ঘুম-ভাঙা-ঘুম লাগা কল্পনা-স্বপ্নে-জড়ানো রাতের শেষ হল সূর্যোদয়ের অনেক পর। কাল রাত্রে তো পারিই নি, আজ সকালেও বুঝতে পারলুম না, কাল রাত্রে কি হয়ে গেল। এ কি আরম্ভ, না এই শেষ! এ কি অন্ধকার রাত্রে চন্দ্রোদয়ের মত আমার ভূবন প্রসারিত করে দেবে, না এ হঠাৎ চমক-মারা বিদ্যুল্লেখা শুধু ক্ষণেকের তরে সুদূর আকাশপটে আমার ভাগ্যের ব্যঙ্গচিত্র এঁকে লোপ পাবে!
আচ্ছন্নের মত জানালার ধারের টেবিলের কাছে এসে দাঁড়াতেই চোখে পড়ল চেয়ারে ঝোলানো আমার কোটের ধের উপর এক গাছি লম্বা চুল।
কি করে এসে পৌঁছল? কে জানে, এ জগতে অলৌকিক ঘটনা কি করে ঘটে?
কিংবা এ ঘটনা কি অতিশয় দৈনন্দিন নিত্য প্রাচীন? যে বিধাতা প্রতিটি ক্ষুদ্র কীটেরও আহার জুগিয়ে দেন, তিনিই তো তৃষিত হিয়ার অপ্রত্যাশিত মরূদ্যান রচে দেন। কিন্তু তার কাছে তখন সেটা অলৌকিক।
কুবেরের লক্ষ মুদ্রা লাভ অলৌকিক নয়, কিন্তু নিরন্নের অপ্রত্যাশিত মুষ্টি-ভিক্ষা অলৌকিক। কিংবা বলব, সরলা গোপিনীদের কৃষ্ণলাভ অলৌকিক—ইন্দ্রসভায় কৃষ্ণের প্রবেশ দৈনিন্দন ঘটনা।
অথবা কি এই হঠাৎ লটারি লাভ আমার হৃদপিণ্ড বন্ধ করে দেবে। অন্ধকার রাতের দুশ্চিন্তা তার কালো চুলকে ভোরের সঙ্গে সঙ্গে সাদা করে দেবে?
কি করি? কি করি?
জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি অল্প অল্প বৃষ্টি। এই বৃষ্টিকেই কাল রাতে কত সোহাগের সঙ্গে বুকে জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিলাম। এখন কোনো কিছুর সন্ধানে বাইরে যেতে পারব না বলে সেই সোহাগের ধন বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়াল।
কিন্তু কোথায় সন্ধান?
সর্দার আওরঙ্গজেবের বাড়ি খুঁজে আমি পাব নিশ্চয়ই। সেই সুদূর বাঙলাদেশ থেকে যখন কাবুল পৌঁছতে পেরেছি তবে এ আর কতটুকু! কিন্তু পেয়ে লাভ? সেখানে তো আর গটগট করে ঢুকে গিয়ে বলতে পারব না, শব্নম বানুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। এ দেশের ছেলেই এটা করতে পারে না। আমি তো বিদেশী। আমি তো এমন কিছু স্বর্ণভাণ্ড নই যে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে মাটি চাপা পড়ে গেলেও লোকে জানতে পারলে খুঁড়ে বের করবে? বরঞ্চ শব্নমই স্বর্ণপাত্র। আমি ভিখারী তার দিকে নিষ্কাম হৃদয়ে তাকালেও সর্দার আমার গর্দান নেবেন।
তা তিনি নিন। রাজারও একটা গর্দান, আমারও একটা। অথচ আশ্চর্য রাজার গর্দান গেলে বিশ্বজোড়া হৈ-চৈ পড়ে যায় আমার বেলা হবে না। কিন্তু ওই কিশোরীকে জড়ানো?
এ তো বুদ্ধির কথা, যুক্তির কথা, সামান্য কাণ্ডজ্ঞানের কথা, কিন্তু হায় হৃদয়েরও তো আপন নিজস্ব যুক্তিরাজ্য আছে, সে তো বুদ্ধির কাছে ভিখিরীর মত তার যুক্তি ভিক্ষা চায় না। আকাশের জল আর চোখের জল তো একই যুক্তি-কারণে ঝরে না।
আবদুর রহমান এসে খবর দিলে, আজ দুপুরে হোটেলে মাছ। অন্যদিন হলে আনন্দে আমি তাকে বখশিশ দিতুম—এদেশে এই প্রথম মাছের নাম শুনতে পেলুম। আজ শুধু অলস নয়নে তাকিয়ে রইলুম।
খেতে গিয়েছিলুম। এদিক ওদিক তাকাই নি। কারণ, কাবুল পাগমানে এখনো মেয়েরা রেস্তেরাতে খেতে বেরয় না। অনেক সর্দারই খেতে এসেছিলেন; হয়তো সর্দার আওরঙ্গজেবও ছিলেন।
হঠাৎ মৃদু গুঞ্জরণ আরম্ভ হল। তারপর সবাই ধড়মড় করে ছুরিকাটা ফেলে উঠে দাঁড়াল। ব্যাপার কি? ‘বাদশা, বাদশা’ আসছেন।
আমার বুকের রক্ত হিম। এই সর্বনেশে দেশে কি স্বয়ং বাদশা বেরন মজনূঁন—অর্থাৎ পাগলদের কিংবা আসামীর সন্ধানে!
না। এটা সরকারী হোটেল। লাভ হচ্ছে না শুনে তিনি স্বয়ং এসেছেন বড় ভাই মুইন-উস-সুলতানের সঙ্গে পেট্রানাইজ করতে। রাজেন্দ্রসঙ্গমে দীনও তা হলে তীর্থ দরশনে আসতে পারে। রাজার সঙ্গে গেলে দীনের রাহা-খরচাটা বাদ পড়ে বটে কিন্তু সেও তো পুরুৎপাণ্ডাকে দু’পয়সা বিলোয়। পরে দেখা গেল তাঁর হিসেবটা ভুল নয়।
অনেক রকম খাবারই সেদিন ছিল। এমন কি সদ্য ভারতবর্ষ থেকে আগত এক পেশাওয়ারী সদাগর পাতি নেবু পর্যন্ত বিলোলেন। অন্যান্য ঠাণ্ডা দেশের মত কাবুলেও কোনো টক জিনিস জন্মায় না। আমারটা আমি গোপনে পকেটে পুরেছিলুম। পরে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তার গন্ধ শুঁকব বলে। দেশের গন্ধ কত দিন হল পাই নি! যে মাছটি খেলুম সেটি ভালো হলেও তাতে দেশের গন্ধ ছিল না।
রাজা উঠে দাঁড়ালেন, কিন্তু কাবুলীদের অবশ্য-কর্তব্য ঢেকুরটি তুললেন না। আমরাও উঠলুম। আমার খাওয়া অনেকক্ষণ হল শেষ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু রাজা না ওঠা পর্যন্ত প্রজাকে খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করে ভান করতে হয়, যেন তার খাওয়া তখনো শেষ হয় নি। রাজা তো প্রজার তুলনায় গোগ্রাসে গিলতে পারেন না। গিললে প্রজাকে আরো বেশী গেলবার ভান করতে হয়।
ইরান-তুরানের অতিথি নিমন্ত্রিত বাড়ি এলে গৃহস্থকে ওই ভান করতে হয়।
এসব আমার চিন্তা-ধারা নয়। আমার সঙ্গে বসেছিলেন তিনজন ভারতীয় ব্যবসায়ী। এরাই গুন গুন করে এসব কথা উর্দুতে বলে যাচ্ছিলেন।
বেরিয়ে এসে দেখি বৃষ্টি থেমেছে। রোদ উঠেছে। গাছের ভেজা পাতা রোদের আলোতে ঝলমল করছে।
এখন বেরনো যায়। কিন্তু যাব কোথায়? সে চিন্তা তো আগেই করা হয়ে গিয়েছে। হলে কি হয়! পাগলামির প্রথম চিহ্ন, পাগল একই কথা বার বার বলে, একই গ্রাস বার বার চিবিয়ে চলে, গিলতে পারে না।
আর বেরতে গেলেই এই তিন ব্যবসায়ী দুশমন সঙ্গ নেবে। এরা এসেছে মাত্র কয়েকদিনের জন্য। কাবুলের ডাষ্টবিনের ছবি তোলে, হ্যাঁট-পিনের পাইকারী দর শুধোয়।
আর আমার ঘরে তো রয়েছে আমার সেই অমূল্য নিধি। আজ সকালের সওগাত।
এদেশের সবুজ চা অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। তিনটের সময় পা টিপে টিপে নিচে নামলুম। সেখানে চা খেয়েই বেরিয়ে যাব। এ সময় আর সবাই আপন আপন ঘরে চা খায়।
টী-রুমে ঢুকেই এক কোণে এক সঙ্গে অনেই কিছু দেখতে এবং শুনতে পেলুম। দেখি, আধ ডজনের বেশী কাবুলী তরুণী মাথার উপরকার হ্যাঁট থেকে ঝোলানো নেট বা বোরকার উত্তরপ্রান্ত—যাই বলা যাক না কেন নামিয়ে গোল টেবিল ঘিরে বসে কিচির মিচির লাগিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গেলুম, এ সময় হোটেলের নিচের তলাটা নির্জন থাকে বলে এই সুবাদে বেচারীরা ফুর্তি করতে, নূতন কিছু একটা করতে এসেছে। এবং এঁদের বুদ্ধিদায়িনীটি কে সেটা বুঝতেও বিলম্ব হল না। শব্নম বানু স্বয়ং দাড়িয়ে ওয়েটারকে তম্বি-তম্বা করছেন ঝড়ের বেগে‘পেসট্রি নেই! কেন? কেক আছে। সে তো বলেছ। অর্ডারও তো দিয়েছি। ডিমের স্যাণ্ডউইচ! কেন? শামী কাবাব দিয়ে স্যাণ্ডউইচ বানাতে পার না? মাথায় খেলে নি? যত সব-’
আমার দিকে পাশ ফিরে কথা বলছিলেন। হঠাৎ কেন জানি নে আমার দিকে তাকাতেই তাঁর মুখের কথা আমাকে দেখার সঙ্গে কলিশন লেগে থেমে গেল। আমিও সঙ্গে সঙ্গে ঠো করে চক্কর খেয়ে বারান্দায়। রওয়ানা দিলাম গেটের দিকে।
সেখানে পৌঁছতে না পৌঁছতেই পিছন থেকে কি একটা শব্দ শুনে ফিরে দেখি, সেই ওয়েটার।
‘আপনাকে একটি বানু ডাকছেন।’
এসে দেখি, তিনি বারান্দায় দাড়িয়ে।
হাসি মুখে বললে, ‘পালাচ্ছিলেন কেন? দাঁড়ান।’
হ্যাঁন্ডব্যাগ খুলতে খুলতে বললে, “আজ সকালে বাবাকে জিজ্ঞেস করলুম, বাঙলাদেশ কোথায়?” তিনি বললেন, ‘ওদেশের এক রাজা নাকি আমাদের মহাকবি হাফিজকে তার দেশে নিমন্ত্রণ করেন। তিনি যেতে না পেরে একটি কবিতা লিখে পাঠান। সেটি আমি টুকে নিয়েছি। এই নিন।’
আমি তখন কিছুটা বাকশক্তি ফিরে পেয়েছি। ধন্যবাদ জানিয়ে পকেটে রাখতে গিয়ে সেই নেকূটায় হাত ঠেকল।
হঠাৎ আমার কি হল? কোনো চিন্তা না করে এই সামান্য পরিচিতা বিদেশিনীর হাতে কি করে সেটা তুলে ধরলুম।
‘এটা কি? ওঃ! নেবু? লীমূন। লীমুন-ই-হিন্দুস্থান। নাকের কাছে তুলে ধরে শুকে বললে, ‘পেলেন কোথায়? কী সুন্দর গন্ধ। কিন্তু ভিতরটা টক না?’ বলে আবার হাসলে।
ওয়টার চলে গেছে। চতুর্দিক নির্জন। দূরে দূরে মালীরা কাজ করছে মাত্র।
তবু আমার মুখে কথা নেই।
মেয়েটি একবার আমার মুখের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালে।
আমি তাকিয়ে মাথা নিচু করলুম।
আস্তে আস্তে ভিতরে চলে গেল।
কী আহাম্মক! কী মুর্খ আমি!
প্রথম বারে না হয় বে-আদবী হত, কিন্তু এবারে এরকম অস্থায়ও আমি শুধাতে পারলাম না, আবার দেখা হবে কি না? এবারে তো সেই ডেকেছিল। কবিতা দিলে। সেই কবিতাটি পড়ার ভান করে, ওই প্রশ্নটা ভালো করে বলার ধরনটা ভেবে নিলেই তো হত।
না, না। ভালোই করেছি। যদি সে চুপ করে যেত তা হলেই তো সর্বনাশ। না বললে তো আমি খতম হয়ে যেতুম। কিন্তু হু, কী মূর্খ আমি! এই যে আঠারো ঘন্টা একই চিন্তায় বার বার ফিরে এসেছি তার ভিতর একবারও ভেবে নিতে পারলুম না, হঠাৎ যদি দৈবযোগে আবার দেখা হয়ে যায় তা হলে কি করতে হয়, কি বলতে হয়, সেই ঘ চেয়ে বড় প্রশ্ন—আবার দেখা হবে কি?—সেইটে কি করে ভদ্রভাবে শুধাতে হয়?
ওরে মূর্খ! দিলি একটা নেবু!
তাও শুনতে হল ভিতরটা টক!
না, সে মীন করে নি।
আঘাৎ করেছে।
না।