সিন্ধুতীরে ফেরা-শ্যামলবাবু

সিন্ধুতীরে ফেরাশ্যামলবাবু

শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে কী বলব। কী লিখব তার সৃষ্টিশীল জীবনের বিস্তার নিয়ে, তার আন্দাজ নেওয়া কঠিন হয়ে গেছে আমার পক্ষে। গত তিরিশ বছর ধরে যে লেখককে পড়ছি নিবিষ্ট হয়ে, বছর চব্বিশ যাকে দেখেছি খুব কাছ থেকে তাঁর এই অসম্ভব মৃত্যু নিশ্চিতভাবে আমাদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকিয়ে দিয়েছে। মানুষ কত নিরুপায়। মানুষ আর একটা অবিকল মানুষ তৈরি করতে যাচ্ছে, স্মৃতি হারানো মানুষের ব্রেন-সেলে নতুন ভ্রূণের মস্তিষ্ক কোষ স্থাপন করতে শিখেছে নাকি, কত রকম মারণাস্ত্র, যুদ্ধ বিমান, মারণ গ্যাস, পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে শিখেছে, খাদ্যের প্রয়োজনে চার ঠ্যাংওয়ালা মুরগি তৈরি করছে কী মহান জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর বিদ্যা প্রয়োগ করে, আবার জাপানে গরু ষাঁড়ের ঘাড়ে, হিপে ইলেকট্রিক জার্কার বসিয়ে তাদের গায়ের মাংসে যাতে ফাইবার না গড়ে উঠতে পারে তার ব্যবস্থা করছে সুস্বাদু মাংসের প্রয়োজনে— এত সব করেও কিনা একটা প্রবল ভাবে বেঁচে থাকতে চাওয়া, বেঁচে থেকে সৃজনকর্মে বিভোর হয়ে থাকতে চাওয়া একটা মানুষকে বাঁচিয়ে তুলতে পারে না। সারিয়ে তুলতে পারে না। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘দশ লক্ষ বছর আগে’ নামের আখ্যানটি যদি কেউ এই সময়ে আবার পড়ে নেন তবে এইসব প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। ‘দশ লক্ষ বছর আগে’ নামের ক্ষুদ্র উপন্যাসটি পড়তে পড়তে এখন আচমকা আমার মনে হচ্ছে শ্যামলবাবু কি টের পেয়েছিলেন তাঁর জাগতিক জীবনের ভবিতব্য? এমনই ভবিষ্যৎদ্রষ্টা ছিলেন তিনি? নাকি এ আমার নিতান্তই কষ্টকল্পনা। কিন্তু প্রাণরহস্যের, জীবনজন্মের যে আশ্চর্য কাহিনি লিখেছিলেন শ্যামল বাবু তাঁর অসুখের কয়েকমাস আগে, তার তুল্য অন্তর্ভেদী, হৃদয়বিজড়িত, এই পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা প্রশ্নেভরা কাহিনী আমি বহুদিন পড়িনি। বহুকাল।

হৃদয়বেত্তা এবং যুক্তির ভিতরে নাকি দ্বন্দ্ব প্রবল। হৃদয় যখন বিস্তারিত হয়, যুক্তির জাল তাতে ভেসে যায়, আবার যুক্তির জাল যখন ছেয়ে ফেলে সব, হৃদয় নাকি তাতে চাপা পড়ে যায়— ‘দশ লক্ষ বছর আগে’ নামের আখ্যানটি পড়তে পড়তে ভাবছি হৃদয়ের অন্তঃস্থলে প্রবেশ করেছে যে কাহিনি, তার ভিতরে শ্যামলবাবুর দুই নবীন বিজ্ঞানী, স্বামী স্ত্রী, আলাপে বসে বলছে—“আমার মনে হয়— আমরা সায়ান্টিস্ট সেজে যা কিছু করছি তার অনেকটাই চলে যাবে— যাচ্ছে ব্যবসায়— মানুষের ভোগে— আরও রুটি মাংস খাব— আরও আরও— আরও বেশি ভোগ করব— এই বিলাসে— এই ডলারে। এর ভেতর বিজ্ঞান কোথায়? গবেষণা কোথায়? প্রাণের জিন এপাশ ওপাশ সেপাশ করে দিয়ে যা করতে চলেছি— তার অনেকটাই তো চলে যাচ্ছে-যাবে যুদ্ধের কাজে। কে বলতে পারে যাবে না?

(দশলক্ষ বছর আগে পৃঃ ৩০)

শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে আমি শেষ থেকে স্মরণ করছি। তিনি যেভাবে ২০০০ সালে বসে ফিরে যেতে পারতেন দশলক্ষ বছর আগের অতিকায় ডায়নোসরের যুগে, সেই সূত্র ধরেই শ্যামলবাবুর শেষ ছোটগল্প ‘সে’ থেকে আমি না হয় পিছিয়ে গেলাম কুবেরের বিষয় আশয়, রাখাল কড়াই, চন্দনেশ্বরের মাচানতলার সময়ে যখন বাতাস ছিল আলোয় ভরা, আলোও ছিল আলোর মতন, মদন বদন নামের নিরন্ন দুই ভূমিহীন যুবক, একটি কুকুর, একটি হুলোবিড়াল, দুটি রাজহাঁস, একটি গাইগরু ও তার তাগড়াই বলদ বাছুর, গোটা আটেক পাতিহাঁস, কোম্পানি বাঁধের ভিতরে গর্তে বাস করা বিষধরদের নিয়ে খোলা মাঠের ভিতরে দালান কোঠা বানিয়ে দুটি বালিকা-কন্যা আর বউ নিয়ে সাপুড়ে মহম্মদ বাজিগর বা গো-বদ্যি বিরজা ডাক্তারের জন্য অপেক্ষা করে ঈশ্বরীতলায় বাস করা অনাথবন্ধু।

এই সময় থেকে সেই সময়ে ফেরা মানে শ্যামলবাবুর দশ লক্ষ বছর আগে নামের ক্ষুদ্র উপন্যাসটির চরিত্র, সেই জন্মসূত্রে আইরিশ কিন্তু বহুকাল আমেরিকাবাসী টিচবোর্ন পরিবারের জেনেটিক বিজ্ঞানী কন্যা এলসা টিচবোর্নের সংহতি কলোনিতে গভীর রাতে দেখা কোটি কোটি বছর আগে নিশ্চিহ্ন ডায়নোসরের কাছে ফিরে যাওয়া যেন। কে কার উত্তরাধিকার বহন করছে, ডায়নোসর থেকে কে হয়ে গেছে পাখি, কে হয়ে গেছে বাঘডাঁশা নামের অতিক্ষুদ্র এক প্রাণী কিংবা পথের সেই কুকুর-জাল কণ্ঠি, চিনে নেওয়া কঠিন, কিন্তু শ্যামলবাবু সেই দুর্জ্ঞেয় পথের খোঁজেই যেন বেরিয়েছিলেন ওই ক্ষুদ্র আখ্যানে। প্রাণের বিবর্তনে সময়ের ভূমিকাকে আবিষ্কার করতে চেয়েছিলেন বাংলা ভাষার এই লেখক। নতুন করে পড়তে পড়তে মনে পড়ে যাচ্ছিল অতি সম্প্রতি সুখ্যাত বিজ্ঞানী দীপঙ্কর হোম মহাশয়ের একটি বক্তৃতার কথা। একটি ঘরোয়া সভায় বিশ্বখ্যাত এই বিজ্ঞানী যে কথা বলেছিলেন, তারপর যে যে কথা উঠে এসেছিল লেখক শিল্পীদের কাছ থেকে, তার থেকেও যেন অনেক বেশি প্রশ্ন উঠে আসে ‘দশ লক্ষ বছর আগে’ পড়লে।

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং গবেষণাগারটি জাপানের কোবে শহরে। চৌষট্টিজন বিজ্ঞানী মানে চৌষট্টিটি মেধাবী মানুষ। চৌষট্টিজন সমস্তদিন একটিও কথা বলে না, তাদের কোনো বিনোদন নেই, নিঃশব্দে গবেষণাগারে দিন কাটায়, নিঃশব্দে ফিরে এসে ঘুমিয়ে নেয়। শুধু আমেরিকার এলসা আর কলকাতার সংহতি কলোনির পরিতোষ কুণ্ডু নিজেরা কথা বলতে পারে। বলতে হয়। তাদের প্রেমের পর পরিণয় হয়েছে। কলকাতায় এসেছিল এলসা। মধ্যরাতে সংহতি কলোনির বাড়ির দোতলা থেকে পেছন দিকের ঝোপ জঙ্গল এবং শুকনো পড়ে থাকা পুকুরের গর্ত থেকে বেরিয়ে আসা এক অতিকায় প্রাণীকে দেখতে পেয়ে ভয় পেয়েছিল সে। সে নিজেই প্রাণের রহস্য উন্মোচনে ব্রতী, সে নিজেই দেখেছে কোটি কোটি বছর আগে নিশ্চিহ্ন প্রাণ ডায়নোসরকে শুকনো জলাশয়ের গর্ত থেকে বেরিয়ে আসতে। আসলে ওই গর্তে বাস করে একটি অদ্ভুত প্রাণী, উদবেড়াল নয়, বাঘরোল নয়, খটাশ নয়, কিছুটা কুকুর কিছুটা বিড়াল বা বাঘের মতো, যাকে কিনা পাশের বাড়ির পাগলা রাখাল মাস্টার বলে বাঘডাঁশা। এ এক এমন প্রাণী যা ক্রমশ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে প্রকৃতি থেকে, যেভাবে প্রায় মুছে গেছে বাঘরোল, বনবেড়াল এবং শিয়াল খটাশও। এলসা ওই বাঘডাশার গর্ত থেকেই বেরিয়ে আসতে দেখেছিল অতিকায় ডায়নোসরকে— এ কি মাইক্রো বায়োলজি, জিন-প্রযুক্তি জানা, প্রাণের রহস্য উদ্ধারে বিভোর, কৃত্রিম প্রাণ সৃজনে নিমগ্ন এলসা কুণ্ডু (টিচবোর্ন)-র শুধুই বিভ্রম? কল্পনা! নাকি অন্তরের সত্য দর্শন? সে তো জানে তার গবেষণা শেষ অবধি মানব কল্যাণে কতটা যাবে, কতটা যাবে যুদ্ধের প্রয়োজন মেটাতে, ব্যবসা আর ডলার উৎপাদনে। পড়তে পড়তে কত মাত্রা যে উদ্ভাসিত হয়ে যায় নতুন আলোর মতো। আচমকা মনে হয় লেখক কি নিজেকে চিনে নিতে চেয়েছিলেন সৃষ্টির আদিরহস্য উন্মোচন করে। ভ্রূণের স্মৃতিতে পৌঁছতে চেয়েছিলেন। কী আশ্চর্য এই আখ্যান। জলধর কুণ্ডুর স্মৃতি আচমকা নষ্ট হয়ে যায়, মনের ভিতরে জেগে ওঠে বিচিত্র পাপবোধ। সেই জলধরকে তার পুত্রবধূ এলসা জাপান থেকে উড়ে এসে আমেরিকায় নিয়ে যেতে চায়, তার মরে যাওয়া ব্রেন সেল রিপ্লেস করবে তাজা ব্রেন সেল দিয়ে। তাজা ব্রেন সেল আসবে সদ্যসৃষ্ট ভ্রূণ থেকে। সেই ভ্রূণ দেবে এলসা নিজে। তার গর্ভে তখন এসে গেছে প্রাণ, যে প্রাণ বয়ে নিয়ে যাবে জলধর কুণ্ডুর বংশধারাকে। এই ক্ষুদ্র উপন্যাসটি তখন এক ঐশ্বর্যময় আখ্যানে পৌছে যায়। এই আখ্যানটিতে শ্যামলবাবু পৌঁছেছেন কুবের সাধুখার কদমপুর, মেদন মল্লর চর থেকে অনাথবন্ধুর ঈশ্বরীতলা থেকে, বিদ্যাধরীর মরা খাত থেকে কলকাতার উপকণ্ঠের সংহতি কলোনি হয়ে জাপানের কোবে শহরের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং গবেষণাগারে—প্রাণ উৎপাদনের কারখানার হিমশীতল নৈঃশব্দে। ঈশ্বরীতলার রূপো কথা, কুবেরের বিষয় আশয় বা আর একটি ক্ষুদ্র উপন্যাস গঙ্গা একটি নদীর নাম-এ কুকুর, বিড়াল, পশু পাখির নানারকম উপস্থিতি। তাদের ভাষা বোঝে যেন অনাথ কিংবা হাজরা হালদার। পশুপাখি এমন কি গঙ্গার অতল তলে ভেসে আসা গাভীন ইলিশও স্বপ্নের ভিতরে মানুষের ভাষায় কথা বলে, প্রাণীর সঙ্গে প্রাণীকীট পতঙ্গের সম্পর্কটি খাদ্য খাদকের। একে অন্যকে খেয়ে বেঁচে আছে, এই নির্মম সত্যটি উদঘাটন করতে করতে শ্যামলবাবু পৌঁছে যান সৃষ্টির রহস্য উদ্ধারে।

 ‘ঈশ্বরীতলার রূপোকথা’ উপন্যাসে বজ্জাত নামের একটি হলো বেড়াল ছিল। সেই বেড়ালটি পাখির ছানা খেতে,পাখির ডিম চুরি করে খেতে উঠে যায় হরিতকি গাছটিতে, নিঃশব্দে। শ্যামলবাবুর বর্ণনায়:

“এই বজ্জাত নেমে আয়!

বজ্জাত তখন একটা উঁচু ডালের পাতার ঝুপসিতে ঢাকা পড়ে গেছে।

দশ গোনার সময়ও পেরোয়নি। ডালপালার ভেতর থেকে বজ্জাত ফ্যাঁস মত একটি আওয়াজ করল।

আহারে! চোখ বুজে ফেলল শান্তা। কোন পাখির প্রাণ গেল!

এবার অনেক জোরে। ডালপালার ভেতরে গা ঘষটানোর আওয়াজ। শান্তা দেখতে দেখতে একেবারে স্ট্যাচু হয়ে গেল। বজ্জাত ঘুরতে ঘুরতে ধপাস করে নীচে পড়ল। আর সঙ্গে সঙ্গে একপাল ঘনকালো মাছি নেমে এল। সাদা বজ্জাতকে মাছিরা ঢেকে কালো করে ফেলল। তারই ভেতর একবার বোধহয় একটু পাশ ফেরার চেষ্টা করল বজ্জাত।

(ঈশ্বরীতলার রূপোকথা)

ইলিশ আর গঙ্গা নিয়ে যে উপন্যাস “গঙ্গা একটি নদীর নাম” সেখানে আছে ‘সন্ন্যাসী কাঁকড়া’ আর শীতল পাটি মাছের কথা। তারা সব ওৎ পেতে থাকে ইলিশের ডিম খেয়ে নেওয়ার জন্য।

 “গঙ্গার পেটের ভেতর যেখানটায় যেখানটায় মাটির থাক ভাগ হয়ে চাকমতো হয়ে আছে সেখানটায় গাভিন ইলিশের দল বুড়বুড়ি কেটে ডিম ছাড়ছে। ওরা জোয়ারের সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্র থেকে এসেছে। ভাটির টানে ভোর রাতে পেটখালি করে সাগরে ফিরে যাবে। পেট খালাসের সময় ইলিশের পেটে ব্যথা হয় নিশ্চয়। জলের নীচে অন্ধকারে রাস্তা চিনে চিনে আসা। অন্ধকারের নিজের একটা আলো আছে। সে আলো জেগে ওঠে ইলিশের চোখে মণিতে। ভারী পেট নিয়ে নড়াচড়া এক অস্বস্তি। সবাই তো সেখানে হাঁ করে আছে খাবার জন্যে। দূর থেকে বিটকেল সব মাছ আসে। কোনোটা আবার খানিক মাছ খানিক কিম্ভূত শরীর নিয়ে ওদের হাঁমুখে পড়ে যাওয়ার বিপদ সব সময়। আড়াল আবডালের জন্য ঝাঁক ধরে ইলিশেরা কখনো যায় হলদি নদীর মুখে নয়াচরের তলার দিকে। চরটা ওপর ওপর দেখনসই। ওপর দিকে ঠিকই আছে। কিন্তু ঘূর্ণি স্রোতে জলের নীচে নয়াচরের পায়ের দিকটা প্রায় ফোপরা। ওখানে পেট খালাস করে ডিম ছাড়া যায়। কিন্তু সন্ন্যাসী কাঁকড়াগুলো, শীতলপাটি মাছ ওৎ পেতে আছে।”

 (গঙ্গা একটি নদীর নাম)

জন্ম মৃত্যু, বেঁচে থাকা সবই যেন একই সূত্রে গেঁথে গেছেন শ্যামলবাবু। ‘কুবেরের বিষয় আশয়’ থেকে ‘গঙ্গা একটি নদীর নাম’— সমস্ত গল্প ও উপন্যাসে। সময় কম নয়। পঁয়ত্রিশ বছর কেটে গেছে হয়ত এরই ভিতরে।

 “গঙ্গা একটি নদীর নাম”-এ আছে এক ভয়ানক মৃত্যুর কথা। মাছমারা হাজরা হালদার ভুটভুটি, জাল সব ভাড়া করে গঙ্গায় ইলিশ ধরতে ভেসে যায়। সঙ্গে যে আছে, সেই মুকুন্দর এই প্রথম জলযাত্রা, তাও রোখে পড়ে। ভুটভুটিতে চাল ডাল নুন তেল কেরসিন আর বরফ, সঙ্গে কাঠের গুঁড়োতে ভরা বস্তা। ভাসতে ভাসতে বড় লালমোহন ভেটকি, পায়রাচাঁদা, বড় গাঙের সাপ, আড়ট্যাংরা ধরা পড়েছে। তারা আছে ভুটভুটি নৌকোর খোলে। তারপর এক সময় ধরা পড়ে ইলিশ। সেই ইলিশ ধরার বর্ণনা বড় ভয়ঙ্কর। ইলিশের নীচে চাপা পড়ে যায় ভেটকি পায়রাচাঁদা। কাঁচা ইলিশের চাপে বরফ গলে যায়। জল থেকে ছিটকে ইলিশ পড়েছে ইঞ্জিনে। যন্ত্রপাতি সব চাপা পড়ে গেছে ইলিশে। এক একটা ইলিশ এক একটা বড় নোট। পচন ধরল ইলিশে। ভুটভুটি বিকল। সমুদ্রে ভাসছে তা। সঙ্গী মুকুন্দর উন্মাদ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। তার ভয় সে আর ফিরতে পারবে কিনা। ইলিশগুলো নিয়ে ফিরতে পারলে সংসারের হাল ফিরত হাজরা হালদারের। পচা ইলিশ করে তুলল তাকে বিপন্ন। বড় গাঙকে পচা গলা ইলিশ ফিরিয়ে দিয়ে কোনো রকমে বেঁচে ফিরতে চায় সে। বেঁচে থাকা টিকে থাকা যে কত কঠিন কাজ তা শ্যামলবাবুকে পাঠ করলে ধরা যায়। কাঠের গুঁড়ো, বরফ, জাল, নৌকো নিয়ে ইলিশ ধরতে বেরিয়ে বরফ গলে যায়, মাছের দেখা মেলে না। আবার বরফ যখন শেষ, তখন আসে রূপোলী ইলিশের ঝাঁক। কে কীভাবে টিকে যায়, টিকে থাকতে কাকে কতটা কী করতে হয় তার আশ্চর্য বিবরণ আছে এই উপন্যাসে। টিকে থাকা আর না টিকতে পারা এইই তো তাঁর অনুসন্ধান।

 ফিরে যাই ঈশ্বরীতলার রূপোকথায়।

 ঈশ্বরীতলা…তে পাতিহাঁসের ঘরে সাপ ঢুকে ফণা তোলে। দুটি হাঁস ভয়েই মারা যায়। নিরুপায় ভীতু প্রাণ। বাওড় থেকে নদীর আমলের পেল্লাই মহাশোল ধরতে ব্যাঙের গর্ত খুঁড়ে ব্যাঙ খুঁজে বেড়ায় মদন বদন। মহাশোল লোভে পড়ে ব্যাঙ খাবে। তারপর মহাশোলটিকে খাবে মানুষ। অনাথের চাষ করা ধান খেয়ে ফেলে মাংসল ঢেউ তোলা ক্রিমি-মাজরা পোকা। কী ধান হয়েছিল যে—লকলকে সবুজ, চওড়া পাতা তার। তখন গর্ভথোড়ে দুধ আসার কথা। কিন্তু ভিতরে ভিতরে যে সব ফোঁপরা হয়ে গেছে কে বুঝবে? ক্রিমিরা সময় সময় সুযোগ মতো নেমে পড়েছিল কাজে। অনাথবন্ধু ধানের মোটা গোছের যেখানেই হাত দেয় সেখান থেকেই শ্বেত প্রজাপতির দল উড়ে যায়। এই প্রজাপতিদের যাদের বাঁ পাখনায় একটা করে কালোফুটকি- তারা মাদী, মাজরা পোকা- ঢেউতোলা ক্রিমির জননী। মাজরা পোকাও তাহলে ধানের থোড় খেয়ে শাদা প্রজাপতি হবে। ধান বাঁচল না। বাঁচল না বটে, কিন্তু ওই ঢেউতোলা ক্রিমি, যা থেকে জন্ম হবে প্রজাপতির তাদের মারতে বিষ ছড়ানো হবে ধানের গায়ে। এই মৃত্যু-কীট পতঙ্গ থেকে না-জানা প্রাণী মানুষের অভিজ্ঞতা এসে পৌঁছয় সংহতি কলোনির শুকনো পুকুর পাড়ের গর্তে বাস করা এক অদ্ভুত প্রাণীতে। কেউই টেকে না, বাঁচেনা, বালি ঝড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় অতিকায় ডায়নোসর, এরপরেও বেঁচে থাকে বাঘডাঁশা, লুকিয়ে থাকে এই ভূমণ্ডলে। তার ভিতরেই জেনেটিক ইঞ্জিনীয়ার এলসা টিচবোর্ণ প্রত্যক্ষ করে ডায়নোসরের শেষ চিহ্নটিকে।

পৃথিবীটা খাদ্য-খাদকের, দখলদারির, দখলকারের, নারী পুরুষের। জমি মাটি এবং নারী দখল করতেই কুবেরের যাত্রা জীবনের এই পথে। জমি মাটি দেয় ফসল। ফসলের কামনা কি লুকিয়ে থাকে না দখলের প্রবল ইচ্ছার ভিতরে? আর নারী দখলের ভিতরেও তো লুকিয়ে থাকে যেন ওই একই সূত্র। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় এইভাবে ভেবেছেন, জাগতিক পৃথিবীকে দেখেছেন। ‘কুবেরের বিষয় আশয়’ উপন্যাসটি লোভের, দখলের এবং আশ্চর্য এক স্বপ্নপূরণের আকাঙক্ষার দীর্ঘ আখ্যান। আমাদের গল্প উপন্যাসে যে এক চতুর কাহিনী সবসময়ই বয়ন করা হয়, যার আরম্ভ থাকে, শেষ থাকে, ফলে পাঠকের তাকে অনুসরণ করতে অসুবিধে হয় না, দরকারে মুখে মুখে কাহিনীটি বলে নিলেও চলে, কুবেরের বিষয় আশয় উপন্যাসটিতে সেই কাহিনী বয়ন তো নেইই, বরং আছে জমি মাটি নারী প্রকৃতিকে ধীরে ধীরে আত্মস্থ করার তীব্র প্রয়াস। জমি কেনাবেচা করতে করতে কুবের সাধুখাঁ জমি মাটির মায়ায় বশীভূত হয়। জমি কেনাবেচা করতে করতে তার হাতে টাকা আসে। টাকা নাড়াচাড়া করতে করতে কত কী! আবার জমি তো শুধু বেচা কেনা নয়, তা থেকে ফসল তোলা যায়। মেদন মল্লর চরে চাষবাসে টাকা ঢেলে বসে কুবের। তাকে ভদ্রেশ্বর স্বপ্ন দেখায় সে কালে কালে চকদার হয়ে উঠবে, কিয়ৎকালের মধ্যে তার মতো চাষী এই ভূমণ্ডলে আর কেউ থাকবে না।

 কুবের সাধুখাঁর ভিতরে খাদক হয়ে ওঠার লোভ যেন জন্ম নিতে থাকে। কিন্তু তার এই জগতকে দেখা তো শুধুই দেখা নয়। তার দুচোখে ক্লান্তিহীন বিস্ময়। সেই বিস্ময় বোধই এই আখ্যানটিকে গভীর জীবনবোধের কাছে নিয়ে যায়। কুবের সাধুখাঁ সামান্য মানুষ, দু চার পয়সা আয় করাই তার কাছে ছিল সমস্যা। নিম্নমধ্যবিত্তের ভাঙাচোরা জীবন ছিল যার সম্বল, মনের ভিতরে এক পাপবোধকে নিরন্তর লালিত করে থাকে যে কুবের সাধুখাঁ, সেই অতি সাধারণ কুবের নিজভূমি ত্যাগ করে নেমে পড়ল জমি কেনাবেচার কারবারে। নিজের চারপাশের গণ্ডি মাড়িয়ে বাইরের বিপুলা পৃথিবীর ভিতরে নেমে এল যেন কুবের। জমি থেকে টাকা হয়। টাকা থেকে আরো জমি। নেশা আর লোভ বাড়ে। চাষবাসে নেমে পড়ল সে মেদনমল্লর চরে গিয়ে। চাষবাস ফসল থেকে সে চকদার, গাঁতিদার হয়ে উঠতে লাগল যেন, জমির পরিমাণ, দখল নিয়ে যে স্বত্ব, স্ট্যাটাস। দখল করল পরস্ত্রী। আর কী বাকি থাকে তার? প্রকৃতির মতো সীমাহীন হয়ে ওঠে যেন তার আকাঙ্ক্ষা। কদমপুরে নগর বসাতে চায়, মেদন মল্লর চরে বড় ফসল ফলিয়ে, চাষা খাটানো চকদার। বাঙালী মধ্যবিত্তের জীবনের ঘেরাটোপ থেকে কুবের যেমন বেরিয়ে পড়েছিল মেদনমল্লর চরে, তেমনি বাংলা উপন্যাসও নতুন পথে যাত্রা করেছিল যেন শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে।

“কুবেরের বিষয় আশয়” উপন্যাসে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় তার প্রকৃতি মগ্নতায় মুগ্ধ করেন। মেদনমল্লর চরে পড়ে থাকা ভাঙা দুর্গ, সরেস কুমারী মৃত্তিকা, চাষবাস, নদীনালা, নদী সরে যাওয়ায় জেগে ওঠা পয়স্থি জমি, চরভরাটি জমি, নদী ভরাটি জমি মিলিয়ে যে অনিঃশেষ প্রকৃতিকে লিখে ফেলেন, সেই প্রকৃতিতে এই তো মরতে মরতে টিকে আছে অদ্ভুত প্রাণী বাঘডাঁশাটি। তাকে যেন কুবেরের বিষয় আশয়-এর ভিতরেই অনুভব করা যায় অন্যভাবে। আমি বলতে চাইছি, ‘দশলক্ষ বছর আগে’ আখ্যানের বীজ যেন কুবের সাধুখাঁ, অনাথবন্ধু বসু (ঈশ্বরীতলার রূপোকথা) বা রাখাল কড়াই গল্পের ক্ষীরোদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে রাখা।

রাখাল কড়াই গল্পে কাঠের কারবারি ক্ষীরোদ চলে বিদ্যাধরীর বাদা মাড়িয়ে গরাণবেড়েতে গাছ কিনতে। সেই গাছ কত বড়, না চার মানুষেও তার বেড় পায়না। সে এক জঙ্গুলে, বুনো তেঁতুল গাছ যার বয়সের গাছপাথর নেই। তিনখানা বড় করাত ভাড়া করে ক্ষীরোদ সেই গাছ একদিন কেটে নেবে। ঠিক করেছে গরাণবেড়ের লোকজন লাগিয়ে তিনদিনে কুড়োলে কুড়োলে কেটে পুরো গাছটা খান কয়েক গোরুর গাড়িতে চাপিয়ে নিয়ে চলে আসবে। যেতে যেতে ধানক্ষেতের ভিতরে বিদ্যাধরী নদীর কথা শোনে ক্ষীরোদ। তিনমাইল চওড়া নদী এখন ধানক্ষেত। ক্ষীরোদ পৌঁছয় গরাণ বেড়ে। ধান ক্ষেতের ভিতর দিয়েই সেই বিপুল বৃক্ষকে প্রত্যক্ষ করে। এক একখানা ডালে শেয়ালদার আধখানা প্লাটফর্ম যেন জুড়ে যাবে। তো গাঁয়ের মানুষ সেই গাছ না দেওয়ার কত ছলই না করে। তেঁতুল গাছের শরিক বুড়ো বলে, তাদের খুড়ো মশায়ের বাপের লেজ ছিল। তিনি নাকি এগাছ থেকে ওগাছে লাফাতে পারতেন। পাকা বাড়ির মেঝেয় চড় মেরে দাওয়া ফাটিয়ে দিতেন। তিনি মরেননি। শেষ বয়সে নাকি একা একাই করাতি নদী পার হয়ে সুন্দরবনের দিকে হেঁটে চলে গেছেন-আর ফেরেননি। তা ঐ তেঁতুল গাছে তাঁর চিতার জন্য একটা ডাল রাখা আছে। তিনি মরলেই তো লাশ চিতায় দিতে হবে। তাঁর নাম পোড়ো গায়েন। তিনি যে তালডোঙায় চেপে চলে গিয়েছিলেন সুন্দরবনের গভীরে, সেই তালডোঙায় চেপেই ফিরবেন। ফিরবেন বটে, কিন্তু নদী তো মরে গেছে। করাতি, বিদ্যাধরী শুকিয়ে কাঠ। আড়াইশো বছরের বুড়ো পোড়ো গায়েন তো আর হেঁটে ফিরতে পারবে না।

 কিন্তু পোড়ো গায়েন ফিরবেই। তাকে ফেরাবে বলেই না তেঁতুল গাছে তার চিতার কাঠটি সংরক্ষিত রেখে তার নাতিপুতি বুড়োরা বসে আছে। পোড়ো গায়েনের ফেরা না ফেরা নিয়ে যখন কথা চলতে থাকে তখনই গাছের উপর থেকে নেমে এল কালো একটি সরীসৃপ, খড়িচোঁচ।

 তেঁতুল গাছটিকে রেখে দেওয়ার জন্য, কাঠের কারবারি ক্ষীরোদ পাকড়াশিকে ফেরত পাঠানোর জন্য কোনো এক পোড়ো গায়েনের নাতিপুতিদের কতই না ছল। ছল করেই না পোড়ো গায়েনের কথাটা তৈরি করা। আবার তৈরিই বা কী করে বলি? এমন কিংবদন্তী তো অতবড় গাছকে ঘিরে গড়ে উঠতেই পারে। এ হয়ত গরাণবেড়ের মানুষের বিশ্বাস। বিশ্বাস-অবিশ্বাস, হ্যাঁ-নার ভিতরের সমস্ত সীমারেখাকে তছনছ করে দিতে পারেন শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। পড়তে পড়তে মনে হয় তালডোঙায় করে সেই আড়াইশো বছর আগে সুন্দরবনের গভীরে ভেসে যাওয়া পোড়ো গায়েন কি আত্মগোপন করে নিজেকে রক্ষা করেছিল? যার লেজ ছিল, যে কিনা এ গাছ থেকে সে গাছে লাফাতে পারত। সেই পোড়ো গায়েনের লুকিয়ে পড়া ছাড়া আর তো কোনো উপায় ছিল না বাঁচার। সংহতি কলোনির পুরনো পুকুরের গায়ের গর্তে যে বাঘডাঁশাটি নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছে, সেই কি তাহলে পোড়ো গায়েন? প্রাণ তো এই ভাবেই থেকে যায় অন্য প্রাণের ভিতরে। এক একটা সময়ে পৃথিবীতে এক এক প্রাণের ঢেউ এসেছে, তা নিঃশেষও হয়েছে, ডায়নোসররা বিলুপ্ত হয়েছিল হয়ত বালির ঝড়ে-প্রকৃতির সঙ্গে যুঝতে না পেরে-কিন্তু তার ছায়া তো বাঘডাঁশার ভিতরে গভীর রাত্রিতে প্রত্যক্ষ করে এলসা টিচবোর্ন(কুণ্ডু)। পোড়ো গায়েনকে আমি যেন দেখতে পাই সেই বাঘডাঁশার ভিতরে। এলসা টিচবোর্নের দেখা সাহিত্যের সত্য, আমার অনুমানও সেই সত্যেরই আর এক রূপ।

“রাখাল কড়াই” গল্পের ক্ষীরোদ ভয় পেয়ে বাদার ধানক্ষেত ধরে পালিয়ে যাচ্ছিল গরাণবেড়ে থেকে! গরাণবেড়ের বুড়োদের কথা তার সত্য মনে হয়েছিল। ফেরার পথে সে দ্যাখে বিদ্যাধরীর মরা সোঁতায় জল আছে। মরা বিদ্যাধরীকে সে বেঁচে উঠতে দ্যাখে যেন। তা কি আর সত্যি হতে পারে? কিন্তু ভীত ক্ষীরোদ পাকড়াশির মনের ভিতরে তেমন এক সম্ভাবনা তৈরি হয়ে যায়। পোড়ো গায়েন ফিরতে পারে এমন অসম্ভবের ইঙ্গিতে কাহিনি অনিঃশেষ হয়ে যায়। এই অনিঃশেষতা শ্যামলবাবুর গল্প, উপন্যাসে দিয়েছে বহুমাত্রা। “দশ লক্ষ বছর আগে” নামের ক্ষুদ্র আখ্যানটিতেও।

আমি আর একটি গল্পের কথা বলছি। “সে” নামের গল্পটি দু’হাজার সালে লেখেন শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর কোনো লেখাই আগের লেখার মতো নয়। যে অনিঃশেষতা তার আশ্চর্য উপন্যাস— কুবেরের বিষয় আশয়, ঈশ্বরীতলার রূপোকথা, চন্দনেশ্বর জংশন, স্বর্গের আগের স্টেশন বা রাখাল কড়াই, চন্দনেশ্বরের মাচানতলায়, হাজরা নস্করের যাত্রাসঙ্গী, দখল, পরী ইত্যাদি গল্পগুলিকে কিংবদন্তীর মতো করে গড়ে তুলেছে আমাদের পাঠ অভিজ্ঞতায়, সেই অনিঃশেষতাও শেষ কথা নয়। শ্যামল বাবু তাকেও ভেঙে দিতে পারেন। “সে” গল্পের বড় পিসেমশাইটির জন্ম ১৮৪৩-এ। তাঁর চোদ্দবছর বয়সে সিপাহী বিদ্রোহ। সেই মানুষটি ছিলেন প্রবল শক্তিমান। ওপার বাংলার বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী মোরেলগঞ্জ নিবাসী বড় পিসেমশাই এখনো কাহিনি কথকের পরিবারে কিংবদন্তীর মত বেঁচে আছেন। তাঁর বড়ছেলে মোহিনীদা এক রাতে পাড়ি দিতেন তিরিশ মাইলের উপর, স্রেফ পায়ে হেঁটে, কথকতা করে বেড়াতেন। বেঁচে থাকলে বড় পিসেমশাই-এর বয়স হতো ১৫৭ বছর। এখন তিনি কোথায়? এই গল্পের কাহিনিকথক, ধরা যাক তিনি শ্যামলবাবুই, ১৫৭ বছর বয়সী পিসেমশাইকে এই শহরে পেয়ে যেতে থাকেন। লোকটা তাঁকে বারবার যেন বিপদের হাত থেকে বাঁচাতে থাকে। এর নাম কি যাদু বাস্তবতা? কল্পনার এই সীমাহীনতা তো শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় পাঠে বারবার প্রলুব্ধ করে। বারবার বিপদে কাহিনিকথকের পিছনে এসে দাঁড়ান যেন মোরেলগঞ্জের বড় পিসে, শ্যামলবাবু দেখতে পান মর্তমান কলার সাইজের পায়ের আঙুল, বুড়ো কাতলা মাছের আঁশের মতো নখ। এক এক সময়ে তার এক একরকম ছদ্মবেশ। বাসের ভিতরে ছাইরঙের ভেলভেট স্যু পায়ে ঢ্যাঙা একটি মানুষ, গায়ে তার স্পোর্টস গেঞ্জি, পরনে রিংকল-ফ্রি প্যান্টুলুন। মধ্যবয়সী যুবক, বছর ৪০-৪৫ হয়ত হতে পারে। তার কি ১৫৭ বছর হবে? শ্যামলবাবু ভাবতে থাকেন। হতে পারে হয়তো। বাইরেটা আগাগোড়াই ছদ্মবেশ কি হতে পারে না? তো সেই লোকই কন্ডাক্টরের হাত থেকে টিকিটের টাকা বাঁচিয়ে দেয়-কাহিনিকথক টিকিট কাটেন না বাসে, তার অফিসে ক্লোজার, পি.এফ, গ্রাচুইটি কোনো টাকাই তিনি পাননি—একদল লোক ভাল দল পাকাতে পারে বলে তাদের জন্য গত বিশ বছরে দফায় দফায় মাইনে বাড়িয়ে আট হাজার কোটি টাকার বোঝা সাধারণ মানুষের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে সরকার–বেশির ভাগ মানুষ ঘাড় নিচু করে আছে, ট্রেনে লজেন্স ফেরি করছে, বর্ডারে নুন পাচার করতে গিয়ে বি.এস এর হাতে চাঁদমারি হয়ে যাচ্ছে— কেন কাটবেন তিনি টিকিট? দু-আনার টিকিট দু’টাকায়। বড় পিসে তার পিছনে পিছনে আছেন। মেট্রো রেলের দরজা চলন্ত অবস্থায় খুলে গেলে মৃত্যু যখন অবধারিত বড় পিসে তাকে বাঁচান। তখন তাঁর ছদ্মবেশ ছিল আগের কালের জমিদারের মতো, ধুতি, পাঞ্জাবি, টিকোলো নাকের নীচে ঢেউ তোলা গোফ। তারপর ক্লান্ত শ্যামলবাবুকে বউবাজারে পিচ্ছিল রাস্তায় উঠতে হয় এক রিকশায়। রিকশাওয়ালা তাঁকে যেন বাঁচাল। তার আর সন্দেহ থাকে না রিকশাওয়ালাই বড় পিসে। এই ফ্যান্টাসি চলতে থাকে। বড় পিসে খারাপ মেয়ের হাত থেকে বাঁচাতে লোডশেডিং করে দেন, শেষ অবধি আশ্চর্য কিংবদন্তী ভেঙেচুরে যায় যখন পথের কচুরি বেচা, ভুট্টা বেচা দরিদ্র স্ত্রীলোকদের বাঁচাতে তিনি থানায় যান। বড় পিসে সঙ্গে আছে ভয় কী? তিনি গিয়ে পড়েন যার হাতে টাইগার নামের সেই আসামী পেটানো ডাণ্ডাবাজ লোকটির মস্ত চেহারা দেখে, পায়ের নখ দেখে, আঙুল দেখে তিনিই যে বড় পিসে সে বিষয়ে আর কোনো সন্দেহই থাকে না। সেই টাইগার তাকে প্রহার করতে আরম্ভ করে। যাবতীয় কল্পনা, বিভ্রম চূর্ণ হয়ে যেতে থাকে যখন বড় পিসের মত মানুষটি তাঁর উপর নির্দয় অত্যাচার আরম্ভ করে। রীতিমতো পুলিশি অত্যাচার নেমে আসে পুলিশের অনৈতিক এবং নিষ্ঠুর আচরণের প্রতিবাদ করতে যাওয়ায়। লেখক যে কল্পনা, বিভ্রমের মায়াবী আলোয় ঢেকে দিয়েছিলেন দেড়শো বছরের পুরনো বড় পিসেকে, তা নিজেই শেষ করে দেন। যাদুকর যাদু শেষ করে দাঁড়াল যে শূন্য মঞ্চে। নিরুপায় মানুষের কথা কত রকম ভাবে বলা যায়। এ-ও এক ধরণ। শ্যামলবাবুর নিজস্ব ধরণ।

 শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্প, উপন্যাসে বাস্তবতা বিভ্রম, কল্পনা পাশাপাশি থেকে মিলে মিশে গেছে। কোনটা বাস্তব কোনটা মায়া তা যেন ধরাই যায় না। আবার কল্পনা, মায়া, বিভ্রমই মূল বাস্তবতা হয়ে দাঁড়ায়। এক নিরুপায় প্রাণকে নানাভাবে দেখে নেওয়ার প্রবণতা তাঁর সব লেখায়। তা “সে” নামের গল্পটিতে যেমন তেমনি শাহজাদা দারাশুকোর মতো ভারত ইতিহাসের সেই আশ্চর্য মানুষটির হৃদয় উন্মোচনেও। আবার শ্যামলবাবুর নিরুপায় প্রাণ যে শুধু মানুষ তাই বা বলি কী করে? বাঘডাঁশাটি কি নিরুপায় নয়? সে অন্ধকার হলে গোপনে বেরিয়ে আসে গর্ত থেকে। “সে” গল্পের কথা তো বললামই। ওই নিরুপায় মানুষটি তো বেঁচে থাকার নানা কৌশল খুঁজে বের করতে করতে বাঁচে। শেষ পর্যন্ত বাঁচতে কী আর পারে? রাখাল কড়াই-এর পোড়ো গায়েনের নাতিপুতিরা বুড়ো তেঁতুলগাছ নিয়ে বাঁচে। হাজরা নস্কর গরুর সঙ্গে খাবার ভাগ করে বাঁচে। পচা ইলিশ ফেলে দিতে দিতে গাঙের ভিতরে কোনো রকমে বেঁচে থাকতে চায় হাজরা হালদার। আবার বাঁচতে পারেনাও কেউ কেউ। ঈশ্বরীতলার হুলোবেড়াল, পাতিহাঁস, গাঙের ইলিশ। আর বালির ঝড়ে দশ লক্ষ বছর আগে বিলুপ্ত হওয়া অতিকায় ডায়নোসর। কিন্তু সেই অতিকায় প্রাণী আবার তার জীবন কণিকা রেখে যায় আর এক প্রাণে, তা বহন করে যায় নানা প্রাণী, বাঘডাঁশাও বহন করে উত্তরাধিকার সূত্রেই হয়ত।

শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে অনেকভাবে দেখা যায়। আমি এই মুহূর্তে তাঁকে এই ভাবে দেখছি। নিরুপায় জীবন, নিষ্ঠুর জীবন, ব্যাপ্ত জীবনকে প্রকৃতির ভিতর থেকে তুলে নিয়ে আসতেন তিনি। মনে পড়ে যাচ্ছে “সে” গল্পের বড় পিসের ছেলে মোহিনী দাদাকে, যে কিনা একা খুলনা পর্যন্ত সমস্ত রাত্রি হেঁটে চলে যেত নামগান করতে করতে। সে ছিল কথক ঠাকুর। দেশভাগের পর এপারে এসে ঘুমতে না পেরে গরুর দড়ি ধরে যাত্রা করেছিল পূর্ব বাংলার পথে। তারপর খরাদীর্ণ পুকুরপাড়ে গরুর সঙ্গে মরেছিল সেই কথক ঠাকুর। মনে পড়ে যাচ্ছে “সাক্ষী ডুমুর গাছ” নামের সেই তিক্ত জীবনের গল্পটিকে। শ্যামলবাবুর শিকড় ছিল মাটির অনেক গভীরে, মাথা ছিল আকাশে। ঠিক যেন সেই পুরনো তলগাছটির মতো। বিষয় আশয় তাঁর কম ছিল না। কুবের সাধুখাঁ তো তিনি নিজে। এই বিষয় আশয়ের স্বাদ আমাদের সাহিত্যে নতুন না হলেও, দেখাটা সম্পূর্ণ নতুন, দেখার ভঙ্গিও। এই নতুনত্বের সজীবতাই তার লেখা আলাদা করে দিয়েছিল সকলের থেকে, তা গল্প হোক, উপন্যাস হোক, বাজার সফরের মতো কেনাবেচার কথা হোক।

যে লেখক তার সমস্ত জীবন ধরে নিরুপায় প্রাণের কথা বলে গেছেন, তাঁর শেষ বছরটি বড় নিরুপায় হয়ে কেটেছিল। যেন বড় গাঙ-সমুদ্রে বিকল হয়ে ভাসা ভুটভুটিতে পচা ইলিশ নিয়ে হাজরা হালদার।

আচমকা আমার মনে হয় সেই পুরনো তেঁতুলগাছটিকে যেন বাণ মেরে দিয়েছিল প্রতিবেশী। পোড়ো গায়েনের নাতিপুতিদের কোনো শরিক। হতেই পারে, এমন বিশ্বাস নিয়েই তো পোড়ো গায়েনেরা বেঁচে থাকে। তাদের অগোচরে গাছটির গোড়ায় কেউ হয়ত ঢেলে দিয়েছিল বিষতেল। শেকড় শুকিয়ে গেল। শ্যামলবাবুকে দেখে তেমন মনে হতো। মানুষ বড় নিরুপায়। মানুষ সর্দি কাশির ঠিক ওষুধটা খুঁজে বের করতে পারেনি আর কিনা ক্লোনিং করে নতুন মানুষ তৈরি করতে যাচ্ছে। মানুষ বড় অসহায় তা যেমন শ্যামলবাবুর যে কোনো লেখা পড়লে টের পাওয়া যায়, তেমনি অনুভব করেছি ২০০০ সালের অক্টোবর থেকে ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত।

শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে আমার দূর নক্ষত্রের মানুষ বলে মনে হয়। মনে হয় সিন্ধু সভ্যতার কেউ। পুরুষপুর, গান্ধারে বসে তিনি যেন নির্মাণ করেছিলেন সভ্যতার এক মহৎ পর্ব। তাঁর লেখার ভিতরে যে আদিমতা তাতে যেন ছায়ায় ঢেকে যাওয়া সেই পৃথিবীর মানুষ বলেই মনে হয় আমার। এ শুধুই মনে হওয়া। শুধুই কল্পনা করা। আর কিছুই নয় হয়ত। কিন্তু এও সত্য, তাঁর গল্প উপন্যাসের চরিত্রগুলি সময় থেকে সময়ান্তরে হেঁটে বেড়ায়। প্রগাঢ় ইতিহাসবোধ, ঐতিহ্যচেতনা শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে আর পাঁচজনের থেকে আলাদা করে দিয়েছে। “গঙ্গা একটি নদীর নাম” উপন্যাসে চাঁদ হোসিয়ারির মালিক চাঁদ মহম্মদের ছেলে তাজ মহম্মদ রূপনারায়ণের কূলে বসেই যেন জেগে ওঠে পাঁচশো বছর আগের পৃথিবীতে, তার সঙ্গে দেখা হয় মনসামঙ্গল কাব্যের লেখক কবি বিপ্রদাস পিপলাই, ওলন্দাজ সার্ভেয়র ফান ডেন ব্রেক, পর্তুগীজ সার্ভেয়র জ্যাও দ্য বারোজ-এর সঙ্গে। কেউই কোনো সময়ে থেমে নেই। বিপ্রদাস মনসামঙ্গল লেখেন ১৪৯৫-এ, তখন নবদ্বীপে নিমাই পণ্ডিতের বয়স মাত্র দশ। ফান ডেন ব্রেক এদেশে আসেন ১৬৩০-এ, আর জ্যাও দ্য বারোজ ১৫৫০-এ, সবাই বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষায় কথা বলে তাজ মহম্মদের সঙ্গে। তারপর তিন সময়ের তিন মানুষ তর্কে বসে আদি সপ্তগ্রাম, সরস্বতী নদীর প্রবাহ, ফাহিয়েনের বিবরণ-আমাদের নদ-নদীর ইতিহাস নিয়ে। সে এক আশ্চর্য লিখন। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে তাহলে সিন্ধুতীরে হেঁটে যেতে দেখবে না কেন তাঁর এই মুগ্ধ পাঠক। তিনিই যেতে পারতেন একই সঙ্গে ১৪৯৫, ১৫৫০, ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব দু’হাজার বছর আগের, তারও আগের পৃথিবীতে। গেছেনও সেই পথে হয়ত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *