৩৫-৩৬. সদানন্দ এগিয়ে গেল

সদানন্দ এগিয়ে গেল, বড়মা! বড়মা।

কোনও প্রতিক্রিয়া নেই। নাকের তলায় আঙুল দিয়ে মাথা নাড়ল, যাঃ, রায়বাড়ির ওল্ডেস্ট লেডি মরে গেল। সবাইকে খবর দিতে হয়।

সায়ন জিজ্ঞাসা করল, আতরবালা কোথায় গেল?

ঠিক। এখানে ছিল দেখে গিয়েছিস তুই?

হ্যাঁ।

চল তো, ওই ঘরগুলো দেখি।

ভেতরের কোনও ঘরেই সে নেই। সদানন্দ চাপা গলায় বলল, বুড়ি মরে গেছে দেখেও চিৎকার না করে আতর গেল কোথায়?

এই সময় বাইরের ঘরে শব্দ হল। গন্ধরাজের গলা ভেসে এল, দরজাটা বন্ধ করে দাও। কেউ ডাকলে বলবে বুড়ি ঘুমোচ্ছে, দেখা হবে না।

আতরবালার গলা শোনা গেল, আমার খুব ভয় করছে।

আমার ওপর ভরসা রাখো। পাবলিক জানলে তুমি বা আমি এক পয়সাও পাব না। এ বাড়ির অন্য শরিকরা দরজায় তালা ঝুলিয়ে দেবে। বুঝতে পারছ? এখন হচ্ছে মাল গোটানোর সময়। কিন্তু তার আগে দেখে নিতে হবে বুড়ি ঠিকঠাক পটল তুলেছে কিনা।

সায়ন দেখল সদানন্দ তাকে ঠোঁটে আঙুল চেপে চুপ করে থাকতে বলে দরজার পাশে ভারী পর্দার আড়ালে চলে গেল। সুতরাং তাকেও সঙ্গী হতে হল। সায়ন বিশ্বাস করতে পারছিল না। এ বাড়ির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ মারা গিয়েছেন অথচ এরা কাউকে খবরটা জানাচ্ছে না?

হ্যাঁ। আউট। ক্যাশ কী আছে? কোথায় আছে?

 আতরবালা গন্ধরাজকে নিয়ে পাশের ঘরে ঢুকল। সদানন্দ বলল, খুব নিচু স্বরে প্রায় না শুনতে পাওয়ার মতো করে, এই তো জীবন কালীদা!

কালীদা কাকে বলছ? সায়ন ওই গলায় জিজ্ঞাসা করল।

 ও তুই বুঝবি না।

গন্ধরাজের গলা পাওয়া গেল, কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছে, দ্যাখো আতরবালা, এখন প্রতিটি মুহূর্ত খুব ইম্পর্টেন্ট। বুড়ি মরে গেছে এটা ডিক্লেয়ার করার আগে যতটা সম্ভব হাতিয়ে নিতে হবে।

কিন্তু তোমাকে আমার বিশ্বাস হয় না!

ওঃ, এখন ওসব ভাবলে চলবে না। বিশ্বাস-টিশ্বাস করার কী দরকার? মালগুলো সামনাসামনি দুভাগ করে নাও। গন্ধরাজ দাঁড়াল, বিশ্বাস করো না বললে, তা বুড়ি চোখ বন্ধ করামাত্র আমার কাছে ছুটে গেলে কেন?

সায়ন ওদের দেখতে পাচ্ছিল না। আতরবালার গলা শুনতে পেল। কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না।

ঠিক করেছ। এখন বলো বুড়ির মাল কোথায় আছে?

ওরা যদি জানতে পারে?

 কেউ জানতে পারবে না। এই যে তোমার যৌবনের সময়ে আমার সঙ্গে কত আনন্দ করেছ তা কি কেউ জেনেছে? এই বুড়ির কানেও কথাটা যায়নি!

তারপর যেই একটু পুরনো হলাম অমনি ছুঁড়ে ফেলে দিলে।

উঃ, ওসব কথা এখন কেন? ওটা জীবনের ধর্ম।

এ বাড়ির যত কাজের মেয়ে এসেছে তাদের কাউকে ছেড়েছ তুমি?

সেটা তারা বলতে পারবে। কিন্তু আমার ঘরের বাইরে গিয়ে তারা কেউ মুখ খোলেনি। খুললে অন্য শরিকরা আমাকে ছিঁড়ে ফেলত। চলো–!

এরপরে আমি কোথায় যাব?

আশ্চর্য! তুমি যখন এ বাড়ির কাজে এসেছিলে তখন আমায় বলেছিলে টাকাপয়সা গয়নাগাঁটি নিয়ে দেশে চলে যাবে।

কার কাছে যাব? সেখানে কেউ নেই।

দ্যাখো, এ তোমার সমস্যা!

ব্যাটাছেলের চরিত্র এই। স্বার্থপর। নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছু বোঝে না। মেয়েমানুষ ধরবে, কদিন ভোগ করবে তারপর ছুড়ে ফেলে দেবে।

দ্যাখো আতরবালা, তুমি আমার মেজাজ গরম করে দিও না। বেশ জোরে বলল গন্ধরাজ, আমি একা ভোগ করেছি, না? তুমি করোনি? তুমি আনন্দ পাওনি? সাততাড়াতাড়ি নিজের শরীর চেলাকাঠ করে ফেলেছ তো আমি কী করব। যে গোরু আর দুধ দিতে পারে না তার সংসারে সন্ন্যাসিনীর মতো থাকা উচিত। এতদিন বুড়িটাকে আগলে ছিলে, চুপি চুপি কত সরিয়েছ সেই হিসেব কি আমি চাইছি?

মাইরি বলছি, কিছুই সরাইনি আমি। সরাবার কথা মাথায় আসেনি কখনও। নড়াচড়া করতে না পারলেও ওঁর চোখকে ফাঁকি দেওয়া অসম্ভব ছিল। গন্ধবাবু, তুমি আমাকে আশ্রয় দাও। আতরবালার গলা একেবারে অন্যরকম শোনাল।

মুশকিল। ঠিক আছে, ভেবে দেখছি।

কথা দাও।

আঃ। বললাম তো!

 আমাকে ছুঁয়ে বলল।

হঠাৎ এত পিরীত গজিয়ে উঠল কেন আতরবালা। চলো, কোথায় আছে?

ওই ঘরে।

 কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে সদানন্দ বলল, নিঃশব্দে বেরিয়ে আয়!

সায়ন সদানন্দকে অনুসরণ করল। ওপাশের ঘরের আলমারি খোলার আওয়াজ হল। সায়ন দেখল সদানন্দ দ্রুত সেই ঘরের দরজা টেনে বাইরে থেকে শেকল তুলে দিয়ে দরজার কাছে ছুটে গেল। তারপর দুটো হাত মুখের দুপাশে নিয়ে গিয়ে চিৎকার করতে লাগল, সবাই চলে আসুন, বড়মা মারা গিয়েছেন। বড়মা মারা গিয়েছেন।

কয়েক মিনিটের মধ্যে বাড়িতে সোরগোল পড়ে গেল। যিনি যেমনভাবে ছিলেন ছুটে এসেছেন। বাইরের ঘরটা এখন মানুষ গিজগিজ করছে। সবাই দেখছিলেন ইজিচেয়ারে শুয়ে আছেন বড়মা।

কমলেন্দু জিজ্ঞাসা করল, কখন হল?

সদানন্দ বলল, সানু এসেছিল দেখা করতে। এই দৃশ্য দেখে ও আমাকে খবর দেয়। আমি এসে বুঝলাম উনি আর নেই।

কমলেন্দু পরীক্ষা করে মাথা নাড়ল। ন’বাবু বললেন, শেষ হয়ে গেল। রায়বাড়ির ঐতিহ্য যিনি ধরে রেখেছিলেন তিনিও চলে গেলেন।

সমরেন্দ্রনাথ বললেন, একজন ডাক্তারকে খবর দাও। ডেথ সার্টিফিকেট দরকার। আর আমেরিকায় জানাতে হবে।

কমলেন্দু মাথা নাড়ল, আতরবালা কোথায়? তাকে দেখছি না কেন?

সদানন্দ বলল, ওঁরা ওই ঘরে আছেন।

ন’বাবু বললেন, ওই ঘরে? ওঁরা কারা?

সদানন্দ বলল, বড়মা মারা যাওয়ামাত্র ওঁর টাকাপয়সা গয়নাগাঁটির দায়িত্ব নেওয়ার জন্যে আতরবালা গন্ধরাজকে ডেকে এনেছিল। আমি এসে দেখলাম ওঁরা ওইসব নিয়ে ব্যস্ত তাই দরজাটা শেকল তুলে দিয়েছি।

ন’বাবু চিৎকার করে উঠলেন, সে কী? কী বলছ তুমি?

 সমরেন্দ্রনাথ বললেন, তুমি ঠিক দেখেছ?

আমি আর সানু, দুজনেই দেখেছি।

 ছি ছি ছি। কী চরিত্র! আত্মীয় বলে ভাবতেও লজ্জা হয়। শেষ পর্যন্ত একটা ঝি-এর সঙ্গে? খোলো দরজা, ডাকো ওকে! ন’বাবু কয়েক পা এগিয়ে গেলেন।

কমলেন্দু বলল, দাঁড়ান।

ন’বাবু দাঁড়িয়ে গেলেন। কমলেন্দু বলল, সারাজীবন লোকটা এই কাজ করে গেল অথচ আপনারা কেউ মুখ খোলেননি। আজ নতুন করে বলে কী হবে? দরজা খোলার পর ওদের নিয়ে কী করবেন তাই আগে ভাবুন।

সমরেন্দ্রনাথ বললেন, আতরবালাকে চলে যেতে বলা হোক।

 কমলেন্দু বলল, গন্ধরাজকে কী বলবেন? তিনিও তো একই অন্যায় করেছেন।

সমরেন্দ্রনাথ বললেন, ওকে তো তাড়িয়ে দিতে পারি না। এই বাড়ির শরিক ও। আমরা বয়কট করতে পারি।

কমলেন্দু বলল, আমরা তো ওর সঙ্গে মেলামেশা করি না। বয়কট করলে ওর তো কোনও ক্ষতি হবে না।

সদানন্দ বলল, ওঁরা এখন ওই অবস্থায় থাকুন। আমি ডাক্তার ডাকতে যাচ্ছি। আপনারা সবাই ভাবুন কীভাবে সৎকার করবেন। সদানন্দ চলে গেল।

বড়মায়ের কথা যেন সবাই ভুলে গিয়েছিল। মেয়েরা এসে গেলেন একের পর এক। আতরবালা এবং গন্ধরাজের কাহিনী তাঁরাও শুনেছেন। কিন্তু পুরুষের সামনে কেউ মুখ খুলছিলেন না। তাঁরা বড়মাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছিলেন। হঠাৎ ঊর্মিলা কথা বলল, এতকাল আতরবালা বড়মাকে সেবাযত্ন কয়ে এসেছে, আমরা কেউ আসিনি। আজ ও যদি অন্যায় করার জন্যে শাস্তি পায় তা হলে দুজনকেই শাস্তি দিতে হবে।

সায়ন বলল, আমাদের উচিত পুলিশকে খবর দেওয়া।

সবাই ওর দিকে তাকাল। ন’বাবু বললেন, পুলিশ!

ওরা বড়মার মৃত্যুর সুযোগ নিয়ে টাকাপয়সা গহনা চুরি করতে চেয়েছিল। এটা পুলিশের ব্যাপার। সায়ন বলল।

কিন্তু তার তো কোনও প্রমাণ নেই।

আমরা দেখেছি।

 ঠিক। কিন্তু ওকে পুলিশে দিলে রায়বাড়ির ইজ্জত মাটিতে লুটিয়ে পড়বে। পুলিশ মানেই ঝামেলা। কোর্টে কেস উঠলে কার সময় আছে রোজ ধর্না দেওয়ার? ওঁর নাতি তো আমেরিকা থেকে সেটার জন্যে আসবে না। সমরেন্দ্রনাথ খোলাখুলি বলে ফেললেন।

ঊর্মিলা বলল, কিছু মনে করবেন না, এটা ঠিক সিদ্ধান্ত হচ্ছে না। একই দোষে দোষী দুজনের বিচার আলাদা হওয়া ঠিক নয়।

কমলেন্দু বলল, ঠিক আছে। এসব করার সময় পরে অনেক পাওয়া যাবে। বড়মায়ের মৃতদেহকে সামনে রেখে করলে নিজেরাই ছোট হয়ে যাব। দরজা খুলে দিয়ে ওদের বলুন এখান থেকে চলে যেতে।

কয়েক সেকেন্ড সবাই চুপচাপ। কেউ এগিয়ে দরজা খুলছে না। শেষ পর্যন্ত ঊর্মিলাই এগোল। শেকল নামিয়ে দরজা ঠেলতেই দেখা গেল আতরবালা ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আঁচলে মুখ গুঁজে কাঁদছে।

ন’বাবু প্রথমে ঘরে ঢুকলেন। সবাই দরজায় দাঁড়াল। ঘরে গন্ধরাজ নেই। ন’বাবু বলে উঠলেন, কই? কেউ তো নেই এ-ঘরে।

সমরেন্দ্রনাথ এবং কর্মলেন্দু ঢুকল। ভাল করে খুঁজে দেখা হল। গন্ধরাজ নেই।

 ন’বাবু বললেন, সদু কোথায়? কী দেখতে কী দেখেছে সে?

কমলেন্দু বলল, কিন্তু সায়ন তো দেখেছে?

 ন’বাবু ডাকলেন, এদিকে এসো বাবা। তোমরা ঠিক দেখেছিলে তো?

সায়ন বলল, হ্যাঁ। আমাদের ভুল হওয়ার কোনও কারণ নেই। ওই দেখুন, বড় আলমারিটা খোলা।

আলমারির গায়ে চাবি ঝুলছে। পাল্লা ঈষৎ খোলা। ন’বাবু ছুটে গেলেন। দেখা গেল লকারের পাল্লা বন্ধ রয়েছে। সেটা খেলা হয়নি।

ন’বাবু আতরবালার সামনে এগিয়ে গেলেন, এখানে কী করছিলে?

আতরবালা জবাব দিল না, একই ভঙ্গিতে কাঁদতে লাগল।

তোমার সঙ্গে কেউ ছিল?

আতরবালা জবাব দিল না। ততক্ষণে কমলেন্দু গরাদহীন জানলার কাছে পৌঁছে গিয়েছে। এখান থেকে যে পালাতে চাইবে তাকে অনেকটা লাফিয়ে একটা দেওয়ালের ওপর গিয়ে দাঁড়াতে হবে। এই বয়সে কি গন্ধরাজের পক্ষে সেটা সম্ভব? কিন্তু ওরা যদি ঠিকঠাক দেখে থাকে তা হলে লোকটা তো হাওয়া হয়ে যেতে পারে না। এই পথ দিয়েই যেতে হয়েছে তাকে।

সমরেন্দ্রনাথ বললেন, দ্যাখো আতরবালা, তুমি যদি সত্যি কথা বলো তা হলে তোমাকে আমরা পুলিশে দেব না। বড়মায়ের দেখাশোনার ভার ছিল তোমার ওপর। তিনি মারা যেতেই এ কী কাণ্ড করলে! ছি ছি ছি। যা ঘটেছে তা স্পষ্ট খুলে বলল। আমি কথা দিচ্ছি–।

আমি কিছু জানি না। মাথা ঝাঁকিয়ে কান্না জড়ানো গলায় বলল আতরবালা।

 তুমি যদি কিছু নাই জানো তা হলে ওরা এ ঘরের শেকল তুলে দিল কেন?

আমি জানি না।

কমলেন্দু এগিয়ে এল, খামোকা সময় নষ্ট করছেন আপনারা। এই অবস্থায় ও যদি স্বীকার না করে তা হলে কোনও প্রমাণ পাবেন না এটা ও ভাল করে জানে। আতরবালা, শুধু একটা কথা বলো, বড়মায়ের কোনও সম্পত্তি কি এর মধ্যে এ ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে?

মাথা নেড়ে না বলতে গিয়েও আতরবালা বলল, জানি না।

ডাক্তার নিয়ে ফিরল সদানন্দ। তিনি বড়মায়ের চিকিৎসা আগেও করেছেন। পরীক্ষা করে প্রফুল্ল মুখে বললেন,  সিম্পলি হার্ট অ্যাটাক। এত দিন যে বেঁচেছিলেন সেটাই অনেকখানি। প্যাড খুলে ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দিলেন ভদ্রলোক। কমলেন্দু সেটা নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আপনার–!

ওটা উনি চেম্বারেই দিয়ে এসেছেন। বুঝতেই পারছেন ডেডবডির সামনে বসে তো টাকা নেওয়া যায় না। ডাক্তার বেরিয়ে গেলেন।

এই সময় নীচে চিৎকার চেঁচামেচি শোনা গেল। তারপর হাউমাউ করতে করতে ভিড় ঠেলে দরজায় এসে দাঁড়ালেন গন্ধরাজ। চিৎকার করে বললেন, কখন হল? কী সর্বনাশ! বড়মা চলে গেলে? ও সমরেন্দ্র, সত্যি উনি চলে গেলেন? আমি শুনে বিশ্বাস করিনি কথাটা।

পুতুলের মতো এগিয়ে গেলেন গন্ধরাজ ইজিচেয়ারে শায়িতা বড়মায়ের শরীরের দিকে। তারপর হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলেন, তুমি পুণ্যবতী, সতীসাবিত্রী। আমাদের রায়বাড়ির শেষ বাতি ছিলে তুমি। তুমি আমাদের অনাথ করে চলে গেলে মা। যখন বেঁচে ছিলে তখন কত কষ্ট দিয়েছি, ঝগড়া করেছি। আমাকে ক্ষমা করে দাও মা।

সমস্ত ঘর যেন জমে বরফ হয়ে গেছে। সবাই নিশ্বাস বন্ধ করে দেখছিল গন্ধরাজকে। সত্যিকারের শোকগ্রস্ত মানুষ যেমন আচরণ মাঝে মাঝে করে গন্ধরাজ এখন তাই করছিল।

কমলেন্দু এগিয়ে এল, আপনি উঠুন। বড়মাকে তৈরি করবেন মেয়েরা।

সে কী? এখনই নিয়ে যাবে তোমরা? এই তো গেলেন!

হ্যাঁ। দেরি করে লাভ তো নেই।

গন্ধরাজ উঠে দাঁড়াল, আহা। প্রতিমা ছিলেন উনি। তোরা তো জানিস না, আমি ছেলেবেলায় দেখেছি। এত বড় বাড়িটাকে দু হাতে আগলে রেখেছিলেন। এই যে বাড়ি বিক্রি হয়ে গেল, ভাঙা হবে, এ নিশ্চয় উনি সহ্য করতে পারছিলেন না। আঃ! নাও, তোমরা ওকে সাজাও। দেখে যেন মনে হয় মহারানি স্বর্গে যাচ্ছেন। গন্ধরাজ চারপাশে তাকাল, সে কোথায়? আতরবালা? আতরবালা নেই? ও আতরবালা?

ওপাশের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল আতরবালা, নিঃশব্দে।

গন্ধরাজ বলল, তুমি ওখানে কেন? বড়মার দামি কাপড়-চোপড় বের করে দাও। এঁদের সাহায্য করো। আমি আমার ঘরে আছি। এ বাড়ি থেকে ওঁকে নিয়ে যাওয়ার সময় একটু খবর দিও কেউ।

গন্ধরাজ চলে যাচ্ছিল। সদানন্দের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ সে নিচু হয়ে গন্ধরাজকে প্রণাম করল। গন্ধরাজ খেঁকিয়ে উঠল, এ কী? প্রণাম করছ? তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি? মৃতদেহের সামনে কাউকে প্রণাম করতে হয় নাকি? যত্ত সব।

গন্ধরাজ চলে গেল। এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে সায়ন নাটক দেখছিল। তার চেয়ে অনেক বড় মানুষগুলো এই নাটকটাকে মেনে নিল। কারও মুখ থেকে একটা কথাও বের হয়নি। কেউ প্রশ্ন করেনি গন্ধরাজকে। আগের ওই ঘটনাটা মিথ্যে, এটাই সত্যি, স্বাভাবিক, এমন একটা ভঙ্গি করে দাঁড়িয়েছিল সবাই। গন্ধরাজ চলে যেতে গুঞ্জন আরম্ভ হল। কেউ কেউ বলতে লাগল কত বড় শয়তান অভিনেতা হলে এমন কাণ্ড করতে পারে। আবার উল্টোটাও বলল কেউ, হয়তো ভুল দেখেছে ছেলেরা। মানুষমাত্রই তো ভুল হয়?

সদানন্দকে প্রণাম করতে দেখে সায়নের ভাল লেগেছিল। এই প্রণাম যে শ্রদ্ধা জানানোর জন্যে নয়, নেহাতই ব্যঙ্গ করার জন্যে সেটা স্পষ্ট। সে সদানন্দর কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ছেড়ে দিলে কেন?

কী করব? সবাই তো কোনারকের মূর্তি হয়ে গিয়েছে।

 কিন্তু আমাদের প্রতিবাদ করা উচিত।

করলাম তো। দেখলি না?

দুর। ওতে কোনও কাজ হবে না। তুমি আমার সঙ্গে থাকবে?

আছি।

আতরবালা ভেতর থেকে দামি শাড়ি জামা বের করে আনল। সৌদামিনী পুরুষদের ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বললেন।

সবাই চুপচাপ নেমে যাচ্ছিল। এখন ব্যাঘ্রবাহিনীর সামনের চাতালে ভিড় জমছে। নামতে নামতে সদানন্দ বলল, এখন শ্মশানে যেতে হবে। তোর ওই নেপালি ছেলেটাকে নিয়ে কলকাতা দেখাতে যাওয়া হল না।

বিষ্ণুপ্রসাদের কথা খেয়ালে ছিল না। কথাটা শুনে মনে হল বিষ্ণুপ্ৰসাদ নিশ্চয়ই সমস্যাটা বুঝতে পারবে। তা ছাড়া ও তো আজই ফিরে যাচ্ছে না।

নীচের ভিড়ে গন্ধরাজকে নিয়ে তেমন আলোচনা হচ্ছিল না। বড়মাযের সঙ্গে রায়বাড়ির সম্পর্কই ঘুরে ফিরে আসছিল। মানুষটি ছিলেন, ইদানীং আর হাঁটাচলা করতে পারছিলেন না কিন্তু এই ফাটল ধরা বাড়িটার মতো ওঁর অস্তিত্ব স্বাভাবিক ছিল। তিনি আজ হঠাৎই আর নেই।

অন্যান্য আত্মীয়স্বজনদের খবর দেওয়া চলছিল। এই সময় কেউ একজন এসে জানাল পাঁড়েজি মাটিতে বসে পড়েছে, কথা বলছে না। কথাটা শুনে ন’বাবু বললেন, ওর শোক জেনুইন। সমরেন্দ্রনাথ বললেন, সে তো হবেই, কতকাল আগের মানুষ। নিজের সব কিছু ছেড়ে এই বাড়ি আঁকড়ে পড়ে আছে। সদানন্দ ভিড় ছেড়ে এগিয়ে গেল সদরের দিকে। সায়ন তার সঙ্গী হল।

বাড়ির বাইরে, দরজার ওপাশে পাঁড়েজি বসে আছে। শরীরটাকে দ-এর মতো দেখাত কিন্তু মাথাটা হাঁটুর ওপর ঝুঁকে পড়ে থাকায় সেটা দেখাচ্ছে না।

সদানন্দ কাছে গিয়ে ডাকল। ও পাঁড়েজি? শরীবটা একটু নড়ল মাত্র। সদানন্দ বলল, আরে, এমন করছ কেন? বড়মায়ের কত বয়স হয়েছিল। এতদিন যে বেঁচেছিলেন তাই আমাদের ভাগ্য। বলতে বলতে ঈষৎ ঠেলতেই পাঁড়েজির শরীরটা একেবারে চিত হয়ে শুয়ে পড়ল। তার মুখের চেহারা, বুকের ওঠানামা দেখে ভয় পেয়ে গেল সদানন্দ। সে চিৎকার করে বলল, সানু, পাঁড়েজির অবস্থা খারাপ। আমি ডাক্তার ডাকতে যাচ্ছি, তুই এখানে থাক। কথাগুলো বলতে বলতে সদানন্দ ছুটে গিয়ে ওপাশে দাঁড় করানো বাইকে উঠে বেরিয়ে গেল সশব্দে। সদানন্দর চিৎকার ভেতরেও পৌঁছেছিল। একটু একটু করে ভিড়টা তৈরি হয়ে গেল পাঁড়েজিকে কেন্দ্র করে। পাঁড়েজির চোখ বন্ধ। বৃদ্ধর বুকের খাঁচা খুব দ্রুত ওঠা-নামা করছে। দুটো গাল জলে ভেজা। পাঁড়েজি যে কাঁদছিল সেটা কাউকে বলে দিতে হবে না। কমলেন্দু বলল, আপনারা একটু সরে দাঁড়ান, হাওয়া আসতে দিন।

ন’বাবু যেন নিজেকেই প্রশ্ন করলেন, মরে যাবে নাকি?

সায়ন লোকটির সামনে হাঁটু মুড়ে বসেছিল। খুব ছেলেবেলায় পাঁড়েজিকে তারা ভয় পেত। লাঠি হাতে বিশাল গোঁফ নিয়ে পাঁড়েজি রাতের বেলায় হুঙ্কার ছাড়ত। মাঝেমাঝেই সেই পেতল বাঁধানো লাঠির খটখট আওয়াজ শোনা যেত। কে যেন বলেছিল পাঁড়েজি সারারাত ভূতপ্রেত তাড়িয়ে বেড়ায়। এটা শোনার পর আর কাছে ঘেঁষতে চাইত না সায়ন।

কিন্তু যখন প্রথম তার অসুখ ধরা পড়ল তখন থেকেই তার চোখে পাঁড়েজির চেহারা বদলে গেল একটু একটু করে। সে যখন পাহাড়ে গিয়েছিল তখন রামজির কাছে প্রার্থনা করেছিল পাঁড়েজি।

সদানন্দ ডাক্তার নিয়ে এল। সেই একই ডাক্তার। তিনি গম্ভীর মুখে পাঁড়েজিকে পরীক্ষা করলেন। তারপর চোখ বন্ধ করে বললেন, সিভিয়ার হার্ট অ্যাটাক। বাঙালি হলে এখনই ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দিতে হত। ওষুধ দিয়ে কোনও লাভ হবে না। কয়েক ঘণ্টার ব্যাপার।

সদানন্দ বলল, এই যে শুনেছি যতক্ষণ খাস ততক্ষণ আশ! ডাক্তাররা সেই আশা ছাড়েন না।

এই সময় পাঁড়েজি জড়ানো শব্দ উচ্চারণ করল। ডাক্তার দুপা সরে এসে ঝুঁকে দেখলেন, শুরু হয়ে গেছে।

সায়ন পাঁড়েজির বুকে হাত রাখল। একটা মানুষের বুকে এত কষ্ট হয়! বৃদ্ধের চোখের পাতা নড়ছিল। ধীরে ধীরে চোখ খুলল। কয়েক মুহূর্ত স্থির চোখে তাকাল পাঁড়েজি। ডাক্তার বললেন, ভিশন নেই। কিছুই দেখছে না, বুঝলেন।

হঠাৎ পাঁড়েজির চোখের তারা বিস্ফারিত হল। তার হাত দুটো কাঁপতে লাগল। সায়ন আরও এগিয়ে গেল, পাঁড়েজি।

পাঁড়েজি সায়নের মুখ থেকে চোখ সরাচ্ছিল না। শীর্ণ, চামড়া কুঁচকে যাওয়া হাত দুটো দুপাশ থেকে কোনওমতে তুলে নিয়ে এল বুকের ওপর। হাত দুটোয় নমস্কারের মুদ্রা ফুটে উঠল। সেই অবস্থায় সায়নের দিকে তাকিয়ে পাঁড়েজি অস্ফুট শব্দ উচ্চারণ করল। জড়ানো হলেও দ্বিতীয়বারে সেটা শুনতে পেল কাছে দাঁড়ানো মানুষেরা, জয় রামজি। বৃদ্ধের শুকিয়ে যাওয়া মুখে চোখের জলের আস্তরণ কিন্তু সেখানে ফুটে উঠল এক অলৌকিক আনন্দ। কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী হল সেটা। তারপর প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেল।

.

ডাক্তার সার্টিফিকেট লিখে দিয়ে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে আরও একবার বললেন, ইটস মির‍্যাকল। আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। ওই অবস্থায় দুটো হাত জড়ো করে প্রণাম করা সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য ব্যাপার। তারপর ওই রামজি উচ্চারণ। ব্রেন এত কাজ করতেই পারে না।

কমলেন্দু বলল, কিন্তু আমরা সবাই দেখলাম ঘটনাটা।

সমরেন্দ্রনাথ বললেন, ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিল তো-।

ডাক্তার বললেন, ওই যে কথাটা আছে, যেখানে জিজ্ঞাসা থেমে যায় সেখান থেকেই দর্শন শুরু হয়। ভুল বললাম বোধহয়। কিন্তু মনে থাকবে ঘটনাটা।

কমলেন্দু সায়নের দিকে তাকাল। পাঁড়েজির প্রতিক্রিয়া সে চোখের সামনে দেখেছে। আর দেখার পরেই মনে পড়েছে পাহাড়ে মা মেরির মূর্তির সামনে দাঁড়ানো সায়নের কথা। সেদিন কি বেশির ভাগ মানুষ ভুল দেখেছিল? অসুস্থ হওয়ার পর ওর মধ্যে কোনও অলৌকিক শক্তি জেগে ওঠে? এসব বিশ্বাস করতে অস্বস্তি হয়। কিন্তু আজ পাঁড়েজি শেষমুহূর্তে ওর মধ্যে কী দেখেছিল?

সায়ন বসে আছে পাঁড়েজির মৃতদেহের পাশে। বাদল এসে গিয়েছে। বড়মায়ের মৃতদেহ যেভাবে নিয়ে যাওয়া হবে পাঁড়েজি নিশ্চয়ই সেই সম্মান পাবে না। তা হলে পাশাপাশি নিয়ে যাওয়া শোভন নয়। একই শ্মশানে দুজনকে নিয়ে যাওয়া উচিত হবে কিনা তাই নিয়ে মতবিরোধ হচ্ছিল। বড়রা সিদ্ধান্ত নিল পাঁড়েজির মৃতদেহের দায়িত্ব হিন্দু সৎকার সমিতিকে দিয়ে দেওয়াই ভাল। মূল্য ধরে দিলে তাঁরাই যত্ন করে সৎকার করে দেবেন। পাঁড়েজির কোনও আত্মীয়ের কথা কারও জানা নেই। এক্ষেত্রে এটাই ভাল ব্যবস্থা। এতকাল মানুষটা এ বাড়িকে সেবা করেছে, তার জন্যে এতটুকু না করলে নয়। বড়মায়ের জন্যে ফুল দিয়ে সাজিয়ে লরি আনার ব্যবস্থা করা হল। সদানন্দ বাদলকে বলল, তুই হিন্দু সৎকার সমিতির গাড়িতে শ্মশানে যা। একটু দেখাশোনা করিস। বড়মাকে নিয়ে বের হতে দেরি হবে। তার আগে যদি পাঁড়েজির কাজ হয়ে যায় তাহলে অন্য শ্মশানে যাওয়ার দরকার নেই। বুঝলি? বাদল মাথা নেড়ে জানাল সে বুঝেছে।

সায়ন উঠে দাঁড়াল, আমিও বাদলদার সঙ্গে যাব।

তুই যাবি?

হ্যাঁ। পাঁড়েজির মুখাগ্নি বাইরের লোক করবে কেন আমরা থাকতে? ওটা আমি করব। সায়ন বলল।

কমলেন্দু এগিয়ে এল, সায়ন তোর শরীর খারাপ।

কে বলল? এখন আমি ঠিক আছি।

এই সময় কাজের লোক এসে সায়নকে জানাল নন্দিনী ডাকছেন। সায়ন ওপরে তাকিয়ে জানলায় মায়ের ঘোমটা দেওয়া মুখ দেখতে পেল। সে চুপচাপ ওপরে উঠে এল। বাইরের ঘরে বিষ্ণুপ্রসাদ বসে আছে। সে আসার পরেই এই বাড়িতে দু দুটো মানুষ মরে যাওয়ায় বেশ বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে।

নন্দিনী জিজ্ঞাসা করলেন, তুই শ্মশানে যাবি?

হ্যাঁ।

কেন।

মাথা নিচু করল সায়ন, তুমি আপত্তি কোরো না।

নন্দিনী কয়েক মুহূর্ত ভাবলেন, তোর শরীর যদি খারাপ হয়?

না গেলে বেশি খারাপ হবে।

কী করে বুঝলি?

তুমি দেখোনি মা, ঠিক প্রাণটা বেরিয়ে যাওয়ার আগে পাঁড়েজি আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়েছিল যে আমার মনে হয়েছিল ওর আর কোনও কষ্ট নেই। যেন আমার ওপর খুব ভরসা করছে।

নন্দিনী মাথা নাড়লেন, তাহলে যা। কিন্তু তাড়াতাড়ি ফিরে আসবি। বিষ্ণুপ্ৰসাদকে সঙ্গে নিয়ে যা।

বিষ্ণুপ্রসাদ সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল।

হিন্দু সৎকার সমিতির গাড়ি এসে গেল। পাঁড়েজির মৃতদেহ যখন ওরা গাড়িতে তুলছে তখন গন্ধরাজকে দেখা গেল বেরিয়ে আসতে। কমলেন্দুরা যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখানে গিয়ে গন্ধরাজ বলল, শোনো, পাঁড়েজির সৎকার করতে যা খরচ হবে সেটা আমি দেব। এখন হাজার টাকা দিচ্ছি। শ্মশানে এতেই হয়ে যাবে। কে যাচ্ছে সঙ্গে?

প্রথমে কেউ কথা বলল না। তারপর কমলেন্দু বলল, সবাই মিলে খরচটা দেওয়া হচ্ছে। আলাদা করে দেওয়ার কী প্রয়োজন?

গন্ধরাজ কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগে সায়ন এগিয়ে গেল, আপনার কি মনে হচ্ছে টাকাটা খরচ করলে সবাই অন্যায়টা ভুলে যাবে?

অন্যায়? কী অন্যায়? নিরীহ মুখ করে জিজ্ঞাসা করল গন্ধরাজ।

আতরবালার সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে বড়মায়ের টাকাপয়সা গয়না চুরি করতে গিয়েছিলেন আপনি। দরজায় শেকল তুলে দেওয়ার পর জানলা দিয়ে পালিয়ে যান। তারপর আবার সামনের দরজা দিয়ে ফিরে এসে এমন নাটক করেন যেন কিছুই জানেন না। আত্মা বলে কিছু আছে কিনা জানি না, আপনার টাকায় সৎকার হলে পাঁড়েজিকে অসম্মান করা হবে।

গন্ধরাজ হাঁ হয়ে শুনছিল। এবার বলল, তুমি অসুস্থ, তাই না? রক্তের অসুখ। সেটা যে মাথাও খারাপ করে দেয় তা তো আমি জানতাম না। এইটুকুনি ছেলে উন্মাদের মতো গুরুজনের সঙ্গে কথা বলছ? ছি ছি ছি।

আপনাকে তো আমি আমার গুরুজন বলে মনে করি না।

 হ্যাঁ। গন্ধরাজ চোখ বড় করে হাত ওল্টাল।

আপনি আমার চেয়ে আগে জন্মেছেন বলেই গুরুজন হতে পারেন না। একজন মানুষ মরে যাওয়া মাত্র যে তার সম্পত্তি চুরি করার চেষ্টা করে তাকে গুরু বলে ভাবার কোনও কারণ নেই।

গন্ধরাজ চিৎকার করল, কী আস্পর্দা? শুনছেন আপনারা? ওর কথা শুনছেন? নেহাত ব্লাড ক্যানসারের পেশেন্ট নইলে এক চড়ে মাথা ঘুরিয়ে দিতাম।

সেটা করার চেষ্টা করলে আপনার খুব দুরবস্থা হত। সদানন্দ এগিয়ে এল, আপনি বারংবার ওর অসুখের কথা বলছেন। আপনি নিজে কী?

মানে?

আপনার মতো একটা লম্পটকে এ বাড়ির লোক এতদিন সহ্য করে এসেছে বলে ভেবেছেন চিরদিন তাই চলবে? যান। নিজের ঘরে চলে যান। পাঁড়েজি বা বড়মায়ের কাজে আপনাকে আমরা দেখতে চাই না। যান এখান থেকে। সদানন্দ শক্ত গলায় বলল।

সদু! গন্ধরাজ কাতর গলায় বলল।

আপনাকে পুলিশে দেওয়া উচিত ছিল। জানলা দিয়ে পালিয়ে গিয়ে বেঁচে গেছেন। যান এখান থেকে। গলা তুলল সদানন্দ।

মাথা নিচু করে ফিরে গেল গন্ধরাজ। ন’বাবুদের মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল এই ঘটনায় তারা খুব খুশি হয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে গন্ধরাজকে তাঁরা সহ্য করে এসেছেন কারণ প্রতিবাদ করার জোর পাননি। পরের প্রজন্ম সেটা করায় তাদের খুব স্বস্তি হচ্ছে।

আজ শ্মশানে মৃতদেহ নেই। এর আগে কখনও শ্মশানে আসেনি সায়ন। কিন্তু বাদল এ ব্যাপারে যে অভিজ্ঞ তা বোঝা গেল। খাতাপত্রের কাজ সেরে একটা পুরোহিত জোগাড় করে পারলৌকিক কাজকর্ম শুরু করে দিল সে। মুখাগ্নি কে করবে পুরোহিত জানতে চাইলে সায়ন এগিয়ে গেল। প্রথমে চালকলার পিণ্ডি গেলাতে হয়। সায়ন মাথা নাড়ল, পাঁড়েজি তো মারা গিয়েছে। মৃতদেহ খেতে পারে না। ওটা কেন করব?

পুরোহিত বলল, ওর আত্মাকে খাওয়াতে হয়।

সায়ন জিজ্ঞাসা করল, ওর আত্মা কোথায়?

পুরোহিত বিরক্ত হল, তুমি কি হিন্দু নও? জানো না আত্মা কোথায় থাকে? এখানে কেউ কেউ এমন ঝামেলা করে!

আমি জানি না আত্মা কোথায় থাকে।

 বাদল এগিয়ে এল। আদেশটা সেই পালন করল। এবার দুটো পাটকাঠিতে আগুন ধরিয়ে পুরোহিত বলল, ওর মুখে চেপে ধরো।

এটাকে কি মুখাগ্নি করা বলে? সায়ন জানতে চাইল।

হ্যাঁ।

তাহলে, আমার পক্ষে মুখাগ্নি করা সম্ভব নয়। বাদলদা, তোমার যদি আপত্তি না থাকে তুমি করতে পারো। সায়ন পিছিয়ে গেল।

ইলেকট্রিক চুল্লির গহ্বরে মৃতদেহ চলে গেলে বাদল বলল, তুই ফিরে যা। এখনও ঘণ্টাখানেক লাগবে। আমি আছি।

সায়ন জিজ্ঞাসা করল, বাদলদা, এইসব নিয়ম যখন চালু হয়েছিল তখন ইলেকট্রিক চুল্লি ছিল?

কী করে থাকবে! ইলেকট্রিক তো অনেক পরে এসেছে। বাদল বলল, আগে তো কাঠের চিতায় পোড়ানো হত। এখনও হয়। সবার সামনে শরীর পোড়ে।

এখন যখন চোখের আড়ালে দাহ হয়ে যাচ্ছে আর সবাই সেটা মেনে নিয়েছে তখন এই নিষ্ঠুর নিয়মগুলো কি পাল্টানো যায় না? কী ভয়ঙ্কর। সায়ন বলল।

বাদল অবাক হয়ে তাকাল। আজ হঠাৎ এই কথা শুনে তারও মনে হল নিয়মগুলো সত্যি নিষ্ঠুর। সে বলল, তোর শ্মশানে আসা উচিত হয়নি।

সায়ন মাথা নাড়ল, না। এখানে এসে ভাল হয়েছে। আমি মাকে বলতে পারব তোমার সৎকার করতে পারব না।

.

৩৬.

বড়মায়ের সৎকার সেরে সবাই বাড়ি ফিরেছিল বিকেলবেলায়। লোহা আগুন ছুঁয়ে যে যার এলাকায় চলে গিয়েছিল। এখন থেকে অশৌচ শুরু হল। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে অশৌচের সঙ্গে সায়নের পরিচয় হয়নি। ন’বাবু মুখাগ্নি করেছেন বলে নিয়মনিষ্ঠ হয়েছেন। বাকিরা খালি পায়ে ঘুরবে, দাড়ি কাটবে না এবং মশলা না দেওয়া নিরামিষ খাবে। পেঁয়াজ রসুনও পড়বে না।

সায়নের বাবা শ্মশানে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে জামাকাপড় ছেড়ে স্নান সেরে ছেলেকে ডাকলেন। সায়ন ঘরে ঢুকে দেখল বাবা গম্ভীর মুখে চেয়ারে বসে রয়েছে। সে জিজ্ঞাসা করল, ডাকছ?

তুমি পাঁড়েজির মুখাগ্নি করেছ?

না।

কেন? তুমি তো সেই কথাই বলে গেলে! ভদ্রলোক যেন স্বস্তি পেলেন, সবাই এই নিয়ে কথা বলছে। বাবা-মা বেঁচে থাকতে কেউ অন্যের মুখাগ্নি করে না। তুমি হয়তো এ কথা জানতে না।

নন্দিনী শুনছিলেন। হেসে বললেন, ও বলেছে আমাদের মুখাগ্নিও করবে না। ওর কাছে ব্যাপারটা শুনে আমিও বলেছি, করিস না।

সে কী? তুমি ওকে এই পরামর্শ দিয়েছ? হিন্দুর ছেলে বাপ-মায়ের মুখাগ্নি করবে না? তোমরা কি উন্মাদ হয়ে গেলে? চেঁচিয়ে বললেন ভদ্রলোক।

মুখাগ্নি করলে কী লাভ হবে? সায়ন জিজ্ঞাসা করল।

তোমার মায়ের কাছ থেকে জেনে নিও কেন মুখাগ্নির প্রয়োজন? কিন্তু তুমি কেন পাঁড়েজির মুখাগ্নি করলে না? কেউ নিষেধ করেছিল?

না। আমার মনে হয়েছে এটা একটা বীভৎস ব্যাপার। এককালে বিধবাদের পুড়িয়ে মারার সময় মানুষ আনন্দ পেত। এখন সেটা সম্ভব নয় বলে মুখ পুড়িয়ে দিয়ে কিছুটা মিটিয়ে নেয়। বাবা, তুমি বলবে এটাই হিন্দুদের রীতি। কিন্তু সব কিছু তো সময়ের সঙ্গে বদলে যায়। এটাও বদলানো উচিত।

তুমি সমাজসংস্কারক হবে নাকি?

এ বাড়ির বাইরে সমাজের কোনও অস্তিত্ব আছে কিনা আমার জানা নেই। আমি আমার মতে যেটা উচিত কাজ সেটাই করব।

বাবা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল সায়নের দিকে, পাহাড়ে তুমি কাদের সঙ্গে মিশছ? এখানে যখন ছিলে তখন তো এসব কথা বলতে না। তুমি ছেলেমানুষ, এখনও জীবন, ধর্ম সম্পর্কে কিছুই জানো না।

কিন্তু কোনটা খারাপ কোনটা ভাল তা বোঝার বয়স আমার হয়েছে।

একটু বেশি হয়েছে। আজ সবার সামনে তুমি তোমার জ্যাঠামশাইকে যেভাবে অপমান করেছ সেটা ওই বেশি বোঝার কারণে। বাড়ির সব চেয়ে বয়স্কা মহিলা মারা গেলে লোকে শোকে স্তব্ধ হয়ে থাকে। আর তখন তুমি–!

তুমি জ্যাঠামশাই কাকে বলছ?

তুমি জানো না?

জানি। কিন্তু জ্ঞান হওয়ার পর থেকে তোমরা কেউ আমাকে বলোনি ওকে জ্যাঠামশাই বলে ডাকতে। উল্টে বারংবার নিষেধ করেছ ওর ঘরে না যেতে, ওর সঙ্গে কথা না বলতে। তোমাদের কথাবার্তায় আমি বুঝেছিলাম লোকটা খুব খারাপ। আজকে হঠাৎ উল্টো কথা বলছ কেন?

উল্টো কথা আবার কী। খারাপ-ভাল বিচার করার বয়স তোমার হয়নি। সম্পর্কের সূত্রে উনি তোমার জ্যাঠামশাই হন। এ বাড়ির রক্ত ওঁর শরীরে। তাঁকে তুমি যেভাবে ছোট করেছ তাতে আমি অবাক হয়ে গিয়েছি।

বড়মায়ের মারা যাওয়ার খবর পেয়ে আতরবালার সঙ্গে লোকটা যে ভাষায় কথা বলছিল তা তোমরা কেউ শোনোনি। সদুদা শুনেছে। মৃতদেহের সম্পত্তি চুরি করতে আতরবালাকেও যা বলেছিল তা শুনে আমি লোকটাকে জ্যাঠা বলে ভাবতে পারি না। শুধু জ্যাঠা কেন, যদি দেখতাম তুমি বড়মায়ের ঘরে ঢুকে আতরবালার সঙ্গে ওই ষড়যন্ত্র করছ তাহলে তোমাকেও আমি বাবা বলে আর ডাকতাম না। আমি যাচ্ছি।

স্তব্ধ মানুষ দুটোর সামনে থেকে চলে এল সায়ন। ওর মাথা ঝিমঝিম করছিল। ডাক্তার আঙ্কল তাকে উত্তেজিত হতে নিষেধ করেছেন। ঘরে ঢুকে দেখল বিষ্ণুপ্রসাদ টিভির সামনে বসে আছে। টিভি চলছে কিন্তু শব্দ হচ্ছে না। ওটা একেবারে কমিয়ে দিয়েছে বিষ্ণুপ্ৰসাদ।

তাকে দেখামাত্র বিষ্ণুপ্ৰসাদ জিজ্ঞাসা করল, তুমি ঠিক আছ?

হ্যাঁ। চেয়ারে বসল সায়ন।

কিন্তু তোমার মুখ লাল হয়ে গেছে।

সায়ন কথা বলল না।

বিষ্ণুপ্ৰসাদ বলল, তোমার এখানে ভাল লাগছে না, না?

সায়ন হেসে ফেলল, তোমার কেমন লাগছে?

ঠিক হ্যায়? আমরা কবে ফিরব?

বুঝতে পারছি না।

তুমি যদি বেশি দিন থাকো তাহলে আমি চলে যাই।

সায়ন কিছু বলার আগে নন্দিনী ঘরে ঢুকলেন, তোকে একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। মাথার তো ঠিক নেই। তোর ডাক্তার ফোন করেছিলেন।

কখন? সায়ন অবাক হল।

তুই যখন শ্মশানে গিয়েছিলি। ভালভাবে পৌঁছেছিস কিনা উনি জিজ্ঞাসা করলেন। আমার কাছে বড়মায়ের মৃত্যুসংবাদ শুনে বললেন, কদিন নিরামিষ খেতে পারিস কিন্তু অন্য কোনও নিয়ম মানা চলবে না। আমি বললাম কোনও নিয়মই তোকে মানতে হচ্ছে না। তুই তোর মতো থাকবি। নন্দিনী ছেলের মাথায় হাত রাখলেন, অত উত্তেজিত হওয়া ঠিক না।

আমি তো উত্তেজিত হয়নি।

তুই কখনও বাবার সঙ্গে ওইভাবে কথা বলিসনি।

প্রয়োজন হয়নি।

প্রয়োজন হলেও লোকে ভদ্রতা করে এড়িয়ে যায়।

আমি তো আগ বাড়িয়ে কথা বলিনি। বাবাই আমাকে ডেকে প্রশ্ন করছিল। আমি যা সত্যি তাই বলেছি।

না বললে হত না?

তাহলে তো নিজের সঙ্গে প্রতারণা করা হত।

নন্দিনী প্রসঙ্গে ঘোরাতে চাইলেন। মাঝখান থেকে এই ছেলেটা কী বিপদে পড়ল। প্রথমবার কলকাতায় এসে বাড়িতে বন্দী হয়ে রইল।

বিষ্ণুপ্ৰসাদ মাথা নাড়ল, না, না, ঠিক আছে।

 সায়ন বলল, বিষ্ণুপ্ৰসাদ চলে যেতে চাইছে।

ওমা! কেন? নন্দিনী অবাক।

ওর এখানে ভাল লাগছে না।

বাড়ি থেকে বের হলে ভাল লাগবে। এসেছ যখন কদিন থেকে যাও। তোমাকে শহর দেখানোর ব্যবস্থা করা হবে। নন্দিনী চলে গেলেন।

সায়ন উঠল। এখন শরীর কিছুটা ভাল লাগছে। ঝিমঝিম ভাবটা কেটেছে। সে ঘর থেকে বেরিয়ে প্যাসেজ দিয়ে ছাদের দরজায় গেল। দরজা খুলে বাইরে তাকাতেই বড় ছাদটা নজরে এল। এখন অন্ধকার। ছাদে কেউ নেই। আজকের ঘটনার পর কেউ হয়তো ছাদে আড্ডা মারতে আসেনি। এলেও অন্ধকার নামার সঙ্গে সঙ্গে ফিরে গেছে।

সায়ন কয়েক পা এগোল। হঠাৎ তার চোখে পড়ল দূরে কার্নিশের ওপর কেউ ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে। নারীমূর্তি। এই আধা-অন্ধকারে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। কে ওখানে?

সায়ন একটু এগোল। সেই সময় নারীমূর্তি সোজা হল। বিস্মিত গলা ভেসে এল, সানু।

হেনা কাকিমা।

কেমন আছিস তুই? এসেছিস সেকথা শুনেছিলাম।

তুমি এই সময় ছাদে কী করছ?

 হেনা কাকিমা হাসল, শুনলে তুই হাসবি। আগে বল, তোর শরীর কেমন আছে?

আমি এখন ভাল আছি।

দেখি, কাছে আয়।

সায়ন এগিয়ে গেল। হেনা কাকিমাকে খুব রোগা লাগছে, অস্পষ্ট হলেও সায়ন সেটা বুঝতে পারল। হেনা কাকিমা জিজ্ঞাসা করল, পাহাড়ের আবহাওয়া ভাল?

কখনও ভাল, কখনও খারাপ। সায়ন বলল, এবার বলো, আমি হাসব না।

হেনা কাকিমা আকাশের দিকে তাকাল, শুনেছি কেউ মারা গেলে শ্রাদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত তাঁর আত্মা বাড়ি ছেড়ে যায় না। ওই মায়া কাটিয়ে দিতে শ্রাদ্ধ-শান্তি করা হয়। আজ এবাড়িতে একসঙ্গে দুজন মারা গিয়েছে। সে ক্ষেত্রে তো ওঁদের এখানে থাকার কথা।

তুমি এসব গল্প বিশ্বাস করো?

জন্ম থেকে শুনে আসছি, লোকে মিথ্যে বলবে কেন? তুই বলবি আমি দেখেছি কিনা? না, আমি দেখিনি। আমি তো ভগবানকেও দেখিনি। তাই বলে যদি বলি ভগবান নেই লোকে হাসবে না?

ঠিক আছে, তারপর?

আত্মারা আলোয় আসতে পারেন না। অন্ধকারেই তাঁরা স্বস্তি পান। এই ছাদে তো আলো নেই। এখানে আসাই তাঁদের পক্ষে সুবিধে, তাই না?

সায়ন চারপাশে তাকাল। হঠাৎ ছাদটাকে রহস্যময় বলে মনে হল। সে বলল, তোমার কথা যদি সত্যিও হয় তাহলেও তাঁদের তুমি দেখবে কী করে? শরীর তো ছাই হয়ে গিয়েছে।

দুর। আত্মারা ইচ্ছে করলে যে কোনও রূপ ধারণ করতে পারে। এই যে আমি এতক্ষণ এখানে একা দাঁড়িয়েছিলাম, মনে হচ্ছিল বাতাসে ফিসফিস শব্দ শুনতে পাচ্ছি।

সায়ন হেনা কাকিমার পরিবর্তন দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছিল। তার খেয়াল হল আজ সে হেনা কাকিমাকে তাদের বাড়িতে আসতে দেখেনি। অথচ মায়ের সঙ্গে হেনা কাকিমার খুব ভাব ছিল। তখন কথায় কথায় হেনা কাকিমা প্রতিবাদ করত। এ বাড়ির নানান ত্রুটি মেনে নিতে পারত না। মা ওকে বোঝাত। সে যখন খুব অসুস্থ হয়ে পড়ল তখন হেনা কাকিমা মায়ের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সেবা করেছিল। তখন অন্য রকম ছিল হেনা কাকিমা।

সায়ন জিজ্ঞাসা করল, তুমি ওঁদের দেখতে চাইছ কেন?

কাউকে বলবি না, কথা দে।

ঠিক আছে।

বড়মাকে দেখতে পেলে জিজ্ঞাসা করব আপনি এতদিন কী সুখে বেঁচে ছিলেন? আর পাঁড়েজিকে পেলে জানতে চাইব এখন তার কেমন লাগছে?

এসব কথা জেনে তোমার কী লাভ হবে?

হেনা কাকিমা জবাব দিল না। আবার আকাশের দিকে তাকাল।

হেনা কাকিমা? সায়ন ডাকল।

হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠল হেনা কাকিমা। ওর শরীর কাঁপছিল। কোনওমতে নিজেকে সামলে বলল, আমি একটুও ভাল নেই রে সানু।

কেন?

আমি সহ্য করতে পারছি না। এত নিষেধ, এত শাসন অথচ আমি আর মেনে নিতে পারছি না। তোকে দেখতে যাওয়ার কথা ছিল। শেষ মুহূর্তে ওরা আমাকে আটকে দিল। কথায় কথায় সন্দেহ করে এরা। শাশুড়ির সঙ্গে এখন স্বামীও যোগ দিয়েছে। মাঝে মাঝেই মনে হয় আত্মহত্যা করি। কিন্তু ভয় হয়। সেই জগৎটার কিছুই জানি না, সেটা যদি আরও খারাপ হয়। হেনা কাকিমা নিচু স্বরে বলল।

তাই তুমি আত্মাদের জিজ্ঞাসা করতে চাও?

জবাব পেল না সায়ন। হেনা কাকিমা অন্য দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

সায়ন হাসল, তুমি যখন সহ্য করতে পারছ না তখন বাপের বাড়ি চলে যাচ্ছ না কেন? সেখানে গিয়ে সব কথা খুলে বলো।

বলেছি। ওরা শোনেনি। বলেছে বিবাহিতা মেয়ের উচিত শাশুড়ির সঙ্গে মানিয়ে চলা! এক এক সময় মনে হয় দূরে কোথাও চলে যাই। কিন্তু কোথায় যাব? হ্যাঁ রে, তোদের পাহাড়ে গেলে আমি থাকতে পারব?

তুমি এ বাড়ির অন্য মেয়েদের সঙ্গে কথা বলো।

 কোনও লাভ নেই। একমাত্র ঊর্মিলা ছাড়া কারও সাহস নেই। এই দ্যাখ টুকটুকিটার কী অবস্থা! শুনেছিস?

না। সায়ন ঘাড় নাড়ল।

তুই ছোট বলে তোর মা তোকে বলেনি।

কী হয়েছে?

টুকটুকিকে ওর শ্বশুরবাড়ি থেকে ফেরত দিয়েছিল। কারণ কী? না বিয়ের পর ওদের বউকে পছন্দ হচ্ছে না। ন’বাবু অনেক অনুরোধ করেছিলেন তারা শোনেনি। বদমায়েসের ঝাড়। কিছুদিন পরে আর একটা বিয়ে দিয়ে রোজগার করতে চেয়েছিল। জামাইয়ের মন ফেরাতে ওরা কত কী করেছিল। যজ্ঞ, তান্ত্রিক কত কিছু। মেয়েটাকে কারও সঙ্গে মিশতে দিত না। শেষ পর্যন্ত কী করে জানি না জামাইকে একদিন এ বাড়িতে নিয়ে এল। আমরা সবাই জানলাম গোলমাল মিটে গেছে। বিকেলে খুব সেজেগুজে টুকটুকি ছাদে এল। খুশিতে ওকে সুন্দর দেখাচ্ছিল। পরদিন জামাই চলে গেল। আর সেই যে গেল আর এল না। এদিকে বেচারা টুকটুকি মা হতে চলেছে। ওর শ্বশুর বলেছে যে বাচ্চাটা আসছে সেটা নাকি ওদের বংশের নয়। শোনামাত্র টুকটুকি এমন অসুস্থ হয়ে পড়েছে যে বিছানা থেকে নামতে পারছে না। মেয়েটাকে জেনেশুনে বলি দেওয়া হল। নিশ্বাস ফেলল হেনা কাকিমা।

মন খারাপ হয়ে গেল সায়নের। ঠিক এই সময় ওপাশের দরজা খুলে গেল। আলো পড়ল ছাদে। সায়ন দেখল একজন সাদা থান পরা বৃদ্ধা টুকটুক করে এগিয়ে আসছেন। কাছে এসে বললেন, ওমা, তুমি? তুমি সানু না?

হ্যাঁ। এই বৃদ্ধা হেনা কাকিমার শাশুড়ি। খুব কম দেখেছে সে। ভদ্রমহিলা ঝগড়া করেন বলে ওদের বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করত না।

অ বউমা! তুমি এত রাত্তিরে এখানে কী করছ?

কথা বলছিলাম। গম্ভীর গলায় জবাব দিল হেনা কাকিমা।

কথা বলার আর জায়গা পেলে না? কাছে না এলে ভাবতাম কোনও ব্যাটাছেলে এখানে এসে জুটেছে বুঝি।

মা! চেঁচিয়ে উঠল হেনা কাকিমা।

তা আমাদের সানুও বেশ বড়সড় হয়ে গেছে। গাল ভর্তি দাড়ি গজিয়েছে। শুনতে পাই কমলেন্দুর বউয়ের সঙ্গে খুব ভাব। তা দেওর-বউদির মধ্যে একটু ভাব হতেই পারে কিন্তু কাকিমা তো মায়ের মতো। তাই না?  

হেনা কাকিমা চাপা গলায় বলল, সানু তুই চলে যা।

বৃদ্ধা বললেন, ও চলে গেলে তোমার আর থাকার কী দরকার? আমার ছেলে বাইরে গেছে বলে তুমি সাপের পাঁচ পা দেখতে পারো না।

হেনা কাকিমা জবাব দিয়ে হনহন করে চলে গেল আলোকিত দরজার দিকে। বৃদ্ধা বলল, যাও। এবার ঘরে যাও।

সায়ন হাসল, এখানে থাকতে ভাল লাগছে। আপনিও থাকুন না।

আমার কি থাকার জো আছে। কত কাজ!

আজ বড়মা মারা গেলেন। আপনাকে ওখানে দেখলাম না তো!

 বুড়ি আমাকে কম জ্বালিয়েছে। এতকাল যে ঝি চোখের মণি ছিল তার কেচ্ছা কাজের লোকের মুখে শোনার পর আর যাওয়ার প্রবৃত্তি হল না। বৃদ্ধা বললেন, বেঁচে থাকতেই যেতাম না ওই মুখের জন্যে, মরে মুখ বন্ধ হয়েছে বলে স্মৃতিটা তো মরেনি।

সায়ন বলল, আস্তে। কথা বলবেন না।

বৃদ্ধা হকচকিয়ে গেলেন, তার মানে?

মনে হচ্ছে ছাদে কেউ এসেছে। ফিসফিসিয়ে বলল সায়ন।

 বৃদ্ধা চারপাশে উদ্বিগ্ন মুখে তাকালেন, কই, কাউকে দেখছি না তো। আর কেউ এখানে ছিল নাকি?

ছিল এবং আছে।

কে? বৃদ্ধার গলায় সন্দেহ।

মানুষ মারা গেলে শ্রাদ্ধ-শান্তি না পাওয়া পর্যন্ত বাড়ি ছেড়ে যায় না, তাই না? আমার মনে হল পাঁড়েজিকে দেখলাম।

বৃদ্ধা দ্রুত সরে এসে সায়নের হাত ধরলেন, ওমা! রাম রাম রাম। এই ভর সন্ধেবেলায়, রাম, রাম, রাম, রাম।

আপনি একটু আগে হেনা কাকিমাকে বললেন এত রাত্তিরে।

ওই হল আরকী! চলো, আমাকে দরজা অবধি পৌঁছে দাও।

দাঁড়ান না। পাঁড়েজি আমাদের কোনও ক্ষতি করবে না। আপনার যদি কোনও কিছু জানতে হচ্ছে করে জেনে নিন।

এই সময় জোরে বাতাস বইল। বৃদ্ধা চোখ বন্ধ করে কাঁপতে লাগলেন।

সায়ন বলল, বড়মা থান পরতেন, একটা সাদা থান দেখতে পাচ্ছি। উনি কেমন আছেন জিজ্ঞাসা করুন।

আমার দরকার নেই। আমি তো এখন মরছি না। বলতে বলতে বৃদ্ধা এগিয়ে যেতেই সায়ন ইচ্ছে করে ওঁর আঁচল ধরে টানল। সঙ্গে সঙ্গে হাঁউমাউ করে চিৎকার করে বসে পড়লেন মহিলা। থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, আমাকে মেরো না, আমাকে মেরো না।

সায়ন ওঁকে তুলে ধরে কোনওমতে দরজায় নিয়ে যেতে পারল। ওকে আঁকড়ে ধরেছিলেন বৃদ্ধা। সায়ন জিজ্ঞাসা করল, আপনি এখন যেতে পারবেন?

তুমি?

আমি একটু ছাদে থাকব। ওঁদের সঙ্গে কথা বলব। সে ছাদে ফিরে এসে মুখ ঘুরিয়ে দেখল বৃদ্ধা আর দাঁড়িয়ে নেই।

হাওয়া বইছে। আজ আকাশ পরিষ্কার থাকায় তারারা জমজমাট। কোথাও কোনও অস্বাভাবিক ব্যাপার নেই। বড়মায়ের অংশ তালাবন্ধ করে দিয়েছে সদুদারা। আতরবালাকে বলা হয়েছে গন্ধরাজের ওখানে থাকতে। এটা নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ঠিক হয়েছে যতদিন সিদ্ধান্ত না নেওয়া হয় ততদিন আতরবালা গন্ধরাজের কাজ করে দিয়ে সেখানে খাওয়া-দাওয়া করবে কিন্তু ব্যাঘ্রবাহিনীর সামনে এসে শোবে। গন্ধরাজকে এই ব্যবস্থা মেনে নিতে হয়েছে।

মানুষ মরে গেলে কি আত্মা হয়ে ঘুরে বেড়ায়? তার মা, বাবা এবং সে যখন মরে যাবে তখন আত্মা হয়ে ঘুরবে? যাদের শ্রাদ্ধ-শান্তি হয় না তাদের আত্মার কী অবস্থা হয়? হিন্দু মুসলমানের অথবা খ্রিস্টানদের আত্মা কি আলাদা নিয়মে চলে? মরে যাওয়ার পরও কি তাদের ধর্মীয় অনুশাসন মানতে হয়? বড়মা ভাল করে হাঁটতে পারতেন না। মরে যাওয়ার পর তাঁর আত্মা কি দ্রুত ছোটাছুটি করতে পারবে? এখন কি পাঁড়েজির সঙ্গে তাঁর দেখা হচ্ছে?

প্রশ্নগুলো মাথায় পাক খাচ্ছিল। সায়ন চারপাশে তাকাল। এই আধা অন্ধকারে সে কাউকেই দেখতে পেল না। আত্মা যদি না থাকবে তাহলে পৃথিবীর সব দেশে ভূতের গল্প বা ঘোস্ট স্টোরিজ লেখা হয়েছে কেন? নাকি মানুষ কল্পনা করতে ভালবাসে বলে এদের সৃষ্টি করেছে। কোথায় যেন পড়েছিল, ঈশ্বর মানুষের সৃষ্টি। মানুষ ছাড়া অন্য কোনও প্রাণী ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুভব করে না। প্রেতের ক্ষেত্রেও তাই। মানুষ ভয় পেতে ভালবাসে। হঠাৎ মনে হল, শুধু ভয় নয়, মানুষ দুঃখ পেতে ভালবাসে। না হলে টুকটুকির বাবা জেনেশুনে দুঃখকে ডেকে আনলেন কেন? ডাক্তার আঙ্কল বলেছিলেন, ভগবানের প্রয়োজন হয়েছিল কারণ তাঁকে কেন্দ্র করে মানুষ একটা শৃঙ্খলা তৈরি করতে চেয়েছিল। যেখানে যুক্তি সমাধান এনে দিতে পারত না সেখানে অসহায় হয়ে না থেকে ঈশ্বরের কাছে আত্মসমর্পণে সুখ পাওয়া যেত।

সায়ন নিশ্বাস ফেলল। এই বৃদ্ধা কী ভয়ঙ্কর। তার হঠাৎ মনে এল এই বাড়িটাও তাই। গন্ধরাজ, আতরবালা, ন’বাবু, এমনকী টুপুরটা পর্যন্ত ওই ভয়ঙ্কর পথে পা বাড়াচ্ছে। নিজেদের বাইরে পৃথিবীর অন্য মানুষের জন্যে এদের কোনও চিন্তা নেই। তার বাবার মনেও ওসব ভাবনা কখনও আসবে না। এই বাড়ি, এই বংশ আর নিজের স্বার্থ, এই নিয়েই সবাই খুশি। ব্যতিক্রম সদানন্দ অথবা কমলেন্দু ঊর্মিলা। কিন্তু সেই ব্যতিক্রম থাকা সত্ত্বেও ওরা এ বাড়ির বাইরের মানুষ নয়। যার সঙ্গে বিয়ে হওয়ার কথা তার বন্ধুকে কাজ পাইয়ে দিয়ে সদানন্দ নিজেকে অনেক মহৎ করেছে কিন্তু এই বংশের বিরুদ্ধে বাইরের কেউ কথা বললে সে সহ্য করতে পারে না। একবারও ভাববে না এই বংশের চেহারাটা ঠিক কী রকম? কমলেন্দু-ঊর্মিলারা সামনে এই বাড়িতে থাকতে চায় গা বাঁচিয়ে। বিদ্রোহ করে এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে পারবে না কখনও।

ঘরে ফিরে এল সে। প্যাসেজের মাঝখানে মায়ের সঙ্গে দেখা হল। নন্দিনী জিজ্ঞাসা করলেন, তুই ছাদে গিয়েছিলি?

হ্যাঁ।

কেন?

 এমনি। তারপর বলল, হেনা কাকিমার সঙ্গে দেখা হল।

ও।

আচ্ছা মা, শাশুড়ি আর স্বামী ওঁর জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে অথচ তোমরা কেউ কিছু বলছ না কেন?

আমরা বললে ওরা শুনবে কেন?

 কেন? এই বংশ এই বাড়ির তো তোমরাও শরিক।

কিন্তু যার যার পরিবার আলাদা।

ধরো তোমার শাশুড়ি বেঁচে আছেন এবং তিনি তোমার ওপর ওইরকম অত্যাচার করছেন। তুমি তো মেনে নিতে, তাই না?

জানি না কী করতাম। যদি এই হত তাহলে কী করতে পারিস বাবা। আয় জলখাবার খাবি। নন্দিনী বললেন।

আমার খেতে ইচ্ছে করছে না। সায়ন বলল।

আশ্চর্য! সেই কখন খেয়েছিস, বিষ্ণুপ্রসাদের নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে।

লুচি আর বেগুনভাজা অনেকদিন পরে খেল সায়ন। বেগুনভাজা খেয়ে বিষ্ণুপ্রসাদ খুব খুশি। নন্দিনী বেগুন ভাজার আগে একটু চিনি ব্যবহার করেন। ফলে স্বাদটা পাল্টে যায়।

বিষ্ণুপ্ৰসাদ চা খেল। সায়ন এক কাপ হরলিকস।

সায়ন জিজ্ঞাসা করল, বাবা খায়নি?

ওর খাওয়া অনেকক্ষণ হয়ে গেছে। যা তোরা ঘরে গিয়ে টিভি দ্যাখ। সাড়ে নটা নাগাদ রাতের খাবার দেব।

এখন যা খেলাম তাতে আমার পেট ভরে গেছে। তুমি বরং বিষ্ণুপ্ৰসাদকে খাইয়ে দিও।

সারারাত না খেয়ে থাকবি?

এইসময় নীচে চিৎকার শুরু হল। কোনও কথা বুঝতে না পেরে সায়ন জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে মা?

নন্দিনী বললেন, ওই প্রমোটারদের লোকের সঙ্গে পাড়ার মস্তানদের ঝামেলা লেগেই রয়েছে।

ওদের কাজের মেয়েটি দরজায় এসে দাঁড়াল, মাগো, কী কাণ্ড! একলাবাবু মায়ের মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিলেন কিন্তু তাকে বাধা দিয়েছে আতরদি। সবাই ওখানে জড়ো হয়েছে। কিন্তু একলাবাবু কারও কথা শুনবেন না, আত্মহত্যা করবেনই।

সায়ন জিজ্ঞাসা করল, একলাবাবু কে?

মেজজ্যাঠা।

ওঃ, গন্ধরাজ। হঠাৎ আত্মহত্যার ইচ্ছে কেন? চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সায়ন। তার খুব কৌতূহল হচ্ছিল।

নন্দিনী আপত্তি করলেন, থাক। তোকে আর ওদিকে যেতে হবে না। মা ব্যাঘ্রবাহিনীর সামনে কেউ আত্মহত্যা করতে পারে না।

কেন? মা কি তাঁর সবকটা হাত বাড়িয়ে থামিয়ে দেবেন? সায়ন হাসল, চলো না, একটু দেখি। নাটক দেখতে তোমার ভাল লাগে না?

নীচের ঠাকুরদালানে তখন উত্তেজনা তুঙ্গে। সমস্ত শরীর পেট্রোলে ভিজিয়ে গন্ধরাজ মায়ের মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। পেট্রোল দ্রুত উবে যাচ্ছিল। তাকে জড়িয়ে ধরে আছেন সমরেন্দ্রনাথ, কী করছ দাদা? আত্মহত্যা মহাপাপ। তুমি মায়ের মূর্তির সামনে আত্মহত্যা করে মহাপাপ করতে চাও?

বেশি জ্ঞান দিস না আমাকে। মহাপাপ! আমার বেঁচে থাকাই তো মহাপাপ। সারাদিন ধরে আমি মাকে ডেকেছি, মা একটা বিহিত করো। পাঁচ পাবলিকের সামনে ওরা আমার ইজ্জত লুটে নিল। আঃ। না, তুই আমাকে ছেড়ে দে। ছেড়ে দে। সমরেন্দ্রনাথের বাঁধন খোলার চেষ্টা করতে লাগলেন গন্ধরাজ। ধ্বস্তাধ্বস্তি চলল।

কমলেন্দু এগিয়ে গেল, কী পাগলামি করছেন আপনি? ওই প্রদীপের আগুন একবার জামায় লাগলে আর দেখতে হবে না!

ও! আমি পাগলামি করছি। আতরবালাকে জড়িয়ে আমার নামে যে কুৎসা রটাল তার কোনও প্রমাণ এরা দিতে পারবে? বড়মায়ের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে আমি ওঁর ঘরে গিয়েছিলাম চুরি করতে? তোরা কেউ আমাকে সেখানে দেখেছিস? প্রমাণ চেয়েছিস ওদের কাছে?

ন’বাবু বললেন, মাথা গরম করে লাভ নেই। যা হবার তা হয়ে গেছে। বাড়িতে এখন শোকের ছায়া!

রাখো শোক। আমি কারও সাতে নেই পাঁচে নেই, কারও পাকা ধানে মই দিই না। বিয়ে-থা করিনি, একা থাকি, আতর মাখি। তাতে তো তোদের সবার বুক জ্বলে। ঠিক আছে বাবা, আমায় ছেড়ে দে, আমি মায়ের সামনে আত্মাহুতি দিই। সব ল্যাটা চুকে যাক।

কমলেন্দু বলল, ঠিক আছে, আপনার অভিযোগগুলো নিয়ে আমরা অশৌচ শেষ হলে আলোচনায় বসব।

নো। নেভার। চিৎকার করলেন গন্ধরাজ, হয় এখনই নয় কখনও নয়। এ বাড়ির ছেলে হয়ে ছোকরা মিস্ত্রিগিরি করে তা তোরা মেনে নিয়েছিস। বংশের মুখে কালি দিচ্ছে। তার এত সাহস আমার গায়ে হাত তোলার কথা বলে। ডাক ওকে। ডাক। গন্ধরাজ এবার স্থির।

সদানন্দ একটু দূরে ছিল, কমলেন্দু বলল, আফটার অল ওঁর বয়স হয়েছে। অশৌচের সময় আর ঝামেলা কোরো না।

সদানন্দ কয়েক পা এগোতেই গন্ধরাজ বলল, অ্যাই, তুই আমাকে চুরি করতে দেখেছিস? বল, সবার সামনে বল।

সদানন্দ চুপ করে রইল।

সমরেন্দ্রনাথ বললেন, সদু, তোমার কাছে তো প্রমাণ নেই। মানুষটা আহত হয়েছে, ক্ষমা চেয়ে নাও।

গন্ধরাজ চিৎকার করল, ক্ষমা? ওখান থেকে ক্ষমা চাইলে তো হবে না। এখানে এসে আমার পা ধরে বলতে হবে ক্ষমা চাইছি।

এবার সকলেই সদানন্দকে অনুরোধ করতে লাগল গন্ধরাজ যা বলছেন তাই করতে। বোঝা গেল সম্পূর্ণ অনিচ্ছায় সদানন্দ এগোল। তারপর গন্ধরাজের পা ছুঁয়ে বলল, ক্ষমা চাইছি।

গন্ধরাজ মাথা নাড়লেন, অদ্ধেক হল। সে ছোঁড়া কোথায়?

সদানন্দ উঠে ঠাকুরদালান থেকে বেরিয়ে গেল। সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে ঘটনাটা দেখছিল সায়ন। সদানন্দ যে এভাবে ক্ষমা চাইবে তা সে কল্পনা করতে পারেনি। সে দেখল তার বাবা হাতজোড় করে এগিয়ে গেল, দাদা, তুমি আর রাগ কোরো না।

না না। রাগ তো আমি করিনি। অপমানে জ্বলে মরছি। তোর ছেলে যার এখনও দুধের দাঁত ভাঙেনি সে আমাকে…আমাকে…উঃ!

আমি ওর হয়ে ক্ষমা চাইছি দাদা।

তুই বলেছিলি ব্লাড ক্যানসারের পেশেন্ট, তাই কিছু বলিনি আমি। কিন্তু এত সাহস পেল কী করে? শুনলাম আবার পাহাড় থেকে স্যাঙাত নিয়ে এসেছে সঙ্গে। এ বংশের কুলাঙ্গার।

ঠিক আছে তুমি ক্ষমা করে দাও। জামা খোলো।

হ্যাঁ, আমি ওর বাপের বড়, ক্ষমা না করে উপায় কী, কিন্তু তুই ক্ষমা চাইলে তো হবে না। তাকে এখানে এসে ক্ষমা চাইতে হবে।

সায়ন দেখল বাবা মাথা নেড়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে আসছে। সে নীচে এল। তারপর স্পষ্ট গলায় বলল, আমি কোনও অন্যায় করিনি। তাই ক্ষমা চাওয়ার কোনও প্রশ্ন ওঠে না।

সায়নের বাবা হকচকিয়ে গেলেন। গন্ধরাজ সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলেন, দেখলি কী আস্পর্ধা।

আমি তোমাকে বলছি ক্ষমা চাইতে। বাবা বললেন।

তুমি অন্যায় কিছু করতে বললে আমাকে সেটা করতে হবে!

ন্যায় অন্যায় বোঝার বয়স তোমার হয়নি। ধমকে উঠল বাবা।

নিশ্চয় হয়েছে। আমি আর ছেলেমানুষ নই। আমি আর সদুদা ওকে আতরবালার সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে টাকাকড়ি গয়নাগাঁটি খুঁজতে দেখেছি। আমরা দরজায় শেকল তুলে দিয়েছিলাম কিন্তু ভাবিনি জানলা দিয়ে পালিয়ে যেতে পারবে। ওই দ্যাখো, ওর পায়ে ব্যান্ডেজ, নিশ্চয়ই কেটে গেছে পালিয়ে যাওয়ার সময়। সায়ন বলল।

কিন্তু সদু তো ক্ষমা চেয়েছে৷ কমলেন্দু বলল।

দেখলাম। এ বাড়িতে থাকতে হবে বলে সবার কথা মেনে নিয়েছে।

গন্ধরাজ চেঁচাল, কেন? তুই এ বাড়িতে থাকবি না?

এরপর এ বাড়িতে থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই।

সানু। চিৎকার করে উঠল বাবা, তোমাকে আমি কালই পাহাড়ে পাঠিয়ে দেব। অসুস্থ বলে যা ইচ্ছে বলতে পারো না তুমি?

আমি যা ইচ্ছে তাই বলছি না। তুমি যদি সত্যি আমাকে পাহাড়ে যেতে দাও তাহলে আমি খুশি হব। এই লোকটা কখনওই আত্মহত্যা করত না। ও প্ল্যান করে তোমাদের ব্ল্যাকমেল করছে। পাহাড়ে আর যে ধরনের মানুষ থাক এরকম অমানুষ থাকে না।

সায়ন এগিয়ে গেল গন্ধরাজের দিকে।

গন্ধরাজের চোখ ছোট হয়ে এল। সায়ন মা ব্যাঘ্রবাহিনীর পাশে গিয়ে জ্বলন্ত প্রদীপ তুলে নিতেই গন্ধরাজের মনে হল মায়ের শরীর জ্বলছে। আর সেই জ্বলন্ত শরীর তার দিকে এগিয়ে আসছে। প্রচণ্ড আর্তনাদ করে গন্ধরাজ দৌড়োল সিঁড়ির দিকে।

সায়নের বাবা ছুটে এসে ছেলের হাত থেকে প্রদীপ কেড়ে নিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, কী করছিলে তুমি? পুড়িয়ে মারছিলে?

না। কিন্তু তোমরা দেখলে প্রদীপ হাতে নিতেই লোকটা কেমন ভয় পেয়ে গেল। যাক, আমরা কাল দুপুরের ট্রেনে ফিরে যেতে চাই।

লম্বা লম্বা পা ফেলে ভিড় কাটিয়ে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতেই ঊর্মিলা তাকে জড়িয়ে ধরল। সেখানে মেয়েরা জড়ো হয়েছিল। ঊর্মিলার পাশে দাঁড়িয়ে হেনা কাকিমা। দু হাতে তার মুখ ধরে হেনা কাকিমা বললেন, তুই আমাকে শক্তি দিয়ে গেলি রে সানু। আমি আর ভয় পাব না।

শুধু নন্দিনী আঁচলের প্রান্ত দাঁতে চেপে পাথরের মতো দাঁড়িয়েছিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *