পৃথিবীর পাঠশালায়

পৃথিবীর পাঠশালায়

যে সময়ে আমি ১৭-১৮, সেই সময়ে পশ্চিমবঙ্গে নক্সালবাড়ির গণ অভ্যুত্থান হয়ে গেছে। আমার বন্ধুরা কেউ কেউ ঘর ছেড়েছে। সোভিয়েত রাশিয়াকে তখন সোভিয়েত সাম্রাজ্যবাদ নামে যথেচ্ছ গালাগালি দেওয়া হতো। দেওয়ালে দেওয়ালে লেখা হতো চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান। কত সব শ্লোগান লেখা হতো, উচ্চারিত হতো, একটি ছিল আমার খুব পছন্দের, “গ্রামে গ্রামে ডাক পাঠাও, জোট বাঁধো তৈরি হও।” সেই ১৭ থেকে ২২-২৩ বছর বয়স ছিল ভয়ের সময়। পুলিশী সন্ত্রাস নেমে এসেছিল সেই সব বিপ্লবীদের শেষ করে দিতে। দুই প্রতিভাবান কবি, বিপ্লবী কবি তিমিরবরণ সিংহ এবং দ্রোণাচার্য ঘোষের মৃত্যু হয়েছিল পুলিশের হাতেই। জেলখানায়। সরোজ দত্তের নিহত হওয়ার কথা নতুন করে বলার নয়।

আমি রাজনীতি করিনি কোনোদিনই। রাজনীতির লোকদের থেকে দূরে থাকতে চেয়েছি বেশিরভাগ সময়। আমার মনে হয়েছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁরা যা বোঝেন, তা আর কেউ বোঝে না। মফস্বলের কেন শহরের রাজনীতিকের কাছে কত যে শুনতে হয়েছে, কী পড়ব, কী লিখব নিয়ে কত কথা। কিন্তু এর মানে যে এইটাই সব তা নয়। বহরমপুর থেকে প্রকাশিত হতো ‘অনীক’। ‘অনীক’ পুরোপুরিই বিপ্লবী সাহিত্যের পত্রিকা। সম্পাদক অধ্যাপক দীপঙ্কর চক্রবর্তী বিপ্লবী রাজনীতি করতেন। জেলও খেটেছিলেন অনেকদিন। তিনি ছিলেন আমার প্রিয় সম্পাদক। পরম শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। কোনোদিন জোর খাটাতে চাননি। ৩০ বছরে একবারই আমার গল্প তাঁর পছন্দ হয়নি। আর তিনি আমার এমন গল্প ছেপেছেন যে তার জন্য তাঁকে জবাবদিহি করতে হয়েছে। নিন্দিত হয়েছেন। পরে প্রমাণিত হয়েছে তিনিই ঠিক। আমার একটি উপন্যাস “নিরুদ্দিষ্টের উপাখ্যান” তিনিই ছেপেছিলেন। চটকল শ্রমিক ভিখারি পাশোয়ানের অন্তর্ধান নিয়ে সেই আখ্যান। হ্যাঁ, পুলিশ তাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। ১৯৯৭-৯৮ এর ঘটনা। দীপঙ্কর চক্রবর্তী, রতন খাসনবিশ বা অনুষ্টুপ সম্পাদক অনিল আচার্য ব্যতিক্রমী মানুষ। এই সব কথা বলা ১৯১৭-র রুশ বিপ্লবের শতবর্ষ নিয়ে কথা বলতে বসে। আমি রাজনীতির মানুষ নই। আমি প্রকৃতিগত ভাবে প্রশ্ন করতে ভালবাসি। রাজনীতি চায় প্রশ্নহীন আনুগত্য। রাজনীতি না করলে কী হবে, ছোটবেলা থেকে রুশ বিপ্লব, চৈনিক বিপ্লব নিয়ে বেড়ে তো উঠেছি। লেখা নিয়ে যাঁদের কাছে গিয়েছি, সেই দেবেশ রায় বা দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তো রাজনীতিরই মানুষ। কিন্তু লেখক হিসেবে অনন্য। অসীম রায়ের গল্পে আমি সেই বয়সে মুগ্ধ। তাঁর গল্প বা উপন্যাস একটুও রাজনীতি বিবর্জিত নয়। অনি, ধোঁয়া ধুলো নক্ষত্র, শ্রেণী শত্রু, অসংলগ্ন কাব্য – আমার প্রিয়পাঠ হয়ে উঠেছিল সেই সময়। সেই সময়ে, ১৯৭৫ সালে আমি “পরিচয়” পত্রিকায় প্রথম গল্প লিখি, শকুন্তলার জন্ম। সম্পাদক দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৭৬-এর পুজোয় “পরিচয়” পত্রিকার শারদীয়তে প্রথম গল্প লিখি “রাজকাহিনি”। সেই বছরই সমরেশ বসু বহুদিন বাদে শারদীয় পরিচয়-এ গল্প লেখেন। দীপেন্দ্রনাথের সম্পাদনায় পরিচয় খুব উচ্চমানে উঠেছিল। পরবর্তীকালে দেবেশ রায় বা অমিতাভ দাশগুপ্ত-র সম্পাদনায়ও। কম বয়স। সেই সময়ে এক অখ্যাত তরুণের পরিচয় পত্রিকায় লিখতে পারা ছিল খুবই গর্বের। ১৯৭৬ সালে পরিচয় পত্রিকা বের করে অসামান্য এক ফ্যাসিবিরোধী সংখ্যা। সেই সংখ্যার প্রুফ দেখতেন দীপেন্দ্রনাথ, আমি কপি ধরতাম। ৮৯ নং মহাত্মা গান্ধী রোডে। সারা দুপুর কেটে যেত। আমি তখন চাকরি সূত্রে থাকতাম মেদিনীপুরের পশ্চিমে গোপীবল্লভপুর থানার অন্তর্গত বংশীধরপুর নামে এক গ্রামে। জরিপের কানুনগো। ছুটি নিয়ে কিংবা লুকিয়ে কলকাতায় চলে এসে সাতদিন-দশদিন, তারপর ফিরে একমাস বাদে আবার দশদিন বাড়িতে। ক্যাম্প অফিসে আমিই তো হেড। যখন থাকতাম, রবিবারেও কাজ করে পালিয়ে আসা দিনগুলির কাজ উদ্ধার করে দিতাম। বহুদূর সেই অঞ্চল। বাসে ৭ ঘন্টার পর ১ ঘন্টা ৪৫ মিনিট পায়ে হেঁটে পৌঁছতে হতো। আদিবাসী অধ্যুষিত। আর নক্সালবাড়ি আন্দোলনে গোপীবল্লভপুর তখন সংবাদের শিরোনামে। সেই সময় সেই আন্দোলন শেষ করে দিয়েছে পুলিশ এবং সেন্ট্রাল রিজারভ পুলিশ। দীপেন্দ্রনাথ প্রুফ দেখতে দেখতে আমার কোনোদিন তলস্তয়, কোনোদিন দস্তয়েভস্কি, কোনোদিন আন্তন চেখভ নিয়ে আলাপ করতেন। কোনোদিন হয়তো গোপীবল্লভপুরে মানুষের বসতির ভাগ নিয়ে কথা জিজ্ঞেস করতেন। জমির মালিক আর ভাগ চাষীদের বাসস্থান যে আলাদা সেই কথা জিজ্ঞেস করে আমার জানাটিকে পরখ করে নিতেন। কোনোদিন বলতেন সোভিয়েত বিপ্লবের কথা। ১৯১৭-র মার্চ মাসে জার নিকোলাস-২ এর পতন এবং জনগণের সরকার গড়ে তোলা রুশ বিপ্লবের কথা। দুনিয়া কাঁপানো সেই দশদিনের কথা। ননী ভৌমিকের অনুবাদে বিখ্যাত সাংবাদিক জন রিডের লেখা দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন-আমাদের উদ্দীপ্ত করেছিল। জারের পতনের কাহিনি নিয়ে সেই বই কী উদ্দীপনাই না জাগিয়েছিল আমাদের রক্তের ভিতরে। এরপর ১৯১৮-র অক্টোবর-নভেম্বরে বলশেভিক-কমিউনিস্টদের শাসন ক্ষমতা অধিকার, পৃথিবীর প্রথম সাম্যবাদের প্রতিষ্ঠা, আমাদের রক্তের ভিতরে স্পন্দিত হতো নিশ্চিত। রাজনীতি করি আর না করি, তবুও। নানা জাতি-উপজাতি, নানা প্রদেশ যুক্ত করে সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা আমাদের কাছে ছিল গল্প কথার মতো। চারপাশের গ্রাম-নগর তখন দেখছি, বুঝতে পারছি সমাজে দুই দল মানুষ, কেউ খায় কেউ খায় না। তখন মানে সেই সত্তর দশকে সোভিয়েতকে চিহ্নিত করা হচ্ছিল সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ হিশেবে। আমি তো রুশ সাহিত্যের অনুরাগী। আমি দেবেশ, দীপেন, অসীম রায়ের অনুরাগী। তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা পড়ে, পরে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় পড়ে প্রান্তিক মানুষ, নিম্নবর্গের মানুষ চিনেছি। চিনেছি নিজের গ্রাম বাসেও। ভূমি সংস্কার বিভাগে চাকরির সুবাদেও। ফলে নিজের তো ছিল অসম্ভব রুশ সাহিত্য প্রীতি। তা হয়েছিল সেই ছোটবেলা থেকে। আমাদের বাড়িতে সোভিয়েত দেশ এবং রুশ দেশে প্রকাশিত রুশ সাহিত্যের অনুবাদ আসতই। আমি জানি সোভিয়েত রাশিয়ায় বিপ্লব না হলে রুশ সাহিত্য আমার কাছে অনেকটাই থেকে যেত অধরা। আমি যেটুকু লিখতে শিখেছি তার অনেক শিক্ষাই যে রুশ সাহিত্য আমাকে দিয়েছে। দীপেন্দ্রনাথ রুশ সাহিত্যের কথা বলতেন। রাজনীতির একটি কথাও না। তাঁর মাথার উপর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি। নিস্তব্ধ দুপুর, আমি পৃথিবীর পাঠশালায় বসে আছি যেন। দীপেন্দ্রনাথ, দেবেশ রায় বা অমিতাভ দাশগুপ্ত এবং পরিচয় পত্রিকা চিরদিনই সোভিয়েতে মুগ্ধ। আমি চিন বা সোভিয়েত কে ভাল বা কে মন্দ, অত বুঝতাম না। বোঝার তেমন আগ্রহ ছিল কি? আমার যাবতীয় আগ্রহ সাহিত্যে। লু-সুন পড়ে মুগ্ধ। ম্যাড ম্যান’স ডায়েরি, আ কিউ এর সত্য কাহিনি আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল সাহিত্যের মহত্ব কোথায়। আ কিউ এর গল্প নিয়ে অরুণ মুখোপাধ্যায় ‘জগন্নাথ’ নামের যে নাটক করেছিলেন, তা বার কয়েক দেখেছি। সত্তর দশকের আরম্ভে রাজরক্ত, চাক ভাঙা মধু, কলকাতার হ্যামলেট, এই সব নাটকে সাম্যবাদ ছায়া ফেলেছে। সাম্যবাদী দর্শন, নক্সালবাড়ি আন্দোলন বাংলা নাটককে প্রভাবিত করেছিল গভীর ভাবে। প্রসঙ্গে ফিরে আসি, আমি আমার শৈশব থেকে রুশ বই, প্রগতি প্রকাশন, রাদুগা প্রকাশন-এর বই পড়ে বড় হয়েছি। সোভিয়েত দেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট সরকার একটা দেশের সাহিত্য, লোককথা, উপকথা সব অনুবাদ করে দেশে দেশে পাঠাচ্ছে। সেই সব বইয়ের দাম খুব কম। এই কাজের জন্যই সে দেশের সরকারের কাছে বিশ্ববাসীর চির-ঋণী থাকা উচিত। আমি প্রথম পড়ি বড় সাইজের উক্রেনীয় লোককথার একটি বই। আমার তখন পাঁচ-ছয় হবে। দাদুর দস্তানা। অসামান্য রঙ আর ছবিতে ভরা সেই বইই বোধ হয় এই অনুবাদ কার্যক্রমের প্রথম বই। খুব সম্ভবত ১৯৫৫ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। বাংলা ভাষায়। অনুবাদ করেছিলেন শঙ্কর রায়। ২০ পৃষ্টার বইয়ের পাতায় পাতায় আশ্চর্য ছবি এঁকেছিলেন, ই.রাচেভ, প্রকাশনা: বৈদেশিক ভাষায় সাহিত্য প্রকাশালয় (মস্কো)। এখন সেই বই হয়তো কারোর সংগ্রহে আছে। আমার কাছে নেই। তখন নিম্নবিত্ত পরিবারের শিশুদের জন্য এই বই ছিল আকাশ থেকে নেমে আসা মন্ডা মিঠাইয়ের মতো। কত বই ছিল এমন ২০-২২ পাতার। বই পেতে দিতাম শানের মেঝেতে। ভাই বোনেরা একসঙ্গে পড়তাম। আর অন্য সময় বই আমার। একই ছবি কতবার যে দেখেছি। কল্পনাকে উসকে দিত সেই বই, দাদুর দস্তানা। বনের ভিতরে পড়ে থাকা দাদুর দস্তানায় নেংটি ইঁদুর থেকে ঘোঁত ঘোঁত করা বুনো শুয়োর অবধি আশ্রয় নিল শীতের হাত থেকে বাঁচতে, শেষে সেই দস্তানা ফেটেই গেল। গল্পটি আবছা মনে আছে। আরো কত বই ছিল, “মোরগছানা”র কথা মনে পড়ে। সেই সব বই শৈশবকে মধুর করেছিল। এ ছাড়াও “প্রথম শিকার”, আজেরবাইজানের গল্প, কত বইয়ের কথা মনে পড়ে। আমাদের বাড়িতেই ছিল তলস্তয়ের ‘দুই হুজার’, নিকোলাই গোগোলের উপন্যাস ‘তারাস বুলবা’। বড় হচ্ছি রুশ সাহিত্য পড়তে পড়তে। আন্তন চেখভের গল্প পড়লাম কোন বয়সে তা আর মনে নেই। কিন্তু ছোটগল্পকে বুঝতে শিখেছি চেখভ পড়ে। হ্যাঁ, গল্পগুচ্ছ কিংবা তিন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং প্রেমেন্দ্র মিত্রর গল্পও আমাকে ছোট গল্প লেখার পাঠ দিয়েছে। চেখভ আমাকে মোহিত করে রেখেছেন এত বছরেও। সেই কেরানির মৃত্যু, মুখোস, কুকুর সঙ্গী মহিলা, ছ’নম্বর ওয়ার্ড, কর্নেলের কুকুর, গুজবেরি…কত গল্প যে আজীবন মুগ্ধ করে রাখল। সাধারণ, অতি সাধারণ, বৈচিত্রহীন মানুষ নিয়ে কী আশ্চর্য সব গল্প। যখন ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি, নাটক নিয়ে মেতেছি। নিজে চেখভের মুখোস গল্পটি নাটকে রূপান্তরিত করলাম। সেই নাটক কতজনকে পড়ে শুনিয়েছি। প্রশংসা পেয়েছিলাম, কিন্তু মঞ্চস্থ করাতে পারিনি কোনো দল দিয়ে। এর পরে চেখভের নাটক দেখলাম অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মরণীয় অভিনয়ে। “মঞ্জরী আমের মঞ্জরী”। গোটা রুশদেশই যেন আন্তন চেখভ। কিন্তু তা যে নয়। এক সোভিয়েত রাশিয়ার ভিতরে নিকোলাই গোগোল, আলেকজান্ডার পুশকিন, লেভ তলস্তয়, ফিওদর দস্তয়েভস্কি, ম্যাক্সিম গোরকি, ইভান তুরগেনেভ, মিখাইল শলোখভ, এত সব মহৎ লেখক। মহৎ শিক্ষক, আমি যত পড়ি ততো ধন্য হয়ে যাই। গোগোলের ‘ওভারকোট’ গল্পেই তো আধুনিক ছোটগল্পের সূত্রপাত। ধীরে ধীরে পড়ছি রুশ সাহিত্য। আমার যেন সমগ্র বিশ্ব সাহিত্যই পড়া হয়ে যাচ্ছে। নিশ্চয় তা নয়, কিন্তু অনেকটা তো বটে। সোভিয়েত বইয়ের জন্যই আমি সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্র, রুশ বিপ্লবকে স্মরণ করছি। আসলে মানুষ তো শাদা কালো। ভালো মন্দতে মেশান। সে কমিউনিস্ট রাষ্ট্র হোক বা না হোক। ক্ষমতাই মানুষকে অন্ধকারে টেনে নিয়ে যায়। রাষ্ট্র শাসক তার ক্ষমতা ধরে রাখতে একনায়ক হয়ে ওঠে। সোভিয়েত ভেঙে যাওয়ার পরে এবং কিছু আগে এমন অনেক কথা শুনেছি যা আমাদের স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছিল। ইতিহাসের স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছিল। কিন্তু যে রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল ১৯১৭-১৮য়, তা সমগ্র বিশ্বকে স্বপ্ন দেখিয়েছিল। সেই স্বপ্নের ভাষা আমরা পড়তে পেরেছিলাম সোভিয়েত বইয়ে। আমি স্মরণ করছি ম্যাক্সিম গোরকির দুই অসামান্য আত্মকথা, আমার ছেলেবেলা এবং পৃথিবীর পাঠশালা। পৃথিবীর প্রকৃত পাঠশালাই হয়ে উঠেছিল সোভিয়েত রাশিয়া। তলস্তয় অনুবাদে পড়লাম, ইভান ইলিচের মৃত্যু, ক্রয়েটজার সোনাটা। পরে রেজারেকশন, আনা কারেনিনা। কিছু গল্প। দস্তয়েভস্কির ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট পড়ি অবশ্য বাংলাদেশের অনুবাদে। অনুবাদ করেছিলেন আকবরউদ্দিন। সেই সোভিয়েত অনুবাদে গ্যাম্বলার পড়লাম। অপমানিত ও লাঞ্ছিত। ফাদার সিয়েরগি ও অন্যান্য গল্প। আমরা যে বিপ্লবের কথা অহরহ পড়েছি, কল্পনা করেছি, সেই বিপ্লবী সাহিত্য তো এসব নয়, কিন্তু মানুষের আত্মার কথা। গোর্কির মাদার অবশ্যই বিপ্লবের আখ্যান, কিন্তু তাও তো ছকের বাইরে। নিজের মায়ের সঙ্গে মিল খুঁজে পেতাম কী করে সেই কিশোরবেলায়। আর গল্পগুলির কথা স্মরণ করুন, চেলকাশ। সমুদ্রতীরের এক সন্ধ্যার সেই গল্প। শীত থেকে বাঁচতে মানুষ মানুষী পরস্পরকে আঁকড়ে শরীরের তাপে তাপিত হচ্ছে। এই রকম একটি গল্পই লিখেছিলেন সমরেশ বসু, খুব সম্ভবত তার নাম, ‘উত্তাপ’। রাশিয়ার লেখকরা আমাদের লেখকদের প্রভাবিত করেছিলেন সত্য। শরৎচন্দ্রের গৃহদাহ উপন্যাস আনা কারেনিনা প্রভাবিত যে তা আন্দাজ করা যায়। পুশকিনের কবিতা, গল্প, ছোট উপন্যাস আমাকে তাড়িত করেছে। স্টেশনের ডাক বাবুর মেয়ের গল্পটি মনে আছে। এমন স্পন্দিত জীবনের গল্প বলেছে রুশ সাহিত্য যে তার তুলনা মেলা ভার। উপজাতি সর্দার এবং অভিজাত পরিবারের সেই রাজপুরুষকে নিয়ে উপন্যাসটি, ‘ক্যাপ্টেনের মেয়ে’ কী অসামান্য! এই ঐতিহাসিক উপন্যাস উপজাতি সর্দারের নেতৃত্বে এক গণ বিদ্রোহের পটভূমিতে ১৮৩৬ সালে লেখা। অভিজাত রাজপুরুষদের নিয়ে জারের শাসন আর উপজাতি সর্দারের বিদ্রোহ, সর্দারের সঙ্গে রাজপুরুষের সাক্ষাৎ, আমি ভুলতে পারিনি। এমনিতে রুশদেশের শীতকাল, তুষারাচ্ছন্ন প্রকৃতির আমি মুগ্ধ পাঠক। প্রকৃতি পাঠই যেন হয় পুশকিন তলস্তয় পড়তে পড়তে। অভিজাত পরিবারের যুবকটি যাচ্ছিল সেনাবাহিনিতে যোগ দিতে। উচ্চপদে তার নিয়োগ হয়েছে। তুষারাচ্ছন্ন প্রান্তরে সে পথ হারায়। তার ফিটন গাড়ি সমেত সে কোথায় চলে যাচ্ছিল জানে না। মারাই পড়ত ঘুরে ঘুরে, কিন্তু এক উপজাতি যুবক এসে তাঁকে বাঁচায়, নিয়ে যায় সরাইখানায়। বিনিময়ে একটি ভদকার বোতল আর শীত বস্ত্রে সে খুশি। হাত মিলিয়ে চলে যায়। সেই যুবকই উপজাতি সর্দার, পরে তার নেতৃত্বে বিদ্রোহ। উপজাতি সর্দার কিন্তু ভোলেনি সেনাবাহিনির তরুণ অফিসারকে। …আশ্চর্য এক কাহিনি। মনে পড়ে যায় শেষ অবধি বিদ্রোহ দমন হলো। ফাঁসিতে যাচ্ছে উপজাতি সর্দার যে কি না রাজপুরুষের গায়ে হাত দেয়নি যখন কয়েকটি এলাকা দখল করে নিয়েছিল। অনেক রাজপুরুষকে কোতল করেছিল কিন্তু এক বোতল ভদকা আর শীত বস্ত্রটির কথা ভোলেনি। ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় সে পুরোনো বন্ধুকে হাত নাড়ে। চিনতে পেরেছিল। এসব কিন্তু জারের আমলে লেখা সাহিত্য। কিন্তু তা ধরেছিল রাশিয়ার সমাজের অন্তরাত্মাকে। অভিজাত সম্প্রদায়ের কাহিনি কিন্তু বর্জন করা হয়নি। অনূদিত হয়ে আমাদের কাছে এসেছিল। আমরা বিপ্লবী সাহিত্য ব্যতীত অন্য কিছুকেই গ্রহণ করতে প্রস্তুত নই যদি সাম্যবাদে আস্থা থাকে। তাই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে হয়তো ইতিকথার পরের কথা লিখতে হয়। আর প্রাগৈতিহাসিক কিংবা দিবারাত্রির কাব্যকে বক্র দৃষ্টিতে দেখা হয়। বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর নিন্দিত হন যথেষ্ট বিপ্লবী নন বলে। বিভূতিভূষণ ভাববাদী, তারাশঙ্কর সামন্ততন্ত্রের জন্য হাহাকার করেছেন। ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট উপন্যাসের রাসকলনিকভকে কী ভাবে তাহলে গ্রহণ করব আমরা? সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। রাশিয়ান সাহিত্য তো সেই কথাই বলেছে। কমিউনিস্ট শাসকরা বুঝেছিলেন এই সব ঐশ্বর্যকে পৃথিবীর মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়ে দেশের গৌরব গাথা পাঠের সুযোগ করে দিতে হবে। ‘ইভান ইলিচের মৃত্যু’ নভেলা তো এক অভিজাত মানুষের পাপ স্বীকারের কাহিনি। খ্রিস্টীয় রীতিই যেন তলস্তয়ের লেখায় বারংবার উচ্চারিত। রেজারেকশনও তাই। কাউন্ট-বিচারক নিজের যৌবন কালের পাপ স্খালন করতে চলল সাইবেরিয়া। এই সব লেখা কমিউনিস্ট দেশ সমগ্র বিশ্বে পাঠিয়েছে অনুবাদ করে, এই দায়িত্ব কোনো রাষ্ট্র নেয় বলে জানা নেই। খুব সস্তায় বইগুলি হাতে পেতাম। অনুবাদ করতেন যাঁরা, তাঁরা অনেকেই বাংলাভাষার সৃষ্টিশীল লেখক। সমর সেন, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, ননী ভৌমিক, হায়াত মামুদ, অরুণ সোম যে অনুবাদ করেছেন মূল রুশ ভাষা থেকে, তা আমরা বাংলাভাষায় লেখা গ্রন্থের মতো করেই পড়েছি। সোভিয়েত দেশ থেকে প্রায় বিনামূল্যে বিতরণের জন্যই যেন বইগুলি আসত। প্রগতি প্রকাশন, রাদুগা প্রকাশন পরে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল লোকসানের ভার সহ্য করতে না পারায়। সেই বিপ্লবী দেশটাই তো নেই। প্রকাশন থাকবে কী করে? পুঁজিবাদী সমাজের কাছে তলস্তয়, দস্তয়েভস্কি কে? বিপ্লবী পার্টির সরকার যে যে কাজ করেছিল, তার ভিতরে এই কাজটিও ছিল অগ্রাধিকার নিয়েই। এই কাজ ছিল বিপ্লবের অন্তর্গত। ভাবতেই পারি না এই নগদ মূল্যের বিশ্ব মনে রেখেছে কি না সেই ঝকঝকে বইগুলির কথা। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যের প্রাধান প্রচারক ছিল কমিউনিস্ট সরকার। তাঁকে তুমি কত নিন্দা করবে? সব যে ধুয়ে যাবে পৃথিবীর সেই পাঠশালার কথা মনে করলে। গোগোলের ওভারকোট কিংবা চেখভের ছ’নম্বর ওয়ার্ড তো বাতিল করেননি তাঁরা যথেষ্ট বিপ্লবী সাহিত্য নয় বলে। কেরানির মৃত্যুকে ভীতু মধ্যবিত্ত, পাতি বুর্জোয়ার কাহিনি বলে ব্যঙ্গ করেননি তো। হ্যাঁ, সলঝেনিতসিনকে তাঁরা সমর্থন করেননি। সত্য। মায়কোভস্কি আত্মহত্যা করেছিলেন সত্য, কিন্তু দস্তয়েভস্কি পড়ে কেউ গোল্লায় যাবে না যে তা বুঝেছিলেন সোভিয়েত যুক্ত রাষ্ট্রের শাসকরা। বুঝেছিলেন, রাশিয়ার আসল ঐশ্বর্য এই সব চিরায়ত গল্প উপন্যাস। পুঁজিবাদি সমাজ ধনতন্তের কোনো দায় নেই ক্লাসিক পড়ানোর, বরং পাল্প লিটারেচর, যাবতীয় কুসাহিত্যের প্রচারক তারা। কিসে বাণিজ্য হবে তা ব্যতীত অন্য কোনো কিছুই ভাবতে পারেন না তাঁরা। সেই বইগুলির জন্য আমি শোকার্ত হই। সেই আশ্চর্য ছাপা আর ছবিতে ভরা দাদুর দস্তানা কিংবা মোরগ ছানা বই কি আর কি এই পৃথিবীর শিশুরা দেখতে পাবে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *