৩.৪ আমার মন শান্ত হয় নি

আমার মন শান্ত হয় নি, অশান্তও থাকে নি। আমার মানস সরোবরের জল জমে বরফ হয়ে গিয়েছে।

ওদিকে কাবুলের বরফ গলতে আরম্ভ করেছে। কবুল উপত্যকার উত্তর-পূর্ব-পশ্চিম গিরিপথে সঞ্চিত পর্বত প্রমাণ তুষার-স্তূপও গলতে আরম্ভ করেছে। এবার জনগণের গমনাগমন আরম্ভ হবে। যে পণ্যবাহিনী এখানে আটকা পড়েছিল তারা হন্যে হয়ে উঠেছে গন্তব্যস্থলে পৌঁছবে বলে। কাবুল উপত্যকার বাইরে যারা আটকা পড়েছিল তারও যে করেই হোক শহরে ঢোকবার চেষ্টা করবে। সঙ্গে সঙ্গে ডাকাতিরও মরশুম গরম হয়ে উঠবে। বাচ্চার বাহুবল উপত্যকার বাইরে সম্প্রসারিত নয়। কাজেই দুদলে লড়াই লাগবে মোক্ষম। তার কারণ এ দেশের ডাকাত আর বণিকে তফাত কম। যে দু’দিন পূর্বে বণিক ছিল সে কিছুটা পয়সা জমিয়ে ডাকাতের দল গড়েছে। আবার যে দুদিন পূর্বে ডাকাত ছিল সে কিছুটা পয়সা করে আজ পণ্যবাহিনী তৈরি করেছে এবং এর পরও অন্য এক শ্রেণীও আছে। এরা দুটো একসঙ্গে চালায়। পণ্যবাহিনী নিয়ে যেতে যেতে সুযোগ পেলে ডাকাতিও করে।

কিন্তু এ সবেতে আমার কী?

আমার স্বার্থ মাত্র এইটুকুই-কাবুল উপত্যকা তো তন্ন তন্ন করে দেখা হয়ে গিয়েছে। এবার যদি বাইরের থেকে কোনও খবর আসে।

আবদুর রহমান এখনও কান্দাহার থেকে ফেরে নি। তার থেকেই আমার বোঝা উচিত এখনও গমনাগমন অসম্ভব।

জানেনের সেবা করতে গিয়ে বার বার হার মানি।

তিনি ডান হাত বাড়িয়ে বাঁ দিকে কি যেন খুঁজলেন। আমি শুধালুম, জানেমা (আমাদের জান্‌), কী চাই?

‘না বাচ্চা, কিছু না।’

পীড়াপীড়ি করি। নিমকদান-লবণের পাত্র।

শব্‌নম জানত।

তিনি কবিতা আবৃত্তি করেন; আমি প্রত্যুত্তর দিতে পারি নে।

প্রতি পদে ধরা পড়ে বোর কাজে আমার অনভ্যাস, অপটুত্ব। অথচ ঠিক সেই কারণেই আমি তাঁর কাছে পেলুম আরও বেশী আদর-সোহাগ। শিশুর আধো-আধো কথা শুনে পিতামাতা যে রকম গদগদ হয়, আমার আধো-আধো সেবা তেমনি তাঁর হৃদয়ের দাক্ষিণ্যে যেন বান ডাকালে।

এক রকম লোক আছে যারা সর্বক্ষণ কথা বলে যাওয়ার পর দেখা যায়, তারা কিছুই বলে নি। অন্য দল সংখ্যায় কম। এদের নীরবতা যেন বাঙময়। এঁরা সেই নীরবতা দিয়ে এমন একটি বাতাবরণ সৃষ্টি করেন যে, শুভ মুহূর্তে সেই ঘন বাষ্পে তাঁরা একটি ফোঁটা বাক্‌-বারির ছোঁয়াচ দেওয়া মাত্রই আকাশ-বাতাস মুখর করে ঝরঝর ধারে বারিধারা নেমে আসে।

এই রকম একটা সুযোগ পেয়ে আমি তাঁকে শুধালুম, আপনি আমার শ্বশুরমশাইকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছেন। আমাকে বলুন তো, তিনি কান্দাহার যাওয়ার সময় বাড়িতে কেন হুকুম রেখে গেলেন, ডাকাতদের যেন কোনও বাধা না দেওয়া হয়?

জানেম বললেন, আওরঙ্গজেব সাধারণ সেনাপতি নয়। প্রকৃত সেনাপতি যে রকম যুদ্ধ জয় করতে জানে, ঠিক সেই জানে কখন আর জয়াশা করতে নেই। সে সময় সে যতদূর সম্ভব স্বল্প ক্ষয়ক্ষতি হতে দিয়ে সৈন্যবাহিনী রণাঙ্গন থেকে হটিয়ে আনে।

‘আওরঙ্গজেব জানত, বাধা দিলে এ বাড়ির কেউই প্রাণে বাঁচবে না। ওদিকে শব্‌নমের উপর ছিল তার অগাধ বিশ্বাস। এসব ব্যাপারে সে যেকোনও পুরুষকে ছাড়িয়ে যায়।

একটু ভেবে দেখলেই বুঝতে পারবে, শব্‌নম যদি অল্প কিছুক্ষণ জাফর খানকে আটকে রাখতে পারত তা হলেই তো ততক্ষণে বাচ্চার হুকুম পৌঁছে যেত যে তাকে যেন নিরাপদে আপন বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়।’

‘সূফীদের অনেকেই তাই পরিপূর্ণ নিষ্ক্রিয়তায় বিশ্বাস করেন। সৎকর্ম, অসৎকর্ম, প্রয়োজনীয় কর্ম, অপ্রয়োজনীয় কর্ম, যাই কর না কেন, তার ফলশ্বরূপ উৎপাদিত হবে নূতন কর্ম এবং ক্রমাগত বাড়তে থাকে সেই কর্ম-জিঞ্জির-চেন্‌-অ্যাকশন। এই কিস্মতের অক্ষমালার কোনও জায়গার তো গিট খুলতে হবে। না হলে এই অন্তহীন জপ-মালা তো ঘুরেই যাবে, ঘুরেই যাবে; এর তো শেষ নেই।’

‘অথচ এ কথা আমি স্থির-নিশ্চয় জানি, শব্‌নম ঠাণ্ডা-মাথা মেয়ে। ক্ষণিক উত্তেজনায় সম্বিৎ হারিয়ে উন্মাদ আচরণ সে করে না। নিশ্চয়ই কোন কিছু একটা চরমে পৌঁছেছিল।’

আমি চিন্তা করে প্রত্যেকটি বাক্য হৃদয়ঙ্গম করার চেষ্টা করছি এমন সময় দাসীরা কলবর করে ঘরে ঢুকে বললে, ‘একজন বোরকা পরিহিতা রমণীকে হিন্দুকুশের গিরি উপত্যকায় দেখা গিয়েছে মজার-ই-শরীফের পথে যেতে।’

চিৎকার চেচামেচির মাঝখানে এইটুকু বুঝতে আমাদের অনেকক্ষণ সময় লেগেছিল।

জানেমন্‌ নীরব।

আমি তাড়াতাড়ি মনসূরকে চিঠি লিখলুম সে যেন পত্রপাঠ ইউসূফকে সঙ্গে নিয়ে আসে। অন্য লোক পাঠালুম সরাইখানাতে।

কিন্তু শব্‌নম আফগানিস্থানের উত্তরতম প্রদেশ সুদূরতম তীর্থ মজার-ই-শরীফের দিকে যাচ্ছে কেন? প্রাণ রক্ষার্থে? সে কি জানে না জাফর খানের খুনের জন্য বাচ্চা তার খুন চয় না?

ঘণ্টা দুয়েকের ভিতর মনসূর এল। সহৃদয় সরাইওয়ালাও স্বয়ং এসে উপস্থিত। ইউসুফ আসে নি। খবর পাঠিয়েছে, বহু বোরকাপরা রমণী বহু তীর্থে একা একা যায়। এ রমণী কিছুতেই শব্‌নম বানু হতে পারেন না। আরও বলেছে, এ রকম গুজব এখন ঘড়ি ঘড়ি বাজারে রটবে—আমি যেন ওসবেতে কান দিই।

মনসূর বললে, ইউসূফ তো আসবে না, পকা খবর না নিয়ে। আমি এই গুজবটা শুনতে পাই কাল। সঙ্গে সঙ্গে গেলুম সরাইয়ে। তারা খবর পেয়েছে তার আগের দিন। তার পর গেলুম ইউসুফের কাছে। সে বললে, এসব পুরনো খবর। মিথ্যে—সে যাচাই করে দেখেছে। তার পর, হুজুর, আমাকে হিসেব করে দেখালে, কাবুল গিরিপথের বরফ গলতে যে সময় লাগে তার আগে সেটা ছড়িয়ে কেউ হিন্দুকুশ পৌঁছতে পারে না। ও মেয়ে হিন্দুকুশ অঞ্চল থেকেই বেরিয়েছে। আরও অনেক কি সব প্রমাণ দিলে যেগুলো আমি বুঝতেই পারলুম না।

সকলেরই এক মত। ও মেয়ে কিছুতেই কাবুল থেকে বেরোয় নি। ওর সন্ধান করতে যাওয়া আর চাঁদের আলোতে কাপড় শুকোতে দেওয়া একই কথা।

আমি সম্ভব অসম্ভব নানা প্রকারের যুক্তিহীন তর্ক, এবং তকহীন নীরবতা দিয়ে আপাতদৃষ্টিতে যা অসম্ভব তা সম্ভব হতে পারে বোঝাবার চেষ্টা করলে সবাই এমন সব অভিজ্ঞতা প্রসূত যুক্তি এবং প্রত্যক্ষদৃষ্ট আপত্তি তুললে যে শেষটায় আমি রেগে উঠলাম। তধন সবাই একে অন্যের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে চুপ করে গেল।

আমি আমার আহম্মুকি বুঝতে পারলুম। এদের না চটিয়ে এদের কাছ থেকে আমার জেনে নেওয়া উচিত ছিল, মাজার শরীফ যাবার জন্য আমার কি প্রস্তুতির প্রয়োজন? এখন যখন শুধালুম, সবাই আশকথা পাশকথা বলতে বলতে বাড়ি চলে গেল।

কান্দাহার থেকে শব্‌নমের কোনও খবর না পেয়ে শেষটায় স্বপ্নে প্রত্যাদেশ ভিক্ষে করেছিলুম, কান্দাহার যাব কি না, আজ রাত্রে ঠিক তেমনি সমস্ত হৃদয় মন ঢেলে দিয়ে নামাজ পড়লুম মাঝ রাত অবধি। বার বার কাতর রোদনে প্রভুকে বললুম, হে করুণাময়, আমাকে দয়া কর, আমাকে দয়া কর।

সেবারে প্রার্থনান্তে যেন তারই কোলে ঘুমিয়ে পড়েছিলুম, স্বপ্নে প্রত্যাদেশও পেয়েছিলুম, কান্দাহার যেয়ো না—আমার তখন সেটা মনঃপূত হয় নি।

তাই কি করীম করুণাময় আমাকে শিক্ষা দিতে চাইলেন তাঁর ক্কাহির-রুদ্ররূপে?

সমস্ত রাত চোখে এক ফোটা নিদ্রা এল না।

সমস্ত দিন কাটল ওই ভাবে। মাঝে মাঝে তন্দ্রা আসে। ঘুমে প্রত্যাদেশ পাব আশ করে যেই শুতে যাই, সঙ্গে সঙ্গে সর্ব নিদ্রার অন্তর্ধান। তিন দিন পর যখন নির্জীব, ক্লান্ত দেহে প্রত্যাদেশের শেষ আশা ছেড়ে দিলুম সেদিন সুনিদ্রা হল। আশা ছাড়লে দেখি ভগবানও সমঝে চলেন।

শব্‌নম যে রকম পূর্ব বাংলার স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসত-যখন-তখন পেশাওয়ার গিয়ে দিল্লী কলকাতা হয়ে পূর্ববাংলায় পৌঁছত, আমিও সেরকম মাজার-ই-শরীফের স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসতুম। প্রথম দিন সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তুমি কি সত্যই জান না, হজরৎ আলী (করমল্লাহু ওয়াজহাহু-আল্লা তাঁর বদন জ্যোর্তিময় করুন) মারা যান আরবভূমিতে এবং তার গোর সেখানেই। অশিক্ষিত অজ্ঞ লোকের মত বিশ্বাস কর তার কবর উত্তর আফগানিস্থানে!’

আমি বললুম, যেখানে এত লোক শ্রদ্ধা জানায়, সেখানে না হয় আমি সেই শ্রদ্ধাটিকেই শ্রদ্ধা জানালুম।

অবজ্ঞার সঙ্গে বললে, তা হলে কাবুলী মুটেমজুর যখন নূতন কোনও সোনা বানানেওয়ালা গুরুঠাকুর মুর্শীদাবাবাজীর সন্ধান পেয়ে তার পায়ের উপর গিয়ে আছার খায় তখন তুমিও সে দিকে ছুট লাগাও না কেন? যত সব!

আমি বললুম, ‘মজাই-ই-শরীফে কিন্তু ইরান-তুরান-হিন্দুস্থান আফগানিস্থানের বিস্তর কবি জমায়েৎ হয়ে কবর-চত্বরে সুন্দর সুন্দর কবিতা আবৃত্তি করেন-মুশাইরা সেখানে সুবো-শাম্।’

সঙ্গে সঙ্গে শব্‌নমের মুখ খুশীতে ভরে উঠল; তাই নাকি? এতক্ষণ বল নি কেন? চল।

উঠে দাঁড়িয়েছিল। যেন তদ্দশ্যেই আমাদের যাত্রারম্ভ!

শব্‌নমের কাছে কল্পনা বাস্তবে কোন তফাত ছিল না। না হলে সে আমাকে ভালোবাসল কি করে?

আসলে আমার লোভ হত, হিউয়েন সাঙ তথাগতের দেশ ভারতবর্ষে যাবার সময় যে পথ বেয়ে মজার-ই-শরীফের কাছের বাহুলিক নগরী—আজকের দিনের বল্‌খ-থেকে বামিয়ানের কাছে হিন্দুকুশ পেরিয়ে কপিশ—আজকের দিনে কাবুল শহর এসে পৌঁছেছিলেন সেই পথটি দেখার। তখনকার দিনে তুষার ভূমি (আজকের তুখার-স্থান) পেরিয়ে যখন বৌদ্ধ শ্রমণ বাহলীকে পৌঁছলেন তখনই তাঁর চোখ জুড়িয়ে গিয়েছিল, তিনি তার অসহ পথশ্রম সার্থক মেনে নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখেছিলেন একশত সঙ্খারাম, তিন শত স্থবির আর কত হজার শ্রমণ-ভিক্ষু কে জানে? এরই কাছে কোথায় যেন ভারতীয় মহাস্থবির প্রজ্ঞাকরের কাছে তিনি অধ্যয়ন করেছিলেন অভিধর্ম। আর বামিয়ানে পৌঁছে দেখেছিলেন, তারও বাড়া—হাজার হাজার সাঙ্ঘারাম-পর্বতগুহায়, সমতল ভূমিতে, উপত্যকায়। আর দেখেছিলেন পাহাড়ের গায়ে দণ্ডায়মান, অসীন, শায়িত শত শত পৃথিবীর সর্ববৃহৎ বুদ্ধমূর্তি। শ’ দুশ ফিউ উঁচু!

তার পর তিনি পঞ্জশীর হয়ে পৌঁছেছিলেন কাবুল উপত্যকায়।

যবে থেকে এখানে এসেছি সেগুলোর সন্ধান করেছি এখানে। এখানে কীর্তিনাশা পদ্মা নদী নেই, এখানে কোনও কিছুই সম্পূর্ণ লোপ পায় না। নবীন যুগের অবহেলা পেলে এখানে প্রাচীন যুগ মাটির তলায় আশ্রয় নিয়ে প্রতীক্ষা করে, কবে নবীনতর যুগের লোক শাবল কোদাল নিয়ে তাদের সন্ধানে বেরবে।

তারও আগের কথা। আমি বাংলাদেশের লোক। হিউয়েন সাঙের ভারততীর্থ পরিক্রমার শেষ প্রাচ্য-প্রান্ত ছিল বাংলা। বগুড়ার কাছে মহাস্থানগড় প্রাচীন পুণ্ড্রবর্ধনে এসেছিলেন বল্‌খ থেকে হিউয়েন সাঙ আর কয়েক শতাব্দী পরে সেখানেই আসেন ওই বল্‌খ থেকে দরবেশ শাহ সুলতান বলখী-কত কাছাকাছি ছিল সেদিনের বল্‌খ আর বগুড়া।

সেই খেই ধরে ধরে দেখেছি, বিক্রমশিলা, নালন্দা? কাবুলে আসার পথে ট্রেন থেমেছিল এক মিনিটের তরে তক্ষশিলায়। সেখানে নামবার লোভ হয় নি একথা বলব না। তারপর পেশাওয়ার-কণিষ্কের রাজধানী। সেখানেও সময় পাই নি। গান্ধারভূমি জালালাবাদে শুধু আখ খেয়েই চিত্তকে সান্ত্বনা দিয়েছি যে, এই আখ খেয়েই হিউয়েন সাঙ শতমুখে প্রশংসা করেছিলেন। ভেবেছিলুম পরবর্তী যুগে এই যে আখের গুড় চীনদেশে গিয়ে রিফাইন্ড হয়ে শ্বেতবর্ণ ধরে যখন ফিরে এল, তখন চীনের স্মরণে এর নাম হল চিনি—তার পিছনে কি হিউয়েন সাঙ ছিলেন? একে উপহাস করেই কি আমাদের দেশে চীনের রাজার আম খাওয়ার গল্প হল?

আজ আবার এই কথা মনে পড়েছে। শব্‌নম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করত–পূর্ব বাঙলায় তার শ্বশুরের ভিটেয় পৌঁছবার পথে এগুলো পড়ে বলে।

কিন্তু যখন কাবুল ছেড়ে আচ্ছনের মত বেরলুম মজার-ই-শরীফের সন্ধানে তখন এসব কিছুই মনে পড়ে নি। কী কাজে লাগবে আমার এই ‘পাণ্ডিত্যে’র মধুভাণ্ড! জরা-জীর্ণ অর্ধলুপ্ত বাড়ির নিচে লুকনো যে সোনার তাল আছে সেটা কি তার সামান্যতম উপকারে আসে? ওর শতাংশ ব্যয় করে বাড়িটা মেরামত হয়, কলি ফেরানো যায়, সে তার সুপ্ত যৌবন ফিরে পায়। শব্‌নমই বলেছিল,

‘এত গুণ ধরি কী হইবে বল দুরবস্থার মাঝে,
পোড়ো বাড়িটাতে লুকনো যে ধন লাগে তার কোনো কাজে?’

কবিতা আমার মুখস্থ থাকে না। শুধু শব্‌নমের উৎসাহের আতিশয্যে আমার নিষ্কর্মা স্মৃতিশক্তিও যেন ক্ষণেকের তরে জেগে উঠত। উর্দুতে বলেছিলুম,

দুর্দিনে, বল, কোথা সে সুজন হেথা তব সাধী হয়,
আঁধার ঘনালে আপন ছায়াটি সেও, হেরো, হয় লয়!

তঙ্গ-দস্তীমে কৌন কিসকা সাত দেতা হৈ?
কি তরিকীমেন্নঁ সায়াভী জুদা হোতা হৈ ইনসাঁসে!

আমার নিজের সামান্য জ্ঞান, কাবুলে ফরাসী রাজদূতাবাসের প্রত্নতাত্ত্বিক যিনি জালালাবাদ-গান্ধার এবং বামিয়ানে খোঁড়াখুঁড়ি করে শত শত ক্ষুদ্র বহৎ অনিন্দ্যসুন্দর বুদ্ধমূর্তি বের করেছিলেন-তাঁর দিনে দিনে দেওয়া অসংখ্য তথ্য ও তত্ত্বজ্ঞান, আমার কোনও কাজেই লাগল না।

কাজে লাগল সে এক সম্পূর্ণ অন্য জিনিস।

কাবুল ছেড়ে আসার পর, হিন্দুকুশের চড়াই তখনও আরম্ভ হয় নি, এমন সময় বেশ কিছুক্ষণ ধরে ক্ষণে ক্ষণে আমার সেই আচ্ছন্ন অবস্থার ভিতরও আমার মনে হতে লাগল, এ জায়গায় আমি যেন পূর্বেও একবার, কিংবা একাধিকবার এসেছি। এ রকম অভিজ্ঞতা নাকি সকলের জীবনেই হয়—কেমন যেন স্বপ্নে না জাগরণে দেখা, আধচেনা-আধভোলা একটা জায়গা বা পরিবেষ্টনী এমন ভাবে সামনে এসে উপস্থিত হয় যে মানুষ পথে যেতে যেতে হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় আর ভাবে, সামনের মোড় নেওয়া মাত্রই একেবারে সম্পূর্ণ এক চেনা জায়গায় এসে পৌঁছবে।

তাই আমি বিশেষ কোনও খেয়াল করি নি।

হঠাৎ মোড় নিতেই দেখি, হাতে ঝুলানো ট্রাউট মাছ নিয়ে একটা লোক আমার দিকে এগিয়ে আসছে। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়—এ জায়গা আবদুর রহমানের পঞ্জশীর।

সামনেই বাজার। ঢুকেই বাঁয়ে দজীর দোকান। ডাইনে ফলওলা—তার পর মুদী-সর্বশেষে চায়ের দোকান। নিদেন একশবার দেখেছি। দোকানীর মেহদি-মাখানো দাঁড়ি, কালে-সাদায় ডোরাকাটা পাগড়ি আবদুর রহমানের চোখ দিয়ে আমার বহুকালের চেনা। আরেকটু হলেই তাকে অভিবাদন করে ফেলতুম। তার দৃষ্টিতে অপরিচিতের দিকে তাকানোর অলস কৌতুহলের স্পষ্টভাষ আমাকে ঠেকালে। এই চায়ের দোকানই আবদুর রহমানের ফার্পো, পেলিটি।

আবদুর রহমান নিরক্ষর। ফার্সী সাহিত্যে তার কোনও সঙ্গতি নেই। কিন্তু সম্পূর্ণ অচেনা জিনিস অজানা পরিবেশ যদি সুদ্ধমাত্র কয়েকটি অতি সাধারণ আটপৌরে শব্দের ব্যবহারে চোখের সামনে তুলে ধরাটা আর্টের সর্বপ্রধান আদর্শ হয়-বহু আলঙ্কারিক তাই বলেন-তবে আবদুর রহমান অনায়াসে লোতি দোদে মম্‌কে দোস্ত বলে ডাকবার হক্ক ধরে। এ বাজারের প্রত্যেকটি দোকান আমার চেনা—আর এখানে দাঁড়ানো নয়, আবদুর রহমান সাবধান করে দিয়েছিল—এই যে কাঁচাপাকা দাঁড়িওলা লোকটা তামাক খাচ্ছে সে বিদেশীকে পেলেই ভ্যাচর ভ্যাচর করে তার প্রাণ অতিষ্ঠ করে তোলে।

চায়ের দোকান পেরোতেই বাঁ দিকে যে রাস্তা তারই শেষ বাড়ি আবদুর রহমানদের। বাড়িতে সে নেই-কান্দাহারে। তার বাপকে আমি চিনি। ধরা পড়ার ভয় আছে।

সামনে খাড়া হিন্দুকুশ। আবদুর রহমানদের মনে মনে সেলাম জানিয়ে একটু পা চালিয়ে তার দিকে এগোলুম।

হিন্দুকুশে এখনও বরফ তার সর্ব দার্ঢ্য নিয়ে বর্তমান। আসলে তার শরীর সাবুদানার চেয়েও সূক্ষ্ম কণা দিয়ে তৈরি আর হিমকণারই মত নরম। কিন্তু বসন্ত-সূর্যও একে গলাতে পারে নি। শক্তকে ভাঙ্গা যায়, নরমকে ভাঙ্গা শক্ত।

ঝড়-তুফানে দিশেহারা হয়ে আন্ন মৃত্যু সম্মুখে দেখেছি, তখন জানতুম না যে এখানে পথ মাত্র একটিই, নিরুদ্দেশ হবার উপায় নেই। বামিয়ানেও পৌঁছলুম। বিরাট বুদ্ধমূর্তি চোখের সামনে দাঁড়িয়েছিল বলেই চিনলুম, এ জায়গা বামিয়ান না হলে কোনও জায়গার নাম আমি কাউকে জিজ্ঞেস করি নি। মাঝে মাঝে শুধু জানতে চেয়েছি, কেউ বোরকাপরা একটি মেয়েকে একা একা মজারের পথে যেতে দেখেছে কি না? ‘হ্যাঁ’, ‘না’, কাবুলের দিকে গিয়েছে, না, মজারের দিকে গিয়েছে, কোন্ এক সরাইয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে—সব ধরনের উত্তরই শুনেছি। দরদী জন আমাকে কাবুলে ফিরে যেতে বলেছে।

দেখি নি, দেখি নি, কিছুই দেখি নি। কয়েদীকে যখন পাঁচশ মাইল হাঁটিয়ে নিয়ে যাও হয় তখন কি সে কিছু দেখে? সাইবেরিয়া নির্বাসনে গিয়েছেন সেরা সেরা সাহিত্যিক-তাঁরা তো কিছুই দেখেন নি। না হলে শোনাতেন না?

হায় রে হিউয়েন সাঙ! স্মৃতির কপালে শুধু করাঘাত।

হিউয়েন সাঙ এ পথে যেতে ঝড়ঝঞ্জার মৃত্যুযন্ত্রণায় একাধিকবার তাঁর জীবন কাতর রোদনে তথাগতের চরণে নিবেদন করেছিলেন। আমি করি নি। তার কারণ এ নয় যে আমি ভিক্ষুশ্রেষ্ঠর চেয়েও অধিক বীতরাগ-দুঃখে অনুদ্বিগমন, সুখে বিগতস্পৃহ-হয়ে গিয়েছিলুম। আমি হয়ে গিয়েছিলুম জড়, অবশ। ক্লোরোফর্মে বিগতচেৎন রুগীর যখন কাটা যায় সে যে তখন চিৎকার করে না তার কারণ এ নয় যে, সে তখন কায়াক্লেশমুক্ত স্থিতধী মুনিপ্রবর। চিন্তামণির অন্বেষণে বিল্বমঙ্গল যা সব করেছিল সে সজ্ঞানে নয় সম্পূর্ণ মোহাচ্ছন্ন অবস্থায়। কী সুন্দর নাম চিস্তামণি! এ নাম বাঙালী মেয়ে অবহেলা করে কেন? অহল্যার মত ‘অসতী’ ছিল বলে? হায়! আজ যদি ওঁর শুদ্ধজ্ঞানের এক কণা আমি পেয়ে যেতুম!

ক্রমে আমার সময়ের জ্ঞান লোপ পেল। কবে বেরিয়েছি, কবে মজার পৌঁছব কোন বোধই আর রইল না।

সরাইয়ের এক কোণে ঠেসান দিয়ে বসে আছি। যে কাফেলার সঙ্গে আজ ভোরে যোগ দিয়েছিলুম তারা কুঠরির মাঝখানে কুণ্ডলি পাকিয়ে মৃদুস্বরে কথা বলছে। এদের বেশ ভাগই আমুদরিয়া পারের উজবেগ। বাঙলা-ভাষায় এদের বলে উজবুক। এরা যে কি সরল বিশ্বাসে ট্যারা চোখ মেলে তাকাতে জানে সে না দেখলে না শুনে বোঝা যায় না। এদের ভাষা আমার জানা। কিন্তু এরা আমাকে ভালবেসেছে। আজ সকালে একরকম জোর করেই আমাকে একটা খচ্চরের উপর বসিয়ে দিয়েছিল।

হঠাৎ কানে গেল কে যেন বললে, জশ্‌ন।

সঙ্গে সঙ্গে পরিষ্কার চোখের সামনে দেখতে পেলুম, স্বপ্নমায়ামতিভ্রম কিছুই নয়, পরিষ্কার দেখতে পেলুম, জশ্‌ন পরবের রাত্রে ডানস্‌ হলের সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে শব্‌নম। সে রাত্রে তার ছিল ভ্রুকুটিকুটিল ভাল, আজ দেখি সে ভ্রুবিলাসী, তার মুখে আনন্দ হাসি।

তার পরই জ্ঞান হারাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *