মিসেস অ্যান্টনি কাজে যোগ দেবার পর ডাক্তার যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। এতদিন সব ছিল, শুধু লক্ষ্মীশ্রীর অভাব ছিল। কোন পেশেন্ট কী খাবে, কাকে কখন নিয়ম করে ওষুধ খাওয়াতে হবে এসবের দায়িত্ব ভদ্রমহিলা চটপট নিয়ে নিলেন। ডাক্তার লক্ষ করেছেন, মিসেস অ্যান্টনি সময় পেলেই সায়নের ঘরে চলে যান, তার সঙ্গে গল্প করেন। এবং তখন তাঁর চোখমুখের অভিব্যক্তিতে মুগ্ধতা পরিষ্কার হয়ে ওঠে। ডাক্তার এর কারণ বুঝতে পারেন না। ঠিক একই ভাবে মিস্টার ব্রাউনের আচরণ তার কাছে রহস্যময় বলে মনে হয়। ভদ্রলোক প্রতিদিন সকাল বিকেলে বেড়াতে বেড়াতে নিরাময়ে আসেন। এসেই সায়নের কথা জিজ্ঞাসা করেন। ওকে দেখার জন্যে যে উদগ্রীব হয়ে থাকেন তা বুঝতে অসুবিধে হয় না। এই ছেলেটির জন্যে ওই দুজন প্রবীণ মানুষ এত কৌতূহলী কেন তা জিজ্ঞাসা করতে অস্বস্তি হয়েছে ডাক্তারের। অম্লানকে ওর বাবা মা কলকাতায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর থেকেই তিনি কিছুটা বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলেন। অসুখের কাছে নয়, মানুষের বিশ্বাসের কাছে হেরে যাওয়ার বেদনা বড় মারাত্মক। এইসময় মিসেস অ্যান্টনি এসে পাশে না দাঁড়ালে তিনি ঠিক কী করতেন তা নিজেই জানেন না। যে জেদ তাকে এখানে এসে নিরাময় খুলতে সাহায্য করেছিল তার শেকড় একটু একটু করে আলগা হচ্ছে। মাঝে মাঝেই মনে হয় বহন করার ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি ভার তিনি কাঁধে নিয়েছেন।
আজ সকালে ডক্টর তামাং এলেন। শহরের মাঝখানে বাজারের ওপর ওঁর চেম্বারে খুব ভিড় হয়। সবসময় হাসেন ভদ্রলোক। ঘুমোনোর সময় ছাড়া কখনই উনি অ্যালকোহল ছাড়া থাকেন না। কিন্তু অ্যালকোহলের প্রতিক্রিয়া তার আচরণে আজ পর্যন্ত কেউ দেখতে পায়নি। শেষ পর্যন্ত লোকে সিদ্ধান্তে এসেছে, মদ্যপানের কারণে ডক্টর তামাং-এর মুখে হাসি লেগে থাকে। অফিসঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ডক্টর তামাং বললেন, গুড মর্নিং ডক্টর।
আরে। কী খবর? আসুন, আসুন। কাগজপত্র পাশে সরিয়ে দিলেন ডাক্তার।
আমি বলি কী, ঘরে না বসে আমরা একটু বাইরে গিয়ে দাঁড়াই। অনেক দিন পরে ঝকঝকে রোদ উঠেছে। ডাক্তার তামাং হাত বাড়ালেন।
গেটের বাইরে পোঁছে ডাক্তার দেখলেন আকাশ আজ কী নীল! সূর্যদেব নতুন বরের মতো সেটা দখল করে বসে আছেন। কোথাও সামান্য মেঘ নেই। মৃদু বাতাস বইছে। আশেপাশের পাহাড়গুলোকে ঝকঝকে দেখাচ্ছে। দূরের কাঞ্চনজঙ্ঘার চেহারা এখন সাদাটে, বুড়ো বুড়ো।
তামাং বললেন, চমৎকার সকাল।
কাছাকাছি দাঁড়াতেই ওঁর নিঃশ্বাসে মদের গন্ধ পেলেন ডাক্তার।
তামাং বললেন, আপনার নিরাময় কেমন চলছে?
ডাক্তার বললেন, নতুন কোনও খবর নেই।
তামাং হাসলেন, আপনি যা করছেন তার তুলনা নেই। কিন্তু আপনার একার পক্ষে বেশি পেশেন্টকে দেখাশোনা করা সম্ভব নয়। মনে হয় বেশ কিছু বেড খালি রয়েছে, তাই না?
ডাক্তার মাথা নাড়লেন, হ্যাঁ।
আপনি যদি আপত্তি না করেন তাহলে আমার কিছু পেশেন্টকে আপনার এখানে রাখতে পারি। এখানকার হাসপাতালের ওপর যাদের ভরসা নেই তাদের শিলিগুড়িতে যেতে হয়। সেখানেও তারা সমস্যায় পড়ে। আপনার সবকিছু তৈরি আছে, এখানে থাকলে ওদের খুব উপকার হবে। তামাং বললেন।
ডাক্তার জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার পেশেন্টরা যদি রক্তের অসুখে আক্রান্ত হন তাহলে তারা স্বচ্ছন্দে এখানে আসতে পারেন।
তামাং বললেন, আমি তা জানি। তেমন একজনকে আজ আপনার কাছে নিয়ে আসতে বলেছি। কিন্তু আমি এর বাইরের পেশেন্টদের কথা বলছি। এই যে বেড খালি আছে অথচ জায়গার অভাবে ওদের এখানে চিকিৎসা করা যাচ্ছে না এই খবর বেশ কিছু মানুষকে অসন্তুষ্ট করছে। আমি সেটা এড়াবার জন্যে আপনার কাছে প্রস্তাবটা করেছি। আমি কথা দিচ্ছি আমার পেশেন্টদের নিয়ে আপনাকে কোনও ঝামেলায় পড়তে হবে না। ওদের সমস্ত দায়িত্ব আমার।
নিরাময়ে বেড খালি যাচ্ছে এই খবর কী করে পেলেন?
প্রয়োজন মানুষকে কৌতূহলী করে, এটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু ডাক্তার তামাং আমি একটা আদর্শ নিয়ে নিরাময় শুরু করেছিলাম, সেই আদর্শ থেকে সরে আসার কোনও কারণ এখনও দেখছি না।
তামাং মাথা নাড়লেন, ঠিক আছে। আপনি যখন চাইছেন না তখন এ নিয়ে আর কথা বলতে চাই না। ও হ্যাঁ, যে মেয়েটিকে পাঠাচ্ছি সে অ্যানিমিয়ায় ভুগছে। অনেক টনিক খাওয়ানো হয়েছে কোনও কাজ হয়নি। মেয়েটি খুব বুদ্ধিমতী। ওকে একটু দেখবেন। ওর বাবা মায়ের আর্থিক অবস্থা ভাল নয়।
ঠিক আছে, ওকে আসতে বলবেন।
ডক্টর তামাং এবার নমস্কার করলেন, তাহলে আমি চলি। মিস্টার ব্রাউনের বাড়ি থেকে ঘুরে আসি।
ডাক্তার নমস্কার ফিরিয়ে দিয়ে ওর যাওয়া দেখলেন। তামাং-এর কথা তাকে বেশ অস্বস্তিতে ফেলে দিল। মাঝে মাঝেই তার ওপর চাপ আসে। উঠতি কিছু রাজনীতি করা ছেলে নিরাময়কে নিয়ে নেপালি বাঙালি সংঘাত তৈরি করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ওদের ওপর তলার নেতারা শক্ত হতে ব্যাপারটা নিয়ে আর এগোয়নি। তামাং নিজের স্বার্থে আর একটা ইস্যু তৈরি করতে চাইছেন নাকি?
.
আজ সকালে শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছিল। জ্বর নেই, গায়ে হাতে ব্যথা, ব্রাউন বসেছিলেন নিজের চেয়ারে। ভুটো বসেছিল তাঁর চেয়ার ঘেঁষে। মাঝে মাঝে কুকুরের মাথায় হাত বোলাচ্ছিলেন তিনি। শরীর খারাপ লাগলেই তার মন বিশ্রী হয়ে যায়। তখন এই বাড়িতে থাকতে একটুও ইচ্ছে হয় না। এই সময় বাইরের গেট খোলার আওয়াজ হতেই ভুটো উঠে দাঁড়িয়ে চাপা গলায় একবার ডাকল। ব্রাউন জানেন পরিচিত মানুষ এলে ভুটো ওইরকম শব্দ করে। তখনই ডক্টর তামাং-এর গলা পাওয়া গেল, গুড মর্নিং মিস্টার ব্রাউন, ভেতরে আসতে পারি।
গুড মর্নিং। আসুন আসুন। যিশু আপনার মঙ্গল করবেন। ব্রাউন সোজা হয়ে বসতেই তামাং দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন।
আপনার যিশু বা বুদ্ধ, অথবা ভগবানের প্রতি আমার আস্থা খুব কম। কোটি কোটি মানুষের সমস্যা সামলানোর মতো কম্প্যুটার তাঁদের হাতে নেই। আমার মঙ্গল এখন আপনিই করতে পারেন। তামাং চেয়ার টেনে বসলেন।
এধরনের কথাবার্তা আজকাল পছন্দ হয় না ব্রাউনের। কিন্তু তার মনে হল ডক্টর তামাংকে যিশুই তার কাছে আজ পাঠিয়ে দিয়েছেন। এ অঞ্চলে তামাং যখন আসেন তখন একবার দেখা করে যান। কিন্তু এই সকালে যখন তার শরীরটা ঠিক নেই তখন ডক্টর তামাংকে পাওয়ার ব্যাপারটাকে কাকতালীয় বলে ভাবতে পারছেন না তিনি।
ব্রাউন বললেন, দেখুন তো, আমার শরীরটা ঠিক নেই কেন?
ঠিক নেই? কী অসুবিধে হচ্ছে?
জ্বর-জ্বর ভাব কিন্তু জ্বর নেই। গায়ে হাত পায়ে বেশ ব্যথা।
ঠাণ্ডা লাগিয়েছেন?
ইচ্ছে করে তো কিছু করিনি।
ডক্টর তামাং উঠলেন। ব্রাউনের হাত ধরে পালস গুনলেন। কপালে এবং গলার নীচে আঙুল ছোঁয়ালেন। তারপর পকেট থেকে স্টেথো বের করে বুক পিঠ পরীক্ষা করলেন চুপচাপ। স্টেথো পকেটে ঢুকিয়ে নিজের চেয়ারে ফিরে যেতে ব্রাউন তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কী মনে হচ্ছে?
ডক্টর তামাং তার বিখ্যাত হাসিটি ঠোঁটে জড়িয়ে নিলেন, কাল রাত্রে কী খেয়েছেন?
কাল রাত্রে? ও হ্যাঁ, সন্ধের সময় যিশুর সামনে যেমন বসি তেমন বসেছিলাম। হঠাৎ মনে হল, এই পৃথিবীতে তিনি এক সময় ছিলেন। পৃথিবীর মাটির ওপর হেঁটে বেড়াতেন অথচ এখন নেই। নেই তবু আছেন। প্রায় দুহাজার বছর আগে যিনি চলে গিয়েছেন শরীর ছেড়ে তিনি আমার সামনে বসে আছেন। সঙ্গে সঙ্গে কিরকম একটা অনুভূতি হল। মনে হল, আজ রাত্রে যদি আমি মরে যাই পৃথিবীর কটা মানুষের কাছে আমি কদিন বেঁচে থাকব? মন খারাপ হয়ে গেল। এই যে মাদার টেরিজা চলে গেলেন, তাকেও তো অনেক অনেকদিন পৃথিবীর কিছু মানুষ মনে রাখবেন। বিষণ্ন গলায় বললেন ব্রাউন।
একটুও ম্লান না হয়ে ডক্টর তামাং বললেন, হিটলারকে মানুষ মনে রাখবে, চেঙ্গিস খান, তৈমুরলঙদের কেউ ভুলবে না। অর্থাৎ কেউ যাতে মনে রাখে সেইজন্যে আপনাকে এক্সট্রিমে যেতে হবে। হ্যাঁ, তারপর আপনি যিশুর ঘর থেকে বেরিয়ে কী করলেন?
শুয়ে পড়লাম। ঘুম এল অনেক দেরিতে।
তার মানে বহুবছর পর আপনি গতরাত্রে পান করেননি। ডিনারও নয়?
হ্যাঁ।
আপনাকে বলেছিলাম, আপনিই আমার মঙ্গল করতে পারেন। তা আপনি উঠবেন না আমি গ্লাসবোতল আনব?
সে কী? এই সাতসকালে?
আপনার ওষুধ এটাই, আমারও। তার জন্যে সময়ের বিচার করার কোনও মানে হয় না। আজ ঘুম থেকে উঠে কিছু খেয়েছেন?
হ্যাঁ, এক কাপ চা। ব্রাউন উঠলেন। প্রথমে ফ্রিজ খুলে মাংসের সসপ্যান বের করে গ্যাস জ্বেলে গরম করে বড় ডিশে ঢাললেন। তারপর মদ এবং গ্লাস নিয়ে গুছিয়ে বসলেন টেবিলে। তিন চারবার চুমুক দিয়ে একটুকরো মাংস মুখে পুরে ব্রাউনের মনে হল তার শরীরের অস্বস্তি অনেকটা কমেছে। ওঁর মুখের ভাব লক্ষ করে ডক্টর তামাং জিজ্ঞাসা করলেন, বেটার?
একটু।
ডক্টর তামাং বললেন, মিস্টার ব্রাউন, শরীর যাতে অভ্যস্ত তাই করা উচিত। আপনি যিশুর উপাসক, উপাসনা করুন, কিন্তু তাই বলে নিজের শরীরটাকে কষ্ট দেবেন কেন? আপনার মন এবং শরীর এক্ষেত্রে আলাদা অস্তিত্ব। মন যা চাইছে না শরীর তা চাইতে পারে।
ব্রাউন হাসলেন, ডক্টর, আপনি মদ খেতে ভালবাসেন। যিশু এখনও আপনার লিভার সুস্থ রেখেছেন। কিন্তু আপনার অন্য পেশেন্টরা কী বলে?
দে হ্যাভ অ্যাকসেন্টেড দিস। কেউ বলতে পারবে না মাতাল হয়ে আমি কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি অথবা চিকিৎসা ঠিকমতো করিনি।
কিন্তু এমন কোনও পেশেন্ট যদি আসে যে মদ খেয়ে লিভার নষ্ট করে ফেলেছে, আর কিছুদিন খেলে বাঁচানো যাবে না তাকে কী বলবেন?
ওয়েল, তাকে জিজ্ঞাসা করব সে কী করবে? মদ খাবে না আরও কিছুদিন বাঁচতে চাইবে? সে যদি দুটোই চায় তাহলে বলব চিংড়িমাছ খেলে যাদের প্রচণ্ড অ্যালার্জি হয় তাদের ওটা না খাওয়া উচিত। দ্বিতীয় গ্লাস শেষ করে ঘড়ি দেখলেন ডক্টর তামাং, এবার উঠতে হবে।
আপনার গাড়ির শব্দ শুনলাম না।
ওটা নিরাময়ের সামনে রেখে এসেছি।
ডাক্তারের সঙ্গে দেখা হল?
হ্যাঁ। ভদ্রলোককে আমি প্রস্তাব দিলাম কিন্তু উনি মানতে চাইলেন না।
কী প্রস্তাব?
ওঁর ওখানে বেশি পেশেন্ট নেই। বেড খালি পড়ে থাকে। আমি আমার কিছু পেশেন্টকে ওখানে রাখতে চেয়েছিলাম। তাদের ট্রিটমেন্টের সব দায়িত্ব আমার। ওঁকে বেড চার্জ দেওয়া হবে। কিন্তু উনি অন্যধরনের পেশেন্ট রাখবেন না। এখন দিনকাল বদলে গেছে। এই ধরনের জেদ স্থানীয় মানুষকে উত্তপ্ত করতে পারে। একবার কেউ যদি নেপালি বাঙালি প্রসঙ্গটা এ ব্যাপারে টেনে আনে তাহলে সামলানো মুশকিল হবে। মিস্টার ব্রাউন, আপনি তো ওঁর ঘনিষ্ঠ, একটু ওঁকে বুঝিয়ে বলুন রাজি হয়ে যেতে। ডক্টর তামাং উঠে দাঁড়ালেন।
ব্রাউন মাথা নাড়লেন, আমি এই কাজটা করতে পারব না।
ডক্টর তামাং অবাক হলেন, কেন?
প্রত্যেক মানুষের স্বাধীনতা আছে সে কী করবে তা ঠিক করার। উনি যে কাজটা করছেন তা কজন ডাক্তার করে থাকেন? ভদ্রলোক যে ব্যবসা করে টাকা রোজগার করতে নিরাময় খোলেননি তা সবাই জানে। ওঁর আদর্শকে শ্রদ্ধা করা উচিত বলেই আমি এমন প্রস্তাব ওঁকে দিতে পারব না। ব্রাউন বললেন।
কিন্তু এটা জানলে সাধারণ মানুষ খেপে যাবে। ডক্টর তামাং বললেন, আমি পাবলিকের সঙ্গে দিনরাত কাজ করি। তাদের মনের ব্যাপারটা ভাল বুঝি।
ব্রাউন উঠে দাঁড়ালেন। ধীরে ধীরে ডক্টর তামাং-এর পাশে হেঁটে বাইরে বের হলেন। বাইরের পৃথিবী এখনও ঝকঝকে। তবে হাওয়া বইছে স্কোয়াশ ফলগুলো দুলছে। পাহাড়ের দিকে তাকলেন ব্রাউন। তারপর বললেন, আর কতদিন এভাবে চলবে ডক্টর?
ডক্টর তামাং না বুঝতে পেরে জিজ্ঞাসা করলেন, মানে?
এই সস্তা সেন্টিমেন্টে সুড়সুড়ি দিয়ে মানুষকে উত্তেজিত করার কথা বলছি।
কী আশ্চর্য। আপনি এই ইস্যুটাকে সস্তা সেন্টিমেন্ট বলছেন?
অবশ্যই।
পাহাড়ের নিঃস্ব মানুষগুলোকে সমতলের মানুষরা বছরের পর বছর এক্সপ্লয়েট করেনি? এখানে এসে এদের বুকের ওপর চেপে বসে থাকেনি?
এসব কথা আন্দোলনের আগে আমরা বলতাম। এসব কথা শুনলে যে কোনও পাহাড়ির রক্ত গরম হত। সেই কারণে আন্দোলন শুরু হয়েছিল। মনে করে দেখুন পুলিশের সঙ্গে তখন লড়াই করে কত তাজা প্রাণ নষ্ট হয়েছে। আমরা সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে পি ডব্লু ডি আর ফরেস্টের বাংলোগুলো জ্বালিয়ে দিয়েছি। লাগাতার ধর্মঘট করেছি এখানে। আবার সেই একই সময়ে সমতলে নেমে ওদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করেছি। শিলিগুড়ি বা কলকাতায় আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে চাইনি। তা যা হোক, সেই আন্দোলনের ফলশ্রুতি হিসেবে আমাদের চেয়ারম্যান সাহেব যে ক্ষমতা পেলেন তা এদেশের কোনও মিউনিসিপ্যাল চেয়ারম্যান স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী যেভাবে চলেন আমাদের চেয়ারম্যান সেইরকম ভাবসাব দেখান। এসব তো হয়ে গেল অনেক বছর। আপনার ভাষায় যারা এককালে আমাদের বুকের ওপর চেপে বসেছিল তারা এখন হয় কেঁচোর মতো রয়েছে নয় ছেড়েছুড়ে চলে গিয়েছে। কোটি কোটি টাকার কথা শুনি। কিন্তু কী উপকার হয়েছে সাধারণ মানুষের? তাদের জীবনযাপনের কতটুকু পরিবর্তন হল। একটাও নতুন রাস্তা, নতুন ব্যবসা, জল এবং আলোর আধুনিক ব্যবস্থা, এনি থিং? মাথা নাড়লেন ব্রাউন, কিছুদিন আগে শুধু ক্ষমতা ব্যবহারের হাতের পরিবর্তন হয়েছে। অথচ আপনারা এখনও সেন্টিমেন্টে সুড়সুড়ি দিচ্ছেন।
ডক্টর তামাং বললেন, আপনি কী বলতে চান, আমরা এখন অনেক বেশি স্বাধীনভাবে ভাবতে শিখিনি। নিজেদের ওপর আস্থা ফিরে পাইনি?
পেয়েছেন। সাধারণ মানুষ জেনেছে উদ্ধত হয়ে সমতলের মানুষের সঙ্গে ব্যবহার করলে কেউ তাকে বাধা দেবে না। আমি স্বীকার করছি এটাই স্বাভাবিক। কমুনিস্ট পার্টিগুলোর অবস্থা দেখুন। যখনই তাদের কর্মীরা অসহিষ্ণু হয়ে পড়ে তখনই নেতারা উত্তেজিত করেন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিয়ে। কর্মীরা ভুলে যায় তাদের নেতারা ছুটি কাটাতে লন্ডন নিউইয়র্ক যাচ্ছেন প্রতিবছর, মার্কিনদের অনুরোধ করে এদেশে এসে ব্যবসা করতে। তারা অবোধর মতো গোবধে মাতে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নিপাত বলে গলা ফাটিয়ে। ঠিক এই ঘটনা এখানেও ঘটছে।
আপনি কী বলতে চাইছেন?
খুব সহজ কথা। যারা ভাল কাজ করতে চাইছে, এখানে এসে মানুষের উপকার চাইছে তারা পাহাড় না সমতলের মানুষ সেটা দেখার দরকার নেই।
নিরাময় এখানকার কটা মানুষের উপকার করেছে? যারা উপকৃত হচ্ছে তারা এসেছে সমতল থেকে। আমি যাদের চিকিৎসা করি তাদের অনেকের পাঁচ টাকা ফি দেবার ক্ষমতা নেই। তাদের কেউ প্রয়োজনে ওখানে ভর্তি হতে পারবে না। ঠিক আছে, আজ আর কথা নয়, পরে না হয় বলা যাবে। ডক্টর তামাং নেমে গেলেন।
ভাল লাগছিল না ব্রাউনের। আবার এরা একটা ভুল করতে চলেছে। কিন্তু তার কিছু করার ক্ষমতা নেই। হ্যাঁ, এটা ঠিক, এই পাহাড় পাহাড়িদের। ব্রিটিশরা এসে নিজেরা আরামে থাকবে বলে এখানে রাস্তা ঘরবাড়ি করেছিল। সেই আসাটা খুব সহজ হয়নি তখন। তখন এই পাহাড়ি এলাকা ছিল সিকিমের রাজার রাজত্ব। রাজা নামগলের আমলে ব্রিটিশরা সন্ধান পায় এই পাহাড় এবং তার সৌন্দর্যের। সেটা আঠারোশো ছাবিবশ খ্রিস্টাব্দ। ইংরেজ সেনাবাহিনী এল দখল নিতে। সিকিমের রাজার সৈন্যদের সঙ্গে তাদের লড়াই হল। সেসময় এইসব এলাকার অধিবাসী ছিল লেপচারা। গল্প আছে, সেই যুদ্ধে প্রচুর ইংরেজ সৈন্য মারা গেলেও মাত্র একজন লেপচা সৈনিক নিহত হয়। তার নাম ডুনো ব্যাপগে। ওই লড়াই-এর জন্যে ডুনো লেপচাদের নায়ক হয়ে গিয়েছে। শুকনো গাছের খোলের মধ্যে লুকিয়ে থেকে বিষাক্ত তীর ছুঁড়ে বন্দুকধারী সেপাইদের মেরে গেছে সে একের পর এক। ডুনোর বীরত্বে লেপচারা উদ্বুদ্ধ হল। ইংরেজ সৈন্যদের তাড়িয়ে তারা নীচে নিয়ে গেল আদুপ দোলের নেতৃত্বে। হেরে গিয়েছিল লেপচারা আধুনিক অস্ত্রের কাছে। তারপর হারল নিজেদের নানান কুসংস্কারের জন্যে। আস্তে আস্তে তাদের সংখ্যা যত কমতে লাগল নেপাল থেকে আসা পাহাড়িদের সংখ্যা তত বেড়ে গেল। ইতিহাস বলে দার্জিলিং-এর পাহাড়ে নেপালিদের অবস্থান দেড়শো বছরের সামান্য বেশি। ইংরেজরা পা রেখেছিল প্রায় একই সঙ্গে। তাই মাঝে মাঝে ধন্দ লাগে। সমতলে যেমন হাজার বছর আগে বাঙালি ছিল না তেমনি এই পাহাড়ে দুশো বছর আগে তার পূর্বপুরুষরা ছিলেন না। কিন্তু এতগুলো বছর একই জায়গায় বংশ পরম্পরায় বাস করলে জায়গাটা নিজের হয়ে যায়। কিন্তু একথা ভুলে গেলে চলবে কেন একশো বছর আগে এসে বাস করছেন এমন বাঙালির অস্তিত্ব পাহাড়ে আছে। তারা কী করে পাহাড়িদের শত্রু হয়ে যাবে?
.
সকালের ডাকে খারাপ খবরটা এল। বিদেশ থেকে এক্সপার্টদের যে টিমের আসার কথা ছিল তারা এখনই আসতে পারবেন না। এই না পারা মানে অনেকখানি পিছিয়ে যেতে হবে তাকে। আর্থিক সমস্যার সমাধানের সম্ভাবনা যেমন ছিল তেমনি আধুনিকতম চিকিৎসাপদ্ধতির সঙ্গে সড়গড় হতে পারতেন তিনি। যা বইয়ে পড়েছেন তা হাতেকলমে করলে অনেকটা এগিয়ে যাওয়া যায়।
অফিসে বসেছিলেন ডাক্তার। এইসময় সায়ন এল।
কেমন আছ তুমি। ডাক্তার হাসলেন।
ভাল না।
সেকী? কী হয়েছে?
এইভাবে শুয়ে বসে থাকতে ভাল লাগছে না। আচ্ছা, আমি কি কোনও কাজ কখনও করতে পারব না? সায়ন স্পষ্ট জিজ্ঞাসা করল।
নিশ্চয়ই পারবে।
কবে থেকে?
একটু স্টেডি হয়ে নাও।
আপনি আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। আমি জানি আমার দ্বারা কিছু হবে না!
স্টপ ইট। চিৎকার করে উঠলেন ডাক্তার আচমকা।
সায়ন চমকে তাকাল। ডাক্তার আঙ্কলের মুখ লাল হয়ে উঠেছে।
আর কখনও ওই কথা উচ্চারণ করবে না। বুঝেছ? বলেছি তুমি আর কোনও কাজ করতে পারবে না। ম্যাজিক জনসনের নাম শুনেছ? ভদ্রলোকের এডস হয়েছিল। তা সত্ত্বেও তিনি বাস্কেটবল খেলে গেছেন। আর সেই খেলা আন্তর্জাতিক মানের। একজন ক্যানসার পেশেন্ট মোটর রেসিং-এ যোগ দিচ্ছেন। দুটো পা নেই এমন একজন কিছুদিন আগে ইংলিশ চ্যানেল সাঁতরে পার হয়েছেন। এদের তুলনায় তুমি তো অনেক ভাল, হাত পাওয়ালা স্বাভাবিক মানুষ। শুধু মাঝে মাঝে তোমার রক্ত একটু অসুবিধে সৃষ্টি করে। কিন্তু তাই বলে তুমি অক্ষম নও। ডক্টর আঙ্কলের গলার স্বর শেষদিকে ধরে এসেছিল।
ঠিক সেইসময় বড়বাহাদুর এসে জানাল কয়েকজন দেখা করতে এসেছে। ডাক্তার মাথা নেড়ে নিয়ে আসতে বললেন। সায়ন উঠে দাঁড়াল। ডাক্তার বললেন, তুমি উঠছ কেন? বোসো। তোমার মা বাবার এখানে আসার কথা ছিল না?
সায়ন মাথা নাড়ল, হ্যাঁ, লিখেছিল তো!
এইসময় দরজায় তিনজন এসে দাঁড়াল। একজন প্রৌঢ়া, দ্বিতীয়জন যুবক, দেখলেই বোঝা যায় একটু উদ্ধত স্বভাবের, তৃতীয়জন কৈশোর পার হওয়া তরুণী, যার স্বাস্থ্য মোটেই ভাল না। ডাক্তার বললেন, বসুন।
ওরা বসলে ডাক্তার মেয়েটিকে দেখলেন এক পলক। খুব শান্ত ভঙ্গিতে বসে আছে সে। ডাক্তার আবার বললেন, বলুন, কী সমস্যা?
প্রৌঢ়া বললেন, আমার মেয়ে। খুব অসুখে ভোগে। ডাক্তার তামাং এতদিন ওকে দেখছিলেন। উনি বললেন আপনার কাছে নিয়ে আসতে।
ডাক্তার মেয়েটির দিকে তাকালেন, কী নাম তোমার?
মেয়েটি চোখ তুলল, কঙ্কাবতী।
বাঃ। চমৎকার নাম। সায়ন, তুমি বুদ্ধদেব বসুর কবিতা পড়েছ?
সায়ন প্রশ্নটা শুনেই মাথা নেড়ে না বলল।
পড়ে দেখো। তার একটি বিখ্যাত কবিতা আছে যার নায়িকা কঙ্কাবতী। সেখানে তিনি বারংবার বলেছেন, কঙ্কা শঙ্কা কোরো না। কঙ্কাবতী, তুমি শঙ্কা শব্দটার মানে জানো?
মাথাটা সামান্য দুলল, মেয়েটি বলল, ভয়।
বাঃ। দাও, ডক্টর তামাং-এর প্রেসক্রিপশনটা দেখি।
প্রৌঢ়া সেটা এগিয়ে দিলেন। পড়তে পড়তে কপালে ভাঁজ পড়ল ডাক্তারের। তারপর বললেন, ব্লাড রিপোর্ট সঙ্গে আছে?
প্রৌঢ়া এবার সেগুলো দিলেন।
ভাল করে দেখে নিয়ে ডাক্তার বললেন, ডক্টর তামাং যা অনুমান করছেন তা যদি সত্যি হয় তাহলে তোমাকে এখানে কিছুদিন থাকতে হবে।
প্রৌঢ়া বললেন, কিন্তু এখানে থাকতে হলে শুনেছি অনেক টাকা দিতে হয়।
যুবক বলল, ওসব নিয়ে মাথা ঘামিও না। পার্টি ঠিক করবে ওটা।
ডাক্তার যুবককে দেখলেন, তুমি এদের কেউ হও?
যুবক বলল, কেন? কেউ না হলে আমি আসতে পারি না?
ডাক্তার বললেন, আমার প্রশ্নের উত্তর দিলে না।
প্রৌঢ়া বললেন, ও আমার পাশের বাড়িতে থাকে। দেখুন, আমি খুব গরিব। ওর বাবা নেই। মেয়েটা পড়াশুনায় খুব ভাল। অভাবের সঙ্গে লড়াই করেও পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়। এ ছাড়া আমার কেউ নেই।
যুবক বলল, ঠিক আছে ঠিক আছে চাচি, এসব কথা ওকে বলার কোনও দরকার নেই। আমি পার্টি অফিসে কথা বলেছি, যা খরচ হবে উনি বিল করে দিলে পার্টি বুঝে নেবে। তবে হ্যাঁ, দেখভাল যেন ঠিকঠাক হয়।
কঙ্কাবতী উঠে দাঁড়াল, মা, চলো।
প্রৌঢ়া অবাক হলেন, চল মানে?
এইভাবে আমার চিকিৎসা করাতে আমি চাই না।
প্রৌঢ়া একটু রাগত গলায় বললেন, তাহলে তুই এলি কেন? আমার যে সামর্থ্য নেই তা তুই জানিস না। ও পার্টির সঙ্গে কথা বলেছে বলে আমি বুকে বল পেয়েছি। তোর বাবা গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনে পুলিশের গুলি বুকে নিয়ে মারা গিয়েছে। পার্টি তার মেয়ের জন্যে এটুকু তো করবেই। এতে আপত্তি কেন?
মেয়েটি জবাব না দিয়ে অন্যদিকে মুখ ফেরাল। যুবক বলল, চাচি, তোমার এই মেয়ের মাথায় গোলমাল আছে। আমি সঙ্গে এসেছি এটাই ও পছন্দ করছে না।
ডাক্তার আবার মেয়েটিকে দেখলেন, আমি আর একবার ওর ব্লাড পরীক্ষা করতে চাই।
যুবক বলল, আরে! আপনার সামনে তো রিপোর্ট আছে, ফালতু ঝামেলা করবেন কেন?
ডাক্তার বললেন, আমার মনে হয় ওকে এখানে না নিয়ে এসে পার্টি অফিসে নিয়ে গেলে ভাল করতেন। এই ছেলেটি ওর চিকিৎসা করতে পারত সেখানে। কথাগুলো বলেই তিনি গলার স্বর বদলালেন, যদি ওর ভাল চাও তো তাহলে চুপ করে বসে থাকো না পারলে বেরিয়ে যাও এখান থেকে।
ছেলেটা একটু ঘাবড়ে গেল। প্রৌঢ়া তাকে ইশারা করলেন চুপ করতে। ডাক্তার বললেন, কঙ্কাবতী, তুমি আমার সঙ্গে একটু এসো মা।
মা শব্দটা কানে যেতে কঙ্কাবতী মুখ ফেরাল। তারপর বিনা প্রতিবাদে সে ডাক্তারকে অনুসরণ করল। সায়ন চুপচাপ বসেছিল। যুবক প্রৌঢ়াকে বলল, একটু উল্টোপাল্টা করলে এই বাড়ি জ্বালিয়ে দেব চাচি। শালা, পাহাড়ে এসে বড়লোক বাঙালিদের কাছ থেকে টাকা ঝাড়ছে আর নেপালিদের পাত্তা দিচ্ছে না।
আপনার নাম কী ভাই?
প্রশ্নটা শুনে যুবক ফিরে তাকাতেই মিসেস অ্যান্টনিকে দেখতে পেল। সায়ন দেখল মিসেস অ্যান্টনির মুখ লাল হয়ে উঠেছে।
যুবক বলল, গণেশ।
আপনার কাছে কোনও প্রমাণ আছে উনি বড়লোক বাঙালিদের কাছে প্রচুর টাকা পাচ্ছেন? জবাব দিন। মিসেস অ্যান্টনি ডাক্তারের টেবিলের পাশে এসে দাঁড়ালেন।
লোকে বলে।
তাদের নিয়ে আসতে পারবেন? যুবক কাঁধ নাচাল। মুখে কিছু বলল না।
এখানে বসে বললেন এই বাড়ি জ্বালিয়ে দেবেন। হ্যাঁ আপনারা এখন তা করতেই পারেন। কিন্তু এই বাড়ি জ্বললে আমিও পুড়ে মরব। সেটা সামলাতে পারবেন?
আপনি নেপালি হয়ে একথা বলছেন? যুবক চাপা গলায় বলল।
আমি মানুষ বলে বলছি। আপনি অমানুষ তাই ওইসব ভাবছেন। গণেশ, আপনার কথা আমি দার্জিলিং-এ জানাব। আপনি কেন এসেছেন এখানে?
এবার প্রৌঢ়া বলল, রাগ কোরো না দিদি। আমার মেয়ের অসুখ, ডাক্তার তামাং এখানে আসতে বলেছিলেন। আমরা খুব গরিব। এখানকার খরচের কথা ভেবে ও একটু মাথা গরম করে ফেলেছে। ভুলে যাও এসব কথা।
মিসেস অ্যান্টনি বললেন, লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে। সায়ন, তুমি কিছু মনে কোরো না। পৃথিবীর সর্বত্র এরকম কিছু উজবুক থাকে।
এইসময় কঙ্কাবতী ফিরে এল। তাকে খুব ক্লান্ত লাগছিল। এক হাতে অন্য হাতের কনুই-এর সামনের দিকটা চেপে ধরেছিল। প্রৌঢ়া জিজ্ঞাসা করলেন, কী হল?
রক্ত নিলেন উনি।
যুবক বলল, আমি বাইরে আছি। বলে সশব্দে চেয়ার সরিয়ে বেরিয়ে গেল।
কঙ্কাবতী বলল, মা, তোমাকে নিষেধ করেছিলাম ওকে সঙ্গে আনতে।
মিসেস অ্যান্টনি বলে উঠলেন, আমি তোমাকে চিনতে পেরেছি। তুমি গতবছর চেয়ারম্যানের হাত থেকে বেস্ট পোয়েট অফ দি ইয়ার প্রাইজটা নিয়েছিলে, না? কবিতা প্রতিযোগিতায় তুমিই তো ফার্স্ট হয়েছিলে?
মেয়েটি কিছু বলার আগেই তার মা বললেন, হ্যাঁ, ঠিক।
তোমার নাম তো কঙ্কাবতী?
হ্যাঁ। ছোট্ট করে বলল মেয়েটি।
মিসেস অ্যান্টনি একটু আগের তিক্ততা ভুলে গিয়ে উচ্ছ্বসিত হলেন, ও সায়ন, এর সঙ্গে আলাপ করো। খুব ভাল কবিতা লিখেছিল ও। প্রাইজ নিতে গিয়ে কবিতাটা আবৃত্তি করেছিল। কী যেন লাইনটা, ও, হ্যাঁ, এত কালো মেঘ কেন এতটুকু নীল পেল না।
সায়ন হাতজোড় করল, নমস্কার।
কঙ্কাবতী যেন এতক্ষণে তার অস্তিত্ব অনুভব করল। করে বলল, নমস্কার।
মিসেস অ্যান্টনি বললেন, সায়ন হল, সায়ন হল–, হঠাৎ থেমে গিয়ে কিছু খুঁজে না পেয়ে বললেন, ওর সঙ্গে কথা বললে আমার মন ভাল হয়ে যায়। তারপর খেয়াল হতে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার কী হয়েছে কঙ্কাবতী?
আমি ঠিক জানিনা। শরীর খারাপ লাগে। খুব দুর্বল।
প্রৌঢ়া বললেন, ডাক্তার তামাং বলেছেন ওর রক্ত কমে গেছে।
মিসেস অ্যান্টনির মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। সেটা সামলে তিনি বললেন, তুমি যাঁর কাছে এসেছ তিনি সব ঠিক করে দেবেন। কোনও ভয় নেই।
এইসময় ডাক্তার ফিরে এলেন তাঁর ল্যাবরেটরি থেকে। চেয়ারে বসে বললেন, তেমন ভয়ের কিছু নেই। কিন্তু আপনার মেয়েকে এখানে কিছুদিন থাকতে হবে। যদি আজই ভর্তি হয়ে যায় তাহলে ভাল হয়।
প্রৌঢ়া কাঁপা গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, ওর কী হয়েছে?
প্রত্যেক মানুষের রক্তে লাল এবং সাদা কণিকা থাকে। সুস্থ মানুষের শরীরে লাল কণিকা সাধারণত তেরো বা চৌদ্দ কাউন্টিং-এ পাওয়া যায়। যখন সেটা আটের নীচে নেমে যায় তখন আমরা চিন্তিত হই। দশের নীচে নামলে অ্যানিমিক বলা হয়। রোগীর চেহারা তখনই ফ্যাকাশে হয়ে যায়। আপনার মেয়ের রক্তকণিকা ছয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। বিলো নর্মাল। বুঝতে পেরেছেন?
তাহলে?
তাহলে আবার কী? চিকিৎসা করলে ওটা নর্মাল হয়ে যাবে। কিন্তু যদি আরও নেমে যায় তাহলে বিপদ। রক্তের জমাট বাঁধার ক্ষমতা তখন কমে যায়। আপনার কোনও চিন্তা নেই। এই যে সায়ন, ও যখন এখানে এসেছিল তখন ওর হেমোয়গ্লাবিন ছিল চারে। কিন্তু এখানে থেকে ওটা প্রায় আটে পৌঁছে গেছে। আপনাকে আবার বলছি কোনও চিন্তা নেই। আমি আছি, মিসেস অ্যান্টনি আছেন, ওর যত্নের কোনও ত্রুটি হবে না।
প্রৌঢ়া বললেন, কিন্তু ডাক্তার, আমি এত টাকা কী করে দেব?
ডাক্তার বললেন, কত টাকা?
আমি শুনেছি অনেক টাকা দিতে হয়।
হ্যাঁ। কারণ ওষুধের দাম খুব বেশি। এক একটা ইনজেকশন প্রায় হাজার টাকা পড়ে। প্রয়োজন পড়লে সেটা দিতে হয়।
তাহলে?
ডাক্তার মিসেস অ্যান্টনিকে বললেন, ওর নামধাম লিখে নিন। ওর মাকে দিয়ে সই করিয়ে নেবেন। চলো সায়ন আমরা কঙ্কাবতীকে নিরাময়টা ঘুরে দেখাই ততক্ষণ। ডাক্তার উঠলেন।
প্রৌঢ়া আবার বললেন, কিন্তু
শুনুন। রক্ত নেওয়ার সময় ওকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম রবীন্দ্রনাথ আর কবি ভানুভক্তের মধ্যে কে বড় কবি? ও জবাব দিয়েছে, তুলনা হয়না। আমার বাবা আর ভগবানের মধ্যে কে বড় তা যেমন তুলনা করা যায় না। এই উত্তর যে মেয়ে দিতে পারে সে আমার মেয়ে না হয়ে পারে না। নিজের মেয়ের কাছে টাকাপয়সা নেবার কথা কেউ ভাবতে পারে?
ডাক্তার কথা বলা মাত্র বড়বাহাদুর এসে বলল, কলকাতা থেকে কয়েকজন সায়নদাদার কাছে এসেছে।
.
১৪.
গেটের সামনে দাঁড়িয়েছিল ওরা। অফিসঘর থেকে বেরিয়ে আসা সায়নকে দেখতে পেয়ে তিনজনের মুখেই হাসি ফুটল। দূরত্বটুকু জোরে হেঁটে এসে প্রথমে নন্দিনীকে জড়িয়ে ধরল সায়ন। নন্দিনীর চোখ বন্ধ হয়ে গেল। ছেলের শরীরটাকে দুহাতে আঁকড়ে ধরে রইলেন কিছুক্ষণ। ঊর্মিলা আর কমলেন্দু হাসিমুখে দৃশ্যটি দেখছিল। সায়ন ফিসফিস করে বলল, শেষ পর্যন্ত তুমি এলে।
নন্দিনী জবাব দিচ্ছিলেন না। হঠাৎ তার শরীর টলতে আরম্ভ করল। একমাত্র ছেলের মঙ্গলের জন্যে যেদিন এখানে রেখে গিয়েছিলেন সেদিন অনেক কষ্টে নিজেকে শক্ত রাখতে পেরেছিলেন। কিন্তু এতদিন দূরে থাকতে থাকতে তার মনে হত মা হিসেবে কোনও কর্তব্যই তিনি করতে পারছেন না। স্বামী নিয়মিত টাকা পাঠাচ্ছে, ছেলের মোটামুটি ভাল থাকার খবর আসছে, ব্যস এটুকুতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। স্বামী তাকে বুঝিয়েছেন, যে-অসুখ ওর হয়েছে তাতে এতদিন যে বেঁচে আছে তাই ঈশ্বরের অনুগ্রহ। এইসব শুনতে শুনতে একসময় মনে হয়েছিল, কত মহিলার তো সন্তান হয় না, সায়ন চলে গেলে তিনি ভেবে নেবেন তারও সন্তান হয়নি। দূরত্ব মানুষকে অনেক কিছু ভুলিয়ে দিতে সাহায্য করে। সায়নের অভাব একটু একটু করে মেনে নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এখন ওর শরীরের উত্তাপ এবং গন্ধ তাঁকে একটানে অনেক বছর পিছিয়ে নিয়ে গেল। ছোট্ট সায়নের শরীর যখন তার শরীরের সঙ্গে লেপ্টে থাকত সেইসব সুখের দিনের অনুভূতি সমস্ত আকাশজুড়ে ফিরে আসায় নিজেকে সামলাতে পারলেন না তিনি। সশব্দে কেঁদে উঠলেন আচমকা।
মাকে কাঁদতে দেখে একটু শক্ত হয়ে গেল সায়ন। ধীরে ধীরে মুখ তুলে দেখল কান্নার দমকে মায়ের মুখ ভেঙে চুরে যাচ্ছে। সে দু হাতে মুখ ধরল, মা। মাগো।
ঊর্মিলা এসে দাঁড়িয়েছিল পেছনে। নন্দিনীর পিঠে হাত রেখে বলল, একী? কী হল? তুমি কাঁদছ কেন?
নন্দিনী নিজেকে শেষ পর্যন্ত সামলালেন।
এই সময় পেছন থেকে ডাক্তারের গলা ভেসে এল, আপনারা বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবেন কেন? সায়ন, ওঁদের নিয়ে গেস্টরুমে যাও।
সায়ন ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, আমার মা। আর এঁরা হলেন–।
কমলেন্দু কথা শেষ করতে না দিয়ে বলল, আমি সম্পর্কে সায়নের দাদা, ইনি আমার স্ত্রী। কাকিমা সায়নকে দেখতে আসছিলেন, আমরা সঙ্গে এলাম।
খুব ভাল হয়েছে। অফিসে একটু কাজ আছে। আপনারা গেস্টরুমে বসে কথা বলুন, আমি একটু বাদে আসছি। ডাক্তার ফিরে গেলেন।
গেস্টরুমের চেয়ারে ওরা বসতেই ঊর্মিলা দৌড়ে জানলার কাছে গেল, দ্যাখো দ্যাখো কাকিমা, এভারেস্ট দেখা যাচ্ছে। কী সুন্দর।
কমলেন্দু বলল, দুটো ভুল হল।
মানে? ঊর্মিলা ছেলেমানুষের মতো ঘাড় বেঁকাল।
প্রথমত, ওটা কাঞ্চনজঙ্ঘা, এভারেস্ট নয়।
ও। ঊর্মিলা মেনে নিয়ে আবার জানালার বাইরে তাকাল। নন্দিনী জিজ্ঞাসা করলেন, দ্বিতীয় ভুলটা কী?
কাঞ্চনজঙ্ঘাকে সুন্দর বলা ভুল। বলা উচিত ভয়ঙ্কর সুন্দর। বলে হাসল কমলেন্দু, সুন্দর কখন ভয়ঙ্কর হয় সায়নবাবু?
সায়ন বলল, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বই। তুমি পড়তে দিয়েছিলে আমাকে। সুন্দরবনের রয়ালবেঙ্গল টাইগার, দারুণ সুন্দর দেখতে তেমনি ভয়ঙ্করও।
কমলেন্দু বলল, পৃথিবীতে কোনও কোনও মহিলা আছেন যাঁদের ভয়ঙ্কর সুন্দর বলা যায়। তা সেসব কথা তোকে বলা যাবে না।
ঊর্মিলা রাগত চোখে স্বামীকে দেখল। তারপর সায়নকে জিজ্ঞাসা করল, তোর শরীর এখন কেমন আছে রে?
ভাল। মায়ের গা ঘেঁষে বসল সায়ন, আমার খুব ভাল লাগছে মা।
নন্দিনী, ছেলের হাত ধরলেন, তুই খুব রোগা হয়ে গিয়েছিস।
যাঃ। আমার ওজন বেড়েছে।
ঊর্মিলা কাছে এসে বলল, এরকম দারুণ জায়গায় থাকলে শরীর ভাল হয়ে যায়। কী সুন্দর দৃশ্য।
তোমরা কখন এসেছ?
কমলেন্দু জবাব দিল, হোটেলে ব্যাগ রেখে সোজা এখানে।
বাবা ভাল আছে?
নন্দিনী বললেন, হ্যাঁরে। তার খুব ইচ্ছে ছিল আসার। কাজের চাপে আসতে পারল না। স্টেশনে এসেছিল পৌঁছে দিতে।
ঊর্মিলা বলল, হেনার জন্যে ভাবনা হচ্ছে।
সায়ন অবাক হল, কেন?
নন্দিনী বললেন, হেনার আসার কথা ছিল আমাদের সঙ্গে। টিকিটও কাটা হয়ে গিয়েছিল। ওর বর তো এখন কুলুমানালিতে তাই আসতে চেয়েছিল। কথা ছিল, সোজা স্টেশনে চলে আসবে। কিন্তু ট্রেন ছাড়ার আগে এসে পৌঁছোয়নি।
কেন?
জানি না রে।
ঊর্মিলা বলল, শাশুড়ি নিশ্চয়ই আটকে দিয়েছে।
কমলেন্দু বলল, আবার বলছি, কল্পনা করে সিদ্ধান্তে আসা ঠিক হবে না।
তা ছাড়া আর কী কারণ থাকতে পারে? ঊর্মিলা রেগে বলল।
শরীর খারাপ হতে পারে। আমি কল্পনা করতে রাজি নই।
হেনার কথা ভেবে মন খারাপ হয়ে গেল সায়নের। হেনার সঙ্গ তার খুব ভাল লাগত। এমন সময় ছোটবাহাদুর দরজায় এসে দাঁড়াল, দো আদমি আয়া।
আমার কাছে? সায়ন অবাক হল।
জি। আইয়ে। বলে বাইরে তাকাল ছোটবাহাদুর।
ঘরে ঢুকল সদানন্দ আর বাদল। ঢুকেই চেঁচিয়ে উঠল, আরে? এখানে? কবে এলে তোমরা?
নন্দিনী হাসলেন, আজই। তুমি?
আর বোলো না। খুব ঝামেলায় পড়ে গিয়েছিলাম। এখানে আসতে দেরি হয়ে গেল। কেমন আছিস তুই? লম্বা হয়ে গিয়েছিল বলে মনে হচ্ছে? এগিয়ে গিয়ে সায়নের কাঁধে হাত রাখল সদানন্দ।
সায়নের খুব ভাল লাগছিল। হেনার জন্যে খারাপ হওয়া মনটা চট করে পাল্টে গেল। মন কিছুক্ষণ ধরে খারাপ হয়ে থাকলে তার শরীর খারাপ হয়ে যায়। সদানন্দকে দেখে সে অনুভব করল, বেঁচে গেল। বলল, ভাল আছি। তুমি কেমন আছ সদুদা।
ফার্স্টক্লাস। বাদলকে মনে আছে তো?
বাঃ! মনে থাকবে না? সায়নের মনে হল এর আগে অন্য নাম শুনেছিল।
বাদল চোখ প্রায় বুজিয়ে হাসল। তারপর পকেট থেকে একটা বড় চকোলেট বের করে বলল, মিষ্টিমুখ করো।
নন্দিনী চটপট জিজ্ঞাসা করলেন, তোর চকোলেট খাওয়া বারণ নয় তো?
পেছন থেকে ডাক্তারবাবু বলে উঠলেন, কোনও বারণ নেই। চকোলেট আইসক্রিম যদি এই বয়সে না খেতে পারা যায় তা হলে– যাক গে, আজ হঠাৎ সায়নবাবুর প্রচুর গেস্ট একসঙ্গে এসে গেছেন দেখছি।
কমলেন্দু বলল, যা বলেছেন। কলকাতায় আমরা সবাই এক বাড়িতে থাকি।
আপনারা কোথায় উঠেছেন?
কমলেন্দু বলল, ট্যুরিস্ট লজে।
বাদল বলল, আমরা স্টেশনের পাশে যে-হোটেলে উঠেছি তার নাম লিটল হাট। সবকিছুই সেখানে লিটল লিল।
তার মানে? কমলেন্দু জানতে চাইল।
খাটগুলো ছোট। ঘরও। টয়লেটে পাশ ফিরে ঢুকতে হয়। চায়ে চিনি কম দিয়েছিল। দিনের বেলায় আলো জ্বালতে হয় এবং সেটা টিমটিম করে। জলও লিটল লিটল পাওয়া যায়। নামকরণ সার্থক।
কমলেন্দু বলল, চার্জও নিশ্চয়ই লিটল লিটল?
পার হেড দুশো টাকা। রুম প্লাস চা। লিটলই বলতে হবে।
ডাক্তার বললেন, আমার খুব খারাপ লাগছে। অনেক কিছু মাথায় ছিল। আপনারা যাঁরা আসবেন তাদের জন্যে থাকার ব্যবস্থা করব ভেবেছিলাম। একা পেরে উঠছি না এখনও পর্যন্ত। সায়ন, একটু চায়ের কথা বলবে?
সায়ন মাথা নেড়ে বেরিয়ে যেতেই ডাক্তার বললেন, আপনার ছেলে এখানে খুব পপুলার। ওকে বাইরে পাঠালাম যদি ওর সম্পর্কে আপনাদের কিছু জিজ্ঞাস্য থাকে তার সুযোগ দেওয়ার জন্যে।
নন্দিনী জিজ্ঞাসা করলেন, ও কেমন আছে।
অনেক ভাল। ইমপ্রুভিং।
আপনি আমাদের ভরসা দিচ্ছেন?
সরি। যখন ওকে এনেছিলেন তখনও বলেছিলাম, আমি তো ভগবান নই। তবে গত এক মাসে মাত্র একবারই ওকে রক্ত দিতে হয়েছিল। এইটে আশার কথা।
নলিনী শঙ্কিত মুখে জিজ্ঞাসা করলেন, আমাদের জানাননি তো।
এটা ওর পক্ষে খুব সাধারণ ঘটনা। কারও সামান্য জ্বর হলে কি সেটা জানানোর মতো খবর হয়? ডাক্তার হাসলেন।
ও কবে ভাল হয়ে যাবে ডাক্তারবাবু?
ডাক্তার একমুহূর্ত স্থির চোখে তাকালেন। তারপর বললেন, এই উত্তর একমাত্র ঈশ্বরই দিতে পারেন। তবে আমরা চেষ্টা করছি যাতে ও রোজ ভাল থাকে।
এই সময় সায়ন ফিরে এল। সবাই তার দিকে এমনভাবে তাকাল যে তার অস্বস্তি হল। সায়ন হেসে জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে?
ডাক্তার বললেন, তোমাকে নিয়ে কথা হচ্ছিল।
আমাকে নিয়ে?
বাঃ, ওঁরা তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন, তোমাকে নিয়ে কথা হবে না?
সায়ন নন্দিনীর দিকে তাকাল, আমি ওনাকে বলেছি মাঝে মাঝে খুব একঘেয়ে লাগে, সময় কাটতে চায় না। এ ভাবে পড়াশুনাও হয় না। তাই আমাকে কোনও একটা কাজের দায়িত্ব দিতে।
তুই আবার কী কাজ করবি? নন্দিনী প্রতিবাদের গলায় বললেন।
না-না। এভাবে বলবেন না। কখনও সখনও ছাড়া সায়নবাবু বেশ ফিট। আমি ওকে ইনজেকশন দেওয়া শেখাব।
ইনজেকশন? নন্দিনী অবাক।
হ্যাঁ। আগে শিখুক তারপর জানাব ও কী করবে।
নন্দিনী বললেন, একটা কথা জিজ্ঞাসা করছি। ওকে কিছুদিনের জন্যে কলকাতায় নিয়ে যেতে পারি?
স্বচ্ছন্দে। ডিসেম্বর জানুয়ারিতে এখানে খুব শীত পড়ে। তখন ও ঘুরে আসতে পারে। প্রয়োজন হলে কী কী করতে হবে আমি লিখে দেব।
কমলেন্দু বলল, ব্যস, আপনার চিন্তা দূর হল কাকিমা। আচ্ছা, ডাক্তারবাবু, আপনি এখানে নিশ্চয়ই অনেকদিন আছেন, কোনও প্রবলেম হয় না?
বুঝতে পারলাম না।
শুনেছি, মানে কাগজে পড়েছি, বাঙালিদের এরা পছন্দ করে না।
ডাক্তার উঠে দাঁড়ালেন, মানুষ মানুষকে কি কখনও অপছন্দ করে? আপনার মনে এই ধারণা যারা তৈরি করে দিয়েছে তারা নিশ্চয়ই কয়েকটা কথা বলেনি। মানুষকে মানুষের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয় স্বার্থপর কিছু নেতা। অথবা মানুষ যখন মানুষকে ভয় পায় তখন অপছন্দ করতে শুরু করে। দেশবিভাগের সময় যখন পূর্ববঙ্গ থেকে জলের মতো শরণার্থীরা আসতে শুরু করলো, চারধারে সমস্যা বাড়ল, তখন এদিককার বাংলার মানুষ ওঁদের অপছন্দ করলেন। ধর্মের দোহাই দিয়ে এদেশে মানুষকে মানুষের বিরুদ্ধে খুনোখুনিতে নামানো তো পুরনো ঘটনা। এ নিয়ে ভাববেন না।
কমলেন্দু মাথা নিচু করল।
নন্দিনী বললেন, আমরা তো কয়েকদিন এখানে থাকব। সায়নকে নিয়ে যেতে পারি?
ডাক্তার একমুহূর্ত ভাবলেন, আপনি এক রাতের জন্যে ওকে নিয়ে যেতে পারেন।
ডাক্তার চলে গেলে সদানন্দ ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট আর শিশি বের করে সায়নকে দিল, নাও। তোমার জন্যে।
সায়ন শিশিতে নারকেলনাড়ু দেখে খুব খুশি। প্যাকেটটা খুলতেই সোয়েটার দেখতে পেল সে। নতুন সোয়েটার। ঊর্মিলা বলে উঠল, আরে, এই সোয়েটার তো তুমি বুনছিলে কাকিমা?
সদানন্দ বলল, ঠিকই। এটা পোস্টাল ডিপার্টমেন্টের কেস হয়ে গিয়েছে। উনি আমাকে দিয়েছিলেন সায়নকে পৌঁছে দিতে। আমার আগেই উনি পৌঁছে গেছেন।
বাদল বলল, সায়নবাবু, শিশিটা কিন্তু আমি খুলিনি।
সদানন্দ বলল, দ্যাখ মদনা, তুই চাইলেই কি আমি খুলতে দিতাম?
নন্দিনী হাসছিলেন এতক্ষণ। এবার জিজ্ঞাসা করলেন, কিছু মনে কোরো না, তোমার আসল নাম কী বলো তো?
আমার তিনটে নাম। তিনটেই আসল।
কী রকম?
মায়ের কাছ থেকে বাদল পেয়েছি, বাবার কাছ থেকে মদন। বাবা রেগে গেলে ওটাকে ভেঙেচুরে চেঁচাতেন, ঠাকুমা রাখলেন, খুব জমজমাট নাম, ব্ৰজগোপাল। ওটা স্কুলের খাতায়। ওই নামে কেউ চিনতে পারবে না আমাকে। চিঠিটা দে। বাদল বলল।
সদানন্দর মনে পড়তেই হিপ পকেট থেকে চিঠি বের করে দিল। সায়ন সেটা খুলে পড়তেই তার মুখে হাসি ফুটল। ঊর্মিলা বলল, কার চিঠি?
পড়তে পড়তে সায়ন জবাব দিল, টুপুরের। দাঁড়াও।
চিঠি পড়া শেষ করে সায়ন জিজ্ঞাসা করল, টুপুর তোমার কাছে আসে মা? ও এসব কিছু লেখেনি।
কী লিখেছে?
কী সব কথা। পড়ব?
সদানন্দ হাসল, তোর আপত্তি না থাকলে আমরা শুনতে পারি?
তুমি চিঠিটা পড়োনি?
উঁহু। অন্যের চিঠি ভদ্রলোক পড়ে না।
থ্যাঙ্ক ইউ। পড়ছি। “সানুদাদা। তোমার চিঠি যখন পেয়েছি তখন আমি বন্ধ ঘরে ছিলাম। সেখানে জানলা দিয়ে আলো আসত, লাইটও জ্বলত কিন্তু চিঠি লেখার হুকুম ছিল না। শুনলাম সদুদা তোমার কাছে যাচ্ছে তাই এই চিঠি লিখছি।
তুমি এখন কেমন আছ? খুব দেখতে ইচ্ছে করে তোমাকে। তুমি চিঠিতে যা যা লিখেছ তার সবই আমি করব। কিন্তু সানুদা, আমার আগে কত হাজার হাজার মেয়ে কত কত পড়াশুনা করেছে, কত বড় হয়েছে তবু মেয়েদের এত শাস্তি পেতে হয় কেন? তাহলে পড়াশুনা করে আমিও তো তাদের মত হব।
বড়দের আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না। তুমি পারো? প্রণাম নিও–টুপুর।“
চিঠি পড়া শেষ করে সায়ন দেখল মায়ের মুখ গম্ভীর হয়ে গেছে, অন্যরাও একই রকম। সে জিজ্ঞাসা করল, কী ব্যাপার মা? টুপুর বন্ধ ঘরে ছিল কেন?
ঊর্মিলা জবাব দিল, বোধহয় দুষ্টুমি করেছিল।
বাদল বলল, সেকী! বাচ্চা মেয়ে দুষ্টুমি করতেই পারে। তাই বলে ঘরে বন্দী করে রাখতে হবে?
নন্দিনী বললেন, থাক ওকথা। এখন তো সব ঠিক হয়ে গিয়েছে। তুই ওকে উৎসাহ দিয়ে একটা চিঠি লিখে দিস।
এইসময় চা এল। চায়ের গন্ধ এবং স্বাদে সবাই চমৎকৃত। কলকাতায় এত ভাল চা সবসময় পাওয়া যায় না।
সায়ন।
সরু গলায় নিজের নাম শুনে পেছন ফিরে সায়ন দেখল মিসেস অ্যান্টনি দাঁড়িয়ে আছেন দরজায়। তাঁকে খুব সঙ্কুচিত দেখাচ্ছে।
সে এগিয়ে গেল, বলুন।
তোমার মা?
হ্যাঁ। সায়ন মায়ের দিকে তাকাল, মা, ইনি মিসেস অ্যান্টনি। আমাদের দেখাশোনা করেন। আমাকে খুব ভালবাসেন।
নন্দিনী কিছু বলার আগেই মিসেস অ্যান্টনি এগিয়ে এলেন সামনে, আপনাকে দেখার সৌভাগ্য হল বলে আমার খুব গর্ব হচ্ছে।
একজন নেপালি প্রৌঢ়ার মুখে সুন্দর বাংলা উচ্চারণ শুনে যতটা নয় তার চেয়ে বলার ভঙ্গিতে নন্দিনী খুব লজ্জায় পড়লেন, সৌভাগ্য বলছেন কেন? আপনাদের কাছে আমার ছেলেকে রেখেছি।
না না। কথা শেষ করতে দিলেন না মিসেস অ্যান্টনি, আমি এখানে খুব অল্পদিন হল এসেছি। কেন এসেছি জানেন? ভদ্রমহিলার চোখমুখ উজ্জ্বল হল।
নন্দিনী কৌতূহল নিয়ে তাকালেন। অন্য সবাই কথাগুলো উপভোগ করছিল।
এই ছেলেটির জন্যে। ওর সামনে বলা ঠিক হচ্ছে না অবশ্য। থাক, আপনারা কদিন তো এখানে আছেন?
কমলেন্দু বলল, হ্যাঁ।
মিসেস অ্যান্টনি বললেন, সায়ন, ডক্টর বললেন আজ তুমি মায়ের সঙ্গে হোটেলে গিয়ে থাকবে। চলো, তোমার জিনিসপত্র গুছিয়ে দিই।
না না। আমিই করে নিতে পারব। আচ্ছা, ওরা চলে গিয়েছে? সায়ন জিজ্ঞাসা করল।
কারা? ও মেয়েটি। হ্যাঁ। ওর মা বিকেলবেলায় ওকে নিয়ে আসবে। মিসেস অ্যান্টনি সবাইকে নমস্কার করে বিদায় নিলেন।
কমলেন্দু দূরত্ব বুঝতে না পেরে একটা মারুতি ভ্যান ভাড়া করে মহিলাদের নিয়ে এসেছিল। আসার পর মনে হয়েছিল টাকাটা ফালতু খরচ হল। এইটুকু পথ, হেঁটেই আসা যেত। কিন্তু ফেরার সময় সে খুশি হল। সায়নকে নিয়ে ওইটুকু পথও বোধহয় হেঁটে যাওয়া ঠিক হত না। আর ভ্যান বলে ছয়জন লোক দিব্যি এঁটে গেছে। টুরিস্ট লজের সামনে গাড়ি ছেড়ে দিতেই বাদল বলল, আঃ, গ্র্যান্ড। কী দারুণ দৃশ্য। হিন্দি সিনেমার মতন।
ট্যুরিস্ট লজটি পাহাড়ি রাস্তার গা ঘেঁষে। ওপাশে আদিগন্ত শুন্যতা। মাঝে মাঝেই সেই শুন্যে মেঘেরা নেমে আসছে। এদের একটি লোক হেসে বলল, কাল এক ফিল্মকা স্যুটিং হুয়া। আমির খান ইহা খাড়া থা।
খবরটা কাউকে তেমন অবাক করল না।
সদানন্দ বলল, তাহলে আমরা এবার যাই।
এখনই যাবে কী? এসো।
কমলেন্দু বলল, চলো, রেস্টুরেন্টে বসা যাক।
ঊর্মিলা বলল, এইমাত্র তো চা খেলাম।
শীতের রাজ্যে এলে ঘন ঘন চা খাওয়া যায়। চলো।
রেস্টুরেন্টটা চমৎকার। খাদের দিকটায় বড় বড় কাচের জানলা। চেয়ারে বসেও অনেকটা পাহাড় দেখা যায়। মেয়েরা চা খেলেন না। সায়নও নয়।
অনেকদিন পরে নিরাময় থেকে বেরিয়ে নিজের আত্মীয়দের সঙ্গে বসে গল্প করতে খুব ভাল লাগছিল সায়নের। একঘেয়েমিটা এখন উধাও। সে মায়ের হাত ধরল পাশের চেয়ারে বসে। নন্দিনী সেটা লক্ষ করেও উদাসীন ভাব দেখিয়ে বললেন, দ্যাখ, দ্যাখ, মেঘগুলো যেন খরগোশের মতো দৌড়োচ্ছে।
সায়ন বলল, আমি রোজ দেখি। কখনও কখনও হাতি হয়ে যায় ওরা।
কমলেন্দু জিজ্ঞাসা করল, তোমাদের প্রোগ্রাম কী?
সদানন্দ বল, কাল একটা গাড়ি ডেলিভারি পাব। নাইনটি সিক্সের ওমনি। একজন ডাক্তারের। ভদ্রলোক মারা গিয়েছেন। ভদ্রমহিলা বাঙালি ছাড়া অন্য কাউকে বিক্রি করবেন না। অথচ এখানে তো মারুতি ওমনির খুব ডিম্যান্ড। ট্যাক্সিগুলোর বেশির ভাগই তাই। নেপালিরা ওঁকে বিক্রির জন্যে চাপ দিলেও উনি রাজি হননি। আমরা গিয়ে কথা বলতে উনি রাজি হয়েছেন।
কত দাম পড়ল?
কলকাতার থেকে সন্তা। আর জিজ্ঞাসা করবেন না। কারণ কত দামে কিনছি বললেই জানতে চাইবেন কী দামে বিক্রি করব। ব্যবসার সিক্রেট কাউকে বলা উচিত নয়। কপট গাম্ভীর্য চোখে মুখে আনল সদানন্দ।
মা, তোমরা দার্জিলিং যাবে না?
যাব বাবা।
আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে?
তুই হাঁটতে পারবি?
পারব।
কিন্তু ডাক্তারবাবু বলেছেন এক রাতের বেশি বাইরে থাকা যাবে না।
হ্যাঁ! আমরা কাল সকালে দার্জিলিং গিয়ে বিকেলে ফিরে আসব। সন্ধ্যার আগে নিরাময়ে গেলে তো ওর কথা অমান্য করা হবে না।
সদানন্দ বলল, ঠিক। সানুকে দার্জিলিং ঘুরিয়ে নিয়ে আসুন।
কমলেন্দু জিজ্ঞাসা করল, গাড়ি কী করে কলকাতায় পাঠাবে?
বাদল বলল, আমরাই চালিয়ে নিয়ে যাব। নো প্রব্লেম।
ঊর্মিলা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, এতটা পথ?
ব্যাপারটা যেন কিছুই নয় এমন ভঙ্গি করে হাসল বাদল। চা খাওয়া হয়ে গেলে সায়নকে আরও দু-চারটে ভাল কথা বলে সদানন্দরা বিদায় নিল। ট্যুরিস্ট লজ থেকে বেরিয়ে নির্জন পথ দিয়ে শহরের দিকে হাঁটতে হাঁটতে সদানন্দ বলল, ডাক্তারটা মাইরি অসাধ্যসাধন করেছে।
কোন ডাক্তার?
সানুর ডাক্তার। কলকাতা থেকে যখন এসেছিল তখন মনে হয়েছিল এক মাসও বাঁচবে না। এই কয়েকমাসের পর ওর চেহারা বেশ ভাল হয়ে উঠেছে। অথচ মৃত্যু ওর অবধারিত। একটা মানুষ, সানুর মতো ভাল ছেলে, কিছুদিনের মধ্যে মরে যাবে ভাবলেই কীরকম রাগ হয়। গলা উঠল সদানন্দর।
প্রত্যেককেই তো মরতে হবে। নিচু গলায় বলল বাদল।
জ্ঞান দিস না। ওর শরীরে মৃত্যু ওত পেতে বসে আছে। ব্লাড ক্যানসার। শুনলি না, ডাক্তার বললেন আমরা শুধু চেষ্টা করতে পারি।
সে-চেষ্টা তো উনি করছেন।
করছেন। একটু চুপ করে হেঁটে সদানন্দ বলল, তুই ঠিক বুঝবি না।
লিটল হাটের উল্টোদিকে অনেক দোকান। তাদের মধ্যে বার কাম রেস্টুরেন্টের সংখ্যাই বেশি। খেয়েদেয়ে ব্যাঙ্ক ড্রাফট নিয়ে ডাউহিলের দিকে যাবে ওরা। ভদ্রমহিলাকে ড্রাফটটা দিয়ে আসবে।
রেস্টুরেন্টে ঢুকে বাদল বলল, সদু, বিয়ার খাবি?
দুর ঠাণ্ডা জায়গায় কেউ বিয়ার খায় নাকি?
পাশের টেবিলে দুজন নেপালি বৃদ্ধ বিয়ার খাচ্ছিলেন। সেদিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বাদল বলল, ওই তো ওরা খাচ্ছে।
ওরা এখানকার লোক। এটাই হয়তো গরমের সময়। তা ছাড়া বিয়ার খেয়ে ভদ্রমহিলার কাছে যাওয়া ঠিক হবে না।
একটু খেলে বুঝতে পারবেন?
কী জানি।
ওরা রুটি মাংস খাচ্ছিল। গাড়িটা কলকাতায় নিয়ে গেলে সব খরচ বাদ দিয়ে হাজার তিরিশ লাভ থাকবে ওদের। মাসে এরকম দুটো কেস করলেই আর চিন্তা করতে হবে না। ওরা এই নিয়ে গল্প করছিল। এইসময় কানে এল একটি ছেলে নেপালিতে কিছু চেঁচিয়ে বলল। তারপরই একটা পাম্পশু গোছের জুতো কিছু উড়ে এসে ওদের টেবিলে সশব্দে পড়ল।
চমকে মুখ তুলল দুজনেই। জলের গ্লাস গড়িয়ে গেল। অল্পের জন্য খাবারের প্লেট বেঁচে গেল। রেস্টুরেন্টের সবাই এবার ওদের দেখছে। একটি ছেলে গম্ভীর মুখে এগিয়ে এসে জুতোটা তুলে নিয়ে বলল, তুই একটা বেয়াদপ জুতো। আকাশে উড়তে তোর খুব ভাল লাগে? অ্যাঁ?
বাদল উঠে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠল, আপনি আমাদের টেবিলে জুতো ছুঁড়েছেন? হোয়াট ইজ দিস?
আমি ছুড়িনি, জুতোই উড়ে এল। ছেলেটি এবার দাঁত বের করে হাসল।
এইসময় কাউন্টার থেকে একটি স্বাস্থ্যবান যুবক উঠে এসে ছেলেটিকে ঈষৎ ধাক্কা দিয়ে বলল, অ্যাই, কী করছ তুমি? আমার কাস্টমারকে ডিস্টার্ব করার কোনও রাইট নেই তোমার। যাও, বেরিয়ে যাও।
ছেলেটা হাসল, আমি তো ডিস্টার্ব করিনি। আমার জুতো করেছে।
যুবক বলল, আমি কিন্তু পার্টি অফিসে তোমার নামে কমপ্লেন করব।
ছেলেটা এবার বাদলদের দিকে তাকাল, আমাদের রুটিতে কেউ যদি হাত বাড়ায় তাহলে সেই হাত ভেঙে দেওয়া হবে। বুঝলে? বলে বেরিয়ে গেল।
যুবক বলল, আপনারা কিছু মনে করবেন না। এরকম ঘটনা কখনও এখানে ঘটেনি। আমি ওর হয়ে আপনাদের কাছে ক্ষমা চাইছি।
সদানন্দ এতক্ষণ চুপ করে বসেছিল। বাদল উত্তর দিতে যাচ্ছে দেখে সে ওর হাত ধরে নিষেধ করে জিজ্ঞাসা করল, আমাদের ওপর ও কেন রেগে গেছে?
আমি ঠিক জানি না। কী সব রুটির কথা বলছিল। আপনাদের আগে পরিচয় ছিল? যুবক বলল। তখন অনেকেই ভিড় করে এসেছে।
সদানন্দ মাথা নাড়ল, না। কখনও দেখিনি ওকে। আমরা শুনেছিলাম পাহাড়ে এখন শান্তি ফিরে এসেছে। টুরিস্টরা নিরাপদ। কিন্তু–।
যুবক বলল, আপনারা খেয়ে নিন, প্লিজ। আমি পার্টি অফিসে খবর দিচ্ছি।
ওরা পুরনো প্লেট ডিশ গ্লাস সরিয়ে নিয়ে নতুন খাবার দিয়ে গেল। কিন্তু আর নতুন করে খাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছিল না দুজনেরই। ম্যানেজার যুবকটির অনেক অনুরোধে শেষ পর্যন্ত সামান্য খেল ওরা। বেসিনে মুখ ধুয়ে কাউন্টারের দিকে এগোতেই দুজন লোক ঢুকল রেস্টুরেন্টে। ম্যানেজার এগিয়ে গিয়ে তাদের ঘটনাটি জানাল। সব শুনে একজন এগিয়ে এসে হাত বাড়াল, আমি লোকাল কমিটির অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি। সেক্রেটারি আজ দার্জিলিং-এ গিয়েছেন। আপনারা কোথায় উঠেছেন?
সদানন্দ লল, লিটল হাটে।
ও। এরকম ঘটনা ঘটেছে বলে আমরাই লজ্জিত। ট্যুরিস্টদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার না করতে দলের স্পষ্ট নির্দেশ আছে। ছেলেটিকে আপনারা চেনেন না?
না।
আপনারা আপনাদের হোটেলে গিয়ে বিশ্রাম করুন। আমি একটু পরে যাচ্ছি।
সদানন্দ দাম দিতে যাচ্ছিল কিন্তু ম্যানেজার কিছুতেই নিল না। বলল, আপনি যদি আবার খেতে আসেন তখন খুশিমনে নেব। এখন নিতে পারব না।
রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে বাদল বলল, চল হোটেলেই ফিরে যাই। এখন ডাউহিলে যাওয়া ঠিক হবে না।
হোটেলের ঘরে দুটো খাটে শুয়ে ওরা ঘটনাটা নিয়ে আলোচনা করছিল। স্থানীয় মানুষজন এমন কী পার্টির নেতার ব্যবহার খুব ভাল। তাহলে ওই ছেলেটি এমন ব্যবহার কেন করল? ওরা কারণ খুঁজে যেটা পাচ্ছিল এবং সেটা ভাবতে একটুও ভাল লাগছিল না।
এইসময় দরজায় টোকা পড়ল। বাদল দরজা খুলে দেখল অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি দাঁড়িয়ে আছে, পেছনে সেই ছেলেটি।
ভদ্রলোক বললেন, ক্ষমা চাও, আমি কোনও কথা শুনতে চাই না।
ছেলেটা প্রতিবাদী চোখে তাকাল, তারপর বলল, ঠিক আছে।
ঠিক আছে বললে হবে না, বলো, ক্ষমা চাইছি।
এইসময় সদানন্দ উঠে এল, কিছু মনে কোরো না ভাই, তুমি কেন জুতোটা ছুড়লে তা আমরা বুঝতে পারছি না।
ভদ্রলোক বললেন, এ ব্যাটা বুন্ধু, মাথা মোটা। ও মিসেস মুখার্জির গাড়ি কিনতে চায় কিন্তু বেশি দাম দেবে না। মিসেস মুখার্জির অধিকার আছে তিনি কাকে গাড়ি বিক্রি করবেন সেটা ঠিক করার। আপনারা এখানে এসে গাড়ি কিনবেন বলে ও খেপে গিয়েছে।
সদানন্দর স্বস্তি হল, আপনার যদি আপত্তি থাকে তাহলে ওই গাড়ি আমরা কিনব না। কিন্তু কথাটা না বলে জুতো ছুঁড়লেন কেন?
এটাই তো ওকে বলেছি। ক্ষমা চা।
এবার ছেলেটি বলল, ঠিক আছে, অন্যায় হয়ে গিয়েছে।
যা ভাগ। ভদ্রলোক বলতেই ছেলেটি চলে গেল, আপনারা মন থেকে মুছে ফেলুন ঘটনাটা। আচ্ছা চলি।
ভদ্রলোক চলে গেলে বাদল বলল, সর্বনাশ।
সর্বনাশ কেন? এ ঘটনা কলকাতাতেও ঘটে। মফস্বলে গাড়ি কিনতে গেলে সেখানে যদি কারও ইন্টারেস্ট থাকে তাহলে সেও এই একই কাজ করতে পারে। বিকেল হয়ে গিয়েছে, চল।
কোথায়?
ডাউহিলে।
যাবি?
হ্যাঁ। আর একটু সময় যাক। যাওয়ার সময় হোটেলের ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে যাব। সদানন্দ হাসল।
সেকী? রাত্রে থাকব কোথায়?
গাড়িতে।
.
সন্ধের পরে মিসেস মুখার্জির বাড়িতে দুটো ব্যাগ নিয়ে হাজির হল ওরা। ভদ্রমহিলা অবাক। বললেন, তোমরা রাত্রে গাড়ি নিয়ে যাবে?
হ্যাঁ।
পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চালাবার অভিজ্ঞতা আছে?
নেই। তাতে কোনও অসুবিধে হবে না।
কাগজপত্রে সইসাবুদ হবার পর ড্রাফট দিয়ে ওরা গাড়িতে উঠল। সদানন্দর ভয় ছিল পর্যাপ্ত পেট্রল নিশ্চয়ই নেই। কিন্তু ইঞ্জিন চালু করে খুশি হল সে। ডাউহিলের রাস্তা দিয়ে ধীরে ধীরে গাড়ি নীচে নামাতে নামাতে সে বেশ স্বচ্ছন্দ হল। এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হলে স্টেশনের সামনে পৌঁছেতেই হবে। ওরা যখন স্টেশনে পেছোল তখন গাড়ির ভিড় নেই। কিছু লোক গুলতানি করছে। ওরা দ্রুত শিলিগুড়ির দিকে বাঁক নিল। এবং সেইসময় বাদল ছেলেটিকে দেখতে পেল। অবাক হয়ে ওদের দেখছে। সেকথা বলতে সদানন্দ স্পিড বাড়াল। বাদল চেঁচিয়ে উঠল, সদু, ওদের হাতে মার খাওয়া ঢের ভাল কিন্তু অ্যাকসিডেন্টে মরতে চাই না। আস্তে চালা।
সদানন্দ প্রথম বাঁকটা পার হল, আমার ওপর তোর কোনও আস্থা নেই রে? মাই ডিয়ার মদনা?