শরৎচন্দ্র

শরৎচন্দ্র

বঙ্কিমচন্দ্রের পর শরতবাবুই দ্বিতীয়জন যিনি আমাদের ভাষার উপন্যাসকে মর্যাদা পূর্ণ জায়গায় পৌঁছে দিয়েছিলেন। তারপরে বাংলা উপন্যাস তার লিখনের শৈলী খুঁজে পেল। বড় বড় ঔপন্যাসিকরা এলেন। শরৎচন্দ্র সাহিত্যের যে সত্যকে বিশ্বাস করতেন, তা ছিল অতি আধুনিক। সময় থেকে এগিয়ে। আমি তাঁর উপন্যাসের পাঠক, গল্পের পাঠক, এ কিছু নতুন কথা নয়। ভারতে যতগুলি ভাষা আছে সব ভাষায় তিনি অনূদিত। ভারতের মানুষ জানে না শরৎচন্দ্র তাদের ভাষা, হিন্দি, গুজরাতি, মৈথিলি বা তেলেগু, তামিলের লেখক নন। তিনি এতই পঠিত নানা ভাষায়, নানা ভাষার মানুষ বিশ্বাসই যেন করে না শ্রীকান্ত তাদের জীবনের তাদের ভাষার উপন্যাস নয়। বিশ্বজনীনতা একে বলে। যে কারণে আমি হেমিংওয়ের ‘ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’ পড়ে দূরের মনে করি না, সেই কারণেই শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত, পল্লী সমাজ, চরিত্রহীন, মহেশ, অভাগীর স্বর্গ সমগ্র ভারতীয় সমাজের লেখা হয়ে ওঠে। শরৎচন্দ্র তাঁর সাহিত্যে আর্ট ও দুর্নীতি প্রবন্ধে লিখছেন, “মানুষ তার সংস্কার ভাব নিয়েই ত মানুষ; এবং এই সংস্কার ও ভাব নিয়েই প্রধানত নবীন সাহিত্য-সেবীর সহিত প্রাচীনপন্থীর সংঘর্ষ বেধে গেছে। সংস্কার ও ভাবের বিরুদ্ধে সৌন্দর্য সৃষ্টি করা যায় না, তাই নিন্দা ও কটু বাক্যের সূত্রপাতও হয়েছে এইখানে। একটা দৃষ্টান্ত দিয়ে বলি। বিধবা বিবাহ মন্দ, হিন্দুর ইহা মজ্জাগত সংস্কার। গল্প ও উপন্যাসের মধ্যে বিধবা নায়িকার পুনর্বিবাহ দিয়ে কোনও সাহিত্যিকের সাধ্য নাই, নিষ্ঠাবান হিন্দুর চক্ষে সৌন্দর্য সৃষ্টি করবার। পড়বামাত্র মন তাঁর তিক্ত-বিষাক্ত হয়ে উঠবে। গ্রন্থের অন্যান্য সমস্ত গুণই তাঁর কাছে ব্যর্থ হয়ে যাবে…।” তিনি বলছেন বিদ্যাসাগর মহাশয় বিধবা বিবাহ বিধিবদ্ধ যখন করেছিলেন, সমাজ তাকে নেয়নি। হিন্দুর মনের ভিতরে তা প্রবেশ করেনি। অনেক গ্লানি এবং নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছিল বিদ্যাসাগরকে। কিন্তু সেই সময়ের কোনো সাহিত্য-সেবী বিদ্যাসাগরের পক্ষ অবলম্বন করেননি। হয়ত তাঁরা বিধবা বিবাহর পক্ষে ছিলেন না, কিংবা তাঁদের ভয় ছিল, পাঠক নেবে না। সমাজ-রুচির বিরুদ্ধে যাওয়ার সাধ্য হয়নি তাঁদের। ফলে এতবড় ঘটনা সামাজিকভাবে মূল্য পেল না, সাহিত্যের ভিতর দিয়ে তা গৃহস্তের অন্তঃপুরে প্রবেশ করল না। ভাবতে পারল না অন্তঃপুর। কিন্তু তাঁরা যদি উদাসীন না থাকতেন, তাঁদের সাহিত্যের কারণে নিন্দা গ্লানি তাঁদেরও সহ্য করতে হতো সত্য, পাঠকের কাছে সৌন্দর্য তখন সৃষ্টি হত না, কদর্য হতো, কিন্তু ৫০ বছর বাদের সেই কদর্যতাই হয়ে উঠত সৌন্দর্যময়। সাহিত্যের সেই রূপে মুগ্ধ হতো ভবিষ্যতের পাঠক। শরৎচন্দ্র বলছেন, “এমনই তো হয়, সাহিত্য সাধনায় নবীন সাহিত্যিকের এই ত সব চেয়ে বড় সান্ত্বনা। সে জানে আজকের লাঞ্ছনাটাই জীবনে তার একমাত্র এবং সবটুকু নয়; অনাগতের মধ্যে তারও দিন আছে; হউক সে শতবর্ষ পরে কিন্তু সেদিনের ব্যাকুল, ব্যথিত নর-নারী শত লক্ষ হাত বাড়িয়ে আজকের দেওয়া তার সমস্ত কালি মুছে দেবে।”

সাহিত্য নিয়ে এই আশ্চর্য ব্যাখ্যা যে কোনো নবীন লেখককে নতুন পথে যাওয়ার সাহস জোগাবে। আমাকে জুগিয়েছিল। পেরেছি কি পারিনি সে প্রশ্ন অবান্তর কিন্তু শরতবাবুর এই পথকেই সাহিত্যের পথ বলে মেনে নিয়েছি অবনত মস্তকে। কেমন সে পথ, শ্রীকান্ত উপন্যাসের অন্নদাদির কথা ভাবুন। ছিলেন নিষ্ঠাবান হিন্দু ঘরের কন্যা। দুই বোনের বড়টি বিধবা। ছোট, অন্নদার সঙ্গে আশ্রিত যুবকের বিবাহ হলো। একদিন আশ্রিত যুবক, অন্নদার স্বামী তার বিধবা দিদিকে হত্যা করে নিরুদ্দেশ হয়। কেন হত্যা, তা বলেননি অন্নদা। অনেকদিন পরে স্বামী আসে সাপুড়ের বেশে। তার সঙ্গে পালায় অন্নদা, ভালোবাসা ছিল। স্বামী তখন মুসলমান। তাতে কী হয়েছে, নিজের ধর্ম না ত্যাগ করে অন্নদা শাহজীর সঙ্গে গঙ্গার তীরে জীবন কাটিয়ে তো দিল। স্বামী শাহজীর মৃত্যুর পর কবর দিয়ে অন্নদা শাঁখা নোয়া ত্যাগ করে, সিঁথির সিঁদুর মুছে দেয়। ভাবুন এক সঙ্গে স্বামী স্ত্রী হয়ে বাস করছে, একজন হিন্দু, আর একজন মুসলমান। শরতচন্দ্র একশো বছর আগে যা ভেবেছিলেন, ভাবতে পেরেছিলেন, তা আমরা এখন কি ভাবতে পারি। ধর্মে ধর্মে কী বিদ্বেষ! হ্যাঁ, প্রায় এই রকম এক ঘটনা আমি শুনেছি বাংলাদেশের এক পরিবারে। স্বামী কনিষ্ঠা কন্যাকে নিয়ে ইসলাম কবুল করেছেন। স্ত্রী এবং জ্যেষ্ঠা কন্যা হিন্দুই রয়ে গেল। স্বামী মারা গেলে ইসলাম মতে জানাজা কবর ইত্যাদি সম্পন্ন হয়। স্ত্রী শাঁখা সিঁদুর ত্যাগ করে যথাবিহিত শ্রাদ্ধের কাজ করেন। অসামান্য এই জীবন। সমাজের পুঞ্জীভূত অন্ধকার এবং আর্ট, দুইয়ের ভিতরে শরতবাবুর আশ্চর্য যাতায়াত। সমাজের কথা লিখতে গিয়ে শিল্পের দিক অবহেলিত হয়নি বলে এত বছর ধরে তাঁর অনুরাগীর সংখ্যা কমেনি, বেড়ে গেছে। বেড়েই গেছে। ক্রমশ বেড়েছে কারণ তাঁর অনেক কথাই সমকালের থেকে এগিয়ে ছিল, আজ যা পড়ে মুগ্ধ হচ্ছি, অন্নদাদির কথা যেমন, তখন নিশ্চয় তত মুগ্ধতা ছিল না। নভেল পড়লে যে ছেলে গোল্লায় যায় এই কথাটি বাল্যকালে শুনেছি খুব। এখন অন্নদাদির কথা যত ভাবি, মুগ্ধতা যায় না। এই রকম স্রোতের বিপক্ষেই যাওয়াই তাঁর উপন্যাস, পল্লী সমাজ, চরিত্রহীন, গৃহদাহ আর শ্রীকান্ত তো নিশ্চয়ই। আমি ভাগলপুরে সেই গঙ্গা, সেই বট যার ঝুরি ধরে ইন্দ্র বিপুল জলোচ্ছ্বাসে ভরা গঙ্গায় নেমে গিয়েছিল, তা দেখেছি। তখন বাংলা উপন্যাসে ভারতবর্ষ আসত। শরতচন্দ্রের পর দুই বিভূতিভূষণ, সতীনাথ ভাদুড়ী, সকলের লেখায় তা ছিল। পরে তা অনেকটা হয়ে যায় ড্রয়িংরুম নভেল, কিন্তু শরতচন্দ্রের দেবদাস তার মুখ। ব্যতিক্রম তো নিশ্চয় আছে। দেশ, গ্রাম, সমাজ সব নিয়ে ব্যতিক্রম আছে। বড় বড় ঔপন্যাসিক পেয়েছি আমরা যাদের লেখায় মহাপৃথিবী ধরা পড়েছে।

এবার অন্য একটি প্রসঙ্গে আসি, আর্ট, শিল্প। শরৎবাবু আর্ট বলতেই স্বচ্ছন্দ ছিলেন। শ্রীকান্ত উপন্যাসে পিয়ারী বাঈ হারিয়ে গেল শ্রীকান্তর জীবন থেকে। চিঠি দিয়ে উত্তর আসে, তার ভিতরে পাটনায় পিয়ারীর বাড়ি যাওয়ার আমন্ত্রণ ছিল না। পিয়ারীর স্মৃতি মলিন হয়ে আসে। তারপর এক সন্ধ্যায়, সেদিন ছিল দোল পূর্ণিমা, খোলা জানালার বাইরে পূর্ণ চন্দ্র, জ্যোৎস্না। চন্দ্রাহত হয়ে শ্রীকান্ত আচমকা বেরিয়ে পড়ে পাটনার টিকিট কেটে রেলগাড়িতে চেপে বসে। পিয়ারীকে মনে পড়েছে যে। কিন্তু নেমে পড়ল পাটনার আগে ‘বাড়’ স্টেশনে। পকেটে দুয়ানি আর দশ পয়সা। সেখানে দেখা বর্ধমানের মেয়ের সঙ্গে, বিয়ে হয়েছে এতদূরে। তার দিদিরও বিয়ে হয়েছিল এখানে। ক’দিন আগে গলায় দড়ি দিয়েছে। বাবার নাম গৌরী তেওয়ারি, নিবাস রাজপুর, বর্ধমান। তাদের বর বর্ধমানে পাওয়া যায় না, তাই এত দূরে বিয়ে দিয়ে মা বাবা খালাস। খোঁজ নেয় না। দরিদ্র ঘরের মেয়ের এমনই হয়। এই মেয়েও মার খায় শ্বশুরবাড়ি। শ্রীকান্ত একটি চিঠি লিখে দেয় গৌরী তেওয়ারিকে। মেয়ের মৃত্যু সংবাদ দিয়ে, আর এক মেয়ের কষ্টের কথা লিখে। কী হয়েছিল জানে না। কিন্তু সনাতন হিন্দু সমাজের রীতিনীতি নিয়ে তিনি যে প্রশ্ন তুলেছেন এখানে তা আজও প্রাসঙ্গিক। কেবল মাত্র টিকে থাকার ভিতরে কি জীবনের সার্থকতা। এই সব আচার বিচার নাকি হিন্দু ধর্মকে টিকিয়ে রেখেছে। একশো বছর আগের কথা আর এই সময়ের কথা কি আলাদা? এতে কি আর্ট ক্ষুন্ন হয়েছে? শরৎচন্দ্রের উপন্যাস রচনার একশো বছর পার হয়েছে ২০১৭-তে। গ্রন্থাকারে শ্রীকান্ত উপন্যাসের প্রকাশকাল ১৯১৭।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *