১৭-১৮. ঘর পেল কঙ্কাবতী

আজ সকালে নিরাময়ে পৌঁছে জীবনে প্রথমবার নিজের জন্যে, সম্পূর্ণ নিজের জন্যে, একটা পুরো ঘর পেল কঙ্কাবতী। পরিষ্কার ঝকঝকে ঘর, খাটে ধবধবে বিছানা, একটা ওয়ার্ডরোব, টেবিল চেয়ার আর দেওয়ালে জিনিস, ওষুধপত্র রাখার র‍্যাক। ঘরের লাগোয়া দরজার ওপাশে বাথরুম, টয়লেট। কঙ্কাবতী কখনও হোটেলে থাকেনি কিন্তু শুনেছে হোটেলের ঘর নাকি এই ধরনের হয়।

আজ এখানে পৌঁছোবার খানিক বাদে তাকে নানান ধরনের পরীক্ষা করলেন ডাক্তার। তার রক্ত এবং ইউরিন নিয়ে যাওয়া হল। ডাক্তার বলে গেলেন, এখন থেকে এই বাড়িকে নিজের বাড়ি বলে মনে করবে। সবসময় হাসিখুশি থাকবে। ইচ্ছে হলে অন্যদের সঙ্গে গল্প করতে যেতে পারো। আর তোমার যদি কোনও বইপত্রের দরকার হয়, জানিও, এনে দেওয়ার চেষ্টা করব। তুমি ঝাল খেতে ভালবাস না মিষ্টি?

কঙ্কাবতী হেসে ফেলেছিল! শেষ প্রশ্নটা যেন আচমকা এসে গেল। তারপর দুষ্টুমি করে বলল, না ঝাল না মিষ্টি।

ডাক্তারও হেসেছিলেন, বেশ। তাই হবে।

মানুষটিকে ভাল লেগে গেল কঙ্কাবতীর। কঙ্কাবতী বাংলা চমৎকার বলতে পারে, পড়তেও। লিখতে গেলে অবশ্য হোঁচট খেতে হয়। ওদের বাড়ির ওপর হর্স স্যু বাঁকের গায়ে সুন্দর কাচের বাড়িতে একজন ভদ্রলোক একা থাকতেন। তিনি বাঙালি। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর পাহাড়ে চলে এসেছিলেন কারণ পাহাড় নাকি তাঁকে টানত। একেবারে বালিকা বয়সে তাঁর সঙ্গে ভাব হয়ে গিয়েছিল কঙ্কাবতীর। ভদ্রলোক খুব পড়তেন আর টেপ চালিয়ে রবীন্দ্রনাথের গান শুনতেন। ওঁর কাছে রোজ বিকেলে যেত সে। যেতে যেতে অনেকগুলো গান সেই বয়সেই শিখে নিয়েছিল। পরে যখন স্কুলে বাংলা নিল তখন ভদ্রলোক তাকে পড়াতেন। ওইটুকু তার বয়স তবু সে জেনে গিয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ছাড়া বিভূতিভূষণ তারাশঙ্কর আর জীবনানন্দ দাশ নামের তিনজন বাঙালি নাকি দারুণ দারুণ বই লিখে গিয়েছেন। একদিন স্কুলে শরৎচন্দ্রের মহেশ গল্পটি শুনে সে কেঁদে ফেলেছিল। বাড়ি না ফিরে সোজা সেই ভদ্রলোকের কাছে গিয়ে জবাবদিহি চেয়েছিল, আপনি আমাকে শরৎচন্দ্রের নাম বলেননি কেন? ভদ্রলোক বেশ অবাক হয়ে বলেছিলেন, অন্যায় হয়ে গিয়েছে মা। রবীন্দ্রনাথের পরেই ওর কথা বলা উচিত ছিল।

এই মানুষটি তাকে ওই কবিতাটি প্রায়ই শোনাতেন যা প্রথম দেখায় ডাক্তার শুনিয়েছিলেন। কঙ্কা, শঙ্কা করো না। শঙ্কা মানে যে ভয় সেটাও তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, কঙ্কাবতী কখনও ভয় পাবে না। জীবনে যত সমস্যা আসুক, মাথা সোজা করে তার সঙ্গে লড়াই করে যাবে। কঙ্কাবতীরা কখনও ভয় পায় না।

মানুষটিকে কোনওদিন ভুলবে না কঙ্কাবতী। তার জ্ঞান হওয়ার পর চারপাশে অমন কোনও মানুষকে সে দেখেনি। আসলে তাদের ওখানে অমন কারও থাকার কথাও ছিল না।

পাহাড়ের গায়ে ছোট ছোট বাড়িগুলোতে যে আরাম ছিল না সেটা বুঝতে অনেক সময় লেগেছিল। ওই ছোট ঘরগুলোতে তারা ঘুমোবার সময় কত অথবা প্রচণ্ড শীতে পাহাড় যখন কুঁকড়ে উঠেছে তখন গায়ে গা লাগিয়ে ছিঁড়ে যাওয়া কম্বলের তলায় পড়ে থাকতে হত। বাবার একটা কথা এখনও মনে আছে। কম্বলগুলো ছিঁড়ে গেছে বলে মা অনুযোগ করতে বাবা রেগে গিয়ে বলেছিল, গরম হওয়া নিয়ে তো কথা। ছেঁড়া কম্বলে তোমার কি কম গরম লাগছে?

কম্বল ছিঁড়ে গেলেও তার উত্তাপ কিছু কম হয় না। সেই উত্তাপ নিয়ে পূর্বপুরুষের মতো তাদের জীবন চলে যাওয়া উচিত ছিল। অনেকগুলো ঘর নিয়ে যে এলাকা তাকে বস্তি বলত সবাই। বস্তির সবাই সবাইকে চেনে, কোনও পরিবারের গোপনীয়তা বলে কিছু নেই। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই সে দেখেছে ঝগড়া ছাড়া কোনও পরিবারের দিন কাটে না। ঝগড়ার কারণ অভাব। ছেলেরা যা রোজগার করে তা এমনিতেই খুব কম তার ওপর একটা অংশ নেশার পেছনে উড়িয়ে দেয় বলে সমস্যা বেড়ে যায়। শিশুরা সবাই স্কুলে যাওয়া আরম্ভ করে। যাওয়াটা মজার, সেখানকার পরিবেশ বস্তির থেকে আলাদা বলে একটা আকর্ষণ থাকে কিন্তু বেশির ভাগ ছেলেমেয়ের উৎসাহটা ফুরিয়ে যায় দু-এক বছরের মধ্যেই। তাদের বাধ্য করতে অভিভাবকরা চেষ্টা করেন না। দশ-বারো বছর থেকেই ছেলেমেয়ে যদি রোজগার শুরু করে দেয় তাহলে খুশি হন তাঁরা। স্বামীর কাছে হতাশ হওয়া স্ত্রীরা ছেলেমেয়ের ওপর ভরসা করতে শুরু করেন। তাই স্কুলে যাওয়ার বদলে ওরা যদি কিছু কামাই করে তাতে আপত্তির কিছু পান না। তা ছাড়া অভাব যেখানে ময়লার মতো শরীরে জড়িয়ে, ধুয়ে ফেলার সাবান কেনা যেখানে স্বপ্নের মতো, সেখানে ছেলেকে স্কুলে পাঠানো, তার নানান প্রয়োজন মেটানো বোঝা হয়ে দাঁড়ায় অনেকের কাছে।

তার ক্ষেত্রেও এটা হওয়া স্বাভাবিক ছিল। তার বয়সী আর পাঁচটা মেয়ে, ঘরে যতই অভাব থাক, দুপুরের পর যখন সেজেগুজে সিনেমা দেখতে যায় তখন তাদের হিন্দি সিনেমার নায়িকা বলে ভুল হয়। সকালে যে ছেঁড়া জামা পরে জামাকাপড় কাচে, জল তোলে, দুপুরের পর তার চেহারা আলাদা হয়ে যায়। তেরো পার হলেই ওরা দলে দলে ছেলে বন্ধু পেয়ে যায়। তাদের টাকায় ফুর্তি করতে ওদের একটুও অসুবিধে হয় না। যা ছিল স্রোতের মতো তাতে গা ভাসানোই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু তার ক্ষেত্রে সে রকমটা ঘটল না। ঘটল না বলে কম কথা শুনতে হয়নি। লেখাপড়া শিখে বিদ্যের জাহাজ হবে, মেমসাহেব হয়ে চাকরি করবে ইত্যাদি টিপ্পনি শুনতে হয়েছে চারপাশ থেকে। যারা ছিল খেলার সঙ্গিনী তারা সরে গিয়েছে মানিয়ে নিতে না পারায়।

বাবার মুখটা মনে পড়লে এখনও কান্না পায় কঙ্কাবতীর। খুব নিরীহ মানুষ ছিল। মা কত মুখ করত, একতরফা কত বকাবকি করত কিন্তু বাবা জবাব না দিয়ে মুখ নিচু করে বসে থাকত। আর সেইজন্যে বস্তির অন্য বউরা ঈর্ষা করত মাকে। মায়ের নাকি মহাভাগ্য। মা যা শোনায় তার সিকি শোনালে তাদের স্বামীরা মেরে হাড় ভেঙে দিত। মায়ের ক্ষেত্রে কিছুই হয় না। অথচ মা খুশি হত না। বাবা যে কিছু বলত না তাতে মায়ের রাগ বেড়ে যেত। বারংবার বলার জন্যে হুকুম করত। শেষ পর্যন্ত বাবা খুব করুণ গলায় বলত, আমি কী বলি বলো তো। তুমি তো সব ঠিক কথা বলছ।

বাবার রোজগার ভাল ছিল না। বস্তিতে যারা ড্রাইভারি করে তাদের হাতে কাঁচা টাকা আসে। সংসারে না দিয়ে বাইরে উড়িয়ে দেয় যারা তাদের কথা আলাদা। কিন্তু বাবা ড্রাইভার ছিল না। স্ট্যান্ডে যেসব ট্যাক্সি দাঁড়াত তাদের হয়ে প্যাসেঞ্জার ডাকত বাবা। বালিকা বয়সে মায়ের সঙ্গে বাজারে যেতে গিয়ে বাবাকে সে চেঁচিয়ে বলতে শুনেছে, শিলগুড়ি শিলগুড়ি- আউর দো প্যাসেঞ্জার। শেয়ারের ট্যাক্সি ভর্তি হয়ে গেলে ড্রাইভার বাবার হাতে একটা টাকা গুঁজে দিয়ে চলে যেত। এসব আন্দোলনের আগের কথা। আন্দোলনের পরে ইউনিয়ন হয়েছে। এমন কী যারা প্যাসেঞ্জার জোগাড় করে তাদের জন্যে একটা আর্থিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। মা বলত, তুমি ড্রাইভারি শিখে নিচ্ছ না কেন? ড্রাইভারদের সঙ্গে তোমার এত বন্ধুত্ব, শিখতে কদিন লাগবে? বাবা বলত, গাড়ির সামনে বসলেই মনে হয় খাদ আমাকে ডাকছে। আমি গাড়ি চালালে তুমি বিধবা হবে।

এত লোক গাড়ি চালায় তারা তো একথা ভাবে না। বাচ্চা বাচ্চা ছেলেরা আঠারো না পেরোতেই ড্রাইভার হয়ে যাচ্ছে, আর তুমি?

তখন কঙ্কাবতীর মনে হত বাবা ড্রাইভার হলে বেশ হত। কখনও সখনও সে বাবার গাড়িতে চেপে শিলিগুড়ি যেতে পারত। বাবা গাড়ি চালাচ্ছে, এই দৃশ্য কল্পনা করলেই বুক ফুলে উঠত। কিন্তু তাকে একা পেয়ে বাবা বলেছিল, ড্রাইভার হতে গেলে আমাকে দুনম্বরি করতেই হবে। ওই কাজটা আমার দ্বারা হবে না বুঝলি। তোর মা কথাটা কিছুতেই বুঝছে না।

হ্যাঁ, ওই বাবার জন্যেই আর পাঁচটা মেয়ের থেকে তার জীবন আলাদা হয়ে গিয়েছে। একা পেলেই বাবা তাকে বলত, তোকে মন দিয়ে পড়তে হবে। অনেক পড়াশুনা করতে হবে। এখানে শেষ হলে দার্জিলিং-এ পড়তে যাবি। সেখান থেকে কলকাতায়। আমি যেমন করে পারি তোর পড়ার খরচ চালাব।

কেন? সে প্রশ্ন করেছিল।

বাবা দুমুহূর্ত তার মুখের দিকে তাকিয়েছিল। তারপর বলল, ইজ্জত নিয়ে বাঁচতে হলে পেটে বিদ্যে থাকা দরকার। ইজ্জত যার আছে সে মেয়েছেলে না ব্যাটাছেলে তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। আমি যা পারিনি তা তোকে পারতে হবে।

ফলে যে সময়ে মেয়েরা পড়া ছেড়ে বাড়িতে বসে যেত সে সময়ে তাকে আড়াই কিলোমিটার পাহাড়ি পথ ভেঙে স্কুলে যেতে হত। কখনও একটা রুটি আর স্কোয়াশের তরকারি জুটত, কখনও শুধুই তরকারি। ভগবান এদিকের পাহাড়ে আগাছার মতো স্কোয়াশের গাছ ছড়িয়ে দিয়েছেন যাতে গরিব মানুষগুলো তাই খেয়ে বেঁচে থাকতে পারে। প্রাইমারি স্কুলে ভাল রেজাল্ট হয়েছিল কঙ্কাবতীর। স্যার বাড়িতে এসে মাকে বলে গিয়েছিলেন তিনি চেষ্টা করবেন ডাউহিল স্কুলে তাকে ভর্তি করিয়ে দিতে। সেখানে না হলে অন্য স্কুল ত আছেই। মোদ্দা কথা এ মেয়েকে পড়াশুনা ছাড়ানো চলবে না। কথাটা বস্তিতে জানাজানি হয়ে গেল। আর তখনই অদ্ভুত অদ্ভুত কাণ্ড দেখল কঙ্কাবতী। যারা এত দিন মুখ বেঁকাত তারা এখন প্রশংসার চোখে তাকায়। দু-একজন বাড়িতে এসে বলে গেল মেয়েকে পড়া না ছাড়াতে। যদি প্রয়োজন হয় অল্পস্বল্প টাকা তারা দিতে পারে। এসব দেখেশুনে মা গালে হাত দিল। সামনে বসিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, তোর কি পড়াশুনা করতে এত ভাল লাগে?

সে মাথা নেড়েছিল নীরবে।

তাহলে পড়। আমার কী! আমাকেই সব কাজ করতে হবে। তবে বলি, এতই যখন পড়ার ইচ্ছে তখন সেইসব বাড়িতে জন্মালি না কেন যেখানে স্বামীরা দু পকেট ভরে টাকা নিয়ে আসে সংসারের জন্যে?

মানুষ কি ইচ্ছে করে জন্মাতে পারে? সে পাল্টা জিজ্ঞাসা করেছিল।

পুরুষমানুষরা পারে। মেয়েমানুষের সেই ক্ষমতা নেই, ভগবান দেননি।

মায়ের কথাটা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু চারপাশের দিকে তাকালে মনে হয় মা মিথ্যে বলেনি। এই যে নরবাহাদূরের মেয়ে লীলা, বিয়ের দুমাসের মধ্যে মুখে কালসিটে নিয়ে ফিরে এসেছিল বাপের কাছে, তার বাচ্চা হল এই সেদিন। কিন্তু রিম্বিকে থাকা স্বামী ভুলেও খোঁজ নিতে আসেনি একবারও। যত দিন পেটে বাচ্চা ছিল নরবাহাদূরের বউ মেয়েকে গালাগাল করে গিয়েছে সমানে। মেয়েটার গলা শোনা যেত না তখন। বাচ্চা হওয়ার পর মেয়েটা চেঁচাতে লাগল, কেন আমার বরকে বিয়ের সময় যা যা দেবে বলেছিলে সেসব দাওনি। দেখেশুনে তোমরা বিয়ে দিয়েছিলে। কথা দিয়ে রাখোনি, দোষ তো তোমাদের।

এই বস্তির ঘরে ঘরে যারা অন্যের দয়ায় বেঁচে আছে তারা মেয়ে। হয় মা, নয় বউ অথবা মেয়ে। কোনও ছেলে এমন অসহায় অবস্থায় নেই। যে বেকার, সংসারে টাকা দিতে পারে না তাকে কথা শোনালে কদিনের জন্যে উধাও হয়ে যায়। ছেলেদের কেউ বলে না সন্ধের আগেই বাড়িতে ফিরতে। তাদের ইজ্জত লুঠতে কেউ রাস্তার অন্ধকারে ওত পেতে থাকে না। মেয়েদের বেলায় থাকে। আবার যেসব পরিবারের স্বামীরা ঠিকঠাক টাকা দেয় তাদের বউদের গলা শোনা যায় না। স্বামীরা পা নাচায় আর সংসারের যাবতীয় কাজ শেষ করতে হিমসিম খায়। দুবেলা পেট ভরে খাওয়ার বদলে সারা জীবনের স্বাধীনতা তারা খুইয়ে বসে আছে। এখন বড় হয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তৃতা শুনলে গায়ে জ্বালা ধরে কঙ্কাবতীর। সর্বহারার পাশে দাঁড়ানোর কথা যারা বলে, শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতদের আন্দোলনের জন্যে যারা উদ্বুদ্ধ করে তাদের কান ধরে বলতে ইচ্ছে করে, তোরা ঘরের মা বোন বউয়ের দিকে তাকা। আগে এদের উদ্ধার কর, এদের মর্যাদা দে তারপর পৃথিবীর নির্যাতিত মানুষের জন্যে ভাববি।

প্রাইমারি স্কুলের স্যারের চেষ্টা যে সফল হবে কল্পনাও করেনি কঙ্কাবতী। ডাউহিলের স্কুল এই জেলার প্রথম সারির নামী স্কুল। দূর দূর থেকে বড়লোকের মেয়েরা পড়তে আসে সেখানে। ভর্তি হওয়ার জন্যে তাদের অভিভাবকদের অনেক কিছু করতে হয়। ওখানে ভর্তি করতে টাকা খরচ করতে তাদের আপত্তি নেই। স্কুলে হোস্টেল আছে কিন্তু সেখানে সবার জায়গা হয় না বলে আশেপাশে অনেক প্রাইভেট হোস্টেল গজিয়ে গিয়েছে। ওই স্কুলের ইউনিফর্ম বানাতে খরচ অনেক, স্কুলের টাকাও কম নয়। তা ছাড়া স্টুডেন্টদের স্ট্যাটাসও নাকি দেখা হয়। অতএব ওখানে তার জায়গা পাওয়ার স্বপ্ন দেখতে চায়নি কঙ্কাবতী। কিন্তু বাবাকে দিয়ে আবেদনপত্রে সই করিয়ে স্যার জমা দিয়েছিলেন সেখানে। কয়েক সপ্তাহ বাদে হাসিমুখে এসে বললেন, মারে, তোর হয়ে গেছে। ডাউহিল স্কুলের ইন্টারভিউ দিতে হবে তোকে।

ইন্টারভিউ? সে অবাক হয়েছিল।

হ্যাঁরে। আর আমি জানি ইন্টারভিউতে তুই পাস করে যাবি।

ইন্টারভিউ পাওয়া মানে হয়ে যাওয়া নয়, কিন্তু স্যারের মুখের ওপর কিছু বলতে পারেনি কঙ্কাবতী। বাবার কল্যাণে সমস্ত বস্তি জেনে গেল কথাটা। এই প্রথম বস্তির কোনও মেয়ে বা ছেলে এমন সুযোগ পেতে চলেছে এই গর্ব কেমন করে সবার হয়ে গেল। যার সঙ্গে দেখা হচ্ছে সে-ই বলছে ভাল করে ইন্টারভিউ দিতে। যেন তার সুযোগ পাওয়াতে তাদের স্বপ্ন সার্থক হবে। বাবা বলল, মেমসাহেবদের স্কুলে ভর্তি হচ্ছিস, কিন্তু মনে রাখিস, মেমসাহেবদের ভাল গুণগুলো শিখতে হবে কিন্তু মেমসাহেব হবি না। মা বলল, খুব তো বলছ। খরচ তো দশগুণ বেড়ে যাবে। কী করে কী হবে?

বাবা হেসেছিল। লাজুক হাসি। তারপর বলল, তোমাদের বলিনি, আমি শিলিগুড়িতে গিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য টেস্ট দিয়ে এসেছি।

অ্যাঁ? মা চিৎকার করে উঠেছিল, তুমি সত্যি বলছ? ড্রাইভার হবে? কিন্তু গাড়ি চালানো শিখলে কবে?

বাবা বলল, ওটা আবার কঠিন নাকি। গাড়ি নিউট্রালে রেখে স্টার্ট দাও। তারপর ফার্স্ট গিয়ারে নিয়ে গিয়ে অ্যাকসিলেটারে চাপ দিলেই ওটা সামনে যাবে। একটু এগিয়ে সেকেন্ড গিয়ারে নিয়ে যাও। আরও জোরে গেলে থার্ড এবং ফোর্থ গিয়ার। যখনই গিয়ার চেঞ্জ করবে তখনই ক্লাচ চেপে ধরবে। এই তো ব্যাপার। এর মধ্যে হাতি ঘোড়া কী আছে।

কঙ্কাবতী দেখেছিল, মায়ের মুখ বৃষ্টি ধোওয়া গাছের পাতার মতো সুন্দর হয়ে গেল। যেন এক মুহূর্তে সমস্ত দুশ্চিন্তা উধাও। বাবা উঠে গেলে মা তাকে বলেছিল, মানুষটা সত্যি ভাল রে। তবে আমার জন্যে কোনওদিন ভাবেনি কিন্তু তোর জন্যে সব কিছু করতে পারে লোকটা।

যেদিন ইন্টারভিউ দিতে যাবে সেদিন ভাল পোশাক পরেছিল সে। বাবাই কিনে এনেছিল জামাটা। স্যার সকালেই এসে হাজির। আর কী আশ্চর্য, দুজন মহিলার সঙ্গে নরবাহাদূরের বউ এসে হাজির। হাতে পুজোর থালা। তা থেকে ফুল তুলে ওর হাতে তুলে দিয়ে বলেছিল, তোর জন্যে পুজো দিয়ে এলাম।

আমার জন্যে?

হ্যাঁ। আর কেউ তো নেই যার ভাল চেয়ে পুজো দেওয়া যায়। তারপর ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করেছিল, তুই আমার মেয়ের হয়ে একটা চিঠি লিখে দিবি?

হ্যাঁ।

তাহলে একবার আসিস।

সে একটা দৃশ্য হয়েছিল বটে। একপাশে স্যার আর একপাশে বাবাকে নিয়ে সে যখন ডাউহিলের স্কুলের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে তখন অন্তত জনা দশেক মানুষ তাদের সঙ্গ নিল। তারাও যাবে তাকে এগিয়ে দিতে। স্যার তাদের অনুরোধ করলেন, আপনাদের যাওয়ার দরকার নেই। স্কুলের ভেতরে ঢুকতে দেবে না। আপনারা প্রার্থনা করুন যাতে ওর অ্যাডমিশনটা হয়ে যায়।

স্কুলের অফিসরুমের সামনে ওঁরা অপেক্ষা করছিলেন। কঙ্কাবতীর ডাক এল প্রায় দু ঘন্টা অপেক্ষা করার পরে। এর মধ্যে সে দেখেছে সুন্দর অসুন্দর দেখতে মেয়েদের বাবা-মায়েরা কী পরিমাণ যত্ন করছে, তাদের পোশাক হাবভাব দেখেই বোঝা যায় সমাজের অর্থবান শ্রেণীর মানুষ।

তোমার নাম?

কঙ্কাবতী দেবী।

তোমার স্কুলের রেজাল্ট তো ভাল। কে পড়ায় তোমাকে?

স্কুলের স্যার। বাড়িতে কেউ পড়ায় না।

তোমার বাবা কী করে?

একমুহূর্ত ভাবল কঙ্কাবতী, তারপর বলল, ট্যাক্সি চালায়।

আই সি। তারপরই জিজ্ঞাসা করলেন, ভারতবর্ষের সবচেয়ে সম্মানিত মহিলার নাম কী?

 মাদার থেরেসা।

যেখানে বাতাস নেই সেখানে পাখি উড়তে পারবে?

 না।

কেন?

বাতাস যেখানে নেই সেখানে পাখি ডানা ঝাপটালেও কোনও প্রতিক্রিয়া হয় না। বাতাসের সঙ্গে পাখির ডানা ঝাপটানোর ফলে যে প্রতিক্রিয়া হয় তাই পাখিকে আকাশে ভাসিয়ে রাখে।

গুড। আমি দুটো বাক্য বলছি। তুমি ওদের এক বাক্যে বল। ইউ সেইড সামথিং। আই ডিড নট হিয়ার।

কঙ্কাবতী বলল, আই ডিড নট হিয়ার হোয়াট ইউ সেইড। লিস্টে নাম উঠল। এবং সেটা প্রথম দিকে।

বাবা তাকে জড়িয়ে ধরেছিল। এখন মনে হয় বাবার মত নিঃস্ব নিঃসঙ্গ মানুষ তাকে নিয়ে ধনী হতে চেয়েছিল। পকেটে যা ছিল তাই দিয়ে মিষ্টি কিনে সবাইকে খাইয়েছিল। সেদিন বস্তিতে উৎসবের আবহাওয়া। এই লোকগুলো কী করে পাল্টে গেল কে জানে!

সে হোস্টেলের মেয়ে নয়। বাড়ি থেকেই যাবে। কিন্তু স্কুলের নিয়ম মানতে হবে। প্রথমে পোশাক। বাজারের একটি বিশেষ মারোয়াড়ির দোকানে সবাই পোশাক কিনতে যায়। তারাও চটপট বানিয়ে দেয়। স্যার তাকে নিয়ে সেখানে গেলেন। খুব ভিড় সেখানে। এক একজন কয়েক প্রস্থ পোশাকের অর্ডার দিচ্ছেন। এইসময় বাবা সেখানে এলেন। স্যারকে তিনি তাই বলেছিলেন। তাদের যখন কাউন্টারের সামনে পৌঁছোবার সুযোগ হল তখন স্যার প্রধান মালিককে বললেন, দুটো পোশাক হলেই চলবে।

ভদ্রলোক বললেন, দুটো নয়, তিনটে করিয়ে নিন।

স্যার বললেন, একটু অসুবিধে আছে!

ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, খুকি, তুমি কোথায় থাকো?

কঙ্কাবতী ঠিকানা বলল।

ভদ্রলোক চোখ বড় করলেন, আরে! তুমিই সেই মেয়ে! প্রিন্সিপ্যাল তোমার খুব প্রশংসা করছিলেন। স্যার, আপনারা দুটোর অর্ডার দিন, তৃতীয়টার জন্যে কোনও পয়সা লাগবে না। ওটা আমি ওকে উপহার দিচ্ছি।

সে কী? না-না।

না। শুনলাম, ওকে বাতিল করার জন্য উঁচু ক্লাসের মেয়েদের যে প্রশ্ন করা হয় তাই করা হয়েছিল। অথচ ও চমৎকার জবাব দিয়েছে। আরে ভাই আমি মারোয়াড়ি। সত্যি কথা। কিন্তু এখানে জন্মেছি ষাট বছর আগে। আমার বাবা এখানে এসেছিলেন বাইশ বছর বয়সে। রাজস্থানের চেয়ে এই পাহাড় আমার অনেক আপন। নিজেকে নেপালি বলতে আপনারা আপত্তি করতে পারেন কিন্তু আমি আমাকে পাহাড়ি বলি। তাহলে এই ছোট্ট মিষ্টি গুণী মেয়েটিকে যদি তার পাহাড়ি দাদু একটা ইউনিফর্ম ভালবেসে দিতে চায় তাহলে আপনারা আপত্তি করবেন না।

ভদ্রলোক আর একজনকে মাপ নিতে বললেন। সেসব হয়ে যাওয়ার পর স্যার বাবাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি টাকা নিয়ে এসেছেন?

নিশ্চয়ই।

কঙ্কাবতী অবাক হয়ে দেখল অ্যাডভান্স নয়, বাবা পুরো টাকাটাই দিয়ে দিল। বাড়ি ফেরার পথে সে জিজ্ঞাসা করল, তুমি অত টাকা কোথায় পেলে? মা বলছিল তোমার কাছে কোনও টাকা নেই।

বাবা বলেছিল, সকালে ছিল না, তাই বলে বিকেলেও থাকবে না এটা কে বলল? তোর মা তো এসব জানে না।

সে বলল, কিন্তু অত টাকা–?

আমাদের কাছে অত টাকা কিন্তু দেখলি তো যারা ইউনিফর্ম বানাতে এসেছিল তাদের অনেকের কাছে ওটা কিছুই নয়।

কিন্তু তুমি টাকাটা পেলে কোথায়?

আমি ধার নিয়েছি।

ধার?

হ্যাঁ। শোধ করে দেব। লাইসেন্স পেয়ে গেলে ট্যাক্সি চালাব। ডেইলি যা রোজগার হবে তাতে এক মাসেই শোধ হয়ে যাবে টাকাটা।

বাবার জন্যে তখন তার গর্ব হচ্ছিল।

আর তার পরেই তার স্কুলের ক্লাস শুরু হওয়ার আগেই পাহাড়ে আগুন জ্বলল। পশ্চিমবাংলা সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামল পাহাড়ের মানুষরা। পাহাড়ি রাজনীতি যাঁরা করছেন তাঁরা স্বতন্ত্র গোর্খাল্যান্ড প্রতিষ্ঠার দাবিতে মরিয়া হলেন। পুলিশের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ প্রকাশ পেতে লাগল নানাভাবে। তখন সমস্ত স্কুল কলেজ বন্ধ। পাহাড় উত্তেজিত এবং সন্ত্রস্ত। গুলির আওয়াজে কুয়াশারাও যেন কেঁপে কেঁপে উঠেছিল।

লাগাতার ধর্মঘট চলছে। ব্যাপারটা ক্রমশ যুদ্ধের চেহারা নিয়ে নিল। সেই যুদ্ধ স্বাধীনতার জন্যে। পাহাড় পাহাড়িদের জন্যে। স্বাধীন গোর্খাল্যান্ড চাই।

কঙ্কাবতী এসব ঠিক বুঝতে পারত না। কিন্তু ওই আন্দোলনের জন্যে কখনও কখনও দোকানে কিছুই পাওয়া যেত না, এমনকী গাছগুলো থেকে স্কোয়াশও উধাও হয়ে গিয়েছিল। টুরিস্ট নেই তাই বাবার রোজগারও বন্ধ হয়ে গেল। বাড়িতে এমন কিছু নেই যা বিক্রি করে কিছু কেনা যায়। কোণঠাসা হয়ে পড়া কিছু মানুষ হেঁটে নেমে যাচ্ছিল শিলিগুড়িতে। ঠিক তখন বাবা একদম পালটে গেল।

এক বিকেলে বাবা জানাল, অনেক হয়েছে। আর নয়। এবার আমিও আন্দোলনে যোগ দিচ্ছি। আমার জন্যে তোমরা চিন্তা কোরো না।

মা আঁতকে উঠল, সে কী? আন্দোলনে গেলে তুমি মরে যেতে পারো।

মরবই এমন কোনও কথা নেই। আর যদি মরি তাহলে জাতভাইদের জন্যে লড়াই করে মরব। সে মরণ ঢের ভাল। এভাবে রোজ রোজ মরে বেঁচে থাকার কোনও মানে হয় না।

মা কাঁদল, আমাদের বস্তির তিনজন পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছে। তাদের কথা বলে বাবাকে আটকাতে চাইল। কিন্তু বাবা কোনও কথা শুনতে রাজি হল না। পার্টি অফিসে নাকি নাম লিখিয়ে এসেছে। আজ রাত্রেই অ্যাকশনে যেতে হবে।

কঙ্কাবতী চুপচাপ শুনছিল। বাবা যখন যাওয়ার আগে তার মাথায় হাত রাখল তখন সে জিজ্ঞাসা করেছিল, তুমি কি যুদ্ধ করতে যাচ্ছ?

যুদ্ধ? হ্যাঁ, এখন তো যুদ্ধই বলা যেতে পারে।

কিন্তু কেন?

বাবা হাঁটু মুড়ে বসে পড়েছিল, এই সব পাহাড়ে যারা থাকে তাদের চেহারা ভাষা আলাদা। পাহাড়ের অনেক ঝামেলার সঙ্গে লড়াই করে তারা বেঁচে থাকে। ব্রিটিশরা আসার আগে কোনও সমতলের মানুষ এখানে আসেনি। এরপর ওরা এসেছে এখানে ব্যবসা বা চাকরি করতে অথবা ফুর্তি করতে। এখানে যারা বাড়ি করেছে তারা এখান থেকে শুধুই নিয়েছে দেয়নি কিছু। আমাদের চাকর দারোয়ান ছাড়া কিছু ভাবেনি। আমাদের ব্যবহার করে আরামে থেকেছে ওরা। পশ্চিমবাংলার সঙ্গে জোর করে আমাদের যোগ করা হয়েছে। কিন্তু পাহাড়ের মানুষদের উপকারের জন্যে কিছু করেনি বাঙালিরা। এখানকার ভাল স্কুলে তাদের ছেলেমেয়ে পড়ে। সাহেবদের ছেলেমেয়ে। যে হাসপাতাল আছে সেখানে সুবিধে হয় না, চিকিৎসার জন্যে শিলিগুড়িতে যেতে হয়। বাঙালিরা আমাদের নিজের লোক মনে করে না। আমরা আর কতকাল পড়ে পড়ে মার খাব? তাই আমাদের স্বাধীন গোর্খাল্যান্ড চাই। চাইলেই তো কেউ হাতে তুলে দেবে না। আমাদের লড়াই করে নিতে হবে। এই পাহাড়ে পাহাড়টা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে এক দিন বলবে আমরাও মানুষ, কারও চাকর নই।

বাবা চলে গেল। সেই রাত্রেই গাড়ি গাড়ি পুলিশ এল লাঠি আর রাইফেল নিয়ে। চিৎকার কান্নায় রাতের অন্ধকার বীভৎস হয়ে উঠল। প্রতিটি ঘর থেকে যুবক প্রৌঢ়দের ধরে ধরে পুলিশ মারছিল। ঘর ছেড়ে মেয়েরা পালাচ্ছিল। তাদের ঘরেও পুলিশ এল। চিৎকার করে বলল, এ ঘরের মরদরা কোথায়?

মা দরজায় দাঁড়িয়ে বলল, কেউ নেই। আমি মেয়েকে নিয়ে আছি।

লোকগুলো শুনল না। জোর করে ঘরে ঢুকে খাটের তলাও খুঁজে দেখল। যাওয়ার সময় অকারণে উনুনটা ভেঙে দিয়ে গেল। যাওয়ার সময় বলে গেল ছেলেরা এসেছে খবর পেলেই তারা ফিরে আসবে। এসে বস্তি জ্বালিয়ে দেবে।

পুলিশ চলে যাওয়ার পর ভীতসন্ত্রস্ত নারী এবং বৃদ্ধেরাও রাগে ফেটে পড়ল। অদ্ভুত ঘৃণা জন্ম নিল সবার মনে। বেছে বেছে পুলিশ নেপালিদের ওপর অত্যাচার করছে। বাঙালি বা মারোয়াড়িদের কিছু বলছে না। পাহাড়ে গোলমাল শুরু হতেই অবশ্য বাঙালিরা নেমে গিয়েছিল। যাদের কোনও জায়গা নেই যাওয়ার তাদের বাড়ির সামনে পুলিশ প্রায়ই ঘুরপাক খেত। কিছু ছেলে এই রকম একটা বাঙালি পরিবারকে বাড়ি থেকে বের করে এনে সেখানে আগুন ধরিয়ে দিল। মজার কথা হল সেই বাঙালি পরিবারকে আশ্রয় দিয়েছিল এক গরিব নেপালি পরিবার।

সূর্য ডোবার আগেই রাস্তাঘাট ফাঁকা। অন্ধকার নামলেই গোলাগুলির আওয়াজ। গুজব রটছে খুব। মিলিটারি নেমেছে। অমুক দাগি পুলিশ অফিসারকে খুন করা হয়েছে। সরকারি বাড়ি, ট্যুরিস্ট বাংলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। তখন বয়স কম। তবু তার মনে হয়েছিল বোকামি। গোর্খাল্যান্ড হলে ওই সব বাড়িগুলো আবার নিজেদের টাকায় তৈরি করতে হবে। সরকার চালাতে হলে তো বাড়ির দরকার। ট্যুরিস্টরা না এলে বাবা ট্যাক্সি চালাবে কার জন্যে?

শেষ পর্যন্ত দুদিন প্রায় অনাহারের পর মা আরও এক পরিবারের সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিল, এখানে থাকা যাবে না। সঙ্গে যা নেওয়া যায় তা পুঁটলিতে এবং স্যুটকেসে নিয়ে ওরা রওনা হল। সূর্য উঠলে পাকদণ্ডির পথ ধরে বাজারের অনেক নীচে পিচের রাস্তায় নেমেছিল ওরা। মাত্র তিরিশ কিলোমিটার পথ, কিন্তু এ জীবনে সেই হাটার অভিজ্ঞতা ভুলতে পারবে না কঙ্কাবতী। মায়ের হাতে স্যুটকেস, তার হাতে পুঁটলি। আগে পিছে অন্যান্য মহিলা, শিশুরা। নীচের দিকে চলতে হচ্ছিল বটে কষ্ট কম হচ্ছিল। কিন্তু কিছুক্ষণ বাদেই ওপর অথবা নীচ থেকে গাড়ির আওয়াজ কানে আসতে লাগল। যদি বড় পাথর পাশে পাওয়া যেত তাহলে তার আড়ালে লুকিয়ে পড়ত সবাই। গাড়িগুলো হয় পুলিশের নয় মিলিটারির। কী ভয়ঙ্কর দেখতে লাগত সেগুলোকে। শব্দ মিলিয়ে গেলে আবার চলা। শিশুদের কষ্ট শুরু হল। চালু রাস্তা বলে রাতারাতি শিলিগুড়িতে পৌঁছে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল বড়দের। পথে যে কয়েকটা বস্তি পড়ল সেগুলো প্রায় ফাঁকা। যারা ছিল তাদের সঙ্গে কথা বলতে দুদণ্ড দাঁড়াতে হচ্ছিল।

ওরা শিলিগুড়িতে পৌঁছেছিল অনেক রাত্রে। এতটা পথ হেঁটেছে কিন্তু যারা আন্দোলন করেছিল তাদের কারও দেখা পায়নি। কঙ্কাবতীর খুব ইচ্ছে হচ্ছিল, বাবা যদি একবার তাদের দেখা দেয়। মা বলেছিল ওই পাহাড়ের কোনও খাঁজে অথবা ওপরে জঙ্গলে ওরা লুকিয়ে আছে। বাবা কি দূর থেকে তাকে দেখতে পেয়েছিল? শুকনা আসার আগেই সন্ধে নেমেছিল। তখন শিশুরা বড়দের কোলে, কঙ্কাবতীও হাঁটতে পারছিল না। গাড়ির আওয়াজ হচ্ছিল। পাহাড়ে আলো ছিটকে যাচ্ছে। লুকোবার জায়গা খুঁজে পাওয়া গেল না। পাহাড়ে ওঠার ক্ষমতা কারও নেই। রাস্তার ধারে পাহাড়ের গা ঘেঁষে ছাগলের মতো দল বেঁধে দাঁড়িয়েছিল ওরা। এই সময় বাঁক ঘুরে দুটো গাড়ি নেমে এল। একটা জিপ অন্যটা বড় ট্রাক। দুটোই পুলিশের। হেটলাইট জ্বালিয়েই গাড়ি দুটো দাঁড়িয়ে পড়ল। জিপ থেকে নেমে এল একজন অফিসার। মহিলা ও শিশুর দলটিকে অবাক হয়ে দেখল। তারপর হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করল, তোমাদের সঙ্গে পুরুষরা নেই?

মা জবাব দিল, নেই!

কোথায় যাচ্ছ তোমরা?

শিলগুড়ি।

অফিসার একটু ভাবল। টর্চ দিয়ে ওদের ভাল করে দেখল। তারপর টর্চের আলো ছুঁড়ে ট্রাকটাকে দেখিয়ে বলল, উঠে পড়ো। আমরা শিলিগুড়ি যাচ্ছি।

সঙ্গে সঙ্গে সবাই আড়ষ্ট হয়ে গেল। কী করবে কেউ বুঝতে পারছিল না। একজন মহিলা ডুকরে কেঁদে উঠলেন। অফিসার অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আরে! কী হয়েছে? তুমি কাঁদছ কেন?

মহিলা বললেন, আমি কোনও কসুর করিনি। আমরা গরিব মানুষ। আমাদের ছেড়ে দাও। সত্যি আমরা কোনও কসুর করিনি।

আমি তো একবারও বলিনি তোমরা কসুর করেছ। তোমরা মহিলা। বাচ্চারাও আছে। আমার ট্রাক খালি যাচ্ছে। তোমরা কেন কষ্ট করে অতটা হাঁটবে? যাও, উঠে পড়ো। আমি তোমাদের কোনও ক্ষতি করব না।

একে একে ওরা ট্রাকে উঠে বসেছিল। ট্রাকটা ফাঁকা। গাড়ি চলতে শুরু করলে মনে হয়েছিল, আঃ কী আরাম। পা দুটো এত ব্যথা করছিল যে কঙ্কাবতী শুয়ে পড়ল ট্রাকের ওপর। মা বলল, সবাই যে খারাপ লোক হবে তা নয়। পুলিশের মধ্যে ভাল লোকও আছে।

চিত হয়ে শুয়ে আকাশ দেখল কঙ্কাবতী। পরিষ্কার আকাশ। গাছগুলোর আড়াল মাঝে মাঝে সরে যাচ্ছিল আর তখন তারাদের দেখতে পাচ্ছিল। হঠাৎ তার মনে হল পৃথিবীর সব জায়গায় গিয়ে এভাবে শুনে কি একই আকাশ দেখা যাবে? ওই রকম মিটিমিটি তারাদের ভিড়। তাহলে তো পৃথিবীর সব আকাশ একই রকম। শুধু মাটির চেহারা আলাদা। কোথাও পাহাড় কোথাও সমতল। আর তাই নিয়ে কত লড়ালড়ি, যুদ্ধ। এই পৃথিবীটা যদি আকাশের মতো হত!

ঠিক সেই সময় পাহাড় কাঁপিয়ে বোমা পড়ল সামনে। প্রচণ্ড জোরে ব্রেক কষল গাড়ি দুটো। সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় বোমা এসে পড়ল জিপের সামনে। ওরা কৌতূহলী হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল। তৃতীয় বোমাটাকে রাস্তায় ফাটতে দেখল ওরা। বোমাগুলো উড়ে আসছে ওপাশের পাহাড় থেকে। সামনের জিপ থেকে পুলিশ নেমে গুলি ছুঁড়তে লাগল পাহাড়ের উদ্দেশ্যে। সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে গুলির আওয়াজ ভেসে এল। একটা গুলি এসে লাগল ট্রাকের বনেটের গায়ে। ঢং করে শব্দ বাজল। মা বলল, সবাই বসে পড়ো নইলে গুলি খেয়ে মরবে।

একজন বাচ্চা জিজ্ঞাসা করল, গুলি করছে কারা? এর উত্তর কেউ দিতে চাইল না। কঙ্কাবতীর মনে হল বাবা যদি ওদের মধ্যে থাকে। কিন্তু বাবা তো কখনও বন্দুক ধরেনি তাহলে গুলি ছুড়বে কী করে। এর মধ্যে একজন পুলিশ বলল, স্যার, এই মেয়েদের ওরা টোপ হিসেবে পাঠায়নি তো! বলল হিন্দিতে।

অফিসার এগিয়ে এল ট্রাকের পেছনে, তোমরা কি জানতে ওরা এখানে অপেক্ষা করছে? সত্যি কথা বলো।

কেউ কিছু বলার আগে কঙ্কাবতী উঠে দাঁড়াল, না, আমরা জানতাম না। আপনি আমাদের বিশ্বাস করুন।

অফিসার চলে গেলেন সামনে। তার পরে তাঁর গলা শোনা গেল, আমাদের সঙ্গে তোমাদের ঘরের মেয়ে বাচ্চারা আছে। ওরা শিলিগুড়িতে যাচ্ছে। আমাদের মারতে গিয়ে তোমরা ওদের মেরে ফেলবে। কোনও যন্ত্রের সাহায্যে কথাগুলো বলা হয়েছিল নিশ্চয়ই কারণ শব্দগুলো পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল।

ওপাশ থেকে কোনও আওয়াজ এল না। কয়েক মিনিট অপেক্ষা করে গাড়ি দুটো আবার চলতে শুরু করল। ধীরে ধীরে সেই পাহাড়ের নীচ দিয়ে ওরা বেরিয়ে এল। শুকনা থেকে সমতল শুরু হয়ে গেল। উর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে লাগল গাড়িদুটো। শিলিগুড়ি শহরের মুখে গাড়ি দুটো দাঁড়াল। ওরা নেমে এল এক এক করে। অফিসার এগিয়ে এলেন। পকেট থেকে দশটা দশ টাকার নোট বের করে এগিয়ে ধরলেন, আপনাদের নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে। এটা নিয়ে খাওয়া-দাওয়া করুন।

সবাই পাথরের মতো দাঁড়িয়েছিল। অফিসার জোর করে মায়ের হাতে টাকাগুলো গুঁজে দিয়ে বললেন, আপনারা না থাকলে আজ হয়তো আমি মারা যেতাম। বেঁচে গেছি বলে মা-বোনকে কাছে পেলে খাওয়াতাম, তাই ভাবুন না।

মনে আছে, দুজনের ভাগে কুড়ি টাকা পড়েছিল। তাই নিয়ে ওরা রিকশায় চেপে হাজির হয়েছিল সেবক রোডের মাসির বাড়িতে। তাদের দেখে মাসির মুখ গম্ভীর হয়েছিল কিন্তু থাকতে দিয়েছিল তাদের। প্রায় তিন মাস ওরা থেকেছিল শিলিগুড়িতে। মাকে একটা কাজ পাইয়ে দিয়েছিল মাসি। নার্সিংহোমে আয়ার কাজ। দিনে কুড়ি টাকা রোজগার। টাকাটা মাসির হাতে তুলে দিতে হত। আর সেটা পেয়ে মাসির ব্যবহার ভাল হয়ে গিয়েছিল। তিন মাস বাদে শোনা যাচ্ছিল পাহাড়ে কিছুটা শান্তি এসেছে। ধর্মঘট ছাড়া আর কোনও যুদ্ধ নেই। তিনটে মাস সে সময় পেলেই পুরনো বই নিয়ে বসত। এগুলো সে পুঁটলিতে বেঁধে নিয়ে এসেছিল। কিন্তু সময় পাওয়াটাই মুশকিল হত। মাসির বাড়ির সব কাজ তাকেই করতে হত।

এই সময় মা একদিন কাজে গিয়েই ফিরে এল চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে। কিছুতেই মাকে ধরে রাখা যাচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত জানা গেল বাবা নেই। নার্সিংহোমে ঢোকার মুখে একজন ট্যাক্সিওয়ালার সঙ্গে দেখা হয়েছিল মায়ের। তার কাছে জানা গেছে মানেভঞ্জনের কাছে পুলিশের গুলিতে বাবা মারা গিয়েছে। মায়ের সঙ্গে সে-ও কেঁদেছিল। অনেক অনেক কান্নার পরে সে বাবার মুখ দেখতে পাচ্ছিল। এবং তখন আর শিলিগুড়িতে থাকতে ইচ্ছে করছিল না। মা-ও এক কথায় রাজি।

পাহাড়ের বস্তিতে ফিরে এসে চারপাশ ফাঁকা হয়ে গেল ওদের। বাবা নেই ভাবলেই কান্না আসত। ঠিক সেই সময় পার্টির লোকজন এসে জানাল ওরা তাদের পাশে আছে। মায়ের জন্যে একটা স্কুলের আয়ার চাকরি ওরাই পাইয়ে দিল।

তারপর যখন সব শান্ত হয়ে গেল, হিল কাউন্সিল কাজ চালু করার পর আবার অফিস, স্কুল খুলতে লাগল। প্রাইমারি স্কুলের স্যার এলেন। সে ভর্তি হয়ে গেল ডাউহিল স্কুলে। বিশেষ ব্যবস্থায় তার সব কিছু মকুব হয়ে গেল। শুধু শর্ত হল তাকে ভাল রেজাল্ট করতে হবে।

এই করতে করতে অনেকগুলো বছর পার হয়ে গেল। তারপর একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে কেমন করে আকাশটা ঘুরতে শুরু করল। চোখের সামনে সব কিছু অন্ধকারে ঢেকে গিয়েছিল কঙ্কাবতীর।

.

১৮.

বাবার মৃত শরীর ওরা দেখতে পায়নি। মা অনেকের কাছে ঘুরেছে, প্রত্যক্ষদর্শীরা কাহিনী শুনিয়েছে। কী করে বাবার শরীরে পুলিশের গুলি বিঁধেছিল সেই কাহিনী শুনতে শুনতে কঙ্কাবতীর কাছে সিনেমার মতো হয়ে গিয়েছে।

ফিরে আসার পর যে দিন গিয়েছে তার স্মৃতি ভয়ঙ্কর। পাহাড়ে কিছুই পাওয়া যেত না। মাঝে মাঝে লরি আসত রিলিফের চাল ডাল আলু নিয়ে। তার জন্যে লাইন পড়ত সারাদিন ধরে। কখনও শুনত আসার পথে সেই লরি লুঠ হয়ে গেছে। তখন রাগে জ্বলত সবাই। নিজেদের বিরুদ্ধে গালাগালির স্রোত বইত। চারপাশে কীরকম চাপা ভয় সব সময় যেন ওত পেতে বসে থাকত। তারপর একটা সময় এল যখন মানুষের মুখে হাসি ফুটল। লাগাতার হরতালের দিন শেষ। পাহাড় পাহাড়িদের জন্যে এই স্লোগানে আকাশ বাতাস মুখরিত। শেষ পর্যন্ত শোনা গেল পাহাড়ে গোর্খাল্যান্ড সরকার এসে গিয়েছে। স্বাধীন গোর্খাল্যান্ড। মাত্র কয়েকটা দিনে এই খবরটা পাল্টে গেল। গোর্খাল্যান্ড নয়, পাহাড়ি মানুষের উন্নয়নের জন্যে বেশ কিছু ক্ষমতা ভারত সরকার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে তুলে দিচ্ছেন।

সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছু মানুষ খুব হতাশ হল। এত আত্মত্যাগ, এত প্রাণের বিনিময়ে যা পাওয়া গেল তা মানতে রাজি হচ্ছিল না অনেকেই। ফলে ফাটল ধরল ঐক্যে। পাহাড়িরা বেশ কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে গেল। কিন্তু মূল ক্ষমতা হাতে নিয়ে যিনি দার্জিলিং দখল করলেন তাঁর প্রতি বেশির ভাগ মানুষের আস্থা তখনও নষ্ট হয়নি।

এ সব ঘটনা যখন ঘটেছিল তখন কঙ্কাবতী নেহাতই বালিকা। তার মতামতের গুরুত্ব কারও কাছে ছিল না। সে সব দেখছে, নিজের মতো করে ভাবছে তা কারও নজরে পড়েনি। তারপর পাহাড় যখন শান্ত হয়ে গেল, প্রাণের ভয়ে পালিয়ে যাওয়া সরকারি অথবা বেসরকারি কর্মচারীরা যখন ফিরে এসে কাজে যোগ দিল, নেতার আশ্বাসে ট্যুরিস্টরা বেড়াতে আসা শুরু করল তখন সব কিছু আগের মতো হয়ে গেল।

সব কিছু আগের মতো এবং তা বাইরের জীবনে। স্টেশনের সামনে দোকানগুলো নতুন করে সাজানো, দার্জিলিং-শিলিগুড়ির বাসগুলো পনেরো মিনিট করে দাঁড়াতে আরম্ভ করল। ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে আগের মতো হইচই হতে লাগল। শুধু যেসব পরিবারের প্রচণ্ড ক্ষতি হয়ে গিয়েছিল আন্দোলনের তোড়ে তারা মুখ বুজে রইল। চারপাশে সবাই আছে, সবই আছে, কেবল বাবা নেই। কথাটা ভাবতেই শরীর কাঁপিয়ে কান্না বেরিয়ে আসতে চাইত। তৎক্ষণাৎ সতর্ক হয়ে যেত কঙ্কাবতী। তাদের ঘরে প্রতি রাতে কান্না বাজে। বিছানায় শুয়েই মা ডুকরে ওঠে। ক্লান্তি প্রবল হয়ে যতক্ষণ ঘুম না ডেকে আনছে ততক্ষণ সেই কান্না ঘরের দেওয়ালে গুমরে মরে। দিনের বেলায় মায়ের মুখের দিকে তাকালেই মনে হয় বয়স এক লাফে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে। তাই মায়ের সামনে কাঁদতে পারে না কঙ্কাবতী। একজন অত কাঁদলে নিজেকে সামলে নেওয়া ছাড়া কোনও উপায় নেই। তারপর যখন স্কুল চালু হল, ডাউহিলের রাস্তা ধরে ফিরে আসার সময় কোনও নির্জন বাঁকে দাঁড়িয়ে দূরের সমতলভূমির দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝেই সে হুহু করে কেঁদে উঠত। তখন তার চোখের জলে বাবার মুখ মাখামাখি, নিচু হয়ে যাওয়া আকাশে কোনও রোদ্দুর নেই। তারপর নিজেকে সামলে যখন বস্তির পথ ধরত তখন অদ্ভুত এক শান্তি আসত মনে। খুব ভাল পরীক্ষা দিলে অথবা সারাদিন উপোস করে পুজো দেওয়ার পর মনে যে আরাম তৈরি হয় তেমনই একটা বোধ অনুভবে আসত।

হ্যাঁ, এটা ঠিক, বাবার মৃত্যু তাদের পরিবারকে আধপেটা খাওয়া থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। বাবার মৃত্যু অত বড় স্কুলে ভর্তি হওয়ার ব্যাপারে তাকে সাহায্য করেছে। শহিদের স্ত্রী এবং মেয়ে হিসেবে যেসব প্রাপ্তি হয়েছে তা বাবা বেঁচে থাকলে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যেত। পার্টি তাদের সাহায্য করেছে খুব। মায়ের চাকরি পাওয়াটা তো তাদের সাহায্য ছাড়া সম্ভব ছিল না। তাদের পাশের ঘরের পরিবারে আন্দোলনের কারণে কোনও বিপর্যয় হয়নি। আন্দোলনের আগে যেমন অভাবের সঙ্গে লড়াই করতে হত এখনও সেটাই করে যাচ্ছে ওরা। স্বামী মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরছে, প্রতিবাদ করলে গালাগালির বন্যা বইয়ে দিচ্ছে। ছেলেমেয়েরা অবাধ্য হয়ে গেছে। মহিলাটি একদিন মায়ের কাছে এসে বলে ফেলল, আমি আর পারছি না। এর চেয়ে আন্দোলনের সময় ও যদি গুলি খেয়ে মরত তাহলে আমাদের খুব উপকার হত। মা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়েছিল। মহিলা আরও বলল, তুমি বেঁচে গেছ। মা নিচু গলায় বলেছিল, এভাবে আমি বাঁচতে চাইনি কখনও। এখনও চাই না।

সব ঠিক আছে, শুধু বাবা নেই। নীচের মাটির নিঃশাস, নদীর ঘ্রাণ কুয়াশা হয়ে আগের মতো উপরে উঠে আসে, হিমজড়ানো পাহাড় তেমনই ঝুম হয়ে বসে থাকে, শেষরাতে বৃষ্টি হয়ে গিয়ে আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেলে কাঞ্চনজঙ্ঘা ঝকমকিয়ে ওঠে, যেমন উচিত। কোথাও কোনও খামতি নেই। একটু একটু করে বড় হওয়ার সময় কঙ্কাবতীর মনে হচ্ছিল তা হলে কেন ওই আন্দোলনটা হল? পাহাড়ি মানুষদের অবস্থা যে আন্দোলনের পর একটুও বদলায়নি তার কি প্রয়োজন ছিল? এই প্রশ্নটা সে করে ফেলেছিল ওই মানুষটাকে।

স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে নতুন যে বাড়িটা তৈরি হয়েছে তার একতলায় ভাড়াটে হয়ে এসেছিলেন তিনি। ফরসা লম্বা, একমাথা কাঁচাপাকা চুল। ওই বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় কানে গান আসত। টেপরেকর্ডারের বাংলা গান। তাদের বস্তিতে কেউ বাংলা গান গায় না। আন্দোলন শুরুর সময় থেকেই বাংলা বই বা বাংলা গানের প্রতি যে বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়েছিল তা অবশ্য আন্দোলন শেষ হওয়ার পর তেমন তীব্র থাকেনি। তাদের স্কুলে পড়ানোর মাধ্যম ইংরেজি হলেও টিচারদের বেশির ভাগই ছিল বাঙালি। বাংলা দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে পড়ানো হত। ওর সঙ্গে পড়ত একটি কলকাতার মেয়ে, হোস্টেলে থাকত। মেয়েটির গানের গলা ছিল খুব ভাল। একজন বাঙালি টিচার মেয়েটিকে গান গাইতে বলতেন। মেয়েটি যে ধরনের গান গাইত সেই ধরনের গান ওই ভদ্রলোকের বাড়ির টেপে বাজত। মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করে সে খুব অবাক হয়েছিল। এত দিন সে যাকে বাংলা গান বলে জানত তার নাকি অনেক শাখা আছে। পুজো বা ধর্মের জন্যে গান ছাড়া আধুনিক মানুষদের ভাললাগার গান গাওয়া হয়। তাদের মধ্যে সবচেয়ে ভাল হল রবীন্দ্রনাথের গান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম এবং কবিতা সে এর মধ্যে পাঠ্যবইতে পড়ে ফেলেছে। তিনি যে গানও বানাতেন সেটা শুনে অবাক হতে বান্ধবী হেসে গড়িয়ে পড়েছিল। যেহেতু স্কুলটা ছিল ইংরেজ ঘরানার, বাংলা গানকে খুব একটা আমল দেওয়া হত না তাই সে বান্ধবীকে বলল সেই বাড়িটার কথা যেখানে নিত্য বাংলা গান বাজে।

বান্ধবী থাকত হোস্টেলে। ওদের বাইরে বের হওয়ার ব্যাপারে বিধিনিষেধ ছিল। কিন্তু হঠাৎ একদিন ছুটি হয়ে যাওয়ায় বান্ধবী তার সঙ্গ নিল। দুজনে হাঁটতে হাঁটতে সেই বাড়ির সামনে যখন উপস্থিত হল তখন কোনও গান টেপরেকর্ডারে বাজছে না। কঙ্কাবতী এমন হতাশ হয়েছিল যে তার বান্ধবীকে বলতে হয়েছিল, নিশ্চয়ই এখন বাড়িতে কেউ নেই। না থাকলে ক্যাসেট বাজাবে কে? চল, ফিরে যাই।

এইসময় সেই ভদ্রলোককে নীচ থেকে উঠে আসতে দেখল ওরা। নীচের ফ্ল্যাটের দরজা খুলতে খুলতে তিনি ওদের দিকে তাকালেন। তারপর এক পা এগিয়ে এসে হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কি কিছু বলবে?

কঙ্কাবতী বান্ধবীর দিকে তাকাল। বান্ধবীর মুখ আকাশের দিকে। কঙ্কাবতী বলল, আমরা গান শুনতে এসেছিলাম। বাংলায় শুরু করে নেপালিতে শেষ করল সে বাক্যটি। নিজের বাংলা সম্পর্কে সে আদৌ সাহসী ছিল না।

গান? ভদ্রলোক প্রথমে বুঝতে পারেননি, তারপরই হেসে উঠলেন, ও, তোমরা টেপের গানের কথা বলছ? বেশ তো, এসো, ভেতরে এসো।

ভদ্রলোক ভেতরে গিয়ে জানলা খুলে দিলেন। ওরা দুজনে দরজায় পৌঁছে দেখল এমন কিছু আসবাব নেই ঘরটিতে। কিন্তু বই রয়েছে অনেক। ঘরের একটা সেলফের ওপর টেপরেকর্ডার রয়েছে। সেলফ ভর্তি ক্যাসেট।

ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, কী গান শুনতে চাও বলে?

বান্ধবী বলল, রবীন্দ্রসঙ্গীত।

বাঃ। কোন ক্লাসে পড় তোমরা?

 সিক্স। কঙ্কাবতী জবাব দিয়েছিল।

উঁ।

সেদিন ওরা চুপচাপ চারটি গান শুনেছিল। পরে কঙ্কাবতী বুঝতে পেরেছিল সেদিনের গানগুলোর নির্বাচন উনি ভেবেচিন্তেই করেছিলেন। আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়া অথবা আলো আমার আলোর মতো দ্রুত তালের গান শুনতে তার খুব ভাল লেগেছিল। গান শোনার পর ওরা উঠে দাঁড়ালে ভদ্রলোক ওদের পরিচয় জানতে চাইলেন। সব শুনে আবার সময় করে আসতে বললেন। কঙ্কাবতী জিজ্ঞাসা করেছিল, এত বই কে পড়ে?

ভদ্রলোক হাসলেন, যতটা পারি আমিই পড়তে চেষ্টা করি।

আপনি? সে খুব অবাক হয়েছিল।

কেন? আমি পড়তে পারি না?

না। আপনি কি কোনও পরীক্ষা দেবেন?

শুনে হে হো করে হেসে উঠলেন তিনি। তারপর নিচু গলায় বললেন, মাগো, এ পরীক্ষা নিজের কাছে দিতে হয়। পৃথিবীতে কত কী বিষয় ছড়িয়ে আছে যা এক জীবনে জেনে যাওয়া সম্ভব নয়। পণ্ডিতরা সেসব কথা তাঁদের বইতে লিখে যান। আমরা সেইসব বই পড়ে কিছুটা জানতে পারি। এ ছাড়া বই থেকে আর এক ধরনের আনন্দ আমরা পেতে পারি। সেটা বন্ধু পাওয়ার আনন্দ। বইয়ের মতো বন্ধু আর কিছু নেই। ভাল বই পাওয়া মানে একটা পরীক্ষায় পাস করে যাওয়া।

কথাগুলো খুব ভাল লেগেছিল কঙ্কাবতীর। এর পরে আর একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে সে হাজির হল ভদ্রলোকের দরজায়। দরজা খোলাই ছিল। ভেতর থেকে গান ভেসে আসছিল, মেঘের পরে মেঘ জমেছে—দারুণ! যেন চোখের সামনে ছবিটা দেখতে পেল কঙ্কাবতী।

গান শেষ হলে সে ঘরে ঢুকতেই ভদ্রলোক বলে উঠলেন, আরে তুমি? এসো এসো। হাত বাড়িয়ে যন্ত্রটাকে থামিয়ে দিলেন। কঙ্কাবতী দেখল একটা বেতের চেয়ারে বসে গায়ে শাল জড়িয়ে বই পড়ছিলেন তিনি। বই পড়তে পড়তে কি ভাল করে গান শোনা যায়?

কী ভাবছ?

আপনি বই পড়ার সময় গান শুনতে পারেন?

 হ্যাঁ। ও বুঝতে পেরেছি। আসলে এইসব গান গত চল্লিশ বছর ধরে শুনে আসছি তো, শুনতে শুনতে বুকের ভেতরে বসে গিয়েছে। এখন শুধু কথা বা সুর নয় অন্য এক অনুভূতি তৈরি হয়ে যায় গান বাজলেই। তাই কান খাড়া করে শুনতে হয় না। এই দেখো না, আমি এখন শেষের কবিতা পড়ছি। অন্তত চারবার পড়েছি এর আগে। আমার নায়ক এখন শিলংয়ের পাহাড়ে। সেখানকার আকাশে তো ঘন ঘন মেঘ জমে, চারদিক আঁধার করে আসে। এই যেমন এখানেও হয়। বই আর গানকে মিশিয়ে নিয়েছে মন।

কঙ্কাবতী অবাক হয়ে তাকিয়েছিল। ভদ্রলোকের কথাগুলোর অর্থ সে ভাল করে বুঝতে পারছিল না। বস্তিতে বা স্কুলে কেউ তার সঙ্গে ওই ভাষায় কথা বলেনি কখনও। কিন্তু ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে এমন সে ভান করল যাতে মনে হয় কথাগুলো বুঝে গিয়েছে। সে জিজ্ঞাসা করল, এই গানটা কি আধুনিক বাংলা গান?

অ্যাঁ? না না। এটা রবীন্দ্রনাথের গান। সেদিন যাঁর গান শুনেছিলে তিনিই রচনা করেছিলেন, পরে অন্য শিল্পীরা সেসব গান গেয়েছেন রেকর্ডে। ওঁরই গান আর এই বইটাও ওঁর। তুমি কি বাংলা পড়তে পার?

হ্যাঁ। তবে খুব ভাল পারি না।

স্কুলের পড়ার বইয়ের বাইরে কবিতা গল্প পড়? মাথা নিচু করেছিল কঙ্কাবতী। তারপর বলেছিলেন, আমি পাইনি।

পাওনি? তোমাদের স্কুলের লাইব্রেরিতে নিশ্চয়ই বই আছে। সেখান থেকে নিচ্ছ না কেন?

 উঁচু ক্লাসে না উঠলে বাড়িতে বই নিয়ে যাওয়ার নিয়ম নেই।

ও। তোমার বাবাকে বলবে মাঝে মাঝে বই কিনে দিতে।

আমার বাবা নেই।

ও। ভদ্রলোক একটু সময় নিলেন, কোথায় থাক তুমি?

নীচের বস্তিতে।

তোমার বাবার কী হয়েছিল?

আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশের গুলি লেগেছিল বুকে।

বাড়িতে আর কে আছেন?

 মা। মা আর আমি।

তুমি বোসো। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছ। এই বাড়িটাকে নিজের বাড়ি বলে মনে করবে। এসেই বসে পড়বে। কেমন? কী খাবে বলো?

কিছু না।

তা হতেই পারে না। সেদিন যখন প্রথম এলে তোমরা বাড়িতে কিছু ছিল না। তারপর রোজ কিছু নিয়ে এসে ভাবি তোমরা হয়তো আসবে। ভদ্রলোক উঠে ভেতরে গেলেন। খুব আড়ষ্ট হয়ে বসেছিল কঙ্কাবতী। উনি ফিরে এলেন একটা প্লেটে পেস্ট্রি আর দুটো মিষ্টি নিয়ে। বললেন, একদম বলবে না আমি মিষ্টি খাই না, জিভে মিষ্টি না লাগলে মন মিষ্টি হয় না। নাও, খেয়ে নাও।

বাধ্য হয়ে খেতে হয়েছিল। প্লেট নামিয়ে রাখতেই ভদ্রলোক বললেন, না, ওখানে নয়। সোজা ভেতরে চলে যাও। ডান দিকে কিচেন। বেসিনে নামিয়ে রাখো। ওখানে জল আছে, খেয়ে নাও। প্লেট তুলে ভেতরে গেল কঙ্কাবতী। রান্নাঘরে ঢুকে তার মনে হল, কী ভাল। তাদের একমাত্র শোওয়ার ঘরটিও এর তুলনায় কিছু নয়। মা যদি এরকম রান্নাঘর পেত খুব খুশি হত। তারপরেই হাসল, দুর? মা এটাকেই শোওয়ার ঘর বানিয়ে ফেলত। বেসিনে হাত ধুতে ধুতে তার মনে হল পৃথিবীর সব সুখ বড়লোকেরা পেয়ে থাকে। তাদের মতো, যারা বস্তিতে থাকে, গরিব-গরিব বাড়িতে বাস করে তাদের কাছে এসব স্বপ্নের মতো মনে হয়। আন্দোলন করে কী লাভ হল? যদি অবস্থা একই থাকে তা হলে। হঠাৎ বাবার কথা মনে পড়ল। কলের জলে চোখের জল ধুয়ে ফেলা বড় সহজ।

মুখ মুছে বাইরের ঘরে আসতেই ভদ্রলোক বললেন, তুমি কার কাছে পড়?

আমার আগের স্কুলের মাস্টারমশাই পড়া দেখিয়ে দেন।

তিনি তোমাকে গল্প কবিতার বই পড়তে দেননি?

মাথা নেড়ে না বলল কঙ্কাবতী।

ভানুভক্তের কবিতা পড়েছ?

সঙ্গে সঙ্গে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল কঙ্কাবতী। আমার স্কুলের বইতে ছিল।

কিন্তু ওঁর যে সংকলন আছে তা তোমার পড়া উচিত।

আচ্ছা, রবীন্দ্রনাথ গান লিখতেন, গল্পও লিখতেন? উনি তো কবি ছিলেন।

হ্যাঁ। উনি গল্প উপন্যাস কবিতা গান লিখেছেন। প্রবন্ধ লিখেছেন। ছবি এঁকেছেন। আবার নতুন ধরনের পড়াশুনার ব্যবস্থা চালু করেছিলেন।

শান্তিনিকেতন?

 বাঃ। তুমি জানো?

আমাদের মিস বলেছেন। কিন্তু একজন মানুষ এত কাজ পারেন?

সবাই পারেন না। যিনি পারেন তিনি অনেক বড় মাপের মানুষ।

.

সেই শুরু হয়েছিল। প্রায় প্রতিদিন স্কুল থেকে ফেরার সময় ওঁর কাছে যাওয়া তার নেশা হয়ে দাঁড়াল। একটু একটু করে বাংলা শেখাতে লাগলেন তাকে। এতে উদ্বুদ্ধ হয়ে কঙ্কাবতী সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ হিসেবে নেপালির বদলে বাংলা নিল। ছয় মাসের মধ্যে তার লেখা বাংলা পড়ে মিস অবাক। চারটে বছর যেন স্বপ্নের মতো মনে হয়। রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাশ, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত থেকে অনেক অনেক কবির কবিতা তিনি পড়িয়েছেন তাকে। তার কিছু সে বুঝেছে অনেক কিছুই অবোধ্য থেকে গেছে। তিনি কবিতাগুলো পড়তেন আর বলতেন, এসব এখনই তুমি ধরতে পারবে না। কিন্তু প্রায়ই যদি পড় তা হলে দেখবে মনের ভেতর বসে যাবে আর তখন মন নিজের মতো করে উপলব্ধি করবে।

এই যে আমি কঙ্কাবতী, আমার এই বড় হয়ে ওঠা শরীর এটাই শেষ কথা নয়। আমার ভেতরে একটা মন আছে, তার একটা নিজস্ব জগৎ আছে তার খবর কখনও জানা যেত না যদি তিনি না বুঝিয়ে দিতেন। তাদের বস্তিতে কেউ এ কথা ভাবতে পারে না। শরীরটা কী করে ভাল থাকবে তাই নিয়ে উদ্বিগ্ন সবাই। তার জন্যে কিছু পাওয়া গেলে সবাই খুশি হয়। তাদের মন ভাল থাকে। শরীর ছাড়া মনের কোনও আলাদা অস্তিত্ব নেই।

কিন্তু রবীন্দ্রনাথের এক একটা গান শুনলে শরীর দূরে সরে যায়, মন বিশাল হয়ে ওঠে। উনি এক সকালে বাজাচ্ছিলেন, আজ যেমন করে গাইছে আকাশ তেমন করে গাও গো। শুনে মনে হয়েছিল, এ আবার কী কথা, আকাশ গান গায় নাকি? কিন্তু মুখ ফেরাতেই মনে হয়েছিল, সত্যি তো। অথৈ মায়াময় নীল গায়ে মেখে আকাশ নতুন সূর্যের আলোয় মুখ ডোবাচ্ছে, এ যদি গান না হয় তা হলে গান কাকে বলে? এইভাবে মনের চোখ তিনি খুলে দিয়েছিলেন তার।

তাঁর একটা নাম ছিল। এস কে রায়। বাড়িওয়ালা তাঁকে মিস্টার রায় বলে সম্বোধন করত। পিওন এসে বলত, মিস্টার রায়, আপনার চিঠি।

তিনি বলতেন, দিদি মনে রেখো। এটা না এলে আমি খেতে পাব না।

ওই কয় বছরে তাঁর কাছে কোনও বাঙালিকে কেউ আসতে দেখেনি। তাঁর শরীরে যৌবন যেমন ছিল না বার্ধক্যও আসেনি। কিন্তু তিনি কোনও ধরাবাঁধা কাজকর্ম করতেন না। না চাকরি না ব্যবসা। সন্ধের পরে তিনি কী করতেন তা কঙ্কাবতী জানে না। কারণ সন্ধে নামবার আগেই সে বস্তিতে ফিরে যেত। তিনি রান্না করতেন নিজেই। তাঁর শরীর অসুস্থ হয়েছে এমন দৃশ্য কোনওদিন দেখেনি সে। মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে করত ওঁর ব্যক্তিগত কথা জানার কিন্তু প্রশ্ন করার সময় মনে হত এগুলো অবান্তর।

একজন বাঙালি একা থাকেন, কারও সঙ্গে মেশেন না অথচ সবার সঙ্গে দেখা হলেই হেসে মাথা নাড়েন এ নিয়ে নেপালিদের মাথা ঘামানোর সময় ছিল না। তা ছাড়া বাড়িটা ছিল একটু নির্জনে। কিন্তু ক্লাস সিক্স থেকে টেনে উঠতে না-উঠতে কঙ্কাবতীর শরীর যেই বড় হল তখন কারও কারও কৌতূহল বাড়ল। দোতলায় নতুন ভাড়াটে এল কাঠমাণ্ডু থেকে। মেয়েকে এখানকার স্কুলে পড়াবেন অথচ হোস্টেল পাননি। তাই ভদ্রলোক ফ্ল্যাটটা ভাড়া করেছেন। স্কুল কাছাকাছি হবে আবার মেয়ের মা সঙ্গে থাকতে পারবে। পাঁচ বছরের বাচ্চাকে ছেড়ে তিনি নাকি থাকতে পারবেন না বলে স্বামীকে ছেড়ে এসেছেন। স্বামী প্রতিমাসে একবার এখানে আসবেন। তাদের পাহাড়ে এ রকম অনেক পরিবার ভাড়া থাকেন।

এক সকালে যখন সে স্কুলে যাচ্ছে তখন ভদ্রমহিলাও তাঁর মেয়েকে পৌঁছোতে যাচ্ছিলেন। তাকে দেখে হেসে বললেন, তোমাকে রোজ দেখি। কী নাম তোমার?

কঙ্কাবতী।

বাঃ। তুমি যে বাড়িতে যাও আমি তার ওপরে ভাড়া নিয়েছি।

ও।

আমার না এখানে খুব একা লাগে, তুমি মাঝে মাঝে আসবে?

 আসব। কিন্তু আমার পড়ার খুব চাপ, সময় বড় কম।

বাঃ। নীচের ওই ভদ্রলোকের কাছে যাও কী করে তাহলে?

উনি আমাকে পড়ান।

ও। তার মানে উনি টিচার? ভদ্রমহিলা হাসলেন, তা টিচার হলেও তো পুরুষমানুষ। একা ওঁর সঙ্গে থাকতে তোমার ভয় লাগে না?

না তো! ঝট করে তাকিয়েছিল কঙ্কাবতী। এই কথাটা কোনওদিন তার মাথায় আসেনি। ভদ্রমহিলা কথাটা বললেন বলে তার খুব খারাপ লাগল। সে জোর গলায় বলল, ভয় করবে কেন? উনি খুব ভাল মানুষ।

সেটা ঠিক। খারাপ মানুষরা অত গান শোনে না। তবে সব বাংলা গান। আমার আবার হিন্দি গান ছাড়া কিছু ভাল লাগে না। ভদ্রমহিলা কথা বলতে বলতে প্রায়ই বাঁ হাতে কপালের ওপর নেমে আসা চুলের ভাঁজ সরিয়ে দিচ্ছিলেন পিছনে, তো উনি একাই থাকেন দেখেছি বউ বাচ্চা নেই?

আমি জানি না।

একদিন ওকে নিয়ে এসো তো, আলাপ করব।

কথাবার্তা নেপালিতে হচ্ছিল। কঙ্কাবতী দ্রুত পা চালাল তার দেরি হয়ে যাচ্ছে এই অজুহাত দিয়ে। সে জানে ভদ্রলোক কখনওই ওপরে যাবেন না। তা ছাড়া যার আলাপ করার ইচ্ছে তারই তো ওর কাছে যাওয়া উচিত। ভদ্রমহিলার কথাবার্তা তার ভাল লাগল না।

সেদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে সে অবাক হল। নীচের ফ্ল্যাটের দরজা জানলা বন্ধ। গানও বাজছে না। এর মানে তিনি এখন বাড়িতে নেই। এ রকমটা হলে তিনি আগেই তাকে বলে দেন অথচ গতকাল কিছু বলেননি। হয়তো কোনও জরুরি প্রয়োজন হওয়ায় বেরিয়ে যেতে হয়েছে এইরকম ভেবে সে বাড়ি ফিরে এল।

তাকে দেখে মা অবাক, কী রে এত তাড়াতাড়ি ফিরলি।

হ্যাঁ, এটা তার বাড়ি ফেরার সময় নয়। কিন্তু প্রশ্নটা শুনে তার খুব রাগ হয়ে গেল। বলল, কেন? অন্যায় করেছি?

আচ্ছা! অন্যায় বলেছি। তুই তো সন্ধের আগে ফিরিস না, সন্ধের এখনও অনেক দেরি। যাক গে, তাড়াতাড়ি জামাকাপড় বদলে নে, একজন আসবে।

কে?

পার্টির অ্যাসিস্টেন্ট সেক্রেটারি। উনি বলেছেন তুই স্কুল থেকে ভালভাবে পাস করলেই চাকরির ব্যবস্থা করে দেবেন।

তার তো অনেক দেরি। আজ আসবেন কেন?

আমার সঙ্গে অন্য দরকার আছে। বলতে বলতে মা মুখ ঘুরিয়ে নিল। মায়ের সঙ্গে এখন পার্টি অফিসের লোকদের খুব ভাব হয়েছে। মায়ের চাকরি যদিও ওরাই করে দিয়েছিল যার জন্যে তাদের খাওয়াপরার অভাব হয়নি, সে-ও পড়তে পারছে। কিন্তু সময়ে অসময়ে পার্টির লোকজন বাড়িতে আসে। তারা অবশ্য ঘরে ঢোকে না, বারান্দায় বসে কথা বলে যায়। বাবা মারা যাওয়ার পর মায়ের যে অবস্থা হয়েছিল তা ধীরে ধীরে কেটে গেছে। কাজ আর ওইসব লোকদের সঙ্গে থেকে মা এখন সহজ হয়ে গিয়েছে। বস্তির লোকজন মায়ের কাছে সাহায্যের জন্যে আসে। কারও পার্টি অফিসে প্রয়োজন থাকলেই মাকে এসে ধরে তারা। বাবা এখন ইতিহাস।

মাকে দোষ দিয়ে লাভ কী! মানুষ কতদিন তার শোক আঁকড়ে বসে থাকবে? সেটা তো আত্মহত্যার শামিল। জীবন ঠিকই একটা বিকল্প ব্যবস্থা করে দিয়ে শোক ভুলিয়ে দেয়। এই যে সে নিজে মাঝে মাঝে বাবার মুখ মনে করে কেঁদে উঠত সে রকম কান্না কত দিন সে কাঁদেনি? কেন কাঁদেনি? না কান্নাটা ভিতর থেকে আসেনি। আসলে ওই মানুষটির সঙ্গে আলাপ করার পর থেকেই একটু একটু করে সেই কান্নাটা সয়ে গেল। কেন? উনি কি তার বাবার বিকল্প হয়ে গেছেন? জামাকাপড় ছাড়তে ছাড়তে হেসে ফেলল কঙ্কাবতী। দুর। তা কি হয়? কেউ কি কারও বিকল্প হতে পারে! তার বাবা পুলিশের গুলি খেয়ে মরে গেলেও আসলে খুব ভিতু প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। সাহস করে কিছু চাইতে পারতেন না। শুধু একেবারে শেষ দিকে তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার চেষ্টা করেছিলেন। মেয়ে বড় হবে, অনেক লেখাপড়া শিখবে এই আশা বুকে নিয়ে ট্যাক্সি চালিয়ে রোজগার বাড়াতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। কিন্তু সে মেয়ে হয়ে বাবার কাছে কিছু পায়নি যা তাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে। শুধু ওই স্বপ্ন দেখার ইচ্ছে ছাড়া। কিন্তু এই এস কে রায় তাকে নতুন পৃথিবীর সন্ধানই শুধু দেননি, প্রায় হাতে ধরে চারপাশ চিনিয়ে দিয়েছেন। স্নেহ বাৎসল্য ভালবাসার এক অপূর্ব অনুভূতি সে পেয়ে আসছে ওঁর কাছ থেকে। বাবার বিকল্প নয়, আর এক ধরনের বাবা যে বন্ধুর মতোও বটে, এস কে রায় তার কাছে তেমনই মানুষ।

মায়ের গলা শুনতে পেল কঙ্কাবতী, আসুন আসুন, কী সৌভাগ্য।

পুরুষকণ্ঠ শোনা গেল, সৌভাগ্য তো আমার। আপনার হাতে চা খাব।

 মায়ের ডাক ভেসে এল, কঙ্কা, কঙ্কাবতী।

অতএব ঘর থেকে বের হতে হল। লোকটাকে সে দেখেছে এর আগে। তাদের স্কুলের সামনে বক্তৃতা করছিল। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোকে হুঁশিয়ার করে বলছেন, যদি তারা নিজেদের ইচ্ছেমতন স্কুল চালাতে চায় তাহলে পার্টি হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হবে। ছাত্রী ভর্তির সময় পাহাড়ের মেয়েদের অগ্রাধিকার দিতে হবে।

লোকটা তাকে সর্বাঙ্গে দেখল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, আপনার মেয়ে?

হ্যাঁ। ক্লাস টেনে পড়ে।

কোন স্কুল?

মা নামটা বলল। লোকটা মাথা নাড়ল, ওখানে কোনও সমস্যা হলেই বলবেন। কিন্তু আপনার যে এত বড় মেয়ে রয়েছে এটা জানতাম না।

ওর বয়স বেশি নয়। আর আমার বিয়ে হয়েছিল খুব অল্প বয়সে। যে বয়সে মা হয়েছিলাম তা এখন কেউ ভাবতে পারে না। মা অকারণে হাসল।

লোকটার পাশে দাঁড়িয়েছিল অল্প বয়সী যে ছেলেটি তার দৃষ্টি একটুও সুবিধের নয়। চোখ সরাচ্ছিল না তার শরীর থেকে। মা বলল, আসুন আসুন, ভেতরে গিয়ে বসি। এখনই ঠাণ্ডা বাড়বে।

লোকটা ঘুরে দাঁড়িয়ে ছেলেটিকে বলল, তাহলে তুমি যাও। আমি চা খেয়ে পার্টি অফিসে যাচ্ছি। ঠিক আছে?

আপনি একা অতটা রাস্তা হাঁটবেন? আমি বরং অপেক্ষা করছি। ছেলেটি তখনও দেখে যাচ্ছিল।

লোকটি বলল, আমি যা বলছি তাই করো।

ছেলেটি দ্রুত মাথা নেড়ে বেরিয়ে গেল। লোকটিকে ঘরে বসিয়ে মা বলল, শোন, চট করে দুটো সন্দেশ নিয়ে আয় তো। মা টাকা বের করে দিল।

কঙ্কাবতী অবাক। অন্তত বছর তিনেক মা তাকে দোকানে পাঠায় না। তাকে বলেছে তোমাকে আর দোকানে যেতে হবে না। তুমি বড় হয়েছ। বড় তো অন্য মেয়েরাও হয়েছে কিন্তু তারা দিব্যি দোকানে যায়, দুপুরে সেজেগুজে শহরে গিয়ে সিনেমা দেখে। তাদের কেউ কিছু বলে না, কিন্তু পাড়ার বেকার ছেলেগুলো দোকানের সামনে বসে তাকে ইশারা করে যায়।

আমি দোকানে যাব?

হ্যাঁ। এবার যা। আমি গেলে উনি একা বসে থাকবেন।

উনি আসবেন সেটা তো জানতে, আগে নিয়ে আসনি কেন?

ভুলে গিয়েছিলাম। আমি আর কৈফিয়ত দিতে পারছি না। যা।

টাকা নিয়ে বস্তির উল্টোদিকের দোকানের সামনে যেতেই আওয়াজ কানে এল। বস্তিরই ছেলে সব। একসময় একসঙ্গে খেলেছে ওরা। একজন চেঁচিয়ে বলল, মাস্টারনি এসে গেছে। আর একজন বলল, আজ কার মুখ দেখে উঠেছি। আর একজন চেঁচিয়ে উঠল। আ মেরা কাশ্মীর কি কলি, লাভ ইন টোকিও হোগা কি নেহি?

কান লাল হয়ে গিয়েছিল। মিষ্টি কিনে ঘুরে দাঁড়াতেই দুজন সামনের পথ আগলে দাঁড়াল। একজন বলল, কী রে আমরা মানুষ না?

আমি কি সে কথা বলেছি?

তোর ভাব দেখে তাই মনে হয়।

কী রকম ভাব করতে হবে?

আর সব মেয়ে যা করে। কাল সকালে স্কুলে না গিয়ে দার্জিলিং-এ চল। ক্যাপিটালে সিনেমা দেখে সন্ধের মধ্যেই ফিরে আসবি।

আমার সময় নেই। পথ ছাড়ো।

তা হলে এখানকার সিনেমায় চল।

বলছি তো সময় নেই।

অ্যাই সরে যা সামনে থেকে। গলাটা ভেসে আসতেই কঙ্কাবতী দেখল সেই ছেলেটি খানিকটা দূরে এসে দাঁড়িয়েছে। ওকে দেখে এদের অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া হল।

একজন শুধু বলল, আরে ইয়ার, আমরা পুরনো বন্ধু একটু ঠাট্টা করছিলাম।

ছেলেটি এগিয়ে এসে বলল, এ আমাদের পার্টির মেয়ে। কেউ এর সঙ্গে ঝামেলা পাকাবি না। মনে থাকে যেন। এসো।

সে বাড়ির পথ ধরতেই ছেলেটি ওর সঙ্গ নিল। হাঁটতে হাঁটতে বলল, দেখো, এর পর তোমাকে এরা আর বিরক্ত করবে না। তোমার নাম কী?

কঙ্কাবতী।

আমার নাম গণেশ। চাচি বলেছে তোমাদের এখানে ঘর খালি হচ্ছে। খালি না হলেও আমরা খালি করিয়ে দেব। দিয়ে এখানে চলে আসব।

কঙ্কাবতী কোনও উত্তর দিল না। ওদের ঘরের কাছাকাছি পৌঁছে থেমে গেল গণেশ। দরজা ভেজানো। ভেতর থেকে হাসির আওয়াজ ভেসে আসছিল। লোকটা হাসছে, সঙ্গে মায়ের গলা। মাকে ওইভাবে হাসতে সে কোনওদিন শোনেনি। সে কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না। এই সময় পাশের ঘরের মাসি এসে দাঁড়াল পাশে, এই কঙ্কা, তুই আমার একটা উপকার কর।

কী? নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করল সে।

মানুটা বেকার বসে আছে। এক পয়সা কামাই নেই। আমার এই ছেলেটা তো অন্য ভাইদের মতো লাফাঙ্গা নয়, তুই তো জানিস। ওকে একটা চাকরি দিতে বল না।

কাকে বলব?

আহা, ন্যাকামি করিস না। তোদের ঘরে কে এসেছেন তা বস্তির সবাই জানে। উনি চেষ্টা করলেই মানুর চাকরি হয়ে যাবে। এখন পার্টির কথা সবাই শুনতে বাধ্য।

আমি কী করে বলব? আমার সঙ্গে তো আলাপ নেই।

তোর মাকে বল। শুনছিস না, ভেতরে কী রকম হাসাহাসি হচ্ছে।

কথাটা শোনামাত্র রাগ হয়ে গেল কঙ্কাবতীর। সোজা এগিয়ে গিয়ে দরজা ঠেলল সে, মা, পাশের ঘরের মাসি তোমাকে বলতে বলল মানুর জন্যে চাকরি করে দিতে।

লোকটা বসেছিল খাটে, পা ঝুলিয়ে মা বসেছে একটু দূরে, টুলে। ওরা দুজনেই তার দিকে অবাক হয়ে তাকাল। শেষ পর্যন্ত মা বলল, কী বলছিস?

উনি নাকি চাকরি দিতে পারেন তাই মাসি বলতে বলল।

মাসি মানে? লোকটি বিরক্ত হয়েছে বোঝা যাচ্ছিল।

পাশের ঘরে থাকে। মানু ওর ছেলে।

ওরা কেউ আন্দোলন করেছে?

না। মা মাথা নাড়ল।

চাকরি কি আমার পকেটে আছে যে চাইলেই দিয়ে দেব? চেঁচিয়ে উঠল লোকটা, এই হয়েছে মুশকিল, যেখানেই যাই পাবলিক ধান্দা ছাড়া আসে না। কোথাও গিয়ে প্রাইভেট কথা বলারও উপায় নেই। লোকটি গজরাচ্ছিল।

মা মিন মিন করে বলল, দেখুন না, কোথাও যদি আর্দালি বেয়ারার কাজ থাকে। মানু ছেলেটা ভাল।

আরে তোমাদের ছেলেমেয়েরা আর্দালি বেয়ারার ওপর কোনও কাজের জন্যে যোগ্যতা রাখে? তার জন্যেই নাম পড়েছে দেড় হাজার। এই এলাকায়। অথচ আমরা চাই বড় বড় উঁচু পোস্টে স্থানীয় ছেলেমেয়েরা ঢুকুক। শালারা পড়াশুনাই করে না যে নাম সুপারিশ করব। দিল মুডটার বারোটা বাজিয়ে।

মা ঝটপট উঠে এসে প্যাকেটটা নিয়ে মিষ্টি প্লেটে ঢেলে এগিয়ে ধরল লোকটার সামনে। লোকটা তার দিকে একবার তাকিয়ে মুখ বেঁকাল, এঃ। মিষ্টি আমি খাই না। ব্লাডে সুগার আছে। মাংস-টাংস নেই?

আমি জানতাম না, জানলে নিশ্চয়ই মাংস করে রাখতাম। এর পরদিন আর এই ভুল হবে না। মা মাথা নাড়তে লাগল।

দুর। এরপর আর এখানে আসা চলবে না।

না না এরকম করে বলবেন না। মা অনুনয় করল।

আমার ব্যাপারটা ভাবা উচিত ছিল। আজ পাশের ঘরের মাসি বলছে কাল বস্তির মানুষ বলবে। কেন বলবে না? সবার তো অভাব রয়েছে, ওরা ভাবছে আমি এখানে মজা করতে এসেছি এই ফাঁকে চাপ দিয়ে যদি কাজটা করিয়ে নেওয়া যায়। আরে এরা তো কেউ জানে না, কী যেন নাম তোমার? লোকটা হাত তুলল।

মা বলল, কঙ্কাবতী।

হ্যাঁ, কঙ্কাবতী, এরা তো কেউ জানে না, তোমার বাবা আর আমি বন্ধু ছিলাম। পাশাপাশি অ্যাকশন করতাম আমরা। পাঙ্খাবাড়ির রাস্তায় আমরা পাঁচজন ছিলাম। একটা চা বাগানের ফ্যাক্টরি উড়িয়ে দেওয়ার প্ল্যান ছিল। কীভাবে করব তাই দেখতে সেদিন গিয়েছিলাম। গাড়ির আওয়াজ পেলেই আড়ালে চলে যাচ্ছিলাম। চা বাগানের কাছাকাছি পৌঁছতেই ওরা গুলি ছুঁড়তে শুরু করল। পুলিশগুলো যে বাঁকের পাশে চা বাগানের মধ্যে লুকিয়ে ছিল সেটা বুঝতে পারিনি কেউ। ইনফরমাররাও জানায়নি। তখন পালাবার একমাত্র পথ উল্টোদিকের জঙ্গলে ঢুকে পড়া। সে দিকে যেতে গেলেও ওদের গুলি খেতে হবে। আমরাও গুলি ছুড়ছিলাম বলে ওরা এগোতে পারছিল না। তখন তোমার বাবা বলল, আমি গুলি ছুঁড়ে ওদের আটকাচ্ছি তোমরা পালাও। আমি আপত্তি করলাম। সে মাথা নেড়ে বলল, আমাকে কেউ মারতে পারবে না। তোমরা যাও। আমরা পালালাম। সে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে ঠিক জঙ্গলে পৌঁছে গিয়েছিল। সেদিন আমার প্রাণ বাঁচিয়েছিল সে। আমার কোনও কৃতজ্ঞতা বোধ থাকবে না? তার মেয়ে তো আমারও মেয়ে। তাকে দেখতে এখানে আসতে পারব না?

চুপচাপ শুনছিল কঙ্কাবতী। লোকটা থামতেই বলল, বাবা কিন্তু সেদিনই মারা গিয়েছিল।

হাঁ। স্রেফ বুদ্ধর মতো মরল। এরকম বাোকামি কেউ করে? ফিরে এসে আমরা যখন গা ঢাকা দিচ্ছি তখন সে ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে গিয়ে দাঁড়াল। একটাও ট্যাক্সি নেই। যাক গে, ও সব কথা থাক। আজ চলি।

সে কী? এখনই যাবেন?

বললাম না, মুড নষ্ট হয়ে গিয়েছে। কাল একবার স্কুলে যাব। তখন কথা বলব। লোকটা বেরিয়ে গেল।

সঙ্গে সঙ্গে মা ঘুরে দাঁড়িয়ে রাগী চোখে তাকাল, কেন তুই ভেতরে এসে ওসব বললি?

বাঃ। মাসি বলতে বলল যে। সে প্রতিবাদ করল।

যে যা বলে বলুক, তোর বুদ্ধি নেই? দেখলি তো, কী রেগে গেল মানুষটা। এখন যদি আমার চাকরি চলে যায় তো হাওয়া খেয়ে থাকবি? তোর পড়াশুনা হবে? মা ছটফট করছিল।

এই সময় মাসি এসে দাঁড়াল। তাকে দেখা মাত্রই মা চিৎকার শুরু করল। সঙ্গে সঙ্গে মাসিও গলা তুলল। কঙ্কাবতী দেখছিল দুজন মহিলার ঝগড়া দেখতে বস্তির অনেকেই সেখানে ভিড় করছে। মাসির বক্তব্য ছিল স্বামী গুলি খেয়ে মরেছে বলে সব কিছু সুবিধে একা কেন ভোগ করবে মা? তারাও পাহাড়ি, তাদেরও অধিকার আছে। মা বলছিল, বেশ করব, একশোবার করব। মাথায় সিঁদুর পরে স্বামীকে যে মেরে ফেলতে চায় তার জিভ খসে পড়া উচিত।

শেষ পর্যন্ত কঙ্কাবতী মাকে জোর করে টানতে টানতে ঘরে নিয়ে এল। মা তখন হাঁপাচ্ছিল। অনেক কষ্টে মাকে শান্ত করতে পেরেছিল সে।

তারপর যখন সব চুপচাপ হল বই নিয়ে বসতে গিয়েও ইচ্ছে করছিল না তার। এই সব ঝগড়াঝাটি মনটাকে একদম তেতো করে ফেলেছিল। ঠিক তখন বাইরে কেউ বলে উঠল, আচ্ছা, কঙ্কাবতীদের ঘর কোনটা?

কঙ্কাবতী সোজা হয়ে বসল। গলার স্বর তার চেনা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *