‘৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ৭৫ বছর

৪২এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ৭৫ বছর

২০১৭ ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ৭৫ বছর যেমন স্বাধীনতার ৭০ বছর। স্বাধীনতার ৭০ বছর যেমন, দেশভাগেরও সত্তর বছর। এই ২০১৭ আবার রুশ বিপ্লবেরও ১০০ বছর। সত্তর, পঁচাত্তর, একশো… বাঙালি জীবনে এই ২০১৭ যেন উদ্‌যাপনের বছর। রুশ বিপ্লবের একশো বছরও উদযাপনের নিশ্চয়। আমি তো রাদুগা, প্রগতি ইত্যাদি প্রকাশনের অনূদিত রুশ সাহিত্য বাল্যকাল থেকে পড়েছি। পড়েই সাহিত্যকে ভালবাসতে শিখেছি। লিখতেও শিখেছি কিছুটা। আন্তন চেখভ, রবীন্দ্রনাথ আমাকে ছোটগল্প লেখার প্রথম পাঠ দিয়েছেন। তলস্তয়, দস্তয়েভস্কি, তারাশঙ্কর বিভূতি, মানিক, সতীনাথ আমাকে উপন্যাসের পাঠ দিয়েছেন। রুশ বিপ্লবের একটা মানে আমার কাছে সস্তায় বিশ্বের সেরা রুশ সাহিত্য এসে পৌছন। বিপ্লব হয়েছিল বলেই নিজের দেশের চিরায়ত সাহিত্য অনুবাদ করে প্রায় বিনামূল্যে তারা দেশে দেশে বিতরণ করেছিল। এই মহত্তকে ভোলা যায় না। সাহিত্যের কোনো দেশ, কোনো ভাষা নেই। সাহিত্য বিশ্বজনীন। গোগোলের ওভারকোট কিংবা চেখভের কেরানির মৃত্যু আমার এই শহরের গল্পও। যাই হোক আমি বলব ভারত ছাড়ো আন্দোলনের কথা। যার প্রথম পাঠ এক সিনেমায়, সিনেমার নাম ‘৪২। এর পরের পাঠ সতীনাথ ভাদুড়ীর উপন্যাস জাগরী এবং ঢোঁড়াই চরিত মানসে। গান্ধীজীর অহিংস অসহযোগ আন্দোলন সতীনাথকে আকৃষ্ট করেছিল এবং গান্ধিবাদী আন্দোলনে সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন তিনি। ১৯৪০ সালের জানুয়ারি মাসে সতীনাথ ভাদুড়ী প্রথমবারের জন্য কারারুদ্ধ হন। ‘৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় বন্দী সতীনাথ জেল ভেঙে পালানোর চেষ্টা করেন। এর ফলে তাঁকে ভগলপুর সেন্ট্রাল জেলে বদলি করা হয়। এই কারাবাসই ‘জাগরী’ উপন্যাসের প্রস্তুতিকাল। এক বিখ্যাত পত্রিকা সম্পাদকের প্রত্যাখ্যানের পর ‘জাগরী’ প্রকাশিত হয় সরাসরি পাণ্ডুলিপি থেকে।

১৯৪২ সালের ১৪-ই জুলাই ওয়ারধায় কংগ্রেস ওয়ারকিং কমিটির অধিবেশনে পাশ হলো প্রস্তাব, শাসক ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে আর সমঝোতা নয়, ক্রিপস মিশনের প্রস্তাব হিন্দু মুসলমান কারোরই মনে ধরেনি, এবার পূর্ণ স্বরাজ চাই। ইংরেজ ভারত ছাড়ো। অহিংসার কাছে হিংসার পরাজয় ঘটবে, গান্ধীজীর আশা ছিল তাই।

স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস ছিলেন ব্রিটিশ উপ-প্রধানমন্ত্রী। তাঁকে ব্রিটিশ সরকার বিলেত থেকে ভারতে পাঠিয়েছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ক্রমাগত বিপর্যস্ত ব্রিটিশ সিংহর জন্য ভারতীয় জনগণের সমর্থন এবং সহযোগিতা অর্জন সম্ভব করার জন্য। ব্রিটিশ সেনা বাহিনিতে শতকরা ৬৫ ভাগ ভারতীয় সৈন্য, তাদের সমর্থন পেতে কংগ্রেসের সমর্থন চাই। এই ইতিহাস আমাদের জানা। তবুও স্মরণ করতে দ্বিধা নেই। এই স্মরণ আমাদের পিতৃপুরুষের তর্পণ। অসংখ্য স্বাধীনতা সংগ্রামী নারী পুরুষ যারা আত্ম-বলিদান দিয়েছে শুধু, পেয়েছে নির্মম দেশভাগ আর উদ্বাস্তুজীবন, অসৎ কালো বাজারিদের উল্লাস, তাদের উদ্দেশে উচ্চারণ করা ভুলি নাই, ভুলি নাই, নিঃশেষে প্রাণ যে করিল দান, তাহাদের কথা ভুলি নাই।

৯-ই আগস্ট, গান্ধীজী ডাক দিয়েছেন ইংরেজ ভারত ছাড়ো। সমস্ত ভারত, আসমুদ্র হিমাচল ভারত জেগে উঠেছে। খণ্ডিত ভারত নয়, সম্পূর্ণ ভারত। গান্ধার দেশের সীমান্ত থেকে মণিপুর, নাগাল্যান্ড পর্যন্ত ভারত। ভারত মহাসাগর থেকে হিমালয় পর্যন্ত ভারত। আমরা ওপার বাংলার মানুষ। স্বাধীনতা মানে পিতৃপুরুষের দেশ ছেড়ে এই দেশে, বসিরহাট এবং কলকাতায় আশ্রয় নেওয়া। ছোট ফ্ল্যাট, যা আসলে ছিল দাদুর দস্তানার মতো (বাল্যকালের রুশ বইটিকে স্মরণ করুন), তার ভিতরেই দেশ, স্বাধীনতার কথা বাবার কাছে শোনা ভোরের বেলায়। সেই সময়ে এক পনেরই আগস্ট সকালে দেখেছিলাম ‘৪২ নামের একটি সিনেমা, আর দেখেছিলাম ‘ভুলি নাই’। তখন ১৫-ই আগস্ট কলকাতার সিনেমা হলে মর্নিং শো হতো, সকাল দশটা থেকে বেলা বারোটা এইসব চলচ্চিত্র। স্বাধীনতা দিবস মানে তখন ব্রেক ড্যান্স নয়। ভুলি নাই ছিল মনোজ বসুর লেখা। সেই ছবি ছিল স্বাধীনতা আন্দোলন নিয়ে। মনে আছে সে-ই ‘৪২। হেমেন গুপ্ত পরিচালিত ‘৪২ ছবির কোনো কোনো দৃশ্য আলাদা করে স্পষ্ট মনে আছে এখনো। দেশি পুলিশ সায়েবের চাবুক পড়ছে নেটিভ মানুষের উপর। স্তম্ভিত বালকের চোখে জল। সিনেমার প্রধান চরিত্রকে, নায়ককে চাবুক মারার সেই দৃশ্য এখনো মনে গেঁথে আছে। ১৯৪২ এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনকে প্রথম জানা ভোরবেলায় বাবার মুখে কিছু কিছু গল্প শুনে, আর সেই বছর দশ-এগারয় বিয়াল্লিশ সিনেমা দেখে। এই ছবিটি ১৯৫১-য় মুক্তি পেয়েছিল। অভিনয় করেছিলেন প্রদীপকুমার, বিকাশ রায়, শম্ভু মিত্র, মঞ্জু দে, নির্মল ঘোষ…। আমি অতি সম্প্রতি দুটি ছবি দেখেছি, বাংলাদেশের নায়ক রজ্জাক মারা যাওয়ার পর জহির রায়হানের জীবন থেকে নেয়া, সেই ১৯৭১-৭২ এর পর আবার। আর দেখলাম ‘৪২। ১৯৫১ সালে যে ছবি নির্মাণ করেছিলেন হেমেন গুপ্ত, তা এক কথায় অসামান্য। দেখতে বসে এখনো চোখ ফেরাতে পারি না। এই ছবির কাহিনি, চিত্রনাট্য, পরিচালনা, সব ছিল তাঁর। ছবি আরম্ভ হয়, বল বল বল সবে শত বীনা বেণু রবে, ভারত আবার জগত সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে…এই গানের সুরে। এখনো সেই সুরে দৃপ্ত হয়ে উঠি। হ্যাঁ এই বয়সেও। কিন্তু তার পরেই বুঝি তা তো হয়নি। এই উপমহাদেশ কি ভাল আছে সেই করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে’র ৭৫ বছর পরে। এক কামারের চরিত্র এঁকেছিলেন হেমেন গুপ্ত। তার বিধবা মেয়ে ময়নাকে পুলিশ তুলে নিয়ে যায় আত্মগোপনকারী কংগ্রেসীদের আস্তানা খুঁজে বের করার জন্য। জেরায় ময়না ভাঙে না। নিষ্ঠুর পুলিশ অফিসার ছিলেন বিকাশ রায়। ময়নাকে সিপাই ব্যারাকে পাঠিয়ে দেয় পুলিশ কর্তা। ব্যারাক হলো জমিদার বাড়ি। ইঙ্গিতে ধরা যায় কে স্বাধীনতার পক্ষে, কে বিপক্ষে। এই ছবিতে গ্রামের একজন চতুর আড়তদার আছে। পুলিশের চর। সে-এক অসামান্য চরিত্র চিত্রণ। ‘৪২ ছবিতে প্রতিবাদী ময়নাকে ছিঁড়ে খায় সিপাইরা। তারপর লাশ ফেলে দেয় জলাশয়ে। ‘৪২ দেখতে দেখতে আমার ১৯৭০-৭২ মনে পড়ে। ‘৪২ দেখতে দেখতে আমার মনে পড়ে সেই ৭১-এ সীমান্তের ওপারে মুক্তিযুদ্ধের কথা, পাকিস্তানি সেনার নারী ধর্ষণ আর অত্যাচারের কথা। বাংলাদেশের চিত্র পরিচালক তানভির মোকাম্মেল-এর একটি ছবি, ‘রাবেয়া’র কথা। কিন্তু ১৯৫১-র ছবি ‘৪২-এ আরো এমন কিছু আছে যা আমি কোথাও পাইনি। ১৯৭১-এ মেয়েরা অনেক আলোকিত, চেতনায় উজ্জীবিত, তারা বিপ্লবে বিদ্রোহে এগিয়ে যেতে পারে। আর এই ২০১৭-য় ছত্তিশগড়ের সোনি সোরির কথা আমাদের অজানা নয়। ১৯৪২-এর আন্দোলনে ছিলেন মাতঙ্গিনী হাজরা, তমলুকে জাতীয় সরকার গড়ে উঠেছিল, ভারত জেগেছিল। তমলুক থেকে পাঞ্জাব, তরঙ্গ উঠেছিল সারা ভারতে। শুনেছি কত অসামান্য প্রতিরোধের গল্প। কিন্তু সব ছাপিয়ে গেছে বিয়াল্লিশ ছবিতে দেখা সেই কামার। গান্ধীজী ডাক দিয়েছিলেন অহিংস আন্দোলনের। ইংরেজ সরকার তা একটু আমিষ করে দিচ্ছিলেন। অত্যাচার সীমাহীন হয়ে গিয়েছিল। পুলিশ কংগ্রেস অফিস ধ্বংস করছিল। সত্যাগ্রহীদের জেলে পুরছিল। রাষ্ট্রদ্রোহী, বিদ্রোহীরা জেলে যে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়, তার বিরাম ছিল না। অহিংস সত্যাগ্রহে মেয়েরা অংশগ্রহন করছিল। গান্ধীজী মেয়েদের বলেছিলেন, সঙ্গে একটা করে ছুরি রাখতে, পুলিশ অত্যাচার করার সুযোগ যেন না না পায়। বলা যায় কি, গান্ধীজী মেয়েদের সহিংস আত্মহননের পথ নিতে বলেছিলেনা। আসলে তা ছিল নিজের উপর হিংসা প্রয়োগই। অত্যাচারীর প্রতি নয়, নিজের প্রতি। এখন এই পথ পরিত্যাগ করেছে হয়তো বিপ্লবী কন্যারা। গান্ধীজীর এই অহিংস নীতির পক্ষে বিপক্ষে আমার কথা নয়। কথা সেই কামারকে নিয়ে। নিজের ধর্ষিতা কন্যা ময়নার হত্যাকান্ড তাকে পথ দেখিয়েছিল স্বাধীনতার। রাত জেগে কামারশালে বসে সে ছুরি বানাতে আরম্ভ করল। একটি বালক হাপর টানে সে হাতুড়ির ঘা দেয় তপ্ত লোহায়। লোহায় নয় সেই সব পুলিশ কর্তা আর সিপাই যারা তার মেয়েকে মেরেছে তাদের মাথায় যেন হাতুড়ি নামায়। কম বয়সে দেখা ‘৪২-এ বিকাশ রায়ের নিষ্ঠুরতার কথা মনে ছিল। কামারের হাতুড়ি নামানর কথা বুঝিনি তখন। এখন দেখতে গিয়ে বুঝি হেমেন গুপ্ত মহাশয় এক অসামান্য মুহূর্ত রচনা করেছিলেন সেই ১৯৫১-য়, যা ছিল প্রতিবাদের সর্বোত্তম প্রকাশ। এবং এই দৃশ্যই সহিংস ব্রিটিশ সরকারের প্রতি অহিংস প্রতিবাদ হয়ে নেমেছিল যেন। ১৯৪২-এর আন্দোলন সম্পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের আন্দোলন। তার আগে যা হতো তা শুধু আলোচনাই। ক্রিপস মিশনের ব্যর্থতায় কংগ্রেসের সার্বিক ঘোষণা ইংরেজ ভারত ছাড়ো। এমন স্পষ্ট কথা এর আগে কংগ্রেস বলেনি। তখন পাকিস্তান প্রস্তাব নেওয়া হয়ে গেছে দু বছর আগে মুসলিম লিগের লাহোর অধিবেশনে। ১৯৪০-এর ২৪শে মার্চ সেই দিন। এ কথা সত্য ভারতীয় মুসলমান তার আত্মপরিচয় খুঁজছিল এই দেশে। কংগ্রেস তার নিজের পার্টি হয়নি সেভাবে। মহম্মদ আলি জিন্নাহ যিনি ছিলেন বিলেত প্রত্যাগত এক আধুনিক মানুষ, মোটেই ধর্মান্ধ নন, কিন্তু তিনি তাঁর দু-ঘন্টার বক্তৃতায় কংগ্রেস আর জাতীয়তাবাদী মুসলমান নেতাদের তীব্র সমালোচনা করে মুসলমানের আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার জন্য আলাদা দেশ দাবি করলেন। মুসলমান জনসাধারণের বৃহৎ অংশে পাকিস্তান প্রস্তাব উদ্দীপনা নিয়ে আসে। তারা উত্তর পশ্চিম এবং উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে নিজ দেশ দাবী করে লাহোর প্রস্তাবে। পরে ১৯৪৬-এ পাকিস্তানের জন্য ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে বাংলা এবং আসাম, পূবের বাংলা এবং উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান চেয়েছিল মুসলিম লীগ। ১৯৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনে গান্ধিজীর পিছনে স্বাভাবিক ভাবেই মুসলিম লিগ আসেনি। কিন্তু জাতীয়তাবাদী মুসলমান ছিলেন। ১৯৪২-এর মার্চে ভারতে আসা ক্রিপস মিশন ব্যর্থ হয়, কেন না এই মিশন ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে ছিল না। বিশ্বযুদ্ধের অবসান অবধি অপেক্ষা করতে বলেছিল মিশন। তারপর নির্বাচিত সরকার শাসন করবে দেশ। মুসলিম লিগের আকাঙ্ক্ষিত দেশভাগ হবে কি হবে না তা ছিল অনুচ্চারিত, কিন্তু পাকিস্তান প্রস্তাবের পক্ষে যেন সায় ছিল। স্পষ্ট করে না বলায়, কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগ মানেনি ক্রিপসের প্রস্তাব।

ক্রিপসের মূলত কংগ্রেস ও মুসলিম লিগসহ অন্যান্য দলের নেতৃবর্গের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর ‘৪২-এর ২৪শে মার্চ তাঁর প্রস্তাব পেশ করেন। স্বাধীনতাকামী দুই প্রধান রাজনৈতিক দল কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগকে তা অবহিত করেন।

(১) যুদ্ধের অবসানে ভারতকে কানাডার মতো অধিরাজ্যের মর্যাদা (Dominion Status) দেওয়া হবে, যা আসলে পূর্ণ স্বরাজ নয়। ব্রিটিশের অধীনেই এক দেশ হবে এই দেশ। মূল ক্ষমতা ব্রিটিশ সরকারের কাছেই থাকবে।

(২) যুদ্ধ শেষে ভারতীয় সংবিধান রচনার জন্য ভারতীয় প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সংবিধান সভা গঠন করা হবে এবং সেই সভাকে ভারতের নতুন সংবিধান রচনার দায়িত্ব দেওয়া হবে।

(৩) নতুন সংবিধান কোনো প্রদেশের পছন্দ না হলে সেই প্রদেশ ভারতীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী সংবিধান রচনা করতে পারবে। ভারতের যে-কোনো প্রদেশ বা দেশীয় রাজ্য ইচ্ছে করলে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের বাইরেও থাকতে পারবে।

(৪) সংখ্যালঘুদের জন্য সংরক্ষণ-ব্যবস্থা বহাল রাখা।

(৫) প্রদেশগুলোর প্রাদেশিক আইনসভা সংবিধান সভার সদস্যদের নির্বাচন করবে, অন্যদিকে দেশীয় রাজ্যের রাজারা তাঁদের সদস্যদের মনোনীত করবেন।

(৬) নতুন সংবিধান রচিত না হওয়া পর্যন্ত ভারতের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব ব্রিটিশ সরকার নিজের হাতে রাখবে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ‘ভিটো’ ক্ষমতা প্রয়োগ করে তা বাতিল করার অধিকার বড়লাটের থাকবে।

ক্রিপসের প্রস্তাবগুলো ভারতের বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলের কাছে গ্রহণ যোগ্য হয়ে উঠতে পারেনি। কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ সহ ভারতের প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক দলই ক্রিপস-এর প্রস্তাব একযোগে প্রত্যাখ্যান করে।

কংগ্রেস মনে করে ক্রিপস মিশনের প্রস্তাবে পাকিস্তানের দাবিকে পরোক্ষভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় অর্থাৎ ক্রিপস প্রস্তাবে দেশ বিভাগের পরোক্ষ ইঙ্গিত থাকায় কংগ্রেস তা প্রত্যাখ্যান করে। সবচেয়ে বড় কথা ভারতের প্রতিরক্ষার পূর্ণ দায়িত্ব ভারতীয়দের হাতে ছেড়ে দিতে ব্রিটিশ সরকার রাজি ছিল না ক্রিপস প্রস্তাবিত জাতীয় সরকারকে ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার মতো সম-মর্যাদা ও ক্ষমতা দেওয়ার কোনো প্রতিশ্রুতি ছিল না।

মুসলিম লিগ ক্রিপস প্রস্তাবে সরাসরি দেশ বিভাগ মেনে না নেওয়ায় তা বর্জন করে। ক্রিপস সায়েবের প্রস্তাব প্রত্যখ্যান করে ১৯৪২এর ২৬শে এপ্রিল গান্ধীজী হরিজন পত্রিকায় ভারত ছাড়ো এই শিরোনামের প্রবন্ধে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান চান। ১৪ জুলাই কংগ্রেসের প্রস্তাবে ৯-ই আগস্ট স্থির হয় ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সূচনার দিন। ৯-ই আগস্ট গান্ধীজী গ্রেপ্তার হয়ে যান ভোরে। ভারতবর্ষ জেগেছিল তারপর থেকে কত রাত, কত ভোর। মহাত্মা গান্ধীর পর সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, জওহরলাল নেহরু, আবুল কালাম আজাদ, জে. বি. কৃপালনী সমেত বহু প্রথম সারির নেতা কারারুদ্ধ হন। ব্রিটিশ সরকার কংগ্রেসকে বেআইনি সংগঠন রূপে ঘোষণা করে। সর্বত্র কংগ্রেস কর্মীদের গ্রেপ্তার করে কারারুদ্ধ করা হয়। হেমেন গুপ্ত মশায়ের বিয়াল্লিশ ছবিতে সেই সব সাধারণ মানুষের কথা আছে, তাদের আত্মত্যাগের কথা। প্রথম প্রথম এই আন্দোলন ছাত্র-শিক্ষক, যুবসম্প্রদায় ও বুদ্ধিজীবী মধ্যবিত্ত মানুষদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, ক্রমে তা দেশের শ্রমিক, কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে গণআন্দোলন হয়ে ওঠে। সরকারি দমননীতির প্রতিবাদে দেশের আপামর জনসাধারণ ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করে। দেশব্যাপী ধর্মঘট, শোভাযাত্রা, মিছিল, মিটিং ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হয়। এ সবের প্রতি সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। নির্বিচার ধর-পাকড়, অত্যাচার শুরু হয়। ২৯শে সেপ্টেম্বর দিন নির্ধারিত হয়েছিল সার্বিক অসহযোগের। অবরোধের। অহিংস মিছিলের। রেললাইন ধ্বংস, স্কুল-কলেজ বর্জন, বিভিন্ন অফিস-আদালত দখল, ট্রেন ও টেলিফোন সংযোগ বিছিন্নকরণ, থানা, ডাকঘর, রেজিস্ট্রি অফিস, রেলস্টেশন দখল ইত্যাদি কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। ‘৪২ ছবিতে আছে সরকার সমস্ত রকম পরিবহন নিষিদ্ধ করছে। সাইকেল পর্যন্ত। যাতে আন্দোলনকারীরা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে।

ভারত ছাড়ো আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্রগুলি ছিল মহারাষ্ট্রের সাতারা, মেদিনী পুরের তমলুক, কাঁথি, দিনাজপুরের বালুরঘাট, উত্তরপ্রদেশের বালিয়া, আজমগড়, আসামের নওগাঁ, ওড়িশার তালচের, বালাশোর ইত্যাদি। বিশিষ্ট নেতাদের মধ্যে সাতারার শ্রীনাথ লালা, নানা পাতিল, বালিয়ার চৈতু পাণ্ডে, সরযূ পাণ্ডে, তমলুকের মাতঙ্গিনী হাজরা, সুশীল ধাড়া, পাঞ্জাবের গৃহবধু ভোগেশ্বরী ফকোননি, আসামের স্কুলছাত্রী কনকলতা বড়ুয়া ভারত ছাড়ো আন্দোলনের দীপশিখা হয়ে উঠেছিলেন। এছাড়া অরুণা আসিফ আলি, সুচেতা কৃপালিনী, জয়প্রকাশ নারায়ণ, আচার্য নরেন্দ্র দেব, রামমনোহর লোহিয়া, যোগেশ চ্যাটার্জি, উষা মেহেতা, অচ্যুত পট্টবর্ধন, অজয় মুখার্জি এই আন্দোলনে নিজেদের বিলিয়ে দিয়েছিলেন।

অবিভক্ত বাংলার মেদিনীপুর জেলার তমলুক ও কাঁথি মহকুমায় এই আন্দোলনের গভীরতা ও ব্যাপকতা ছিল বেশি। তমলুকের মাতঙ্গিনী হাজরা ছিলেন গান্ধিজীর অনুরাগিনী একজন গ্রাম্য বিধবা মহিলা। দেশ তাঁর কাছে ছিল জননী স্বরূপা। মহাত্মাজী ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ডাক দিলে মাতঙ্গিনী হাজরা ও রামচন্দ্র বেরার নেতৃত্বে হাজার হাজার মানুষ ১৯৪২-এর সেই অসহযোগের দিন, ২৯ শে সেপ্টেম্বর নানাদিক থেকে এসে তমলুক থানা ও আদালত অবরোধ করেন। ‘৪২ ছবিতে রূপকাশ্রয়ে এই দিনটির কথা আছে। ৭৩ বছর বয়স্কা কৃষকবধু মাতঙ্গিনী হাজরা তমলুক আদালত শীর্ষে ভারতের ত্রিবর্ণ রঞ্জিত পতাকা তুলতে গিয়ে ব্রিটিশের গুলিতে প্রাণ হারান। মাতঙ্গিনী হাজরার দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের আদর্শ জাতিকে উদ্বুদ্ধ করে। অজয় মুখার্জি, সুশীল কুমার ধাড়া ও সতীশচন্দ্র সামন্তের নেতৃত্বে প্রশাসনের কেন্দ্র, মহকুমা অফিস দখল নেওয়া হয়। অজয় মুখার্জির উদ্যোগে ১৯৪২-এর ১৭ ডিসেম্বর তমলুক মহকুমায় ‘তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার’ গঠিত হয়। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সরকারি দমন নীতির প্রচন্ডতা ও উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাবে ভারত ছাড়ো আন্দোলন স্তিমিত হয়ে আসে। হেমেন গুপ্ত মহাশয়ের ‘৪২ ছবিতে মাতঙ্গিনী হাজরার আত্মত্যাগের মতো বৃদ্ধা ঠাকুমার মৃত্যু আছে পুলিশের গুলিতে। পতাকা হাতে শিশু মৃত্যু আছে। আছে প্রধান চরিত্র, নায়কের স্ত্রী উন্মাদিনী ধর্ষিতা নারী বীনার চেতনা পুনরজ্জীবন। সে-ই পতাকা হাতে মিলিটারি ব্যারাকের ভিতরে যাত্রা করে। তার পিছনেই জনতা। ধর্ষিতা নারীকে সমুখে দেখে ধর্ষক পুলিশ কর্তা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে লুটিয়ে পড়ে। ‘৪২ এক আশ্চর্য ছবি। অন্তিম দৃশ্যে, স্বাধীনতা এলে যখন জনতা জয়ধ্বনি করে, তার ভিতরে গান্ধী টুপি পরিহিত সেই আড়তদার দালাল-গুপ্তচর ঢুকে পড়েছে। সে জয়ধ্বনি করছে গান্ধীজীর নামে। স্বাধীনতার পরে যা হয়েছিল তাই-ই দেখিয়েছেন পরিচালক। স্বাধীনতার পর ধীরে ধীরে সেই সব দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষই ক্ষমতার কাছাকাছি চলে যায় যে তা আমাদের অভিজ্ঞতায় আছে। তারাই বেশি গান্ধীবাদী হয় এবং দরকারে দমন-পীড়ন হত্যা করে। কিন্তু আমাদের শেষ কথা, কিছুই ভুলি নাই। ১৯৪২- আমাদের স্মরণে আসুক আবার। ‘৪২-এর আন্দোলনে স্বাধীনতা এলে এই উপমহাদেশের চেহারা অন্য রকম হয়ে যেতে পারত। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *