২১-২২. লাজুক হাসলেন এলিজাবেথ

অদ্ভুত লাজুক হাসলেন এলিজাবেথ, ওমা, ওভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? সচেতন হলেন ব্রাউন, না না। মাথা নাড়লেন তিনি, কিছু নয়।

আমাকে নিশ্চয়ই খুব খারাপ দেখাচ্ছে না? এলিজাবেথ এগিয়ে এলেন।

না না, নিশ্চয়ই না। কিন্তু আপনার ঠাণ্ডা লাগতে পারে। আমার এই বাড়ি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত নয়। রাত যত বাড়বে ঠাণ্ডা তত।

দেখা যাবে তখন। আপনি টিভিতে কোনও বিশেষ প্রোগ্রাম দেখছেন?

না না। জাস্ট, ওটা চালিয়ে বসে থাকি।

এলিজাবেথ টিভির পর্দায় চোখ রাখলেন। একটি ছেলে আর একটি মেয়ে কোমর দুলিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে নাচছে। আর তার মধ্যেই ওদের পোশাক পাল্টে যাচ্ছে। এই পাহাড়ে আবার পরক্ষণেই সমুদ্রের ধারে ওরা নেচে যাচ্ছে। হঠাৎ কোত্থেকে একদল নারীপুরুষ বেরিয়ে এসে পেছনে একই ভঙ্গিতে নাচ শুরু করতেই এলিজাবেথ হো হো করে হেসে উঠলেন। ব্রাউন হকচকিয়ে গিয়ে টিভি বন্ধ করে দিলেন।

হাসি থামিয়ে এলিজাবেথ জিজ্ঞাসা করলেন, ইন্ডিয়ার ইয়ং জেনারেশন ওইভাবে নাচে বুঝি? পাহাড় থেকে নাচতে নাচতে সমুদ্রে? কিন্তু অত দলবল নিয়ে ওরা নাচে কেন?

ব্রাউন বললেন, ওটা সিনেমা। দর্শকদের মনোরঞ্জনের জন্য তৈরি। জীবনের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই।

রূপকথার গল্প বলে তো মনে হল না?

 ব্রাউন বাধ্য হলেন বলতে, এসব দেখে ইন্ডিয়াকে ভুল বুঝবেন না।

 কিন্তু আমি ইন্ডিয়াকে বুঝতে চাই। টিভি তো তাতে সাহায্য করবে।

এগুলো কমার্শিয়াল ফিল্ম। আপনি বসুন।

বিয়ার খাচ্ছেন?

 বিয়ার? না না। এটা কান্ট্রি লিকার। একেবারে দেশীয় প্রথায় তৈরি।

দেশীয় প্রথা? আমি এক গ্লাস পেতে পারি?

না না। আপনার খুব খারাপ লাগবে।

কেন?

একটু টকো গন্ধ আছে।

একবার চেষ্টা করে দেখি।

অগত্যা ব্রাউন আর একটি গ্লাস নিয়ে এসে ভর্তি করে এলিজাবেথকে দিলেন। গ্লাস নাকের কাছে নিয়ে গিয়ে বলেন এলিজাবেথ। তাঁর মুখচোখ বিকৃত হল। অস্ফুটে বললেন, টেরিবল।

আপনি রেখে দিন। ব্রাউন হাসলেন।

আপনি যখন খাচ্ছেন তখন আমি একটু খেয়ে দেখি। বলে এলিজাবেথ বাঁ হাতে নাক টিপে চোঁ চোঁ করে গ্লাসটা খালি করলেন। তারপর বমি করার মতো একটা শব্দ করে ভেতরে ছুটে গেলেন। ব্রাউন কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। এই বস্তু খাওয়ার ব্যাপারে তাঁর স্ত্রীরও তীব্র আপত্তি ছিল। অথচ ডাক্তার তামাং এমন মুখ করে খান যেন অমৃত পান করছেন। এখন এটা খেয়ে যদি এলিজাবেথ অসুস্থ হয়ে পড়েন তাহলে?

দু পা এগিয়ে গিয়ে ব্রাউন ডাকলেন, এলিজাবেথ?

 কয়েক সেকেন্ড বাদে এলিজাবেথ বেরিয়ে এলেন, সরি। কী ভয়ঙ্কর জিনিস। আপনি ওটা খান কী করে?

অভ্যেস। প্রথম প্রথম একটু খারাপ লাগে, পরে সেটা চলে যায়।

আমার কাছে সিভ্যাস রিগ্যাল আছে। ওটা দিচ্ছি আপনাকে।

সরি। বিদেশি মদ, মানে স্কচ আমার আলমারিতে আছে। কিন্তু ওতে আমার ঠিক সুবিধে হয় না। পাঁচ পেগ স্কচ দু ঘণ্টায় খেয়ে ফেললে নেশা হয়ে যায়। অথচ এই জিনিস তিন ঘণ্টা ধরে খেয়েও আমি প্রেয়ার করতে পারি, মৌজও হয়। ব্রাউন হাসলেন।

এই সময় দরজায় শব্দ হল। ব্রাউন দরজা খুলে দেখলেন ম্যাথুজ দাঁড়িয়ে আছে। তার এক হাতে লিস্ট আর অন্য হাতে শপিং ব্যাগ। এখন রাত। পাহাড়ে অন্ধকার নেমে গেছে। ব্যাগটা হাত বদল করে ম্যাথুজ বলল, লিস্টটা দিয়ে সিমি বলল ওর শরীর খারাপ লাগছে। তাই রোস্টেড চিকেন স্যালাড আর ব্রেডরোল নিয়ে আসতে। ওর পক্ষে রান্না করা সম্ভব হবে না। আমি তাই এনেছি। আর এই লিস্টের জিনিসগুলো।

কী এগুলো?

ড্রেসড চিকেন, কর্নফ্লেক্স, ডিম, রুটি।

থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাথুজ।

ম্যাথুজ মাথা নেড়ে অন্ধকারে নেমে গেল। দরজা বন্ধ করার আগে তিনি সিমির কথা আর একবার ভাবলেন। মেয়েটা এমন ব্যবহার করল কেন?

ভেতরে এসে ব্রাউন দেখলেন ওপাশের জানলা খুলে এলিজাবেথ দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি বললেন, ঠাণ্ডা লাগবে।

লাগুক। কিন্তু ফ্যান্টাস্টিক। পাহাড়ের গায়ে গায়ে হিরে জ্বলছে।

আপনি একটা গরম কিছু গায়ে চাপান।

জানলা বন্ধ করে এলিজাবেথ বললেন, আপনি বেসিক। ওগুলো কি ওরা নিয়ে এল? সিমি কোথায়?

বস্তুগুলো নিয়ে কিচেনে যেতে যেতে ব্রাউন বললেন, আজ রাত্রের জন্যে চিন্তা নেই।

সামান্য শীত লাগছে এখন, এলিজাবেথ সেটাকে গ্রাহ্য করলেন না। এই অনভ্যস্ত পরিবেশে তাঁর বেশ মজা লাগছিল। এখানে আসার কথা বন্ধুদের বললে তারা তীব্র আপত্তি জানিয়েছিল। ভারতবর্ষ গরিব দেশ। সর্বত্র ভাল হোটেল নেই। তা ছাড়া যে লোকটাকে তিরিশ বছর আগে কিছু সময়ের জন্যে দেখেছ, কোনও যোগাযোগ রাখনি, তাকে দেখতে এত কষ্ট করার কোনও যুক্তি নেই। ভারতবর্ষের জল খারাপ, বাতাসে অসুখ ভেসে বেড়াচ্ছে। তা ছাড়া যার কাছে যেতে চাইছ সে হয়তো অনেকদিন আগেই মরে গেছে।

কথাগুলো সত্যি। কিন্তু ওই একই জীবনের প্রতি বিরক্ত হয়ে উঠছিলেন এলিজাবেথ। স্বামীর মৃত্যুর পরে যখন একটু দিশেহারা অবস্থা তখন থেকে আর এক উৎপাত শুরু হল। অল্প বয়সে তাঁকে কেউ সুন্দরী বলত না। বিয়ের পর থেকে তাঁর চেহারা ভাল হতে আরম্ভ করল। এবং তখন থেকেই নিজের শরীর সম্পর্কে সচেতন হয়েছিলেন তিনি। মেদ জমতে দেননি, মুখের এবং গলার চামড়ায় বার্ধক্যকে ডেকে আনেননি। ফলে বয়সের তুলনায় তাঁকে অনেক কম দেখায়। তাই চল্লিশের পুরুষরা যখন ঠারেঠুরে আর কেউ কেউ সোজাসুজি প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে ফেলল তখন এলিজাবেথ বিরক্ত হলেন। ঠিক করলেন একটা বাহানা নিয়ে বেরিয়ে পড়বেন। কলকাতায় পৌঁছে পরিবর্তনটা চোখে পড়ল। রাস্তাঘাট মানুষ এবং তাদের বাসস্থান সম্পর্কে যেটুকু ধারণা হোটেলে যেতে যেতে হয়েছিল তাতে বুঝলেন বন্ধুরা কিন্তু বাড়িয়ে বলেনি। অর্থাভাব এবং বেনিয়মটা এখানে নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্রান্ড হোটেলে তাঁর জন্যে কোনও খবর অপেক্ষা করে ছিল না।

এখন এই পাহাড়ে তাঁর কিন্তু ভাল লাগছে। ব্রাউনকে দেখে তিনি খুশি হয়েছেন। মানুষটি ভাল। যাঁকে দেখতে অত দূরে এমনভাবে এলেন তিনি সুস্থ আছেন, এটাই তো অনেক পাওয়া। কিন্তু একটু আগে জানলা দিয়ে অন্ধকারে ঢাকা পাহাড়ের বুকে যে হিরে জ্বলতে দেখলেন তার সঙ্গে আমেরিকার অনেক জায়গার কোনও পার্থক্য নেই। সূর্যের আলো যদি বাস্তবকে নগ্ন করে দেয় অন্ধকার তার শরীরে আব্রু এনে দেয়। কিন্তু অন্ধকার কি স্থানকাল ভেদে আলাদা চেহারা নেয় না? তাঁর বাড়িতে যদি হঠাৎ অতিথি আসত এবং ফ্রিজে যদি কোনও খাদ্যবস্তু না থাকত তাহলে তিনি কি প্রতিবেশীদের মধ্যে কাউকে পেতেন যাকে বলা যেত মল থেকে বাজার করে নিয়ে আসতে? ভাবতেই পারা যায় না। সম্পর্কের মধ্যে যে দূরত্ব তাকে তো অন্ধকারই বলা যেতে পারে। নাকি মেকি ভদ্রতার আড়াল অন্ধকারের মতো সেই দূরত্বকে আব্রু পরিয়ে রাখে।

ব্রাউন ফিরে এসে নতুন গ্লাস নিলেন, সিমি একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছে।

কাঁধ ঝাঁকালেন এলিজাবেথ, তাই? তারপর পাশে এসে বসলেন, কী হল? আমাকে দিলেন না?

ব্রাউন অবাক হয়ে বললেন, আপনি এই বস্তু পান করবেন?

আপনার আপত্তি না থাকলে।

না না। আপত্তি করব কেন? তখন তো বুঝলেন এটা একটু নিচু মানের।

আপনি যখন পারছেন তখন আমি না হয় চেষ্টা করে দেখি।

ব্রাউন গ্লাস ভর্তি করে এগিয়ে দিলেন। ঘোলাটে পদার্থটিকে অনেক কসরত করে পেটে চালান করলেন এলিজাবেথ। তারপর গ্লাস নামিয়ে বললেন, এটা খেলে কি নেশা হয়?

এক গ্লাসে হয় না। তিন চারে একটু মেজাজ আসে।

তার মানে আপনি নেশা করার জন্যে পান করেন না?

বলতে পারেন। এটা এখন অভ্যেসে এসে গেছে। হালকা আমেজ এল, খেয়ে-দেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমের জন্যে ট্যাবলেট খেতে হল না। একা থাকি, নেশা করে মাতাল হয়ে গেলে অনেক সমস্যা, বুঝতেই পারছেন।

এলিজাবেথ ব্রাউনের দিকে চুপচাপ তাকিয়ে থাকলেন। ব্রাউনের অস্বস্তি হচ্ছিল। পান করতে করতে তিনি বললেন, আপনাদের তো সন্ধেবেলায় ডিনার খাওয়ার অভ্যেস। কলকাতা থেকে রওনা হওয়ার পর আর খাওয়া হয়নি। এখন খেয়ে নেবেন?

আমার কোনও তাড়া নেই।

ব্রাউনের অস্বস্তি হচ্ছিল। একা টিভি দেখতে দেখতে পান করা এক কথা আর কেউ কথা না বলে তার দিকে তাকিয়ে আছে এটা বেশ বিরক্তিকর ব্যাপার। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, চুপচাপ কেন? কথা বলুন।

আপনার এই জীবন ভাল লাগে?

কিছু তো করার নেই।

মানতে পারছি না। আপনি শারীরিক দিক দিয়ে অশক্ত হয়ে যাননি এখনও।

মনের দিক দিয়ে কিছুটা তো হয়েছি।

কেন?

হয়তো জলহাওয়ার দোষে। ভারতবর্ষের মানুষ সত্তর পেরিয়ে গেলে নিজেদের গুটিয়ে নেয়। অবশ্য রাজনৈতিক নেতাদের কথা আলাদা।

আপনি যদি আবার বিয়ে করতেন তাহলে হয়তো এমন ভাবতেন না।

ব্রাউন হাসলেন, ব্যাপারটা সহজ নয়।  

মানে?

 এ দেশের মানুষ ষাট পেরিয়ে গিয়ে বিয়ে করতে চাইলে লোকে হাসবে। বিয়ের কনে খুঁজে পাওয়াই মুশকিল হবে। পঁচিশ তিরিশ বছরের মেয়েরা বুড়ো বলে ঠোঁট ওল্টাবে আর পঞ্চাশ পার হওয়া মহিলারা একা থাকলেও ভিমরতি হয়েছে বলে ভাববেন। ওই বয়সে বিয়ের কথা চিন্তাও করতে পারেন না তারা। আপনাদের দেশে যেটা স্বাভাবিক এটা এখানে কল্পনার বাইরে।

ব্রাউন গ্লাসে চুমুক দিলেন।

এলিজাবেথ জিজ্ঞাসা করলেন, তার মানে এখানকার বয়স্ক মানুষেরা স্ত্রী বা স্বামী মারা গেলে খুব একলা হয়ে যান?

প্রায় তাই। আগে নাতি-নাতনিদের নিয়ে ভুলে থাকা যেত। এখন ছেলেমেয়েরা দূরে দূরে চলে গেলে অন্য কিছু করার তো থাকে না।

রাত বাড়ছিল। সেইসঙ্গে ঠাণ্ডাও। এলিজাবেথ তাঁর ঘরে গিয়ে শীতবস্ত্র জড়িয়ে নিলেন। খাবার গরম করে ব্রাউন তাঁকে ডাকলেন। ব্রাউনের পক্ষে এই খাবার নিত্য কিনে খাওয়া সম্ভব নয়। স্যালাড দিয়ে রোস্টেড চিকেন রুটির সঙ্গে খেতে চমৎকার লাগছিল তাঁর। তিনি লক্ষ করলেন এলিজাবেথ কোনও প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন না। চুপচাপ খেয়ে নিলেন তিনি।

ব্রাউন বললেন, রাত্রে যদি কোনও অসুবিধে হয় তাহলে আমাকে ডাকতে দ্বিধা করবেন না। আমার ঘুম খুব পাতলা।

অসুবিধে মানে?

নতুন জায়গা। তার ওপর আপনাদের মত আরামদায়ক নয়। আমি একটা রুমহিটার চালিয়ে দিচ্ছি। যদি বেশি গরম লাগে বন্ধ করে দেবেন।

এলিজাবেথ দরজা বন্ধ করলে ভুটোকে খাবার দিয়ে ব্রাউন নিজের ঘরে চলে এলেন। এই নির্জন রাত্রে একজন সুন্দরী মহিলার সঙ্গে তিনি আছেন, গত রাতেও ভাবতে পারতেন না তিনি। এলিজাবেথের যে বয়স হয়েছে সেটা চট করে বোঝা যায় না। স্টার মুভিজে যেসব ছবি দেখানো হয় তাতে এমন বয়স্কা সুন্দরীদের প্রায়ই দেখা যায়। ষাট পেরিয়েও তাঁরা তাঁদের যৌবনরেখা প্রকট রাখতে পেরেছেন। নেপালি তো বটেই ভারতীয় মহিলাদের কজন সেটা পারেন অথবা পারতে চান? বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করলেন ব্রাউন। আজ মনে হচ্ছে যেন গত পরশু ঘটনাটা ঘটেছিল। এলিজাবেথকে তাঁর বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে গল্প করে তিনি যখন ফিরে যাচ্ছিলেন তখন মনে হয়েছিল বিয়ে না করলে তিনি ওঁর প্রেমের জন্যে কাঙাল হতে পারতেন। আর পাঁচটা জাহাজির থেকে নিজের পার্থক্য ঠিক রাখতে তিনি খুব সংযত জীবনযাপন করতেন বলে এই ভাবনাটা দ্রুত মন থেকে সরিয়ে দিতে পেরেছিলেন। কিন্তু সেই সামান্য আলাপের সূত্র ধরে এলিজাবেথ একা এত বছর পরে তাঁর কাছে চলে এল। শুধুই কৌতূহল! আজ হঠাৎ ব্রাউনের বুকের বাতাস ভারী হল। অদ্ভুত অস্বস্তি। না, কারও কাছে তাঁর কোনও দায় নেই। নতুন করে জীবন শুরু করলে কারও কিছু বলার নেই। মুশকিল হল যে অর্থ সঞ্চিত আছে তার সুদে বাকি জীবনটা একা কাটিয়ে দিতে তিনি পারবেন কিন্তু আর একজনের দায়িত্ব নিতে চাইলে সে সব গোলমাল হয়ে যাবে। এই বয়সে নতুন করে রোজগার করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। ব্রাউন নিশ্বাস ফেললেন। ঠিক তখনই বাইরের দরজায় শব্দ হল এবং ভুটো প্রবলভাবে ডেকে উঠল। এত রাত্রে কে এল? এখানকার সবাই জানে রাত দশটার পর তিনি পানাহার করে ঘুমিয়ে পড়েন। একমাত্র কোনও খারাপ খবর থাকলে সেটা দেওয়ার জন্যে কেউ আসতে পারে। কম্বল সরিয়ে সোয়েটার পরে ব্রাউন ঘর থেকে বেরিয়ে আলো জ্বাললেন। তারপর বাইরের ঘরে দরজায় পৌঁছে জিজ্ঞাসা করলেন, কে?

আমি। গলার স্বর সিমির।

খুব অবাক হয়ে দরজা খুললেন ব্রাউন। ভুটো চিৎকার করে যাচ্ছিল। কিন্তু সিমিকে দেখামাত্র চুপ করে গেল। সিমির হাতে একটা ক্যাসারোল। কোনও কথা না বলে ঘরে ঢুকে টেবিলের ওপর সেটা রেখে বলল, মাংস রান্না হয়েছিল, দিয়ে গেলাম।

এত রাত্রে?

ও, খাওয়া হয়ে গেছে বুঝি?

হ্যাঁ, অনেকক্ষণ।

ও। তাহলে নিয়ে যাচ্ছি।

না না। কষ্ট করে নিয়ে এসে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে কেন? ফ্রিজে রেখে দিচ্ছি। কালকে খাব আমরা।

ঝাল আছে। তোমার মেমসাহেব খেতে পারবে তো।

ওহো। দেখা যাক।

সিমি দরজার দিকে পা বাড়াল। ব্রাউন জিজ্ঞাসা করলেন, এত রাত্রে তুমি একা যাবে, চলো আমি তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।

সিমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল, আমি তো একাই এসেছি। বলে দ্রুত বেরিয়ে গেল। সিমির কথাবার্তা, ভঙ্গি খুব অচেনা মনে হচ্ছিল ব্রাউনের। দরজা বন্ধ করে ফিরে আসতেই দেখলেন এলিজাবেথ তাঁর ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে হাসছেন।

ও, আপনারও ঘুম ভেঙে গেছে তাহলে!

আমার এখনও ঘুম আসেনি।

ব্রাউন ক্যাসারোলটা ধরলেন। এখনও গরম আছে। ঠাণ্ডা না হলে ফ্রিজে ঢোকানো ঠিক হবে না। বললেন, মেয়েটা পাগল!

কেন? এলিজাবেথ প্রশ্ন করলেন।

নইলে এত রাত্রে কেউ খাবার পৌঁছে দিতে আসে?

ও কি আপনাকে প্রায়ই খাবার এনে দেয়?

তা দেয়। ও আছে বলে মাঝে মাঝে জিভের স্বাদ বদলায়। কিন্তু এখানকার সবাই জানে এই সময় আমি ঘুমিয়ে পড়ি। ও কখনও আগে এ সময় আসেনি।

আজ এল, তাই তো!

 হ্যাঁ। খুব অবাক হয়েছি আমি।

আমি হইনি।

কেন?

কোনও কোনও ব্যাপার আছে যা শুধু মেয়েরাই বুঝতে পারে!

 সেটা কী?

বোঝানো যাবে না। মেয়েলি ইনস্টিংক্ট। ধরুন ব্যাপারটা এইরকম, মেয়েরা সন্দেহ করতে খুব ভালবাসে। মনে সন্দেহ একবার ঢুকলে তাদের টেনশন বেড়ে যায়। তখন যাচাই করার জন্যে যে কোনও একটা ছুতো ঠিক খুঁজে বের করে। আচ্ছা, গুডনাইট। এলিজাবেথ ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন।

.

রাতে একবার নিত্য ঘুম ভাঙে, টয়লেটে যান, ভুটোর সঙ্গে কথা বলেন, তারপর বিছানায় ফিরে যান ব্রাউন। আজ সেসবের কিছুই হল না। ঘুম ভাঙলে দেখলেন ঘর অন্ধকার। জানলার পর্দা সরিয়ে মরা আলো দেখতে পেলেন। ঘড়িতে এখন সাতটা। ধড়মড়িয়ে বিছানা ছেড়ে টয়লেটে গেলেন তিনি। পরিষ্কার হয়ে একটু কেতাদুরস্ত পোশাকে বসার ঘরে এসে দেখলেন এলিজাবেথের দরজা খোলা।

তিনি হালকা গলায় বললেন, গুড মর্নিং। কিন্তু কেউ সাড়া দিল না। নিজেকে অপরাধী ভাবছিলেন ব্রাউন। এর মধ্যে চা তৈরি করে দেওয়া উচিত ছিল তাঁর। হাজার হোক অতিথি। এই সময় দেখতে পেলেন বাইরের দরজা ভেজানো এবং ভুটো নেই। তিনি বাড়ির সামনে গেটে গেছে ওদের দেখতে পেলেন। রাস্তার বাঁকে দাঁড়িয়ে এলিজাবেথ কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে তাকিয়ে আছেন। এখানকার আকাশে এখন মেঘেরা চলাফেরা করলেও কাঞ্চনজঙ্ঘার মাথাটা পরিষ্কার। এরকম ঘটনা খুব কমই ঘটে। তার চেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার, ভুটো এলিজাবেথের পায়ের কাছ ঘেঁষে চুপটি করে বসে আছে। এত তাড়াতাড়ি ও কোনও মানুষের সঙ্গে ভাব করে না। সত্যি কথা বলতে সিমি ছাড়া আর কারও সঙ্গে ভুটোর সদ্ভাব নেই। কুকুরটার নিশ্চয়ই মহিলাদের সম্পর্কে দুর্বলতা আছে।

ব্রাউন গলা তুললেন, গুড মর্নিং।

এলিজাবেথ ঘাড় ঘুরিয়ে নীচে তাকালেন, গুড মর্নিং। ঘুম ভাঙল?

হ্যাঁ। আজ একটু দেরি হয়ে গেল। রাতে কোনও অসুবিধে হয়নি তো?

কাঁধ ঝাঁকালেন এলিজাবেথ, ঠিক আছে। তারপর মুখ ফিরিয়ে বললেন, এরকম দৃশ্য আমি কখনও দেখিনি। আপনার কাছে না এলে বঞ্চিত হতাম।

ততক্ষণে ব্রাউন পৌঁছে গেছেন কাছে। এবার মেঘ জমতে আরম্ভ করেছে কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে। ধীরে ধীরে দৃশ্যটা আড়ালে চলে গেল। এলিজাবেথ বললেন, যাঃ।

ব্রাউন বললেন, আজকের দিনটা ভাল যাবে না।

কেন?

এইরকম মেঘলা থাকবে। ছায়া ছায়া। মাঝে মাঝে টুপটাপ বৃষ্টি পড়বে। একেবারে স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া। মন খারাপ করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।

হয়তো। কিন্তু লস অ্যাঞ্জেলসে আমরা তো এমন আবহাওয়া পাই না। আপনাদের এই জায়গাটাকে আমার খুব ভাল লাগছে। এলিজাবেথ বললেন।

ধন্যবাদ।

এই রাস্তাটা কত ওপরে গিয়েছে?

 অনেকটা। চার্চের পাশ দিয়ে ঘুরে উল্টোদিকের পাহাড়ে পৌঁছোনো যায়।

আমি একটু হেঁটে আসতে পারি?

 অবশ্যই। কিন্তু আপনার তো এখনও চা খাওয়া হয়নি।

এলিজাবেথ ওপরের দিকে তাকিয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে হাসলেন। এই সময় তাঁকে বেশ সুন্দরী দেখাল। ব্রাউন কথাটা বলবেন কি না ভাবছিলেন এই সময় নীচের রাস্তায় সায়নকে দেখতে পেলেন। রাস্তার ধারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা। সঙ্গে সঙ্গে তার খেয়াল হল ওর কথা তিনি একদম ভুলে গিয়েছিলেন। সায়ন সুস্থ হয়ে বাইরে বেরিয়েছে দেখে তাঁর খুব ভাল লাগল। তিনি বললেন, একটু ওপাশে চলুন, আপনার সঙ্গে একজনের আলাপ করিয়ে দেব। আপনার ভাল লাগবে।

এলিজাবেথ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, কে তিনি?

 ব্রাউন বললেন, একজন ইয়ং ম্যান। কিন্তু অন্য ধরনের ছেলে।

এলিজাবেথ ব্রাউনের সঙ্গে হেঁটে এলেন। সায়ন ওঁদের দেখতে পেল। ব্রাউনের সঙ্গে একজন শ্বেতাঙ্গিনীকে দেখে সে অবাক হল। সাদা প্যান্ট আর নীল পুলওভার পরা লম্বা মহিলাটি তার মায়ের চেয়ে বয়সে অনেক বড় কিন্তু হাঁটার ভঙ্গি অনেক বেশি স্মার্ট। কাছাকাছি আসতেই সে বলল, গুড মর্নিং, মিস্টার ব্রাউন।

গুড মর্নিং, মাই সন। তুমি এখন কেমন আছ?

 ভাল। আপনি ভাল আছেন?

আমি তো সবসময় ভাল থাকি। যিশু আমাকে খারাপ থাকতে দেন না। এই দ্যাখো, আমার খুব পুরনো বন্ধুকে তিনি পাঠিয়ে দিয়েছেন। ইনি এলিজাবেথ, লস অ্যাঞ্জেলসে থাকেন। আর এর নাম সায়ন।

এলিজাবেথ হাত বাড়িয়ে দিলেন। সায়ন ওঁর হাত স্পর্শ করে উত্তাপ পেল। সে জিজ্ঞাসা করল, আপনি এখানে বেড়াতে এসেছেন?

এসেছিলাম মিস্টার ব্রাউনকে দেখতে। সেই সুবাদে বেড়ানোও হচ্ছে। আচ্ছা, তুমি কি এখানকার বাসিন্দা? এই পাহাড়ের? এলিজাবেথ জিজ্ঞাসা করলেন।

সায়ন মাথা নাড়ল, না। আমি কলকাতা থেকে এসেছি।

এলিজাবেথ বললেন, তাই বলো। আমিও এইরকম অনুমান করছিলাম।

ব্রাউন জিজ্ঞাসা করলেন, কীরকম?

এখানকার মানুষদের মুখের গঠন গায়ের রঙের সঙ্গে চিন বা জাপানের মানুষদের খুব মিল আছে। সত্যি বলতে কী, আপনাকে যখন প্রথম দেখি তখন জাপানি বলে ভুল করেছিলাম। এখানে এসে ট্যাক্সি ড্রাইভার, যে লোকটি কাল খাবার এনে দিল, ওই মেয়েটি, এরা সবাই আপনার মতো দেখতে। এরা যে পাহাড়ের লোক তা বুঝতে অসুবিধে হয় না। কিন্তু একে দেখতে একেবারে আলাদা। বোঝাই যায় এখানকার মানুষ নয়। আচ্ছা, তুমিও কি ক্রিশ্চান?

না। জন্মসূত্রে আমি হিন্দু।

 হিন্দু? এলিজাবেথ যেন কিছু মনে করার চেষ্টা করলেন।

ব্রাউন বললেন, আপনার একটা ভুল হচ্ছে। শরীর দেখে যাদের পাহাড়ের মানুষ বলে মনে করছেন তাদের সবাই কিন্তু ক্রিশ্চান নয়।

তা হলে? এলিজাবেথ অবাক।

বেশির ভাগই হিন্দু। খুব অল্পসংখ্যার মানুষ ক্রিশ্চান বা বৌদ্ধ। আমাদের এই পাহাড়টায় অবশ্য ক্রিশ্চানদের সংখ্যাই বেশি। কারণ অনেককাল আগে এখানকার মানুষরা একসঙ্গে ক্রিশ্চান হয়েছিল।

গুড মর্নিং এভরিবডি।

ওঁরা দেখলেন ডাক্তার তাঁর নিরাময়ের গেটে এসে দাঁড়িয়েছেন। ব্রাউন চিৎকার করে গুড মর্নিং বললেন। তারপর এলিজাবেথকে নিয়ে এগিয়ে এলেন, ডক্টর, ইনি এলিজাবেথ, আমেরিকায় থাকেন। গতকাল আমার বাড়িতে এসেছেন। তিরিশ বছর আগে আমাদের একটু আলাপ হয়েছিল।

ডাক্তার এলেন, তাই নাকি! বাঃ! এখানে এসে নিশ্চয়ই খুব খারাপ লাগছে না।

না। এখনও নয়। আচ্ছা, আপনিও তো পাহাড়ের মানুষ নন?

 এলিজাবেথের প্রশ্নে অবাক হলেন ডাক্তার। জিজ্ঞাসা করলেন, হঠাৎ এই প্রশ্ন?

 আপনাকে মিস্টার ব্রাউনের মতো দেখতে নয় বলে জিজ্ঞাসা করছি।

ও। হ্যাঁ। বোধহয় মঙ্গোলিয়ান ধাঁচ পাহাড়ের মানুষদের ফিচার সমতলের মানুষদের থেকে আলাদা করেছে। সেটা রক্তের সূত্রে। কিন্তু আমি নিজেকে পাহাড়ের মানুষ বলে মনে করি। আচ্ছা, আপনারা যদি আমাকে একটু চা খাওয়ানোর সুযোগ দেন তাহলে কৃতার্থ বোধ করব। কয়েক মিনিটের জন্যে ভেতরে আসুন না। ডাক্তার হাসলেন।

ওঁরা ভেতরে ঢুকলেন। ডাক্তার ডাকলেন, সায়ন, চলে এসো। একটু গল্প করা যাক। আমেরিকান মেমসাহেবের কৌতূহলে সায়নের মজা লেগেছিল। সে-ও পা বাড়াল।

অফিসঘরের চেয়ারে বসে এলিজাবেথ চারপাশে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, এটা কি কোনও ক্লিনিক?

ব্রাউন অল্প কথায় বুঝিয়ে দিলেন নিরাময়ে কী করা হয়। ডাক্তারের ভূমিকা কী।

এলিজাবেথ হতভম্ব হয়ে গেলেন, আপনি একা এসব করেছেন?

 ডাক্তার মাথা নাড়লেন, না, না। আমি একা কী করে পারব? আমার সহকারী আছে, প্রয়োজন হলেই শহরের ট্রেইন্ড নার্সদের সাহায্য নিই। হসপিটালের ডাক্তাররাও সাহায্য করেন। আর এখন মিসেস অ্যান্টনি এসে যাওয়ায় ছেলেমেয়েদের খাওয়া-দাওয়া নিয়ে চিন্তা করতে হয় না।

মিসেস অ্যান্টনি?

উনি পাহাড়ের মানুষ। স্বামী মারা যাওয়ার পর সময় কাটছিল না তাঁর। নিজে থেকে আমাদের সাহায্য করতে এসেছেন।

তার মানে এখানে ডাক্তার বলতে আপনি একা?

হ্যাঁ, ব্যাপারটা সেইরকমই।

আমার মনে হয় সেটা ঠিক হচ্ছে না। আপনি অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। তখন পেশেন্টদের দেখাশোনা করবে কে? তাদের সমস্যা হবে! এলিজাবেথ কথা শেষ করলেন না।

সেরকম হলে লোক্যাল ডাক্তারদের সাহায্য পাব।

কিন্তু আপনি একা এতখানি দায়িত্ব না নিয়ে আরও কয়েকজন স্পেশালিস্টকে সঙ্গে নিচ্ছেন না কেন। একটা টিম যদি কাজ করে তাহলে সুবিধে বেশি।

আপনি ঠিক বলেছেন। কিন্তু সমস্যাটা অর্থনৈতিক। এখানে যা-কিছু করেছি তা আমার চেষ্টায় এবং সঞ্চয়ে। অন্য জায়গায় পেশেন্টরা যায় কিছুদিনের জন্য, সুস্থ হয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরে। এখানে দীর্ঘকাল থাকতে হয়। ট্রিটমেন্টের খরচও অনেক। প্রয়োজন হলে খুব দামি ইনজেকশন দিতে হয়। এদের গার্জেনদের ওপর চাপ থাকেই। আর একজন স্পেশালিস্টকে নিতে গেলে সেই চাপ আরও বাড়াতে হবে আমাকে।

কিন্তু আপনার ব্যক্তিজীবন?

না। আমার কোনও আলাদা জীবন নেই। এই নিরাময়ই আমার প্রথম এবং শেষ কথা। স্বীকার করছি অর্থের অভাবে আমাদের সমস্যা খুব বেড়ে যাচ্ছে। যেসব সংস্থা আমাদের সাহায্য করেছেন তারা না করলে চালানো সম্ভবও হত না। তবু আমি হাল ছাড়তে নারাজ। দেখাই যাক না।

সরকারি সাহায্য পান না?

না। সরকার এটাকে ব্যক্তিগত ব্যবসা মনে করেন।

এই সময় ছোটবাহাদুর চা নিয়ে এল। চা আর বিস্কুট। সায়ন এতক্ষণ দরজায় দাঁড়িয়ে শুনছিল। ব্রাউনের পেছনে ছিল বলে তিনি ওকে দেখতে পাননি। ছোটবাহাদুর ঢোকায় ব্রাউন ঘাড় ঘোরাতেই ওকে দেখতে পেলেন, আরে! তুমি দাঁড়িয়ে কেন? বোসো। এখানে বোসো।

সায়ন এগিয়ে এল। চেয়ারে বসে ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করল, আমি কি এক কাপ চা পেতে পারি?

অফ কোর্স।

চায়ে চুমুক দিয়ে সায়ন এলিজাবেথের দিকে তাকাল, আমেরিকায় তো অনেক দেশের মানুষ বাস করছে। এ নিয়ে সমস্যা হয় না?

একেবারেই যে হয় না তা বলব না। তবে আমাদের দেশের প্রতিটি স্টেট বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেয়। ডিফেন্সের দায়িত্ব কেন্দ্রের। ফিনান্সের একটা অংশ রাজ্যের। এ ছাড়া স্টেট নিজের আইনমতো চলে। ফলে কোনও স্টেটের মানুষ মনে করে না কেন্দ্র তাদের ওপর কিছু চাপিয়ে দিচ্ছে। তা ছাড়া এখানে আইন এমনভাবে তৈরি যাতে প্রতিটি মানুষ তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করতে পারে। কথা বলতে বলতে এলিজাবেথ বারংবার সায়নের দিকে তাকাচ্ছিলেন।

এইসময় বড়বাহাদুর এসে বলল, আপনার মা এসেছেন।

ডাক্তার তাকালেন, উনি তো আজই ফিরে যাচ্ছেন?

সায়ন উঠে দাঁড়াল, হ্যাঁ।

ঠিক আছে। তুমি ভিজিটার্স রুমে ওঁকে বসাও। আমি একটু বাদে যাচ্ছি।

সায়ন চলে গেলে এলিজাবেথ জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার ছেলে?

না। ডাক্তার হাসলেন।

ব্রাউন গম্ভীর গলায় বললেন, সায়ন এখানকার পেশেন্ট।

মাই গড। আঁতকে উঠলেন এলিজাবেথ, ওরও লিউকোমিয়া হয়েছে?

 হ্যাঁ। তবে ওর অসুখটার সঙ্গে লড়াই করা যাচ্ছে।

আমি ভাবতেই পারছি না। ওরকম সুন্দর ছেলে। হায় ভগবান!

ব্রাউন বললেন, সায়ন একটু আলাদা। আমি ওর মুখের দিকে তাকালে যিশুকে দেখতে পাই। ইয়েস, আই মিন ইট।

ডাক্তার হাত নাড়লেন, না মিস্টার ব্রাউন। এভাবে বলবেন না। একেই তো ওই ঘটনাটা প্রচারিত হওয়ায় আমাদের বিপদে পড়তে হয়েছে।

এলিজাবেথ জানতে চাইলেন, কী বিপদ?

ডাক্তার সংক্ষেপে মেরির মূর্তির সামনে সায়নের মোমবাতি জ্বালার গল্পটা বললেন। এলিজাবেথ কিছু বলতে যাচ্ছিলেন এমন সময় মিসেস অ্যান্টনি অফিসে ঢুকলেন। ডাক্তার বললেন, এর কথাই তখন বলছিলাম। মিসেস অ্যান্টনি। আর ইনি হলেন এলিজাবেথ।

মিসেস অ্যান্টনি হাত জোড় করে নমস্কার করলেন। এলিজাবেথ সেটাকে নকল করার চেষ্টা করলেন। ডাক্তার বললেন, কিছু যদি মনে করেন আমাকে একটু উঠতে হবে। আপনার সঙ্গে কথা বলে ভাল লাগল। আপনি আমাদের এখানে কতদিন থাকছেন?

আমার ফেরার টিকিট ওপেন আছে। আই ডোন্ট নো, হয়তো আজই ফিরে যেতে পারি, নয়তো কাল। কিন্তু যাওয়ার আগে আপনার সঙ্গে একবার দেখা করে যেতে চাই।

ও, নিশ্চয়ই। আমি খুব খুশি হব।

এলিজাবেথ এবং ব্রাউন অফিসঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই কঙ্কাবতীকে দেখতে পেলেন। একটা হলুদ চাদর জড়িয়ে কঙ্কাবতী সিঁড়ির শেষ ধাপে দাঁড়িয়েছিল। ব্রাউন দাঁড়িয়ে গেলেন, এই মেয়েটিকে তিনি এর আগে এখানে দেখেননি। মিসেস অ্যান্টনি এগিয়ে এলেন, ওর নাম কঙ্কাবতী।

এলিজাবেথ চাপা গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, ও কি অসুস্থ?

মিসেস অ্যান্টনি নিচু স্বরে বললেন, হ্যাঁ। তবে মারাত্মক নয়।

এলিজাবেথ বললেন, মাই গড! নীচের প্যাসেজে দাঁড়িয়ে কয়েকজন মানুষ তার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে বেশ অস্বস্তি হল কঙ্কাবতীর। সে মুখ ঘুরিয়ে সরে যাচ্ছিল কিন্তু মিসেস অ্যান্টনি তাকে ডেকে বললেন, গুড মর্নিং! এখন কেমন আছ?

ভাল। শান্ত গলায় বলল কঙ্কাবতী।

ইনি মিস্টার ব্রাউন আর উনি এলিজাবেথ।

ব্রাউন বললেন, পরে আলাপ করব। আমি পাশেই থাকি। যিশু তোমার মঙ্গল করবেন। আচ্ছা, চলি।

বাইরে বেরিয়ে এসে এলিজাবেথ ঘুরে দাঁড়িয়ে নিরাময়কে দেখলেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা ভারতবর্ষের মানুষ কি আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার সুযোগ পায় তো?

ব্যাপক হারে না হলেও বড় বড় শহরে নিশ্চয়ই পায়।

ডাক্তার যা বললেন এবং আমি যা বুঝলাম তাতে এই হোমে সেরকম চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। তাহলে কেন এইসব পেশেন্টদের অভিভাবকেরা ওদের পাঠিয়েছেন?

দুটো কারণ। এরা নিশ্চিতভাবে বাড়িতে থেকে চিকিৎসা করাতে পারত। কিন্তু যে মেডিক্যাল তদারকি এদের ওপর প্রতিনিয়ত করা দরকার তা বাড়িতে করা একটু মুশকিল। হঠাৎ ব্লিডিং আরম্ভ হলে সমস্যা তৈরি হয়। নিরাময়ের ডাক্তার আধুনিক চিকিৎসার খুঁটিনাটি জানেন। তার ওপর পেশেন্টদের প্রতি ওঁর মমতা ভালবাসা এত বেশি যে ওরা ওঁর জন্যে মনে জোর পায়। এই কারণেই এখানে এলে ওদের ভাল লাগে।

এখানে থেকে কেউ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছে?

আপনি নিশ্চয়ই জানেন এই অসুখ থেকে একেবারে মুক্তি পাওয়া প্রায় অসম্ভব। তবে অসুখটাকে নিয়ন্ত্রণ করে নিয়মের মধ্যে থাকলে দীর্ঘকাল বাঁচা যায়। সেরকম অনেকেই এখান থেকে ফিরে গেছে। ব্রাউন কথা বলতে বলতে দেখলেন একটা গাড়ি নীচ থেকে উঠে আসছে। গাড়িটা সামনে আসতেই তিনি পেছনে বসা একলা মেয়েটিকে চিনতে পারলেন। হাত তুলে বললেন, গুড মর্নিং।

গাড়িটা দাঁড়িয়ে গেল। ব্রাউন বললেন, তুমি তো জুলি ডিসুজা। আমাকে বোধহয় চিনতে অসুবিধে হচ্ছে তোমার!

মেয়েটি দরজা খুলে এল। সাদা জিনস আর লাল পুলওভারে ওকে চমৎকার দেখাচ্ছে। হেসে বলল, দিদির অ্যাকসিডেন্টের খবর দিতে আপনি গিয়েছিলেন।

হ্যাঁ। ঠিক। ওহো, তোমার দিদি কেমন আছে এখন?

 ভাল।

ড্রাইভার? তাকে তো শিলিগুড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

ও এখনও হাসপাতালে।

সত্যি, আমার অন্যায় হয়ে গিয়েছে। তালেগোলে একদম ভুলে গিয়েছিলাম। ব্রাউন মাথা নাড়লেন, আমার খোঁজ নেওয়া উচিত ছিল।

এটুকু বলার জন্য ধন্যবাদ।

তুমি কোত্থেকে আসছ?

দার্জিলিং। শোনামাত্র আড়ষ্ট হয়ে গেলেন ব্রাউন। ওর দিদির সম্পর্কে লোক যে বদনাম দিয়েছে সেই একই বদনাম কি এর সম্পর্কে দেবে? জুলিও কি একই পথে এগোচ্ছে? এই সময় এলিজাবেথ বললেন, আপনাদের কথা আমি বুঝতে পারছি না। শুনেছি ইন্ডিয়াতে অনেক ভাষা চালু আছে। এটা কোন ভাষা?

ব্রাউন বললেন, নেপালি। ওহহ, খুব লজ্জিত। আপনার সামনে আমাদের ইংরেজিতে কথা বলা উচিত ছিল। এর নাম জুলি ডিসুজা আর ইনি এলিজাবেথ।

আপনি ইংরেজ?

না। আমেরিকান। তুমি যে পাহাড়ের মানুষ তা দেখেই বোঝা যায়।

জুলি আসল, আমি চলি।

ব্রাউন বললেন, একদিন গিয়ে তোমার দিদিকে দেখে আসব।

দিদি কাঠমাণ্ডুতে চলে যাচ্ছে। আমরাও যাব। ওখানেই সেটল করব।

কথাবার্তা ইংরেজিতে হচ্ছিল। এলিজাবেথ জিজ্ঞাসা করলেন, কাঠমাণ্ডু কোথায়?

 নেপালে। আমরা ওখান থেকেই এখানে এসেছি।

নেপাল তো ইন্ডিয়া নয়। তাহলে তুমি কি ইন্ডিয়ান নও!

আমি ঠিক জানি না। কিন্তু আমি নেপালি এটুকু জানি।

জুলির গাড়ি ওপরে উঠে গেলে এলিজাবেথ বললেন, মেয়েটার কথাবার্তা ঠিক বুঝতে পারলাম না। মিস্টার ব্রাউন, ইন্ডিয়ার সিটিজেন নেপালে সেটল করতেই পারে কিন্তু ও ইন্ডিয়ান কি না সেটা জানবে না কেন?

.

২২.

বসেছিলেন নন্দিনী ছেলের হাত হাতে নিয়ে। কমলেন্দু এবং ঊর্মিলাও এসেছে। ডাক্তার বললেন, কোনও চিন্তা করবেন না। সায়ন এখন অনেক ভাল আছে। এর পরের বার যখন দেখবেন তখন বোধহয় অবাক হয়ে যাবেন।

ঊর্মিলা জিজ্ঞাসা করল, কী রকম?

 ওর কাজকর্ম বেড়ে যাবে। আমাকে তো সাহায্য করবেই, ইচ্ছে করলে বাইরের জগতে পা রাখতে পারে। আমি এ ব্যাপারে যা করার করব।

নন্দিনী বলেন, তাই যদি হয় তাহলে ও তো কলকাতায় যেতে পারে। আবার পড়াশুনা আরম্ভ করতে পারে। তাই না?

ঊর্মিলা বলল, ঠিকই। বিপদ কেটে গেলে ও এখানে পড়ে থাকবে কেন?

 ডাক্তার মাথা নাড়লেন, আমি জানাব। তখন ইচ্ছে হলে ওকে নিয়ে যেতে পারবেন।

নন্দিনী ছেলের হাত শক্ত করে ধরে একগাল হাসলেন।

সায়ন বলল, কিন্তু জানো মা, পাহাড়ে এসে আমি ভাল আছি। ওখানে যেমন সবসময় কষ্ট হত, এখানে হয় না।

কমলেন্দু বলল, তা তো ঠিকই। ওখানে ধোঁয়াধুলো বেশি এখানে ওসব নেই। তার ওপর ঠাণ্ডা আবহাওয়া। এখানে তো ভাল থাকবেই।

সায়ন বলল, আমি জানি তোমাদের অনেক টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে। বেশি দিন বাবার ওপর চাপ দেওয়া ঠিক নয়। কিন্তু–।

নন্দিনী বাধা দিলেন, এ আবার কী কথা? টাকাপয়সা নিয়ে ভাবতে তোকে কে বলেছে? তোর জন্যে খরচ করে কি আমরা না খেয়ে পড়ে আছি? আশ্চর্য।

তাহলে বাবা কেন এল না? মুখ তুলল সায়ন।

নন্দিনী হকচকিয়ে গেলেন। সামলে নেওয়ার চেষ্টা করলেন তৎক্ষণাৎ, ওর তো আসার খুব ইচ্ছে ছিল। বলেছিলেন, তুমি ওদের সঙ্গে যাও, আমি কাজকর্ম সামলে দুদিন বাদেই হাজির হচ্ছি। নিশ্চয়ই সেগুলো সামলে ওঠেননি।

সায়ন হাসল, তুমি সত্যি কথা বলছ না মা।

মানে?

তুমি বাবাকে আড়াল করতে চাইছ।

কী বলছিস তুই?

আচ্ছা, এখন কটা বাজে? সাড়ে নটা তো? বাবা এখনও ঘুমোচ্ছে। দশটার পরে ঘুম থেকে উঠে চা খাবে, খবরের কাগজ পড়বে। লুচি তরকারি খাবে। তারপর দু-চারটে ফোন করবে। যেসব জায়গায় বাবার কমিশন বাঁধা তাদের সঙ্গে কথা সেরে স্নান করে ভাত খাবে দুপুর পার করে। তারপর ঘুমোবে। আমি ঠিক বলছি কিনা? সায়ন আবার হাসল, আসলে আমার সামনে এলে খারাপ লাগবে বলে বাবা আসেনি।

নন্দিনী কোনও কথা বলতে পারলেন না। স্বামীর না আসা তিনি সমর্থন করতে পারেননি। কিন্তু যে বাড়িতে জন্মেছেন এবং যেখানে বউ হয়ে এসেছেন সেখানে স্বামীর কাজের প্রতিবাদ না করাটাই রেওয়াজ। ছেলেকে তিনি নিজের মতো করে গড়তে চেয়েছিলেন। ওই বাড়ির প্রভাব যাতে ওর ওপর না পড়ে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতেন। স্বামীকে অলস জীবনযাপন করতে দেখেছিলেন তিনি। যেহেতু রায়বাড়িতে চাকরি করার দৃষ্টান্ত নেই তাই উনি চাকরি করেন না। পিতৃপুরুষের রেখে যাওয়া সম্পত্তি ভাঙিয়ে জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারলেই ওঁর শান্তি। কলকাতার বড় বড় তিনটে বিদেশি কোম্পানিতে ওঁর বাবা যেসব জিনিসপত্র সাপ্লাই দিতেন তার দায়িত্ব তিন বন্ধুকে দিয়ে কমিশন পেয়েই তাঁর ব্যবসা করার শখ মেটে। সায়নের অসুখ যে সারবে না এমন বিশ্বাস করে বসে আছেন তিনি। প্রথম দিকে যতটা ছিল-না দিনদিন সেটা বাড়ছে। ছেলের সামনে এসে দাঁড়াতে ভদ্রলোক মনের জোর পান না। তাই এবারও আসবেন বলে আসেননি। সায়ন যেটা বলল সেটা একশো ভাগ সত্যি। নন্দিনী তা জানেন কিন্তু ছেলের মুখে শুনতে এখন খারাপ লাগল।

ডাক্তার বললেন, টাকাপয়সা নিয়ে তুমি কেন ভাবছ সায়ন?

কমলেন্দু বলল, হ্যাঁ, এসব নিয়ে তুই একদম ভাববি না। বাড়িতে মা ব্যাঘ্রবাহিনী আছেন। তিনি ঠিক রক্ষা করবেন।

সায়ন বলল, তাহলে আমাকে এখানে পাঠালে কেন?

কমলেন্দু অবাক হল, তার মানে? তোর চিকিৎসা–।

সেটা জানি। এসব না করিয়ে যদি মা ব্যাঘ্রবাহিনীর সামনে আমাকে শুইয়ে রাখতে তাহলে তিনি নিশ্চয়ই আমাকে রক্ষা করতেন। ওষুধ ইনজেকশনের দরকার হত না। কথাগুলো সায়ন হাসতে হাসতে বলল।

ঊর্মিলা কপট ভয়ের চিহ্ন ফোঁটাল চোখেমুখে, এ কি ছেলে রে বাবা। তুই মা ব্যাঘ্রবাহিনীকে বিশ্বাস করিস না? রায়বাড়িতে জন্মেছিস তো?

নন্দিনী বাধা দিলেন, থাক। ঠাকুরদেবতা নিয়ে ঠাট্টাইয়ার্কি করা আমার ভাল লাগে না। ডাক্তারবাবু, আপনি বলেছিলেন শীত বাড়লেই ওকে আমরা নিয়ে যেতে পারি।

ঠিকই।

তাহলে নভেম্বরের মাঝামাঝি টিকিট কাটতে বলি?

বেশ।

নন্দিনীরা ট্যাক্সি নিয়ে এসেছিলেন। ফেরার পথে ট্যুরিস্ট লজ থেকে জিনিসপত্র নিয়ে সোজা শিলিগুড়ি চলে যাবেন। ওঁদের তিস্তাতোর্সায় টিকিট হয়েছে। চলে যাওয়ার আগে ডাক্তার সায়নকে বললেন মিসেস অ্যান্টনিকে ডেকে আনতে। সে বেরিয়ে যেতে ডাক্তার নন্দিনীকে বললেন, আমি ওর সামনে বলতে চাইছিলাম না। চলে যাওয়ার সময় আপনারা ইমোশনাল হয়ে যাবেন না। রোজ যেমন লজে ফিরে যেতেন সেইভাবে যাবেন। কান্নাকাটি হলে সায়নের শরীর রি-অ্যাক্ট করতে পারে। বুঝতেই পারছেন।

ওরা যখন ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে তখন মিসেস অ্যান্টনিকে নিয়ে সায়ন অফিসঘর থেকে বেরিয়ে এল। ডাক্তার বললেন, মিসেস অ্যান্টনি। কাল যে প্যাকেটটা আনিয়েছিলাম ওটা যদি অনুগ্রহ করে এনে দেন!

মিসেস অ্যান্টনি সঙ্গে সঙ্গে, ও, সিওর’ বলে ভেতরে চলে গেলেন। পরক্ষণেই বেরিয়ে এলেন একটা চৌকো প্যাকেট হাতে নিয়ে।

ডাক্তার বললেন, এইটে আপনাদের জন্যে।

নন্দিনীর বুকের মধ্যে বরফ জমছিল। এরপর সেই নভেম্বরের আগে ছেলের সঙ্গে তাঁর দেখা হবে না। কিন্তু এর মধ্যে যদি কিছু হয়ে যায়! ভাবলেই শরীর ঝিমঝিম করে। কিন্তু ডাক্তার বলেছেন যাওয়ার সময় কান্নাকাটি করা চলবে না। সায়নের ভাল চাইলে সেটা করা অন্যায় হবে। কিন্তু কী করে নিজেকে সামলাবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। এখন ওই প্যাকেটটাকে দেখে তিনি যেন একটা বিষয় পেয়ে গেলেন।

নন্দিনী বললেন, ওমা! এসব কেন? না, না, আপনি আমাদের লজ্জায় ফেলে দিচ্ছেন। বেশ জোরে জোরে বলে উঠল নন্দিনী।

ডাক্তার বললেন, এতে লজ্জা পাওয়ার কোনও কারণ নেই। কাছেই মকাইবাড়ি বলে একটা চা-বাগান আছে। ওদের চায়ের নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন। সেই চা ওই প্যাকেটে আছে। খুবই সামান্য কিন্তু আপনারা নিলে আমার খুব ভাল লাগবে।

মিসেস অ্যান্টনি জোর করে নন্দিনীর হাতে প্যাকেট তুলে দিলেন। সায়ন বলল, দুটো ভাগ করবে। তোমরা আধাআধি নেবে।

ঊর্মিলা বলল, তোকে আর পাকামো করতে হবে না।

ওঁরা ট্যাক্সিতে উঠলেন। সায়ন ট্যাক্সি অবধি এগিয়ে এসেছিল। বলল, প্রত্যেক সপ্তাহে চিঠি দেবে। বাবাকে বলবে আমি ভাল আছি।

নন্দিনী নিঃশব্দে মাথা নাড়লেন। কমলেন্দু বলল, চলি রে।

ট্যাক্সিটা যেই বাঁক পার হল, নিরাময় চোখের আড়ালে চলে গেল, অমনি ডুকরে কেঁদে উঠলেন নন্দিনী। ভেতরের সব কান্না যেন একসঙ্গে বেরিয়ে আসতে চাইল। পাশে বসা ঊর্মিলা তাকে জড়িয়ে ধরল, শক্ত হও। সায়ন তো নভেম্বরে চলে আসছে। আর তো কটা দিন। নন্দিনী নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলেন। এই সময় ট্যাক্সি সেই ঝোরার সামনে এল। ঊর্মিলা দেখল মা মেরির মূর্তির সামনে আজ কোনও মোমবাতি জ্বলছে না। সে আড়চোখে কমলেন্দুকে দেখল। কমলেন্দু গম্ভীর মুখে খাদের দিকে চেয়ে আছে। প্যাকেটটা নন্দিনীর কোল থেকে তুলে নিয়ে ঊর্মিলা বলল, এটা কলকাতায় গিয়ে খোলা হবে না। সায়ন যেদিন যাবে সেদিন খুলবে। এই চা সেদিন সবাই মিলে খাব!

হাই সায়ন।

সায়ন মুখ ফিরিয়ে দেখল সিমি নীচ থেকে উঠে আসছে। আজ দারুণ সেজেছে সিমি। সাদা জিনসের ওপর লাল পুলওভার। মাথায় লাল কাপড় স্টাইল করে বাঁধা। মা চলে যাওয়ায় মন খারাপ হচ্ছিল খুব কিন্তু সিমিকে দেখে সেটা চাপা পড়ে গেল। সিমি ওর সামনে এসে জিজ্ঞাসা করল, কী দেখছ অমন করে?

সায়ন হাসল, তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।

 চোখ কপালে তুলল সিমি, মাই গড! তুমিও?

আমিও মানে?

ছেলেদের মুখে এই কথাটা শুনতে শুনতে আমি পাগল হয়ে গিয়েছি। পুরুষগুলোর স্বভাব হল মেয়েদের পটাতে তাদের সুন্দর বলে তেল মারা। এখন আর ওসব চলে না।

আমাকে তুমি এসব কথা বলছ কেন?

কারণ আমি ভেবেছিলাম তুমি আলাদা। কত বয়স তোমার?

সায়নের রাগ হয়ে গেল, আমি যদি খুব বাচ্চা অথবা বুড়ো হতাম তাহলে তোমার মনে ওই চিন্তা আসত না, তাই না?

মোটেই না। আজকালকার বাচ্চাগুলো টিভি দেখে দেখে পেকে গিয়েছে। দশ বছরের বাচ্চা কোমর দুলিয়ে গান গায়, দিল তো পাগল হ্যায়। আর বুড়োগুলো আরও শয়তান।

তোমাকে তেল দিয়ে আমার লাভ কী হবে?

সিমি তাকাল সায়নের চোখের দিকে। তার খেয়াল হল, সায়ন অসুস্থ। আর পাঁচজনের মতো স্বাভাবিক নয়। তার ওপর মা মেরির দয়া আছে ওর ওপরে। এভাবে কথা বলা ঠিক হয়নি।

সে হাত বাড়াল, সরি। আমি কথা উইড্র করছি। এসো, আমরা বন্ধু হই। জোর করেই সে সায়নের হাত ধরে ঈষৎ ঝাঁকাল।

স্পর্শ পেতেই সায়নের রাগ চলে গেল। সে হেসে বলল, কিন্তু তোমাকে আজ সত্যি সুন্দর দেখাচ্ছে। কোথাও বেড়াতে যাচ্ছ?

হ্যাঁ। এখান থেকে ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে যাব। সেখানে কাউকে ম্যানেজ করে দার্জিলিং-এ বেড়াতে যাচ্ছি। ঠোঁট টানটান করল সিমি।

ও। বেড়াতে যাচ্ছ।

হ্যাঁ। কিন্তু ঠিক করেছি আজ যদি কোনও ভাল ছেলে আমাকে ভদ্রভাবে অ্যাপ্রোচ করে তাহলে তাকেই বিয়ে করব। সারাদিন ম্যালে থাকব। দেখি আজ আমার কপালে তেমন কোনও ঘটনা লেখা আছে কি না! সিমি খুব গম্ভীর গলায় কথাগুলো বলল।

সায়ন অবাক হয়ে তাকাল, কিন্তু যদি কেউ তোমাকে বিয়ে করতে না চায়?

 তাহলে এই জীবনে বিয়ে করব না, হ্যাঁ।

মিস্টার ব্রাউন এ কথা জানেন?

ওঁর কি আমার কথা শোনার মতো সময় আছে?

বাঃ, উনি তো তোমাকে খুব স্নেহ করেন।

করতেন। কিন্তু বান্ধবী চলে আসার পর সব ভুলে গেছেন। সিমি এক পা এগিয়ে এল, আমরা কেউ কোনওদিন দেখিনি একজন আমেরিকান মেমসাহেব হুট করে চলে এল ওঁর কাছে। একই বাড়িতে দুজনে রাত কাটাল। আমি যদি কোনও ছেলের সঙ্গে এক বাড়িতে রাত কাটাতাম তাহলে আর দেখতে হত না। অথচ ওঁকে কেউ কিছু বলছে না।

না, না। এভাবে বলা ঠিক নয়। উনি বুড়ো মানুষ। যিনি এসেছেন তিনিও বেশ বয়স্কা। তার ওপর বিদেশিনী, অতিথি।

রাখো। ওই বুড়িকে এখনও দেখোনি, দেখলে বুঝবে যে কোনও ছুঁড়ির চেয়ে উনি কম যান না। আর পুরুষমানুষ? যত বুড়োই হোক আমি বিশ্বাস করি না। রাগে শরীর জ্বলে যাচ্ছে। মাথা নাড়ল সিমি।

এত রাগ কোরো না। তুমি তো আমার বন্ধু হতে চেয়েছ। বন্ধুর কথা নিশ্চয়ই তুমি শুনবে। মাথা ঠাণ্ডা করো। সায়ন বলল।

সিমি সায়নের মুখের দিকে তাকাল। ওর হঠাৎ মনে হল লোকগুলো বোধহয় ভুল দেখেনি। মিস্টার ব্রাউনও বলেন সায়নের নাক চোখের সঙ্গে যিশুর মিল আছে। সে মাথা নামাল, তুমি সব বুঝতে পার, না?

কেউ বুঝিয়ে বললে বুঝতে চেষ্টা করি।

বেশ। তাহলে চলো, ওই পাথরটার ওপরে গিয়ে বসি। এখান দিয়ে লোকজন যাচ্ছে আর হাঁ করে আমাকে দেখছে। সিমি এগিয়ে গেল। খাদের ধারে একটা বিশাল পাথর পড়ে আছে দীর্ঘদিন, তার এক ধারে গিয়ে বসল সিমি। ওখানে বসলে রাস্তা থেকে চট করে দেখা যায় না, একমাত্র যাঁরা নীচ থেকে উঠে আসবে তারাই দেখতে পাবে। সায়ন একটু দূরে বসল।

সামনে বিশাল গাছ। নীচের গাছগুলোর মাথা ঝুঁকে দেখা যায়। খাদটা ঢালু হয়ে নেমে গেছে মাইলের পর মাইল। তারপরই পাহাড়ের পাঁচিল। তাদের মাথায় কাঞ্চনজঙ্ঘা। কিন্তু আজ মেঘেদের দিন। ঘোলাটে হয়ে আছে চারধার। হাওয়া বইছে না। কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকটা ঢাকা পড়ে গেছে মেঘে। অদ্ভুত রকমের স্যাঁতসেতে হয়ে আছে এখানকার পৃথিবী। কথা না বললে মন খারাপ হয়ে যায়।

সায়ন বলল, আজ দার্জিলিং-এ যেও না, বৃষ্টি হতে পারে।

হোক।

বাঃ, বৃষ্টি হলে যে ছেলেটি তোমাকে সত্যি বিয়ের কথা বলত তার দেখা পাবে না। তাই না?

তুমি আমার সঙ্গে রসিকতা করছ?

না। রসিকতা কেন করব?

সিমি ঘুরে বসল, তুমি আমার কথা শোনো। শুনে বলল আমি কী করব?

ঠিক আছে।

আমি দুজনকে ভালবাসতাম। ভালবাসা বলব না, দুজনকেই আমার ভাল লাগত। কিন্তু ঠিক কাকে বিয়ে করব বুঝতে পারিনি।

ওরা জানে?

জানে। মানে এটা জানে আমার খুব ভাল লাগে, ভাল বন্ধু। কিন্তু কাউকেই আমি বলিনি যে তাকেই ভালবাসি। দুজনেই অবশ্য আমাকে বলেছে খুব ভালবাসে। তারপর আমেরিকায় চলে গেল ওরা। যাওয়ার আগে বলে গেল আমি রাজি হলেই বিয়ে করে সেখানে নিয়ে যাবে। কিন্তু এই কয় বছরে মাত্র দুটো চিঠি লিখেছে ওরা। জানো? আমি ওদের এখন ভুলে গিয়েছি। ঠিক করেছি কিনা বলো? কাতর মুখে তাকাল সিমি।

তুমি চিঠি লিখেছ?

 কতবার! উত্তর দিচ্ছে না জেনে আর লিখছি না। তোমাদের মিসেস অ্যান্টনি ওদের একজনের মা। উনিও ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করেছেন।

কেন?

 ছেলে নষ্ট হয়ে গেছে।

কথাটা ভালভাবে বুঝতে পারল না সায়ন। আজ সিমি যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে তা নিয়ে কখনও সে কোনও মেয়ের সঙ্গে কথা বলেনি। এমনকী ছেলেদের সঙ্গেও নয়। গল্পের বই পড়ে পড়ে নারীপুরুষের সম্পর্কের কথা জেনেছে সে। মাঝে মাঝে কৌতূহল হয় আরও জানার জন্যে। সেটা আবার মিলিয়েও যায়।

তারপর? সায়ন জিজ্ঞাসা করল।

তারপর কত ছেলে আমার দিকে হাত বাড়িয়েছে কিন্তু কাউকে আমি পাত্তা দিইনি। সবাই আমার শরীরটাকেই চায়, বুঝলে?

মন না পেলে শরীর নিয়ে কী হবে?

যাঃ বাবা। শরীর নিয়ে যারা সন্তুষ্ট থাকতে চায় তারা মনের ব্যাপারে মাথা ঘামায় না। লিচু খেয়েছ? মুখে পুরলে, শাঁসটা খেয়ে বিচি থু করে ফেলে দিলে। ওরা মেয়েদের সেইভাবে ফেলে দেয়। বলেই মুখ ফেরাল সে, তুমি কোনও মেয়ের শরীর ভোগ করোনি? কলকাতায় শুনেছি স্কুলে থাকতেই এসব হয়!

ভোগ করা মানে? আচমকা প্রশ্নটা ছিটকে বের হল।

মাই গড। তুমি কখনও প্রেম করোনি?

না।

কোনও মেয়েকে চুমু খাওনি?

না।

কেন?

জানি না কেন।

 তোমার এই অসুখটা কবে হয়েছে?

বছর দেড়েক।

 তার আগে কোনও মেয়েকে কাছে পাওনি?

 না। হাসল সায়ন। তার খুব মজা লাগছিল।

তাহলে তুমি বুঝবে না। হাল ছেড়ে দিল সিমি।

আচ্ছা, সিমি, তুমি বললে ছেলেরা মেয়েদের ভোগ করে ছুঁড়ে ফেলে দেয়, মেয়েরাও তো তাই করতে পারে!

জানি না। আমি একসময় ভেবেছিলাম করব। কিন্তু সাহস পাইনি। কিন্তু জানো, মাঝে মাঝে আমার মনে হয় কোনও ছেলেকে শরীর চাইছে। এই জন্যেই অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। যাক গে। এখন ওই ম্যাথুজ আমার সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ম্যাথুজ?

মাংসওয়ালা। থুক করে থুতু ফেলল সিমি, লোকটার সারা শরীরে কাঁচা মাংসের গন্ধ। কাছে গেলেই বমি আসে। এখন বোঝো, এই লোকটা নাকি আমাকে ভালবাসে। ওই বুড়ো ব্রাউন ওর হয়ে বলতে এসেছিল আমাকে। কী যে করি।

গোরুর মাংস কেটে বিক্রি করে বলে ম্যাথুজকে প্রথম দিকে পছন্দ হয়নি সায়নের। তারপর মনে হয়েছে ওই একই দৃশ্য কলকাতার ফুটপাতের পাশের দোকানগুলোতে দেখা যায়। ছাল ছাড়ানো খাসির শরীর ঝুলিয়ে বসে আছে দোকানদার। যার যেমন প্রয়োজন কেটে বিক্রি করছে। একবার ছাল ছাড়ানো হয়ে গেলে সেটা ছাগল ভেড়া না বাচ্চা গোরুর মাংস তা বোঝা মুশকিল। এখানকার পাহাড়ি ক্রিশ্চান মানুষেরা যখন গোরুর মাংস খেতে অভ্যস্ত তখন সেটা বিক্রি করলে ম্যাথুজ কোনও অন্যায় করছে না। পরে লোকটার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে তার। বেশ ভালই লেগেছে। লোকটাকে খুব নিস্পৃহ, কবিদের মতো উদাস মনে হয়েছে। সায়ন বলল, কিন্তু ম্যাথুজ লোকটা ভাল।

সিমি শরীর বেঁকিয়ে সায়নকে কয়েক সেকেন্ড দেখল, আমাকে দ্যাখো তো। আমার সঙ্গে ওকে মানাবে? মানালে আমি নিজেই ওর সঙ্গে প্রেম করতে যেতাম না? একই পাড়ায় থাকি, রোজ দেখছি, অথচ আমার মনে কিছুই হচ্ছে না এমন কারও মন আমার জন্যে যদি ছটফট করে তাহলে আমি কী করতে পারি! বলো?

তা ঠিক। সায়ন মাথা নাড়ল। এসব ব্যাপার তার কাছে এখনও ধোঁয়াশা। কিন্তু শুনতে বেশ মজা লাগছিল।

যাক। আজ আমার মন পরিস্কার হয়ে গেল।

কেন?

তুমি আমাকে ঠিক বলেছ। তৃপ্তির হাসি হাসল সিমি।

কিন্তু তুমি মিস্টার ব্রাউন সম্পর্কে ঠিক বলোনি। উনি ভাল মানুষ।

হতে পারে। কিন্তু ওই আমেরিকান মেমসাহেবটা কাল রাত্রে ইংরেজি ছবির নায়িকার মতো পোশাক পরেছিল কিন্তু মিস্টার ব্রাউন ওকে কিছু বলেনি।

শার্টপ্যান্ট?

দুর! সে তো আমিও পরি। নাইটি। এতখানি পিঠ খোলা, বুক বেরিয়ে পড়েছে অনেকটা কিন্তু কোনও হুঁশ নেই।

তুমি কী করে দেখলে?

বাঃ, মাংস রান্না করে দিতে গিয়েছিলাম আমি। হ্যাঁ, একটু রাত হয়ে গিয়েছিল ঠিকই। আসলে টিভিতে বুড়ো ওই রকম মেয়ে দেখে তো তাই নিজের বাড়িতে দেখতে মজা লাগছে। কথা শেষ করে সায়নের দিকে তাকাল সিমি। একটু যেন অস্বস্তি হল। তারপর বলল, ঠিক আছে, আমি আর এ নিয়ে কিছু বলব না।

আসলে মেমসাহেবকে দেখে তোমার রাগ হয়েছে।

কেন হবে না? ঝাঁঝিয়ে উঠল সিমি, এতদিন আমি ছাড়া বুড়োর তো আর কেউ ছিল না। দরকারে অদরকারে সবসময় আমাকে প্রয়োজন হত। এখন আমেরিকা থেকে মেমসাহেব এসেছেন, ব্যাস তাঁকে পেয়ে সব ভুলে গেলেন? বুড়ি বেঁচে থাকলে মেমসাহেবকে রাখতে পারতেন বাড়িতে? আমার মনে হচ্ছে ওই মেমসাহেব বুড়োকে নিয়ে ঠিক আমেরিকায় চলে যাবে।

কেন?

 তা জানি না।

 সায়ন উঠে দাঁড়াল, চলো, আমরা মিস্টার ব্রাউনের বাড়িতে যাই।

আমি যাব না।

কাল রাত্রে তো গিয়েছিলে। আর একবার নিশ্চয়ই যেতে পারো।

খুব অনিচ্ছা নিয়ে হেঁটে রাস্তায় এল সিমি। সায়ন দেখল নিরাময়ের গেটে মিসেস অ্যান্টনির পাশে কঙ্কাবতী দাঁড়িয়ে আছ। মিসেস অ্যান্টনি ওর হাতটা ধরে রেখেছেন।

আরে সিমি, কেমন আছ তুমি?

 ভাল। নতুন চাকরি ভাল লাগছে?

খু-উব। তবে চাকরি বলাটা ঠিক নয়। এটাই আমার জীবন হয়ে গিয়েছে। সায়ন, কেমন আছ?

ভাল। সায়ন হাসল, কঙ্কাবতী, কোথাও যাচ্ছ?

কঙ্কাবতী ঘাড় নাড়ল, না।

 সিমি জিজ্ঞাসা করল, এ কে? আগে কখনও দেখিনি।

সায়ন নিচু গলায় বলল, ও নতুন এসেছে। খুব ভাল মেয়ে।

সিমি চোখ ঘোরাল, ভাল! তুমি কী করে বুঝলে ও ভাল মেয়ে?

বাঃ, কথা বললে বোঝা যায় না?

বাবা! এর মধ্যে ওর সঙ্গে এত কথা বলে ফেলেছ?

 তুমি ঠিক বলছ না!

 হয়তো। কোথায় বাড়ি ওর?

মিসেস অ্যান্টনিকে জিজ্ঞাসা করো, উনি সব জানেন।

ঠোঁট ওল্টাল সিমি, আমার বয়ে গিয়েছে।

সায়ন গলা তুলল, মিসেস অ্যান্টনি, আমরা মিস্টার ব্রাউনের বাড়িতে যাচ্ছি, আপনারা কি যাবেন?

মিসেস অ্যান্টনি হাসলেন, না বাবা। অনেক কাজ পড়ে আছে। কঙ্কাবতী এসে অবধি নীচে নামেনি বলে ওকে নিয়ে এখানে এসেছি। তুমি তাড়াতাড়ি ঘুরে এসো, যে কোনও মুহূর্তে বৃষ্টি শুরু হয়ে যেতে পারে।

সায়ন আকাশের দিকে তাকাল। মেঘগুলো এখন আরও নীচে নেমে এসেছে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ওদের শরীর। বাতাস আরও ঠাণ্ডা হয়ে গেল। সিমি পা বাড়াল। হাঁটতে হাঁটতে বলল, ওই মেয়েটা যেতে চাইলে আমি ফিরে যেতাম।

কেন?

আমার ভাল লাগত না।

তুমি সবাইকে বন্ধু হিসেবে ভাবতে পার না?

না। কেন ভাবব? কেউ কি আমার কথা ভাবে?

চড়াই ভাঙতে অসুবিধে না হলেও সাবধানে পা ফেলছিল সায়ন, ফলে সিমি এগিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল। দ্বিতীয় বারে সে জিজ্ঞাসা করল, তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে? তাহলে ফিরে যাই। চলো।

সায়ন মাথা নাড়ল, না, না। আমি ইচ্ছে করেই জোরে হাঁটছি না।

ওরা মিস্টার ব্রাউনের বাড়ির সামনে পৌঁছোতেই ভুটো তার বান্ধবীকে নিয়ে এগিয়ে এল। সিমি বলল, এই কুকুরটা মহা বদমাস। পাড়ার সবকটা মেয়েকুকুরের সঙ্গে ওর ভাব।

সায়ন বলল, সেটা কি খারাপ? তার মানে ভুটো ঝগড়াটে নয়।

 সিমি কথাটা গ্রাহ্য না করে ধমকাল, এই, ভাগ্। যা এখান থেকে।

এই সময় মিস্টার ব্রাউন বেরিয়ে এলেন, আরে! এসো এসো। যিশু তোমাদের মঙ্গল করুন। ওপরে উঠে আসতে কোনও অসুবিধে হয়নি তো সায়ন?

না মিস্টার ব্রাউন।

এসো ভেতরে এসো। এসো সিমি।

সিমি যে ভঙ্গিতে ভেতরে ঢুকল তাতে মনে হল বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তার নেই। ওরা চেয়ারে বসতেই টপটপ করে বৃষ্টি শুরু হল। মিস্টার ব্রাউন বললেন, যাঃ।

সিমি জিজ্ঞাসা করল, কী হল?

এলিজাবেথ বললেন একটু হেঁটে আসবেন। যদি মাঝপথে বৃষ্টি পান তাহলে ভদ্রমহিলা ভিজে যাবেন। নতুন লোক, বৃষ্টিতে ভেজা ঠিক নয়।

এত যখন চিন্তা তখন সঙ্গে ছাতি দিলেন না কেন?

আমার কি সব কথা মনে থাকে? ব্রাউন জানলায় গিয়ে দাঁড়ালেন। আকাশ কালো হয়ে গিয়েছে। বাতাস বন্ধ। বৃষ্টি পড়ছে অসাড়ে। নেমে যাচ্ছে খাদের মধ্যে ঝিম মেরে দাঁড়ানো গাছেদের মাথায়। এলিজাবেথের আজ অথবা কাল চলে যাওয়ার কথা। বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাধালে মুশকিল হবে।

সিমি বলল, দুশ্চিন্তা দেখে মনে হচ্ছে ছাতি নিয়ে আমিই ওঁকে খুঁজতে বের হই। আরে বাবা, কচি খুকি নয়, ঠিক কোনও ছাউনির তলায় দাঁড়িয়ে যাবে। আমরা বরং একটু কফি খাই। সিমি উঠে পড়ল।

সায়ন বলল, আমি কিন্তু খাব না।

সিমি একবার তাকাল তারপর কিচেনের দিকে এগিয়ে গেল। মিস্টার ব্রাউন কিছু না বলে বৃষ্টি দেখতে লাগলেন উদ্বিগ্ন মুখে। সায়ন কী করবে বুঝতে পারছিল না। ভদ্রমহিলা থাকলে কথা বলা যেত। কিছু প্রশ্ন তার মনে এসেছে। সে একটু এগিয়ে যিশুর ঘরের সামনে দাঁড়াল। মোমবাতি জ্বলছে যিশুর মূর্তির সামনে। অদ্ভুত সুন্দর পরিবেশ। সায়ন ভেতরে ঢুকল। যিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে তার মন ভাল হয়ে গেল। সে বাবু হয়ে বসল। মাত্র দু হাজার বছর আগে এই মানুষটা পৃথিবীতে ছিলেন। কিন্তু ঠিক এই মানুষটা কি? তখন তো ফটোগ্রাফি কল্পনার বাইরে ছিল। যিশুর মুখ কেউ এঁকে রেখেছিলেন বলে শোনা যায় না। একটা বইতে সে পড়েছে যিশু কেমন দেখতে ছিলেন সেটা নিয়ে বিতর্ক আছে। কেউ কেউ বলেছেন যিশুর কুঁজ ছিল, দেখতেও কদাকার ছিলেন। কিন্তু যিশুর এই চেহারা দেখলে মনে কী আরাম হয়। ভোরবেলায় যখন কাঞ্চনজঙ্ঘার ওপর সূর্যের প্রথম আলো পড়ে তখনকার ছবির সঙ্গে কোনও পার্থক্য থাকে না। অথচ এমন মানুষকে মানুষই খুন করেছিল। যিশু যদি অসুখে ভুগে মারা যেতেন তাহলে কি এতদিন এইভাবে বেঁচে থাকতেন? মানুষ জন্মায়, বড় হয় এবং শরীরের ক্ষয় অবশ্যম্ভাবী বলে মারা যায়। কারও কারও অসুস্থতা মৃত্যুর কারণ হয় অনেক আগেই। সেইসব মানুষকে কজন মনে রাখে? যিশু তো অনেক বড় মাপের মানুষ, সুভাষচন্দ্র, বিবেকানন্দকে বাঙালি কোনওদিন ভুলতে পারবে? তাঁরা এমন কিছু করেছিলেন যা সাধারণ মানুষ করেনি। সায়নের শরীরে কাঁপুনি এল। তার শরীরে অসুখ আছে। হয়তো সেই অসুখ নামক রাক্ষসটা এখন ঘাপটি মেরে বসে আছে সুযোগের অপেক্ষায়। তার আগে তাকে কিছু করতে হবে। এমন কিছু যা মানুষ মনে রাখবে অনেক দিন। নইলে তার সঙ্গে তিন হাজার বছর আগে যে মানুষটি শুধু মরে যাওয়ার জন্যে জন্মেছিল তার কোনও পার্থক্য থাকবে না।

দরজায় দাঁড়িয়েছিলেন ব্রাউন। তাঁর দিকে পেছন ফিরে যিশুর মূর্তির দিকে তাকিয়ে বসে আছে সায়ন। ওর মুখ তিনি দেখতে পাচ্ছেন না। কিন্তু বসার ভঙ্গিতে বোঝা যায় পৃথিবী ভুলে গেছে এই মুহূর্তে। ব্রাউন যিশুর মুখের দিকে তাকালেন। হাজার বার দেখা এই মুখটিতে যেন এই মুহূর্তে অপূর্ব আলো মাখামাখি। সিমি ডাকল তাঁকে, বাঃ, বৃষ্টি থেমে গিয়েছে। কফি রেডি।

বৃষ্টি থেমে গিয়েছে? ব্রাউন দ্রুত সরে এলেন জানলায়। কী কাণ্ড? একটু আগে আকাশ কালো হয়ে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল অনন্তকাল ধরে বৃষ্টি চলবে। এই কয়েক মিনিটের মধ্যে আকাশের চেহারা আচমকা পাল্টে গিয়েছে। মেঘগুলোকে কেউ যেন ছিঁড়ে ছিঁড়ে ছুঁড়ে ফেলছে পৃথিবীর অন্য প্রান্তে। অন্ধকার সরে গিয়ে সবুজ আলো ছড়িয়েছে আকাশে। কী দ্রুত ছুটে যাচ্ছে টুকরো মেঘেরা। তারপরেই আলো রং পাল্টাল। আকাশে নীল ফুটছে। এমনকী কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকটায় পাহাড়ের আদল দেখা যাচ্ছে। সাধারণত এরকম হয় না। এত বছর পাহাড়ে থেকে এ অভিজ্ঞতা কখনও হয়নি ব্রাউনের। তাঁর মনে যে ভাবনাটা এল সেটা বিশ্বাস করতে খুব ইচ্ছে করছিল তাঁর। তিনি জানেন কাউকে বিশ্বাস করাতে পারবেন না তিনি।

ব্রাউন আবার ফিরে গেলেন যিশুর ঘরের দরজায়। নিচু গলায় ডাকলেন, সায়ন! সায়ন, মাই বয়।

সায়ন তাকাল, কোনও কথা বলল না।

তুমি কি জানো, যিশুর সামনে বসে প্রেয়ার করছ বলে বৃষ্টি থেমে গেছে, মেঘ সরে যাচ্ছে, হয়তো রোদ উঠতে পারে!

না তো! সায়ন উঠে দাঁড়াল, তা ছাড়া আমি তো কোনও প্রেয়ার করিনি।

প্রেয়ার করোনি? ব্রাউন অবাক।

না তো!

তাহলে ওইভাবে বসেছিলে কেন?

আমি ভাবছিলাম।

ঠিক তখনই একটি গাড়ি সামনের রাস্তায় এসে থামল। ডাক্তার তামাং হইহই করতে করতে ভেতরে ঢুকলেন। ব্রাউনকে দেখে বললেন, কী হল, শরীর ঠিক আছে তো?

ব্রাউন বললেন, হ্যাঁ আছে।

ডাক্তার তামাং আড়চোখে সায়নকে দেখে এগিয়ে গেলেন, আরে সিমি যে! তুমি এখানে মানে নিশ্চয়ই মিস্টার ব্রাউনের জন্যে কিছু বানিয়ে এনেছ। আরে! এটা কী? কফি? ছি ছি ছি। মিস্টার ব্রাউন, আপনি এখন কফি খাচ্ছেন?

মিস্টার ব্রাউন থপথপ পায়ে এগিয়ে গেলেন, সাধারণত এই সময় আমি কফি খাই না, তবে ছোটদের অনুরোধ এড়ানো তো যায় না।

না না। ভাল কথা নয়। যার যা অভ্যেস তার তাই করা উচিত। চটপট শুরু করা যাক। আমাকে আবার এখনই সোনাদায় ছুটতে হবে। তোমরা বরং কফি খেয়ে নাও। ডাক্তার তামাং বসে পড়লেন চেয়ারে।

গত রাতে দিয়ে যাওয়া মাংস ফ্রিজ থেকে বের করে খানিকটা প্লেটে ঢেলে দিল সিমি। ওঁরা যখন মদের গ্লাস নিয়ে বসেছেন তখন সিমি কফির কাপ হাতে নিয়ে সায়নকে জিজ্ঞাসা করল, তুমি সত্যি কফি খাবে না?

সায়ন মাথা নাড়ল, না। কফিটা খেয়ে নাও, আমি ফিরব।

কফির কাপে চুমুক দিয়ে সিমি বলল, বাঃ, আকাশটা কীরকম বদলে গেল। আমার আর দার্জিলিং যেতে ইচ্ছে করছে না।

বাঃ। খুব ভাল।

তুমি খুশি?

হুঁ।

তোমার কথা আমি রাখলাম। আচ্ছা, তোমার বয়স কত?

 কেন?

 আমি কি তোমার চেয়ে বয়সে একটু বড় হব? দুর, বয়স জেনে কী হবে? কেউ একজন তো বড় হবেই। সায়ন, তুমি খুব ভাল। তোমার অসুখ সারিয়ে দেওয়ার জন্যে যদি আমার সব রক্ত দিলে কাজ হত তাহলে আমি দিয়ে দিতাম। সিমি চোখ বন্ধ করল।

ওরা কথা বলছিল ভেতরের জানলার পাশে দাঁড়িয়ে। সায়ন অবাক হয়ে মেয়েটার দিকে তাকাল। সিমিকে তার ভালমন্দয় মেশানো মেয়ে বলে মনে হত। মন্দ কারণ ও কাউকে সহ্য করতে পারে না। একটু আগে কঙ্কাবতীকে পর্যন্ত নয়। কিন্তু এখন যে কথাগুলো বলল তাতে ওর সম্পর্কে ভাবনা বদলে গেল সায়নের। সে সিমির হাত ধরে বলল, তুমি যে এই কথাগুলো বললে তাতেই আমি খুশি।

সিমি চোখ খুলল, কেন বললাম জানো?

সায়ন মাথা নাড়ল, না।

বুঝতে চেষ্টা করো, ঠিক পারবে।

.

ঘরের ওপাশে মাংস খেতে খেতে ডাক্তার তামাং বললেন, শেষ পর্যন্ত একটি লোক্যাল পেশেন্টকে নিরাময়ে ভর্তি করা গেছে। না করলে গোলমাল হত।

ব্রাউন কথাটা পছন্দ করলেন কিন্তু কিছু বললেন না। পেটে মদ পড়া সত্ত্বেও তাঁর মন সায়নকে নিয়েই ছিল। ডাক্তার তামাং বললেন, ওই ছেলেটিকে আপনি খুব পছন্দ করেন, তাই না? কী নাম যেন?

সায়ন।

হ্যাঁ। ওকে নিয়েই তো কী সব গুজব রটেছিল। রাবিশ। গ্লাসে চুমুক দিয়ে পানীয় শেষ করে আবার ঢাললেন ডাক্তার তামাং, সোনাদায় যেতে হচ্ছে কারণ চেয়ারম্যান আজ ওখানে আসছেন।

আপনি তাহলে রাজনীতিতে যোগ দিচ্ছেন।

না মিস্টার ব্রাউন। এটাকে রাজনীতি বলবেন না। রাজনীতি মানে এখন নোংরামি। ভারতের যত বুড়োহাবড়া মানুষ সেটা করে। দেখলেন না এক একটা ইলেকশন হচ্ছে আর তারপর গদির জন্যে কী খেয়োখেয়ি করছে। আজ বলছে বি জে পি সাম্প্রদায়িক দল কাল বলছে বি জে পি বন্ধু। যে দলের দশটা এম পি আছে তারা মন্ত্রিত্ব পাইয়ে দেবার জন্যে দর হাঁকছে। কিন্তু আমরা এখানে যেটা করছি সেটা পাহাড়ি মানুষের ভালর জন্যে। গতবার এখানে ইলেকশন বয়কট করা হয়েছিল। সামান্য কিছু লোকের ভোটকে এখানকার মানুষের রায় বলে চালানো হয়েছে। এবার সেই সামান্য ভোটও যাতে না পড়ে তার ব্যবস্থা করতে হবে। ঘরের জন্যে চিন্তা করা রাজনীতি করা নয়। ডাক্তার তামাং চুমুক দিতেই এলিজাবেথের গলা শোনা গেল বাইরে। মিস্টার ব্রাউন উঠে দাঁড়াবার আগেই এলিজাবেথ ভেতরে ঢুকলেন।

ব্রাউন বললেন, আপনি ভিজে যাননি তো? আমি খুব চিন্তায় ছিলাম।

এলিজাবেথ বললেন, একটু ভিজেছি। কিন্তু আমার সব কিছু গোলমাল হয়ে গিয়েছে মিস্টার ব্রাউন। আমি একটা সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছি।

কী সিদ্ধান্ত? ব্রাউন ঠিক বুঝতে পারছিলেন না।

আমি এখানে কিছুদিন থেকে যাব। কারণ আমার থাকা উচিত।

এলিজাবেথ দৃঢ় গলায় বললেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *