প্রদোষে প্রাকৃতজন

প্রদোষে প্রাকৃতজন

[শিরোনামটি ঔপন্যাসিক শওকত আলির উপন্যাসের। তাঁর প্রয়াণ হয়েছে কিছু মাস আগে। এপারের লেখক, অনুজ প্রতিম আফসার আমেদের প্রয়াণকথা লিখতে গিয়ে তাঁর উপন্যাসের শিরোনামগ্রহণ বাংলাভাষার এই বড় লেখককে স্মরণ করা। প্রয়াত শওকত আলিকে আমার প্রণাম।]

আফসার এল আচমকা। আসার কথা তো ছিল না। তখন ভোরের আলো ফুটছে, না তখন বেলা শেষ হয়ে যাচ্ছে বলতে পারব না। প্রদোষকালে আলো মরে যায় অমন। প্রত্যুষের আলো অত বিষণ্ণ হয় না। আমি কোথায় ছিলাম বলতে পারব না। সেখানে আরো অনেকে ছিল। পরিচিত অপরিচিত। তাদের অনেকেই চেনে আফসার আমেদকে। আবার চেনেও না। আমি আফসারকে দেখে উল্লসিত। আমিই দেখতে পেলাম আফসার আমেদ আসছে। ফ্যাকাশে নীল একটা শার্ট আর পুরনো টেরিকটনের প্যান্ট। পায়ে রবারের জুতো। কাঁধে ব্যাগ নেই। এমন হতে পারে সে বাংলা একাডেমির উপরতলা থেকে নেমে আসছিল। আবার হতে পারে বাংলা একাডেমি যাওয়ার পথে আমাকে দেখে দাঁড়াল। আমি কি ওই প্রাঙ্গণের বট অশ্বত্থ কিংবা অনামি কোনো গাছের নিচে বসে ফোনে আফসারকে ডেকেছিলাম? আমার অভ্যাস ছিল তেমন। তখন আমার চাকুরিস্থল আলিপুর ছিল। দরকারে অদরকারে আড্ডা দিতে আফসারের কাছে চলে আসতাম। মোবাইল ফোন যখন নিইনি, নিচের রিসেপসন থেকে ইন্টারকমে ফোন করতাম, বাইরে আছি। সে নেমে আসত। তখন সে চারতলায় বসত। বাংলা বই রিভিউ ম্যাগাজিনের দায়িত্বে ছিল। পরে সে নেমে আসে নিচের তলায়। তখন গিয়েই বলতাম বাইরে আছি, তোমার টিফিন হয়ে গেছে? টিফিন করতে পারি আমরা। আফসারকে একদিন, সে অনেকদিন বাদে দেখেছিলাম হাঁটতে গিয়ে বেঁকে যাচ্ছে। এ কী! তোমার কী হয়েছে আফসার।

ডাক্তার দেখাচ্ছি অমরদা, কিছু টেস্ট করতে হবে।

কিন্তু এই আফসার সেই আফসার নয়। বেশ সুস্থ। সেই গত জুলাইয়ের মাঝামাঝি আমাদের শেষ দেখা। বেলভিউ নার্সিংহোমে আমি, নলিনী, সমীরণ দাস গেলাম। আর এসেছিল সন্দীপ নট্ট। নাসিমার সঙ্গে দেখা বেলভিউয়ে। মুখখানি ম্লান। সারাদিন বসে আছে। ওর ছেলে শতাব্দর সঙ্গে দেখা। ১৪০০ বঙ্গাব্দে তার জন্ম, শতাব্দ নাম সেই কারণে। আফসারকে দেখেছিলাম খুব শীর্ণ হয়ে গেছে। সেদিন সারাদিন ধরে ওর পেটে জমা তরল নিষ্কাশন করা হয়েছিল, শতাব্দ বলল। কিন্তু আমাদের দেখে চোখমুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল। বেল ভিউয়ের খরচ কী করে চলবে? আমার সঙ্গে এক সন্ধ্যায় সমরেশ রায়ের কথা হয়েছিল। সমরেশদা বলেছিলেন, আফসার বেল ভিউ থেকেই ফোন করেছিল। বিপুল ব্যয় ভারের কথা সমরেশদা তুলতে আফসার বলেছিল, “বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে যে খুব।” খরচ সামলাতেই পিজিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানেই তার শেষের কদিন কেটেছিল। পিজি হাসপাতালে বড় ডাক্তারের অধীনেই ছিল। কিন্তু শরীর জীর্ণ হয়ে গিয়েছিল, দিন ফুরিয়ে এসেছিল। বেঁচে থাকার প্রবল তৃষ্ণা নিয়ে আফসার আমেদ, আমাদের যুগের বড় লেখক বিদায় নিয়েছে এই গ্রহ থেকে। এই গ্রহে কত ব্যবস্থা। প্যাকেজে কত ঝাঁ চকচকে চিকিৎসালয়ে চিকিৎসা হয়। চিকিৎসা খরচের ব্যবস্থা ছিল না তার। বেঁচে থাকার ব্যবস্থা ছিল না ষাটে পা দেওয়া এই প্রতিভাবান লেখকের। সেই ব্যবস্থা বহুদিন ধরেই ছিল না। যেখানে চাকরি ছিল, সেখানে প্রবল অসম্মান ছিল। সেই অসম্মানের সাক্ষীও হয়েছি আমি এক-দুবার। তার চাকরি পাকা ছিল না। অবসরের পর কিছুই পায়নি। অভাব তার সঙ্গী। লিখতে এসেছিল। লিখতে লিখতে চলে গেছে। আরো লেখা ছিল, সেই কারণেই বেঁচে থাকতে চেয়েছিল। সাহিত্য অকাদেমির কাছে আমার প্রস্তাব, পুরস্কৃত লেখকের চিকিৎসা-বীমা করে দিন। সঙ্গীত নাট্য অকাদেমির এই ব্যবস্থা আছে। সাহিত্য অকাদেমির কেন থাকবে না? তাহলে আফসারের চিকিৎসার সামান্য জমা টাকা, অকাদেমি পুরস্কারে পাওয়া টাকা সব চলে যেত না।

যেখানে আরম্ভ করেছিলাম, সেখানে ফিরে যাই। সেই প্রদোষ কালে। দেখতে পেলাম আফসার আসছে। সেই আগের আফসার। কৃষ্ণকায় সেই মধ্যবয়সী। আমার অনুজ। বসল আমার কয়েক হাত দূরে। সেখানে অন্যরা ছিল। কিন্তু আফসার আমেদের আসা না আসায় তাদের কিছু যায় আসে না। বলল, অমরদা, আপনাকে দেখতে পেলাম।

কেমন আছ আফসার? কথার কথা। কেমন আছে সে মাটির নিচে। এসব কথা জিজ্ঞেস করার কোনো মানে হয় না। বলল, আছি, অমরদা আপনার মনে আছে সব?

কী মনে থাকবে?

আফসার চুপ করে থাকল, বলল, আপনার সেই বাড়ি!

তোমার সেই গল্প আত্মপক্ষ?

ম্লান মুখে হাসল। হ্যাঁ, ঘুরে এসেছি। সব বদলে গেছে। চিনতে কষ্ট হয়েছে।

 আফসার একটি একটি গল্প লিখেছিল, ‘আত্মপক্ষ’। তার কথা বলি। আমাদের সেই গল্পের কথা আফসার তুলল। আফসারের বাড়ি বাগনান শহর থেকে ভিতরে, বাইনান গ্রামে। কলকাতার কাছে কোনো আশ্রয় ছিল না। আর আমি তো জন্ম থেকেই ভাড়াবাড়ির বাসিন্দা। আমরা কলকাতার কাছে সল্টলেক সংযুক্ত এলাকা, মহিষবাথান গ্রামে জমি কিনি একসঙ্গে। সামনে পিছনে, একই প্লট। আমি আগে বাড়ি করলাম। এবার আফসার আর আফসারের স্ত্রী নাসিমা গিয়ে উঠল আমার বাড়িতে। ওখানে থেকে নিজের বাড়ি করবে। কিন্তু সেখানে মসজিদের আজান শোনা যায় না। আত্মীয় স্বজন নেই কেউ। আর সেই ২০০২ সালে গুজরাত দাঙ্গাও ঘটে গিয়েছিল। নাসিমা বলল, বাগনানে ফিরে যাবে চেনা জায়গায়। আফসার চলে গেল। আমরা এক সঙ্গে থাকতে পারলাম না। আমিও নতুন বাড়ি প্রায় তৈরির মূল্যে বিক্রি করে দিলাম আফসার জমি বিক্রি করে দিতে। এরপর আফসার বারোমাস পত্রিকায় একটি গল্প লেখে আত্মপক্ষ। আমি পরের শারদীয়তে লিখি আফসারের গল্পের বিপরীতে একটি গল্প, হ্যাঁ বারোমাস পত্রিকাতেই। আফসারের গল্প অসম্ভব ভালো হয়েছিল। আত্মপক্ষ গল্পে বন্ধু অমরদার বাড়িতে পরিবার নিয়ে চলে আসে গল্প কথক। সেই মহিষবাথান, সংযুক্ত এলাকা। গল্প কথকের মনে হয়, তারা মুসলমান, হিন্দু এলাকায় বাড়ি করতে যাচ্ছে, ঠিক হবে কি? সহাবস্থানের ভিতরে যে প্রেম তাইই ছিল জমি কেনা সূত্র। অমরদার সঙ্গে সে জমি কিনেছে। ঠিক করেছে কি? বাগনানে আত্মীয়স্বজন সকলে থাকে, তাদের ছেড়ে একেবারে হিন্দু এলাকায় অমরদার নতুন করা বাড়িতে মুসলমান পরিবারটি থাকতে এসেছে। স্থানীয় মানুষ আসে, আলাপ করে, তারা সকলে হিন্দু। বউগুলিও হিন্দু। মুসলমান এখানে কেউ নেই। লেখক, কথকের বউ নাসিমা খাপ খাইয়ে নিতে পারবে কি? হিন্দু বন্ধুর পরিবার রেখে গেছে কালী ঠাকুরের ছবি, ধুপ-ধুনো, দেবীর গলার মালা শুকিয়ে গেছে। নাসিমা ওই ছবি, ধুপ ধুনো মালা নিয়ে কী করবে? সে তো হিন্দুত্বে বিশ্বাস করে না। ধর্মপ্রাণ মুসলমান নারী। কালী ঠাকুরের ছবি তার ঘরে রাখবে কী করে? সেই ছবি অন্যঘরে খাটের তলায় রেখে দিল। তাতে অনুতাপ হলো স্বামীর। ওঁদের পুজোর দেবী, তাঁকে অনাদরে রাখা কি ঠিক? কিন্তু নাসিমা যে চায় না তার সমুখে কালী ঠাকুরের ছবি থাকুক। নাসিমা যে রাখতে চায় না। আফসারের মনে হয় অমরদা বিষয়টি বুঝবেন। কিছু মনে করবেন না। সমস্যা তার বউ নাসিমার। গভীর রাতে নাসিমাই স্বামীকে জাগিয়ে তোলে, তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আগে এমন হয়নি কখনো। ঘুমতে পারছে না সে। পরদিনও সে অস্থির। তার অস্থিরতা যায় না। চোখে অকারণে জল আসছে। নতুন জায়গা বলে হয়তো। কিছুতেই খাপ খাওয়াতে পারছে না নাসিমা। ফজরের আজানে তার ঘুম ভাঙেনি, তাই মন খারাপ। অথচ তার দুই সন্তান কেমন মিশে যাচ্ছে প্রতিবেশি বাড়ির সমবয়সীদের সঙ্গে। নাসিমা অবশ্য সারাদিনে স্বাভাবিক হয়ে এল কিছুটা। তা দেখে নিশ্চিন্ত লেখক। কেন নাসিমার উদ্বেগ গেছে, সারাদিনে তার মনে হয়েছে গত সন্ধ্যায় যে সে কালী ঠাকুরকে খাটের তলায় চালান করেছিল, তার জন্য পাপ হতে পারে। অন্যের ঠাকুর দেবতাকে অনাদর করেছে বলেই রাতে সে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তখন সে দেবীকে তার নিজের জায়গায় ফিরিয়ে আনে। নিজে ঝেড়ে মুছে যথাস্থানে স্থাপন করে ধূপ জ্বালিয়ে দেয়। আফসার সেই মহিষবাথান থেকেই আসছে। আমি বললাম, আফসার আমাদের উপর তোমার অভিমান আছে? আমরা সেভাবে তোমার পাশে দাঁড়াতে পারিনি। কীভাবে দাঁড়াব তাও বুঝতে পারিনি। আমাদের কারোরই সেই সঙ্গতি নেই যা নিয়ে তোমার পাশে দাঁড়াতে পারি।

আফসার বলল, সব ভুলে গেছি অমরদা।

আমি চুপ করে থাকলাম।

আফসার বলল, হেরে গেছি অমরদা।

আমি মাথা নিচু করলাম। পরাজয় আমাদের তা বুঝতে পারছি।

 লেখাটুকু বাদ দিয়ে সারাজীবন শুধু হেরেই গেছি।

 আসল জায়গায় জিতেছ আফসার।

 যাতে না লিখতে পারি, তার ব্যবস্থা ছিল। কথাটা আফসার বলল, না আমার মনে হলো, তা আমি বলতে পারব না। আফসার বলেনি। সে ভুলে গেছে সব। কথাটা উড়ে এসেছে সন্ধ্যার নতুন অন্ধকার থেকে। আমার ভালোবাসার মানুষ, বহুদিনের সঙ্গী, প্রিয় লেখক বন্ধু হেরে গিয়েছে। অসুখ তাকে শেষ করে দিল। হ্যাঁ, প্রাকৃতজনের যাওয়া এমনই হয়। হায়!

***

‘সেই নিখোঁজ মানুষটা’ উপন্যাসের জন্য আফসার গত ডিসেম্বরে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পেয়েছিলে। সাত মাসের ভিতরে প্রয়াণ। কোনো সুখ স্বস্তি ওর জীবনে ছিল না। যে সরকারী প্রতিষ্ঠানে ২৪/২৫ বছর চাকরি করেছে তারা পাকা করেনি চাকরি। উদ্দিষ্ট পোস্টে অনভিজ্ঞ মানুষকে নেওয়া হয়েছে ওকে নেওয়া হয়নি। অবসরের কোনো সুবিধা পায়নি। দেখেছি ওকে প্রাপ্য মর্যাদা দেননি ছোটখাট সাংস্কৃতিক আমলা। বাংলা একাডেমি তাকে বঙ্কিম পুরস্কার দিয়েছিল। আফসার নিজ যোগ্যতায় তা পেয়েছিল। অনিরাপদ জীবন ছিল ওর সঙ্গে। ছিল ভয়ানক উদ্বেগ আর অর্থনৈতিক নিরাপত্তা হীনতা। আমি কত কথা শুনেছি ওর মুখে। খুব মৃদুভাষী ছিল। ও ভুলে যেতে পারে, আমি তো ভুলিনি। আমাদের দেশ, সমাজ, রাষ্ট্র একজন গুণী কথাশিল্পীকে রক্ষা করতে পারে না। তার পাশে দাঁড়ায় না।

আফসার আমেদ, সদ্য কৈশোর অতিক্রান্ত হাওড়া জেলার বাগনানবাসী এক যুবক বাঙালি মুসলমান সমাজের বিবাহের গান সংগ্রহ করে সুখ্যাত পরিচয় পত্রিকায় নিয়ে এসেছিলেন সম্পাদক দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে ১৯৭৮ সালে। সেই প্রবন্ধ পড়ে সম্পাদক অবাক। বিশ্বাসই হয় না, এই যুবক এমন গভীর ভাবে অনুধাবন করেছে বিয়ের গানের ভিতরের আনন্দ এবং অশ্রু। সেই লেখা থেকেই তরুণ লেখক আফসার আমেদ চোখে পড়েন লেখক অমলেন্দু চক্রবর্তী এবং দেবেশ রায়ের। নানা সাহিত্যপত্রে আফসারের আত্মপ্রকাশে এই দুই অগ্রজের স্নেহ জড়িয়ে আছে। আফসারের গল্প লেখা শুরু তখন। প্রথম প্রকাশিত গল্প জলস্রোতে জনস্রোতে। তারপর থেকে পরিচয়, কালান্তর, বারোমাস, প্রতিক্ষণ, সারস্বত ইত্যাদি সাহিত্য পত্রে নিয়মিত লিখতে শুরু করেন। তাঁর লেখায় এল প্রায় অচেনা বাঙালি মুসলমানের অত্মকথাই যেন। কী অপূর্ব তাঁর দেখা। আফসার আমেদ বিশিষ্ট হয়েছিল তার অন্তর্দৃষ্টির জন্য। কালান্তর শারদীয়তে আফসার তাঁর প্রথম উপন্যাস লেখে ১৯৮০ সালে, ঘরগেরস্তি। সাহিত্যের ভালো পাঠক ঘুরে তাকিয়েছিলেন এই নবীন লেখকের দিকে। এরপর প্রতিক্ষণ সাহিত্য পত্রে আফসার আমেদ যে উপন্যাস লেখে গত শতকের আটের দশকের মাঝামাঝি, ‘আত্মপরিচয়’ নামের সেই উপন্যাসেই বিস্মিত করে অনুসন্ধিৎসু পাঠককে। বাঙালি মুসলমান নারীর জীবন ছিল সেই অসামান্য আখ্যানে। ছিল বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয় উন্মোচনের এক নিদর্শন। এক ভয়ানক হত্যাকান্ডে শুরু সেই উপন্যাস। অন্ধকার রাত্রি। ধনী গৃহস্তের পুত্রবধূ হত হয়েছে। তার গোর কাটতে বসে আছে গ্রামের সবচেয়ে গরিব মানুষটি। আমি এখনো ভুলতে পারিনি সেই অংশগুলি। গোর কাটার মানুষটি হয়ে উঠেছিল প্রধান চরিত্র। আর মুসলমান নারীর অবস্থান ওই সমাজে যেমন তার অন্তর্ভেদী বিবরণ। আফসারের ওই উপন্যাস পড়ে মুসলমান কেন হিন্দু নারীর অসহায় অবস্থাও উপলব্ধ হয়। আফসার ওই ভাবে তার নিজস্ব গণ্ডীর বাইরে চলে যেতে পেরেছিল। তখন থেকে আফসার আমার পাঠ্য তালিকায়। এরপর আফসার ক্রমশ খ্যাতিমান হয়ে উঠতে থাকে। আলাপ হলো লাজুক একটি যুবকের সঙ্গে। সেই আলাপও বছর ৩৫। উদার মানবিকতা তার দর্শন। আর সমস্ত রকম ধর্মীয় কুসংস্কারের বিপক্ষে। আফসার আমাকে তার নিজের কথা বলত। সামান্য ছিল তাঁর জীবিকা। লেখার জন্য ত্যাগ করেছে। সাধনা করেছে। তাঁর লেখার পটভূমি বাগনান এবং তার আশপাশ। হ্যাঁ,আফসার আমেদ বাঙালি মুসলমান জীবনের বিশ্বস্ত চিত্রকর। হ্যাঁ, চিত্রময় তাঁর লেখা। ধানজ্যোৎস্না উপন্যাস পড়লে তা ধরা যায়। মনে হয় এক কবির লেখা উপন্যাস পড়ছি। যা কিছু সুন্দর, তার সঙ্গে কবিতার তুলনা করতে ভালবাসি আমরা। ধানজ্যোৎস্না উপন্যাসের কাহিনি নিয়ে ছবি করেছিলেন মৃণাল সেন। ছবির নাম, আমার ভুবন। এরপর খণ্ড বিখণ্ড, কলকাতার বই বাঁধাই করেন যাঁরা তাঁদের জীবন নিয়ে একটি উপন্যাস লেখেন আফসার। ‘অন্তঃপুর’ নামের উপন্যাসটি ছিল মুসলমান নারীর অন্তঃপুরের কথা। গত শতকের শেষদিকে আফসার আমেদের উপন্যাসে একটি বড় বাঁক আসে ‘বিবির মিথ্যা তালাক তালাকের বিবি এবং হলুদ পাখির কিসসা’ রচনার পর। মুসলমান বাঙালির জীবনে অনেক রকম রূপকথা, কিসসা, গুজব, কল্প-কাহিনি যা ছড়িয়ে ছিল পথের ধূলায় আফসার আমেদ যেন তা কুড়িয়ে আনতে থাকে। লেখকের এই অদ্ভুত যাত্রা ছিল বাংলা উপন্যাসের এক নতুন পথে। হ্যাঁ নিভৃতচারী লেখক সকলের অজান্তেই সেই কাজটি করে যেতে থাকে। আফসার আরম্ভ করে কিসসা সিরিজ রচনা। বিবির মিথ্যা তালাক…রচনার পর, কালো বোরখার বিবি কুসুমের গন্ধ ও চল্লিশজন লোক। তারপর আশ্চর্য বশীকরণ কিসসা, মেটিয়াবুরুজে কিসসা, একটি ঘোড়সওয়ার কিসসা, হিরে ও ভিখারিনি সুন্দরী রমণী কিসসা।এই উপন্যাসগুলিতে বাঙালি মুসলমান রমণীর সামাজিক অবস্থানের কথা আছে, আছে ধর্মীয় নিগড়ের কথা। তিন তালাক যে কত নিষ্টুর এক জীবন-চর্চা তা আফসারের লেখার ভিতরে নানা ভাবে এসেছে। প্রতিক্ষণ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘রক্তলজ্জা’ নামের একটি গল্পের কথা মনে পড়ছে, রক্তলজ্জা গল্পের ‘হাসান’ও ‘ফতিমা’কে ভুলিনি আমি। এই গল্প এক আশ্চর্য প্রেমের, যার সঙ্গে মিশে থাকে ধর্মীয় বিশ্বাস, বিশ্বাসের পবিত্রতা এবং নিগড়ও। নারী পুরুষের সম্পর্কের। একটি সামাজিক সম্পর্ক রক্তের ভিতরে প্রবেশ করেছে, তাকে নানা ভাবে নানা কোণ থেকে দেখেছেন আফসার আমেদ। এই দেখা মানবিক। ধর্ম যেভাবে মানুষের জীবনে জড়িয়ে থাকে, তা লিখেছেন আফসার। সেখানে তাঁর দেখা সম্পূর্ণ আলাদা। মৌলিক। রক্তলজ্জা গল্পের ফতিমার স্বামী শাকিল। ফতিমা ভালোবাসে চাচাতো দেওর হাসানকে। হাসান দুবছর বিয়ে করেছে। তার বউ সেলিমা ভালো মেয়ে। কিন্তু সন্দেহ না করতে করতে সন্দেহের দিকে ধাবিত হয় তার মন। হাসানকে যখন জেরা করে সেলিমা, হাসান কোরান ছুঁয়ে বলে সে ফতিমার ঘরে যায়নি। এই কথা ফতিমা শুনতে পায়। তাদের তো একই ভিটেতে বসবাস। মিথ্যে বলল হাসান আল্লার কসম খেয়ে। হাসান কোরানের পবিত্রতার বিশ্বাসে আঘাত করেছে। ফতিমা যন্ত্রণায় দুমড়ে যায়। এ এক আশ্চর্য গল্প। ফতিমা মনে মনে হাসানকে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে দিতে চায়। কেন না হাসান তার প্রেমকে স্বীকার করেনি, কোরান ছুঁয়ে মিথ্যে বলতে পেরেছে। জানালা বন্ধ করতে গিয়ে আঙুল ছেঁচে রক্তাক্ত হয় ফতিমা। রক্তাক্ত হাতে কোরান পাঠে বসে ফতিমা। সে যে রক্তাক্ত তা ভুলেই যায়। রক্তাক্ত তর্জনী কোরানের পৃষ্ঠায় ডানদিক থেকে বাঁদিকে বর্ণমালার নিচে বুলোয় ফতিমা। আহা এমন প্রেম আর প্রত্যাখ্যানের গল্প লেখা হয় কম।

***

উপরের কথাগুলি আফসার শুনলই না। বলল, আমি যাই।

 কোথায় যাবে ?

 চুপ করে থাকল। দেখি পাশে কেউ নেই। আমার ঘুম ভাঙল। ভোরের মেঘলা করা আবছা আলো ফুটেছে তখন। আফসার আমেদ কিছু বলতে এসে ফিরে গেছে। আসলে মুখ ফুটে কোনোদিনই সে কিছু বলতে পারত না। এই ভোরেও না। সকালে প্রদোষের অন্ধকার নেমেছে। মেঘে ভরেছে আকাশ। এক ফোঁটা দু ফোঁটা জল…।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *