নন্দিনীর অনেক কিছু বলার ছিল কিন্তু তিনি কিছুই বললেন না। তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধে তিনি কখনও কথা বলেননি। বিয়ের পর বায়বাড়িতে এসে এক দিকে যেমন ঐতিহ্য, বংশগৌরব এবং রীতিনীতির কথা শুনেছেন তেমনই আর এক দিকে মেয়েবউদের চাপা অসন্তোষের সাক্ষী হয়ে থেকেছেন। সেই অসন্তোষ কখনই সীমা ছাড়াতে পারেনি, সেই সাহস কারও হয়নি। স্বামী অলস প্রকৃতির, পিতৃপুরুষের রেখে যাওয়া ব্যবসার কমিশন পেয়েই খুশি, এযাবৎকাল তিনি এই ছবি দেখতেই অভ্যস্ত। শ্বশুর শাশুড়ি চলে যাওয়ার পর যখন সংসারের দায়িত্ব নিতে হল তখন আবিষ্কার করলেন স্বামী তাঁর ওপর কিছু চাপিয়ে দিচ্ছেন না কিন্তু একটা প্রচ্ছন্ন লক্ষ্মণগণ্ডি চারপাশে এঁকে দিয়েছেন। সেই গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন নিজেকে, এ বাড়ির অনেক বউ তো ওইটুকু স্বাধীনতাও পায়নি।
সায়ন যখন অসুস্থ হয়ে পড়ল তখন পৃথিবীটা টলে গেল। ছেলে যখন অ্যাসেম্বলি অফ গড চার্চ হাসপাতালে তখন দুবেলা যাতায়াত করতে হত নন্দিনীকে। বিকেলে স্বামী সঙ্গে যেতেন। সকালে পাড়েজি ট্যাক্সি ডেকে এনে ড্রাইভারের পাশে বসত। এই যে প্রয়োজনে বেরুতে হবে তা কখনও ভাবেননি নন্দিনী, স্বামীর পক্ষেও মেনে না নিয়ে উপায় ছিল না। ছেলের জীবন নিয়ে যে টানাপোড়েন চলছিল তা অনেক রক্ষণশীলতার শেকড় আলগা করে দিল। সেই কারণে পরে, অনেক পরে, ছেলেকে দেখতে যখন পাহাড়ে গিয়েছিলেন তিনি তখন কোনও আপত্তি হয়নি। অথচ এই হঠাৎ পাওয়া স্বাধীনতার অপব্যবহার করেননি নন্দিনী। রায়বাড়ির বউয়ের তথাকথিত আব্রু তিনি বজায় রেখে চলেছেন!
কিন্তু একটু আগে সায়ন বলে গেল সে আগামীকাল চলে যাবে। এ বাড়িতে যে ঘটনা ঘটে গেল তারপর ছেলেকে আটকে রাখার কোনও ইচ্ছে তাঁর হচ্ছে না। অথচ ছেলে চলে গেলে খুব কষ্ট হবে তাঁর। ওর বাবা প্রচণ্ড রেগে আছেন। হয়তো তিনি নরম গলায় কথা বললে ছেলে মত বদলাতে পারে। সায়ন এখন আর কিশোর নয়। আর এবার ওকে যত দেখছেন তত অচেনা মনে হচ্ছে নন্দিনীর। একটি পূর্ণ বয়স্ক পুরুষের মতো ব্যবহার করছে মাঝে মাঝে। সায়নের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকালে বুকের ভেতরটা সিরসির করে ওঠে তাঁর। ওর কথার প্রতিবাদ করতে ইচ্ছে হয় না। আজ দুমড়ে যাওয়া মন নিয়ে নন্দিনী স্বামীর কাছে গেলেন।
সায়নের বাবা বিছানায় শুয়েছিলেন টানটান হয়ে। একটা হাত ভাঁজ করে চোখের ওপর রাখা। নন্দিনী স্বামীকে দেখলেন। কীভাবে শুরু করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। খাটের পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিলেন তিনি।
তোমাকে একটা কথা বলছি। ওর হয়ে কোনও সুপারিশ করবে না তুমি। চোখের ওপর থেকে হাত না সরিয়ে কথা বললেন সায়নের বাবা।
আমি কারও হয়ে সুপারিশ করতে আসিনি।
তাহলে কেন এসেছ?
এটা আমারও ঘর, এ ঘরে আসতে পারব না?
আমি তোমাকে চিনি।
কতটা চেন তুমি আমাকে?
এ নিয়ে তর্ক করতে আমার একটুও ইচ্ছে হচ্ছে না। আমার মাথা খুব গরম হয়ে আছে, আমাকে দিয়ে কথা বলিও না।
তাহলে তুমি চাও কাল সানু চলে যাক।
বাড়িতে চোখের সামনে দাঁড়িয়ে ঔদ্ধত্য দেখানোর চেয়ে সেটাই ভাল।
ওর পক্ষেও যুক্তি আছে। তুমি কথা বলে দ্যাখো।
সায়নের বাবা উঠে বসলেন, আমি ওর সঙ্গে কোনও কথা বলতে চাই না। ওইটুকুনি ছেলে আজ আমার মাথা হেঁট করে দিয়েছে। বাপের বয়সী একজনকে চূড়ান্ত অপমান করেছে। রায়বাড়ির মর্যাদাকে ধুলোয় নামিয়েছে।
কিন্তু ওই ভদ্রলোকও তো সৎ নন।
কে সৎ বা অসৎ তার বিচারের অধিকার ওকে কেউ দেয়নি। কই, সদু পর্যন্ত মেনে নিয়েছিল সব। আর ও কালকের যোগী দুদিন পাহাড়ে থেকে কালাপাহাড় হয়ে গেল?
কালাপাহাড়ের তুলনাটা যে খাটে না তা স্বামীকে মনে করিয়ে দিতে গিয়েও থেমে গেলেন নন্দিনী। বললেন, তাহলে যাক।
সায়নের বাবা বললেন, হ্যাঁ, যাক। আর একটা কথা, ওর খরচ বেশিদিন টানা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি এখনই সেটা বন্ধ করে দিচ্ছি না। কিন্তু তিন চার মাসের পর আর পারব না!
সে কী? আঁতকে উঠলেন নন্দিনী, এ কী বলছ তুমি?
এটাই আমার সিদ্ধান্ত।
তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল? ও অসুস্থ, কী ভয়ঙ্কর রোগের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে আছে, তুমি ভুলে গেলে?
না। আমি ভুলিনি। প্রথম যখন রোগ ধরা পড়েছিল সেদিনের কথা তোমার মনে আছে? ডাক্তার যখন বলল লিউকোমিয়া তখন তুমি কান্নায় ভেঙে পড়েছিলে। ও বেশিদিন বাঁচবে না জেনে প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিলে। তারপর ডাক্তার দত্ত যখন লড়াই করার আশ্বাস দিলেন তখন আমরা ভাবলাম যে কদিন বাঁচে সে কদিনই আমাদের লাভ। আমরা চিকিৎসার কোনও কার্পণ্য করিনি যদিও জানতাম ও কখনও সুস্থ হবে না। কিন্তু তার প্রতিদানে ও যা করল তাতে মনে হচ্ছে ভস্মে ঘি ঢেলে কী লাভ!
ভস্মে ঘি ঢালছ?
নয়তো কী? ছেলেবেলায় একটা ইংরেজি সিনেমা দেখেছিলাম। প্রচণ্ড বরফের মধ্যে আটকে পড়ে স্বামী-স্ত্রী শীতে কাঁপছে। একটা দেশলাই আছে কিন্তু আগুন জ্বালাবার মতো কিছু নেই। একটা কাঠ বা খড়কুটো, কিছুই না। হঠাৎ স্বামীর মনে পড়ল তার পকেটে কিছু টাকা আছে। সে সেই টাকা বের করে আগুন জ্বেলে স্ত্রীর সামনে ধরতে লাগল। কিন্তু অত অল্প আগুনে শীত যাচ্ছিল না। একে একে সব টাকা পুড়ে ছাই হয়ে গেল। ভোরের আগে স্ত্রী ঠাণ্ডায় মরে গেল। আলো ফুটলে স্বামী দেখল তার সামনে স্ত্রীর মৃতদেহ আর অনেক টাকার ছাই। স্ত্রীর সৎকার করতে যে টাকা লাগবে তা আর ওর কাছে নেই।
বাঃ। তোমার আজই মনে হল ওর পেছনে যে টাকা ঢালছ তা নেহাতই অপচয়। এমন কথা তুমি ভাবতে পারলে?
ও আমাকে ভাবতে বাধ্য করেছে। দু-এক বছর পর ও পৃথিবীতে থাকবে না। কিন্তু আমি থাকব, রায়বাড়ির বংশমর্যাদা থাকবে। যাও, আমাকে আর বিরক্ত কোরো না।
তুমি এত নিষ্ঠুর আমি জানতাম না।
বেশ তো, নতুন শিক্ষা হল।
সেবার তুমি ইচ্ছে করে আমার সঙ্গে পাহাড়ে যাওনি ওকে দেখতে।
এখন তুমি অনেক কিছু গবেষণা করে বের করতে পারো। আমার যা বলার তা স্পষ্ট বলে দিয়েছি। সায়নের বাবা বললেন, অনেক কিছু আমাদের খারাপ লাগে কিন্তু খারাপ লাগছে বলেই বিদ্রোহ করব এ কেমন কথা। আর ওর আচরণের সঙ্গে যখন আমার মানসম্মান জড়িয়ে আছে তখন ভাবা উচিত ছিল না? ন’বাবু বললেন, আহা, ক্যানসারের পেশেন্ট তো, মাথা গরম করে ফেলেছে, কদিনই বা বাঁচবে, হয়তো নতুন বাড়ি দেখে যেতে পারবে না। ভাল লাগল এসব কথা শুনতে?
অতএব নন্দিনীর কিছু করার নেই। অ্যাসেম্বলি অফ গড চার্চ-এর ডাক্তার বলেছিলেন, যতক্ষণ খাস ততক্ষণ আশ। ও যখন ফ্যাটাল পেশেন্ট নয় তখন লড়াই করার সুযোগ থাকছে।
সেই লড়াইটাই চলছিল। কিন্তু এখন কোথা থেকে কী হয়ে গেল।
আর একটু রাত বাড়লে নন্দিনী ছেলের ঘরে গেলেন। তাঁর মন বলছিল সায়ন যদি বাবার সঙ্গে নরম গলায় কথা বলে তাহলে পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে। তিনি দরজায় দাঁড়িয়ে অবাক হলেন। বিষ্ণুপ্ৰসাদ নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে কিন্তু সায়ন বিছানায় নেই, টয়লেটের দরজা আধা ভেজানো, আলো জ্বলছে না।
ছ্যাঁত করে উঠল বুক। নন্দিনী তড়িঘড়ি অন্য ঘরগুলো দেখলেন। কোথাও না পেয়ে ছাদের দরজার দিকে ছুটলেন। দরজা খোলা। অন্ধকার ছাদে এখন সামান্য তারার আলো। ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে সায়ন। মুখ আকাশের দিকে। নন্দিনী দ্রুত ছেলের পাশে এসে দাঁড়ালেন, এখানে কী করছিস?
সায়ন তাকাল। তারপর হাসল, তারা দেখছিলাম। পাহাড়ে আমি যত তারা দেখি এখানে তাদের অনেকেই দেখা দিচ্ছে না।
তুই এত রাতে তারা দেখতে এসেছিস?
তুমি কবে শেষবার তারা দেখেছ? একটু তাকিয়ে দ্যাখো, ভাল লাগবে।
ছেলের কথায় নিতান্ত অনিচ্ছায় নন্দিনী মুখ তুললেন। ঠিক নীল আকাশ নয় কিন্তু প্রচুর তারা পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে আছে। কোনওটা বেশি উজ্জ্বল, কোনওটা নিষ্প্রভ। এই তারাদের ভিড়ে চোখ রাখতে রাখতে নন্দিনী ক্রমশ আচ্ছান্ন হয়ে পড়লেন। একটা আলোর রাস্তা যেন আকাশে সাঁটা হয়ে আছে। ওটা কী? আকাশগঙ্গা? এটা যে কালপুরুষ তা স্পষ্ট বুঝতে পারলেন তিনি। কালপুরুষ দেখা কি ভাল? অমঙ্গল হবে না তো! নন্দিনী ঝট করে ছেলের বাজু আঁকড়ে ধরলেন।
সায়ন জিজ্ঞাসা করল, কী হল?
ঘরে চল।
আর একটু দাঁড়াও না!
সানু, সত্যি কাল তুই চলে যাবি? এই অশৌচের সময় যেতে নেই।
সায়ন কথা বলার আগেই প্রচণ্ড শব্দ হল। তারপরই বিকট চিৎকার। সায়ন দৌড়োল ছাদের আর এক প্রান্তে। শব্দটা ভেসে এসেছিল সেদিক থেকেই। কার্নিশের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সে দেখল বেশ কিছু ছেলে আধা অন্ধকারে চেঁচাচ্ছে। যেখানে তাদের পাথরের পরিগুলো ছিল, যারা সরে যাওয়ায় নতুন বাড়ি উঠছে ছেলেগুলো সেখানে বোমা মারতে লাগল। ঘনঘন সেই শব্দে আশেপাশের গাছগুলো থেকে ঘুমন্ত পাখিরা ভয়ে চেঁচামেচি করে ডানা মেলল। সায়নের কানে এল একটা গলা, আয় শালা, নেমে আয়, দেখি কী করে বাড়ি বানাস। উড়িয়ে দে, জ্বালিয়ে দে।
পাশেই সাজানো ইটের সাময়িক ঘরে শ্রমিকরা শুয়েছিল। ওরা সেখানে বোম মারতেই কার রোল উঠল। বাঁচাও, বাঁচাও, মর গিয়া মর গিয়া চিৎকার করে ছুটে পালাতে লাগল শ্রমিকরা। নন্দিনী চাপা গলায় বললেন, সরে আয় সানু, ওরা তোকে দেখে ফেলবে।
দেখে ফেললে কী হয়েছে? হাত ছাড়াতে চাইল সায়ন।
এ বাড়ি থেকে একটু প্রতিবাদ হলেই ওরা এদিকে বোম ছুড়বে।
আশ্চর্য! ওরা অন্যায় করছে অথচ বাড়ির কেউ প্রতিবাদ করছে না?
কী করে করবে? ওদের হাতে বোমা রিভলবার আছে, ওরা গুণ্ডা!
ওরা গুণ্ডা বলে ওদের অন্যায়কে মেনে নেবে সবাই?
তুই ভেতরে চল, এ নিয়ে তোকে মাথা ঘামাতে হবে না। সায়ন হাত ছাড়িয়ে নিল জোর করে। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল নিরাময়ের ওপর আক্রমণের দৃশ্য। ওখানে যারা আক্রমণ করতে এসেছিল তাদের ভুল বোঝানো হয়েছিল। পাহাড়ের মানুষের সঙ্গে সমতলের মানুষের বিরোধ তৈরি করা হয়েছিল। ঠিক যেভাবে হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা বাধানো হয় সেইভাবে ওই আবেগে পাহাড়ি মানুষদের অন্ধ করার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু এরা কারা? পয়সার লোভে হামলা করতে এসেছে কিছু পেশাদার গুণ্ডা। আর তাদের ভয়ে সবাই জানলা দরজা বন্ধ করে বসে আছে।
সায়ন ঘুরে দাঁড়াল, আচ্ছা মা, ওরা যদি এ বাড়ির ওপর হামলা করে, মেয়েদের গায়ে হাত দিতে চায় তাহলে বাবা কাকা জ্যেঠারা কী করবে? ওদের হাতে বোমা আছে এই ভয়ে লুকিয়ে থাকবে?
আমি জানি না। খুব ঘাবড়ে গেছেন নন্দিনী।
তখন রায়বাড়ির বংশমর্যাদা অটুট থাকবে? এখন যদি ওখানে কেউ খুন হয় তাহলে রায়বাড়ির কৌলীন্য বাড়বে?
প্রশ্নের জবাবের জন্যে অপেক্ষা না করে হনহন করে ছাদ পেরিয়ে দরজার ভেতর চলে গেল সায়ন। কয়েক সেকেন্ড পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকলেন নন্দিনী। তাঁর মাথা কাজ করছিল না। সংবিত ফিরতেই তিনি দৌড়োলেন।
দরজা খুলে নীচে নেমে আসতেই সায়ন দেখতে পেল ঠাকুরদালানের সামনে সদানন্দ এবং বাদল চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে। এ বাড়ির সদরদরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে রাখা হয়েছে। তাকে দেখে সদানন্দ বলল, এই এক ঝামেলা শুরু হয়েছে। ওরা এসে বোমা মারবে, খিস্তি করবে আর তার এক ঘণ্টা বাদে পুলিশ যখন আসবে তখন ওরা হাওয়া হয়ে গেছে।
বাদল বলল, পাঁচ মিনিট আগে উঠলেই আমি বেরিয়ে যেতে পারতাম। এখন পুলিশ না ফিরে যাওয়া পর্যন্ত আটকে থাকতে হবে।
সদানন্দ বলল, তোকে তো বলছি আজ এখানেই থেকে যা।
সায়ন জিজ্ঞাসা করল, ওরা কী চাইছে?
বাদল বলল, মাল্লু। অপোনেন্ট পার্টি প্রমোটারের কাছ থেকে মালু পেয়ে গেছে বলে ওরা ঝামেলা করছে।
মাল্লু মানে তো টাকা? সায়ন জিজ্ঞাসা করল।
বাদল হাসল, হ্যাঁ। তোকে এসব ভাষা বলা ঠিক হয়নি।
ওরা কেন টাকা চাইছে?
কোনও কারণ নেই। তুমি বাড়ি বানিয়ে লাভ করবে একা তা হতে দেব না, আমাদেরও কিছু দাও–এই আর কী!
তাহলে তো কাল কোনও দোকানে গিয়ে বলতে পারে তুমি ব্যবসা করে একা লাভ করতে পার না, আমাদেরও কিছু দাও।
বাদল বলল, পারে মানে? করছে তো। দোকানে দোকানে তোলা তুলছে না? কোথায় আছিস?
তোমরা এর প্রতিবাদ করছ না কেন?
দ্যাখ, ওদের পেছনে পার্টি আছে, পুলিশ আছে, আর আমাদের পেছনে কাকা জ্যেঠারাও নেই। বীরত্ব দেখানোর কোনও মানে হয় না। সদানন্দ বলল।
সায়ন নীচে নেমে এল, আমি ওদের সঙ্গে কথা বলব।
পাগল! সদানন্দ চেঁচিয়ে উঠল।
তুমি একটা কথা ভুলে গেছ সদুদা! সায়ন শক্ত গলায় বলল।
সদানন্দ বাধা দিল, তুই ব্যাপারটা বুঝতে পারছিস না–।
আমরা তো অনেক কিছুই বুঝতে পারি না। আমার যে অসুখ হয়েছে তাতে এতদিন এভাবে বেঁচে থাকাটা অনেকের কাছে বোঝার বাইরে, তাই না? তা ছাড়া আমি ওদের সঙ্গে মারপিট করতে চাইছি না, কথা বলতে যাচ্ছি। সায়ন নেমে এল। সদানন্দ হঠাৎ গুটিয়ে গেল। সায়নের বেঁচে থাকাটা তার কাছেও বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল। প্রথম প্রথম সে এই নিয়ে মাথা ঘামিয়েছে। কিন্তু পরে স্বাভাবিক বলে চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছিল। আজ সায়ন প্রসঙ্গ তুলতেই তার মনে সঙ্কোচ এল।
এই সময় চিৎকারটা ভেসে এল, সদু, ওকে আটকাও। ওকে যেতে দিও না।
সায়ন ঘুরে দাঁড়াল, মা, তুমি মিছিমিছি ভয় পাচ্ছ, আমার কিছু হবে না।
দরজা খুলল সায়ন এবং তখনই আবার বোম পড়ল সামনে এবং হল্লা শুরু হল। রায়বাড়ির দরজা খুলতে হয়তো আলো বেরিয়েছিল বাইরে, সেটা চোখে পড়া মাত্র আচমকা চিৎকার থেমে গেল। রায়বাড়ি থেকে যে কেউ বেরিয়ে আসতে পারে এ সময় তা বোমবাজরা ভাবতে পারেনি। সায়ন কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে দেখার চেষ্টা করল। ঝাপসা দেখাচ্ছে সামনের দিকটা। কেউ একজন চিৎকার করল, কে বে?
এই বে শব্দটা মিলিয়ে যাওয়ামাত্র গাড়ির আওয়াজ হল। বড় রাস্তা ছেড়ে রায়বাড়ির গেটের সামনে একটা জিপ হেডলাইট জ্বালিয়ে এসে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে দৌড়োদৗড়ি শুরু হয়ে গেল। জিপের দিকে দুটো বোম ছুড়ল ওরা। সায়ন অনুমান করল ওটা পুলিশের জিপ। কিছুক্ষণের মধ্যেই জায়গাটা নিস্তব্ধ হয়ে গেল। এবার জিপটা এগোল। হেটলাইটের আলো এসে পড়ল রায়বাড়ির ওপরে, সায়নের মুখে। জিপগাড়িখানা আচমকা ব্রেক কষল সায়নের পাশে এসে দুটো সেপাই জিপের পেছন থেকে লাফিয়ে নেমে শক্ত করে সায়নের দু হাত ধরে টানতে লাগল। জিপ থেকে নেমে অফিসার বলল, সব শালা পালিয়েছে এ ব্যাটা থেকে গিয়েছে। বীরত্ব দেখানো হচ্ছে? চল, আজ তোর বীরত্ব বার করছি।
টানাহ্যাঁচড়ায় মাটিতে পড়ে যাচ্ছিল সায়ন, একজন সেপাই তাকে আবার দাঁড় করিয়ে দিতেই রায়বাড়ির দরজা পুরো খুলে গেল। পিল পিল করে বেরিয়ে আসতে লাগল ছেলেরা। ন’বাবু কাতর গলায় অফিসারকে প্রায় প্রতি রাতের অত্যাচার বন্ধ করার জন্যে অনুরোধ করতে লাগলেন। কমলেন্দু বলল, আপনি এলেন আর ওরা পালিয়ে গেল। কেন পালাতে দিলেন?
অফিসার মাথা নাড়লেন, এক ব্যাটা ধরা পড়েছে। ওই একজনই বলে দেবে বাকিদের কোথায় পাওয়া যাবে। কোনও চিন্তা করবেন না।
সদানন্দ জিপের পেছনে চলে এসেছিল। তার চোখে পড়তেই সে চিৎকার করে উঠল, ছেড়ে দিন, ছেড়ে দিন ওকে। ও আমাদের ছেলে।
আপনাদের ছেলে মানে? অফিসার এগিয়ে গেলেন।
ততক্ষণে ন’বাবুরা হইচই শুরু করে দিয়েছেন। অফিসারের নির্দেশে সায়নকে ছেড়ে দিল সেপাইরা। অফিসার খিঁচিয়ে উঠলেন, এ আপনাদের বাড়ির ছেলে?
কমলেন্দু মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।
আপনারা যখন দরজা বন্ধ করে ভেতরে বসে সিনেমা দেখছিলেন তখন এ কেন বাইরে এসে দাঁড়িয়েছিল? হোয়াই? গর্জন করলেন অফিসার, অ্যাই, তুমি ওদের চেনো? ওদের দলে তুমিও আছ মনে হচ্ছে!
সদানন্দ জবাব দিল, ও এখানে থাকে না।
এখানে না থাকলে যে যোগাযোগ থাকবে না এই জ্ঞান আপনাকে কে দিল?
না। ও অসুস্থ, পাহাড়ে এক নার্সিংহোমে থাকে। কমলেন্দু বলল।
অ। শুনুন, এই অ্যান্টিসোশ্যালদের তো পুলিশ সবসময় হাতের কাছে পাচ্ছে না। আপনাদেরও প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে। অফিসার বললেন।
ন’বাবু জিজ্ঞাসা করলেন, আমরা কী করে প্রতিরোধ করব? ওদের হাতে অস্ত্র আছে, আমরা কি ওদের সঙ্গে কখনও পেরে উঠব?
তাহলে আপনাদের প্রমোটারকে বলুন। তিনি একটা দলের সঙ্গে ব্যবস্থা করে আর একটা দলকে বঞ্চিত করবেন এটা তো ঠিক কথা নয়।
সায়ন চুপচাপ শুনছিল। টানাহ্যাঁচড়াতে তার শরীরে কিঞ্চিৎ ব্যথা হচ্ছিল। অফিসারের কথা শেষ হওয়ামাত্র সে এগোল, তার মানে এর পরে যদি আর একটা দল এখানে বোমাবাজি করতে আসে তাহলে একই কথা বলবেন?
পুলিশ অফিসার খুব বিরক্ত হয়েছেন সেটা তার মুখ দেখে বোঝা গেল, দ্যাখো ভাই, তোমার বয়স অল্প, তুমি এসব বুঝবে না।
আপনি ঠিকই বলেছেন। আমি সত্যি বুঝতে পারি না কেন পুলিশ অ্যান্টিসোশ্যালদের প্রশ্রয় দেয়। ওদের পাইয়ে দিতে চায়।
কী? কী বললে তুমি? আই উইল অ্যারেস্ট ইউ। আমার সামনে দাঁড়িয়ে পুলিশের নামে বদনাম করছ? চিৎকার করে উঠলে অফিসার।
বদনাম তো আপনারা ইচ্ছে করে নেন। একটা চোর চুরি করে লুকিয়ে-চুরিয়ে, আপনাদের তো সেই চক্ষুলজাও নেই। ওরা এখানে বোমাবাজি করছে। আপনি এসে ওই দূরে গেটের সামনে জিপ নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। কেন আপনি চটলজদি ওখানে চলে গেলেন না গেলে ওদের সবাই পালিয়ে যেতে পারত না। আপনি যাননি কারণ ওদের ধরার কোনও ইচ্ছে আপনার ছিল না। আবার এখন ওদের পাইয়ে দেওয়ার জন্যে সুপারিশ করছেন? চমৎকার! সায়ন একটানা বলে গেল।
অফিসার হাসলেন, বিষদাঁত কী করে ভাঙতে হয় চাকলাদার জানে। অ্যাই, ওকে জিপে তোল।
হুকুম পাওয়ামাত্র দুজন সেপাই সায়নকে চ্যাংদোলা করে জিপে তুলল। অফিসার ড্রাইভারের পাশে উঠে বসামাত্র জিপ চালু হল। সদানন্দরা চেঁচামেচি শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই জিপ মুখ ঘুরিয়ে ছুটল গেটের দিকে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে সেটা চোখের আড়ালে চলে গেল।
জিপে বসেছিল সায়ন দুই সেপাইয়ের মধ্যে প্রায় চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে। রাস্তা ফাঁকা, কোথাও কোনও
শব্দ নেই। হঠাৎ একটা সেপাই ফিসফিস করে বলল, ভাগনে মাংতা?
সায়ন অবাক হয়ে গেল, কেন?
শ রুপিয়া নিকালো, জিপ রুখনেসে ভাগ যানা।
আমার কাছে টাকা নেই।
সেপাই দুটো মুখ ঘুরিয়ে নিল চটপট।
সায়নকে ওরা যেখানে ঢুকিয়ে দিল সেখানে আরও কয়েকজন বসে বা শুয়েছিল। অফিসার চিৎকার করে বললেন, এই নে নয়া মুরগি, দোস্তি কর, হা হা হা। বলে চোখের আড়ালে চলে গেলেন।
লোকগুলো পিটপিট করে সায়নকে দেখল। একজন বলল, লাইনে নতুন মনে হচ্ছে। কখনও দেখিনি আগে, ভদ্দরলোকের চেহারা, কেস কী?
সায়ন সোজা ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল, তোমাদের কি বিনা দোষে ধরে নিয়ে আসা হয়েছে না সত্যি অন্যায় করেছ?
লোকগুলো মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। তারপর ওদের একজন বলল, বুঝতে পেরেছি বাবু, আপনি পার্টি করেন। যান, ওপাশে গিয়ে বসুন, কেউ আপনাকে বিরক্ত করবে না।
সায়ন লোকটাকে দেখল, তারপর খানিকটা তফাতে গিয়ে বসল।
ঘরটা স্যাঁতসেঁতে, দুর্গন্ধে নিশ্বাস নেওয়া কষ্টকর। মেঝে স্যাঁতসেঁতে। মিনিট দশেক কোনওমতে সেখানে থাকার পর সায়ন উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে লাগল। তার চিৎকার শুনে একজন সেপাই এগিয়ে এল। সায়ন তাকে বলল, অফিসারকে ডাকো, এখানে কোনও মানুষ থাকতে পারে না।
সেপাই হাসল, ওরা মানুষ না?
সায়ন রেগে গেল, যা বলছি তাই করো। অফিসার কোথায়?
সেপাই ফিরে গেল। মিনিট দুয়েক বাদে অফিসারকে দেখা গেল, চ্যাংড়ামো হচ্ছে? আমি তোমার বাপের চাকর যে ডাকলেই চলে আসব? তোমাকে গোলাপের বিছানায় শুইয়ে রাখতে হবে, অ্যাঁ। অ্যাই, তোদের বলে গেলাম আর তোরা কিছু করিসনি?
সেই লোকটা বলল, ইনি পার্টি করেন, কিছু করলে মরে যাব।
পার্টি করে? এই যে বলল, অসুস্থ, নার্সিংহোমে থাকে! যত্ত দুনম্বরি কথা। অ্যাই তুমি কোন পার্টি কর?
আপনি দরজাটা খুলুন।
মামার বাড়ি? আগে বিষদাঁত ভাঙি তারপর দরজা খুলব। লোকটা অকস্মাৎ ক্ষেপে গেল, আমার নামে বদনাম!
ঠিক আছে। যদি কেউ বলে আপনি ঘুষ খান না, সাধারণ মানুষের ওপর যেসব মাস্তান অত্যাচার করে তাদের ধরে ধরে শাস্তি দেন, কেউ চাপ দিয়েও আপনাকে ন্যায়ের পথ থেকে নড়াতে পারে না তাহলে আপনার কেমন লাগবে? খুশি হবেন? সায়ন হাসল।
সঙ্গে সঙ্গে যেন চুপসে গেলেন অফিসার, রসিকতা হচ্ছে?
তাহলে দেখুন, দুটোই আপনার খারাপ লাগছে।
অফিসার দরজা খুললেন। তারপর ডান হাত বাড়িয়ে সায়নের কলার ধরলেন। এবং ধরামাত্র তাঁর মনে হল বুকের বাঁদিকের পাঁজরের তলায় ব্যথা হচ্ছে। ব্যথাটা প্রবল হয়ে উঠছে। তিনি কোনওমতে বলতে পারলেন, ব্যথা, খুব ব্যথা, বাঁচাও।
সায়ন হাত ছাড়িয়ে দিয়ে বলল, কোথায় ব্যথা?
বুকে! ও, মা–!
সায়ন দ্রুত অফিসারের বুকে মালিশ করতে লাগল। ভদ্রলোকের মুখে ঘাম জমছিল। হঠাৎ শব্দ করে ঢেঁকুর তুললেন তিনি। তারপর এক বুক নিশ্বাস নিয়ে বললেন, থ্যাঙ্কু। আঃ।
ভাল লাগছে?
হ্যাঁ। মনে হচ্ছে উইন্ড হয়েছিল। এই শালা হরিপদর পরোটা মাংস খাওয়া ছাড়তে হবে। অ্যান্টাসিড ছাড়া খেলেই! দ্বিতীয় সেঁকুর তুললেন তিনি। পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছলেন।
আমি কি বাইরে যেতে পারি?
ঠিক আছে।
অফিসার ওকে বাইরের ঘরে নিয়ে এসে বসতে বললেন। নিজে টেবিলের উল্টোদিকে বসে বললেন, তোমাকে একটু অন্যরকম মনে হচ্ছে। শোনো, আমরা পুলিশরা খারাপ মন নিয়ে চাকরি করতে আসি না। আসার পর আমাদের খারাপ করে দেওয়া হয়। ছেলেবেলায় আমি ঘুষ নেওয়াকে পাপ বলে মনে করতাম। কেউ ঘুষ নিলে এড়িয়ে যেতাম তাকে। এখন আমার ছেলেমেয়ে জানে কী করে টাকা আসছে, জেনেও কখনও প্রশ্ন করে না। কারণ এই চাকরিতে ঘুষ না নিলে চাকরি থাকবে না অথবা পানিশমেন্ট পোস্টিং হয়ে যাবে। তোমাদের প্রমোটারের কাছে আমরা প্রথমে যাইনি, তিনিই এসেছিলেন। মিউচুয়াল করার সময় বলে গেলেন যারা ঝামেলা করবে তাদের তিনিই ম্যানেজ করবেন। এখন একটা দলকে তিনি ম্যানেজ করে অন্য দলকে পাত্তা দেননি। দোষ কার?
এ সব কথা আমাকে কেন বলছেন?
আই ডোন্ট নো। তুমি যখন বুকে হাত বোলালে তখন একটা অন্যরকমের অনুভূতি হচ্ছিল। আই কান্ট এক্সপ্লেইন, একটা সুপার ন্যাচরাল অনুভূতি। আমার বোধহয় ভুল হচ্ছে, ওয়েল, চলো, তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি। সায়ন দেখল মানুষটার মুখ একদম বদলে গেছে।
আপনার উচিত এখন একজন ডাক্তার দেখানো।
না, না, ঠিক আছি। নো প্রব্লেম। মাথা নাড়লেন ভদ্রলোক, শুনলাম তুমি অসুস্থ, নার্সিংহোমে ছিলে। তাই?
হ্যাঁ।
কী হয়েছিল? আমার রক্তে লোহিতকণিকা খুব কমে গেছে।
সে কী? অ্যানিমিক?
তার চেয়েও কম।
মাই গড! তার চেয়ে কম হলে কী বলে যেন, কী বলে?
লিউকোমিয়া।
হ্যাঁ, সে কী? তাই?
হ্যাঁ। সায়ন হাসল, তাতে অবশ্য আমার অসুবিধে হয় না।
অফিসার উঠে দাঁড়ালেন, সর্বনাশ। আগে বলবে তো? কিছু যদি করে ফেলতাম তাহলে মানবাধিকার কমিশন আমাকে শেষ করে দিত!
অন্যায় যে করেনি তার সঙ্গে কিছু করবেন কেন?
মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারি না! চলো ভাই, পৌঁছে দিচ্ছি।
সায়নকে জিপের সামনের সিটে বসালেন ভদ্রলোক, আসলে কী জানো, আজকাল আমি সবসময় কমপ্লেক্সে ভুগি। মন্দ কাজকেও ভাল বলে ভাবতে চেষ্টা করি। কোনও উপায় নেই।
হঠাৎ রাস্তা দিয়ে কয়েকজনকে হেঁটে আসতে দেখা গেল। কাছাকাছি হলে সায়ন চিনতে পারল, বাবা, সদানন্দ, কমলেন্দু এবং আরও কয়েকজন। সায়ন বলল, জিপ থামান। আমার বাড়ির লোকজন আসছে।
জিপ থামিয়ে অফিসার বললেন, আপনাদের থানায় যেতে হবে না। আমি ওকে বাড়িতে পৌঁছে দিতে যাচ্ছি। ফিরে যান।
চুপচাপ রায়বাড়ির সামনে চলে এল জিপ। এখন রায়বাড়িতে কিছু আলো জ্বলছে। জিপ থেকে সায়ন নামতে অফিসারও নামলেন, একটা কথা, ডাক্তার কী বলছে?
কী ব্যাপারে?
অসুখের–মানে।
লড়াই করে যেতে হবে।
অফিসার মাথা নাড়লেন। হঠাৎ সায়ন জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, আপনি এমন আচমকা বদলে গেলেন কেন বলুন তো?
অফিসার মাথা নাড়লেন, বুঝতে পারছি না। আমার মা অনেককাল আগে মারা গেছেন। ছেলেবেলায় অসুখ করলে মা বুকে হাত বুলিয়ে দিত। আজ এতদিন বাদে ঠিক সেইরকম স্পর্শ, দুর, আমি এসব ভাবলে পাগল হয়ে যাব। আচ্ছা, আসি ভাই৷ অফিসার গাড়িতে উঠে বেরিয়ে গেলেন।
রায়বাড়ির সদর দরজায় দাঁড়াতেই নন্দিনী ছুটে এসে সায়নকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে উঠলেন। মায়ের পেছনে আর যাঁরা ছিলেন তাদের মধ্যে হেনা, ঊর্মিলা, কৃষ্ণাদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল।
কৃষ্ণা বললেন, বলিহারি সাহস তোমার, পুলিশের সামনে বীরত্ব দেখাতে হয়? ভয়ে আমার হাত পা কাঁপছিল।
ঊর্মিলা বলল, সাহস দেখাল বলে পুলিশ ওকে ফিরিয়ে দিয়ে গেল।
হেনা কাকিমা জিজ্ঞাসা করলেন, হ্যাঁ রে তোকে মারধর করেনি তো?
নন্দিনীর কান্না কমে এসেছিল। সায়ন বলল, মারার আগে ভদ্রলোকের বুকে এত ব্যথা শুরু হয়ে গেল যে সুযোগ পেলেন না।
হেনা কাকিমা বললেন, হবেই তো, অধর্ম করলে হবে না?
নন্দিনী অদ্ভুত চোখে ছেলের দিকে তাকালেন, বুকে কষ্ট শুরু হয়ে গিয়েছিল? তারপর?
তারপর আর কী! কমে গেল।
কমে গেলে রাগ চলে গেল?
তা নয়। আমি বুকে মালিশ করে দিয়েছিলাম বলে বোধহয় আর মারতে পারল না। সায়ন হাসল।
নন্দিনী কোনও কথা না বলে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন। আর তখনই ছেলেরা ফিরে এল। সদানন্দ কমলেন্দু বারংবার কী কী ঘটনা ঘটেছিল তা জানতে চাইছিল। অফিসারের ব্যবহারের এই পরিবর্তনের কারণ নিয়ে জল্পনা শুরু হল।
সায়নের বাবা বললেন, অনেক রাত হয়েছে। শোবে চলো।
নিজের ঘরে ঢুকে সায়ন দেখল বিষ্ণুপ্ৰসাদ ঘুমাচ্ছে। এই যে এত কাণ্ড হল ও টের পায়নি, কেউ ডাকেনি ওকে। চুপচাপ পোশাক পাল্টে শুয়ে পড়ল সায়ন। অফিসারের মুখ চোখের সামনে চলে এল। হয়তো আজকের রাতটা, কাল থেকে আবার নিজের জগতে ফিরে যাবেন ভদ্রলোক।
সায়নের মনে হল এ বাড়ির ভেতরে যে নীতিহীনতা, স্বার্থপরতা তার চমৎকার প্রকাশ এ বাড়ির বাইরেও। পাহাড়ে থেকে তার চোখ খুলে না গেলে হয়তো সে এই চেহারা দেখতে পেত না। এইভাবে বেঁচে থাকার কোনও অর্থ হয়?
দুটো ঘর ওপাশে সায়নের বাবা বলছিলেন, না, আমার মনে এখন আর কোনও কষ্ট নেই নন্দিনী, সানু ওখানেই ফিরে যাক, যে কদিন থাকবে ভালভাবে থাকতে পারবে তাহলে।
নন্দিনী আবিষ্কার করলেন তাঁর বুকের ভেতরটা হঠাৎ হালকা হয়ে গেল।
.
৩৮.
ঝাপসা, সব ঝাপসা। চোখ টান করে দেখার চেষ্টা করল সায়ন। কিন্তু চোখের পাতা দুটো আকর্ষণ করল পরস্পরকে। সামনে তখন অন্ধকার আর সেই অন্ধকারে কেউ যেন হু হু করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তাকে। মাধ্যাকর্ষণের এলাকায় ঢুকলে যেমন হয়। সেই অনুভূতিটাও কয়েক মুহূর্তের, তারপর আর কিছু নেই।
দ্বিতীয় বার যখন চোখ খুলল সায়ন তখন আকাশটা ঘরের মধ্যে। ঘরে কোনও দেওয়াল নেই, কয়েক হাত দূরেই আকাশ। এবার ঝাপসা নয়, নোংরা লেগে থাকা মেঘেরা চলে গেল সেই আকাশ থেকে। স্বচ্ছন্দে হেঁটে এলেন মিস্টার ব্রাউন। ঠিক যেভাবে হেঁকে বলতেন, গুড মর্নিং মাই বয়, ঠিক তেমনই তার ঠোঁট নড়ল। কেমন আছেন মিস্টার ব্রাউন? প্রশ্ন শুনে আরও হাসলেন ভদ্রলোক, ভাল নেই মাই বয়, একটুও ভাল নেই।
সে কী? আপনি যিশুর কাছে গিয়েছেন, ভাল না থাকার তো কথা নয়।
আমি এখন পরমপিতার আশ্রয়ে। সর্বত্র তিনি বিরাজমান। কিন্তু তাকে দেখা যায় না, অনুভূতিতে নিতে হয়। পৃথিবীতে তিনি আলোর মতো, বাতাসের মতো। এখানে আমি তার কাছে, খুব কাছে। যেন কারও ঘরে এসেছি, ঘরটা তার বুঝতে পারছি, তিনি কোনও কাজে বাইরে গেছেন। অথচ যিশু ছিল আমার সঙ্গে যখন পৃথিবীতে ছিলাম। এখানে কেউ নেই, খুব একা লাগে মাই সন। যিশু আমাকে এখানে পৌঁছে দিয়েছেন কিন্তু আমি তাকেই দেখতে পাচ্ছি না।
আকাশটা কেঁপে গেল। মিস্টার ব্রাউনের ছবি ঝট করে মিলিয়ে গেল ঠিক যেভাবে টিভিতে লোডশেডিং হয়।
তৃতীয়বার যখন চোখ খুলল সায়ন তখন দৃষ্টি পরিষ্কার। চোখের সামনে ডাক্তার আঙ্কল। তার মুখে হাসি, কেমন লাগছে এখন?
ভাল।
টেক রেস্ট। কথা বোলো না আর।
আমি এখন কোথায়?
নিরাময়ে। ডাক্তার আঙ্কল সরে গেলেন সামনে থেকে। সায়ন মাথা ঘোরাল। হ্যাঁ, এটা তো নিরাময়ের জানলা। জানলার পর্দা টানা। কিন্তু সে নিরাময়ে কী করে পৌঁছোল? বিষ্ণুপ্ৰসাদ কোথায়? আহা, বেচারা কলকাতায় গেল অথচ কলকাতা দেখতে পেল না। কিন্তু কলকাতায় বাইরের লোক গিয়ে কি দেখে। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, পাতাল রেল, কালীঘাট? ওগুলো দেখা কি কলকাতাকে দেখা? রায়বাড়িতে এই কয়েকদিনে যা ঘটে গেল সেটাই এখন কলকাতার আসল ছবি। তার কিছু দেখেছে বিষ্ণুপ্ৰসাদ, কিছুটা ঘুমিয়ে পড়েছিল বলে দেখতে পায়নি।
মিসেস অ্যান্টনি ঘরে ঢুকলেন, হ্যালো, গুড মর্নিং।
গুড মর্নিং। এখন তাহলে সকাল? আমি জানতাম না।
কী করে জানবে? তুমি তো তিন দিন ধরে ঘুমিয়ে ছিলে।
আমাকে কে নিয়ে এল এখানে?
সবাই। তোমার বাবা, মা, বিষ্ণুপ্রসাদ। কিন্তু আর কথা বোলো না।
মা, বাবা?
হ্যাঁ। তারা আছেন। ওঁদের বিকেলবেলায় আসার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কীরকম হালকা হয়ে গেল মনটা। সায়নের মনে হল সে নিজের জায়গায় ফিরে এসেছে। মিসেস অ্যান্টনি তাকে একটা ক্যাপসুল খাইয়ে দিলেন। সায়ন তার দিকে তাকিয়ে হাসল, তুমি খুব ভাল।
মিসেস অ্যান্টনি একটু কেঁপে উঠলেন। সায়ন চোখ বন্ধ করতেই ধীরে ধীরে ঘরের বাইরে চলে গেলেন। তারপর সিঁড়ির কয়েকটা ধাপ নেমে আচমকা শরীর কাঁপিয়ে কান্না এল তার। নীচের প্যাসেজে হেঁটে যাচ্ছিল ছোটবাহাদুর। ওপরে তাকিয়েই ছুটে এল কাছে, নেপালিতে জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে? কাঁদছ কেন?
কান্নাটা কোনও মতে গিলে ফেললেন মিসেস অ্যান্টনি। বললেন, এমনি।
ভিজিটার্সদের জন্যে নিরাময়ে একটা সময় ঠিক করে দেওয়া আছে। তার অনেক আগেই নন্দিনী স্বামীর সঙ্গে চলে এসেছিলেন। ডাক্তারের চেম্বারে অপেক্ষা করছিলেন তারা। ডাক্তার ঘরে ঢুকে বললেন, এ যাত্রায় আমরা চিন্তামুক্ত।
ও, ভগবান। চোখ বন্ধ করলেন নন্দিনী।
সায়নের বাবা জিজ্ঞাসা করলেন, সেন্স ফিরেছে?
হ্যাঁ। তবে কথা কম বলাবেন।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। হাসলেন সায়নের বাবা।
ডাক্তার হঠাৎ অন্য গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, ওখানে কিছু হয়েছিল?
মানে? সায়নের বাবা থমকে গেলেন।
কোনও মানসিক প্রব্লেম? ডাক্তার সরাসরি তাকালেন।
হ্যাঁ। ভদ্রলোক মাথা নিচু করলেন।
ও। তাহলে ওকে কলকাতা থেকে এত দূরে নিয়ে এলেন কেন?
ও ইনসিস্ট করছিল এখানে আসার জন্যে। সায়নের বাবা বললেন,
নন্দিনী যোগ করলেন, তা ছাড়া আপনার ওপর আমার ভরসা বেশি।
আশ্চর্য! কোনও মানুষ এরকম অসুস্থ হলে তখনই তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা উচিত। আমি পির বা সন্ন্যাসী নই যে মরা মানুষ বাঁচিয়ে দেব। অবশ্য তারা যে কাজটা করতে সক্ষম তা আমি বিশ্বাস করি না। ওকে কলকাতার কোনও নার্সিংহোমে ভর্তি করানো উচিত ছিল, তাহলে হয়তো এতটা সাফার করত না। ডাক্তার কথা বলতে বলতে পেপার ওয়েটে হাতের চাপ দিচ্ছিলেন।
সায়নের বাবা বললেন, কিন্তু আপনি বললেন ওর বিপদ কেটে গেছে।
হ্যাঁ। কিন্তু আপনারা ঝুঁকি নিয়েছিলেন।
এইসময় দরজায় এসে দাঁড়াল কঙ্কাবতী। তার শরীরে স্কুলের ইউনিফর্ম। ডাক্তার তাকে দেখতে পেয়ে হেসে বললেন, কেমন হল স্কুল?
কঙ্কাবতী যে তৃপ্ত তা তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। মাথা হেলিয়ে বলল, ভাল। সবাই আমাকে হেল্প করবে বলেছে। সায়ন কেমন আছে?
ভাল। অনেক ভাল।
আমি একবার দেখা করতে পারি?
পারো। কিন্তু দুটোর বেশি কথা বলবে না।
কঙ্কাবতী মাথা নেড়ে চলে গেলে সায়নের বাবা জিজ্ঞাসা করলেন, কে?
ডাক্তার কঙ্কাবতীর পরিচয় দিলেন, আজ দুদিন হল ও আবার স্কুলে যাওয়া আসা শুরু করেছে। সেটা করতে পেরে ওর বিমর্ষ ভাবটা প্রায় চলে গেছে, কিন্তু– ডাক্তার কথা শেষ করলেন না।
কিন্তু?
মিস্টার রায়, আমি একটা অদ্ভুত পরিস্থিতিতে রয়েছি। আমি এই নিরাময় শুরু করেছিলাম শুধু পেশেন্টদের চিকিৎসা করে জীবনে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যে নয়। কারণ এই অসুখ কখনওই কাউকে চিরকালীন সুস্থতা দেবে না। আমি একটু অন্যরকম ভেবেছিলাম। যে কোনও মানুষকেই জন্মাবার পর মুহূর্ত থেকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে হয়। খুব বেশি হলে কেউ একশো বছর বাঁচেন, কেউ আশি নব্বইতে যাত্রা শেষ করেন। আবার চল্লিশ থেকে ষাটের মধ্যে জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে এমন মানুষের সংখ্যাই সম্ভবত বেশি। আমি ধরে নিচ্ছি একটি মানুষ ষাট বছর বেঁচে থাকবে। তাকে যা করার তা এর মধ্যেই করে যেতে হবে। ইতিহাসের কথা ছেড়ে দিন, আমরা প্রত্যেকে তো আমাদের বাবা অথবা ঠাকুদারকে দেখেছি। তারা ছিলেন, কাজকর্ম করতে দেখেছি, এখন তারা নেই। অতএব আমারও ভবিতব্য একই। নিরাময়ে যারা মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে তাদের খানিকটা সুস্থতা এনে দিতে যদি সক্ষম হই তাহলে এখানে থেকেই তারা তাদের মতো বাঁচতে পারে। একজন স্বাভাবিক মানুষের আয়ু যদি ষাট হয় তাহলে আমার পেশেন্টদের হয়তো পনেরো অথবা কুড়ি। এটা এমন কী কম সময়? ডাক্তার নিঃশ্বাস নিলেন। কিন্তু আমি একেবারেই সক্ষম হইনি। এখানে চিকিৎসার জন্যে যারা এসেছে তাদের অভিভাবকরা আমার ওপর ভরসা রাখতে পারেননি। একথা ঠিক কেউ অসুস্থ হলে, সে নিজের সন্তানও যদি হয়, মানুষ উদ্বিগ্ন হয়, প্রাণপণ চেষ্টা করে সুস্থ করতে কিন্তু অসুস্থতা দীর্ঘকাল ধরে চললে একটা গা-ছাড়া ভাব এসেই যায়। আর এক্ষেত্রে তো জানাই আছে কোনওদিন রোগমুক্ত হবে না। আমি তাই কোনও অভিভাবককে জোর করতে পারি না। এখানে রেখে চিকিৎসা করানোর জন্যে যে খরচ তা যদি দীর্ঘকাল তারা বহন করতে অক্ষম হন আমি সেটা মেনে নিতে বাধ্য। আমার সমস্যা এখানেই। এতকাল আমি আমার সর্বস্ব দিয়ে কাজ করার চেষ্টা করেছি। একমাত্র সায়ন ছাড়া আর কারও মধ্যে অসুস্থতাকে অতিক্রম করে জীবনের কাছে পৌঁছোতে দেখিনি। এই মেয়েটির মধ্যে সেই সম্ভাবনা আছে। কিন্তু আমার পক্ষে তো আর নিরাময়কে ধরে রাখা সম্ভব নয়।
ঘরের আবহাওয়া আচমকা ভারী হয়ে গেল। সায়নের বাবা কথা খুঁজলেন। শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি সরকারি সাহায্য পান না?
হিল কাউন্সিল সামান্য অর্থ দিয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গ সরকার নিরাময়কে একটা নার্সিংহোম ছাড়া কিছু মনে করে না। আমি আশা করেছিলাম বাইরে থেকে সাহায্য পাব। একটি প্রতিনিধি দলের এখানে আসার কথা ছিল। কিন্তু তারাও সরে দাঁড়িয়েছে। আমি যদি নিরাময়কে একটি সাধারণ নার্সিংহোমের পর্যায়ে নিয়ে যাই তাহলে অর্থের অভাব হবে না। প্রচুর ধনবান পাহাড়ি পরিবার আমার পেট্রন হয়ে যাবেন। কিন্তু আমি প্রথম থেকেই সেটা করতে চাইনি। এই যে মেয়েটিকে দেখলেন, আবার স্কুলে যাচ্ছে, ওর মুখের হাসি মিলিয়ে যাবে, সামনে অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখবে না যদি আমি নিরাময় বন্ধ করে দিই। কিন্তু আমি কী করতে পারি? আমার ক্ষমতা কতটুকু?
ডাক্তারের কথা শেষ হতে না হতেই দেখা গেল এলিজাবেথ প্যাসেজ দিয়ে এগিয়ে আসছেন। ডাক্তার উঠে দাঁড়ালেন, গুড আফটারনুন।
গুড আফটারনুন ডক্টর। সায়ন কেমন আছে? এলিজাবেথ ইংরেজিতে প্রশ্ন করলেন। ওঁর পেছনে বিষ্ণুপ্ৰসাদ। সে সায়নের বাবা মাকে নমস্কার করল।
ভাল। বিপদ চলে গেছে।
ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। ওই মেয়েটি স্কুলে যাচ্ছে?
হ্যাঁ। বসুন এলিজাবেথ। এঁরা সায়নের বাবা মা।
এলিজাবেথ নন্দিনীর হাত ধরলেন, আমি আপনাদের মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। কিন্তু চিন্তা করবেন না, ডক্টর তো বললেন সায়ন এখন বিপদ মুক্ত।
নন্দিনী সঙ্কোচে পড়লেন, ইংরেজিতে কথা বলতে তিনি অভ্যস্ত নন। কেউ ধীরে ধীরে বললে সামান্য বুঝতে পারেন। তিনি মাথা নাড়লেন।
এলিজাবেথ বোধহয় অনুমান করলেন। হেসে বললেন, সায়ন বহুৎ আচ্ছা।
ডাক্তার হাসলেন, বাঃ, আপনি এর মধ্যেই বেশ হিন্দি বলছেন।
আই ক্যান স্পিক নেপালি বেটার। এলিজাবেথ বাচ্চা মেয়ের মতো মুখ করলেন, একটা ভাল খবর দিচ্ছি। ইন্ডিয়া গভর্নমেন্ট আমার ভিসার মেয়াদ বাড়িয়ে দিয়েছে।
বাঃ। এ তো, খুব ভাল খবর।
ডক্টর। আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।
বলুন।
হ্যাঁ। এই জন্যে আমি ডক্টর তামাংকেও এখানে আসার জন্যে অনুরোধ করেছি। অবশ্যই আমি ক্ষমা চাইছি আপনার অনুমতি নেওয়া হয়নি বলে।
সেটা ঠিক আছে। কিন্তু কী ব্যাপার বলুন তো।
ডক্টর তামাং এসে পৌঁছোন, তারপর–।
ডাক্তার বুঝলেন। নন্দিনীর দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনারা এখন ছেলের কাছে যেতে পারেন। কিন্তু ওকে বেশি কথা বলতে দেবেন না।
সায়নের বাবা মাথা নেড়ে স্ত্রীকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। ওঁদের যাওয়া দেখে এলিজাবেথ জিজ্ঞাসা করলেন, ওরা কি সায়নকে দেখতে যাচ্ছে?
হ্যাঁ। আপনি যাবেন?
না না। ওঁরা যাচ্ছেন, সায়ন ওঁদের সঙ্গে কথা বলবেই। তার ওপর আমি গেলে কথা বলা বেড়ে যাবে। এখানে এসে আমি বেশি কথা বলতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। বরং আমার ইচ্ছে ওই মেয়েটি, হ্যাঁ, কঙ্কা, কঙ্কার সঙ্গে একটু কথা বলব। এলিজাবেথের কথা শেষ হতেই গাড়ির আওয়াজ পাওয়া গেল। ডাক্তার তামাংকে দেখা গেল প্যাসেজ দিয়ে আসতে। এলিজাবেথ বললেন, উনি এসে গিয়েছেন!
ডাক্তার তামাং হাত তুলে নিঃশব্দে হাসলেন। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল আজ একটু বেশি পরিমাণেই পান করেছেন। এলিজাবেথ বললেন, আমরা কি আপনার অফিসঘরে বসেই কথা বলব?
ডাক্তার বললেন, কোনও অসুবিধে নেই।
তিনজনে বসার পর এলিজাবেথ জিজ্ঞাসা করলেন, ডক্টর তামাং, আপনি সম্পূর্ণ সুস্থ আছেন তো?
একশোবার। ডাক্তার তামাং-এর গলা ঈষৎ জড়ানো।
এলিজাবেথ একটু ভাবলেন। তারপর ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি আমাকে বলেছিলেন যে নিরাময়কে বাঁচিয়ে রাখা আপনার পক্ষে কঠিন হয়ে যাচ্ছে। আপনি কি এখনও সেইরকম ভাবছেন?
ডাক্তার হাসলেন, এর চেয়ে বড় সমস্যা আমার সামনে নেই।
কেন কঠিন হচ্ছে?
প্রথম কারণ অর্থ। মূলত পেশেন্টদের গার্জেনের টাকায় আমাকে চালাতে হত। সেই টাকা ঠিক সময়ে পাওয়া যেত না, গেলেও খরচ অনেক বেশি হত। সেই বেশি খরচটা আমার সঞ্চয় থেকে মেটাতাম। বাইরে থেকে যা সাহায্য পেয়েছি তা না পেলে অনেক আগেই নিরাময় বন্ধ হয়ে যেত। এখন বাইরের সাহায্য আর পাচ্ছি না। আমার সঞ্চয়ও প্রায় শেষ। দ্বিতীয়ত, শুরুর দিকে আমি যত পেশেন্ট পেয়েছিলাম এখন তা পাই না। একটু সুস্থ হলেই অথবা সুস্থতা না এলে অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন হয়ে পেশেন্টদের ফেরত নিয়ে যান। ফলে কমতে কমতে এখন পেশেন্টের সংখ্যা এত কমে গেছে তাদের জন্যে যে টাকা আসে তাতে খরচ কমানো যাচ্ছে না। তৃতীয়ত, আমি নিরাময় করেছিলাম যে উদ্দেশ্যে তা প্রায় ব্যর্থ হতে চলেছে। আমি চেয়েছিলাম যেকয় বছর এরা বাঁচবে সেই কয় বছর এরা যেন বিছানায় পড়ে না থাকে। সত্যি কথা বলতে কি সায়ন ছাড়া সেই উদ্যম আমি কারও মধ্যে দেখিনি। ডাক্তার কথা শেষ করলেন।
এলিজাবেথ জিজ্ঞাসা করলেন, কেন? কঙ্কাবতী?
ডাক্তার তাকালেন, ঠিকই। ও স্কুলে যেতে চাইছিল, যাচ্ছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে ওর অসুখ সায়নের পর্যায়ে কখনও যায়নি।
ডাক্তার তামাং এতক্ষণ চোখ বন্ধ করে শুনে যাচ্ছিলেন, এবার চোখ খুললেন, যেটা সরকারের করা উচিত সেটা একজন ব্যক্তির পক্ষে করা সম্ভব নয়। আমাদের দেশে হাসপাতালগুলোয় হয়তো এই অসুখের চিকিৎসার জন্যে বিভাগ খোলা আছে কিন্তু তাদের নব্বই ভাগই অকর্মণ্য। শুধু ওদের জন্যে কোনও হাসপাতাল বা নার্সিংহোম এদেশে হয়েছে বলে শুনিনি। ডাক্তার যে একা এতদিন লড়াই করে গেলেন এটা কম কথা নয়।
ডাক্তার বললেন, কী হবে লড়াই করে যদি হেরে সরে যেতে হয়।
এলিজবেথ বললেন, আমরা এক্ষেত্রে ডাক্তার তামাং-এর সাহায্য চাইতে পারি না?
ডাক্তার তামাং তাকালেন।
এলিজাবেথ বললেন, নিরাময়কে আমরা দুটো ভাগে যদি ভাগ করি তা হলে কেমন হয়? একভাগে আপনার পেশেন্ট থাকবে আর অন্য ভাগ জেনারেল পেশেন্ট যারা নার্সিংহোমে ভর্তি হতে চায় তাদের জন্যে। এই শহরে হাসপাতাল আছে কিন্তু নিতান্ত বাধ্য না হলে সেখানে কেউ যেতে চায় না। যারা মরিয়া হয়ে শিলিগুড়ি বা দার্জিলিঙে যায় তাদের উপকার হবে এতে আর নিরাময়ের অর্থসমস্যা অনেক কমে যাবে।
কিন্তু সেটা নার্সিংহোম হয়ে যাবে, নিরাময় থাকবে না। ডাক্তার বললেন।
কেন? আপনি চান না, একজন মহিলা এখানে এসে নিশ্চিন্তে সন্তান প্রসব করুন? আপনি চান, কোনও হার্টের পেশেন্ট সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরুন?
নিশ্চয়ই চাই। কিন্তু নিরাময় হয়েছিল সেই সব মানুষের জন্যে যারা সীমাবদ্ধ জীবন পেতে পারে। ডাক্তার মাথা নাড়লেন।
ঠিক। তাতে তো কোনও অসুবিধে হচ্ছে না।
মানে!
আপনার যদি আর্থিক অসুবিধে না থাকত তা হলে এখন যে কজন পেশেন্ট এখানে আছে তাদের নিয়েই কাজ করতেন। বাকি ঘরগুলো খালি পড়ে থাকত। তাই তো?
ডাক্তার এলিজাবেথের দিকে তাকালেন। এলিজাবেথ হাসলেন, আমি যদি বলি ঘর খালি থাকা সত্ত্বেও পেশেন্ট না নিলে সেটা বিলাসিতা ছাড়া কিছু নয় তা হলে কী জবাব দেবেন?
কিন্তু তা হলে নিরাময়ের কোনও চরিত্র থাকবে না।
এলিজাবেথ মাথা নাড়লেন, আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, নিরাময় মানে কী? জানলাম ওই শব্দটার মনে রোগমুক্তি।
এই সময় ডাক্তার তামাং কথা বললেন, কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না এই সব কথার সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক?
এলিজাবেথ তাকালেন, সম্পর্ক নিশ্চয়ই আছে ডাক্তার। আমি এই কয়েক মাস ধরে এখানকার গ্রামের মানুষের সঙ্গে মিশেছি। অসুখ ওদের নিত্যসঙ্গী। কিন্তু কার কী অসুখ হয়েছে তা তারা নিজেরাই জানে না। শিশুমৃত্যুর হার খুব বেশি। আগে নাকি সরকারি মেডিক্যাল ইউনিট গ্রামগুলোতে যেত এখন সেটাও বন্ধ। আর হাসপাতালের নাম শুনলেই ওরা আঁতকে ওঠে। গেলে নাকি ফিরে আসা যাবে না, মরতে হলে গ্রামের মাটিতে মরাই ভাল।
ডাক্তার তামাং বললেন, ব্যাপারটা আপনার চোখে নতুন মনে হলেও এশিয়া এবং আফ্রিকাতে এটাই স্বাভাবিক ঘটনা।
সোজা হয়ে বসলেন এলিজাবেথ, আমি আমার সীমিত সামর্থ্যে একটু অন্যরকমভাবে সমস্যার সমাধান করতে চাই আর তাই এখানে এসেছি।
কী রকম? ডাক্তার তামাং যেন জিজ্ঞাসা করতে হয় তাই করলেন।
আমেরিকায় কয়েকটা সংস্থা আছে যারা মানুষের জন্যে কাজ করে। তাদের কাছে আমি একটা প্রপোজাল পাঠাই। ওদের একটা সংস্থার সঙ্গে আমি কিছুটা জড়িত। তারা আমার কথায় বিশ্বাস করে দুলক্ষ ডলার অনুমোদন করেছে একটা শর্তে যে সমান পরিমাণ অর্থ আমাদেরও জোগাড় করতে হবে। ওরা প্রথমে পঞ্চাশ হাজার দেবে। তারপর কেমন কাজ হচ্ছে দেখার জন্যে লোক পাঠাবে। তার রিপোর্টে সন্তুষ্ট হলে বাকি টাকাটা পাঠাবে।
আপনার প্রপোজাল কী ছিল? ডাক্তার জিজ্ঞাসা করলেন।
এই পাহাড়ি মানুষদের জন্যে একটি আধুনিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরি করা যেখানে তারা সহজেই আসতে পারবে। এলিজাবেথ হাসলেন।
হাসপাতাল? ডাক্তার তাকালেন।
না। স্বাস্থ্যকেন্দ্র। প্রতিটি গ্রামের প্রত্যেকটা মানুষ এখানে এসে কার্ড নিয়ে যাবে। তাদের পরিবারের সদস্যদের নাম বয়স সেখানে উল্লেখ করা থাকবে। কেউ অসুস্থ হলে ওই কার্ড নিয়ে এলেই চিকিৎসা করা হবে। এলিজাবেথ বললেন, ওই একটা কার্ড ওদের আত্মবিশ্বাস অনেক বাড়িয়ে দেবে।
ডাক্তার তামাং বললেন, মাপ করবেন। আপনার কথা আমার কাছে অস্পষ্ট। আপনি বললেন দু লক্ষ ডলার পাওয়া যাবে যদি ওই পরিমাণ টাকা এখান থেকে জোগাড় করা যায়। দু লক্ষ ডলার মানে প্রায় পঁচাশি লক্ষ টাকা।
হ্যাঁ। এখন আপনারা বলুন এক কোটি সত্তর লক্ষ টাকায় কি এই রকম স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরি করা সম্ভব? উদগ্রীব মুখে তাকালেন এলিজাবেথ।
ডাক্তার বললেন, ঠিক কী ধরনের স্বাস্থ্যকেন্দ্র হবে তা না জানলে বলা মুশকিল। কিন্তু ওই পঁচাশি লক্ষ টাকার ব্যবস্থা কীভাবে হবে?
এলিজাবেথ নিচু গলায় বললেন, ওটা নিয়ে আপনারা চিন্তা করবেন না।
ডাক্তার তামাং চমকে তাকালেন। এলিজাবেথ একটু যেন বিব্রত হলেন, আমি আপনাদের সঙ্গে কাজ করতে চাই। এই টাকায় বিশাল কিছু না হোক সাধারণ মানুষের কিছু প্রয়োজন যদি মেটানো যায় সেই চেষ্টাই না হয় আমরা করি।
ডাক্তার বললেন, আপনার প্রস্তাব শুনে খুব খুশি হলাম। এখানকার গরিব মানুষদের জন্যে আপনি এতটা ভেবেছিলেন, ওদের সাহায্যের জন্যে এগিয়ে এসেছেন, এ থেকে আপনার মনের পরিচয় আমি পাচ্ছি। কিন্তু এলিজাবেথ, এর সঙ্গে নিরাময়ের সম্পর্ক কোথায়? এখানে ঘরের সংখ্যা অল্প, জায়গাও কম। আপনি যা চাইছেন তা তো এখানে হবে না।
এলিজাবেথ বললেন, ঠিকই। কিন্তু নিরাময়কে একপাশে রেখে আমরা যদি নতুন বাড়ি তৈরি করে নিই তা হলে তো স্থানাভাব হবে না। ওপাশে অনেকটা জায়গা খালি পড়ে আছে। এই বাড়ির মালিকানা নিয়ে সমস্যা থাকলে তার সুরাহা করা যেতে পারে।
ডাক্তার তামাং চুপচাপ শুনছিলেন। এবার বললেন, আপনার ইচ্ছেকে আমি সম্মান জানাচ্ছি। কিন্তু একটা প্রশ্ন, নতুন বাড়ি যদি তৈরি করা হবে তবে সেটা এখানে কেন? শহরের মধ্যে জায়গা দেখে করাই তো ভাল, যাতে যোগাযোগের সুবিধে পাওয়া যায়, তাই না?
এলিজাবেথ বললেন, তাতে শহরের মানুষের সুবিধে হতে পারে, কিন্তু যাদের কথা ভেবে এই পরিকল্পনা সেই পাহাড়ের মানুষরা বঞ্চিত হবে। ওই গ্রাম থেকে নেমে শহরে গিয়ে যদি চিকিৎসা করাতে আপত্তি না থাকত তা হলে ওরা হাসপাতালেই যেত। আসলে মানুষের মনে কোনও কোনও ব্যাপারে যুক্তিহীন জড়তা জন্মে যায়। গ্রামের মানুষের পক্ষে এখানে আসা সহজ এবং স্বাভাবিক হবে। গ্রাম এবং শহরের ঠিক মাঝখানে বলে আমরাও কিছু সুবিধে পাব। তা ছাড়া, আপনার সম্পর্কে এখানকার মানুষের মনে দুর্বলতা আছে, আপনাকে ওরা সন্ন্যাসীর মতো মনে করে। আমি নিরাময় নামটার সুযোগ নিতে আপনাদের অনুরোধ করছি।
সুযোগ! ডাক্তার অবাক হলেন।
নিরাময় নাম রাখলে ওদের মানসিক জড়তা চলে যাবে। হ্যাঁ, ডক্টর তামাং, আপনি তো মিস্টার ব্রাউনের বন্ধু ছিলেন। আপনি মদ খাওয়া পছন্দ করেন কিন্তু এখানকার সাধারণ মানুষ সেটাকে উপেক্ষা করে। আপনার ওপর গভীর আস্থা না থাকলে ওরা কেউ মদ খেয়ে থাকা ডাক্তারের কাছে অসুস্থ হয়ে যেত না। শুধু এই কারণেই আপনি যদি ওঁর সঙ্গে যোগ দিয়ে এই নতুন নিরাময় তৈরি করেন সেই উদ্দেশ্যেই আমি এসেছি। এলিজাবেথ বললেন।
ডাক্তার তামাং ঠোঁট কামড়ালেন। তারপর বললেন, ঠিক আছে। কেউ যদি দশ পা এগিয়ে ভাবতে পারে তা হলে আমি এক পা এগোব না কেন? কিন্তু এই দুই প্রৌঢ়ের পক্ষে কত রোগী দেখা সম্ভব?
আপনারা দুজনে মিলে স্থির করুন মানুষের প্রাথমিক প্রয়োজন কী এবং সেই বিভাগগুলো খুলবেন। একটা অনুরোধ, প্রতিটি বিভাগে উপযুক্ত এবং বিশেষজ্ঞ ডাক্তার যেন ভারপ্রাপ্ত হয়ে থাকেন। কিন্তু তাঁর পরামর্শ নিয়ে যেসব ডাক্তার পেশেন্টদের সঙ্গে কাজ করবেন তারা যেন পাহাড়িদের ভাষা জানেন, সেটা আগে দেখতে হবে।
পাহাড়িদের ভাষা সমতল থেকে পাশ করা খুব কম ডাক্তারই জানেন। সে ক্ষেত্রে তাদের ট্রেনিং দিয়ে ভাষা শেখাতে হয়। ডাক্তার তামাং হাসলেন, আপনার বক্তব্য আমি বুঝতে পেরেছি। আপনি চাইছেন না গ্রামের গরিব মানুষগুলোর কোনও কমিউনিকেশন প্রবলেম যেন না থাকে; তারা স্বচ্ছন্দে মনের কথা বলতে পারে, তাই তো?
ঠিক। এটা খুব জরুরি।
আজকাল পাহাড়ের অনেক ছেলেই ডাক্তারি পড়তে যাচ্ছে। আমরা তাদের কাছে আবেদন করতে পারি।
হ্যাঁ। কিন্তু অন্য জায়গায় চাকরি করলে তারা যা পেত এখানে তার চেয়ে কম পেলে হয়তো অনুগ্রহ দেখাতে পারে এবং সেটা আমাদের কাম্য নয়। আমরা চেষ্টা করব ঠিকঠাক পারিশ্রমিক দিতে। এখন বলুন, আমাদের এই পরিকল্পনা কতদিনে বাস্তব চেহারা নেবে?
ডাক্তার তামাং বললেন, অন্তত তিন-চার বছর।
ওঃ নো। প্রচণ্ড জোরে মাথা দোলালেন ভদ্রমহিলা, আমাদের টার্গেট এক বছর। তার জন্যে অল-আউট যাব আমরা। ডাক্তার, আপনি কিছু বলছেন না?
ডাক্তার এতক্ষণ শুনছিলেন। এবার বললেন, আমার কিছু বলার নেই এলিজাবেথ। আপনি যা চাইছেন তাই হবে। আমার এতদিনের ভাবনাচিন্তা আপনার প্রস্তাব শোনার পর আমি পাল্টে ফেলতে রাজি আছি।
এলিজাবেথ উঠে দাঁড়ালেন, আজ এই পর্যন্ত। ডক্টর তামাং-এর ওপর দায়িত্ব থাকবে সাধারণ অসুখের চিকিৎসা দেখার। আপনি বাকিটার দায়িত্ব নেবেন। মিউনিসিপালিটির অনুমতি, নতুন নিরাময়ের নির্মাণের জন্যে ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে কথাবার্তা যদি ডক্টর তামাং বলেন তাহলে ভাল হয়। টেন্ডার চেয়ে কাজ শুরু করতে গেলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। এ ব্যাপারে যাঁরা যোগ্য তাঁদের মধ্যে থেকে একজনকে নির্বাচন করুন। আর হ্যাঁ, নতুন নিরাময়ের চুড়ান্ত দায়িত্বে আমরা তিনজন থাকছি যদি অনাবাসী আইন প্রতিবন্ধক হয়ে না দাঁড়ায়। ডাক্তার তামাং, আপনার সঙ্গে আবার কখন কথা বলা যেতে পারে?
চব্বিশ ঘণ্টা সময় দিন। আমরা যদি প্রতিদিন এই সময় নিরাময়ে মিলিত হই তাহলে কাজ করতে সুবিধে হবে। ডাক্তার তামাং বললেন।
এলিজাবেথ মাথা নেড়ে বেরিয়ে গেলেন দ্রুত, সঙ্গে বিষ্ণুপ্ৰসাদ। ডাক্তার তামাং ঘুরে দাঁড়ালেন, এরকম কখনও ভাবতে পেরেছেন?
ডাক্তার মাথা নাড়লেন, না।
ভদ্রমহিলা এসেছিলেন স্রেফ কৌতূহলে। বহু বছর আগের দেখা একজন মানুষের কাছে। এসে থেকে গেলেন। আমি শুনেছি রাত্রে মাত্র পাঁচ ঘণ্টা ঘুমোন। কখনও অলস সময় কাটান না। মিস্টার ব্রাউনের বাড়িতে যে মহিলাকে আমি সেদিন দেখিছিলাম তার সঙ্গে আজকের এর কোনও মিল নেই।
ডাক্তার বললেন, এদেশে এসে বিদেশিনীরা এমন কর্মকাণ্ড অনেক করেছেন ডক্টর তামাং। আমরা তাঁদের জন্যে গর্ব অনুভব করি। এলিজাবেথ সেই তালিকাটা বাড়ালেন। কিন্তু এবার থেকে নতুন নিরাময়ের জন্যে আমাদের সক্রিয় হতে হবে।
ইয়েস। জানেন ডাক্তার। ক্রমশ নিজেকে ঘোলা জলের মতো মনে হচ্ছিল। জীবন সম্পর্কে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছিলাম। এই উদ্যোগ আমাকে প্রচণ্ড সাহায্য করবে। উনি যে আমার কথা মনে রেখেছেন এ জন্যে আমি কৃতজ্ঞ। ডক্টর তামাং বললেন।
.
কেউ কথা বলছিল না। বিছানার পাশে বসে নন্দিনী ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন। সায়নের চোখ বন্ধ। সম্ভবত মায়ের স্পর্শে যে সুখ তা সমস্ত শিরায় শিরায় উপভোগ করছিল সে। সায়নের বাবা বসেছিলেন জানলার ধারে। জানলা ঠাণ্ডার কারণে বন্ধ।
নন্দিনী বললেন, অনেকদিন তো হয়ে গেল, এবার যেতে হবে বাবা।
চোখ বন্ধ করেই সায়ন জিজ্ঞাসা করল, কবে যাচ্ছ?
নন্দিনী বললেন, তোর বাবা আজ টিকিট কাটতে দেবেন।
ডাক্তার আঙ্কলকে বললে টিকিট পেয়ে যাবে।
তোর শরীর কেমন আছে এখন?
ডাক্তার আঙ্কল তো তোমাকে বলেছেন, ভাল আছি।
সায়নের বাবা বললেন, সম্পূর্ণ ভাল কী করে হবে? সেটা নয় বলেই ডাক্তারবাবু কম কথা বলাতে বলেছেন।
সম্পূর্ণ ভাল আমি কখনওই হব না বাবা।
তবু—
চোখ খুলল সায়ন, তোমরা টিভিতে ফুটবল খেলা দেখেছ? নব্বুই মিনিট ধরে হয়, তার পরে এক্সট্রা টাইম, তারপর টাইব্রেকার আর তাতেও সুরাহা না হলে সাডেন ডেথ, গোল করলেই খেলা শেষ। এসব সাধারণ মানুষের জন্যে। আমাদের জন্যে ওয়ান ডে ক্রিকেট। পঞ্চাশ ওভার খেলার কথা ছিল, বৃষ্টির জন্যে কমিয়ে পঁচিশ। আমার কুড়ি ওভার চলে গেছে। পাঁচ ওভার পরে প্যাভিলিয়নে ফিরে যেতে হবেই। মা, এসব নিয়ে তুমি একটুও চিন্তা কোরো না।
সায়নের বাবা মাথা নিচু করলেন, অনেক চেষ্টায় নন্দিনী নিজেকে সামলালেন। এই সময় দরজায় এসে দাঁড়াল কঙ্কাবতী। ওঁদের দেখে দুটো হাত কপালে তুলে নমষ্কার করল। এখন তার পরনে স্কুলের ইউনিফর্ম নেই। নন্দিনী ডাকলেন, এসো৷।
কঙ্কাবতী ধীরে ধীরে সায়নের সামনে এল। তাকে দেখে সায়ন হাসল, আমি একটু মায়ের আদর খেয়ে নিচ্ছি, তুমি তো রোজ খাও।
কঙ্কাবতী হাসল, তারপর খুশি খুশি গলায় বলল, আমি আবার স্কুলে যাচ্ছি। আমার যে কী ভাল লাগছে তা বোঝাতে পারব না।
নন্দিনী বললেন, বাঃ, পড়াশুনা করতে তোমার ভাল লাগে বুঝি?
হ্যাঁ, আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে। আমি ভেবেছিলাম আর কোনওদিন স্কুলে যেতে পারব না। কিন্তু সায়ন বলত নিশ্চয়ই পারব। তাই না সায়ন? কঙ্কাবতী যেন আচমকা পাল্টে গেছে। শামুকের মতো মুখ লুকোনো মেয়েটা আজ ঝরনার মতো উজ্জ্বল।
সায়নের বাবা উঠে দাঁড়ালেন, এবার যেতে হয়।
ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন নন্দিনী। তারপর কঙ্কাবতীর দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বেরিয়ে এলেন বাইরে। মিসেস অ্যান্টনি উঠছিলেন তরতরিয়ে। ওঁদের দেখতে পেয়ে বললেন, একটা খুব ভাল খবর আছে। আমাদের নিরাময় আরও বড় হচ্ছে।
সায়নের বাবা বললেন, সেকী? একটু আগে যে অন্য কথা শুনলাম।
সেটা আমরাও শুনেছিলাম। কিন্তু ঈশ্বর যখন যেমন ইচ্ছে করেন পৃথিবীতে তেমন ঘটনা ঘটে। মিসেস অ্যান্টনি বললেন।
কথাটা খাটে উঠে বসা সায়নের কানে পৌঁছোল। সে গলা তুলল, তাহলে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ডিক্টেটারের নাম ঈশ্বর।
মিসেস অ্যান্টনি গালে হাত দিয়ে নন্দিনীকে বললেন, শুনলেন, আপনার ছেলের কথা শুনলেন!
নন্দিনী মাথা নাড়লেন, ওকে অমন কথা বলতে নিষেধ করে দেবেন।
মিসেস অ্যান্টনি হাসলেন, পাগল! ওকে নিষেধ করার ক্ষমতা আমার নেই। ওর মুখের দিকে তাকালেই সব গোলমাল হয়ে যায়। মিস্টার ব্রাউন যাওয়ার আগে কী যে ঢুকিয়ে দিলেন মনে! ওপরে উঠে গেলেন মিসেস ব্রাউন।
হোটলের পথে যেতে যেতে নন্দিনীর মনে হল তাঁর আর কিছু করার নেই। ছেলের সম্পর্কে এই যে এত ভেবেছেন তার কোনও প্রয়োজন ছিল না। সায়ন এখানে ওর মতো ভাল থাকবে।
আচ্ছা, প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও মনে ভাবনা আসে কেন?