মাত্র একটি অঙ্গে আমাদের বিয়ে সর্বাঙ্গসুন্দর হয়েছিল।
শব্নম এই প্রথম খবর দিয়ে আসছিল বলে আবদুর রহমান কাবুল বাজার ঝেঁটিয়ে খান-পিনার সাজ-সরঞ্জাম কিনে রেখেছিল। রাত বারোটায় দস্তরখান পাতা হল, পদের পর পদ আসতে লাগল। শব্নম ওদের নিমন্ত্রণ করল, আমাদের সঙ্গে বসে খেতে। সিন্ধুর ওপারে সেবকগণ প্রভূ পরিবারের সঙ্গে বসে খেতে সম্পূর্ণ অনভ্যস্ত নয়। ওরা কিন্তু রাজী হল না। শোনাবার মতলবে ওদের ফিসফিস থেকে বোঝা গেল, ওরা বাজী ধরেছে, কে বেশী পোলাও খেতে পারে-প্রচুর সময় লাগার কথা।
শব্নম মাথা গুঁজে খেল। রুটি দিয়ে জড়িয়ে ধরে মাংস, তরকারি এমন কি ঝোল পর্যন্ত তুলে খেল, অথচ রুটি ছাড়া অন্য কোনও জিনিস হাতের সংস্পর্শে এল না, শুধু আমি দুজন লোককে করতে দেখেছি, শব্নম আর ভূপালের এক প্রধান মন্ত্রী। এদের খাওয়ার পর হাত ধেবার প্রয়োজন হয় না। রুটির যেটুকু ময়দার গুড়ো আঙুলের ডগায় লেগেছে সেটুকু ন্যাপকিনে মুছে নিলেই হল। শব্নম আমাকে কিছু না বলে হাত ধুয়ে এসে আমার পাশে বসে বললে, তুমি কিছু মনে করো না; এ ব্যাপারে আমার লজ্জাবোধ একটু বেশী।
বাইরে ভয়ঙ্কর শীত। চিমনিতে আবার কাঠ দেওয়া হল।
আগুনের সামনে আমরা দুজানা কার্পেটের উপর বসে আছি।
শব্নম প্যারিসের গল্প বলছে। মাঝে মাঝে আমার হাতখানা কোলে তুলে নিয়ে আদর করছে। একবার হৃদয় সম্বন্ধে কী একটা বলতে গিয়ে বললে, ‘এই তো তোমার হার্ট-’ বলে তার ডান হাত আমার বুকের উপর রাখতে গিয়ে তার হাত সেই ভিজিটিংকার্ড কেসটায় ঠেকল। সঙ্গে সঙ্গে চুপ করে গেল।
আমি শুধালুম, কী হল?
“তোমার ঘরে কাঁচি আছে?”
‘বোস। শোবার ঘরে নিয়ে গিয়েছিলুম। এনে দিচ্ছি।’
বললে, ‘বা রে! এখন আমি সর্বত্র যেতে পারি।’ বলেই পাখি যে রকম বসা অবস্থাতেই ওড়া আরম্ভ করতে পারে সেই রকম ফুড় করে উড়ে গিয়ে কচিখানি নিয়ে এল।
আমাকে মুখোমুখি বসিয়ে আমার হাতে কাঁচি দিয়ে বললে, আমার জুল্ফ কাটো।
বাঙলা জুলপি কথাটা জুলফ্ থেকে এসেছে। ইরান তুরানের কুমারীদের অনেকেই দু গুচ্ছ অলক রগ থেকে কানের ডগা অবধি ঝুলিয়ে রাখে। শব্নমের চুল ঢেউ-খেলানো হলে তার জুল্ফ দুটির সৌন্দর্য ছিল অসাধারণ।
আমি ঠিক জানি নে, একদা বোধ হয় ইরান তুরানের বর বাসর ঘরে নববধূর জুল্ফ দুটি পুরোপুরিই কেটে দিত। এর পর যে নূতন চুল গজাত নববধূ সে চুল কানের পিছনে অন্য চুলের সঙ্গে মিলিয়ে দিত। জুল্ফে হক্ক কুমারীদের-ইরানে বলা হয় ‘দুখ্তর’ সংস্কৃতে ‘দুহিতৃ’ স্পষ্ট বোঝা যায়, একই শব্দ। আজকাল এই জুল্ফ কাটার রেওয়াজ যে-সব জায়গায় আছে সেখানেও বোধ হয় জুলফের শুধু ডগাগুলোই কেটে দেওয়া হয়।
আমি বললাম, আমার হাত কেটে ফেললেও তোমার জুল্ফ কাটতে পারব না।
অনুনয় করলে, তা হলে ডগাগুলো কেটে দাও।
আমি বললাম, আমায় মাফ কর।
‘আমি চিরকালই কুমারী থাকব?’
‘তুমি চিরকালই আমার সামনে পাগমানের সেই ডানস্-হল থেকে নামছ, তুমি চিরকালই আমার প্রথম সন্ধ্যার হিমিকা। কিন্তু বলতো, তুমি এই জুল্ফ কাটা নিয়ে এত চাপ দিচ্ছ কেন?’
‘তবে কাছে এস।’
আমি আমার দুই তর্জনী দিয়ে তার দুটি জুল্ফ আঙুল দিয়ে পাকিয়ে পাকিয়ে তার মুখ তুলে ধরে বললুম, বল।
“দেখ, চারদিকে এই অশান্তি এই অনিশ্চয়তা, এর মাঝখানে তোমাকে নিঃশেষে পাবার জন্য আমার হৃদয় আমাকে ভরসা দিচ্ছে না।”
আমি বললুম, আমি তো চাই।
আমার দু হাতে ধরা জুল্ফি-বন্ধনের মাঝখানে যতটা পারে মাথা দুলিয়ে বললে, “না, না, না। তুমি আমাকে এত বেশী ভালবাস যে তোমার চাওয়া-না-চাওয়া সব লোপ পেয়েছে। আমার ভালবাসা তার কাছে দাড়াঁতেই পারে না।”
‘এবারে ভাল করে শোন। বিয়ের আগে তোমার সঙ্গে আমি এমন কোনও আচরণ করি নি যার জন্যে আল্লার সামনে আমাকে লজ্জা পেতে হবে। কিন্তু তোমার অসাক্ষাতে, এখানে কান্দাহারে, দিনের পর দিন, রাত্রির পর রাত্রি, দুপুর রাত্রে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গিয়ে সন্ধ্যা প্রদীপ না জ্বেলে গৃহকোণে কতবার আমি তোমাকে আমার সর্বস্ব সমর্পণ করেছি, তুমি জান না। চতুর্দিকে বিশ্বসংসার তখন প্রতিবার লোপ পেয়ে গিয়েছে একেবারে নিঃশেষে। আমি যেন বেলাভূমিতে দাড়িয়ে, আর তুমি মহাসিন্ধু, দূর থেকে তরঙ্গে তরঙ্গে ধীরে ধীরে আমার দিকে এগিয়ে আসছ। আমি দম নিয়ে নাক-মুখ বন্ধ করার আগেই তুমি আমাকে তরঙ্গের আলিঙ্গনে আমার সর্বস্বত্তা লোপ করে দিলে। আর কখনও তুমি এসেছ ঝড়ের মত। আমার ওড়না তুলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে, আমার জুল্ফগুচ্ছের ভিতর ঢুকে গিয়ে তার প্রত্যেকটি চুল আলাদা আলাদা করে এদিক ওদিক উড়িয়ে দিয়ে, আমার চোখের প্রতিটি কাজলের গুঁড়ো কেড়ে নিয়ে, আর সর্বশেষে আমার প্রতিটি লোমকূপে শিহরণ জাগিয়ে আমাকে যেন তোমার সর্বাঙ্গে জড়িয়ে কোথায় কোথায় উধাও হয়ে গেলে-কালপুরুষের পাশ দিয়ে কৃত্তিকা, সাত-ভাই চম্পার ঝাঁকের মাঝখান দিয়ে।
‘জ্ঞান ফিরতে দেখি, আমি মাথা ঝুঁকে বর্ডারের উপর বুলবুলির চোখে তুলি লাগিয়ে বসে আছি।’
আমি চুপ করে শুনে গেলুম।
নিঃশ্বাস ফেলে বললে, “তুমি পুরুষ, তুমি কি করে বুঝবে কুমারীর প্রেম। তুমি তো সমুদ্র-তরঙ্গ, ঝড়ের ঘূর্ণি। আর আমার প্রেম? -স্বপ্নে স্বপ্নে বোনা শুক্তির মুক্তো। কত ছোট আর কত অজানার নিভৃত কোণে তার নীড়। কত আঁখি-পল্লব থেকে নিংড়ে নিংড়ে বের-করা এক ফোঁটা আঁখি জল। আর তার প্রতিটি ক্ষুদ্রতম কণাতে আছে কুমারীর লজ্জা, ভয়, সঙ্কোচ।”
চুপ করে গেল।
আমি কাঁচি হাতে নিয়ে জুল্ফ থেকে তিন গোছা চুল কেটে নিয়ে বললুম, এই মুক্ত করলুম, আমি তোমার লজ্জা, সঙ্কোচ, ভয়।
আগুনের সামনে বসেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল বাইরে শীত কী রকম ঘনিয়ে আসছে। সে শীত যখন তার চরমে পৌঁছেছে তখনও শব্নম তার জুল্ফ কানের পিছনে ঠেলে দিতে দিতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললে, একি নেমকহারামির চূড়ান্ত নয়-যে বাড়ীতে কুড়িটি বছর কাটিয়েছি সেটা আর নিজের বাড়ি বলে মনে হচ্ছে না? আর এ বাড়ি? এ বাড়ি আসলে তোমার আপন বাড়িও নয়—এ বাড়িতে তো আমার শাশুরি-মা তোমাকে জন্ম দেন নি। তবু মনে হচ্ছে, এ বাড়িতেই যেন শিশুকাল থেকে আমরা খেলাধুলা ঝগড়াঝাটি মান অভিমান করে আজ আমাদের চরম মিলনে পৌঁছলুম।
একটুখানি ভাবলে। তারপর মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে বললে, উহুঁ, এটাও যেন সম্পূর্ণ সত্য নয়। কেমন যেন মনে হচ্ছে, আমরা দুটি শিশু এ বাড়ির আঙিনাতে খেলা করছি, আর ও বাড়ির ছাদে বসে আব্বাজান, জানেমন্ একে অন্যের সঙ্গে গল্প করতে করতে আমাদের দিকে স্নেহদৃষ্টি রেখে সকল বিপদ আপদ ঠেকিয়ে রাখছেন। খেলা ছেড়ে ছুটে গিয়ে একবার জানেমনের কোলে বসে জিরিয়ে আসি।
আমার মোজাটা খুলতে খুলতে বললে, ‘এই যে লাগল গোলমাল, এর শেষ কবে, আর কোথায়, কেউ বলতে পারে না। তোমাকে আবার কখন দেখতে পাব তাও জানি নে। তবে এখন আমার বুক ভরা সান্ত্বনা। ওই বাচ্চা যদি কাল এসে যেত তা হলে আমাকে মহাবিপদে ফেলত। পাগলা-ভিড় ঠেলে এসে তোমাকে বিয়ে করতে হত। এখন আমি নিশ্চিন্ত মনে যাচ্ছি।’
আমি অবাক হয়ে বললুম, এই শীতে? এত রাত্তিরে?
‘এই সময়টাই সবচেয়ে ভাল। ডাকুদের দামী দামী ওভারকোট নেই যে এই শীতে বেরুবে। কাল সকালে দেখবে কাবুলে মেলার ভিড়। চোর ডাকাত বেবাক মৌজুদ। প্রথম লুট আরম্ভ হলেই ওরা সব ঝাঁপিয়ে পড়বে। বাচ্চা তো উপলক্ষ্য মাত্র। তুমি এ দেশের হালহকীকৎ জান অতি অল্প। আমাকে বিশ্বাস করে নিশ্চিন্ত হও।’
আমি সেদিন তাকে বিশ্বাস করেছি। আজও করি।
খুশী হয়ে বললে, ‘এই তো চাই। আমি তোপল্ খানকে ডাকি। তুমি যাও, শুয়ে পড়। কতক্ষণ ধরে এই সুট পরে আছ।’
শীতের দেশ বলে আমি শিলওয়ার, চুড়িদার পাঞ্জাবী পরে শুই।
শোবার ঘরে ঢুকেই বললে, “বাঃ! কী চমৎকার দেখাচ্ছে তোমাকে! কিন্তু এ আবার কি রকমের কুর্তা? দু দিকে চেরা কেন?’ দেখি? হাত ঢুকিয়ে দিয়ে বললে, “ও! পকেট! ভারী অরিজিনাল আইডিয়া তো। হাতে আবার পট্টি করে বোতাম। ও, বুঝেছি, খাবার সময় আস্তিন যাতে ঝোলে ডুবে না যায়। আমিও এরকম একটা করাব। সবাই বলবে, ‘আমি কি অরিজিনাল। এবারে তুমি শোও দিকি নি।’
তিন দিকে লেপ গুঁজতে গুঁজতে বললে, তুমি কণামাত্র দুশ্চিন্তা করো না। তোপল্ খান একটা সার্ভে করে এসেছে। আমার কথাই ঠিক। রাস্তায় কাক-কোকিল নেই। আচ্ছা, তুমি আমাকে স্বপ্নে দেখবে তো?
আমি বললুম, নিশ্চয়ই।
মাথা, জুল্ফ, কানের দুল দোলাতে দোলাতে বললে, না, তা করতে পারবে না। আমার কড়া মানা। আমি খাটে শুয়ে ড্যাব ড্যাব করে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকবো আর তুমি প্রেমসে তোমার স্বপনচারিণীর সঙ্গে লীলা-খেলা করবে—সেটি হচ্ছে না। ও আমার সতীন-দজ্জাল বেটী ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
আমি বললুম, ‘তুমিও আমাকে স্বপ্নে দেখলে পার।’
আশ্চর্য হয়ে বললে, বল কী তুমি? তুমি পুরুষ মানুষ। চারটে প্রিয়েকে বিয়ে করতে পার, স্বপ্নে জাগরণে যে রকম খুশী ভাগাভাগি করতে পার। কিন্তু আমি মেয়েছেলে। আমার কেবল তুমি। আমি বললুম :
‘স্বপন হইতে শতশত গুণে
প্রিয়তর বলে গুণি?’
অর্থ আর সুর দুইই তার মন পেল।
বললে, ‘কান্দাহারে তোমাকে প্রতি রাত্রে স্বপ্নে আবাহন জানাতুম। তখন তোমাকে বিয়ে করি নি, তাই। আচ্ছা, এবারে তুমি চুপ কর, আর চোখ বন্ধ কর।’
উঠে গিয়ে আলো নেবাল। ড্রইংরুমে থেকে এ ঘরে সামান্য আলো আসে।
আমার ছোট্ট চারপাঈটির কাঠের বাজুতে হাল্কা ভাবে বসে সেই আধো-আলো অন্ধকারে অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল—আমি বন্ধ চোখে সেটা চোখের তারাতে তারাতে দেখতে পেলাম।
এবারে তার নিশ্বাস আমার ঠোটে এসে লাগছে।
ভীরু পাখির মত একবার তার ঠোঁট আমার ঠোঁট স্পর্শ করল—দুবার—শেষবারে একটু অতি ক্ষীণ চাপ।
এ অভিজ্ঞতা আমার জীবনে এই প্রথম নয়।
কৈশোরে যখন ওষ্ঠাধরের গোপন রহস্য আধা আধা কল্পনায় বুঝতে শিখেছি তখন আমি আকাশের তারার সঙ্গে মিতালী পাতাবার জন্য রাত্রিযাপন করতুম খোলা বারান্দায়। শরতের ভোরবেলা দেখতুম পাশের শিউলি গাছের বিরহবেদনা-ফোঁটা ফোঁটা চোখের জলের শিউলি আমার চতুর্দিকে ছড়ানো।
এক ভোরে অনুভব করলুম ঠোটের উপর তারই একটি।
এ সেই হিমিকা-মাখা, শব্নম-ভেজা শিউলি!