৩.৫ চোখ মেলে দেখি

চোখ মেলে দেখি, শব্‌নমের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছি। শুচিস্মিতা শব্‌নম প্রসন্নবয়ানে আমার দিকে তাকিয়ে।

হায়, এই সত্য হল না কেন? আস্তে আস্তে তার চেহারা মিলিয়ে গেল কেন?

এই ‘বিকারে’ কত দিন কেটেছিল জানি না। শব্‌নমকে কাছে পাওয়া, তার মুখে সান্ত্বনার বাণী শোনা যদি বিকার হয় তবে আমি সুস্থ হতে চাই নে। আমি সুস্থ হলুম কেন?

মজার-ই-শরীফে হজরত আলীর কবর চত্বরের এক প্রান্তে চুপচাপ বসে থাকি গভীর রাত্রি পর্যন্ত।

কাবুলের সূফী সাহেব আমার নিরুদ্দেশ হওয়ার খবর পেয়ে সেখানকার সরাইখানাতে সন্ধান নিয়ে কিছুদিনের ভিতরই জানতে পারলেন, আমাকে মজারের পথে দেখা গিয়েছে। আমার কাবুল ফেরার মেয়াদ যখন ফুরিয়ে গেল তখন তিনি বেরলেন আমার সন্ধানে। আমাকে যখন পেলেন তখন আমি মজারের কাছেই। উজবেগদের সাহায্যে আমাকে অচৈতন্যাবস্থায়ই এখানে নিয়ে আসেন।

গ্রীষ্মের সন্ধ্যা। মধ্যগগনে দশমীর চন্দ্র। হাওয়া আসছে উত্তর-পুব-আমুদরিয়া আর বল্‌খ থেকে। মসজিদচত্বরে পুণ্যার্থীরা এষার সমবেত উপাসনা শেষ করে এখানে ওখানে নৈমিত্তিক (নফল) আরাধনা করছে। সূফীরা স্থানুর মত নিষ্পলক দৃষ্টিতে, কিংবা মুদ্রিত নয়নে আপন গভীরে নিবিষ্ট। রাত গভীর হলে মজারের কেউ বা মধুর কণ্ঠে জিকর গেয়ে ওঠে।

এ সব রোজ দেখি, আবার রোজই ভুলে যাই। আমার স্মৃতিশক্তি কিছুই ধারণ করতে পারে না। প্রতিদিন মনে হয়, জীবনে এই প্রথম আঁখি মেলে এ দেখছি! কোনদিন বা সরাই থেকে এখানে আসবার সময় পথ খুঁজে পাই না। শহরের লোক আমাকে চিনে গিয়েছে। কেউ না কেউ পথ দেখিয়ে রওজাতে পৌঁছিয়ে দিয়ে যায়।

আমি মজনূঁন, আমি পাগল—এ কথা আমি সরাইয়ে, রাস্তায় ফিস্‌-ফিস্‌ কথাতে একাধিবার শুনেছি। এ দেশে প্রিয়বিচ্ছেদে কাতর জনকে কেউ বিদ্রূপের চোখে দেখে না। শুনেছি, সভ্য দেশের কেউ কেউ নাকি এদের এ দৃষ্টান্ত হলে অনুকরণ করতে শিখছেন। এদের চোখে দেখি, আমার জন্য নীরবে মঙ্গল কামনা। দরগায় বসে বসেও যে আমি নামাজ পড়ি নে তাই নিয়ে এরা মোটেই বিচলিত নয়। মজনূনের উপর কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। আর একদিন শুনেছিলুম বোরকা পরা দুটি তরুণীর একজন আরেক জনকে বলছে, কি তোর প্রেম যে, তাই নিয়ে হর-হামেশা আপসা-আপসি করছিস! ওই দেখ প্রেম কী গরল! শব-ই-জুফফাফের ফুল শুকোবার আগেই এর প্রিয়া শুকিয়ে হাওয়া হয়ে যায়। হয়েছিস ওর মত তুই মজনূন-পাগল?

আমি মাথা হেঁট করে এগিয়ে গিয়েছিলাম। প্রেম কি গরল? প্রেম তো অমৃত। আমার মত অপাত্রে পড়েছিল বলেই সঙ্গে সঙ্গে পাত্র চিড় খেল। আমার নামের মিতা আরবভূমির মজনূঁন তে পাগল হন নি। তিনি প্রেমের অমৃত খেয়ে পেয়েছিলেন দিব্য রূপ। সংসারের আর কেউ সেটি খায় নি বলে সে রূপ চিনতে না পেরে তাকে বলেছিল পাগল। যে দু একটি চিত্রকর বুঝতে পেরেছিল, তারা ছবিতে সেই দিব্যজ্যোতি দেবার চেষ্টা করেছে।

‘সেরে উঠছি’। যদি এটাকে সেরে ওঠা বলে। এতদিন অবশ ছিলুম, এখন এখানে ওখানে বেদনা পাচ্ছি। শব্‌নম এখন আর আমার সম্মুখে যখন তখন উপস্থিত হয় না। হলেও মুখে বিন্দু হাসি। সূফী সাহেবকে সেটা জানাতে তিনি ভারী খুশী হলেন। তাঁর শিষ্যদের বিশ্বাস তিনি অলৌকিক শক্তির অধিকারী, তিনি অতিপ্রাকৃতে এরকম বিশ্বাস করেন না। তিনি বিশ্বাস করেন, শোকে কাতর অপ্রকৃতিস্থ লোকের মনে শান্তি এনে তাকে সবল সুস্থ করতে পারা এ পৃথিবীর সব চেয়ে বড় অলৌকিক ঐশী শক্তি।

এ কথা আমিও মানি। কিন্তু এই যে শব্‌নম আমাকে এসে দেখা দিয়ে যায়, এটাকে তিনি এত সন্দেহের চোখে দেখেন কেন? স্বপ্নে মায়ায় শব্‌নমের এই যে দান এ তো সত্যকে অসম্মান করে না, সে তো তখন অবাস্তব, অসত্যের পরীর ডানা পরে এসে আকাশ কুসুম দিয়ে আমার গলায় হন্দ্রমাল্য পরায় না। কৈশোরে এক সঞ্চয়িতায় পড়েছিলুম, কে যেন এক চীনদেশীয় ভাবুক বলেছেন, স্বপ্নে দেখলুম, আমি প্রজাপতির শরীর নিয়ে ফুরফুর করে ঘুরে বেড়াচ্ছি এটা কি কোনও প্রজাপতির স্বপ্ন নয়—সে স্বপ্নে দেখছে যে সে মানুষের রূপ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে? সর্বসত্তা নিয়ে যেখানে সন্দেহ সেখানে তাঁর বিদ্বেষ আমার স্বপ্নের প্রতি!

সূফী সাহেব বললেন, জানেমন্ খবর পাঠিয়ে জানিয়েছেন, আমি কাবুল না ফিরলে তিনি নিজে আমার সন্ধানে বেরবেন। তার লোক উত্তরের জন্য আছে।

আমি তাঁর দিকে তাকালাম।

তিনি আমার প্রশ্ন বুঝতে পেরেছেন। শান্তকণ্ঠে বললেন, তার কোনও খবর নেই; কিন্তু আমি বিশ্বাস করি সে ভাল আছে।

আমি বললুম, চলুন।

আবদুর রহমানের পিতাকে এবারে আর ফাঁকি দেওয়া যায় নি। খেতখামারের কাজ করে বাকী সময় সে নাকি বাজারের চায়ের দোকানে বসে আমার প্রতীক্ষা করত। তার সঙ্গে মুখোমুখী দেখা না হলেও সমস্ত বাজারে আমাকে দেখামাত্রই যে রকম হুলুধ্বনি দিয়ে উঠেছিল তা থেকেই বুঝেছিলুম, বিখ্যাত বা কুখ্যাত হওয়া যায় নানা পদ্ধতিতে, এবং কোনও চেষ্টা না করেও।

তার উপর সূফী সাহ্বে বুড়োর মুরশীদ বা গুরু।

শুনলুম, আমানুল্লা কর্তৃক ফ্রান্সে নির্বাসিত তাঁর সিপাহসলার বা প্রধান সেনাপতি নাদির খান বাচ্চাকে তাড়াবার জন্য গজনী পর্যন্ত পৌঁছে গেছেন। রঙরুটের অপেক্ষা না করে কান্দাহারেই আবদুর রহমান তাঁর সৈন্যদলে ঢুকেছে।

শব্‌নমের কাছে শুনেছিলুম, ফ্রান্সের নির্বাসনে আমার শ্বশুরমশাই আর নাদির খানে তাঁদের পূর্বপরিচয় গভীরতর হয়েছিল। বহু যুগের পারিবারিক দ্বন্দ্ব ছিল বলেই একদিন যখন হঠাৎ মৈত্রী স্থাপিত হল তখন সেটা গভীরতম বন্ধুত্বের রূপ নিল। ফ্রান্সে সব মেয়েরই একটি করে গড-ফাদার থাকে, শব্‌নমের ছিল না বলে দুঃখ করতে নাদির নিজে যেচে তার গড-ফাদার হবার সম্মান লাভ করেছিলেন-শব্‌নম বলেছিল। তবু আমার শ্বশুর আমানুল্লা আফগানিস্থান ত্যাগ না করা পর্যন্ত নাদিরের অভিযানে যোগ দেন নি।

আমার ভয় হল, বাচ্চা যদি জানেমনের উপর দাদ নেয়!

কুহ-ই-দামন, জবল্‌-উস্‌-সিরাজ অঞ্চল পেরবার সময় দেখি বাচ্চার সঙ্গী ডাকাতরা তাকে ডেজার্ট করে পালাচ্ছে। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য! অত্যাচারী মাস্টারের নিপীড়নে যখন নিরীহ শিশু ভ্যাক করে কেঁদে ফেলে তখন করুণা হয়, কিন্তু সেই স্যাডিস্ট মাস্টার যখন হেডমাস্টারের হুড়ো খেয়ে কেঁচোটি হয়ে যান তখন ঘেন্না ধরে, হাসি পায়। নিরীহ বাছুরের দুশমন শূয়োরকে বাঘ তাড়া লাগালে যেমন মনটা প্রফুল্ল হয়ে ওঠে। রাস্তার উপরে, এদিকে ওদিকে ছড়ানো তাদের পরিত্যক্ত লুটের মাল, দামী দামী রাইফেল। নাদির-বাঘ আসছে, ওগুলো কুড়োবার সাহস কারও নেই। শুনেছি কোনও শান্ত জনপদবাসী নাকি নিরপরাধ প্রশ্ন শুধিয়েছিল এক পলায়মান ডাকাতকে, সে কোন্ দিকে যাচ্ছে, আর অমনি নাকি ডাকাত বন্দুক ফেলে নিরস্ত্র পথচারীর পা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছিল। ঐতিহাসিক খাফী খান তাহলে বোধ হয় খুব বেশী বাড়িয়ে বলেন নি যে, আবদালী দিল্লি আসছে শুনে মারাঠা সৈন্যরা নাকি ‘আইমা’ ‘কাইমা’—অর্থাৎ মায়ের স্মরণে চিৎকার করতে করতে যখন দিল্লী থেকে পালাচ্ছিল তখন নাকি শহরের রাঢ়ীবুড়ীরাও ধমক দিয়ে ওদের নিরস্ত্র করে মালপত্র কেড়ে নিয়েছিল।

বিজয়ী নাদীর কাবুলে প্রবেশ করলেন নগরীর পশ্চিম দ্বার দিয়ে। পরাজিত আমি উত্তর দ্বার দিয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *