৩১-৩২. নিরাময়ের সামনে গাড়ি

নিরাময়ের সামনে গাড়ি থামিয়ে ডাক্তার তামাং হাসলেন, ইয়েস মাই বয়, কিছু বলবে এবার? খারাপ চালালাম।

ওঁর গলার স্বর তখনও জড়ানো। সদানন্দ পেছনে বসেছিল, চোখ বড় করে শুনল। উত্তরের জন্যে অপেক্ষা না করে ডাক্তার তামাং ইশারা করলেন নেমে যেতে।

ওরা নামতেই ভদ্রলোক বিপদজ্জনকভাবে গাড়ি ঘুরিয়ে নীচে নেমে গেলেন। সদানন্দ জিজ্ঞাসা করল, লোকটা যে মাতাল। এখনই অ্যাকসিডেন্ট করবে। কোত্থেকে এলি তুই?

সায়ন বলল, না, অ্যাকসিডেন্ট করবেন না। এসো, ভেতরে এসো।

মিসেস অ্যান্টনি গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন প্যাসেজে। বললেন, তোমার লাঞ্চ টাইম হয়ে গেছে সায়ন। ডাক্তারবাবু শুনলে খুশি হবেন না।

সায়ন সদানন্দকে জিজ্ঞাসা করল, কোথায় উঠেছ তুমি? ট্যুরিস্ট লজে?

দুর! ওখানে যা চার্জ তা দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি একটা ছোট হোটেলে জিনিসপত্র রেখেছি। তুই যা খেয়ে নে।

তুমি খেয়েছ?

আমার স্নান-খাওয়া হয়ে গিয়েছে।

দোতলায় উঠে নিজের ঘরের দিকে যেতে থমকে গেল সায়ন। দূরে কঙ্কাবতী দাঁড়িয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে তাকিয়ে আছে। সে ওর কাছে গেল, শোনো, তোমার মা আজ বিকেলে আসবেন?

কেন? কঙ্কাবতী তাকাল।

আগে বলো আসবেন কি না নইলে খবর পাঠাতে হবে।

মা তো রোজ বিকেলে আসে।

বেশ। তা হলে ওঁকে বলবে কাল সকালে যেন ডাক্তার তামাংয়ের সঙ্গে দেখা করেন। চেম্বারে না, বাড়িতে। বুঝলে?

কেন?

ডাক্তার তামাংয়ের সঙ্গে ওঁর চাকরির ব্যাপারে কথা হয়েছে।

 উনি এসেছিলেন?

না। আমি গিয়েছিলাম।

সে কী? সে তো অনেক দূর। কার সঙ্গে গেলে?

কার সঙ্গে আবার। হেঁটেই গিয়েছিলাম। হেসে ফিরে গেল সায়ন। ও বুঝতে পারছিল কঙ্কাবতী অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ঘরে ঢুকে আয়নায় নিজেকে দেখল সে। এই কদিন সে যেভাবে হাঁটাহাঁটি করেছে মাসখানেক আগেও তা করার কথা ভাবতে পারত না। তার শরীরের রক্তে মৃত্যুকণা ছড়িয়ে আছে। সুযোগ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে। কিন্তু এখনও তার শরীর খারাপ লাগছে না। যতক্ষণ না করে ততক্ষণ অসুখের কথা চিন্তা করে লাভ কী।

নিরাময়ের বাইরে দাঁড়িয়ে সদানন্দ সিগারেট খাচ্ছিল। সায়নকে দেখে বলল, ফ্যান্টাস্টিক জায়গা। তবে দু-চারদিন থাকা যায় তার বেশি হলে মরে যাব।

কেন? সায়ন ওর বলার ভঙ্গিতে হেসে ফেলল।

আড্ডা মারার লোক নেই, সিনেমা থিয়েটার নেই, আমি মুখ বন্ধ করে বসে থাকতে পারি না। তা আজ যেতে পারবি? তুই তো ফিট হয়ে গেছিস।

আজ কী করে যাব? ডাক্তার আঙ্কলকে বলতে হবে। উনি পরীক্ষা করে দেখে তবে অনুমতি দেবেন।

তোকে দেখে মনেই হচ্ছে না কোনও অসুখ আছে। এর আগেরবার যখন এসেছিলাম তখন দেখেছিলাম তোর মুখচোখ কেমন ফ্যাকাশে। এখন সেই ভাবটা নেই। দ্যাখ না বলে, যদি ছেড়ে দেয়।

তোমার ফেরার টিকিট কাটা আছে?

দুর! পয়সা দিলে সব ম্যানেজ হয়ে যাবে।

ওইভাবে আমি যাব না।

 দুর বোকা। তুই চাইলেই বিশ-পঁচিশ দিনের মধ্যে রিজার্ভেশন পাবি নাকি? সব ফুল। ও শালা কম্পুটার হওয়ার পর আরও বেশি ফুল হচ্ছে। এই দ্যাখ না আসার আগের দিন টিকিট কাটতে গিয়ে শুনলাম একশো বাইশ নম্বর ওয়েটিং লিস্টে থাকতে হবে। পঞ্চাশ টাকা দক্ষিণা দিয়ে ট্রেনে উঠে দেখলাম ওয়ান থার্ড বার্থ খালি পড়ে আছে। বোঝ?

মাথা নাড়ল সায়ন, বললাম তো ওইভাবে টাকা দিয়ে আমি যাব না। তার চেয়ে আনরিজার্ভ কম্পার্টমেন্টে চলো, রাজি আছি।

তোকে পাগলা মশায় কামড়েছে। ওখানে কেউ উঠতে পারে? সারারাত সোজা হয়ে বসে থাকতে হবে যদি বসার জায়গা পাস। তুই কেন, আমারই শরীর খারাপ হয়ে যাবে। তোর কি আদর্শে লাগছে?

অত বড় কথা আমি জানি না। আমি ওভাবে যাব না।

শোন, সিগারেটের শেষটুকু ছুঁড়ে ফেলল সদানন্দ, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হয় নইলে ব্যাকডেটেড হয়ে পস্তাতে হবে। পঞ্চাশ সালে রায়বাড়ির যা নিয়ম ছিল তা এখন নেই। তখন আমাকে গাড়ির ব্যবসা করতে দেখলে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হত। বড়মায়ের নাতি তার বউকে আমেরিকায় নিয়ে যেতে পারত না। কিন্তু এখন সেটা সম্ভব হয়েছে। অন্ধদের দেশে যে চোখ খুলে চলবে সে অসহায় হয়ে পড়বে। তার চেয়ে চোখ বন্ধ করে অন্ধ সেজে থাকলে অনেক স্বস্তি। এখন কেউ ঘুষ বল বা বকশিস বল, না পেলে কোনও কাজ করে না। এটা যাতে পাবলিককে দিতে হয় তাই সর্বত্র গেঁড়াকলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মানুষও অভ্যস্ত হয়ে গেছে এই সিস্টেমে। বুঝলি?

আমি তো অভ্যস্ত হইনি।

যাচ্চলে! তুই হঠাৎ এরকম কথা বলতে শুরু করলি? তোর মধ্যে দেখছি বেশ চেঞ্জ এসেছে। সানু, তুই বড় হয়ে গেছিস।

আর কতকাল ছোট থাকব বলো। সায়ন বলল, ডাক্তার আঙ্কলকে বললে উনি চেষ্টা করতে পারেন। ওঁর অনেক জানাশোনা আছে।

ও। তাহলে তো কথাই নেই।

মা ভাল আছে?

 হ্যাঁ। সবাই এখন বেশ উত্তেজিত।

কেন?

ওই পুরনো ভাঙা বাড়িতে আর থাকতে হবে না। আরে যতই বিশাল রায়বাড়িকে দেখতে লাগুক ভেতরটা তো ঝাঁঝরা। সেই আদ্যিকালের ব্যবস্থা এখন আর চলে না। বাইরের লোক এসে বাথরুমে যেতে চাইলে খারাপ লাগে। কোনও ভদ্রলোকের বাড়িতে আজকাল চৌবাচ্চা থাকে না।

আমরা কোথায় যাব?

 তোকে তোর মা লেখেনি? প্রমোটারকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে দায়িত্ব। যেখানে পরীরা ছিল সেখানে এর মধ্যেই প্ল্যান স্যাংশন করিয়ে মাটি খোঁড়া শুরু হয়ে গেছে। ওঃ, তা নিয়ে কী ঝামেলা। এ পার্টি সকালে বোম ফেলে তো ও পার্টি বিকেলে।

বোম ফেলেছে? আমাদের বাড়িতে?

 অবাক হওয়ার কিছু নেই। এটা এখন রেওয়াজ। কেউ বাড়ি বানাতে ইট ফেললেই বোম পড়ছে। পার্টির ছেলেদের কাছ থেকে ইট বালি সিমেন্ট নিতে হবে। তার জন্যে অ্যাডভান্স দিতে হবে তাদের। তিন চারটে দল একই ডিম্যান্ড করে। না দিলে টাকা দাও। তুমি বাড়ি বানাবে আর আমরা চেয়ে চেয়ে দেখব? আমরা হলে পাগল হয়ে যেতাম। প্রমোটাররা জানে কী করতে হবে।

কী করে ওরা?

 যারা বোম ফেলে তাদের দাদাদের টাইট দেয়। একজন প্রমোটারকে লাভের হিসেব করতে হয় পার্টির দাদা থেকে ছোট ভাই, লোকাল থানার জন্যে বাজেট রেখে। দাদারা ভাইদের পাইয়ে দেয় নইলে পার্টি থাকবে না। দাদারাও তাদের অংশ নিয়ে চুপ করে যায়। যতদিন উদ্বোধনী না হবে পুলিশ পাহারা দেবে যাতে নতুন কোনও পার্টি হামলা না করে।

তারপর?

তারপর আর কী। বলছে তো বছরখানেকের মধ্যে বাড়ি কমপ্লিট হয়ে যাবে। তখন আমরা ওখানে উঠে যাব। কে কোন ফ্ল্যাট পাবে তা লটারি করে ঠিক হবে। মা সিংহবাহিনীর জন্যে নীচে হলঘর হচ্ছে।

এতে প্রমোটারের কী লাভ হচ্ছে?

বাঃ! বাকি জমিটা। অত বিশাল ফাঁকা জমিতে অন্তত তিন তিনটে পাঁচতলা বিল্ডিং তুলবে লোকটা। মালে মালাকার হয়ে যাবে ও। আমাদের বাড়িটা ভেঙে কত কী পাবে।

সবাই রাজি হয়েছে?

হবে না। ফ্ল্যাট প্লাস মাল পাবে। বাকি জীবনটা ওই দিয়ে কোনওমতে চালিয়ে নেওয়ার স্বপ্ন দেখছে সবাই।

পাঁড়েজি? পাঁড়েজি কোথায় যাবে?

যাঃ বাবা। এত লোক থাকতে ওর কথা মনে পড়ল?

বাঃ ও তো বাবার জন্মের আগে থেকে রায়বাড়িতে আছে।

থাকবে কোথাও। ওকে নিয়ে এখনও কোনও আলোচনা হয়নি। যা, ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে আয়। আমি এখানে অপেক্ষা করছি। সদানন্দ বলল।

ভেতরে গিয়ে ভিজিটার্স রুমে বসবে চলো।

 না রে। ওখানে গেলে ওষুধ ওষুধ গন্ধ নাকে আসে, শরীর খারাপ হয়ে যায়।

ডাক্তার আঙ্কল অফিসঘরে ছিলেন। ওকে দরজায় দেখে বললেন, কী ব্যাপার? শরীর কেমন লাগছে?

ভাল।

বাজার অবধি হেঁটে গিয়েছিলে?

হ্যাঁ।

শুনলাম তোমাকে নিয়ে নাকি খুব হইচই হয়েছে?

 লোকে ভিড় করেছিল।

তুমি কি ব্যাপারটাকে প্রশ্রয় দিতে চাও?

না।

গুড। বোসো।

সায়ন বসল, কলকাতা থেকে আমার এক দুসম্পর্কের দাদা এসেছেন। মা পাঠিয়েছেন ওকে। আমার যাওয়ার কথা ছিল–।

ও। হ্যাঁ। তাই তো। কবে যাবে?

 দাদা আজই ফিরতে চাইছেন।

আজই?

হ্যাঁ। আমি বলেছি আপনার সঙ্গে কথা বলব।

বেশ তো। তুমি যদি যেতে চাও তো যাও। তোমার তো কিছুদিনের জন্যে যাওয়ার কথা ছিল। এখন তোমার শরীর বেশ ভাল। ডাক্তার উঠে একটা রেজিস্টার বের করলেন, সাধারণত পঁচিশ থেকে তিরিশ দিনের মধ্যে তুমি আবার অসুস্থ হয়ে পড়তে। সময়টা এসে গেছে কিন্তু তোমার মধ্যে কোনও অসুস্থতার লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি না। আমি একবার ব্লডটা দেখে নিচ্ছি। যদি ঠিক থাকে যেতে পারো। আর যদি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড় তাহলে কী কী করতে হবে তা তুমি জানো।

কিন্তু আমার একটা অসুবিধে হচ্ছে।

কী রকম?

উনি ফেরার টিকিট করেননি। বলছেন, এক্সট্রা টাকা দিয়ে বার্থ নিয়ে নেবেন। ওভাবে আমি যাব না।

ডাক্তার হাসলেন, তা হলে?

আপনি যদি টিকিটের ব্যবস্থা করে দেন তা হলেই যাওয়া সম্ভব।

দ্যাখো, আজকের টিকিট এখানে পাওয়া যাবে না। আমি একটা চিঠি লিখে দিতে পারি নিউ জলপাইগুড়ির এরিয়া অফিসারকে। তাঁর হাতে যদি ভি আই পি কোটায় বার্থ থেকে থাকে তা হলে পেতে পারো। কিন্তু একটা ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে। ওটা ফুল হয়ে গেলে বিপদে পড়বে।

তা হলে?

তোমরা কাল পরশু যেতে পারো।

ঠিক আছে।

ডাক্তার আঙ্কল ভেতরে গিয়ে সায়নের রক্ত নিলেন পরীক্ষা করার জন্যে। এখন এসবে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে সায়ন। সে বাইরে বেরিয়ে এল।

সদানন্দ জিজ্ঞাসা করল, কী বলল?

আজ যাওয়া যাবে না। কাল বা পরশু চলো।

কেন খামোকা আমাকে বসিয়ে রাখবি।

তা হলে তুমি চলে যাও। আমি একা যেতে পারব।

তুই একা যাবি? পাগল? তোর মা আমাকে আস্ত রাখবে না।

আমি এখন অনেকটা সুস্থ এবং বাচ্চা নই। তোমার থাকতে যখন অসুবিধে হচ্ছে তখন তুমি চলে যাও।

সদানন্দ চিন্তায় পড়ল, তা হয় না। ঠিক আছে, কালই যাব।

এই সময় একটা মারুতি ভ্যান নীচ থেকে উঠে এল। সায়ন দেখল ভ্যানটা নিরাময়ের সামনে থামল। দুক্ষন নেপালি ভদ্রলোক ভ্যান থেকে নেমে সোজা গেট পেরিয়ে ভেতরে চলে গেল।

সদানন্দ জিজ্ঞাসা করল, তোদের এখানে ঝামেলা হয়েছিল?

 কেন?

 জানলার কাঁচগুলো সব ভাঙা দেখছি। পাথর পড়ে আছে।

হ্যাঁ।

নেপালিরা ঝামেলা করেছিল?

নেপালিরা করেনি। যেমন কলকাতার সব বাঙালি আমাদের বাড়ির সামনে গিয়ে বোম ফেলেনি। কয়েকজন রাজনৈতিক উঠতি নেতা কাজটা করেছে।

সদানন্দ বলল, এখানে আর বাঙালিরা থাকতে পারবে না। অথচ শিলিগুড়ি থেকে ওপরে আসার রাস্তাগুলো বন্ধ করে দিলে এরা খেতে পাবে না। জানিস?

জানি না। তবে কলকাতার সব জায়গায় বাঙালিরা থাকতে পারে?

মানে?

বড়বাজারে গেলে একজন সাধারণ বাঙালি বাড়ি ভাড়া পাবে? আমি কোথায় যেন পড়ছিলাম রাসবিহারী অ্যাভিনিউর আশেপাশে বাঙালি বাড়িওয়ালা সাউথ ইন্ডিয়ান ভাড়াটে বেশি পছন্দ করে, বাঙালিকে নয়। মিথ্যে কথা?

সদানন্দ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল। এই সময় ছোটবাহাদুর বেরিয়ে এসে ডাকল, সায়নবাবু, ডাকদার সাহাব ডাকছেন।

সায়ন ভেতরে চলে এল।

অফিসঘরে ডাক্তার আঙ্কলের সামনে ভদ্রলোক দুজন বসে আছেন। ওকে দেখামাত্রই ওঁরা উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন করমর্দনের জন্যে। সায়ন এসবে অভ্যস্ত নয়। সে বেশ হকচকিয়ে হাত স্পর্শ করল।

ডাক্তার আঙ্কল বললেন, বোসো।

সায়ন বসলে তিনি বললেন, এঁরা তোমার সঙ্গে আলাপ করতে চান বলে ডেকে আনলাম। ইনি মিস্টার সুব্বা আর ইনি মিস্টার প্রধান।

কী ব্যাপার আমি বুঝতে পারছি না।

মিস্টার প্রধান বললেন, আপনাদের ওপর যে বর্বর আক্রমণ করা হয়েছে তার জন্যে আমরা লজ্জিত। আমরা শুনেছি আপনি এর প্রতিবাদ করতে গিয়েছিলেন। আগামীকাল এর প্রতিবাদে আমরা হরতাল ডাকতে চাই।

কেন?

আমরা প্রতিবাদ জানাতে চাই। মিস্টার সুব্বা বললেন।

তাতে কী লাভ হবে? বরং ক্ষতি হবে অনেক। সাধারণ মানুষ কাজ করতে পারবেন না বলে রোজগার বন্ধ হবে, গাড়ি না চললে অনেক ক্ষতি হবে।

তা হবে। কিন্তু প্রতিবাদ জানানো তো উচিত।

একদিন হরতাল করলে যারা অন্যায় করেছিল তারা নিজেদের শুধরে ফেলবে বলে আমার মনে হয় না। সায়ন বলল।

ডাক্তার আঙ্কল মাথা নাড়লেন, সায়ন ঠিক বলছে।

সায়ন বলল, এর চেয়ে আপনারা যদি ওদের বোঝান তা হলে বেশি কাজ হবে। আপনাদের কিছু ছেলে অন্যায় করেছে বলে সাধারণ মানুষকে শাস্তি দেবেন কেন?

মিস্টার প্রধান বললেন, ওরা আমাদের ছেলে নয়। এই পাহাড়ে আমরা আন্দোলন শুরু করেছিলাম চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে। এখন তো ওঁর কথাবার্তায় কোনও মিল নেই। কিছুদিন আগেও উনি ওয়েস্টবেঙ্গল গভর্নমেন্টকে উপেক্ষা করে সেন্টারের সঙ্গে ভাব জমিয়েছিলেন। যেই বি জে পি পাওয়ারে এল অমনি তিনি ওয়েস্টবেঙ্গল গভর্নমেন্টের সঙ্গে দোস্তি করছেন। লাস্ট ইলেকশনে উনি সাবোটাজ করেছেন বলে আমাদের কোনও ক্যান্ডিডেট দিল্লিতে গেল না। ধীরে ধীরে পাবলিক ওঁর পাশ থেকে সরে যাচ্ছে। উনি এখন আমাদের ইস্যুটা ইন্টারন্যাশনাল কোর্টে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। পাবলিককে বোঝাবার চেষ্টা করছেন ওদের জন্যে লড়ে যাচ্ছেন কিন্তু মামলা করা মানে দীর্ঘকালের জন্যে ইস্যুটাকে ঝুলিয়ে দেওয়া এটা সাধারণ মানুষ বুঝে গেছে। আর এই কারণেই নীচেরতলার ক্যাডাররা ওঁর কথা শুনছে না। যে যার ধান্দা মেটাতে ক্ষমতাকে এক্সপ্লয়েট করছে। এর প্রতিবাদ করা দরকার।

সায়ন কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করছিল। সে জিজ্ঞাসা করল, আপনারা কি এখন এক দলের সদস্য নন?

না। আমাদের সংগঠন এখন আলাদা।

 ডাক্তার আঙ্কল বললেন, মিস্টার প্রধান, একটু আগেও আমি আপনাকে বলেছি এসবের মধ্যে আমি নেই। কোনওরকম রাজনৈতিক ঝামেলায় নিরাময়কে নিয়ে যেতে আমি চাই না। এই পাহাড়ে আমি নিরাময় তৈরি করেছিলাম সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক কারণে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক আছে আমাদের। চেয়ারম্যান এবং আপনাদের মধ্যে যে বিরোধ তাতে আমাদের জড়াবেন না।

মিস্টার সুব্বা বললেন, দেখুন আপনি পাহাড়ি নন কিন্তু এতকাল এখানে থাকায় পাহাড়ের মানুষ হয়ে গিয়েছেন। আমরা আপনাকে আমাদের থেকে আলাদা বলে মনে করি না। এই যে রাজনৈতিক সমস্যা এটা তো আপনারও সমস্যা। তাই না?

যখন ভোট দিতে যাব তখন এ নিয়ে ভাবব। আমার কথা আপনাদের স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছি। ডাক্তার আঙ্কল বললেন।

তার মানে আপনাদের ওপর যে হামলা হল তা মেনে নিচ্ছেন?

হ্যাঁ। এটা কলকাতা বর্ধমান অথবা ডায়মন্ডহারবারেও হতে পারত। তা ছাড়া আমাকে আরও বড় কিছু নিয়ে ভাবতে হচ্ছে।

যেমন?

ক্রমশ অভিভাবকরা আমার ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলছেন। তাঁরা একের পর এক পেশেন্টকে নিয়ে যাচ্ছেন। তা ছাড়া আমিও তো বাইরের হামলা থেকে তাদের বাঁচাবার প্রতিশ্রুতি দিতে পারছি না। অসুখের বিরুদ্ধে আমি লড়াই করতে প্রস্তুত কিন্তু অসভ্যতার বিরুদ্ধে কিছু করতে অক্ষম। কারণ পুলিশ আমার পাশে এসে দাঁড়াবে না। তাই ভাবছি নিরাময় বন্ধ করে দেব। ডাক্তার আঙ্কলের গলা ধরে এল।

সে কী? মিস্টার সুব্বা অবাক হলেন।

আমি ভাবছি। সিদ্ধান্ত এখনও নিইনি। যাক গে, ওর সঙ্গে আপনাদের আলাপ হল। সেদিন ও যা করেছে তা মানুষেরই করা উচিত, আমি খুশি।

হঠাৎ মিস্টার সুব্বা জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি আজ শহরে গিয়েছিলেন?

সায়ন বলল, হ্যাঁ।

ডক্টর তামাং আপনাকে ওদের সঙ্গে দেখা না করতে দিয়ে পেছনের পথ দিয়ে বের করে এনেছেন?

এত ভিড় হয়েছিল যে ও-ছাড়া অন্য উপায় ছিল না।

কেন অত ভিড় হয়েছিল?

আমি জানি না।

এখানকার মানুষ আপনাকে ভালবেসেছে। এখন ওদের পাশে দাঁড়ানো আপনার কর্তব্য। দেখুন, আমরা চাই পাহাড়ে শান্তি ফিরে আসুক। কিন্তু আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে সেটা পেতে চাই না। আর এই ব্যাপারে আপনার সাহায্য চাই। আগামীকাল এখানে হরতাল ডাকতে চেয়েছি আমরা। আজ বিকেলে যদি বাজারের ওখানে মিটিং ডাকা যায় এবং সেখানে আপনি ওই অত্যাচারের বর্ণনা করেন তা হলে আগামীকাল এখানকার পাহাড়ে আর একটা নতুন শক্তির জন্ম হবে। এই শক্তি শান্তির শক্তি।

ডাক্তার আঙ্কল বললেন, আমি আপনাদের মনে করিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছি। যার সঙ্গে আপনারা কথা বলছেন সে নিরাময়ের একজন পেশেন্ট, কোনও রাজনৈতিক নেতা নয়। রাজনীতি করতে সে এখানে আসেনি।

অত্যাচারের প্রতিবাদ করাকে কি রাজনীতি বলবেন ডক্টর?

 এক্ষেত্রে যেভাবে আপনারা ভাবছেন তাতে অন্য কিছু বলা যায় না।

বেশ। আগামীকাল আমরা হরতাল ডাকছি না। কিন্তু প্রতিবাদ মিছিল তো বের করতে পারি? তাতে নিশ্চয়ই আপনারা যোগ দেবেন?

ডাক্তার আঙ্কল বললেন, সমস্ত দল মিলে করলে নিশ্চয়ই যোগ দেব।

মিস্টার প্রধান হাসলেন, ক্ষমতায় যারা আছে তারা কী করে নিজেদের বিরুদ্ধে মিছিল করবে ডক্টর?

সায়ন বলল, আমি কি এখন যেতে পারি?

মিস্টার সুব্বা বললেন, তা হলে?

আমি এখনই কিছু বলতে পারছি না। সায়ন উঠে দাঁড়াল।

ডাক্তার আঙ্কল বললেন, সেদিনের ঘটনাটা বিস্তারিতভাবে লিখে চেয়ারম্যানকে জানিয়েছি, কপি দিয়েছি থানায়, এস পি-কে। ওঁরা কী ব্যবস্থা নিচ্ছেন না জানা পর্যন্ত আমি কিছুই করতে পারি না।

সায়নের পেছন পেছন ওরা বেরিয়ে এলেন বাইরে। ঘুরে ঘুরে সেদিনের ভাঙচুর দেখলেন। হঠাৎ মিস্টার প্রধান জিজ্ঞাসা করলেন, একটা কথা, আপনি কি ক্রিশ্চান?

না। জন্মসূত্রে আমি হিন্দু।

 তা হলে লোকে যেশাসের সঙ্গে আপনাকে মেলায় কেন?

যারা মেলায় তাদের জিজ্ঞাসা করুন। আমি একজন সাধারণ মানুষ। আমার রক্তপাত হয়, আমি মির‍্যাকল করতে পারি না। আপনারা যদি ওই কারণে আমার কাছে এসে থাকেন, তা হলে ভুল করেছেন।

সায়নের কথায় হাসলেন ওরা। তারপর ভ্যানে চেপে ফিরে গেলেন।

সদানন্দ বসেছিল পাথরের ওপর। সিগারেট খাচ্ছিল।

সায়ন ওর পাশে গিয়ে বসল, তুমি বড্ড বেশি সিগারেট খাচ্ছ।

টেনশনে। বুঝলি।

কীসের টেনশন? তোমাকে তো বললাম আজ চলে যেতে পারো।

দুর। ওসব নয়। আমার বিয়ে জানিস?

সত্যি? কবে? হঠাৎ সব ভুলে গেল সায়ন।

 সদানন্দর মুখটা আচমকা পাল্টে গিয়েছিল। বেশ লাজুক লাজুক দেখাচ্ছিল তাকে। বলল, মা খুব ধরেছে। একা থাকতে পারছে না। বড়মাও বললেন। আমি অবশ্য চেয়েছিলাম নতুন বাড়িতে গিয়ে যা করার করা যাবে। কিন্তু আমার কথা কে শুনবে বল!

তোমার বিয়ে কবে?

এখনও দিন ঠিক হয়নি। তবে মাস তিনেকের মধ্যেই হয়ে যাবে।

যাঃ। তা হলে তোমার বিয়েতে থাকা হবে না।

কেন?

আমি কলকাতায় গিয়ে বেশিদিন তো থাকতে পারব না।

সদানন্দ বলল, আমি বুঝতে পারছি না তোর আর এখানে ফিরে আসতে হবে কেন? তুই তো বেশ সুস্থ। যেসব ওষুধ এখানে খাচ্ছিস তাই যদি ওখানে খাস তা হলে কোনও সমস্যা থাকবে না।

সায়ন হাসল, এখান থেকে চলে গেলেই আমি আবার অসুস্থ হয়ে পড়ব। আচ্ছা, এমন করলে হয় না, এখন না গিয়ে তোমার বিয়ের সময় যদি যাই! তিন মাসের মধ্যে তো বলছ!

তোর মা যে এখন যাবি বলে আশা করে আছে।

আমি মাকে চিঠি দিচ্ছি। এখন ওখানে গিয়ে তো আমার কিছু করার নেই, বাড়িতেই বসে থাকতে হবে। তোমার বিয়ের সময় গেলে খুব মজা করতে পারব। হ্যাঁ, সেটাই ভাল হবে।

সদানন্দকে চিন্তিত দেখাচ্ছিল। সে এসেছে সায়নকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। একা ফিরে গেলে নিশ্চয়ই কথা শুনতে হবে। আবার সায়ন যে কথা বলছে তারও যুক্তি আছে। সে মাথা নাড়ল, না, তুই আমার সঙ্গে চল। কদিন থেকে ফিরে আসতে হলে ফিরে আসিস। তারপর আবার বিয়ের আগে যাবি।

এই সময় বিষ্ণুপ্ৰসাদকে দেখা গেল ওপর থেকে দ্রুত নেমে আসতে। সায়ন চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কোথায় যাচ্ছ?

থানায়। বিষ্ণুপ্ৰসাদ দাঁড়াল।

কোনও সমস্যা হয়েছে?

হ্যাঁ। ম্যাথুজের কাছ থেকে মাংস কেড়ে নিয়ে মারধর করেছে ওরা। বিষ্ণুপ্ৰসাদ বলল।

 কারা করেছে?

এখানে যারা করে। ওরা ম্যাথুজের কাছে টাকা চেয়েছিল চাঁদা হিসেবে। ব্যবসা করবে অথচ চাঁদা দেবে না এটা চলবে না। ম্যাথুজ বলেছিল সে ব্যবসা করছে না। ম্যাডাম তাকে অনুরোধ করায় ও প্রায় কেনা দামে গ্রামের মানুষদের মাংস দিচ্ছে। ওরা শুনতে চায়নি।

ম্যাথুজ কেমন আছে?

প্রচণ্ড মার খেলে মানুষ যেমন থাকে। চললাম।

 সায়ন চেঁচিয়ে বলল, তুমি একটু দাঁড়াও।

বিষ্ণুপ্ৰসাদকে দাঁড়াতে দেখে সায়ন ভেতরে ছুটল। অনেকদিন বাদে সে দৌড়োল। একটু ঝিমঝিম করছিল মাথা কিন্তু সে উপেক্ষা করল।

অফিসঘরে ডাক্তার আঙ্কল ছিলেন না। তাঁকে পাওয়া গেল ল্যাবরেটরিতে। সায়নকে দেখে হাসলেন, তোমার রক্ত দেখছি আমার চেয়েও লাল।

তাই?

হিমোগ্লোবিন চমৎকার ভাল। ঠিক আছে, তুমি যেতে পারো। বলতে বলতে ডাক্তার আঙ্কলের। মুখটা বদলে যাচ্ছিল।

সায়ন বলল, আপনার সাহায্য দরকার।

ডাক্তার আঙ্কল বেরিয়ে এলেন, কী ব্যাপারে?

 ম্যাথুজকে ওরা মেরেছে।

কোন ম্যাথুজ?

 মিস্টার ব্রাউনের বাড়ির ওপরে যার মাংসের দোকান ছিল।

ও হ্যাঁ, কারা মেরেছে?

পার্টির ছেলেরা। ওরা ম্যাথুজের কাছে চাঁদা চেয়েছিল। কিন্তু ম্যাথুজ এখন ব্যবসা করে না। এলিজাবেথ যে তিনটে গ্রামে কাজ করছেন সেখানে কেনা-দামে মাংস দিচ্ছিল ও। এলিজাবেথের কাজে ও যোগ দিয়েছিল। বিষ্ণুপ্ৰসাদ ওখান থেকে এসেছে। ও যাচ্ছে থানায়, আপনি একটা চিঠি লিখে দেবেন?

ডাক্তার আঙ্কলের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। এক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে বললেন, তুমি ওকে অপেক্ষা করতে বলো। আমি গাড়ি বের করছি।

গ্যারাজ থেকে গাড়ি বের করে বিষ্ণুপ্ৰসাদকে পাশে বসিয়ে ডাক্তার আঙ্কল শহরে চলে গেলেন।

সদানন্দ জিজ্ঞাসা করল, নেপালিরা মেরেছে?

হ্যাঁ।

বাঙালিকে?

না, নেপালিকে। তোমার ধারণা ভুল সদুদা। যারা মারে তারা কখনও জাত দেখে না। সায়ন বলল।

কী জানি। সদানন্দ বলল, আমার তো এসব জায়গায় এলেই মনে হয় বিদেশে এসেছি। বাংলাদেশ বলে মনে হয় না।

বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের নাম সদুদা! তুমি সে দেশের নাগরিক নও। তাই না?

কথাটা ঠিক। তবু কলকাতা বর্ধমান হাওড়াকে বাংলাদেশ বলে ভাবতে আমরা অভ্যস্ত। তাই বলে ফেলি। ঠিক আছে, পশ্চিমবাংলা বলে মনে হয় না। হয়েছে?

তাহলে তো তুমি এদের আন্দোলনকে সমর্থন করছ?

মনে মনে করি, মুখে করি না।

তোমার দোষ নেই। এই মন আর মুখের ফারাকই হল আমাদের সর্বনাশের কারণ। তাহলে সাঁওতালদের গ্রামে গেলে তোমার মনে হবে ওটা বাংলাদেশ নয়। আসলে পুরনো ভাবনাচিন্তাগুলো এখন বাতিল করে দেওয়া উচিত এটা অনেকের মাথায় ঢুকছে না। তোমার কথা মানতে গেলে পশ্চিমবঙ্গকেই চারটে টুকরো করা দরকার। সায়ন হাসল।

দুর! এসব পলিটিকস আমি বুঝি না। আমি গাড়ি বুঝি। যেখানে সস্তায় গাড়ি পাব ছুটে যাব। ইঞ্জিন ভাল থাকলে কিনে নেব। ব্যাস। সদানন্দ বলল, তোর ডাক্তার তো চলে গেল, কিছু বলে গেল?

হ্যাঁ। আমার রক্ত এখন স্বাভাবিক অবস্থায় আছে।

তবে? চেঁচিয়ে উঠল সদানন্দ, আমি তোকে দেখেই বলেছিলাম। তাহলে কালই যাওয়া যাক। বুঝলি?

ডাক্তার আঙ্কলকে টিকিটের কথা বলি।

ইস, আগে মনে করতে পারলি না? লোকটা নিশ্চয়ই স্টেশনের দিকে গেল। তাহলে আমি এখন চলি। একটা সিনেমা দেখব। কলকাতায় তো দেখা হয় না। কাল সকালে আসব। সদানন্দ শিস দিতে দিতে চলে গেল।

.

মিসেস অ্যান্টনি মাটির দিকে মুখ করে কিছু ভাবছিলেন। সায়ন ওঁর পাশে এসে দাঁড়াল, কী ভাবছেন মিসেস অ্যান্টনি?

মুখ তুললেন মহিলা, আমার কপালটা খুব খারাপ জানতাম, জানাটা ভুল নয়।

কেন? কিছু হয়েছে?

আমি নিরাময়ে এসেছিলাম অনেক আশা নিয়ে। সত্যি বলছি, সেই আশা পূর্ণ হয়েছিল। তোমাদের সঙ্গে থেকে আমার সব একাকিত্ব ভুলে গিয়েছিলাম। আমার ছেলের কথাও মনে আসে না আর। অথচ একসময় ও ওই ব্যবহার করেছে জেনেও কষ্ট পেতাম। কিন্তু আজ একটু আগে ডক্টর বললেন, উনি নিরাময় বন্ধ করে দিতে পারেন। খুব সিরিয়াসলি ভাবছেন। এই মানুষটাকে অল্প যে কদিন দেখলাম তাতে বুঝতে পেরেছি উনি হালকা কথার মানুষ নন। নিরাময় বন্ধ হয়ে গেলে আমার কী হবে? মিসেস অ্যান্টনি তাকালেন।

আমাদের কী হবে? সায়ন পাল্টা জিজ্ঞাসা করল।

তোমরা চলে যাবে যে যার বাড়িতে। শুধু আমি আর ওই অভাগা মেয়েটা, কঙ্কাবতী, আমরাই বিপদে পড়ব।

আপনি ভুলে যাচ্ছেন, বাড়িতে চিকিৎসা করেও কাজ হচ্ছিল না বলে আমি এখানে এসেছিলাম। ওখানে ফিরে গেলে আগের অবস্থা হতে পারে।

না না। মাথা নাড়লেন মিসেস অ্যান্টনি, কিছুতেই না। যিশু তোমার পাশে আছেন। তিনি সব সময় তোমাকে রক্ষা করবেন।

তাই যদি বলেন, যিশু তো আপনার পাশেও আছেন।

মাথা দোলালেন মিসেস অ্যান্টনি। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বললেন, এখানে আসার আগে সেটা বুঝতে পারতাম না। মিসেস অ্যান্টনি চলে গেলেন ভেতরে।

কীরকম ভারী হয়ে গেল মনটা। ডাক্তার আঙ্কল সত্যি নিরাময় বন্ধ করে দেবেন? কোথায় যাবেন উনি? কী নিয়ে থাকবেন ডাক্তার আঙ্কলের কোনও আত্মীয়স্বজনকে সে কখনও দেখেনি।

বাবু!

সায়ন দেখল বড়বাহাদুর দাঁড়িয়ে আছে।

বাবু! নিরাময় কি বন্ধ হয়ে যাবে?

কে বলল তোমাকে?

 সবাই বলছে।

আমি জানি না।

আপনি ডাকদার সাহেবকে বলুন যেন বন্ধ না হয়। আপনার কথা উনি শুনবেন। বন্ধ হয়ে গেলে এই বয়সে কোথায় যাব আমি?

তোমার আত্মীয়স্বজন কেউ নেই?

 না। আপনারাই আমার সব। যখন নিরাময় খুলল তখন থেকে আমি এখানে আছি। আপনি একটু ডাকদার সাহেবকে বলুন।

আচ্ছা, ডাক্তার আঙ্কলের কাছে ওঁর কোনও আত্মীয়কে আসতে দেখেছ?

না। কেউ আসেনি। উনিও আমার মতন একা।

ঠিক আছে। আমি বলব।

সায়ন ধীরে ধীরে নিজের ঘরে গেল। এখন দুপুর নয়। এখানে দুপুর আর বিকেলের মধ্যে তফাত খুব সামান্য। মেঘলা থাকলে তো তাপও বোঝা যায় না। সে চেয়ারে বসল। তারপর মাকে চিঠিটা লিখল। মা, আমার শরীর এখন আগের থেকে অনেক ভাল আছে। বিন্দুমাত্র চিন্তা কোরো না। সদুদা এসেছে। ফেরার রিজার্ভেশন নেই। থাকলেও এখনই আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। কয়েকটা ব্যাপারে মন ভেঙে যাওয়ায় ডাক্তার আঙ্কল নিরাময় বন্ধ করে দেওয়ার কথা ভাবছেন। এই সময় আমি চলে গেলে আমার খুব খারাপ লাগবে। উনি বন্ধ করে দিলে তো যেতে হবেই। তদ্দিন এখানে থাকি। তুমি ও বাবা আমার ভক্তিপূর্ণ প্রণাম নিও।

এই সময় নীচে দুটো গাড়ির আওয়াজ হল। সেই সঙ্গে মানুষের কথাবার্তা। সায়ন নীচে নেমে দেখল মিসেস অ্যান্টনির সঙ্গে পাঁচজন মানুষ কথা বলছেন। ডাক্তার আঙ্কল নেই জানার পরেও ওঁরা প্রশ্ন করে চলেছেন! সায়নকে দেখে মিসেস অ্যান্টনি বললেন, ওর নাম সায়ন, ও সেদিন এখানে ছিল।

দলের সবচেয়ে প্রবীণ মানুষটি ভ্রূকুঁচকে তাকালেন, আই সি! তুমিই সায়ন। খুব খুশি হলাম তোমার দেখা পেয়ে। তোমার কথা আমি শুনেছি। ওয়েল, চেয়ারম্যান আমাদের পাঠিয়েছেন সেদিনের ঘটনায় যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার হিসেব নিতে। পরিষদ ক্ষতিপূরণ দিতে চায়।

সায়ন হাসল, এ বাড়ির ভাঙা কাচ সারানো যেতে পারে, কিন্তু আবার যে ভাঙবে না তার কোনও গ্যারান্টি কি চেয়ারম্যান দিতে পারবেন?

.

৩২.

ডাক্তার চিঠিটা পড়ছিলেন। চেয়ারম্যানের সচিব লিখেছেন চিঠিটা। নিরাময়ের ওপর যে হামলা হয়েছে তার জন্যে চেয়ারম্যান ব্যক্তিগতভাবে তাঁর দুঃখ জানাতে বলেছেন। মিস্টার ব্রাউনের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সামান্য ভুল বোঝাবুঝির কারণে কিছু কর্মী উত্তেজিত হয় এবং সেই সুযোগ নেয় সেইসব সমাজবিরোধীরা যাদের সঙ্গে দলের কোনও সম্পর্ক নেই। ডাক্তার নিশ্চয়ই পৃথিবীর ইতিহাসে বারংবার এইরকম ঘটনা ঘটতে দেখেছেন। যেসব কর্মীরা উত্তেজিত হয়েছিল তারা এখন লজ্জিত। পুলিশকে বলা হয়েছে যত দ্রুত সম্ভব সমাজবিরোধীদের গ্রেপ্তার করতে। চেয়ারম্যান আবার মনে করিয়ে দিতে বলেছেন যে নিরাময় অথবা ডাক্তারের প্রতি তাঁর অগাধ আস্থা আছে। তার প্রতীক হিসেবে তিনি বিশেষ তহবিল থেকে দশ হাজার টাকার অনুদান পাঠাচ্ছেন।

চিঠির সঙ্গে একটা ব্যাঙ্ক ড্রাফট রয়েছে দশ হাজার টাকার। ডাক্তার সেটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। নিশ্চয়ই চেয়ারম্যানের পাঁচজন প্রতিনিধি ফিরে গিয়ে ভাঙচুরের যে এস্টিমেট দিয়েছেন সেইমতো ক্ষতিপুরণ করেছেন তিনি। এই টাকা না নিলে সরাসরি সংঘাতের পথে যেতে হবে। না নেওয়ার কোনও কারণ আছে? পাহাড়ে পশ্চিমবঙ্গ বা ভারত সরকার যা করতে পারেন না চেয়ারম্যানের সরকার তা স্বচ্ছন্দে পারেন।

ডেকেছেন? সায়ন টেবিলের উল্টোদিকে বসল।

হ্যাঁ। তোমার বাবা আমাকে চিঠি দিয়েছেন। উনি লিখেছেন তোমাকে বেশ কয়েকবার লেখা সত্ত্বেও তুমি কলকাতায় যাওয়ার বিষয়টা এড়িয়ে যাচ্ছ। ওরা আমাকে অনুরোধ করেছেন তোমার শরীর ভাল থাকলে যেন আমি জানিয়ে দিই, ওঁরা এসে তোমাকে নিয়ে যাবেন। তুমি তো এসব কথা আমাকে বলোনি? ডাক্তার তাকালেন।

এখানে পরপর যেসব ঘটনা ঘটে গেল তাতে যেতে ইচ্ছে করছিল না।

কিন্তু ওঁরা তোমার জন্যে অধীর হয়ে আছেন। আমি তো আগেই তোমাকে ছুটি দিয়েছিলাম। তাহলে আমি লিখে দিই।

না। আমি একাই যেতে পারব।

বেশ। তোমাকে কেউ এনজেপি স্টেশনে গিয়ে ট্রেনে তুলে দিয়ে আসবে। ওঁরা শেয়ালদায় রিসিভ করবেন।

তারও দরকার নেই। আমিই পারব।

ডাক্তার তাকালেন, আমি জানি তুমি পারবে। কিন্তু অসুখটার কথা তোমার অজানা নয় সায়ন। ঝুঁকি নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।

সায়ন একটু ভাবল, আমি যদি কাউকে সঙ্গে নিয়ে যাই?

কাকে নিয়ে যাবে?

বিষ্ণুপ্ৰসাদকে বললে সে যেতে রাজি হবে।

তাহলে তো খুবই ভাল হয়। তোমার এক দাদা এসেছিল, সে ফিরে গেছে, এ কথা আমাকে বলোনি। তোমার কি কলকাতায় যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না?

না।

 কেন? সবাই তো নিজের বাড়িতে ফিরে যেতে চায়।

আমিও চাইতাম। কিন্তু মিস্টার ব্রাউনের মৃত্যুটা দেখে আমার মন বদলে গিয়েছে। আমার আর বেঁচে থাকার জন্যে বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে না।

চোখ ছোট হল ডাক্তারের, কী করতে চাও?

কিছু একটা করতে চাই। বাবা-মায়ের মতো শুধু বেঁচে থাকতে চাই না।

হাসলেন ডাক্তার, বেশ! ভাবো, কী করবে। তোমরা যাতে কালই যেতে পার তার চেষ্টা করছি। তুমি বিষ্ণুপ্ৰসাদেব সঙ্গে কথা বলো।

সায়ন মাথা নেড়ে অফিসঘরের বাইরে এল। আজ সকাল থেকেই আকাশ মেঘে ঢাকা। কুয়াশারা নেমে এসেছে রাস্তার ওপরে। ঝট করে অনেকটা দেখা যাচ্ছে না। পুলওভার পরতে হয়েছে ঠাণ্ডা বেড়ে যাওয়ায়। গেটের বাইরে এসে কুয়াশা দেখছিল সে। এখানে পৃথিবীর চেহারাটা ঘন ঘন বদলে যায় বলে সব কিছু নতুন নতুন মনে হয়, একঘেয়েমি আসে না। এখন কোথাও কোনও শব্দ নেই। সায়ন দেখল কুয়াশার বুক চিরে কঙ্কাবতীর মা এগিয়ে আসছে। হঠাৎ যেন বয়স বেড়ে গেছে মহিলার। খুব ধীরে পা ফেলছে। মাথা নিচু।

সায়ন জিজ্ঞাসা করল, কেমন আছেন?

মুহূর্তেই মুখের চেহারা বদলে গেল মহিলার, হাসি ফুটেই মিলিয়ে গেল, ভাল না। আমি ডাক্তারবাবুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।

কেন? আপনার শরীর খারাপ?

না। এখানে আর চলছে না। শিলিগুড়িতে গেলে একটা স্কুলে আবার চাকরি পেতে পারি। যা মাইনে দেবে তাতে পেট চলে যাবে। ডাক্তারবাবু যদি মেয়েটাকে ছেড়ে দেন তাহলে ওকেও সঙ্গে নিয়ে যাব।

সে কী? ওর পড়াশোনা কী ওখানে হবে?

হবে না। এতদূর যে হয়েছে তাই আমাদের ভাগ্য। আমাদের মতো গরিব মানুষের সংসারে পড়াশুনার কথা ভাবাই অন্যায়। মহিলা মুখ নিচু করল।

সায়ন বলল, আপনি কথাটা ঠিক বললেন না মা।

 চমকে তাকাল, আপনি আমাকে মা বললেন।

বাঃ, আপনি তো আমার মায়েরই বয়সী। দেখুন, অনেক বড়লোকের ছেলের পড়াশুনো হয় না। কারণ সে সেটা করতে চায় না বা পড়ে না। আবার খুব গরিবের হলেও অনেক কী করে বিদ্বান হয়েছে। আমার বিশ্বাস কঙ্কাবতী তা পারবে। কিন্তু আপনি যদি ওকে সাহায্য না করেন তাহলে খুব অন্যায় করা হবে।

কিন্তু আমি কী করে সাহায্য করব? আমি! মহিলা চুপ করে গেল।

আপনি ডাক্তারবাবুকে বলুন। উনি নিশ্চয়ই একটা পথ বের করে দেবেন। মহিলা তাকাল। তারপর বলল, আপনি ইচ্ছে করলে সব হয়ে যায়।

আমি? সায়ন অবাক।

হ্যাঁ। আমি শুনেছি। তা ছাড়া আপনিই তো আমাকে নরকে যাওয়া থেকে রক্ষা করেছেন। কিন্তু আমি জানি আমার ভাগ্যে কিছু নেই, আমি হতভাগী। কথাগুলো বলে মহিলা নিরাময়ের ভেতর চলে গেল।

মন খারাপ হয়ে গেল সায়নের। শিলিগুড়িতে গেলে কঙ্কাবতী আর বাঁচবে না। অসুখটার সঙ্গে লড়াই করা সম্ভব হবে না। পড়াশুনো ছেড়ে দিয়ে যদি ও কাজ খুঁজতে বের হয় কোনও চাকরি পাবে না। মায়ের মতো ওকে আয়ার কাজ করতে হবে। খারাপ হয়ে যাওয়া মনে রাগ এল আচমকা। যদি তার ক্ষমতা থাকত তাহলে সে এক মুহূর্তে পৃথিবীর মানুষের সমস্ত সমস্যার সমাধান কবে দিত। মিস্টার ব্রাউন তার মধ্যে যিশুকে দেখেছেন, এই মহিলা বলে গেল সে ওকে নরকবাস থেকে রক্ষা করেছে, একগাদা লোক দেখেছে মাদার মেরি তার শরীরে আশীর্বাদের হাত রেখেছেন অথচ সে নিজে এসবের কিছুই টের পায়নি। ঘুমের ঘোরে যে মানুষ হাঁটে, সে নিজে কিছুই টের পায় না। কিন্তু জেগে যাওয়ার পর সেই হাঁটাচলার কিছু প্রমাণ নিশ্চয়ই খুঁজে পায়। তার ক্ষেত্রে এটাও তো সহজ হচ্ছে না। সে যদি বলে এই কুয়াশাগুলো সরে যাক তাহলে কি কুয়াশারা সরে যাবে? যত বোকামি! লোকে যে যার নিজের বিশ্বাসকে তার ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। এমন অসহায় লাগে এরকম চাপ এলে মনে হয় কেন বিশ্বাসটা সত্যি হল না!

বিষ্ণুপ্ৰসাদকে ধরতে হলে চার্চের ওপরে উঠতে হবে। অতটা রাস্তা সে মিস্টার ব্রাউনের মৃতদেহের সঙ্গে হেঁটেছিল। সেদিন পরিস্থিতি অন্যরকম ছিল। আজ কি যাওয়া উচিত হবে? কিন্তু বিষ্ণুপ্ৰসাদকে পাওয়া দরকার। সায়ন হাঁটতে লাগল।

মিসেস ডিসুজার ছেড়ে যাওয়া বাড়িটা ভাড়া নিয়েছেন এলিজাবেথ। সেখানে পৌঁছে সায়ন দেখল দরজা খোলা আছে। এতটা উপরে ধীরে ধীরে উঠে এলেও শরীর এখন ঝিমঝিম করছে। ব্যাপারটাকে সে পাত্তা দিচ্ছিল না। এতটা চড়াই ভেঙে এলে সুস্থ মানুষেরও অস্বস্তি হবে। সে কলিং বেলের বোতাম টিপল। তৃতীয়বারে দরজা খুলল ম্যাথুজ। তার মাথায় ব্যান্ডেজ, হাতেও। সায়নকে দেখে হাসার চেষ্টা করল, তুমি? একা এসেছ? এসো এসো।

এটা বসার ঘর। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে ম্যাথুজ। চেয়ারে বসে বলল, আমাকে দেখতে এত দূরে উঠে এসেছ, আমি খুব খুশি হয়েছি।

তুমি এখন কেমন আছ?

ভাল। হাত ভাঙেনি। অনেকগুলো সেলাই করাতে হয়েছে। সাতদিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যাব। ওরা কেউ বাড়িতে নেই, গ্রামে গিয়েছে।

পুলিশ এসেছিল?

হ্যাঁ।

তোমাকে যারা মেরেছিল তাদের অ্যারেস্ট করেছে?

না। মাথা নাড়ল ম্যাথুজ।

 সে কী? কেন?

পুলিশ আমাকে এদের নাম জিজ্ঞাসা করেছিল। আমি বলেছি কাউকেই চিনি না। তাই পুলিশ ফিরে গিয়েছে।

তুমি কাউকেই চিনতে পারোনি?

পারব না কেন? আমি নাম বললে পুলিশ ওদের অ্যারেস্ট করত। থানায় নিয়ে গিয়ে পেটাত। তারপর কয়েকদিন রেখে ছেড়ে দিতে বাধ্য হত। ফিরে এসে ওরা আবার আমাদের সঙ্গে শত্রুতা করত। কিন্তু আমি জেনেশুনেও নাম বলিনি জেনে ওরা খুব ঘাবড়ে গিয়েছে। এখন একেবারে চুপ করে গিয়েছে। ম্যাডামের কাজ করতে কোনও অসুবিধে হচ্ছে না।

ম্যাথুজ হাসল, কাজ করাটাই আসল কথা, নাম বললে ওটা করা যেত না।

সায়ন অবাক হয়ে গেল। ম্যাথুজ কসাই ছিল। কিন্তু সে সময়েও ওর হাবভাবে দার্শনিকের ভাবভঙ্গি ফুটে উঠত। এখন যেন সেটা আরও স্পষ্ট। সে জিজ্ঞাসা করল, বিষ্ণুপ্রসাদ কি আজ এখানে এসেছে?

হ্যাঁ। ও ম্যাডামের সঙ্গে গিয়েছে। কেন?

ওকে আমার দরকার।

তুমি কি ওর খোঁজেই এসেছ? সায়ন একটু চিন্তা করল, সত্যি কথা বললে তাই বলতে হয়। তুমি যে এখানে রয়েছ আমি তা জানতাম না।

ম্যাথুজ হাসল, তুমি জানবে কী করে! ম্যাডাম আমাকে যেতে দিল না। বলল সাতদিন এখানে থেকে শরীর সারিয়ে যেতে। ঠিক আছে, আমি বিষ্ণুপ্ৰসাদকে বলে দেব তোমার সঙ্গে দেখা করতে।

সায়ন বলল, তুমি অনেকক্ষণ কথা বলেছ। আমি যাচ্ছি, তুমি বিশ্রাম করো।

ম্যাথুজের বোধহয় একা থাকতে ভাল লাগছিল না। সায়ন চলে যাক সে চাইছিল না। কিন্তু সায়ন ওকে দরজা বন্ধ করতে বলে বেরিয়ে এল। এখন তাকে নিরাময়ে যেতে হলে আর চড়াই ভাঙতে হবে না। নীচে নামতে কখনওই অসুবিধে হয় না। সে হাঁটতে হাঁটতে চার্চের দিকে তাকাল। এখনও রোদ ওঠেনি। কিন্তু চার্চের গায়ে কুয়াশা লেগে নেই। কোনও মানুষ ওখানে নেই, শান্ত ছবির মতো দেখাচ্ছে দূর থেকে। আর সেদিকে তাকিয়ে থাকতেই মিস্টার ব্রাউনের মুখ মনে পড়ল, যিশু কা বড়াই।

সায়ন এগিয়ে গেল সমাধিক্ষেত্রের দিকে। গেট খুলে ভেতরে যেতে প্রথমে মনে হয়েছিল খুঁজে পাবে না। চাপ চাপ কুয়াশায় সমস্ত সমাধিক্ষেত্র ঢাকা পড়ে আছে। যেন মৃত আত্মাদের চাদরে ঢেকে রেখেছে প্রকৃতি। যেখানে মিস্টার ব্রাউনকে সমাধি দেওয়া হয়েছে সেখানে এখনও কোনও বেদি তৈরি করা হয়নি। আশেপাশে যাঁরা আছেন তাঁদের নাম এবং জন্মমৃত্যুর তারিখ স্পষ্ট লেখা আছে বেদির ওপর। মিস্টার ব্রাউনের কফিন যেখানে রয়েছে তার মাটির ওপরে একটি কাঠের ফলক দাঁড়িয়ে। ফলকের নীচে দুটো গোলাপ ফুল, টাটকা। বোঝাই যায় আজ কেউ রেখে গেছে!

দুটো হাত সামনে রেখে দাঁড়িয়েছিল সায়ন। মারা যাওয়ার পর মানুষের আত্মা নাকি তার কর্মফল অনুযায়ী স্বর্গ বা নরকে যায়। এই যাওয়াটা কেউ দেখেনি। মানুষই এইরকম কল্পনা করে নিয়েছে। তার চেয়ে যেটা স্বাভাবিক সেটাই ভেবে নেওয়া ভাল। শরীরের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত কিছু এই পৃথিবীর মাটিতে মিশে যায়। তার অস্তিত্ব থেকে যায় যারা বেঁচে থাকে তাদের স্মৃতিতে, যতদিন থেকে যেতে পারে। মাটি এখনও কাঁচা, কুয়াশায় ভিজে কিছুটা নরম, এর নীচে কাঠের কফিনে শুয়ে আছেন মিস্টার ব্রাউন। না, মিস্টার ব্রাউন না বলে তাঁর মৃত শরীর বলাই ভাল। এই কদিনে নিশ্চয়ই সেই শরীরে বিকৃতি এসেছে। হয়তো কফিন খুললে এখন তাঁকে চেনা যাবে না।

মানুষটাকে স্পষ্ট দেখতে পেল সায়ন। বড় শরীর, ফোলা ফোলা মুখে সবসময় যে হাসিটা লেগে থাকত সেটাও স্পষ্ট। দেখা হতেই বলতেন, হ্যালো মাই বয়। চোখ বন্ধ করল সায়ন কিছুক্ষণ তারপর সমাধিক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে এল।

ফিরে আসার সময় কাণ্ডটা হল।

 রাস্তাটা পিচের নয়। মাঝেমধ্যেই দুপাশে এর ওর বাড়ির দরজা পড়ছে, কখনও কাঠের গেট, কখনও গাছগাছালি। বাঁক ঘুরতেই দেখল একটা বাড়ির সামনে বেশ ভিড়। সায়ন যখন এই রাস্তা বেয়ে উঠেছিল তখন এই ভিড় ছিল না। এই পাহাড়ে যারা সায়নকে চিনত না তারা মিস্টার ব্রাউনের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে যে গোলমাল হয়েছিল তারপর থেকে চিনে গিয়েছে। তাদেরই একজন এগিয়ে এসে বলল, খুব বিপদ হয়েছে, পূর্ণ গুরুং-এর বাচ্চাটার জ্বর বেড়ে গেছে। ওর মা ওকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাইছে না।

কেন?

ওর আগের বাচ্চাটার অসুখের সময় হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানেই মারা গিয়েছিল সেটা। তাই–!

ডাক্তারকে খবর দেওয়া হয়েছে?

হ্যাঁ। আপনাদের ওখানকার ডাক্তারবাবু নেই, ডাক্তার তামাং-এর কাছে লোক গিয়েছে। ফিরে আসেনি এখনও। আপনি একটু দেখবেন?

আমি কী দেখব? আমি কি ডাক্তারি জানি?

তবু–। লোকটা বলতেই আশেপাশের অনেকেই হাতজোড় করে মিনতি করতে লাগল। এইসব সরল মানুষদের অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারল না সায়ন। সে বাড়িতে ঢুকল। কাঠের বাড়ি। চারপাশে তাকালেই বোঝা যায় অভাবের সঙ্গে এদের নিত্য লড়াই চলছে। বৃদ্ধ এবং মহিলাদের মাঝখানে পথ করে ওকে যে ঘরে নিয়ে যাওয়া হল তার জানলা বন্ধ। আলো জ্বলছে। বিশ্রী গুমোট গন্ধ পাক খাচ্ছে। তক্তপোশের ওপর অনেকগুলো কম্বলের তলায় যে শিশু শুয়ে আছে তার মুখ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। এরকম পরিবেশে থাকলে সুস্থ মানুষই অসুস্থ হয়ে যাবে।

সায়ন জিজ্ঞাসা করল, জ্বর কবে থেকে হয়েছে?

একজন মহিলা জবাব দিলেন, দুদিন। জ্বর থাকলেও ভালই ছিল। কিন্তু আজ সকাল থেকেই শরীর শক্ত হয়ে গেছে, কথা বলছে না।

সায়নেরই দমবন্ধ হয়ে আসছিল। সে জানলা খুলে দিতে বলল। সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটির মা আপত্তি করল, ঠাণ্ডা লেগে যাবে। ওর বুকে ঠাণ্ডা বসে যাবে।

সায়ন বলল, ঘরে হাওয়া আসা দরকার। জানলা খুলুন।

একজন পুরুষ জানলা খুলে দিতেই তাজা বাতাস ঘরে ঢুকল। সেই গুমোট গন্ধ দ্রুত কেটে যাচ্ছিল। শিশুটির মাথার কাছে গেল সায়ন। একে এখনই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া দরকার। কিন্তু ডাক্তার এসে সেটা না বললে ওর মা কিছুতেই সেটা মেনে নেবে না। সে বাচ্চার কপালে হাত দিল। কপাল পুড়ে যাচ্ছে। শৈশবে তার খুব তড়কা হত। মায়ের মুখে শুনেছে জ্বর বেড়ে শরীর শক্ত হয়ে যেত তখন। সেসময় ডাক্তারের নির্দেশে তাকে নগ্ন করে সমস্ত শরীর ভেজা কাপড়ে বারংবার মুছিয়ে দিলে জ্বর কমে যেত। এই শিশুর কি সেরকম কিছু হয়েছে? টুপুরের একবার খুব জ্বর হয়েছিল। তখন টুপুরের মা ওর কপালে ভেজা কাপড় রাখতেন।

সায়ন জিজ্ঞাসা করল, একটা পরিষ্কার সাদা কাপড় জলে ভিজিয়ে দেবেন?

গরম জলে? একজন মহিলা জানতে চাইল।

না। ঠাণ্ডা জলে।

অনুরোধ রাখা হল। সায়ন কাপড়টি ভাঁজ করে শিশুর কপালে রাখল। মিনিট দেড়েকের মধ্যে সেটা গরম হয়ে উঠল। কম্বল সরিয়ে দিল সায়ন। তারপর বারংবার জলে কাপড় ভিজিয়ে শিশুটির গলা বুক কপাল মুছিয়ে দিতে লাগল। মিনিট দশেকের মধ্যে শিশুটির শরীর নরম হল। এই সময়টায় ঘরের কোনও মানুষ কথা না বলে সাগ্রহে তাকিয়ে ছিল। শিশুর নিশ্বাস স্বাভাবিক হতেই গুঞ্জন উঠল।

এইসময় বাইরের মানুষজন জোরে জোরে কথা বলতে লাগল। তারা ডাক্তারবাবুকে নিয়ে ঘরের ভেতর এল। সায়ন তাঁকে দেখে উঠে দাঁড়াতেই তিনি অবাক হয়ে বললেন, তুমি? এখানে?

এরা জোর করে ধরে নিয়ে এল। আমি কপাল আর শরীর যতটা সম্ভব ভেজা কাপড়ে মুছিয়ে দিয়েছি। সায়নের গলায় দ্বিধা ছিল।

গুড। ডাক্তার শিশুর কপাল দেখলেন, স্টেথো দিয়ে বুক এবং পিঠ পরীক্ষা করলেন। তাঁকে খুব গম্ভীর দেখাচ্ছিল। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, অয়েল ক্লথ আছে?

এ বাড়িতে সেটা নেই, কিন্তু পাশের বাড়ি থেকে সেটা চলে এল। ডাক্তার তার ওপর শিশুটিকে শুইয়ে ভেজা চপচপে কাপড় আপাদমস্তক বোলাতে লাগলেন। তারপর শরীরটাকে শুকনো কাপড়ে মুছিয়ে মাথাটা ধুয়ে দিলেন। দেখা গেল শিশু চোখ খুলেছে।

একটা হালকা চাদর ওর শরীরে চাপিয়ে ডাক্তার বললেন, এখন এর সেবা ঠিকঠাক করা উচিত। একে এখন হাসপাতালে নিয়ে যান।

সঙ্গে সঙ্গে শিশুর মা মাথা নাড়ল, না। ওখানে গেলে আমার এই বাচ্চা আর বাঁচবে না।

ডাক্তার ধমক দিলেন, কী বাজে কথা বলছ? তোমার বাচ্চার কোনও ক্ষতি হবে না। দু-তিনদিন রেখেই ওরা একে ছেড়ে দেবে। এখানে থাকলে ওর সেবা ঠিকঠাক করতে পারবেনা তুমি।

পুরুষরা মহিলাকে বোঝাতে লাগল ডাক্তারবাবুর কথা মেনে নিতে। কিন্তু সে কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। বারংবার বাচ্চাটিকে আঁকড়ে ধরছিল। ডাক্তারবাবু বললেন, যা ভাল হবে তাই করতে বললাম। যদি না শোনো তাহলে কেউ আমার সঙ্গে আসুক, ওষুধ দিয়ে দেব।

মহিলা জোরে কেঁদে উঠল। তারপর উন্মাদিনীর মতো সায়নের হাত ধরল, তুমি ওর মাথায় হাত দিয়ে বলো ও ফিরে আসবে আমার কাছে। বলো, তাহলেই আমি ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাব।

সায়ন খুব হকচকিয়ে গেল, আমি বললে কী হবে?

তুমি বললে সব হবে। আমার বাচ্চা মড়ার মতো পড়েছিল, তুমি আসার পর ওর শরীরে প্রাণ এল। একমাত্র তুমি বললেই আমি শুনব।

সায়ন প্রবলভাবে মাথা নাড়ছিল। মহিলা তার হাত কিছুতেই ছাড়ছিল না। সায়ন ডাক্তারবাবুর দিকে তাকাতেই তিনি মাথা নেড়ে ইশারা করলেন মহিলার অনুরোধ রাখতে। খুব অবাক হয়ে গেল সায়ন। তার দ্বিধা যাচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত ডাক্তারবাবু শুদ্ধ বাংলায় বললেন, একটি ক্ষুদ্র অসত্য যদি বিরাট সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করে তাহা হইলে সেই অসত্যটির আশ্রয় গ্রহণ করা কর্তব্য।

এরা বাংলা অল্পবিস্তর বোঝে। সেটা কথ্য বাংলা। ইংরিজি কিছু কিছু বোঝে সবাই। অতএব এই বাংলায় কথা বললেন ডাক্তার, সায়ন বুঝতে পারল। সে শিশুর মাথার কাছে এগিয়ে গিয়ে কপালে হাত রাখল, ও ভাল হয়ে যাবে।

সঙ্গে সঙ্গে সবাই আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল। ডাক্তারবাবুর পাশাপাশি বাইরে বেরিয়ে এল সায়ন। একজন টাকা দিতে এগিয়ে আসতেই ডাক্তারবাবু মাথা নেড়ে না বললেন। বাচ্চাটাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্যে অপেক্ষা করল না ওরা। একজন কোলে করে দৌড়তে লাগল। কয়েকজন তার পেছনে যাদের মধ্যে শিশুর মাও রয়েছে।

ডাক্তারবাবুর পাশাপাশি হাঁটছিল সায়ন। ঢালু পথ, অসুবিধে হচ্ছে না। কিন্তু খুব নার্ভাস হয়ে গিয়েছিল সে। মহিলা কেন শিশুর মাথায় হাত রাখতে বললেন? কেন তাকে দিয়ে কথা আদায় করিয়ে নিলেন? অর্থাৎ এ কি এখনও তাকে ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ বলে ভাবছে?

হঠাৎ ডাক্তারবাবু বললেন, আমি বুঝতে পারছি তোমার অসুবিধে হচ্ছে।

সায়ন কোনও কথা বলল না। মাথা নিচু করে হাঁটতে লাগল।

আচ্ছা, তুমি কি নিজের মধ্যে কোনও পরিবর্তন বা পার্থক্য অনুভব কর? তুমি কি নিজেকে কখনও কখনও চিনতে পার না?

না তো! এসব কখনওই হয় না আমার।

অথচ এখানকার মানুষ তোমার মধ্যে ওসব দেখতে পছন্দ করছে।

 হ্যাঁ। ওই মেরির মূর্তির সামনে গিয়ে আমি ভুল করেছিলাম।

মিস্টার ব্রাউন অশিক্ষিত মানুষ ছিলেন না। অন্য কোনও বই পড়েছেন কি না জানি না বাইবেল তাঁর মুখস্থ ছিল বলে জানি। তা ছাড়া বই পড়ে যে শিক্ষা পাওয়া যায় তার চেয়ে অনেক বেশি শিক্ষা তিনি পেয়েছিলেন জীবন থেকে। জাহাজে জাহাজে কত বন্দরে ঘুরে যে মানুষ, মানুষ দেখতে চান তাঁর মতো শিক্ষিত আর কে আছেন? এই মিস্টার ব্রাউন মৃত্যুর আগের মুহূর্তে তোমার মধ্যে নিজের ইচ্ছে প্রয়োগ করে তুষ্ট হয়ে গেছেন। কেন?

আমি জানি না।

তুমি জানো আমি এসব বিশ্বাস করি না। এই পৃথিবীর কিছু মানুষ তাঁদের ব্যক্তিত্ব এবং বুদ্ধির সাহায্যে নিজেদের আলাদা করে সাধারণ সরল মানুষদের প্রভাবিত করে গেছেন এবং যাচ্ছেন। আর সেটা করবেন বা কেন? সাধারণ মানুষই এসব খুব পছন্দ করে। তোমার বয়স কম। তা না হলে বলতাম তোমার প্রতি এদের এই আস্থাটাকে এদের উপকারের কাজে লাগাও। আমি হাজার ভয় দেখালেও কোনও কাজ হত না। মেয়েটি তার অন্ধ সংস্কার নিয়ে ওই ঘরে বসে থাকত আর শিশুটি মারা যেত। অথচ তুমি ওর কথামতো কাজ করতেই দেখলে কীরকম ছটফটিয়ে হাসপাতালের দিকে ছুটল। তাতেই বাচ্চাটার উপকার হল। এইটে হলে মিথ্যাচরণে কোনও আপত্তি নেই আমার।

ওরা নেমে আসছিল ম্যাথুজের বন্ধ দোকান ছাড়িয়ে মিস্টার ব্রাউনের বাড়ির সামনে। দরজায় তালা। গেট বন্ধ। তার সামনে বসে আছে শীর্ণ ভুটো। যে-ই তাকে ডেকে নিয়ে যাক ফাঁক পেলেই ভুটো চলে আসে গেটের সামনে। তাকিয়ে থাকে বন্ধ দরজার দিকে। নড়ে না। খুব দ্রুত আরও শীর্ণ হয়ে যাচ্ছে সে।

সায়ন ডাকল, ভুটো।

ভুটো মুখ ফেরাল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে এল সায়নের কাছে। এসে মাথা নিচু করে দাঁড়াল।

ভুটো, এখানে কী করছিস?

ভুটো মাটিতে বসে পড়ে দুই থাবায় মুখ রেখে অদ্ভুত গলায় কেঁদে উঠল। সায়ন হাঁটু গেড়ে বসল। ডাক্তারবাবু বললেন, একটু সতর্ক থেকো। মিস্টার ব্রাউন ওকে কখনও ইনজেকশন দিতে নিয়ে যাননি। গায়ে পোকা থাকাই স্বাভাবিক।

সায়ন ভুটোর মাথার মাঝখানে হাত বোলাল, ডোন্ট ক্রাই ভুটো। তুই কাঁদলে মিস্টার ব্রাউন কষ্ট পাবেন। প্লিজ ভুটো!

ভুটোর কান্না থামল। ওর লেজ নড়তে লাগল।

সায়ন উঠে দাঁড়াল, কাম অন ভুটো। চলে আয়। দেখা গেল ভুটো আদেশ মান্য করল। সায়নের পেছন পেছন হাঁটতে লাগল সে।

ডাক্তাবাবু এগিয়ে গেলেন। তাঁর কাজ আছে। ভুটো এত আস্তে চলছে যে সায়নকে গতি কমাতে হল। নিরাময়ের সামনে পৌঁছে সে দেখল কঙ্কাবতী তাদের দিকে পিছন ফিরে দূরের আকাশ আর কুয়াশাভরা খাদের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। ভুটোকে নিয়ে নিরাময়ে ঢুকে ছোটবাহাদুরকে দিয়ে খাবার আনিয়ে সে ওর মুখের সামনে ধরতেই কুকুরটা গোগ্রাসে খেতে লাগল। ও যে অভুক্ত ছিল তা খাওয়ার ভঙ্গিতে বোঝা যাচ্ছিল।

খাওয়া শেষ করে মুখ তুলে সায়নকে দেখল ভুটো। তারপর প্যাসেজের একপাশে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিল সায়ন। ভুটো চোখ বন্ধ করল।

বাইরে বেরিয়ে কঙ্কাবতীর কাছে চলে এল সে। এসে বুঝল কঙ্কাবতী কাঁদছে। সায়নের উপস্থিতি বুঝতে পেরে মুখ ঘুরিয়ে নিল। সায়ন খানিকটা দুরত্বে পাথরের ওপর বসে জিজ্ঞাসা করল, তোমার মা চলে গিয়েছে?

মাথা নেড়ে নিঃশব্দে হ্যাঁ বলল কঙ্কাবতী। তাকাল না।

তোমার মন শান্ত করো।

কঙ্কাবতী বলল, আমি কী করব বুঝতে পারছি না।

 আচ্ছা যে ভদ্রলোক তোমাকে বলে গিয়েছিলেন খুব প্রয়োজন হলে তাঁকে জানাতে, তাঁকে জানাচ্ছ না কেন?

না। আমি কাউকে বিরক্ত করতে চাই না।

কেন?

উনি আমার ক্ষতি করে গিয়েছেন। উনি যদি আমাকে এভাবে বদলে না দিতেন তাহলে আমি আর পাঁচটা নেপালি মেয়ের মতো স্বাভাবিক থাকতে পারতাম। ওরা যেভাবে সব কিছু মেনে নেয় তাই মেনে নিতে পারতাম। আমাদের মতো ঘরের মেয়েদের তো সেটাই করা উচিত ছিল।

তুমি মন থেকে বলছ এই কথাগুলো?

কঙ্কাবতী জবাব দিল না। হাঁটুর ওপর চিবুক রাখল।

সায়ন বলল, তোমার যে কষ্ট হচ্ছে সেটা আমারও হয়েছিল। আমিও যখন বুঝতে পারলাম আমি আর নিয়মিত কলেজে যেতে পারব না, ক্লাস করতে পারব না তখন খুব কেঁদেছিলাম। আমার শরীর তোমার চেয়েও খারাপ ছিল! সবাই ভেবেছিল আমি আর বাঁচব না। যে বাঁচবে না তার পড়াশুনো নিয়ে কেউ কি মাথা ঘামায়? কিন্তু আমি তো এখনও বেঁচে আছি। আজ দ্বিতীয়বার আমি ওই চার্চ পর্যন্ত হেঁটে গেলাম এবং এলাম। এটা কিছুকাল আগেও আমি ভাবতে পারতাম না। আমার মন থেকে পড়াশুনো করার ইচ্ছেটা চলে গেল। এখন মনে হয় যদি কিছু একটা কাজ করে যেতে পারতাম, যতটা সময় বেঁচে থাকব ততটা সময়কে ঠিকঠাক কাজে লাগাতে পারলে সায়ন মাথা নাড়ল, আমার কথা ছেড়ে দাও। তুমি তো আমার মতো অসুস্থ হওনি কখনও। তুমি কেন ভেঙে পড়বে?

আমি কী করব?

লড়াই করবে। ডাক্তারবাবু বলেন লড়াই না করে কখনও হেরে যাওয়া উচিত নয়। এখন কিছুদিন তো এখান থেকেই তোমার স্কুলে যাওয়ার কথা ছিল।

কিন্তু এখানে আমি কতদিন থাকব? আমার মায়ের কোনও কাজ নেই। মা খেতে পাচ্ছে না অথচ আমি কত ভাল খাবার খাচ্ছি। মা আমাকে নিয়ে শিলিগুড়িতে চলে গেলে আমার সব নষ্ট হয়ে যাবে, আমি জানি। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল কঙ্কাবতী।

না। তোমার মাকে শিলিগুড়িতে যেতে হবে না।

এইসময় গাড়িটা উঠে এল নীচের রাস্তা থেকে। শব্দ শোনা যাচ্ছিল, বাঁক ঘুরতে তাকে দেখা গেল। ডক্টর তামাং-এর গাড়ি। ওদের দেখতে পেয়ে তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন, হ্যালো।

সায়ন এগিয়ে গেল, কেমন আছেন ডক্টর তামাং।

ফাইন। আই অ্যাম অলওয়েজ ফাইন। তবে এখানে এলেই আমার মন খারাপ হয়ে যায়। আমার সিনিয়র পার্টনার এখন ওপরে গিয়ে একা একা কোটা শেষ করছে, আমি তাকে সঙ্গ দিতে পারছি না। ওয়েল!

আপনি কি বাচ্চাটাকে দেখতে যাচ্ছেন?

হ্যাঁ। তুমি জানলে কী করে?

আমি শুনেছি ওরা আপনাকে খবর দিতে গিয়েছিল। বাচ্চাটা এখন একটু ভাল আছে, ওকে ওরা শেষ পর্যন্ত হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছে।

বাঃ, খুব ভাল। তোমাকে ধন্যবাদ। আমাকে আর ওপরে উঠতে হল না। ও কে? কঙ্কাবতী না? এই যে খুকি, ডক্টর তামাং চিৎকার করলেন, তোমার মায়ের কী খবর? তাঁর তো আমার ওখানে যাওয়ার কথা ছিল। চাকরি রেডি কিন্তু ক্যান্ডিডেটের পাত্তা নেই কেন?

কঙ্কাবতী অবাক হয়ে তাকাল।

ডক্টর তামাং বললেন, কাল সকালে দেখা করতে বোলো। আচ্ছা সায়ন, আমি আর নামছি না। ডাক্তারকে আমার রিগার্ড দিও। বাই। গাড়ি ঘুরিয়ে ভদ্রলোক আবার নীচে গেলেন।

কঙ্কাবতী এবার দৌড়ে এল কাছে, দেখলে!

 সায়ন অবাক হল, কী?

তুমি বললে মাকে শিলিগুড়িতে যেতে হবে না অমনি মায়ের এখানে চাকরি হয়ে গেল। কঙ্কাবতী হাসল।

দূর। আমার মনেই ছিল না, ওঁর ব্যাপারে ডক্টর তামাং আগেই বলেছিলেন।

তোমার মাকে তখন জিজ্ঞাসা করতে ভুলে গেলাম। আজ বিকেলে ওঁর সঙ্গে দেখা হবে?

 চোখমুখের চেহারা বদলে গিয়েছিল কঙ্কাবতীর। ঘাড় নেড়ে বলল, হ্যাঁ।

তাহলে খবরটা দিয়ে দিও। সায়ন আকাশের দিকে তাকাল। আজ বোধহয় সূর্য উঠবে না। এরকম ছায়া ছায়া দিন বেশিক্ষণ ভাল লাগে না। সে বলল, কাল থেকে কদিন আমি এই পাহাড় কুয়াশা দেখতে পাব না?

চমকে তাকাল কঙ্কাবতী, কেন?

আমি আজ কলকাতায় যাচ্ছি।

 কঙ্কাবতীর মুখের চেহারা বদলে গেল। সায়ন বলল, অনেকদিন যাইনি, মা খুব ব্যস্ত হয়েছে। তাই যাচ্ছি।

যদি ওখানেই থেকে যেতে হয়–।

থেকে যাব কেন? আমি তো কদিনের জন্যে যাচ্ছি।

কঙ্কাবতী হঠাৎ নিরাময়ের দিকে হাঁটতে লাগল। তার এইভাবে চলে যাওয়ার কোনও কারণ খুঁজে পাচ্ছিল না সায়ন। সে কদিনের জন্যে চলে যাবে সেই খবর শুনে কঙ্কাবতীর মুখের আলো নিবে গেল কেন?

সায়ন।

চিৎকারটা কানে আসতেই মুখ ঘুরিয়ে সে দেখতে পেল বিষ্ণুপ্ৰসাদ দ্রুত নেমে আসছে। কাছে এসে সে জিজ্ঞাসা করল, কী ব্যাপার? ম্যাডাম পর্যন্ত অবাক হয়ে গিয়েছেন। তুমি আমার খোঁজে ওপরে গিয়েছিলে?

হ্যাঁ।

কী ব্যাপার?

আমি কাল কলকাতায় যাব। তুমি আমার সঙ্গে যেতে পারবে?

কলকাতায়? চিন্তায় পড়ল বিষ্ণুপ্ৰসাদ, আমি কখনও যাইনি।

দুজনে একসঙ্গে যাব। আমি একাই যেতে পারতাম কিন্তু তুমি সঙ্গে গেলে তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে পারব।

বিষ্ণুপ্ৰসাদ বলল, আমি ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলি।

কিন্তু সময় তো বেশি নেই।

বুঝেছি। ম্যাডাম যদি কদিনের জন্যে ছেড়ে দেন তাহলে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু কাছে তো টাকা নেই।

সেটা তোমাকে ভাবতে হবে না।

এখন আমাদের খুব কাজের চাপ। যদি ম্যাডাম না ছাড়েন তাহলে তুমি কিছু মনে কোরো না। বিষ্ণুপ্ৰসাদ আবার ওপরের দিকে রওনা হল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *