৩.১ যে মানুষ ছেলে-বয়স থেকে অন্ধের সেবা করেছে

তৃতীয় খণ্ড

যে মানুষ ছেলে-বয়স থেকে অন্ধের সেবা করেছে তার সেবা হয় নিখুঁৎ। এতখানি পাওয়ার পরও যে আমি শব্‌নমের সেবার দিকে খুঁৎখুঁতে চোখে তাকিয়েছিলুম, একথা বললে নিজের প্রতি অপরাধ করা হয়। আমি দেখেছিলুম, অনুভব করেছিলুম তার সেবা-নৈপূণ্য, আর্টিস্টের মডেল যে রকম ছবিটি যেমন যেমন এগোয় তকে মাঝে মধ্যে সন্তুষ্ট নয়নে দেখে যায়।

ভোরবেলা অনুভব করলুম, চতুর্দিকে লেপ গুঁজে দেওয়ার সময় তার হাতের ভীরুস্পর্শ।

সকালবেলা সামনে যে ভাবে চায়ের সরঞ্জাম সাজালে তার থেকে বুঝলুম, কান্দাহারে যে হাত বুলবুল-গুলের মাঝখানে বিচরণ করেছে সে মাটিতে নামতে ও জানে।

হঠাৎ লক্ষ্য করলুম, শব্‌নমের চোখ দুটি লাল। আমার হাতের পেয়ালা ঠোঁটে যাবার মাঝপথে থমকে দাঁড়ালো।

শব্‌নম বুঝেছে। বললে, আজ অতি ভোরে বাবা কান্দাহার চলে গিয়েছেন। তোপল্‌ খান এসে খবর দিলে, আমানুল্লা তাকে তার শেষ ভরসার মালিকরূপে চিনতে পেরেছেন। বাবা জানেন, আমানুল্লার সর্বআমির-ওমরাহ তাকে বর্জন করেছেন, কুরবানীর ছাগলকেও মানুষ জল দেয়, তারা—থাকগে।

‘যাবার সময় বলে গেছেন, তুমি যেন সকালবেলাই ব্রিটিশ লিগেশনে নিজে গিয়ে আমাদের বিয়ের দলিল জিম্মা করে আসো!’

আর কি বলেছেন?

‘বলেছেন, সুযোগ পেলে তুমি একাই হিন্দুস্থানে চলে যেয়ো।’

তুমি? সেই তো ভালো।

না। তুমি। তার মুখ খুশীতে ভরে গিয়েছে। বললে, জান, আব্বা এখন তোমাকে আমার চেয়েও বেশী ভালবাসেন। বললেন, ‘কেন বেচারীকে আমাদের ঘরোয়া বিপদের ভিতর জড়ালুম।’ এই প্রথম দেখলুম, বাবা কোনও কাজের জন্য অনুশোচনা করলেন। তখন আমি তাকে বললুম-অবশ্য আমি আগেই স্থির করে রেখেছিলুম, এক দিন না এক দিন জানেমন্‌কে দিয়ে বলাবো—যে তোমাকে আমি আগের থেকেই ভালবাসতুম। আমাদের প্রথম শাদীর কথাটা কিন্তু বলি নি। সেটা বলবো, যেদিন তাঁর কোলে তাঁর প্রথম নাতি দেব। বাবা ভারী খুশী হয়ে নিশ্চিন্ত মনে কান্দাহার গেছেন।

আমি ব্যাপারটা হৃদয়ঙ্গম করার চেষ্টা করলুম। শেষটায় বললুম, তোপলের সঙ্গে একবার দেখা হল না।

বললে, সে আস্তে আস্তে তোমাকে দেখে গেছে। তুমি তখন ঘুমুচ্ছিলে। আর তোমাকে বলতে বলে গেছে, সব কিছু চুকেবুকে গেলে তার আপন দেশ মজার-ই-শরীফে আমাকে নিয়ে যেতে।

ছোট্ট বাচ্চাকে মা যে রকম জামা কাপড় পরাতে ইচ্ছে করে দেরী করে, প্রতিপদ চড়াবার পর বাচ্চাটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে, শব্‌নম ঠিক সেই রকম আমাকে জামকাপড় পরালে। যখন আমার জুতোর ফিতে বাধতে গেল মাত্র তখনই বাধা দিয়েছিলুম।

শব্‌নমের মুখে হাসি কান্না মাখানো। তার পিছনে গাম্ভীর্য। আমি ঠিক বুঝতে পারলুম না।

দেউড়ি পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে বললে, ‘বেশী দেরী করো না।’

তার পর কানে কানে বললে, তুমি আমার মিলনে অভ্যস্ত হয়ে যেয়ো না।

বয়স্করা বেরুচ্ছে না, বাচ্চারা রাস্তায় খেলা করছে ঠিকই।

ইংরিজীতে প্রবাদ আছে, ‘দেবদূত যেখানে যেতে ভয় পান, মূর্খেরা সেখানে চিন্তা না করে ঢোকে।’ এর উল্টোটাও ঠিক। মৃত্যুভয় শুধু মূর্খের, তাই বয়স্করা বেরুচ্ছে না। বাচ্চারা দেব-শিশু, তারা নির্ভয়ে খেলছে। যেটা খেলছে সেটা শুধু এই সময়েই এবং শীতের দেশেই সম্ভব। কবুলের অষ্টাবক্রপৃষ্ঠ রাস্তার জায়গায় জায়গায় জল জমে যায়— সে কিছু নূতন কারবার নয়—সেই জমা জল ফের জমে গিয়ে বরফ হয়ে দিব্য স্কেটিং-রিষ্ক হয়ে দাঁড়ায়। সাবধানী পথিকও সেখানে পা হড়কে দড়াম করে আছাড় খায়। বাচ্চাদের সেইটেই স্বর্গপুরী। অন্যত্র বলেছি, কাবুলীরা পায়জারে শত শত লোহার পেরেক ঠুকে নেয় বলে তার তলাটা সবসুদ্ধ জড়িয়ে মড়িয়ে হয়ে যায় পিছল। বাচ্চারা শুকনো মাটিতে একটুখানি দৌড়ে এসে সেই বরফের উপর নিজেকে ব্যালান্‌স করে সামনের দিকে একটু ভর দেয় এবং সাঁই করে বরফের অপর প্রান্তে পৌঁছে যায়। আমরা দেশে যে রকম নদীর ঢালু পাড়েতে জল ঢেলে সেটাকে পিছল করে সুপুরীর খোল দিয়ে আসন বানিয়ে হড়হড় করে নিচে নেমে যাই।

মাঝে মাঝে দেউড়ির মুখে দাঁড়িয়ে কোনও কোনও মা ছেলেকে গালিগালাজ দিয়ে বাড়ির ভিতরে ডাকে—ত্বআয় পিদর-সুখ্‌তে—ওরে পিতৃদহ (বাপকে যে পুড়িয়ে মারে), তোর বাপ নির্বংশ হোক—তোর যম বাড়ির ভিতরে না বাইরে? এখনি ভিতরে আয় বলছি।

‘মাদর-সুখ্‌তে’ বা ‘মাতৃদহ’ কখনও শুনি নি। বোধ হয় উড়ো খইয়ের মত নরকাগ্নিকুণ্ডও ‘জনকায় নমঃ।’

বিট্রিশ লিগেশনের যে কর্মচারীর সঙ্গে আমার শ্বশুরমশায়ের কথাবার্তা হয়েছিল তিনি আমাকে সাদর অভ্যর্থনা জানালেন। আমি কিছু বলার পূর্বেই আমাকে অভিনন্দন জানালেন, মিষ্টিমুখ করালেন। ইনি পেশাওয়ারের লোক। তবে কি কৌটিল্য ওই অঞ্চলের লোক? গুপ্তচর বিদ্যা উত্তরাধিকারসূত্রে দাক্ষিণ্য পেয়েছেন? কিন্তু লোকটি চমৎকার। বিয়ের দলিলখানা লোহার সিন্দুকে তুলতে তুলতে বললেন, ‘অনবদ্য হাতের লেখা। মনে হয়, দলিল নয়, ছন্দে গাথা অভিনন্দন পত্র। আমি যত শীঘ্র পারি বাচ্চাই-সকাওকে কথাচ্ছলে জানিয়ে দেব যে হিন্দুস্থানে আফগানিস্থানে যুগ যুগ ধরে যে ‘আতাঁৎ কর্দিয়াল’-‘হার্দিক রাখীবন্ধন’-গড়ে উঠেছে এই বিয়ের মারফতে তারই এক নূতন অধ্যায় আরম্ভ হল।

যিনি এতখানি সহৃদয় তাঁকে ওকীব-হাল করতে হয়। তবু একটু চিন্তা করে বললাম, সর্দার আওরঙ্গজেব খান আজ ভোরে কান্দাহার চলে গেছেন।

চমকে উঠে বললেন, ‘সে কী!’ একটু ভেবে বললেন, নিশ্চয়ই ছদ্মবেশে।

আরও কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, এটা কি ভালো করলেন? আমি অবশ্য তার রাজনৈতিক চালের কথা ভাবছি নে, আমি ভাবছি, তিনি এই দুর্দিনে সবাইকে কার হাতে ছেড়ে দিয়ে গেলেন?

আমি কিছু বলবার পূর্বেই তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, অবশ্য তেমন কিছু দুশ্চিন্তা করার নেই।

এ ভদ্রলোক আমাকে সাধারণত সহজে ছাড়তে চান না। আজ অবশ্য দেশের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছে।

আমাদের দেশেরই যখন বহু পাখি শীতকালে হাওয়া বদল করতে যায় তখন এই শীতের দেশে লতাপাতা কীটপতঙ্গহীন ঋতুতে থাকবে কে? তবু হঠাৎ দেখি, একজোড়া ক্ষুদে পাখি একে অন্যকে তাড়া করছে, বরফে লুটোপুটি খাচ্ছে, ফুরুৎ ফুরুৎ করে পলক থেকে বরফের গুড়ো ঝাড়ছে। আমাকে দেখে উড়ে গিয়ে গাছের একটা ন্যাড়া ডালে বসল।

আমি জানি এসব পাখি মানুষের দাক্ষিণ্যের উপর নির্ভর করে, এবং শুধু জৈনরাই পিঁপড়েকে চিনি খাওয়ায় তাই নয়, কঠোর-দর্শন কবুলী খানসাহেবকেও আমি জোব্বার জেব থেকে শুকনো রুটি বের করে টুকরো টুকরো করে ছুঁড়ে দিতে দেখেছি।

আমি গাছটার কাছে আসতে আবার উড়ে গিয়ে রাস্তার পাশের আরেকটা গাছে বসল। আমার পকেটে কিছু ছিল না বলে বড় দুঃখ হল। কাবুল শহরে না পৌঁছন পর্যন্ত এরা উড়ে উড়ে আমাকে সঙ্গ দিল।

শব্‌নমের যত কাছে আসছি আমার হৃদয়ের ক্ষুধা ততই বেড়ে যাচ্ছে। কাল রাতে তাকে পেয়েছি পাওয়ার সীমা ছাড়িয়ে। আর আজ এই ঘণ্টা দুইয়ের বিচ্ছেদে প্রাণ এত ব্যাকুল হয়ে উঠল? এতদিন পরে বুঝতে পারলুম, লাখ লাখ যুগ ধরে হিয়ায় চেপে রাখলেও হিয়া জুড়োয় না।

এ কি? বাড়ির সদর দরজা খোলা কেন? কাবুলে তো এরকম হয় না—শাস্তির সময়ে, দিন দুপুরেও।

একটু ইতস্তত করে বাড়িতে ঢুকলাম।এ কি! এত যে চাকর দাসদাসী আঙ্গিনা ভর্তি করে থাকে, আজও সকালে বিয়ের পরের দিনের কি এক পরব তৈরী করতে লেগে গিয়েছিল, তারা সব গেল কোথায়? জিনিসপত্র তেমনি ছাড়ানো। সিঁড়ির মুখে একটা কলসী কাত হয়ে পড়ে আছে; তার জল জমা হয়ে খানিকটা বরফ হয়ে গিয়েছে। কাবুলীর কি অমঙ্গল চিহ্ন চেনে না?

আমার বুকের ভিতর কি রকম করতে লাগল। আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছি নে।

কাকে ডাকি? আমি তো কারোরই নাম জানি নে।

হঠাৎ কি অজানা অমঙ্গল আশঙ্কা মনে জেগে উঠল। ছুটে গেলুম আমাদের বাসর ঘরের দিকে। খোলা দরজা খাঁ খাঁ করছে।

‘শব্‌নম’, ‘শব্‌নম’-চেঁচিয়ে উঠলাম। কোনও উত্তর নেই।

সবকিছু সাজানো গোছানো। এক ঐ চা পর্যন্ত। শুধু একদিকে একটি ছোট পেয়ালা চা-তার আধ পেয়ালা খাওয়া হয়েছে।

এঘর ওঘর সব ঘর খাঁ খাঁ করছে। সেই পাগলের মত ছটোছুটির ভিতর একই ঘরে ক’বার এসেছি বলতে পারব না। এমন কি জানেমনের ঘরেও গেলুম। সেখানেও কেউ নেই।

অমার জ্ঞান বুদ্ধি সব লোপ পেয়েছে। আঙ্গিনায় নেমে শুষ্ককন্ঠে চেচাতে লাগলুম, ‘কে আছ, কোথায় আছ? কে আছ, কোথায় আছ?’

কতক্ষণ কেটে গেল কে বলতে পরে।

আমার পিছন থেকে কে এসে আমার দু-পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে আরম্ভ করেছে। এ বাড়ির চাকর। আমি ভাঙা গলায় যতই তাকে প্রশ্ন করি সে আরও চিৎকার করে কাঁদে। সে বরফের উপর শুয়ে পড়ে গোঙরাতে আরম্ভ করেছে।

দেউড়ি দিয়ে আরও লোক ঢুকছে! বাড়ির দাসদাসী। আমাকে ঘিরে তারা চিৎকার করে সবাই কাঁদছে। বুক-ফাটা কান্না—জিগরের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে। সবাই আমার পা, হাঁটু, জানু জড়িয়ে ধরবার চেষ্টা করছে।

এই অর্ধচেতন অবস্থায় বুঝতে পেরেছি, নিদারুণ অমঙ্গল না হলে এতগুলো মানুষ এরকম মাথা খুঁড়তে পারে না।

এরই মাঝখানে ভিড় ঠেলে সেই কলেজের ছোকরাটি আমার কাছে এগিয়ে এল। সেও পাগড়ির লেজ দিয়ে মুখ নাক ঢেকে সেটা বাঁ হাত দিয়ে ধরে আত্মগোপন করছে। প্রথমটায় আমিও তাকে চিনতে পারি নি। তার চোখে আতঙ্ক, ঘৃণা আর কান্না। পাড়া প্রতিবেশির ভিতর একমাত্র সেই সাহস করে দুঃসংবাদ দিতে এসেছে। যত বড় দুঃসংবাদই হোক আমি সেটা শুনব। অনিশ্চয়তার যন্ত্রণা থেকে হোক সেটা দুঃসহতর অসহ্য। কানের কাছে মুখ রেখে চেঁচিয়ে বললে, ‘শব্‌নম বীবীকে বাচ্চার সেনাপতি জাফর খানের লোক নিয়ে গিয়েছে-।’ আমার পায়ের তলায় যেন কিছু নেই। ছেলেটি আমার কোমড় দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে আকুল কণ্ঠে বললে, “হুজুর, এসময়ে আপনি অবশ হবেন না। আপনার জ্যাঠা শ্বশুরমশাই তাঁর সন্ধানে আর্ক দুর্গে গিয়েছেন। আপনাকে বাড়িতে থাকতে বলে গিয়েছেন। বলে গিয়েছেন, আপনি যেন কিছুতেই না বেরোন।”

আমাকে ধরাধরি করে জানেমনের ঘরে পৌঁছে দিয়ে বললে, ‘আমি আর্কে চললুম খবর নিতে।’

কতক্ষণ কি ভাবে কেটেছিল বলতে পারব না। দাস-দাসীরা কাঁদছে। দু-একজন যেন কথাও বলছে, কান্নার সঙ্গে সঙ্গে। কেন সর্দার আওরঙ্গজেব চলে গেলেন? তিনি থাকলে তো এরকম হত না। কেন তিনি কড়া মানা করে গেলেন, কেউ নে ডাকুদের সঙ্গে লড়তে না যায়। তোপল্‌ থাকলে, হুকুম পেলে একাই তো বিশ জনকে শেষ করতে পারতো। ওরা-নিজেরাও তো কিছু কাপুরুষ নয়! আরও অনেক ফরিয়াদ তারা করেছিল।

এদের ভিতর যে সবচেয়ে বৃদ্ধ সে আমাকে বিছানা থেকে তুলে একটা চেয়ারে বসালে। তার চোখ শুকনো। মনে হল সে কাঁদে নি, কথাও বলে নি। আমি কোনও কথা বুঝতে পারছি না দেখে আমাকে ধীর কণ্ঠে বললে, ‘ছোট সাহেব, আপনি শক্ত হন। আপনি এ বাড়ির জোয়ান মালিক। আপনি ভেঙে পড়লে এই এতগুলো লোক পাগল হয়ে কি যে করবে ঠিক নেই। এরা প্রথমটায় প্রাণের ভয়ে প্রতিবেশীদের বাড়িতে লুকিয়েছিল। এখন আবার ক্ষেপে গিয়ে কি যে করবে বলা যায় না। বাচ্চার ডাকুরা লুটপাট করে নি কিন্তু এখন আর সবাই আসবে বাড়ি লুট করতে। আমি কিছুই বলি নি। এ বাড়িটা রক্ষা করাই কি এখন আমার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য?’

আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে বললে, দেখুন হুজুর, এ বাড়ির কত সম্মান, কত বড় ইজ্জত। সর্দার আওরঙ্গজেব পরিবারের বাস্তুভিটে না হয়ে আর কারো হলে এতক্ষণে পাড়া প্রতিবেশীরাই এ বাড়ির দোর জানালা পর্যন্ত লুট করে নিয়ে যেত।

আমি তখনও কোনও সাড়া দিচ্ছি নে দেখে হতাশ কণ্ঠে বললে, এই যে এতগুলো লোক, এদের জীবন-মরণ আপনার হাতে। সর্দার হুকুম দিয়েছিলেন, বাচ্চার লোককে যেন কোনও বাধা না দেওয়া হয়। এখন অন্য লোক লুট করতে এসে এদের মেরে ফেলতে পারে-আপনি হুকুম না দিলে এরা যে পাগলের মত কি করে ফেলবে তার কোনও ঠিক নেই।

ওই একই কথা বার বার বলে।

‘আপনার শ্বশুরমশাই, জ্যাঠাবশুরমশাই আপনার প্রতি যে আদেশ রেখে গেছেন সেটা পালন করুন। শব্‌নম বীবীর জন্য যা করার সে তাঁর জানেমন্‌ করবেন।’

এবারে শেষ অস্ত্র ছাড়লো—তিনি ফিরে এসে যদি শোনেন আপনি ভেঙে পড়েছিলেন তখন কি ভাববেন?

আমি তখন উঠে দাঁড়িয়ে তাকে আদেশ করলুম, বিট্রিশ লিগেশনের সেই ভারতীয় কর্মচারীকে সব খবর দিয়ে আসতে। কি ভাবে কি হয়েছিল আমি এখনও জানি নে লিখে জানাব কি?

এইবারে তার চোখে জল এল। অস্ফুট কন্ঠে আল্লার বিরুদ্ধে কি এক ফরিয়াদ জানালে। রওয়ানা হওয়ার সময় তবু তার মুখের উপর কি রকম যেন একটা প্রসন্নতা দেখা গেল। বোধ হয় ভেবেছে, তবু শেষটায় বাড়ির কর্ণধার পাওয়া গেল।

হায় রে কর্ণধার!

একজনকে আদেশ দিতে বাকীরা কি জানি কি ভেবে, অন্ধভাবে কি যেন অনুভব করে চলে গেল।

আমি শব্‌নমের-আমার-আমাদের, আমাদের মিলন রাত্রির ঘরে আর যাই নি।

শব্‌নম নাকি দাস-দাসীদের হাতিয়ার নিয়ে বাড়ি রক্ষা করতে দেয় নি। বোরকাটা পরে নিয়ে ওদের সঙ্গে সঙ্গে চলে গিয়েছিল। জানেমন্‌ ডাকাতদের বলেছিলেন, শব্‌নম বিবাহিতা রমণী। তাঁর কথায় কেউ কান দেয় নি। তিনি সঙ্গে সঙ্গে রওয়ানা হন। দু’জন লোক তাকে ধরে নিয়ে গিয়েছে।

আমাকে কি ঐ বাড়ির তদারকির জন্যই রেখে গেলেন? আমি কি অন্য কোনও কাজের উপযুক্ত নই?

আমি যাব আর্কে? এ বাড়িতে আমার কি মোহ?

এই সময়ে লোকে চা খায়! দেখি, শব্‌নমের বুড়ী সেবা-দাসী চা নিয়ে এসেছে।

আমাকে একটি চিরকুট এগিয়ে দিল। বোধ হয় ভেবেছে, আমি কিছুটা প্রকৃতিস্থ হয়েছি।

দুটি মাত্র কথা। বাড়িতে থেকো। আমি ফিরব।

আমি কাপুরুষ নই, আমি বীরও নই। এরকম অবস্থায় মানুষ ভানভনিতাও করতে পারে না। আমার ভিতরে যা আছে, তা ধরা পড়বেই।

বৃদ্ধকে বাড়িতে বসিয়ে যেতে পারতুম। অন্য কাউকে লিগেশনে পাঠালেই তো হত।

না, সর্দার হওয়ার মত ধাত দিয়ে বিধাতা আমাকে গড়েন নি।

কিন্তু লিগেশনে খবর পাঠাবার মত সম্বিতমান লোক ওই তো একমাত্র ছিল। অন্য কাউকে পাঠালে যে দুশ্চিন্তা থাকত সে লোকটি খবর ঠিক জায়গায় ঠিকমত পেছিয়েছে কি না।

না, সর্দার হওয়ার মত ধাত দিয়ে বিধাতা আমাকে গড়েন নি।

শব্‌নমের কোনও কথা তো আমি কখনও অমান্য করি নি। অনেকে অনেক কথা বলবে, অনেকে অনেক উপদেশ দেবে, তাই সে যাবার সময় স্থির বুদ্ধিতে পাকা আদেশ দিয়ে গিয়েছে।

এখন না হয় সবাই আমাকে বাড়িতে থাকতে বলছে, কিন্তু যদি বিপদ কেটে যায়, হ্যাঁ, যদি বিপদ কেটে যায়, তবে একদিন সবাই ভাববে না যে আমি ভীরুর মত বাড়িতে হাত পা গুটিয়ে বসে রয়েছিলুম, সবাই যখন আর্কে।

হায়রে আত্মাভিমান! সবাই যেন বোঝে আমি বীরপুরুষ!

কার কাছে আত্মাভিমান? শব্‌নম কি এতদিনে জানে না, আমি বীর না কাপুরুষ। সে তো প্রথম দিনে-না, প্রথম মুহূর্তেই আমাকে চিনে নিতে পারে নি?

লোকজনদের সবাই এখন আমার বাড়ি চেনে। একজনকে ডেকে বললুম, যাও তো, আবদুর রহমানকে ডেকে নিয়ে এস।

হে খুদাতালা, তুমি আমাকে পথ দেখাও। আমার আনন্দের দিনে তুমি আমাকে শিখিয়েছিলে তোমাকে স্মরণ রাখতে। আজ এই চরম সঙ্কটের দিনে সেই অনুগ্রহ কর, মহারাজ! আমি তোমাকেই স্মরণ করছি।

খবর এল, আবদুর রহমান আমার ছাত্রের কাছ থেকে খবর পেয়ে প্রীতবেশী কর্ণেলের ছেলেকে বাড়িতে বসিয়ে আর্কে চলে গেছে।

তারপর আমার মতিভ্রম আরম্ভ হল।

স্বপ্ন দেখি নি, সে আমি ঠিক ঠিক জানি। যেন স্পষ্ট, স্পষ্ট কেন, স্পষ্ট হতেও স্পষ্টতর দেখতে পাচ্ছি, আমি মায়ের এক জানুতে শব্‌নম অন্য জানুতে বসে আছে আর মা কলাপাতার সামোসাতে মোড়া ধান-দূর্বা আমাদের মাথার উপরে রেখে আশীর্বাদ করছেন। জাহানারা আর কুটি মুটি মাটিতে শুয়ে সক্কলের আগে নূতন চাচীর মুখ দেবার চেষ্টা করছে।

সম্বিতে ফিরেছিলুম বোধ হয় মায়েরই পুণ্যবলে, তাঁরই আশীর্বাদের ফলে।

মনসুর সামনে দাঁড়িয়ে। সেই কলেজের সহৃদয়, বীর ছেলে।

নতমস্তকে বললে, আপনার জ্যাঠাঘশুর সোজা নূতন বদশা বাচ্চাইসকাওয়ের দরবারে চলে যান। সে আর্কে ছিল না। তিনি মোল্লাদের উদ্দেশ্য করে জাফর খান এবং তার দলবলকে চিৎকার করে অভিসম্পাত দিতে থাকেন। তাকে একটা ছোট কুঠরিতে বন্ধ করে রাখা হয়েছে।

আমি উঠে দাঁড়িয়ে তাকে আলিঙ্গন করে বললুম, তুমি আমার অনেক উপকার করলে। এর চেয়ে মহত্ত্বর কোনও গুরুদক্ষিণা নেই।

রাস্তায় নেমে বললুম, এবারে তুমি বাড়ি যাও।

বাড়ির লোক আবার অট্টরোল করে উঠেছে। ছেলেটি সঙ্গে সঙ্গে চলতে চলতে আমাকে বার বার যেতে মানা করছে, আর বলছে সেখানে গিয়ে কোনও লাভ নেই।

আশ্চর্য! ওদের কথা, ওদের অনুনয় আমি ঠিকমত শুনি নি কিন্তু নেড়া চিনার গাছের ডগায় যে ষোড়শীর চাদ উঠেছে, সেটা ঠিক লক্ষ্য করেছি। বুকে যেটুক রক্ত ছিল সেও যেন জমে গেল। কাল রাত্রে শব্‌নম এই চাঁদের-

রাস্তায় প্রচণ্ড ভিড়। আর্কে ঢোকে কার সাধ্য। ঘোড়সওয়ার অনেক। তারা বেপরোয়া মানুষের ভিতর দিয়ে, উপর দিয়ে, তাদের জখম করে চলেছে আরও বেপরোয়া হয়ে আর্কের দিকে, আর আর্কের ভিতর থেকে আরেক বিরাট জনধারা বেরিয়ে আসতে চাইছে শহরের দিকে। দুদিক থেকেই জনসংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে প্রতি মুহূর্তেই এবং দুই জনোচ্ছাস মিলে গিয়ে যে খণ্ড খণ্ড আবরে সৃষ্টি হয়েছে তার থেকে কোনও দিকেই কেউ এগুতে পিছোতে পারছে না। অথচ চাপ দুদিক থেকে বেড়েই যাচ্ছে ক্রমাগত। কেউ যেন আপন সম্বিতে নেই।

এই প্রথম আমি আমার আপন সম্বিতে ফিরে এলুম।

এতক্ষণে বুঝতে পারলুম, এ জনতা ভেদ করে মনসুরের আসতে সময় লেগেছিল কেন?

হঠাৎ দেখি, দূরে তিন জন ষোড়সওয়ার জনতার উপর মাথা তুলে আর্ক থেকে বেরিয়ে শহরের দিকে আসছে। তাদের গতি অতি মন্থর, কিন্তু দৃঢ়। মাঝখানের সওয়ার নিষ্ক্রিয়, নিরুদ্বেগে বসে আছে। পাশের দুই সওয়ার বল্লম না কি দিয়ে যেন নির্মমভাবে উত্ত জনতাকে খোঁচা দিচ্ছে, পথ করে দেবার জন্য।

চাঁদের আলো মুখে পড়েছে। এ কি? এ তো জানেম্‌ন।

চিৎকার করে উঠেছিলুম, ‘জানেম্‌ন, জানেম্‌ন, জা—।’

কে শোনে?

আমার শরীরে হাতির বল থাকলেও আমি তাঁর দিকে এগুতে পারতুম না। জনতরঙ্গের যে সামান্যতম গতিবেগ সে আমাকে নিয়ে চলেছে বড় রাস্তার দিকে।

নিরঙ্কুশ দুর্ভাগ্য সারি বেঁধে আসছে দেখে নিপীড়িত জন পাছে অজ্ঞান হয়ে সর্ব যন্ত্রণা থেকে নিষ্কৃতি পায় তাই ব্যঙ্গরাজ কিন্মতাধিপতি মাঝে মাঝে অভাগার কপালেও লক্ষ্মীর অঞ্চল বুলিয়ে দেন। আমি জনপীড়ায় অনিচ্ছায় সরছি শহরের দিকে, জানেমনের গতিও সেদিকে—যদিও তিনি অনেক দূরে। একটুখানি কম ভিড় পৌঁছতেই আমি নেমে গেলুম রাস্তার পাশের বরফ-জমা নয়ানজুলিতে। সেখানে তাঁর পৌঁছতে লাগল যেন অনন্তকাল। চার-পাঁচ জন লোক তাঁর ও অন্য দুই ঘোড়সওয়ারের গা ঘেঁষে ঘেঁষে চলছে—এদের দলেরই হবে। এদেরই একজন আমাকে চিনতে পেরে চিৎকার করে উঠল। আমিও সঙ্গে সঙ্গে জানেমন্‌কে ডেকেছিলুম, কিন্তু আমার গলা দিয়ে শব্দ বেরোয় নি।

জানেমনের মুখের দিকে আমি এক লহমার তরে তাকিয়েছিলাম।

বিকৃত, বিকট, বীভৎস-যেন এর কোনোটাই নয়-কিংবা সব কটাই—তিনি কিন্তু সেগুলো সংহরণ করে নিয়েছেন রুদ্ররাজ পূষনের মত। এক চোখ দিয়ে রক্ত ঝরে বাম গালে জমে আছে।

তিনি নেমে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। তার হৃদস্পন্দন আমি অনুভব করতে পারি নি। শুনেছি, যোগীরা নাকি স্বেচ্ছায় সেটা বন্ধ করে দিতে পারেন। মনে হল, তিনি স্বেচ্ছা অনিচ্ছার বাইরে।

ঘোড়সওয়াররা আর্কের দিকে ফিরে গেল। সঙ্গীর পিছনে পিছনে এল। তাদেরই একজন শুধু বার বার বিড়বিড় করে বলছে, ‘আমার কোনও দোষ নেই।’

জানেমন্‌ আমাকে হাত ধরে নিয়ে যে ভাবে দৃঢ়পদে চলেছেন, তাতে আমাকেই জ্যোতিহীন বলে মনে হবে। তিনি কোনও কথা বলছিলেন না। তবু বুঝলুম, তিনি আমাদের কর্তব্যাকর্তব্য স্থির করে ফেলেছেন। মাঝে মাঝে শুধু আমার ডান হাতখানা তার বুকের উপর চেপে ধরছিলেন। আমার অশান্ত ভাব দেখে শেষটায় বললেন, ‘শব্‌নম আর্কে নেই। তার সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না।’

বাড়িতে ঢুকলে আবার কান্নার রোল পড়ল। শব্‌নমের বাড়ি ফেরার ক্ষীণতম আশাটুকুও আমাদের গেল।

সেই বৃদ্ধ লিগেশন থেকে ফিরে এসেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *