আবার জন্ম নেব, এস হে ২৫শে বৈশাখ

আবার জন্ম নেব, এস হে ২৫শে বৈশাখ

ফিরে এল সেই পঁচিশে। পঁচিশে এলে বাল্যকাল ফিরে আসে। কৈশোর উঁকি দেয়। যৌবনবেলার কথা মনে পড়ে। পঁচিশে ধীরে ধীরে আমার এই বয়সেও পৌঁছে গেছে। রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন, আমাদের আনন্দের দিন। রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন আমাদেরই মিলিত এক জন্মদিন। হ্যাঁ, তাই যেন। বাঙালীর একটিই উৎসবের দিন, ২৫শে। বাঙালি বুঝি কোনো এক পঁচিশেই জন্মেছিল। সেই পঁচিশে থেকে বাঙালির যাত্রা শুরু। সেই পঁচিশে দুশো, পাঁচশো, হাজার বছর আগে, পাল বংশ, গুপ্তযুগ, তা পেরিয়ে সেই কত হাজার বছর আগে রেবা নদীর তীরে হয়েছিল উদযাপন। কিংবা উজ্জয়িনীর শিপ্রা নদীর কুলে বেজেছিল শুভ জন্মদিনের শঙ্খ। সেই হাজার বছর আগে ঠিক হয়ে গিয়েছিল কোনো এক পঁচিশে জন্ম নেবেন তিনি। সত্যি বলতে গেলে পঁচিশে বৈশাখের আনন্দ যেন নিজ গৃহে নতুন শিশু জন্মানোর আনন্দ। আমার কাছে প্রতিটি পঁচিশে বৈশাখে রবীন্দ্রনাথ জন্ম গ্রহণ করেন। আর এও সত্য পঁচিশে এলে ২২শের কথা মনে এসে যায়। পঁচিশে বেজেছিল সহস্র শঙ্খ, ২২শে নেমেছিল অনন্ত বারি ধারা। কে যেন জিজ্ঞেস করেছিল, শিশু কন্যা হয় তো, ২২শে শ্রাবণ কি খুব বৃষ্টি হয়েছিল? আমি তো বাইশে নিয়ে যা জানি, শুনেছিলাম বৃষ্টিই হয়নি, রৌদ্র পোড়া আকাশ ছিল কলকাতার মাথায়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কি কলকাতার? রবীন্দ্রনাথ এই মহাবিশ্বের। গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী, পদ্মা, মেঘনা, তিস্তা, তোর্সা, করতোয়া, মহানন্দা, ডাহুক, সুবর্ণরেখা, ডুলুং… সমস্ত নদীর তীরে কবি তো ছিলেন। ২২শে অনন্ত বারিধারা নেমেছিল, বন্যা হয়েছিল, নদীর গতিপথ বদলে গিয়েছিল এপার, ওপার কোথাও।

কবি ১৩৪৫ (১৯৩৮) এর ২৫শে বৈশাখে কালিম্পঙে লিখেছিলেন তাঁর “জন্মদিন” কবিতাটি।

আজি আসিয়াছে কাছে
জন্মদিন মৃত্যুদিন; একাসনে দোঁহে বসিয়াছে;
দুই আলো মুখোমুখি মিলিছে জীবনপ্রান্তে মম
রজনীর চন্দ্র আর প্রত্যুষের শুকতারা-সম –
একমন্ত্রে দোঁহে অভ্যর্থনা।।

কবির তখন ৭৭ বছর পার হলো। সেই বয়সে পৌঁছে এই প্রজ্ঞায় তিনি পৌঁছেছেন। সুতরাং বাইশে অনন্ত বরিষণে কত নদী তার গতিপথ বদলে নিয়েছিল যে তা ভেবে নিতে আমার কোনো অসুবিধা হয় না। আমরা সকলেই যে পঁচিশে বৈশাখের সন্তান। পঁচিশে না থাকলে বাঙালির কী থাকত? শুধুই বাইশে, জলপ্লাবন? ৪৩-এর মন্বন্তর, দাঙ্গা, দেশভাগ, বাঙালি শুধুই ভিটে হারা হতো। বোমা পিস্তল, নাফা-মুনাফা ব্যতীত বাঙালির আর কিছুই থাকত না। ফেলে আসা ওপারের সঙ্গে সেতু তো রবীন্দ্রনাথ। পঁচিশে বৈশাখ। যদিও ওঁদের উদযাপন আমাদের সঙ্গে প্রায়ই মেলে না। একদিন আগে হয়ে যায়। কিন্তু সেও তো পঁচিশেই। বৈশাখই। গানে কবিতায় যে বাঙালিয়ানা, তাই দিয়ে আর ২৫শে দিয়ে ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে ওঁরা দাঁড়াচ্ছেন। আমরা নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধানে, বিন্ধ্য হিমাচল যমুনা গঙ্গায় রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন, আমাদের জাতির জন্মদিন পালন করছি। আমার ছোটবেলায় প্রথম পঁচিশে আমাদের ফ্ল্যাটবাড়ির ঘরে। আমার দাদা একটি রেকর্ড প্লেয়ার কিনে এনেছিলেন, এইচ.এম.ভি. কোম্পানির। তার কোনো স্পিকার ছিল না। ঢাউস জি.ই.সি. রেডিওয় জুড়ে দিয়ে গান শোনা হত। সেই রেকর্ড প্লেয়ারে বাজল রবীন্দ্রনাথের গান দেবব্রত বিশ্বাসের গলায়। মেঘ বলেছে যাব যাব…। রবীন্দ্রনাথের একটি বাধানো ছবি এনেছিলেন বাবা। সেই ছবিতে খুড়তুতো দিদি চন্দন পরালো যেমনটি পরাত আমাদের জন্মদিনে আসনে বসিয়ে। সেই বছর ছিল পঁচিশের একশো বছর। ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দ, ১৩৬৮ বঙ্গাব্দ। চন্দন পরিয়ে বেলফুলের মালা পরিয়ে ধুপ জ্বেলে দেওয়ার পর ছোটবোন নাচল, এস হে বৈশাখ এস এস। হারমনিয়ামে গান গাইল উপরের ফ্ল্যাটের তেজেনবাবুর মেয়ে। আমি আবৃত্তি করলাম, আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে…। ছোট নদী আমি দেখেছিলাম কিশলয়ে আঁকা। তার কতদিন বাদে শান্তিনিকেতন যেতে বাসে অজয় পার হয়েছি, আমাদের ছোট নদী…। ২৫শে বৈশাখ। খড়ি নদীর ধারে প্রতিবিম্ব পত্রিকা করেছিল এক ২৫শে বৈশাখ। এসেছিলেন মোহন সিং। কত রাত অবধি গান। কথা। পঁচিশে উদযাপন। আমাদের পঁচিশে হতো বাড়ির ছাদে, তক্তপোশে মঞ্চ। মায়ের শাড়ি, বিছানার চাদর দিয়ে মঞ্চ সজ্জা, কারটেন। ছাত্রের পরীক্ষা কিংবা পেটেও পিঠে অভিনয়। একবার ছাদ থেকে মাটিতে নেমে এসে স্টেজ বানিয়ে বড় রবীন্দ্র জয়ন্তী। বিনি পয়সার ভোজ নাটকে রূপান্তরিত হলো, অক্ষয়বাবুর সঙ্গে অন্য চরিত্ররাও এল মঞ্চে। সে এক হৈ হৈ। আমাদের পঁচিশে। গোপালদা গাইলেন, চলে যায়, মরি হায়, বসন্তের দিন চলে যায়। তিনি তখন সত্যিই বসন্তের দিন পার করছিলেন। কিছুই করতেন বলে জানি না। শুধু গান গাইতেন কোনো এক হলুদবসনার উদ্দেশে। সে সেই বসন্ত পার করে তাঁকে বৈশাখের দারুণ অগ্নিবানের ভিতরে পৌঁছে দিয়ে নিজের বসন্তে ফিরে গিয়েছিল। সেই গোপালদাকে দেখি পা টেনে টেনে হেঁটে আসছেন ব্রিজের দিক থেকে। ময়লা জামা প্যান্ট, রুখু চুল। একা ছাড়া আর একজনের সঙ্গে তাঁকে দেখিনি কোনোদিন। এই তো আসছে আবার পঁচিশে। এইতো বছর বছর পঁচিশে। আসুন না গোপালদা… চলে যায় মরি হায়, বসন্তের দিন চলে যায়…। গলা তুলেছিলেন গোপালদা এমন যে কিছু না বুঝে আমার চোখে জল। তাঁকে দেখি পথে। আমি তাঁকে চিনতে পারি। তিনি তাকিয়েও দ্যাখেন না…গুণগুণ করছেন একা একা কদম গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে,

আজ মম জন্মদিন। সদাই প্রাণের প্রান্তপথে
ডুব দিয়ে ঊঠেছে সে বিলুপ্তির অন্ধকার হতে
মরণের ছাড়পত্র নিয়ে। মনে হতেছে, কী জানি,
পুরাতন বৎসরের গ্রন্থিবাঁধা জীর্ণ মালাখানি
সেথা গেছে ছিন্ন হয়ে;…

এস হে পচিশে বৈশাখ। আবার জন্ম নেব আর এক পঁচিশে, সেই যাত্রা শুরু হোক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *