জানেমন্ বললেন, বাছা এবার নামাজের সময় হয়েছে। তুমি ইমাম হও।
বয়োজ্যেষ্ঠ সচরাচর নামাজের ইমাম-অধিপতি হন। বিকলাঙ্গ হন না। আমি আপত্তি জানাতে তিনি উত্তর না দিয়ে শুধু বললেন, ‘আর, নামাজের শেষে দোওয়া মাঙবার সময় কোনও কিছু চেয়ো না। ওর যার প্রাপ্য তাকে তাই দেবে।’
আল্লার উপর অভিমান!
মনসুরের কাছে সব শুনলুম।
বাচ্চা-ই-সকাও আর্কে ছিল না—জানেমন্ যখন সেখানে পৌঁছন। বাচ্চার খাস কামরার দিকে তিনি রওয়ানা হলে কেউ বাধা দেয় নি।
মনসূর বললে,
‘আপনি জানেন না, হুজুর, এদেশের লোক বড় সাহেবকে কি সম্মানের চোখে দেখে। শুধু কি বাচ্চার জন্মভূমি?—ময়মনা হিরাত, মজার বদখ্শান সর্বত্রই জানে তিনি সূফী, তিনি আল্লার সঙ্গে কথা বলতে পারেন। ডাকাতদের ভিতরও জাফর খান কি সহজে অত ঘোরতম পাষণ্ড খুঁজে পেয়েছিল, যারা শব্নম বীবীকে ধরে—’ ঢোক গিলে বললে, আমি বলছি, নিয়ে যেতে? এবং তারাও কি শেষ পর্যন্ত বাঁচবে?
‘বড় সাহেব বাচ্চার খাসকামরার শব্দ শুনে বুঝলেন, মোল্লারা সেখানে জমায়েৎ। এরা কাবুল শহরের সব চেয়ে অপদার্থ। আমানুল্লার আমলে এরা প্রায় ভিক্ষা করে জিন্দেগী চালাচ্ছিল। এদের কোন্ গোঁসাই বড় সাহেবের নুন-নেমক খায় নি—তিনি তো দানের সময় পাত্রপত্র বিচার করেন না।
‘বড় সাহেব সেখানে দাঁড়িয়ে বাচ্চাকে অভিসম্পাত করতে লাগলেন।’
‘সে আমি আপনাকে বলতে পারব না, হুজুর; এতো গাল-গালাজ, চিৎকার চেঁচামেচি নয়। তিনি শান্ত, দৃঢ়, উচ্চকণ্ঠে যেন আল্লার হয়ে পৃথিবীর সর্ব নরাধম পশুকে তাদের জন্য ভবিষ্যদ্বাণী করে যাচ্ছিলেন।
‘হঠাৎ তার বন্ধ চোখ ফেটে রক্ত বেরল। আমার শোনা কথা, যৌবনে চোখের অপারেশন প্রায় শুকিয়ে গিয়ে জ্যোতি ফিরে পাবার মুখে তাঁর গলায় কি আটকে গিয়ে তিনি বিষম খান। তখন ব্যাণ্ডেজের উপর দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসে। সেই হয় সর্বনাশ। আজ আমি দেখি, কোনও কিছুনা, হঠাৎ বন্ধ চোখ দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে।
‘পাপ পুণ্যের কি জানি, হুজুর? অপনার কাছেই তো শিখছি। জানি কুমারী, বিধবা, কোনও অবলাকে ধরে নিয়ে যাওয়া পাপ, আর ইনি তো বিবাহিতা, রমণী। মোল্লারা, ওই অপদার্থ মোল্লারা—’
আমি ক্ষীণ কণ্ঠে বললুম, সব মোল্লাই কি—?
বললে, সে আমি জানি নে, হুজুর। আপনিও তো একদিন ক্লাসে নিজেকে মোল্লা বংশের ছেলে বলে পরিচয় দিয়েছিলেন। আমিও মোল্লা, মোল্লার বেশে ওইখানে গিয়েছিলুম বলে।
‘সেই মোল্লাদের প্রবীণ যিনি, তাঁর আদেশে বড় সাহেবকে একটা কুঠরিতে নিয়ে বন্ধ করে রাখা হল। তাঁকে নিয়ে যাওয়ার পর সে বললে, কি বলতে কি বলে ফেলবেন ইনি। হাজার হোক নূতন বাদশাকে চটিয়ে লাভ কি? হয়তো এরা সত্যই আমাদের সাহায্য করতে চেয়েছিল।
‘ফরসা লোকও ভয় পাংশু হয়-নির্লজ্জও লজ্জা পায়।’
সে সব কথা থাক।
‘সন্ধ্যার দিকে হঠাৎ খবর এলো—কি করে, কোথা থেকে জানি নে, শব্নম বীবী জাফর খানকে গুলি করে মেরে ফেলেছেন।’
হুজুর, আপনি শক্ত হন।
‘আর জাফরের যে দেহরক্ষী শব্নম বীবীকে বন্দীখানায় নিয়ে যাচ্ছিল সে ও শব্নমবীবী দুজনেই অন্তর্ধান করেছেন।’
আমি বেরবার জন্য তৈরি ছিলুম। বললুম, বৎস, তুমি আমার অনেক উপকার করেছ। এখন তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আমি সন্ধানে বেরই।
সে বললে, আপনি সব কথা শুনে নিন। বড় সাহেব সেই হুকুম করেছেন।
‘যে রক্ষী শব্নম বীবীকে নিয়ে যাচ্ছিল সে এখন বড় সাহেবের পা ধরে কাঁদছে। তাকে ডাকব, না আমি বলব? আদেশ করুন।’
আমি কিছুই হৃদয়ঙ্গম করতে পারছি নে।
বললে, ওর বাপদাদা সাহেবদের নুন খেয়েছে কান্দাহারে। সে ডাকাত হয়ে বাচ্চার দলে ভিড়েছে। সে যা বলেছে তার মূল কথা, শব্নম বীবীকে প্রথমটায় একটা কুঠরিতে বন্ধ করে রাখা হয়। সন্ধ্যার দিকে জাফর তাকে ডেকে পাঠায়। জাফর সে ঘরে একা ছিল। ভিতরে কি হয়েছিল কেউ বলতে পারবে না একমাত্র শব্নম বীবী ছাড়া। হঠাৎ একটি মাত্র গুলি ছোড়ার শব্দ হল। দেহরক্ষীর দল যা দেখবে ভেবেছিল, দেখল তার উল্লোটা। জাফর খান ভয়ে লুটিয়ে আর শব্নম বীবীর হাতে পিস্তল। হাসান আলী—আমাদের এই রক্ষী বললে, সে কিছুই জানত না। আর পাঁচজন রক্ষীর সঙ্গে ছুটে গিয়ে সে এই প্রথম দেখলে তার মনিবদের ঘরের মেয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে।
হাসান আলী ডাকাত—আহাম্মুক নয়। সে তখন নাকি শব্নম বীবীকে বন্দীখানায় নিয়ে যাওয়ার ভান করে আর্কের দেউড়ির দিকে রওয়ানা দেয়।
মনে পড়লো, শান্তির সময়ও জানতুম না, শব্নমকে কোথায় খুঁজতে হবে।
‘ইতিমধ্যে বাচ্চ-ই সকাও আর্কে ফিরেছেন এবং তার কিছুক্ষণ পর হাজার হাজার লোক, এবং শত শত ঘোড়া-গাধা-খচ্চরে চড়ে গাঁয়ের লোক এসেছে, নূতন বাদশাকে অভিনন্দন জানাতে—সোজা ফার্সীতে বলে, ইনাম, বখশিশ, লুটের হিস্যা কুড়োতে। এরা একবার আর্কে ঢুকতে পারলে বেশ কিছুটা খণ্ড-যুদ্ধ লেগে যাওয়া বিচিত্র নয়। জাফর খান তাই আগেই হুকুম দিয়ে রেখেছিল, জনতা দুর্গে ঢোকার চেষ্টা করলে তাদের যেন ঠেকানো হয়। লেগে গেল ধুন্দুমার। আপনি তার শেষটুকু দেখেছেন, হুজুর—বুঝুন তখন কি হয়েছিল।
বাচ্চা ফিরতেই মোল্লারা তাকে সবকিছু বলে শব্নম বীবীকে ছেড়ে দিতে বলে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নাকি খবর আসে জাফর খান খুন হয়েছে। এবং আশ্চর্য, শব্নম বীবীকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বাচ্চার হুকুমে সমস্ত আর্ক তন্ন তন্ন করে তালাশ করা হয়েছে।
আমি শুধালুম, হাসান আলী কি বলে!
‘ওই এক কথা—“আমার কোনও দোষ নেই, আমার কোনও কসুব নেই।” ভিড়ের চাপে নাকি একে অন্যের কাছ থেকে ছিটকে পড়ে!’
সে কতক্ষণ হল?
‘ঘন্টা দুই হবে। আপনি তো সে ভিড়ের এক আনা পরিমাণ দেখলেন।’
‘হসান আলীকে ডাক।’
এল। আমার যা জানার চেয়ে প্রয়োজন সে কি আমি প্রশ্নের পর প্রশ্ন শুধিয়ে জিজ্ঞেস করি নি। ওই এক কথা। হাসন আলী হঠাৎ দেখে, শব্নম বানু তার কাছে নেই -ওই এক কথা।
আমি মনসূরকে বললাম, চল।
দেউড়িতে এসে মনসূর শুধালে, কোথায় যাবেন, হুজুর?
তাই তো। কোথায় যাব? ‘চল, আর্কে। না। চল, আবদুর রহমান কোথায় দেখি।’
কর্নেলের বাড়ি পৌঁছতে মনসূর সেখানে খবর নিলে। যখন ফিরলো তখন তার মুখ দেখেই আমি বুঝতে পারলুম, কোনও খবর নেই। মনসূর কিছুক্ষণ পরে বললে, কর্নেলের বীবী আপনাকে বলতে বললেন, শব্নম বীবীকে লুকেবার প্রয়োজন হলে তিনি প্রস্তুত আছেন। তাদের গায়ের বাড়ি সম্পূর্ণ নিরাপদ। তারপর মনসূর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললে, কর্নেলের মত সজ্জন লোক মারা গেলেন যুদ্ধে—আর বেঁচে রইল এই ডাকাতরা। তারপর বিড়বিড় করে স্কুলপাঠ্য বই থেকে বিখ্যাত কবিতা আবৃত্তি করলে, “তন্বঙ্গী কুমারী লজ্জা নিবারণের ট্যানা এই বলে বাড়ি থেকে বেরতে পারছে না, আর ওদিকে বড়লোকের কুকুর মখমলের বিছানায় শুয়ে আছে। হে সংসার, আমি তোমার মুখের উপর থুথু ফেলি।”
আমি কি বলব, কি ভাবব। মনসূরের দার্শনিক কাব্যাবৃত্তি আমার ভালোও লাগে নি মন্দও লাগে নি।
মনসূর শেষ কথা বললে, কিন্তু দেখুন হুজুর কর্নেলের স্ত্রী ভেঙে পড়েন নি।
আমি গুরু, সে শিষ্য।
মনে নেই, হয়তো কোনও দিন ক্লাসে চরিত্রবল সম্বন্ধে বক্তৃতা দিয়েছিলুম।
আবদুর রহমান বাড়ি ফেরে নি।
কাবুল নদীর পোলের উপর তার সঙ্গে দেখা। গায়ে ওভার কোট নেই। বাকী জামকাপড় টুকরো টুকরো। মনসূর তার সঙ্গে কথা বললে। বলার শোনার কিছু নেই। আবদুর রহমান ঘণ্টা তিনেক ওই জনসমুদ্র মন্থন করেছে। গালে, বাহুতে, হাতের কাছে জখমও তার দেখতে পেলুম। কোনও গতিকে পা টেনে টেনে চলে আসছিল। কিছুতেই বাড়ি যেতে রাজী হল না।
আর্কের সামনে দুটি একটি লোক। সেখানে মার্শল ল। পাঁচজনের বেশী একত্র দেখলে শাস্ত্রীদের গুলি চালানোর হুকুম। জায়গাটা এখন প্রায় ফাঁকা।
আবদুর রহমান মনসূরকে বলে, হুজুরকে বলুন, এ জায়গায় সব তন্ন তন্ন করে দেখেছি। এই পেয়েছি।
তাকিয়ে দেখি আমার পাঞ্জাবির—আমারই হবে এক পাশের ছেড়া কাপড়ের সঙ্গে একটি পকেট। এদেশে এরকম সাইড পকেটওয়ালা পাঞ্জাবি হয় না। এটা শব্নম আমার কাছ থেকে নমুনা হিসেবে নিয়ে গিয়েছিল, একদিন ওইটে আমার ঘরে পরেছিল।
এইটে পরেই কি সে আর্কে এসেছিল?
দয়াময়, দয়া কর।
অনেকক্ষণ পর মনসূর মৃদুস্বরে ফের শুধালে, কোথায় যাবেন, হুজুর?
‘তোমার বাড়ি।’
ভারী খুশী হয়ে বললে, তাই চুলন হুজুর। আমি তাকে খুশী করার জন্য প্রস্তাবটি করি নি। তার কাছ থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্য। নেমক-হারামী? হ্যাঁ। কিন্তু আমি একা, একবার নিজের সঙ্গে একা হতে চাই।
আবদুর রহমানকে নিয়েও বিপদ। শেষটায় যখন বললুম, কর্নেলের ছেলেকে বসিয়ে রাখার হক্ক আমাদের নেই—তার মা ওদিকে হয়তো ব্যাকুল হচ্ছেন তখন সে রাজী হল। বাড়িতে ঢোকার সময় হঠাৎ তার মুখে হাসি ফুটল। কেন? হায় রে! যদি বীবী সাহেবা ওই বাড়িতে ওঠেন!
মনসূর আমাকে খাওয়াবার চেষ্টা করেছিল। বলেছিল সে জানে, আমি সমস্ত দিন কিছু খাই নি। আগের রাত্রে কতখানি খেয়েছিলুম, সে পাশে বসে দেখেছে—সে তো বরের খাওয়া!
তার প্রত্যেকটি কথা আমার বুকে বিঁধছিল। কেন সে কাল রাত্রের কথা আমাকে স্মরণ করায়? আমি বললুম, ‘বাবা, আমি এখন কিছু খেতে গেলে বমি হবে।’
কোথায় যাই? কোথায় সন্ধান করি? কোথায় গেল সে? একটা মানুষ কি করে হঠাৎ অদৃশ্য হতে পারে? কেন দেখা দিচ্ছে না? জাফরকে খুন করল কাদের ভয়ে? খবর পাঠাচ্ছে না কেন? আমাকে জড়াতে চায় না বলে। কিংবা–কিংবা না, না, আমি অমঙ্গল চিন্তা করব না।
এই দুপুর রাত্রে কার কাছে গিয়ে আমি সন্ধান নিই? কড়া নাড়লে তো কেউ দরজা খুলবে না। নিশ্চয়ই ডাকাত-বাচ্চার ডাকাত। গৃহস্থ গুলি ছুড়তে পারে। তা ছুড়ুক।
মাত্র একটি প্রাণীর কথা মনে পড়ল। শব্নম বিয়ের রাতে বলেছিল না পরে? আমার যে সব গুলিয়ে যাচ্ছে-যে তার সখীদের সে ভুলে গিয়েছে। তখন একজনের নাম ও করেছিল। সে-ই তা হলে সব চেয়ে তার প্রিয় সখী। বাড়িটা আবছা আবছা চিনি-স্বামীর নাম থেকে। তখন শুনেছিলুম কান না দিয়ে। সেখানেই যাই। আর্কের অতি কাছে। হ্যাঁ, হ্যাঁ, আশ্রয় নিতে হলে সেই তো সবচেয়ে কাছে।
আর্কের কাছে এসেছি। ক্লান্তিতে পা দু’খানা অবশ হয়ে এসেছে-না শীতে। হঠাৎ মনে হল, শব্নম যদি ইতিমধ্যে বাড়ি ফিরে থাকে? হে খুদা! পাগলের মত ছুটলুম বাড়ির দিকে।
বাড়ি থেকে আবার বেরিয়েছি। কেউ ছাড়তে চায় নি। জানেমন্ শুধু বলেছিলেন, ‘বে-ফায়দা, বে-ফায়দা কিন্তু ঠেকাবার চেষ্টা করে নি।’
বাঁচালে। চাঁদ মেঘে ঢাকা পড়েছে। রাত কটা হল? ঘড়িতে দম দেওয়া হয় নি। চাঁদটা কাল রাতের কথা বড্ড বেশী স্বরণ করিয়ে দেয়। যেন আমার আপন মন নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিতে কিছু কসুর করছে!
কাবুলে দিনদুপুরেও অপরিচিতজনকে কেউ কোনও বাড়ি বাতলে দেয় না। কে জানে তুমি কে? হয়তো রাজার গুপ্তচর। তার বিপদ ঘটাতে এসেছ। বন্ধুজন যদি হবে তবে তো বাড়ি তোমার চেনা থাকার কথা।
এ-রাজা আবার ডাকু। বেধড়ক লুটপাট হচ্ছে। তার উপর রাত দুপুর। তিনটেও হতে পারে।
তবু বাড়ি খুঁজে পেয়েছিলুম। দরজাও খুলেছিল।
শব্নমের নববর গভীর রাতে নিজের থেকে এসেছে—যার সঙ্গে কোনও চেনা-শোনা নেই। আনন্দোল্লাস হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু এরা আর সব খবর ইতিমধ্যেই পেয়ে গিয়েছে। শোকে আনন্দে মিশিয়ে তারা আমাকে যা অভ্যর্থনা জানিয়েছিল সে রকমধারা অপরিচিতের বাড়িতে কেউ কখনও পায় আমি কল্পনাই করতে পারি নি। মুরুব্বীরা কেমন যেন অপরাধীর মত ম্লান হসি হেসে আমাদের একা রেখে চলে গেলেন। সখীর স্বামী বয়সে কম হলেও বিচক্ষণ লোক। আমাকে সখী-গুল্-বদন বানুর কাছে বসিয়ে কি একটা অছিলা করে উঠে গেলেন।
সম্পূর্ণ অপরিচিত আমি—শাস্ত্রে নিশ্চয়ই বারণ—তবু সে আমাকে একা পাওয়া মাত্রই আমার হাত দুখানা নিজের হাতে তুলে চোখে ঠেকিয়ে ভেজিয়ে দিয়েছিল। আমাদের নিয়ে সে কত সুখস্বপ্ন দেখেছিল সে কথা বলতে বলতে বার বার তার গলা বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল আর কখনও বা হাউহাউ করে কেঁদে উঠেছিল।
‘কোথায় যতে পারে? তাকে কে না স্থান দেবে? কিন্তু আমার বাড়িতে না এসে অন্য কার বাড়িতে যাবে? আমার শ্বশুর তার জ্যেঠার বিশেষ বন্ধু।’
হঠাৎ তার কি খেয়াল গেল জানি নে। বলে উঠল, ‘তাই হয় তো হবে, হ্যাঁ, তাই!’ যেন আপন মনে চিন্তা করছে। আমি কোনও কথায় বাধা দিই নি। পাছে সামান্যতম কোনও দিকনির্দেশ তারই ফলে কাটা পড়ে যায়, এবং পরে সেটা তার স্মরণে না আসে।
বললে, তাই বোধ হয় সে তার অতি অল্প চেনা কোনও লোকের বাড়িতে গিয়েছে। একসঙ্গে দুজনাতে বলে উঠলাম, তাহলে খোঁজ নেব কোথায়?
গুল্-বদন বানুর শোক, দুশ্চিন্তা উদ্বেগের গভীরতা আমার ভাগ্য নিপীড়নের কাছে এসে দাঁড়াল যেন একাত্মদেহ সখার মত। এ তো সান্ত্বনা নয়, প্রবোধ-বাণী নয়, এ যেন আমার হয়ে আরেকজন আমার সমস্ত দুর্ভাবনা আপন কাঁধে তুলে নিয়ে দূর দূরান্তে তাকিয়ে দেখছে, কোথায় গিয়ে সে ভার নামানো যায়।
‘কিন্তু খবর পাঠাচ্ছে না কেন? ধরা পড়ার ভয়ে, সুযোগ পায় নি বলে?—কেউ তাকে আটকে রেখে সুযোগ দিচ্ছে না বলে?—আপন মনে গুল্-বদন বানু কথা বলে যাচ্ছে, আর মাঝে মাঝে আমার হাত দুখানা আপন হাতে তুলে নিচ্ছে।
‘এই আমাদের প্রথম দর্শন—আর শব্নম কাছে নেই।’
এবার সে কেঁদে ফেললে।
তার স্বামী আপন হাতে খুঞ্চায় করে রুটি–গোস্ত নিয়ে এসেছেন। চাকরের মত হাত ধোবার জাম-বাটি ধারাযন্ত্র নিয়ে এলেন তারপর। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি ওঁকে শান্ত করবে না, তুমিই ভেঙে পড়ছ। অতি শান্তকণ্ঠে, কোনও অনুযোগ না করে।
আমি বললুম, ‘আমার বমি হয়ে যাবে।’
সেই কণ্ঠেই বললেন, ‘তা যাক। যেটুকু পেটে রইবে সেইটুকুই কাজে লাগবে।’
পাশে বসে বাঁ হাত দিয়ে পিঠে হাত বুলাতে বুলতে ডান হাত দিয়ে খাবার তুলে দিয়েছিলেন। গুল্-বদন সামনে এসে হাঁটু গেড়ে খাড়আ গোড়ালির উপর বসে সামনে তোয়ালে ধরে দাসীর মত সেবার অপেক্ষা করছিল।
এরা বড়লোক। সেবা করার সুযোগ পেলে এরা জন্মমাসকে হার মানায়।
আমি বললুম, এবার উঠি। আমার সব শোনা হয়ে গিয়েছে। ইতিমধ্যে গুল্-বদন বানু জানুর উপরে কাগজ রেখে পরিষ্কার গেটগোট অক্ষরে শব্নমের সম্ভব অসম্ভব সব পরিচিতদের ফিরিস্তি তৈরি করেছেন। স্বামী মাঝে মাঝে তাকে সাহায্য করলেন। গুল্-বদন বার বার আমাকে বললে, তোমাকে কিছু করতে হবে না। এসব জায়গায় আমার শওহর-স্বামী যাবেন। তার স্বামী স্বল্পভাষী। বললেন, ‘এ বাড়িতে আমার কোনও কাজ নেই। আমি ছোট ছেলে। আপনাকে কথা দিচ্ছি, আমার কোনও ত্রুটি হবে না। আমানুল্লার পরিত্যক্ত যেসব সত্যকার ভালো গোয়েন্দা ছিল তারাই আমাকে সাহয্য করবে। কিন্তু কঠিন কাজ। আমি শব্নম বীবীকে চিনি। তিনি যদি মনস্থির করে থাকেন কেউ যেন তার খবর না পায়, তবে তিনি এমনই পরিপাটিরূপে সেটা করবেন যে সে গিঁঠ খোলা বড় কঠিন হবে।’
আমি ধন্যবাদ জানাই নি। উঠে দাঁড়ালুম। গুল্-বদন চেচিয়ে উঠলেন, এ রাতে আপনি কোথায় যাবেন? ঝড় উঠেছে।
তার স্বামী বললেন, চলুন। চকমেলানো বাড়ির চত্বরে নামতে দেখি, উপরের বহু ঘরে আলো জ্বলছে। মুরুব্বিরা জেগে আছেন।
চত্বরেই বুঝলুম ঝড় কত বেগে চলেছে। যদিও চতুর্দিকে তিনতলা ইমারতে ইমারতে নিরন্ধ্র বন্ধ।
দেউড়ি খুলতেই আমরা ব্লিজার্ডের ধাক্কায় পিছিয়ে গেলুম। বরফের সাইক্লোন। সামনে এক বিঘতও দেখা যায় না।
স্বামী বললেন, আপনি না দেখলে বিশ্বাস না করে ঘরের ভিতর শুধু ছটফট করনে। এবারে চলুন। ঘরে গিয়ে আলো নেবাই। না হলে মুরুব্বিরা জেগে রইবেন।
প্রথম আঘাতে মানুষ বিমূঢ় হয়ে যায়। তারপর আসে ভাগ্য-বিধাতার উপর দিগ্বিদিক শূন্য অন্ধ ক্রোধ। তারপর নিজব অসাড়তা।
কিন্তু সে জাড্যে নিদ্রা আসে না।
দেশের মেঘলা ভোর তবু বোঝা যায়। এ দেশে বরফের ঝড়ের পিছনে সূর্যোদয় পঞ্চেন্দ্রিয়াতীত ষড়যন্ত্রযোগে অনুভব করতে হয়।
ওরা বাধা দেয় নি। ঝড় থেমেছে কিন্তু যে ভাবে একটানা বরফ পড়ছে তার ভিতর আমি কিছুতেই বাড়ির পথ খুঁজে পেতুম না। আমার বার বার মনে হচ্ছিল, পথপ্রদর্শক আমাকে ঠিক উল্টো পথে নিয়ে যাচ্ছে।
আশ্চর্য! এমন জিনিসও মানুষ এসময় ভোলে! গুল্-বদনের ফিরিস্তি সঙ্গে আনি নি।
আমি কোথায় পৌঁছলুম!