প্রায় লাফিয়ে উঠে দরজা খুলল কঙ্কাবতী, খুলে দেখল এস কে রায় সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন। অদ্ভুত এক অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল তার মনে, সর্বাঙ্গে। কোনওরকমে বলতে পারল, আপনি।
হ্যাঁ, আমাকে আসতে হল। ভদ্রলোক যেন দ্বিধায় পড়েছেন।
আসুন, ভেতরে আসুন। সসংকোচে কঙ্কাবতী সরে দাঁড়াল দরজা থেকে। এত বছরের আলাপ, কিন্তু কখনওই উনি তার খোঁজে আসেননি। আর নিজের বাড়িতে ওঁকে আসতে বলার সাহস হয়নি তার। চারপাশে অভাব এমন হাঁ কয়ে রয়েছে যে ওঁর মতো মানুষকে এখানে মানায় না। কিন্তু আজ যখন উনি এসেই পড়েছেন তখন সব ছাপিয়ে আনন্দ প্রবল হয়ে উঠল।
এস কে রায় বললেন, না। বসব না। কঙ্কাবতী, তোমাকে একটা কথা বলা জরুরি বলে মনে হল। আমি কিছুদিনের মধ্যেই এখান থেকে চলে যাচ্ছি। তুমি খুব ভাল মেয়ে। আমি প্রার্থনা করব তুমি একজন ভাল মানুষ হও। কিন্তু আমি যতদিন আছি তুমি আমার সঙ্গে দেখা করতে যেও না। আচ্ছা, চলি।
ভদ্রলোক ঘুরে দাঁড়াতেই প্রশ্নটা ছিটকে বেরিয়ে এল কঙ্কাবতীর মুখ থেকে, কিন্তু কেন?
ভদ্রলোক দাঁড়ালেন। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, সব কথা তোমাকে খুলে বলা সম্ভব নয়। মনে করো, আমার ভাল হবে তাই তোমাকে অনুরোধ করছি।
কথা শেষ করে তিনি দাঁড়ালেন না। পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল কঙ্কাবতী। বাবার মৃত্যুর খবর শুনে এক ধরনের শূন্যতাবোধে আক্রান্ত হয়েছিল সে। কিন্তু মৃত্যু কী তা সে দেখেনি। আজ যেন চোখের সামনে মরণকে দেখতে পেল সে। পেয়ে অসাড় হয়ে গেল। হঠাৎ একটা চাপা গালাগাল কানে এল। কঙ্কাবতী শুনল মা বলছে, বেশ হয়েছে, বাপের বয়সী মানুষের সঙ্গে জড়ালে তো এমন হবেই। কোনওদিন কিছু বলিনি, ভেবেছিলাম লোকটা মাস্টারি করে, কিন্তু এসব তো মাস্টারের কথা নয়।
মা! চিৎকার করে উঠেছিল সে। তারপর বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে গিয়েছিল।
চাপা গলায় মা বলল, এখন আর চেঁচিয়ে কী হবে? পাড়াপড়শিরা এতদিন ফিসফাস করত এখন চেঁচিয়ে কথা বলবে। যে লোকটা তোর বাপের চেয়ে বড় তার সম্পর্কে কিছু না জেনে জড়াতে গেলি? সবাই বলে, তোমার মেয়ে একদম আলাদা। বড় হচ্ছে, শরীর বাড়ছে কিন্তু বস্তির আর পাঁচটা মেয়ের মতো ছেলেদের সঙ্গে ফ্যা-ফ্যা করে ঘুরে বেড়ায় না। পড়াশুনা নিয়ে থাকে। এখন মর।
সমস্ত শরীর জুড়ে কান্নার ঢল নেমেছিল। মায়ের কথাগুলো আর কানে ঢুকছিল না। আমি যতদিন আছি তুমি আমার সঙ্গে দেখা করতে যেও না। কেন? কোনও উত্তর খুঁজে পাচ্ছিল না সে। উনি ভাড়াটে ছিলেন। ভাড়াটেরা চিরকাল এক জায়গায় থাকে না। কোনও কারণে যদি ওঁকে চলে যেতে হয় সেটা অস্বাভাবিক নয়। দূরে চলে গেলেও তো যোগাযোগ রাখা যায়। কিন্তু যাওয়ার আগে দেখা করতে নিষেধ করলেন কেন? তাও এই বাড়িতে এসে বলতে হল তাঁকে? কী অন্যায় করেছে সে?
মা বলল, অনেক হয়েছে, এইবার ওঠো। রাত হচ্ছে।
কঙ্কাবতী সাড়া দিল না। দু-তিনবার বলার পর মা তার পাশে এসে দাঁড়াল, শোন, এখন কান্নাকাটি করে কোনও লাভ নেই। লোকটা চলে গেলে তোর কি ক্ষতি হবে?
ক্ষতি হবে? সে কী করে বোঝাবে? চুপ করে রইল সে, বালিশে মুখ গুঁজে।
এখন চুপচাপ থাকলে পরে বিপদে পড়বি। তোর বিপদ মানে আমার বিপদ।
বিপদ? প্রশ্নটা আচমকা বেরিয়ে এল ঠোঁট থেকে।
হ্যাঁ। পুরুষদের কী। বয়স মানে না, মেয়েমানুষ পেলেই ফুর্তি করে নেয়। বলে গেল, কদিন বাদেই চলে যাবে। তোর সঙ্গে যদি ওসব করে থাকে তা হলে এখনই বল, ওকে আমি ছাড়ব না। পার্টির লোকজনকে বলে কান ধরে বিয়ে করতে বাধ্য করব।
না। চেঁচিয়ে উঠল কঙ্কাবতী।
বোকামি করিস না। প্রেম ভালবাসা এক জিনিস আর পেটে বাচ্চা এসে গেলে কারও কাছে মুখ দেখাতে পারব আমরা? তোর আর পড়াশুনা হবে?
বিছানায় উঠে বসল সে, তিনি আমার বাবার মতন, হয়তো, তার চেয়েও বেশি।
সে কী? মায়ের মুখটা অদ্ভুত হয়ে গেল।
তুমি ওসব কথা আর কখনও বলবে না।
আমি না বললেও পাঁচজনে তো বলতে ছাড়বে না। কজনকে বোঝাবি লোকটা তোর বাবার চেয়েও বেশি? বাবার চেয়েও বেশি কেউ হতে পারে বলে জানতাম না।
কথা বলতে ভাল লাগছিল না। ইচ্ছে করছিল, তখনই, ওই রাতে তাঁর কাছে ছুটে গিয়ে প্রশ্ন করতে। কিন্তু সেটা সম্ভব ছিল না। মা যেতে দিত না। তা ছাড়া অত রাত্রে একা সে কখনও বাড়ির বাইরে যায়নি।
রাত্রে কিছু খেল না। বিছানায় শুয়েও ঘুম এল না। এমনিতেই এখানে পৃথিবী নিঃশব্দ, তবু বস্তির লোকজনের গলা থেমে গেলে সেটা আরও ভয়ঙ্কর বলে মনে হচ্ছিল কঙ্কাবতীর। উনি চলে যাবেন, আর দেখা করতে চান না ভাবতেই চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে আসছিল তার। শেষ পর্যন্ত ঘুম এল না। মানুষের বুকে যদি কান্না ছিটকে ওঠে তা হলে ঘুম উধাও হয়ে যায়।
সকাল হল। ভোরবেলায় মা রান্না করে রেখে সাততাড়াতাড়ি স্কুলে চলে যায়। আজও গেল। মায়ের সঙ্গে কোনও কথা হল না তার। সে যে প্রতিদিনের মতো বিছানা ছেড়ে পড়াশুনা শুরু করছে না দেখেও মা চুপ করে রইল। যাওয়ার সময় শুধু শুনিয়ে গেল, কাল রাত্রে উপোস দিয়েছ, খাবার ঢাকা দিয়ে গেলাম, দয়া করে খেয়ে নিও। সে শুনল, জবাব দিল না।
আজ রোদ ওঠেনি। ছায়া ছায়া পাহাড়ে কুয়াশারা ছড়িয়ে আছে এখানে ওখানে। এরকম আবহাওয়া দেখলে খুব মন খারাপ হয়ে যেত কঙ্কাবতীর। আজ হল না। মন আর কত বেশি খারাপ হতে পারে!
দূর থেকে বাড়িটাকে দেখা মাত্র পা দুটো আড়ষ্ট হয়ে গেল। উনি নিষেধ করে গিয়েছেন, যদি তাকে দেখে রেগে যান? সঙ্গে সঙ্গে মনে হল, যতই রাগুন, ওঁকে প্রশ্ন করার অধিকার তার আছে। বাড়িটার কাছে চলে এসে কঙ্কাবতী দেখল জানলাগুলো খোলা কিন্তু গান বাজছে না। এই বাড়িতে উনি আছেন কিন্তু টেপরেকর্ডার বন্ধ এমন কখনও হয়েছে বলে মনে পড়ল না। ওপরের জানলার দিকে নজর যেতেই সে দেখতে পেল কালকের সেই ভদ্রমহিলা যিনি কাঠমাণ্ডু থেকে মেয়েকে নিয়ে এসে এখানে ফ্ল্যাট ভাড়া করে আছেন তিনি জানলা দিয়ে নিঃশব্দে হাত নেড়ে তাকে ডাকছেন। ভদ্রমহিলার মুখের অভিব্যক্তি এবং হাত নাড়া দেখে খুব অবাক হল সে। যেন অত্যন্ত জরুরি কিছু জানাতে উনি ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
চট করে একতলায় ঢুকতে সাহস হচ্ছিল না বলে ওপরের আমন্ত্রণে সাড়া দিল সে। দোতলায় ওঠার সিঁড়ি পাশে। ওপরে উঠতেই ভদ্রমহিলাকে দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। এক মুখ হাসি নিয়ে কঙ্কাবতীর হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গেলেন তিনি।
আলাপ হয়ে গিয়েছে, আমার সঙ্গে আলাপ হয়ে গিয়েছে। হাসি চলকে উঠল।
ও। কঙ্কাবতী গম্ভীর হয়ে গেল।
কী ভাল মানুষ। নেপালিও বলতে পারেন।
কী করে আলাপ হল?
আর বোলো না। কাল সন্ধেবেলায় হঠাৎ লোডশেডিং হয়ে গেল। ঘরে কেরোসিন নেই যে হ্যারিকেন জ্বালব। ছোট্ট একটা মোমবাতি ছিল, সেটা জ্বালিয়ে ভয় পেলাম শেষ হয়ে গেলে কী করব! তখন ওই অন্ধকারে নীচে যেতেই দেখলাম ওর ঘরে আলো জ্বলছে। ওই যে ব্যাটারির আলো। সাহস করে দরজায় আওয়াজ করলাম। উনি তো আমাকে দেখে খুব অবাক। বললাম। শুনে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে একটা বড় মোমবাতি দিয়ে দিলেন।
তখন উনি নেপালিতে কথা বললেন?
হ্যাঁ। আর বাচ্চা একা আছে, অন্ধকারে ওপরে উঠতে হবে বলে আমাকে এখানে পৌঁছে দিয়ে গেলেন। আমি কত করে ওঁকে বসতে বললাম, এক কাপ চা খাওয়াতে চাইলাম, উনি কিছুতেই রাজি হলেন না। বললেন, আর একদিন আসবেন। কথাগুলো বলার সময় ভদ্রমহিলার মুখে খুশি উপচে পড়ছিল।
ভালই তো।
ভদ্রমহিলা কঙ্কাবতীর হাত ধরলেন, তুমি আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট। কিন্তু বুঝতেই পারছ, এখানে একদম একা থাকি, কিছুতেই সময় কাটতে চায় না, তাই ওঁর সঙ্গে যদি বন্ধুত্ব হয় তা হলে বেঁচে যাই। একই বাড়িতে থাকি বলে বাইরের কেউ বুঝতে পারবে না। আমার না ওঁকে খুব ভাল লেগেছে।
সে কি! আপনি তো বিবাহিতা–!
আহা। আমি তো বন্ধুত্বের কথা বলেছি। একা থাকলে বিবাহিতা মেয়েরও বন্ধুর প্রয়োজন হয়। আর একটু বড় হও তখন বুঝবে।
কথাটা তখনই তাঁকে বললে ভাল হত না?
চান্স পেলাম কোথায়? উনি যখন এই দরজায়, কিছুতেই ভেতরে ঢুকছেন না ঠিক তখন নীচে একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল। হর্ন শুনে উনি নীচে নেমে গেলেন। তারপর নীচে খুব চেঁচামেচি হল। আমি তো ভয়ে মরি। আধঘণ্টা বাদে দেখলাম একজন মহিলা আর একজন পুরুষ ওঁর ওখান থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠে গেল।
এটা কখন হয়েছিল? কঙ্কাবতী শক্ত হল।
এই তো, সন্ধের কিছু পরে। কী ব্যাপার, তুমি জানো?
আমি কী করে জানব?
ওঁর আত্মীয়স্বজনকে কখনও দেখোনি?
না। আচ্ছা, আমি চলি।
আহা, এখনই যাবে কি! তুমি নিশ্চয়ই ওঁর কাছে যাচ্ছ? ওঁকে তো বলতে পারো আমার কথা। মানে, আমি তোমার দিদির মতো, আমার কাছে কোনও সঙ্কোচ যেন না করেন। ভদ্রমহিলা কঙ্কাবতীর কাঁধে হাত রাখলেন।
ওঁর সঙ্গে আমার এসব কথা বলার সম্পর্ক নয়। কথাগুলো বলেই দ্রুত নীচে নেমে এল কঙ্কাবতী। দরজা ভেজানো ছিল। মৃদু শব্দ করল সে।
খোলাই আছে। ভেতর থেকে গলা ভেসে এল।
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল কঙ্কাবতী। এই ঘরে তিনি নেই। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। তোয়ালেতে মুখ মুছতে মুছতে তিনি এলেন। ওকে দেখতে পেয়ে অবাক হয়ে তাকালেন। তারপর গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, কী ব্যাপার?
আপনার সঙ্গে কথা বলতে এসেছি।
কিন্তু আমি তোমাকে এখানে আসতে নিষেধ করেছিলাম।
আমি কি জানতে পারি কেন আপনি নিষেধ করেছেন?
এস কে রায় কিছুক্ষণ কঙ্কাবতীর দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর তোয়ালে রেখে এগিয়ে এসে ওর হাত ধরে জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে তোমার?
হঠাৎই সমস্ত শরীর কাঁপিয়ে কান্না এল। অনেক চেষ্টায় সেটা সামলে নিতে পারল কঙ্কাবতী। তারপর কোনওমতে মাথা নেড়ে না বলল।
তোমার মুখের অবস্থা এরকম কেন? রাত্রে ঘুমোওনি?
কঙ্কাবতী কোনও জবাব না দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিল।
তুমি বোসো, এখানে বোসো। চেয়ারটা দেখিয়ে দিলেন তিনি।
কঙ্কাবতী বসল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সে দু হাতে মুখ ঢেকে ফেলল। তার শরীর কাঁপছিল। এস কে রায় বললেন, কঙ্কা, আমি খুব দুঃখিত, তোমাকে কষ্ট দিতে কখনও চাইনি। কিন্তু এ ছাড়া আমার কোনও উপায় ছিল না।
কঙ্কাবতী মুখ তুলল না। আর একটা চেয়ারে গিয়ে বসলেন এস কে রায়। তারপর বললেন, তুমি যখন প্রথম এক বান্ধবীর সঙ্গে এখানে এসেছিলে তখন বেশ ছোট ছিলে, বাইরের পৃথিবী সম্পর্কে কিছুই জানতে না। প্রতিটি দিন তোমাকে আমি যা জানি তা শিখিয়ে এসেছি। নিজের মেয়েকে বাবা যেমন করে শেখায় তার চেয়ে কিছু কম আমার ইচ্ছে ছিল না। তোমার মধ্যে আগ্রহ ছিল তাই আমার ভাল লাগত। কিন্তু আমাকে এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে অনেক দুঃখে, না নিয়ে উপায় ছিল না।
হাত না সরিয়ে কঙ্কাবতী জিজ্ঞাসা করেছিল, কেন?
তাহলে তোমাকে আমার কথা বলতে হয়। আমি কলকাতার মানুষ। ভাল চাকরি করতাম। গল্প উপন্যাস লিখতাম। লিখে নাম হল। যে নাম হলে একজন লেখককে আর কোনও চাকরি করতে হয় না, সেই রকম পর্যায়ে পৌঁছে গেলাম। তোমাকে আমি অনেকের লেখা পড়িয়েছি কিন্তু কখনও নিজের লেখা পড়তে দিইনি। আমি বিবাহিত। কিন্তু আমাদের সন্তান হয়নি। এ নিয়ে কোনও সমস্যা আমার হয়নি। স্ত্রীর সঙ্গে বিয়ের কয়েক বছর পর থেকেই আমার দুরত্ব বাড়ে। সেটা কার দোষে তা এখন বিচার করা যাবে না। হয়তো তাঁর কিংবা আমার। আমি বিভিন্ন সভাসমিতিতে যাই, কলকাতার বাইরেও যেতে হত। নিজেকে নিয়েই থাকতাম। তিনি কলেজে পড়ান, তাঁর মতো চলেন। এই সময় আমাদের জীবনে এমন কিছু ঘটল যা তোমাকে বলা যাবে না। সেই ঘটনার জেরে আমরা দুজনে দুই মেরুর মানুষ হয়ে গেলাম। কলকাতা আমার আর ভাল লাগছিল না। এমনকী লেখালেখিতেও কোনও উৎসাহ ছিল না। জীবন সম্পর্কেই সমস্ত উৎসাহ হারিয়ে ফেললাম। শেষ পর্যন্ত ঠিক করলাম, বাকি জীবনটা কোনও নির্জন জায়গায় গিয়ে একাই কাটিয়ে দেব। মোটামুটি চলে যায় এমন সঞ্চয় নিজের জন্যে রেখে বাকিটা তাঁকেই দিয়ে দিলাম। আমার প্রকাশকদের বলে দিলাম তাঁর অ্যাকাউন্টে পাওনা টাকা জমা দিতে। প্রথমে গিয়েছিলাম সমুদ্রের ধারে। কিন্তু ওই যে ঢেউ-এর আসা ও ফিরে যাওয়া, একই নিয়মে, দেখতে দেখতে একঘেয়েমি এসে গেল। ওটা যেন মানুষের জীবনের মতো। অনেক উৎসাহ নিয়ে শুরু করে একটা বিশেষ সীমায় আটকে যাওয়া। চলে এলাম পাহাড়ে। এই বাড়ি ভাড়া নিলাম। একটু একটু করে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। দিনরাত পাহাড় তার চেহারা পাল্টায় নানারকমভাবে, সময়টা চমৎকার কেটে যায়। গান শুনি, বই পড়ি। যে আমি তিরিশ বছর ধরে ক্রমাগত লিখে গিয়েছি সেই আমার লেখার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে হয় না। যেন এতদিন সেই বুড়োটা ঘাড়ে উঠে চেপে বসেছিল, চাকরবাকর করে রেখেছিল, তার হাত থেকে মুক্তি পেয়ে কী আরাম লাগত না লিখে। তুমি এলে। তোমাকে পেয়ে আমার উৎসাহ বেড়ে গেল। এই কবছর ধরে তোমাকে শেখাব বলে কতরকম কথা ভেবেছি। আর সেটা করতে গিয়ে মাথায় লেখার ভাবনা যে আসেনি তা নয়। আমি ডায়েরি লিখে গিয়েছি। কঙ্কা, তুমি নেপালি মেয়ে, যে পরিবেশে জন্মেছ, সেই পরিবেশকে অতিক্রম করেছ। আর তার জন্যে আমার কোনও ভূমিকা আছে ভাবতে খুব ভাল লাগে।
এস কে রায় কথা বলতে বলতে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলেন জানলার দিকে। শেষের কথাগুলো বোধহয় নিজেকেই নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি।
তাহলে আমাকে এখানে আসতে নিষেধ করলেন কেন?
কারণ আমি এখান থেকে চলে যাচ্ছি। তোমার সঙ্গে প্রতিদিন দেখা হলে আমার যেতে কষ্ট হবে। এস কে রায় তাকালেন।
আমার যে শুনেই কষ্ট হচ্ছে।
জানি। কঙ্কা! তুই আমার মেয়ে, তাই না?
হ্যাঁ।
কিন্তু ওরা অন্য কথা বলছে।
কঙ্কাবতী অবাক হয়ে তাকাল।
এস কে রায় মুখ ফিরিয়ে বললেন, গতরাতে আমার স্ত্রী এসেছিলেন। সঙ্গে ছিল কাউন্সিলের একজন। আমার স্ত্রীর ধারণা কলকাতা থেকে পালিয়ে এসে আমি পাহাড়ি মেয়েদের নিয়ে এখানে মজা করছি। উনি খোঁজখবর নিয়ে জানতে পেরেছেন একটি অল্পবয়সী মেয়ে রোজ আমার কাছে আসে। মেয়ের বয়সী হলেও আমার যে ললিতা কমপ্লেক্স তৈরি হয়নি তার নিশ্চয়তা কোথায়? পুরুষমানুষের মধ্যে নাকি একটা জন্তু সবসময় জেগে বা ঘুমিয়ে থাকে। উনি আমার বিরুদ্ধে মামলা করতে চান। আমাকে শাস্তি না দিলে তৃপ্তি পাবেন না কিন্তু কিছুতেই ডিভোর্স দেবেন না। মাননীয় সদস্য বলে গেলেন, বিবাহিত বাঙালি যদি পাহাড়ি মেয়েদের সঙ্গে ঝুটঝামেলা করে তা হলে সেটা ক্ষমা করা হবে না। আমি সেই কারণেই তোকে আমার কাছে আসতে নিষেধ করেছি। আমার যা হয় হোক, জীবন তো ফুরিয়ে আসছে, কিন্তু তোর সামনে অনেকটা পথ মা, মাথা উঁচু করে সেই পথ হেঁটে যেতে হবে তাকে।
কে কী বলল তাতে আমার কিছু এসে যায় না। আমার বাবার পক্ষে যা সম্ভব ছিল না তা আমি আপনার কাছে পেয়েছি। আপনিই তো বলেছেন যিনি জন্ম দেন তিনি যেমন বাবা তেমনই যিনি শিক্ষা দেন তিনিও। তা হলে?
ওরে, এসব সত্যি। কিন্তু এইসব সত্যিগুলোকে ঘোলা করতে কিছু লোক আইনের আশ্রয় নেয়। ওরা যদি তোকেও আদালতে হাজির করে সেটা আমার ভাল লাগবে না। আর মানুষের স্বভাব হল যে কোনও নোংরা অভিযোগ উপভোগ করা। তোর ক্ষেত্রে সেটা হোক আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারি না।
হঠাৎ কেঁদে ফেলল কঙ্কাবতী, আমি তা হলে কী করব?
পড়াশুনা করবি। অনেক ওপরে উঠবি। আমি তোকে একটা ঠিকানা দিয়ে যাচ্ছি, যে কোনও প্রয়োজনে আমাকে ওই ঠিকানায় লিখলেই আমি সেটা জানতে পারব। আর শোন, ওই টেপরেকর্ডার আর এই ক্যাসেটগুলো তুই নিয়ে যা। এগুলোর মধ্যেই আমি থাকব।
কী করে?
যখন গানগুলো বাজাবি তখনই আমার কথা মনে পড়বে তোর।
আমার ওরকম মনে পড়া চাই না।
দুর পাগলি! যে কোনও সৃষ্টির মধ্যে স্রষ্টা বেঁচে থাকেন। তাজমহল দেখলে শাজাহানের কথা মনে পড়বেই। রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনলে বা কবিতা পড়লে তিনি আমাদের কাছে বেঁচে ওঠেন। আমি সাধারণ মানুষ, স্রষ্টা নই। এই দেখ, এই আংটিটা, আমার মা দিয়েছিলেন, এটার দিকে তাকালেই মাকে মনে পড়ে। তেমনই ওই রেকর্ডারে গান শুনলে তোর ঠিক আমাকে মনে পড়বে।
মনে পড়ার জন্যে গান শুনতে হবে?
ঠিক আছে বাবা, তোর কাছে ওগুলো থাকলে আমার ভাল লাগবে। হল?
আপনি কোথায় চলে যাচ্ছেন? করুণ গলায় জিজ্ঞাসা করল কঙ্কাবতী।
এখনও ঠিক করতে পারিনি। কলকাতায় আমি ফিরব না।
আপনার সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না? দু চোখে জল এসে গেল।
কেন হবে না? তোর যখন খুব প্রয়োজন হবে তখন লিখিস, ঠিক চলে আসব। এস কে রায়ের কথা শেষ হওয়া মাত্র গাড়ির আওয়াজ কানে এল। গাড়িটা থামল বাড়ির সামনে। খোলা দরজা দিয়ে কঙ্কাবতী দেখল একজন প্রৌঢ়া মহিলা গাড়ি থেকে নেমে হনহন করে এ দিকেই আসছেন। তার খুব ভয় লাগল। সে উঠে দাঁড়াতেই ভদ্রমহিলা দরজায় পৌঁছে গেলেন। অদ্ভুত চোখে কঙ্কাবতীকে দেখে তিনি এস কে রায়ের দিকে তাকালেন, এই নাকি? এ তো নেহাতই পুঁচকে!
এস কে রায় হাসলেন, তা হলে বোঝো, কতখানি খারাপ চিন্তা তোমার মাথায় এসেছিল? কে কী বলেছে তাই শুনেছ, নিজের চোখে দেখে নিশ্চয়ই লজ্জা পাচ্ছ।
মুখ শক্ত হয়ে গেল প্রৌঢ়ার, মোটেই না। পুরুষদের চিনতে আমার বাকি নেই। ছেলের জন্যে মেয়ে দেখতে গিয়ে নিজেই বর হয়ে বসতে চায়। যাক গে, কাল রাত্রে মনে হয়েছিল সকালে ভালভাবে কথা বলব। তোমাকে একটা সুযোগ দেওয়া দরকার। সে কারণেই এসেছিলাম। কিন্তু তোমার বালিকা-প্রেমিকাকে এই সাতসকালে এখানে দেখতে পাব তা ভাবিনি।
এস কে রায় চিৎকার করে উঠলেন। ওই গলায় তাঁকে বলতে কখনও শোনেনি কঙ্কাবতী, গেট আউট, বেরিয়ে যাও এখান থেকে। তোমার যদি মেয়ে থাকত তা হলে তার সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে তুমি সন্দেহ করতে। তোমার মতো মেয়েরা যারা জীবনে কাউকে সুখী করতে পারে না তারা তো এমনই নোংরা হবেই। কথাগুলো বলতে বলতে এস কে রায় কঙ্কাবতীর দিকে তাকালেন, মাগো, প্লিজ, তুই বাড়ি চলে যা। জীবনের এই কুৎসিত দিকটা তুই দেখিস তা আমি চাই না। যা।
কঙ্কাবতী দু চোখে জল নিয়ে উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়োল। তার চোখের সামনে জলের আড়াল, কোথায় যাচ্ছে কোন দিকে, ঠাওর না করেই ছুটছিল। হঠাৎ ডান পায়ের বুড়ো আঙুল কনকন করে উঠল, শরীরটা ছিটকে উঠে পড়ে গেল রাস্তার এক পাশে। এবং সেই মুহূর্তেই পৃথিবী অন্ধকার। জায়গাটা যেহেতু বাঁকের এ পাশে তাই এস কে রায়দের বাড়ি থেকে দেখা গেল না। জায়গাটা নির্জন, এই পতন দেখার জন্যে কেউ কাছাকাছি ছিল না। মিনিট খানেকের মধ্যেই চেতনা ফিরে এল কঙ্কাবতীর। ঝটপট উঠে বসতেই সে দেখতে পেল আঙুল থেকে রক্ত বেরিয়ে যাচ্ছে। শক্ত হাতে চেপে ধরল সে আঙুলটা। অথচ রক্ত বন্ধ হচ্ছে না। সঙ্গে রুমাল নেই। একটা গাঁদাফুলের গাছ দেখতে পেয়ে তার পাতা ছিঁড়ে ক্ষতমুখে চেপে ধরল সে। রক্ত কমে এল। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাড়ি ফিরল সে। মা নেই। দরজা খুলে ছেঁড়া কাপড়ে আঙুল বাঁধল সে। তার সমস্ত শরীর ঝিমঝিম করছিল। ভদ্রমহিলার মুখটা মনে পড়ল। কী ভয়ঙ্কর গলায় কথা বলছিলেন তিনি। শরীরে কাঁপুনি এল। দাঁড়াতে পারছিল না কঙ্কাবতী।
বিকেলবেলায় যখন মা এল তখন কঙ্কাবতীর ধুম জ্বর। চোখ লাল, গলার স্বরে কাঁপুনি। মা দেখল বিছানার পায়ের দিকটায় রক্তের ছাপ। রক্ত বন্ধ হয়েছে কিন্তু বিছানায় শোওয়ার পরও পা থেকে পড়েছে। মা ব্যস্ত হয়ে পড়ল। জিজ্ঞাসা করল, কী করে জ্বর বাধালি? পা কাটল কী করে?
কঙ্কাবতী জবাব দিল না। জবাব দেওয়ার মতো শারীরিক ক্ষমতা তার ছিল না। মা ছুটল ডাক্তারখানায়। ট্যাবলেট কিনে নিয়ে এসে খাওয়াল। জ্বরের ঘোরে চমৎকার ঘুম এনে দিল কঙ্কাবতীকে।
জ্বর ছাড়ল ঠিক দুটো দিন পরে। রক্তপাত বন্ধ হয়ে গেছে প্রথম দিনেই। ডাক্তার তামাং এসেছিলেন। জ্বরো চোখে তাঁকে দেখেছিল কঙ্কাবতী। হাসি হাসি মুখে অনেক উৎসাহ দিয়ে গেলেন। কিন্তু জ্বর ছাড়ার পর মাটিতে পা ফেলতে গেলেই মাথা ঘুরতে লাগল তার। ডাক্তারের কাছ থেকে ঘুরে এসে মা বলল, পেট ভরে খেতে হবে। এখন স্কুলে যাওয়া চলবে না। শরীর ঠিক না হওয়া পর্যন্ত বাইরে বের হওয়া বারণ।
কঙ্কাবতী কোনও কথা বলল না। তার কিছুই ভাল লাগছিল না। যে মানুষটাকে সে বাবার বিকল্প বলে ভেবেছিল, তার চেয়ে বয়সে জ্ঞানে কত বড় মানুষ, তাঁকে কেন আক্রমণ করছেন মহিলা? তার যদি ক্ষমতা থাকত তা হলে গিয়ে মহিলাকে বোঝাত। তিনি বললেন, এটা জীবনের কুৎসিত দিক। কুৎসিত মানে যদি খারাপ কদাকার হয় তা হলে জীবনের অনেক কিছুই তো সেরকম। তাদের এই বস্তিতেই জন্ম থেকে বড় হতে হতে সে এরকম অনেক কিছুর সঙ্গে পরিচিত হয়েছে। বাবা মা ভাই বোন বন্ধুর সম্পর্কগুলো মাঝেমাঝেই এখানে বদলে যায়। তাই নিয়ে চেঁচামেচি হয়, কদিন সবাই কথা বলে, তারপর সব কিছু ঝিমিয়ে যায়। তিনি তাকে দেখাতে না চাইলেও, জানেন না, সে ইতিমধ্যেই দেখে ফেলেছে। ওখানে থাকলে এর চেয়ে বেশি কী দেখত? এইটুকু ভাবতেই মাথা ঝিমঝিম করে উঠল।
মা ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মেয়ের শরীরে জ্বর নেই। কিন্তু এত দুর্বল যে কেউ না ধরলে বাথরুমে যেতে পারবে না। ডাক্তার তামাং ওষুধ দিচ্ছেন, কিন্তু তাতে তেমন কাজ হচ্ছে না। স্কুলে যাওয়ার কোনও উপায় নেই। সেসব ভাবলেই মেয়ের কান্না শুরু হয়ে যায়। অনেক প্রশ্ন করেও মা জানতে পারেনি কেন পড়ে গিয়েছিল, কেন জ্বর এল?
এই সময় গণেশের আগমন। দিশেহারা মা যেন তাকে পেয়ে বেঁচে গেলেন। গণেশ পার্টির কর্মী। মুখে সব সময় খই ফুটছে। ডাক্তার তামাং-এর কাছে কঙ্কাবতীর খবর পৌঁছে দেয় সে। একদিন মাকে বলল, একজন তান্ত্রিক এসেছেন। তিব্বতি তান্ত্রিক। তিনি সব অসুখ সারিয়ে দিতে পারেন, সেখানে নিয়ে চলল ওকে।
কোথায়?
পাঙ্খাবাড়িতে। খুব ভিড় হচ্ছে, এমনিতে গেলে দেখা পাবে না। কিন্তু পার্টির লোক বলে আমি ঠিক ম্যানেজ করে নেব। দাঁত বের করে হাসল গণেশ।
মা খুব উৎসাহিত হল। কিন্তু পাঙ্খাবাড়িতে কঙ্কাবতীকে নিয়ে যাওয়া হবে কী করে? গাড়ি ভাড়া করতে প্রচুর খরচ হবে। গণেশ অভয় দিল, কিছু ভেবো না। ও হল শহিদের মেয়ে। বিনা পয়সায় গাড়ি নিয়ে আসছি। আজ রবিবার, সামনের মঙ্গলবার রেডি থেকো তোমরা।
মা বলল, বাবা গণেশ, তুই না থাকলে আমাদের যে কী হত?
গণেশ হাসল। উত্তর না দিয়ে কঙ্কাবতীর খাটের কাছে এল, এই যে মেমসাব, আমার ওপর ভরসা রাখো, কোনও চিন্তা নেই।
কঙ্কাবতী মুখ ফিরিয়ে নিল দেওয়ালের দিকে। গণেশ বলল, বুঝলে চাচি, তোমার মেয়ে আমাকে পছন্দ করে না।
আচ্ছা, অপছন্দ করার কী আছে। এত উপকার করছ।
তার ওপর পার্টি থেকে আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে বাস ট্যাক্সি যাতে কোনও ঝামেলা না করে তা দেখতে। ওদের ইউনিয়নের সঙ্গে ওঠাবসা করতে হচ্ছে। বুঝতেই পারছ এ লাইনে কামাই কী রকম?
তা তো ঠিকই। মা বলল।
তোমার মেয়ের মুশকিল কী জান চাচি, ও মেমসাহেবদের স্কুলে অনেকটা পড়াশুনো করে ফেলেছে। ওহো, তোমার কোনও চিন্তা নেই আর চাচি।
কেন? বুঝতে না পেরে মা জিজ্ঞাসা করল।
সেই বাঙালি বুড়োটা ভেগেছে।
ভেগেছে।
হ্যাঁ। ফ্ল্যাট খালি করে চলে গিয়েছে। তোমাকে বলেছিলাম মেমসাব যেন ওর কাছে পড়তে না যায়। তুমি শোনোনি।
আমি বললেই ও যেন শুনছে। বলে বাবার কাছে মেয়ে যাচ্ছে!
তাই নাকি? এ দিকে লোকটার বউ এসে পার্টি অফিসে কমপ্লেন করেছে তার স্বামী চরিত্রহীন লম্পট। বাচ্চা মেয়েদের সঙ্গে প্রেম করে। আর একটু হলেই মেমসাব ফেঁসে যেত। লোকটাকে পুলিশের হাতে তুলে দেবার আগেই যখন নিজে চলে গেল তখন আর আমরা ঝামেলা বাড়াতে চাইলাম না।
কথাগুলো কানে যেতেই শরীর শক্ত হয়ে গেল কঙ্কাবতীর। তিনি চলে গিয়েছেন? চলে যে যাবেন তা অবশ্য বলেছিলেন কিন্তু এমনভাবে চলে যাবেন? কঙ্কাবতীর মনে পাথর জমল কিন্তু তার এখন আর কান্না পেল না।
মা বলল, বাঁচা গেছে। আপদ দূর হয়েছে। আমার মেয়ে ওর কাছে পড়া বুঝতে যেত, তার বেশি আর কী সম্পর্ক বাবার বেশি বয়সী মানুষের সঙ্গে হতে পারে। আমি তো শুনেছি ওই বাড়িতে একটা বউ বাচ্চা নিয়ে একাই থাকে। তার সঙ্গে কিছু হয়েছিল কি না কে জানে!
গণেশ হাসল, না চাচি। ওই বউটা খুব ভাল। ওর স্বামী কাঠমণ্ডুতে থাকে। আমাদের অফিসে এসে ডোনেশন দিয়ে গেছে। এই তো, গতকাল গিয়েছিলাম খবর নিতে। আমাকে অনেক কিছু খাওয়াল। নীচের ফ্ল্যাটের লোকটা সম্পর্কে ওর ধারণা খুব খারাপ। বলল, অল্প বয়সী মেয়ের ওপর নাকি ওর খুব ঝোঁক ছিল। আমি অবশ্য এসব কথায় কিছু মনে করিনি। লোকে তো বানিয়ে বানিয়ে কত কথা বলে।
কঙ্কাবতী এবার উঠে বসল, মা, আমি সামনের মঙ্গলবার কোথাও যাচ্ছি না।
যাচ্ছিস না মানে? মা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল।
তান্ত্রিকরা যদি সব অসুখ সারিয়ে দিতে পারত তা হলে দেশে কোনও ডাক্তারের দরকার হত না, হাসপাতালও তৈরি হত না। ওরা সবাই ভয় দেখিয়ে ভাওতাবাজি করে। বোকা লোকজন সেই ভাঁওতায় ভোলে।
তুই সব জেনে বসে আছিস?
জানি বলেই বলছি।
এইটুকু মেয়ে তুই আমার চেয়ে বেশি জানবি?
হ্যাঁ মা, সত্যি কথাটা শোনো। তোমার চেয়ে আমি অনেক বেশি জানি।
কী বললি? মা চেঁচিয়ে উঠল, আমি তোকে জন্ম দিয়েছি আর আমাকেই তুই এ কথা বললি? শুনেছ, শুনেছ গণেশ, মেয়ের কথা শুনেছ?
গণেশ হাসল, বেশি পড়াশুনো করলে হিন্দুরা খ্রিস্টান হয়ে যায়। ওর কোনও দোষ নেই। তান্ত্রিকের দেওয়া ওষুধ খেয়ে অসুখ যখন সেরে যাবে তখন বুঝতে পারবে। ঠিক আছে চাচি, আমি এখন যাব। অনেক কাজ পড়ে আছে। ওবেলায় আসব একবার।
গণেশের এই আসা-যাওয়া একদম ভাল লাগে না কঙ্কাবতীর। মা যখন থাকে না তখন গণেশ যেভাবে তার দিকে তাকিয়ে থাকে তাতে খুব অস্বস্তি হয় ওর। কিন্তু মাকে বোঝালেও বুঝবে না। এস কে রায় খুব খারাপ লোক আর ওই বাড়ির ওপরের তলার বউটা বেশ ভাল, এসব শুনলে মাথা গরম হয়ে যায় কিন্তু কঙ্কাবতী বুঝে গিয়েছে প্রতিবাদ করে কোনও লাভ হবে না।
পরদিন দুপুরে একটা লোক এল। মা তখন স্কুলে। খাট থেকে নেমে দরজা খুলতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। পা ফেললেই মাথা ঘুরছে অথচ শুয়ে থাকলে তেমনটা হচ্ছে না। লোকটা নেপালি, হাতে একটা বড় পিজবোর্ডের বাক্স। বলল, কুরিয়ার সার্ভিস থেকে আসছি। কঙ্কাবতী কার নাম?
আমার।
বস্তির কয়েকজন কৌতূহল নিয়ে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিল। লোকটা তাদের জিজ্ঞাসা করল, এর নাম কঙ্কাবতী?
ওরা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।
লোকটা বাক্সটা ঘরে নামিয়ে রেখে কাগজ বের করে সই করিয়ে নিয়ে চলে গেল। পাশের ঘরের মাসি এগিয়ে এল, ওমা, কত বড় বাক্স। তোর নামে এল? কে পাঠাল রে?
জানি না। নিচু স্বরে বলল কঙ্কাবতী।
নিশ্চয়ই অনেক দামি জিনিস আছে। পার্টি থেকে দিল?
বললাম তো জানি না। বলে মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিল কঙ্কাবতী। এইটুকুতেই শরীর কাহিল হয়ে পড়েছিল বলে সে শুয়ে পড়ল। বাক্স খোলার কথা মনেই এল না।
ঘুম ভাঙল যখন তখন মা এসে গিয়েছে। সে দেখল টেবিলের ওপর বাক্স রেখে মা সেটাকে খুলছে। তারপর মায়ের উৎফুল্ল গলা শুনল, বাঃ। কী সুন্দর। কে পাঠাল রে?
কী?
টেপরেকর্ডার। সঙ্গে অনেকগুলো ক্যাসেট।
ঝটপট উঠে বসল কঙ্কাবতী। মা বলল, এত দামি জিনিস তোর নামে এল আর কে পাঠাল তা তুই জানিস না?
জবাব দিল না কঙ্কাবতী। কোনওমতে হেঁটে টেবিলের কাছে গেল সে। সেই টেপরেকর্ডার। উনি তো চলে গিয়েছেন এখান থেকে তা হলে পাঠালেন কী করে? উত্তরটা সঙ্গে সঙ্গে মাথায় এল। সে বাক্সের মধ্যে ঝুঁকে পড়ল। কোনও চিঠিপত্র নেই। মা টেপটা তুলে নিয়ে প্লাগটা গর্তে ঢোকাবার চেষ্টা করছে। ক্যাসেটগুলো দু হাতে তুলে নিয়ে বিছানায় চলে এল। সব রবীন্দ্রনাথের গান।
মা বলল, এ কী! এ যে সব বাংলা গান। হিন্দি নেই?
কঙ্কাবতী মাথা নেড়ে না বলল।
খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে মা বলল, বুঝতে পেরেছি। সেই বাঙালিটা পাঠিয়েছে। সত্যি কথা বল। ঠিক কি না?
আমি কী করে জানব?
তুই জানিস না? ওর বাড়িতে তুই এসব গান শুনিসনি?
শুনেছি। কিন্তু এগুলো যে উনি পাঠিয়েছেন তা জানব কী করে?
মা পাশে এসে বসল, ঠিক আছে, ঠিক আছে। এই বস্তিতে বাংলা গান বাজানোর দরকার নেই।
তা ছাড়া তোকে কেউ টেপরেকর্ডার পাঠিয়েছে শুনলে লোকে অনেক কুকথা বলবে। অভাবের সংসারে আমরা টেপরেকর্ডার নিয়ে কী করব। তার চেয়ে গণেশকে বলব এটা বিক্রি করে দিতে। তাতে দুটো পয়সা আসবে। তোর চিকিৎসার জন্যে তো টাকা লাগবে। দে, ওগুলোকে আবার বাক্সে ঢুকিয়ে রাখি।
না। শক্ত গলায় বলল কঙ্কাবতী।
না মানে? এগুলো আমি মরে যাওয়ার আগে বিক্রি করতে দেব না।
কেন? এত টান কেন এদের ওপর।
মা, শোনো, একটা গান শুনে দ্যাখো, তোমার মন ভরে যাবে। কঙ্কাবতী অনুনয় করল, তুমি আমার জন্যে এটা বাড়িতে রেখে দাও।
তুই এগুলো ওর কাছ থেকে চেয়েছিলি?
না। উনি নিজেই পাঠিয়েছেন।
মা কিছু না বলে সরে গেলেন। কঙ্কাবতী ক্যাসেটগুলো দেখতে লাগল। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ক্যাসেটটা প্রায়ই বাজাতেন তিনি। যেতে দাও যেতে দাও গেল যারা। তুমি যেও না, তুমি যেও না, আমার বাদলের গান হয়নি সারা। ক্যাসেটটা খুলল সে। খুলতেই খাপের ভেতরে কাগজের টুকরোটা চোখে পড়ল। এস কে রায়, কেয়ার অফ সুপ্রিয় বুকস, কলেজ স্ট্রিট, কলকাতা।
উনি বলেছিলেন তেমন কোনও সমস্যা হলে যোগাযোগ করতে। সেই কারণেই কি এই ঠিকানাটা পাঠিয়েছেন। আচ্ছা, যদি এই ক্যাসেটটা সে না দেখত! অদ্ভুত মন খারাপ হয়ে গেল কঙ্কাবতীর। উনি নিশ্চয়ই জানতেন এই ক্যাসেটটা সে দেখবেই।
ক্যাসেটটাকে রেকর্ডারে ঢুকিয়ে ভলুম কমিয়ে প্লে টিপে দিল কঙ্কাবতী। খুব আস্তে গান বাজছিল। খাটে বসে শোনা যাচ্ছিল না। কঙ্কাবতী টেপরেকর্ডারের কাছে কান নিয়ে গেল, দীপ নিবেছে নিবুক নাকো, আঁধারে তব পরশ রাখো বাজুক কাঁকন তোমার হাতে/আমার গানের তালের সাথে, যেমন নদীর ছলোছলো জলে ঝরে ঝরোঝরো শ্রাবণধারা। এখনও অনেক শব্দ স্পষ্ট মানে তৈরি করে না কঙ্কাবতীর কাছে তবু সব মিলিয়ে যে-অনুভূতিটা তৈরি হয় সেটা এই মুহূর্তেও হল। আর তখনই কঙ্কাবতী চোখ বন্ধ করল। না, সে একা নয়। কেউ তাকে ছেড়ে যায়নি।
সোমবার সকালে মায়ের স্কুলে যাওয়া হল না। গণেশ ডাক্তার তামাংকে নিয়ে এল। তিনি অনেকক্ষণ পরীক্ষা করলেন। চোখের পাতা, আঙুলের ডগা দেখলেন। তারপর বললেন, ওর রক্ত পরীক্ষা করতে হবে। খাওয়া-দাওয়া করে?
একেবারেই খেতে চায় না। মা অভিযোগ করল।
না খেলে চলবে কেন মা। কঙ্কাবতীর দিকে তাকিয়ে হাসলেন তিনি।
লোক এসে রক্ত নিয়ে গেল। বিকেলে মা সেই রিপোর্ট আনতে গেল। রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তার তামাংকে দেখাতে যাবে।
কঙ্কাবতী প্রায়ান্ধকার ঘরে একাই শুয়েছিল। শরীর দুর্বল, মাথা ধরে আছে আর কী রকম অস্বস্তি। সে বাক্সটার দিকে তাকাল। টেপরেকর্ডার ওর মধ্যে ঢুকিয়ে কাপড় দিয়ে আড়াল করে রেখেছে মা। কেউ দেখুক এটা চায় না।
কঙ্কাবতী ধীরে ধীরে উঠল। টেপরেকর্ডারকে চালু করতে শরীরের অনেক শক্তি খরচ করতে হল তাকে। মেঝের ওপর বসে টেপরেকর্ডারের কাছে গেল কঙ্কাবতী। জোরে বাজানো চলবে না। এ ঘরের বাইরে যেন আওয়াজ না যায়। কান পাতল সে, আমার সকল হৃদয় উধাও হবে তারার মাঝে/যেখানে ওই আঁধারবীণায় আলো বাজে। আঁধারবীণায় আলো কীভাবে বাজে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। কিছুটা বুঝে অনেকটা না বুঝে সেদিন চলে এসেছিল কঙ্কাবতী। আজ, এখন, এই অন্ধকার হয়ে আসা ঘরে বসে তার মনে হল এই কথাটাই সত্যি, খুব সত্যি, এখন দিক-বিদিকের শেষে এসে দিশাহারা কিসের আশায় বসে আছি অভয় মানি। অভয় মানি, অভয় মানি। অভয় মানে ভয় নেই।
ঠিক সেই সময় রিপোর্ট দেখে ডাক্তার তামাং-এর মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। কঙ্কাবতীর মায়ের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, আপনার মেয়ের হেমোগ্লাবিন মারাত্মক নেমে গিয়েছে। আমি যে ওষুধগুলো লিখে দিচ্ছি তা আজ থেকেই খাওয়াতে আরম্ভ করুন। কয়েকদিন পরে আবার ব্লাড পরীক্ষা করব। কিন্তু ওকে এসব কিছু বলবেন না।
.
২০.
একটা ইউক্যালিপটাস গাছ রয়েছে। নিরাময়ের এই দোতলা ঘরের জানলার ওপাশেই। কয়েকটা পাহাড়ি টিয়া সেই গাছের ডালে বসে ঘাড় ঘুরিয়ে এই ঘরের বাসিন্দাকে নজর করছিল। বিছানায় টানটান শুয়ে থাকা কঙ্কাবতীর ভারি মজা লাগছিল ওদের দেখতে। কী বিজ্ঞ বিজ্ঞ ভাব! ওরা কি রোজ গাছটায় কিছুক্ষণ বসে! এই ঘরে তার আগে যে ছিল তাকে কি ওরা চিনত! সে নিচু গলায় ডাকল, এই!
সঙ্গে সঙ্গে পাখিগুলো শক্ত হয়ে বসল। তারপর একজন উড়ে যেতেই বাকিগুলো তাকে অনুসরণ করল। গাছটা ফাঁকা। গাছের যতই প্রাণ থাকুক যতক্ষণ ফুল না ফোটে, ফল না ঝোলে অথবা পাখি না বসে ততক্ষণ তাকে জীবন্ত বলে মনে হয় না। কঙ্কাবতী চোখ ফিরিয়ে নিল। সে শুয়ে আছে কিন্তু ঘুম আসছে না। ডাক্তার তামাং-এর ওষুধ খেয়ে শরীর বল পেয়েছিল। একটু একটু করে তাদের ঘরের বাইরে যেতে পারছিল। স্কুলে যাওয়ার জন্যে মন ছটফট করত। কত কী পড়ানো হয়ে যাচ্ছে ক্লাসে অথচ সে কিছুই জানতে পারছে না। স্কুলের দু-তিনজন বান্ধবী এসে মাঝে মাঝেই তাকে খবর দিয়ে যেত। কিন্তু ডাক্তার তামাং বলল ভালভাবে সেরে উঠতে গেলে তাকে কিছুদিন নার্সিংহোমে থাকতে হবে। নার্সিংহোমে থাকতে গেলে প্রচুর টাকা দরকার। তার মায়ের সেই টাকা নেই। টাকা না থাকলে তার অসুখ সারবে না। অথচ অসুখটা ঠিক কী তাও ডাক্তার তামাং ভালভাবে বোঝাননি। বলেছেন, রক্তের লোহিতকণিকা কমে যাচ্ছে দ্রুত। টনিক দিয়ে তাকে এই মুহূর্তে বাড়ানো যাবে না। শেষ পর্যন্ত মা পার্টি অফিস থেকে ঘুরে এসে জানান, ব্যবস্থা হয়েছে। তাকে নেতারা আশ্বাস দিয়েছেন শহিদের মেয়ের জন্যে কিছু করবেন। শহিদের মেয়ে। বাবাকে শহিদ বলে ভাবতে তার ইচ্ছে করে না। যে অর্থে ভগৎ সিং শহিদ, ক্ষুদিরাম বাঘাযতীন শহিদ বাবা কি সেইরকম শহিদ? বাবা ঠিক কোথায় মারা গিয়েছিল তাই নিয়ে দুরকম গল্প চালু আছে। মানেভঞ্জনের কাছে না এখানকার ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে? মাঝে মাঝে মনে হয়, বাবা নয়, বাবার মতো দেখতে আর কেউ হয়তো মারা গিয়েছে পুলিশের গুলিতে। হঠাৎ একদিন বাবা হাজির হয়ে বলবে কেমন আছিস। নিশ্বাস ফেলল কঙ্কাবতী।
ডাক্তার তামাং বলেছিলেন নিরাময়ের ডাক্তারকে দেখাতে। উনি রক্তের ডাক্তার। শব্দটা কী যেন, হেমাটলজি? ভাগ্যিস বলেছিলেন। নইলে গণেশকে ওভাবে জব্দ করত কে? ডাক্তারবাবুকে তার খুব ভাল লেগেছে। এস কে রায়ের সঙ্গে কিছু ব্যাপারে বেশ মিল আছে ওঁর। ডাক্তার কবিতাটা জানেন। কথা বলার ধরনে আপন আপন ভাব আছে। উনি তাকে নিজের মেয়ে হিসেবে ভেবেছেন। ভানুভক্ত আর রবীন্দ্রনাথের মধ্যে কোনও তুলনা করতে সে চায়নি, শুধু এটুকুতেই তিনি তাকে ভালবেসে ফেললেন? এস কে রায় বলতেন, কবি-শিল্পীদের কখনও একের সঙ্গে আর একজনের তুলনা করতে নেই। খুব অল্পখ্যাত কোনও কবির একটা লাইন তোমার কাছে চিরজীবনের সম্পদ হয়ে যেতে পারে।
কেমন আছ?
কঙ্কাবতী চোখ ফেরাল, মিসেস অ্যান্টনি। সে হাসল।
মিসেস অ্যান্টনি কাছে এলেন, মুখটা অমন শুকনো দেখাচ্ছে কেন?
কই, না তো!
না বললে হবে। একটু পরে খাবার আসবে। সেটা খেয়ে ভাল করে মুখ ধুয়ে এসো। আমি ক্রিম মাখিয়ে চুল আঁচড়ে দেব। কী সুন্দর চুল অথচ কী করে রেখেছ।
কঙ্কাবতীর খুব ভাল লাগল। তার একটা ক্রিমের শিশি ছিল। বাবা কিনে দিয়েছিল অনেকদিন আগে। বেশি শীত পড়লে একটু একটু করে সেটা ব্যবহার করত। সেটা যখন শেষ হয়ে গেল তখন বাবা নেই। মায়ের এত অভাব আর একটা ক্রিম কিনে দেওয়ার কথা বলতে পারেনি সে। নিজের চুল নিজেই বেঁধে এসেছে এতদিন। সেই কবে ছেলেবেলায় মা বকবক করতে করতে চুল বেঁধে দিত, এখন ভাল করে মনে পড়ে না।
সাজগোজ হয়ে গেলে মিসেস অ্যান্টনি বললেন, কী সুন্দর দেখাচ্ছে তোমাকে। চলো, আমরা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। মিসেস অ্যান্টনি ওকে নিয়ে বাইরে এলেন। আশেপাশের ঘরগুলোর দরজা খোলা। ঘরের ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করার কোনও ব্যবস্থা নেই। মিসেস অ্যান্টনি বললেন, এই ঘরগুলোতে তোমার চেয়ে অসুস্থ ছেলেমেয়েরা রয়েছে। সবাই একটু একটু করে ভাল হচ্ছে। তোমার যখন ভাল লাগবে তখন ওদের সঙ্গে গিয়ে আলাপ করে এসো।
এই যে মাদার, বাঃ, দারুণ দেখাচ্ছে তোমাকে।
গলার স্বর কানে যেতেই ওরা দেখল ডাক্তারবাবু সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছেন। তাঁকে খুব প্রফুল্ল দেখাচ্ছিল। মিসেস অ্যান্টনি হাসলেন, আপনার এই মেয়ে তো সত্যি সুন্দরী।
হুঁ। দেখছি তাই। তা কঙ্কাবতী, এখন তোমার কী অসুবিধা হচ্ছে?
খুব দুর্বল লাগছে।
সেটা তো স্বাভাবিক। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। মিসেস অ্যান্টনি, সায়নকে বলুন তো, সারাক্ষণ ঘরে শুয়ে না থেকে একটু হাঁটাহাঁটি করতে। ওর মা দু বেলা ঘরে গিয়ে গল্প করছেন, এটা ঠিক নয়।
মিসেস অ্যান্টনি মাথা নেড়ে চলে গেলেন। ডাক্তার জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন লাগছে এখানে? নিশ্চয়ই বাড়ির জন্যে মন কেমন করছে?
কঙ্কাবতী তাকাল, আমাদের কোনও বাড়ি ছিল না, একটা ঘর ছিল। আমার অসুখ হওয়ার পর মায়ের কষ্ট খুব বেড়ে গিয়েছিল। এখানে এসেছি বলে অনেক সমস্যা কমে যাবে। আচ্ছা, আমার চিকিৎসার জন্যে আপনার কত খরচ হবে?
ডাক্তার অবাক হয়ে তাকালেন। অনেককাল তিনি পাহাড়ে আছেন। সম্পন্ন শিক্ষিত নেপালি পরিবারের ছেলেমেয়েদের মর্যাদাবোধের কথা জানেন। কিন্তু নীচের তলার ছেলেমেয়েদের মধ্যে অভাব আর অশিক্ষা যে প্রভাব ছড়িয়েছে তার ফলও লক্ষ করেছেন। কঙ্কাবতী বস্তিতে থাকত, পরিবারের আয় অতি সামান্য। এত অল্প বয়সে এই গলায় প্রশ্নটা একদম আশা করেননি ডাক্তার।
তিনি বললেন, চলো, ভেতরে গিয়ে গল্প করি।
কঙ্কাবতীর হাঁটা লক্ষ করলেন তিনি। যে কোনওদিন মেয়েটার শরীর থেকে রক্ত বেরিয়ে আসতে পারে। যেদিন ও প্রথম পড়ে গিয়েছিল সেদিনই রক্তপাত হওয়া স্বাভাবিক ছিল। কঙ্কাবতীকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে একটা চেয়ার টেনে নিলেন তিনি, টাকাপয়সার কথা জেনে তোমার কী লাভ হবে?
জানা থাকলে সুবিধে হয়। মাথা নামাল কঙ্কাবতী।
কী সুবিধে?
আমি চাকরি করে শোধ করতে চাই।
বাঃ। বাবা কি মেয়েকে ধার দেয় যে শোধ করার কথা বলছ?
আপনি বলছেন অনেক টাকা খরচ হতে পারে।
ঠিক। সেটা হবেই তা এখনই বলা যাচ্ছে না। প্রাথমিক ওষুধ যদি কাজ দেয় তাহলে খরচ এমন বেশি কিছু নয়।
আপনি আমাকে আগে দেখেননি। আমার কথা শুনে ভাল লেগেছে বলে মেয়ের মতো মনে করেছেন। কিন্তু আমি আপনাকে–’ থেমে গেল কঙ্কাবতী। ঠিক কীভাবে বললে খারাপ শোনাবে না তা সে বুঝতে পারছিল না।
ঠিক আছে, আমি হিসেব রেখে দেব। যখন আমার অবস্থা খুব খারাপ হবে তখন তোমাকে বলব। বাবা-মা বুড়ো হয়ে গেলে তো ছেলেমেয়ে তাকে সাহায্য করে। কিন্তু সেদিন তোমাকে তোমার নামের মানে জিজ্ঞাসা করতেই তুমি বলে দিলে। নেপালি মেয়েদের তো এত ভাল বাংলা শব্দের মানে জানার কোনও প্রয়োজন নেই। তুমি কি নিজের নামের মানে জানার আগ্রহে ওটা জেনেছ? ডাক্তার প্রসঙ্গ যোরালেন।
না। অনেকের মতো আমারও আগ্রহ ছিল না। কয়েক বছর আগে হঠাৎই জেনেছি। তারপর বুদ্ধদেব বসুর কবিতাটা পড়েছি।
সর্বনাশ। বলল কী? ডাক্তার আকাশ থেকে পড়লেন।
কেন? পড়াটা কি অন্যায়?
আরে বাবা তা বলছি না। এখনকার ছেলেমেয়েদের অনেকে ওঁর নামই জানে না। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, তুমি বাংলা সাহিত্যের অনেকের লেখা পড়েছ?
কিছু কিছু।
এই আগ্রহ হল কী করে?
কঙ্কাবতী তাকাল। তারপর বলল, রবীন্দ্রনাথের গান শুনে।
কথাটা সত্যি। এস কে রায়ের বাড়িতে টেপরেকর্ডারে গান বাজত। সেই গান শুনেই ওরা আকৃষ্ট হয়েছিল। বান্ধবীর উৎসাহ চলে গিয়েছিল কিন্তু সে পোঁছে গিয়েছিল এক আশ্চর্য জগতে।
ডাক্তার অবাক হয়ে তাকিয়েছিলেন। এটা যদি কলকাতা হত তিনি একটুও ভাবতেন না। কোনও কোনও বাঙালি মেয়ের পক্ষে এমন কথা বলা স্বাভাবিক। কিন্তু বিপরীত পরিবেশে বড় হয়ে ওঠা একটি নেপালি মেয়ের মুখে এমন কথা আশাই করা যায় না।
দরজায় ছায়া পড়তেই ডাক্তার দেখলেন সায়ন এসে দাঁড়িয়েছে। তিনি হাসলেন, এসো সায়ন। আমাদের এই নতুন বন্ধুটির সঙ্গে তোমার নিশ্চয়ই আলাপ হয়নি।
দরজায় দাঁড়িয়েই সায়ন জবাব দিল, না, কিন্তু ওকে আমি দেখেছি।
দেখেছ? কোথায়? আপনার অফিসঘরে।
ও, হ্যাঁ হ্যাঁ। তুমি ছিলে সেদিন। এর নাম কঙ্কাবতী আর এ সায়ন। জানো কঙ্কাবতী, সায়ন খুব বিখ্যাত হয়ে গেছে এখানে। তার ধকল সামলাতে আমাকে হিমসিম খেতে হয়েছে। ও নীচের ঝোরার গায়ে মেরির মূর্তির পাশে উঠে মোমবাতি জ্বালিয়েছিল। তখন নাকি পথচলতি লোকজন দেখতে পায় মেরি ওকে আশীর্বাদ করছেন। ব্যস। পরদিন থেকে আমার এখানে মানুষের ভিড় হতে শুরু করল। সবাই ওকে দেখতে চায়। যে মেরির আশীর্বাদ পেয়েছে সে মানুষের সব সমস্যার সমাধান করে দিতে পারে। আমি যত বলি সায়ন একজন সাধারণ মানুষ তবু কেউ বিশ্বাস করবে না। যে অন্ধ হতে চায় তাকে তুমি দেখাবে কী করে? শেষ পর্যন্ত পুলিশ এসে ভিড় সরাল। এখনও কিছু লোক নিরাময়ের সামনে এসে অপেক্ষা করে যদি সায়নকে দেখতে পায়। জানি না তাদের ভয়ে সায়নবাবু ঘর থেকে বের হচ্ছে না কিনা। ডাক্তার হাসলেন।
সায়ন চুপচাপ শুনছিল। তার শরীর এখনও দুর্বল। এই রক্তপাত তাকে খুব ধাক্কা দিয়েছে। একেবারে বিনা কারণে তার শরীর থেকে রক্ত বেরিয়ে এসেছিল। বিকেলে যে হেঁটে অতটা দূর যেতে পারে সে নিশ্চয়ই অসুস্থ ছিল না। তাহলে রক্ত পড়ল কেন? এ ঘটনা বলে দিচ্ছে সে যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন অমনই বিনা নোটিসে শরীর থেকে রক্ত বেরিয়ে আসবে, অসুস্থ হয়ে পড়বে। এই সত্যিটা তাকে ক্রমশ গিলে ফেলছে। কোনও কিছু ভাবতেই আর ভাল লাগে না এখন।
তোমার মা তো সকালে এসেছেন? ডাক্তার জিজ্ঞাসা করলেন।
হ্যাঁ।
কদ্দিন থাকছেন ওরা?
আগামীকাল চলে যাবেন।
ও, তাই তোমার মন খারাপ?
সায়ন জবাব দিল না। মা চলে গেলে তার নিশ্চয়ই খারাপ লাগবে কিন্তু তার চেয়ে বেশি খারাপ লাগছে নিজের মনের জোর চলে যাওয়াতে।
আপনি আমাকে কোনও কারণে ডেকেছিলেন? সায়ন জিজ্ঞাসা করল।
ডেকেছিলাম? ও হ্যাঁ, কঙ্কাবতী নতুন এসেছে, ওর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব বলে ডেকেছিলাম। কিন্তু তুমি তো ঘরেই ঢুকছ না।
সায়ন কঙ্কাবতীর দিকে তাকাল, পরে তোমার সঙ্গে কথা বলব।
তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে? কঙ্কাবতী প্রথম কথা বলল।
না। এখন ভাল আছি। তারপর হাসল, আমি এখানে এতদিন আছি কিন্তু ভাল করে নেপালি বলতে পারি না। তোমার কাছে নেপালি শেখা যাবে। আচ্ছা।
মাথা নেড়ে সায়ন চলে গেল তার ঘরের দিকে। ডাক্তার কিছু বললেন না। সায়নের এই পরিবর্তন চোখে পড়ার মতো। উৎসাহ হারিয়ে ফেলা মানুষদের অসুখ চেপে ধরে। লড়াই করার ক্ষমতা দ্রুত কমে যায়। এটা ভাল নয়। কিন্তু এখনই সায়নকে প্রশ্ন করলে কিছুই জানা যাবে না।
মারুতি ট্যাক্সিটা নিরাময় পেরিয়ে ওপরে উঠতে গিয়েই দাঁড়িয়ে গেল। নেপালি ড্রাইভার মুখ বের করে চারপাশে তাকাল। তারপর কাউকে না পেয়ে আবার অ্যাকসিলেটারে চাপ দিল। গাড়িটা বাঁক নিয়ে ওপরে উঠতেই ম্যাথুজের কসাইখানার সামনে পৌঁছোল। ম্যাথুজ আজ অনেকদিন পরে দোকান খুলেছে। না আজ কোনও মাংস সে কাটেনি। বেশ কিছুদিন বন্ধ থাকা দোকানের নোংরা পরিষ্কার করছিল সে। ড্রাইভার তাকে নেপালিতে জিজ্ঞাসা করল, মিস্টার ব্রাউনের বাড়িটা কোথায়?
ম্যাথুজ দেখল লোকটা এই অঞ্চলের নয়। গাড়ির পেছনে একজন মেমসাহেব বসে আছে। সে জিজ্ঞাসা করল, কোত্থেকে আসছ?
বাগডোগরা এয়ারপোর্ট থেকে। কেন?
এদিকের ড্রাইভার হলে ওকে চিনতে। কথাটা বলতে গিয়ে নজরে পড়ল সিমি ওপর থেকে নেমে আসছে। সঙ্গে সঙ্গে আড়ষ্ট হয়ে গেল ম্যাথুজ।
খুব বিখ্যাত লোক মনে হচ্ছে। বাড়িটা কোথায়?
ম্যাথুজ সিমির দিকে তাকিয়ে বলল, এরা ব্রাউনের বাড়িতে যাবে, তুমি একটু চিনিয়ে দাও। সিমি আড়চোখে ম্যাথুজকে দেখে ড্রাইভারকে ইশারা করল গাড়ি ঘোরাতে। ড্রাইভার গাড়ি ঘুরিয়ে নিলে সে সামনে হাঁটতে লাগল। ম্যাথুজ লক্ষ করল সিমি তার দিকে তাকাল না, কথা বলা তো দূরের কথা।
ব্রাউনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সিমি মাথা নেড়ে ইশারায় বোঝাল এই সেই বাড়ি। ট্যাক্সিওয়ালা মুখ ফিরিয়ে খবরটা জানিয়ে দিতেই পেছনের দরজা খুলল। সিমি দেখল একজন বয়স্কা মহিলা ট্যাক্সি থেকে নামলেন। বয়স হয়েছে কিন্তু কী সুন্দর ফিগার ভদ্রমহিলার। মাটিতে দাঁড়িয়ে তিনি চারপাশে তাকালেন। তাঁকে বেশ প্রসন্ন দেখাচ্ছিল। এই সময় ভুটোর গলা শোনা গেল। ওপাশ থেকে ডাকতে ডাকতে গেটের কাছে এসে সিমিকে দেখে একটু থমকাল সে। সিমি জিভে শব্দ করল। ভদ্রমহিলা এগিয়ে এলেন, তুমি ইংরেজি বুঝতে পারো?
সিমির হাসি পেয়ে গেল। এই পাহাড়ের ক্রিস্টান সম্প্রদায়ের জন্যে ইংরেজি বুঝতে কারও অসুবিধে নয়। অনেকেই ভাষাটা বলে ভাল। সে মাথা নাড়ল।
তুমি কি জানো মিস্টার ব্রাউন এখনও এই বাড়িতে থাকেন?
নিশ্চয়ই।
উনি সুস্থ আছেন তো?
কাল পর্যন্ত তো সুস্থই দেখেছি। আপনি কোত্থেকে আসছেন?
ইউ এস এ।
দেশের নামটা শোনামাত্র সিমি একবার তাকাল। তারপর গেট খুলে ভেতরে ঢুকে ব্রাউনের বন্ধ দরজায় শব্দ করল। ভুটো গেট খোলা পেয়ে আবার গর্জন শুরু করেছে। ভদ্রমহিলা দূর থেকে জিভে আওয়াজ তুলে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন। ভেতর থেকে ব্রাউনের ভরাট গলা ভেসে এল, ভুটো চুপ। চুপ কর।
দরজা খুললেন ব্রাউন, ও তুমি। তোমাকে দেখে ও চেঁচাচ্ছে কেন?
আমাকে দেখে নয়। একজন গেস্ট এসেছেন।
গেস্ট? ব্রাউন বেরিয়ে এলেন ঘেরা বারান্দায়। তখনই তাঁর নজরে পড়ল। চিঠিটা তাঁকে সাহায্য করল। নইলে তিরিশ বছরের ধুলো ঘেঁটে ঠিকঠাক পৌঁছোতে পারতেন কিনা সন্দেহ। সহাস্যে তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন, আরে! কী আশ্চর্য!
ভদ্রমহিলা হাসলেন, আমি এলিজাবেথ। ভেতরে আসতে পারি?
ওয়েলকাম, ওয়েলকাম। হোয়াট এ সারপ্রাইজ। আমি চিঠিটা পেয়েছিলাম কিন্তু ভাবতে পারিনি আপনি সত্যি সত্যি আসবেন। দু হাত বাড়িয়ে এগিয়ে গেলেন ব্রাউন। সিমি দেখল ভদ্রমহিলা, যিনি নিজেকে এলিজাবেথ বললেন, স্বচ্ছন্দে হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসা ব্রাউনকে জড়িয়ে ধরলেন। নেপালিদের তুলনায় ব্রাউন যেমন লম্বা তেমন তাঁর ভারী শরীর। ভদ্রমহিলা ব্রাউনের কপালের কাছাকাছি। এইভাবে প্রকাশ্যে দুজন নারীপুরুষ এই পাহাড়ে কখনই আলিঙ্গনাবদ্ধ হয় না। দুজনের বয়সের কথা মনে রাখলেও ব্যাপারটা আদৌ পছন্দ হল না সিমির। সে মুখ নিচু করে ওদের পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। আলিঙ্গন মুক্ত হয়েই ব্রাউন সেটাকে লক্ষ করলেন। তিনি ডাকলেন, সিমি, কাম হিয়ার। লিজা, এ হচ্ছে সিমি, মাই লেটেস্ট গার্ল ফ্রেন্ড।
এলিজাবেথ হেসে বললেন, ওর সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে। কিন্তু মনে হচ্ছে আপনার গার্ল ফ্রেন্ড আমাকে দেখে খুশি হয়নি।
ব্রাউন কপটভঙ্গি করলেন, ইজ ইট? না, না, সিমি খুব ভাল। তারপর ব্রাউন ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ট্যাক্সিওয়ালাকে বললেন এলিজাবেথের জিনিসপত্র ঘরের মধ্যে এনে দিতে। এলিজাবেথ জিজ্ঞাসা করলেন, এখানে ফোন করলেই ট্যাক্সি পাওয়া যায় তো?
ব্রাউন বললেন, ট্যাক্সি পেতে হলে নীচের রাস্তায় যেতে হবে। আমার বাড়িতে ফোন নেই। ফোনের তো কোনও দরকার পড়ে না।
তাহলে ট্যাক্সিটাকে রেখে দিলেই হয়। আমি সারাদিনের জন্যে কন্ট্রাক্ট করেছি।
তাই নাকি?
আপনার সঙ্গে দেখা করে এখানকার কোনও ভাল হোটেলে চলে যেতাম।
এখানে তো ভাল হোটেল নেই। সেটা আছে ঘণ্টাখানেক দূরে দার্জিলিঙে। তবে এখানে একটা ভাল ট্যুরিস্ট লজ আছে। সেখানে পৌঁছোতে কোনও সমস্যা হবে না।
এলিজাবেথ ট্যাক্সি ছেড়ে দিলেন। জিনিসপত্র ভেতরে পৌঁছে দিয়ে ট্যাক্সিওয়ালা গাড়ি নিয়ে নেমে গেল। ঢোকার মুখে ভুটো আবার তার আপত্তি জানাল। ব্রাউন একটা চেন তুলে বেঁধে রাখার ভয় দেখাতে সে চুপ করল।
সিমি বলল, আমি একটু পরে আসছি।
ব্রাউন বললেন, ঠিক আছে। কিন্তু একবার এসো।
ভেতরে ঢুকে যিশুর ঘরের সামনে দাঁড়াতেই এলিজাবেথ স্থির হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ বাদে বললেন, বাঃ, কী সুন্দর।
ব্রাউন বললেন, যিশু আপনার মঙ্গল করুন।
এলিজাবেথ মাথা ঝুঁকিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বললেন, হ্যাঁ, তিনি সবসময় আমাকে রক্ষা করেন।
ব্রাউনের ডাইনিং কাম সিটিং রুমের চেয়ারে বসে এলিজাবেথ জিজ্ঞাসা করলেন, কোনও ইন্ডিয়ানের বাড়ির ভেতর আমি এই প্রথম ঢুকলাম। আর সবাই কোথায়?
ছেলেমেয়েরা যে যার জায়গায় কাজকর্ম করছে।
আপনার স্ত্রী?
মিসেস ব্রাউন অনেক দিন আগে আমাকে ছেড়ে যিশুর কাছে চলে গিয়েছেন।
ওঃ।
আমি একাই থাকি। কোনও অসুবিধে নেই। এখন বলুন তো, আমাকে আপনি এত দিন ধরে মনে রাখলেন কী করে?
ব্যাপারটা খুব অস্বাভাবিক লাগছে, তাই না?
আপনার চিঠি পেয়ে আমি খুব অবাক হয়েছিলাম।
চিনতে পেরেছিলেন?
একটু ধন্দ লেগেছিল প্রথমে, তারপর! হ্যাঁ, তিরিশ বছর তো কম সময় নয়।
আপনি অনেক মোটা হয়ে গিয়েছেন। চুল কমে গিয়েছে। কিন্তু হাসি, কথা বলার ধরন একই রয়েছে। আপনার ওজন কমানো উচিত। এলিজাবেথ ভ্রূভঙ্গিতে হাসলেন।
ব্রাউন হেসে বললেন, আপনি কিন্তু একইরকম রয়েছেন। তিরিশ বছর আগে আপনার শরীর যেমন ছিল এখনও তেমন।
ও ভগবান! এলিজাবেথ চোখ বন্ধ করলেন, পঞ্চাশ পেরিয়ে গিয়েছি কবে! যাকে বলে বুড়ি তাই এখন আমি। আপনার কথা কেন মনে পড়ল বলুন তো?
ব্রাউন উৎসুক হয়ে তাকালেন।
সেদিন টিভিতে একটা ছবি দেখাচ্ছিল। একটি আমেরিকান মেয়েকে কুমিরের হাত থেকে বাঁচাল জাপানি ছেলে। এরকম ছবি তো কতই হয়। কিন্তু সেই জাপানি ছেলেটার দিকে তাকাতেই আপনার কথা মনে পড়ে গেল। আপনার মনে আছে, আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম আপনি চিনা না জাপানি? তখন এত বোকা ছিলাম যে কোনও পার্থক্য বুঝতে পারতাম না।
মনে পড়েছে।
বলেছিলেন আপনি ইন্ডিয়ান। তবে নেপালি। নেপালিদের মুখের সঙ্গে জাপানি বা চাইনিজদের সামান্য মিল আছে। কারণ সবই মঙ্গোলিয়ান মুখ। না, আপনার মুখ দেখে মনে হচ্ছে কিছুই মনে নেই!
বড় অস্পষ্ট, তবে আপনি যখন বলছেন তখন একটু একটু করে স্পষ্ট হচ্ছে। আপনার সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল সমুদ্রের ধারে।
কীভাবে হয়েছিল।
তখন সন্ধের মুখ। দুটো মেক্সিকান আপনার হাত ধরে টানছিল। আর আপনি ভয়ে হেল্প হেল্প বলে চিৎকার করছিলেন। আশেপাশের কেউ সাহায্যের জন্যে এগিয়ে যাচ্ছিল না। আমার মাথায় রক্ত উঠে গেল।
খুব মেরেছিলেন লোক দুটোকে। তারপর আমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিলেন। তখন জেনেছিলাম আপনি নাবিক। নাবিকদের আমরা পছন্দ করতাম না। কারণ শুনেছিলাম প্রতিটি বন্দরে একটা করে বউ থাকে। কিন্তু পৌঁছে দেওয়ার সময় আপনি একবারও আমার হাত ধরেননি। মাকে বলতে তিনি আপনাকে বসতে বললেন। আপনারা সেই রাতটা ওখানে থাকবেন বলেছিলেন। মা তাই ডিনার খেয়ে যেতে বলেছিলেন। আপনি রাজি হননি। তখন আমি আপনার ঠিকানা চেয়েছিলাম। আপনি বলেছিলেন এই পাহাড়ের গ্রামে আপনার যে ছোট বাড়ি সেটাতে বেশি দিন থাকবেন না। তবু লিখে দিয়েছিলেন। চলে যাওয়ার সময় আমি আপনাকে একটা ফুল দিয়েছিলাম। টিউলিপ।
ইয়েস। মনে পড়ছে। ঝট করে তিরিশ বছর আগে চলে গিয়েছিলেন ব্রাউন। তিনি তখন বিবাহিত। সন্তানের জনক। সুন্দরী একজন আমেরিকান মহিলাকে উদ্ধার করা কর্তব্য ছিল। ওদের আতিথ্য ভাল লেগেছিল, এই মাত্র।
এলিজাবেথ বললেন, খুব ভাবতাম আপনার কথা। আমার পরিচিত কোনও ছেলে অমন ভদ্র ব্যবহার করেনি। আমাকে নরম দেখলেই তারা হাত বাড়িয়েছে। পার্থক্য ছিল বলেই মনে পড়ত। চিঠি লিখতে ইচ্ছে করত। কিন্তু আপনি কবে দেশে ফিরবেন জানতাম না। তা ছাড়া আপনি যদি বিবাহিত হন? সেই আশঙ্কাও ছিল। তার কিছু দিন বাদে বব-এর সঙ্গে আলাপ এবং বিয়ে। তখন সব ভুলে গেলাম।
বব কেমন আছেন?
জানি না। আমরা পাঁচ বছর ঘর করে বুঝলাম কেউ কাউকে মানতে পারছি না। আলাদা হলাম। দ্বিতীয়বার বিয়ে করি বছর খানেক বাদে। সেই বিয়ে অনেক কাল টিকল। আমার দুই ছেলে। তারা কলেজ শেষ করে যে যার মতো আছে। আমার দ্বিতীয় বরের নাম আর্নল্ড। বেচারা বছর তিনেক হল ক্যানসারে মারা গিয়েছে। তারপর থেকে আমি একা। হঠাৎ ওই ছবিটা দেখে মনে পড়ে গেল আপনার কথা। সঙ্গে সঙ্গে পুরনো ডায়েরিগুলো ঘাটতে লাগলাম। প্রায় চল্লিশ বছরের চল্লিশটা ডায়েরি আমার কাছে সযত্নে রাখা আছে। পেয়ে গেলাম আপনার ঠিকানা। খুব কৌতূহল হল। ট্র্যাভেল এজেন্টের কাছে খবর নিয়ে জানলাম এটা ইন্ডিয়ার ইস্টার্ন রিজিওনে পড়ে। কাছাকাছি বড় শহর কলকাতা এবং তার ভাল হোটেলের নাম গ্র্যান্ড। আমার টাকার অভাব নেই এখন। ভাবলাম বেরিয়ে পড়ি। তাই হোটেল বুক করে একটা চিঠি লিখলাম আপনাকে। আপনি বেঁচে আছেন কিনা তাই তো জানতাম না। তবু চলে এলাম।
এসে যদি শুনতেন আমি মারা গিয়েছি অনেক আগে।
তা হলে আপনার কবরের ওপর ফুল রেখে ফিরে যেতাম।
আপনি কি জানতেন আমি ক্রিশ্চান?
বাঃ আপনার নামেই তো সেটা বোঝা যায়।
তা বটে। ব্রাউন উঠলেন, অনেক কথা বলা হয়েছে। কী খাবেন বলুন? চা না কফি? কোল্ডড্রিকস আমার বাড়িতে নেই।
কফি। কিন্তু বানাবে কে?
আমি। ব্ল্যাক না রেগুলার?
ব্ল্যাক। উইদাউট সুগার।
ব্রাউন তাঁর কিচেনে চলে গেলেন। গ্যাসে জল বসিয়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকাতেই নজরে পড়ল পাহাড়ের বাঁকে দোকানের পাশে ম্যাথুজ দাঁড়িয়ে আছে দু হাত বুকের ওপর ভাঁজ করে। ওর মুখ তিনি দেখতে পাচ্ছেন না কিন্তু মনে দুঃখ প্রবল না হলে মানুষ ওই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। ছেলেটার কী হল?
কফি করে একটা ট্রেতে বিস্কুটের সঙ্গে নিয়ে এলেন ব্রাউন। এলিজাবেথ বললেন, ধন্যবাদ। কিন্তু আপনারটা?
সরি ম্যাডাম। আমি এই বিকেলে কফি খাই না।
তা হলে আমার জন্যে কষ্ট করলেন কেন?
এত দূরে এসেছেন, ঠাণ্ডায় কফি ভাল লাগবে। আপনাদের ওখানে তো ঠাণ্ডা পড়ে না। এখানে আমরা খুব শীত পাই।
সেটা এখন বুঝতে পারছি।
আপনি কবে কলকাতায় এসেছেন?
গতকাল।
ওঃ। তা হলে তো আপনি খুব পরিশ্রান্ত।
মোটেই নয়। আই অ্যাম ফাইন। কফির কাপে চুমুক দিল এলিজাবেথ। কফি খাওয়া হয়ে গেলে ব্রাউন জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কত দিন এদিকে থাকবেন বলে ভেবেছেন?
আই ডোন্ট নো। এলিজাবেথ হাসলেন।
আমি কাউকে ট্যাক্সি ডাকতে পাঠাই। একটু পরে অন্ধকার নেমে গেলে ট্যুরিস্ট লজে যেতে অসুবিধে হবে।
বেশ তো।
ব্রাউন বের হলেন। আকাশ আজ পরিষ্কার। পশ্চিম দিকটায় সূর্যদেব এখনও রয়েছেন। পুবের পাহাড়গুলোয় গাঢ় নীল ছায়া জমছে। একটু বাদেই গাছগুলো সুস্থির হয়ে যাবে। এলিজাবেথ পাশে এসে দাঁড়ালেন, বিউটিফুল।
হ্যাঁ। আমাদের জায়গাটা সুন্দর।
আচ্ছা, আপনার এখানে দ্বিতীয় শোওয়ার ঘর নেই?
নিশ্চয়ই।
তা হলে ট্যাক্সির জন্যে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?
আপনি টুরিস্ট লজে যাবেন–?
আমি এখানে থাকলে আপনার কোনও অসুবিধে হবে?
অবাক হয়ে তাকালেন ব্রাউন, আমার এখানে?
হ্যাঁ। এক্সট্রা বেডরুম নেই এ বাড়িতে?
অবশ্যই আছে। কিন্তু আমি একেবারে ছন্নছাড়া হয়ে আছি। একা থাকি, যেটুকু না হলে চলে না সেইটুকুই করি। এখানে আপনার খুব অসুবিধে হবে। মানে যে ধরনের বেডরুম এবং টয়লেটে আপনারা অভ্যস্ত।
ব্রাউনকে থামিয়ে দিলেন এলিজাবেথ, দেখাই যাক না। অসুবিধে হলে অন্য কোথাও যাওয়া যাবে। আসলে এখানে থাকলে আপনার সঙ্গ পাওয়া যাবে। আপনি নিশ্চয়ই ওই ট্যুরিস্ট লজে থাকতে চাইবেন না।
ব্রাউন বেশ ফাঁপড়ে পড়লেন। তিনি একা থাকেন। একজন বিদেশিনী তাঁর বাড়িতে আছেন একথা জানাজানি হলে তাঁর কিছু এসে যাবে না। লোকে তাঁকে জানে, শ্রদ্ধা করে। তা ছাড়া যে বয়সের মানুষকে নিয়ে ওসব জল্পনা তৈরি হয় সেই বয়সটাকেও তিনি পেরিয়ে এসেছেন। কিন্তু তাঁর এই ছন্নছাড়া জীবন এলিজাবেথ থাকলে বিপন্ন হবেই। ওপাশের ঘরের লাগোয়া বাথরুমে আধুনিক সব ব্যবস্থা আছে। মুশকিল হবে ওঁর খাওয়া-দাওয়া নিয়ে। আমেরিকান খাবারের কাছাকাছি কিছু তিনি কী করে ব্যবস্থা করবেন?
কী ভাবছেন?
আপনাকে কী খাওয়াব তাই ভাবছি।
কম মশলা দেওয়া যে কোনও খাবার আমার চলবে। আরে মশাই, হাজার হোক আমি একজন মহিলা। পৃথিবীর প্রথম দিন থেকেই মহিলারা পরিস্থিতির সঙ্গে আগে মানাতে পেরেছে।
তা হলে তো কোনও সমস্যাই রইল না। কথাটা বলেই ব্রাউন লক্ষ করলেন সিমি উঠে আসছে। এলিজাবেথ নিচু গলায় বললেন, আপনার গার্ল ফ্রেন্ড।
ব্রাউন মন্তব্য করলেন না। সিমি কাছে আসতেই তিনি বললেন, তোমাকে একটু উপকার করতে হবে। ইনি এখানে কিছু দিন থাকবেন। ওঁর জন্যে খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। তুমি ম্যাথুজকে বলো আজকের ডিনারটা ট্যুরিস্ট লজ থেকে নিয়ে আসতে। কন্টিনেন্টাল ডিনার। কথাগুলো ইংরেজিতে বললেন ব্রাউন।
সিমি নেপালিতে জিজ্ঞাসা করল, উনি এখানে থাকবেন কেন?
ব্রাউন অস্বস্তিতে পড়লেন। এলিজাবেথের সামনে নেপালিতে কথা বলা সঙ্গত নয় জেনেও সিমি প্রশ্নটা করল। তিনি হাসার চেষ্টা করলেন, উনি আমার খুব পুরনো বন্ধু। আমার অতিথি।
অতিথি শব্দটা শুনে চোখ নামাল সিমি।
এলিজাবেথ জিজ্ঞাসা করলেন, সিমি, তুমি কত দূরে থাকো?
বেশি দূরে নয়। সিমির মুখ এখনও গভীর।
আচ্ছা, দোকান থেকে খাবার না আনিয়ে আমরা তো বাড়িতেই কিছু বানিয়ে নিতে পারি। পারি? এলিজাবেথ প্রশ্নটা করলেন।
আপনি কী খাবেন বলুন আমি চেষ্টা করছি বানিয়ে দিতে।
সিমি কথাটা বলতেই উচ্ছ্বসিত হলেন ব্রাউন, বাঃ খুব ভাল হল। সিমি যখন সাহায্য করতে চাইছে তখন কোনও চিন্তা নেই। দাঁড়াও, আসছি।
ভেতরে ঢুকে গেলেন ব্রাউন। আলমারি খুলে টাকা বের করলেন। হঠাৎ তাঁর মনে হল নিজের জন্যে তিনি কখনওই এমন ব্যস্ত হতেন না। আর একটা মানুষ এ বাড়িতে থাকলে তাঁকে ব্যক্তিগত ইচ্ছে অনিচ্ছে চেপে রাখতে হবে। এই যে একটু বাদে তিনি পান করতে বসবেন এবং সেই সঙ্গে টিভি দেখবেন সেটা কি সম্ভব হবে? ব্রাউনের মনটা ভারী হয়ে গেল।
সিমিকে টাকাগুলো দিয়ে ব্রাউন বললেন, তোমাকে শহরে যেতে হবে না। একটু আগে দেখলাম ম্যাথুজ ওর দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ওকে ডেকে আনো, আমি বললে ও নিশ্চয়ই বাজার করে এনে দেবে।
সিমি তাকাল। একমুহূর্ত ভাবল। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন ব্রাউন। ঠিক সেই সময়ে ম্যাথুজ ওপর থেকে নেমে আসছিল। কোটের দু-পকেটে হাত ঢুকিয়ে গম্ভীর মুখে পা ফেলছিল।
ব্রাউন বললেন, গুড আফটারনুন ম্যাথুজ। তোমার কথাই বলছিলাম।
ম্যাথুজ দাঁড়াল। কিন্তু কোনও কথা বলল না।
এঁর নাম এলিজাবেথ। এ হল ম্যাথুজ।
ম্যাথুজ বলল, গ্ল্যাড টু মিট ইউ।
এলিজাবেথ মাথা নেড়ে হাসলেন।
ব্রাউন বললেন, তোমার দোকানটা এবার খোলো। আমাদের খুব অসুবিধে হচ্ছে। এই ভদ্রমহিলা আমার কাছে এসেছেন। ওকে ভালমন্দ খাওয়াতে এখনই শহরে যাওয়া দরকার। তোমার দোকান খোলা থাকলে চিন্তা করতে হত না।
ম্যাথুজ বলল, আমি কি কোনওভাবে সাহায্যে লাগতে পারি?
নিশ্চয়ই। সিমি রান্না করে দেবে বলেছে। ও ঠিক কী কী জিনিস চাইছে তা যদি তুমি শহর থেকে এনে দাও তা হলে আমি খুশি হব। ব্রাউনের হাত থেকে টাকা নিয়ে ম্যাথুজ জিজ্ঞাসা করল, কী কী আনতে হবে?
সিমি বলল, আমার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াও। আমি একটা কাগজে লিখে দিচ্ছি। সিমি নেমে গেল দ্রুত। ম্যাথুজ বলল, আমি আসছি।
ব্রাউন বললেন, ফেরার সময় হাঁটার দরকার নেই। একটা ট্যাক্সি নিয়ে নিও।
ম্যাথুজ ধীরে ধীরে নামতে লাগল।
রোদ চলে যাচ্ছে দ্রুত। পাহাড় ছায়ায় মাখামাখি। ব্রাউন বললেন, এখানে হঠাই অন্ধকার নামে আর তখনই ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করে। চলুন, ভেতরে যাই।
এলিজাবেথকে যে ঘরটা দেখিয়ে দিলেন ব্রাউন সেটা একসময় তাঁর স্ত্রীর ঘর ছিল। ব্যবহার করা না হলেও সেটা দিব্যি পরিষ্কার রয়েছে। বিছানার চাদর পাল্টে লেপ বের করে দিলেন তিনি। সুটকেসগুলো এই ঘরে নিয়ে যেতে তাঁকে হাঁসফাঁস করতে হল। তারপর বললেন, একটু মানিয়ে নিন। বাথরুমে হিটার আছে। জল গরম করে নেবেন।
অনেক ধন্যবাদ। এলিজাবেথ দরজায় দাঁড়িয়ে বললেন।
ব্রাউন চলে যাচ্ছিলেন, এলিজাবেথ ডাকলেন, মিস্টার ব্রাউন।
ব্রাউন ঘুরে দাঁড়ালেন।
আমি এখানে থেকে গেলাম বলে আপনার কোনও অসুবিধে হল না তো?
না-না।
ওই মেয়েটির মুখ বলছে ও পছন্দ করেনি।
ও আমার নাতনির মতো। খুব ভাল মেয়ে।
এই দেখুন, আপনার কুকুরটাও আমাকে অপছন্দ করছে।
কাল থেকেই ও আপনার ফ্যান হয়ে যাবে।
দেখা যাক। হ্যাঁ, একটা কথা, আপনি রোজ যেভাবে কাটান ঠিক সেভাবেই থাকুন। আমার জন্যে নিজের কোনও অভ্যেস পাল্টাবেন না।
ধন্যবাদ। ব্রাউন ঘুরে দাঁড়াতেই শোওয়ার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলেন এলিজাবেথ। এই ঘরে কোনও কার্পেট নেই। এই প্রথম মেঝেতে পা রাখলেন তিনি। একটু অস্বস্তি হচ্ছিল তাঁর।
প্রার্থনা সেরে যিশুর ঘর থেকে বেরিয়ে ব্রাউন দেখলেন এলিজাবেথের ঘরের দরজা তখনও বন্ধ। তিনি তাঁর পানীয় নিয়ে বসলেন। আজ মনে হল এই দিশি পানীয়ে একটু বেশি রকমের টকটক গন্ধ। এলিজাবেথ নিশ্চয়ই অপছন্দ করবেন। কিন্তু কিছু করার নেই। উনি বলেছেন ওঁর জন্যে কোনও অভ্যেস না পাল্টাতে। টিভিটা খুললেন। মনীষা নাচছে। গ্লাসে চুমুক দিলেন আরাম চেয়ারে বসে। এই সময় দরজা খোলার শব্দ হল। গ্লাস হাতে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই ব্রাউনের নিঃশ্বাস থমকে গেল এক লহমার জন্যে।