বেচতে বেচতে নতুন বছর

বেচতে বেচতে নতুন বছর

পত্র ঝরণের কাল শেষ। কচি পাতা জেগেছে সোনামুখীর শালবনে। শুকনো পাতার স্তুপে আগুন লাগিয়ে জীর্ণ পুরাতন সব ত্যাগ করে নতুন পাতায় সেজে উঠছে শালবন। এখন বনাঞ্চল ফাঁকা ফাঁকা। বহুদূর পযর্ন্ত দেখা যায়। অপারেশন গ্রিন হান্ট এই সময়ে হয়েছিল। বনে কারো লুকিয়ে থাকার উপায় নেই। এই সময়ে আদিবাসীরা শিকারে যায়। অবশ্য শিকারের আছেই বা কী? মেঠো খরগোস, শজারু…এই সব। শীতকাল চলে গেছে। বসন্তও যায় যায়। চৈত্রের দুপুরে ডাক উঠেছে, ও বাবা, ভোলানাথের চরণেই সেবা লাগি, মোয়াদেব! আরে যে লোকগুলোকে আমরা সবদিন দেখি এমনি এমনি। মধুদা রিকশা চালায়, সাধনদার চাল ব্যবসা, গোরাদা ফুটবল খেলে ভালো, তারাই সব বদলে গেছে, পালটে গেছে। গাজনের সন্ন্যাসী হয়েছে। এদের সঙ্গে জুটেছে লালু কাওরা। কাহার। সে খেতে পায় না এমনিতেই। সড়কি নিয়ে কচ্ছপ খুঁজে বেড়ায়। ঘরামির কাজ করে, মাটি কোপায়। কিন্তু তাতে সংসার চলে না। পেটপুরে খাওয়াও হয় না। এই এক মাস গেরুয়া ধরে সন্ন্যাসী হয়ে তার ভাত জোটে, ফলমূল জোটে। গাজনের সন্ন্যাসীদের দিতে কার্পণ্য করে না গেরস্ত। কিন্তু তা গাঁয়ে। আমাদের সেই ছেলেবেলায়। অবাক হয়ে দেখতাম এই কদিন আগে যে লোকটি তাস পেটাচ্ছিল বাজারে বকুল গাছের গোড়ায়, বাঁধানো চাতালে, সে গেরুয়া ধরে মহাদেবের চরণে সেবা লাগি বলে বেড়াচ্ছে। মধুদা রিকশাওয়ালা কিন্তু গেরুয়া পরেই সওয়ারি নিয়ে চলেছে আমতলা থেকে নলকোঁড়া। মাঝে মাঝে হাঁক মারছে’ ‘মোয়াদেবের সেবা লাগি…’। চৈত্র শেষে গাজন। সে এক মস্ত হৈ হৈ। বান ফোঁড়া, খেজুর গাছ মোড়া, উপর থেকে ঝাঁপ, সে কত কী! শিব মন্দিরে এয়োতির লাইন। মহাদেবের মাথায় দুধ ঢালতে কে আর আসেনি। যার স্বামী একটা বিধবা মেয়েছেলের জন্য হাটখোলা থেকে আর বাড়িই ফেরে না সব দিন, সেও এসেছে শিবের লিঙ্গমূর্তিতে দুধ ঢালতে। লোকটা যে সব টাকা সেই বিধবার কাছেই ঢেলে দিচ্ছে, হে মহাদেব, নতুন বছরে কী হবে? সব মনে পড়ে যায় সকাল বেলায় ড্যাডাং ড্যাডাং কাঁসর বাজিয়ে সন্ন্যাসী, সন্ন্যাসিনীদের ফ্ল্যাটের দুয়ারে এসে দাঁড়াতে দেখে। হাতে সরা। তার ভিতরে একটি জবা ফুল। সন্ন্যাসীর হাতে শিবলিঙ্গের ছবি, দিতে হবে কিছু। মেলে না। মনে পড়ে যায় লিঙ্গ বর্ধক জাপানি যন্ত্রের কথা। বিধবার পায়ে হাটখোলার গণেশদা সব দিয়ে দিল জাপানি তেল মেখে। বসন্ত কাল যে। সব্বোনেশে চৈত। সবটা ঘেটে দিয়ে যাচ্ছে এই সব চিনে জাপানি কোম্পানি। আমাদের ভোলানাথের আর মান থাকল না গো। হ্যাঁ, চৈত্র বড় সবর্নেশে। দুপুরভর এপাশ ওপাশ করে এবাড়ির সে আর ওবাড়ির ও। দুপুর আগুন হয়েছে। গা হাত পা আগুন হয়েছে। মনও। অনুরোধের আসর তো উঠে গেছে। মনে করো আমি নেই, বসন্ত এসে গেছে… কেউ বলে ফাল্গুন কেউ বলে কুসুমের মাস…।

সব আমাদের সেই বাল্যকালের কথা। এই কালে সেই রামও নেই, রাবনও নেই। কিন্তু সীতাহরণ আছে। টেলিভিশন দেখে স্বামীর ঘর থেকে ফিরে আসা তপুদির কি আর সেই কল্পনার দুয়ার খুলতে পারে? সেই সময়ে তা হতো। রেডিওর এরিয়ালের তারে কাকেদের সভা বসত বেলা পড়ে এলে। এ বাড়ির কুমু, সারা দুপুর আগানে বাগানে ঘুরে বেড়ায়, সাপের শঙ্খ লাগা দেখেছে সে চৈত্রের ঘোর রৌদ্রের ভিতর আরো অনেকের সঙ্গে। কচি আমের খোসা ঝিনুকে ছাড়িয়ে কুচি কুচি করে লঙ্কা আর নুনে জারিয়ে খেতে খেতে তপুদি কুমুর কাছে শোনে সাপের শঙ্খ লাগার কথা। ইস, তাকে ডাকেনি কেন কুমু। নতুন বস্ত্র ফেলে দিত। তার উপরে উঠে যেত যদি সাপ সাপিনী, সেই কাপড় নিয়ে সব কাজে জয় হয়। তপুদির স্বামী পারবে, পারবে। পুরুষ মানুষ পারবে না কেন? সাপের শঙ্খ লাগা কাপড় পেতে শোবে তারা।

হ্যাঁ, সেই চৈত্র এসে চলে যাচ্ছে। এই শহর তো সেই চৈত্র জানে না। চৈত্রের ড্যাডাম ড্যাডাম ভেসে আসবে নতুন ওঠা গরম বাতাসে, তা শোনেনি এই শহর। এ শুধু জানে চৈত্র সেলের কথা। সেল যেন নতুন নিয়ে এসে পুরোনোকে বিদায়ের অভিনয়। সেল সেল সেল। শ্যামবাজার থেকে হাতিবাগান, দুপাশের ফুটপাথ, রাস্তার ধার দখল হয়ে গেছে চৈত্র সেলে। কিছুই না। বাজার তোলা, উপলক্ষ করে কিছু বেচা কেনা করে নেওয়া। হকারে কলকাতা শহর ছেয়ে গেছে। চৈত্র সেলের সঙ্গে আমাদের যৌবনও সেলে এসে গেছে। সস্তায় যৌবনকাল বেচা হয়ে যাচ্ছে যেন, পুরোন জামা কাপড়ের সঙ্গে তারাও নেমেছে নিজেদের বিকিয়ে দিতে। সেই সব ছেলেরা, ২০, ২২, ২৪ যখন চিৎকার করতে থাকে সেল সেল সেল… তারপর বুড়ো হয়ে যায় অকালে, বৈশাখ আসে না আর। চৈত্র প্রলম্বিত হতে থাকে। কত বছর ধরে এই শহরে চৈত্র সেল চলছে ফুটপাথে, তার হিসেব কে রাখে। দর কষাকষি চলতেই থাকে। পাঁচশো টাকা দাম বললে, আপনাকে পঞ্চাশ বলে আরম্ভ করতে হবে। তারপর চলবে। পাঁচশো টাকার জিনিশ দেড়শোয় কিনেও মনে হবে ঠকে গেলাম। কিছুতেই মন স্থির হয় না দরাদরির বেচা-কেনায়। বৈশাখের পয়লায় নতুন বছর। বছরের আরম্ভের দিনে সোনার দোকান থেকে বই-এর দোকানে ভীড়। বইয়ের পাড়ায় প্রকাশক খুব নিষ্ঠা ভরে মানেন বৈশাখের এই দিনটিকে। আরম্ভ তো। আরম্ভের দিনে লেখকরা আসেন। আগে বই প্রকাশ হতো অনেক, এখন বই মেলায় যা হতে পারেনি, তাই-ই পয়লা বৈশাখে। নতুন বছরের নতুন দিন আরম্ভ হয় মেলামেশায়। বেশ বেশ বেশ। আমি দেখতে পাই সেই শ্যামল, সিরাজ, সুনীল, বরেন, বিমল কর, সমরেশ বসুরা বৈশাখের প্রথম দিনে আছেন। আছেনই। পার হয়ে যাচ্ছেন ট্রাম রাস্তা। বই-এর ঘরে ঘরে তাঁদের আসা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *