২.৭ আমার প্রিয়া, আমার বউ

আমার প্রিয়া, আমার বউ, আমার বিবাহিত স্ত্রীকে আবার বিয়ে করতে চলেছি!

এ যেন একই দিনে দু’বার সূর্যোদয়। কিন্তু তাও হয়। সূর্যোদয়ের একটু পরে ঘন মেঘে সূর্য পড়ল সম্পূর্ণ ঢাকা। সব কিছু ভাস-ভাসা অন্ধকার-সূর্যোদয়ের পূর্বে যে রকম। মেঘ কেটে পরিষ্কার আকাশে আবার পূর্ণ সূর্যোদয় হল।

কিংবা বলব, ভারতবর্ষে মানুষ যেমন একই দেহ নিয়ে দুইজন্ম লাভ করে ‘দ্বিজ’ হয়। প্রথম জন্ম তার ব্যক্তিগত, দ্বিতীয় বারে লাভ করে গুরুর আশীর্বাদ, সমাজের সম্মতি। আমাদের এই দ্বিতীয় বিয়েতে আমরা পব পিতার আশীর্বাদ সমাজের মঙ্গল কামনা।

সুস্থ বর স্বাভাবিক অবস্থায়ও পরের দিন ঠিক ঠিক বলতে পারে না কি কি হয়েছিল, কোনটার পর কি ঘটেছিল। আমার অবস্থা আরও খারাপ।

কিংখাপের জামা-জোব্বা পরে মাথা নিচু করে বসে আছি শাদীর মজলিসের মাঝখানে। একবার মাথাটা উঁচু করে চার দিকে তাকালুম। মাত্র একটি পরিচিত মুখ দেখতে পেলুম। আমার কলেজের আমারই ছাত্র। তারই কচি মুখটি শুধু হাস্যোজ্জ্বল। আর সকলের মুখে আনন্দ আতঙ্কে মেশানো কেমন যেন এক আবছায়া অবছায়া ভাব। আবার মাথা নিচু করলুম।

এবারের বিয়েতে শব্‌নম সভাতে এসে আমার মুখোমুখি হয়ে বসল না। আমার মুখপাত্র হয়ে একজন ‘উকিল’ দুজন সাক্ষীসহ অন্দরমহলে গিয়ে বিবাহে শব্‌নমের সম্মতি নিয়ে এসে মজলিসে আমার সামনে মুখোমুখি হয়ে বসে বললেন, অমুকের কন্যা অমুক, আপনি, অমুকের পুত্র অমুককে এত স্ত্রীধনে মুহম্মদী চার শর্তে বিবাহ করতে রাজী আছেন—আপনি কবুল আছেন? বাকিটা প্রথম বারের মত।

হ্যাঁ, মনে পড়ল। এর আগে দ্বন্দ্ব হয়ে গিয়েছে স্ত্রীধন কত হবে তাই নিয়ে। সাধারণত বর পক্ষ সেটা কমাতে চায়, কন্যা পক্ষ সেটা বাড়াতে চায়। এখানে হল উল্টো। পরিবারের ঐতিহ্য ও সম্মান বজায় রেখে আওরঙ্গজেব খান কমিয়ে কমিয়ে যে অঙ্ক বললেন, আমি তার গুরুর মারফতে ঢের বেশী অঙ্ক জানিয়ে দিলুম। গুরুই শেষটায় রফারকি করে দিলেন।

বড় দুঃখে তোপল্‌ খানের কথা মনে পড়ল।

বর-বধুর মঙ্গল কামনা করে প্রার্থনা করেছিলেন গুরু। সমস্তটা কবিতা কবিতায়। এবং সব কবিতা মাত্র একজন কবি মৌলানা জালাল উদ্দীন রূমীর থেকে নিয়ে। আশ্চর্য, কি করে জানলেন উনিই আমার সব চেয়ে প্রিয় কবি।

তারপর ও ঝাপসা।

আমার অপরিচিত এক ভারতীয় বোধ হয় আমাকে মুরুব্বীদের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমি তাঁদের সম্মান জানাতে তাঁরা আমাকে আশীর্বাদ করেছিলেন। সক্কলের পয়লা কার কাছে গিয়েছিলুম মনে নেই। শ্বশুরমশাই কিংবা জ্যাঠ শ্বশুরমশাই—অর্থাৎ জানেমন্—আমি কারও মুখের দিকে তাকাই নি।

এসব কায়দা খাস আফগানী কি না আমি জানি নে। পরে শব্‌নমের কাছে শুনেছিলুম ওই অপরিচিত ভারতীয় মিত্রটি সবকিছু আধা-আফগান আধা-হিন্দুস্থানী কায়দায় করিয়েছিলেন।

জিরোবার জন্য আমাকে ছুটি দেওয়া হল। বেরুতেই দেখি আমার ছাত্রটি। সে আনন্দে, উৎসাহে সেখানে চেঁচামেচি লাগিয়েছে। আমার সম্বন্ধে তার গুণকীর্তনের যেটুকু কানে এসেছিল তার সিকি ভাগ সত্য হলে তুর্কীর খলীফার সিংহাসন ইস্তাম্বুল যাদুঘর থেকে বের করে এনে তার উপর আমাকে বসাতে হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে নোবেল প্রাইজের সবকটা পুরস্কার নাগাড়ে একশ বছর ধরে আমাকে নিয়ে যেতে হয়।

আমাকে দেখতে পেয়ে লাফ দিয়ে এসে আমার হাত দুখানার উপর তার দুচোখ চেপে ধরে বার বার বলে, “হুজুর, এ কী আনন্দ, আপনি আমাদের দেশে বিয়ে করলেন। হুজুর, ইত্যাদি।” শেষটায় বললে, কলেজের সবাই বড় পরিতৃপ্ত হবে, হুজুর, এ আমি বলে রাখছি।

হায় রে কলেজ! আমরা তখনও জানতুম না বাচ্চা তিন দিন পরে কাবুলের তাবৎ ইস্কুল কলেজ নস্যাৎ করে দেবে।

একটা ঘরে বসিয়ে তামাক সিগারেট আমার সামনে রাখা হল। শব্‌নমের সমবয়সী আত্মীয়-স্বজনরা প্রথমটায় কিন্তু-কিন্তু করে পরে বাঁধন-ছাড়া বাছুরের মত লাফালাফি দাপাদাপি ঠাট্টা-রসিকতা করলে। আমার কবিতায় শখ জেনে শেষটায় লেগে গেল বয়েৎবাজি, কবিতার লড়াই এবং মুশাইরা। শুধু ফার্সী না—দুনিয়ার যত সব ভাষায়। তবে মোলায়েম প্রেমের কবিতার অধিকাংশই ছিল ফার্সীতে।

খবর এল, জানেমন্‌ আমার জন্য অপেক্ষা করছেন।

আমাকে সামনে বসিয়ে আমার সর্বাঙ্গে হাত বুলালেন। এমন কি চোখে, নাকে, গালে, কপালে, ঠোটে পর্যন্ত। তখন দেখলুম, তিনি অন্ধ।

অতি মৃদু কণ্ঠে বলতে আরম্ভ করলেন, “শোন বাচ্চা, তোমাকে সব কথা বলার মত লোক বাড়িতে আর কেউ নেই আমি ছাড়া। জন্মের প্রথম দিন থেকে আজ পর্যন্ত শব্‌নম একদিনের তরেও আমার চোখের আড়াল হয় নি। আমি জন্মান্ধ নই, যৌবনে চোখের জ্যোতি হারাই। শব্‌নম সে জ্যোতি ফিরিয়ে এনেছে। আজ যদি কেউ বলে শব্‌নমের ভালবাসার পথে আমি একটিমাত্র কাঁটা পুঁতলে আমার চোখের জ্যোতি ফিরে পাব তা হলে আমি সে প্রস্তাব হেসে উড়িয়ে দেব।

‘প্রথম দিনই আমি বুঝতে পেরেছিলুম, সে ভালবেসে ফিরেছে। যখন ফিরে এল, তখনই শুনি তার গলা বদলে গিয়েছে, তার হাসি বদলে গিয়েছে, আমাকে আদর করার ধরন বদলে গিয়েছে। যেন এতদিন ছিল পাতার আড়ালে লুকানো ফুল-এখন তার উপর পড়েছে প্রভাত বেলার স্নিগ্ধ আলো। ঘরের কোণের প্রদীপ হঠাৎ যেন আকাশের বিদ্যুতে রূপান্তরিত হয়ে গেল। তার নিশ্বাস-প্রশ্বাসে যেন এক নবীন মাধুরী এসে ধরা দিয়েছে। তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নূতন ছন্দে নূতন তালে নেচে উঠেছে।

‘আমার থেকে দূরে চলে গেল? না, বাচ্চা, না। সেই তো প্রেমের রহস্য।’

‘এতদিনে বুঝতে পারল, আমি তাকে কতখানি ভালবেসেছি তোমাকে ভালবাসার পর। আগে আমার কাছে আসত ঝড়ের মত, বেরিয়ে যেত তীরের মত। এখন আমার সঙ্গে কাটায় ঘন্টার পর ঘণ্টা। তোমার বিরহ থেকে বুঝেছে, সে আড়ালে গেলে আমার কী দুশ্চিন্তা হয়। যে-বেদনা সে পেয়েছে, সেটা সে আমাকে দিতে চায়। অথচ দুই ভালবাসায় কত তফাৎ। আমার ভালবাসা স্নিগ্ধ জ্যোৎস্নালোকের মত, তোমার ভালবাসা মরুভূমিতে মরণাপন্ন তৃষ্ণার্তকে সঞ্জীবনী অমৃতবারি দেওয়ার মত।’

আমাকে কিছু বলে নি। আমিও জিজ্ঞেস করি নি। প্রেম গোপন রাখতে যে গভীর আনন্দ আছে তার থেকে আমি তাকে বঞ্চিত করতে যাব কেন? শুনেছি প্রথম গর্ভধারণ করে বহু মাতা সেটা যত দিন পারে গোপন রাখে। নিভৃতে আপন মনে সেই ক্ষুদ্র শিশুটির কথা ধ্যান করতে করতে সে চলে যায় সেই স্বর্গলোকপানে যেখান থেকে মুখে হাসি নিয়ে নেমে আসবে এই শিশুটি।

‘আমিও নিভৃতে অনকে চিন্তা করেছি, কে সে বীর যে শব্‌নমের চিত্তজয় করতে সক্ষম হয়েছে। তার সঙ্গে যাদের বিয়ে হতে পারে তাদের সবাইকে তো আমি চিনি। এদের কেউই নয়, সে কথা নিশ্চয়।’

‘বুঝলুম, কোন জায়গায় কোন বিপত্তি বাধা আছে তাই সে তোমাকে পুরোপুরি পাচ্ছে না। আমার বেদনার অন্ত রইল না। ওই একবার আমার নিজের প্রতি ধিক্কার জন্মাল, কেন আমি জ্যোতিহীন হলুম। না হলে আমি তোমাদের বাধাবিঘ্ন সরিয়ে দিতুম না, যার সামনে দু’জন দুদিক থেকে এসে থমকে দাঁড়িয়েছে?’

সে বেদনা আজ কেটে গিয়েছে বলে তার স্মরণে জানেমনের মুখ পরিতৃপ্তির স্মিতহাস্যে কানায় কানায় ভরে উঠল।

আমি বললুম, ‘আমি বিদেশী। আপনারা আমাকে হিমি-শব্‌নমের উপযুক্ত মনে করেন কি না সেই ভয়ে আমিও অসহায়ের মত মার খেয়েছি। আমি বুঝি।’

‘তোমার গলাটি আমার ভারী পছন্দ হয়েছে। এখন তো ওই দিয়েই আমি মানুষকে চিনি। আরও কাছে এস বাচ্চা। আমার পিঠে হাত বুলিয়ে দাও। শব্‌নম যে রকম দেয়। এ কি, তোমার হাত অত নরম কেন? প্রায় শব্‌নমের মত।’

আমি হেসে বললাম, বাংলা দেশের লোক আপনাদের মত শক্তিশালী হয় না।

‘বাঙলাদেশ? তাই বল। তাই শব্‌নমের এত প্রশ্ন, হাফিজ বাঙলাদেশে গেলেন না কেন, হাফিজের অর্থকষ্ট বাঙলার রাজা তো দূর করে দিতে পারতেন, আরও কত কি। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্য লাগল, একদিন সে যখন এক অজানা কবির কবিতা পড়ে আমায় শোনাতে গেল। ভারী মধুর আর করুণ। ঠিক ফার্সী নয়, আবার ইয়োরোপীয় কবির ফার্সী অনুবাদও নয়। কেমন যেন চেনা চেনা অথচ অচেনা। আবার কেমন যেন এটা-ওটায় মেশান। যেন গন্ধ গোলাপের, চেহারা কিন্তু নরগিসের, এ আবার বসন্তে না ফুটে ফুটছে যেন শীতকালে। একটি কবিতা আমার বিশেষ করে মনে পড়ছে “খুদ-কুশী-ই- সিতারা।” বৃদ্ধ থামলেন। যেন মনে মনে কবিতাটির চোখে মুখে হাত বুলিয়ে নিলেন। বুঝলুম, এটা ‘তারকার আত্মহত্যা’।

আমি বললুম, এ কবির পিতা সূফী সাধক ছিলেন এবং অতি উত্তম ফার্সী জানতেন। কবি ব্যাল্যবয়সে পিতার কোলে বসে বিস্তর ফার্সী গজল-কসীদা শুনেছেন। আসছে গ্রীষ্মে এখানে তাঁর আসবার কথা ছিল; বোধ হয় আপনাদের কবি হাফিজ বাঙলাদেশে যেতে পারেন নি বলে বাঙলার কবি তার প্রতিশোধ নিতে আসছিলেন। এখন তো সব-কিছু উলোট-পালট হয়ে গেল।

জানেমন্‌ বললেন, হাফিজের পাঁচশ বছর পরে যোগাযোগ এসেছিল তোমাদের কবির মাধ্যমে। আরও ক’শ বছর লাগবে ফের এই যোগাযোগ হতে কে জানে? কে যেন এক বিদেশী জ্ঞানী দুঃখ করে বলেছেন মানুষ একে অন্যকে ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা করে বেশী—দু’জনের মাঝখানে সেতু বাঁধার চেষ্টা করে তার চেয়ে ঢের ঢের কম;-

‘হায় রে মানুষ,
বাতুলতা তব
পাতাল চুমি;-
প্রাচীর যত না
গড়েছ, সেতু তো
গড়ো নি তুমি।’

তাই প্রার্থনা করি, শব্‌নমে তোমাতে আজ যে সেতু গড়লে সেটি অক্ষয় হোক।

আমি বললুম, ‘আমিন—তাই হোক।’

এমন সময় খবর এল, ভোজে বরকে ডাকা হচ্ছে।

উঠবার সময় জানেমন্‌ আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, আমার যদি একটি কথা বিশ্বাস কর, তবে বলি, শব্‌নমের মধ্যে এতটুকু খাদ নেই। ওকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করলে তোমার কখনো কোনও ক্ষতি হবে না। মিথ্যা কখনও তাকে স্পর্শ করতে পারে নি। শিশির বিন্দুর মত সত্যই সে পবিত্র, স্বর্গ হতে সে এসেছে সম্পূর্ণ কলুষ-কালিমা মুক্ত হয়ে। আমি বুঝেছি, তুমিও বড় সরল প্রকৃতি ধর। তোমাদের মিলনে স্বর্গের আশীর্বাদ থাকবে।

আমাকে উপহার দিলেন এক বিরাট বদ্‌খশানী রুবী। তার উপরে খোদাই সম্পূর্ণ কাবা শরীফের ছবি। এত বড় রুবি। আর এ রকম সুক্ষ্ণ খোদাই আমি কাবুল যাদুঘরেও দেখি নি অথচ আমি জানতুম, বদখ্‌শনে আফগানিস্থানের প্রদেশ বলে কাবুলের জাদুঘরে রুবির যে সঞ্চয় আছে সেটি পৃথিবীতে অতুলনীয়।

বললেন, মনে যদি কখনও অশান্তি আসে তবে এটি আতশী কাচ দিয়ে দেখ। শুনেছি, জমজমের কুয়ো পর্যন্ত দেখা যায়। মাইক্রোস্কোপ দিয়ে নাকি জল ওঠাবার সাজসরঞ্জাম পর্যন্ত পরিষ্কার ফুটে ওঠে। এটি আমাদের পরিবারের ছ’শ বছর ধরে আছে। প্রার্থনা করি, ‘কাবা যতদিন থাকবে, তোমাদের ভালবাসা ততদিন অক্ষয় থাকবে।’

আমেন!

তারপর আবার সব ঝাপসা। আবছায়া আবছায়া মনে পড়ছে, ভোজে পাশে বসেছিল আমার ছাত্রটি। সে আমাকে এটা ওটা খাওয়াবার চেষ্টা করেছিল আর তার উচ্ছ্বসিত উদ্বেলিত আনন্দ সে কিছুতেই ঠেকিয়ে রাখতে পারছিল না। আমি নিজের অপ্রতিভভাব ঢাকবার জন্য তাকে সংস্কৃতের ‘হাঁহাং দদ্যাৎ, হুঁহুং দদ্যাৎ’ এবং ‘পরান্নং প্রাপ্য দুর্বুদ্ধে-’ ফার্সীতে অনুবাদ করে মৃদু কণ্ঠে শুনিয়েছিলুম।

রাত প্রায় বারোটার সময় এক অপরিচিত নওজোয়ান আমাকে হাতে ধরে সিড়ি ভাঙতে ভাঙতে তেতলার মুখে এক দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে বললে, বড়ই অফসোস, কি করে হৃদয়-দুয়ার ভেঙে নববরের-নওশাহের-নবীন বাদশার সিংহাসন লাভ করে অভিষিক্ত হতে হয় তার খবর আমি জনি নে। আমার সে সৌভাগ্য এখনও হয় নি। আপনাকে তাই কোন সদুপদেশ দিতে পারলুম না। তবে এটুকু জানি, শব্‌নম বানুর প্রসন্ন, অতিশয় সুপ্রসন্ন সম্মতি নিয়েই এই শুভ মুহুর্ত এসেছে। আজ পর্যন্ত কাবুলকান্দাহার, জালালাবাদ-গজনীর কোন তরুণই সাহস করে শব্‌নম বানুর পাণি কামনা করতে পারে নি। আপনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তাই আপনি তরুণ সমাজের সুস্মিত অভিনন্দনসহ তাদের গর্বের ধনের সঙ্গে চারিচক্ষু মিলনে যাচ্ছেন। সুদিন এলে আমরা আপনাদের নিয়ে যে নয়া পরব করব তখন দেখতে পাবেন আপনি কারও দিলে এতখানি চোট না দিয়ে শব্‌নম বানুর দিল জয় করেছেন। এ রকম সচরাচর হয় না। শব্‌নম বানু অসাধারণ বলেই এই অসম্ভবটা সম্ভব হল। আবার অভিনন্দনই জানাই।

দরজা খুলে আমাকে ভিতরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।

সে ছবি আমি জীবনে কখনও ভুলব না।

যবে থেকে আমাদের বিয়ে ঠিক হয়েছে তখন থেকে এ-ছবিটি কি রকম হতে পারে তার নানা স্বপ্ন আমি সমস্তদিন ধরে দেখেছি। বরযাত্রায় আসার সময়, বিয়ে বাড়ীর চাপা কলরব মৃদু গুঞ্জরণ, শাদী মজলিসের গম্ভীর নৈস্তব্ধ্যে এমন কি চাচা-জান যখন তাঁর স্নেহপ্লাবন দিয়ে আমার হৃদয়ের একূল ওকূল দুকূল ভাসিয়ে দিচ্ছিলেন তখনও-তখনও আমি একটার পর একটা ছবি মনে এঁকেছি আর মুছেছি, মুছেছি আর এঁকেছি।

কখনও দেখেছি সখীজন পরিবতা শব্‌নম বাসর ঘরের কলগুঞ্জরণ মুখরিত উজ্জ্বলালোকে নববধূর অতিভূষণে জর্জরিতা, আভূমি বিনতা। আর কখনও দেখেছি সূচীভেদ্য অন্ধকার ঘরের একপ্রান্তে আমি জাত-মূর্খের মত দাঁড়িয়ে ভাবছি কিংবা বলব, ভাবতেই পারছি নে, কি করা উচিত। হয় তো অনেক কষ্টে এদিক-ওদিক হাতড়ে হাতড়ে আসবাবপত্রের ধারাল খোঁচা ধাক্কা খেয়ে খেয়ে কোনও গতিকে শব্‌নমের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছি, এমন সময়, এমন সময় হঠাৎ ঘরের চারিদিকে জ্বলে উঠল পঞ্চাশটা জোরাল টর্চ! সঙ্গে সঙ্গে অট্টরোল অট্টহাস্য। শব্‌নমের সখীরা চতুর্দিকের দেয়ালের সঙ্গে গা মিশিয়ে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়েছিলেন এই শুভ মুহূর্তের জন্য। আলো জ্বালিয়ে সঙ্গে সঙ্গে গাঁইয়া গান ধরলে,

‘রুটি খায় নি, দাল খায় নি, খায়নি কভু দই,
হাড়-হাভাতে ওই এল রে—বাবে তোরে সই!
মরি, হায় হায় রে!’

কাবুলের বজ্র-বিগলন শীতে আমার মন ঘেমে ঢোল-না, না, ঢোল নয়, জগঝম্প।

সব ছবি ভুল, কুল্লে তসবীর তালগোল পাকিয়ে প্রথমটায় পিকাস্‌সোতে পরিবর্তিত হয়ে অন্তর্ধান করল।

বিরাট ঘর। কাবুলের গৃহস্থ বাড়ির চারখানা বৈঠকখানা নিয়ে এই একটা ঘর।

তার সুদূরতম কোণে একটি গোল টেবিল। টেবিলক্লথ ভারী মখমলের-জমে যাওয়া রক্তের কাল্‌চে লাল রঙের। তার উপরে সেই প্রাচীন যুগের গ্লোবওলা এক বিরাট রীডিং-ল্যাম্প। সমস্ত ঘর প্রায়ান্ধকার রেখে তার গোল আলো পড়েছে শব্‌নমের মাথার উপর, হাঁটুর উপর, পাদপীঠে রাখা তার ছোট্ট দুটি পায়ের উপর। ঠাণ্ডা, মোলায়েম আলো-আর সেই আলোতে শব্‌নম বাঁ হাতে তুলে ধরে একখানা চটি বই পড়ছে।

শান্ত, নিস্তব্ধ, নির্দ্বন্দ্ব, গ্রন্থিমুক্ত বিশ্রান্তি।

ত্রিভুবনে আর যেন কোনও জনপ্রাণী কীটপতঙ্গ নেই। শুধু একা শব্‌নম। সে প্রশান্ত চিত্তে অপেক্ষা করছে তার দয়িতের জন্য। সে আসছে দূর-দূরান্ত থেকে-যেখানে তৃতীয়ার ক্ষীণচন্দ্র গোধূলী লগনের তারাকে পাণ্ডু চুম্বন দিয়ে বাঁশবনের সবুজনীড়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

আশ্চর্য! সে আমি! কে বিশ্বাস করবে সে আমি!

পা টিপে টিপে কিছুটা এগুতে না এগুতেই শব্‌নম মাথা তুলে আমার দিকে তাকালে। যত নিঃশব্দেই আমি এগুই না কেন, তার কান শুনতে পাক আর নই পাক, তার সদাজাগ্রত কোটিকর্ণ-হৃদয় তো শুনতে পাবেই পাবে।

আমি দ্রুততর গতিতে এগুলুম। আমার হিয়ার বেগের সঙ্গে আমি পেরে উঠি কি করে?

শব্‌নম সিংহাসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। সিংহাসনই বটে। সেই কালচে লালের মখমলে মোড়া, সোনালী কাঁধ হাতলওলা, তার মাঝে মাঝে রয়েল ব্লুর মীনা দিয়ে আঙুর গুচ্ছ আঙুর পাতার নকশা কাটা সুউচ্চ সিংহাসন। বসবার সীট মাটি থেকে আট দশ ইঞ্চি উঁচু। হয় কি না হয়, কিন্তু পিছনের হেলান মানুষের মাথা ছাড়িয়ে আরও দু’মাথা উঁচু।

এই প্রথম শব্‌নম অমার সঙ্গে লৌকিকতা করে উঠে দাঁড়ালে।

আমার দিকে তাকিয়ে চোখ মুখ ঠোঁট গাল চিবুক নাসারন্ধ্র কানায় কানায় ভরে তুলে আমার দিকে তৃপ্তি দাক্ষিণ্য আর নর্ম-সম্ভাষণের মৃদু হাসি হাসলে।

গালের টোল কোন অল গভীরে লীন হয়ে গিয়েছে। সেখানে অন্ধকার। আলো ঢুকতে পারে নি বলে? না, সেখানে কেউ এক ফোঁটা কাজল ঢেলে দিয়েছে বলে?

আজ শব্‌নম সেজেছে।

নববধূকে জবরজ করে সাজানোতে একটা গভীর ত্ত্ব’ রয়েছে। রূপহীনার দৈন্য তখন এমনই চাপা পড়ে যায় যে, সহৃদয় লোক ভাবে, ‘আহা, একে যদি সরল সহজ ভাবে সাজানো হত তবে মিষ্টি দেখাতো; আর সুরূপার বেলাও ভাবে ওই একই কথা না সাজালে তাকে আরও অনেক বেশী সুন্দর দেখাতে!

শব্‌নমকে সেভাবে সাজানো হয় নি, কিংবা সেভাবে সে নিজেকে সাজাতে দেয় নি।

এ যেন পূর্ণচন্দ্রের দূরে দূরে কয়েকটি তারা ফোঁটানো হয়েছে-চন্দ্রের গরিমা বাড়ানোর জন্য। এ যেন উৎসব-গৃহের সৌন্দর্যের মাঝখানে ধূপকাঠি জ্বালানো হয়েছে। শব্‌নমের ভাষায় বলি, বাতাসে বাতাসে পাতা গোলাপ-সৌগন্ধের মাঝখানে বুলবুলের বীথি-বৈতালিক!

তার চুলের বিচ্ছুরিত আলোর মাঝখানে থাকে থাকে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বচ্ছ রূপালি শামা-প্রজাপতি। মাথায় অভ্র-আবীর ছড়ানো হয়েছে অশেষ সযত্নে, এক একটি কণা করে তিন সখী বাসর গোধূলিতে আরম্ভ করে এইমাত্র বোধ হয় কুল প্রসাধন সমান করেছেন।

চোখের কোল, আঁখিপল্লব, ধনু-ভূরু এত উজ্জ্বল নীল কেন? এ তো কাজল কিংবা সুর্মার রঙ নয়। এ যে এক নবীন জৌলুস। তবে কি নীলকান্তমণি চূর্ণ করে কাজলের কাজ করা হয়েছে? তারই শেষ কয়টি কণা টোলের অতলে ছেড়ে দিয়েছে।

এঁকে বেঁকে নেমে-আসা দুই জুলফের ডগায় আবার সেই নীলমণি-চূর্ণ। একদিকে তুষার শুভ্র কর্ণশঙ্খ, অন্যদিকে রক্ত কপোল।

সে কপোল এতই লাল যে আজ যেন কোনও প্রসাধন প্রক্রিয়া দ্বারা সেটাকে ফিকে করা হয়েছে। বদখ্‌শানের রুবি চুর্ণ দিয়ে? তা হলে ঠোঁট দুটিকে টসটসে রসাল ফেটে যায়-যায় আঙুরের মত নধর মধুর করে লালের আভা আনা হল কিসের চূর্ণ দিয়ে? এ রঙ তো আমি আমার দেশের বিম্ববিপীর উচ্চতম শাখাতে পল্লববিতানের অন্তরালে দেখেছি-যেখানে মানুষের কলুষদৃষ্টি, দুষ্ট বালকের স্কুল হস্ত পৌঁছায় না।

ওষ্ঠ পূর্বভাগে, স্ফুরিত নাসারন্ধ্রের নিচে সামান্য, অতি সামান্য একটি নীলাঞ্জন রেখা। ভরা ভাদ্রের গোধূলি বেলা আকাশের বায়ু কোণে পুঞ্জে পুঞ্জে জমে ওঠা শ্যামাম্বুদে আমি দেখেছি এই রঙ। গভীর রহস্যে ভরা এই রঙ। তারই উপরে স্ফুরিত হচ্ছে শব্‌নমের দুটি ক্ষুদ্র নাসারন্ধ্র। নিচে অতি ক্ষীণ কম্পমান স্ফুরণ লেগেছে তার ওষ্ঠাধরে।

এই প্রথম দেখলুম তার চোখ দুটি। এ দুটি থেকে আগুনের ফুলকি বেরুতে দেখেছি, এ আঁখি দুটিতে আচম্বিতে জল ভরে ফেটে পড়তে দেখেছি, কিন্তু এ চোখ দুটিকে আমি কখনও দেখিনি। আজ এই প্রাচীন দিনের ল্যাম্প আমাদের মিলনে শুভলগ্নে ঠিক সেই আলোটি ফেললে যার দাক্ষিণ্যে আমি শব্‌নমের চোখ দুটি দেখতে পেলুম।

সবুজ না নীল? নীল না সবুজ? অতৃপ্ত নয়নে আমি সে দুটি আঁখির গভীরতম অতলে অনেক্ষণ ধরে তাকালুম তবু বুঝতে পারলুম না সবুজ না নীল। হাঁ, হাঁ, হঠাৎ মনে পড়ে গেল, হাঁ, দেখেছি বটে এই রঙ আসামের হাফুলঙের কাছে! বড় বড় পাথরের মাঝখানে গিরিপ্রস্রবণ কুণ্ডের স্থির নীলজলের অতলে সবুজ শ্যাওলা। সেদিন ঠিক করতে পারি নি, কি রঙ দেখলুম, নীল না সবুজ—আজ বুঝলুম দুয়ের সংমিশ্রণে এমন এক কম্পলোকের রঙ প্রভাসিত হয় যে, সে রঙ ইহভূমের আর্টিস্টের পেলেটে তো নেই-ই, সৃষ্টিকর্তা যে আকাশে রঙ বেরঙের তুলি বোলান তাতেও নেই।

শব্‌নমের স্মিত হাস্য ফুরোতে চায় না। কী মধুর হাসি!

কাবুলের মেয়েরা কি বিয়ের রাতে গয়না পরে না। শব্‌নম পরেছে সামান্য দু’তিনটি। তার সেই বিরাট খোঁপা জড়িয়ে একটি মোতির জাল। ঘনকৃষ্ণ কুন্তলদামের উপর স্তরে স্তরে, পাকে পাকে যেন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হিমানীকণা ঝিলিমিলি মেলা লাগিয়েছে।

দু’কানে দুটি মুক্তোলতা ঝুলছে আর তার শেষ প্রান্তে একটি করে রক্তমণি-রুবি। শুভ্র মরাল কন্ঠের বরফের উপর যেন দু ফোঁটা সদ্যঝরা তাজা রক্ত পড়েছে। এই, এখখুনি বুঝি রক্তের ফোঁটা দুটি ছড়াতে চুবসাতে আরম্ভ করবে।

কাবুলী কুর্তা গলা বন্ধ হয়-বিশেষ করে মেয়েদের। আজ দেখি, গলা অনেকখানি নিচে ঘুরিয়ে কাটা হয়েছে। তাই দেখা যাচ্ছে একটি মোতির মালা। তার শেষ প্রান্তে কি, দেখতে পেলুম না। সেটি জামার ভিতরে। সে কি সৌভাগ্যবান। এই এতদিনে বুঝতে পারলুম কালিদাস কোন দুঃখে বলেছিলেন, ‘হে সৌভাগ্যবান মুক্তা, তুমি একবার মাত্র লৌহশলাকায় বিদ্ধ হয়ে তার পর থেকেই প্রিয়ার বক্ষদেশে বিরাজ করছ; আমি মন্দভাগ্য শতবার বিরহ শলাকায় সছিদ্র হয়েও সেখানে স্থান পাই নে।’

শব্‌নমের পরনে সার্টিনের শিলওয়ার, কুর্তার রঙ ফিকে লাইলেক, ওড়না কচি কলাপাতা রঙের এবং দুধে আলতা সংমিশ্রণের মত সেই কচি কলাপাতা রঙের সঙ্গে দুধ মেশানো। ইতস্তত রূপালি জরির চুমকি। কলাবনে জোনাকির দেয়ালি।

শব্‌নমের স্মিতহাস্য অন্তহীন। আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে আছি।

হাসতে হাসতে আমাকে গভীর আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে আমার ঠোঁটের উপর তার স্ফুরিতাধরোষ্ঠ চেপে ধরে যেন অতৃপ্ত আবেগে আমার পাণ্ডুর অধরের শেষ রক্তবিন্দু শুষে নিতে লাগল।

আমি মুহ্যমান, কম্প্ৰবক্ষ, বেপথুমান। আমার দৈহিক স্পর্শকাতরতা অস্তমিত! আমার সর্বসত্ত্বা শব্‌নমে বিলীন।

কোন্ দিগন্তে সে আমায় উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল, কোন তারা নির্ঝরের ছায়াপথে সে আমায় ভাসিয়ে নিয়ে গিয়ে, কোন্ সপ্তর্ষির তারা জাল ছিন্ন করে কোন লোকে নিয়ে গিয়েছিল জানি নে। অচৈতন্য অবস্থায় দেখি, আমি শব্‌নমের সিংহাসনে বসে আছি, সে আমার কোলে আড়াআড়ি হয়ে বসে, তার বুক আমার বুকের উপর রেখে, ডান হাত দিয়ে আমার গলা জড়িয়ে, বাঁ হাত দিয়ে আমার গাল বুলোতে বুলোতে, তার মুখ আমার কানের উপর চেপে ধরে শুধোচ্ছে, খুশী? খুশী? খুশী? খু…..???

আমি আলিঙ্গন ঘনতর করে বলেছিলুম, “আমি তোমার গোলাম। আমাকে তোমার সেবার কাজ দাও।”

শুধিয়ে চলেছে, ‘খুশী? খুশী? খুশী-?

আমি বললুম, ‘আল্লা সাক্ষী, আমি প্রথম যেদিন তোমাকে ভালবেসেছি সেদিন থেকে শত বিরহ-বেদনার পিছনেও খুশী। তুমি জান না, তুমি আছ, এতেই আমি খুশী। প্রথম দিনের প্রথম খুশীর প্রথম নবীনতা বারে বারে ফিরে আসছে।

শব্‌নম গুণগুণ করে ফরাসীতে গাইলে,

‘করেছি আবিষ্কার।
তোমারে ভালবাসিবার
প্রথম যেমন বেসেছি ভালো, সেই বাসি প্রতিবার।’

নয় কি?

আমার উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করেই বললে, দাঁড়াও! আলো জ্বালি।

আমার কথায় কান না দিয়ে ঘরের প্রায়ান্ধকার কোণ থেকে নিয়ে এল আঁকশি। তার ডগার ন্যাকরায় কি মাখানো জানি নে। শব্‌নম আনাড়ি হতে দেশলাই জ্বালিয়ে সেটার কাছে নিতেই দপ করে জ্বলে উঠল। সেই জ্বলন্ত আঁকশি দিয়ে সে ঝাড়বাতির অগুনতি মোমবাতি জ্বালালে। ঘরের দেয়ালে দামী ফরাসী সিল্কের ওয়ালপেপারে সে আলো প্রতিফলিত হয়ে আমার চোখ ধাঁধিয়ে দিলে।

আমার পায়ের কাছে পাদপীঠে বসে বললে, “তুমি নূতন রাজা এসেছ, তোমাকে বরণ করার জন্য সব কটা আলো জ্বালাতে হয়। যে বেশ পড়েছ, তার জন্য এ আলোর প্রয়োজন। কি সুন্দরই না তোমাকে-”

‘থাক।’

‘চুপ!-দেখাচ্ছে। আমার ওস্তাদের মেয়ের রুচি আছে।’

আমি বললুম, তোমাদের কবি হাফিজই তো বলেছেন।

‘বলে দাও বাতি না জ্বালায় আজি, আমাদের নাহি সীমা,
আজ প্রেয়সীর মুখ চন্দ্রের আনন্দ-পূর্ণিমা’
-(সত্যেন দত্ত)

শব্‌নম বললে, “ওঃ, হাফিজ। তিনি তো বলেছেন আজ বাতি জ্বালিয়ে না”—অর্থাৎ তার পর মাত্র একদিনের তরে। আমাদের পরব হবে প্রতি রাত্রি। তাই আজ রাত্রের আনুষ্ঠানিক আলো মাত্র একবারের তরে জ্বালিয়ে দিলুম। ভয় করো না, তাও নিবিয়ে দিচ্ছি এখখুনি।

আমি খুশী হয়ে বললুম, ‘টেবিল ল্যাম্পের ওই ঠাণ্ডা আলোতে তোমাকে কি অপূর্ব সুন্দর দেখাচ্ছিল কি বলব? মাথার চুল থেকে খালি পায়ের নখের ডগাটি পর্যন্ত কী এক অদ্ভুত রহস্যময় অথচ কী এক অনাবিল শান্তিতে ভরপুর হয়ে বিভাসিত হচ্ছিল, কি করে বোঝাই? আচ্ছা, মোজ-ছাড়া পায়ে তোমার ঠাণ্ডা লাগছে না বাইরে যা শীত!’

অবাক হয়ে বললে, বা রে! তুমি যে বলেছ আমার খালি পা দেখতে ভালো লাগে।

আমি আফসোস করে বললাম, তোমার কতটুকু দেখতে পাই।

চোখ পাকিয়ে বললে, চোপ! দুষ্টুমী করো না। চোখ ঝলসে যাবে। সেমেলে যখন জুপিটারের দেবরূপ দেখতে চেয়েছিলেন তখন তার কি হয়েছিল জান না?

আমি শুধালুম, কি হয়েছিল?

‘আলোতে পোকা পড়লে যে রকম ফট করে ফেটে যায়—তাই হয়েছিল?’ প্রত্যেক মানুষই জুপিটার। তার দেবরূপ উন্মোচন করা বিপজ্জনক। জান, তাকাতে গিয়ে আমারই মাঝে মাঝে ভয় হয়।

ফুরুৎ করে উড়ে গিয়ে কোথা থেকে সিগারেট এনে ঠোঁটে চেপে, আনাড়ি ধরনের দেশলাই ধরিয়ে কাশতে কাশতে আমায় দিয়ে বললে, ভালো না লাগলে ফেলে দিয়ে।

এ দুর্দিনে এ রকম সোনামুখী বুশবোদার মিশরী সিগারেট পেল কোথায়?

বললে, জানেমন্‌ তিন মাস অন্তর অন্তর তিন তিন হাজার করে মিশর থেকে আনায়। আমাকে ধরার চেষ্টা করেছিল—পারে নি। কিন্তু কেউ খেলে সিগারেটের গন্ধ আমার ভালোই লাগে। ন্যাকরা করে ওয়াক থু বলতে পারি নে।

আমি বললুম, ‘সর্বনাশ! এই সুপার স্পেশাল সিগারেট যিনি খান তাঁর জন্যে তুমি এনেছিলে আমার সেই ওঁচা সিগারেট!’

বললে, আমার বন্ধুর সিগারেট। জানেমন্ দুটো ধরিয়ে একটা আমাকে দিয়ে বললে, এ সিগারেট খেতে তো তোর আপত্তি হবে না।

আমি শঙ্কিত হয়ে শুধালুম, “তুমি কি বলেছিলে?”

‘নির্ভয় বলেছিলুম, “লব সুখতে?”—পোড়ার ঠোঁটো, পোড়ার মুখো, যা খুশী বলতে পার। ওই পোড়ার সিগারেট খেয়ে খেয়ে জানেমন্‌ তার ঠোঁট মভ্‌ করে ফেলেছে, দেখ নি?”

আমি শুধালুম, ‘তন্ময় হয়ে কি পড়ছিলে? গুড় বাই টু ফ্রীডম?’

বললে, “সে কি? বরঞ্চ তোমার লীলাখেলা বন্ধ হল। কিন্তু আগে বলি, তোমার নিশ্চয় হাসি পাচ্ছে, একই কনেকে দুদু বার বিয়ে করছ বলে? আমারও পাচ্ছিল। হঠাৎ মনে পড়ল, তোমাকে বলেছিলুম, তুমি দ্বিচারী—তুমি বাস্তবে আমাকে আদর কর, আর স্বপ্নে আরেক জনকে। আল্লাতালা তাই একই শব্‌নমের সঙ্গে তোমার দু’বার বিয়ে দিয়ে তোমাকে দ্বিচারী বদনাম থেকে মুক্তি দিয়েছেন। স্বপ্নের শব্‌নম আর বাস্তবের হিমিকা এক হয়ে গেল। না?’

আমি বললাম, অতি সূক্ষ্ম যুক্তিজাল। কিংবা বলব হৃদয়ের ন্যায় শাস্ত্র-নব্য ‘নব-ন্যায়’। তোমাকে তো বলেছি, হৃদয়ের যুক্তি তর্কশাস্ত্রের বিধি-বিধানের অনুশাসন মানে না। আকাশের জল আর চোখের জল একই যুক্তি কারণে ঝরে না।

আশ্চর্য হয়ে বললে, এ কথাটা তুমি আমাকে কখনো বল নি। এ ভারী নূতন কথা।

আমি বললুম, হবেও বা, কারণ কোনটা তোমাকে বলি আর কোনটা নিজেকে বলি এ দুটোতে আমার আকছারই ঘুলিয়ে যায়।

আমার হাঁটুর উপর চিবুক রেখে শব্‌নম অনেকক্ষণ ধরে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।

আমি আশ্চর্য হয়ে চিন্তা করতে লাগলুম, শব্‌নম কি গিরিগিটি? সে যেমন দেহের রঙ বদলায় সেই রকম শব্‌নম চোখের রঙ ঘড়ি ঘড়ি বদলাতে পারে। আলোর ফেরফারে তো এত বেশী অদলবদল হওয়ার কথা নয়। এখন তো দেখছি, শ্যাওলার ঘন সবুজ, অথচ এই অল্প কিছুক্ষণ হল দেখেছি, একেবারে স্বচ্ছ নীল। তবে কি ওর হৃদয়াবেগ, চিন্তাধারার সঙ্গে সঙ্গে ওর চোখের রঙও বদলায়। স্থির করলুম, লক্ষ্য করে দেখতে হবে।

আমি মাথা নিচু করে, দুহাত দিয়ে তার মাথা তুলে, তার ঠোঁটের উপর ঠোঁট রাখলাম। আমার চোখ দুটি তার চোখের অতি কাছে এসে নিবিড় দৃষ্টিতে তার চোখের অতলে পৌঁছে গিয়েছে। শব্‌নম অজানা আবেশে চোখ দুটি বন্ধ করলে।

কতক্ষণ চলে গেল কে জানে? বুকের ঘড়ি যেন প্রতি মুহূর্তে প্রহরের ঘণ্টা বাজাচ্ছে। হিমিকাকে এই আমার প্রথম চুম্বন।

অনেকক্ষণ পরে, বোধ হয় একশ বছর পরে, শব্‌নম তার ঠোঁট যতখানি সামান্যতম সরালে কথা বলা যায় সেটুকু সরিয়ে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললে, ‘চুমো খাওয়া তোমাকেই সাজে। সেই নদীপারে প্রথম হার মানার পর আমি মনস্থির করেছিলাম, সব জিনিস আমি দেব, আর তুমি নেবে। চুমো খাব আমি, অলিঙ্গন করব আমি, আর তোমাকে যে তোমার ছেলেমেয়ে দেব আমি, সে তো জানা কথা। এখন দেখছি, তা হয় না। চুমো খাওয়া পুরুষেরই সাজে।’

আমি বললুম। কিন্তু আমি যদি বলি, তুমি যখন আমাকে চুমো খাও তখন আমার কাছে সেটা অনন্তগুণ মধুময় বলে মনে হয়?

‘বাঁচালে’ বলে ঠোঁটে ঠোঁট রেখে চাপ দিলে নিবিড় আবেশে।

জানি নে, কতক্ষণ, বহুক্ষণ পরে দেখি, শব্‌নম আমার কোলে মাথা রেখে ঘুমুচ্ছে। বললে, আমার খোঁপাটা খুলে দাও।

তারপর হঠাৎ ধড়মড় করে উঠে আবার উড়ে গিয়ে ফিরে এল ফিরোজা রঙের চীনা কাচের একটি ডিকেণ্টার হাতে করে। কাচের ফিকে রঙের ভিতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে কড়া লালের বেগুনী আভা।

বললে, ‘পার্দনে মোয়া, মঁশের-মাপ কর দোস্ত-একদম ভুলে গিয়েছিলুম, তুমি আমার গালের টোল ভরে সিরাজী খেতে চেয়েছিলে।’

আমি রীতিমত ভয় পেয়ে বললুম, করেছ কি? এটা জোগাড় করতে গিয়ে জানাজানি হয় নি?

শব্‌নম হেসে ফেটে আটখানা। বললে,

তুমি কি ভেবেছ, তুমি মোল্লাবাড়িতে বিয়ে করেছ? রাজা তিমুর থেকে আরম্ভ করে বাবুর, হুমায়ুন-কে শরাব খেয়ে টং হয় নি বল তো? এ বাড়িতে আমার ঠাকুর্দা পর্যন্ত। তাঁর জমানো মাল এখনও নিচে যা আছে তা দিয়ে তিন পুরুষ চলবে।

আমি বললুম, আমার দরকার নেই। আমি হাফিজের চেলা। তিনি বলেছেন,

“শর্করা মিঠা, আমারে বল না, হিমি। আমি তাহা জানি”—সঙ্গে সঙ্গে শব্‌নম গেয়ে উঠল,

“তবু সবচেয়ে ভালবাসি ওই মধুর অধরখানি?”

আমি বললুম তুমি যে এত আলো জ্বালিয়েছ তারও দরকার নেইঃ-

“বলে দাও, বাতি না জ্বালিয়ে আজি, আমাদের নাহি সীমা?”—

সেই আঁকশির উলটো দিক দিয়ে আলো নেবাতে নেবাতে গুনগুন করে শব্‌নম বার বার গাইলে,

“আজ প্রেয়সীর মুখচন্দ্রের আনন্দ পূর্ণিমা?”

তারপর ঘরের কোণ থেকে সেতার এনে আমার কোলের উপর বসে তার খেলা চুল আমার বুকের উপর ছোয়ে দিয়ে সমস্ত গজলটি বারবার অনেকবার গাইলে। তন্ময় হয়ে শেষের দুটি ছত্র অনেকক্ষণ ধরে, কখনও গুনগুন করে, কখনও বেশ একটু গলা চড়িয়ে গাইলে,

“প্রিয়ারে ছাড়িয়া থেক না হাফিজ! ছেড় না অধর লাল
এ যে গোলাপের চামেলির দিন—এ যে উৎসব-কাল?”

আমি একটি ক্ষুদ্র দীর্ঘনিবাস ফেলে বললুম, তোমার এত গুণ! তোমাকে আমি কোথায় রাখি। সুন্দর ইউসুফ শুধু যে সে যুগের সব চেয়ে সুপুরুষ ছিলেন তাই নয়, তাঁর মত দূরদৃষ্টি নিয়ে জন্মেছিল অল্প লোকই, এবং সব চেয়ে বড় ছিল তাঁর চরিত্রবল। তাই তাঁর মার কোল থেকে কেড়ে নিয়ে তাঁকে বসিয়ে দিলে, সেই সুদূর মিশরের রাজসিংহাসনে।

শব্‌নম বললে, হ্যাঁ। আর তাই মাতৃভূমি কিনানের স্মরণে,

“মিশর দেশের সিংহাসনেতে বসিয়া ইসুফ রাজা
কহিত, ‘হায়রে! এর চেয়ে ভাল কিনানে ভিখারী সাজা?”

দাঁড়িয়ে উঠে আমাকে হাতে ধরে নিয়ে গেল দক্ষিণের দেয়ালের দিকে। থিয়েটারের পরদার মত একখানা মখমলের পরদা ছিল ঘরের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত অবধি ঝোলানো। একটানে সেটা সরাতেই সামনের খোলা পৃথিবী তার অসীম সৌন্দর্য নিয়ে আমাকে একেবারে বাক্যহারা করে দিল।

দুখানা চেয়ার পাশাপাশি রেখে আমায় শুধালে, শীত করছে?

আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই পুস্তিনের একখানা ফারকোট দু’জনার জানু থেকে পা অবধি জড়িয়ে দিয়ে তাকিয়ে রইল বাইরের দিকে।

এ সৌন্দর্য শুধু শীতের দেশেই সম্ভব।

সমুদ্রের জল আর বেলাভূমির বালুর উপর পূর্ণিমার আলো প্রতিফলিত হয়ে যে জ্যোৎস্না চোখ ধাঁধিয়ে দেয় এখানে যেন তারই পৌনঃপুনিক দশমিক এখানে শত শত যোজন-জোড়া নিরন্ধ্র সর্বব্যাপী ধবলতম ধবল বরফের উপর প্রতিফলিত হয়ে এক পক্ষের পূর্ণচন্দ্র যেন শত পক্ষের জ্যোতিঃ আহরণ করেছেন, হিমানী-যোগিনী উমারাণীর এক বদন-ইন্দু যেন চৌষট্টি যোগিনীর মুখেন্দীবর দীপান্দিতায় রূপান্তরিত হচ্ছেন।

দূরে পাগমান পর্বতের সানুদেশ, চূড়া—তারও দূর দিগন্তে হিন্দুকুশের অর্ধগগনচুম্বী শিখর, কাছে শিশির ঋতুর নিদ্ৰবিজড়িত বিসর্পিল কাবুল নদী, আরও কাছের সুপ্তিমগ্ন নিষ্প্রদীপ গৃহ-গবাক্ষ চন্দ্রশাল-হৰ্মামালা, পল্লবহীন নগ্ন বৃক্ষ, হৃতপত্র শাখা প্রশাখা, উদ্বাহু মিনার-মিনারিকা, বিপরীতার্থ ডিম্ব গম্বুজ, গোরস্তানের শায়িত সারি সারি কবরের নামলাঞ্চন-প্রস্তর-ফলক—সর্ব সৌন্দর্য সর্ব বিভীষিকা, সর্ব সৰ্বাধিকারীর অলঙ্কার সর্ব সর্বহারার দৈন্য, ভদ্রাভদ্র সকলের উপর নির্বিচারে প্রসারিত হয়েছে তুষারের আস্তরণ। আকাশের মা-জননী যেন এক বিরাট শুভ্র কম্বল দিয়ে তাঁর একান্ন পরিবারের ধনী-দরিদ্র রাজা-প্রজা তার সর্বসন্তান-সন্ততিকে আবরিত করে তাদের পার্থক্য ঘুচিয়ে দিয়েছেন।

কী নৈঃশব্দ্য, নৈস্তব্ধ! রাজপথের দ্বিতীয়য়ামের মদ্যানুরাগী, সখা, কদ্রুপ সঙ্গীতস্তনিত গণিকাবল্লভ সকলেই একই প্রিয়ার গভীর আলিঙ্গন সোহাগে সুষুপ্ত—সে প্রিয়া গৃহকোণের তপ্ত শয্যা। রাজপ্রাসাদের দুর্গ প্রকারের প্রহর ডিন্ডিম নিস্তব্ধ। কল্য ঊষার মধুর-কণ্ঠ মুআজ্জিন অদ্য নিশার নিদ্রাস্তরণে আকষ্ঠ বিলীন।

গম্ভীর প্রহেলিকাময় এ দৃশ্য। কে বলে একা, একটিমাত্র রঙ দিয়ে ছবি আঁকা যায় না? কে বলে একা একমাত্র সা স্বর দিয়ে গান গাওয়া যায় না? কে বলে একা একটি ফুল ভুবন পুলকিত করতে পারে না? এই সর্বব্যাপী শুভ্রতা-সৌরভে যে সঙ্গীত মধুরিমা আছে সে তো মানুষের সবচৈতন্যে প্রবেশ করে তাকেও বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে একাত্মদেহ করে দেয়। সৃষ্টিরহস্য তখন তার কাছে আর প্রহেলিকা থাকে না সে তখন তারই অংশাবতার। আমার হৃদয় তখন সে সৌন্দর্যে অবগাহন করতে করতে হিন্দুকুশ পেরিয়ে আমু দরিয়া তাশকন্দ ছাড়িয়ে বৈকালী হ্রদের কূলে কূলে সন্তরণ করছে।

আমাদের মাথার উপর পূর্ণচন্দ্র। এতক্ষণে আমার চোখ থেকে টেবিল ল্যাম্পের শেষ জ্যোতিঃকণার রেশ কেটে গিয়েছে। দেখি, প্রখর চন্দ্রালোক বিচ্ছুরিত হচ্ছে শব্‌নমের সিত ভালে, স্ফুরিত নাসিকারন্ধ্রে, ইষতার্দ্র ওষ্ঠাধরে, সমুন্নত কঞ্চুলিকা শিখরাগ্রে। বেলাতটের নীলাভ কৃষ্ণাম্বুর মত তার চোখের তারায় গভীর নৈস্তব্ধ্য। গিরিকুমারীর মরালগ্রীবা, হিন্দুকু গিরির মতই ধবল শুভ্র। এতদিনে বুঝতে পারলুম অক্ষতযোনী গৌরীকে কেন গিরিরাজতনয়া বলে কল্পনা করা হয়েছে।

পূর্ণচন্দ্রের দিকে তাকিয়ে মৃদু কণ্ঠে বললুম, হে কমরুল কওকাব। এই কমরুন্নিসাকে আশীর্বাদ কর। হে ইন্দুবর-না, না, হে ইন্দুমৌলি, তুমি একদা গিরিকুমারীর শুভ্রশুচিতার চরম মূল্য দিয়েছিলে। আজ এই কাবুলগিরিকন্যাকে তুমি আমার প্রসন্ন দক্ষিণ মুখ দেখাও। আমাদের বাতায়নপ্রান্তে এসে তোমার ইন্দীবর নয়ন উন্মীলন করে দেখ, এ কুমারীর কটিতট তোমারই মত, হে নটরাজ, তোমারই ডমরুকটির মত ক্ষীণচক্র-

“হে ক্ষীণ কটি এ তিন অনে নটরাজে শুধু রাজে
এ হিমা প্রতিমা আমারে বরিয়া নাহি যেন মরে লাজে।”

শব্‌নম আবার সেই প্রথম দর্শনের দীর্ঘ স্মিতহাস্য দিয়ে ঘরের ভিতর চন্দ্রালোকে এনে শুধালে, আমার ‘নূরু-ই-চশম্‌-আঁখির আভা—কি ভাবছ?’

আমি বললুম, গিরিরাজ হিন্দুকুশকে বলছিলুম তোমার মঙ্গল কামনা করতে।

‘সে কি বুৎ-পরস্তী প্রতিমাপূজার শামিল নয়।‘

আলবৎ নয়। আমি যখন আমার বন্ধুকে বলি, আমার মঙ্গল কামনা কর, তখন কি আমি তার পূজো করি? আমি যখন গিয়াসউদ্দীন চিরাগ-দিল্লীর কবরে গিয়ে বলি, “হে খাজা তুমি আমার মঙ্গল কামনা কর,” তখন কি আমি তাকে খুদা বানাই? অজ্ঞজন যখন মনে করে এই গোরের কোন অলৌকিক শক্তি আছে, অর্থাৎ গোরেই আল্লার অংশ বিরাজ করছে তখনই হয় বুৎ-পরন্তী।

আপন মনে একটু হেসে নিয়ে বললাম, ‘আর এই বুৎ-পরন্তী আরম্ভ হয় তোমাদের দেশেই প্রথম। আজ যে অঞ্চলের নাম জালালাবাদ তারই নাম সংস্কৃতে গান্ধার-’

‘দাঁড়াও, দাঁড়াও। মনে পড়েছে। এখনও জালালাবাদের বকরী-ছাগলকে কাবুল বাজারে বলে বুজ-ই গান্ধারী। তার পর বল।

আলেকজাণ্ডারের গ্রীক সৈন্যরা যখন সেখানে থাকার ফলে বৌদ্ধ হয়ে গেল তখন তারাই সর্বপ্রথম গ্রীক দেব-দেবীর অনুকরণে বুদ্ধের মূর্তি গড়ে তাঁর পূজো করতে লাগল -ভারতবর্ষের আর সর্বত্র তখনও বুদ্ধের মূর্তি গড়া কড়া মানা, এমন কি বুদ্ধকে অলৌকিক শক্তির আধার রূপে ধারণা করে তাকে আল্লার আসনে বসানো বৌদ্ধদের কল্পনার বাইরে। সেই গ্রীক বৌদ্ধমূর্তি হিন্দুস্থানে ছড়িয়ে পড়বার পর, পরবর্তী যুগে সেই আর্টের নাম হল গান্ধার আর্ট।

ভারী খুশী হয়ে বললে, ওঃ! আমরা মহাজন।

আমি আরও খুশী হয়ে বললুম, বলে! এখনও কাবুলীরা আমাদের টাকা ধার দেয়।

গম্ভীর হয়ে বললে, ‘সে কথা থাক’। আরেক দিন এ কথা উঠলে পর শব্‌নম বিরক্ত হয়ে বলেছিল, ভারত আফগান উভয় সরকারে মিলে এ বদনামি বন্ধ করে দেওয়া উচিত।

‘আর তোমাদের মেয়ে গান্ধারী আমাদের ছেলে ধৃতরাষ্ট্রকে বিয়ে করেছিল। তাদের হয়েছিল একটা ছেলে আর একটি মেয়ে।

‘ক’টি বললে?’

‘একশ এক।’

আমার হাঁটুতে মাথা ঠুকতে ফুকতে বললে, ‘হায়, হায়! আমার সর্বনাশ হয়ে গেল। আমি স্থির করেছিলুম, আমিই তোমাকে একশটা আণ্ডা বাচ্চা দেব। এখন কি হবে।’

আমি আনমনে বাঁ হাত তার গ্রীবার উপর রেখে চুলে পাক মেরে ডান হাতে ডগাগুলো পাকের ভিতর ঢুকিয়ে চাপ দিতেই খাসা এলে-খোঁপা হয়ে গেল।

শব্‌নম আপন জীবন মরণ সমস্যার কথা ভুলে গিয়ে, ফারকোটের ঢাকনা ঠেলে ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে শুধালে, ‘তিন সত্যি করে বল, তুমি ক’জন মেয়ের খোঁপা বেঁধে দিয়ে দিয়ে এ রকম হাত পাকিয়েছ?’

আমি অপাপবিদ্ধ স্বরে বললুম, মায়ের হাত জোড়া থাকলে আমাকে খোঁপাটা শক্ত করে দিতে বলতেন।

আস্তে আস্তে ফের পাশে বসে বললে, যাক! তোমার উপস্থিত বুদ্ধি আছে।

অর্থাৎ বিশ্বাস করল কি না তার ইসপার-উসপার হল না।

আমি বললুম, তুমি সেদিন আমার হাত টিপতে টিপতে বললে, আমার হাত বড় নরম। আমি সরল ইমানদার মানুষ-কই আমি তো শুধোই নি, তুমি কজন পুরুষের হাত টিপে টিপে এ তত্ত্বটা আবিষ্কার করলে?

‘বিস্তর। আব্বা, আজেমন—এ যাবৎ। টিপে দেব আরও বিস্তর। তোমার আব্বা,-বল তো ভাই, তোমার জানেমন্‌ কজন?

আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই বললে, ছিঃ। শহরের সঙ্গে প্রথম রাত্রে তর্ক করতে নেই। তুমি জিজ্ঞেস করছিলে না, কি বই পড়ছি, যখন ঘরে ঢুকলে? আমার এক সখী বইখানা টেবিলের উপর রেখে গিয়েছিলেন। ‘শব-ই-জুফফাফ’—‘বাসর-রাত্রি’। আল্ল-রসুলের দোহাই দিয়ে বিস্তর ভালো কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে এ বইয়ের লেখক একটা উপদেশ দিয়েছে পঞ্চাশ বার—“শওহরের ভালো-মন্দ বিচার করতে যেয়ো না। তিনি আল্লার দেওয়া উপহার।”

আমি পরম পরিতৃপ্তির নিশ্বাস ফেলে বললুম, ‘এ লেখক শতায়ু হন, সহস্ৰায়ু হন। আমি নিশ্চিন্ত হলুম-কারণ আমি-’

বাধা দিয়ে বললে, তুমি একটু চুপ করো তো। আমি তোমাকে যে কথা বলবার জন্য জানলার কাছে নিয়ে এসেছিলাম সেইটের আখেরী সমাধান করতে চাই—এ নিয়ে যেন আর কোনদিন কোনও বাক-বিতণ্ডা না হয়।

আমি সত্যিই ভয় পেয়ে বললুম, ‘আমি যে ভয় পাচ্ছি হিমিকা।’

‘আবার! শোনো।’

ওই যে পূর্ণচন্দ্র তাকে সাক্ষী রেখে বলছি,

আমি জুলিয়েটের মত তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বললুম, ‘না, না, ওকে না। বরঞ্চ তুমি ফজরের আজানের পূর্বেকার শব্‌নম হিমিকার নাম করে-’

‘তা হলে তোমার প্রিয় গিরিরাজ হিন্দুকুশের উপর যে চির হিমিকা বিরাজ করছে, প্রচণ্ডতম নিদাঘেও যার ক্ষয়ক্ষতি হয় না, তাকে সামনে রেখে বলছি, তার দোহাই দিয়ে বলছি, তুমি আত্মবমাননা করো না, নিজেকে লঘু করে দেখ না। কুমারী কন্যা যে রকম প্রহরের পর প্রহর ধরে বছরের পর বছর আপন দয়িতের স্বপ্ন দেখে, মাতা যে রকম প্রথম গর্ভের কণিকাটিকে সোহাগ কল্পনায় প্রতিদিন রক্তমাংস দিয়ে গড়ে তোলে, ঠিক তেমনি আমি তোমাকে তৈরি করেছি, সেই যে-দিন আমি প্রথম বুঝলুম, আমি অসম্পূর্ণ, আমি নিদ্রিতা শাহজাদী, আমি অন্ধ প্রদীপ, আমার দয়িত রাজপুত্র দূরদূরান্ত আমার প্রতীক্ষ-দিনান্তের ওপার থেকে এসে আমাকে সঞ্জীবিত করবে, অশ্রুজল সিঞ্চন করে করে আমি যে প্রেমের বল্লরী বাড়িয়ে তুলেছি, তারই করুণ করস্পর্শে পুষ্পে পূন্সে মঞ্জরিত হবে সে একদিন- আকাশ-কুসুম চয়ন করে করে রচেছি তার জন্য আমার শব্‌-ই-জুফফারের ফুলশয্যা, প্রার্থনা করেছি, সে রাত্রে যেন পূর্ণচন্দ্র গিরিশিখরের মুকুটরূপে আকাশে উদয় হয়। সূর্যের প্রেম পেয়ে সে হয় ভাস্বর, আমার অন্ধবদনও তেমনি জ্যোতির্ময় হবে আমার বঁধুর ওষ্ঠাধরের সামান্যতম ছোয়াচ লেগে।

‘তাই যখন তোমাকে প্রথম দেখলুম তখন আপন চোখকে বিশ্বাস করতে পারি নি।’

‘আমি আমার হৃদয়ে ঝাপসা ঝাপসা যে স্কেচ এতদিন ধরে এঁকেছিলুম এ যেন হঠাৎ ভাস্করের হাতে পরিপূর্ণ নির্মিত মূর্তি হয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। চিন্ময় মৃদু সৌরভ যেন মৃন্ময় নিকুঞ্জবনের কুসুমদামে রূপান্তরিত হল।’

‘টেনিস কোর্টে তাই অত সহজে তোমার সঙ্গে কথা বলতে পারছিলুম কিন্তু সমস্তক্ষণই ভাবছিলুম অন্য কথা—’

‘মৃন্ময় চিন্ময় হয় সে আমি জানি। কি যেন এক ফলের কয়েক ফোঁটা রসকে শুকিয়ে তাতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে করা হল ধুঁয়ো। তারই আড়াই পাক মগজের সেল্‌কে আলতো আলতো ছুঁতে না ছুঁতেই পথের অন্ধ ভিখারী দেখে, সে রাজবেশ পরে শুয়ে আছে বেহেশ্‌তের হুরীর স্ত্রীর কোলে মাথা দিয়ে। প্রণয়পীড়ায় ব্যথিত আতুর ক্রন্দসী-প্রেয়সী হুরীরাণী তারই দিকে তাকিয়ে আছে, করুণ নয়নে, পথের ভিখারীর মত, যেন অভাগিনীর প্রেম-নিবেদন পদদলিত না হয়!’

‘অতদূর যাই কেন, আর এ তো নেশার কথা।’

‘একটি অতি ক্ষুদ্র তুচ্ছ কালো তিল। শীরাজবাসিনী তুর্কী রমণী সাকীর গালে সেইটি দেখে হাফিজ মুহুর্তেই তার বদলে সমরকন্দ্‌ আর বুখারা শহর বিলিয়ে দিয়ে ফকীর হয়ে গোরস্তানে গিয়ে বসে রইলেন।’

‘কিন্তু চিন্ময় মৃন্ময় হয় কি করে?’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, বুঝেছি, বুঝেছি। পরে বুঝেছি, আরও ভালো করে, মর্মান্তিকরূপে কান্দাহারে। আমার হৃদয়বেদনা তো সম্পূর্ণ চিন্ময়। তারই পেয়ালা যখন ভরে যায় তখন সে উপছে পড়ে আঁখি বারি রূপে। তুমি সুন্দর বলেছ, ‘আকাশের জল আর চোখের জল একই কারণে ঝরে না’; ‘আমি তাতে যোগ দিলুম—তাদের উপাদানও সম্পূর্ণ আলাদা, একটি মৃন্ময় আরেকটা চিন্ময়, একটা বাঙ্ময়-সারা আকাশ মুখর করে তোলে, আরেকটা নৈস্তন্তে বিরাজ করে সর্ব মনময়।

আমি স্থির করেছিলুম, কিছু বলব না। শব্‌নমের আত্মপ্রকাশের আকুবাকু আমার স্পর্শকাতরতাকে অভিভূত করে দিলে। আস্তে আস্তে বললুম, আমার এক কবি বলেছেন, তুমি আমার প্রিয়, কারণ—“আমার হিয়ার ভিতর হৈতে কে কৈল বাহির?”

বললে, সুন্দর বলেছেন। কিন্তু আজ আমি কবিতার ওপারে।

‘বিশ্বাস করবে না, ডানস্‌ হলের সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় তোমাকে ভালো করে না দেখে হোটেলের বেয়ারা ভেবে যখন হুকুম দিয়েছিলুম, গাড়ি আনতে, তখনও ভেবেছিলুম এ কি রকম বেয়ারা-এর তো বেয়ারার বেয়ারিঙ নয়—ভালো করে তাকিয়ে দেখি, আজ পর্যন্ত যত মানুষ দেখেছি, যত বর্ণনা পড়েছি, যত ছবি দেখেছি এর বেয়ারিঙ তো তাদের একটার সঙ্গেও মিলছে না। তারপর কে যেন আমার বুকের ভিতরে ছবির খাতা মোচড় মেরে মেরে পাতার পর পাতা খুলে যেতে লাগল—তাতে ব্যথা-কিন্তু কি আনন্দ—এক এক বার তোমার দিকে তাকিয়ে দেখি আর ছবির দিকে তাকাই-কী অদ্ভুত—হুবহু মিলে যাচ্ছে। পথে যেতে যেতে, তোমার বাহুতে যখন আমার বাহু ঠেকল, খেলার জায়গায়, নদীর পাড়ে, তোমার ঘরে-এখনও দেখেই যাচ্ছি, দেখেই যাচ্ছি, এ দেখা আমার কখনও ফুরবে না। যেমন যেমন পাতা মিলিয়ে দেখছি, সঙ্গে সঙ্গে আরও নয়া নয়া তসবীর আঁকা হয়ে যাচ্ছে।’

হঠাৎ সে হাঁটু গেড়ে আমার দুই জানু আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে কাতর কণ্ঠে বললে, ওগো, তুমি কেন ভাব, তুমি অতি সাধারণ জন? তোমার ঐ একটিমাত্র জিনিসই আমার বুকের ভিতর যেন ঝড় এসে আমার বুকের বরফ ধুনরীর মত তুলো-পেঁজা করে দেয়। আমার অসহ্য কষ্ট হয়। তুমি কেন আমার দিকে আতুরের মত তাকাও, তুমি কেন তোমার যা হক্ক তার কণাটুকু পেয়েও ভিখারীর মত গদগদ হও? তুমি কেন বিয়ের মন্ত্রোচ্চারণে শেষ হতে না হতেই সদম্ভে কাঁচি এনে আমার জুল্‌ফ কেটে দাও না, তুমি কেন আমার মুখের বসন দুহাত দিয়ে টুকরো টুকরো করে ছিড়ে ফেল না-সিংহ যে রকম হরিণীর মাংস টুকরো টুকরো ছিড়ে ছিড়ে খায়?

আমি নির্বাক।

চাঁদ বহুক্ষণ হল বাড়ির পিছনে আড়াল পড়েছে। আবছায়াতেও শব্‌নমের চোখ জ্বলজ্বল করছে।

হঠাৎ মধুর হেসে সুধীরে তার মাথাটি আমার জানুর উপর রেখে বললে, না, গো, না। সেইখানেই তো তুমি। তোমার অজনাতে তোমার ভিতর একজন আছে যাকে আমি চিনি। সে বলে, “আমার যা হক্কের মাল আমার কাছে তাই এসেছে—আমার তাড়া কিসের?” আর জান, তুমিই একমাত্র লোক যে আমার প্রতি মুহুর্তে কবিতা উদ্ধৃতি শুনে কখনও শুধায় নি, তুমি বাস্তবে বাস করো, না, কাব্যলোকে? তুমিই একমাত্র যে বুঝেছে যে কাব্যলোকে বাস না করলে বাস কি করব ইতিহাসলোকে, না দর্শনলোক, না ডাক্তারদের ছেঁড়া-খোঁড়ার শবলোকে? আর এ সব কোনও লোকেই যদি বাস না করি তবে তো নেমে আসবও সেই লোকে-গাধা গরু যেখানে ঘাস চিবোয় আর জাবর কাটে।

কিন্তু এ কিছু নয়, কিছু নয়। আল কথা, সে তোমার মৃত্যুঞ্জয় প্রেম। আমি সুজাতা, সুচরিতা, সুস্মিতা আর আমার প্রেম যেন নব বসন্তের মধু নরগিস-তোমার প্রেম ভরা-নিদাঘের বিরহরসঘন দ্রাক্ষাকুঞ্জ। তারই ছায়ায় আমি জিরবো, তারই দেহে হেলান দিয়ে আমি বলব, সেই আঙুর আমি জিভ আর তালুর মাঝখানে আস্তে আস্তে নিষ্পেষিত করে শুষে নেব। এই যে রকম এখন করছি।

আমার মুখ কাছে টেনে নিল।

তারপর হঠাৎ হেসে উঠে শুধালে, বল দেখি, মেয়েরা অনেকক্ষণ ধরে চুমো খেতে পারে না কেন?

‘কি করে বলব বল।’

দুমিনিট মুখ বন্ধ করে থাকতে পারে না বলে। কথা কইতে ইচ্ছে যায়। আর শোন, জানেমন্‌ আমাকে ডেকে কি বললে, জান? বললে, তুমি নাকি আমার আঁধার ঘরের অনির্বাণ বিজলি। তোমার বুকের ভিতর নাকি বিদ্যুৎবহ্নি। আমরা একশ বছর বাঁচলেও নাকি তোমার প্রেম ক্ষণে ক্ষণে চমক দিয়ে আমাকে নিত্য নবীন করে রাখবে। আর চেয়ে মারাত্মক কথা কি বলেছে, জান? বলেছে, আমি যেন তোমার কাছ থেকে ভালবাসতে শিখি।

দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললে, তার মানে তুমি আমাকে বেশী ভালবাস। তাঁকে অবিশ্বাস করি কি করে? চোখের রোশনী নেই বলে তিনি হৃদয় দেখতে পান।

আমার আহ্লাদের দুকূল প্লাবিত হয়ে গেল। শব্‌নমকে বুকে ধরে বললুম, বন্ধু, তোমার ক্ষুদ্রতম দীর্ঘনিশ্বাস আমাকে কাতর করে। কিন্তু এখন যে দুশ্চিন্তায় তুমি দীর্ঘনিশ্বাস ফেললে সেটা দীর্ঘতম হোক।

কান্না হাসিতে মিশিয়ে বললে, আমি স্বামীসোহাগিনী।

কাবুল নদরী, ওপারে সার-বাধাঁ পল্লবহীন দীর্ঘ তন্বঙ্গী চিনার গাছের দল দাঁড়িয়ে আছে বরফে পা ডুবিয়ে। যেন নগ্ন গোপিনীর দল হর্ম্যসারির পশ্চাতে লুক্কায়িত রাধামাধব চন্দ্রের কাছ থেকে বস্ত্র ভিক্ষা করছে। তাদের ছায়া দীর্ঘ হতে দীর্ঘতর হতে লাগল। চন্দ্রাভা পাণ্ডুর।

‘এ কি?’ বলে উঠল হঠাৎ হিমিকা। ‘এ কি? এদিকে বলছি স্বামীসোহাগিনী, ওদিকে তার আরাম সুখের খেয়ালই নেই আমার মনে। তোমার ঘুম পায় নি?’

আমি বললাম, না তো! তোমার?

আমার মনে হচ্ছে, আমি যেন সমস্ত জীবন ঘুমিয়ে এইমাত্র জেগে উঠলুম।

উঠে গিয়ে আলমারি খুলে আমার জন্য পাজামা কুর্তা নিয়ে এল। বললে, দেখ দিকি মোটামুটি ফিট হয় কি না। আমি আন্দাজে সেলাই করেছি।

গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে গেল, ‘আমি তাকে নিয়ে যাব, আমার মায়ের বাড়ীতে। মা আমায় শিখিয়ে দেবে। আমি তাকে পান করতে দেব সুগন্ধি মদিরা-আমারই ডালিম নিংড়ে বের করা রসের সুরভি মদিরা। তার বাম হাত রইবে আমার মাথার নিচে আর তার ডান হাত দিয়ে সে আমায় আলিঙ্গন করবে। আমার অনুরোধ, আমার আদেশ, অয়ি জেরুজালেম-বালা-দল আমার প্রেমকে চঞ্চলিত করো না, তাকে জাগ্রত করো না, যতক্ষণ সে না পরিতৃপ্ত হয়। ….আমি তাকে নিয়ে যাব আমার মায়ের ঘরে—যে ঘরে আমাকে গর্ভে ধারণ করেছিলেন। আমি তাকে পান করতে দেব আমারই ডালিম নিংড়ে—’

চার হাজার পাঁচ হাজার বৎসরের পুরাতন বাসর-রাতি গীতি।

পুরাতন!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *