৪১-৪২. এলিজাবেথের সঙ্গে কাজ

এলিজাবেথের সঙ্গে কাজ শুরু করে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল সায়ন। একজন বিদেশিনী এই কয়েক মাসের মধ্যেই এই অঞ্চলের পাহাড়ি মানুষদের যাবতীয় সমস্যা নিয়ে যে-ভাবনাচিন্তা করছেন তা ওঁর আগে কেউ ভেবেছে বলে শোনা যায়নি। এলিজাবেথের বসার ঘরের দেওয়ালে একটা ম্যাপ টাঙানো রয়েছে। ওটা তিনি নিজের হাতে এঁকেছেন। ওই ম্যাপে কাছাকাছি দশটি গ্রামের অবস্থান, তাদের লোকসংখ্যা ইত্যাদি সুস্পষ্ট বলা আছে। ভারতবর্ষের বেশির ভাগ মানুষের সঙ্গে এদের কোনও পার্থক্য নেই। বেশির ভাগই অক্ষরজ্ঞানহীন, রোজগার নামমাত্র এবং জন্মহার খুব বেশি। এদের কোনও গৌরব করার মতো অতীত নেই, আনন্দে থাকার মতো বর্তমান অথবা আশা করার মতো ভবিষ্যৎ নেই। পাহাড়ে যখন আন্দোলন শুরু হয়েছিল তখন এরা প্রাথমিকভাবে নিরুত্তাপ থাকলেও পরে চাপে পড়ে কেউ কেউ সেই আন্দোলনে অংশ নিয়েছে। পুলিশের সঙ্গে সেই সশস্ত্র সংঘাতে যেসব আন্দোলনকারী মারা গিয়েছে তাদের বেশির ভাগই এইসব গ্রামের মানুষ। কিন্তু পরবর্তীকালে যারা গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে পেরেছিল তারা ছাড়া বাকিদের জীবন একই খাতে বয়ে চলেছে। এদের গ্রামে শহরের নেতাদের আনাগোনা হলে বুঝতে হবে ভোট আসছে। তখন ওদের আকাশ ফুলে ভরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি শোনানো হয়। ভোটের আগের দিন যারা নিয়ন্ত্রণ করতে আসে তাদের ভয়ে এরা লাইনে দাঁড়ায় এবং হুকুম পালন করে নিঃশব্দে। করে ভাবে, স্বস্তি পাওয়া গেল।

এলিজাবেথ এদের সাক্ষর করতে চান। পৃথিবীর খবর এদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার অভিলাষ তাঁর। যতটা সম্ভব স্বনির্ভর করতে আগ্রহী তিনি। আর জন্মহার কমাতে বদ্ধপরিকর। এই তিনটে কাজ করা মোটেই সহজ নয়। কিন্তু সায়ন লক্ষ করছিল এইসব মানুষেরা এলিজাবেথকে গ্রহণ করেছে খুব আন্তরিকতার সঙ্গে। কোনও ভারতীয় মহিলা হলে হয়তো এতটা সম্ভব হত না। এলিজাবেথের সাদা চামড়া, কথায় কথায় হাসি, বন্ধুর মতো ব্যবহার ওদের আকর্ষণ করে।

কাজ শুরু করার আগে এলিজাবেথ সায়নকে নিয়ে বসেছিলেন। ম্যাপটা দেখিয়ে গ্রামগুলোর অবস্থান জানিয়ে বলেছিলেন, তোমাকে একটা কথা বলছি। তুমি কাজ করতে চাইছ, এর চেয়ে আনন্দের কথা কিছু নেই। ঈশ্বর তোমাকে সবসময় সাহায্য করবেন। কিন্তু একজন সাধারণ মানুষের সঙ্গে তোমার পার্থক্য আছে। তোমার শরীরে যে-অসুখ রয়েছে তা অতিরিক্ত পরিশ্রমে মাথাচাড়া দিতে পারে। তাতে যদি তুমি অসুস্থ হয়ে পড় তাহলে তোমার পক্ষে কাজ করা সম্ভব হবে না। অতএব এমন পরিশ্রম কখনওই করবে না যা তোমাকে অসুস্থ করবে। ঠিক আছে? আমরা এখানে তিনটে দলে নিজেদের ভাগ করেছি। আমি, সিমি এবং আরও কয়েকজন মেয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে মেয়েদের জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে বোঝাবার চেষ্টা করছি। এই কাজটা ছেলেদের পক্ষে সম্ভব নয়। মেয়েরা শুনতে চাইবে না।

সাক্ষর করার প্রচেষ্টা শুরু হয়ে গিয়েছে। একটু-আধটু লেখাপড়া জানে এমন কয়েকজনকে বেছে নিয়ে সকাল দুপুর সন্ধেবেলায় গ্রামে গ্রামে ক্লাস শুরু হয়েছে। এলিজাবেথ বললেন, অবাক হওয়ার ব্যাপার, বাচ্চাদের থেকে বয়স্করাই ওইসব ক্লাসে আসতে আগ্রহী বেশি। তাদের জন্যেই সন্ধেবেলায় ক্লাস করতে হচ্ছে।

কিন্তু ওদের জন্য কি স্কুল করা সম্ভব?

না, না। স্কুলের কথা আমি একদম ভাবছি না। এলিজাবেথ বললেন, স্কুল তৈরি করার মতো সঙ্গতি আমাদের নেই। আমরা শুধু কতগুলো গ্রুপে ওদের জমা করে অক্ষরপরিচয় করিয়ে দিতে চাই।

এই কাজটার দায়িত্ব আমি নিতে পারি।

খুব ভাল কথা। কিন্তু তোমাকে আমি আর একটু বড় দায়িত্ব দিতে চাই। আমাদের তিন নম্বর কাজ হল ওদের স্বনির্ভর হতে সাহায্য করা। এই দশটা গ্রামের মানুষের সংখ্যা আট হাজার তিনশো তিরিশজন। মাত্র আটশো তিনজন মানুষ যা হোক কিছু রোজগার করে নিয়মিত। বাকিদের কেউ কেউ কখনও-সখনও রোজগার করে আর বেশির ভাগই বেকার। চাষাবাদ পাহাড়ে খুব কম হয়। যা হয় তাই বিক্রি করে বাঁচার চেষ্টা করে। অভাবের জন্যে এদের কিছু ছেলেমেয়ে ষোলো-সতেরো বছর বয়স হলেই বাড়ি ছেড়ে উধাও হয়ে যায়। যাদের চেহারা সুন্দর সেইসব মেয়েদের লোভ দেখিয়ে নরকের পথে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এই ব্যাপারটা অবিলম্বে বন্ধ করা দরকার।

পুলিশ জানে?

জানে। কিন্তু অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান না হলে এটা বন্ধ কী করে হবে? পুলিশের পক্ষে তো দিনরাত পাহারা দেওয়া সম্ভব নয়। তুমি দিনসাতেক সময় নাও। এই গ্রামগুলো ঘুরে ওদের সঙ্গে কথা বলে দ্যাখো ওরা কী করতে পারে। আমি ডেয়ারি ফার্ম, পোলট্রি ফার্ম ইত্যাদির কথা ভেবেছি। তুমি যদি অন্য কোনও প্রস্তাব দাও তাহলে সেটা নিয়েও ভাবা যেতে পারে। সাতদিন পরেই আমরা কাজ শুরু করব।

সায়ন উদ্বুদ্ধ হল। ম্যাপ দেখে সে ঠিক করে নিল কবে কোন গ্রামে যাবে। এই গ্রামগুলোতে পৌঁছোতে তাকে বিস্তর হাঁটাহাটি করতে হবে।

ম্যাথুজ বলল, দু-একদিন সায়ন তার সঙ্গে যেতে পারে। ও প্রতিদিন দুটো গ্রামে মাংস বিক্রি করতে যায়।

সায়নের কপালে ভাঁজ পড়ল। সে জিজ্ঞাসা করল, তুমি যে মাংস বিক্রি করতে যাও, কেনে কারা?

কেন। গ্রামের মানুষজন?

ওদের হাতে মাংস কেনার মতো টাকা থাকে?

বাঃ, ম্যাডাম তো অনেক কম দামে মাংস বিক্রি করতে বলেছেন।

যত কম দাম হোক, টাকা পায় কোথায়?

 মাথুজ মাথা নামাল, সবাই দাম দিতে পারে না। আসলে আমাকে মুশকিলে ফেলেছেন ম্যাডাম, এটা ওঁকে বোঝাতে পারি না।

কীরকম?

 উনি বলেছিলেন গ্রামে ঢোকার পর যারা প্রথমে মাংস কিনবে তাদের কম দামে বিক্রি করতে। তারপর বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর যদি দেখি অনেকেই কিনতে চাইছে কিন্তু টাকার অভাবে পারছে না তাহলে তাদের ধারে মাংস দিতে। পকেট থেকে একটা নোটবই বের করে মুখের সামনে নাড়ল ম্যাথুজ, সবকটা পাতায় ওদের নাম আর মাংসের ওজন লিখে রেখেছি। এটা শুরু হওয়ার কিছুদিন পরেই দেখলাম যাদের সামর্থ্য আছে তারাও আর টাকা না দিয়ে ধার নিচ্ছে। সবাই বুঝে গিয়েছে জীবনে শোধ দিতে হবে না।

শোধ না দিলে মাংসের দাম উঠবে কী করে?

উঠবে না।

তাহলে তো তোমার প্রচণ্ড ক্ষতি।

না, আমার পরিশ্রমটাই যাচ্ছে, টাকা যাচ্ছে না। ম্যাডাম দিচ্ছেন।

কিন্তু এই ব্যাপারটাকে সমর্থন করা যায় না।

ম্যাডামকে বলেছি। তিনি বলেন আরও একটু দেখতে। ওঁর আশা ওরা নিশ্চয়ই মাংসের দাম শোধ করে দেবে। হতাশ গলায় বলল ম্যাথুজ।

তুমি সাধারণত কতটা মাংস নিয়ে যাও?

আগে বেশি নিতাম, এখন কুড়ি পঁচিশ কেজির বেশি নিই না।

আগামীকাল পাঁচ কেজি সঙ্গে নেবে।

কেন?

কাল কাউকে ধার দেবে না। পাঁচ কেজির বেশি কি ওরা নগদ দাম দিয়ে তোমার কাছ থেকে কেনে? সায়ন জিজ্ঞাসা করল।

পাঁচ? এখন ওরা একশো গ্রামের টাকাই দেয় না।

 ম্যাডামের বাড়ি থেকে ফিরছিল সায়ন। এতদিন বাদে একটা কাজের সঙ্গে সে যুক্ত হতে যাচ্ছে বলে মন ভাল লাগছিল। এইসময় দুটো মোটরবাইক নীচ থেকে উঠে আসছিল পাশাপাশি। সায়নকে দেখে ওরা নিজেদের মধ্যে কিছু কথা বলে দুপাশে দাঁড়িয়ে গেল আচমকা।

নমস্কার। আপনি তো সায়নবাবু? ডান দিকের আরোহী জিজ্ঞাসা করল।

হ্যাঁ। আপনারা?

আমরা লোক্যাল ছেলে। বেকার। বাম দিকের আরোহী জবাব দিল।

কী চান আপনারা?

চাই তো অনেক কিছু। ভাল মেয়েছেলে, প্রচুর টাকা, দেবেন আপনি?

ওসব আমি কী করে দেব?

বাঃ। পাবলিক বলে আপনার মধ্যে নাকি যিশু মাঝে মাঝেই চলে আসে। আপনি চাইলে সব হবে।

আপনারা ভুল শুনেছেন। আমার কোনও ক্ষমতা নেই। আর আমার মধ্যে যিশু কেন, কোনও ভগবানই কখনও ঢোকেননি। তাঁদের অন্য কাজ আছে।

তাহলে থানা থেকে আপনি সূরজকে ছাড়িয়ে আনলেন কী করে?

সূরজ কোনও দোষ করেনি। পুলিশকে বুঝিয়ে বলতে ওরা ছেড়ে দিল।

কথাটা শুনে দুজনেই হো হো করে হাসতে লাগল। তারপর হাসি থামিয়ে ডান দিকের আরোহী বলল, এ কথাটা কোনও বাচ্চাও বিশ্বাস করবে না। যাকগে, আপনি এদিকে কোথায় গিয়েছিলেন? গির্জায়?

না। আমি ম্যাডামের ওখান থেকে আসছি।

আচ্ছা! আপনার সঙ্গে ওই সি আই এ এজেন্টের পরিচয় আছে?

উনি সি আই এর এজেন্ট?

নিশ্চয়ই। নইলে আমেরিকা থেকে সব ছেড়েছুড়ে এই পাহাড়ে গরিবদের নিয়ে কেউ থাকে? লোকের উপকার করা সব বাহানা, আসল ধান্দা হল পাহাড়ের আন্দোলন থামিয়ে দেওয়া।

সায়ন হাসল, আপনারা আমার থেকে দেখছি অনেক বেশি জানেন। আমি যতক্ষণ প্রমাণ না পাচ্ছি ততক্ষণ এসব বিশ্বাস করতে পারছি না।

আপনি তো এখন সুস্থ। কলকাতায় কবে যাবেন?

কেন?

আপনার বাড়ি কলকাতায়। এখানে নয়। ফালতু এখানে পড়ে থাকবেন কেন?

 আমি ভারতবর্ষের মানুষ। ভারতবর্ষের যে কোনও জায়গায় আমি থাকতে পারি, তাই না? আচ্ছা, আমি চলি।

সায়ন পা বাড়াতেই ডান দিকের আরোহী হাত বাড়াতে যাচ্ছিল কিন্তু বাম দিকের আরোহী তাকে পাহাড়ি ভাষায় নিষেধ করল।

এতক্ষণ মনে যে ভাল লাগাটা ছিল তা আচমকাই চলে গিয়েছিল। এরা কারা? পার্টির লোক? পাহাড়ে যারা স্বাধীনতা আনতে চেয়েছিল তারা এখন নানান দলে ভাগ হয়ে গিয়েছে। এরা কোন দলের? যে দলেরই হোক এরা ম্যাডামের বিরুদ্ধে নোংরা প্রচার শুরু করেছে। যে কোনও বিদেশিকে সি আই এর এজেন্ট বলা খুব সহজ ব্যাপার। যে শুনবে তারই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করবে। ভাগ্যিস যিশুখ্রিস্টের সময় আমেরিকা ছিল না, নইলে তাঁকেও হয়তো সি আই এর এজেন্ট বলা হত।

মিস্টার ব্রাউনের বাড়ির সামনে পৌঁছে সায়ন দেখল একটা বড় ট্রাক রাস্তার অনেকটা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইতিমধ্যে প্রচুর মালপত্র তোলা হয়ে গিয়েছে। কয়েকজন শ্রমিক বিছানাপত্র নিয়ে এল বাড়ির ভেতর থেকে।

এইসময় মিস্টার ব্রাউনের ছেলেকে দেখতে পেল সায়ন। যে গেটের সামনে মিস্টার ব্রাউন দাঁড়িয়ে সবার কুশল জিজ্ঞাসা করতেন সেখানে এসে দাঁড়ালেন ভদ্রলোক। বাবার মৃত্যুর পর ইনিই এসেছিলেন।

সায়ন এগিয়ে যেতে ভদ্রলোক হাসলেন, বাড়িটা বিক্রি করে দিলাম।

ও।

আসলে এখানে এসে তো কেউ থাকবে না, মিছিমিছি বাড়িটাকে ফেলে রেখে লাভ কী। শিলিগুড়ি থেকে তো আমি কখনও চলে আসব না।

আপনি কি নিরাময়কে বিক্রি করলেন?

না না। ওরা আমার কাছে জলের দরে বাড়িটা চেয়েছিল। হ্যাঁ, আমি মানছি ওরা গরিব মানুষের উপকার করতে হাসপাতাল করছে, এই বাড়ি ওদের কাজে লাগত। কিন্তু আমার তো ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবার কোনও ইচ্ছে নেই। আমি কাঠমাণ্ডুর এক ভদ্রলোককে বিক্রি করে দিলাম।

কাঠমাণ্ডু?

হ্যাঁ। পার্টি থেকেই ঠিক করে দিল। নিরাময় যা অফার করেছিল তার থেকে অনেক বেশি পেয়েছি। হাসলেন ভদ্রলোক।

এই বাড়িতে মিস্টার ব্রাউন থাকতেন। ওঁর স্মৃতি আর থাকবে না।

স্মৃতি? আরে ভাই মানুষটাই যখন নেই তখন স্মৃতি নিয়ে কী হবে? কিন্তু আমাকে বিপদে ফেলে দিয়েছেন ফাদার যোশেফ।

কীরকম?

 যিনি বাড়িটা কিনেছেন তিনি হিন্দু। বাবার উপাসনার ঘরে তিনি তাঁর দেবতাদের রাখবেন। এই যিশুর মূর্তিটাকে শিলিগুড়িতে নিয়ে রাখার মতো জায়গা আমার বাড়িতে নেই। আমি তাই ফাদারকে বলেছিলাম মূর্তিটাকে চার্চে নিয়ে যেতে। কিন্তু ভদ্রলোক এত দেরি করছেন। বেশ উদ্বিগ্ন মুখে তিনি রাস্তার দিকে তাকালেন।

ওই মূর্তিটি আপনার বাবার খুব প্রিয় ছিল!

ভদ্রলোক তাকালেন, কিছু বলতে গিয়ে বললেন না। এইসময় শ্রমিকরা এসে জানাল সমস্ত মালপত্র গাড়িতে তোলা হয়ে গেছে।

হঠাৎ ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কি খ্রিস্টান?

হেলে ফেলল সায়ন, কেন?

তাহলে মূর্তিটাকে আপনার কাছে রেখে যেতাম। আপনি পরে ফাদারকে দিয়ে দিতেন।

আপনি আমাকে স্বচ্ছন্দে দিয়ে যেতে পারেন।

ভদ্রলোক যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। দ্রুত ভেতরে চলে গিয়ে একটা বিশাল পিজবোর্ডের বাক্স শ্রমিকের কাঁধে চাপিয়ে নিয়ে এলেন। সায়ন লোকটিকে বলল, তুমি আমার সঙ্গে এসো।

নিরাময়ের গেটে পৌঁছে বাক্সটাকে নামাতে বলল সে। বড় এবং ছোটবাহাদুর সেখানে দাঁড়িয়েছিল। সায়ন তাদের জিজ্ঞাসা করল, ডাক্তার আঙ্কল কি ভেতরে আছেন?

হ্যাঁ। কঙ্কাদিদির খুব শরীর খারাপ। রক্ত দেওয়া হচ্ছে।

অবাক হয়ে গেল সায়ন। কঙ্কাবতীকে রক্ত দেওয়া হচ্ছে। এইসময় সে পদমকুমার এবং আর একটি ছেলেকে দেখল নিরাময় থেকে বেরিয়ে যেতে। যাওয়ার সময় পদমকুমার তাকে নমস্কার করে গেল। সায়ন দেখল সমস্ত মালপত্র সংগ্রহ করে মিস্টার ব্রাউনের ছেলের ট্রাক নীচের দিকে নেমে গেল। সে ছোটবাহাদুরকে বলল, বাক্সটাকে নিয়ে ভিজিটার্স রুমে চলো।

ভিজিটার্স রুমে একটা বড় টেবিল আছে দেওয়াল ঘেঁষে। বাক্স থেকে মূর্তি বের করে টেবিলের ওপর রাখতেই বড়বাহাদুর এবং ছোটবাহাদুর ভক্তিভরে নমস্কার করল। ছোট বাহাদুর জিজ্ঞাসা করল, এখন থেকে এখানেই উনি থাকবেন?

মাথা নাড়ল সায়ন, না, ফাদারকে পৌঁছে দিতে হবে। তিনি চার্চে নিয়ে যাবেন।

ওরা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে সায়ন ভাল করে মুর্তিটাকে দেখল। মিস্টার ব্রাউনের আরাধনার ঘরে মোমবাতি জ্বলত মূর্তির সামনে। তার আলোয় যিশু যেরকম অলৌকিক হয়ে উঠতেন এখন সেরকম মনে হচ্ছে না। ভিজিটার্স রুমের নিওন বাতির আলোয় যিশুকে একজন সাদামাটা সুন্দর চেহারার মানুষ ছাড়া কিছু মনে হচ্ছে না। একজন সহজ মানুষ হাসিমুখে তাকিয়ে আছেন। ধর্মপ্রচারক বা ঈশ্বরের অবতার নন, এ সময় ওঁকে বন্ধু ছাড়া অন্য কিছু ভাবা যাবে না।

সায়ন যিশুর মুখের দিকে তাকাল। মিস্টার ব্রাউন এই মূর্তির মুখের গড়নের সঙ্গে তার মুখের মিল খুঁজে পেয়েছিলেন। তার চিবুকের মাঝখানে একটা ছোট্ট খাঁজ আছে। খুবই সামান্য। সায়ন দেখল মূর্তিটিরও একই চেহারা। সে চোখের দিকে তাকাল। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকার পর হঠাৎ শরীরটা ঝিমঝিম করে উঠল সায়নের। ওই কৌতুকমাখানো চোখ দুটোয় কি সম্মোহনীশক্তি আছে?

প্রার্থনা করো সায়ন। এ ছাড়া অন্য কোনও পথ নেই।

গলাটা কানে যেতেই ধাতস্থ হল সায়ন। ডাক্তার আঙ্কল পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। সে অবাক হয়ে তাকাল।

ডাক্তার বললেন, ঘণ্টা তিনেক আগে হঠাৎই কঙ্কাবতী অসুস্থ হয়ে পড়ে। ওর নাক কান দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসে। ওর শরীরের লক্ষণ দেখে মনে হয়েছিল এখনই বিপদের সম্ভাবনা নেই। কিন্তু কেন যে এমন হল আমি বুঝতে পারছি না। ওকে আমি ছেড়ে দেব বলে ভেবেছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে পদমকুমারকে পাওয়া গিয়েছিল বলে রক্ত দিতে পেরেছি। এখন ব্লিডিং বন্ধ হয়ে গিয়েছে কিন্তু শি ইজ নট আউট অফ ডেঞ্জার।

কেন?

যে পরিমাণে রক্তপাত হয়েছে তা শুধু নাক কান ছাড়া অন্যত্রও হতে পারে। শরীরের ভেতরে হলে বিপদ হবেই। তাই আমাদের প্রার্থনা করা ছাড়া কোনও উপায় নেই। এইসব সময়ে আমরা সত্যিই হেল্পলেস।

সায়ন বড় নিশ্বাস ফেলল। ডাক্তার আঙ্কল বললেন, আমি মিরাকলে বিশ্বাস করি না। কিন্তু আজ এই সময়ে যিশুর মূর্তি নিরাময়ে এল। কীরকম কাকতালীয় ব্যাপার। অথচ দ্যাখো, মনে জোর পাচ্ছি।

সায়ন জিজ্ঞাসা করল, কঙ্কাবতীর মা এসেছেন?

হ্যাঁ। আমি ডক্টর তামাংকে খবর দিয়েছি। জুনিয়ার ব্রাউন কি যিশুর মূর্তি তোমাকে দিয়ে গেলেন?

না। চার্চে দিতে বলে গেলেন।

ও। ভদ্রলোক বাড়িটাকে আমাদের কাছে বিক্রি করতে রাজি হলেন না।

এইসময় ফাদার যোশেফকে দরজায় দেখা গেল। ডাক্তার বললেন, আসুন ফাদার।

 সায়ন বলল, মিস্টার ব্রাউনের ছেলে আপনার জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। ওঁর পক্ষে যিশুর এই মূর্তি শিলিগুড়িতে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। উনি আপনাকে দিতে চেয়েছিলেন চার্চে রাখার জন্যে। আপনাকে না পেয়ে আমাকে বলেছেন দিয়ে দেবার জন্যে। কিন্তু ফাদার, আমরা কি এখানে মূর্তিটিকে কয়েকদিন রাখতে পারি?

ফাদার মাথা নাড়লেন, যতদিন ইচ্ছে রাখতে পারো।

সায়ন বলল, আমি একটা কথার জবাব ওঁকে দিইনি। উনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন আমি খ্রিস্টান কিনা? আমি সেটা এড়িয়ে গিয়ে মূর্তিটিকে রাখতে চেয়েছি।

ঠিকই করেছ। পিতার স্মৃতির প্রতি যে সন্তান সম্মান জানাতে পারে না তার কোনও ধর্ম নেই। সে হিন্দু মুসলমান অথবা খ্রিস্টান নয়। আর যে খ্রিস্টান যিশুর মূর্তিকে দায় বলে মনে করে তার কাছে সত্য গোপন করলে কোনও পাপ হয় না। কিন্তু ডক্টর, আমি শুনলাম আপনার একজন পেশেন্ট খুব অসুস্থ?

হ্যাঁ। আমি আপনাকে অনুরোধ করব ওর জন্যে প্রার্থনা করতে।

নিশ্চয়ই করব। কয়েকটা মোমবাতি পাওয়া যেতে পারে?

মোমবাতি এল। ফাদার সযত্নে সেগুলোকে জ্বালিয়ে যিশুর মূর্তির পাশে বসিয়ে দিলেন। সেই মোমবাতির নরম আলো যিশুর চিবুকে কপালে ছড়িয়ে পড়তেই সায়নের মনে হল তিনি অলৌকিক হয়ে উঠলেন। ফাদার সেই মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করতে লাগলেন। ডাক্তার আঙ্কলের মাথাও নীচের দিকে। সায়ন ধীরে ধীরে বেরিয়ে এসে সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠে এল।

কঙ্কাবতীর ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে দৃশ্যটি দেখতে পেল সে। মিসেস অ্যান্টনি মাথার পাশে বসে, পায়ের কাছে ওর মা। ঝোলানো বোতল থেকে টুপ টুপ করে রক্তের ফোঁটা নলের ভেতর দিয়ে নীচে নেমে যাচ্ছে। সম্পূর্ণ চিত হয়ে শুয়ে আছে কঙ্কাবতী। চোখ বন্ধ। রক্ত যাচ্ছে তার শরীরে। ওকে কি ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে? সায়ন চোখ বন্ধ করল। তারপর মনে মনে বলল, কঙ্কা, শঙ্কা কোরো না।

রাতটা কেটে গেল। সকাল হতেই সায়ন চলে এল কঙ্কাবতীর ঘরে, এসে খুশি হল। কঙ্কাবতী বালিশে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে আছে। একটা চাদর তার বুক অবধি টানা। ওর মা ঘরে নেই কিন্তু মিসেস অ্যান্টনি আছেন। এই ভদ্রমহিলা গতরাতে বাড়ি যাননি নাকি? সায়ন প্রশ্ন করতে সাহস পেল না।

মিসেস অ্যান্টনি কঙ্কাবতীর চুল আঁচড়ে দিচ্ছিলেন, সব ঠিক হয়ে যাবে। ডক্টর বলেছেন আর তোমার কোনও বিপদ নেই।

কঙ্কাবতী তাঁর দিকে তাকাল, কিন্তু আমার অমন হল কেন? আমি তো সেরে গিয়েছিলাম তাহলে আমার রক্ত বের হল কেন?

ওরকম হয়। তুমি এসব নিয়ে একটুও ভাববে না।

কিন্তু আমার পেটে ব্যথা করছে।

কাল থেকে টয়লেটে যাওনি তো, তাই। ডক্টর ওষুধ দিয়েছেন, টয়লেট হয়ে গেলে ব্যথা চলে যাবে। কথা বলতে বলতে মিসেস অ্যান্টনি সায়নকে দেখতে পেলেন, আরে এসো এসো। গুড মর্নিং।

গুড মর্নিং। কেমন আছ কঙ্কা?

ভাল না। আমার পেটে ব্যথা করছে। অদ্ভুত গলায় বলল কঙ্কাবতী।

ওটা সামান্য ব্যাপার।

তোমার শরীর থেকে যখন রক্ত বের হয় তখন কি পেটের ব্যথা শুরু হয়? কঙ্কাবতী জিজ্ঞাসা করল।

না। সায়নের সেরকম কখনও হয়নি। সে মাথা নাড়ল, না।

তাহলে আমার কেন হচ্ছে? বলতে বলতে জানলার বাইরে তাকাল কঙ্কাবতী। সেখানে নিষ্পত্র গাছটিকে সে দেখতে পেল না। অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ওমা, গাছটা কোথায় গেল? ওখানে গাছ ছিল।

মিসেস অ্যান্টনি তাকালেন, নতুন হাসপাতাল হচ্ছে, বোধহয় কন্ট্রাকটরের লোকজন কেটে ফেলেছে। আমাদের নিরাময় তো আরও বড় হবে।

তাহলে আমি আর পাখি দুটোকে দেখতে পাব না।

কোন পাখি?

ওই গাছের ডালে এসে বসত।

কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে সরে এল সায়ন। তার ভাল লাগছিল না। আজ কঙ্কাবতীর কণ্ঠস্বর একদম অন্যরকম শোনাচ্ছে। কীরকম ছেলেমানুষের মতো যার মধ্যে শুধুই অস্থিরতা।

.

ম্যাথুজ এবং বিষ্ণুপ্ৰসাদ অপেক্ষা করছিল। সায়ন শুনতে পেল ম্যাডাম এবং সিমি সাতসকালেই বেরিয়ে গেছেন। ম্যাথুজের হাতে একটা ছোট্ট ব্যাগ, সম্ভবত তার মধ্যেই মাংস আছে। সে বলল, আজ আমার হাঁটতে কষ্ট হবে না।

কুড়ি পঁচিশ কেজি মাংস নিয়ে রোজ হাঁটতে?

উপায় কী! প্রথম প্রথম যখন তারও বেশি নিয়ে যেতে হত তখন একটা খচ্চর ভাড়া করতাম। কিন্তু আমি ভাবছি জানতে পারলে ম্যাডাম রেগে যাবেন।

না রাগবেন না। আর যদি রেগে যান তাহলে আমি বুঝিয়ে বলব।

ওরা তিনজন কথা বলতে বলতে হাঁটছিল। এখন আর পিচ বা পাথরকুচির রাস্তা নেই। হেঁটে হেঁটে মানুষ পাহাড়ে সরু পথ তৈরি করে ফেলেছে, খানিকটা উঠে বেশ কিছুটা নীচে নামতেই জঙ্গল দেখতে পেল ওরা। জঙ্গলের গায়েই গ্রাম। এই গ্রাম বেশি বড় নয়। মুরগি ডাকছে ওখানে।

সায়ন জিজ্ঞাসা করল, এই গ্রামের অবস্থা কীরকম?

একটু ভাল। বিষ্ণুপ্ৰসাদ বলল, কয়েকজন শিলিগুড়ি লাইনে ট্যাক্সি চালায়, খালাসির কাজ করে। কিছু লোক মিলিটারিতে গিয়েছে, তাদের টাকা আসে। আর এদিকটায় খুব ভাল স্কোয়াশ আর কলা হয়।

গ্রামে ঢুকে কিন্তু সায়নের মনে হল না বিষ্ণুপ্রসাদের বক্তব্য ঠিক। চারপাশে অভাবের হাঁ-মুখ, এদের পোশাক, চেহারায় তার ছাপ স্পষ্ট। গ্রামের মাঝখানে একটা বড় পাথরের ওপর মাংসের থলি রে ম্যাথুজ চিৎকার করল, টাটকা মাংস, নরম মাংস, ম্যাডাম দাম কমিয়ে দিয়েছেন বলে আপনারা খুব সস্তায় পেয়ে যাচ্ছেন, আড়াইশো পাঁচশো এক কিলোর প্যাকেট আছে, ফুরিয়ে যাওয়ার আগে জলদি নিয়ে যান।

সায়ন দেখল মাত্র চার পাঁচজন লোক বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ম্যাথুজের কথা শুনছে। একই কথা ম্যাথুজ বারংবার বলে যাচ্ছিল কিন্তু কেউ কিনতে এগিয়ে আসছিল না।

সায়ন নিচু গলায় ম্যাথুজকে বলল, টাকা না দিলে কাউকে মাংস দেবে না আজ। বলবে ধারবাকি বন্ধ। ম্যাথুজ মাথা নাড়ল।

বিষ্ণুপ্ৰসাদকে নিয়ে গ্রামটাকে ঘুরে দেখল সায়ন। তারপর কয়েকজন যুবককে ডেকে একজায়গায় জড়ো করল, আপনারা কি কোনও কাজকর্ম করেন?

ক্ষেতি করি। একজন বলল।

তাতে আপনাদের সংসার ভালভাবে চলে?

সবাই একসঙ্গে মাথা নাড়ল, না।

তাহলে কী করে চালান?

নিজেরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে শেষ পর্যন্ত একজন বলতে পারল, চলে না। তখন ইসখুস খেয়ে বেঁচে থাকি।

ইসখুস?

বিষ্ণুপ্ৰসাদ বলল, স্কোয়াশকে ইসখুস বলা হয়।

 তোমরা শহরে গিয়ে কাজ করো না কেন?

 গিয়েছিলাম, কাজ পাইনি।

তোমাদের গ্রামের অনেকেই তো পেয়েছে।

ওরা আমাদের পাত্তা দেয়নি।

কথা বলার সময় দু-একজন করে শ্রোতার সংখ্যা বাড়ছিল। সায়ন জিজ্ঞাসা করল, তোমরা এখন লেখাপড়া করছ?

বিষ্ণুপ্ৰসাদ বলল, এরা আসে না। আমি এই গ্রামে পড়াতে আসি। আসে মেয়েরা আর বুড়োরা। আমি এদের বলেছি সই করতে না জানলে সবাই তোমাদের ঠকাবে। কোথাও চাকরি করতে পারবে না। কিন্তু এদের কানে ঢুকছে না।

ঠিকই। কী করে লিখতে হয় আর কী করে পড়তে হয় তা তোমাদের শিখতে হবে। এটা খুব জরুরি। সায়ন বলল।

একজন জিজ্ঞাসা করল, কেন? আমার বাপঠাকুরদাও তো জানত না।

তারা কখনও ব্যবসা করেনি। তোমরা যদি ভালভাবে বেঁচে থাকতে চাও তাহলে তোমাদের ব্যবসা করতে হবে।

আমরা ব্যবসা করব? খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল একজন।

হ্যাঁ। তোমাদের কেউ চাকরি দেবে না। তাই সবাই মিলে একসঙ্গে ব্যবসা করা ছাড়া তোমাদের বাঁচার কোনও উপায় নেই। ব্যবসায় হিসেব লেখা খুব প্রয়োজন। লিখতে জানলে সেটা করতে কোনও অসুবিধে হবে না।

আমরা কী ব্যবসা করব?

তোমরা যখন চাষবাস করো তখন কী করলে আরও বেশি ফসল ফলানো যায় তার রাস্তা আমরা দেখিয়ে দেব। সেই ফসল তোমরাই বাজারে বিক্রি করবে। আমরা তোমাদের মুরগির বাচ্চা এনে দেব। এই গ্রামের প্রত্যেক মানুষের মাথাপিছু একটা বাচ্চা। তোমরা তাদের বড় করবে। সেই মুরগির ডিম বিক্রি করতে পারবে। তাদের বাচ্চা বড় হলে সেগুলোর জন্যে ভাল দাম পাবে। কীভাবে মুরগির চাষ করতে হয়, ডিম ফোটানোর জন্যে কী কী যন্ত্র লাগে, ওদের কী খাওয়াতে হয় এসব ম্যাডাম তোমাদের বুঝিয়ে দেওয়ার জন্যে লোক পাঠাবেন। কিন্তু তোমাদের খুব পরিশ্রম করতে হবে। রাজি আছ?

আমাদের টাকা দিতে হবে না?

না। তোমাদের পরিশ্রম আর চেষ্টা থাকলেই হবে। কিন্তু একটা শর্ত আছে।

সবাই তাকাল সায়নের দিকে।

যখনই তোমরা মুরগি থেকে রোজগার শুরু করবে তখনই একটু একটু করে ম্যাডামকে তাঁর টাকা ফিরিয়ে দিতে হবে। রাজি?

পঞ্চাশ ষাটজন মানুষ একসঙ্গে চিৎকার করল, রাজি।

দ্যাখো, আমরা মানুষ। গোরু ভেড়া মুরগি নই। একটা ছাগলকে তুমি যা দেবে তা সে খেয়ে নেবে কিন্তু সে কিছু ফিরিয়ে দেবে না। আমরা মানুষ হয়ে শুধু যদি হাত পেতে নিই, ফিরিয়ে দেওয়ার কথা না ভাবি তাহলে আমাদের সঙ্গে ছাগলের পার্থক্য থাকবে না। দাম শোধ করতে হবে না ভেবে যারা ধার নেয় তাদের আর যাই বলা যাক মানুষ বলা যাবে না। ম্যাডাম তোমাদের ধার দেবেন, তোমরা যদি তা শোধ করে দাও তাহলে তাঁকে সম্মান জানানো হবে। আর এই জন্যে তোমাদের হিসেব রাখতে হবে। তাই অক্ষর চিনতে শুরু করো। সায়ন কথাগুলো শেষ করতেই দেখল প্রতিটি মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।

একজন বলল, আমাদের এখন চাষ নেই। কবে থেকে ব্যবসা শুরু করব?

 দিন সাতেকের মধ্যে জানতে পারবে। কিন্তু তার আগে বলো তোমাদের গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান কে?

একজন প্রৌঢ় এগিয়ে এলেন। সায়ন তাঁকে জিজ্ঞাসা করল, আমার এই প্রস্তাবে আপনার কোনও আপত্তি নেই তো?

মনে হচ্ছে ভালই হবে কিন্তু পার্টিকে জানাতে হবে।

কোথায় গিয়ে জানাবেন?

শহরে।

তারা যদি নিষেধ করে?

সঙ্গে সঙ্গে জনতা চিৎকার করে প্রতিবাদ জানাল।

সায়ন বলল, আপনাদের কষ্টের দিনে পার্টি যদি কোনও সাহায্য না করে তাহলে তাদের নিষেধ করার কোনও অধিকার নেই। আপনি নিজে পঞ্চায়েত প্রধান। এই গ্রামের মানুষদের জন্যে কী করেছেন?

আমার কিছু করার ক্ষমতা নেই।

কেন? আপনাদের হাতে সরকারের দেওয়া টাকা আসে না?

না। আমি একবার শহরে গিয়ে টিপসই করে দিই। ওরা আমাকে টাকা দেয় না। বলে, আরও বড় কাজে টাকাটা লাগবে।

আপনার পঞ্চায়েতের অন্য সদস্যরা আপত্তি করে না?

ওরা কেউ শহরে যায় না।

এখন দেখছেন আপনার গ্রামের মানুষ চাইছে সুস্থ হয়ে বেঁচে থাকতে। এদের দাবি মেনে নিন। আপনারা একটা সমিতি তৈরি করুন যাদের হাতে ব্যবসা চালাবার দায়িত্ব থাকবে। এই ব্যবসার আয় যেন প্রত্যেকটি পরিবার পায় সেটা লক্ষ রাখবেন।

প্রধান হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলেন, কতদিনে ব্যবসা থেকে টাকা পাওয়া যাবে?

মুরগিগুলো বড় হয়ে যতদিন না ডিম পাড়বে ততদিন অপেক্ষা করতে হবে। আমি সাতদিন পরে আবার আসব। সায়ন বলল।

ম্যাথুজ তার জায়গায় দাঁড়িয়েছিল। সায়নকে ডেকে বলল, আজও কেউ কিনতে আসেনি। আসবে না, জানতাম।

সায়ন এবং বিষ্ণুপ্রসাদের পেছনে ছেলেগুলো আসছিল।

 সায়ন বলল, চলো, পাশের গ্রামে যাই।

 এই সময় একজন বৃদ্ধ এগিয়ে গেল ম্যাথুজের সামনে, চলে যাচ্ছ?

মাথুজ বলল, হ্যাঁ।

তাহলে আমাকে পাঁচশো গ্রাম ধার দাও।

সঙ্গে সঙ্গে হাঁ হাঁ করে উঠল ছেলেগুলো। উত্তেজিত গলায় কথা বলতে বলতে জবরদস্তি বৃদ্ধকে সরিয়ে নিয়ে গেল। বৃদ্ধ সম্ভবত ভাবতেই পারছিল না সে কী অপরাধ করেছে।

গ্রাম থেকে বেরিয়ে এসে ম্যাথুজ জিজ্ঞাসা করল, এটা কী করে হল?

 বিষ্ণুপ্ৰসাদ বলল, আমিও অবাক। সায়নের বক্তৃতায় যে এমন কাজ হবে তা ভাবতেও পারিনি। রাতারাতি লোকগুলো মানুষ হয়ে গেল?

ম্যাথুজ বলল, তোমার মধ্যে সত্যি ক্ষমতা আছে সায়ন।

সায়ম কিছু না বলে হাঁটছিল। ছেলেগুলোর আচরণে সে খুব খুশি। ভারতবর্ষের নব্বইভাগ মানুষ আত্মসম্মানহীন অবস্থায় বেঁচে থাকে। এই ছেলেগুলোর মতো তারা সবাই যদি আত্মসম্মানবোধটা ফিরে পেত!

.

সন্ধ্যায় এক শরীর ক্লান্তি নিয়ে নিরাময়ে ফিরে এসে সায়ন শুনল, কঙ্কাবতীর অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে।

.

৪২.

কঙ্কাবতীকে ঘিরে তখন তিনজন মহিলা দাঁড়িয়ে। তারা ওকে বোঝাচ্ছিলেন কিছুই হয়নি, ডাক্তার ওষুধ দিয়েছেন, সেরে যাবে। এঁদের মধ্যে কঙ্কাবতীর মা-ও রয়েছে। ওই মহিলাদের সায়ন এর আগে দেখেনি। কথাবার্তায় অবশ্য বোঝা যাচ্ছিল ওঁরা কঙ্কাবতীর মায়ের পরিচিত।

কঙ্কাবতী শুয়েছিল বিছানায়। একেবারে শিশুর মতো ছটফট করছিল পেটে হাত চেপে। হঠাৎ সায়নকে দেখতে পেয়ে সে ককিয়ে উঠল, আমি মরে যাব, আমাকে বাঁচাও। খুব কষ্ট।

সায়ন এগিয়ে যেতেই মহিলারা সরে দাঁড়াল। চাদরের ঢাকা থাকলেও বোঝা যাচ্ছিল কঙ্কাবতীর পেট ফুলে উঠেছে। এই সময় মিসেস অ্যান্টনি ঘরে ঢুকলেন, ওর মা ছাড়া সবাই অনুগ্রহ করে বাইরে চলে যান!

মিসেস অ্যান্টনির হাতে কিছু যন্ত্রপাতি। সায়ন দেখল অনিচ্ছাসহকারে বাকি দুজন মহিলা বেরিয়ে গেলেন। সে কঙ্কাবতীর দিকে তাকিয়ে হাসল, সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি ভয় পেও না।

নীচে নেমে অফিসঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে সে ডাক্তার তামাংকে দেখতে পেল। খুব মনোযোগ দিয়ে তিনি একটা এক্সরে প্লেট দেখছেন। টেবিলের উল্টোদিকে ডাক্তার আঙ্কল বসে আছেন গম্ভীর মুখে, চোখ বন্ধ করে।

সেই অবস্থায় ডাক্তার আঙ্কল বললেন, না ডক্টর তামাং, অপারেশন ছাড়া আর কোনও পথ আমাদের সামনে খোলা নেই।

ডাক্তার তামাং সোজা হয়ে বসলে, কিন্তু মেয়েটার শরীরের যে অবস্থা তাতে অপারেশন করা। —

হ্যাঁ, তাও ঠিক।

তা ছাড়া অপারেশন করবেন কোথায়? নিরাময়ে এত বড় অপারেশনের ঝুঁকি নেওয়া কি উচিত হবে? খারাপ কিছু হয়ে গেলে অ্যান্টি প্রোপাগান্ডা হবে।

আমি অ্যান্টি প্রোপাগান্ডায় ভয় পাইনা, মেয়েটার জীবন নিয়ে ভাবছি। নিরাময় আর লোক্যাল হাসপাতালের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। কলকাতা বা শিলিগুড়িতে নিয়ে গেলে কিছু বাড়তি ফেসিলিটিস পাওয়া যেত।

সায়ন ঘরে ঢুকতেই ওঁরা তাকালেন। সায়ন জিজ্ঞাসা করল, কঙ্কাবতীর অবস্থা কতটা খারাপ? ওর পেটে ব্যথা হচ্ছে কেন?

ডাক্তার তামাং বললেন, এরকম কেসে এমন ঘটনা এর আগেও হয়েছে। ব্লিডিং যখন হয় তখন নাক বা কান দিয়ে যদি রক্ত বেরিয়ে যায় তাহলে ভয়ের কিছু থাকে না। কিন্তু শরীরের ভেতরে যদি রক্তক্ষরণ হয় তাহলে বিপদ বেড়ে যায়। মেয়েটির ক্ষেত্রে ওর নাক কানের সঙ্গে পেটেও ব্লিডিং হয়েছে। এবং সেই রক্ত জমাট বেঁধে বেশ বড় ডেলা হয়ে রেক্টামের মুখ ব্লক করে দিয়েছে। এর ফলে ওর স্টুল বের হতে পারছেনা। ওকে জোলাপ দেওয়া হয়েছে, গ্লিসারিন সাপোজিটারি ব্যবহার করা হয়েছে, আজ ডুস দেওয়া হয়েছে কিন্তু ওই রক্তের শক্ত ডেলাকে সরানো যাচ্ছে না। একটা পাইপের মুখে শক্ত কিছু আটকে গেলে যা হয় ওর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। এই জন্যে ওর পেট ফুলে যাচ্ছে, পেটে বাতাস জমছে এবং সেই কারণে যন্ত্রণা হচ্ছে।

এখন কী করবেন?

ওই ডেলাটাকে সরিয়ে দেওয়া ছাড়া কোনও উপায় নেই। এবং এর জন্যে আমরা বড়জোর চব্বিশ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে পারি। তারপর ওকে আর বাঁচানো যাবে না।

কেন?

পেট আরও ফুলে যাবে, যন্ত্রণা বাড়বে, নতুন করে ব্লিডিং হতে পারে।

এতক্ষণ ডাক্তার আঙ্কল চুপচাপ ছিলেন। বোঝাই যাচ্ছিল সিদ্ধান্ত নিতে তিনি দ্বিধা করছেন এবং তার জন্যে বেশ কষ্ট পাচ্ছেন। এসময় মিসেস অ্যান্টনি দরজায় এসে দাঁড়ালেন, ডক্টর, কোনও কাজ হল না।

ডাক্তার আঙ্কল মাথা নাড়লেন, ডক্টর তামাং, এবার আপনার অভিমত চাই।

ডাক্তার তামাং বললেন, ওর মায়ের সঙ্গে কথা বলা দরকার।

নিশ্চয়ই। ডাক্তার আঙ্কল মিসেস অ্যান্টনিকে বললেন, কঙ্কাবতীর মাকে একটু এখানে আসতে বলুন। জরুরি কথা আছে।

মিসেস অ্যান্টনি বেরিয়ে গেলে সায়ন জিজ্ঞাসা করল, অপারেশনের ব্যাপারে আপনারা এত চিন্তা করছেন কেন?

ডাক্তার তামাং বললেন, ওর রক্তে হেমোগ্লাবিন এত কম যে ঝুঁকি নিতে সাহস হচ্ছে না! ওর শরীর খুব দুর্বল। অপারেশনের ধকল সহ্য করতে পারবে কিনা সে-বিষয়ে সন্দেহ আছে। অথচ অপারেশন না করলে ওকে বাঁচানো যাবে না।

তাহলে তো ঝুঁকি নেওয়াই উচিত।

হ্যাঁ উচিত। ডাক্তার আঙ্কল বললেন।

সায়ন বেরিয়ে এল। ওপর থেকে মিসেস অ্যান্টনির সঙ্গে নেমে আসছে কঙ্কাবতীর মা। সে গেস্টরুমে ঢুকল। যিশুর মূর্তির সামনে মোমবাতি জ্বলছে। কী পবিত্র অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে মনে, ওই মুখ দেখলে। উনি ঈশ্বরের পুত্র ছিলেন কি ছিলেন না তা নিয়ে যারা তর্ক করে তারা করুক কিন্তু মানুষ যদি ওঁর সামনে এসে শান্তি পায় তাহলে মানুষের শেষদিন পর্যন্ত উনি থাকবেন।

.

সন্ধের পর পাহাড়ে স্বাভাবিক মানুষেরা বাধ্য না হলে চলাফেরা করেনা। চারপাশ চুপচাপ, এমনকী রাতজাগা পাখিরাও আজ ডাকছে না। রাত্রে নিরাময়ের অতিথিদের নিজের ঘরে থাকাই নিয়ম। সায়ন খাওয়া-দাওয়ার পর কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়েছিল। আজ রাত্রে কঙ্কাবতী যাতে ঘুমোতে পারে তাই ওকে কড়া ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কয়েকজন নিশ্চয়ই ঘুমোবেন না। ডাক্তার তামাং ফিরে গেছেন অপারেশনের ব্যবস্থা করতে। আগামীকাল কঙ্কাবতীর অপারেশন হবে।

হঠাৎ কষ্ট হতে লাগল সায়নের। এই কষ্ট অন্য রকমের। শরীরে নয় অথচ সমস্ত শরীরে এক অসাড় যন্ত্রণা। কঙ্কাবতীর সঙ্গে তার যে সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল তা পৃথিবীর অন্য কোন মানুষের সঙ্গে হয়নি। অথচ আজ সেই মেয়েটা একেবারে অন্য গলায় কথা বলছে। সেই শান্ত মিষ্টি ছবিটার সঙ্গে কোনও মিল নেই। এই মেয়ে এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে। অপারেশন টেবিলেই যদি ওকে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয় তাহলে আর কোনওদিন কথা বলা হবে না।

অনেক রাতে নীচে মানুষের কথাবার্তা হচ্ছে বুঝতে পারল সায়ন। সে আর পারল না। পুলওভার গলিয়ে নীচে নেমে দেখল ডাক্তার আঙ্কল আর পদমকুমার কথা বলছেন। ডাক্তার আঙ্কল বললেন, আমি যদি নিজে গিয়ে ওদের অনুরোধ করি তাহলে কি কাজ হবে?

পদমকুমার মাথা নাড়ল, না ডাক্তার সাহেব। ওরা এত ভয় পেয়েছে যে কিছুতেই আসতে রাজি হবে না। কাল বললে দেরি হয়ে যাবে তাই আজ এসে বললাম।

সায়ন জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে?

তুমি এখনও জেগে আছ? নো নো সায়ন। তুমি ভুলে যেও না কয়েকটা নিয়ম মেনে না চললে আবার অসুস্থ হয়ে পড়বে। ডাক্তার বিরক্ত হলেন।

আমার ঘুম আসছিল না। পদমকুমার এখন এসেছে কেন?

ব্লাড ডোনারদের লিস্টে যাদের নাম ছিল তারা আগামীকাল আসতে অস্বীকার করেছে। কাল কঙ্কাবতীর অপারেশন, ওর গ্রুপের ব্লাড যাদের শরীরে আছে তাদের খবর পাঠিয়েছিলাম। পদম বলছে ওরা কেউ আসবে না।

কেন?

ওদের শাসানো হয়েছে রক্ত দিতে এলে কেউ বাড়ি ফিরে যাবে না।

কারা শাসিয়েছে?

শহরের কয়েকজন গুণ্ডা।

গুণ্ডারা কেন এভাবে শাসাতে যাবে?

মাথা নিচু করল পদমকুমার। ডাক্তার আঙ্কলকে খুব নার্ভাস দেখাচ্ছিল। তিনি বললেন, এখনই ডক্টর তামাংকে জানাতে হবে। রক্ত না পেলে কাল অপারেশন করা যাবে না। ওকে তাহলে আজই শিলিগুড়িতে নামিয়ে নিয়ে যেতে হয়।

সায়ন বলল, এর আগে কখনও এমন ঘটনা ঘটেনি।

ডাক্তার আঙ্কল বললেন, বুঝতেই পারছি এটা কয়েকজন গুণ্ডার কাজ নয়। এর পেছনে অন্য কোনও শক্তি সক্রিয়। আমাকে চেয়ারম্যান কথা দিয়েছিলেন যে কখনওই নিরাময়কে বিপদে ফেলা হবে না।

সায়ন জিজ্ঞাসা করল, কাল কখন অপারেশন করবেন?

ভেবেছিলাম সকাল দশটায়, কিন্তু এখন তো ভেবে কোনও লাভ নেই। ডাক্তার আঙ্কল বললেন, কাল বিকেলের মধ্যে অপারেশন না করতে পারলে চোখের সামনে মেয়েটাকে মরে যেতে দেখতে হবে। নো, আই কান্ট ডু দ্যাট। আমি ওকে এখনই শিলিগুড়ি নিয়ে যাব।

ডাক্তার আঙ্কল ছোটবাহাদুরকে ডেকে কিছু বলে ভেতরে চলে গেলেন। সম্ভবত, বাইরে বেরুবার জন্যে তৈরি হতে। পদমকুমার অপরাধীর মতো দাঁড়িয়েছিল একপাশে। এই ছেলেটি ইতিমধ্যে রক্ত দিয়েছে নিরাময়ের অতিথিদের বাঁচাতে। ওর কোনও স্বার্থ নেই, কোনও দায় নেই, কিন্তু ওকে দেখে মনে হচ্ছে অপরাধটা যেন ও নিজেই করেছে।

সায়ন নীচে নেমে এগিয়ে গেল পদমকুমারের কাছে, তোমার তো কোনও দোষ নেই, তুমি মন খারাপ কোরো না।

খুব খারাপ, খুব খারাপ। বিড়বিড় করল পদমকুমার। তারপর হঠাৎ মুখ তুলে উজ্জ্বল চোখে সায়নকে দেখল। সায়ন অবাক হল, কী দেখছ?

তুমি পারো। তুমি কেন চুপ করে আছ?

ও এমন ঘটনা কয়েকজন কখনওই নির

আমি পারি? সায়ন জিজ্ঞাসা করল।

বাঃ, সবাই বলে তোমার মধ্যে যিশু মাঝে মাঝে দেখা দেন। মা মেরি তোমাকে আশীর্বাদ করেন। তোমাকে দেখে পুলিশ ভয় পেয়ে সূরজকে ছেড়ে দিয়েছে। এরকম ঘটনা এর আগে কখনও হয়নি।

কিন্তু বিশ্বাস করো পদমকুমার, আমার কোনও ক্ষমতা নেই।

তুমি বলছ কিন্তু লোকে অন্য কথা বলে। মাথা নাড়ল পদমকুমার।

হঠাৎ একটা কাঁপুনি শরীরে ছড়িয়ে পড়ল। সায়ন চোখ বন্ধ করল। নিজের সঙ্গে অনেকবার কথা বলেছে সে, এদের ভুল ভাঙাবার জন্যে প্রচুর চেষ্টা করেছে। কিন্তু কেউ বুঝতে চায়নি সে আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতোই একজন। সে মেনে নেয় না। সাধারণ মানুষকে একটুও উৎসাহিত করে না বলে এরা তাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করে না কিন্তু তার কথা মন দিয়ে শোনে। আজ গ্রামে গিয়ে সে অত সহজে কাজটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারল এই কারণেই।

আমি অনুরোধ করলে ওরা রক্ত দিতে আসবে? সায়ন জিজ্ঞেস করল।

নিশ্চয়ই আসবে। ওরা না এলে অন্য লোকজন আসবে।

 ঠিক আছে, চলো, আমি রাজি আছি। পদমকুমার, আমি সাধারণ মানুষ, কোনও অলৌকিক ক্ষমতা আমার নেই, কিন্তু আমার কথায় যদি একটি মেয়ের জীবন রক্ষা পায় তাহলে আমি সেটা করতে রাজি আছি।

পদমকুমার বলল, কিন্তু এত রাত্রে তুমি কোথায় যাবে?

তোমাদের গ্রামে!

যারা ওই গ্রুপের রক্ত দেবে তারা তো সবাই এক গ্রামে থাকে না! তোমাকে অনেকগুলো গ্রামে যেতে হবে। এত রাত্রে তুমি কি সেটা পারবে?

আমাকে পারতে হবে। কিন্তু যারা ঘুমিয়ে পড়েছে তাদের—

 আমি বলি কি, সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করো।

এই সময় ডাক্তার আঙ্কল তৈরি হয়ে বেরিয়ে এলেন, তুমি এখনও এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন? যাও শুয়ে পড়ো। আচ্ছা, পদমকুমার, তোমার কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। এতদিন ধরে অনেক উপকার করেছ তুমি।

আমি কিন্তু ভয় পাইনি। আপনি আমাকে ছয় মাসের মধ্যে রক্ত দিতে নিষেধ করেছেন, কিন্তু দরকার হলে আমি দিতে পারি।

পদমকুমারের কাঁধে হাত রাখলেন ডাক্তার, বাঃ, খুব ভাল। আমি এখন ওকে নিয়ে শিলিগুড়ি চলে যাচ্ছি। ওখানে ব্লাড ব্যাঙ্ক আছে, আশা করি কোনও সমস্যা হবে না।

এই সময় সায়ন বলল, কিন্তু এখানেই যদি রক্তের ব্যবস্থা হয়ে যায় তাহলে এত রাতে ওকে নিয়ে যাওয়ার দরকার কী!

রক্তের ব্যবস্থা কী করে হবে?

আপনি আমাকে এক সময় বলেছিলেন কোনও ভাল কাজের জন্য মিথ্যের ভান করলে অন্যায় হয় না। আজ আমি সেটা করতে চাই।

সায়ন কথাগুলো বলা মাত্র পদমকুমার বলল, কিন্তু আমি বলছি সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে। গ্রামে অনেক মানুষ এখন ঘুমিয়ে পড়েছে।

ডাক্তার আঙ্কল বললেন, আমি তোমাদের কথা বুঝতে পারছি না।

পদমকুমার বলল, সায়ন যদি অনুরোধ করে তাহলে মানুষ রক্ত দিতে আসবেই।

 ডাক্তার আঙ্কল মাথা নাড়লেন, আমি জানি না। যদি না আসে!

পদমকুমার বলল, আপনি সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।

ডাক্তার আঙ্কল সায়নের দিকে তাকালেন। তারপর ভেতরে চলে গেলেন।

পদমকুমার বলল, আমি যাই। এখনই যাদের দেখা পাব বলব কাল সকালে এখানে আসতে। তোমার নাম করে বলব।

এখানে আসতে বলবে কেন?

বাঃ! রক্ত তো এখানেই দিতে হবে। পদমকুমার চলে গেল।

.

ঘুম আসছিল না। খাটে কম্বলের নীচে শুয়ে ছটফট করছিল সায়ন। কঙ্কাবতী মরে যাবে? অসম্ভব। ওকে বাঁচাতে যা করার তা করতে হবে। কিন্তু যদি পদমকুমারের কথায় কেউ রাজি না হয়, নিরাময়ের সামনেটা কাল সারা সকাল যদি এমনি সুনসান থাকে তাহলে? ডাক্তার আঙ্কলের তাড়াহুড়োর সময়টা নষ্ট করা হবে আর কে বলতে পারে এর জন্যে কঙ্কাবতীর চলে যাওয়ার সম্ভাবনা আরও বেড়ে যাবে না!

.

এতদিন সে বিরক্ত হত, মজাও পেত। কেউ তার মধ্যে যিশুর ছায়া দেখছে, মাদার মেরিকে আশীর্বাদ করতে দেখেছে। এগুলোকে সে উড়িয়ে দিয়েছে অবহেলায়। মিস্টার ব্রাউন ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন। যিশু ছাড়া তিনি কিছু ভাবতে পারতেন না। ওই মূর্তির মুখের সঙ্গে তার সামান্য মিল খুঁজে পেয়ে তিনি আবেগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। কিন্তু নিজের কাছে খটকা লাগে দুটো জায়গায়। একটা ট্রেনে ঘটেছিল। ওই চোরাকারবারিদলের নেতা হঠাৎ কী দেখেছিল তার মধ্যে? দ্বিতীয়টা এখানকার থানায়। পুলিশ আচমকা ওরকম আচরণ করল কেন? তাহলে তার অজান্তে এমন কিছু ব্যাপার ঘটে যা সে নিজে জানতে পারে না, কেউ কেউ দেখে। ট্রেনের অন্য যাত্রীরা দেখতে পায়নি, থানায় উপস্থিত জনতা জানতে পারেনি। শুধু যে জানলে পরিস্থিতি পাল্টে যাবে সে-ই জেনে যায়। আজ বিছানায় শুয়ে মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল সায়নের। ডাক্তার আঙ্কল বলেছেন বেশি টেনশন না করতে। কিন্তু এখন সে নিশ্চিন্তে ঘুমোবে কী করে? হঠাৎ মনে পড়ল ম্যাডামের কথা। ওঁর সঙ্গে কথা বলতে পারলে ভাল হত। ম্যাডামের সঙ্গে তো অনেকে আছে। ওদের কারও কারও রক্তের গ্রুপ তো কঙ্কাবতীর সঙ্গে মিলে যেতে পারে! পদমকুমারের কথামতো ঝুঁকি না নিয়ে ওঁর কাছে যাওয়া উচিত ছিল!

সায়ন বিছানা ছেড়ে নামল। পুলওভার, মাফলার, মাঙ্কিক্যাপ এবং প্যান্ট জুতো পরে দরজা খুলল নিঃশব্দে। নিরাময় এখন নিঃশব্দ। আলো জ্বলছে কিন্তু কোনও মানুষের অস্তিত্ব বোঝা যাচ্ছে না। এখন রাত দুটো।

দরজা ঈষৎ ফাঁক, বারান্দায় নজর, সায়ন চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল। সে এখন নিরাময়ের আইন ভাঙতে যাচ্ছে। অশ্বত্থামা নামক এক হাতির কথা ভেবে যুধিষ্ঠির যদি মিথ্যাচারণ করতে পারেন তাহলে! পায়ের শব্দ হল। বারান্দায় কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। তারপরই চাপা কান্নার আওয়াজ কানে এল। সায়ন বুঝতে পারল ইনি কঙ্কাবতীর মা। খানিকটা কেঁদে মহিলা আবার মেয়ের ঘরের দিকে চলে গেলেন। সায়ন দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল। সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে দেখল প্যাসেজের আলো নেবানো। অর্থাৎ বড় এবং ছোট বাহাদুর এখন ঘুমোচ্ছ দরজা বন্ধ করে। অফিসঘরে আলো জ্বলছে। তার মানে ডাক্তার আঙ্কল জেগে আছেন। হঠাৎ আর একটা অনুভূতি প্রবল হল।

কে কঙ্কাবতী? প্রায় নিঃস্ব একটি পাহাড়ি মেয়ে যে রক্তের অসুখে ভুগছে। চিকিৎসা করানোর ক্ষমতা নেই। এখানে এসেছিল পার্টির সুপারিশ নিয়ে। কিন্তু এখন কী ঘটছে? পার্টি কোথায়? তারাই গুণ্ডাদের দিয়ে মেয়েটির মৃত্যুকে ডেকে আনতে সাহায্য করছে। যার কাছে কোনও স্বার্থ নেই, কোনও পাওয়ার আশা নেই তার জন্যে একজন মানুষ রাত জাগছেন, তাকে বাঁচাতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। শুধু পকেট ভরানোর জন্যে, বড়লোক হওয়ার জন্যে যেসব ডাক্তারের কাহিনী শোনা যায় সেগুলো এক নিমেষে ম্লান হয়ে যায় এরকম কিছু মানুষের জন্যে। সায়নের মনে হল, লোকে তার ভেতর যিশুকে দেখে, আসলে ওদের সেটা দেখা উচিত ছিল ডাক্তার আঙ্কলের মধ্যে। যিনি যিশু নন, কিন্তু কখনও কখনও তাঁকেও অতিক্রম করেন।

সায়ন ধীরে ধীরে প্যাসেজে এসে দাঁড়াল। ডাক্তার আঙ্কল তাকে দেখলে নিশ্চয়ই রেগে যাবেন। ওঁকে না জানিয়ে যেতে হবে। অফিসঘরের দরজা এড়িয়ে কয়েক পা যেতেই গেস্টরুম নজরে এল।

হঠাৎ মনে পড়তেই সে ভেতরে ঢুকল। ঘর অন্ধকার। যিশুর মূর্তির সামনে জ্বালানো মোমবাতিগুলো এখন ছোট হয়ে নিবে যেতে বসেছে। অনেক নীচ থেকে তাদের নিবন্ত আলোর প্রান্ত যিশুর চিবুকে ঠেকেছে। চোখমুখে অন্ধকারের ছায়া। অদ্ভুত দেখাচ্ছে যিশুকে। যেন একটা চাপা ক্রোধ ঠিকরে উঠেছে চোয়ালে। সায়ন চোখ বন্ধ করল। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে প্যাসেজ পেরিয়ে নিঃশব্দে দরজা খুলল।

খোলা আকাশের তলায় এসে ঠাণ্ডা কতখানি তীব্র টের পেল সায়ন। দুপকেটে হাত ঢুকিয়ে সে হাঁটছিল। মিস্টার ব্রাউনের বাড়ির সামনে দিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে সে পরিষ্কার আকাশ দেখতে পেল। মর্তলোকের সব তারা আজ এই মাঝরাতে আকাশে নিজেদের মধ্যে আড্ডা জমিয়েছে।

এখন মানুষেরা যে যার বিছানায়। আলো জ্বলছে না কোথাও। অন্ধকার বেশ পাতলা কারণ তারারা তাতে আলো মিশিয়েছে। হঠাৎ একটা কুকুর চিৎকার করে উঠল। যে বাড়ির ভেতর থেকে কুকুরটা ডাকছে তার সামনে পৌঁছে সায়ন চাপা গলায় বলল, ঠিক আছে, চুপ কর।

সঙ্গে সঙ্গে একটা গলা ভেসে এল, কে? কে ওখানে?

 সায়ন দাঁড়াল, আমি। কোনও ভয় নেই।

এবার আলো জ্বলল। দরজা খুলছে দেখে দাঁড়াতে হল সায়নকে। কুকুরটা সমানে চিৎকার করে চলেছে। বারান্দায় বেরিয়ে এসে লোকটা চেঁচাল, কে তুমি?

আমি সায়ন, নিরাময়ে থাকি।

সায়ন! আরে! আপনি? এত রাতে আপনি কোথায় যাচ্ছেন?

ওপরে। আমাদের একজনের অপারেশন হবে। ওকে বাঁচাতে গেলে রক্ত দরকার।

রক্ত? লোকটা হতভম্ব।

চলি। সায়ন হাঁটতে লাগল।

লোকটা চিৎকার করল, দাঁড়ান দাঁড়ান। আমার রক্ত কাজে লাগবে?

আমি জানি না। ডাক্তারবাবু ঠিক করবেন।

হঠাৎ লোকটা আরও জোরে চেঁচাতে লাগল, আরে ভাই, তোমরা সবাই ঘুম থেকে ওঠো। একজনের অপারেশন হবে, রক্ত দরকার।

লোকটা সরল, না পাগল?

এত ঠাণ্ডা বলেই হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল না। জোরে হাঁটায় ঠাণ্ডা কম লাগছিল। বাড়িটার সামনে পৌঁছে বেল টিপল সায়ন। তৃতীয়বারে আলো জ্বলল। কাচের জানলার পাশে এসে সিমি জিজ্ঞাসা করল, কে?

আমি সায়ন।

 সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে গেল। খুব অবাক হয়ে সিমি জিজ্ঞাসা করল, এ কী? তুমি? এত রাতে এখানে? কী হয়েছে?

ম্যাডামকে ঘুম থেকে তোলা যাবে?

ম্যাডাম তো বাড়িতে নেই। সিমি দরজা বন্ধ করল।

সে কী, খুব মন খারাপ হয়ে গেল সায়নের।

হ্যাঁ। বিদেশ থেকে প্রচুর সাহায্য এসেছে। সেগুলো ছাড়াতে বাগডোগরা এয়ারপোর্ট গিয়েছেন আজ বিকেলে, কাল সকালে ফিরবেন। সিমি বলল, তুমি এই ঘরে এসে বোসো। ইস, ঠাণ্ডায় তোমার হাত একেবারে বরফ হয়ে গেছে।

সায়নের হাত ধরেছিল সিমি। সেইভাবেই পাশের ঘরে নিয়ে গিয়ে খাটের উপর বসাল। এটা বোধহয় ওর ঘর।

সায়ন জিজ্ঞাসা করল, আর সবাই কোথায়?

কেউ নেই। ম্যাথুজ আর প্রসাদ ম্যাডামের কথা শুনে সন্ধের পর রওনা হয়ে গিয়েছে। ম্যাডামের একার পক্ষে অত মালপত্র নিয়ে আসা সম্ভব হবে না। তুমি তো সারাদিন ওদের সঙ্গে ছিলে, তাই না?

হ্যাঁ। আমি উঠি সিমি।

কেন?

আমার হাতে সময় কম।

 কী হয়েছে এখনও বলনি!

 কঙ্কাবতীর কাল অপারেশন হবে। রক্তের দরকার। যারা এতদিন রক্ত দিতে আসত তাদের গুণ্ডারা ভয় দেখিয়েছে বলে আসছে না। আমি ভেবেছিলাম ম্যাডামের সাহায্য নেব। রক্ত না পেলে ওকে বাঁচানো যাবে না।

তুমি কঙ্কাবতীকে খুব ভালবাস, না?

ও ভাল মেয়ে ভালবাসব না কেন?

আমি ভাল নই বলে–!

কী আশ্চর্য! তুমি ভাল নও কে বলল?

 তাহলে কেন আমাকে তুমি ভালবাসার কথা বলনি!

সায়ন হাসল, আমি কঙ্কাবতীকেও ভালবাসার কথা বলিনি।

সত্যি?

আমি উঠি।

আমি তো রক্ত দিতে পারি, পারি না?

 তুমি রক্ত দেবে? উঠে দাঁড়াল সায়ন।

হ্যাঁ। ম্যাডাম ফিরে এলেই আমি যেতে পারি।

 ঠিক আছে। এসো। সায়ন বেরিয়ে এল বাইরে। দরজা বন্ধ করল সিমি। হাঁটতে হাঁটতে চার্চের সামনে এসে দাঁড়াল সায়ন। চার্চ এখন অন্ধকার।

ভোরের কিছু আগে কি পৃথিবীর চেহারাটা কিছুক্ষণের জন্যে ঘোলাটে হয়ে যায়? অন্তত, এখানে এই পাহাড়ে তেমনই দেখাচ্ছিল। অনেক নীচের খাদ থেকে কুয়াশারা সাপের মতো গুঁড়ি মেরে ওপরে উঠে আসছিল। ঝট করে মনে হচ্ছিল মাটি তার অতৃপ্তি একটু একটু করে উগড়ে দিচ্ছিল এখন। চার্চের সামনে দাঁড়িয়েছিল সায়ন। তার এখন কিছু করার নেই। পদমকুমার যে আশ্বাস দিয়েছে তা যদি সত্যি হয় তাহলেই কঙ্কাবতীর জন্যে রক্ত জোগাড় করা সম্ভব হবে। সে নিরাময়ের জন্যে পা বাড়াতে যাচ্ছিল হঠাৎ চার্চের পাশের বাড়িতে আলো জ্বলে উঠল এবং শব্দ করে দরজা খুলে গেল।

যে মানুষটি বের হলেন তাকে দূর থেকেই চিনতে পারল সায়ন, ফাদার। ফাদার যোশেফ।

টর্চের আলোয় পথ দেখতে দেখতে ফাদার এগিয়ে আসছিলেন। সায়নের ওপর আলো পড়তেই তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কে ওখানে?

আমি সায়ন।

সায়ন! কী ব্যাপার? তুমি এই সময়ে?

ম্যাডামের কাছে গিয়েছিলাম। ওঁরা কেউ নেই। কঙ্কাবতীকে বাঁচাতে রক্ত দরকার। যারা ভালবেসে দিত তাদের গুণ্ডারা ভয় দেখিয়েছে বলে আসতে চাইছে না।

সে কী? কঙ্কাবতীর কী হয়েছে?

 ওর শরীরের অবস্থা খুব খারাপ। কাল অপারেশন না করলে বাঁচবে না।

আমি রক্ত দিতে পারি।

 অনেক ধন্যবাদ ফাদার। কিন্তু আপনার গ্রুপের সঙ্গে ওর গ্রুপ যদি না মেলে তাহলে কাজ হবে। আপনি কোথায় যাচ্ছেন?

আমি পাশের গ্রামে যাচ্ছি। ওখানে এক বৃদ্ধের অন্তিম সময় এসে গেছে। কাল সন্ধেবেলায় আমি কথা দিয়ে এসেছি যে ভোরের আগেই তার পাশে উপস্থিত হব।

আমি আপনার সঙ্গে যেতে পারি?

 নিশ্চয়ই। কিন্তু ওখানে পৌঁছোতে আধঘটা লাগবে।

লাগুক। ওখানকার মানুষের কাছে আমি কঙ্কাবতীর জন্যে আবেদন করব।

ওরা হাঁটছিল, কুয়াশা এখন ওদের চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেছে। টর্চের আলো এখন কোনও কাজে আসছে না। ফাদার কোনও কথা বলছেন না। ওরা অনেকটা চড়াই উতড়াই ভাঙার পর গ্রামে ঢুকল।

এইসময় গ্রামের মানুষের ঘুমোনোর কথা। কিন্তু সায়ন অবাক হয়ে দেখল আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে মানুষগুলো একটা বাড়ির সামনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ফাদারকে দেখে কয়েকজন এগিয়ে এল। ফাদার জিজ্ঞাসা করলেন, কী খবর?

এখন আর কথা বলছেন না। বোধহয় আপনি পাশে গেলেই–

ফাদারের সঙ্গে ঘরের দরজায় পৌঁছে গেল সায়ন। ঘরের ভেতর কিছু আধাঘুমন্ত মানুষ মাথা নিচু করে বসেছিল। একটা চারপায়ার ওপর কম্বল চাপা দিয়ে যাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে তিনি জীবিত কি মৃত তা বোঝা যাচ্ছিল না। ফাদারকে দেখে সবাই গুনগুন করে উঠল। ফাদার চারপায়ের পাশে যেতেই একজন একটা বসার জায়গা এগিয়ে দিল। ফাদার সেখানে বসে লোকটির কপালে হাত রাখলেন, তারপর কবজি তুলে নাড়ি দেখলেন।

সায়ন চুপচাপ দেখছিল। দরজার ওপাশে তখন মানুষের ভিড়। ফাদার বাইবেল বের করে নিচুস্বরে পড়তে লাগলেন। সায়ন অনুমান করল মানুষের শেষ সময়ে এটা শেষ প্রার্থনা। মুহূর্তেই একটা অন্যরকম আবহাওয়া তৈরি হয়ে গেল ঘরের মধ্যে। খানিক বাদে মানুষটির বুক ওঠানামা করতে লাগল। এবং সেই অবস্থায় একটি শীর্ণমুখ ব্যাকুল চোখে চারপাশে তাকাতে লাগল। হঠাৎই সেই চোখ সায়নের ওপর পড়তেই মানুষটি স্থির হয়ে গেলেন। কয়েক সেকেন্ড যাওয়ার পর ফাদার পড়া থামিয়ে নাড়ি পরীক্ষা করলেন। তারপর মাথা নেড়ে কপাল এবং দুই বুকে আঙুল ছুঁইয়ে মৃতের চোখের পাতা টেনে বন্ধ করে দিলেন।

কিছু মানুষ ডুকরে কেঁদে উঠলেন। মেয়েদের গলাই বেশি। সায়ন বাইরে বেরিয়ে আসতেই ঘরের একজন মানুষ এগিয়ে এসে তার সামনে হাতজোড় করে দাঁড়াল, নমস্কার! আপনাকে শেষসময়ে দেখে উনি চলে গেলেন। আপনি এসেছেন বলে আমরা কৃতজ্ঞ।

সায়ন অনেক কিছু বলতে পারত, বলল না। এই সময় এক বৃদ্ধা কাঁদতে কাঁদতে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দুহাত বাড়িয়ে বললেন, তুমি আমাকে ওঁর কাছে পাঠিয়ে দাও। তুমি আমাকে ছুঁয়ে যিশুকে বলো যিশু তোমার কথা শুনবেন।

এই সময় ফাদার বেরিয়ে এলেন, তোমরা ওকে বিরক্ত কোরো না। ও খুব সমস্যায় আছে।

 প্রথম লোকটি জিজ্ঞাসা করল, কী সমস্যা ফাদার?

 নিরাময়ে একটি নেপালি মেয়ে খুব অসুস্থ। কাল তার অপারেশন হবে কিন্তু রক্ত পাওয়া যাচ্ছে না। সায়ন তোমাদের কাছে এসেছে রক্ত দেওয়ার অনুরোধ জানাতে। না হলে মেয়েটাকে আর বাঁচানো যাবে না, ফাদার বললেন।

সঙ্গে সঙ্গে একটা সম্মিলিত আওয়াজ উঠল। সবাই রক্ত দিতে চায়। সেই বৃদ্ধা হকচকিয়ে গিয়েছিলেন। এবার কাঁপা গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, আমি কি রক্ত দিতে পারি। যে চলে গিয়েছে তার জন্যে তো সারা জীবন কাঁদব কিন্তু আর একজন যদি আমার রক্ত পেয়ে বেঁচে যায়।

তাঁকে কথা শেষ করতে দিল না সায়ন। দুহাতে জড়িয়ে ধরে সায়ন বলল, মা, আপনি যে বলেছেন তাতেই আমরা খুশি। আপনার এই বয়সে রক্ত দেওয়া উচিত নয়। আপনি এখানেই থাকুন।

সায়ন যখন বৃদ্ধাকে জড়িয়ে ধরেছে তখন জনতা চেঁচিয়ে উঠল উল্লাসে, যেন তারা এক স্বর্গীয় দৃশ্য দেখল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই জনা কুড়ি মানুষ রওনা হল পাহাড়ের পথে। ফাদার থেকে গেলেন মৃতের কাছে। কয়েকজন চলে গেল অন্য গ্রামগুলোতে খবর দিতে। ওরা যখন মিস্টার ব্রাউনের বাড়ির সামনে পৌঁছোল তখন আকাশ লাল। ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। আকাশের গায়ে পাহাড়ের রেখাগুলো চমৎকার আঁকা হয়ে গেছে। অন্ধকার ক্রমশ সরে যাচ্ছে গাছের মাথায়। বাঁক ঘুরতেই সায়ন অবাক হয়ে গেল। নিরাময়ের সামনে প্রচুর মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। সেই লোকটি যাকে ম্যাডামের বাড়িতে যাওয়ার সময় সায়ন বলেছিল সমস্যার কথা, যাকে পাগল বা সরল বলে মনে হয়েছিল সে দৌড়ে এল সামনে, আমরা এসে গেছি। যত রক্ত চাও নাও, মেয়েটাকে বাঁচাও।

ভিড়ের মধ্যে যে পথ তৈরি হয়েছিল সেই পথ ধরে নিরাময়ের গেটে পৌঁছোতেই ডাক্তার আঙ্কলকে দেখতে পেল সায়ন। তাকে দেখেই বুকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি। ফিস ফিস করে বললেন, আমি তোমার জন্যে গর্বিত। ডাক্তার তামাংকে খবর দেওয়া হয়েছে। তিনি এসে গেলেই আমরা ব্লাড গ্রুপ ঠিক করে নিয়ে রক্ত নেব। তুমি ওদের বলো আর একটু সময় ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে।

সায়ন আবেদন জানাল। একটু উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে সে জনতাকে ধন্যবাদ জানাল এই ভোরে রক্ত দিতে আসার জন্যে। যাকে বাঁচাবার জন্যে এত চেষ্টা সেই পাহাড়ি মেয়েটির কথাও বলল সে। মেয়েটি পাহাড়ের জেনে জনতার উল্লাস আরও বাড়ল। জনতা জানল, সবাইকে রক্ত দিতে হবে না। যাদের রক্তের সঙ্গে মেয়েটির রক্ত মিলবে তাদের কয়েকজনকেই শুধু ডাকা হবে।

এর মধ্যে একজন মহিলা এগিয়ে এলেন, আমার বুকে সবসময় ব্যথা করে বাবা। হাসপাতালের ওষুধ খেয়েও ঠিক হয়নি। এখানকার ডাক্তার তো আমার চিকিৎসা করে না। তুমি আমার বুকে হাত বুলিয়ে দাও, আমি ঠিক ভাল হয়ে যাব।

সেটা কি সম্ভব? আপনি ডাক্তার তামাংকে দেখান।

না, কোনও ডাক্তার আমাকে ভাল করতে পারবে না। তুমি আমার বুকে হাত বুলিয়ে দিলেই আমি সেরে যাব।

এতে আপনি কিছুতেই সারতে পারেন না।

না। আমি স্বপ্ন দেখেছি। আমি খ্রিষ্টান নই। কিন্তু একজন সাধু স্বপ্নে আমাকে তোমার কাছে আসতে বলেছেন। আমার বুকে হাত রাখলে তোমার তো কোনও ক্ষতি হবে না বাবা। মহিলা কাতর গলায় বললেন।

সায়ন দেখল জনতা চুপ করে তাকে লক্ষ করছে। তার ইচ্ছে করছিল মহিলাকে তিরস্কার করতে, ওঁর ভুল ভাঙিয়ে দিতে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মনে হল, সেটা করলে এই জনতার মধ্যে প্রতিক্রিয়া হবে। হয়ত ওরা এখান থেকে চলে যেতে পারে। পদমকুমার পাশে এসে দাঁড়াল, ও যা বলছে তাই করো।

সায়ন হাত তুলল। মাথার ওপর দিয়ে মহিলার বুকে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, আমাকে ক্ষমা করো মা।

হাত সরিয়ে নিতেই মহিলা চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ। সঙ্গে সঙ্গে আরও অনেক মানুষ প্রায় একসঙ্গে ছুটে এল তাদের সমস্যা নিয়ে। সবাই সায়নের কাছে সাহায্য চায়। পদমকুমাররা কোনও মতে সায়নকে নিরাময়ের মধ্যে নিয়ে যাওয়া মাত্র ডাক্তার তামাং-এর গাড়ি পৌঁছে গেল।

.

আটজনকে নির্বাচন করে তাদের রক্ত নেওয়ার পর কঙ্কাবতীর অপারেশনের তোড়জোড় শুরু হল। তার আগে ডাক্তার আঙ্কেল সায়নকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তুমি আজ সারাদিন বিছানা থেকে উঠবে না। এখনই ঘরে চলে যাও। বাইরে তখনও মানুষের ভিড়, সায়ন নির্দেশ অমান্য করতে সাহস পায়নি। কিন্তু খাটে শুয়েও তার ঘুম আসছিল না।

আজ এ কী করল সে? মহিলাকে স্তোক দিল? তাহলে কেউ তাকে প্রশ্ন করল না কেন, এতই যখন ক্ষমতা তখন কঙ্কাবতীকে সে সারিয়ে দিচ্ছে না কেন? কেন তাকে রক্তের জন্যে আবেদন করতে হচ্ছে।

একটু বাদেই অপারেশন হবে। কিন্তু কঙ্কাবতীকে দেখতে যাওয়ার সাহস হচ্ছিল না তার। চোখ বন্ধ করে সে প্রার্থনা করতে লাগল, মেয়েটা যেন বেঁচে যায়। এই প্রার্থনা কোনও দেবদেবী বা তাঁদের অবতারের কাছে নয়, সে যেন নিজের কাছেই প্রার্থনা করছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *