ডাক্তার তামাং অবাক হয়ে এলিজাবেথকে দেখছিলেন। ভদ্রমহিলার শরীরের গড়ন, চামড়ার রং বলে দিচ্ছে ইনি বিদেশিনী। কথা বলার ধরন থেকে বোঝা যায় ব্রিটিশ নন, আমেরিকান। এরকম একজন বয়স্কা সুন্দরী এই বাড়িতে কী করে এলেন তা বুঝতে পারছিলেন না তামাং।
ব্রাউন বললেন, আমি আপনার কথা কিছুই, একটু যদি পরিষ্কার করে বলেন।
এলিজাবেথ এবার ডাক্তার তামাংয়ের দিকে তাকালেন। সিমি এবং সায়ন এগিয়ে এসেছে কাছে। এলিজাবেথকে উত্তেজিত হতে দেখে কিছুই ঠাওর করতে পারছে না।
এলিজাবেথ নিজের পোশাক দেখলেন। একটু লজ্জিত ভঙ্গিতে বললেন, একসকিউজ মি। তিনি দ্রুত তাঁর ঘরে চলে গেলেন।
সেই যাওয়া দেখতে দেখতে ডাক্তার তামাং জিজ্ঞাসা করলেন, কে এই ভদ্রমহিলা? এদেশের মানুষ বলে মনে হচ্ছে না।
না। মিস্টার ব্রাউন বললেন, উনি আমেরিকায় থাকেন। আমার পরিচিত।
আমেরিকায় আপনি কবে গিয়েছিলেন?
জাহাজে চাকরি করার সময়।
আপনার এখানেই এসেছেন?
ব্যাপারটা সেইরকম ডাক্তার তামাং।
দেখে মনে হল একেবারে হিপি টাইপ নয়। মানে, ভাল অবস্থা।
হ্যাঁ। উনি বেশ সম্পন্ন মহিলা।
আপনার এখানে ওঁর অসুবিধে হচ্ছে না? আমাকে জানালে কোনও ভাল বাংলোয় ওঁর থাকার ব্যবস্থা করে দিতাম। আপনার এখানে তো কাজের লোকও নেই।
ব্রাউন বললেন, উনি হঠাৎ এসে পড়েছেন। আমার এ বাড়িতে যা যা অসুবিধে তা জেনেও থাকতে চেয়েছেন। অতএব এ নিয়ে কোনও চিন্তা করার দরকার নেই।
এইসময় ভিজে পোশাক পাল্টে বেরিয়ে এলেন এলিজাবেথ। এখন সহজ দেখাচ্ছে তাকে। ব্রাউন পরিচয় করিয়ে দিলেন ডাক্তার তামাংয়ের সঙ্গে। করমর্দন করার পর এলিজাবেথ বললেন, খুব ভাল হল আপনার সঙ্গে আলাপ করে। আপনি ডাক্তার, এই কারণেই ভাল হল।
কেন? আপনার শরীর কি খারাপ লাগছে? ডাক্তার তামাং ব্যস্ত হয়ে উঠলেন।
না, না। আমি সম্পূর্ণ সুস্থ। আপনি কি স্পেশালিস্ট না–। কথা খুঁজছিলেন এলিজাবেথ।
ব্রাউন তাকে সাহায্য করলেন, ডাক্তার তামাং এখানে খুব জনপ্রিয়। জেনারেল প্র্যাকটিস করেন। সাধারণ মানুষের সেইটাই আগে প্রয়োজন।
নিশ্চয়ই। আজ সকালে আর একজন ডাক্তারের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। কিন্তু উনি হেমাটলজিস্ট। ওঁকে ওঁর কাজ করতে দেওয়া উচিত।
কিন্তু আমাকে কী জন্যে প্রয়োজন তা তো বললেন না?
এলিজাবেথ একটু ভাবলেন। সবাই তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। এলিজাবেথ বললেন, এখান থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চার্চের পাশ দিয়ে ওপাশের পাহাড়ে চলে গিয়েছিলাম। যাওয়ার সময় রাস্তার দুধারের বাড়িগুলো দেখে অস্বস্তি হচ্ছিল। সেগুলো অযত্নে তৈরি, বাচ্চাগুলো কেমন ছন্নছাড়া। চার্চটি সুন্দর। ফাদার ছিলেন না। সেখানে না ঢুকে ওই পাহাড়ে গিয়ে আমি হতভম্ব হয়ে গিয়েছি। মানুষ যে এত কষ্ট করে শুধু জীবনধারণের জন্যে পশুর মতো বাস করতে পারে তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারতাম না। টিভিতে আফ্রিকার খরা এলাকার ছবি দেখেছি। ওদের কিছু নেই। চারপাশে শুধু হাহাকার। কেউ কেউ সন্দেহ করেন টিভিতে ছবি তৈরি করে বাড়িয়ে দেখায়। আমরা মাঝে মাঝে ডোনেট করেছি কিন্তু ওদের প্রত্যক্ষ করিনি। অথচ আজ ওদের ভাঙাচোরা ঘরগুলোতে দাঁড়িয়ে দেখলাম চারপাশে প্রাচুর্য থাকা সত্ত্বেও অশিক্ষার কারণে দারিদ্র্য ওদের সব কিছু কেড়ে নিয়েছে। একটা পাঁচ মাসের বাচ্চার মায়ের ব্রেস্ট মিল্ক নেই, ফেন খাইয়ে রাখা হয় কারণ তারা দুধ কিনতে পারে না। ভাবা যায়? কলকাতায় এসে শুনেছিলাম এখানে নাকি কম্যুনিস্টরা সরকার চালাচ্ছে দু যুগ ধরে। কম্যুনিজম মানে তো সবাই সমান অধিকার ভোগ করবে। সমানভাবে ধনবণ্টন হবে, কিন্তু একী নমুনা দেখলাম আমি? তিরিশ বছর আগে কেনা ছিঁড়ে ফালি ফালি হয়ে যাওয়া কম্বলে বাচ্চাগুলো ওখানে উষ্ণতা খোঁজে? কোনও কম্যুনিস্ট নেতা কখনও ওদের কাছে পৌঁছোয়নি। শুনলাম কমুনিস্টদের কাছ থেকে স্বায়ত্তশাসনের কিছুটা ক্ষমতা আদায় কবে পাহাড়ের মানুষরা নিজেদের দেখাশোনা করছেন এখন। তারাও এদের জন্যে কিছু করেননি। ওরা আমার কথা বুঝতে পারছিল না। আমি ওদের ভাষা জানি না। কিন্তু কান্নার ভাষা বুঝতে কোনও অসুবিধে হয় না। কথা বলতে বলতে গলা ভারী হয়ে গেল এলিজাবেথের।
মিস্টার তামাং এরকম প্রতিক্রিয়ার কারণ বুঝতে পারলেও ব্যাপারটাকে সহজ করতে চাইলেন, এদেশের মানুষদের বোধহয় আগে আপনি দেখেননি। অধিকাংশই খুব গরিব। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা জীবনটাকে তাদের মতো করে উপভোগ করে। বাইরে থেকে দেখে সেই ব্যাপারটা বোঝা যায় না।
উপভোগ করে? যে শিশুটি দুধের বদলে ফেন খেয়ে বেঁচে আছে সে কী আনন্দ উপভোগ করছে? ফেনের স্বাদ? আপনি যে কথা বললেন ডাক্তার তা এককালে রোমান রাজারা বলত দুটো মানুষকে আমরণ যুদ্ধে নামতে বাধ্য করে। বলত মানুষগুলো উপভোগ করছে। মাথা নাড়লেন এলিজাবেথ, মিস্টার ব্রাউন বললেন আপনি এখানকার জনপ্রিয় ডাক্তার। আচ্ছা, আপনি শেষ কবে ওখানে পেশেন্ট দেখতে গিয়েছেন বলুন তো?
ডাক্তারের মুখ শক্ত হল। তিনি বললেন, আমাকে যদি ওইসব গ্রামের মানুষ কল না দেয় তাহলে আমি যাব কী করে! আর ওরা যখন বোঝে বাড়িতে থাকলে পেশেন্ট মারা যাবে তখনই হাসপাতালে নিয়ে যায়। যে অবস্থায় নিয়ে যায় সেই অবস্থায় বাঁচানোও শক্ত হয়ে পড়ে।
আপনার ফি কত?
হঠাৎ এ প্রশ্ন?
এখানে নিশ্চয়ই কাউকে দেখতে এসেছেন?
এবার ব্রাউন বললেন, না না। এদিকে কোনও পেশেন্টকে দেখতে এলে ডাক্তার তামাং খানিকক্ষণ আমার সঙ্গে গল্প করে যান।
আপনি নিশ্চয়ই কাউকে দেখতে এসেছিলেন এদিকে?
হ্যাঁ। সাধারণত আমি কারও বাড়িতে গেলে দেড়শো টাকা নিই।
এখানকার লোকেদের প্রধান খাবার কী? রুটি?
না। এখনও চালই বলা যায়।
চালের দাম কত? এখনও দশ টাকায় পাওয়া যায়। দশ টাকায় এক কিলোগ্রাম।
তার মানে আপনাকে বাড়িতে ডাকতে হলে ওদের পনেরো কিলোগ্রাম চালের দাম দিতে হবে। ওরা তো এক কিলোগ্রাম চালই জোগাড় করতে হিমসিম খেয়ে যায়। তাই না?
ঠিক তাই। সেইজন্যে সরকারি হাসপাতাল আছে। সেখানে গেলে বিনা পয়সায় চিকিৎসা করা হয় ওদের।
আপনাকে যাঁরা বাড়িতে ডাকেন তারা হাসপাতালে যান না কেন?
ওয়েল। প্রত্যেকের নিজস্ব কারণ আছে। যাঁরা খরচ করতে পারেন তারা বারোয়ারি ব্যবস্থায় না গিয়ে একটু স্পেশ্যাল কেয়ার চান। এই জন্যে লোকে হাসপাতালে না গিয়ে নার্সিংহোমে যায়।
তার মানে নার্সিংহোমে হাসপাতালের থেকে ভাল চিকিৎসা হয়?
তা তো নিশ্চয়ই। কারণ বেশি টাকা দিতে হয়।
বেশি টাকা দিতে হয় আর একদম টাকা দিতে হয় না। এটা কী করে কম্যুনিস্ট সরকারের আমলে সম্ভব?
দেখুন ম্যাডাম, আমি কমুনিস্ট নই। এ প্রশ্নের জবাব কী করে দেব?
মিস্টার ব্রাউন, আমাকে এখানকার হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারেন? এলিজাবেথ ঘুরে তাকালেন।
ব্রাউন বললেন, আপনার সেখানে ভাল লাগবে না।
কেন?
এখানকার হাসপাতালগুলোর অবস্থা ভাল নয়।
ও। আজ যদি আমি এখানে অসুস্থ হয়ে পড়ি তাহলে ওখানে নিয়ে যাবেন না আপনি? আমার যদি বেশি টাকা খরচ করার ক্ষমতা না থাকে?
সায়ন চুপচাপ শুনছিল। এই বিদেশিনী মহিলা উত্তেজিত হয়ে যেসব কথা বলছেন সেগুলো যে প্রচণ্ডভাবে সত্যি তা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল না। কিন্তু এই সত্যি কথাগুলো নিয়ে চারপাশের কোনও মানুষ ভাবে বলে তার জানা নেই। কলকাতায় ওদের বাড়ির খুব কাছেই হাসপাতাল। কিন্তু সেবার মেজজেঠুর বুকে ব্যথা হতেই সবাই অনেক দূরের নার্সিংহোমে নিয়ে গেল। যেন সেখানে নিয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক ব্যাপার।
এলিজাবেথ বললেন, মিস্টার ব্রাউন, আমি আমেরিকায় চলে গিয়ে বাকি জীবনটা যেভাবেই কাটাই এইসব মানুষগুলো প্রতিনিয়ত আমাকে তাড়া করে বেড়াবে। দামি গাড়ি, ভাল খাবার, চমৎকার বাড়িতে বসে আমি ভাবব এই মানুষগুলো কীরকম জন্তুর মতো বেঁচে আছে। জানেন, একটি দেড় বছরের শিশু আমার আঙুল ধরে কিছু একটা বলেছিল। ওর মা বলল ও আমার কোলে উঠতে চায়। ইঙ্গিতে বোঝাল আমাকে। আমি কোলে নিতেই বৃষ্টি নামল। বাধ্য হয়ে ওদের ঘরে ঢুকেছিলাম আমি। ওটাকে যে ঘর বলা যায় তা আগে কখনও ভাবিনি। কিন্তু শিশুটির শরীরের উত্তাপ আমার বুকে এখনও লেগে রয়েছে। তাই ভেবে দেখলাম, আমার এখানে কিছুদিন থাকা উচিত। আমার যেটুকু ক্ষমতা আছে তাই দিয়ে ওদের পাশে দাঁড়াতে চাই। এ ব্যাপারে আপনার সাহায্য চাই মিস্টার ব্রাউন।
ব্রাউন চোখ বড় করে শুনছিলেন। বললেন, নিশ্চয়ই। তবে আপনি নিশ্চয়ই সব কিছু ভেবে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।
অবশ্যই। প্রথমে আমার একটা নিজস্ব থাকার জায়গা দরকার। সেটা ওই গ্রামটির কাছাকাছি হলে ভাল হয় যাতে ওরা চট করে আমার কাছে আসতে পারে। মোটামুটি থাকা যায় এমন বাড়ি হলেই চলবে। এলিজাবেথ বললেন।
খোঁজ নিতে হবে। চাইলেই যে বাড়ি পাওয়া যাবে তেমন আশা করা ঠিক নয়। তবে দেখব। বলতে বলতেই খেয়াল হল ব্রাউনের, ও হ্যাঁ, ডিসুজাদের বাড়ি খালি হবে। মেয়েটা বলছিল ওরা এখান থেকে চলে যাবে। তবে ঠিক কবে যাবে জানি না।
ডাক্তার তামাং অনেকক্ষণ খালি গ্লাস হাতে নিয়ে বসে কথা শুনছিলেন। এবার জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি ঠিক কী কাজ করতে চান?
ওটা এখনও ভাবিনি। তবে আমাকে দয়া করে মিশনারি বলে ভাববেন না।
কিন্তু এখানে থেকে এসব কাজ করার জন্যে আপনাকে সম্ভবত সরকারি অনুমতি নিতে হবে। আপনি জানেন না, আগে এসব এলাকায় বিদেশিদের আসা নিষিদ্ধ ছিল। তারপর পারমিট নিয়ে আসতে হত। এখন নিয়ম অত কড়া নেই তবে তারা ট্যুরিস্ট হিসেবে বেড়াতে আসতে পারেন, দীর্ঘকাল থাকতে পারেন না।
এরকম নিয়মের কারণ কী?
ভারত সরকার সীমান্তের কাছাকাছি জায়গাগুলো সম্পর্কে সতর্কতা অবলম্বন করেছেন। ডাক্তার তামাং উঠে দাঁড়ালেন, আজ আমি যদি আমেরিকায় গিয়ে দীর্ঘকাল এইসব করতে চাই তাহলে নিশ্চয়ই আপনাদের সরকার সেটা বরদাস্ত করবে না।
কিন্তু যতদিন আমার ভিসার মেয়াদ শেষ না হচ্ছে ততদিন নিশ্চয়ই থাকতে পারি। আর সেই থাকার সময় যদি কারও দিকে বন্ধুর মতো হাত বাড়িয়ে দিই তাতে আপনার সরকারের আপত্তির তো কারণ নেই। এলিজাবেথ তেজি গলায় বললেন।
এবার সায়ন কথা বলল, কলকাতায় অনেক বিদেশি ফুটবলার বহু বছর ধরে খেলে টাকা রোজগার করছে। তাদের ব্যাপারে কেউ কিন্তু আপত্তি করে না।
ডাক্তার তামাং কাঁধ নাচালেন, হতে পারে। আমার খুব দেরি হয়ে গিয়েছে। সোনাদায় চেয়ারম্যান হয়তো পৌঁছে গিয়েছেন। আচ্ছা, মিস্টার ব্রাউন, আবার দেখা হবে।
ডাক্তার বেরিয়ে যাচ্ছিলেন এলিজাবেথ শেষ মুহূর্তে তাকে ডাকলেন, ডক্টর!
ডাক্তার তামাং ঘুরে দাঁড়ালেন।
এলিজাবেথ বললেন, আপনার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার সময় বলেছিলাম ভাল হয়েছে। ওখানে ডাক্তারের সাহায্য লাগবেই। আপনাকে ডাকলে আসবেন?
ডাক্তার তামাং বললেন, আপনি যদি আমাকে প্রফেশন্যাল কল দেন তাহলে অবশ্যই যাব। আর যদি দাঁতব্য প্রতিষ্ঠানে গিয়ে পেশেন্ট দেখতে বলেন তাহলে ভেবে বলতে হবে, আমি সপ্তাহে একটা সময় বের করতে পারছি কিনা।
ডাক্তার তামাংয়ের গাড়ির শব্দ হতেই এলিজাবেথ বললেন, উনি ঠিকই বলেছেন। আসলে মানুষ যদি সরাসরি মুখের ওপর সত্যি কথা বলে তাহলে তাকে বুঝতে যেমন অসুবিধে হয় না তেমনই কাজ করতেও সুবিধে হয়।
ব্রাউন বললেন, এবার অন্য প্রসঙ্গে আসি। সকাল থেকে কিছুই খাওয়া হয়নি আপনার। বলুন, ব্রেকফাস্টে কী খাবেন?
হঠাৎ সিমি বলল, আপনারা বসুন, আপনাদের ব্রেকফার্স্ট আমি বানিয়ে দিচ্ছি। আপনি নিশ্চয়ই বেশি মশলা বা ঝোল খেতে চাইবেন না?
একগাল হাসলেন এলিজাবেথ, হাউ সুইট। হ্যাঁ, আমি কোনও ঝুঁকি নিতে চাই না।
ব্রাউন বললেন, সিমি, তাহলে সবার জন্যেই ব্রেকফার্স্ট বানাও।
সায়ন মাথা নাড়ল, না, মিস্টার ব্রাউন, আমি বাদ। সিমি চলে গেল।
ব্রাউনের মনে পড়ল, ওহো! তোমার কি এখনও বাইরে খাওয়া নিষেধ?
আমি চাই না। ওই যে উনি বললেন, ঝুঁকি নিতে চাই না।
এলিজাবেথ উঠে এলেন সায়নের কাছে, তুমি এখন কেমন আছ?
ভাল। সায়ন হাসল।
এলিজাবেথ ওর হাত ধরলেন, এখানে তোমাকে আর কতদিন থাকতে হবে?
আমি জানি না। তবে কলকাতার থেকে এখানে থাকতে আমার ভাল লাগে।
কেন?
পাহাড়ের জন্যে। পাহাড়ি মানুষের জন্যে। সায়ন এলিজাবেথের দিকে তাকাল, একটু আগে আপনি বাড়ির কথা বলছিলেন। আমি একটা বাড়ির হদিস দিতে পারি, তবে সামান্য মেরামতি করতে হবে। কিন্তু ওই গ্রাম থেকে কিছুটা দূর হয়ে যাবে।
কোথায়? মিস্টার ব্রাউন জানেন?
নিশ্চয়ই। উনিই আমাকে চিনিয়েছিলেন।
ব্রাউন জিজ্ঞাসা করলেন, কোন বাড়ির কথা বলছ?
একটু নীচে যে বাড়িতে পবন বাহাদুর পুড়ে মরে গিয়েছিল। যে বাড়িটা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।
ব্রাউন মাথা নাড়লেন, ওটা মেরামত করতে অনেক খরচ হবে। তা ছাড়া মিষ্টার মুখার্জিদের খুঁজে বের করে অনুমতি নিতে হবে। তার চেয়ে আমি নিমা প্রধানের সঙ্গে কথা বলব।
এলিজাবেথ জিজ্ঞাসা করলেন, পুড়ে কেউ মারা গিয়েছিল? কী হয়েছিল?
ব্রাউন বললেন, খুব দুঃখজনক ঘটনা। পাহাড়ের মানুষেরা আন্দোলন করেছিল তাদের অভাব অভিযোগ নিয়ে। ভারত সরকার তাদের বঞ্চিত করে রেখেছে। তা ওই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত চেহারা নিল, পাহাড় পাহাড়িদের জন্যে। আন্দোলনকারীদের একটা অংশকে কিছু স্বার্থান্বেষী উসকে দিল। এসব অঞ্চলে সমতল থেকে আসা প্রচুর মানুষ বহু বছর ধরে বাড়ি বানিয়ে বাস করছে। তাদের তাড়াবার জন্যে লোকগুলোকে লেলিয়ে দেওয়া হল। ওই বাড়িটিতে তারা আগুন লাগিয়ে দেয়। বাড়ির মালিকরা ছিল না কিন্তু অদ্ভুত ঘটনাটা ঘটল। একটি নেপালি ছেলে, নাম বন বাহাদুর, হঠকারিদের বাধা দিতে গেল। সেই পাহাড়ি ছেলেটির মনে হয়েছিল কাজটা অন্যায় হচ্ছে। বেচারাকে শহিদ হতে হয়েছিল।
মাই গড। এলিজাবেথ গালে হাত দিলেন, বাড়িটাকে দেখতে পারি?
নিশ্চয়ই। প্রায় শেষ হওয়ার মুখে বাড়িটায় আগুন দেওয়া হয়েছিল। ভেবেছিলাম কাউন্সিল বাড়িটা নিয়ে কোনও জনহিতকর কাজ করবে। করেনি।
সমতলের মানুষদের সম্পর্কে ওই মনোভাব এখনও আপনাদের আছে?
আপনাকে বললাম এটা পাহাড়ের সাধারণ মানুষের মনের কথা নয়। খুব সামান্য সংখ্যার মানুষের উগ্র মতবাদকে গ্রাহ্য করা উচিত নয়।
ওঁদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ধীরে ধীরে ঢালু পথ বেয়ে নিরাময়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল সায়ন। কী আশ্চর্য। এর মধ্যে আকাশ অনেকটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। কালো মেঘের দল উধাও। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে সাদাটে মেঘেরা সেঁটে আছে চুপচাপ। হালকা রোদ উঠব উঠব করছে। পাহাড় কী দ্রুত নিজের চেহারা বদলে ফেলে। সঙ্গে সঙ্গে সিমির কথা মনে পড়ল। সিমিও কি পাহাড়ের মতো? মিস্টার ব্রাউনের বাড়িতে যাওয়ার আগে ও কত রূঢ় কথা বলেছিল। মিস্টার ব্রাউনকে গালাগাল দিয়েছে, এলিজাবেথকে সহ্য করতে পারেনি। অনেক অনুরোধ করে ওকে নিয়ে যেতে পেরেছিল সায়ন। সিমি যাতে বর খুঁজতে দার্জিলিং-এ না যায় তাই ওই চেষ্টা করেছিল। কিন্তু কী হল? সেই মেয়ে এখন কিচেনে গিয়ে মিস্টার ব্রাউন আর এলিজাবেথের জন্যে ব্রেকফার্স্ট বানাচ্ছে? এলিজাবেথের কী খেতে অসুবিধে হবে জেনে নিচ্ছে? সিমির এই পরিবর্তন অবশ্য এলিজাবেথের কথায় হয়েছে। এবং সেটা হওয়ায় ভারি ভাল লাগছিল সায়নের।
নিরাময়ের গেটের সামনে যেতেই ঘটনাটা ঘটল। একটা লোক হাউমাউ করে চেঁচিয়ে সোজা সায়নের পায়ের ওপর লুটিয়ে পড়ে বলতে লাগল, তুমি আমার ভগবান, তুমি আমার ভগবান।
সায়ন কিছুতেই লোকটাকে ছাড়াতে পারছিল না। এই সময় ছোটবাহাদুর বেরিয়ে এসে লোকটাকে জোর করে সরিয়ে নিল। লোকটা তখনও কাঁদছিল। ছোটবাহাদুর তাকে ঝাঁকিয়ে জোর গলায় বলল, কী হচ্ছে কী? কে তুমি? কী চাই?
লোকটা কাঁদতে কাঁদতে বলল, উনি ভগবান। আমার মেয়েকে বাঁচানো যাবে না বলেছিল এখানকার ডাক্তাররা। উনি বলেছিলেন শিলিগুড়িতে নিয়ে গিয়ে বড় ডাক্তার দেখাতে। ওঁর শরীরের রক্ত একটা রুমালে ছিল। সেটা মেয়ের মাথায় ঠেকিয়ে আমি শিলিগুড়িতে নিয়ে যাই। সেখানে বড় ডাক্তারের ওষুধ খেয়ে মেয়ে এখন অনেক ভাল আছে। ডাক্তার বলেছে ওর আর কোনও ভয় নেই। ওষুধ খেয়ে যেতে হবে আরও তিন হপ্তা। আজ ওকে শিলিগুড়ি থেকে এখানে নিয়ে এসেছি। ওঁর জন্যেই আমার মেয়ে জীবন ফিরে পেল।
ছোটবাহাদুর হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কোথায় থাকো?
আমি ট্যুরিস্ট লজে চাকরি করি।
এতক্ষণে মনে পড়ল সায়নের। সে চোখ বন্ধ করল। লোকটা কথা বলছিল নেপালিতে কিন্তু বুঝতে কোনও অসুবিধে হয়নি। সে এগিয়ে গেল লোকটার সামনে, তুমি আমার রক্তমাখা রুমাল মেয়ের শরীরে ঠেকিয়ে খুব অন্যায় করেছ। আমি একজন সাধারণ মানুষ। ভাল ডাক্তার ঠিক ওষুধ দিয়েছেন বলে তোমার মেয়ে সুস্থ হচ্ছে। যাও এখান থেকে।
কথাগুলো বাংলায় বললেও লোকটা হতভম্ব হয়ে শুনল। সায়ন আর বাইরে না দাঁড়িয়ে প্যাসেজে পা রাখল।
.
নিয়মিত ওষুধ এবং পথ্য ছাড়া আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো বেঁচে থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয় এটা সায়ন বুঝে গিয়েছে। ডাক্তারবাবুর কাছে যেসব মেডিক্যাল জার্নাল আসে সেগুলো তার অফিসের র্যাকেই থাকে। দুপুরবেলায় সায়ন মাঝে মাঝেই সেখানে যায়, পাতা ওল্টায়। আজকের ডাকে আসা জার্নালে এই অসুখ সম্পর্কে অনেকটা আলোচনা করা হয়েছে। বিজ্ঞান চেষ্টা করে চলেছে প্রকৃতিকে হারাতে। এখন পর্যন্ত বোন ম্যারো পাল্টে, বারংবার রক্ত দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা পেশেন্টদের সম্পর্কে আলোচনা পড়তে পড়তে চমকে উঠল সায়ন। ভদ্রলোকের বয়স পঞ্চাশ। থাকেন জার্মানিতে। পাঁচ বছর ধরে ওষুধ এবং ডাক্তারের ওপর নির্ভর করেছিলেন তিনি। যখন সুস্থ থাকতেন তখন হাঁপিয়ে উঠতেন। আর পাঁচটা সাধারণ মানুষ যা করছে তাই করার জন্যে ছটফট করতেন। শেষ পর্যন্ত ওইরকম সুস্থ থাকার সময়ে একদিন গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। সমুদ্রের ধারে চলে গিয়ে দিব্যি আছেন সেখানে। রোজ ভোরে ওঠেন। চার কিলোমিটার হাঁটেন। প্রচুর পরিমাণে শাকসবজি আর সামুদ্রিক মাছ খান। নিয়মিত সমুদ্রে সাঁতার কাটেন। গত ছয় মাসে তিনি একবারও অসুস্থ হননি। পেশেন্টের মনের জোর এক্ষেত্রে রোগকে মাথা তুলতে দিচ্ছে না, এ কথা ডাক্তাররা বলছেন না। কিন্তু সেটা যে একটা কারণ তাও অস্বীকার করার উপায় নেই।
নিজের ঘরে ফিরে এল সায়ন। কোথায় যেন পড়েছিল সে জীবের জন্ম হয় মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্যে। খুব অল্প সময়ের জন্যে মানুষ পৃথিবীতে বেঁচে থাকে। একটা কচ্ছপ তার চেয়ে অনেক বেশি আয়ুর অধিকারী। এই বেঁচে থাকার সময়টায় কেউ কেউ এমন কিছু কাজ করে যান বলেই তাকে মনে রাখে পরবর্তী কালের মানুষেরা। শুধু মরে যাওয়ার জন্যে বেঁচে থাকার কোনও মানে হয়? চট করে এলিজাবেথের মুখ মনে পড়ল তার। কোথায় আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলস আর কোথায় এই পাহাড়! ভদ্রমহিলা বেড়াতে এসেছিলেন মিস্টার ব্রাউনের কাছে। এসে এখানকার মানুষের দুর্দশা দেখে কিছুদিন থেকে যাওয়ার কথা ভেবেছেন। থেকে গিয়ে ওদের যতটা পারবেন সাহায্য করবেন। কেন? এদেশে প্রচুর বড়লোক আছেন, কই তারা তো এমন ভাবছেন না! ডাক্তার তামাংয়ের সঙ্গে এলিজাবেথ যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলেন তার প্রত্যেকটা কথাই সত্যি।
সায়নের মনে হল তার কিছু করা উচিত।
শুয়েছিল কঙ্কাবতী। এখানে আসার পরে তার শরীর খানিকটা ভাল। আজ মিসেস অ্যান্টনির সঙ্গে নীচে নেমেছিল। খুব ভাল লাগছিল তখন। কিন্তু ওপরে ওঠার সময় কাহিল হয়ে পড়ল। কথাটা মিসেস অ্যান্টনিকে না বললেও তিনি যে বুঝতে পেরেছিলেন তা কিছুক্ষণ পরে টের পেয়েছিল কঙ্কাবতী। হঠাৎ ডাক্তারবাবু এসে হাজির, কী ব্যাপার হে? কেমন আছ?
ফ্যাকাশে মুখে ক্লান্ত গলায় কঙ্কাবতী বলেছিল, ভাল।
ভাল তো থাকবেই। এখানে এসে কেউ খারাপ থাকে না। দেখি। ডাক্তারবাবু তার পাস পরীক্ষা করলেন। তারপর ঈষৎ ঝুঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, কী খেতে ইচ্ছে করছে? মাছ মাংস ডিম মিষ্টি, যা ইচ্ছে তাই বলো।
কঙ্কাবতী মুখ ফেরাল, ঠোঁটের কোণে চিলতে হাসি।
ডাক্তার বললেন, উঁহু। তুমি না বলা পর্যন্ত এখান থেকে নড়ব না আমি।
আমার খেতে ইচ্ছে করে না।
জানি তো। তবু যদি কিছু ভাল লাগে। মুরগির স্টু না করে ঝোল করলে নিশ্চয়ই ভাল লাগবে। অল্প ঝাল থাকলে চমৎকার। তাই না?
কঙ্কাবতী তাকাল। তারপর সলজ্জ গলায় বলল, হাতিশাক খাব।
হাতিশাক? ওহো, মাথাটা হাতির শুঁড়ের মতো হয়? আরে এই শাক তো রাস্তার দুপাশে আগাছার মতো ছড়িয়ে আছে। আমরা বলি ঢেঁকির শাক। পেঁয়াজ দিয়ে চচ্চড়ি রাঁধলে দারুণ হয়। আমি এখনই মিসেস অ্যান্টনিকে বলছি। কথা বলতে বলতে ডাক্তার একটা প্যাকেট খুলে ডিসপোজেবল সিরিজ বের করলেন, দেখি এবার হাতটা দাও। হ্যাঁ। সিরিঞ্জে রক্ত টেনে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, লাগেনি তো?
না।
দুপুরে ভাতের পাশে হাতিশাকের চচ্চড়ি ছিল। যখন মায়ের হাতে টাকা থাকত না তখন এই শাকই ওদের পেট ভরাত। ওরা একা নয়, বস্তির সমস্ত গরিব মানুষের খাবার হল এই শাক আর স্কোয়াশ। শাকটা খাওয়ার সময় বেশ গন্ধ পেয়ে ভাল লেগেছিল কঙ্কাবতীর।
আজ বিকেলে মা এল বেশ সেজেগুজে। মাকে এমন সাজতে সে অনেকদিন দেখেনি। টিপ পরা ছেড়ে দিয়েছিল মা বাবা বেঁচে থাকতেই। আজ কপালের মাঝখানে খয়েরি টিপ পরায় মাকে কী মিষ্টিটাই না দেখাচ্ছিল। সারাজীবন মা খুব কষ্ট পেয়ে এসেছে। বাবা থাকতে এক কষ্ট, চলে যাওয়ার পর আর এক কষ্ট। তার এই অসুখটাও মাকে খুব বিপদে ফেলে দিয়েছে। এরকম সময়ে। মা যদি একটু ভাল থাকে তাহলে খুশি হওয়ারই কথা। মা তার বিছানার পাশে এসে বলল, ডাক্তারবাবু বলল আজ রাত্রে তোকে রক্ত দেওয়া হবে।
কখন বলল?
এই তো, এখন। কাল শুনে গেলাম তুই ভাল আছিস, আমার কী কপাল। ভগবান কখনও একটুও সুখ দেবেন না আমাকে।
আমি ভাল আছি মা।
ভাল থাকলে রক্ত দেবে কেন?
হয়তো আরও ভাল থাকার জন্যে।
ইসস। রক্তের কত দাম জানিস? পার্টির ভয়ে বিনা পয়সায় তোকে এখানে রেখেছে তারপর কারণ ছাড়া রক্ত দেবে বলে আমি ভাবি না। কী যে করি!
কেন? কী হয়েছে?
আমার যে শিলিগুড়ি যাওয়ার খুব দরকার।
কেন?
পার্টির কাজে।
পার্টির কাজ? তুমি পার্টির কাজ করছ নাকি?
বাঃ। যারা তোর এত উপকার করল তারা বললে না বলি কী করে?
মাসির বাড়িতে থাকবে?
না। সেবার তোর মাসি যে খারাপ ব্যবহার করেছিল তা আমি কী করে ভুলব। তোকে ঝিয়ের মতো খাটিয়েছিল। ওই জন্যে তো অসুখটা হল।
ওই জন্যে কারও এই অসুখ হয় না মা।
কেন হয়?
জানি না।
মা কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। তারপর ওর হাতে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, তা ছাড়া কাজটা তো ঠিক শিলিগুড়িতে নয়, যেতে হবে মালবাজারের দিকে।
বেশ তো, যাও না।
কী করে যাব। তোকে আজ রক্ত দেবে। যদি শরীর খারাপ হয়ে যায়?
শরীর খারাপ হলে ডাক্তারবাবু দেখবেন। তুমি থেকে তো কিছু করতে পারবে না।
তা পারব না।
তাহলে?
লোকে কী বলবে? মেয়েটাকে ফেলে চলে গেল। মা চিন্তিত।
এই সময় মিসেস অ্যান্টনি এলেন, প্রাইভেট কথা হচ্ছে না তো।
মা মাথা নাড়ল, আর প্রাইভেট। আচ্ছা, মেয়ের কী এমন হয়েছে যে আজ রক্ত দিতে হবে। ওষুধ খাওয়ালে ঠিক হবে না?
ওষুধে যদি হয়ে যেত তাহলে ডাক্তারবাবু রক্ত দেওয়ার কথা ভাবতেন না। আর রক্ত দেওয়া হবে বলে ভয় পাচ্ছেন কেন?
রক্তের কথা ভাবলেই আমার ভয় আসে।
না না। খিদে পেলে যেমন আমরা খাই তেমনই শরীরের রক্ত কমে গেলে রক্ত দিলেই কাজ হয়। আপনি এজন্যে চিন্তা করবেন না। কঙ্কাবতী মোটেই ভিতু নয়। তাই না। এই মেয়ে, দেখেছ, তোমার মাকে কী সুন্দর দেখাচ্ছে। মিসেস অ্যান্টনি কথাটা বলতেই এই যৌবনের শেষ ধাপে এসেও গালে লালচে ছোপ লাগল কঙ্কাবতীর মায়ের।
লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, কী যে বলেন, কোথায় কী?
কঙ্কাবতী বলল, মাকে শিলিগুড়িতে যেতে হবে। এই খবরটা শুনে কী করবে বুঝতে পারছে। আমি বললাম, যাও, ঘুরে এসো।
হ্যাঁ। কাজ থাকলে চলে যান। কোনও চিন্তা করবেন না। মিসেস অ্যান্টনি এক গ্লাস জল আর ক্যাপসুল নিয়ে কঙ্কাবতীর কাছে গেলেন, হাঁ করো তো।
কঙ্কাবতী বলল, আমার আর ওষুধ খেতে ভাল লাগে না।
ভাল না লাগলেও খেতে হবে মা। এই দ্যাখো না, সায়ন কীরকম হেঁটে বেড়াচ্ছে। ওষুধ খায় বলেই ভাল আছে ও। মিসেস অ্যান্টনি বললেন।
কঙ্কাবতীর মায়ের যেন কিছু মনে পড়ে গেল, ওর নাম সায়ন, না!
কার নাম? মিসেস অ্যান্টনি ওষুধ খাইয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।
ওই যে, মাদার মেরির সামনে যে মোমবাতি জ্বালাতে গিয়েছিল!
ওহো। গল্পটা আপনিও শুনেছেন!
বাঃ। কে না শুনেছে। খুব ভিড় হয়েছিল এখানে?
তা হয়েছিল। কিন্তু যেই লোকে জানল সায়ন নিজেই অসুস্থ আর সেই অসুখটা সে সারাতে পারছে না তখন বেশির ভাগেরই উৎসাহ কমে গেল।
তুই দেখেছিস ওকে? মা মেয়েকে জিজ্ঞাসা করল।
হ্যাঁ।
কঙ্কাবতীর মা একটু ভাবলেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা, আমি যে বাইরে যাচ্ছি তা ডাক্তারবাবুকে বলে যেতে হবে?
আপনি তো আমাকে বললেন, আমি বলে দেব। শুধু খুব দরকার পড়লে আপনাকে যেখানে পাওয়া যাবে সেই ঠিকানাটা যদি রেখে যান।
ঠিকানা, ঠিকানা তো আমি ঠিক জানি না! মা বলল।
যেখানে যাচ্ছেন সেখানকার কাউকে জানেন না?
না, মানে, পার্টির কাজে যাচ্ছি তো, ওরাই পাঠাবে। অবশ্য আমি দিন তিনেকের মধ্যেই ফিরে আসব।
ঠিক আছে। তেমন প্রয়োজন হলে লোক্যাল পার্টিকে জানিয়ে দেব।
তেমন প্রয়োজন কি হবে বলে মনে হয়?
না না। বললাম তো চিন্তা করবেন না। নিন, আপনারা গল্প করুন। মিসেস অ্যান্টনি বেরিয়ে গেলেন।
মা বলল, এখানকার সবাই বেশ ভাল, না?
হ্যাঁ। কিন্তু তুমি একটা কথা ভুল বলেছ। কঙ্কাবতী বলল।
কী?
এখানে আমি আছি ডাক্তারবাবুর জন্যে। উনি যদি রাজি না হতেন তাহলে তোমার পার্টি কিছুই করতে পারত না।
কী করে বুঝলি?
আমি জানি।
মা কিছুক্ষণ মেয়ের মাথায় হাত বোলালেন, আমি তোকে খুব বকি, না? আমার ওপর রাগ করেছিস?
নীরবে মাথা নেড়ে না বলল কঙ্কাবতী। একটু বাদে মা উঠে দাঁড়াল, আমি আজ চলি, দেরি হয়ে যাচ্ছে।
তুমি আজই চলে যাবে।
হ্যাঁ।
শিলিগুড়িতে কার সঙ্গে যাবে?
লোকজন আছে। মা মুখ নামাল, চলি।
মেয়ের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে মা চারপাশে তাকাল। করিডোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কয়েকজন। দেখলেই বোঝা যায় এরা পেশেন্ট। মহিলা তাদের একজনের কাছে গিয়ে নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করল, সায়ন কোথায় থাকে?
বালক হাত তুলে ঘর দেখিয়ে দিল।
প্রায় নিঃশব্দে চলে এল মহিলা। দরজায় পৌঁছে উঁকি মারতে দেখতে পেল একটি ছেলে চেয়ারে বসে কিছু পড়ছে, তার পেছনটা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। কান খাড়া করে শুনল মহিলা। নিশ্চয়ই কবিতা। তবুও ভোরবেলা আবছা মানুষেরা আবছা-আরও মায়াজাল খোঁজে। দগ্ধ বিনুনির গন্ধ মোছা দিন সদ্য জেগে ওঠে আলগোছে। চটি বইটি বন্ধ করে ছেলেটি বলল, চৈতালী, আপনি বড় ভাল লেখেন। আঃ, আমি যদি এরকম লিখতে পারতাম!
ছেলেটি উঠে দাঁড়াতেই সোজা হয়ে গেল মহিলা। সায়ন জিজ্ঞাসা করল, বলুন। কিছু চাই আপনার?
মহিলা অপলকে তাকিয়েছিল সায়নের মুখের দিকে। হঠাৎ যেন মনে হল তার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।
সায়নের মনে হল এই মহিলাকে সে আগে দেখেছে। দেখলে এখানে এই নিরাময়েই দেখা হয়েছে। তারপরেই খেয়াল হল, ইনি কঙ্কাবতীর মা নন তো? সেদিন এঁকে অন্যরকম দেখাচ্ছিল। আজ মনে হচ্ছে বয়স অনেক কমে গিয়েছে।
সায়ন ডাকল, মা, আপনি কিছু বলবেন?
সঙ্গে সঙ্গে সব কিছু গোলমাল হয়ে গেল মহিলার। দ্রুত মাথা নেড়ে না বলতে লাগলেন তিনি। দরজা ধরে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল মহিলা, আচ্ছা, মা মেরি তোমার সঙ্গে কথা বলেছেন?
না তো!
তুমি খ্রিস্টান?
না। আমার বাবা মা হিন্দু। সায়ন এগিয়ে গেল, আপনি একটু বসুন। মনে হচ্ছে আপনি অসুস্থ।
কঙ্কাবতীর মা ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসল। সায়ন কোনও কথা না বলে বিছানায় বসে মহিলাকে দেখতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে মহিলা যেন নিজের মনেই বলল, কী করব? আমার কী করা উচিত।
যেটা করলে মন ভাল থাকবে তাই করা উচিত।
কিন্তু সেটা করতে চাইলে আমার চাকরি চলে যেতে পারে।
কেন?
যে আমায় চাকরি দিয়েছে তাকে অস্বীকার করতে হবে। আর তাহলেই সে রেগে যাবে। তাকে খুশি করতে আমি ইচ্ছের বিরুদ্ধে–।
কথাটা শেষ করতে পারল না মহিলা।
নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোনও কাজ করা ঠিক নয় মা।
তুমি আমাকে মা বলছ?
বাঃ। আপনি তো কঙ্কাবতীর মা। তাহলে আমার মা হবেন না কেন? আপনার শরীর এখন ভাল লাগছে?
হ্যাঁ। আচ্ছা বাবা, আসি। উঠে দাঁড়াল মহিলা।
আসুন। আবার দেখা হবে। আপনি জিজ্ঞাসা করছিলেন না মা মেরির সঙ্গে আমার কথা হয়েছে কিনা? পাথরের মূর্তি কী করে কথা বলবে? কিন্তু আপনি মানুষ, তাই আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারলাম।
কঙ্কাবতীর মা দ্রুত নীচে নেমে এলেন। অফিসঘরের দরজায় দাঁড়ানো মিসেস অ্যান্টনিকে দেখে এগিয়ে গেল, শুনুন, আমি ঠিক করলাম কোথাও যাব না এখন। তাই পুরনো ঠিকানাতেই আমাকে পাবেন।
কঙ্কাবতীর মা যখন হনহনিয়ে নিরাময় থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে তখন গণেশ গেটের সামনে। মহিলা তাকে লক্ষ করেনি বুঝে মাথা নাড়িয়ে হাসল গণেশ। তারপর প্যাসেজে পা রাখল।
.
২৪.
কঙ্কাবতীর মন ভাল ছিল না। মিসেস অ্যান্টনি হাসিমুখে জানিয়ে যাওয়ার পর মনে হল তার জন্যেই মাকে অনেক কিছু ছাড়তে হচ্ছে। যাব বলেও শেষ পর্যন্ত শিলিগুড়িতে যাচ্ছে না। তাকে যাওয়ার কথা বলে নীচে গিয়ে অন্য কথা কেন বলল সেটাই সে বুঝতে পারছিল না। অথচ মায়ের সঙ্গে কথা বলার সময় সে বুঝতে পারছিল যেতে পারলে মা খুশি হবে। একটা মানুষ দিনের পর দিন একই জায়গায় আটকে অভাবের সঙ্গে কতদিন লড়ে যেতে পারে! গেলে মায়ের জীবনে বৈচিত্র্য আসত। আর এই সব ভাবতেই তার মন আরও খারাপ হয়ে গেল। সে যদি এই ধরনের অসুখে আক্রান্ত না হত তা হলে মাকে এভাবে আটকে থাকতে হত না। তার রক্তে অসুখ ঢুকেছে। সাধারণ কোনও অসুখের মতো সেটা তাড়াতাড়ি সেরে যাওয়ার নয় তা এতদিনে সে বুঝে গেছে। নার্সিংহোমে সে কিছু বই মাকে দিয়ে আনিয়েছিল। কিন্তু এখন আর সেগুলোয় চোখ বোলাতে একটুও ইচ্ছে হয় না। সে স্কুলে যেতে পারবে কিনা, পরীক্ষায় বসতে পারবে কিনা তার কোনও নিশ্চয়তা নেই।
হঠাৎ দরজায় কেউ এসেছে বুঝতে পেরে মুখ ফিরিয়ে অবাক হয়ে গেল কঙ্কাবতী। গণেশ দাঁড়িয়ে আসছে। সে উঠে বসে চাদরটা গলা পর্যন্ত টানতেই গণেশ ঘরে ঢুকে টুলের ওপর বসল, বাঃ, বেশ আছ। সুন্দর ব্যবস্থা।
কী চাই? কঙ্কাবতী জিজ্ঞাসা করল।
তোমাকে দেখতে এলাম। গণেশ হাসল।
আসার দরকার ছিল না। কঙ্কাবতী মুখ ফেরাল।
বাঃ। আমি তোমাকে এখানে ভর্তি করালাম আর আমি আসব না? পার্টির চাপ না থাকলে ওই শালা ডাক্তার তোমাকে বিনা পয়সায় এখানে রাখত? কখনও না। বাঙালিরা শুধু পয়সা কামাবার ধান্দায় পাহাড়ে এসে থাকে। গণেশ পকেট থেকে সিগারেট প্যাকেট বের করল।
খবরদার, তুমি এখানে সিগারেট খাবে না।
কেন? আমি তো হাসপাতালে গিয়েও খাই।
এখানে খাওয়া নিষেধ।
আচ্ছা। ঠিক আছে, খাব না। প্যাকেট পকেটে ঢুকিয়ে রেখে গণেশ হাসল, তোমার মা একটু আগে এসে কী বলে গেল?
তাতে তোমার কী দরকার?
এই। মুখ শক্ত হল গণেশের, এত চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলছ কেন? তোমাকে আমার ভাল লেগেছিল বলে আসাযাওয়া করি। কোনওদিন বেইজ্জত করিনি। তোমার মা কী করছে তা জানো?
কঙ্কাবতী অবাক হয়ে তাকাল।
গণেশ বলল, মায়ের খারাপ কাজের কথা শুনতে কোনও ছেলেমেয়ের ভাল লাগে না জানি। কিন্তু যা সত্যি তা তোমার শোনা দরকার।
কী বলতে চাইছ?
আমি শালা তোমার সঙ্গে ধান্দা করব বলে অ্যাসিস্ট্যান্ট লোক্যাল সেক্রেটারিকে নিয়ে তোমাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। যাতে তোমাদের উপকার করা যায়। লোকটা তোমার মায়ের সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করছে। হাসল গণেশ।
কঙ্কাবতীর চোখ ছোট হল।
এসব কথা আমাকে বলে তোমার কী লাভ হবে?
বলব না? নিজের মাকে সতর্ক করো।
মায়ের ব্যাপার মা-ই ভাল বুঝবে।
বুঝতে পারলে ভাল হত। এই যে শুকনাতে যে মিটিং হচ্ছে তাতে আমরাই যাচ্ছি না তো তোমার মায়ের যাওয়ার কী দরকার? আমি জানি মিটিং-এর পরে ওরা শিলিগুড়িতে গিয়ে কোনও হোটেলে উঠবে। তুমি জানো কি তোমার মা শুকনায় যাচ্ছে? জানো না। এখানে অসুবিধে বলে শিলিগুড়ির হোটেলে থাকবে।
তুমি এই ঘরে কী করে এলে? কঙ্কাবতীর কণ্ঠস্বর পাল্টে গেল।
মানে? গণেশ অবাক।
এখানে আসার সময় কেউ বাধা দেয়নি? বাধা দেবে?
আমাকে? কারও হিম্মত আছে? হুঁঃ। জিজ্ঞাসা করতেই তোমার ঘর দেখিয়ে দিল। হাসল গণেশ।
তুমি এখনই এখান থেকে চলে যাও।
যদি না যাই?
আমি চেঁচাব। ডাক্তারবাবুকে ডাকব।
হারামিটাকে ডাকো। ওর ব্যবসা করা আজই ঘোচাচ্ছি।
এই সময় মিসেস অ্যান্টনি দরজায় এসে দাঁড়ালেন। তাকে দেখল গণেশ। তারপর উঠে দাঁড়াল, তোমার উপকার করতে এসেছিলাম। তুমি বহুত খারাপ ব্যবহার করলে। আরে তোমার সম্পর্কে আমার মনে এক সময় ধান্দা এসেছিল ঠিকই কিন্তু এখন সেটা নেই। কেন নেই জানো? ডাক্তার তামাং আমাকে সব কথা খুলে বলেছে। তোমার রক্তে ক্যানসার হয়েছে। বেশি দিন বাঁচবে না তুমি। যে মেয়ে বেশি দিন বাঁচবে না তার সঙ্গে প্রেম করে কী লাভ?
কথাটা বলেই হনহন করে বেরিয়ে যাচ্ছিল গণেশ। মিসেস অ্যান্টনি খপ করে তার হাত চেপে ধরতেই সে দাঁড়িয়ে গেল। প্রচণ্ড রেগে গিয়ে মিসেস অ্যান্টনি বললেন, এসব কথা বলতে তুমি এখানে এসেছ? বদমাইস। চলো, তোমার ব্যবস্থা করছি।
গণেশ হাত ছাড়াবার চেষ্টা করতেই মিসেস অ্যান্টনি চিৎকার করলেন, দারোয়ান, দারোয়ান! জলদি এসো।
ততক্ষণে হাত ছাড়িয়ে দৌড়োতে শুরু করেছে গণেশ। কিন্তু নীচে নামার সিঁড়ির মুখে তার সঙ্গে বড়বাহাদূরের সংঘর্ষ হয়ে গেল। দু হাতে তাকে জাপটে ধরল বড়বাহাদুর। প্রচণ্ড চিৎকার করে গালাগাল দিচ্ছিল গণেশ। তাকে টানতে টানতে নীচে নামাতেই ডাক্তার বললেন, ওকে অফিসরুমে নিয়ে এসো।
অফিসের সামনে কর্মচারীদের ভিড় দেখে সায়ন কৌতূহলী হল। এই নিরাময়ে এমন দৃশ্য দেখা যায় না। সে ভিড় সরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই শুনল ডাক্তার বলছেন, তুমি চুপ করে বসে থাকো। মিসেস অ্যান্টনি, কী হয়েছে বলুন তো?
মিসেস অ্যান্টনি উত্তেজিত ছিলেন। তাঁর মুখ থেকে নেপালি বেরিয়ে এল। তিনি যা শুনেছেন তা দ্রুত বলে ফেললেন। ডাক্তার গণেশের দিকে তাকালেন। গণেশ উদ্ধত ভঙ্গিতে একটা চেয়ারে বসেছিল। ডাক্তার তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। তারপর নিচু গলায় বললেন, ঠাণ্ডা মাথায় যারা মানুষের ক্ষতি করতে চায় তাদের কী শাস্তি পাওয়া উচিত?
আমি কারও ক্ষতি করিনি। আপনারা কিন্তু নিজের বিপদ ডেকে আনছেন। এইভাবে আমাকে আটকে রাখার জন্যে বহুত দাম দিতে হবে, মনে থাকে যেন!
দাম তুমি আর কী নেবে হে! ডাক্তার এগিয়ে গেলেন দরজার দিকে। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে বড়বাহাদুরকে বললেন, ও যেন পালাতে না পারে। আমি ফিরে আসা পর্যন্ত এই ঘরে ওকে আটকে রাখবে।
গাড়ি বের করলেন ডাক্তার গ্যারাজ থেকে। সায়ন এগিয়ে গেল, আমি আপনার সঙ্গে যাব?
মাথা নাড়লেন ডাক্তার, না। তুমি এখানেই থেকো, দেখো যেন আর কোনও ঝামেলা না হয়। আর হ্যাঁ, মেয়েটার অবস্থা নিশ্চয়ই ভাল নেই। ওর সঙ্গে কথা বলো। আমি এখনই ফিরে আসছি।
যত দ্রুত সম্ভব গাড়ি চালিয়ে ডাক্তার থানায় এলেন। থানায় লোক নেই বললেই চলে। একজন সেপাই বলল, চেয়ারম্যান সাহেব সোনাদা এসেছেন বলে সাহেবরা সেখানে গিয়েছেন।
কোনও বিশেষ কারণে চেয়ারম্যান যদি ওসিকে ডেকে পাঠান তা হলে তিনি থানা ছেড়ে যেতেই পারেন। যদিও ওসির ওপর তাঁর সরাসরি কর্তৃত্ব নেই। সোনাদা এখান থেকে বেশি দূরে নয়। মিনিট দশেকের মধ্যে সেখানে পৌঁছে ডাক্তার জানতে পারলেন স্থানীয় একটি স্কুলে সম্মেলন হচ্ছে এবং চেয়ারম্যান ইতিমধ্যেই পৌঁছে গিয়েছেন। স্কুলের গেটের বাইরে গাড়ি রেখে ভেতরে ঢোকার সময় ক্যাডাররা বাধা দিল। কার্ড ছাড়া ঢোকা যাবে না। এটা দলীয় সম্মেলন। বাইরের লোকদের প্রবেশ নিষেধ।
ডাক্তার বললেন, আমাকে দলের বাইরের মানুষ বলে কেন ভাবছ?
আপ বাঙ্গালি হ্যায় না?
হ্যাঁ।
তো!
এর জবাবে কী বলা যায় ভেবে পাচ্ছিলেন না ডাক্তার। যে ছেলেটি তার সঙ্গে কথা বলছে তার জন্মের আগেই তিনি এই পাহাড়ে চলে এসেছিলেন।
ডাক্তার বললেন, ঠিক আছে। আমি এখানেই অপেক্ষা করছি। তুমি যদি দয়া করে ওসি সাহেবকে খবর দাও তা হলে কৃতার্থ হব।
কোন ওসি? এখানে তো তিনটে থানার ওসি হাজিরা দিয়েছে।
ডাক্তার তাঁর এলাকার নাম বললেন।
মিনিট চারেক বাদে ভদ্রলোককে দেখতে পেলেন ডাক্তার। হাসি হাসি মুখের নেপালি ভদ্রলোক অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, আরে! ডাক্তার। আপনি এখানে?
আপনার সঙ্গে একটু দরকার ছিল।
নিশ্চয়ই খুব জরুরি, না হলে এখানে আসতেন না। আসুন, ভেতরে আসুন।
এটা দলীয় সম্মেলন। এই ছেলেটি বলছে ওখানে যাওয়ার অধিকার আমার নেই।
ওসি ছেলেটির দিকে তাকালেন, কাকে কী বলছ তুমি? ওঁকে আসতে বলো।
ছেলেটি ইশারা করল বাঁ হাত নেড়ে ভেতরে যেতে।
লনে বেশ ভিড়। সবাই নিচু গলায় কথা বলছে। ওসি ডাক্তারকে নিয়ে একপাশে সরে এলেন, বলুন, প্রব্লেম কী?
ডাক্তার ঘটনাটা বললেন। তারপর যোগ করলেন, আমরা কোনও মানুষকে সুস্থ করতে পারি না, তার আয়ু যাতে বাড়ে সেই চেষ্টা করি। কিন্তু এই ছেলেটি মানসিক আঘাত দিয়ে মেয়েটির ক্ষতি করেছে। সে জানত না তার লিউকোমিয়া হয়েছে। জানি না এটা শোনার পর সে কী করবে?
ওসি মাথা নাড়লেন, ভেরি বাড। ওর প্রচণ্ড শাস্তি হওয়া উচিত। কিন্তু আমার মনে হয় পুলিশের এক্ষেত্রে কিছু করার নেই।
কেন? ও অপরাধ করেছে।
করেছে। কিন্তু এটা এমন অপরাধ যা আইনের ফাঁক খুঁজে পাবে। ছেলে যদি বাবাকে খেতে না দেয়, অনাহারে বাবা যদি মারা যায় তা হলে পুলিশ ছেলেকে শাস্তি দিতে পারে না। অপরাধ করেও ছেলে বেঁচে যায়। হ্যাঁ, বিদেশের আইন মানসিক আঘাত দেওয়ার জন্যে ছেলেটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সক্ষম। এ দেশে শারীরিক আঘাতই প্রতিকার পায় না। ছেলেটার নাম কী?
গণেশ। সে একজন রাজনৈতিক কর্মী। তার দলের সম্মেলন এখানে হচ্ছে অথচ এখানে না এসে সে একটি অসুস্থ মেয়ের ক্ষতি করতে নিরাময়ে গিয়েছে।
গণেশ। বুঝতে পেরেছি। ছেলেটা খুব বজ্জাত। তার অবশ্য এখানে আসার কথা নয়। এটা দলের অন্য শাখার সম্মেলন। কিন্তু ও জানল কী করে মেয়েটার লিউকোমিয়া হয়েছে? ওসি জিজ্ঞাসা করলেন।
ডক্টর তামাং নাকি ওকে বলেছেন।
ওসি বললেন, ডক্টর! আপনি আমার অবস্থা বুঝতে চেষ্টা করুন। একটা মেয়েকে মানসিক আঘাত দিয়েছে বলে ওকে আমি অ্যারেস্ট করলে কোর্টে জামিন পেয়ে যাবে। যদি কোর্টে না পাঠিয়ে মারধর করি তা হলে পার্টি আমার বারোটা বাজিয়ে দেবে। দলের যে কোনও ক্যাডারের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেওয়ার আগে লোক্যাল কমিটির সঙ্গে কথা বলতে হয়।
কিন্তু ছেলেটা আমাকে শাসিয়েছে।
হ্যাঁ। ওর নাম গণেশ বলেই আমি আপনাকে অন্য পথে যেতে বলছি।
কোন পথ?
আসুন আমার সঙ্গে। ওসি এগোলেন।
ভিড় ঠেলে ওসি ভেতরে ঢুকলেন। সেখানে কয়েকজন গম্ভীর চেহারার লোকের সঙ্গে ডাক্তার তামাং কথা বলছিলেন। ওসির সঙ্গে ডাক্তারকে দেখে অবাক হয়ে গেলেন তিনি। ওসি তাঁকে বললেন, ডক্টর এসেছেন। ওঁর সমস্যা হয়েছে। কথা বলবেন!
ডাক্তার তামাং জিজ্ঞাসা করলেন, কী ব্যাপার?
আপনি যে মেয়েটিকে আমার নিরাময়ে ভর্তি করতে বলেছিলেন তার ট্রিটমেন্ট চলছে।
হ্যাঁ। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
কিন্তু আমি তাকে নিয়ে সমস্যায় পড়েছি।
কী রকম?
মেয়েটি জানত না তার লিউকেমিয়া হয়েছে। সম্ভবত ভেবেছিল অ্যানিমিয়ায় ভুগছে। কিন্তু আজ একটি ছেলে এসে তাকে জানিয়ে গিয়েছে রোগটা কী?
মাই গড। হু ইজ হি?
তার নাম গণেশ।
গণেশ। আপনি চেনেন? ওসিকে জিজ্ঞাসা করলেন ডাক্তার তামাং।
ওসি বললেন, চিনি। এই সংগঠনের কর্মী।
সে জানল কী করে মেয়েটির কী অসুখ হয়েছে? ডাক্তার তামাং উত্তেজিত হয়ে গেলেন। হঠাৎ তাঁকে অন্য রকম দেখাল।
ডাক্তার বললেন, ও বলেছে আপনার কাছ থেকে রোগের নাম জেনেছে।
আমার কাছ থেকে? ওঃ, নো। ডাক্তার তামাং অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন, ওহো, হ্যাঁ, মনে পড়ছে। ছেলেটি ওদের নিয়ে আমার কাছে এসেছিল। দু-দুবার রক্ত পরীক্ষা করার পর যখন বুঝলাম টেন্ডেন্সি কী তখন বলেছিলাম চিকিৎসার খরচ অনেক পড়বে। ও বলেছিল পার্টির কাছে অ্যাপিল করতে। আমি একটা সুপারিশ করেছিলাম। তাতে যে অসুখটাকে সন্দেহ করছি তার নাম উল্লেখ করা ছিল। কিন্তু চিঠিটা একটা খামে বন্ধ করে দিয়েছিলাম। ও বলেছিল লোক্যাল কমিটির সেক্রেটারিকে দিয়ে দেবে। ওটা ওর পড়ার কথা নয়।
ও পড়েছে। ডাক্তার বললেন।
ছেলেটা কোথায়?
আমার ওখানে আটকে রেখেছি।
বেশ করেছেন। ওসি আপনি স্টেপ নিন। ওই ছেলে একটা ক্রিমিন্যাল।
আইনের ফাঁক থেকে যাচ্ছে ডক্টর তামাং। আমি প্রমাণ করতে পারব না ও কোনও অন্যায় করেছে। তবে ডক্টরকে শাসিয়েছে বলে ব্যবস্থা নিতে পারি। ওসি বললেন।
ডাক্তার তামাং ওঁদের একটু অপেক্ষা করতে বলে এগিয়ে গেলেন। পার্টির এক বড়কর্তার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলার পর মূল ভিড়টির দিকে এগিয়ে গেলেন।
ডাক্তার কিছু বলার আগেই ওসি বললেন, ডাক্তার তামাং চেয়ারম্যানের কাছে গেলেন। দেখুন, উনি কী বলেন। উনি যদি গ্রিন সিগন্যাল দেন তা হলে কোনও চিন্তা নেই। ওঁর কথাই শেষ কথা।
এত সামান্য ব্যাপার নিয়ে ওঁকে বিরক্ত করা কি ঠিক হচ্ছে?
ওসি মাথা নাড়লেন। ঠিক কী বোঝাতে চাইলেন তা বোঝা গেল না। তিনি ঘড়ি দেখলেন, ডক্টর, আমাকে একটু যেতে হচ্ছে। আপনি অপেক্ষা করুন।
ওসি চলে গেলেন। ডাক্তার লক্ষ করলেন সবাই তাঁকে দেখছে। আজ ডাক্তার তামাং-এর প্রতিক্রিয়া দেখে খুব ভাল লাগছে তাঁর। ভদ্রলোকের আগের ব্যবহার আর আজকের উদ্যোগের মধ্যে কোনও মিল নেই। একটু পরেই একজন এসে বলল, আপনাকে চেয়ারম্যান ডাকছেন।
ডাক্তার এগোতেই তাঁর পোশাক পরীক্ষা করা হল। কোনও অস্ত্র নেই দেখে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল চেয়ারম্যানের কাছে। সাধারণ নেপালিদের পোশাক পরে ভদ্রলোক কথা বলছিলেন কয়েকজনের সঙ্গে। ডক্টর তামাং একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। সমস্ত গোর্খাদের জন্যে আলাদা রাজ্যের আন্দোলন শুরু করেছিলেন যিনি, সেই ভয়ঙ্কর পাহাড়ি যুদ্ধে যিনি স্বয়ং অংশগ্রহণ করেছিলেন কি না জানা নেই কিন্তু তাঁর দাপটে দিল্লি কেঁপেছে অনেকবার, পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার নতজানু হয়ে নিজের সম্ভ্রম বিকিয়ে বসে আছে অনেককাল। পশ্চিমবঙ্গের কোনও মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান যা স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না তা এই চেয়ারম্যান বাস্তবে সম্ভব করেছেন। গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের সময় এই মানুষটির প্রভাব ছিল আকাশছোঁয়া। কিন্তু ক্ষমতা ও অর্থ আদায়ের পর দলে এবং আনুগত্যে ভাঙন দেখা দিল। দল এবং উপদল ছড়িয়ে পড়েছে পাহাড়ে পাহাড়ে। যারা ছিল মুক্তিযুদ্ধের কাঁধ মেলানো সৈনিক তারা এখন ক্ষমতার স্বাদ না পেয়ে হয়ে গেছে বিক্ষুব্ধ। তবু এখনও, দার্জিলিং-এর এই পাহাড়ে এর অবস্থান সবার আগে। এর সামান্য ইশারায় এখানকার মানুষের জীবনধারা পরিবর্তিত হয়ে যায়। গত লোকসভা নির্বাচনে ইনি চেয়েছিলেন পাহাড়ের মানুষ কোনও ভোট দেবে না। কারণ কোনও দলই পাহাড়ের মানুষের অভাব দূর করার প্রতিশ্রুতি দেয়নি। আর যদি নির্বাচনের ফায়দা তোলার জন্যে দিয়ে থাকে তাহলে সেই প্রতিশ্রুতি বিশ্বাসযোগ্য নয়। তাঁর ইচ্ছা বাস্তবায়িত হয়েছে। পাহাড়ে ভোট পড়েনি বললে সত্যি কথা বলা হয়।
চেয়ারম্যান ডাক্তারের দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন, নমস্তে। আপনার নার্সিংহোম কী রকম চলছে ডাক্তার?
সরি স্যার। আমি নিরাময়কে ঠিক নার্সিংহোম বলতে চাই না।
ও, হ্যাঁ। আপনি তো ব্যবসা করেন না। আপনার অ্যাপ্লিকেশন আমি পেয়েছি। মুশকিল হল, পশ্চিমবঙ্গ সরকার আমাদের এত কম টাকা দেয় যে আমরা অনেক কিছুই করে উঠতে পারি না। দিল্লিকে বললে তারা আবার পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে দেখিয়ে দেয়। যাক গে, আপনার সমস্যার কথা বলুন। চেয়ারম্যান খুব ধীরে ধীরে কথা বললেন।
আমার মনে হয় ডক্টর তামাং আপনাকে সব জানিয়েছেন।
হ্যাঁ। উনি যা বলেছেন সেটা কি কোনও নতুন সমস্যা?
তার মানে?
পশ্চিমবাংলার গ্রামে গ্রামে ঘুরে দেখুন, যারা বি জে পি-কে ভোট দিয়েছে, তৃণমূলকে ভোট দিয়েছে তাদের কী ধরনের সমস্যার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে সি পি এম। হাইকোর্ট বলেছে মাইক বাজিয়ে সভা করা চলবে না। আপনাদের জ্যোতিবাবু কী করলেন? একজন সরকারি অফিসার হাইকোর্টের আদেশ মানতে চাইলেন বলে রেগে যা-তা বললেন। উনি যদি এমন করতে পারেন তা হলে আমার একজন ক্যাডার তা করতেই পারে। আপনি নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে-দল ক্ষমতায় থাকে তাদের কর্মীরা একটু-আধটু বেপরোয়া কথা বলে থাকেই। চেয়ারম্যান হাসি মুখে তাকালেন।
ডাক্তার মাথা নাড়লেন, আপনার কাছে এসব কথা শুনব আশা করিনি।
চেয়ারম্যান একজনকে বললেন, ডাক্তার দাঁড়িয়ে আছেন। ওঁকে চেয়ার দাও।
সঙ্গে সঙ্গে একজন একটা চেয়ার এগিয়ে দিল।
চেয়ারম্যান বললেন, বসুন ডাক্তার।
আমি ঠিক আছি। ডাক্তার বললেন।
আপনাকে আমি অনুরোধ করছি বসার জন্যে।
ডাক্তার বুঝলেন এই অনুরোধের অন্য নাম আদেশ। তিনি বসলেন।
চেয়ারম্যান কয়েক মুহূর্ত ভাবলেন, হুগলি বলে পশ্চিমবঙ্গে একটা জেলা আছে। একটি পরিবার সেই জেলার এক গ্রামে থাকত। বর্ধিষ্ণু পরিবার, প্রচুর জমি, পুকুর। তারা কোনও পার্টি করত না। সব পার্টি চাঁদা চাইতে এলে দিয়ে দিত। চাষের সময় সাঁওতালরা আসত, তাদের দৈনিক মজুরি দিয়ে চাষ করাত, ধান কাটাত। হঠাৎ পঞ্চায়েত বলল, বাইরের লোকদের দিয়ে ওসব কাজ করানো চলবে না। লোক্যাল বেকার ছেলেদের দিয়ে করাতে হবে। যাদের তারা পাঠাল তারা জিন্দেগিতে ওসব কাজ করেনি। পরিবারটি আপত্তি জানাল। পরের দিন ওদের বাড়িতে ডাকাতি হয়ে গেল। নিঃস্ব করে দিয়ে চলে গেল লোকগুলো। কেউ বাধা দিতে এল না। ওরা ছুটে গেল থানায়। থানা ডায়েরি নিল না। ওরা গেল পঞ্চায়েতে। তারা বলল, যারা ডাকাতি করেছে তাদের নাম দিতে। মুখে কাপড় বাঁধা ডাকাতদের নাম তারা বলতে পারল না। ভয়ে ওরা পালিয়ে গেল কলকাতায়। তারপর লোক ধরে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের একজন বড়কর্তার চিঠি পৌঁছে দিল পঞ্চায়েতে। পঞ্চায়েতের প্রধান সেই চিঠি পড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল। ওরা গেল লালবাজারে। লালবাজার হুগলির এস পি-কে বলল তদন্ত করতে। তিনি তদন্ত করছেন। আগামী যত বছর বামফ্রন্ট ক্ষমতায় থাকবে ততদিন তিনি তদন্ত করে যাবেন। ডাক্তার, আপনি আমার কথা কি বুঝতে পারছেন? চেয়ারম্যান জিজ্ঞাসা করলেন।
পারছি। ডাক্তার মাথা নামালেন।
অতএব আমার দলের একজন ক্যাডার যদি আপনাকে শাসিয়ে থাকে তাহলে সে শিক্ষা পেয়েছে ওদের কাছ থেকে। তাই না? চেয়ারম্যান হাসিমুখে বললেন!
ডাক্তার বললেন, মাননীয় চেয়ারম্যান স্যার। আমি রাজনীতি বুঝি না। আমি ডাক্তার, মানুষের কাজে নিজেকে লাগাতে চাই। তবে আমার সামান্য বুদ্ধিতে বুঝেছি, পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের কোনও জায়গা নেই। তুলনায় সি পি এম অনেক সুসংহত দল। তাদের ভাবনাচিন্তায় নিজস্বতা আছে। তারা যা করতে চায় তা সব সময় সম্ভব হয়ে ওঠে না। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মানুষের পাশে কারও যদি দাঁড়াবার অধিকার থাকে তা হলে তা সি পি এমের আছে। তাদের ক্যাডাররা যা গ্রামে গ্রামে করছে তা নিশ্চয়ই আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের অনুমোদন ছাড়াই করছে। আমি এই কথা বিশ্বাস করি।
চেয়ারম্যান বললেন, আপনি বললেন আপনি রাজনীতি বোঝেন না। কিন্তু যে কথাগুলো বললেন তাতে স্পষ্ট আপনি সি পি এমের সমর্থক। তাই না?
ডাক্তার বললেন, আমি কি উঠে দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারি?
কেন? বসে কথা বলতে কি অসুবিধে হচ্ছে?
হ্যাঁ। আপনি দাঁড়িয়ে আছেন। চেয়ারে বসে নিজেকে একজন অভিনেতা বলে মনে হচ্ছে।
বেশ। যাতে আপনি স্বচ্ছন্দ হন তাই করুন।
ডাক্তার উঠে দাঁড়ালেন, মাননীয় চেয়ারম্যান স্যার। ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পর কংগ্রেস ক্ষমতায় এল। তাদের ক্যাপিটাল ছিল গাঁধীজি। দেশ গঠনের জন্যে কোনও সঠিক পদ্ধতি তাদের আয়ত্তে ছিল না। শুধু সেন্টিমেন্ট ভাঙিয়ে তারা দীর্ঘদিন রাজত্ব করে গেছে। সেই তুলনায় সি পি এম অনেক বৈজ্ঞানিক দল। তাদের কাজকর্ম, আদর্শ, কাজ করার ইচ্ছে অনেক বেশি বিজ্ঞান এবং জীবননির্ভর। তাদের শরিক দলগুলোর কোনও অস্তিত্ব পশ্চিমবঙ্গে নেই। এরা আলাদা দাঁড়ালে কেউ নির্বাচিত হবে না। এটা সি পি এম জানে। জেনেও এরা এদের বহন করে চলেছে। এইটেই সি পি এমের উদার। তাই না?
কেন?
এদের ছাড়াই সি পি এম পশ্চিমবঙ্গে রাজত্ব করতে পারত। কিন্তু সি পি এমের সমর্থন ছাড়া এই দলগুলো মুছে যেত। যেহেতু এরা কংগ্রেসবিরোধী তাই সি পি এম এদের বহন করে চলেছে। ফলে ভুলভ্রান্তি হওয়া স্বাভাবিক। তবে আপনি হুগলির যে ঘটনার কথা বললেন তা আমি অস্বীকার করছি না। নীচের তলার কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি ওরা। ডাক্তার ধীরে ধীরে কথা বলছিলেন।
বাঃ। আপনি সি পি এমের সমর্থক তা শেষ পর্যন্ত স্বীকার করলেন।
আপনি ভুল করছেন। আমি কোনও রাজনৈতিক দলের সমর্থক নই।
কিন্তু আপনি তো ওদের হয়ে ওকালতি করছেন।
নিয়মিত খবরের কাগজ পড়লে সাধারণ মানুষের যে ধারণা তৈরি হয় আমি তার কথাই বলেছি। নিরাময়ে কোনও রাজনৈতিক দলের ছায়া পড়তে দিইনি।
আমাদের আন্দোলন সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?
পাহাড়ের মানুষের অভাব আছে। তাদের ওপর বহুদিন ধরে অবিচার করা হয়েছে। কিন্তু একজন ভারতীয় হয়ে ভারতবর্ষকে টুকরো হয়ে যেতে দেখতে চাই না।
বাঃ। আপনি একজন শিক্ষিত লোক হয়েও অশিক্ষিতের মতো কথা বলছেন। ব্রিটিশরা এদেশে আসার আগে ওই ভারতবর্ষ কনসেপ্ট ছিল? মোগলরাও তাদের স্বার্থে যা করতে পারেনি তা ব্রিটিশরা পেরেছিল। গায়ের জোরে সবাইকে মাথা নিচু করিয়ে ইন্ডিয়ান ছাপ দিয়েছিল। তাদের ভয়ে মানুষ দুশো বছর ধরে অনেক কিছু মেনে নিয়েছে। ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পর প্রায় তিরিশ বছর লেগেছে ঘোর কাটতে। এখন যে যার পুরনো দাবির কথা তুললে আপনি বললেন ভারতবর্ষ খণ্ডবিখণ্ড হচ্ছে? আমার কোনও নেপালি ভাইয়ের জীবনযাপন, ভাবনাচিন্তার সঙ্গে তামিল গুজরাতির সামান্য মিল আছে? আপনার কলকাতার বাঙালিরা দার্জিলিং-এ বেড়াতে এসে ভাবে না এটা তাদের বাংলা নয়? বলুন? ওই ব্রিটিশের চাপিয়ে দেওয়া ভারতবর্ষ সেন্টিমেন্ট আমি মানি না। আমি মনে করি সংবিধান পাল্টে নতুন করে রাজ্যগুলোকে গঠন করা দরকার। যে যার কালচার নিয়ে আলাদা থাকবে আমেরিকার স্টেটগুলোর মতো। ডিফেন্স থাকবে সেন্টারের হাতে। নতুন নাম হবে ইউনাইটেড স্টেটস অব ইন্ডিয়া। চেয়ারম্যান গম্ভীর গলায় কথাগুলো বলতেই একজন নেতা এগিয়ে এসে তাঁর কানে নিচু স্বরে কোনও খবর দিলেন।
চেয়ারম্যান বললেন, ওয়েল, ডক্টর, আপনি মানুষের উপকার করছেন বলে আমি আপনার কোনও ক্ষতি বরদাস্ত করব না। ছেলেটি কোথায়?
আমার ওখানেই ওকে রাখা হয়েছে।
ছেড়ে দিন। চেয়ারম্যান আর দাঁড়ালেন না।
ডাক্তার তামাং এগিয়ে এলেন, আপনি খুব ভাগ্যবান।
কী রকম?
চেয়ারম্যান কারও সঙ্গে এত কথা বলেন না। পছন্দ না হলে বড় মাপের ভি আই পি এলেও দেখা করেন না। ডাক্তার তামাং মাথা নাড়লেন।
.
দরজায় দাঁড়িয়ে সায়ন দেখল কঙ্কাবতীকে। চুপচাপ ঘাড় বেঁকিয়ে জানলার বাইরে যে গাছটা তার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর এই ভঙ্গিতে পৃথিবীর সব বিষণ্নতা মাখামাখি। এই যে সে দরজায় দাঁড়িয়ে সেটাও ওর অনুভূতিতে নেই।
সায়ন বলল, আসব।
কঙ্কাবতী চমকে তাকাল। সায়ন দেখতে পেল চোখের কোণে দু ফোঁটা জল জমেছিল এতক্ষণ, মুখ ফেরাতেই তারা গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে। চকিতে মুছে নিল কঙ্কাবতী। কিন্তু কিছু বলল না।
ঠিক আছে, পরে না হয় আসব। সায়ন ঘুরে দাঁড়াল।
না। কঙ্কাবতী চাপা গলায় বলল।
সায়ন অবাক হল। তারপর ভেতরে ঢুকে টুল টেনে বসল। কঙ্কাবতী মুখ নামাল। তারপর বালিশ টেনে কোলের ওপর তুলে তাতে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। এ ঘরে আসার আগে সায়ন ভেবেছিল কঙ্কাবতী নিশ্চয়ই খুব কান্নাকাটি করছে। মিসেস অ্যান্টনি অনুরোধ করা সত্ত্বেও সে এখানে আসতে ইতস্তত করছিল। তাহলে কি এতক্ষণ কঙ্কাবতী কাঁদেনি? ওই পাতা ঝরে যাওয়া ন্যাড়া গাছটার দিকে অপলকে তাকিয়েছিল? সে দেখল কান্নার দমকে মেয়েটার পিঠ ওঠানামা করছে। সায়ন নিচু গলায় বলল, কে কী বলে গেল তাই শুনে ভেঙে পড়ছ কেন?
কঙ্কাবতীর কোনও প্রতিক্রিয়া হল না। একই ভঙ্গিতে কেঁদে যাচ্ছিল সে।
সায়ন বলল, আমাদের শরীরে রক্ত কম। ডাক্তারবাবু বলেন, একশো ফোঁটা রক্ত নিংড়ে এক ফোঁটা চোখের জল তৈরি হয়। তুমি এভাবে কাঁদলে আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে কঙ্কা।
আমি বাঁচব না। লিউকোমিয়া হলে কেউ বাঁচে না। মুখ তুলল না মেয়েটি।
কে বলল তোমায় লিউকোমিয়া হয়েছে?
মাথা তুলল কঙ্কাবতী। কান্নায় ভাঙচুর হয়ে যাওয়া মুখে বলল, আমি জানি। ব্লাড ক্যানসার আর লিউকোমিয়া একই।
তোমার যে ব্লাড ক্যানসার হয়েছে তা কে বলেছে?
ডাক্তার তামাং গণেশকে বলেছেন। বড় নিশ্বাস ফেলল কঙ্কাবতী, আমি এখন কী করব?
নিজের কথা ভেবে এত কাঁদছ, আচ্ছা, আমি এখানে কেন আছি কখনও ভেবেছ? আমার কী অসুখ? সায়ন জিজ্ঞাসা করল।
কঙ্কাবতী মুখ ফেরাল। সে যেন কিছুই বুঝতে পারছে না।
তোমার থেকে আমার শরীরে হেমোগ্লোবিন অনেক কমে যায় মাঝে মাঝে। তখন নাক আর কান দিয়ে পাতলা রক্ত বেরিয়ে আসে। তোমার কি সে রকম কখনও হয়েছে? হয়নি। তাই তো?
ঠোঁট টিপে মাথা নেড়ে না বলল কঙ্কাবতী।
তা হলে দ্যাখো, আমি তো তোমার মতো কেঁদে ভাসাচ্ছি না। আমি দিব্যি হেঁটে বেড়াচ্ছি, বাইরে যাচ্ছি, আর কদিন বাদে ডাক্তারবাবু আমাকে কাজের সুযোগ করে দেবেন। চোখ মোছো তুমি।
কিন্তু—
কোনও কিন্তু নয়। রক্তে ক্যানসার হওয়া মানেই সঙ্গে সঙ্গে মরে যাওয়া নয়। ডাক্তারবাবু বলেন ঠিকমতো চললে অনেকদিন ভালভাবে বেঁচে থাকা যায়। আচ্ছা, একদম সুস্থ মানুষ তো আচমকা অ্যাকসিডেন্টে মারা যায়। যায় না?
কঙ্কাবতী মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।
তা হলে? সায়ন হাসল, তুমি তো কঙ্কাবতী, যে কঙ্কা শঙ্কা করে না।
এবার সামান্য হাসল কঙ্কাবতী। তার পরেই উদাস হয়ে গেল।
আবার কী হল?
কিছু না।
কিছু তো ভাবছ। গণেশ কিছু বলেছে?
হ্যাঁ।
কী বলেছে?
ও আমার মায়ের বদনাম করছিল।
কী বলেছে?
মা নাকি—। আমি কিন্তু রাগ করিনি। মা জীবনে কিছুই পায়নি। আমার বাবা মদ খেয়ে সব উড়িয়ে দিত। মা কিছু বললে মারধরও করেছে। শুধু আমায় খুব ভালবাসত বাবা। তখন বুঝেছিলাম মানুষ দুরকম হয়। একরকম দেখে বিচার করতে নেই।
তোমার মায়ের কী বদনাম দিয়েছে ও?
মা নাকি একজনকে ভালবাসে। তার সঙ্গে শিলিগুড়ি যাচ্ছে আজ। মা আমার কাছে এসেছিল একটু আগে। বলব পার্টির কাজে শিলিগুড়িতে যেতে হচ্ছে। কিন্তু এখান থেকে চলে যাওয়ার পর মিসেস অ্যান্টনি এসে বলে গিয়েছিলেন মা কোথাও যাচ্ছে না। এখানেই আছে। অথচ তার পরে গণেশ এসে বলল মা চলে যাচ্ছে। মা যদি কারও সঙ্গে থেকে সুখী হয় তা হলে আমার খুব ভাল লাগবে। গণেশ যাই বলুক আমার কিছু এসে যায় না। কিন্তু মা আমার কাছে সত্যি কথা বলল না কেন? মা কি যায়নি? না গিয়েছে? কঙ্কাবতী যেন নিজের মনেই কথা বলে যাচ্ছিল।
সায়ন বলল, উনি যখন মিসেস অ্যান্টনিকে বলে গেছেন তখন নিশ্চয়ই যাননি। কঙ্কাবতী, তুমি খুব ভাল মেয়ে।
কঙ্কাবতী অবাক হয়ে তাকাল।
সায়ন বলল, তুমি মায়ের ভাল চাও। নিজের কথা ভাব না।
কঙ্কাবতী বলল, আমি তো মরেই যাব। আমি না থাকলে মায়ের কী হবে? তাই মা যদি সত্যি কাউকে পায়–।
তুমি যদি মরে যাওয়ার কথা বল তা হলে আর আমি তোমার সঙ্গে কথা বলব না। কেন মরবে তুমি? আচ্ছা, এই সময় তোমার শরীরে কোনও কষ্ট আছে?
না।
তা হলে? যতক্ষণ বাঁচবে ততক্ষণ মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করব আমরা।
সায়নের কথা শেষ হওয়ামাত্র পায়ের আওয়াজ হল। ডাক্তার তামাংকে নিয়ে ডাক্তার ঘরে ঢুকলেন। ডাক্তার তামাং কঙ্কাবতীর কাছে গিয়ে বললেন, আমি খুব দুঃখিত। গণেশ যা বলেছে তা সত্যি নয়।
কঙ্কাবতী অবাক হয়ে তাকাল।
আমি কখনও অন্য কাউকে পেশেন্টের অসুখের কথা বলি না। তোমার মাকে যখন বলিনি তখন গণেশকে কেন বলব? আর তোমার অসুখের ঠিক অবস্থাটা কী তা যখন আমি নিশ্চিত নই তখন বলতে যাব কেন? তুমি গণেশের কথায় কিছু ভেবে নিও না। বুঝলে মেয়ে?
সায়ন বলল, ও বুঝেছে।
ডাক্তার কঙ্কাবতীর মাথায় হাত বোলালেন, কাল থেকে তুমি অফিসে বসে আমাকে সাহায্য করবে। বুঝলে?
ওঁরা নেমে গেলে সায়ন উঠে দাঁড়াল, আমি এখন চলি।
না।
তুমি বিশ্রাম নাও।
আর একটু। অদ্ভুত গলায় বলল কঙ্কাবতী।
সায়ন আবার বসল। কঙ্কাবতী বাইরের দিকে তাকাল। সময় চলে যাচ্ছে। কেউ কথা বলছে। হঠাৎ কঙ্কাবতী চমকে উঠল। বাইরের ন্যাড়া গাছে একটা পাখি এসে বসল। সঙ্গে সঙ্গে গাছটা পাতায় পাতায় ভরে গেল। পাখিটা আনন্দে শিস দিতেই আর একটা পাখি উড়ে এল সেখানে। কঙ্কাবতী উত্তেজিত হয়ে বলল, আরে কী অদ্ভুত! বলতেই গাছটা আগের মতো ন্যাড়া হয়ে গেল। সে বোকার মতো মুখ ফেরাতেই দেখল সায়ন তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভেতরটায় অপূর্ব আরাম ছড়িয়ে পড়ল। সে মাথা নাড়ল, ঠিক আছে।