পরদিন সকালবেলাই খবর পেলুম, আমানুল্লার সৈন্যদল রাত্রিবেলা হেরে যাওয়াতে তিনি তার বড় ভাইকে সিংহাসনে বসিয়ে কান্দাহার পালিয়ে গিয়েছেন।
রাস্তার অবস্থা আরও ভয়ঙ্কর। বোরকা তো অন্তর্ধান করেছেই, তাগড়া জোয়ানরাও একলা-একলি বেরয় না—এক একটা দলে অন্তত পাঁচ-সাত জন না থাকলে মানুষ নিজেকে নিরাপদ মনে করে না। বাচ্চার ডাকু সৈন্যদল রাস্তা ছেয়ে ফেলেছে।
তিন দিন পর আমানুল্লার দাদাও সিংহাসন ত্যাগ করে চলে গেলেন। বাচ্চা সাড়ম্বরে সিংহাসনে বসল।
এ খবর যে কোন প্রামাণিক আফগান ইতিহাসে সবিস্তার পাওয়া যায়-একথা পূর্বেই বলেছি। আমি ইতিহাস লিখতে বসি নি; বাচ্চার আপন হাতে জ্বালানো দাবানল শব্নম ও আমার মত নিরীহ শুষ্ক পত্রের দিকে কি ভাবে এগিয়ে এল সেইটে বোঝাবার জন্য হ্রস্বতম খেইগুলো ধরিয়ে দিচ্ছি মাত্র।
দুহাতে মাথা চেপে ধরে ভাবছি, কি করি, কি করি? কোন দিকে পথ, কোথায় আলো—আর কোনটাই বা আলেয়া?
সুখ চাই নে, আনন্দ চাই নে, এমন কি প্রিয়মিলনও চাই নে-কি করে এই দাবানল থেকে শব্নমকে রক্ষা করি?
আমি রক্ষা করবার কে?
এমন সময় হন্তদন্ত সিঁড়িতে বুটের ধপাধপ শব্দ করে আবদুর রহমান ঘরে ঢুকে প্রায় অস্ফুট স্বরে বললে, ‘সর্দার আওরঙ্গজেব খান এসেছেন আপনার সঙ্গে দেখা করতে।’ আবদুর রহমানের গলা শুকিয়ে গিয়েছে।
আমি দুবার শুনেও প্রথমটায় ঠিক বুঝতে পারি নি।
তাড়াতাড়ি নিচে নেমে দেউড়ির দিকে এগিয়ে গেলুম।
মাথা নিচু করে কিচ্ছু না বলে নীরব অভ্যর্থনা জানালমু।
তিনি গম্ভীরে—এবং সেই অর্ধসম্বিতেও আমার মনে হল প্রসন্ন অভিবাদন জানালেন? মৃদুকণ্ঠে বললেন, ‘আপনার পরে’—অর্থাৎ আপনি পথ দেখিয়ে নিয়ে চলুন। তিনি কেন এসেছেন, এই ভাবনার ভিতরও আমি আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলমু, শব্নমের গলা মধুর এঁর গলা গম্ভীর, অথচ দু’গলারই আদল এক, ঝংকার সমধ্বনি। যেন শিশু শব্নম বাপের পাগড়ী জোব্বা গোঁফদাড়ি পরে এসেছে।
আমি আপত্তি না জানিয়ে ‘খানা-ই শুমা অস্ত—’ এটা আপনার বাড়ি, বলে আগে আগে পথ দেখিয়ে বসবারর ঘরে নিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ইরানী কায়দায় এবার ‘এটা আপনার বাড়ি’ বলার পর অভ্যাগতজন আদেশ করবেন, গৃহস্থ তাঁর কথা মত চলবে।
আমাকে আসন দেখিয়ে নিজে সোফায় বসলেন।
আমি কার্পেটের দিকে তাকিয়ে রইলুম। ইরান আফগানের মুরুব্বীরা এতে খুশী হয়ে বলেন, বাচ্চা খিজালং মী কশদ—ছেলেটার আব্রু-শরম-বোধ আছে।
শুধালেন, আপনি আমার পরিচয় জানেন?
আমি মৃদু কণ্ঠে বললুম, কিছু কিছু জানি।
বললেন, “তাই যথেষ্ট। আমিও আপনাকে কিছু কিছু চিনি। এদেশে এখন অল্প বিস্তর বিদেশী আসতে আরম্ভ করেছেন কিন্তু আমি সকলের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করবার সুযোগ এখনও পাই নি। তবে গেল বছর আপনাদের কলেজের বাৎসরিক পরবে আপনি এদেশে শিক্ষা বিস্তার সম্বন্ধে যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন সেইটে শোনার সুযোগ আমার হয়েছিল। আপনি বড় একাগ্র মনে অত্যন্ত দরদ দিয়ে আপনার বক্তব্য পেশ করেছিলেন সেটা আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে। আমার মনে হয়েছিল, আপনি এই পরদেশকে অনেকখানি ভালবেসে ফেলেছেন। নয় কি?
আমি মাথা নিচু রেখেই বললুম, ‘এদেশ আমাকে অবহেলা করে নি। এদেশে আমি আশাতীত ভালবাসা পেয়েছি। প্রতিদানের চেয়েও বেশী দেবার চেষ্টা করেছি।’
‘এই তো ভদ্রজনের আচরণ।’
আমি তখন শুধু ভাবছি, তাঁর এখানে আসার রহস্য কি? তবে কি শব্নম তাকে কিছু বলেছে। তাই বা কি করে হয়?
নিজের থেকেই তিনি কাবুলের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অতি সুন্দর প্রাঞ্জল ভাষায় আমাকে বোঝালেন। তাঁর যুক্তিধারা থেকে পদে পদে প্রমাণ তিনি সাধারণ সৈন্যদেরও কঠিন জিনিস বোঝাতে অভ্যস্ত।
সর্বশেষ বললেন, আমি সোজা কথা বলাটাই পছন্দ করি। আমার মনে হচ্ছে, আপনিও সরল লোক। তাই আপনার কাছে অন্য লোক না পাঠিয়ে আমি নিজেই এসেছি। যদিও এ অবস্থায় নিজে আসাটার রেওয়াজ দেশে নেই।
আমি আমার নিজের প্রাণ বাঁচাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠি নি। আমি সিপাই। প্রাণের প্রতি যাদের অত্যধিক মায়া তারা ফৌজে বেশী দিন থাকে না—অন্তত দু’পয়সা কামাবার জন্য আমার ফৌজে থাকার কোন প্রয়োজন ছিল না।
এবার আপনাকে যা বলছি তা গোপনে।
‘আমার একটি কিশোরী কন্যা আছে। লোকে বলে অসাধারণ সুন্দরী। অন্তত তার সে খ্যাতি অনেক দূর ছড়িয়ে পড়েছে। আমি আজ বিশ্বস্ত সূত্রে খবর পেয়েছি বাচ্চা-ই সকাওয়ের দ্বিতীয় সেনাপতি-প্রথম সেনাপতির ছোট ভাই বছর দুই পূর্বে কাঠ বেচতে এসে তাকে কাবুলে দেখতে পেয়েছিল-আমার মেয়ে সচরাচর পর্দা মানতো না। যে জিনিস তখন তার বদ্ধ উন্মাদবস্থার ও উৎকট কল্পনার বাইরে ছিল আজ সৈন্যদল প্রয়োগে সেটা অসম্ভব নাও হতে পারে।’
‘আপনি হিন্দুস্থানী। আপনি যদি আমার মেয়েকে বিয়ে করেন তবে সে হিন্দুস্থানী ন্যাশনালিটি পেয়ে যাবে। আমি আপনাদের রাজ-দূতাবাসে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি; ভারতীয় এক বড় রাজকর্মচারী বললেন, ‘আইনত আমার মেয়ের যে অধিকার জমাবে সেটা তিনি রক্ষা করার সর্ব চেষ্টা করবেন। যদিও প্রয়োজন ছিল না, তবুও কথা উঠেছিল, এখানে শিক্ষিত অবিবাহিত কে কে আছেন। সেই প্রসঙ্গে আপনার নাম যখন উঠল মাত্র তখনই তিনি সন্তর্পণে তার উৎসাহ দেখিয়েছেন।’
এই অভাবনীয় পরিস্থিতির সামনে পড়ে আমি বিস্ময়েই হোক, আনন্দেই হোক, কিছু বুঝতে পেরেই হোক হয়তো একটা অস্ফুট শব্দ করেছিলাম।
তিনি বললেন, আপনি একটু চিন্তা করুন এবং তার পূর্বে বাকী কথা শুনে নিন।
বাচ্চা-ই-সকাও এখন মোল্লাদের কথা মত চলে। অন্তত তারা বিবাহিতা স্ত্রীলোককে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়াটাতে সম্মতি দিতে পারবে না।
‘ব্রিটিশ এ্যারোপ্লেন ভারতীয় নারীদের আপন দেশে নিয়ে যাচ্ছে। আপনাদের ভারতীয় কর্মচারী আমাকে সদয় আশ্বাস দিয়েছেন, প্রথম সুযোগেই তিনি আমার মেয়েকে হিন্দুস্থান পাঠিয়ে দেবেন।
‘এদেশে ফরাসী জর্মন বিদেশী প্রায় স্বাই অবিবাহিত। কিন্তু আমার মেয়ে কিছুতেই ইউরোপীয় বিয়ে করবে না। প্রথমত তারা খৃষ্টান, দ্বিতীয় তাদের সাম্রাজ্যবাদ প্রবৃত্তি এবং তৃতীয়—বোধ হয় এইটেই সর্বপ্রথম বলা উচিত ছিল তাদের শারীরিক অশুচিতা সে অত্যন্ত ঘৃণা করে। যদিও তার তমদ্দুন-ফরহঙ্গের, তার বৈদগ্ধ্যের অর্ধেকেরও বেশী ফরাসী।’
‘এ কথাটা তুললুম, আপনি হয় তো শুধাবেন, আমার মেয়ের মত আছে কি না। আপনি মত দিলে তাকে আমি জিজ্ঞেস করব, কারণ ধর্মত আইনত সে প্রাপ্তবয়স্কা। যদি সে অমত করে, আশা করি আপনার অভিমানে লাগবে না। যে রকম আমি আপনাকে সরল মনে বলছি, আপনি অমত করলে আমি কণামাত্র অপমানিত বোধ করব না।’
‘কারণ, হয়তো আপনারা আপনাদের গোষ্ঠির বাইরে বিয়ে করেন না; আমরাও আমাদের গোষ্ঠির বাইরে বিয়ে করি নে—যদিও ইসলাম এরকম গোষ্ঠি পাকানো নিন্দার চোখে দেখে। আপনি রাজী না হলে আমি কখনও ভাববো না, আপনি আমার মেয়েকে কিংবা আমি এবং আমার গোষ্ঠিকে খাটো করে দেখলেন।
‘আমার মেয়ে সম্বন্ধে বাপ হয়ে আমি কি বলব। আমি প্রশংসা করতে চাই নে। সে আমার একমাত্র মেয়ে, ছেলেও নেই, তার গর্ভধারিণী-’
এই প্রথম তার সরল দৃঢ় কথাতেও যেন একটু অতি ক্ষীণ কাঁপন শুনতে পেলুম।
‘-অল্প বয়সে মা মারা যান। বাপ হয়ে তাই ইংরেজের মত ম্যাটার অব ফ্যাক্ট বা সাদামাটা ভাবে বলি, তার চারটে ‘বি’-ই আছে। বিউটি, ব্রেন, বার্থ, ব্যাঙ্ক—অবশ্য চতুর্থটা বলার কোন প্রয়োজন ছিল না।’
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘সর্বশেষে আমি আপনাকে সাবধান করে দিতে চাই, আপনি রাজী হলে ফলস্বরূপ বাচ্চার সেনাপতির বিরাগভাজন হবেন।’
এতক্ষণ তিনি আমার দিকে ঝুঁকে, উরুতে দুই কনুই রেখে, চিবুক দুই হাতের উপর রেখে কথা বলছিলেন। এবারে শিরদাঁড়া খাড়া করে ফৌজী কায়দায় সোজা হয়ে বললেন, এবারে আপনি চিন্তা করে বলুন।
তিনি যে ভাবে শান্ত হয়ে আসনে বসলেন তার থেকে বোঝা গেল, প্রিয়-অপ্রিয় নানা রকম সংবাদ শুনতে তিনি অভ্যস্ত। আমার না তাকে বিচলিত করবে না আমার হাঁ তাকে প্রসন্ন করবে।
আমার ‘হাঁ’, ‘না’ ভা বার কি আছে। তবু আমি এতই হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলুম যে প্রথমটায় আমি কিছুই বলেত পারি নি। তারপর মাথা নিচু রেখেই নববরের কষ্টে বলেছিলুম, ‘আপনার কন্যাকে আমি আল্লাহতালার মেহেরবানীর মত পেতে চাই।’ আমি ইচ্ছে করেই আমার সম্মতি প্রস্তাবের রূপ দিয়ে প্রকাশ করেছিলুম-কিন্তু আপন অজানতে। আমি বিশ্বাস করি, করুণাময় তাঁর অসীম দয়ায় মূককে যে শুধু ভাষাই দেন তা নয়, সৌজন্যের ভাষাও বলতে শেখান।
আওরঙ্গজেব খান দাঁড়িয়ে উঠে আমায় আলিঙ্গন করলেন।
আসন গ্রহণ করে বললেন, আমার কন্যার কিম্মৎ যদি ভাল থাকে তবে আপনি অসুখী হবেন না। আর আপনি আমার উপকার করলেন। জামাতার কাছে উপকৃত হওয়া বড় আনন্দের বিষয়।
আমি বললুম, আপনি গুরুজন। যদি অনুমতি করেন তবে একটি নিবেদন আছে। আমি আমার গলা ফিরে পেয়েছি।
প্রসন্ন কণ্ঠে বললেন, আপনাকে অদেয় আমার কিছুই নেই।
আমি হাত জোর করে বললাম, আপনি দয়া করে উপকারের কথা তুলবেন না। আমি আপনার কন্যার পাণি প্রার্থনা করছি, শিষ্য যে রকম মুর্শীদের কাছে গুরু-কন্যা কামনা করে।
এবারে তিনি বিচলিত হলেন। আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘন ঘন আমার মস্তক চুম্বন করতে করতে বললেন, বাচ্চা-বৎস—তুমি ভদ্র ঘরের ছেলে, তুমি ভদ্র ঘরের ছেলে। তোমার পিতা-মাতার আশীর্বাদ তোমার উপর আছে।
আমি তাঁর হস্ত চুম্বন করলুম।
নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘পাপাচার শুভদ্ধির চেয়ে দ্রুত গতিতে চলে। তাই শুভকর্ম শীঘ্র করতে হয়। বাচ্চার সেনাপতি জাফর খানের পাপবুদ্ধিকে হারবার জন্য তেমাদের বিবাহ যতশীঘ্র সম্ভব সম্পন্ন করা উচিত। তুমি কি বল?’
আমি বললুম, আপনার কাছ থেকে আমার পরিচিত ‘শুভস্য শীঘ্রম’ বাক্যের প্রকৃত নিগূঢ় অর্থ বুঝলুম। এখন থেকে আমার আর কোন মতামত নেই।
‘আজ সন্ধ্যায়?’
‘আজ সন্ধ্যায়!’
উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘সময় কম। ব্যবস্থা করতে হবে। কীই বা ব্যবস্থা করব? এই দুর্দিনে?
আমি জানি শব্নম রাজী, কিন্তু ইনি কোন সাহসে সব ব্যবস্থা করার চিন্তাতে লেগে গেলনে। বোধ হয় কন্যার জনকানুরাগে অখণ্ড বিশ্বাস ধরেন।
আমাকে কোনও কিছু বলবার সুযোগ না দিয়ে এক মুহূর্তেই অন্তর্ধান করলেন।
মুক্তি, মুক্তি, মুক্তি। আমি মুক্তি পেয়েছি।
আর আমাকে হাত-পা বাঁধা অসহায়ের মত মার খেতে হবে না। ওই আমলেই বাঙলা দেশে আমাদের মধ্যে রটেছিল যে টেগার্টের পুলিশ বিপ্লবীদের হাত পা বেঁধে সর্বাঙ্গে মধু মাখিয়ে ডাঁশ পিপড়ের মাঝখানে ফেলে রাখে। আমাকে আর সে যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে না।
আমি এখন শব্নমের কাছে গিয়ে দাঁড়াতে পারব।
তার মিলনের জন্য এখন আমাকে আর প্রহরের পর প্রহর গুণতে হবে না। আমি যে কোন মুহূর্তে তার সম্মুখে উপস্থিত হতে পারি। আমার দশদিক এখন সত্যই নিরদ্বন্দ্বা হয়ে গেল।
পরিপূর্ণ আনন্দের সময় মানুষের মন ভিন্ন ভিন্ন দিকে ধায় না। একটা আনন্দ নিয়ে সে পড়ে থাকতে ভালবাসে। শিশুর মত একটি পুতুলই বার বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে। তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমুতে যায়। আমি আমার মুক্তির আনন্দ নিয়ে তন্ময় হয়ে পড়ে রইলুম। আমার অন্য সৌভাগ্যের কথা ভাববারই প্রয়োজন হল না, ফুরসৎ হল না।
এক ঘন্টা হয় কি না হয়, এমন সময় আবদুর রহমান সৌম্যদর্শন এক অতি বৃদ্ধকে আমার ঘরে নিয়ে এল। ধবধবে সাদা চাপ দাঁড়ি, সাদা গোঁপ-মোল্লাদের মত ছোট করে ছাটা নয়, সাদা বাবরী চুল, তার উপর সাদা পাগড়ী, চোখের পাতা এমন কি ভুরু পর্যন্ত বরফের মত সাদা। এবং সে সাদা বেয়ে যেন তেল ঝরে পড়ছে। এর বয়স কম হলে আমি বলতুম, এটা সাদা নয়, সত্যিকারের প্ল্যাটিনাম ব্লণ্ড।
আমি তাঁকে যত্ন করে বসালাম।
অতি সুন্দর ফার্সী উচ্চারণে বললেন, আমি আওরঙ্গজেব খানের গুরু। তার মেয়েরও গুরু। দুজনাকেই ফার্সী পড়িয়েছি। এখনও আমাদের তিন জনাতে মুশাইরা হয়।
‘এই খানিকক্ষণ আগে আওরঙ্গজেব খান এসে আমায় সুখবর শোনালে, আপনার সঙ্গে শব্নমের সাদী আজ সন্ধ্যাবেলাই হবে। আমি বড় খুশী হয়েছি। আমি বড়ই খুশী হয়েছি।’
এইটুকু বলে তিনি দু’খানা হাত তুলে আল্লার কাছে তার কৃতজ্ঞতা জানিয়ে প্রার্থনা করলেন। আমিও হাত তুলে আস্তে আস্তে ‘আমিন আমিন’ বললুম।
বললেন, ‘যেই শুনতে পেলুম, আপনার মুরুব্বি এখানে কেউ নেই, অমনি আমি বললুম, আমার উপর এর ভার রইল। আওরঙ্গজেব চায় নি যে এই খুন-রাহাজানির মাঝখানে আমি রাস্তায় বেরই। আমি তাকে স্পষ্ট বলে দিলুম, এ সংসারে আমি এমনিতেই আর বেশীদিন থাকব না—না হয় দু’দিন আগেই গেলুম।’
আমি বললুম, আপনি শতায়ু হন।
বৃদ্ধের রসবোধ আছে। বললেন, আমার বয়স আশী হয়েছে আরও কুড়ি বছর বাঁচতে চাই নে। বরঞ্চ ওই কুড়িটি বছর আপনি আপনার আয়ুতে জুড়ে দিন কিংবা শব্নম বানু আর আপনাতে ভাগ করে। কোন জিনিস বরবাদ করাটা আমি আদপেই পছন্দ করি নে। এখন, প্রথম কথাঃ আওরঙ্গজেব খান আপনাকে জানাতে বলেছেন, আজ সন্ধ্যায় আপনাদের বিবাহ। আমি এসে আপনাকে নিয়ে যাব।
‘দ্বিতীয় কথা! আপনার বন্ধু-বান্ধব কে কে এখানে আছেন তাদের নাম-ঠিকানা বলুন। আমি কিংবা আমাদের বাড়ির লোক তাদের নিমন্ত্রণ জানিয়ে আসবে উভয় পক্ষ থেকে। দুজন করে লোক যাবে।
আমি বললুম, এই দুর্দিনে নিমন্ত্রণ করে কাকে আমি বিপদে ফেলি। তাদের কারোর যদি ভালমন্দ কিছু একটা হয় তবে তাদের বাল-বাচ্চার সামনে আমি আমার মুখ দেখাতে পারব না। আর আমার সেরকম মিত্র বা সখাও কেউ নেই। এদের সকলের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে এখানে—তাও সহকর্মীরূপে। কিন্তু তার পূর্বে আমার উচিত আপনার বাড়িতে গিয়ে আপনাদের সকলকে নিমন্ত্রণ করা।
বৃদ্ধ ব্যাকুল হয়ে বললেন, না, না, না। আপনি বিদেশী এদেশের অবস্থা জানেন না। এখন শুধুমাত্র লৌকিকতা করার জন্য রাস্তায় বেরনো উচিত নয়। আমি আপনার হয়ে তাদের সবাইকে নিমন্ত্রণ জানাব। তারা সবাই বরপক্ষের হয়ে যাবে।
‘এবারে আপনার খিদমৎগার আবদুর রহমানকে দাওয়াৎ করতে হবে।’
আমি বললুম, তাকে ডাকি।
আবার ব্যাকুল হয়ে বললেন, না, না, না। আমি তাকে হিন্দুস্থানী কায়দায় কনে পক্ষ থেকে নিমন্ত্রণ জানাব তার কাছে গিয়ে।
‘তৃতীয় কথা : আপনার জামা-কাপড়ের ব্যবস্থা আমি করব। আমার মেয়ে আপনার মোটামুটি উচ্চতা আওরঙ্গজেব খানের কাছ থেকে জেনে নিয়েছে এবং সেলাইয়ের কলে বসে গিয়েছে। এতো জোব্বার ব্যাপার, হাঙ্গামা কম। এবার আপনি আমায় বুকে বুক লাগিয়ে দাঁড়ান। আমি ঠিক ঠাহর করি নি।’
মোকা পেয়ে তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে একটা আলিঙ্গনও দিলেন।
আমি তাঁর হস্তচুম্বন করে বললুম, ‘আমার বলতে সাহস হচ্ছে না, কিন্তু কাপড় চোপড়ের খরচটা?’
বৃদ্ধা সপ্রতিভ। বললেন, নিশ্চয়! খয়রাতি বা ধারের জামাজোড়ায় বিয়ে করাটা মনহুসী—অপয়া।
আমি বললুম, এদেশে ভারতীয় কারেনসির কদর আছে বলে শুনেছি।
তাঁকে আমার মানিব্যাগটা দিলুম।
তিনি দুএকখানা নোট তুলে নিয়ে বললেন, বিয়ের পর শব্নম আর আমার মেয়েতে বোঝাপড়া করে নেবে।
বৃদ্ধ উঠলেন।
এঁর কথা বলার ধরন শোনবার মত। শব্নম বয়েৎ ছাড়ে মাঝে-মধ্যে, ইনি প্রায় প্রত্যেকটি কথা বললেন, বয়েতের মারফতে। ঠিক বলতে পারব না, বোধ হয় তাঁর মেয়ে যে সেলাইয়ের কলে বসে গেছেন সেটাও বয়েতেই বলেছিলেন। কিন্তু শব্নমের বেলা যে রকম তাকে থামিয়ে টুকে নিতে পারি, এর বেলা সেটা পারলুম না বলে দুঃখ রয়ে গেল।
আবদুর রহমানকে দাওয়াৎ জানিয়ে বিদায় নেবার সময় আমাকে বললেন, আপনাকে কয়েকটি বয়েৎ শোনালুম, আপনি তো আমাকে একটিও শোনালেন না। আপনার বুঝি এতে মহব্বৎ নেই।
আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, আপনাকে শোনাব আ-মি? আপনার তো সব বয়েৎ জানা।
তিনি বললেন, সে কি কথা? চেনা গান লোকে শোনে না? নূতন লাইব্রেরিতে গেলে আমরা সর্বপ্রথম চেনা বইয়ের সন্ধান করি নে? জলসা-ঘরে গিয়েও প্রথম খুঁজি চেনা মুখ এবং বলতে নেই, গোরস্তানে গিয়েও প্রস্তরফলকে চেনা জনেরই নাম খুঁজি।
বাপ্স! চার-চারটে তুলনা—এক নিঃস্বাসে।
আমি সায় দিয়ে বললুম, ‘আমার এক বন্ধু একটি কবিতা লিখেছেন। শুনবেন?’ বলে নরগিসের
তোমার আমার মাঝখানে বঁধূ অশ্রুর পারাবার
কেমনে হই পার-?
কবিতাটি শোনালুম। বুড়ো এঘোরে থ’মরে গেলেন। কাবুলের লোক এরকম লিখেছে? অসম্ভব! ওর সঙ্গে আমার আলাপ করতেই হবে। বয়সে নিশ্চয়ই কাঁচা। চিন্তাশীল এবং স্পর্শকাতর। ছন্দে মিলে সবুজ রঙের কাঁচা ভাব একটু রয়েছে। যদি লেগে থাকে তবে ইরান হিন্দুস্থানে একদিন নাম করবে। ইন্শা আল্লা, ইন্শা আল্ল—আল্লা যদি দেন, আল্লা যদি করান।
দেউড়িতে বললুম, আমাকে দয়া করে আপনি বলবেন না।
হেসে বললেন, ‘নওশাহ, নূতন রাজা, নববর, তাই বলেছি। কাল থেকে তুমি বলব। আওরঙ্গজেবও বলেছিলেন, ‘বাচ্চা খিজালৎ মী কশদ’—ছেলেটির আব্রু—শরম বোধ আছে।’ আমি বড় খুশী হয়েছি, আগাজান। আর কানে কানে বলি, ‘শব্নমের মত মেয়ে আমি আমার এই দীর্ঘ জীবনে দুটি দেখি নি। নাম সার্থক করে শব্নমের মত পবিত্র।’
অতি সত্য কথা। তবু আমার অভিমান হল। সবই শব্নম, শব্নম —আমি যেন কিচ্ছুই না।