২.১ পলে পলে তুষানলে দগ্ধ

দ্বিতীয় খণ্ড

সকলইে বলে, পলে পলে তুষানলে দগ্ধ হওয়ার চেয়ে বহ্নিকুণ্ডে ঝম্প দেওয়া ভাল। আমি জানি, আমার সম্মুখে কত দীর্ঘ দিনের বিরহ সেটা যদি আমি প্রথম দিনে জানতে পারতুম তা হলে সেটা কিছুতেই সইতে পারতুম না। আমার প্রার্থনামত আল্লাহতালা আমাকে এক সঙ্গে একটি কদমের বেশী ওঠাতে দেননি। আলো দিয়েছিলেন কিংবা বেদনা দিয়েছিলেন এক পা চলার-বিরহদিগন্ত কত দূরে দেখতে দেন নি। তাঁকে দোষ দিই কি করে?

আর শব্‌নম! সে তো শিউলি। শরৎ-নিশির স্বপ্ন—প্রভাতের বিচ্ছেদ বেদনা। সে যখন ভোরবেলা সর্ব বন্ধন থেকে মুক্ত হয়, সে কি স্বেচ্ছায়?

ওই কঠিন কঠোর সময়েও সে এবার ঝড়ের মত আমার ঘরে এসেছিল।

এক নিশ্বাসে কথা শেষ করে কেঁদেছিল! এই প্রথম আর ওই তার শেষ কান্না। তার বাবাকে আমানুল্লা কান্দাহারের গবর্নর করে পাঠাচ্ছেন। ফ্রান্সের নির্বাসন শেষ হওয়ার পর দেশে ফিরলেন বটে, কিন্তু আমানুল্লা আর সর্দার আওরঙ্গজেব খানেতে বনাবনি হল না; বিশেষত তিনি আমানুল্লার উগ্র ইউরোপীয় সংস্কার পদ্ধতি আদপেই পছন্দ করতেন না। এখন ইউরোপ যাবার মুখে তিনি বিশ্বাসী লোক খুঁজছেন। আওরঙ্গজেব নাকি প্রথমটায় যেতে চান নি। এখন স্থির হয়েছে, তিনি মাত্র তিন মাসের জন্য যাবেন। আওরঙ্গজেবদের পিতৃভূমি কান্দাহার তিনি ভাল করে চেনেন-তিন মাস পরে অবস্থা দেখে আমানুল্লাকে জানাবেন, ঠিক কোন্ লোককে তাঁর পরের গবর্নর করে পাঠালে সে কান্দাহারের বিশ্বাস অর্জন করতে পারবে।

এত দুঃখের মাঝখানেও ওইটুকু আনন্দের বাণী। কাবুলে রাজনৈতিক মরুভূমিতে বাস এক রকম অসম্ভব। হয় তুমি রাজার পক্ষে, রাজার প্রিয়ভাজন-নয় তুমি কারাগারে কিংবা ওপারে; শব্‌নম যদিও বললে, তার আব্বা এসব ব্যাপারে ঈষৎ উদাসীন। ফ্রান্সে নির্বাসনকালে তিনি সেখানকার স্যাঁ সীর মিলিটারি কলেজের অধ্যাপকদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে মিলিটারি স্ট্রাটেজি সম্বন্ধে বিস্তর গবেষণা করেছিলেন, এখনও করেন,—আর তার ফাঁকে ফাঁকে কাব্য-চর্চা।

সেদিন শব্‌নম তেজী তুর্কী রমণীর মত কথা বলেনি, কথায় কথায় কবিতা বলতে পারেনি। শুধু অনুনয় বিনয় করেছিল।

আমি শুধু একটি কথা বলেছিলুম, তোমার না গেলে হয় না?

বেচারী ভেঙে পড়ে তখন।

টসটস করে, কোনো আভাস না দিয়ে, ঝরে পড়েছিল অনেক ফোঁটা মোটা মোটা চোখের জল।

আমার দু হাত তুলে ধরে তাদেরই দু পিঠ দিয়ে আপন চোখের জল মুছতে মুছতে বলেছিল, ওইটেই তুমি শুধু শুধিয়ো না, লক্ষ্মীটি। এই একটা প্রশ্ন আমার মাথার ভিতর ঢুকে যেন পোকার মত কুরে কুরে খাচ্ছে। না গেলে হয় না? না গেলে হয় না?—অসম্ভব, অসম্ভব। কিস্মৎ কঠিন হয়ে দেখা দিয়েছেন, তুমি ওকে রুদ্রতর করো না।

দরজার কাছে এসে তার কথামত দাঁড়ালুম। বললে যেটা সে আগের বারও বলেছিলে, ‘আমার বিরহে তুমি অভ্যস্ত হয়ে যেয়ো না।’

ওর তো কথার অভাব নেই। বুঝলুম, প্রাণের কথা মাত্র একটি।

ভোরবেলা আমি আধো ঘুমে। সমস্ত রাত অনিদ্রায় কেটেছে। আমার শিয়রে বসে শব্‌নম। আমি চোখ মেলতেই সে দুহাত দিয়ে আমার চোখ বন্ধ করে দিল।

যেন শুনলুম, ‘ব আমানে খুদা’—তোমাকে খুদার আমানতে রাখলুম। ‘বু খুদা সর্পূমৎ’—তোমাকে খুদার হাতে সর্পোদ করলুম।

‘আমার বিরহে-’

সমস্ত ব্যাপারটা কয়েক সেকেণ্ডের। দীর্ঘতম স্বপ্নও নাকি কয়েক সেকেন্ডের।

বলতে পারব না, সত্য না স্বপ্ন। শব্‌নমকে শুধোবার সুযোগ পাই নি। বোধ হয় সত্যস্বপ্ন। কিংবা স্বপ্ন সত্য।

প্রথমে তিন মাস, তার পর চার মাস, তার পর ছমাস। আমানুল্লা বিদেশ থেকে এক এক দু দু মাসের ম্যায়াদ বাড়ান; আর শব্‌নমরা ফিরতে পারে না।

সহ্যের সীমা পেরিয়ে গেল।

শব্‌নমদের প্রাচীন ভৃত্য তোপল খান দু-তিন মাস অন্তর অন্তর একবার করে কাবুল আসে আর শব্‌নমের চিঠি দিয়ে যায়—ডাককে অবিশ্বাস করার তার যথেষ্ট ন্যায্য হক্ক ছিল।

সে চিঠিতে কি ছিল আমি বলতে পারব না। ফার্সীতে ফরাসীতে মেশানো চিঠি। যে শব্‌নম কথায় কথায় কবিতা বলতে পারত সে বিদায়ের সময়কার মত একটি কবিতাও উদ্ধৃত করে নি কিংবা করতে পারে নি। মাত্র একবার করেছিল। তাও আমি আমার চিঠিতে সে কথার উল্লেখ করেছিলুম বলে। তখন লিখেছিল :

“আজ হুরে হালে ধরা শুদ ইক্লাহ পর্জীর
হমচু ওয়ারানে কি আজ গনজে খুদ্‌ আবাদ্‌ ন্‌ শুদ?

এত গুণ ধরি কি হইবে বলে দূরবস্থার মাঝে।
পোড়া বাড়িটাতে লুকনো যে ধন,-লাগে তার কোনো কাজে?”

আর ছিল কান্না আর কান্না।

প্রত্যেকটি শব্দে, প্রত্যেকটি বাক্যে। এমন কি আমাকে খুশী করবার জন্য যখন জোর করে কোন আনন্দ ঘটনার খবর দিত তখনও সেটি থাকতো চোখের জলে ভেজা।

থাক। আমার এ গুপ্তধনে কী আছে তার সামান্যতম ইঙ্গিত আমি দেব না। এখন এটি আমার চোখের জলে ভেজা।

এক বছর ঘুরে যাওয়ার পর আমি একদিন রোজা করলুম। সন্ধ্যার সময় গোসল করে, সামান্য ইফতার (পারণা) করে নমাজে বসলুম। দুপুর রাত্রে ঘুমুতে গেলুম। স্বপ্নে সত্য পথ নিরুপণের এই আমাদের একমাত্র পন্থা।

স্বপ্নদেশ হল, কান্দাহার যেয়ো না। ভোর রাত্রে।

আমার মস্তকে বজ্রাঘাত। আমি ভেবেছিলাম, কোন আদেশই পাব না এবং বিবেককে সেই পন্থায় চালিয়ে দিয়ে আমি কান্দাহারের পথ নেব।

অবশ্য কুরান শরীফে এ প্রক্রিয়ার উল্লেখ নেই। কাজেই না মানলেও কোন পাপ হবে না। কোন কোন মৌলানা এ প্রক্রিয়া অপছন্দও করে থাকেন।

এমন সময় আবদুর রহমান এসে ঘরে দাঁড়াল। আমি তার দিকে তাকালুম। বললে, ‘কাল আমি কান্দাহার যাবার অনুমতি চাই।’

আবদুর রহমান সেই যে পাগমানে গোড়ার দিকে একদিন বলেছিল আওরঙ্গজেব-পরিবার কাবুল চলে গিয়েছেন তারপর সে ওই বিষয়ে একটি কথাও বলে নি।

আমি শুধালুম, “কেন?”

‘ওখানে আমার এক ভাগ্নে আছে। তোপল খান দু মাস হল আসে নি।’

এ দুটো কথাতে কি সম্পর্ক আছে ঠিক বুঝতে পারলুম না। -একটু চিন্তা করে স্থির করলুম, আবদুর রহমানকে দিয়ে চিঠি লিখে কান্দাহার আসবার অনুমতি চাইব, আর আজ রাত্রে যদি কোনো প্রত্যাদেশ না আসে তবে তার সঙ্গে বেরিয়ে পড়তেও পারি। আবদুর রহমান চলে গেল।

আমি নত মস্তকে শ্লথ গতিতে টেবিলের দিকে চললুম, চিঠিখানা তৈরি করে রাখতে। এই এক বৎসর আমি ফার্সী শিখেছি প্রাণপণ—সেই ছিল আমার বিরহে সান্ত্বনার তীর্থ-তবু চিঠি লিখতে সময় লাগে।

টেবিলের কাছে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখি, শব্‌নম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *