। কি ভাই দেয়নি? সবাই সমস্বরে সমর্থন জানাল।

ম্যাথুজ চেঁচাল, ম্যাডামকে তোমরা চেন। তিনি তোমাদের জন্যে জিনিস এনে বিক্রি করে দিতে পারেন না। এই সামান্য টাকার লোভে তিনি এখানে পড়ে নেই। তিনি আমাদের ভালবেসে উপকার করতে চান, ওঁকে সন্দেহ করলে অপমান করা হয়।

জনতা চুপ করে যেতেই দেখা গেল দুটো মোটরবাইক নীচ থেকে উঠে আসছে। জনতা ওদের জায়গা করে দিতেই ম্যাডামের বাড়ির সামনে পৌঁছে গেল, অ্যাই, মেমসাহেব কোথায়?

ম্যাথুজ জিজ্ঞাসা করল, কেন?

 কৈফিয়তটা তোকে দেব নাকি শুয়োরের বাচ্চা। ডাক তোর মেমসাহেবকে।

গলাটা ভেতর থেকেও শোনা যাচ্ছিল। ম্যাডাম বাইরে বেরিয়ে এলেন।

এই যে, আপনি ভেবেছেন কী? যা ইচ্ছে তাই করবেন?

আপনাদের উত্তেজনার কারণ জানতে পারি?

 তিনটে ম্যাটাডোরে কী কী মাল এসেছে এখানে?

 কেন?

ওগুলো স্মাগলিং গুডস কিনা দেখতে হবে।

পুলিশ নিয়ে আসুন। কাগজপত্র দেখাব।

জিনিসগুলো কী?

গুড়ো দুধ, শুকনো ফল, বিস্কিট, জামাকাপড়।

ওগুলো কাদের জন্যে?

এদের জন্যে। এদের গ্রামে পৌঁছে দেওয়া হবে।

গুঁড়ো দুধ। সেই দুধ খেয়ে যদি এদের বাচ্চারা মরে যায় তাহলে আপনি কি ক্ষতিপূরণ দেবেন?

মরে যাবে? মানে?

এসব জিনিস যারা পাঠায় তারা বাতিল হয়ে যাওয়া মালই পাঠায়, আর সেটা পেটে গেলে বাচ্চারা অসুস্থ হতে পারে।

হবে না। সজোরে বললেন ম্যাডাম।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। আমাদের দেশে খারাপ খাবারের কথা কেউ ভাবতে পারে না।

 তার মানে আমাদের দেশে ভাবে? এই দ্যাখো ভাই, এই বুর্জোয়া আমেরিকান পাহাড়ের মানুষকে অপমান করছে।

জনতার মধ্যে থেকে যে লোকটা প্রথমে চেঁচিয়েছিল সে এবার প্রতিবাদ করে উঠল, উনি অপমান কোথায় করলেন? তোমরাই তো পায়ে পা লাগিয়ে ঝামেলা করছ। তোমরা এখান থেকে যাও তো, আমাদের ব্যাপার আমরাই বুঝে নেব। কথাগুলো শেষ হওয়ামাত্র সমবেত জনতা তাকে সমর্থন করল। ছেলে দুটো তৎক্ষণাৎ বাইক ঘুরিয়ে নেমে গেল নীচে।

ম্যাডাম বললেন, আপনাদের অনেক ধন্যবাদ। আপনারা এখন দয়া করে যে যার গ্রামে ফিরে যান। আপনাদের জিনিস আপনাদের কাছেই পৌঁছে দেব আমরা। শুধু প্রত্যেক গ্রাম থেকে চারজন করে মানুষকে এখানে পাঠান জিনিসগুলো বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে।

ম্যাডাম ভেতরে ঢুকে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন। তাঁর মুখে কালো ছাপ, চোখ বন্ধ। সায়ন পেছন থেকে সমস্ত ব্যাপারটা দেখেছিল। সে উল্টোদিকের চেয়ারে বসে বলল, ম্যাডাম, আপনি কিছু মনে করবেন না।

আমি জানি আমার মনে করা উচিত নয়। কিন্তু আমি কী করতে পারি? আমি যে আমেরিকান এটা আমার অপরাধ নয়। উন্টে আমেরিকান বলে আমি গর্বিত। আমি যদি আফ্রিকার গরিব দেশের মানুষ হতাম, আমি যদি পোল্যান্ড যুগোস্লাভিয়ার মহিলা হতাম তাহলে এখানে এসে একদিন থাকাও বিলাসিতা ছাড়া কিছু ভাবতে পারতাম না।

এদের কথায় কান দেবেন না। এরা ভারতবর্ষের মানুষ নয়।

ভারতবর্ষ? কই, ওরা বলল বুর্জোয়া আমেরিকান পাহাড়ের মানুষকে অপমান করছে, বলল না ভারতবর্ষের মানুষকে অপমান করছে।

সেটা বলার মতো মানসিকতা ওদের নেই।

সায়ন, মাঝে মাঝেই মনে হয় এখান থেকে আমার চলে যাওয়াই উচিত। কিন্তু যে কাজটা শুরু করেছি তা শেষ না করে গেলে বাকি জীবনটা আমি কী নিয়ে বাঁচব? কী কৈফিয়ত দেব নিজেকে? ম্যাডাম উঠে দাঁড়ালেন।

গতকাল যে গ্রামে সায়ন গিয়েছিল সেখানেই প্রথমে যাওয়া হল। ওই গ্রামের চারজন মানুষ বাক্সগুলো মাথায় নিয়ে এল, বিষ্ণুপ্ৰসাদ এবং ম্যাথুজও হাত লাগাল। বাচ্চা বা বৃদ্ধ আছে এমন পরিবারকে দুধের প্যাকেট দেওয়া হল। একটা প্যাকেট খুলে কী করে দুধ গুলতে হবে দেখিয়ে ম্যাডাম প্রথম গ্লাসটা খেলেন। সায়ন অনুমান করল এটা ওই ছেলে দুটোর কথার প্রতিক্রিয়া। সবার সামনে দুধ খেয়ে ম্যাডাম বোঝাতে চাইছেন যে অসুস্থ হলে তিনিও বাদ পড়বেন না। শিশু এবং বৃদ্ধ থাকায় যেসব পরিবার দুধ পেল না তারা বিমর্ষ হল।

দ্বিতীয় গ্রামে যাওয়ার পথে ম্যাডাম বললেন, খারাপ লাগছে কিন্তু কিছু করার নেই। যাদের বেশি প্রয়োজন তাদের কথা আগে ভাবতে হবে। এতে যদি কেউ অসন্তুষ্ট হয় তো কী করা যাবে!

দ্বিতীয় গ্রামে তেমন ঝামেলা হল না। উল্টে তাদের দুজন মহিলা রুটি আর তরকারি নিয়ে এল ম্যাডাম এবং সায়নের জন্যে। সেগুলো বিষ্ণুপ্ৰসাদ এবং ম্যাথুজের সঙ্গে ভাগ করে নিলেন ম্যাডাম।

খেতে খেতে একটু আলাদা হয়ে ম্যাথুজ লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলল, তোমাকে একটা ভাল খবর দেব।

তাই? কী খবর?

সিমি আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে।

বাঃ! এ তো খুব ভাল খবর!

আরও লজ্জা পেল ম্যাথুজ, আমার মনে হয় ম্যাডামই ওকে রাজি করিয়েছেন। সিমি যে খুব জেদি মেয়ে তা তো তোমার জানা।

সায়ন খুব খুশি হল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মনে হল সিমি তার কাছে খবরটা চেপে গেল কেন? রাত্রে যখন তাকে বসতে বলল তখন তো এসব ব্যাপারের কোনও ইঙ্গিত দেয়নি! তবু মেয়েটা শেষ পর্যন্ত তার দুই পরবাসী বন্ধুর কথা ভুলে ম্যাথুজকে গ্রহণ করতে পারছে, এর চেয়ে আনন্দের কথা আর কী হতে পারে!

.

কঙ্কাবতীর ব্লাড গ্রুপের রক্ত পর্যাপ্ত নিয়ে ফ্রিজে বোতলের মুখ উল্টো করে রাখা হয়েছিল। এখন কঙ্কাবতী অপারেশন টেবিলে শুয়ে আছে। ডাক্তাররা শেষবার তার এক্স-রে প্লেট দেখে নিয়ে জমাট বাঁধা রক্তপিণ্ডের অবস্থান শরীরের ঠিক কোন জায়গায় তা বুঝে নিলেন। যিনি অজ্ঞান করাবেন তিনি নিচু গলায় বললেন, হিমোগ্লোবিন এত কম যে ভয় হচ্ছে।

ডক্টর তামাং বললেন, কোনও উপায় নেই। ব্লাড প্রেসার কীরকম আছে?

নার্স বললেন, বেশ কম। নাইনটি বাই সিক্সটি।

ডক্টর তামাং বললেন, সামান্য বেড়েছে। আপনি কি আর একটু অপেক্ষা করতে চান ডক্টর?

 ডাক্তার আঙ্কল মাথা নাড়লেন, হ্যাঁ।

অ্যানেসথেসিস্ট বললেন, আমি আর একবার চেক করে নিচ্ছি।

তখন অপারেশন থিয়েটারের বাইরে কয়েকটি মানুষ চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল। কঙ্কাবতীর মা, মিসেস অ্যান্টনি এবং দুই বাহাদুর। হঠাৎ মিসেস অ্যান্টনির খেয়াল হতে তিনি বড়বাহাদুরকে জিজ্ঞাসা করলেন, সায়ন এখনও ফেরেনি?

বড়বাহাদুর মাথা নাড়ল। না। মিসেস অ্যান্টনি যেন নিজের সঙ্গেই কথা বললেন, আমরা সবাই এখানে দাঁড়িয়ে কী করছি? অ্যাঁ? ডাক্তারবাবুরা যা করা উচিত তাই করছেন, আমরা আমাদের কাজে যাই, বুঝলে!

পরের গ্রামেও গিয়ে কোনও সমস্যা হল না। সবাই এসে হাসিমুখে বাচ্চা এবং বৃদ্ধদের জন্য গুঁড়ো দুধ নিয়ে গেল। একটু আলাদা দাঁড়িয়ে ম্যাডাম বললেন, এখানে স্কোয়াশের ফলন কোনও যত্ন ছাড়াই পাওয়া যায়। কলকাতায় তোমরা স্কোয়াশ খাও?

সায়ন মনে করতে পারল না। বাড়িতে মা শাকসবজি রান্না করেন। আলু পটল বেগুন মুলোর অস্তিত্ব বোঝা যায়। লাউ বা চালকুমড়ো হলে তা নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু স্কোয়াশের কথা শুনেছে বলে স্মরণে আসছে না।

সে বলল, বোধহয় ওখানে পাওয়া যায় না বলেই খাওয়া হয় না।

 ম্যাডাম খুশি হলেন, সেই কথাই আমি ভেবেছি। যে জিনিসটা এখানে প্রকৃতির খেয়ালে প্রচুর পরিমাণে হয় তার চাষে যদি একটু যত্ন নেওয়া যায় তাহলে কোয়ালিটি ভাল হতে বাধ্য। সেই স্কোয়াশ রপ্তানি করে তো এরা ভাল টাকা রোজগার করতে পারে। অন্য শাকসবজিতে প্রতিযোগিতা আছে কিন্তু স্কোয়াশের বেলায় এদের কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী নেই।

কিন্তু সেটা করতে তো, আপনি কি বিদেশের কথা বলছেন?

আরে না না। এখান থেকে কলকাতা দিল্লিতে পাঠানোর কথা ভাবছি। যে পদ্ধতিতে অন্য সবজি ওসব জায়গায় যায় সেই একই পদ্ধতিতে যাবে। সেটার ব্যবস্থা করতে আমাদের কাউকে ওখানে যেতে হবে।

সায়ন মাথা নাড়ল, কলকাতার মানুষ ঝিঙে খায়। স্কোয়াশ খেতে একটুও আপত্তি করবে না। এখানে যে জিনিস পাহাড় জঙ্গলে অবহেলায় পড়ে থাকে তা আমরা ঝিঙের চেয়ে কম দামে দিতে পারব।

গুড। তুমি এ ব্যাপারে কাগজকলমে একটা খসড়া করে ফেল। আমরা এখানকার কৃষিবিভাগের সাহায্য চাইব। ওঁরা নিশ্চয়ই ভাল পরামর্শ দেবেন। আসল সমস্যা হল এখান থেকে কোথায় কার কাছে কীভাবে পাঠাতে হবে। ব্যবসায়ীরা যদি লাভের গন্ধ পায় তাহলে দেখবে সমস্যার সমাধান এক মুহূর্তে হয়ে যাবে।

ভদ্রমহিলার প্রতি শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গেল সায়নের। এখানকার মানুষকে তীব্রভাবে ভাল না বাসলে তাদের উপকারের পথগুলো ওর মনে আসত না। উনি বাইরে থেকে সাময়িক সাহায্য দিয়ে ওদের আরও অলস করতে চাইছেন না। ওরা যাতে নিজেদের পায়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে সেটাই ওঁর কামনা। গোরু, মুরগি অথবা স্কোয়াশের চাষের পরিকল্পনায় হয়তো অভিনবত্ব নেই কিন্তু পর্বতের মূষিক প্রসবের চেয়ে এটা ঢের কাজের হবে।

দুপুর কয়েক পা হাঁটলেই হঠাৎ বিকেল হয়ে যায় এখানে। আলোর চেহারা বদলাতে আরম্ভ করে। ম্যাডাম ম্যাথুজদের ডেকে বললেন অন্য গ্রামগুলোতে গিয়ে খবর দিতে যাতে কাল সকালে তারা লোক পাঠায়। ম্যাথুজ এবং বিষ্ণুপ্ৰসাদরা রওনা হয়ে গেল। সন্ধের মধ্যে তাদের ফিরতে হবে।

ম্যাডাম বললেন, চলো, আমরা ফিরে যাই। কিন্তু এখান থেকে আমাদের বাড়িতে সোজা পথে অনেকটা হাঁটতে হবে। ওপাশে একটা শর্টকাট রাস্তা আছে, ওটা দিয়ে অনেক তাড়াতাড়ি পৌঁছোনো যায়। যাবে?

বেশ তো, চলুন। হাসল সায়ন।

ওহোঃ না। মাঝে মাঝে খাড়াই উঠতে হবে। তোমার পক্ষে সেটা ঠিক হবে না।

মাথা নাড়ল সায়ন, না না। আমি এখন ঠিক আছি। চলুন।

পায়ে চলা পথ ধরে ওরা হাঁটতে লাগল। এসব পাহাড়ে গ্রাম ছাড়ালেই পৃথিবীটা নির্জন হয়ে যায়। অল্পস্বল্প গাছগাছালি, কিছু পাখি আর পড়ে থাকা গভীর খাদের পাশ দিয়ে ওঠানামা।

হঠাৎ সায়ন জিজ্ঞাসা করল, ম্যাডাম, আপনি আর কতদিন এখানে আছেন?

ম্যাডাম হাসলেন, যতদিন ভারত সরকার আমাকে ভিসা দেবে। তার পর কিছুক্ষণ চুপচাপ হেঁটে বললেন, মাঝে মাঝে মনে হয় এসব করার কোনও মানে হয় না। আমাকে সবাই বাইরের লোক বলে মনে করে। এই যে ছেলেগুলো গালাগাল দিয়ে গেল, আমি ভারতীয় হলে দিতে পারত না।

না ম্যাডাম। আপনি ভারতীয় হলে ওরা অন্য গালাগাল দিত।

কেন?

কারণ এ দেশের গরিব মানুষগুলোকে কেউ নিঃস্বার্থ সাহায্য করুক তা কোনও রাজনৈতিক দল চায় না। মানুষগুলোকে হাতছাড়া করবে না ওরা আবার তাদের পায়ের নীচে মাটি দেবে না।

ম্যাডাম কথা বললেন না। সায়ন লক্ষ করল ভদ্রমহিলার হাঁটাচলার মধ্যে বয়সের কোনও ছাপ নেই। কত বয়স হবে ওঁর? পঞ্চাশের আশেপাশে হয়তো। এখানে আসার পর সাজগোজ প্রসাধন একেবারে ছেড়ে দিয়েছেন। এখনও মনে পড়ে প্রথম যেদিন মিস্টার ব্রাউনের বাড়িতে ওঁকে দেখেছিল তখন যথেষ্ট সুন্দরী বলে মনে হয়েছিল। এঁকে দেখে ঈর্ষান্বিত হয়েছিল সিমি। কোনও কারণ নেই, হয়তো মেয়েরা অন্য কোনও সুন্দরীকে মনে মনে গ্রহণ করতে পারে না বলেই সিমির মধ্যে ভাবান্তর হয়েছিল। সেই সিমি এখন ম্যাডামের প্রিয়জন। সেই ম্যাডামের সঙ্গে এই মহিলার পোশাক এবং চেহারার বিপুল পার্থক্য এসে গিয়েছে। এই ম্যাডাম যদি আমেরিকায় যান তাহলে ওঁর বন্ধু আত্মীয়রা দেখে চমকে উঠবেন।

হঠাৎ ম্যাডাম দাঁড়িয়ে পড়ল, সূর্য এখন পশ্চিম আকাশে। আর সেই আকাশে এখনই রং জমতে শুরু করেছে। পাহাড়গুলো এখনও স্পষ্ট। ম্যাডাম সেদিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বললেন, বিউটিফুল। ঈশ্বর আমাদের জন্যে কী সম্পদ সাজিয়ে দিয়েছেন।

সায়ন তাকাল। এত পরিষ্কার আকাশ এখানে সচরাচর দেখা যায় না। অস্তে যেতে এখনও অনেক দেরি কিন্তু এর মধ্যেই তার আয়োজন শুরু হয়ে গিয়েছে। এরকম একটা ছবির সামনে তাকালে মন কীরকম হয়ে যায়।

আবার হাঁটা শুরু হল। মাঝে মাঝে এত খাড়াই ভাঙতে হচ্ছিল যে সায়ন শরীরে কষ্ট বোধ করছিল। অথচ ম্যাডাম বেশ স্বছন্দ। সায়নের মনে পড়ল ডাক্তার আঙ্কল বলেছিলেন, আমাদের যতটুকু সামর্থ্য ঠিক ততটুকুই করা উচিত। মুশকিল হল সামর্থ্য কতটুকু তা আমরা নিজেরাই জানি না।

ম্যাডাম একটা পাথর দেখিয়ে বললেন, চলো, এখানে একটু বসি।

বসতে পেরে ভাল লাগল সায়নের।

আকাশের দিকে তাকিয়ে ম্যাডাম বললেন, আমার মন বলছে মেয়েটা ভাল হয়ে যাবে। এতক্ষণে নিশ্চয়ই ওর অপারেশন হয়ে গেছে, কী বলো?

সায়ন চুপচাপ মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। তারপরেই খেয়াল হল এই অপারেশনের ফলে কঙ্কাবতী হয়তো এখনকার নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাবে। রক্তের শক্ত হয়ে যাওয়া ডেলা তুলে নিলে শারীরিক অস্বস্তি দূর হবে কিন্তু মূল রোগ তো কোনওদিন সারবে না। ভাল হওয়া ওর কখনও হবে না।

সে ম্যাডামের দিকে তাকাল। শিরদাঁড়া সোজা রেখে বসে আছেন উনি, মুখ ঈষৎ ওপরের দিকে তোলা। এই বয়সের বাঙালি মেয়েরা কেন এমন ভঙ্গি রাখতে পারে না? কেন এঁদের মতো শরীর বা শারীরিক ক্ষমতা থাকে না?

হঠাৎ ম্যাডাম বললেন, জানো সায়ন, তোমাদের এখানে এসে আমার মনে পড়ে গিয়েছিল ছেলেবেলার কথা। আমার মায়ের বাবা থাকতেন ইয়োলো স্টোন নামের এক শহরের কাছে। প্রতি গ্রীষ্মে মায়ের সঙ্গে আমি তাঁর কাছে যেতাম। শহর থেকে দূরে তাঁর বিশাল খামারবাড়ি ছিল। এই রকম ভ্যালি, গাছগাছালি, কী সুন্দর হাওয়া। আমার খুব ভাল লাগত। চলে আসার সময় মন খারাপ হয়ে যেত। একটা ছোট্ট লেক ছিল, তাতে নৌকা বাইতাম আমি। দশ বছর বয়স পর্যন্ত আমি সেখানে গিয়েছি প্রতি গ্রীষ্মে। তারপর আর যাইনি।

কেন?

দাদুর এক কর্মচারী খামারবাড়ির নির্জনে একা পেয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। তাকে আমার ভাল লাগছে কিনা তার তোয়াক্কা না করে প্রেম নিবেদন করেছিল। আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কাউকে বলিনি, এমনকী মাকেও নয়। যে কদিন ছিলাম আর বাড়ি থেকে বের হইনি। তখন তো আমার দশ বছর বয়স, যখন ভয় বেশি বেশি পেতাম। ম্যাডাম হাসলেন।

সায়ন জিজ্ঞাসা করল, সেই ছেলেটার খবর আর পাননি?

না। দাদু মারা যাওয়ার পর খামারবাড়ি বিক্রি করে দেওয়া হল। ওখানকার সঙ্গে সম্পর্ক শেষ হয়ে গেল। এখানে এসেই চট করে সেসব স্মৃতি মনে পড়ল।

ভাগ্যিস আপনি এখানে এসেছিলেন–।

 মুখ ফিরিয়ে হাসলেন এলিজাবেথ, আমার আসার ব্যাপারটা অস্বাভাবিক, না?

তা কেন? মিস্টার ব্রাউন আপনার বন্ধু ছিলেন, তাঁর কাছে আসতেই পারেন।

না, না, যাকে বলে বন্ধু তা আমরা কখনওই ছিলাম না। একজন ইন্ডিয়ান সেইলার আমার উপকার করেছিল, তাকে বাড়িতে নিয়ে এসে চা খাইয়েছিলাম, ব্যাস এতটুকু, কিন্তু ওই প্রথমবার কোনও মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছিল একে কোনও পাপ স্পর্শ করেনি। ও যে পাহাড়ি, ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে পাহাড়িদের চেহারার কোনও মিল নেই, এসব জানতাম না। উল্টে ব্রাউন যে আমাকে প্রেম নিবেদন করেনি তা ভেবে খারাপ লেগেছিল।

তারপর?

তারপর আর কী! চিঠি লিখলে আমি জবাব দিতাম। তার পর তো সংসারে জড়িয়ে পড়লাম। সে-দীর্ঘ সময়। তারপর যখন সব দায়িত্ব শেষ হয়ে গেল তখন ভাবলাম মানুষটা কেমন আছে দেখে আসি। ম্যাডাম হাসলেন, আমার এই ভাবনাটাকে লোকে পাগলামি ছাড়া কিছুই বলবে না জানি।

কেমন দেখলেন?

চোখে চোখ রাখলেন এলিজাবেথ। তারপর বললেন, তুমি বয়সে অনেক ছোট। সব কথা তোমাকে বলতে অস্বস্তি হচ্ছে। কিন্তু তুমি তো অ্যাডাল্ট, তাই না?

সায়ন জবাব না দিয়ে হাসল।

এলিজাবেথ আবার একটু নীচে নেমে যাওয়া সূর্যের দিকে তাকালেন, মিস্টার ব্রাউন খুব ভদ্রলোক ছিলেন। স্ত্রী মারা যাওয়ার পরেও এই যে তিনি ছেলেদের কাছে না গিয়ে একা থাকা পছন্দ করতেন এর ব্যাখ্যা কী হবে? উনি কারও সঙ্গে মানাতে পারতেন না, নাকি নিজের প্রাইভেসি নষ্ট হোক সেটা চাইতেন না? আমার মনে হয়েছে উনি নিজের জগৎ তৈরি করে নিয়ে শামুকের মতো থাকাটাই পছন্দ করতেন। আর এই তৈরি করার ব্যাপারে তাঁকে সাহায্য করেছিলেন যেশাস৷ যেশাসকে অবলম্বন করে দিব্যি কাটিয়ে গেলেন ভদ্রলোক।

এই কথাগুলো বলতে আপনার অস্বস্তি হচ্ছিল?

না। আমি বলতে চাই, পুরুষরা যখনই মনে করে তাদের বয়স হয়ে গেছে তখনই তারা নিজেকে অথর্ব দেখতে পছন্দ করে। তাই অল্প বয়সে ওর মুখ দেখে আমার যা মনে হয়েছিল বার্ধক্যে সেটা হয়নি।

অবাক হয়ে গেল সায়ন, আপনি বললেন প্রথম দেখায় ওঁর মুখ নিষ্পাপ বলে মনে হয়েছিল আপনার। এখন সেটা মনে হয়নি?

নীরবে মাথা নাড়লেন এলিজাবেথ, হ্যাঁ, মনে হয়নি। আত্মপ্রতারকরা কখনওই মুখ নিষ্পাপ রাখতে পারে না। চলো, এবার হাঁটা যাক।

ম্যাডাম আগে হাঁটছিলেন। সরু পায়ে চলা পথ। দুপাশে জঙ্গল আর পাহাড়। গাছের ছায়া দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। মিস্টার ব্রাউন সম্পর্কে ম্যাডামের ব্যাখ্যা একদম পছন্দ হচ্ছিল না সায়নের। ওঁর মুখ দেখে কখনওই পাপীর কথা মনে হয়নি। অবশ্য পাপ কাকে বলে, পাপী কতরকমের হয় এসব তার ভাল জানা নেই।

ওরা যেখানে পৌঁছেছিল সেখান থেকে ওপরের বড় রাস্তাটা দেখা যায়। ঘুরে গেলে অন্তত মিনিট পনেরো লাগবে ওখানে পৌঁছতে। ম্যাডাম জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার কষ্ট হচ্ছে না তো সায়ন?

সায়ন বলল, একটুও না।

ঠিক তখন একটা গাড়ির আওয়াজ হল। সায়ন দেখল একটা জিপ উল্টোদিক থেকে আসছে। অর্থাৎ গাড়িটা নীচের বাজার থেকে উঠে আসেনি, গ্রাম থেকে ঘুরে আসছে। হঠাৎ জিপটা দাঁড়িয়ে গেল। ম্যাডাম সেটা লক্ষ করলেন, কার গাড়ি? তবে কি মিস্টার স্মিথ এসেছেন?

মিস্টার স্মিথ কে?

 ওয়ার্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের একজন বড় অফিসার। আমি ওঁদের অনুরোধ করেছিলাম আসার জন্যে, উনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

উনি কী জন্যে এলেন?

এইসব মানুষের উপকারে লাগবে এমন অনেক কাজ করেন ওঁরা। চলো, তাড়াতাড়ি ওঠা যাক। ভদ্রলোক বোধহয় আমাকে খুঁজতে গ্রামের দিকে গিয়েছিলেন। ম্যাডামের কথায় বেশ ফুর্তির ভাব লক্ষ করল সায়ন।

ঘুরপথেই ওরা উঠছিল। জায়গাটা আর নির্জন নেই। পৃথিবীর সমস্ত পাখি যেন এখানকার গাছে গাছে জড়ো হয়ে প্রাণপণ ডেকে যাচ্ছে। ম্যাডাম বললেন, এদের আজ খাবার জোটেনি নাকি, বড় চেঁচাচ্ছে।

সারারাত ঘুমোবার আগে ওরা এইভাবে চেঁচিয়ে নেয় এ কথা ম্যাডামেরও জানা আছে। সায়ন হেসে জিজ্ঞাসা করল, এবার এদের জন্যে খাবারের ব্যবস্থা করবেন নাকি আপনি?

ম্যাডাম জোরে হেসে উঠলেন আর তখনই ওদের দেখা গেল।

 রাস্তাটা যেখানে বাঁক নিয়েছে সেখানে চারজন ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। এই চারজনের দুজনকে সায়ন চেনে। মোটরবাইকে করে মাঝে মাঝেই এদিকে আসে। তার সঙ্গে গায়ে পড়ে ঝামেলা করার চেষ্টা করেছিল।

ম্যাডাম নিচু গলায় বললেন, ওরা ওখানে কেন?

সায়ন জিজ্ঞাসা করল, ওদের আপনি চেনেন?

দুজনকে চিনি। আজ ওরা আমার বাড়িতে এসে আমাকে আমেরিকান বলে গালাগাল করেছিল। ওখানে ওরা কী করছে?

চলুন, আমরা পাশ কাটিয়ে চলে যাব।

ওরা এগোল। ক্রমশ দূরত্বটা কমে আসছিল। সায়ন দেখল ওরা চারজন এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যে যেতে হলে পথ ছেড়ে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকতে হয়।

একেবারে সামনে পৌঁছে ম্যাডাম বললেন, তোমরা এভাবে দাঁড়িয়ে আছে কেন? পথ ছাড়ো, আমাদের যেতে দাও।

চারজনের কেউ জবাব দিল না।

ম্যাডাম জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদের মতলবটা কী বলো তো?

এবার একজন পাহাড়ি ভাষায় কথা বলল, তোকে দেখব।

সায়ন প্রতিবাদ করল, তোমরা ম্যাডামকে তুই বলে কথা বলছ?

চারজনেই সায়নকে দেখল। দ্বিতীয়জন বলল, অ্যাই, তুই আধামুর্দা, চুপচাপ থাক। আসুন মেমসাব, চলে আসুন।

ওদের বলার ধরনে এমন কিছু ছিল যে ম্যাডাম সায়নের দিকে তাকালেন। সায়ন কী করা উচিত বুঝতে পারছিল না। কিন্তু দ্বিধা সরিয়ে ম্যাডাম এগোলেন। ওঁকে আসতে দেখে মাঝখানের দুজন এক পা পিছিয়ে গেল। ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে ম্যাডাম আবার জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কী চাও?

তোকে দেখতে চাই। প্রথম ছেলেটাই জবাব দিল।

তোমরা কি আমাকে দেখতে পাচ্ছ না?

না। হঠাৎ হাত বাড়িয়ে ছেলেটা ম্যাডামের জামার বোতামের জায়গা ধরে জোরে টান দিতেই সেটা ছিঁড়ে গেল অনেকটা, ম্যাডাম হুমড়ি খেয়ে পড়লেন।

সায়ন চিৎকার করে উঠে ছুটে যেতেই একজন সজোরে লাথি চালাল। তলপেটে আঘাত পেয়ে ককিয়ে উঠল সায়ন এবং তার শরীরটা ছিটকে নীচে গড়িয়ে পড়ে একটা পাথরে আটকে গেল। ওর চোখের সামনে তখন অন্ধকার, সমস্ত শরীরে যন্ত্রণা, নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। কোনও মতে চোখ খুলতেই সে দেখতে পেল ম্যাডাম একটি ছেলেকে সজোরে ঠেলে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে হায়েনার মতো চিৎকার করে ঝাঁপিয়ে পড়ল বাকি তিনজন। ম্যাডাম পড়ে গেলেন মাটিতে। কয়েকমুহূর্তেই ওরা ম্যাডামের শরীর থেকে শেষ সুতোটাও খুলে নিয়ে হ্যাঁ হ্যাঁ করে হাসতে লাগল। সম্পূর্ণ নগ্ন ম্যাডাম উঠে দাঁড়িয়ে কিছু বলতে চেষ্টা করতেই পড়ে যাওয়া ছেলেটা এগিয়ে গেল, আরে ব্বাস। কী চিজ হ্যায়। এহি হ্যায় আসলি আমেরিকান চিজ। বলতে বলতে সে ম্যাডামের শরীরে হাত দিতে গেল। ম্যাডম চকিতে স্পর্শ বাঁচিয়ে চিৎকার করলেন, তোমরা এসব কেন করছ? আমি তোমাদের চেয়ে বয়সে অনেক বড়। তোমরা আমার ছেলের মতো।

ওরা বিকট হাসি হাসল। তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ম্যাডামের ওপরে। সায়ন সমস্ত শক্তি জড়ো করে উঠে বসল। তার মাথা ঘুরছে। ম্যাডামের শরীরটাকে তিনজনে ধরে রেখেছে মাটিতে চেপে, চতুর্থজন ওর শরীরের ওপরে। সে নেমে পড়তেই আর একজন সেই কাজের দায়িত্ব নিল। সায়ন উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করল। তারপর টলতে টলতে এগিয়ে গেল ওপরে। ওদের একজন ওকে দেখতে পেয়ে একটা পাথর তুলে ছুড়ল। আঘাতটা এড়াতে পারল না সে।

যখন জ্ঞান ফিরল তখন ওরা কেউ নেই। কোনওমতে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে ম্যাডামের শরীরটার কাছে পৌঁছে সে হাউহাউ করে কেঁদে উঠল। ম্যাডামের সমস্ত শরীরে ক্ষতচিহ্ন। হায়েনার দাঁত বসে গেছে সেখানে। শরীর স্থির কিন্তু ঠোঁট নড়ছে। চোখের সামনে শরীরটা কিন্তু আচমকা আর দেখতে পেল না সায়ন। তার নাক কান দিয়ে রক্ত গড়িয়ে নামছে নীচে। শরীর টলছে। তবু গাড়ির আওয়াজ কানে এল। এবং সেইসঙ্গে কথাবার্তা।

ছেলে চারটে দৌড়ে নামল নীচে। ম্যাডামের শরীরটাকে এক ঝটকায় তুলে নিয়ে গেল ওপরে যেখানে গাড়িটা দাঁড়িয়ে। গাড়ির সিটে শরীরটাকে ফেলে ওরা ঘুরে দাঁড়াতেই খুব ঘাবড়ে গেল। রক্তাক্ত একটা শরীর এগিয়ে আসছে তাদের দিকে। পা টলছে, হাত দুপাশে বাড়ানো। ওরা এবার ভয় পেল। ঝটপট ক্যান থেকে পেট্রোল জিপের সিটে ঢেলে দিয়ে আগুন ধরিয়ে ওরা দৌড়োল।

সায়ন কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না কিন্তু প্রচণ্ড শব্দে যখন জিপটা জ্বলছিল তখন আগুনের অস্তিত্ব বুঝতে পারল। সে জ্বলন্ত জিপের দরজা খুলতে চেষ্টা করতেই তার শরীর আগুনের আলিঙ্গনে ধরা পড়ল।

তখন চরাচরে বিষণ্ন আলো। সূর্যদেব বিদায় নিচ্ছেন। তবু রাতের চেয়ে বড় আতঙ্ক সামনে দেখে পাখিরা বোবা হয়ে গেল। জ্বলন্ত অবস্থায় সায়ন কোনওমতে ম্যাডামের পা স্পর্শ করতে পারল। জ্বলন্ত পা।

জ্বলন্ত আগুনের সেই রথ ক্রমশ আকাশ অধিকার করতে ওপরে, আরও ওপরে উঠে যাচ্ছিল। ঈশ্বর বলে কেউ যদি কোথাও থাকেন তাহলে তিনি বিপন্ন বোধ করছিলেন অবশ্যই। এই আগুন যদি আরও দীর্ঘতর হয় তাহলে তাঁর স্বর্গের অস্তিত্ব লোপ পাবে।

 নিরাপদে ফিরে গিয়ে ছেলে চারটে মশগুল ছিল। ছিনতাই করা একটা জিপ তাদের আড়াল করতে অনেক গল্প সাজাবে। ওরা কেউ পেছনে তাকায়নি তাই অগ্নিরথ দেখতে পায়নি। ওরা কেউ সামনে তাকাবে না তাই লক্ষ লক্ষ অগ্নিরথের অস্তিত্ব টের পাবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *